রচনার উদ্দেশ্য
বাংলাদেশে যারা যেভাবে যতটুকু দ্বীনের খেদমত করেছেন তাঁদের মধ্যে ঐক্যবোধ সৃষ্টি করা, মুখলিসীনে দ্বীন ও খাদেমে দ্বীনদের মধ্যে পারস্পরিক জানাজানি ও মহব্বতের পরিবেশ সৃষ্টি করে ইসলামী শক্তিকে সুসংহত করা এবং ইসলামী আন্দোলনের সকল কর্মীকে এ ঐক্য সৃষ্টির জন্য উদ্বুদ্ধ করাই এ পুস্তিকার প্রধান উদ্দেশ্য।
দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হলো বাংলাদেশে ইসলামী আন্দোলনকে বিজ্ঞান সম্মত কর্মসূচী গ্রহণে সহায়তা করা এবং তৃতীয় বিশ্বের বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষিতে ও বাংলাদেশের আভ্যন্তরীর পরিস্থিতি বিবেচনা করে এমন একটি কর্মসূচী রচনার প্রস্তাব পেশ করা যা সার্বজনীনভাবে যে কোন ইসলামী দলই বিবেচনা করে দেখতে পারেন।
প্রসংগক্রমে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইসলামী আন্দোলন গোটা বিশ্বেই বর্তমান এবং কতক দেশে ইসলামী সরকারও কায়েম আছে। বাংলাদেশের মুসলমানদের জন্য এটা অত্যন্ত উৎসাহের ব্যাপার যে, তারা ইসলামের ব্যাপারে ঐ বিশ্বব্যাপী আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন নয়।
৭ বছর (২৩-১১-৭১ থেকে ১০-০৭-৭৮) বিদেশে তাকতে বাধ্য হওয়ায় দুনিয়ার বহুদেশ দেখার এবং মুসলি দেশগুলোতে ইসলামী আন্দোলনের অবস্থা গভীরভাবে পর্যালোচনার সুযোগ পেয়েছি। একটি বিষয় আমাকে অত্যন্ত উৎসাহিত করেছে যে, আল্লাহর প্রতি ঈমান, রাসূলের প্রতি মহব্বত ও ইসলামের জন্য দরদের দিক দিয়ে বাংলাদেশের মুসলিম জনগণ অন্য কোন মুসলিম দেশের পেছনে নয়। এ দেশে ইসলামের খাদেমগণের মধ্যে ঐক্য সম্ভব হলে মুসলিম বিশ্বে বাংলাদেশ উচ্চ মর্যাদার আসন লাভ করবে সে বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।
বাধ্য হয়ে বিদেশে পড়ে না থাকলে যে জন্মভূমির মহব্বত এত তীব্রভাবে অনুভব করা যায় না সে কথা দেশে থাকতে কোন দিন টের পাইনি। মুসলিম হিসেবে জন্মভূমির মহব্বত এ জন্যও বেশি বোধকরা স্বাভাবিক যে, আমার মনিব আল্লাহ পাক নিজ ইচ্ছায় আমাকে এদেশে পয়দা করেছেন। আমি পরিকল্পনা করে এ দেশে পয়দা হইনি। সুতরাং আমার প্রিয় জন্মভূমিতেই দ্বীনের খেদমত করা আমার প্রধানতম কর্তব্য। এ অনুভূতির ফলেই বাংলাদেশের ব্যাপারে বিদেশে থেকেও চিন্তা-ভাবনা করতে বাধ্য হয়েছি। এমন কি কোথাও নিজকে প্রতিষ্ঠিত করার খেয়াল প্রর্যন্ত হয়নি। এ বিশ্বাস কখনও দূর্বল হয়নি যে, আল্লাহ পাক যখন বাঁচিয়ে রেখেছেন তখন একদিন জন্মভূমিতে নিয়ে খেদমতের সুযোগও দিবেন। বিদেশে থাকাকালে বাংলাদেশে দ্বীনের খেদমত সম্পর্কে যা ভাবতাম তার একাংশ এ পুস্তিকার মাধ্যমে প্রিয় দেশবাসীর বিবেচনার জন্য পেশ করলাম।
এ কথা প্রকাশ করা হয়তো অপ্রাসাংগিক হবে না যে, বিদেশে পড়ে থাকা অবস্থায় একটা বিষয় মনে সবচেয়ে বড় সান্তনার কারণ ছিল। আমি দেশ থেকে পালিয়ে যাইনি বা হিজরতের কোন চিন্তাও করিনি। ঘটনাক্রমে আমার ইচ্ছার সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে আমি বিদেশে রয়ে গেলাম। ১৯৭১ সালের ২২শে নভেম্বর জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করি। ৩রা ডিসেম্বর করাচী থেকে রওয়ানা ঢাকা রওনা হই। দেশের কাছে পৌছার পর ঢাকায় ভারতীয় বিমান বাহিনীর আক্রমণের ফলে আমার বিমান জিদ্দায় যেয়ে আশ্রয় নেয়। যুদ্ধাবস্থার দরুন করাচীও ফিরে যেতে পারিনি। এভাবেই বিদেশে রয়ে গেলাম। পরে পত্রিকায় খবর দেখলাম যে মুজিব সরকার আমার নাগরিকত্ব বাতিল করেছে।
