পরকাল জয় পরাজয়ের দিন
আল্লাহ তায়ালা পরকালের বিচার দিবসকে সত্যিকার জয় পরাজয়ের দিন অথবা সাফল্য ও ব্যর্থতার দিন বলে ঘোষণা করেছেনঃ
(আরবী *************************************************************)
“কাফেররা বড় গালগর্ব করে বলে থাকে যে, মৃত্যুর পর আর কিছুতেই তাদেরকে পুনরুত্থিত করা হবে না। (হে নবী) তাদেরকে বল, “আমার প্রভুর কসম, নিশ্চয়ই তোমাদেরকে পরকালে পুনরুত্থিত করা হবে। অতপর তোমরা দুনিয়ায় কি কি করেছ, তা তোমাদেরকে জানানো হবে। আর এসব কিছুই খোদার জন্যে অতি সহজ ব্যাপার। অতএব তোমরা ঈমান আন আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি এবং সেই ‘নূরের’ প্রতি যা আমি নাযিল করেছি। তোমরা যা কিছু কর, তাঁর প্রতিটি বিষয়ের খবর আল্লাহ রাখেন। এসব কিছুই তোমরা জানতে পারবে সেই দিন, যেদিন তিনি তোমাদেরকে সেই মহাসম্মেলনের (রোজ হাশর) জন্যে একত্র করবেন। সে দিনটা হবে পরস্পরের জন্যে জয় পরাজয়ের দিন। যারা আল্লাহর উপর ঈমান আনবে এবং সৎকাজ করবে, আল্লাহ তাদের পাপরাশি মিটিয়ে দেবেন। তাদেরকে বেহেশতে প্রবেশাধিকার দেবেন যেখানে তাদের আবাসগৃহের নিম্নভাগ দিয়ে প্রবাহিত হবে স্রোতস্বিনী। তারা সেখানে বসবাস করবে চিরকাল। আর এটাই হচ্ছে বিরাট সাফল্য। পক্ষান্তরে যারা আল্লাহ ও পরকাল অস্বীকার করবে এবং মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেবে আমার বাণী ও নিদর্শন, তারা হবে জাহান্নামের অধিবাসী। সেখানে তারা থাকবে চিরকাল। সেটা হবে অতীব নিকৃষ্ট স্থান।”-(সূরা তাগাবুনঃ ৭-১০)
উপরে ‘নূর’ বলতে কুরআন পাককে বুঝানো হয়েছে।
‘তাগাবুন’ শব্দের কয়েক প্রকার অর্থ আছে, তা এক একটি করে সামনে বর্ণনা করা হচ্ছে।
সত্যের বিরোধী যারা তারা সকলেই পরকাল বিশ্বাস করতে চায়নি কিছুতেই। এ ব্যাপারে তারা চরম হঠকারিতা প্রদর্শন করেছে। অথচ তাদের কাছে এমন কোন মাধ্যম ছিল না, এবং আজো নেই যার সাহায্যে তারা নিশ্চিত করে বলতে পারে যে, পরকাল বলে কিছু নেই। গ্রন্থেন প্রথম দিকে এ আলোচনা করা হয়েছে।
নবী মুহাম্মাদকে (সা) উপরোক্ত আয়াতে কাফেরদের কথিত প্রগলভ উক্তির জবাব দিতে বলেছেন আল্লাহ। অবিশ্য জবাব আল্লাহ স্বয়ং বলে দিচ্ছেন। আর আল্লাহর শপথ করেই জবাব দিতে বলা হয়েছে। শপথ তো একমাত্র সেই ব্যক্তিই করতে পারেন যিনি কোন কিছুর সত্যতা সম্পর্কে চাক্ষুষ জ্ঞান রাখেন। পরকাল সম্পর্কে নবীর যে জ্ঞান তা শুধু এতটুকু নয় যে আল্লাহ তা বলেছেন। অবিশ্য আল্লাহ কিছু বললেই কোন কিছুর সত্যতা সম্পর্কে কোনই সন্দেহ থাকতে পারে না। তবে সেটা হবে কোন কিছু না দেখেও তা অভ্রাস্ত অ সত্য বলে দৃঢ় বিশ্বাস করা। চোখে দেখা বিশ্বাস তা নয়।
আল্লাহ যে মৃতকে জীবিত করতে পারেন, এ দৃঢ় বিশ্বাস অ প্রত্যয় হযরত ইবরাহীমের (আ) ছিল। তবুও মৃতকে জীবিত করার ক্রিয়া তিনি স্বচক্ষে দেখতে চান। তাঁর পূর্ণ বিশ্বাসে পরিনত করে মানসিক প্রশান্তি লাভ করতে চান তিনি। তাই তিনি খোদার কাছে প্রার্থনা করলেন। অতপর খোদা চারটি মৃত পাখীকে হযরত ইবরাহীমের (আ) চোখের সামনে পুনর্জীবিত করে দেখিয়ে দিলেন। (সূরা আলা বাকারাঃ ২৬০ আয়াত দ্রষ্টব্য)
এখন মৃতকে জীবিত করার যে বিশ্বাস, তা হযরত ইবরাহীমের (আ) এবং একজন মুমেনের এক হতে পারে না। কিন্তু আমাদের শেষ নবীর (সা) পরকাল অ মৃতকে পুনর্জীবন দানের বিশ্বাস হযরত ইবরাহীমের (আ) উপরোক্ত চাক্ষুষ বিশ্বাসের মতোই ছিল। আল্লাহ তাঁর শেষ এবং প্রিয়তম নবীকে মে’রাজের রাতে তার সৃষ্টি রহস্য এবং আরো অনেক গোপন তথ্যও স্বচক্ষে দেখার সুযোগ দিয়েছিলেন। সে জন্যে পরকালের সত্যতা সম্পর্কে খোদার শপথ করে বলতে তাঁর কোন প্রকার দ্বিধা হওয়ার কথা নয়।
