এসব ছাড়াও কতগুলি নিয়ম প্রবর্তন করা হয়েছিল, যেগুলি পালন করলে নাজাত পাওয়া যেতে পারে। প্রত্যেক মুসলমানের উচিত, হিন্দুস্তানের কোন না কোন ফকিরী তরিকার সভ্য হওয়া; আল্লাহ্র এই বাণী স্মরণ রাখাঃ “হে সত্য- বিশ্বাসিগণ আল্লাহ্কে ভয় কর, তাহলে তোমরা সুখী হবে”। এই নির্দেশকে দিশারী হিসেবে গ্রহন করলে, এটা পরিষ্কার হয়ে উঠে যে, প্রত্যেক মানুষের সাধনা করা উচিত- আল্লাহ্কে ভয় করা, ঈমানে শক্ত হওয়া এবং আল্লাহ্র সান্নিধ্য লাভ করা [ এটা একমাত্র সম্ভব যুগের ইমাম সাহেবের, কিংবা কোন পীরের মুরীদ হয়ে], আর কাফেরদের বিরুদ্ধে জেহাদ করা। প্রত্যেকটি নির্দেশ প্রথানুসারে পালন করতে হবে। আল্লাহ্কে ভয় না করলে ঈমান শক্ত হয়না। আর মুরশিদের সাক্ষাৎ না পেলে তার জেহাদ করাও হয়না। সৈয়দ আহমদ বিশেষ ভাবে জোর করতেন নামাজ আদায় করতে, জাকাত প্রভৃতি ধর্মীয় কর আদায় করতে ও জেহাদে যোগদান করতে। সৈয়দ আহমদ নিজে ছিলেন পেশাদার সৈনিক, আর মালবের আমীর খান পিণ্ডারির নেতৃত্বে তিনি বহু যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এজন্য তিনি জেহাদের গৌরব সম্মন্ধে আলোচনা করতে আনন্দ অনুভব করতেন। জেহাদ কাফের ও মোমেন মুসলমানদের মধ্যে প্রাচীর তুলে দেয়; আর মুসলমানরা কাফেরদের সংস্পর্শ থেকে বেঁচে যেয়ে হৃদয়ে পবিত্র হয়ে উঠে ও দ্রুতগতিতে দরবেশের মর্যাদায় উন্নীত হয়। তিনি মুজাহিদের প্রসংসা কীর্তনে কখনও ক্লান্তি অনুভব করতেননা। তারা তো আল্লাহ্র নায়েব; তিনি নিজের জীবদ্দশায় জেহাদের প্রয়োজনীয়তা সম্মন্ধে বিশেষ জোর দেন এবং তার মুরীদান ও বংশধরদের জন্য এই চরম নির্দেশ দিয়ে যান যে, তারা যেন যে, রোজ- কেয়ামত পর্যন্ত জেহাদ চালাতে কখনও বিরত না হয়। ‘সিরাতুল মুস্তাকিমের’ নীচের উদ্ধৃতি থেকে জেহাদের পক্ষে যুক্তির মোটামুটি এই পরিচয় মেলেঃ
“জেহাদ হচ্ছে অসীম সুফলের কাজ। বৃষ্টি যেমন মঙ্গল করে মানব জাতির, প্রাণীর ও উদ্ভিদ- জগতের, সেই রকম জেহাদে সকল মানুষ উপকৃত হয়। এই উপকার সাধিত হয় দুরকমে- সাধারণভাবে, যার দরুন সব মানুষ, এমনকি পৌত্তলিকরাও এবং বিধর্মীরাও, আর প্রাণী- জগত ও বৃক্ষলতা উপকৃত হয়; আর বিশেষ ভাবে যার দরুন কয়েক শ্রেণী মাত্র উপকৃত হয় এবং বিভিন্ন অনুপাতে হয়। সাধারন উপকার সম্বন্ধে বলা যায় যে, এসব হল স্বর্গীয় আশিসধারা, যেমন যথাসময়ে প্রচুর বর্ষণ, সবজি ও শস্যের প্রচুর আমদানি এবং সুখের সময়; এসবের ফলে মানুষ অভাবমুক্ত ও দৈবদুর্বিপাক থেকে নিশ্চিত হয়, অথচ তার ধন সম্পদ উথলে উঠে। আর শিক্ষিতের সংখ্যা বৃদ্ধি হয়, বিচারকের ন্যায় বিচার হয়, মামলাকারীদের বিবেকজ্ঞান বর্ধিত হয় এবং ধনবানরা আরও দানশীল হয়।
আবার এসব আসিসধারা শতগুণে বেড়ে উঠে যখন ইসলামের মহিমা স্বীকৃত হয়, শক্তিশালী বাহিনীর অধিকারী মুসলমান শাসকদের গৌরব বৃদ্ধি হয় এবং তারা সকল দেশে শরীয়তী আইন বলবত ও ঘোষণা করেন। কিন্তু একবার এই দেশটার [ভারতের] দিকে তাকাও স্বর্গীয় আশিসধারা সম্বন্ধে তার ভাগ্যের সঙ্গে তুরস্ক বা তুর্কীস্তানের তুলনা কর। শুধু তাই নয় ১২৩৩ হিজরির [১৮১৮ খৃঃ] হিন্দুস্তানের বর্তমান বিবেচনা কর, যখন তার বেশির ভাগই দারুল হরব হয়ে গেছে, আর তার সঙ্গে দু’তিন শতক আগের ভারতের তুলনা কর এবং তার সে আমলের সঙ্গে এ আমলের স্বর্গীয় আসিসধারা ও শিক্ষিতের সংখ্যা বৈষম্যটা লক্ষ কর।“
