দ্বিতীয় প্রবন্ধ
বারাসতে সৈয়দ আহমদের শিষ্যদের মধ্যে একজন ছিলেন নিসার আলী ওরফে তিতুমীর। তার বাস ছিল চাদপুর গ্রামে। সাধারন গ্রামীণদের চেয়ে তিনি ছিলেন উচ্চকুলের ও সম্ভ্রান্ত জোতদার মুনশী আমীরের সঙ্গে তার বিবাহসূত্রে আত্নীয়তা ছিল। তিনি ছিলেন একজন খারাপ ও বেপরোয়া স্বভাবের লোক। ১৮১৫ সালে তিনি কলকাতায় পেশাদার কুস্তিগির হিসেবে বাস করতেন। পরে তিনি নদীয়ায় জমিদারদের লাঠিয়াল নিযুক্ত হন। একটা মারামারিতে জড়িত হয়ে তিনি কারাদণ্ড ভোগ করেন। কারাবাস থেকে খালাস পেয়ে তিনি ঘটনাক্রমে দিল্লীর শাহী বংশের একজনের দৃষ্টিপথে আসেন ও তার অনুচর হয়ে মক্কায় হজ্জ করতে যান। সেখানে সৈয়দ আহমদের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। সৈয়দ আহমদ পূর্বেই ১৮২২ সালে তথায় গমন করেছিলেন। তিনি সৈয়দ আহমদের মুরীদ হন। ১৮২৭ সালে তিনি ভারতে প্রত্যাগমন করেন পূর্বের বাসগ্রামের অনতিদূরে অবস্থিত হায়দারপুরে বসবাস করতে থাকেন। এখানে তিনি ওহাবী মতে সংস্কার প্রচার করতে থাকেন। সৈয়দ আহমদের মতো তিনি পীরপূজার নিন্দা করতেন, মাজার তৈরির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ তোলেন, মৃত ব্যাক্তিদের নামে দান- খয়রাতের উপযোগিতা অস্বীকার করতেন, নিজের মুরিদদের দাড়ি রাখতে বলতেন এবং তাদের এমন এক বিশেষ ধরনের পোশাক পরতে বলতেন যাতে সহজেই তাদের কাফেরদের থেকে পৃথকভাবে চেনা যায়। তাছাড়া তাদের তিনি নির্দেশ দিতেন নিজেদের মজহাব ছাড়া অন্য লোকদের সঙ্গে মেলামেশা না করতে। কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি হয়ে উঠলেন তিন চারশো ভক্ত অনুগামীদের ধর্মীয় নেতা এবং তার প্রভাব বিস্তৃত হয়ে পড়লো ইছামতী নদীর পার্শ্ববর্তী নারিকেলবেড়িয়া গ্রামের চারপাশের অঞ্চলে, প্রায় আঠারো- কুড়ি মাইল দীর্ঘ ও বারো- চৌদ্দ মাইল প্রশস্ত এলাকা জুড়ে।
এই মজহাবের উত্তরোত্তর বুদ্ধি হানাফী কৃষক সম্প্রদায় ও হিন্দু জমিদারকুল অত্যন্ত অসন্তোষ ও উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছিল। চাষিরা প্রতিবাদ করতো এই নয়া মজহাবের অনুসারীরা তাদের বহু স্রদ্ধাহ অনুষ্ঠান ও আচার নীতি সম্বন্ধে নিতান্তই শ্রদ্ধাহীন ভাবে কথা বলার জন্য। আর প্রাচীনপন্থী জমিদারেরা সহজেই তাদের বিরুদ্ধে চাষিদের অভিযোগ শুনতেন এবং এই নয়া মজহাবের বৃদ্ধি রোধ করতে সর্বশক্তি ব্যায় করতেন। কারণ তারা মোটেই তাদের সম্মান দেখাত না এবং এমন একটা দৃঢ় ঐক্যভাব দেখাতো, যার দরুন তারা নিজেদের স্বার্থ ভবিষ্যতে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশংকা করতেন।
সৈয়দ আহমদের ১৮২৯- ৩০ সালের বিরাট বিজয় তার বাংলাদেশের অনুগামীদের উপর বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছিল। তারা নিজেদের আন্দোলনের সাফল্য সম্বন্ধে আরও প্রত্যয়ী হয়ে উঠলো। অতঃপর তারা নীরবে ও গোপনে কাজ করার এ পর্যন্ত অনুসৃত অভ্যাসটা ত্যাগ করলো এবং প্রকাশ্যে অন্য ধর্মের উপর অনুদারতা জাহির করতে লাগলো। ১৮৩০ সালের আগস্ট মাসের বারাসতের জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেটের গোচরে আসে যে, পাঞ্জাবে মালিক নামে একজন ওহাবিকে তার জমিদার জরিমানা করেছেন ও আটক করেছেন। কারণ সে মোহররমের সময় একটা মশহুর মাজার ভেঙ্গে ফেলেছিল। ১৮৩১ সালের প্রথম ভাগে পুর্ব বাংলায় গোলযোগ ওঠে এবং এপ্রিল মাসে ফরিদপুরের হাজী শরীয়তুল্লাহর অনুগামীরা, যারা সৈয়দ আহমদের প্রচারিত মতবাদের অনুরূপ মত পোষণ করতো, প্রকাশ্যে একটা গ্রামের উপর হামলা চালায় ও লুঠতরাজ করে, কারণ সে গ্রামের জনৈক বাসিন্দা তাদের মজহাবে যোগদান করতে স্বীকৃত হয়নি।
ইছামতী নদীর তীরে অবস্থিত পুর্ণার জমিদার ছিলেন কৃষ্ণরায়। ১৮৩১ সালে জুন মাসে কৃষ্ণরায়ের অত্যাচারে অবস্থা ঘোরালো হয়ে উঠলো। তিনি তার ওহাবী প্রজাদের উপর মাথাপিছু আড়াই টাকা করে কর বসালে এতাকে দাড়ির উপর কর হিসাবে জাহির করে জ্বালাটা আরও বাড়িয়ে তুললেন। বিনা প্রতিবাদে তিনি পূর্ণা গ্রামে কর আদায় করলেন এবং তারপ পার্শ্ববর্তী গ্রাম সরফরাজপুরে কর আদায় করতে গমন করলেন। কিন্তু এখানে তার প্রচেষ্টা দুর্ভাগ্যক্রমে সফল হল না। তিতুমীরের একদল অনুগামী এখানে পূর্ব থেকেই জমায়েত ছিল। একথা বলা শক্ত যে, তারা পূর্বপরিকল্পনা অনুসারেই কিংবা ঘটনাক্রমে সেখানে হাজির ছিল। যা হোক তারা প্রতিবাদ জানালো এবং কর আদায়কারী পিয়াদাদের ধরে আটক করে রাখল। পরিস্থিতির সংবাদ সঙ্গে সঙ্গে জমিদারকে জানানো হয়। তার ক্ষমতার এরকম প্রকাশ্য অবমাননায় তিনি ক্ষেপে উঠেন এবং দু’ তিনশো অনুচর সংগ্রহ করে নিজেই সরফরাজপুর গমন করেন। একটা দাংগা বেঁধে যায়, কয়েকখানা ঘর লুঠ করা হয় ও একটা মসজিদ পুড়িয়ে ফেলা হয়। তারপর উভয় পক্ষই বারাসত থানায় পুলিশের কাছে ঘটনার বিষয়ে এজাহার দেয়। জমিদারের লোকেরা তিতুমীরের অনুগামীদের বেআইনি কয়েদ ও আটক রাখার ও নিজেদেরই মসজিদ পোড়ানোর জন্য দায়ী করে। থানায় মুহরি সঙ্গে সঙ্গে অকুস্থলে হাজির হন ও তদন্ত শুরু করেন। জমিদার পলাতক হলেন এবং কিছুদিন আত্মগোপন করে সাত জুলাই তারিখে বারাসতের জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেটের নিকত আত্মসমর্পণ করেন। তখন তিনি প্রকাশ করেন যে, ঘটনার বিষয় তিনি কিছুই জানেননা এবং দাংগার সময় তিনি সত্যি সত্যি কলিকাতায় ছিলেন। ইতিমধ্যে বারসতের থানার দারোগা ঘটনার তদন্তের ভার গ্রহণ করেন তার হাতের কারসাজিতে সমস্তই সহসা ভিন্ন চেহারা ধারন করলো। তখন মামলার আসল ফরিয়াদীরা ও সাক্ষীরা নিজেরাই মসজিদ পুড়িয়ে দেওয়ার ও জমিদারকে মিথ্যা অপরাধে জড়িত করার দোষে দায়ী হয়ে গেল। তিতুমীরের অনুগামীরা পলাতক হল এবং তাদের আসল মামলার সাক্ষী দিতে হাজির হলনা, কারণ তাহলে তারাই আটক হয়ে পড়বে। এভাবে অবস্থাটা চরম ভাবে সফল হয়ে গেলো জমিদারের পক্ষে। দারোগা তাদের বিরুদ্ধে