ওহাবী আন্দোলন
আবদুল মওদুদ
প্রথম প্রবন্ধ
[১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে সৈয়দ আহমেদের মৃত্যুকাল পর্যন্ত]
কিছুকাল ধরে বাংলার মুসলমানরা সাধারনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। ‘পাইওনিয়ার’ পত্রিকার প্রবন্ধগুলো ‘ইংলিশম্যান’ নামক ইংরেজি পত্রিকাই ও ‘দূরবীন’ নামক ফারসি পত্রিকাই পুনরমোদিত হচ্ছে। ‘দূরবীন’ ই মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার্থে কলিকাতাই প্রকাশিত একমাত্র পত্রিকা। আবার ‘দূরবীনে’ জওয়াব হিসেবে প্রকাশিত প্রবন্ধগুলো ‘পাইওনিয়ার’ ও ‘ইংলিশম্যান’ পত্রিকার মারফত ইউরোপীয় সাধারনের দৃষ্টিগোচরে আসছে।
কিন্তু একদিকে ‘ইংলিশম্যান’ ও মুসলমান পত্রিকাগুলো সরকারকে যেমন চাপ দিচ্ছে মুসলমানদের বর্তমান অবনত অবস্থার উন্নয়নের জন্য ও দেশের প্রতিষ্ঠিত রাজ সরকারে তাদের ন্যায়সঙ্গত অংশ দেওয়ার জন্যে, তেমনিই অন্যদিকে হিন্দু সম্প্রদায়ও এগিয়ে আসছে সাবধান করে দেয়ার জন্য যে, মুসলমানদের মধ্যে এক শ্রেণীর সূচিন্নিত বিদ্রোহী লোক আছে; আর তারা সমগ্র মুসলমান সম্প্রদায়ের কতখানি সহানুভূতি ভোগ করে আজও তা অজানা রয়ে গেছে। ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ পত্রিকাই [দুসরা আগস্ট, ১৮৭০] এই রকম মন্তব্য প্রকাশিত হয়েছে;
“ফারাজী ও ওহাবী মজহাবগুলো নিজেরা বড় রকমের আন্দোলন গড়ে তোলার মত শক্তিশালী না হলেও [আমরা অবশ্য তাও বিশ্বাস করিনে] সদাপ্রস্তুত মূলকেন্দ্র হিসেবে ভয়ংকর প্রতিষ্ঠান, কারণ সেগুলোকে কেন্দ্র করে যতো সব অসন্তোষ, ঘৃণা ও উচ্চাশা পুঞ্জীভূত হয়। আর অনুকূল অবস্থায় সেই সবকে এই বিশাল ও বিভিন্ন সম্প্রদায়সংকুল সম্রাজ্জের হরেক রকম পরস্পরবিরোধী মতাবলম্বীদের থেকে পৃথক করা শক্ত হয়ে পরে। বর্তমান সরকার যতই পারদর্শী ও শুভাকাঙ্ক্ষী হোক, ততোটা বুদ্ধিমান নয় বলেই এসবের সংখ্যা খুব বেড়ে গেছে। আরও দুর্ভাগ্য এই যে, নানারকম নীরব চেষ্টাই তারা বিদেশিকে এদেশে ডেকে আনতে পারে, কিংবা তাদের আসার পথ সুগম করে দিতে পারে। এ বিষয়ে আমাদের উদ্বেগতা হয়ত বাড়াবাড়ি হতে পারে, কিন্তু আমরা কেমন করে ভুলবো যে, বাংলাদেশে উদ্ভুত হয়েও ফারাজী মজহাবের নাম শোনা যাচ্ছে এমন সব দেশীয় রাজ্যের মধ্যেও, যেখানে তাদের দেখা পাওয়া মোটেও চিন্তা করা যায়না; অথচ সেই সব রাজ্যেও তারা নিজেদের আওতায় ও প্রভাবে পতিত বাশিন্দাদের নিজেদের মত দীক্ষিত করে নিচ্ছে। আর ওহাবীরা তো ছড়িয়ে আছে সাড়া ভারতময়; আমাদের উত্তর- পশ্চিম সীমান্তে ও হায়দ্রাবাদের মতো শক্তিশালী ও সদা উত্তপ্ত মুসলমান রাজ্যেও তাদের সংখ্যা খুবই বেশি। অথচ আমরা আজও জানিনে, তাদের সংখ্যা কত, অবস্থাই বা কি, সম্ভাবনা কি, প্রভাবই বা কতোখানি এবং কারাই বা তাদের নেতা। বাংলাদেশে বিস্তর ফারাজী পল্লী আছে; কিন্তু তাদের সংখ্যা, সংগঠন, রাজনীতি ও ধর্ম আমরা ও সরকারের আজও তিমিরে রয়ে গেছি। এতে দারুণ শৈথল্যই প্রকাশ পায়। ওহাবীরা খুবই বিপিদজনক সম্প্রদায় এবং সারা ইসলামিস্থানে বিস্তৃত, অথচ ফারাজী হল স্থানীয় সম্প্রদায়। ওহাবী আন্দলন জন্ম নিয়েছিল ইসলামের উৎস মূল আরব দেশে এবং বর্তমানে সমগ্র মুসলিম জগতে ছড়িয়ে পড়েছে। ওহাবী প্রচার করা খ্রিস্টান মিসনারির মতোই অসংখ্য ও তেমনই ধর্মনিষ্ঠ, আবার তাদের শিক্ষাও জেসুটদের মতোই বিধর্মী রাজশক্তির বিরুদ্ধে শত্রুভাবাপন্ন। অতএব জেসুটদের মতোই ওহাবীরা বিপজ্জনক হয়ে উঠতে সক্ষম। বিরুদ্ধবাদী হলেও ওহাবীরা গোঁড়া মতবাদিদের চোখে কোঠর সংযমসীলতার জন্যে স্রদ্ধার পাত্র এবং ওহাবীদের উগ্র ধরমান্তারন দরুন নিজেরা ধর্মীয় সব অনুশাসন পালনে অক্ষমতা- হেতু কিছুটা ধর্মীয় শিথিলতার জন্যেও যেন ওহাবীদের সম্মুখে লজ্জিত। জেসুটদের মতোই ওহাবীদের আছে নিজস্ব সংগঠন; তাদের প্রচারকদিগকেও রীতিমত টাকা পয়সা দেওয়া হয় এবং এই সব টাকা পয়সা আসে সংসারী লোকদের কাছ থেকে আদায়কৃত সাধারণ মূলধন থেকে। ওহাবী সম্প্রদায়ের লোকেরা একটা সুনির্দিষ্ট পথ ঠিক করে নিয়ে সাধারণ জনগনের সাথে মিশে নীরবে কাজ করে যায়। কেউ কেউ দৈনন্দিন বেচা কেনার কাজ করে, কেউবা কখন কাফেরদের আদালতে কেরানীগিরির কাজও করে। কিন্তু কখনো তারা নিজেদের ধর্মীয় বৈশিষ্ট্য কিংবা রাজনৈতিক লক্ষ্য ভুলে না। তারা অলক্ষে আরও সুচারুভাবে এসব উদ্দেশে কাজ করে যায়। টাকা পয়সার সাহায্য দিয়ে নতুন মতাবলম্বী সংগ্রহ করে এবং দূরের ও নিকটের সহকর্মীদের সাথে নিবিড় সংযোগ রেখে ভারত কিংবা আরবেই হোক জিহাদ পরিচালনা করে। এই আন্দোলনটা নিঃসন্দেহে সবদিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ; কারণ তার একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে, পৃথিবীতে ইসলামের রাজনৈতিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত করা আর এই উদ্দেশে ইসলামের অনুসারীদের আদিম ইসলামে ফিরিয়ে নিয়ে যেয়ে ধর্মীয় পুনরুজ্জীবিত করা। আমরা হইত এইরকম কোন কর্মসূচীর সম্ভাবনা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে পারি। কিন্তু আমাদের কখনয় বিস্মিত হওয়া উচিত নয় ইতিহাসের এই প্রধান ও দুঃখজনক শিক্ষা যে, কোনও বিস্তৃত ও বড় বরবরতার হাতে সভ্যতা চিরস্থায়ী হতে পারেনা। আর তার চেয়ে বেশি না হলেও ধর্মান্ধতা হচ্ছে সমান বিপজ্জনক। আমাদের আরও স্মরণ রাখা উচিত যে, মুসলমান ধর্মের এই দুটিই ধ্বংসাত্মক প্রবনতা আছে। বর্তমানে জগতের ভবিষ্যৎ প্রগতি বিষয়ে যদিও আমরা নিরাশ না হতে পারি, তাহলেও আমাদের এই বিশ্বাস থাকা উচিত যে, ওহাবী আন্দোলনকে যদি আমাদের বুকের উপর শক্তি সঞ্চয় করতে দেয়া হয়, তাহলে উপযুক্ত সময়ে সীমান্তের ও বাহিরের বিরুদ্ধ শক্তিগুলির সঙ্গে হাত মিলিয়ে সেটা রাষ্ট্রের সমূহ বিপদ ঘটাতে পারে। অতএব সরকারের উচিত কাজ হচ্ছে ফারাজী ও ওহাবীদের সম্বন্ধে এবং আরও যেসব সম্প্রদায় ভারতের ভিতরে ও বাহিরে রাজনৈতিক উচ্চাশা পোষণ করে, সে সবের তন্নতন্নভাবে তদন্ত করা। কারণ মুসলমানদের মধ্যে ধর্মের বন্ধনেই রাজনৈতিক সম্বন্ধ গজায়।। অথচ অন্যান্য জাতির মধ্যে গোত্রীয় সম্বন্ধ হল বড় কথা। ফারাজী ও ওহাবীরা বাকি মুসলমানদের কতোখানি সহানুভূতি ভোগ করে, সঠিকভাবে বলা শক্ত। হইত তাদের কতগুলি ধর্মীয় নীতি গোঁড়া মুসলমানদের খুবই অপ্রীতিকর, কিন্তু তাদের সকলের মধ্যে রয়েছে একই ধর্ম বন্ধন। তাছাড়া এই সম্প্রদায় দুটির রাজনৈতিক লক্ষণ তো সকল মুসলমানদের কাছে পরম আদরনীয়। আর মানুষ হিসেবে তারা সদ্য রাজ্যহারা হয়ে শোকান্নিত এবং একটা আক্রমণাত্মক ধর্মের অনুসারী হয়ে তারা খ্রিস্টান, হিন্দু, ইহুদী, বৌদ্ধ কাফেরদের বিরুদ্ধে জেহাদ করা অবশ্য কর্তব্য হিসেবে গণ্য করে।“ এখানে যেসব প্রশ্ন তোলা হয়েছে, বর্তমান প্রবন্ধে সেসবের আংশিক জওয়াব দেয়ার চেষ্টা করা হবে। তবে ওহাবী ও গোঁড়া সুন্নিদের মাঝে যেসব বিষয়ে পার্থক্য আছে, সে সবের খুঁটিনাটি আলোচনা যথাসম্ভব বাদ দেয়া যাবে।
