বাংলাদেশে ইসলামের খেদমত
রাসূলুল্লাহ (সা)-কে শ্রেষ্ঠতম আদর্শ (উসওয়াতুন হাসান)মেনে যারা যেভাবে দ্বীন ইসলামের যতটুকু খেদমত করার জন্য ইখলাসের সাথে চেষ্টা করেন তারাই আহলে সুন্নাত আল জামায়াতের অন্তর্ভুক্ত। আপতঃ দৃষ্টিতে অনেক জামায়াত বা দলে তাদেরকে বিভক্ত মনে হলেও তারা সবাই আল জামায়াতে শামিল। কোন একটি দলের আল-জামায়াতের দাবীদার হয়ে আর সব দলকে আল-জামায়াত থেকে খারিজ ঘোষণা করার কোন অধিকার নেই।
আল্লাহর রাসূল(সা) যে আল-জামায়াতের পরিচালক ছিলেন সে জামায়াতে শামিল হওয়া ছাড়া মুসলমান থাকা সম্ভব ছিল না। কিন্তু তিনি দুনিয়া থেকে চলে যাবার পর তার উম্মতগণ দুনিয়াতে যত দলেই বিভক্ত হোক সবাইকে তাঁর আল-জামায়াতভুক্ত মনে করতে হবে। অবশ্য কোরআন ও সুন্নাহর-বিরোধী মত ও পথে যারা বিশ্বাসী তাদের কথা আলাদা।
এ কথা আমাদের সবাইকে মেনে নেয়া উচিত যে, আল্লাহর রাসূলের পরিচালনায় ইসলামী জামায়াত যেরূপ নির্ভুল ও সব রকম ত্রুটি থেকে পাক ছিল নবীর পর উম্মত দ্বারা পরিচালিত কোন জামায়াত তেমন নিখুঁত হতে পারে না। শুধু তাই নয়, রাসূল (সা) যেমন দিনের পূর্ণ নমুনা ছিলেন তেমন সর্ব গুণের সমন্বয় আর কারো মধ্যে সম্ভব নয়। তাই রাসূল (সা)- কে আদর্শ মেনে যারা ইখলাসের সাথে তাঁকে অনুকরণ ও অনুসরণ করতে চেষ্টা করেন তাঁরাও সকল বিষয়েই তাঁকে পূর্ণরূপে অনুকরণ করতে সক্ষম নন। কেউ রাসূল (সা)-এর আধ্যাত্মিক দিকে এত বেশী মন দেন যে অন্যান্য ক্ষেত্রে মনোযোগ দেয়া সম্ভব হয় না। কেউ রাসূল (সা) আনীত দ্বীনী ইল্মের প্রসারে এমন ব্যস্ত যে, অন্য কিছু করার মোটেই অবসর পান না। কেউ আবার যিকরের প্রতি এমন আকৃষ্ট যে অন্য কিছুতে তেম মজা পান না। কেউ রাসূল (সা)-এর সমাজ সংস্কারমূলক কাজের উপর এতটা গুরুত্ব দান করেন যে, অন্যান্য দিকে মনোযোগ কম হয়ে যায়।
ইসলামের আলোকে সমাজ গড়ার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন প্রকার জামায়াত গড়ে উঠে। কেউ আল্লাহ ও রাসূল (সা)-এর আনুগত্য এবং আখেরাতের কামিয়াবীর জযবা ব্যক্তি জীবনে সৃষ্টি করার কাজে নিয়োজিত। কেউ ব্যক্তি চরিত্র গঠনের সাথে সাথে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ও ইসলামী সংস্কারমূলক কাজ করা জরুরী বিবেচনা করেন। কেউ মসজিদ তৈরি বা এর হেফাযত করাকেই বড় খেদমত মনে করেন। আবার কেউ সাংগঠনিক কাজে মন না দিয়ে ওয়েবের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে ব্যাপক ইলামী চেতনা ও জাগরণ সৃষ্টি করেছেন। কেই ফোরকানীয়া মাদরাসার মারফত শিশুদের কোরআন পাঠ শিক্ষা ও নামায শিক্ষা দানেই গোটা জীবন নিয়োজিত করেছেন। কেউ মাদরাসায় আজীবন মুহাদ্দিসের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। আবার কেউ মসজিদে মসজিদে কোরআন পাকের তফসীর করে দ্বীনের দায়িত্ব পালন করেছেন। কেউ ইসলামী সাহিত্য রচনা করে এবং কেউ তা প্রকাশ করে দ্বীনের খেদমত করেন।
এসবের প্রতিটি কাজই দ্বীনের সত্যিকার খেদমত। ইখলাসের সাথে সাধ্যমত যে যতটুকু করতে চেষ্টা করেছেন তা অবশ্যই আল্লাহ পাক কবুল করবেন এবং মুসলিম উম্মতও তার খেদমত দ্বারা উপকৃত হচ্ছে।
কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় সব ধরনের খেদমতকে আমরা সবাই উদারভাবে গ্রহণ করি না। যে যে ধরনের কাজ করেছেন সেটাকেই দ্বীনের আসল খেদমত মনে করেন এবং অন্যদের কাজকে কোন খেদমেই মনে করেন না। শুধু তাই নয়, কেউ কেউ অপরের কাজের কোন কোন দোষকে বড় করে দেখিয়ে তাদের বিরুদ্ধে প্রচারে লেগে যান। কারো কারো এ জাতীয় কার্যকলাপ থেকে আমার মনে হয় যে, দ্বীনের প্রকাশ্য দুশমনদের বিরুদ্ধে কোন কিছু বলারও তাদের অবসর নেই। কোন কোন দ্বীনের খাদেম অন্য কোন দলের বিরুদ্ধে প্রচারেই চরম ব্যস্ত এসব কারণেই এ দেশে বিপুল ইসলামী শক্তি থাকা সত্ত্বেও ইসলাম-বিরোধী শক্তির তুলনায় ঐক্যের অভাবে মুসলিম শক্তি দুর্বল হয়ে আছে।
অথচ দেশের ‘মুখলিসীনে দ্বীন’ যদি ঐক্যবদ্ধ হয় তাহলে এদেশে ইসলামের পথ রোধ করার সাহসও কেউ করবে না। এ ঐক্যের ভিত্তি রচনা করতে হবে দ্বীনের সব খাদেমকে দুটি নীতি মেনে নিতে হবে:
এক : যে যতটুকু পারেন বুঝেন দ্বীনের খেদমত করে যাবেন। কিন্তু কোন দ্বীনী জামায়াত বা কাজের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বা গোপনে প্রচার করবেন না। যদি কখনো কোন জামায়াত বা খেদমত সম্পর্কে আলোচনার প্রয়োজন হয় তাহলেও শ্রোতার মনে বিরূপ ধারণা সৃষ্টির চেষ্টা না করে দরদী মন নিয়ে কথঞা বলবেন। তাদের কোন ত্রুটি বা ‘কমী’ আছে মনে করলে সংশোধনের নিয়তে পরামর্শ দিতে পারেন।