উপরের পবিত্র আয়াতে বর্ণিত “অতপর তোমরা দুনিয়ায় কি কি করেছ, তা তোমাদেরকে জানানো হবে”-কথাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ সুরার প্রারম্ভেই আল্লাহ বলেছেন যে, তিনি মানুষ সৃষ্টির পর তাঁকে পরিপূর্ণ কর্ম স্বাধীনতা দিয়েছেন। সে ইচ্ছা করলে চরম অবিশ্বাসী হয়ে পাপ পথে চলতে পারে। সে হতে পারে নির্মম অত্যাচারী অপরের ধন-সম্পদ ইজ্জত-আবরু লুণ্ঠনকারী ও রক্ত পিপাসু নরপিচাশ। অথবা আল্লাহ, তাঁর রসূল ও পরকালের প্রতি ঈমান এনে সে অতি পবিত্র জীবনযাপনও করতে পারে। এই যে ভালো এবং মন্দ পথে চলার স্বাধীনতা এবং এ স্বাধীনতাদানের সাথে একথারও ঘোষণা যে, ভালো-ভাবে চলার জন্যে পুরস্কার এবং মন্দ পথে চলার শাস্তি অনিবার্য-এরপর একথা কি করে চিন্তা করা যায় যে, এ স্বাধীনতা দানকারী ও সতর্ককারী আল্লাহ মৃত্যুর পর মানুষকে জিজ্ঞেস করবেন না যে, সে কোন পথ অবলম্বন করেছিল? বস্তূত এটা জানার জন্যেই তো পরকাল। আল্লাহ এমন এক শক্তিশালী সত্তা যিনি জীবন মৃত্যু এজন্যে দিয়েছেন যে, এর দ্বারা তিনি মানুষকে পরীক্ষা করে দেখবেন দুনিয়ার জীবনে কর্মের দিক দিয়ে কে ছিল উত্তম।–(সূরা মুলকঃ ২ আয়াত দ্রষ্টব্য)
অতপর পরকালের এ দিবসকে বলা হয়েছে প্রকৃত জয় পরাজয়ের দিবস। একথাটিও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং এর মধ্যেই নিহিত আছে পরকালের সার্থকতা।
দুনিয়াতে একটি মানুষ তার নিজস্ব জ্ঞানবুদ্ধি ও কর্মশক্তি নিয়ে জীবন পথে চলা শুরু করে। তার জীবনকে সুখী ও সুন্দর করার জন্যে তার শ্রম-চেষ্টা-সাধনার অস্ত থাকে না। প্রত্যেকেই তার নিজ নিজ কর্মসূচি কার্যকর করে সাফল্য অর্জন করতে চায়। মানুষের প্রতিদিনেরই এই যে শ্রম-সাধনা এর পরিণামে জয় পরাজয় নির্ণীত হয়।
দৃষ্টিভংগী ও জীবন দর্শনের বিভিন্নতার কারণে অবশ্যি জয় পরাজয় অথবা সাফল্য-অসাফল্যের মানদণ্ডও বিভিন্ন হয়ে থাকে। যে কোন হীনপন্থার কার্যসিদ্ধি হলেও অনেকের দৃষ্টিতে তাকে বলা হয় সাফল্য। সাফল্য অর্জন করতে গিয়ে যদি অন্যায় অবিচার, চরম দুর্নীতি, অসভ্য, হীন ও জঘন্য পন্থা অবলম্বন করতে হয়, তবুও তাকে মনে করা হয় সাফল্য। বলপূর্বক অপরের ধন-সম্পদ হস্তগত করে, মিথ্যা মামলায় জড়িত করে এবং মিথ্যা সাক্ষ্য প্রমাণাদির দ্বারা কাউকে সর্বশান্ত করে কেউ হচ্ছে বিজয়ী, লক্ষপতি, কোটিপতি। একেও সাফল্য বলা হয় অনেকের দৃষ্টিতে। বহু গাড়ি-বাড়ির মালিক হয়ে স্ত্রী-পুত্রসহ পরম সুখে বিলাস বহুল জীবন যাপন করে সে বিজয়ী ব্যক্তি। লোকে বলে লোকটার জীবন সার্থক বটে।
অসাধু উপায়ে ওগাধ সম্পদের মালিক হয়ে কেউ বা সমাজে তার অধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়। সে চায় সকলকে তার পদানত করে রাখতে। তার বিরুদ্ধে টু শব্দটি সে বরদাশত করতে পারে না। স্বার্থান্বেষী মুসাহিবের দল দিনরাত তার জয়গান করে বেড়ায়। সত্যের আওয়াজ সে সমাজে বন্ধ হয়ে যায়। সত্যের ধারক ও বাহকরা তার দ্বারা হয় নিপীড়িত ও জর্জরিত। তাদের স্থান হয় কারাগারের অন্ধকার কুঠরিতে। সে ক্ষমতামদত্ত হয়ে সকলের উপর করতে চায় খোদায়ী। এটাও তার এবং অনেকের মতে বিরাট সাফল্য।
অপরদিকে এক ব্যক্তি সত্যকে মন প্রানে গ্রহণ করে সৎ জীবন যাপন করার চেষ্টা করে। দুর্নীতি, সুদ, ঘুষ, কালো বাজারি, মিথ্যা ও প্রতারণা প্রবঞ্চনা বর্জন করে সে হয় ক্ষতিগ্রস্ত। সত্যের প্রচার ও অসত্যের বিরুদ্ধে ‘সংগ্রাম’ করার জন্যে তার আত্নীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব তার সংস্পর্শ থেকে দূরে সরে পড়ে। সমাজে অবহেলা আনাদর ও দারিদ্র তার জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। লোকে বলে, লোকটি নেহায়াত নির্বোধ। নতুবা এমনিভাবে তার জীবন ব্যর্থ হতো না।