জেহাদের বিশেষ সুফলের সংখ্যা এত বেশি যে, প্রত্যেকটি উল্লেখ করা সম্ভব নয়। সেগুলির বেশির ভাগই হচ্ছে সেসব পুরস্কার, যা ধর্মার্থে নিবেদিত প্রাণ মুসলমানদের ইসলাম প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে। একটির অবশ্য বিশেষ উল্লেখ এখানে প্রয়োজন, কারণ যাদের বিরুদ্ধে জেহাদ চালানো হয়, তাদের সম্বন্ধে তার বৈশিষ্ট্য আছে। এরকম হয়তো ধারনা করা যেতে পারে যে, মুসলমানদের পক্ষে জেহাদের সাফল্য নিঃসন্দেহে উপকারজনক হলেও, যাদের বিরুদ্ধে জেহাদ হয়, তাদের উপকার হয় কিনা, তা খুবই সন্দেহজনক। এরকম ধারনা করা ভুল। কাফের হওয়ার দরুন তারা বরাবরই পাপের মধ্যে জীবন- যাপন করে এবং ক্রমাগত আল্লাহ্র বিরোধিতা করে। তারা যতো বেশি দিন এই দুনিয়ায় বাস করবে, তত ভীষণ শাস্তি তাদের পরকালে ভোগ করতে হবে। অতএব, তাদের আয়ু কমিয়ে দিলে ভবিষ্যতের শাস্তি থেকে একেবারে নিষ্কৃতি না পেলেও তার তীব্রতা কমানো হবে।
কুরআনে দান করার প্রয়োজনীয়তা সোচ্চার ভাবে ঘোষিত হয়েছে। দান দুরকমের- বাধ্যতামূলক ও স্বেচ্ছামূলক দান, মুসলমানি আইন অনুসারে অবশ্য দেয় এবং তার পরিমাণ, কন কন সম্পত্তির উপর দেয়, কোন শ্রেণীর লোককে এটা আদায় দিতে হবে, সবই আইনে নির্দিষ্ট। জাকাত ইউরোপের ‘টাইথের’ মত, তবে তার পরিমাণ ও কোন সম্পত্তির উপর দেয়, সবই ভিন্ন। সাধারণভাবে বলা যায় যে, জাকাত দিতে হয় চান্দ্র বছরের উদ্ধৃত্ত সম্পত্তির মুল্যের উপর আড়াই টাকা হারে। জাকাত দেওয়ার নিয়ম মুহম্মদ বিশেষ ভাবে প্রবর্তন করেন এবং যখনই কোন গোত্র ইসলাম গ্রহন করত, তখনই তারা একজন ধর্মীয় শিক্ষক ও মাশুল আদায়কারী এক সঙ্গে গ্রহন করত। আবু বকরের সময় জাকাত না দেয়া রাজদ্রোহের তুল্য অপরাধ গণ্য হতো এবং আপত্তিকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার উপযুক্ত কারণ বিবেচিত হতো। এসব ধর্মীয় কর প্রকৃত পক্ষে রাষ্ট্রীয় রাজস্ব হিসেবে বিবেচিত হতো এবং অভাবগ্রস্ত মুসলমানদের ও ধর্মীয় যুদ্ধে যোগদানকারীদের সাহায্যেই ব্যায় করা হতো। কিন্তু ক্রমে ক্রমে মুসলমান রাজ্য বিস্তৃতির ফলে অন্যান্য যেসব মাশুল ও করাদি আদায় করা হতো, তাই রাষ্ট্রীয় ব্যয় নির্বাহে যথেষ্ট বিবেচিত হতো। এজন্য জাকাত ইত্যাদি ধর্মীয় কর সরকার কর্তৃক আদায়ের ব্যাবস্থা পরিত্যক্ত হয় এবং সেসব আদায় দেয়ার দায় লোকের বিবেক জ্ঞানের উপর ছেড়ে দেয়া হয়। সৈয়দ আহমদের কর্মজীবনের বহু পূর্বেই এসব ধর্মীয় কর আদায়ের সরকারী ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যায় এবং ধর্মনিষ্ঠ মুসলমানরা এসব দ্বারা ফকির, গরীব ছাত্র ও মুসাফিরদের সাহায্য করতে থাকেন। সৈয়দ আহমদের নীতি অনুসারে এই নিয়ম আপত্তিকর বিবেচিত হয়। এসব ধর্মীয় কর আল্লাহ্র রাহে দেয়, অতএব মুসলমান রাষ্ট্রে শাসন কর্তৃপক্ষকে দেওয়া বিধেয়। কিন্তু মুসলমানেরা যখন অমুসলমান রাষ্ট্রে বাস করে, তখন সেসব কর সমকালীন ইমাম বা ধর্ম নেতাকে আদায় দেয়া উচিত, কারণ তিনি হচ্ছেন দুনিয়ায় আল্লাহ্র খলীফা। সৈয়দ আহমদ নিজেকে হিজরি তের শতকের ইমাম মনে করতেন এবং ন্যায্য অধিকার হিসেবে সেসব কর দাবী করতেন।
সৈয়দ আহমদ যখন বাংলাদেশ সফর করতে থাকেন, তখন বাংলাদেশে তার খলীফারা তার সাহায্যার্থে প্রাণপণ চেষ্টা করতেন। পাটনা হয় তাদের প্রধান কর্মকেন্দ্র এবং শাহ্ মুহম্মদ হোসেন স্থানীয় নেতা হিসেবে চিহ্নিত হন। অসংখ্য পুস্তক ও ইশতিহার মুদ্রিত ও প্রচারিত হতে থাকে। এভাবে সুরক্ষিত হয়ে এই ধর্মান্ধ গোষ্ঠী ভারতীয় মুসলমানদের একত্রিত ও ভারত উদ্ধার করতে শিক্ষা দিতে থাকে। তারা এ উদ্দেশ্যে টাকা পয়সা সংগ্রহ করতে থাকে এবং সৈয়দ আহমদের ইমাম মেহেদী দাবীটা প্রতিষ্ঠিত করতেও চেষ্টা করতে থাকে।