ভারতীও মুসলমানদের দুটি সম্প্রদায়ে ভাগ করা যায়ঃ সুন্নী ও শিয়া। সুন্নীরা মুসলমানদের ধর্মে বিশ্বাস করে সমস্ত আবেগ ও অনুভূতি দিয়ে আর শিয়ারা একই ধর্মে বিশ্বাস করে জ্ঞানের তথা যুক্তির ভিত্তি মূলে।
শিয়ারা আনন্দ পায় অনুষ্ঠান, ধর্মীয় শোভাযাত্রা প্রভৃতি ধর্মীয় বাহ্যিক আড়ম্বর প্রদর্শনে। সুন্নীরা এসব আড়ম্বর অনুষ্ঠানকে তাদের ধর্মের বিপরীত হিসেবেই মনে করে এবং ইসলামের আদি সহজ সরল পথেই চলার চেষ্টা করে। শিয়ারা আরও গভীর বিশ্বাস করে যে, তীর্থ পথে যাওয়াই ও মৃত ওলী- দরবেশদের মাজার জিয়ারতে অশেষ পুণ্যলাভ হয়, অথচ সুন্নীরা কম বিশ্বাস করে যে, একমাত্র তীর্থযাত্রাই কোনও পুণ্য সঞ্চয় হয়, কিংবা ওলী- দরবেশদের মাজারে এভাবে ধন্না দিয়ে কোন কিছু পার্থিব সুফল পাওয়া যায়। এই দুটি সম্প্রদায়ের আবার প্রত্যেকটি বহু মজহাবে বিভক্ত এবং প্রত্যেক মজহাবের আবার নীতিগত ও আচার আনুষ্ঠানিক বৈশিষ্ট্য আছে। তবে সমস্ত শিয়া সম্প্রদায় সুন্নী সম্প্রদায়ের প্রতিটি মজহাবের উপর বিদ্বেষভাবাপন্ন, আবার সুন্নীরাও শিয়া সম্প্রদায়ের সব মজহাবকেই একই বিদ্বেষ দৃষ্টিতে দেখে থাকে। এরকম ধর্মীয় বিশ্বাসের পার্থক্য হেতু বিদ্বেষ ভাবটা আরও তীব্র হয়ে উঠে তাদের পয়গম্বরের জামাতা আলীর সঙ্গে অন্য খলীফাদের রাজনৈতিক বিরোধ স্মৃতিতে উদয় হলেই। আর তার অভিব্যাক্তি হয় প্রায়ই প্রকাশ্য ঝগড়া- ফ্যাসাদ, অত্যাচার- উৎপীড়নে এবং দুই সম্প্রদ্যায়ের বাহাসে বক্তৃতাই। ধর্মীয় সব উপলক্ষেই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্বেষটা আরও বেশি প্রকাশ হয়ে পরে। পাটনা, মুর্শিদাবাদ, ঢাকা ও আরও যেসব জায়গায় শিয়া সংখাবহুল, সেই সবখানে মুহররম মাসের প্রথম দশ দিন শিয়ারা খুবই জাকজমকের সঙ্গে মহররম উৎসব পালন করে। আর তখন শান্তি ভঙ্গ যাতে না হয়, তার জন্যে বড় ব্যস্ত থাকতে হয় সরকারকে।
মুসলমান ধর্মের মূল ভিত্তি হচ্ছে, কুরআন, মুহম্মাদের বাণী ইত্যাদি অর্থাৎ সুন্নী মুসলমান ধর্মতাত্ত্বিকদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত ইজমা এবং কুরআন ও হাদীস থেকে গৃহীত মীমাংসা বা কিয়াস।
মুহাম্মাদের জীবদ্দশায় কুরআন ছিল একমাত্র প্রামাণ্য গ্রন্থ। যার নির্দেসানুসারে সব রকম সমস্যার সমাধান হত এবং প্রত্যেক নয়া সমস্যার জন্য পূর্বে বিধান না থাকলে নয়া ওহী নাযিল হত। আল্লাহ্র বাণী একমাত্র মুহাম্মাদের কাছে পৌঁছাত, অতএব তারই গোচরীভূত বিষয়সমূহের মধ্যেই ওহীর দ্বারা মীমাংসা হত। এই অসুবিধাটা প্রথম লক্ষ্য করা গেল, যখন নিকটবর্তী গোত্রসমুহে নতুন ধর্ম প্রচারের জন্য দূত পাঠানো হতে লাগল তারাও একে একে নতুন ধর্ম গ্রহণ করতে লাগল। মুহাম্মাদের মৃত্যুর পর তার অনুসারীরা যখন বিভিন্ন দেশে শাসন বিস্তার করতে লাগল তখন তাদের রিতি- নীতি আরবদের থেকে পার্থক্য হেতু তাদের সঙ্গে ব্যাবহার সম্বন্ধে কুরআনের বিধান সমূহের ন্যূনতা আরও বেশি করেই দেখা দিল। আর এই জন্য পয়গম্বরের বাণী ও কাজ কর্ম এসব সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় দিশা হয়ে উঠল।
পয়গম্বরের বাণী ও কাজের কর্ম দ্বিতীয় শতকের পূর্বে শুরু হইনি। আর এই কর্ম চলেছিল তার উত্তরাধিকারীদের মধ্যে লড়াই চলা কালে। সংগ্রহকারীরা ছিলেন নিঃসন্দেহে সৎ ও ধর্মনিষ্ঠ ব্যক্তি এবং সুন্নার বিশুদ্ধতা নিরূপণ কালে তারা কথকের চরিত্র দ্বারা ও নিজের ঐশী প্রেরণা দ্বারা চালিত হতেন। কোন হাদিসের সত্যাসত্য নিরুপনের জন্য গোপন সাক্ষ্য কখনো গৃহীত হতোনা। সমকালীন লোকদের এই ধরনের সাক্ষ্য গ্রহণও অধর্মের কাজ না হলেও প্রগলভতা হিসেবে বিবেচিত হত। ধর্মভীরু লোকদের কথিত প্রত্যেক হাদিসই খাটি হিসেবে গৃহীত হত, তা যতই অসম্ভব হোক না কেন। আবার যাদের ধর্মীয় বিশ্বাস দুর্বল, তাদের কথিত প্রত্যেক হাদিসই পরিত্যাক্ত হত। কিন্তু এইটা যাচাই করে দেখা হতনা হাদিসটির কতটুকু মুহাম্মাদের নিজস্ব আর কতটুকু বা কথিত অসাবধানকৃত সংযোগ। কিংবা এটাও অনুসন্ধান করে দেখা হতোনা যে, প্রত্যেক হাদিসের উৎপত্তির সময় ও পরবর্তীকালের বর্ণনাকারীদের সময়ের মধ্যে অবস্থার কি রয়েছে।
এরকম মুখে মুখে প্রচারিত পুঞ্জিকৃত হাদিস থেকে যা আশা করা উচিত, সেই রকমই রচিত কাহিনী থেকে সংগ্রহ হয়েছে। অথচ সেগুলো খাটি হিসেবে স্বীকৃত হলেও অনেক স্থলে পরিষ্কার ভাবে বিরোধী। কিন্তু এসব অসংগতি ও অনৈক্য সত্ত্বেও তাদের সত্যতা নিয়ে সন্দেহ দূরে থাক, ইসলামি বিশ্বাসীদের দৃঢ়তা আরও প্রবল হয়ে উঠে। এসব অনৈক্যকে ধরা হয়ে মুহাম্মাদের সুদূরপ্রসারী জ্ঞান, কারণ তিনি নিজের অনুসারীদের মুক্তির জন্য শুধু একটিমাত্র সংকীর্ণ পথ খোলা রাখেননি। আর পরস্পর বিরোধীগুলোকে বলা হত – এসব হচ্ছে ইসলামের প্রথম অবস্থার নিয়ম, কিন্তু পরে মুহাম্মাদ কর্তৃক সংশোধিত বা নাকচ করা রূপ। এজন্নেই দেখা যায় মুহাম্মাদ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রক্রিয়াই নামাজ পড়ছেন। কখনো একবার মাত্র তিনি কান পর্যন্ত হাত উঠিয়েছেন, কখনো উঠিয়েছেন একাধিকবার। কখনো তিনি নামাজ শুরু করেছেন জোরে ‘বিসমিল্লাহ্’ বলে, আবার অন্য সময় বলেছেন মনে মনে। তার সাহাবারা তাকে অনুসরণ করবার আগ্রহে তাকে যেভাবেই নামাজ পরতে দেখেছেন ঠিক সেই ভাবেই নামাজ আদায় করে গেছেন, আর তাত দরুন পরবর্তীকালের জন্যেও রেখে গেছেন অনৈক্য।
হিজরির প্রথম শতকের শেষ ভাগ থেকে তৃতীয় শতকের মধ্য ভাগ পর্যন্ত চারজন মশহুর মুসলমানি আইনের ব্যাখ্যাতার আবির্ভাব ঘটে। তারা প্রত্তেকেই প্রত্যেকটি হাদিসের সভ্যতার মান সম্বন্ধে বিভিন্ন মত পোষণ করেন। তারা প্রত্যেকেই ইসলামের এক- একটি মজহাবের প্রতিষ্ঠাতা।
