ইসলামী ঐক্য ইসলামী আন্দোলন
অধ্যাপক গোলাম আযম
তোমাদের মধ্যে যারা ঈমানদার ও সৎকর্মশীল তাদেরকে দুনিয়ার খেলাফত দান করার ওয়াদা আল্লাহ করেছেন। (নূর-৫৫)
প্রকাশকের কথা
অধ্যাপক গোলাম আযম ইসলামী আন্দোলনের একজন অকুতভয় নির্ভীক সেনানায়ক। বর্তমান বিশ্বে যে কয়জন ইসলামী চিন্তাবিদ আছেন তাঁদের মধ্যে তিনি অন্যতম। আল্লাহর যমীনে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠা করাই তাঁর জীবনের যাবতীয় কর্মতৎপরতার মূল লক্ষ্য। তাঁর মন-মেধা, চিন্তা-ভাবনা একমাত্র সে উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হচ্ছে। এ দুনিয়ায় আল্লাহর প্রেরিত কোন নবী রাসূলই সম্পূর্ণ একা অপরের সহায়তা ছাড়া আল্লাহর দ্বীন কায়েমের প্রচেষ্টায় কামিয়াব হয়নি।
আল্লাহর দ্বীনকে মানুষের মনগড়া সকল বাতিল মতবাদের উপর বিজয়ী করার লক্ষ্যে অধ্যাপক গোলাম আযম আল্লাহর দ্বীনের সকল সৈনিকগণকে নূন্যতম কর্মসূচীর ভিত্তিতে একই প্লাটফরমে সমবেত হয়ে কাজ করার আহবান জানিয়েছেন। “ইসলামী ঐক্য ইসলামী আন্দোলন” পুস্তিকার এটাই প্রধান আলোচ্য বিষয়। আল্লাহর দ্বীনের সৈনিকগণ এ পুস্তিকা পাঠে যদি ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের কোন কর্মসূচী গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ হন তবেই লেখক হিসেবে ইসলামী আন্দোলনের এ মহান চিন্তা নায়কের উদ্দেশ্য এবং প্রকাশক হিসেবে আমার মনোবাঞ্চা পূরণ হবে। আল্লাহ আমাদের সকলকে ইসলামের বিজয়ের উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধ হবার তৌফিক দান করুন। আমীন।
-প্রকাশক
একাদশ সংস্করণের ভূমিকা
১৯৭৮ সালের জুলাই মাসে আল্লাহ্ তায়ালা প্রায় ৭ বছরের দীর্ঘ বাধ্যতামূলক নির্বাসন জীবনের অবসান ঘটিয়ে আমাকে দেশে ফিরে আসার সুযোগ দান করেন। ঐ বছর সেপ্টেম্বর মাসেই এ পুস্তিকাটি রচনা করি এবং নভেম্বর মাসে তা প্রকাশিত হয়। ১৯৯৬ সালে বইটি দশম বার মুদ্রিত হয়। বইটি সাময়িক প্রয়োজন পূরণের উদ্দেশ্যে লেখা হলেও ঐ প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়নি বলে প্রকাশক আবার ছাপাবার ব্যবস্থা নিয়েছেন। ৩৬ বছর আগে লেখা ভূমিকাটির বদলে বর্তমান প্রেক্ষিত অনুযায়ী নতুন করে লিখছি। বেইটি বিভিন্ন জায়গায় তথ্যগত সংশোধন করতে হয়েছে সময়ের পরিবর্তনের কারণে।
বইটির আলোচ্য বিষয় আমার প্রবাস জীবনের চিন্তার ফসল। আমি পাকিস্তান আন্দোলনের ছাত্র কর্মী ছিলাম। মিঃ গান্ধি ও পন্ডিত নেহরুর নেতৃত্বে পরিচালিত ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের “ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ” ও ‘সর্ব ভারতীয় একজাতীয়তার’ শ্লোগান মুসলিম জাতির স্বার্থের সম্পূর্ণ বিরোধী বিবেচনা করে কায়েদে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ ইসলামী আদর্শ ও মসুলিম জাতয়তার ভিত্তিতে (টুনেশন থিওরী) ভারতকে বিভক্ত করে পাকিস্তান নামে পৃথক একটি রাষ্ট্র কায়েমের জন্য বৃটিশ সরকারের নিকট দাবী জানায়।