জৌনপুরের মওলবী কেরামত আলী চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ঢাকা, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর ও বরিশাল জেলায় সফর করতে লাগলেন। পাটনার মওলবী ইনায়েত আলী মধ্য বাংলায় তার কর্মব্যবস্থা নিয়োজিত করলেন এবং পাবনা, ফরিদপুর, রাজশাহী, মালদহ ও বগুড়ায় প্রচারকার্য চালাতে লাগলেন। তার ভাই বেলায়েত আলী কিছুকাল বাংলাদেশে তার সাহায্য করেছিলেন, কিন্তু তার প্রধান কর্মক্ষেত্র ছিল মধ্যভারত, হায়দ্রাবাদ ও বোম্বাই।
সকল মুসলমানই স্বীকার করেন যে, রোজ- কেয়ামত কখন হবে, একমাত্র আল্লাহ্ই জানেন। তবে সেদিন ঘনিয়ে আসার কয়েকটি বিশেষ চিহ্ন আছে এবং বহু মশহুর আলেম ইসলাম ধর্মের দিক দিয়ে সেগুলির নির্দেশ দিতে চেষ্টা করেছেন, যেমন চেষ্টা করেছেন ডক্টর কিউমিং সাহেব খ্রিস্টানদের জন্য। এসব চিহ্নকে আবার ছোট বড় হিসেবে ভাগ করা হয়। ছোট চিহ্ন হল, মুসলমানদের ঈমান নষ্ট হওয়া, ছোট জাতের বড় বড় পদ ও মর্যাদা লাভ করা, মানুষ রিপুর পরবশ হওয়া, সংগ্রাম- সংঘাত ও রাজদ্রোহ বৃদ্ধি পাওয়া, তুর্কীদের সঙ্গে যুদ্ধ, ভূমিকম্প ও দুর্ভিক্ষের আধিক্য। আর বড় চিহ্ন হল, ইমাম মেহেদীর আবির্ভাব। তিনি হবেন হযরত মুহম্মদের বংশধর এবং তার নাম ও পিতার নাম হবে হযরত মুহম্মদের নাম ও তার পিতার নাম। তিনি খোরাসানে জন্মগ্রহণ করবেন। কিন্তু তার প্রথম কর্মজীবন মানবচক্ষুর অন্তরালে থাকবে। শেষে তিনি মদিনায় উদিত এবং সমগ্র আরব দেশের শাসক হবেন। অতঃপর কনস্টাটিনোপল পুনর্দখল করবেন, তার পূর্বেই সেটা নাসারাদের কর্তৃত্বে চলে যাবে। কিন্তু নবরিজিত রাজ্যসমূহের স্থিতিস্থাপকতা সাধনের পূর্বেই খৃস্টশত্রু ও তার অনুচরদের আবির্ভাব হবে এবং মেহেদী এ সংবাদ পেয়ে দামেস্কে উপস্থিত হবেন। তখন দামেস্কের পূর্বে একটা সারা কিল্লাহর নিকটে হযরত ঈসা পৃথিবীতে নেমে আসবেন এবং মুসলমানদের তার শত্রুর বিরুদ্ধে চালনা করে খৃস্টশত্রুকে নিহত করবেন ও তার বাহিনীকে ছিন্ন ভিন্ন করে দিবেন।
সৈয়দ আহমদের মুরিদরা শিক্ষা দিত যে, ইমাম মেহদী সম্পর্কিত এই ধারনা সাধারনের ভ্রান্তি প্রসূত। তিনি আরব ও তুরস্ক বিজয়ী খলীফার চেয়ে নিশ্চয়ই বড় হবেন। অন্যপক্ষে ইমাম মেহদী হবেন মধ্যবর্তী ইমাম, তিনি হযরত মুহম্মদের মৃত্যু ও হযরত ঈসার আবির্ভাবের মধ্যবর্তী সময়ে উদিত হবেন এবং ভারাতীয়দের সাহায্যে ও তাদের বাহুবলে সারা বিশ্ব জয় করবেন। তারা আরও শিক্ষা দিত যে, গোঁড়া সুন্নীরা ইমাম মেহদীকে একজন মশহুর নেতা হিসেবে বেশি বিবেচনা করাই হযরত কর্তৃক ভবিষ্যতবাণীতে উল্লেখিত নেতাদের বিষয় চিন্তা করেনি, আর এজন্য সুন্নীরা হাদিসটির অপব্যাখ্যা করে ফেলেছে। হযরত মুহম্মদ ঘোষণা করেছিলেন যে, হযরত মূসার মৃত্যুর পর বারোজন পয়গম্বর যেমন পর পর জন্মগ্রহণ করে তার ধর্মকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন ও সুদৃঢ় ভিত্তি মূলে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, সেই রকম বারোজন খলীফাও তার মৃত্যুর পর উদিত হবেন এবং ইসলাম ধর্মকে অনুরূপ উজ্জীবিত করবেন। এরকম প্রত্যেক খলীফার ইতিকাহিনীর ইংগিত দেওয়া হয়েছে হাদিসে। তারা সকলেই সমান মর্যাদার হবেনা, কিন্তু প্রত্যেকেই তাদের মর্যাদানুযায়ী ধর্মীয় দুর্নীতি গুলির সংস্কার সাধন করবেন, মুসমান জনসাধারণকে সমগ্রভাবে ঐক্যসূত্রে বেঁধে ফেলবেন এবং হযরত মুহম্মদের সমকালীন ইসলাম বিস্তার করবেন। সেই খলীফাদের একজন হবেন ইমাম মেহদী। রসূল বলেছেনঃ তোমরা যখন খোরাসান থেকে কল পতাকা আসতে দেখবা, তোমরা তাদের সঙ্গে মিলিত হউ। কারণ তাদের সঙ্গে আল্লাহ্র মেহদী আছেন। কিন্তু একথা পরিষ্কার যে, রোজ- কেয়ামতের সময় ইমাম মেহদী উদিত হবেন না, তিনি আসবেন মুহম্মদ ও ঈসার মধ্যবর্তী কালীন সময়ের ঠিক মাঝামাঝি কালে। মুহম্মদ আরও এক সময় বলেছিলেন যে, তার পরেই খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হবে টা বজায় থাকবে ত্রিশ বছর কাল এবং ইমাম মেহদী আসবেন তার পরবর্তীকালে। অন্য এক সময় তিনি বলেছিলেন যে, তার সময়ে যেমন সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেই রকম হযরত ঈসার সময় টা লয় পাবে এবং মেহদী আসবেন মাঝ সময়।