প্রথম – আবু হানিফাঃ তার জন্ম ৮০ হিজরিতে ও মৃত্যু ১৫০ হিজরিতে। তিনি হানাফী মজহাবের স্রষ্টা, আর ভারতীয় মুসলমানদের প্রায় সমস্তই হচ্ছে এই মজহাবের অন্তর্ভুক্ত।
দ্বিতীয় – আবু আবদুল্লাহ শাফীঃ প্রায় ১৫০ হিজরিতে জন্ম ও মৃত্যু ২০৪ হিজরিতে। তিনি শাফী মজহাবের প্রতিষ্ঠাতা।
তৃতীয় – মালিকঃ ৯৫ হিজরিতে জন্ম ও মৃত্যু ১৭৯ হিজরি। তার অনুসারীরা ‘মালিকী’ নামে কথিত।
চতুর্থ – ইবনে হামবলঃ জন্ম ১৪৪ ও মৃত্যু ২৪১ হিজরি। তিনি ‘হামবলী’ মজহাবের প্রতিষ্ঠাতা। আরবে এদের সংখ্যা বেশি দেখা যায়।
এই চার মজহাবের প্রতিষ্ঠাতারা ছিলেন নিঃসন্দেহে অত্তন্ত ধর্মনিষ্ঠ ও স্বধর্মের আইন- কানুন সম্মন্ধে তাদের জ্ঞান ছিল সুগভীর। প্রত্যেকেই প্রচুর গবেষণা করে মত নির্ধারণ করেন যে, আইনের বিশেষ ক্ষেত্রে বিশেষ ব্যাখ্যা দরকার এবং কতকগুলি হাদীস অন্যগুলির চেয়ে জোরালো, আর এজন্যই তারা নিজ নিজ বিশ্বাস অনুসারে মত প্রচার করে গেছেন। তার ফলাফল এই হয়েছে যে, বহু তুচ্ছ ও বহু দরকারি বিষয়ে মতানৈক্যের সৃষ্টি হয়েছে। এভাবে আবু হানিফা মত প্রচার করেছেনঃ হাদীসের গুরুত্ব বিবেচনা করে এই সিদ্ধান্ত করা যায় যে, নামাজে প্রথমে চুপে চুপে ‘বিসমিল্লাহ্’ উচ্চারণ করা উচিত,নামাজের প্রথমে হাত দুটি কান পর্যন্ত উঠানো উচিত এবং নামাজ পরা কালে হাত দুটি বুকের উপরে আড়াআড়ি ভাবে রাখা উচিত। অন্য দিকে শাফী বলেছেনঃ ‘বিসমিল্লাহ্’ জোরে উচ্চারণ করতে হবে নামাজের কালে মাঝে মাঝে হাত দুখানা কান পর্যন্ত উঠাতে হবে এবং নামজ পড়ার সময় হাত দুটি বুকের উপর জোরানো থাকবে। আবার আবু হানিফা বলেঞ্জে, কোন মানুষ নিরুদ্দেশ হলে নব্বই বছর গত না হলে তাকে মৃত ধরা যাবেনা এবং এই সময়ের মধ্যে তার স্ত্রীর দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ নাজায়েজ হবে; অন্যদিকে মালিকী মজহাবের মতানুসারীর পক্ষে মাত্র চার বছর পরেই দ্বিতীয় বিবাহ জায়েজ হবে।
সুন্নী সম্প্রদায়ের এই চারটি মজহাবকে পৃথক ধর্মমত ধরা সংগত হবেনা, সেগুলি বরং খাটি মুসলমান ধর্মের চারটি শাখা। প্রত্যেক মজহাবপন্থীরা তাদের বিধি- বিধান ও আচার- অনুষ্ঠান অবশ্যই মেনে চলতে বাধ্য এবং আরও বিশ্বাস করতে বাধ্য যে, এসব পালনেই তার নাজাত বা মুক্তিলাভ সম্ভব। প্রত্যেক মজহাবের আইন- কানুন তার জন্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এক মজহাব থেকে অন্য মজহাবে পরিবর্তন প্রায় হয়না, আর যদি বা হয় তবে তা নিন্দার চখে দেখা হয়। এই পুনর্দিক্ষাও খুবই বিশেষ ক্ষেত্রে হয়ে থাকে, আর তাও হয় যখন তাদের মধ্যে খুবই কম পার্থক্য দেখা যায়।
এসব থেকে স্বত্বই লক্ষণীয় যে, মুসলমানদের ধর্মীও ব্যাপারে ব্যাক্তিগত যুক্তি বিচারের স্বাধীনতা নেই। তারা অবশ্যই কুরআন ও হাদীস গ্রন্থ পরবে, কিন্তু তার বেশি তারা অগ্রসর হতে পারবেনা, কিংবা আপন মজহাবের মত বিরোধী কোন স্বাধীন ব্যাখ্যা গ্রহনের অধিকার নেই। অথচ দেখা যাচ্ছে যে, মজহাবগুলোর প্রতিষ্ঠাতারা বিভিন্ন সিদ্ধান্তে উপনিত হয়েছিলেন এবং এই থেকেই প্রমাণিত হয় যে, তারা প্রত্যেকেই এই অধিকার ভোগ করেছেন এবং এই জন্য পূর্ববর্তী ব্যাখ্যা তার শিক্ষা মেনে চলেননি। অথচ কার্যত মুসলমান জনসাধারণ ব্যাক্তিগত ব্যাখ্যা করার চেষ্টাও করতে পারবেনা এবং চার ইমামে কোন একজনের মতাবলম্বী হতে বাধ্য। আমরা পরে দেখাব যে, ওহাবীরা এটাকেই অন্য সব বিষয়ের মতো প্রথমেই অস্বীকার করেছিল।
‘ওহহাবী’ শব্দে প্রথমে যথার্থ ভাবে একদল আরব মুসলমানকে চিহ্নিত করা হয়েছিল। আর শব্দটার উৎপত্তি হচ্ছে সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতার নাম শেখ আবদুল ওহাব থেকে। তিনি গত শতাব্দীর প্রথম দিকে আরব দেশের নজদ অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। বসরার মাদ্রাসায় তিনি শিক্ষা লাভ করেন পরে ভ্রাম্যমাণ সউদাগর হিসেবে দামেসক, পারস্য উপসাগরের উপকূলবর্তী শহরগুলোতে এবং পারশ্যেও সফর করেন। বহু বছর সফরের পর তিনি আরব প্রত্যাগমন করেন নিজ প্রদেশের রাজধানী দারিয়ায় বসবাস কায়েম করেন। সেখানে তিনি সংস্কার কাজ শুরু করেন এবং নিজের বিশেষ মতবাদও প্রচার করতে থাকেন। তিনি শিক্ষা দেন যে, মুসলমানদের উচিত হযরতের জীবদ্দশায় ও তার পরের খেলাফতের আমলে ইসলামের যেরূপ ছিল, তারই অনুসারী হওয়া; প্রত্যেক মুসলমানের উচিত একমাত্র আল্লাহর উপর এবং তারই উপর অকুণ্ঠ নির্ভর করা, হযরত মুহম্মদ কিংবা কোন ওলী- মর্যাদা এভাবে অযাথা বাড়িয়ে না তোলা, যাতে আল্লাহ্র মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করা হয়। হযরতের পর থেকে যেসব অনুষ্ঠান, উৎসব ও নিয়ম উদ্ভূত হয়েছে সেসব একেবারে পরিহার করা এবং সর্বোপরি ইসলামের শৈশাবস্থায় ইসলাম যেমন তরবারির মুখে প্রচারিত হয়েছিল, তেমনিভাবে ইসলাম জারী করা।
তার শিক্ষা দারিয়ার সরদার শেখ মুহম্মদ ইবন সউদ গ্রহণ করেন এবং তার মুরীদ হন। তার কন্যাকেও ইবন সউদ শাদী করেন। গত শতকের মধ্যভাগে আবদুল ওহহাবের মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুর পর তার একমাত্র পুত্র মুহম্মদ ইবন সউদের মুরুব্বিয়ানায় মধ্য আরবের শাসক হয়ে উঠেন। তারপর ওহাবী রাজ্য বহু ভাগ্য বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে, কিন্তু আমাদের বর্তমান আলোচনার পক্ষে সেসবের কোন প্রয়োজন নাই।
দেখা যায় যে, বর্তমান শতকের প্রথম ভাগে ওহাবী মতবাদ আরব প্রত্যাগত বহু হাজীর দ্বারা ভারতে আমদানী করা হয়েছে। আর এতা সুনিশ্চিত যে, ফরিদপুরের বাশিন্দা ও মশহুর দুদু মিয়ার পিতা হাজী শরীয়তউল্লাহ্ কর্তৃক এই ধরনের মতবাদ নিম্নবঙ্গে প্রচারিত হয়েছিল। তার অনুসারীদের বলা হয় ফারাজী। নানা কারণে ভারতে ফারাজীদের প্রভাব যৎসামান্যই। কিন্তু শরীয়তউল্লাহ্র শিক্ষার ফল এই দাড়ায় যে, লোকে হিন্দুস্থানের বাশিন্দা সৈয়দ আহমদের মতবাদ গ্রহণ করবার প্রকাশ করতে থাকে। এসব মতবাদের ঐতিহাসিক গুরুত্ব এত বেশি যে, এখানে সেসবের বিস্তৃত আলোচনার দরকার আছে।