দুই : দ্বীনের যত রকম খেদমত হচ্ছে তা যে নিজ নিজ ক্ষেত্রে একে অপরের সহায়ক ও পরিপুরক সে কথা বুঝবার চেষ্টা করা উচিত। অপরের সম্পর্কে সরাসরিভাবে না জেনেই বিরোধী কোন কথা শুনে বিরূপ ধারণা করা ঠিক নয়। যারা যে ধরনের খেদমতে নিয়োজিত সেটাকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মনে করাই স্বাভাবিক। এ গুরুত্ববোধ ব্যতীত নিষ্ঠার সাথে কাজ করা অসম্ভব। কিন্তু অন্যান্য খেদমতকে তুচ্ছ জ্ঞান করা অন্যায়। কার খেদমত কত বড় তা একমাত্র আল্লাহ পাকই বিবেচনা করবেন।
দ্বীনের খাদেমগণের মধ্যে এ ধরনের উদার মনোভাব সৃষ্টির উদ্দেশ্যে কয়েকটি গঠনমূলক পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে :
এক : প্রত্যেক দলেই কিছু উদারমনা লোক পাওয়া যায়। তারা সক্রিয় ভূমিকা নিয়ে নিজেদের সহকর্মীদের মনের সংকীর্ণতা দূর করার চেষ্টা করতে পারেন।
দুই : এক দলের উদারপন্থীগণ অপর দলের উদারপন্থীদের সাথে সহযোগিতা করে উভয়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি করতে পারেন।
তিন : নির্দলীয় কতক লোক উদ্যোগী হয়ে সব দলের মধ্যে মহব্বত ও সহযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারেন। এ কাজটি যে দ্বীনের কত বড় মহান খেদমত সে কথা যাদেরকে বুঝবার তৌফীক আল্লাহ পাক দিয়েছেন তাঁরা অবশ্যই চেষ্টা করেন।
বাংলাদেশে দ্বীনের খেদমতে নিয়োচিত প্রতিষ্ঠান ও জামায়াতগুলোর তালিকা নিম্নরূপ :
১। মাদরাসা (ফোরকানিয়া, হাফিযিয়া, আলীয়া ও কওমী)
২। মসজিদ
৩। পীর-মুরীদী বা খানকাহ
৪। ওয়ায-নসিহত ও দারসে কোরআন
৫। ইসলামী সাহিত্য রচনা ও প্রকাশ
৬। তাবলীগ জামায়াত
৭। জামায়াতে ইসলামী
৮। ইসলামী রাজনৈতিক দলসমূহ
স্থানীয় বিভিন্ন ইসলামী প্রতিষ্ঠান
১০। ছাত্র ও ছাত্রীদের ইসলামী সংগঠন।
আমাদের দেশে এসবের মাধ্যমে দ্বীনের যে খেদমত হচ্ছে সে সম্বন্ধে অতি সংক্ষিপ্ত আলোচনা এখানে পেশ করা হচ্ছে যাতে এ সব মহান খেদমতের গুরুত্ব অনুভব করা সহজ হয়।
মাদরাসা
ফোরকানিয়া, হাফেযিয়া, কওমী ও আলীয়া)
দ্বীনী খেদমতের মধ্যে সর্ব প্রথমেই মাদরাসার স্থান। কারণ এ মাদরাসাগুলোই দ্বীন-ইসলামের আসল ভিত্তি-কোরআন ও হাদীসকে বাঁচিয়ে রেখেছে। ইংরেজ শাসকরা মুসলমানদের নিকট থেকে রাজ্য কেড়ে নিয়ে যখন এ দেশ থেকে ইসলামকে খতম করার মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল তখন গরীব মুসলমানদের সাহায্য ও দান নিয়ে ওলামাগণ যেভাবে মাদরাসা কায়েমের আন্দোলন করেছিলেন, সে ইতিহাস যারা জানেনা তারা মাদরাসার গুরুত্ব কি করে বুঝবে? সে ইতিহাস জানার সাথে সাথে মাদরাসাগুলো জাতিকে কি দিয়েছে সে কথা প্রতিটি মুসলমানের জানা কর্তব্য।
(ক) ফোরকানিয়া মাদরাসা : ফোরকানিয়া মাদরাসার দরুনই দেশের অশিক্ষিত মুসলমানদের বিরাট অংশ কোরআন শরীফ তেলাওয়াত ও নামায-রোযা শিখতে পেরেছে। দেশের সরকার যাদেরকে মাতৃভাষায় নিজের নামটুকু পর্যন্ত দস্তখত করা শেখাতে পারেনি তাদেরকে ফোরকানিয়া মাদরাসা আরবী ভাষার কোরআন শিক্ষা দিয়ে যে যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছে তা কে অস্বীকার করতে পারে? কোরআনের সাথে এটুকু সম্পর্কই জনগণের অন্তরে ঈমানের আলো জ্বালিয়ে রেখেছে।
(খ) হাফিযিয়া মাদরাসা : এ দেশে যে হারে হাফেয তৈরি হচ্ছেন আরব দেশগুলোতেও এত সংখ্যায় হাফেয পয়দা হচ্ছেন না। কোরআন মজীদের হেফাযতের এ বিরাট খেদমতের ফলে প্রতি রমযানে তারাবীহর মধ্যে সবাই অল্প সময়ে গোটা কোরআন শোনার মহা সৌভাগ্য লাভ করেছেন। ২০ রাকাত তারাবীহ পড়া কোরআনের লোভেই সহজ হয়েছে। খতমে তারাবীহ রমযানকে এক পবিত্র উৎসবে পরিণত করেছে।
(গ) কওমী বা খারেজী মাদরাসা : সরকারী কোন সাহায্য না নিয়ে শুধু মুসলমান জনসাধারণের নৈতিক ও আর্থিক সহযোগিতায় যারা কওমী মাদরাসাগুলো চালাচ্ছেন তারা যে কি কষ্ট করে দ্বীনের এতবড় খেদমত আঞ্জাম দিচ্ছেন তা ভুক্তভোগী ছাড়া অন্যেরা বুঝতে অক্ষম। এসব মাদরাসায় যে ওলামা বিশেষ করে মুহাদ্দিস ও মুফাসসির তৈরি হচ্ছেন, তাঁরা দেশের গৌরব এবং দ্বীনের মহান খাদেম। এ মাদরাসাগুলো না থাকলে মুসলমানদে দৈনন্দিন জীবনে দ্বীন-ইসলামের প্রয়োজনয় মাসলা-মাসায়েল শিক্ষার কি উপায় ছিল?