এরকম ভবিষ্যৎ বাণীও করা হয়েছিল যে, রসূলের ঠিক পরবর্তী খলীফাদের পর একদল সুলতান হবেন, যারা পার্থিব সুখ- সম্ভোগে মত্ত হয়ে ধর্মকে বিকৃত করে ফেলবেন ও মানুষকে খেলাফতের আদর্শ থেকে বিপথে নিয়ে যাবেন। কিন্তু কালক্রমে তারাও স্বেচ্ছাচারী শাসকদের হাতে কঠোরভাবে লাঞ্চিত ও উৎপীড়িত হবে। তখন আসমান থেকে বৃষ্টি হবে না এবং মাটিতে ফসল ফলবেনা। তারপর খরাসানের পূর্বদিগস্থ দেশ থেকে একটি দরিদ্র জাতির আবির্ভাব হবে। তারা পাহাড় অঞ্চলে প্রবেশ করবে এবং জন্য স্বেচ্ছাচারী শাসকের সঙ্গে যুদ্ধ করবে। কিন্তু তার পূর্বেই মেহদীর জন্ম হবে। বাল্যকালে তিনি অখ্যাত থাকবেন। কিন্তু সেই মানুষটা যখন একটা রাজ্য জয় করবে, তখন তিনি উদিত হবেন ও তাদের ইমাম হিসেবে গৃহীত হবেন। তিনি হিন্দুস্থান জয় করবেন। এবং পশ্চিমে অগ্রসর হয়ে পারস্য জয় করবেন আর যতদিন তিনি জেরুজালেমের উপর নিশান উত্তোলন না করছেন, ততদিন তিনি ক্ষান্ত হবেননা।
মেহদীর আবির্ভাব সম্বন্ধে যেসব চিহ্ন জড়িত, সেগুলি নিঃসন্দেহে সাক্ষ্য দেয় যে, হিজরি তের শতকেই তার জন্ম হবে। দিল্লীর বাদশাহের শক্তি হিন্দুজাতি মারহাট্টাদের নিকট মাথা নত করেছে। মধ্যভারত অত্যন্ত বিশৃঙ্খল অবস্থায় পতিত। আউধ ও বাংলার সুন্নী মুসলমানরা বহুকাল শিয়া শাসনাধীনে থাকার দরুন ধর্মীয় নিষ্ঠায় শিথিল হয়ে গেছে এবং হিন্দু রেওয়াজ গ্রহন করেছে। কিছুকাল হল খৃস্টান শক্তি [ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, লর্ড ওয়েলেসলী ও হেসটিংসের দক্ষতায়] ভারতে একচ্ছত্র হয়ে উঠেছে ও মালবের পাঠান দস্যুদের সব আশা- ভরসা নির্মূল করে দিয়েছে। আর শেষ কথা এই যে, পাঞ্জাবে শিখরা আজান দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। চারদিক থেকেই রসূলের ভবিষৎবাণী ফলিত হওয়ার চিহ্ন দেখা দিয়েছে। অতএব মেহদীর আবির্ভাবের সময় হয়ে গেছে, আর এজন্য সৈয়দ আহমদের দাবীতে কোন সন্দেহ থাকতে পারেনা। তিনি সৈয়দ এবং হযরত মুহম্মদের বংশধর। তার নাম আহমদ,আর আল্লাহ্র বাণী থেকে এটা পরিষ্কার যে, আহমদ ও মুহম্মদ একই নাম। তার জন্ম হয়েছে ১২০১ হিজরিতে, অর্থাৎ হিজরির তের শতকের প্রারম্ভে। তিনি মুরশিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। স্বভাবে তিনি রসূলের মতোই আর তার বাল্যকাল অখ্যাত ভাবেই কেটেছিল। তিনি খোরাসানের পূর্বদিকে অবস্থিত পার্বত্য অঞ্চলে প্রবেশ করেছেন একদল অনুচর নিয়ে ভারতের অমুসলমান শাসকদের সঙ্গে জেহাদ করার জন্য।
সৈয়দ আহমদের শিষ্যরা যে সিদ্ধান্তে এসেছিল, টা অবশ্য বিতর্কমূলক। তারা এ সিদ্ধান্তে এসেছিল নিতান্তই স্বেচ্ছাকৃত ভাবে এবং যেসব হাদীস তাদের পূর্বকল্পিত সিদ্ধান্তের অনুকূল ছিল, সেগুলি জোড়াতালি দিয়ে। কিন্তু এসব করেও সেসব হাদিসের সঙ্গে সংগতি রাখা গেলনা, যেগুলি দ্বার্থহীন। রসূল ঘোষণা করেছিলেন যে ইমাম মেহদীর পিতার নাম হবে তার নামে এবং তিনি হবেন আরবের শাসক। প্রথম শর্তটি সৈয়দ আহমদের শিষ্যরা একেবারে বর্জন করল আর শেষেরটি সম্বন্ধে তারা বিনা যুক্তিতেই দেখাতে চাইল যে, তাদের বিশ্বাসের সঙ্গে তার অসংগতি