সৈয়দ আহমদের জন্ম হয় ১২০১ হিজরির মুহররম মাসে, আউধের রায়বেরেলীতে। তার বাল্য জীবন সম্মন্ধে খুব অল্পই জানা যায়। তবে মনে হয়, ছেলেবেলাতেই তিনি গৃহত্যাগ করেন ও আমীর খান পিণ্ডারির ফৌজে প্রবেশ করেন। এই আমীর খান পরবরতীকালে টঙ্কের নওয়াব হন। ফৌজে সৈয়দ আহমদের পদবী কি ছিল, সে সম্মন্ধে মতভেদ আছে, তবে তার অনুসারীদের এই বিষয়ে মৌনভাব দেখে মনে হয়, তিনি কোন নামকরা দায়িত্বভার পাননি। ১৮১৭ খৃষ্টাব্দে আমির খানের ফৌজ ভেঙে দেয়া হলে সৈয়দ আহমদ দিল্লীতে গমন করেন এবং মশহুর শাহ্ আবদুল আজীজের মুরীদ হন।
এই সময়ে শাহ্ আবদুল আজীজ হিন্দুস্থানের শ্রেষ্ঠ আলেম হিসেবে গণ্য হতেন। তার পান্ডিত্তের খ্যাতি হিন্দুস্থানের বাইরেও ছড়িয়ে পরেছিল।
এবং আরবের পন্ডিত সম্রাজ্জ তাকে ‘শামসুল হিন্দ’ খেতাব দান করেন। ভারতীয় মুসলমানদের উপর তার প্রভাব ছিল অপরিসীম। শরীয়তের জটিল প্রশ্নে তার ফতোয়া আজও অভ্রান্ত হিসেবে স্বীকৃত হয়। আর তার নাম যে কোন দলের শক্তিস্থম্ভ হিসেবে গণ্য হওয়ার দরুন ওহাবীরা ও হানাফীরা তাকে নিজ নিজ মজহাবের সমর্থনকারী হিসেবে নিজেদের দলে টানাটানি করে থাকে। প্রত্যেক মজহাবই নিজের সুবিধার জন্য দলেরই চরম মতানুসারী ছিলেননা এবিং অনেকটা উদার সনাতন পন্থী [যদি এমন কথা বলা চলে] ছিলেন। তিনি ছিলেন মুকাল্লদ, আর এজন্য চার ইমামের মর্যাদা সর্বদাই রক্ষা করতে চেষ্টা করতেন।
আরবের ওহাবী আন্দোলন ও তার মতবাদ তার অজানা থাকার কথা নয়। আর হইত সে সবের প্রভাবে তিনিও স্বীকার করতেন যে, তার সুন্নী সম্প্রদায়ের কিছুটা সংস্কার দরকার। তার চেষ্টাও ছিল যে, শিয়া ও হিন্দুদের সংশ্রবে থাকার দরুন যেসব রীতি- নিতী, আচার- অনুষ্ঠান সুন্নীদের মধ্যে ঢুকে পড়েছে, সেসবের রদ- রহিত হওয়া উচিত। কিন্তু তার বেশি দূর সংস্কার তিনি চাননি এবং তার শেষ জীবনের দিকে সৈয়দ আহমদের মতামত যখন খুবই প্রবল হয়ে উঠেছিল, তখন তিনি সেসবের অস্বীকার করেন। আর তার সেসব আত্মীয় এই আন্দোলনে যোগদান করেছিল, তাদের বঞ্চিত করে তিনি এক অনাত্মীয়কে উত্তরাধিকারী করে যান। সমকালীন পরিস্থিতি বিবেচনা করে তিনি ইংরেজ সরকারের প্রতি উদার মনোভাবই প্রকাশ করতেন। তিনি ইংরেজি শিক্ষা করার এবং নয়া বিজেতাদের অধীনে চাকরি গ্রহণ করার উপযোগিতা স্বীকার করতেন। বর্তমানকালের বহু মুসলমানের ভাব বিবেচনা করলে তার এসব মতবাদ নিশ্চয়ই প্রগতিমূলক ছিল।
সৈয়দ আহমদ কয়েক বছর দিল্লীতে অবস্থান করেন এবং শাহ্ আবদুল আজীজের পরিবারে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হন। তার সবচেয়ে অন্তরঙ্গ হয়ে উঠে শাহ্ আবদুল আজীজের ভাইপো মওলবী মুহম্মদ ইসমাইল ও তার জামাতা মওলবী আবদুল হাই। তারা দুজনেই ছিলেন মশহুর আলেম এবং সৈয়দ আহমদের প্রতি একান্ত অনুরক্ত মুরীদ এবং জীবনের শেষ পর্যন্ত তার সহচর ছিলেন।
এই দুই মহাপন্ডিতের মধ্যে মুহম্মদ ইসমাইল ‘সিরাতুল মুস্তাকীম’ রচনা করেন ১২৩৩ হিজরিতে [১৮১৮ খৃষ্টাব্দে]। এটি ভারতের মুসলমানদের কাছে কুরআনের মতোই শ্রদ্ধার বস্তু। তাতে দেখা যায় যে, সৈয়দ আহমদ যেন স্বপ্নাদেশ পেয়ে মুরশিদের স্থান গ্রহণ করতে বাধ্য হন এবং নিজের মতবাদ প্রচারের উদ্দেশে মুরীদ করতে থাকেন। মওলবী মুহম্মদ ইসমাইল ও মওলবী আবদুল হাই হন তার প্রথম মুরীদ। তাদের প্রভাবে ও ব্যাক্তিত্তে অন্য বহু লোক সৈয়দ আহমদের মুরীদ হয়ে যায় এবং তিনি একজন ধর্মীও শিক্ষক হিসেবে প্রসিদ্ধ হয়ে উঠেন। বহু মশহুর আলেম তার খাদিম হয়ে তাকে অসম্ভব সম্মান দেখাতে থাকেন এবং তারই শিক্ষার বরখেলাপ হলেও কখন তারা তার পালকি বহন করতেন, আবার কখন বা তার পালকির দুপাশে পায়ে ছুটাছুটি করতেন। তারা তাকে সম্বোধন করতেন ‘আমীরুল মুমেনিন’,’ইমাম হানাফী’,’ইমাম মেহেদী’ বলে এবং প্রচার করতেন যে, তিনি ইমাম ও পয়গম্বরের পর্যায়ে পৌঁছে গেছেন। ১২৩৫ হিজরিতে [১৮২০ খৃঃ] তিনি মওলবী আবদুল হাই ও
মওলবী মুহম্মদ ইসমাইলকে নিয়ে দিল্লী ত্যাগ করেন এবং সাড়া ভারতে সফর করতে বের হয়ে পরেন ধর্মীও সংস্কার আনার জন্য এবং শিখদের বিরুদ্ধে জেহাদ বা ধর্মীয় যুদ্ধ ঘোষণা করতে উত্তেজিত করতে। কারণ, শিখরা তখন পাঞ্জাবের মুসলমানদিগকে উৎপীড়ন করত এবং স্বাধীনভাবে তাদের ধর্ম পালনে বাধা দিত। বিশেষ করে শিখরা আজান দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। আর এটাই ছিল মুসলমানদের বিদ্রোহ ঘোষণা করার পক্ষে উপযুক্ত কারণ। তিনি প্রথমে গমন করেন সাহারানপুরে, সেখান থেকে যান রামপুরে ও বহু পাঠানের সরদার ফয়জুল্লাহ খানের সঙ্গে কিছুদিন অবস্থান করেন। তারপর তিনি কলিকাতার পথে রউনা হন গোরখপুর, জৌনপুর প্রভৃতি স্থানের ভিতর দিয়ে এবং পথে বহু মুরীদকে দীক্ষা দান করেন।
তিনি পাটনায় হাজির হন বিশাল এক নৌবহর ও ৫০০ লোকের উপর উৎসাহী মুরীদানকে সঙ্গে নিয়ে এবং এখানে অবস্থান করেন কয়েকদিন। তিনি প্রতমে থাকেন মীর আশরাফের মাজারে এবং পরে থাকেন মাদ্দপা মসজিদে। সাদিকপুরের মওলবী বেলায়েত আলী, মওলবী ইনায়েত আলী, মওলবী ফরহাত হোসেন, মওলবী ইলাহী বখশ ও তার পুত্র মওলবী আহমদ উল্লাহ্ তার মুরীদ হন। পাটনার বহু বাসিন্দাও তার শিষ্য হয়ে যায়। অতঃপর তিনি কলকাতা রউনা হন। কিন্তু তার পূর্বে তিনি শাহ্ মুহম্মদ হোসেন,বেলায়েত আলী ও ইনায়েত আলীকে পাটনায় তার খলীফা নিযুক্ত করে যান এবং তার হয়ে মুরিদ করতে ও শিখদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত জেহাদের জন্য রসদ সংগ্রহ করতেও ভার দিয়ে যান। পাটনা থেকে কলকাতায় তিনি নৌবহর নিয়ে সফর করেন এবং গঙ্গা নদীর দুপাশের বহু জায়গায় তা মত প্রচার করতে করতে যান। কলিকাতায় তিনি হাজির হন ১৮২১ খৃঃ শেষের দিকে এবং এখানে ধর্মীয় শিক্ষক হিসেবে আশ্চর্য সাফল্য লাভ করেন। কলিকাতা ও বারাসতের বাসিন্দারা দলে দলে তার নিকট জমা হতে থাকে। তাদের মধ্যে তিতুমীরও তার মুরীদ হন। এই তিতুমীর পরে ১৮৩১ খৃঃ বারাসতে বিদ্রোহের ঝাণ্ডা তুলেছিলেন। এই সময়ে সৈয়দ আহমদ অসংখ্য অনুগামী ও জাকাত হিসেবে অর্থ সংগ্রহ করেন। তার বিশেষ শিক্ষা- আদিম ও সহজ সরল ইসলামে আমদানিকৃত সবরকম বেদাত বর্জন করতে হবে এবং এই শিক্ষাটি মুসলমানদের মধ্যে দৃঢ়মূল হয়ে যায়। যেসব টাকা পয়সা আগে উৎসবে ব্যায় করা হত, এখন থেকে সেসব একটিমাত্র খাতে – শিখদের বিরুদ্ধে জেহাদের জন্য সঞ্চিত হতে লাগলো।
