দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ কুরআনের অর্থনৈতিক নির্দেশনা
১. মৌলিক তত্ত্ব
মানুষের জীবিকা ও অর্থনীতি সম্পর্কে একেবারে প্রাথমিক ও মৌলিক কথা হলা যে, মহান আল্লাহই মানুষের জীবিকা ও অর্থনীতির সমুদয় উপকরণ সৃষ্টি করেছেন, যার ফলে সেগুলোকে এমনভাবে এবং এমন প্রাকৃতিক বিধানের উপর সৃষ্টি করেছেন, যার ফলে সেগুলো মানুষের জন্যে উপকারী ও কল্যাণবহ হয়েছে। তিনিই মানুষকে এসব থেকে ফায়দা লাভের সুযোগ করে দিয়েছেন। তিনিই মানুষকে সেগুলো ব্যয় ব্যবহার করার ক্ষমতা দান করেছেন। এই প্রকৃত সত্যকথা ও মৌলিক তত্ত্বকে আল কুরআন অত্যধিক গুরুত্ব দিয়ে বারবার উল্লেখ করেছেঃ
هُوَ الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضَ ذَلُولًا فَامْشُوا فِي مَنَاكِبِهَا وَكُلُوا مِنْ رِزْقِهِ وَإِلَيْهِ النُّشُورُ
“তিনিই যমীনকে তোমাদের জন্যে বাধ্যগত ও বশীভূত করে দিয়েছেন। অতএব তোমরা এর প্রশস্তহতার উপর চলাচল কর এবং আহার কর তাঁর প্রদত্ত জীবিকা থেকে। আর (জেনে রেখো) তোমাদের পুনরায় জীবিত হয়ে তাঁরই কাছে ফিরে যেতে হবে।” [আল মুলকঃ১৫]
وَهُوَ الَّذِي مَدَّ الْأَرْضَ وَجَعَلَ فِيهَا رَوَاسِيَ وَأَنْهَارًا وَمِنْ كُلِّ الثَّمَرَاتِ جَعَلَ فِيهَا زَوْجَيْنِ اثْنَيْنِ
“আর তিনিই যমীনকে বিস্তৃত করে দিয়েছেন, তাতে পাহাড় বানিয়েছেন আর প্রবাহিত করে দিয়েছেন সমুদ্র ও নদ নদী। আর তিনি সৃষ্টি করেছেন সব ধরনের ফল ফলাদি দুই দুই প্রকার।” [আর রা’দঃ ৩]
هُوَ الَّذِي خَلَقَ لَكُمْ مَا فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا
“তিনি তোমাদের জন্যে সেই সবই সৃষ্টি করেছেন, যা পৃথিবীতে রয়েছে।” [আল বাকারাঃ ২৯]
اللَّهُ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَأَنْزَلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَأَخْرَجَ بِهِ مِنَ الثَّمَرَاتِ رِزْقًا لَكُمْ وَسَخَّرَ لَكُمُ الْفُلْكَ لِتَجْرِيَ فِي الْبَحْرِ بِأَمْرِهِ وَسَخَّرَ لَكُمُ الْأَنْهَارَ () وَسَخَّرَ لَكُمُ الشَّمْسَ وَالْقَمَرَ دَائِبَيْنِ وَسَخَّرَ لَكُمُ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ() وَآتَاكُمْ مِنْ كُلِّ مَا سَأَلْتُمُوهُ وَإِنْ تَعُدُّوا نِعْمَتَ اللَّهِ لَا تُحْصُوهَا إِنَّ الْإِنْسَانَ لَظَلُومٌ كَفَّارٌ