নাই। অবশ্য আরও কতগুলি পৃথক কারণ ছিল, যার দরুন এই মতটা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। রাজশক্তি হিসেবে নিজেদের পতন ভারতীয় মুসলমানরা প্রত্যক্ষ করল, আর এশিয়া মাইনরে যুদ্ধ বিগ্রহের কহিনীও তাদের অবিদিত ছিলনা। তারা স্বপ্ন দেখত নিজেদের শান্তিময় ও সার্বভৌম শাসনাধিকারের, আর ইমাম মেহদীর আবির্ভাব ব্যতীত অন্য কোন উপায়ে তার সম্ভাবনা দেখতনা। বহু সুন্নী প্রকাশে বলাবলি করত, তার উদয় হবে হিজরি তের শতকে [১৭৮৬- ১৮৮৬ খৃঃ] আর শিয়ারা আরও নির্ভুল হয়ে দেখাতে চাইতো যে, হিজরির ১২৬০ সালে [১৭১৮ খৃঃ] তিনি উদিত হবেন। কিন্তু বছরের পর বছর কেটে যেতে লাগলো, কিন্তু ইমাম মেহদীর আবির্ভাব হওয়ার অন্যতম প্রধান চিহ্ন খ্রিস্টান শক্তির দ্বারা কন্সটন্টিনোপলের বিজয় দেখা গেলনা, আর এজন্য তাদের আশাও ক্ষীণ হয়ে আসতে লাগলো। সহসা সৈয়দ আহমদের আবির্ভাবে কতগুলো চিহ্ন তো মিলে গেলো, অতএব হাদীস সম্বন্ধে অনভিজ্ঞ জনসাধারণ তাকে ইমাম মেহদীর প্রকৃত মর্যাদায় বরন করে নিল। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের সম্মানের খাতিরে একথা বলতেই হয় যে, তারা এ মিথ্যা দাবীর তীব্র বিপক্ষতা করেছিলেন। সৈয়দ আহমদের দাবীর পোষকতাই নানা ধর্মীয় জাল ভবিষ্যৎবাণীও সৃষ্টি হয়েছিল। তাদের মধ্যে নিম্নের কাঁদিসটি মশুরঃ
আমি আল্লাহ্র কুদরত দেখছি, দুনিয়ার অবস্থা দেখছি,
আমি জ্যেতিষবলে দেখছি না, অনুপ্রেরণাই দেখছি।
আমি দেখছি চোখ মেলে খোরাসান, মিসর, সিরিয়া, ইরানের দিকে,
আমি সবখানেই কেবল বিশৃঙ্খলা ও যুদ্ধ দেখছি।
দুনিয়ায় বহু পরিবর্তন আসছে—
হাজারের মধ্যে আমি একটাই বিশেষ লক্ষ করছি।
আমি একটা আশ্চর্য কাহিনী শুনছি,
আমি এই দুনিয়াই দুঃসময় প্রত্যক্ষ করছি।
চারিদিকে দেখছি বিশাল বাহিনী লড়ছে, আর লুঠ করছে,
আমি দেখছি হীন বংশের লোক অকেজো শিক্ষা নিয়ে
আজ মোল্লা মওলবী আলখাল্লা পরছে।
আমি দেখছি সরদার ব্যাক্তি বন্ধুরা সব
সব জাতির মধ্যে লাঞ্চিত ও অবনত হচ্ছে।
প্রত্যেকেই দুবার করে নওকরী পাবে, আবার হারাবে;
দারিদ্রে ভুগবে, তারপর আবার নওকরি মিলবে।
আমি দেখছি, তুর্কীরা ও ইরানীরা সংগ্রামে- সঙ্ঘাতে মেতেছে।
আমি দেখছি সব শ্রেণীর লোকেরা শঠ ও প্রবঞ্চক হয়ে উঠছে।
আমি দেখছি, ধর্মনিষ্ঠ লোকেরা দেশত্যাগী হয়েছে,
আর দেশগুলো দুষ্টু লোকের আবাস হয়ে উঠেছে
শুধু একটিমাত্র সুখময় স্থান থাকবে-
কারণ আমি বিপদবারনকে প্রত্যক্ষ করছি।
বহু বহু বছর গত হলে পর-
আবার এ দুনিয়া সুন্দর হয়ে উঠবে।
আমি সিরিয়ায় একজন সুসিক্ষিত শাসককে দেখছি।
সমকালীন অবস্থার বিপরীতে আমি দেখছি,
একটা যুগকে, যেটা স্বপ্নময় বলে মনে হয়।
আমি দেখছি বারশো বছর গত হলে পর
পৃথিবীতে বহু আশ্চর্য ঘতনা ঘটবে।
আমি দেখছি, দুনিয়াই সুখের আয়নাখানাই
মরচে ধরে গেছে, বিবর্ণ ধুল;অয় হয়ে গেছে।
আমি দেখছি, জালিমের সীমাহীন অত্যাচার।
আমি দেখছি, সারাটা পৃথিবী ভরে গেছে
বিবাদ বিসম্বাদে, অত্যাচারে ও দুঃখ যন্ত্রণায়।
আমি দেখছি, মুনিবরা আজ গোলাম বনে গেছে,
আর গোলামরা সব মুনিবের জায়গা দখল করেছে।
আমি দেখছি মানুষ দুঃখে ও বিপদে চুপ করে রয়েছে।
নতুন আশরাফী তৈরি হবে কম সোনা দিয়ে।
আমি দেখছি দুনিয়ার সব শাসকরা আজ
পরস্পরের বিরুদ্ধে সারিবদ্ধ হয়ে দাড়িয়ে গেছে।
চাঁদ তার চাঁদনী হারিয়ে আধার হয়ে যাবে,
সূর্যটাও হারিয়ে ফেলবে তার তেজ।
আমি দেখছি, সুদূরের সউদাগররা
সফরকালে বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়ছে।
আমি দেখছি তুর্কীরা অত্যাচারিত হচ্ছে।
আমি দেখছি তরুলতা সব ফলহীন শুষ্ক হয়ে গেছে।