এ দেশেই আমার জন্ম। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পাসপোর্ট ও ভিা পদ্ধতি চালু হবার আগে ১৯৫০ সালে একবার তাবলীগ জামায়াতের সাথে এক সফরে দিল্লী গিয়েছিলাম এবং আর একার ১৯৫২ সালে কোলকাতা যাবার সুযোগ হয়েছিল।
এ সব কথা প্রকাশ করার উদ্দেশ্য এই যে, আমার জন্মভূমির সাথে সম্পর্কটা এমন গভীর যে, বাকী জীবনটা এ দেশে আল্লাহর দ্বীনের খেদমতে কাটাবার চিন্তা ছাড়া বিদেশে ‘আরাম’ করর সামান্যতম আগ্রহও নেই। আল্লাহ পাক আমাকে তাঁর দ্বীনের খেদমতে মৃত্যু পর্যন্ত যেন নিয়োজিত রাখেন এ দোয়াই সবার নিকট চাই এবং এ কারণেই এ বিষয়টা এখানে উল্লেখ করতে বাধ্য হলাম।
বাংলাদেশের পটভূমি ও ইসলামের সম্ভাবনা
পাকিস্তান আমলে কেন্দ্রীয় সরকারের কুশাসন, ইসলামের নামে অনৈসলামী কার্যকলাপ, গণবিরোধী নীতি ও রাজনৈতিক সমস্যা সামরিক পদ্ধতিতে সমাধানের অপচেষ্টার ফলে এ দেশের জনগনের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। সে সুযোগে এক শ্রেণীর রাজনীতিক ও ইসলাম বিরোধী মতাদর্শের বাহকগণ বাংলাদেশে আন্দোলনকে এমন খাতে পরিচালনার ব্যবস্থা করেন যার ফলে এদেশে ধর্ম নিরপেক্ষতার মুখোশ দ্বীন ইসলামকে অন্যান্য ধর্মের মতই নিছক পূজা পাঠ জাতীয় এবং ব্যক্তি জীবনে সীমাবদ্ধ ধর্মে পরিণত করার অপচেষ্টা চলে। ‘ইসলাম’ ‘মুসলিম’ শব্দ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যলয় এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে উৎখাত করা হয়। পত্র-পত্রিকায় ‘দাউদ হায়দার’ জাতীয় ধর্মদ্রোহীদের লেখা ও কবিতায় মুসলমানদের প্রাণধিক প্রিয় নবীর (সা) সম্পর্কে চরম আপত্তিকর কথা পর্যন্ত প্রকাশ পায়।
বাংলাদেশের মুসলমানদের ঈমান তখন এক বিরাট পরীক্ষার সম্মুখীন হয়। তারা এ কঠিন পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। এভাবেই মুসলিম চেতনাবোধ অনৈসলামী শক্তির বিরুদ্ধে দানা বাঁধতে থাকে। ১৯৭৫ সালে আগষ্ট বিপ্লব এবং সাতই নভেম্বরের সিপাহী জনতার স্বতঃস্ফূর্ত ইসলামী জাগরণ বাংলাদেশের আদর্শিক পটভূমিকে সম্পূর্ণরূপে বদলে দেয়। এরই স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া ক্রমে ক্রমে চরম ধর্মবিরোধী শাসনতন্ত্রের ধর্মমূখী সংশোধন চলতে থাকে। বাংলাদেশ আন্দোলনের পটভূমি যেভাবেই রচনা করার চেষ্টা হোক না কেন, বর্তমানে ইসলামের নৈতিক শক্তি এতটা মজবুত যে, মুসলিম বিশ্বে বাংলাদেশের মুসলিম জনতা এখন আর অবহেলার পাত্র নয়। ইসলামের ভবিষ্যৎ অন্য কোন মুসলিম দেশ থেকে একানে যে কম উজ্জ্বল নয় এ কথা ক্রমে সুস্পষ্ট হচ্ছে। সরকারী পর্যায়ে ইসলামের যে অবস্থাই থাকুক, এ দেশের কোটি কোটি মুসলিমের সামগ্রিক চেতনায় ইসলামের প্রভাব ক্রমেই যে বৃদ্ধি পাচ্ছে তা স্বীকার না করে উপায় নেই।