“তিনিই আল্লাহ, যিনি আকামণ্ডল সৃষ্টি করেছেন, সৃষ্টি করেছেন পৃথিবী, আর আকাশ থেকে বর্ষণ করেছেন পানি। অতপর এরই সাহায্যে তোমাদের জীবিকার জন্যে সৃষ্টি করেছেন নানারকম ফলফলাদি। নৌযানকে তিনি তোমাদের নিয়ন্ত্রণাধীন করেছেন, যাতে করে তাঁরই নির্দেশ তা সমুদ্রে চলাচল করে। তিনি সমুদ্রকেও তোমাদের বশীভূত করে দিয়েছেন। তিনি সূর্য-চাঁদকেও তোমাদেরই কল্যাণার্থে একটি নিয়মের অধীনে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছেন, সেভাবেই তারা আবর্তিত হচ্ছে। আমি তোমাদের স্বার্থেই রাত দিনকে একটি বিধানেনর অধীন করে দিয়েছি। আর তোমরা যা কিছু চেয়েছো[“অর্থাৎ যা কিছুর তোমরা মুখাপেক্ষী এবং বর্তমানে তোমরা যা কিচু চাও। অতীতের চাওয়অ না চাওয়াতে কিছু যায় আসেনা।” বায়দাবী, আনোয়অরুত তানযীল ৩য় খণ্ড ১৬১ পৃষ্ঠা। মুস্তফা আলবাবী, মিশর ১৩৩০ হিঃ (১০১২ ইং)।] তা সবই তোমাদের দিয়েছি। তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহরাজি গুণকে চাইলে গুণতে পারবেনা।” [সূরা ইব্রাহীমঃ৩২-৩৪]
وَلَقَدْ مَكَّنَّاكُمْ فِي الْأَرْضِ وَجَعَلْنَا لَكُمْ فِيهَا مَعَايِشَ قَلِيلًا مَا تَشْكُرُونَ
“আমরা পৃথিবীতে তোমাদের কর্তৃত্ব দান করেছি এবং সেখানেই তোমাদের জন্যে জীবনের উপকরণ সৃষ্টি করে দিয়েছি।” [আল আ’রাফঃ ১০]
أَفَرَأَيْتُمْ مَا تَحْرُثُونَ (63) أَأَنْتُمْ تَزْرَعُونَهُ أَمْ نَحْنُ الزَّارِعُونَ
“তোমরা কি তোমাদের কৃষি খামারের ব্যাপারে চিন্তা করে দেখেছো? এই যে তোমরা বীজ বপন কর, তা থেকে [গাছ ও ফসল] তোমরা উৎপাদন কর, নাকি আমি?” [আল ওয়াকিয়াঃ৬৩-৬৪]
২. বৈধ অবৈধের সীমা নির্ধারণের অধিকার কেবলমাত্র আল্লাহর
এই মৌলিক তত্ত্বের ভিত্তিতে কুরআন মূলনীতি নির্ধারণ করে দিয়েছে যে, মানুষ আল্লাহ প্রদত্ত উপায় উপকরণসমূহ উপার্জন ও ব্যবহার করার ক্ষেত্রে স্বাধীন ও স্বেচ্ছাচারী হবার অধিকার রাখেনা। তাছাড়া নিজের খেয়াল খুশী মতো হালাল হারাম এবং বৈধ অবৈধের সীমা নির্ধারণ করার বৈধ অধিকারও তার নেই। বরঞ্চ তার জন্যে সীমা নির্ধারণ করবার একচ্ছত্র অধিকারী কেবলমাত্র আল্লাহ। আরবের প্রাচীন মাদ্ইয়ান জাতি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে লাগামহীন উপার্জন ও ব্যয় করার দাবিদার ছিলো। তাদের এ দৃষ্টিভংগির জন্যে কুরআনে তাদের তিরষ্কার করা হয়েছেঃ
قَالُوا يَا شُعَيْبُ أَصَلَاتُكَ تَأْمُرُكَ أَنْ نَتْرُكَ مَا يَعْبُدُ آبَاؤُنَا أَوْ أَنْ نَفْعَلَ فِي أَمْوَالِنَا مَا نَشَاءُ إِنَّكَ لَأَنْتَ الْحَلِيمُ الرَّشِيدُ
“তারা বললোঃ হে শুয়াইব! তোমার নামায কি তোমারেক এই নির্দেশ দেয় যে, আমাদের পুরুষানুক্রমে পূজা করে আসা মা’বুদদের আমরা পরিত্যাগ করবো, কিংবা আমাদের অর্থসম্পদের বিষয়ে আমরা নিজেদের ইচ্ছেমতো যা কিচু করতে চাই, তা করতে পারবোনা?” [সূরা হুদঃ৮৭]