আমি প্রত্যক্ষ করছি ঐক্য, সহিষ্ণুতা ও সাবধানতার প্রয়োজনীয়তা।
দুঃখ করোনা, আমি বন্ধুকে প্রত্যক্ষ করছি, সে আসছে।
শীতের প্রখরতা কেটে গেলে পর
বসন্ত আসে সুর্যের সব গরিমায় প্রদিপ্ত হয়ে।
তার সাধনা সফল হলে পর তিনি এ জীবন থেকে চলে যাবেন,
আমি দেখছি তার পুত্র পিতাকেমনে রাখবে।
আমি পুত্রের রাজগি প্রত্যক্ষ করছি।
আমি দেখছি মহৎ বংশে তার জন্ম,
তিনি সারা দুনিয়ার শাহানশাহ।
আকৃতি ও স্বভাবে তিনি রসূলের সমতুল।
আমি দেখছি তিনি সুশিক্ষিত ও গম্ভীর প্রকৃতির,
আমি অনুভব করছি, ঈমানের বাগিচা
পুষ্পের মধুর সৌরভে পরিপূরিত।
আমি বন্ধুর হাতে দেখছি ঈমানের ফুল।
শোন বন্ধু শোন! এই সুলতান চল্লিশ বছর রাজত্ব করবেন।
আমি দেখছি পাপীর পতন, সে নিষ্পাপ ইমামের
দৃষ্টি থেকে নিজেকে লুকোতে চাইছে।
হে গাজীবর! যারা দুশমনকে হত্যা করে, তিনি তাদের বন্ধু।
তিনি তাদের ভালোবাসেন, তাদের সব কাজ সমর্থন করেন।
আমি দেখছি সত্যধর্ম ও ইসলামের মহিমা
উজ্জীবিত ও শক্তিময় হয়ে উঠছে প্রতিদিন।
আমি প্রত্যক্ষ করছি নওশেরওয়ার ধন দওলত,
আর সেকেন্দার শাহের অগণিত সম্পদ।
সত্য ইমাম আবার উদিত হবেন
আর সারা জাহানে রাজত্ব করবেন।
আমি দেখছি ও পড়ছি আহমদ।
অক্ষরগুলো শাহের নাম উদ্ভাসিত করে তুলছে।
আমি দেখছি দ্বীনের পথ হবে একমাত্র পথ,
আর পৃথিবী হবে উর্বরা।
আমি নিশ্চয় করে বলছি, তার দ্বারা
সারা দুনিয়াই শান্তি নেমে আসবে।
আমি দেখছি মেহদীকে ও ঈসাকে,
প্রত্যেকেই নিজের যুগে শাহীতে বরিত হয়েছেন।
আমি সারা দুনিয়াকে দেখছি দ্বিতীয় মিসর হয়ে গেছে,
আমি সেখানে দেখছি ন্যায় শাসনের কিল্লাহ।
আমি শাহের অধীনে দেখছি সাত জন আগন্তুককে,
আর তারা সকলেই উপযুক্ত মানুষ।
আমি দেখছি আল্লাহ্ সকলকেই করুণা করেছেন।
আমি দেখছি নিষ্ঠুর লোকের তরবারিগুলো কোষবদ্ধ,
তাদের সব মর্চে ধরে গেছে, ভোতা ও অকেজো হয়ে পড়েছে।
আমি দেখছি নেকড়ে, মেষ, বাঘ ও হরিণ
শান্তিতে সব এক সাথে বাস করছে।
আমি দেখছি, তুর্কীবাহিনী নীরবে বসে আছে,
আর তাদের দুশমনরা অলস হয়ে যাচ্ছে।
আর আমি দেখছি নিয়ামতুল্লাহকে,
সকলের থেকে নির্জনে একাকী বসে আছে।
এই রকম ছিল এই বিস্তৃত পুনরুজ্জীবনের মোটামুটি রূপ। অথচ দেখা যাচ্ছে যে, সমকালীন ব্রিটিশ সরকার সে সম্বন্ধে কিছুই ওয়াকিফহাল ছিলেননা। বাস্তবে এ পর্যন্ত প্রকাশিত নথিপত্র থেকে যতদূর দেখা যায়, এখনও পর্যন্ত ওহাবী মতবাদ সম্বন্ধে সরকারের কোন ধারণাই নাই। মিস্টার রেভেন্স যেসব সরকারী নথিপত্র সংগ্রহ করেছেন, তার ১২৭ পৃষ্ঠায় এরকম দেখতে পাওয়া যায়ঃ
সৈয়দ আহমদের শিষ্যরা সাধারন ভাবে ওহাবী পরিচিত হলেও তারা এ উপাধি বর্জন করে এবং জিজ্ঞাসিত হলে নিজেদের হানাফী হিসেবে পরিচয় দেয়। বহুদিকে ফারাজী সম্পদ্রায়ের সঙ্গে তাদের অনেক মিল রয়েছে, আর ফারাজীরা সম্ভবতঃ বেশী গোঁড়া হানাফী। তবে পার্থক্যটা মনে হয় এই যে, হানাফীরা সৈয়দ আহমদকে বলে সৎ ও ধর্মনিষ্ঠ মানুষ। তাকে ইমাম হিসেবে স্বীকার করেনা; আর বলে যে তিনি মৃত। অন্যদিকে ওহাবীরা ও তার শিষ্যরা ঘোষণা করে যে, তিনি ইমাম; আর নিজেই শিষ্যমণ্ডলীকে বলেছিলেন, তিনি কিছুদিনের মত অন্তর্হিত হয়ে যাবেন, কিন্তু পুনরায় উদিত হবেন; তিনি কখনও মৃত নন। মুসলমানদের মধ্যে যারা বেশী অশিক্ষিত, তাদের মধ্যে সৈয়দ আহমদ ও ইমাম মেহদী সমন্ধে ধারনা খুবই গোলমেলে; কারণ সব শ্রেণীর মুসলমানের ধারনা যে, ইমাম মেহদী আসবেন মহাপ্রলয় ও শেষ বিচারের দিন সমাগত হবেন। আর ভুল ধারণাটার কিছুটা ওহাবীরা অস্বীকার করলেও তারা এতিকে পরোক্ষ ভাবে জিইয়ে রেখেছে তাদের অশিক্ষিত শিষ্যদের ধর্মীয় উন্মাদনা বাড়িয়ে তোলার জন্য। কারণ তাদের আশা আছে বিধর্মীদের উপর বিজয় লাভের ও দুনিয়াবী শক্তি ও শাসন প্রতিষ্ঠার, দ্বীন ইসলাম জারীর ও শেষে বেহেশতে সুখ লাভের।“ কিন্তু মওলবীদের পুথপত্রগুলি, যেগুলিকে খুবই সাবধানে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি থেকে গোপন রাখা হতো, তা থেকে মোটেই সন্দেহ থাকেনা যে, তাদের পৃথক মতামত কি ছিল। মিস্টার রেভেনস সম্ভবত লক্ষ করেননি, তার রিপোর্টের ১৪৭ পৃষ্ঠায় মুহম্মদ জাফরের রোজ নামচার তর্জমায় এই উক্তি টুকু আছেঃ