গরহাজির রিপোর্ট দিলেন এভাবে জমিদারের বিরুদ্ধে রাহাজানি ও ঘর জ্বালানির মামলাটা সাক্ষের অভাবে ফেসে গেলো। শেষ পর্যন্ত তিনি উভয়পক্ষকেই কোর্টে সোপর্দ করলেন মারামারি করার অপরাধে। মামলাটিতে যেভাবে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করা হয়েছিল, তাতে মনে হয়, দারোগা অসহায় অবস্থায় পড়েছিলেন। তিতুমীরের অনুগামীরা দরখাস্ত দিয়ে নিবেদন করে যে, ঘটনার পর আঠারো দ্বীন পর্যন্ত কোন পাল্টা মামলা দায়ের করা হয়নি; তারা দারোগার ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ আনল এবং অভিযোগের সপ্রমাণে সাক্ষীদের নামে সমন জারীর প্রার্থনা করলো। কিন্তু তাদের এসব দরখাস্তে মোটেই কর্ণপাত করা হয়নি। মামলাটা কিছুকাল চলার পর উভয়পক্ষকেই খালাস দেয়া হয়। ওহাবীরা কিন্তু দারোগার বিরুদ্ধে তীব্র বিদ্বেষ পোষণ করে এবং কয়েক মাস পরে তিনি সহসা তাদের কবলে পরলে তারা তাকে নৃশংস ভাবে হত্যা করে।
মামলা শেষ হওয়ার পর উভয়পক্ষ ঘরে ফিরল। কিন্তু তারপর তিতুমীরের অনুগামীদের উপর ভীষণ উৎপীড়ন করা হতে লাগলো। এরকম প্রকাশ হতে লাগলো যে, জমিদার প্রতিপক্ষকে জব্দ করার মতলবে বাকী খাজনার দায়ে তাদের আটক করতে থাকেন। তিনি দেওয়ানী আদালতে তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা বাকী খাজনার মামলা দায়ের করতে লাগ্লেন। ২৫ শে সেপ্টেম্বর তারিখে মুসলমানরা তাদের মামলায় জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেটের হুকুমের বিরুদ্ধে আপীল দায়ের করতে কলকাতায় গেলো। কিন্তু জজ সাহেব তখন বাকেরগঞ্জ মামলার সুনানি সুনতে গিয়েছিলেন। এজন্য তারা কিছুই করতে পারলনা।
পুর্বে না হলেও, ঠিক এই সময়ে তিতুমীর জেহাদ ঘোষণার সংকল্প করলেন। কিছুকাল পূর্বে মিসকিন সাহ নামক একজন ফকীর তার সঙ্গে যোগ দেন ও তার বাড়ীতেই বসবাস করতে থাকেন। মিসকিন শাহের অন্যান্য মুরিদরাও জমায়েত হতে লাগলো, এই মজহাবের অন্যান্য লোকদের নিকট হতে চাঁদা আদায় হতে লাগলো এবং চাউল ও অন্যান্য সামগ্রী ক্রয় করে নারিকেলবাড়িয়ায় মইজুদ্দিন বিশ্বাসের বাড়িতে জমা হতে লাগলো। সম্ভবত ২৩ শে অক্টোবর তারিখে তিতুমীর তার অনুগামীদের একটা ভোজ দেওয়ার উছিলায় জড়ো করলেন এবং মাসের শেষের দিকে তার বহু অনুচর নানা রকম অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে জমায়েত হতে লাগলো।
কয়েকদিন কেটে গেলো নারিকেলবাড়িয়া গ্রামখানিকে ঘিরে একটা মজবুত বাঁশের কিল্লাহ নির্মাণ করতে। ইতিমধ্যেই এই জমায়েতের সংবাদ পূর্ণার জমিদারের কর্ণে পৌঁছাল। তিনি বেশ অনুধাবন করলেন যে, আক্রমণের প্রথম চোট উদ্যত হবে তার উপরেই। এজন্য তিনি সঙ্গে সঙ্গে কর্তৃপক্ষের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করলেন কিন্তু কোনও ফল হলনা। ৬ই নভেম্বর তারিখের সকালবেলায় প্রায় পাঁচশো ধর্মান্ধ পূর্ণা আক্রমন করতে চলল। তারা প্রথমে একজন ভ্রাম্মনকে হত্যা করলো, তারপর গ্রামবাসীদের দুটি গরুকে ধরে জবেহ করলো। বাজারের মাঝখানে তার রক্ত দিয়ে একটি হিন্দু মন্দির অপবিত্র করলো এবং অঙ্গ- প্রত্যঙ্গগুলো তাচ্ছিল্ল্যভাবে ঝুলিয়ে দিল দেব মূর্তির সম্মুখে ও বাজারের কোণে কোণে। এসব করার পর তারা সব দোকানপাট লুট করে ও পথবাহী স্মিথ নামে একজন দেশীয় খৃষ্টানকে ধরে মারধর করে এবং যেসব মুসলমান তাদের মজাহবে যোগ দেইনি, তাদের বেইজ্জত করে। অতঃপর তারা প্রকাশ্যে ঘোষণা করলো যে, কোম্পানীর শাসন খতম হয়ে গেছে; এবং দাবী করলো যে, শাহী ক্ষমতা একমাত্র মুসলমানদেরই প্রাপ্য ও জন্মগত অধিকার; তা ইউরোপীয়রা অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করে ফেলেছিল। মনে হয়, এসব ভুমিকা ইচ্ছা পূর্বক ও সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র হিসেবেই করা হয়েছিল। বাঙালীরা বিরাট একদলে জমায়েত হলে যেসব হৈ- চৈ ও গোলযোগ উপস্থিত হয়, তার কিছুই হয়নি, বিদ্রোহীরা জঙ্গি নিয়েমানুবর্তিতা মেনে চলেছিল এবং গোলাম মাসুমের নেতৃত্বে সামরিক কায়দায় সারি বেঁধে কুচকাওয়াজ করতে করেত চলেছিল।
পরদিন সকালে তারা নদীয়া জিলার ভিতরে হামলা করে এবং লাউঘাটা গ্রামে প্রবেশ করে। এই গ্রামে তাদের সম্প্রদায়ের লোকদের সংখ্যা কিছু বেশী। তারা প্রথমে হিন্দুদের বস্তিতে একটা গরু জবেহ করে। তখন হিন্দু রায়তরা বাধা দেয় ও একটা দাংগা বেঁধে যায়। এই দাংগায় গ্রামের হিন্দু মোড়ল নিহত হয় এবং তার ভাই ও আরও কয়েকজন আহত হয়। তারপর বিদ্রোহীরা তাদের সদর কর্মকেন্দ্র নারিকেলবাড়িয়ায় প্রত্যাগমন করে। তার পরের কয়েকদিন কেটে গেলো লাউঘাটার হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে যে দারোগা তদন্ত করতে এসেছিলেন তাকে খেদিয়ে ফিরিয়ে দিতে রামচন্দ্রপুর ও হুগলী গ্রাম দুটি লুট করতে এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামের হিন্দুদিগকে অপমান করতে ও বল পূর্বক ইসলামে দিক্ষীত করতে। ১৪ তারিখে তারা শেরপুরের জনৈক সম্ভ্রান্ত মুসলমানের বাড়ি লুট করে এবং বলপূর্বক তার কন্যার সঙ্গে নিজেদের দলপতির শাদী দিয়ে দেয়।