নিজের খেয়াল খুশীমতো কোনো জিনিসকে হারাম এবং কোনো জিনিসকে হালাল বলাকে কুরআন ‘মিথ্যাকথা’ বলে ঘোষণা করেঃ
وَلَا تَقُولُوا لِمَا تَصِفُ أَلْسِنَتُكُمُ الْكَذِبَ هَذَا حَلَالٌ وَهَذَا حَرَامٌ
“আর তোমরা তোমাদের মুখের কথা দিয়ে মিথ্যা হুকুম জারি করোনা যে, এটা হালাল আর ওটা হারাম।” [ এ আয়াত নিজের খেয়ালখুশী মতো হারাম হালালের ফয়সালা করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছে। [বায়দাবী ৩য় খন্ড ১৯৩ পৃষ্ঠা]।
আল্লামা আলূসী তাঁর বিখ্যাত তাফসীর রূহুল মুয়ানীতে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেনঃ “এ আয়াতের সারকথা হলো, য জিনিস হালাল বা হারাম হবার ব্যাপারে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে কোনো হুকুমই পৌছেনি, তোমরা সেটাকে হালাল বা হারাম কিছুই বলবেনা। এমনটি করলে তোমরা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপকারী বলে গণ্য হবে। কেননা আল্লাহর হুকুম ছাড়া আর কিছুই হালাল হারাম নির্ণয়ের মাণদণ্ড নয়।”
[রুহুল মুয়ানী ১৪শ খন্ড ২২৬ পৃষ্ঠা মুনীরিয়া মু্দ্রণালয়, মিশর, ১৩৪৫ হিঃ]] [আন নহলঃ ১১৬] কুরআন এরূপ নির্দেশ জারি করার অধিকার আল্লাহ এবং [তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে] তাঁর রাসূলের জন্যে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেঃ
يَأْمُرُهُمْ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَاهُمْ عَنِ الْمُنْكَرِ وَيُحِلُّ لَهُمُ الطَّيِّبَاتِ وَيُحَرِّمُ عَلَيْهِمُ الْخَبَائِثَ وَيَضَعُ عَنْهُمْ إِصْرَهُمْ وَالْأَغْلَالَ الَّتِي كَانَتْ عَلَيْهِمْ
“হে [রাসূল] তাদেরকে ভালো ও কল্যাণের নির্দেশ দেয় আর মন্দ ও অকল্যাণ থেকে বিরত রাখে। তাদের জন্যে পবিত্র জিনিসে হালাল এবং অপবিত্র নোংরা জিনিসকে হারাম করে। আর তাদের জন্যে পবিত্র জিনিসকে হালাল এবং অপবিত্র নোংরা জিনিসকে হারাম করে। আর তাদের উপর থেকে সেব বোঝা নামিয়ে দেয় যেগুলো তাদের উপর চাপানো ছিলো এবং সেসব বন্ধন খুলে দেয় যেগুলোর দ্বারা তারা বন্দী ছিলো।” [আল আ’রাফঃ ১৫৭]
৩. আল্লাহ-নির্ধারিত সীমার ভেতরে ব্যক্তিমালিকানার স্বীকৃতি
কুরআন আল্লাহ তা’আলার সার্বভৌম মালিকানার অধীনে এবং তাঁর আরোপিত সীমারেখার ভেতরে ব্যক্তিমালিকানাকে স্বীকার করেঃ
لَا تَأْكُلُوا أَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ إِلَّا أَنْ تَكُونَ تِجَارَةً عَنْ تَرَاضٍ مِنْكُمْ
“তোমরা অবৈধ পন্থায় একে অপরের অর্থসম্পদ ভোগ-ভক্ষণ করোনা। তবে পারস্পরিক সন্তুষ্টির ভিত্তিতে তোমাদের মাঝে লেনদেন ও ব্যবসা বাণিজ্য হতে পারে।” [সূরা নিসাঃ২৯]