উপরে বর্ণিত জীবনের বিজয় সাফল্য ও ব্যর্থতার বাহ্যিক রূপ আমরা আমাদের চারিপাশে হর-হামেশাই দেখতে পাই। কিন্তু সত্যিকার জয় পরাজয় অথবা অসাফল্য নির্ণীত হবে পরকালের বিচারের দিন।
পরকাল যে জয় পরাজয় নির্ণয় করে সে সম্পর্কে কিছু আলোচনা করা যাক।
অনেক তাফসীরকার এরূপ মন্তব্য করেছেন যে, পরকালে বিচারের শেষে বেহেশতবাসীগণ জাহান্নামবাসীর বেহেশতের ঐসব অংশ লাভ করবেন যা শেষোক্ত ব্যক্তিগণ লাভ করতো যদি তারা দুনিয়ার জীবনে বেহেশতবাসীর ন্যায় কাজ করতো। ঠিক তেমনি জাহান্নামবাসীগণ বেহেশতবাসীদের জাহান্নামের ঐসব অংশ অধিকার করবে যা বেহেশতবাসীগণ লাভ করতেন, যদি তাঁরা দুনিয়াতে জাহান্নামবাসীদের মতো জীবন যাপন করতেন।
বুখারী শরীফে হযরত আবু হোরায়রাহ (রা) কর্তৃক বর্ণিত আছে যে, যে ব্যক্তিই বেহেশতে প্রবেশ করবে তাকে জাহান্নামের সে অংশটি দেখানো হবে যেখানে তার স্থান হতো যদি সে সৎপথ অবলম্বন না করতো। এর ফলে সে খোদার অধিকতর কৃতজ্ঞ হবে। অনুরূপভাবে জাহান্নামবাসীকেও বেহেশতের সে অংশটুকু হবে যে অংশ সে লাভ করতো, যদি সে দুনিয়ার জীবনে সৎপথে চলতো। এতে করে তার অনুতাপ অনুশোচনা আরও বেড়ে যাবে।
দুনিয়ায় উৎপীড়িত ও নির্যাতিত যারা তারা পরকালে জালেমদের ততো পরিমাণে নেকি লাভ করবে যা তাদের প্রতি কৃত অবিচার উৎপীড়নের বিনিময় হতে পারে। অথবা মজলুমের সেই পরিমাণ গুনাহ জালেমের ঘাড়ে চাপানো হবে। সেদিন তো মানুষের কাছে কোন ধন-সম্পদ থাকবে না যার দ্বারা সে মজলুমের দাবী পূরণ করতে পারবে। নেকী এবং গুনাহ ব্যতীত কারো কাছে আর অন্য কিছুই থাকবে না। অতএব দুনিয়াতে যদি কেউ কারো প্রতি অন্যায় করে থাকে, তাহলে মজলুমের দাবী পূরণের জন্য তার কাছে কোন সঞ্চিত নেকি থাকলে তাই মজলুমকে দিয়ে দিতে হবে। অবশ্যি মজলুমের প্রতি যে পরিমাণ অন্যায় করা হবে, ঠিক ততো পরিমাণই সে প্রতিপক্ষের নেকি লাভ করবে। অথবা যালেমের তহবিলে কোন নেকি না থাকলে মজলুমের ততো পরিমাণ গুনাহ যালেমের ঘাড়ে চাপানো হবে।
এ সম্পর্কে বুখারীতে একটি হাদীস আছে যা বর্ণনা করেছেন হযরত আবু হোরায়রাহ (রা)। হাদীসে বলা হয়েছে যে, কোন ব্যক্তি যদি তার ভাইয়ের (মানব সন্তানের) প্রতি কোন প্রকার অন্যায় অবিচার করে, তাহলে তার উচিত এখানেই (দুনিয়াতেই) তা মিটিয়ে ফেলা। কারণ আখেরাতে কারো কাছে কোন কপর্দকই থাকবে না। অতএব সেখানে তার নেকির কিয়দংশই সে ব্যক্তিকে দেয়া হবে। অথবা তার কাছে যথেষ্ট নেকি না থাকলে, মজলুমের গুনাহের কিয়দংশই তাঁকে দেয়া হবে।
অনুরূপভাবে মসনদে আহমদে জাবের বিন আবদুল্লাহ বিন উনায়েস কর্তৃক বর্ণিত আছে যে, নবী (সা) বলেছেন, “কোন বেহেশতী বেহেশতে এবং কোন জাহান্নামী জাহান্নামে প্রবেশ করতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না সে তার কৃত অন্যায় ও জুলুমের দাবী মিটিয়ে দিয়েছে। এমন কি কাউকে একটি মাত্র চপেটাঘাত করে থাকলেও তার বদলা (বিনিময়) তাকে দিতে হবে।”
বর্ণনাকারী বলেন, “অতপর আমরা জিজ্ঞেস করলাম যে, তা কেমন করে হবে? আমরা তো সেদিন কপর্দকহীন হবো।”
নবী বলেন। “পাপ-পুণ্যের দ্বারা সে বদলা দিতে হবে।”
মুসলিম শরীফে এবং মুসনাদে আহমদে হযরত আবু হোরায়রাহর (রা) একটি বর্ণনা আছে। একদা নবী করিম (সা) সমবেত সাহাবীদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা কি জান, নিঃস্ব কে?”