মনে হয়, এ পর্যন্ত বেসামরিক কর্তৃপক্ষের আন্দোলনটার গুরুত্ব সম্বন্ধে কোন ধারণাই জন্মাইনি। অথচ পরিস্থিতির এমন সব অবস্থা হয়েছিল, যা থেকে প্রথমেই খাটি সংবাদ পাওয়া নিশ্চয়ই উচিত ছিল। আক্রান্ত এলাকাটি নদীয়া ও বারাসত জিলার অংশ নিয়ে বিস্তৃত। তার মাঝে মাঝে অনেক নীল কুঠি ছড়িয়ে ছিল এবং বাগুন্ডির সরকারী লবণগোলাও ছিল অনতিদূরে অবস্থিত। ২৮শে অক্টোবর তারিখে প্রথমেই বারাসতের ম্যাজিস্ট্রেট সংবাদ পান যে, তিতুমীরের অনুগামীরা নারিকেলবাড়িয়ায় জমায়েত হচ্ছে। কিন্তু ব্যাপারটাকে তিনি এতোই তুচ্ছ ভাবলেন যে, তিনি মনে করলেন জান দুয়েক বরকন্দাজ দিয়েই জমায়েতটাকে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া যাবে। কয়েকদিন আর কোন সংবাদ পাওয়া গেলো না। কয়েকজন লোক মারফত যা কিছু সামান্য খবর মিলল, তাতে জানা গেলো যে, বিদ্রোহীরা কয়েকটা খুন করেছে। তখন তিনজন জমাদারকে ত্রিশ জন বরকন্দাজ দিয়ে নির্দেশ দেওয়া হল বারাসতের ম্যাজিস্ট্রেটকে সাহায্য করতে। কিন্তু এই সামান্য লোকবল নিয়ে তিনি বিদ্রোহের মোকাবিলা করতে অক্ষমতা জানালেন। তবে নদীয়া ও বারাসতের বাশিন্দাদের সৌভাগ্য এই যে, সেখানে আরও এমন সব ব্যাক্তি ছিলেন, যারা আন্দোলনটাকে তিচ্ছ ভাবেননি। ১১ই ও ১২ই নভেম্বর তারিখে বিদ্রোহীদের সদর কর্মকেন্দ্রে নিকটবর্তী নীলকুঠির ভারপ্রাপ্ত সহকারী কর্মচারী মিঃ পিরন কলিকাতাবাসী তার মালিক স্টরমকে পত্র পাঠান। তাতে তিনি ১০ই তারিখে অনুষ্ঠিত নৃশংস ঘটনা সম্বন্ধে বিস্তারিত বর্ণনা দেন। স্থানীয় বেসামরিক কর্মকর্তাদের নিষ্ক্রিয়তার অনুযোগ তোলেন এবং একথাও পরিষ্কার ভাবে জানান যে, গোলযোগ নিবারণ করতে কোন সক্রিয় পন্থা অবলম্বন করা না হলে সরকার ভীষণ বিপদ্গ্রস্থ হবে। মিঃ স্টরম তখনই যথাবিহীত ব্যাবস্থা করলেন। ১৩ই তারিখে তিনি নদীয়াই ও বারাসাতের ম্যাজিস্ট্রেটদ্বয়কে এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে পত্র দিলেন এবং তার কর্মচারীর পত্রগুলি ডেপুটি গভর্নরের নিকট পাঠিয়ে দিলেন বিবেচনার জন্য। প্রথমে সরকার বিদ্রোহের অস্তিত্বই বিশ্বাস করতে চাইলেন না। তারা তো কোন সংবাদই পাননি, যা থেকে তাদের বিশ্বাস জন্মাতে পারে যে, এ ধরনের বিদ্রোহ হতে পারে। অতএব তারা সম্ভাবনা সম্বন্ধে কোন সংবাদ না পাওয়ায় এতদূর ভীষণ বিদ্রোহের ঘটনা অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল। কিন্তু এই ভ্রান্তি ঘুচে গেলো যখন সরকারী রিপোর্ট বারাসাতের ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট থেকে একই ধরনের পত্র পাওয়া গেলো।
তখন আশু প্রস্তুতি চলতে লাগলো বিদ্রোহ দমন করতে। কলকাতা সামরিক বাহিনীর একটা অংশ বাগুন্ডির যশোর লবণগোলায় পাঠিয়ে দেয়া হল মিঃ আলেকজান্ডারকে নির্দেশ দেওয়া হল সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যোগ দিতে ও বিদ্রোহ দমনে অগ্রসর হতে। তিনি ১৪ই তারিখে রওয়ানা হলেন এবং বাগুন্ডিতে সহযোগিতার জন্য বারাসতে সব রকম বন্দোবস্ত করে ফেললেন। বেলা ৯ টার সময় তিনি বাদুরিয়ায় পৌঁছলেন। এটা বিদ্রোহের শিবির থেকে ৬ মাইল দূরে ছিল। সেখানে দারোগা বহু বরকন্দাজ ও চৌকিদার নিয়ে তার সঙ্গে যোগ দিলেন। সমগ্র বাহিনীর সংখ্যা দাঁড়ালো একশো কুড়িজন। কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর তারা শত্রুর সন্ধানে অগ্রসর হলেন। তারা দেখলেন যে, পাঁচ- ছয়শো লোক নানা অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে নারিকেলবাড়িয়া গ্রামের সামনের ময়দানে যুদ্ধার্থে দাঁড়িয়ে গেছে এবং গোলাম মাসুম অশ্বপৃষ্ঠে তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বাঙালীরা সাধারনত ভীরু জাত। মিঃ আলেকজান্ডার ও তার দলবল কোন ভীষণ বিরুদ্ধতার আশংকা করেননি। তারা নিশ্চিত ভেবেছিলেন, ওহাবীরা সামরিক বাহিনী দেখলেই ছত্রভঙ্গ হয়ে যাবে। এই ধারনার বশবর্তী হয়ে সিপাহীদের নির্দেশ দেওয়া হয় ফাকা আওয়াজের টোটা ভরতে। আর মিঃ আলেকজান্ডার রক্তপাত এড়াবার ইচ্ছায় একাই অগ্রসর হয়ে দেশী লোকদের ভর্তসনা করতে গেলেন। কিন্তু তার কথায় কোন কর্ণপাত করা হলনা। বিপক্ষরা তাকে ও তার দলবলকে ইটপাটকেল ও সমান স্তরের অস্ত্র দিয়ে আক্রমন করলো এবং পরে গোলাম মাসুম বাহিনী নিয়ে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পরলে সিপাহীরা ফাকা গুলি ছুড়ল। কিন্তু দুশমনরা সঙ্গে সঙ্গে তাদের ঘিরে ফেলল ও কেটে খন্ড খন্ড করে ফেলতে লাগলো। কলকাতা সামরিক বাহিনীর জমাদার, দশজন সিপাই ও তিনজন বরকন্দাজ নিহত হয়। বারাসতের দারোগা, কলোঙ্গা থানার জমদার ও কয়েকজন বরকন্দাজ গুরুতর ভাবে আহত হন ও বিদ্রোহীদের হাতে বন্দী হন। তারা তাদের নিজেদের কিল্লাই ধরে নিয়ে যাই ও দারোগাকে নৃশংস ভাবে হত্যা করে। মিঃ আলেকজান্ডার বহু কষ্টে বেঁচে যান। তিনি প্রাণ নিয়ে পলায়ন করতে লাগলেন, আর বিদ্রোহীরা নাঙ্গা তলোয়ার হাতে তাকে তারা করে ফিরতে লাগলো। শেষে তিনি বাদুরিয়ায় উপস্থিত হন ও একটা নৌকা ধরে যশোরের লবণগোলায় সূর্যাস্তের সময় পৌঁছালেন। তার মুখে যুদ্ধের বিশদ বিবরণ শুনে সেখানকার রেসিডেন্ট মিস্টার বারবারের চোখে- মুখে কি পরিমাণ আতংক দেখা দিয়েছিল তা সহজেই অনুমেয়। তিনি তো সকালে মিঃ আল্রকজান্ডারকে রওয়ানা করে দিয়েছিলেন এই ভরসাই যে, সিপাইদের উপস্থিতিই গোলযোগ নিবারণের জন্য যথেষ্ট হবে। এখন পরিষ্কার হয়ে গেলো যে, বিদ্রোহটা যা ভাবা হয়েছিল তার চেয়েও গুরুতর এবং কালক্ষেপ করা মোটেও সমীচীন হবেনা। লবণগোলায় যা কিছু টাকা পয়সা ছিল সমস্তই তাড়াতাড়ি একটা নৌকাই উঠিয়ে ফেলা হল এবং মিঃ আলেকজান্ডারের জিম্মায় সুন্দরবন হয়ে কলকাতায় পাঠিয়ে দেওয়া হল।
বিপদের উপর বিপদ উপস্থিত হল। ১০ই নভেম্বর তারিখে নদীয়ার ম্যাজিস্ট্রেট সংবাদ পেলেন বিদ্রোহীরা লাউঘাটা আক্রমণ করেছে। ১২ই তারিখে সোজা তাদের অক্ষমতা জানালো সাহায্য ব্যতীত বিদ্রোহের মোকাবিলা করতে। একজন দারোগা ও কুড়িজন বরকন্দাজ পাঠিয়ে তাদের শক্তি বৃদ্ধি করা হল। তারপর পুলিশের নিকট থেকে আর কোন সংবাদ পাওয়া যায়নি। কিন্তু ১৪ই তারিখে মিঃ স্টর্মের পত্র এসে গেলো। তখন ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব তাড়াতাড়ি যা পারলেন পুলিশ সংগ্রহ করে তাদের নিয়েই দাঙ্গাবাজদের নমন করতে অগ্রসর হলেন। সেখানে মিঃ এনড্রুজ নামে একজন নীলকর সাহেব তার চারজন ও যেসব কর্মচারী সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছিল, তাদের নিয়েই তার সঙ্গে যোগ দিলেন। মোটেই কালক্ষেপ করা হলনা এবং প্রায় দু’ তিনশো সশস্ত্র বাহিনী ইছামতী নদীর নীচের দিকে অগ্রসর হল বিদ্রোহীদের আক্রমণ করতে। তারা ১৬ই তারিখের বিকেল পাঁচটায় বাদুরিয়ার কুঠিতে উপস্থিত হয়ে দেখল, বিদ্রোহীরা ঐ দ্বীন সকালবেলায় কুঠিটিকে লুণ্ঠন ও ধ্বংস করে দিয়েছে। মিঃ পিরণ বারাসতের ম্যাজিস্ট্রেটকে যে সংবাদ দিয়েছিলেন, এটা হল তার প্রতিশোধ গ্রহণ।