‘আমি হচ্ছি মুনশি তোফায়েল আলী মারফত মওলবী বেলায়েত আলী শাহের ঘনিষ্ঠ মুরীদ ও খাদিম। এখনও পর্যন্ত সৈয়দ আহমদের উপর আমার দ্বিধাহীন বিশ্বাস যে, তিনি মাঝামাঝি যুগের ইমাম আমার আরও বিশ্বাস যে, তিনি বেঁচে আছেন। হাদিসের উক্তি মতে যুগের ইমামকে স্বীকার না করে যে কেউ মৃত্যুবরণ করবে, ষে অজ্ঞতার পরলোকে যাবে। যেসব লোক সৈয়দ আহমদের ইমামত অস্বীকার করে, তারা সকলেই ধর্মভ্রষ্ট। আল্লাহ্ পাপীদের সঠিক পথে চালনা করুন ইমামের অভিব্যাক্তির আলোকধারায় তারা অভিষিক্ত হোক।‘
কিন্তু এই সম্প্রদায়ের মতবাদ বহু পূর্বেই ডক্টর হার্কটস মাদ্রাজ তার “কানুন-ই -ইসলাম” পুস্তকে লোকচক্ষে তুলে ধরেছিলেন। তার গ্রন্থের ২৫০ পৃষ্ঠার এই সম্প্রদায়কেই নিঃসন্দেহে তিনি উল্লেখ করে বলেছেনঃ
“গায়ের মেহদীরা প্রত্যেক জিলায় বা শহরে একটা জামাতখানা তৈরি করে এবং লায়লাতুল কদরের রাত্রিতে সকলেই সেখানে সমবেত হয় মেহদীর ‘দোগানা’ বা দু-রাকাত নামাজ আদায় করে। তারপর তারা সমবেত কণ্ঠে তিনবার পরতে থাকে- ‘আল্লাহু ইলাহুনা মুহাম্মাদুন নবীয়ুনা আল- কুরআন মেহদী আমান্না ওয়া সাদ্দাকনা” অর্থাৎ আল্লাহ্ সর্বশক্তিময়, হযরত মুহম্মদ আমাদের নবী এবং কুরআন ও মেহদী খাটি ও সত্য। তারপর তারা এই বলে শেষ করে- ‘ইমাম মেহদী এসেছিলেন ও চলে গেছেন, যারা এতে অবিশ্বাস করে তারা কাফের।‘ সুন্নীরা এসব শুনে এমনভাবে ক্ষেপে উঠে যে, তারা প্রথমে ছোট ছেলেদের লেলিয়ে দেয় খেলাচ্ছলে তাদের উপর ঢিল ছুরতে, তারপর নিজেরাই তলোয়ার নিয়ে হামলা করে। বিপক্ষ দল অন্য দিকে মনে করে যে, এমন পবিত্র রজনীতে মৃত্যু শাহাদাতের মর্যাদা এনে দিবে তারা জীবনকে তুচ্ছ করে আত্মরক্ষারথে দাড়িয়ে যায়। উপরোক্ত কারনে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিসদৃশ ঘৃণা আজ পর্যন্ত বর্তমান রয়েছে, আর এজন্য প্রত্যেক বছরেই বহু জীবনপাত হয়ে যায়। এই লেখকও এই রকম দু’তিনটি ভীষণ মারামারিতে উপস্থিত ছিলেন, কিন্তু কোন ক্ষেত্রেই গায়ের মেহদীদের জয়ী হতে দেখেননি। তিনি আরও লক্ষ করেছেন যে, এসব মারামারিতে তদন্ত রিপোর্টের বর্ণনানুযায়ী মৃতেরা বরাবরই মাটির দিকে মুখ রেখে পরে থাকে। সাধারন লোকেরা যখন এই বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে ঘোষণা দেই যে, এটা হচ্ছে তাদের ধর্মে বিশ্বাসহীনতা , তখন তারা প্রতিবাদ করে- ‘না না তা নয়; আমাদের শহীদরা সেজদায় পরে আছে” এই শত্রুতার প্রকৃত কারণ হচ্ছে এইঃ সুন্নীরা ও শিয়ারা আশা করে যে, মেহদী ভবিষ্যতে উদিত হবেন। অন্যদিকে গায়ের মেহদীরা মনে করে যে, সৈয়দ মুহম্মদ জিয়নপুরী [জয়পুরী] হচ্ছেন ইমাম মেহদী। তিনি ইতিমধ্যেই দুনিয়াই আবির্ভূত হয়েছিলেন ও চলে গেছেন এবং আর উদিত হবেননা। তারা মেহদীকে পয়গম্বরের মতোই স্রদ্ধা করে এবং বলে যে, যারা তাকে অস্বীকার করে, তারা নিঃসন্দেহে দোযখে যাবে। এজন্য তাদের বলা হয় গায়ের মেহদী [মেহদী বিহীন], অথচ তারা নিজেদের বলে প্রকৃত মেহদীওয়ালে কিংবা দায়েরাওলে। শেষেরটি বলার কারণ এই যে, ‘পীর- ই- দস্তগীর’ এর উপর তাদের কোন আস্থা নেই। অধিকাংশ গায়ের মেহদী হচ্ছে পাঠান আদিজাতিদের মধ্যে; কিন্তু সুন্নী শিয়াদের তুলনায় তারা এতোই সংখ্যাল্প যে, ‘গমের আটায় লবণের ছিটার মতো’।