(ঘ) আলীয়া মাদ্রাসা : সরকারী অনমোদনে চললেও আলীয়া মাদরাসাগুলোও প্রধানত: মুসলমানদে সাহায্যেই গড়ে উঠেছে। স্কুল-কলেজকে যে হারে সরকার টাকা দেন, সে তুলনায় এসব মাদরাসা সামান্যই পেয়ে থাকে। এসব মাদরাসায় পড়া ছাত্রদের এক বিরাট অংশ আজ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রী নেবার উছিলায় ভর্তি না হলে আধুনিক শিক্ষালাভে নিয়োজিত ছাত্র সমাজ ইসলামের আলো থেকে একেবারেই বঞ্চিত থাকত। ফাযেল ও টাইটেল পাশ ছেলেরা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী দাওয়াত ও তাবলীগের যে কি বিরাট খেদমত করেছে তা অনেকেই হয়ত জানেন না। এদেরই একাংশ সরকারী অফিসে চাকুরীরত আছে বলে সেখানেও দ্বীনের আলো জ্বলে।
কওমী ও আলীয় মাদরাসাগুলো যদি ওলামাদের বিরাট বাহিনী পয়দা না করতো তাহলে দেশের লাখো লাখো মসজিদ কোথা থেকে ইমমা সংগ্রহ করতো? প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের আরবী ও ইসলামিয়াতের শিক্ষক কোথায় পাওয়া যেত? দেশের জনপ্রিয় বড় বড় ওয়ায়েজ, ইসলামী সাহিত্যিক ও আরবী থেকে বাংলায় ইসলামী কিতাবের অনুবাদক পাওয়া কি এসব মাদরাসা না থাকলে সম্ভবপর হতো? এ সংক্ষিপ্ত আলাচনায় মাদরাসার খেদমতের পূর্ণ আলোচনা অসম্ভব। শুধু মাদ্রাসার গুরুত্ব প্রমাণ করার প্রয়োজনে কিছু পয়েন্ট পেশ করা হলো। প্রকৃত পক্ষে ওলামাগণই যে জাতির নৈতিক শিক্ষক সে কথা অনুধাবন করলে মাদরাসার গুরুত্ব সহজেই বুঝা যাবে।
দ্বীনের ইলমই নতুবয়তের উত্তরাধিকার। তাই রাসূলুল্লাহ (সা) আলেমগণকে নবীদের ওয়ারিশ বলে ঘোষণা করে দ্বীনী ইলমের এত বড় মর্যাদা দিয়েছেন। কওমী ও আলীয়া মাদরাসাগুলো না থাকলে কোরআন ও হাদীসের আকারে অহীর মারফতে রাসূল (সা) এর নিকট আল্লাহ পাকের প্রেরিত জ্ঞানের মহা ভান্ডারের এমন চমৎকার হেফাযত কিছুতেই সম্ভব হতো না।
মসজিদ
মসজিদ তৈরি করা, নামাযীদের খেদমতের যাবতীয় সুব্যবস্থা করা এবং ইমাম মুয়য্যিনের এন্তজাম করা কোন এলাকার মুসলমানদের যে কত বড় দ্বীনী খেদমত তা সবই উপলব্ধি করেন না। মুসলমানদের যে মহল্লায় মসজিদ নেই সে মহল্লায় ইসলামী জীবন ধারার কোন চিহ্নই নেই। তাই সরকারীভাবে কোন আবাসিক এলাকা সৃষ্টি করা হলে তাতে স্কুল, সিনেমা, পার্ক ইত্যাদির সাথে মসজিদের কোন পরিকল্পনা না থাকলেও ঐ এলাকার কিছু সংখ্যক মুসলমানের উদ্যোগে সেখানে যখন মসজিদ গড়ে ওঠে তখনি তা মুসলমানদের মহল্লা বলে বুঝা যায়। মুসলমানদের সামাজিক কেন্দ্র হিসেবে মসজিদের মর্যাদা বহাল করা হলে এর বিরাট খেদমতের পরিচয় আরও স্পষ্ট হবে।
বাংলাদেশে মসজিদ মিশন, মসজিদ সমাজ ও আঞ্জুমানে ইত্তেহাদের “বাইতুশ শরফ মসজিদ” জাতীয় প্রতিষ্ঠান মুসলিম সমাজে মসজিদের সত্যিকার মর্যাদা বহাল করার জন্য চমৎকার কর্মসূচী প্রণীয় করেছে। যে পরিমাণে এ সবের বাস্তবায়ন সম্ভব হবে সে পরিমাণেই মসজিদ জনসাধারণের নিকট আকর্ষণীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। সাধারণত মসজিদে নামাযের ঘর হিসেবেই পরিচিত। বড় জোর মসজিদকে ফোরকানিয়া মাদরাসা হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। যেখানে মসজিদ সংলগ্ন কওমী মাদরাসা আছে সেখানে অবশ্য মসজিওদ ইসলামী শিক্ষাগার হিসাবে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু মসজিদকে মুসলিম জাতির প্রধান সামাজিক ও তামুদ্দনিক মর্যাদায় উন্নীত করা উচিত। এভাবেই মসজিদ থেকে ইসলামের সঠিক খেদমত পাওয়া যেতে পারে।
পীরের খানকাহ বা পীর-মুরীদী ব্যবস্থা
জনসাধারণকে ইসলামী জীবন যাপন শিক্ষাদান, তাদের মধ্যে আল্লাহ ও রাসূলের মহব্বত পয়দা করা এবং দুনিয়ার মুয়ামালাতে কোরআন-হাদীস মোতাবেক তাদেরকে পরিচালনা করা ইত্যাদি বড় বড় খেদমতের উদ্দেশ্যেই পীর-মুরীদী ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। মুসলিম জনতার দ্বীনী প্রয়োজনেই এ ব্যবস্থা চালু রয়েছে।