মিঃ আলেকজান্ডারের পরাজয়ের সংবাদও এসে গেলো। কিন্তু বিদ্রোহীদের ক্ষমতা কতখানি এবং তাদের উদ্দেশ্যই বা কি, সে সম্বন্ধে ভাসা ভাসা খবর আসতে লাগলো। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব আরও শক্তি সাহায্য না পাওয়া পর্যন্ত আর অগ্রসর হতে প্রথমে রাজি হলেননা। কিন্তু সংবাদদাতারা তাকে মতলব করেই জানালো, বিদ্রোহীরা এমন কিছু সংখাধিক নয়, বা উপযুক্ত অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত নয়, যার দরুন বিজয় লাভের সন্দেহ থাকতে পারে। এভাবে প্রতারিত হয়ে তিনি আক্রমণ করাই স্থির করলেন। ১৭ তারিখের সকালে ইউরোপীয় হাতির উপর সওয়ার হয়ে বাহিনী নিয়ে নারিকেলবাড়িয়ার দিকে অগ্রসর হলেন। সেখান থেকে দূরত্ব ছিল মাত্র চার মাইল। পথে বাঙালীরা একে একে সরে পড়তে লাগলো এবং দলটি যখন নারিকেলবাড়িয়া গ্রামের খোলা ময়দানে উপস্থিত হল, তখন দেখা গেলো যে, মাত্র কুড়ি বা ত্রিশ জন উত্তর ভারতীয় বরকন্দাজ ব্যাতিত প্রত্যেক দেশীয় লোক অদৃশ্য হয়ে গেছে। অথচ তারা দেখল যে, বিদ্রোহীরা প্রায় এক হাজার লোক, রীতিমত যুদ্ধ সজ্জায় দাড়িয়ে আছে এবং খোদ তিতুমীর তাদের নেতৃত্ব করছেন। এরকম পরিস্থিতে আক্রমণ করা সমীচীন নয় ভেবে ইউরোপীয়রা পিছনে হটতে লাগলো। কিন্তু যেই তারা পিছন ফিরল, তখনই বিদ্রোহীরা দ্রুত গতিতে তাদের ধাওয়া করলো ধরে ফেলে নদীয়া ফৌজদারি কোর্টের নাজিরকে ও দুজন বরকন্দাজকে হত্যা করলো। বেচারারা পালিয়ে বাচতে পারেনি। বাকী সকলেই প্রাণপণে ধাবমান হয়ে ইছামতী নদীর তীরে পৌঁছালো ও বহু কষ্টে নৌকা ধরতে পারল। তারপর তারা ঝাকে ঝাকে গুলি ছুরতে লাগলো, কিন্তু কোন ফল হয়নি। বিদ্রোহীরা একজন মাত্র মারা গেলো ও একজন আহত হল। মিঃ আলেকজান্ডারের পরাজয়ের পর ধর্মান্ধদের বিশ্বাস জন্মেছিল যে, তারা আল্লাহ্ কর্তৃক দুশমনের গুলি থেকে বিশেষ হেফাজতে রক্ষিত ও নিরাপদ। তাদের এ বিশ্বাস আরও দৃরভূত হল, যখন তারা দেখল যে, নদীয়াই ম্যাজিস্ট্রেটের বাহিনী তাদের খুব কম ক্ষতি করতে পেরেছে। অতএব তারা অসম সাহসে সামনে অগ্রসর হল এবং ইউরোপীয়দের নৌকাগুলি ঘিরে ফেলতে ও উপরে উঠতে চেষ্টা করতে লাগলো। অবস্থা তখন বেগতিক দেখে ইউরোপীয়রা নৌকাগুলি নদীর অপারে ফেলে দৌড়াতে লাগলো এবং এক মাইল তফাতে রাখা হাতিগুলির উপর উঠে পালিয়ে গেলো। প্রায় ২৬ মাইল এসে তারা একটা বড় নীলকুঠিতে আশ্রয় পায়। একটি হাতি, একটি পানশী, একটা বজরা ও অন্যান্য নৌকা বিদ্রোহীদের হাতে পড়লো। বিদ্রোহীরা পর পর দুটি যুদ্ধে স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে হারিয়ে জয়লাভ করে উল্লসিত হয়ে উঠে ও আরও লুণ্ঠন চালাতে থাকে। তারা হুগলীর নীলকুঠি আক্রমণ করে এবং ম্যানেজারকে সপরিবারে বন্দী করে, তারপর তাদের নারিকেলবাড়িয়ার কিল্লায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং তিতুমীর ও মিসকিন শাহের সামনে হাজির করা হয়। তারা বন্দীদের নিকট অবিলম্বে বিনাশর্তে তাদের হুকুমত মেনে নিতে দাবি জানান। ম্যানেজার বুদ্ধিমানের মতো সম্মত হলেন। তিনি জিম্মি হতে রাজি হলেন এবং ভারতীয় শাসকরূপে তাদের অধীনে নীল চাষ করতে সম্মত হলেন। তখন তারা তার বশ্যতাই সন্তুষ্ট হয়ে তাকে মুক্তি দিলেন। বেসামরিক কর্তৃপক্ষ একেবারে অকেজো হয়ে পড়লো এবং বিদ্রোহীরা তাদের সমস্ত নিষ্ক্রিয়তার সুযোগ নিয়ে উত্তরের কৃষ্ণনগরের দিকে অগ্রসর হতে ইচ্ছা করলো। তারা স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে ও জমিদারদের উপর ইশতেহার জারী করে নির্দেশ দিল তাদের হুকুমত মেনে নিতে এবং তাদের অভিযানকালে রীতিমত রসদ যোগাতে। কিন্তু শীঘ্রই তাদের রাজ্য জয়ের স্বপ্নটা ভেঙ্গে গেলো।
মিঃ আলেকজান্ডার ১১ই নভেম্বর কলকাতায় পৌঁছেন এবং নিজের পরাজয়ের কাহিনী সবিস্তারে বর্ণনা করেন। জুরুরি অবস্থায় মোকাবিলা করতে সরকার আর মোটেই কালক্ষেপণ করেনি। দেশীয় পদাতিক বাহিনীর দশম রেজিমেন্টের একটা অংশ, মুতি কামান সহ অশ্ব চালিত সাঁজোয়া বাহিনী এবং দেহরক্ষী দলের একটা অংশকে নির্দেশ দেওয়া হয় অবিলম্বে মিঃ আলেকজান্ডারের সাথে যোগ দিতে। এই বাহিনী ১৭ই তারিখের সন্ধার পর বারাসত থেকে অগ্রসর হতে থাকে ও পরদিন সকাল ১১ টার সময় সমগ্র অশ্বারোহী ও সাঁজোয়া বাহিনী নারিকেলবাড়িয়ার সামনে উপস্থিত হয়। পদাতিক বাহিনী অশ্বারোহী বাহিনীর সঙ্গে সমান তালে অগ্রসর হতে পারেনি, এজন্য অশ্বারোহী বাহিনী সারাদিন গ্রামটির সম্মুখে অবস্থানের পর সন্ধ্যার সময় পিছনে ফিরে আসে ও পদাতিক বাহিনীর সাথে মিলে ছাউনি ফেলে। ১৯ তারিখে সমগ্র বাহিনী একযোগে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করলো। তারা দেখল, বিদ্রোহীরা রীতিমত সজ্জিত হয়ে যুদ্ধার্থে ময়দানে উপস্থিত আছে এবং তাদের সম্মুখে গত রাতের নিহত একজন ইউরোপীয়নের খন্ডিত দেহ ঝুলান আছে। অশ্বারোহী বন্দুকধারীরা বিদ্রোহীদের অসম সাহসে আক্রমন সহ্য করতে লাগলো। কিন্তু বার বার গোলার আঘাতে তাদের দলের লোক অত্যধিক নিহত হওয়াই তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়লো ও কিল্লাহর ভিতরে আশ্রয় নিল। তাদের প্রায় ষাট সত্তর জন নিহত ও সমান সংখ্যক আহত হয়। কিল্লাহটি তোপের মুখে অধিকার করা হয়।
কিল্লাহর ভিতরে বিদ্রোহীদের বন্দী করে আনা কয়েকজঙ্কে পাওয়া যায়, আর পাওয়া যায় স্থানীয় গ্রামগুলি ও নীলকুঠিগুলি থেকে লুট করে আনা প্রচুর মালামাল। এগুলো বিজয়ী সিপাহীরা লুট করে নেয়। তিতুমীর যুদ্ধক্ষেত্রে শহীদ হন, টার সহকারী গোলাম মাসুমসহ সাড়ে তিনশো বিদ্রোহীকে বন্দী করা হয়। আলীপুর কোর্টে তাদের বিচার হয়। বিচারে গোলাম মাসুমের ফাঁসির আদেশ হয় ও প্রায় ১৪০ জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হয়। পরবর্তীকালে মিঃ কলভিন বিদ্রোহের স্থানীয় কারণসমূহের একটি বিস্তৃত রিপোর্ট দাখিল করেন। তারা উপর সরকার নিম্নলিখিত মন্তব্য করেই যথাকর্তব্য সমাধা করেনঃ