ভারতীয় কৃষক সম্প্রদায়কে এ আন্দোলনে যোগদান করতে প্রলুব্ধ করার উদ্দেশ্য এই অশিক্ষিত লোকদের স্বার্থ, গর্ব ও গোঁড়ামিকে উত্তেজিত করার জন্য সবরকম যুক্তি খাড়া করা হয়েছিল। তাদের বলা হয়েছিল, তারাই হচ্ছে আল্লাহ্র নির্দেশিত প্রাচ্যদেশীয় জাতি, যারা সারা পৃথিবী জয় করবে এবং ভবিষ্যতে সৈয়দ আহমদের শাসনাধীনে তারাও শান্তিতে বাস করবে। মুসলমানদের মধ্যে ক্ষমতা আসবে এবং সব রকম পার্থিব বিভেদ লয় প্রাপ্ত হবে। দুর্ভিক্ষ আর হবেনা এবং অভাব- অনটনও আর থাকবেনা। আসমান থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে বারিধারা বর্ষিত হবে, দুনিয়া শস্য- শ্যামলা হয়ে উঠবে। তা ছাড়া ভারতে জেহাদের বিষয়ে ভবিষ্যৎবাণী পরিষ্কার ভাবেই করা হয়েছে এবং মুহম্মদ তার ধর্মানুসারীদের ধনপ্রাণ দিয়েই এই জেহাদ সমর্থন করতে নির্দেশ দিয়ে গেছেন। জেহাদে যারা মৃত্যু বরন করবে, তারা শাহাদাতের মর্যাদা লাভ করবে; আর যারা প্রাণে বাঁচবে, তারা অবশ্যই নাজাত বা মুক্তিলাভ করবে। যারা এ বিষয়ে নিরুৎসাহী, তাদের কি শাস্তি হবে, তারও উল্লেখ করতে মওলবীরা পিছু হটেননি। এই শ্রেণীর লোকদের মৃত্যু হবে পাপী হয়েই এবং তারা অবিশ্বাসীদের সঙ্গে সমান শাস্তি লাভ করবে।
উত্তর- পশ্চিম অঞ্চলের বাশিন্দাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী সংখ্যক মুজাহেদিন এসেছিল। দক্ষিণাত্যের বাশিন্দাদের ধর্মীয় উদ্দীপনা এতখানি বর্ধিত করা হয়েছিল যে, মেয়েরা পর্যন্ত গহনা বিক্রি করে আন্দোলনের টাকা দান করেছিলেন। বাঙালীরা প্রথমে পিছনে পড়েছিল; তারা স্বভাবতই ভীরু এবং উত্তর- পশ্চিম অঞ্চলের বাশিন্দাদের চেয়ে অধিককাল স্থায়ী সরকারের অধীনেও ছিল; এজন্য তাদের মধ্য থেকে কম সংখ্যক মুজাহেদীন এসেছিল। কিন্তু কালক্রমে তাদের বুদ্ধিমত্তার প্রাধান্য সবাইকে ছাড়িয়ে গেলো এবং আন্দোলনটার অনেকখানি বাঙালি মুসলমানদের উজ্জীবনের রূপ গ্রহণ করেছিল।
মোটের উপর আন্দোলনটা সফল হয়েছিল। সব শ্রেণীর মানুষের অভাব পূরনার্থে তা কার্যযকরী হয়েছিল। মুজাহিদরা শহীদ হওয়ার সুযোগ লাভ করল, আর শান্তিপ্রিয় লোকরা চাদা আদায় দিয়েই নাজাত ও মুক্তিলাভের পথ খুজে পেল।
মওলবীদের সাম্যনীতি ও ধর্মীয় ঐক্যের প্রচারনায় ছিল নিঃসন্দেহে আন্দোলনটি সাধারনের জনপ্রিয় হওয়ার একটা প্রধান কারণ। তারা শিক্ষা দিলেন যে, প্রত্যেক মুসলমানই পরস্পরকে দেখবে ভাই- ভাই হিসেবে। পদমর্যাদাসিক্ত ও প্রভাবশালী লোকদের বাহ্যিক অধিক সম্মান দেখানো হচ্ছে মুসলমান ধর্মে বেদাত, কারণ পয়গম্বরের জীবদ্দশায় এমন কোন রেওয়াজ ছিলনা, অতএব এটি বর্জন করা উচিত। প্রত্যেক মুসলমান তার পদমর্যাদায় যাই হোক না কেন, সাধারন নিয়মের ;আসসালামুআলায়কুম’ সম্বোধনেই তাকে সন্তুষ্ট হতে হবে। আর যারা বিধর্মী, তা সে হিন্দুই হোক বা খৃস্টানই হোক, তাকে কোন সম্মান দেখাতে হবেনা।
সৈয়দ আহমদ কর্তৃক পেশোয়ার জয়ের সংবাদটা দ্রুতগতিতে সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়লো। মওলবীরা তার প্রয়োজনীয়তা বেশী করেই বাড়িয়ে দিলেন এবং আন্দোলনটাকে নতুন ভাবে জাগিয়ে তুললেন। কিন্তু হটাত যেন আন্দোলনটা নিভে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিল। উত্তর- পশ্চিম ভারত থেকে ক্রমাগত পলাতকের দল আসতে লাগলো সৈয়দ আহমদের মৃত্যুবার্তা নিয়ে এবং তার অনুগামীদের ছত্রভঙ্গ হওয়ার দুঃসংবাদ নিয়ে।