কিন্তু দুঃখের বিষয় যে দ্বীনী শিক্ষার অভাবে সুযোগে এবং সমাজে পীরের প্রতি ভক্তি প্রচলিত থাকায় বহু লোক পীরের কোন যোগ্যতা ছাড়াই পীর মুরশীদীর মতো মহান ব্যবস্থাটিকে নিছক পার্থিব ব্যবসা বানিয়ে জনগণের ঈমান নষ্ট করার কাজ করে যাচ্ছে। একটি সহজ উদাহরণ থেকে সমস্যাটা ভালোভাবে বোঝা যাবে। আমাদের দেশে খুব কম লোকই পাশ করা ভাল ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা করাবার ক্ষমতা রাখে বা সুযোগ পায়। কিন্তু রোগ হলে সবাই চিকিৎসার জন্য চেষ্টা করবেই। তাই দেশে এত হাতুড়ে ডাক্তারের ব্যবস্থা চলছে। তারা ডাক্তারী বিদ্যা জানে না। বাজারে চাহিদা থাকার কারণেই তাদের ব্যবসা চলে এবং লোকদের পয়সা নিয়ে তাদেরকে মরণের পথে এগিয়ে দেয়। ঠিক তেমনি এক শ্রেণীর ভন্ড পীর মানুষের হেদায়াত ও আখিরাতের মুক্তির চাহিদার ফলে তাদের হীন ব্যবসা চালাতে সক্ষম হয়।
হাতুড়ে ডাক্তার আছে বলেই যেমন চিকিৎসা ব্যবস্থাটাই খারাপ বলা চলে না, তেমনি ভন্ড পীর আছে বলেই পীড়-মুরীদী ব্যবস্থাটাকেই মন্দ বলা অন্যায়। মূল্যবান জিনিসেরই নকল বের হয়। বাজারে যে মালের চাহিদা নেই সে মালের নকল কেউই বের করে না। তাই আসল ও নকল পীরের পার্থক্য না জেনে সকল পীরকেই মন্দ মনে করা মস্ত বড় পাপ।
মুজাদ্দিদে আলফেসানী (রঃ), মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রঃ) এবং মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী (রঃ) এর মতো মহান খাদেমে দ্বীন কি পীর ছিলেন না?
মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রঃ)-এর রচিত ‘কাসদুল সাবীল’ পুস্তিকাটি মাওলানা শামুল হক ফরিদপুরী (রঃ) খাঁটি পীর চিনাবার উদ্দেশ্যেই বাংলায় তরজমা করেছিলেন। খাঁটি পীর যেমন ঈমান, ইলম ও আমলের শিক্ষক, বেআলেম ব্যবস্যায়ী পীর তেমনি ঈমানের ডাকাত।
ওয়ায-নসিহত
আমাদের দেশে ওয়াযের মাহফিলের ব্যবস্থা করে ভাল আলেম, রক্তগণকে দাওয়াত দিয়ে এনে ইসলামী জ্ঞান বিতরণ ও ঈমানী চেতনা সৃষ্টির যে রেওয়াজ আছে তা বহু দেশে বিরল। লাখে লাখো লোকের সমাবেশে সীরাতুন্নবী উপলক্ষে বা ওয়ায-নসীহতরূপে যোগ্য আলেমগণের আকর্ষণীয় বক্তৃতার যে বিরটর প্রভাব তা এ দেশের সরকারকেও আতংকিত করতে দেখা গেছে। জনগণের মধ্যে ইসলামী জোশ ও দ্বীনের জন্য কোরবানীর জযবা পয়দা করার ব্যাপারে ওয়াযের অবদান অবশ্যই স্বীকার করতে হবে।
লক্ষ লক্ষ মুসলমান ওয়াযের মাহফিলে এসে দ্বীনের বহু কথা শুনতে পান। ওয়ায়েযগণের মধ্যে যারা কোরআন ও হাদীসের শিক্ষা জনগণের মধ্যে বিতরণের দিকে বিশেষ আগ্রহী তারা যদি ওয়াযের সাথে সাথে শ্রোতাদের ইসলামের বুনিয়াদী ইলম হাসিল করার জন্য মাতৃভাষায় প্রকাশিত বই-পুস্তক পড়া নিজ নিজ এলাকার মসজিদে ইসলামী বই রাখা ও পড়ার জন্য তাগিদ দেন এবং মসজিদে সাপ্তাহিক আলোচনা বৈঠকের মাধ্যমে দ্বীনের তাবলীগকে ব্যাপক করার নসীহ করেন তাহলে ইসলামের বিরাট খেদমত হতে পারে। শুধু ওয়ায করে চলে আসলে গোটা ওয়ায আওয়াজেই পর্যসিত হয়। তাই দ্বীনী কাজের প্রোগ্রাম না দিলে প্রকৃত ও স্থায়ী ফায়দা হয় না।
ইসলামী কিতাবাদি রচনা, অনুবাদ ও প্রকাশনা
কোরআন পাক ও হাদীস শরীফের প্রকাশনা, এর তরজমা ও অনুবাদ, বিশ্বের অতীত ও বর্তমান ইসলামী চিন্তাবিদদের সাহিত্য অনুবাদ, ইসলামের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে গবেষণামূলক বই রচনা ও প্রকাশনা এমন বিরাট ইসলামী খেদমত যে শিক্ষিত লোক মাত্রই এর গুরুত্ব অনুভব করবেন। উর্দু ভাষায় গত দু’শ বছরের এত বিপুল ইসলামী সাহ্যি সৃষ্টি হওয়ার ফলেই পাকিস্তান ও হিন্দুস্থানের শিক্ষিত লোকদের মধ্যে যারা নামায-রোযাও ঠিকমত করে না তাদেরও ইসলাম সম্বন্ধে জ্ঞান যথেষ্ট আছে। কিন্তু বাংলা ভাষায় এ সাহিত্যর অভাবেই অনেক দ্বীনদার শিক্ষিত লোকও ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ বা সামান্যই জানেন। পাকিস্তান আমলে বাংলা ভাষায় ইসলামী সাহিত্য রচনা ও অনুবাদের যে প্রচেষ্টা শুরু হয় তা এখনও অব্যাহত আছে- এটা খুবই খুশীর বিষয়। বাংলা ভাষায় ইসলামী সাহিত্যের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলেই বেশ সন্তোষজনকভাবে আলেমদের মধ্যে সাহিত্যিকের সংখ্যা ও মান বৃদ্দি পাচ্ছে। এরই ফলে ইসলামী আদর্শের পত্রিকাদিও বাড়ছে।
তাবলীগ জামায়াত