১৮২২ সালে প্রথম দিকে সৈয়দ আহমদ বহু মুরীদ নিয়ে মক্কা গমন করেন এবং তথায় হজ্জ পালন করে মদীনায় উপস্থিত হন। এখানে তুর্কি কর্তৃপক্ষ তার বিরুদ্ধতা করে এবং তার মতবাদীরা যেসব প্রচার করত, সেসব সহ্য করতেও অস্বীকার করে। তারা পূর্বেই আরবের ওহাবীদের নিকট বহু নির্যাতন সহ্য করেছিলো। এখন যেসব মওলবী ধর্মীয় সংস্কারের কথা প্রচার করতেন, অনেকেই আটক হয়ে পরেন।
১৮২৩ সালের অক্টোবর মাসে সৈয়দ আহমদ কলিকাতায় ফিরে আসেন। পথে বোম্বাইয়ে তিনি কয়েকদিন অবস্থান করেন ও বহু মুরীদ করেন। ডিসেম্বর মাসে তিনি জন্মস্থান রায়বেলির উদ্দেশে যাত্রা করেন এবং পথে পাটনা ও গোয়ালিয়ারে অবস্থান করেন।
পাটনায় শাহ্ মুহম্মদ হোসেন এক বিশাল মুজাহীদ বাহিনী নিয়ে তার সঙ্গে মিলিত হন। তার খলিফাদের এক মজলিস হয় এবং বহু পূর্বে পরিকল্পিত কাজের জন্য মানুষ ও টাকা পয়সা সরবরাহের ব্যাবস্থা করা হয়। এতা মনে করা হয়েছিল যে, সৈয়দ আহমদের ও তার সহকর্মীদের এসব কার্যকলাপ হইত সরকারকে ভীতিগ্রস্ত করবে, অন্তত সরকারের হস্তক্ষেপের দরকার হবে। এতা নিশ্চয়ই সকলের মনে আছে যে, কয়েক বছর পূর্বে ইংল্যান্ড রোমান ক্যাথলিক যাজকতন্ত্র স্থাপনের স্থাপনের চেষ্টা হলে সাধারনের খুবই উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল এমং একটা নিষেধাজ্ঞা মূলক দন্ডবিষয়ক আইন প্রবর্তনের দরকার হয়েছিল। অথচ তখন রোম ও দেশে কোন রাষ্ট্রীয় শক্তি স্থাপনের ইচ্ছা করেনি, কিংবা ইংরেজ ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের রাজভক্তিতে সন্দেহ হওয়ার এতটুকু কারণ উপস্থিত হইনি। আর ভারতে সাড়া দেশটা সৈয়দ আহমদের খলীফাদের মধ্যে ভাগ- বাটোয়ারা হয়ে গেল এবং ব্রিটিশ সরকারের স্বার্থের প্রতিকূলে একটা সরকারও বাস্তব ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলো; কিন্তু শাসন কর্তৃপক্ষ এই প্রতিষ্ঠানটির সম্বন্ধে চল্লিশ বছর ধরে কিছুই জানতে পারলনা- এথেকেই প্রমাণ হয় যে, তারা শাসিত জাতি সম্বন্ধে কত অজ্ঞ ছিল। সৈয়দ আহমদ অতঃপর টংকে উপস্থিত হন এবং পুরান নায়ক আমীর খাঁর সঙ্গে কিছুকাল অতিবাহিত করেন। আমীর খাঁর পুত্র তার মুরীদ হন। টংক থেকে তিনি মরুভূমি অতিক্রম করে সিন্ধুতে উপস্থিত হন ও খয়েরপুরের মীর রুস্তম খাঁর অতিথি হন। এখানে বহু মুজাহিদ তার সঙ্গে যোগদান করেন। অতঃপর তিনি উত্তর- পশ্চিম সীমান্তের পাহাড় অঞ্চলে প্রবেশ করেন এবং কাবুলে কান্দাহারের পারবত্যবাসিদের মধ্যে জেহাদ প্রচার করতে থাকেন শিখদের বিরুদ্ধে। কিন্তু কোন বিশেষ ফল না হওয়াই তিনি খিলজিদের অঞ্চলে প্রবেশ করেন এবং ১৮২৬ সালের শেষের দিকে পেশোয়ার ও সিন্ধুনদের মধ্যবর্তী ইউসুফজাই পাহাড়ে প্রবেশ করেন।
ইউসুফজাই আদিবাসীরা বহু বছর ধরে লক্ষ করেছিলো যে, শিখরা একের পর এক প্রদেশ আফগানদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিচ্ছিল, আর তার দরুন তারা নিজেদের আজাদী সম্বন্ধে খুবই উদ্বিগ্ন ছিল। ১৮২৩ সালে পেসোয়ারার শাসনকর্তা ইয়ার মুহম্মদ খা রণজিৎ সিংহ কে কর দিতে স্বীকার করেন। কিন্তু এতা তার ভাই আজীম খাঁর মনঃপূত হলনা। তিনি ইয়ার মুহম্মদ খাকে পেশোয়ার থেকে বিতাড়িত করে দেন এবং শিখদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেন। মার্চ মাসে শিখদের ও পাহাড়িয়া আদি জাতিদের মধ্যে নওশেয়ার একটি যুদ্ধ হয় কিন্তু কোন ফল হয়না। শেষে আদি জাতিরা তাদের সরদার মুহম্মদ আজীম খা কর্তৃক পরিত্যাক্ত হয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে পরে। শিখরা পেশোয়ার দখল করে ফেলে ও লুটপাট করে খাইবার পর্যন্ত হাজির হয়। কিন্তু পেশোয়ার নিজেদের দখলে রাখা শক্ত বিবেচনা করে ইয়ার মুহম্মদকে জায়গীর হিসেবে দান করে।
এই পরিস্থিতে ইউসুফজাই আদিবাসীরা নিজেদের আজাদী রক্ষার উদ্বেগে ও শিখদের শায়েস্তা করার মতলবে সৈয়দ আহমদকে দুহাত বাড়িয়ে গ্রহণ করল এবং তার কর্তৃত্বও মেনে নিল। তখন তিনি তাদের সাহায্য নিয়ে শিখদের থাকোরায় আক্রমণ করেন, কিন্তু পরাজিত হয়েও অক্ষত ফিরে আসেন। ক্রমে ক্রমে শক্তি সঞ্চয় করতে লাগলেন এবং ইয়ার মুহাম্মদও তার সঙ্গে চুক্তি করতে বাধ্য হলেন ও ইউসুফজাই আদীজাতিদের আজাদী স্বীকার করলেন। অবস্থা এভাবেই থেকে গেলো ১৮২৯ সাল পর্যন্ত; কিন্তু তখন সৈয়দ আহমদ পেসোয়ারার দিকে অগ্রসর হলেন এবং ইয়ার মুহম্মদ তাকে বিষ প্রয়োগ করতে চেষ্টা চেয়েছিলেন। একটা যুদ্ধ হল, ইয়ার মুহম্মদ নিহত হল এবং তার অনুগামীরা বিধ্বস্ত হল। পেশোয়ার কোন রকমে রক্ষা পেল- শের সিংহ ও ভেন্তুরার একদল সিখ বাহিনী নিয়ে উপযুক্ত সময়ে উপস্থিত হওয়ার দরুন। ১৮৩০ সালে জুন মাসে সৈয়দ আহমদ জেনারেল আলারডের অধীন একদল শিখ বাহিনীকে আক্রমণ করেন কিন্তু এবারও পরাজিত হন। শীঘ্রই তিনি ইয়ার মুহম্মদ খাঁর উত্তরাধিকারী সুলতান খাঁর বিরুদ্ধে পেশোয়ার আক্রমণ করেন এবং সুলতান মুহম্মদকে বিতাড়িত করে পেশোয়ার দখল করতে সক্ষম হন। তার এই সামরিক জয় পরোক্ষ শিখদের পক্ষে মঙ্গলকরই হয়েছিল। সৈয়দ আহমদ আক্রমক হিসেবে জয়ী হয়ে পেসোয়ারের শাসক হয়ে উঠলেন, কিন্তু শাসন বিষয়ে তার ধর্মান্ধতা শেষ পর্যন্ত তার প্রথম সম্প্রদায়ের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার আশা- ভরসা সব নষ্ট করে দিল। তার প্রথমকাজ হল খলীফা খেতাব ধারন করা ও নিজেকে স্বাধীন ঘোষণা করা এবং নামাংকিত তংকা জারি করা- ‘আহমদ ইসলামের রক্ষক’ তার তরবারির উজ্জ্বলে কাফেরদের ধ্বংস সাধিত হয়। আরও তিনি আরবের ওহাবীদের পদাংক অনুসরণ করে দাবি করলেন। তার প্রজারা মুহম্মদ ও তার খলীফাদের আমলে জাকাত ফেতরা আদায় দেবে। এই সময় আরও চেষ্টা করা হয় পেশোয়ারের গোঁড়া হানাফী মুসলমানদের তার দলভুক্ত করতে। এজন্য শিক্ষিত মুসলমানদের এক বিরাট জলসা ডাকা হয় এবং পারস্পরিক অনেক ছাড়- রিয়াত করা হয়। মওলবী ইসমাইল ত্যাগ করলেন ব্যাক্তিগত ব্যাখ্যা করার অধিকার ও ‘রাফিয়াদান’ করা এবং একজন মুকল্লদ হানাফী হিসেবে স্বীকৃত হলেন। আর হানাফীরা সৈয়দ আহমদের প্রচারিত বেদাত ও শেরক সম্বন্ধ মতবাদ স্বীকার করল এবং জেহাদের সাহায্যার্থে জাকাত প্রভৃতি আদায় করতেও স্বীকৃত হল। ধর্মান্ধদের আবেগের অতিসহ্য শীঘ্রই প্রকট হয়ে উঠল। আবদুল ওহহাবের উত্তরাধিকারীরা মদিনায় পয়গম্বরের মাজার ভেঙে দিয়েছিলো। আর সৈয়দ আহমদের অনুগামীরা পেশোয়ারের মাজার গুলোও ভেঙে ফেলতে লাগলো এবং ইসলামের প্রাথমিক অবস্থায় তরবারির সাহায্যে যেমন ধর্ম প্রচারিত হয়েছিল, সেইরকম তারাও পার্শ্ববর্তী হিন্দুদের সঙ্গে শান্তির বাস করতে অস্বীকার করল। অতএব এই মতবাদটাই জোরেশোরে প্রচারিত হতে লাগলো যে, যারা পুতুল পুজকদের সঙ্গে বিরোধ করতে চায়না তারা নিজেরাই পুতুল পুজক হয়ে গেছে। পাঞ্জাবকে ‘দারুল হরব’ বা দুশমনের দেশ হিসেবে আখ্যা দিয়ে জয় করার জন্য জেহাদ ঘোষণা করা হল।