তাঁরা বললেন, “যে কপর্দকহীন এবং যার কোন ধন-সম্পদ নেই, সেই তো নিঃস্ব।”
নবী (সা) বললেন, “আমার উম্মতের মধ্যে নিঃস্ব ঐ ব্যক্তি যে নামায, রোযা, যাকাত প্রভৃতি সৎকাজগুলো সংগে নিয়ে কিয়ামতের মাঠে হাজির হবে এমন অবস্থায় যে সে দুনিয়াতে কাউকে গালি দিয়েছে, কারো নিন্দা অপবাদ করেছে, কারো ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করেছে, কাউকে হত্যা করেছে, কাউকে মেরেছে। অতপর তার পুণ্যসমূহ মজলুমদের মধ্যে বণ্টন করা হলো। তারপরেও বদলা পরিশোধের জন্যে তার কাছে আর কোনই পুণ্য অবশিষ্ট রইলো না। তখন মজলুম দাবীদারদের গুনাহের বোঝা তার উপরে চাপানো হলো এবং সে জাহান্নামে প্রবেশ করলো।”
বিরাট পুণ্যের মালিক মজলুমদের বদলা পরিশোধ করতে গিয়ে বিরাট পাপের বোঝা মাথায় নিয়ে জাহান্নামে গেল। কি ভয়ানক পরিণাম! চিন্তা করতেও শরীর রোমাঞ্চিত হয়। আল্লাহ রক্ষা করুন আমাদেরকে এ ধরনের পরিণাম থেকে।
বিরাট প্রবঞ্চনা
উপরে উল্লেখিত আয়াতে “তাগাবুন” শব্দটি আরবী ভাষায় প্রতারণা প্রবঞ্চনা অর্থেও ব্যবহৃত হয়।
সাধারণত দেখা যায়, দুনিয়ায় মানুষ শির্ক, কুফর, অন্যায়, অবিচার, ব্যভিচার, লাম্পট্য, খুন-খারাবি প্রভৃতি বড় বড় পাপ কাজে নিশ্চিন্ত মনে ও পরম আনন্দে পরস্পর পরস্পরের সাহায্য সহযোগিতা করে থাকে। তাদের পরস্পরের মধ্যে এ ব্যাপারে গভীর বন্ধুত্ব ও সৌহার্দ স্থাপিত হয়।
চরিত্র পথভ্রষ্ট পরিবারের লোকজন, পাপচার ও গোমরাহীর প্রচারক নেতৃবৃন্দ ও তাদের অনুসারীগন, দস্যু-তস্করের দল, গোমরাহী পাপাচার ও অশ্লীলতা প্রচার ও প্রসারকারী পার্টি ও কোম্পানীগুলো এবং ব্যাপক অন্যায় অবিচার ও ফেৎনা ফাসাদের ধারক বাহক রাষ্ট্র ও জাতিসমূহ একে অপরের সাহায্য সহযোগিতা করে থাকে পাপাচার ছড়াবার ব্যাপারে। কোন দুর্বল দেশ ও রাষ্ট্রকে পদানত করে তার অধিবাসীবৃন্দকে গোলাম বানাবার জন্যে একাধিক রাষ্ট্র অভিযান চালায় এ বিশ্বাসের উপরে যে তাদের মধ্যে বিরাট বন্ধুত্ব (Alliance) অথবা সামরিক চুক্তি (Military pact) সাধিত হয়েছে।
পরস্পর সম্পর্ক রক্ষাকারী প্রত্যেকেই এ ধারণাই পোষণ করে থাকে যে, তারা একে অপরের পরম বন্ধু এবং চরম সাফল্যের সাথেই তাদের সাহায্য সহযোগিতা চলছে। কিন্তূ তারা যখন পরকালে বিচারের মাঠে হাজির হবে, তখন তারা উপলদ্ধি করতে পারবে যে, তারা চরমভাবে প্রতারিত হয়েছে। উপরে বর্ণিত লোকগুলোর প্রত্যেকেই অনুভব করবে যে, শুভাকাংখী পিতা, ভ্রাতা, স্বামী, স্ত্রী, বন্ধু, লীডার অথবা যাকে সে সহযোগী মনে করতো, সে প্রকৃতপক্ষে তার চরম শত্রু। সেদিন সকল সংশ্রব-সম্বন্ধ, আত্নীয়তা, বন্ধুত্ব, Alliance অথবা pact শত্রুতায় পরিনত হবে। সেদিন একে অপরের প্রতি গালিবর্ষণ ও অভিসম্পাৎ করবে। প্রত্যেকেই চাইবে তার দোষ অপরের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে, যাতে করে প্রতিপক্ষই চরম শাস্তি ভোগ করে। এ সম্পর্কে কুরআনের বিভিন্ন স্থানে উল্লেখ আছে।
পাপীদের পরস্পরের প্রতি দোষারোপ
মানুষ তার মানবিক দুর্বলতার কারণে অনেক সময় অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়ে। স্বামী স্ত্রীর জন্যে, পিতা সন্তানের জন্যে, বন্ধু বন্ধুকে খুশী করার জন্যে, রাজনৈতিক নেতা ও পীর-ওস্তাদকে তুষ্ট করতে গিয়ে, ঊর্ধ্বতন কর্মচারীকে খুশী করে চাকুরী বহাল রাখতে অথবা উন্নতিকল্পে, অথবা অত্যাচারী শাসকের মনস্তুষ্টির জন্যে অনেকে পাপ কাজে লিপ্ত হয়। তাদের এ নির্বুদ্ধিতার কারণে পরকালে তাদেরকে চরমভাবে প্রতারিত ও নিরাশ হতে হবে। পবিত্র কুরআনে বার বার সে কথারই উল্লেখ করে এ ধরনের আত্ন-প্রবঞ্চিত দলকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। তার কিছু উদ্ধৃতি নিম্নে দেয়া হলোঃ
(আরবী ******************************************************)
“যাদের কথায় লোকেরা চলতো, তারা কিয়ামতে তাদের অনুসারীদের কাছ থেকে সম্পূর্ণরূপে কেটে পড়বে। উভয়ে সেদিনের ভয়ংকর শাস্তির ভয়াবহতা দর্শন করবে। উভয়ের সম্পর্ক একেবারে ছিন্ন হয়ে যাবে। অনুসারীদল বলতে থাকবে, যদি কোন প্রকারে আমরা একবার দুনিয়ায় ফিরে যেতে পারতাম, তাহলে আমরা সেখানে এদের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক হয়ে যেতাম যেমন আজ তারা আমাদের থেকে হয়েছে। কিন্তূ আল্লাহ সকলকেই তাদের কর্মফল দেখিয়ে দেবেন যা তাদের জন্যে বহন করে আনবে অনুতাপ অনুশোচনা। তাদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে এবং তারা সে জাহান্নামের অগ্নি থেকে কোনক্রমেই বের হতে পারবে না।”-(সূরা আল বাকারাঃ ১৬৬-১৬৭)