এ জামায়াত ৬টি উসুলের ভিত্তিতে মুসলমানদের ব্যক্তিজীবন গড়ে তুলবার এক ব্যাপক আন্দোলন চালাচ্ছেন। তাবলীগ জামায়াত সার দুনিয়ায়ই কর্মতৎর। মুসলিম সমাজ দুনিয়ার আকর্ষণে আখিরাতকে ভুলে কালেমা বাইয়্যেবার জীন্দেগী থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। তাদেরকে আখিরাতমুখী করার বিরাট খেদমত এ জামায়াত আঞ্জাম দিচ্ছে। এ উদ্দেশ্যে এ জামায়াত মুসলমানদের সংসার জীবন থেকে আলাদা হয়ে ৪০ দিন (একচিল্লা) বা ৪ মাস (তিন চিল্লা) সময় জামায়াতের সাথে কাটিয়ে মন-মগজকে দ্বীন ও আখিরাতমুখী বানাবার দাওয়াত দেয়। জনসাধারণের মধ্যে যারা দ্বীন সম্পর্কে অজ্ঞ তারা এ জামায়াত দ্বারা সবচেয়ে বেশি উপকৃত হচ্ছেন। কালেমা শুদ্ধ করে পড়া ও এর অর্থ বুঝা, নামাযকে সুন্দর করা, দ্বীনের জরুরী ইলম হাছিল করা ও যিকরের অভ্যাস করা, মুসলমানদেরকে সম্মান করা, সব কাজ নিয়ত ছহীহ করে করা, আল্লাহর পথে মাঝে মাঝে কিছু দিনের জন্য তাবলীগ জামায়াতের সাথে কাটান ইত্যাদি এ জামায়াতের মূল ৬টি শিক্ষা।
তাবলীগ জামায়াত সম্পর্কে সঠিকভাবে না জানার দরুন অনেকে এ জামায়াত সম্পরেক নানারকম বিরূপ মন্তব্য বরেন। আমি এ জামায়াতের সাথে সাড়ে চার বছর ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছি বলেই এর বিরাট দ্বীনী খেদমতকে ভালভাবে বোঝার সুযোগ পেয়েছি। তাবলীদের ভাইয়েরা এ জন্যই বলে থাকেন, কিছু দিন জামায়াতের সাথে না থাকলে কি করে এর কাজকে জানা ও বোঝা সম্ভব হবে? ভাইদের এ কথাটি খুবই সত্য। ভাইদের কথাটিকে সমর্থন করেই তাদের খেদমতে আরজ করতে চাই যে, অন্যান্য জামায়াদ এবং দ্বীনী খেদমতকেও নিকটে যেয়ে না জেনে তাদের সম্বন্ধে দূর থেকে কোন ধারণা করতেল একই কারণে ভুল হবে।
তাবলীগ জামায়াত আখিরাতের কামিয়াবীর উদ্দেশ্যে দুনিয়ায় আল্লাহর হুকুম ও রাসূলের তরীকা মোতাবেক জীবন যাপনের যে মহান জযবা পয়দা করছে তা দ্বরা দ্বীনের বিরাট খেদমত হবে যদি তারা মানুষের মধ্যে এ ধারণা সৃষ্টি হতে না দেন যে, তাবলীগ জামায়াত যতটুকু তালিম দিচ্ছে সেইটুকুই ইসলামের পূর্ণরূপ বা তাবলীগ জামায়াতই একমাত্র সহীহ জামায়াত।
জামায়াতে ইসলামী
এ জামায়ত ইসলামকে মানব সমাজে তেমনি পূর্ণরূপে কায়েম দেখতে চায় যেমন- আল্লাহর রাসূল (সা) মদীনায় কায়েম করেছিলেন। সে মহান উদ্দেশ্যেই এ জামায়াত কর্মীদের ব্যক্তি জীবন গঠন করে সমাজে ঈমানদার, খোদাভীরু ও চরিত্রবান নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে চেষ্টা করছে। এ জামায়াত যে ইসলামী সাহিত্য সৃষ্টি করছে তা আধুনিক শিক্ষিতদেরকে এ দ্বীরে সুস্পষ্ট ইলম দান করতে সক্ষম। আধুনিক বিশ্বে ইসলাম বিরোধী মতবাদ ও চিন্তা-ধারা শিক্ষিত যুব সমাজকে যেভাবে পথভ্রষ্ট করছে এর সত্যিকার মোকাবিলা এ সাহিত্য দ্বারাই সম্ভব হচ্ছে। বাংলা ভাষায় ইসলামী সাহিতের অভাব এ সাহিত্য দ্বারা অনেকখানি পূরণ হয়েছে।
মাদরাসা শিক্ষা ও আধুনিক সাধারণ শিক্ষার দ্বারা শিক্ষিত সমাজে যে বিরাট ব্যবধান সৃষ্টি হয়েছে জামায়াতে ইসলামী পরিবেশিত ইসলামী সাহিত্য সে দুরত্ব দূর করে উভয় প্রকার শিক্ষিত লোকদের মধ্যে মজবুত সেতু বন্ধন রচনা করেছে। এ সাহিত্য মাদরাসা শিক্ষিতদের আধুনিক দৃষ্টি-ভঙ্গি দান করে এবং আধুনিক শিক্ষিতদেরকে ইসলামী দৃষ্টি ভঙ্গি দান করে। উভয় শিক্ষায় যে অভাব রয়েছেতা এ সাহিত্য দ্বারা দূল হওয়ায় শিক্ষিত সমাজে ভারসাম্য সৃষ্টি হওয়া সহজ হয়েছে।
কোন আন্দোলন মানব সমাজে যে মতাদর্শ কায়েম করতে চায় তাকে সে আদর্শের উপযোগী লোক তৈরি করার কর্মসূচী অবশ্যই নিতে হয়। জামায়াতে ইসলামী তাই ইসলামী চরিত্র সৃষ্টির প্রয়াজনে কর্মীদের বাস্তব ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করেছে যাতে ঈমান, ইলম ও আমলেরদিক দিয়ে অত্যাবশ্যক গুণাবলী পয়দা হয়। আল্লাহর দ্বীন আল্লাহর যমীনে তাদের দ্বারাই কায়েম হওয়া সম্ভব যারা নিজেদের জীবনের সর্বক্ষেত্রে দ্বীনের আনুগত্য করে। জামায়াতে ইসলামী এ ধরনের লোক তৈরি করার একটি কারখানা।
যারা সত্যিই আধূনিক শিক্ষিত সমাজের নিকট দ্বীন ইসলামকে যোগ্যতা ও বলিষ্ঠতার সাথে পরিবেশন করতে চান তারা মাওলানা মওদূদী (রঃ) সাহিত্য থেকে প্রয়োজনীয় জ্ঞান, প্রেরণা ও মনোবল হাসিল করতে পারেন। বিশেষ করে নিম্নলিখিত তিনটি বই সব চেয়ে বেশি সহায়ক :