‘মিঃ কলভিনের রিপোর্ট থেকে সন্তোষজনক ভাবে লক্ষ করা যায় যে, বিদ্রোহটা সর্বতোভাবেই সামান্য ব্যাপার ছিল এবং কোন সময়েই তা আদি উৎপত্তিস্থান থেকে বাইরে ছড়িয়ে পরেনি। আরও জেনে সন্তোষ লাভ করা যায়, দেশের কনে প্রভাবশালী ও বিত্তশালী ব্যাক্তি এই বিদ্রোহের সঙ্গে যোগ দেয়নি। কিন্তু যতোই সন্তোষের বিষয় হোক না কেন, এসব অবস্থা থেকে নিশ্চয়ই অবাক হতে হয় যে, এমন সব কার্যকলাপে এতোখানি তীব্রতা ও নৃশংসতা হতে পারে”।
এ ধরনের মন্তব্য লিপিবদ্ধ করেই সরকার এই বিদ্রোহের উপর যবনিকা টেনে দিলেন। সরকার বিদ্রোহীদের ভাব্লেন, মাত্র অবিবেচক লোক, যাদের কাজের কোন কৈফিয়ত থাকতে পারেনা। তাদের ধর্মীয় মতবাদ কি ছিল এবং কি জন্য তারা এরকম ভীষণ অপরাধজনক কাজে লিপ্ত হল, সে সম্বন্ধে কোন তদন্ত করা প্রয়োজনীয় বিবেচিত হয়নি, কারণ, এই শ্রেণীর লোকদের কাছে টার চেয়ে বেশী কিছু বেশী আশা করা যায়না। তারপর প্রায় চল্লিশ বছর গত হয়ে গেছে, কিন্তু এখনও এই বিদ্রোহের ইতিহাস পাঠকালে কেউ সরকারের চরম উদাসীনতাই আশ্চর্য না হয়ে পারে না। ১৮২২ সালে সৈয়দ আহমদ ভারতের বর্তমান অমুসলমান শাসকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন এতোটুকু বাধাগ্রস্থ না হয়ে এবং ১৮২৭ সালে তিনি শিখদের বিরুদ্ধে জেহাদ আরম্ভ করেন। বাংলাদেশ থেকে অজস্র মানুষ ও টাকা পয়সার সাহায্য প্রকাশ্যভাবেই তার নিকট পাঠানো হতো। এ বিষয়ে কোন গোপনীয়তা অবলম্বন করা হতো না। সরকার নিশ্চয়ই পাঞ্জাবে তার বিজয়গুলি সম্বন্ধে অবহিত ছিলেন। তবুও যখন তার অনুগামীরা আত্মবলে বলীয়ান হয়ে কলকাতা থেকে মাত্র ত্রিশ মাইল দূরে বিদ্রোহের ঝান্ডা উড়িয়ে দিল তখন সেতাকে মাত্র দুর্বোধ্য গোলযোগ হিসেবে উড়িয়ে দেয়া হল। আর বিদ্রোহীদের আখ্যা দেয়া হল নির্বোধ ও অবিবেচক এবং কোন ষড়যন্ত্র বা অভিসন্ধি সাধনে অক্ষম।
সৈয়দ আহমদের মৃত্যু সংবাদ যখন পাটনায় পৌছালো, তখন মওলবী ইনায়েত আলী দাক্ষিণাত্যে ও নিম্নবঙ্গে প্রচারকার্যে ব্যাস্ত ছিলেন। তারা তৎক্ষণাৎ পাটনায় প্রত্যাবর্তন করলেন এবং অতঃপর কি কর্তব্য হবে, সে বিষয়ে গভীর আলোচনা করলেন। সৈয়দ আহমদের মৃত্যু ভীষণ দুর্ভাগ্য বিবেচিত হয়েছিল। শুধু নেতা হিসেবেই ছিল তার ক্ষতি অপরিসীম। তিনি ছিলেন যুদ্ধ বিশারদ এবং আমীর খানের অধীনে তিনি যে অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন, তার ফলে সৈন্য যোজনায় তার পারদর্শিতা জন্মেছিল। আর কোন নেতা তার অভাব পূরণের উপযুক্ত ছিলেননা। মওলবী ইসমাইলও বালাকোটের যুদ্ধে তার সঙ্গে শহীদ হন, আর মৌলবি আব্দুল হাই কিছু পূর্বেই দিল্লীতে জান্নাতবাসী হন। কিন্তু পাটনায় মওলবীদের বিবেচনায়, সৈয়দ আহমদের মৃত্যুর দরুন অবস্থার সঠিক গুরুত্ব অনুধাবন করতে হলে সমকালীন পরিস্থিতি লক্ষ করা দরকার। তার অনুগামীরা প্রথম থেকেই দুটি বিরুদ্ধ দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল, আর এজন্য এ দুটির মধ্যেই ঐক্য সাধনই ছিল জীবনব্যাপী প্রচেষ্টা। স্বীকৃত ইমাম হিসেবে তার মর্যাদা এবং সম্প্রীতি আনায়নে অসীম ক্ষমতার বলে তিনি এ বিষয়ে সফলকাম হয়েছিলেন। কিন্তু সামান্য কারনেই তাদের মধ্যে পুনরায় বিচ্ছেদ ঘটতে পারে, তারও যথেষ্ট চিহ্ন দেখা যেত। একদিকে তার শিষ্যদের এক বিরাট অংশ নেতৃত্ব করতেন মওলবী আবদুল হাই ও মওলবী কেরামত আলী জৌনপুরি। তাদের বিরুদ্ধ দলের নেতৃত্ব করতেন মওলবী ইসমাইল, যিনি চার ইমাম- আবু হানিফা, আবু শাফী, মালিক ও ইবনে হাম্মালকে অনুসরণ করার সার্থকতা বরাবরই অস্বীকার করতেন এবং ব্যাক্তিগত ভাবে ব্যাখ্যা করার অধিকার চরমভাবেই প্রতিষ্ঠিত করতেন। সৈয়দ আহমদ ছিলেন মধ্যপন্থী। তিনি সর্ববিধ ধর্মীয় বিধি ও আচার- অনুষ্ঠান পালন করতেন হানাফী মজহাবের অনুসারী হিসেবে কিন্তু সামঞ্জস্য বিধানের জন্য একটি নয়া ফকীরের তরিকা সৃষ্টি করে নীরবে মওলবী ইসমাইলের অনুসারীদের সমর্থনও করতেন। তার এই মুহম্মদী তরিকার চিন্তা মৌলিক কিছু নয়। আসলে সকল মুসলমানই মুহম্মদী দ্বীন অর্থাৎ মুহম্মদের ধর্মের অনুসারী। আবদুল ওহাব যখন আরবে প্রচারকার্য আরম্ভ করেন, তখন তিনি প্রচলিত সকল মজহাবকে অস্বীকার করেন এবং নিজেকে কেবল মুসলমান হিসেবে প্রচার করেন। তিনি নিজেকে একজন নয়া ধর্ম প্রবর্তক হিসেবে জাহির করতে, কিংবা একটা নয়া মজহাব সৃষ্টি করতে কুন্ঠবোধ করতেন। একজন ফকীরের ধর্মে এত গভীর জ্ঞানের দরকার নায়। যেসব মশহুর প্রতীকী ফকীরি প্রতিষ্ঠান আছে, তাদের প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠাতার কোন একটি বৈশিষ্টের জন্যই সে নামে অখ্যাত হয়েছে, যেমন কাদিরীয়া নামাঙ্কিত হয়েছে প্রতিষ্ঠাতা আবদুল কাদিরের নামানুসারে। সৈয়দ আহমদ দাবী করতেন, তিনি মুহম্মদেরই পদাংকের অনুসারী, আর এজন্য তিনি নতুন শাখার জন্ম দেন মহাম্মদি তরিকা অনুসরণ করে। আর তার উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদের জন্য সেসব আচার- নিতি প্রবর্তন করা, যেসব মুহম্মদের সময় প্রচলিত ছিল। এই রকম পরিস্থিতে তার মৃত্যু আন্দোলনটিকে ধ্বংসের মুখে এনে দেয়। আরও দুর্ভাগ্য এই যে, হানাফী আলেমরা ঘোষণা করলেন, ইমামের দ্বারাই জেহাদ চালানো সম্ভব, অতএব সৈয়দ আহমদের মৃত্যু হয়ে থাকলে জেহাদ বন্ধ করতে হবে। এসব বিষয় পাটনার মওলবীদের নিশ্চয়ই চিন্তান্বিত করে থাকবে, কারণ তারাই ছিল সৈয়দ আহমদের একনিষ্ঠ অনুসারী। সৈয়দ আহমদের মুরশিদ হিসেবে আবির্ভাব হওয়ার বহু পূর্বে তারা জনৈক আবদুল হকের মুরীদ ছিলেন। তিনি ছিলেন বেনারসবাসী গোঁড়া ওহাবী। তার প্রথম জীবনে নাম ছিল গোলাম রসূল। কিন্তু ওহাবী মতে দীক্ষা নেওয়ার পর তিনি এই ধর্ম বিগর্হিত নাম বর্জন করে নাম গ্রহণ করেন আব্দুল হোক। তারপর তিনি মক্কায় গমন করেন। সেখানে বিরুদ্ধ মতবাদ পোষণের দরুন তিনি তুর্কী কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিতে পতিত হন। তাকে বন্দী করার আদেশ দেওয়া হয়, কিন্তু গোপনে তিনি নজদে পলায়ন করেন। তখন নজদ ছিল আরবের মদ্ধে ওহাবী অঞ্চল। নজদে কিছুকাল বসবাস করে তিনি বেনারসে প্রত্যাবর্তন করেন। এখানে তিনি নজদী শেখ হিসেবে সুপরিচিত হন এবং মুরিদ করতে আরম্ভ করেন। মওলবী বিলায়েত আলী তার প্রথম দলের মুরীদ।