খোদার প্রতি মিথ্যা দোষারোপকারীদেরকে মৃত্যুকালে আল্লাহর ফেরেশতাগণ জিজ্ঞেস করবেনঃ
(আরবী **************************************************************)
“আল্লাহ ব্যতীত আর যাদের বন্দেগী তোমরা করতে তারা আজ কোথায়? তারা বলবে যে, তারা তাদের কাছ থেকে সরে পড়েছে। অতপর তারা স্বীকার করবে যে, তারা আল্লাহর প্রতি অবিশ্বাসই করেছে। আল্লাহ তাদেরকে বলবেন, তোমাদের পূর্বে জ্বিন এবং মানুষের মধ্যে যে দল অতীত হয়েছে তাদের সাথে তোমরা জাহান্নামে প্রবেশ কর। অতপর এদের একটি দল যখন জাহান্নামে প্রবেশ করবে, তখন তাদেরই অনুরূপ দলের প্রতি অভিসম্মাৎ করতে থাকবে। যখন সব দলগুলো সেখানে একত্র হবে, তখন পরবর্তী দল তার পূর্ববর্তী দল সম্পর্কে একথা বলবে, হে প্রভু, অরা আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছে। অতএব তাদের জন্যে জাহান্নামে শাস্তি দ্বিগুণ করে দিন। আল্লাহ বলবেন, তোমাদের উভয়ের জন্যেই দ্বিগুণ শাস্তি। কিন্তু এ সম্পর্কে তোমরা কোন জ্ঞান রাখ না। তাদের প্রথমটি শেষেরটিকে বলবে, তোমরা আমাদের চেয়ে মোটেই উত্তম নও। অতএব তোমাদের অর্জিত কর্মের শাস্তি ভোগ কর।”-(সূরা আল আরাফঃ ৩৭-৩৯)
সাধারণত দেখা যায় যারা দুর্বল, বিত্তহীন, শাসিত ও শোষিত তারা ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় ক্ষমতাসীন অত্যাচারি শাসকদের আনুগত্য করে। পরকালে তাদের পরিণাম সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ
(আরবী **************************************************************)
“যখন উভয় দলকে হাশরের মাঠে একত্র করা হবে, তখন দুর্বল শ্রেনী ক্ষমতা গর্বিত উন্নত শ্রেনীর লোকদেরকে বলবে, “আমরা তোমাদেরই কথা মেনে চলেছিলাম। আজ তোমরা কি খোদার আযাবের কিছু অংশ আমাদের জন্যে লাঘব করতে পার? তারা বলবে, তেমন কোন পথ আল্লাহ আমাদেরকে দেখালে তো তোমাদেরকে দেখিয়ে দিতাম। এখন এ শাস্তি আমাদের জন্যে অসহ্য হোক অথবা ধৈর্যের সাথে গ্রহণ করি উভয়ই আমাদের জন্যে সমান। এখন আমাদের পরিত্রানের কোন উপায় নেই।”-(সূরা ইবরাহীমঃ ২১)
(আরবী **********************************************************)
“হযরত ইবরাহীম (আ) বললেন, তোমরা যে আল্লাহকে বাদ দিয়ে প্রতিমাগুলোকে খোদা বানিয়ে নিয়েছ, এ তোমাদের পারস্পরিক বন্ধুত্বের কারণেই। কিন্তু কিয়ামতে তোমরা একে অপরের বিরুদ্ধাচারণ ও অভিসম্পাৎ করবে। আর তোমাদের চূড়ান্ত বাসস্থান হবে জাহান্নাম। তোমাদের থাকবে না কোন সাহায্যকারী।”-(সূরা আনকাবুতঃ ২৫)
উপরের আয়াতে একথাই বলা হয়েছে যে, বিশ্ব স্রষ্টা ও প্রতিপালক আল্লাহ তায়ালার পরিবর্তে স্বহস্তে নির্মিত প্রতিমাগুলোকে খোদা বানিয়ে নেয়ার পশ্চাতে কোন যুক্তিই নেই। লোকেরা তাদেরকে খোদা বানাবার ব্যাপারে একে অপরের বন্ধু হিসেবে কাজ করেছে, তাদের পারস্পরিক স্বার্থ ও বন্ধুত্ব তাদেরকে এ প্রতিমা পুজায় উদ্বুদ্ধ করেছে। তাদের এ ভুল তারা পরকালে বুঝতে পারবে।
(আরবী ************************************************************)
“হে মানবজাতি! তোমরা ভয় কর তোমাদের প্রভু খোদাকে এবং ভয় কর সেই দিনকে যেদিন কোন পিতা তার পুত্রের এবং কোন পুত্র তার পিতার কোনই কাজে লাগবে না। আল্লাহ (কিয়ামত সম্পর্কে) তোমাদের সঙ্গে যে ওয়াদা করেছেন, তা এক অনিবার্য সত্য। অতএব তোমাদেরকে তোমাদের পার্থিব জীবন যেন প্রবঞ্চিত না করে এবং প্রতারক শয়তান যেন তোমাদেরকে ভুলিয়ে না রাখে আল্লাহ থেকে।”-(সূরা লুকমানঃ ৩৩)
(আরবী ***************************************************************)
“সেই কিয়ামতের দিনে যখন তাদেরকে জাহান্নামে অধঃমুখে নিক্ষেপ করা হবে, তখন তারা বলবে, আমরা যদি আল্লাহ ও রসূলকে মেনে চলতাম। এবং তারা বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক প্রভু। হায়রে আমরা তো আমাদের নেতা ও মুরব্বিদের কথা মেনেই চলছিলাম। অতএব হে প্রভু তাদের শাস্তি দ্বিগুণ করে দিন এবং তাদেরকে চরমভাবে অভিশপ্ত করুন।”-(সূরা আল আহযাবঃ ৬৬-৬৮)