(ক) তাফহীমূল কোরআন :
ইহা কোরআন পাকের এমন একটি সহজ ও হৃদয়গ্রাহী তাফসীর যা পড়লে ভালভাবে কোরআন বুঝবার মজা পাওয়া যায়। যে মহানবীর (না) নিকট এ কোরআন নাযিল হয়েছিল সে নবীর জীবন যে এ কোরআনেরই বাস্তব রূপ তা উপলব্ধি করা যায়। ৩৪ বছরের নবুয়তের জীবনে রাসূল (সা) যে বিরাট দায়িত্ব পালন করেছেন, কোরআন যে সে উদ্দেশ্যেই নাযিল হয়েছিল তা সুস্পষ্টরূপ এ তাফসীর দেখান হয়েছে। তাফহীমুল কোরআন অধ্যয়ন করলে এ কথা অতি সুন্দরভাবে বুঝা যায় যে, কালেমায়ে তাইয়্যেবিার দাওয়াত থেকে শুরু করে ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করে ইসলামী হুকুমাতের মাধ্যমে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনকে আল্লাহ পাকের মর্জী মতো গঠন করা পর্যন্ত যাবতীয় কাজ করাবার-উদ্দেশ্যেই কোরআন নাযিল হয়েছে। এ কোরআন শুধু তেলাওয়াত করা ও তাফসীর পড়ার জন্য নয়। মুসলিমদের নিকট কোরআনের দাবী হলো রাসূল (সা) ও সাহাবায়ে কেরামের অনুকরণে ইসলামকে অন্য সব ব্যবস্থার উপর জয়ী করার জন্য জান ও মাল দিয়ে জামায়াতে বদ্ধভাবে চেষ্টা করতে হবে। তাফহীমুল কোরআন আল্লাহর পথে এ জিহাদেরই প্রেরণা যোগায়। কোরআন যে বাস্তব জীবনের কর্মসূচী তাফহীমুল কোরআন থেকে অতি সহজে সে কথা বোধগম্য হয়।
(খ) রাসায়েল ও মাসায়েল :
কয়েক খণ্ডে বিস্তৃত এ গ্রন্থে আধনিক যুগ-জিজ্ঞাসার কোরআন-হাদীস ও যুক্তিভিত্তিক বলিষ্ঠ জওয়াব রয়েছে। জীবনের সবদিক ও বিষয় এবং ইসলাম সম্পর্কে যত রকম প্রশ্ন মাওলানা মওদূতীকে করা হয়েছে সে সবের এমন চমৎকার জওয়াব তিনি দিয়েছেন যা অন্তরকে আলোচিক তরে এবং দ্বীনের ব্যাপক জ্ঞান দান করে। ইসলামের দিকে শিক্ষিত সমাজকে যারা আহবান জানায় তারা ঐ সব প্রশ্নেরই সম্মুখীন হয়। তাই এই বইটি জ্ঞানের এক অফুরন্ত ভাণ্ডার। যে কোন প্রশ্নের জওয়াব দেবার অদ্ভূত যোগ্যতা সৃষ্টি করার যাদুকরী ক্ষমতা এ বই থেকে হাসিল করা যায়। অবশ্য মাওলানার প্রতিটি বই দ্বীনী ইলমের উজ্জ্বল মশাল। নিরপেক্ষ মন নিয়ে পড়লে তেহা সব চেয়ে বেশি উপকৃত হওয়া যায় তবে সমালোচনার দৃষ্টিতেই আলেম সমাজের পড়া উচিত যাতে সঠিক রায় তরা কায়েম করতে পারেন।
(গ) ইসলামের বুনিয়াদি শিক্ষা: -হাকিকত সিরিজ
এই বইটি প্রকৃতি পক্ষে জুমআর ধারাবাহিক খুতবা হিসেবে তিনি সাধারণ মানুষের বোধগম্য ভাষায় ইসলামের বুনিয়াদী শিক্ষাকে অতি সহজ করে পেশ করেছেন। কালেমা, নামায, রোযা, যাকাত হজ্জ ও জিহাদ সম্পর্কে এমন সহজ সরল যুক্তিপূর্ণ আলোচনা অতুলনীয়। মাওলানা মওদূদী (রঃ) এ বইতে অতি আকর্ষণীয় যুক্তি দ্বারা বুঝিয়ে দিয়েছেন যে কালেমা নামায, রোযা, যাকাত ও হজ্বকে হাদীসে ইসলামের পাঁচটি বুনিয়াদ কেন বলা হয়েছে। মানুষের গোটা জীবন আল্লাহর হুকুম ও রাসূলের তরীকা অনুযায়ী যাপন করার কি কি বাস্তব ট্রেনিং এ পাঁচটি বুনিয়াদের মাধ্যমে হাসিল করা যায় তা ব্যাখ্যা করে তিনি একদিকে প্রমাণ করেছেন যে, যারা কথায় কথায় ইসলামের নাম নেয় অথচ নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাতের গুরুত্ব দেয় না তারা যেমন সত্যিকার ইসলাম বুঝে না, তেমনি যারা নামায রোযা করে অথচ ব্যক্তি সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের কর্মক্ষেত্রে রাসূল (সা) এর অনুসরণ করা প্রয়োজন মনে করে তারাও আসল ইসলামকে কবুল করেনি।
ইসলামের এ পাঁচটি বুনিয়াদেরর সাথে জিহাদের আলোচনা শামিল করে তিনি প্রমাণ করেছেন যে আল্লাহ পাক শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠান হিসাবে নামায রোযার ব্যবস্থা করেনি। নামায, রোযা, হজ্ব ও যাকাতের মাধ্যমে আল্লাহ পাক ঐ সব বুনিয়াদী গুণ মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করতে চান যা আল্লাহর দ্বীনকে দুনিয়ায় বিজয়ী করার জন্য বিশেষ জরুরী। দ্বীনকে বিজয়ী করার প্রচেষ্টাকেই জিহাদ বলা হয়। তাই ইসলামের পাঁচটি বুনিয়অদের সাথে জিহাদের অতি ঘনিষ্ট সম্পর্ক। নামায রোযা করে ও জিহাদের গুরুত্ব বুঝে না তারাও সঠিক পথে নেই। এ বিষয়ে বইখানী অতুলনীয়।
(ঘ) ইসলামী রাজনৈতিক দলসমূহ :