আরও উল্লেখযোগ্য যে, সৈয়দ আহমদ বিশেষভাবে ছোটখাটো বিভেদগুলি এড়িয়ে চলতেন। তার ধর্মীয় শিক্ষার মোটামুটি সার কথা এই যে, তিনি ছিলেন একান্তভাবে আল্লাহ্নির্ভর, আর দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, তিনিই ইমাম মেহদী- হিজরি তের শতকের একমাত্র নেতা। তার যেসব খলীফা এসব মতবাদ প্রচার করতেন, তাদের মধ্যে বিলায়েত আলী ছিলেন সমধিক প্রসিদ্ধ। তিনি সাধারণে এ মতবাদ কেবল মুখেই প্রচার করতেননা, এর সমর্থনে একখানা পুস্তিকাও রচনা করেছিলেন। এখন সৈয়দ আহমদ যদি সত্যই মৃত হন তাহলে দুনিয়া তাকে ভন্ড আখ্যা দিবে। এজন্য প্রথম থেকেই তিনি সৈয়দ আহমদের মৃত্যুর খবর অস্বীকার করতেন। তার মুরশিদের কয়েকটি বাণী তার স্মরণ হল, আর সেসবের বলে তিনি এসব মিথ্যা বিবেচনা করতেন। সৈয়দ আহমদ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, তিনি বহু জয়লাভ করবেন, আর কাফেররা যতবারই পরাজিত হবে, ততবারই তারা তার মৃত্যু সংবাদ রটনা করবে তার অনুগামীদের হতোদ্যম করতে ও তাদের উৎসাহে ভাটা দিতে। এখন তো সেই অবস্থায় উপস্থিত হয়েছে। মাত্র কয়েকদিন আগে সৈয়দ আহমদ ছিলেন পেশোয়ারের শাসক; এখন গুজব আসছে যে, তিনি মৃত ও তার অনুগামীরা ছত্রভঙ্গ। এসব অবিশ্বাস ও বিশ্বাসের যোগ্য নয়। এ সম্বন্ধে যা কিছু সন্দেহ ছিল সবই অবশ্য দূর হয়ে গেলো কয়েকদিন পরে উত্তর- পশ্চিম থেকে খবর পাওয়ায়, আর তার দ্বারা মওলবীদের প্রথম ধারনা সঠিক হওয়ার বিশ্বাসও ঘনীভূত হয়ে গেলো।
সৈয়দ আহমদ যখন বালাকোটে পরাজিত হন তখন মওলবী কাসিম একদল বাহিনী নিয়ে মুজফফরাবাদ আক্রমন করতে ব্যাস্ত ছিলেন। সৈয়দ আহমদের মৃত্যুতে সেই অভিযান বন্ধ হয়ে যায়। মওলবী কাসিম ফিরে আসেন, যুদ্ধ থেকে পলাতক জ্বিহাদীদের একত্রিত করেন এবং সৈয়দ আহমদের পরিবারদের নিয়ে সিত্তানায় গমন করেন। এই গ্রামের মালিক ছিলেন সৈয়দ আহমদের অন্তরঙ্গ বন্ধু সৈয়দ আকবর। সেখানে মওলবীদের এক আসরে বসে এবং স্থিরীকৃত হয় যে, আপাতত জেহাদ বনায়ের অঞ্চলের তখতাবন্দেই সীমাবদ্ধ থাকবে, কারণ এই গ্রামটিতে সৈয়দ আহমদের বংশ ছিল অত্যন্ত ক্ষমতাশীল। অতঃপর তদন্ত শুরু হয় কীভাবে সৈয়দ আহমদ মৃত্যু মুখে পতিত হন। কোন কোন জিহাদি প্রকাশ করে, তারা তাকে শহীদ হতে স্বচক্ষে দেখেছে। আবার অনেকে দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করলো, তিনি মরেননি। তারা সাক্ষ্য দিল, ভীষণ যুদ্ধের সময় একটা ধূলিমেঘ ইমাম সাহেবকে ঘিরে ফেলে; তারপর আর তাকে জীবিত দেখা যায়নি, তার মৃতদেহও পাওয়া যায়নি। মওলবী কাসিম ছিলেন শেষের দলের। তিনি শীঘ্রই অন্যান্য খলীফার নিকট পত্র পাথালেন। তার মধ্যে তিনি বালাকটের বিপর্যয়ের বিস্তৃত বিবরণ দিলেন, মুজাহিদদের ইমাম সাহেব অদৃশ্য হওয়ার দরুন বর্তমান শোচনীয় অবস্থা জানালেন সাহায্য চেয়ে পাঠালেন আরও মানুষ ও টাকা পয়সার। এ থেকেই পাটনার মৌলবিদের সৈয়দ আহমদের সম্পর্কে বিশ্বাস আরও দৃঢ়ীভূত হল। তারা ভাবলেন তিনি তো জিবন্দসাতেই নিজের অদৃশ্য হওয়ার ভবিষ্যৎ বাণী করেছিলেন। অতএব তারা নতুন উদ্যমে জেহাদ প্রচার করতে লাগলেন। তারা প্রচার করতে লাগলেন যে, আল্লাহ্ ইমাম সাহেবকে লোকচক্ষু থেকে গোপন করে একটা পর্বত গুহায় লুকিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু তার অনুগামীরা যখন একত্রিত হয়ে ধর্মে আন্তরিকতা স্বরূপ ঐক্যভাবে জেহাদ পরিচালনা করবে তখন আবার তিনি উদিত হবেন ও পূর্বের মতো তাদের বিজয়ের পথে চালনা করবেন। এসব প্রচারনা স্রবনেচ্ছু সাধারণের উপর প্রভাব বিস্তার করলো। যে আন্দোলনটা বালাকোটে ধংস হয়ে গেছে বলে মনে হয়েছিল, সেটা আবার নয়া উদ্যমে জেগে উঠলো।
একজন ইউরোপীয়র নিকট এটা নিশ্চয়ই অবিশ্বাস হবে যে, মাত্র এরকম উক্তি সহজে বিশ্বাস করা যাবে এবং সেটাকে জেহাদের উদ্দেশে্য কাজেও লাগানো যাবে। সে স্বভাবতই ধারনা করবে যে, এরকম আজগুবি ও অবিশ্বাস কাহিনী শোনার আগে লোক নিশ্চয়ই সম্ভাব্য বলিষ্ঠ প্রমাণ চাইবে। আর সাধারন বুদ্ধিসম্পন্ন কোন মানুষকে এরকম মায়াকাহিনি বিশ্বাস করান নিশ্চয়ই অসম্ভব, কোন পরিমাণ সাক্ষেই তা সম্ভব নয়। কিন্তু মুসলমানের নিকট এর কিছুই অবিশ্বাস নয়। তার সম্প্রদায়ের ধর্মীয় পুরাকাহিনীর সঙ্গে এর দস্তুর মতো সংগতি আছে এবং প্রথম শুনেই সম্ভব ছাড়া আর কিছু মনে হবে না। এজন্য সামান্য মাত্র সাক্ষেই সে বিশ্বাস করে বসবে। আর এরকম ঘটনা তো পূর্বেও ঘটেছিল। একথা সকলেরই জানা যে, হযরত ইউনুস কিছুকাল অদৃশ্য হয়েছিলেন এবং একটা বিরাট মাছের পেটে লুক্কায়িত ছিলেন। হযরত মুসাও অদৃশ্য হয়েছিলেন, যখন তিনি সিনাই পর্বতে উঠে ‘তউরাত’ গ্রহণ করেছিলেন। মহান নেতা জুলকারনাইন ইয়াজুজ ও মাজুজকে বন্দী করে তারা তাদের দ্বারা পৃথিবী ধংস বন্ধ করেছিলেন তিনিও প্রায় একই অবস্থায় অদৃশ্য হয়ে গেছিলেন তাদের ধর্মহীন অনুগামীদের শাস্তিদানের উদ্দেশে্য এবং পুনরায় তাদের আবির্ভূত হতে অনুমতি দিয়েছিলেন যখন তারা অনুতাপ করেছিলেন ও স্ব স্ব ধর্মমতে নিষ্ঠাবান হয়েছিলেন। হযরত ঈসাও মরনের হলাহল পার করেননি। এখনও তিনি আসমানে জীবিত আছেন এবং পুনরায় খ্রিস্ট শত্রুর সাথে যুদ্ধ করতে ধরাধামে উদিত হবেন। ভারতীয় মুসলমানরা পরিস্কারভাবেই ধর্মভ্রষ্ট হয়ে গেছে। অতএব এটা এমন কিছু অযৌক্তিক ধারনা নয় যে, মধ্যবর্তী ইমাম সাহেব সমভাবেই অদৃশ্য হয়ে গেছেন।