وَأَحَلَّ اللَّهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا
“আল্লাহ ব্যবসাকে বৈধ করেছেন আর অবৈধ করে দিয়েছেন সুদকে।”
وَإِنْ تُبْتُمْ فَلَكُمْ رُءُوسُ أَمْوَالِكُمْ
“তোমরা যদি সুদ নেয়া য়েতে ফিরে আস [তওবা কর] তবে নিজেদের মূলধন ফেরত নেবার অধিকার তোমাদের রয়েছে।” [আল বাকারাঃ২৭৯]
إِذَا تَدَايَنْتُمْ بِدَيْنٍ إِلَى أَجَلٍ مُسَمًّى فَاكْتُبُوهُ
“যখন তোমরা পরস্পরের মধ্যে নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্যে লেনদেনের [ঋণ দেয়া নেয়ার] ফয়সালা করবে, তখন তার দলিল দস্তাবিজ লিখে নিও।” [আল বাকারাঃ ২৮২]
وَإِنْ كُنْتُمْ عَلَى سَفَرٍ وَلَمْ تَجِدُوا كَاتِبًا فَرِهَانٌ مَقْبُوضَةٌ
“যদি তোমরা ভ্রমণরত থাক আর [ঋণ লেনদেনের দলিল দস্বাবিক লেখার জন্যে] কোনো লেখক না পাও, তবে সাথে সাথে অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যায় এমন বস্তু বন্ধক রেখে কার্য সম্পদান কর।” [আল বাকারাঃ ২৮৩]
لِلرِّجَالِ نَصِيبٌ مِمَّا تَرَكَ الْوَالِدَانِ وَالْأَقْرَبُونَ وَلِلنِّسَاءِ نَصِيبٌ مِمَّا تَرَكَ الْوَالِدَانِ وَالْأَقْرَبُونَ
“পিতামাত ও নিকটাত্মীয়দের পরিত্যক্ত অর্থসম্পদে পুরুষের অংশ রয়েছে। মহিলাদেরও অংশ রয়েছে পিতামাতা এবং নিকটাত্মীয়দের রেখে যাওয়া অর্থসম্পদে।” [আন নিসাঃ ৭]
لَا تَدْخُلُوا بُيُوتًا غَيْرَ بُيُوتِكُمْ حَتَّى تَسْتَأْنِسُوا
“অনুমতি না নেয়া পর্যন্ত নিজেদের ঘর ছাড়া অন্যদের ঘরে প্রবেশ করোনা।” [আন নূরঃ ২৭]
أَوَلَمْ يَرَوْا أَنَّا خَلَقْنَا لَهُمْ مِمَّا عَمِلَتْ أَيْدِينَا أَنْعَامًا فَهُمْ لَهَا مَالِكُون
“ওরা কি দেখেনা, আমরা তাদের জন্যে নিজের হাতে বানানো জিনিসগুলোর মধ্যে গৃহপালিত পশুও সৃষ্টি করেছি, আর তারা সেগুলোর মালিক হয়েছে?” [সূরা ইয়াসীনঃ ৭১}
وَالسَّارِقُ وَالسَّارِقَةُ فَاقْطَعُوا أَيْدِيَهُمَا
“পুরুষ চোর এবং নারী চোর উভয়ের হাত কেটে দাও।” [আল মায়িদাঃ ৩৮]
وَآتُوا حَقَّهُ يَوْمَ حَصَادِهِ
“ফসল কাটার দিন [জমির উৎপাদন থেকে] আল্লাহর অধিকার পরিশোধ কর।” [আল আনআমঃ ১৪১]
خُذْ مِنْ أَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً
“হে নবী! তাদের অর্থসম্পদ থেকে যাকাত আদায় কর।” [আত তওবাঃ ১০৩]
وَآتُوا الْيَتَامَى أَمْوَالَهُمْ وَلَا تَتَبَدَّلُوا الْخَبِيثَ بِالطَّيِّبِ وَلَا تَأْكُلُوا أَمْوَالَهُمْ إِلَى أَمْوَالِكُمْ إِنَّهُ كَانَ حُوبًا كَبِيرًا