১৯৪৫ ও ’৪৬ সালে জনগণের সরাসরি ভোটের মাধ্যমে এ বিষয়ে মুসলিম জনগণ পাকিস্তানের পক্ষে সুস্পষ্ট রায় দেবার ফলে ইংরেজ সরকার ও কংগ্রেস দল ভারত বিভাগকে মেনে নিতে বাধ্য হয়।
দ্বি-জাতিত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান কায়েম হবার পর শাসকগোষ্ঠী ইসলামী আদর্শের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে। ফলে মুসিলম জাতীয়তার ভিত্তি দুর্বল হতে থাকে। দেশের ইসলামী শক্তি বিছ্ছিন্ন অবস্থায় থাকায় ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী, বাংগালী জাতীয়তাবাদী ও সমাজতন্ত্রীরা রাজনৈতিক ময়দান দখল করে নেয়। যদি রাজনীতিতে ইসলামী শক্তি ঐক্যবদ্ধ থাকতো তাহলে ইসলাম বিরোধী শক্তি একচেটিয়া ভাবে নেতৃত্ব দখল করতে পারতো না।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে পৃথিবীর মানচিত্রে আসন লাভের পর ঐ ইসলাম বিরোধী শক্তিই ক্ষমতা লাভ করে। তাদের ইসলাম বিরোধী অপতৎপরতা সম্পর্কে যতই অবগত হচ্ছিলাম, ততই অন্তরে চরম অস্থিরতা বোধ করছিলাম।
৭২ সাল থেকে ৭৭ সাল পর্যন্ত রমাদান ও ঈদ উপলক্ষে মক্কা শরীফে ও মদীনা শরীফে প্রতি বছরিই যাবার সৌভাগ্য হয়েছে। দোয়া কবুল হবার বিশেষ জায়গায় হাজির হলে বাংলাদেশের ইসলামী শক্তিগুলোর ঐক্যর জন্য মহান মাবুদের দরবারে কাতরভাবে দোয়া করতাম। আমার মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মিল যে, বেদ্বীনদের শাসন থেকে মুক্তির একমাত্র পথই হলো ইসলামী ঐক্য।
মদীনা শরীফের মসজিদে “রাওদাতুল জান্নাত” (বেহেশতের বাগান) হিসাবে যে জায়গাটি রসূল (সা) চিহ্নিত করে দিয়েছেন সেখানে বসে আল্লাহর দরবারে বহুবার ধরণা দিয়েছি। ঐক্য কিভাবে সম্ভব হতে পারে এ বিষয়ে চিন্তা করেছি। আর এ বিষয়ে আল্লাহ তায়ালার সাহায্য চেয়েছি। ৭৬ সালে মদীনা শরীফ্টে ঐক্যের ফর্মূলা সম্পর্কে একটা সুস্পষ্ট ধারণা সৃষ্টি হলো। ১৯৭৭ সালে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী সাহেবের নিকট লন্ডনে আমার ঐ চিন্তার ফসল প্রকাশ করি। তিনি খুব উৎসাহ দেখালেন।
দেশে ১৯৭৮ সালে এসে ঐ চিন্তার ফসলিই এ পুস্তিকাতে লিখি। উলামা ও মাশায়েখগণের নিকট বইটি পৌঁছাবার ব্যবস্থা করা হয়। প্রথমে যাঁরা সাড়া দেন তারা হলেন চট্টগ্রামের বায়তুশ শরফের পীর সাহেব মাওলানা আব্দুল জব্বার, জরমোনাইর পীর সাহেব মাওলানা সাইয়েদগ ফযলুল করীম, ঢাকার প্রখ্যাত মুফাস্সিরে কোরআন মাওলানা সাইয়েদ মুহাম্মদ মাসুম ও মাওলানা সাইয়েদ কামাল উদ্দীন জাফরী। মাওলানা সাঈদীতো আগেই একমত হয়েছেন। তাঁরা একটি কমিটি গঠন করে উলামা ও মাশায়েখগণের সাথে যোগাযোগের ব্যবস্থা করেন। তিন বছর যোগাযোগের পর ১৯৮১ সালের ডিসেম্বরে টি এন্ড টি কলোনী মসজিদে একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং “ইত্তেহাদুল উম্মাহ্” নামে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন কায়েম করা হয়। ১৯৮২ সালের ডিসেম্বরে “ইত্তেহাদুল উম্মাহর” প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী সম্মেলনে খতীবে আযম নামে খ্যাত মাওলানা সিদ্দীক আহমদসহ অনেক নতুন ব্যক্তি এ সংগঠনে শামিল হোন।