সৈয়দ আহমদের ক্রমাগত অনুপস্থিতে একজন সর্দার নির্বাচন করা অপরিহার্য হয়ে পরে জেহাদ পরিচালনা করার জন্য। এই নির্বাচনের ভার ছিল ভারতীয় খলীফাদের উপর। তারা দলে দলে দিল্লীতে একত্রিত হলেন ও মওলবী নাসিরুদ্দিনকে নির্বাচন করেন। আরও ঠিক করা হল যে, তিনি টংক ও সিন্ধুর মধ্য দিয়ে অভিযান চালিয়ে বনায়েরের তখতাবন্দে অবস্থিত মুজাহিদ দলে যোগদান করবেন।
নাসিরুদ্দিন মাত্র কয়েকজন অনুগামীসহ দিল্লী ত্যাগ করেন। টংকে বহু নও মুজাহিদ তার সঙ্গে যোগ দেয় এবং তিনি বহু অস্ত্র সস্ত্র ও টাকা পয়সা সাহায্য পেলেন। সেখান থেকে তিনি সিন্ধুর শিকারপুরে গমন করেন এবং প্রতিজ্ঞা করেন যে, শিখদের সঙ্গে মোকাবিলা করার উপযুক্ত বাহিনী সংগ্রহ না হওয়া পর্যন্ত তিনি নড়বেননা। ১৮৩৩ সালে সৈয়দ আহমদের পরিবারবর্গ এবং তখতাবন্দে পলাতক তার বাকি সৈন্যরা নাসিরুদ্দিনের সঙ্গে যোগ দিল। মুজাহিদরা সিন্ধুতে প্রধান বাহিনীর সঙ্গে থেকে গেলো, কেবল সৈয়দ আহমদের পরিবার টংকে ফিরে গেল। সিন্ধুর আমীররা ছিলেন ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী গোঁড়া এবং তারা অমুসলমান শাসকদের উপর খড়গহস্ত ছিলেন। তারা আমাদের দূতদের ঘৃণা করতেন এবং তাদের সঙ্গে অপমানকর ব্যাবহার করতেন। তারা শিখদের ক্রমবর্ধমান শক্তিকে ভীতির চোখে দেখতেন, আর রণজিৎ সিংহ ছিল তাদের ও ওহাবীদের প্রধান শত্রু। আর এটাও ছিল সর্বজনবিধিত যে, রণজিৎ সিন্ধু আক্রমনের শুধু সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। এজন্য আমীররা সম্ভবতঃ ওহাবী নেতাদের সাহায্য চেয়ে থাকবেন অধিকৃত অঞ্চল রক্ষা করতে। কারণ যাই হোক না কেন, নাসিরুদ্দিন শিকারপুরেই অবস্থান করতে লাগলেন এবং পাহাড়িয়া অঞ্চল থেকে জেহাদ চালানোর ইচ্ছা আপাতত ত্যাগ করলেন। ক্রমে ক্রমে তার বাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধি হতে লাগলো। সারা বাংলাদেশ থেকে অজস্র নয়া মুজাহিদ ও টাকা পয়সা আসতে লাগলো। তবু তিনি নিষ্ক্রিয় বসে থাক্লেন এবং হাজারার বিরুদ্ধে একটা উল্লখের অযোগ্য অভিযান ছাড়া আর কখনও শিখদের বিরুদ্ধে জেহাদ করেননি। কিন্তু উত্তেজনার সময় ঘনীভূত হতে লাগলো। লর্ড অকল্যান্ড যখন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলেন শাহ্ সুজাকে কাবুলের লোকদের উপর জোড় করে বাদশাহ করতে, তখন দোস্ত মুহম্মদ ইংরেজদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করলেন ও ওহাবীদের আমন্ত্রণ করলেন এই জেহাদে যোগ দিতে। নাসিরুদ্দিন দোস্ত মুহম্মদকে সাহায্য করতে রাজি হলেন, কিন্তু অনেক মওলবী তার বিরুদ্ধে গেলেন এবং নিজেদের অনুচর নিয়ে দেশে ফিরে গেলেন। প্রায় এক হাজার লোক নাসিরুদ্দিনের সঙ্গে থাকল। তাদের নিয়েই তিনি কাবুল যাত্রা করলেন দাদুরের নিকট গেলে তিনশো বাছা বাছা যোদ্ধা পাঠালেন আমীরকে সাহায্য করতে। তাদের পাঠানো হল গজনীর রক্ষা ব্যাবস্থায় সাহায্য করতে। কিন্তু ইংরেজ বাহিনী কিল্লাহটি আক্রমন ও দখল করার সময় তাদের সকলকেই ধংস করে দেয়। তারপর কাবুল শীঘ্রই ইংরেজদের হস্তাগত হল, আর হতোদ্যম ওহাবীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে হিন্দুস্থান ও বাংলাদেশে নিজের নিজের বাড়িতে ফিরে গেলো।
সিন্ধু হতে ওহাবীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলে গোলাম কাসিম পাহাড়িয়া অঞ্চলে ফিরে গেলেন ও সৈয়দ আহমদের খলীফা হিসেবে প্রচারকার্য চালাতে লাগলেন। তিনি প্রধানত বাস করতেন কাগানের কাওয়াই নামক স্থানে। কাগানের আমীর জামীন শাহ্ ও নওবত শাহ্ তার মুরীদ হন। কাবুল থেকে ওহাবীরা আপন আপন গৃহে ফিরে যাওয়ার কিছুকাল পরেই গোলাম কাসিম নেতাদের নিকট সংবাদ পাঠান, ইমাম পুনরায় উদিত হয়েছেন এবং ইচ্ছা জানিয়েছেন যে, পুনরায় শিষ্যদের সঙ্গে তিনি মিলিত হয়ে শিখদের বিরুদ্ধে জেহাদ চালনা করবেন। সৈয়দ আহমদের নামাংকিত হয়ে বিভিন্ন খলীফার নিকট চিঠি পাঠানো হল, তাদের আহব্বান জানানো হল অনুগামীদের নিয়ে মুরশিদের সঙ্গে যোগদান করতে। পাটনার খলিফারা শীঘ্রই এই আহব্বানে সাড়া দিলেন এবং বৃটিশ ভারত থেকে পুনরায় দলে দলে কাফেলা পাহাড়িয়া অঞ্চলে আসতে লাগলো। ইনায়েত আলী শীঘ্রই উপস্থিত হলেন ও নেতৃত্বভার গ্রহণ করলেন এবং তার পরিচালনায় জেহাদীরা শিখদের আক্রমন করলো ও বালাকোট থেকে বিতাড়িত করে দিল।
বালাকোটের পার্শ্ববর্তী গ্রাম কাগান। নজফ খাঁ সেখানকার শাসনকর্তা ও ওহাবীদের বন্ধু। শিখরা তার এলাকা হস্তগত করে নেওয়ায় এখন তিনি ইনায়েত আলীর সাহায্য প্রার্থনা করলেন। যেসব মওলবী ইনায়েত আলীর সঙ্গে যোগদান করেছিলেন, তাদের মধ্যে ছিলেন হায়দরাবাদের মওলবী জয়নুল আবেদিন। বিলায়েত আলী যখন প্রথম দক্ষিণাত্য সফর করেন তখন তার সঙ্গে জয়নুল আবেদীনের পরিচয় হয়। জয়নুল আবেদীন তার প্রচারকার্যে মুগ্ধ হন এবং গোঁড়া ধর্মান্ধ হয়ে উঠেন। তিনি ছিলেন বলিষ্ঠ মানসের আবেগপ্রবণ মানুষ এবং সর্বশক্তি দিয়ে এই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। তার উৎসাহ লক্ষ করে বিলায়েত আলী তাকে পূর্ব বাংলার জেলাগুলিতে প্রচারকার্যে পাঠিয়ে দিলেন। সিলেট ও ঢাকা জেলায় তার শিষ্যসংখার আধিক্য থেকেই প্রচারক হিসেবে তার সাফল্যের প্রমাণ মিলে। পাহাড়িয়া অঞ্চলে ইমাম সাহেবের সঙ্গে যোগদানের আদেশ পেয়েই তিনি তাড়াতাড়ি রওনা হয়ে গেলেন এবং পিছনে চলল তার এক হাজার অনুগামী, নজর এড়াবার জন্য তারা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে যায়। সেখানে উপস্থিত হলে একদল জিহাদি দিয়ে তাকে পাঠানো হল শিখদের বিরুদ্ধে নজফ খাঁ কে সাহায্য করতে। কিন্তু পরাজিত হয়ে তিনি বালাকোটে ফিরে আসেন। অতঃপর তিনি সেনা নায়কের কাজ ত্যাগ করেন এবং যুদ্ধ বিগ্রহ থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