(আরবী *******************************************************************)
“এসব কাফেরগন বলে, কিছুতেই কুরআন মানব না। আর এর আগের কোন কিতাবকেও মানব না। তোমরা যদি তাদের অবস্থা দেখতে যখন এ জালেমরা তাদের প্রভুর সামনে দণ্ডায়মান হবে এবং একে অপরের প্রতি দোষারূপ করতে থাকবে। সেদিন অসহায় দুর্বলরা গর্বিত সমাজ-পতিদেরকে বলবে, তোমরা না থাকলে তো আমরা আল্লাহর উপর ঈমান আনতাম। গর্বিত সমাজপতিরা দুর্বলদেরকে বলবে, তোমাদের নিকটে হেদায়েতের বাণী পৌঁছার পর আমরা কি তোমাদেরকে সৎপথ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলাম? তোমরা নিজেরাই তো অপরাধ করেছ। দুর্বলেরা বড়লোকদেরকে বলবে, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। বরঞ্চ তোমাদের দিবা-রাত্রের চক্রান্তই আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করে রেখেছিল। আল্লাহকে অস্বীকার করার এবং দাসত্বে আনুগত্যে তাঁর অংশীদার বানাবার জন্যে তোমরাই তো আমাদেরকে আদেশ করতে। আল্লাহ বলেন, তারা যখন তাদের শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে তখন তাদের লজ্জা অনুশোচনা গোপন করার চেষ্টা করবে। আমরা এসব সত্য অস্বীকারকারীদের গলদেশে শৃখংল পরিয়ে দেব। যেমন তাদের কর্ম, তেমনি তারা পরিণাম ফল ভোগ করবে।”-(সূরা সাবাঃ ৩১-৩৩)
আবার দেখুন, সমাজে যেসব খোদাবিমুখ ও খোদাদ্রোহী ক্ষমতাসীন হয়ে অপরের উপরে শাসন চালায়, সত্যের আহবানকারীদের সাথে তাদের চরম বিরোধ শুরু হয়। সত্যাশ্রয়ী খোদভীরুদেরকে তারা ঘৃনার চোখে দেখে এবং সমাজের ফেৎনা ফাসাদের জন্যে ক্ষমতাসীন শাসক শ্রেনী সত্যের আহবান-কারীদেরকে পথভ্রষ্ট, ভণ্ড, ধর্মের মুখোশধারী এবং বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী বলে দোষারোপ করে। কিন্তূ পরকালে তারা চরমভাবে প্রতারিত হবে যখন তাদের কাছে প্রকৃত সত্য প্রকট হয়ে পড়বে। তারা বলবেঃ
(আরবী *************************************)
“এবং তারা (দোযখের মধ্যে থেকে) বলবে, কি ব্যাপার তাদেরকে তো আমরা দেখছি না যাদেরকে আমরা দেখছি না যাদেরকে আমরা দুষ্ট লোকের মধ্যে গণ্য করতাম।”-(সূরা সয়াদঃ ৬২)
কেয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা অবিশ্বাসীদেরকে বলবেনঃ
(আরবী *****************************************)
“আজ সেই চূড়ান্ত মীমাংসার দিন যাকে তোমরা মিথ্যা বলতে। (তারপর আল্লাহর আদেশ হবে) এসব যালেমদেরকে তাদের সংগী-সাথীদের এবং যাদের হুকুম মেনে এরা চলতো তাদেরকে ঘেরাও করে নিয়ে এসো এবং তাদেরকে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাও। আচ্ছা, একটু তাদেরকে দাঁড় করাও। তাদেরকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে, তোমাদের কি হলো যে, একে অপরের আজ কোন সাহায্য করছ না? বাঃরে আজ তো দেখি এরা নিজেদেরকে একে অপরের উপরে ছেড়ে দিচ্ছে। নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ও অনুসারী পরস্পর মুখমুখি হয়ে কথা কাটাকাটি করবে। অনুসারীগন বলবে, তোমাদের আগমন আমাদের উপর ভীষণভাবে প্রভাব বিস্তার করতো অর্থাৎ তোমাদের আদেশ না মেনে আমাদের উপায় ছিল না। নেতৃস্থানীয় লোকেরা বলবে, তোমরা তো নিজেরাই ইচ্ছা করে ঈমান আননি। তোমাদের উপরে আমাদের এমন কি কর্তৃত্ব ছিল? বরঞ্চ তোমরা নিজেরাই ছিলে অবাধ্য নাফরমান। এখন আমাদের প্রভুর উক্তি সত্যে পরিনত হয়েছে। এখন আমাদের সে শাস্তির আস্বাদ গ্রহণ করতে হবে। (পরে তারা স্বীকার করে বলবে) আমরা তোমাদেরকে বিপদগামী করেছি এবং আমরা নিজেরাও বিপদগামী ছিলাম। আল্লাহ বলেন, উভয় দলই ঐদিন শাস্তি গ্রহণের ব্যাপারে সমান অংশীদার হবে। অপরাধীদের সাথে আমরা এরূপ ব্যবহারই করে থাকি।”-(সূরা আস সাফফাতঃ ২১-৩৪)
যারা নিছক পার্থিব স্বার্থের জন্যে খোদাদ্রোহী ও খোদাবিমুখ নেতৃবৃন্দ এবং শাসকদের মনস্তূস্টির জন্যে খোদার নাফরমানীতে লিপ্ত হয়, উপরের আলোচনা থেকে তাদের শিক্ষাগ্রহণ করা দরকার।
নবী করিম (সা) তাই ঘোষণা করেনঃ
(আরবী **********************************)
“আল্লাহর নাফরমানী করে কোন সৃষ্টির (মানুষ) আনুগত্য কিছুতেই করা যেতে পারে না।”