প্রথমবস্থা থেকেই ধর্মান্ধদের সরকারের সাফল্যের সম্ভাবনা ছিল খুবই কম। কারণ এতার লক্ষ ছিল পৃথিবীর ইতিহাস থেকে বার বছর মুছে ফেলা এবং একটা বিদেশী জাতকে মুহম্মদের সমকালীন আরববাসীদের স্বভাব, রীতিনীতি ও আচার- অনুষ্ঠানের অনুসারী হতে বাধ্য করা। ধর্মীয় অনুরাগ থাকা সত্ত্বেও শীঘ্রই স্থানীয় বাসিন্দারা অসন্তুষ্ট হয়ে এবং সৈয়দ আহমদের বিরুদ্ধে দোষারোপ করতে লাগলো যে, তিনি পাহাড়ি আদি জাতিদের মেয়েদের সঙ্গে তার ভারতীয় অনুচরদের শাদী দিচ্ছেন। ১৮৩০ সালে নভেম্বর মাসে তিনি বাধ্য হলেন সুলতান মুহম্মদ খাঁর হাতে পেশোয়ার ছেড়ে দিতে, তবে সুলতান মুহম্মদ খা তাকে কর দিতে রাজি হলেন। অতঃপর সৈয়দ আহমদ সিন্ধুনদ অতিক্রম করে পূর্ব তীরে উপস্থিত হলেন শিখদের জয় করতে। কিছুকাল তিনি খণ্ডযুদ্ধ চালাতে লাগলেন, কিন্তু কোন ফল হয়নি। ১৮৩৯ সালের মে মাসে বালাকোটে একদল শিখ বাহিনী অতর্কিতে তাকে আক্রমণ করে এবং সম্পূর্ণ ভাবে ধ্বংস করে দেয়। সৈয়দ আহমদ ও মুহম্মদ ইসমাইল শহীদ হন।
অন্যকিছু বলার পূর্বে এখানে সৈয়দ আহমদের ব্যাক্তিগত বর্ণনা, তার মতবাদ ও সেগুলি লোকপ্রিয় হওয়ার কারণগুলির আলোচনা করা যেতে পারে। তিনি ছিলেন মাঝারি গঠনের ব্যাক্তিত্বশালী মানুষ, আর সাড়া বুক ছেয়ে দাড়ি থাকার দরুন তাকে আরও ভারিক্কী মানুষ মনে হত। ১৮২০ সালে যখন তিনি নিম্নবঙ্গ সফর করেন তখন তার বয়স ছিল প্রায় ছত্রিশ বছর। তার পোশাক ছিল মাথায় সাদা কাপড়ের পাগড়ী, বুক পর্যন্ত খোলা কুর্তা ও পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত নামানো সাদা চোস্ত পাজামা। সবগুলোই ছিল সুতি কাপড়ের। সমকালীন উত্তর ভারতীয় মুসলমানদের রেওয়াজ অনুযায়ী তিনি হিন্দুস্থানে প্রচলিত চার তরিকার ফকিরীতে বিশ্বাসী ছিলেন। তার স্বভাব ছিল গম্ভীর, সান্ত ও সংবেদনশীল। মুরীদানের সঙ্গে ‘বয়েত’ বা দীক্ষা দেওয়াকালীন সময় ব্যাতিত তিনি খুব কম আলাপ করতেন। বারাসতের মুরীদানের সংখ্যা এত বেড়ে উঠে যে, তিনি পাগড়ী খুলে দিয়ে টা ছুইয়ে মুরীদ করার রেওয়াজ করেন। তিনি স্বভাবতই মৌন থাকতেন এবং মুসলমান আইনে অজ্ঞতার দরুন ধর্মীয় আলোচনা পরিহার করতেন। এজন্য যখনই কোন বাকযুদ্ধ উপস্থিত হত, তখন তিনি নীরব দর্শকের ভুমিকা পালন করতেন আর তার দুই শিষ্য মওলবী আবদুল হাই ও মওলবী মুহম্মদ ইসমাইল বিপক্ষ দলের সঙ্গে বাকযুদ্ধ চালাতেন। তার অনুগামীদের ও তারও বিশ্বাস ছিল যে, আকৃতিতে ও স্বভাবে তিনি ছিলেন পয়গম্বর সাহেবের সমান। তার প্রায় ভাবাবেশ বা মূর্ছা হত [ তা যে কি বলা শক্ত] এবং তিনি ও তার মুরীদান বিশ্বাস করতেন যে, পয়গম্বর সাহেবের মতোই তখন আল্লাহর সঙ্গে তার সাক্ষাৎ- সংযোগ ঘটতো। সংক্ষেপে বলা যায়, তিনি দরদী, সান্ত ও অশিক্ষিত ছিলেন, মাঝে মাঝে তার স্নায়ুবিকার ঘটতো। তিনি নিজেকে পূর্ব এশিয়ার মুসলমানদের ইমাম হিসেবে দাবী করতেন এবং তার সমর্থনে অদ্ভুত যুক্তিও খাড়া করতেনঃ কোন মানুষই কোন দেশে ধর্মীয় শিক্ষক হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি, যদি তার অনুপ্রেরণার সঙ্গে কিছুটা পাগলামি মেশানো না থাকে।
ধর্মীয় আলোচনায় কিছুতেই অংশগ্রহণ না করার নীতি গ্রহণ করার দরুন সৈয়দ আহমদ বাস্তবপক্ষে কিসে বিশ্বাসী ছিলেন তা ধারণা করা শক্ত। গোঁড়া সুন্নীরা ও তার নিকট- অনুগামীরা বিশ্বাস করত যে, তিনি আদর্শিক মানুষ; তাবে সুন্নীরা আরও বলত যে, তিনি ভিন্ন জাতীয় মতবাদ প্রকাশ করতেননা, তার খাদেম মওলবিরা যাই বলুক না কেন; অথচ তার মুরীদানরা কখনই একথা স্বীকার করতেন্না। তার বানী সমুহের সংগ্রহ হিসেবে ‘সিরাতুল মুস্তাকিমের’ উল্লেখ করা হয়। এখানে মওলবী ইসমাইলের রচনা, তবে এখানে তার মুরশিদদের সঠিক বাণীই উদ্ধৃত হয়েছে, বলা হয়ে থাকে। নিম্নবঙ্গের মুসলমানরা কিতাবটি খাটি না বলে সন্দেহ প্রকাশ করে থাকে এবং বলে যে, মওলবী মুহম্মদ ইসমাইল নিজের মতবাদ প্রকাশ করার আগ্রহাতিশয্যে সেগুলিই কিতাবখানির মধ্যে তার মুরশিদের বাণী হিসেবে চালিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু বইখানার বিষয়বস্তু থেকে ও সৈয়দ আহমদের মুরীদানের সাক্ষ্য থেকে ধারণা হয়, বইখানা খাটি হিসেবেই প্রকাশিত হয়েছে। একজন ফকিরের নিকট যেমন আশা করা যায়, তেমনই তার শিক্ষার বহুলাংশ সেই দিকটা খুলে দেখায়, কিভাবে একজন তত্ত্বজিজ্ঞাসু ওলীর [সন্ত পুরুষ] মর্যাদায় উন্নীত হতে পারেন। তার শিক্ষার মৌল ভিত্তি হচ্ছে, চরম অদৃষ্টবাদ ও এক আল্লাহে অকুণ্ঠ বিশ্বাস। মানুষের কিছুই করার যোগ্যতা নেই তার নিজের প্রচেষ্টাই; তাকে একান্ত ভাবে নির্ভর করতে হবে এক আল্লাহ্র উপরেই এবং মানুষের জন্মের বহু পূর্বেই তিনি এই তার সব কর্মধারা ও মরজগতে তার পরিনতি অমোঘ বিধানে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। আসলে মানুষ স্বাধীন সত্ত্বা নয়; কিন্তু তাদের স্বাধীন ইচ্ছা আছে, এই ধারণার বশবর্তী হয়েই তারা নিজ নিজ কর্ম ফলের জন্য নিজেদের দায়ী মনে করে থাকে। পৃথিবীর ইতিহাসে যুগে যুগে আল্লাহ্ করুণা করে মানুষের জন্য ইমাম বা নেতা পাঠিয়ে থাকেন। তাদের দায়িত্ব হল মানুষকে মুক্তির পথে চালনা করা। গত যুগের পয়গম্বররা- ঈসা, মুহম্মদ সকলেই এই শ্রেণীর মানুষ ছিলেন। কিন্তু মুহম্মদের ওফাতের পর থেকে নবুয়তের ধারা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পরবর্তী যে ইমাম আসেন তার মর্যাদা ওলীর উপরে কখনও উঠতে পারেনা। এসব অবশ্য তত দরকারী বিষয় নয়। তাবে ওলী হচ্ছেন পয়গম্বরের পরবর্তী মর্যাদার মানুষ; ঠিক যেন ছোট ভাইয়ের মতো। ইমাম ধাপে ধাপে মুহম্মাদের শিখানো তরীকাই নাজাতের পথে অগ্রসর হন। তবে ইমাম সময়ে সময়ে আল্লাহ্র সঙ্গে মিশে যান, তখন ঐশী গুণ তার মধ্যে এসে যায়; আর তখন তিনি হয়ে উঠেন সর্বদর্শী এবং কেরামত দেখাবার অধিকারী হন। এরকম ইমাম চেনার কতগুলি নির্দিষ্ট চিহ্ন আছে। তিনি সৈয়দ হবেন এবং নীচ অবস্থায় জন্ম হবে। প্রথমে ইমাম হিসেবে তার মর্যাদা স্বীকৃত হবেনা, কিন্তু ক্রমে ক্রমে ইমামের চিহ্ন প্রকাশ হয়ে পড়বে এবং শেষে তিনি ইমাম হিসেবে স্বীকৃত হবেন। তাখন সব মুসলমানই তাকে দুনিয়ায় তাকে আল্লাহ্র খলীফা হিসেবে মেনে নিবে এবং তার কাজ হবে তাদের মধ্যে ঐক্য আনায়ন করা ও তাদের ঈমান রক্ষা করা।