এ পর্যন্ত ইমাম সাহেব স্বয়ং আবির্ভূত হয়ে জেহাদীবাহিনী চালানোর ভার গ্রহণ করেননি। তার সম্বন্ধে বলা হতো যে, তিনি কাওয়াইএর নিকট কোন একটা পাহাড়ের গুহায় বাস করেন। কিন্তু পাহাড়টিকে কঠিন পাহারায় ঘিরে রাখা হতো এবং কোন জেহাদীকে তার ধারে কাছে যেতে দেয়া হতোনা। কিন্তু জয়নুল আবেদীন একবার মুরশিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলেন। তখন সব ভয় ও বাধা তুচ্ছ করে গুহায় তার মুরশিদের অবস্থান করার কথা, সেখানে জোর করে প্রবেশ করলেন এবং তিনি সেখানে দেখলেন, খড়ে তৈরি তিনটি মাত্র মূর্তি সেখানে বিদ্যমান। একটি সৈয়দ আহমদের ও দুটি তার খাদিমদের।
ধর্মীয় উৎসাহে তীব্র আঘাত লাগলো। তিনি এই অভিশপ্ত স্থান দ্রুতবেগে ত্যাগ করলেন এবং অনুগামীদের এই ভয় দেখিয়ে জেহাদ করতে নিষেধ করলেন যে, মওলবী কাসিম ও মওলবী কাদিরের মতো মূর্তি পূজকদের সঙ্গে থেকে জেহাদ করা হল কাফেরের কাজ। এই সময় তিনি কলকাতায় জনৈক বন্ধুর নিকট নিম্নলিখিত যে পত্রখানি লিখেন, তাতে লোককে সৈয়দ আহমদের অস্তিত্ব সম্বন্ধে যে ধোঁকাবাজি করা হয়েছিল, তার পরিচয় পাওয়া যায়ঃ
‘আসসালামু- আলাইকুম- আল্লাহ্র শান্তি ও আশিস আপনার উপর বর্ষিত হোক। অধীনের আরজ এই যে, বিলায়েত আলীর শিক্ষায়, ঈমানে ও ইসলামে কোন রকম বেদাত আমদানী করা এ অধীন অবিমিশ্র পাপ হিসেবেই বিবেচনা করে এবং সেসব বর্জন করা ধর্মীয় নির্দেশ হিসেবেই গণ্য করে। এই ধারনার বশবর্তী হয়ে আমরা পীর মওলবী বিলায়েত আলীর সততায় নির্ভর করতুম, আর এজন্য যুক্তিবহির্ভূত একটা বিষয়ে বিশ্বাস স্থাপন করে আমি একটা অতি পরিচিত স্থানে যায়। সেখানে যেয়ে ইমাম হুমামের উপযুক্ত কোন কিছুরই অস্তিত্ব সেখানে নেই। অন্যপক্ষে কাসিম কাজ্জার দ্বারা প্রবঞ্চিত করিমা আলী আমাদের শিবিরে আসে মোল্লা কাদিরের দ্বারা প্রেরিত হয়ে এবং বলেন, আমেরুল মুমেনিন শেখ ওয়ালী মুহাম্মদকে এতদূর মিথ্যুক বলেছেন যে, সে বলে বেড়াই, যদি রণজিৎ সিংহ কবর থেকে উঠে আসে ও অনুতাপ করে, তাহলে ইমাম সাহেব তার রাজতখতে বসাবেন এবং শূন্যে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াবেন, ঠিক যেমন ফিরতেন বাদশাহ সোলায়মান। মোল্লা কাদির ঈদ- উজ- জোহার পূর্বে বলেছিলেন পয়গম্বর সাহেব ও সমস্ত আলী ইমাম সাহেবের সঙ্গে বসেছিলেন ও তাকে বলেছিলেন, ওঠ! কাফেরবিহীন যে বালাকোটে এসে গেলো’। তখন ইমাম বললেন, “আল্লহর হুকুম ছাড়া আমি উঠতে পারিনে”। শেষে পয়গম্বর সাহেব নিজেই তাকে উঠতে বললেন, কিন্তু তিনি জওয়াব দিলেন, “বান্দার সে ক্ষমতা নেই”।
“মোল্লা কাদির সৈয়দ আহমদের একটি মূর্তি তৈরি করেছিলেন এবং সেটি কোনও মানুষকে দেখাবার আগে সকলের নিকট থেকে এই প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলেন যে, কেউ তার হাতে হাত মিলাতে কিংবা তার সঙ্গে কথা বলতে চেষ্টা করবেনা, কারণ এরকম চেষ্টা করলেই ইমাম সাহেব পুনরায় চৌদ্দ বছরের জন্য অদৃশ্য হয়ে যাবেন। সব মানুষই দারুণ অভিভুত হয়ে দূর থেকে প্রাণহীন মূর্তিটাকে দর্শন করতো এবং সালাম করতো। কিন্তু জওয়াব মিলত না। এদিকে লোকেরা তার হস্তমর্দন করতে উৎসুক হয়ে উঠত। কিছুদিন গত হওয়ার পর লোকেরা একটা ছলনায় সন্দেহ করতে লাগলো এবং ইমামের হস্তধারণ করতে জিদ করতে লাগলো। কিন্তু মোল্লা কাদের তাদের সন্দেহ দূর করতে চেষ্টা করলেন এবং বললেন, কেউ যদি আগে খবর না দিয়ে ইমাম সাহেবের হস্তধারণ করতে চেষ্টা করে, তাহলে মিয়া আব্দুল্লাহ সাহেব তাকে পিস্তল ছুঁড়বে। কিছুকাল পরে মোল্লা দেখলেন, আমি মোটেই ভিত নই, আর লোকেরা ইমাম সাহেবের হস্তধারণ না করে ক্ষান্ত হবে না। তখন তিনি বলতে লাগলেন যে, ইমাম হুমাম এই আদেশ দিয়েছেনঃ লোকেরা আমায় দেখেই সন্তুষ্ট নয়, তারা আমার হস্তমর্দন করতে চায় আমার সঙ্গে কথাও বলতে চায়। তাদের যে অনুগ্রহ দেখানো হয়েছে, তা পেয়ে তারা ধন্য নয়। এজন্য ন্যায়বান আল্লাহ্ তাদের উপর অসন্তুষ্ট হয়েছেন, আর আমি যতদিন মুজাহিদ বাহিনীর নেতা হিসেবে যোগদান না করছি, ততদিন আমি আর তাদের সামনে উপস্থিত হচ্ছিনা। এরপর মূর্তিটাকে আর দেখা যায়নি। আরও কিছুদিন পর মোল্লা তোরাব এবং কাবুল ও কান্দাহার থেকে কয়েকজন সম্ভ্রান্ত ব্যাক্তি উপস্থিত হন এবং এই প্রতারণা প্রকাশ করে দেন। তখন বহু অনুনয় বিনয়ের পর মোল্লা কাদিরকে রাজী করান হল মূর্তিটাকে একবার সকলকে দেখাতে। তারা মূর্তিটাকে পরীক্ষা করে দেখলে, সেটা ছাগলের চামড়ায় ঘাসে ভর্তি এবং কয়েকখানা কাঠ, চুল প্রভৃতি দিয়ে মানুষের অবয়ব তৈরি করা হয়েছে। তখন এই বান্দা কাসিম কাজ্জাবকে এর কারণ জানাতে বলেন। সে বলে, এটা ঠিক বটে, তবে ইমাম হুমাম একটা কেরামত দেখিয়েছেন, আর সেজন্যই এসব অবিশ্বাসী লোকদের সম্মুখে তৈরি মূর্তিতে আবির্ভূত হয়ছেন। এরপর মোল্লা কাদির এরকম বলতে থাকেনঃ হুজুর এখন আমার উপর নারাজ হয়েছেন। এজন্য আমার বাড়ি আশা ছেড়ে দিয়েছেন কিন্তু মিয়া চিশতী সাহেব এখনও মাঝে মাঝে আসেন। মওলবী খোদাবখশ এর রাখাল ছেলেকে ধরে প্রহার করেন ও তারই জুতাজোড়া নিয়ে ফরাক্কাবাদ যান। এইসব হল লোকের মূর্তি পূজা ও কুফুরীর সামান্য নমুনা মাত্র। আমি প্রথমে মূর্তিটাকে যেমন দেখেছি, তারই সঠিক বর্ণনা আপনাকে জানালুম। এখন এসব লোকের মিথ্যা ও ভুল স্পষ্ট দিবালোকের মতো পরস্কার হয়ে গেছে। আর আমি তাদের সঙ্গ ত্যাগ করে পাপ থেকে বেঁচেছি। এই সঙ্গে আমি বদি- উজ- জামান ও মওলবী রজব আলীকে সালাম জানাচ্ছি”।
জয়নুল আবেদীন কলিকাতা ফিরে গেছেন এবং ওহাবী মতবাদ একেবারে ত্যাগ করেছেন। তার অনুগামীরাও তার পথ অনুসরণ করলেন। আর তার দরুন তৃতীয় বার পরিস্থিতি এমন হল, যেন ওহাবী আন্দলন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে। কিন্তু পাটনার মওলবীদের অদ্ধ্যবসায় বলে আবার সব বাধা দূরীভুত হল এবং অল্প দ্বীনের মধ্যেই সম্প্রদায়টা পুনরায় উজ্জীবিত হোএ উত্তর- পশ্চিম অঞ্চলে এতোখানি শক্তিশালী হয়েছিল, যেমনটি ছিল ঠিক সৈয়দ আহমদেরই জীবনকালে।