(আরবী ********************************************************************)
“যারা আল্লাহ ও পরকাল অস্বীকার করেছিল, তারা কিয়ামতের দিন বলবে, হে আমাদের প্রভু। জ্বিন ও মানুষের মধ্যে যারা আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিল, তাদেরকে দেখিয়ে দিন। আমরা আজ তাদেরকে পদদলিত করে হেয় ও অপমানিত করবো।”-(হামীম আস সাজদাঃ ২৯)
(আরবী *******************************************************************)
“কিয়ামতের দিন বন্ধুদের পরস্পর সাক্ষাত হলে তারা কেউ কারো সাথে কথা বলবে না। পাপীরা সেদিন মনে করবে, সেদিনের শাস্তি থেকে পরিত্রান লাভের জন্যে তার বিনিময়ে তার পুত্র, স্ত্রী, ভ্রাতা, পরিবারস্থ লোকজন, এমন কি দুনিয়ার সবকিছুই সে বিলিয়ে দিতে পারে এত করেও যদি সে পরিত্রান পায় এ আশায়। কিন্তু তা কখনও হতে পারে না। শাস্তি তাদের হবেই, জাহান্নামের অগ্নিশিখা সেদিন তাদের চর্ম ভস্মিভুত করবেই।”-(সূরা মায়ারেজঃ ১০-১৬)
(আরবী **********************************************************************)
“কিয়ামতের সে ভয়ংকর দিনে মানুষ তার ভ্রাতা, মাতা, পিতা, স্ত্রী এবং পুত্র থেকে দূরে পলায়ন করবে। সেদিন প্রত্যেকেই এতো ভীতসন্ত্রস্ত ও ব্যস্ত থাকবে যে, অন্য কোন দিকে লক্ষ্য করার তার ফুরসৎ থাকবে না।”-(সূরা আবাসাঃ ৩৪-৩৭)
খোদাদ্রোহী এ খোদাবিমুখ লোকেরা পরকালে যে বিরাট প্রতারণা ও প্রবঞ্চনার সম্মুখীন হবে তা উপরের আলচনায় সুস্পষ্ট হয়েছে।
এ দুনিয়ার বুকে কিছু লোক কিছু মানুষকে খোদার শরীক বানিয়ে নিয়েছে। অর্থাৎ এসব বানাওটি খোদার শরীকদেরকে খুশী করার জন্যে বিশ্বস্রষ্টা খোদার কথা ও নির্দেশ তারা অমান্য করেছে এবং সেরাতুল মুস্তাকীম পরিত্যাগ করে জীবনের ভুল পথ অবলম্বন করছে। তাদেরকে প্রকাশ্যে ‘ইলাহ’ অথবা ‘রব’ বলে সম্বোধন করা হোক আর না হোক, যখন তাদের এমনভাবে আনুগত্য করা হয়েছে যেমন খোদার আনুগত্য করা উচিত, তখন তাদেরকেই খোদার অংশীদার বাঃ শরীক করা হয়েছে। এসব বাতিল খোদা বাঃ খোদার অংশীদার এবং তাদের অনুসারীদের সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ
(আরবী ***********************************************************)
“(তারা যেন সেদিনকে ভুলে না যায়) যেদিন খোদা তাদেরকে ডেকে বলবেন, আজ কোথায় আমার সেসব অংশীদারগণ যাদেরকে তোমরা আমার অংশীদার মনে করতে? একথা যাদের প্রতি আরোপিত হবে তারা বলবে, ‘হে আমাদের পরওয়ারদেগার! এরাই হচ্ছে ঐসব লোক যাদের আমরা পথভ্রষ্ট করেছিলাম। আমরা যেমন পথভ্রষ্ট ছিলাম, তেমনি তাদেরকেও আমরা পথভ্রষ্ট করেছি।’ তারপর তাদের অনুসারীদেরকে বলা হবে, ‘তোমরা যাদেরকে আমার শরীক বানিয়েছিলে, তাদেরকে সাহায্যের জন্যে ডাক।’ তারা তাদেরকে ডাকবে কিন্তূ তারা কোন জবাব দিবে না। তখন উভয় দল জাহান্নামের শাস্তি আসন্ন দেখতে পাবে। কতই না ভালো হতো যদি তারা সৎপথ অবলম্বনকারী হতো।”-(আল কাসাসঃ ৬২-৬৪)
পরকাল লাভ-লোকসানের দিন
উপরে উল্লেখিত পবিত্র কুরআনের আয়াতে পরকালকে ইয়াওমুত্তাগাবুন বলা হয়েছে। ‘তাগাবুন’ শব্দের অর্থ জয়-পরাজয় এবং প্রবঞ্চনা-প্রতারণা, যার সম্যক আলোচনা উপরে করা হয়েছে। উপরন্তূ ব্যবসার লাভ-লোকসানকেও আরবী ভাষায় ‘তাগাবুন’ বলা হয়। অর্থাৎ পরকাল সত্যিকারভাবে লাভ-লোকসানের দিন।
মানুষ এ আশা হৃদয়ে পোষণ করে ব্যবসা করে যে, সে তার ব্যবসার দ্বারা লাভবান হবে। তার ব্যবসা লাভজনক হলে স্বভাবতঃই সে আনন্দিত হয়। ক্ষতির সম্মুখীন হলে, সে হয় দুঃখিত মর্মাহত।
দুনিয়ার মানুষ সাড়া জীবনভর যা কিছু করছে তাকে আল্লাহ একটা ব্যবসার সংগে তুলনা করেছেন। অতপর ব্যবসার লাভ-লোকসান জানা যাবে পরকালের বিচার দিনে। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেনঃ
(আরবী *******************************************************************)