এ ঐক্য সংগঠন জনগণের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগায় । জিলা শহরগুলোতে ইত্তেহাদুল উম্মাহর সম্মেলন উপলক্ষে স্থানীয়ভাবে যে তহবিল সংগ্রহ হতো তাতে উদ্বৃত্ত অংক কেন্দ্রে জমা হতো। ঢঅকা শহরে বিরাট এক অফিস নিয়ে এ সংগঠনের সম্প্রসারণের ব্যবস্থা করা হগয়।
এ প্লাটশরমটির অগ্রগতি দেখে আশা করা গিয়েছিল যে ক্রমে সকল ইসলামী শক্তির ঐক্যমঞ্চ গড়ে উঠবে। ইত্তেহাদুল উম্মাহ একটি অরাজনৈতিক সংগঠন হিসাবে ঘোষণা দিয়েই যাত্রা শুরু করে। হয়তো ভবিষ্যতে যথাসময়ে রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ করা যেতো। কিন্তু ১৯৮৭ সালে মাজলিসে সাদারাতের (সভাপতি মন্ডলী) এক বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ কতক সদস্যের অনুপস্থিতিতে অতি উৎসাহী সদস্যদের প্রচেষ্টার “ইলামী শাসনত্রন্ত্রেরঃ দাবীতে আন্দোলন করার সিদ্ধান্ত গ্রহীত হয়। অথচ রাজনৈতিক কর্মসূচী গ্রহণ করার ব্যাপারে মাজলিসে সাদারাতের পূর্ণাঙ্গ বৈঠকে আলোচনা হওয়া প্রয়োজন ছিল। ফলে সদস্যগণের মধ্যে ভুল বাঝাবুঝির পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে যায়। এরপর ইত্তেহাদুল উম্মাহর গতি হঠাৎ করেই থেমে গেল।
১৯৯৭ সালে ঝালকঠির মাওলানা আযীযুর রহমান (কায়েদ সাহে) ও ফুরফুরা শরীফেরর পীর সাহেবের উদ্যোগে ঐক্য প্রচেষ্টা নতুন করে শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত ২০০০ সালেরর অক্টোবর মাসে মুহতারাম খতীব মাওলানা ওবায়দুল হককে সভাপতি, মাওলানা মহীউদ্দীন খানকে সহ-সভাপতি, মাওলানা মুফতী সাঈদ আহমদকে মহা-সচিত এবং মাওলানা হারুনুর রশীদ খানকে যুগ্ম-মহাসচিব মনোনীত করে জাতীয় শরীয় কাউন্সিল নামে একটি ঐক্যমঞ্চ গঠন করা হয়। এ মঞ্চে সকল ইসলামী মহলকে শরীক করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
পাকিস্তানে দেওবন্দী, বেরেলভী, আহলি হাদীস, জামায়াতে ইসলামী, এমনকি শিয়া সত “মুত্তাহিদা মাজলিসে আমল” নামক সর্বদলীয় ইসলামী ঐক্যজোট ২০০২ সালের অক্টোবরে জাতীয় নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করে বিরাট সাফল্য লাভ করে। জাতীয় সংসদে এ ইসলামী ঐক্যজোট প্রধান বিরোধী দলের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। সীমান্ত প্রদেশে এ জোটের সরকার কায়েম আছে এবং বেলুচিস্তানে এ জোট কোয়ালিশন সরকারে শরীক রয়েছে।
এ জাতীয় ঐক্য গঠন করা গেলে বাংলাদেশেও ইসলামী শক্তি রাজনৈতিক ময়দানে বিরাট ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হতে পারে।
ঐক্যের পরিবেশ সৃষ্টিতে এ বইটি বিশেষ অবদান রাখবে বলেই আমার আশা।
গোলাম আযম
রবিউল আউয়াল, ১৪২৫
এপ্রিল, ২০০৪