ইসলামকে একটি পূর্ণাংগ জীবন বিধান হিসেবে কায়েম করা এবং মানব জীবনের যাবতীয় সমস্যার সমাধান কোরআন ও হাদীস থেকে পেশ করার উদ্দেশ্য বিজ্ঞান সম্মত কর্মসূচী বা ব্যাপক কর্মতৎপরতা সবার না থাকলেও বাংলাদেশে এমন বেশ কয়টি সংগঠন রয়েছে যারা এদেশে ইসলামকে বিজয়ী দেখতে চায়। তাঁরা ইসলামের স্বার্থে কথা বলে। তাদের মধ্যে কতক জ্ঞানী লোকও যেমন আছে, তেমনি ইসলামের আনুগত্য করার আগ্রহও কিছু লোকের আছে। ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপের প্রতিবাদ তারা বলিষ্ঠভাবে করেন। ইসলামের রাজনৈতিক মতবাদ ও অর্থনৈতিক সমাধানের কথা ঐ সব সংগঠনের ম্যানিফেষ্টোতে অবশ্যই রয়েছে। সুতরাং ইসলামের প্রকৃত বিজয়ের জন্য বিজ্ঞান সম্মত কর্মসূচী তাদের যে পরিমাণই থাকুক বা ব্যক্তি গঠনের কাজ যেটুকুই করুক তারা ইসলামী আন্দোলনেরই সহায়ক। ইসলাম বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে এদের সবাই ইসলামী আন্দোলনের সহযোগী ভূমিকা পালনে সক্ষম।
এসব সংগঠনের সবাই সমানভাবে রাজনৈতিক ময়দানে কর্মতৎপর নয়। কোন কোনটি রাজনৈতিক চিন্তাধারা পোষণ করলেও নিজ নামে সক্রিয় রাজনীতি করে না। কোনটি ওলামাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ, কোনটি ওলামা প্রধান আবার কোনটি আধুনিক শিক্ষিতদের দ্বারা পরিচালিত। এ ধরনের কতক সংগঠন দেশ-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য। কিন্তু সিলেটে জেলা পর্যায়েও ওলামাদের দ্বারা সংগঠিত এ জাতীয় প্রতিষ্ঠান আছে। এ ছাড়া এমন আরও কিছু রাজনৈতিক দল রয়েছে যারা তাদের গঠনতন্ত্র ও মেনিফেষ্টোতে ইসলামী রাজনৈতিকজ দল হিসেবে ঘোষণা না দিলেও তারা ইসলামী শক্তির সহায়ক এবং প্রয়োজনের সময় তারা ইসলামের পক্ষে সমর্থন করতে দ্বিধা করেন না।
স্থানীয় বিভিন্ন ইসলামী প্রতিষ্ঠান
দেশে এমন বহু ইসলামী প্রতিষ্ঠান আছে যা দেশভিত্তিক নয়। স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন নামে নির্দিষ্ট কোন এলাকায় এসব কর্মরত রয়েছ। ইসলামী পাঠাগার, তাফসীর মাহফিল, কোরআন প্রচার সমিতি, ইসলামী সমাজ কল্যাণ পরিষদ বা সমিতি ইত্যাদি বিভিন্ন নামে এসব প্রতিষ্ঠান ইসলামের খেদমত করে আসছে
ছাত্র ও ছাত্রদের ইসলামী সংগঠন
বাংলাদেশে বর্তমানে অনেক ছাত্র সংগঠন আছে। রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্র শাখা হিসে্বেই সাধারণতঃ এরা পরিচিত। এতগুলো ছাত্র প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ইসলামী আদর্শের ধারক বাহক দেশব্যাপী প্রতিষ্ঠান মাত্র দুটো: [১৯৭৮ সালে এ বইটি যখন লিখা হয় তখান ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে এ দুটো ইসলামী সংগঠনই ছিল। পরবর্তী কালে আরও কয়েকটি ইসলামী ছাত্র সংগঠন কায়েম হয়েছে]
ক) ইসলামী ছাত্র শিবির
খ) ইসলামী ছাত্রীসংস্থা
(ক) ইসলামী ছাত্র শিবির
বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, মাদরাসা ও স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে ইসলামের বিপ্লবী দাওয়াত পৌঁছান, তাদেরকে সুসংগঠিত করে বিজ্ঞানসম্বত কর্মসূচী ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ছাত্রদের মধ্যে ইসলামী জ্ঞান বিস্তার করা এবং উন্নত ইসলামী চরিত্র সৃষ্টি করার মহান দায়িত্ব এ প্রতিষ্ঠানই পালন করছে। সকল ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের মধ্যে সত্যিকার ইসলামী আন্দোলনের কাজ চালিয়ে যাবার গুরুভার বইবার মতেহা আর কোন ছাত্র সংগঠন না থাকায় ইসলাম বিরোধী ও ধর্ম নিরপক্ষে অগণিত ছাত্র সংগঠনের মোকাবিলায় শিবির এককভাবেই ইসলামের প্রতিনিধিত্ব করছে।
জনগণের ময়দানে বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠান ও ওলামাদের মাধ্যমে দ্বীনের যে খেদমত হচ্ছে সেখঅনে কেউ বাতিলের বিরুদ্ধে একেবারে একা নয়, কিন্তু কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরাট ছাত্র সমাজের মধ্যে দ্বীনের দায়িত্ব একা ছাত্র-শিবিরকেই পালন করতে হচ্ছে। ছাত্রমহল তাবলীগ জামায়াতকে তাদের আদর্শের দুশমন মনে করে না। সমাজতন্ত্রী ও ধর্মনিরপেক্ষ ছাত্রসংগঠনগুলোর সাথে তাবলীগ পন্থীদের কোন সংঘর্ষ হয় না। তাই আদর্শের ময়দানে ছাত্র শিবির একাই ইসলামের পতাকাবাহী হিসাবে পরিচিত বলে বাতিল পন্থীরা শিবিরের বিরুদ্ধে এতটা মারমুখি।