“তোমরা যারা ঈমান এনেছ শোন। আমি কি তোমাদেরকে এমন একটা ব্যবসার কথা বলব না যা তোমাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি থেকে পরিত্রান দেবে? সে ব্যবসা হচ্ছে এই যে, তোমরা ঈমান আনবে আল্লাহ, তাঁর রসূলের উপর এবং জিহাদ করবে আল্লাহর পথে তোমাদের মাল ও জান দিয়ে। এটাই তোমাদের জন্যে উত্তম কাজ যদি তোমরা জ্ঞান রাখ। অতপর আল্লাহ তোমাদের মাফ করে দেবেন এবং তোমাদেরকে এমন বাগানসমূহে প্রবেশ করাবেন (চির বসবাসের জন্যে) যার নিম্নভাগ দিয়ে প্রবাহিত থাকবে স্রোতস্বিনী এবং চিরদিনের বাসস্থান ও বাগানসমূহে তোমাদেরকে দান করবেন সুরম্য আবাসগৃহ। এটা হলো প্রকৃতপক্ষে বিরাট সাফল্য।”-(সূরা আস সফঃ ১০-১২)
ব্যবসা এমন এক বস্তূ যার মধ্যে মানুষ তার মূলধন, সময়, শ্রম, যোগ্যতা ও জ্ঞানবুদ্ধি বিনিয়োগ করে। এসব এ জন্যে সে করে যে, তার দ্বারা সে লাভবান হবে। কুরআন পাকের আলোচ্য আয়াতে ঈমান এবং আল্লাহর পথে জিহাদকে ব্যবসা বলা হয়েছে। মানুষ যদি তার সবকিছুই এ কাজে নিয়োজিত করে তাহলে সে যা লাভ করবে টা পরবর্তী আয়াতে বলা হয়েছে। টা প্রধানত তিনটিঃ
o সে পরকালে কঠিন যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি থেকে পরিত্রান লাভ করবে।
o আল্লাহ তার পাপরাশি মাফ করবেন।
o এমন বেহেশতে তার স্থান হবে, যেখানে সে ভোগ করবে আল্লাহর অফুরন্ত সুখ সম্পদ। সেটা হবে তার চিরন্তন বাসস্থান। আর এসব কিছুকেই বলা হয়েছে বিরাট সাফল্য। বিরাট সাফল্য কথাটি এখানে উপরোক্ত আলোচনায় জানা গেল যে, পরকাল প্রকৃতপক্ষে মানুষের চিরন্তন লাভ-লোকসানের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তকারী।
পূর্বের আলোচনায় একথাও সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হয়েছে যে, পরকাল অর্থাৎ মরণের পরের যে জীবন তা এক অবশ্যম্ভাবী ও অনিবার্য সত্য। এর যে আবশ্যকতা আছে তাও বলা হয়েছে।
১. ‘জিহাদ’ শব্দের অর্থ সর্বাত্নক প্রচেষ্টা। কোন কিছু লাভ করার জন্যে শারীরিক, মানসিক, আর্থিক, বুদ্ধিবৃত্তিক সকল প্রকার প্রচেষ্টা এবং তার জন্যে সকল উপায়-উপাদান কাজে লাগানোকে জিহাদ বলে। জিহাদ দুই ধরনের হতে পারে। আল্লাহর পথে জিহাদ এবং শয়তানের পথে জিহাদ। একমাত্র আল্লাহর সন্তোষলাভের জন্যে এবং তাঁরই নির্ধারিত রীতি-পদ্ধতির মাধ্যমে যে জিহাদ, তাকে বলা হয়েছে আল্লাহর পথে জিহাদ। নিছক পার্থিব ও ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্যে যে জিহাদ, তাহলো শয়তানের পথে জিহাদ। অন্যকথায় আল্লাহর দ্বীনের মুকাবিলায় যে জিহাদ, তাকেই বলা হয়েছে শয়তানের পথে বা তাগুতের পথে জিহাদ। সকল যুগেই সত্য দ্বীনের মুকাবিলায় শয়তানের পথে জিহাদ করেছে খোদাদ্রোহী শক্তিগুলো। বিশেষভাবে উল্লেখ্য। সব ভালো, যার শেষ ভালো। অতএব পরকালের শেষ জীবনের যে সাফল্য, তা হবে সত্যিকার সাফল্য।
প্রকৃত ব্যাপার এই যে, দুনিয়ার জীবনটা হলো মানুষের এক বিরাট পরীক্ষা কেন্দ্র।
(আরবী ***************************************************************)
“আল্লাহ জীবন এবং মৃত্যু এ জন্যে দিয়েছেন যে, তিনি তোমাদেরকে পরীক্ষা করে দেখবেন কে তোমাদের মধ্যে আমলের দিক দিয়ে উৎকৃষ্ট।”-(সূরা মুলকঃ ২)
মানুষকে বিবেক, ভালো-মন্দের জ্ঞান এবং কর্ম স্বাধীনতা দিয়ে এখানে পাঠানো হয়েছে। পাঠানো হয়েছে নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে। তার জীবনের কর্মসুচীও বলে দেয়া হয়েছে তাকে। তার সময় উত্তীর্ণ হওয়ার পর যিনি তাকে পাঠিয়েছেন, তাঁর কাছেই তাকে ফিরে যেতে হবে। প্রত্যাবর্তনের পর স্বভাবতই এবং সম্পূর্ণ ন্যায়সংগতভাবেই তাকে জিজ্ঞেস করা হবে যে, তাকে যে কর্মসূচি দেয়া হয়েছিল তা সে কতখানি পালন করেছে।
তার জীবনের কর্মসুচী হলো পবিত্র কুরআন। যার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হচ্ছে শেষ নবী মুহাম্মদ মুস্তফার (সা) সমগ্র জীবন। সে জন্যে এ জীবন প্রতিটি মানুষের জন্যেই এক মহান ও অপরিহার্য আদর্শ।
মানুষ তার উক্ত কর্মসূচীকে করতে তাকে পুরস্কৃত করা হবে মৃত্যুর পরবর্তী জীবনে। আর অবহেলা করলে তাকে অবশ্য অবশ্যই শাস্তি গ্রহণ করতে হবে। কিন্তূ কর্মসূচী বাস্তবায়িত করা না করা তার স্বাধীনতার উপরেই ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এটাই হলো তার বিরাট অগ্নি পরীক্ষা। পাশের আনন্দ এবং পাশ না করার দুঃখ তো এক স্বতঃসিদ্ধ ব্যাপার। পরীক্ষার্থী তার কর্তব্যে অবহেলা করলে তাকে চরম অনুতাপ অনুশোচনার সম্মুখীন হতে হয় এটা তো কোন নতুন কথা নয়।
_________________________