১৯৭০ সালে জনগণ যাদের ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করেছেন তাদেরকে গণঅধিকার আদায়ের দায়িত্ব ও ক্ষমতা দেয়াই উদ্দেশ্য ছিল। ইসলামী আদর্শ ও মুসলিম জাতীয়তার উপর হস্তক্ষেপ করার কোন অধিকার তাদেরকে দেয়া হয়নি। সুতরাং যখন জনগণ দেখল যে, তাদের অধিকার আগের চেয়েও খর্ব করা হযেছে এবং জনসাধারণকে সরকারের গোলামে পরিণত করা হচ্ছে এমন কি মুসলিম জাতীয়তাবোধকে পর্যন্ত ধ্বংস করা হচ্ছে তখন সবাই চরম নৈরাশ্য ও ভীষণ অস্থিরতাবোধ করল। এরই ফলে ১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্ট সপরিবারে দেশের প্রেসিডেন্ট হত্যার মতো বেদনাদায়ক ঘটনার দিনটিকেও জনগণ এত উৎসাহের সাথে নাজাত দিবস হিসেবে গ্রহণ করেছিল।
বাংলাদেশের ইসলামী শক্তির মজবুত ভিত্তি
ইসলাম নিজস্ব গতিতেই ইসলামের প্রথম যুগে আরব ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে সমুদ্র পথে চাটগাঁয়ে মাধ্যমে এ’দেশর পৌছে। এর পর যুগে যুগে মুবাল্লিগ, অলী ও দরবেশগণের আদর্শ জীবন এদেশের জনগণকে ইসলাম গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে। রাজ্য বিজয়ীদের চেষ্টায় এদেশে ইসলাম আসেনি; বরং ইসলামের প্রসারের ফলেই এখানে মুসলিম শাসনের পত্তন হয়।
এ কথা সত্য যে দ্বীন ইসলামের সঠিক ও ব্যাপক জ্ঞানের অভাবে এ দেশের মুসলমানদের মধ্যে তাদের অমুসলিম পূর্ব-পুরুষদের অনেক কুসংস্কার, ভন্ড পীর ও ধর্ম ব্যবসায়ীদের চালু করা শিরক-বিদায়াত, প্রতিবেশী অন্যান্য ধর্মের কতক পারিবারিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক রীতিনীতি বিভিন্ন রূপে কম-বেশি চালু রয়েছে। কিন্তু এদেশে অশিক্ষিত মুসলমানদের মধ্যে ও আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস নবীর প্রতি মহব্বত এবং মুসলিম হিসেবে জাতীয় চেতনাবোধ এমন প্রবল রয়েছে যে, সকল রাজনৈতিক উত্থান-পতনের মধ্যেও কোন কালেই তা হারিয়ে যায়নি। বাংলাদেশ আন্দোলনের রাজনৈতিক তুফানে মুসলিম জাতীয়তাবোধ খত হয়ে গেছে বলে সাময়িকভাবে ধারণা সৃষ্টি হলেও এ দেশের মুসলিম জনতা ঐ চেতনার বলিষ্ঠ পরিচয় দিয়েছেন।
এ কথা যুগে যুগে প্রমাণিত হয়েছে যে, এদেশের জনগণ মনস্তাত্ত্বিক দিক দিযে ভাবপ্রবণ হবার ফলে কখনও কখন রাজনৈতিক গোলক ধাঁধাঁয় সাময়িকভাবে বিভ্রান্ত হতে পারে বা ভুল করতে পারে। কিন্তু চেতনাভাব কখন ইসলামী চেতনা ও মুসলি জাতীয়তাবোধকে তাদের জীবন থেকে মুছে ফেলতে দেয়নি। বাঙ্গালী জাতীয়তার মহাপ্লাবন এবং ধর্ম-নিরপেক্ষতার সরকারী অপচেষ্টা এ দেশের মুসলিম জাতীয়তাবোধের নিকট যেভাবে শোচনীয় পরাজয় বরণ করতে বাধ্য হয়েছে তা বাংলাদেশে ইসলামী শক্তির মজবুত ভিত্তির সুস্পষ্ট সন্ধান দেয়।
বাংলাদেশ এখন আর ‘বাঙ্গালী’ জাতির বাসস্থান নয়। বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ‘মুসলিম দেশ’ হিসেবে গৌরব বোধ করে। বাংলাদেশ ইসলামী সেক্রেটারীয়েটের মতো ‘বিশ্ব মুসলিম রাষ্ট্রসংঘের’ উল্লেখযোগ্য সদস্য হিসেবে প্রত্যেক ইসলামী পররাষ্ট্র মন্ত্রী সম্মেলনে উৎসাহের সাথে যোগদান করে। শাসনতন্ত্রের কলংকস্বরূপ রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে যে ‘ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদের’ উল্লেখ ছিল এ দেশের ইসলামী চেতনাবোধ তা বরদাশত করেনি বলে শাসনতন্ত্র থেকে এ ইসলাম বিরোধী কথাটি উৎখাত হয়ে গেছে।