ইসলামপন্থী পিতামাতাও আধুনিক শিক্ষার প্রয়োজনে ছেলেমেয়েদের কলেজ বিশ্বাবিদ্যালয়েই দিতে বাধ্য হয়। আলেমদের সন্তানও ঐ শিক্ষার ফলে দ্বীন থেকে দূরে চলে যেতে পারে। তাই আধুনিক শিক্ষার পরিবেশে ছাত্র শিবির মুসলিমমনা পিতামাতার সন্তানদের জন্য একমাত্র ভরসাস্থল। যেসব ছাত্র শিবিরের সাথে যুক্ত হয় তাদের সম্পর্কেই আশা করা যায় যে, শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাংগনের পরিবেশে ইসলামী না হলেও তারা মন-মগজ ও চরিত্রে মুসিলম হিসেবে গড়ে উঠবে। এ হিসেবে ইসলামী ছাত্রশিবির আল্লাহ পাকের এক বড় নিয়ামত। মুসলিম অভিভাবকগণ যদি তাদের সন্তানদেরকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার সাথে সাথে মুসলিমও বানাতে চান তাহলে শিবিরের মাধ্যমেই তা সম্ভব। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থায় ছাত্রদের মন-মগজ ও চরিত্র ইসলাম অনুযায়ী গঠনের কোন ব্যবস্থা নাই। তাই ইসলাম বিরোধী মত ও পথে গড়ে তুলবার উদ্দেশ্যে বহু ছাত্র-সংগঠন এখানে অবাধে কাজ করে যাচ্ছে এমন কি তারা শিক্ষাংগনে এতটা প্রাধান্য অর্ঝন করে আছে যে প্রশাসন ও সেখানে অসহায় দর্শক মাত্র। এ পরিবেশে ইসলামী ছাত্র- শিবির ছাত্রদেরকে ইসলামী জ্ঞঅন ও চরিত্রে গড়ে তুলবার যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে তা গোটা মুসলিম জাতির জন্য গৌরব ও সৌভাগ্যের বিষয়।
(খ) ইসলামী ছাত্রী সংস্থা:
বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজে ও স্কুলে ছাত্রীদের সংখ্যা যে হারে বাড়ছে, সমাজে মহিলাদের মধ্যে অশালীনতা, বেহায়াপনা ও উচ্ছৃংখলতা তার চেয়েও বেশী হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভদ্র ঘরের মেয়েরা এমন কি দ্বীনদার ঘরের মেয়েরা পর্যন্ত স্কুল-কলেছের পরিবেশে এমন অশালীন পোশাকের প্রতি আকৃষ্ট হয় যে, অভিভাবকগণ অসহায়ের মতো তাদের চাল-চলন সহ্য করতে বাধ্য হচ্ছেন। আধুনিকতার নামে ছাত্রী মহলের এ ধরনের প্রবণতা রোধ করা অছাত্রদের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়।
কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সমস্ত ছাত্র সংগঠন ইসলামের ধার ধারে না বা ইসলামী বিরোধী আদর্শের ধারক, তাদের সাথে যুক্ত হয়ে যে বিরাট সংখ্যক ছাত্রী বিশেষ ধরনের মন- মগজ ও চরিত্রে গড়ে উঠেছে তা রীতিমতো আতংকের বিষয়। শিক্ষালয় তাদেরকে পুঁথিগত বিদ্যাটুকু ছাড়া চরিত্রবান নাগরিক বানাবার কোন ব্যবস্থা না করায় বিভিন্ন রাজনৈতিক মতবাদ ও সাংস্কৃতিক চিন্তাধারা ছাত্রীদেরকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তা দূরদর্শী লোকদের জন্য অবশ্যই চিন্তার বিষয়। ইংরেজের গোলামীর যুগে এদেশের এক শ্রেণীর পুরুষদের মধ্যে চারিত্রিক পতন ঘটলেও তাদের পারিবারিক জীবনে মহিলাদের মধ্যে মুসলিম ঐহিত্য ও কৃষ্টি বহাল থাকায় ব্যাপক হারে সাংস্কৃতিক বিপর্যয় সৃষ্টি হতে পারেনি। কিন্তু বর্তমানে মহিলা অংগনের সাংস্কৃতিক প্রাচীর ভেংগে মুসলিম জাতির বংশধরদের মধ্যে দ্রুত বিজাতীয় সংস্কৃতি প্রসার লাভ করছে। নারী ও পুরুষের সহশিক্ষা ও একই ধরনের শিক্ষা নিয়ে একই কর্মক্ষেত্রে কাজ করা ও মেলামেশার অবাধ সুযোগের ফলে মুসলিম সমাজের পারিবারিক কাঠামো ও সামাজিক শাসনব্যবস্থা ভেংগে পড়ছে।
এমনকি মারাত্মক পরিবেশে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে “ইসলামী ছাত্রী সংস্থা” নামে যে সংগঠনটি ধীর গতিতে ও মজবুত পদক্ষেপে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করছে, দেশের মুসলিম অভিভাবকগণ এর মাধ্যমে তাদের শিক্ষার্থী মেয়েদেরকে হেফাযত করার সুযোগ নিতে পারেন। আধুনিক শিক্ষার সাথে সাথে সচেতন মুসলম মহিলা হিসেবে ছাত্রী মন-মগজ ও চরিত্র গঠন করার একমাত্র সংগঠনই ইসলামী ছাত্রী সংস্থা। শালীন পোশাক ও ইসলামী পর্দা যে উচ্চ শিক্ষার পথে বাধা নয় এ সংগঠনের মেয়রা তা প্রমাণ করছে। বরং এরা বুঝতে চায় যে ইসলামী জ্ঞানে সমৃদ্ধা ও ইসলামী চরিত্রে সজ্জিতা মেয়েরাই জাতীয় উন্নতির প্রকতি সহায়ক।