শাস্ত্রীয় বচনের দিক থেকে এসব বিবেচনা করলে সৈয়দ আহমদের ইমামত এতোই চিহ্নিত যে, সন্দেহের অবকাশই থাকেনা। তিনি জন্মেছেন সৈয়দকুলে ও অখ্যাত অবস্থায়। মুহম্মদ যেমন বেহেশতে মুসার সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন, তেমনি সৈয়দ আহমদ সেই দুই তরিকার প্রতিষ্ঠাতা ফকিরের সাক্ষাৎ পান, যাদের তরিকায় তিনি বিশ্বাসী। আর খোদ আল্লাহ্ যেমন মুহম্মদের কাঁধে হাত রেখে তার মর্যাদা উন্নীত করেন, সেই রকম মুহম্মদও তার কাঁধে হাত রেখে তার মর্যাদা উন্নীত করেন; অতএব সৈয়দ আহমদ নিশ্চয়ই যুগের ইমাম, কিংবা তার চেয়েও বেশি ইমাম হুমাম অর্থাৎ ইমামকুলের শিরোমণি। আর মুহম্মদ যেমন ছিলেন শেষ নবী, তেমনি সৈয়দ আহমদের সঙ্গে সঙ্গে ইমামের ধারাও শেষ হয়ে যায়।
মুসলমানদের মধ্যে একটি সর্ববাদিসম্মত কাহিনী চালিত আছে যে, মুহম্মদের মৃত্যুর পর থেকে রোজ- কিয়ামত পর্যন্ত খলীফা ইসলামের শাসক হবেন। কিন্তু বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে মতবিরোধ থেকে গেছে, এই পর্যন্ত কতজন খলীফা উদিত হয়েছেন। শিয়ারা বিশ্বাস করে যে, এগারো ইমাম গত হয়েছেন এবং দ্বাদশ ইমাম মুহম্মদ আবুল কাসিম ২৫০ হিজরিতে জন্মগ্রহণ করেন। শিয়ারা বিশ্বাস করেনা যে, তার মৃত্যু হয়েছে; বরং তাদের ধারণা যে, তিনি কোন গুপ্ত স্থানে লুকিয়ে আছেন এবং উপযুক্ত সময় উপস্থিত হলেই তিনি পুনরায় উদিত হবেন ও মুসলমানদিগকে পুনরায় কাফেরদের বিরুদ্ধে চালনা করবেন। সুন্নীদের মধ্যে বিভিন্ন মত বর্তমান আছেঃ কোন দল মনে করে, ছয় জন খলীফা গত হয়েছেন, কোন দল বলে চারজন; তবে এতা নিশ্চিত যে, রোজ- কিয়ামতের আগে ছয়জন খলীফা উদিত হবেন; কিন্তু সেকাল কখন আসবে, সেটা অজ্ঞাত। সৈয়দ আহমদ দাবী করতেন যে, তিনি এইরকম একজন খলীফা এবং এই দাবীর সমর্থনে এইসব যুক্তি খাড়া করতেন; তিনি কি সৈয়দ নন এবং সেই হিসেবে মুহম্মদের বংশধর নন? তার জামাতা হযরত আলীর ও কন্যা ফাতেমার বংশধর নন? এই দুজনকি স্বপ্নে তাকে দেখা দেননি ও সন্তান হিসেবে আদর করেন কি? একজন তাকে গোসল করিয়েছেন ও অন্যজন তাকে লেবাস পরিয়েছেন। এরপর আর কি বেশি প্রমাণের দরকার যে, তিনি ইমাম ও খলীফাদের আসনের অধিকারী? এতেই ত অধিকার স্বীকৃত হয় যে, তিনি আমিরুল মুমেনীন অর্থাৎ মোমেন মুসলমানদের চালক। তার পূর্বে ত সুন্নীদের মধ্যে আর কোন ইমাম এই খেতাব গ্রহণ করেননি, এ খেতাবতো একমাত্র খলীফাদের ও অন্য মুসলমান স্বাধীন শাসকদের দ্বারাই গৃহীত হত। এভাবে খলিফার ভুমিকা সৈয়দ আহমদের মনে গেথে গেলো এভাবেই চালিত হয়ে তিনি ভারতকে বিভক্ত করে নিজের খলীফা নিযুক্ত করলেন জাকাত প্রভৃতি ধর্মীয় কর আদায় করতে শেষে তিনি পেশোয়ারে আযাদীও ঘোষণা করেছিলেন।
কিন্তু সব মানুষই সমান নয়, আর সকলেই ইমামের মর্যাদায় হওয়ার স্পর্ধাও করতে পারেনা। এজন্য সাধারন মানুষের ঈমান ও ধর্ম পালনের জন্য কতকগুলি মোটামুটি নিয়ম নির্দেশিত হওয়ার দরকার। সৈয়দ আহমদের ধর্মীয় নীতিগুলো ছিল একজন ফকিরের মতো, যার বিশ্বাস ছিল যে, তিনি মুহম্মদেরই জীবনধারা সর্বাংশে অনুকরণ করতে চেষ্টা করেছেন। সুন্নীদের মতোই ধর্মীয় মৌল ভিত্তি গুলোকে স্বীকার করে নিয়ে তিনি নির্দেশ দেন যে, এই মৌল ভিত্তিগুলোর মধ্যে একমাত্র কুরআনই অভ্রান্ত; আর হাদীস ত ওহীর মতো নাযিল হয়নি, অতএব মুহম্মদের সাহাবাদের মতামতের বা আলেমদের সিদ্ধান্তের মতো তাতে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা, তবে মাত্রায় হইত কম হতে পারে। এই ভ্রান্তির সম্ভাবনা কি করে এড়ানো যায়? মুহম্মদ তাহাদিগকেই একমাত্র নাজাতের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যারা পরবর্তী কুরআন ও হাদীস দ্বারা চালিত হবেন। অতএব সবচেয়ে নিরাপদ হচ্ছে তার উম্মতদের সিদ্ধান্ত পরিহার করা, তা তারা যতই ধর্মনিষ্ঠ হন। আবার কামালিওত হাসিল করতে হলে আরও কিছু বর্জন করা দরকার। যদিও মুহম্মদ এই যুগের মুসলমানদিগকে কুরআন ও হাদীস ছাড়া অন্য কিছুর উপর নির্ভর করতে নিষেধ করেছেন, তবুও এ থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা যায়না যে, হাদীস মানতেই হবে। ঈমানের মূলভিত্তি হিসেবে হাদীস দরকারী বটে, তবু আজকাল লক্ষ্য করা যায় যে, লোকে হাদিসকে কুরআনের তুল্যমূল্য হিসেবেই বিবেচনা করে। অতএব সবচেয়ে নিরাপদ হচ্ছে হাদিসকে ত্যাগ করে কুরআনকেই আঁকড়ে ধরা। সৈয়দ আহমদ যখন পাটনায় মুহম্মদ হোসেনকে তার খলীফা নিযুক্ত করেন, সেই সনদ থেকেই তার শিক্ষার অসম্পূর্ণ হলেও মোটামুটি যথার্থ পরিচয় নিচে দেয়া হলঃ
“করুণাময় আল্লাহ্র নামে বলছিঃ যারা সাধারণভাবে আল্লাহ্র রাহে চলতে চায় এবং বিশেষ করে সৈয়দ আহমদের যেসব বন্ধু উপস্থিত আছে বা অনুপস্থিত আছে, তারা সকলেই জানুক যে, ধর্মনিষ্ঠ ওলীদের হাতে বয়েত বা দীক্ষা গ্রহণ করার উদ্দেশ্য হল আল্লাহ্র সন্তুষ্টি সাধন করা, আর তার উপায় হচ্ছে তার পয়গম্বরদের হুকুম বা বিধান মেনে চলা। যে কেউ মনে করে যে, তার রসূলের হুকুম না মেনেও আল্লাহ্র সন্তুষ্টি বিধান করা চলে, সে মিথ্যুক ও প্রতারিত। তার দাবীও মিথ্যা ও গ্রহনের অযোগ্য। রসূলের হুকুম দুটি বিষয়ের উপর নির্ভরশীলঃ
প্রথমঃ কোন সৃষ্টিতে আল্লাহ্র গুণ আরোপিত না করা [ শিরক ]
দ্বিতীয়ঃ রসূলের সময় বা তার পরবর্তী খলীফাদের সময় যেসব নীতি বা আচার-অনুষ্ঠান ছিলনা, সেসব আমদানী বা অনুসরণ না করা [ বেদাত ] ।
প্রথমটি হচ্ছে এরকম বিশ্বাস না করা যে, ফেরেশতা, জীন, মুরশিদ, ওস্তাদ, শাগরেদ, পয়গম্বর বা পীর কারও মুসিবত বা বিপদ দূর করতে পারেন। এরুপ কোন সৃষ্টির নিকট নিজের ইচ্ছা বা আশা- আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য ধরা না দেয়া; তাদের কারও ভাল বা মন্দ করার ক্ষমতা আছে, এতা অবিশ্বাস করা; আল্লাহ্র ক্ষমতার নিকট তাদের প্রত্যেককেই নিজের মতো অসহায় মনে করা, বরং তাদেরেকে আল্লাহ্র প্রিয়জন মনে করা। জীবনের ঘটন- অঘটন নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা তাদের আছে কিংবা আল্লাহ্র গুণ জ্ঞান দ্বারা অবহিত আছেন, এরকম বিশ্বাস করাই হল চরম ধর্ম বিগর্হিত [কুফর] কোন সত্য- সন্ধ মুসলমান এরুপ কোন মতবাদে জড়িত হতে পারেননা।
“দ্বিতীয়টি সম্বন্ধে বলা যায় যে, ধর্মে নতুনত্ব বা বেদাত আমদানী না করা হচ্ছে, রসূলের জীবদ্দশায় যেভাবে এবাদত- বন্দেগী করা হত ও তার তার জীবনে যেসব রীতি- নীতি চলিত ছিল সেগুলি আঁকড়ে ধরে থাকা; সব রকম বেদাত বর্জন করা, যেমন বিয়ে- শাদীতে আনন্দ- উৎসব, শোকোতসব, মাজার সাজানো, কবরে সৃতিসৌধ তোলা, মৃত্যু বার্ষিকীতে ফাতেহায় অঢেল খরচ করা, তাজিয়া তৈরি করা প্রভৃতি এবং এসব রেওয়াজ একেবারে বন্ধ করে দিতে প্রাণপণ চেষ্টা করা। একজন প্রথমে এসব রেওয়াজ ত্যাগ করবে এবং তারপর অন্য সব মুসলমানকে শেখাবে যে, তার পক্ষে অবশ্য কর্তব্য হচ্ছে রসুলের হুকুম ও আল্লাহর বিধান মেনে চলা। যা করতে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন শুধু তাই পালন করা এবং যা করতে নিষেধ করেছেন তা থেকে দূরে থাকা। এসব আমার মনে বিশেষ ভাবে গেথে গেছে; অতএব যারা আল্লাহর সন্ধান করে, তাদের চোখের সামনে এসব তুলে ধরা দরকার এবং পরস্পর হাতে হাত মিলিয়ে এসব আঁকড়ে থাকা উচিত; আর বিশেষ ভাবে উচিত শেখ মুহম্মদ হোসেনের হাতে হাত মিলিয়ে থাকা, কারণ তিনি আমার হাতে হাত মিলিয়ে এসব পালন করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছেন। আমিও তাকে তোমাদের কাছে সুপারিশ করছি যে, তিনি আমার হয়ে তোমাদিগকে হেদায়েত বা সৎ শিক্ষা দিবেন। শেখ মুহম্মদ হোসেনের উচিত উপরের বিধি মেনে চলা, এসব বিধান সম্যকভাবে পালনকাজে আল্লাহ্র দিকে তনুমন নিয়োজিত করা; শিরক ও বেদাতের যে সব মালিন্য দেহে জমে আছে, সেসব একেবারে মুছে ফেলা তার হাতে হাত মিলিয়ে একযোগে কাজ করার প্রতিজ্ঞা গ্রহণে সকলকে আহ্বান করতে চেষ্টা করা।“
শিরক ও বেদাতের প্রতিই ছিল তার তীব্র ঘৃণা। তিনি তার অনুগামীদের নিষেধ করেছিলেন, যারা এর কোন একটিতে অনুরক্ত, তাকে বিবাহ না করতে। তাদের অবশ্য কর্তব্য হচ্ছে, প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার করা; কারণ আল্লাহ্ আদেশ দিয়েছেন, “তোমরা সাবধান হয়ে যাও, যেহেতু হেদায়েত করলে মোমেন বান্দার উপকার হয়”। আল্লাহ্ আর বলেছেন, “তোমরা মানুষকে হেদায়েত করে যাও, যেন তার দ্বারা তাদের উপকার হয়। যারা আল্লাহ্কে ভয় করে, তাদের সতর্ক করা উচিত; কিন্তু কট্টর কাফেররা এসব থেকে পালিয়ে যাবে, আর তারা দোযখের ভীষণ আগুনে নিক্ষিপ্ত হবে। সেখানে তারা মরবেওনা, বাচবেওনা। যেখানে অনুরোধে কাজ হয়না, সেখানে ত তরবারি আছেই, যার ব্যাবহার শুধু উপযুক্ত নয়, দরকারী বলে মনে করা হত। আর এসব মতবাদ শুধু ফাকা আওয়াজ হিসেবে মনে হত না। আমরা দেখেছি সৈয়দ আহমদ তার কর্মজীবনের শেষের দিকে পেশোয়ারের একটি বড় মাজার ভেঙ্গে দিয়েছিলেন, আর তার অনুগামীরা পাটনায় তলোয়ার হাতে নিয়ে একটা মুহররমের মিছিল আক্রমন করেছিল ও তাজিয়া নষ্ট করে দিয়েছিল।
সব মুসলমানই স্বীকার করে যে, শিরক মহাপাপ, অতএব সৈয়দ আহমদের মতবাদ এমন কিছু নতুন শিক্ষা দেয়নি। কিন্তু তার শিক্ষার ধরনটা ছিল আপত্তিকর। হানাফীরা বিশ্বাস করে যে, তখনই শিরক মহাপাপ করা হয়, যখন কেউ সজ্ঞানে আল্লাহ্ ব্যাতিত অন্য কারও উপর ইলাহিগুণ আরোপ করে। কিন্তু নয়া সংস্কার পন্থীরা আর বেশি দূর গিয়েছিল এবং তুচ্ছ ব্যাপারকেও তার সঙ্গে যুক্ত করে ফেলাছিল। যেমন, আল্লাহ্কে বলা হয় সবকিছুর দাতা [বখশ দেনেওয়ালা]; অতএব যদি কারও নামের একাংশ হয় ‘বখশ’ তাহলে তার অন্য অংশটা আল্লাহ্র নিরানব্বইটা নামের মধ্যে একটা হতেই হবে। ইলাহী বখশ বেশ শুদ্ধ নাম, কিন্তু ছেলের নাম মুহম্মদ বখশ রাখা হলে আল্লাহ্র সিফত বাগু মুহম্মদের উপর আরোপ করা হয়, এবং তার ফলে নামদাতা এ দুনিয়া থেকে কাফের হিসেবে মরণ বরন করে এবং পরকালে অনন্ত শাস্তি ভোগ করে। এরকম বহু উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। বেদাত আমদানী সম্মন্ধে রসূলের একটি হাদীসের নজীর দেয়া হয় যে, তিনি বলে গেছেন, যে কেউ ইসলামে নতুনত্ব [বেদাত] আমদানী করবে সে হবে অভিশপ্ত। মুসলমান আলেমদের মতানুযায়ী এই হাদিসটির কতকটা আক্ষরিক ব্যাখ্যা করা হয়। তারা মনে করেন যে, মুহম্মদের জীবদ্দশায় আরবে যেসব রীতি- নীতি ছিল, এই হাদিসটির দ্বারা তার রদবদল একেবারে নিষিদ্ধ হয়ে গেছে; অতএব তাদের সিদ্ধান্ত যে, ধর্মের বিপরীত কোন পরিবর্তন করা চলেনা। সভ্যতার উন্নতির জন্য কিংবা ইসলামের মহিমার জন্য নতুনত্তের আমদানী নিষিদ্ধ নয়। যেমন, একধরনের নতুনত্ব হচ্ছে, আরবী ব্যাকরণ পড়া এবং আরবী অভিধান সম্পাদনা করা কিংবা তার ব্যাবহার করা, কিন্তু কুরআনের মর্মার্থ গ্রহণে তা অত্যন্ত দরকারী। আর এক রকম হচ্ছে, স্কুল- কলেজ স্থাপন করা ধর্মীয় শিক্ষার জন্য, এটা বাধ্যতামূলক না হলেও অনুসরণ করা উচিত। আরও একপ্রকার বেদাত দূষণীয় নয়, যেমন মুহম্মদের চেয়ে ভাল খাওয়া ও পরা। কিন্তু একরকম বেদাত, মসজিদে ছবি টাঙ্গানো নিষিদ্ধ। কিন্তু সৈয়দ আহমদ বেদাত শব্দের এই ব্যাখ্যা দেননি। তিনি মনে করতেন, তিনি রসূলের কদমে কদম মিলিয়ে চলেছেন, আর এজন্য চেষ্টা করতেন যে, হিজরির প্রথম শতকের রীতি- নীতি তের শতকের মানুষের দিশারী হবে। যেসব রেওয়াজ, যতোই নির্দোষ হক না কেন,ধর্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হলেই তা মুহম্মদ ও তার পরবর্তী খলীফাদের আমলে চলিত না থাকলে তিনি সোজাসুজি বর্জন করতেন। মোমেন মুসলমানদের অবশ্য কর্তব্য হল, উপরোক্ত যুগের লোকের জীবন নিখুঁতভাবে অনুসরণ করা। ধর্মের জন্য মাত্রাধিক উৎসাহ, তার সদুদ্দেশ্যপ্রণোদিত হলেও দূষণীয়;আবার তেমনি ধর্মের জন্য উৎসাহ না থাকাও পাপ। যতোই তুচ্ছ হোক, কোন বেদাতই নিষেধাজ্ঞা থেকে বাদ দেওয়া হতোনা। শোকের চিহ্ন হিসেবে কালো, সবুজ কিংবা নীল বস্ত্র পরা, পাকা কবর তোলা; উট, খচ্চর কিংবা গাধায় চড়তে লজ্জাবোধ করা; কাউকে অত্যধিক সম্মান দেখানো, কিংবা তা না পাওয়ার জন্য বিরক্তবোধ করা এ সমস্তই ধর্মের বড় রকম বিরুদ্ধতা হিসেবে গণ্য করা হত এবং অনুরোধে বা বল প্রয়োগে বন্ধ করে দেওয়া হতো।