“আর এতীমদের অর্থসম্পদ তাদের হাতে অর্পণ কর। এবং তাদের অর্থসম্পদ নিজের অর্থসম্পদের সাথে মিশ্রণ করে ভক্ষণ করোনা।” [আন নিসাঃ ২]
أُحِلَّ لَكُمْ مَا وَرَاءَ ذَلِكُمْ أَنْ تَبْتَغُوا بِأَمْوَالِكُمْ مُحْصِنِينَ غَيْرَ مُسَافِحِينَ
“এই [নিষেধ করা মহিলাদের] ছাড়া আর যতো মেয়ে মানুষ রয়েছে, তাদেরকে নিজেদের অর্থসম্পদরে বিনিময়ে হাসিল করা তোমাদের জন্যে বৈধ করে দেয়া হয়েছে, যদি তোমরা তাদেরকে বিয়ের দুর্গে সুরক্ষিত কর এবং অবৈধ সম্পর্ক স্থাপন না কর।” [আন নিসাঃ ২৪]
وَآتُوا النِّسَاءَ صَدُقَاتِهِنَّ نِحْلَةً
“আর সন্তুষ্টচিত্তে স্ত্রীদেরকে তাদের মোহর পরিশোধ করে দাও।” [আন নিসাঃ ৪]
وَآتَيْتُمْ إِحْدَاهُنَّ قِنْطَارًا فَلَا تَأْخُذُوا مِنْهُ شَيْئًا
“[বিয়ের সময়] স্ত্রীকে অঢেল অর্থসম্পদ দিয়ে থাকলেও [তালাক দেয়ার সময়] তা থেকে কিছুই ফেরত নেবেনা।” [আন নিসাঃ ২০]
) مَثَلُ الَّذِينَ يُنْفِقُونَ أَمْوَالَهُمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ كَمَثَلِ حَبَّةٍ أَنْبَتَتْ سَبْعَ سَنَابِلَ
“যারা নিজেদের অর্থসম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করে তাদের এই ব্যয়ের উপমা হলো এমন, যেমন একটি বীজ বপন করা হলো এবং তার থেকে বের হলো সাতটি ছড়া।” [আল বাকারাঃ ২৬১]
وَتُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ
“আর তোমরা জিহাদ কর আল্লাহর পথে নিজেদের অর্থসম্পদ ও জানপ্রাণ দিয়ে।” [আস সফঃ ১১]
وَفِي أَمْوَالِهِمْ حَقٌّ لِلسَّائِلِ وَالْمَحْرُومِ
“আর তাদের অর্থসম্পদে অধিকার রয়েছে প্রার্থী [সাহায্যপ্রার্তী] ও বঞ্চিতদের।” [সূরা যারীয়াতঃ ১৯]
উল্লেখিত নির্দেশ ও উপদেশসমূহের একটিও ব্যক্তিমালিকানাবিহীন অবস্থায় ধারণা পর্যন্ত করা যেতে পারেনা। কুরআন এমন এক অপরিহার্য অর্থনৈতিক পরিকল্পনা পেশ করে, যা সার্বিক পর্যায়ে ব্যক্তির মালিকানাধিকারের উপর প্রতিষ্ঠিত। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী [Consumer goods] এবং উৎপদান মাধ্যম [Means of Production] –এর মধ্যে বিভক্তি টেনে কেবলমাত্র প্রথমোক্তটি পর্যন্ত ব্যক্তিমালিকানাকে সীমীত রাখা এবং শেষোক্তটি পর্যন্ত জাতীয়করণ করার ধারণা করার কোনো সুযোগ এতে নাই। একইভাবে এতে শ্রমের মাধ্যমে উপার্জিত অর্থমসম্পদ [Earned Income] এবং বিনা পরিশ্রমে উপার্জিত অর্থসম্পদ [Unearned Income]-এর মধ্যে কোনো পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়না। যেমন, একথা সবারই জানা যে, কোনো ব্যক্তি বাবা মা, সন্তান সন্ততি, স্বামী বা স্ত্রী কিংবা ভাইবোন থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে যে অর্থসম্পদ লাভ করে তা তার শ্রমের মাধ্যমে উপার্জিত সম্পদ নয়, আর যাকে যাকাত দেয়া হয়, তার জন্যেও তার প্রাপ্ত যাকাতের অর্থ শ্রমের মাধ্যমে উপার্জিত সম্পদ নয়। তাছাড়া এই অর্থনৈতিক পরিকল্পনার মধ্যে এমন ধারণারও নাম গন্ধ পাওয়া যায়না যে, তা কেবল একটি অস্থায়ী সময়কালের জন্যে। আর প্রকৃত উদ্দেশ্য এমন একটি চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হওয়া, যেখানে পৌঁছে ব্যক্তিমালিকানা খতম করে জাতীয় মালিকানা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হবে। এটাই যদি প্রকত উদ্দেশ্য হতো, তবে অবশ্যি কুরআন তা সুস্পষ্ট ভাষায় বলে দিতো এবং সে ব্যবস্থা সম্পর্কে উপদেশ ও নির্দেশাবলী পদান করতো। আল কুরআনের সূরা আ’রাফের—{আরবী****************} “যমীন আল্লাহর” [আয়াতঃ ১২১২৮] আয়াত থেকে ‘ব্যক্তিগত মালিকানা বাতিল এবং জাতীয় মালিকানা স্বীকৃত’ –এরূপ অর্থ উত্থাপন করার কোন অবকাশ নেই। কুরআন তো একথাও বলেঃ
لِلَّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ
“আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছুই আছে সব আল্লাহর।” [আলবাকারাঃ ২৮৪]
এর থেকে এরূপ অর্থ বের করা যেতে পারেনা যে, পৃথিবী ও আকাশের কোনো কিছুতেই ব্যক্তিমালিকানা থাকবেনা এবং টেনে হিঁচড়ে এ অর্থও বের করা যেতে পারেনা যে, সবকিছুই জাতীয় মালিকানায় থাকবে। আল্লাহর মালিকানা যদি মানব মালিকানার অস্বীকৃতি হয়ে থকে, তবে তা অবশ্যি ব্যক্তিমালিকানা এবং জাতীয় মালিকানা উভয়টার জন্যেই অস্বীকৃতবোধ হতে হবে। সূরা হামীম আস্ সাজদারঃ
وَقَدَّرَ فِيهَا أَقْوَاتَهَا فِي أَرْبَعَةِ أَيَّامٍ سَوَاءً لِلسَّائِلِينَ
“আর তিনি তাতে পূর্ণ চারদিনে প্রার্থীদের প্রত্যেকের প্রয়োজন পরিমাণ খাদ্যসামগ্রী সঞ্চিত করে রেখেছেন” [আয়াতঃ ১০]। এই আয়াতটি থেকেও এরূপ যুক্তি গ্রহণ করা কিছুতেই সঠিক নয় যে, “কুরআন পৃথিবীর সমুদয় খাদ্য উপকরণকে সকল মানুষের জন্যে সমবন্টন করতে চায়, আর এ সাম্য জাতীয় মালিকানা ছাড়া প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। সুতরাং জাতীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠা করাই কুরআনের লক্ষ্য।” আয়াতটির অনুবাদ যতি এমনটি ধরেও নেয়া হয় যে: “আল্লাহ পৃথিবীতে খাদ্য উপকরণসমূহ চারদিনে একটি পরিমাণ মতো রেখে দিয়েছেন, যা সব প্রার্থীর জন্যে সমান সমান,” [এরূপ অনুবাদ মোটেও সঠিক নয়। আয়াতটির মূল শব্দগুলো হলো এরূপঃ (আরবী***************)
আল্লামা যমখশরী, বায়দাবী, রাযী, আলূসী এবং অন্যান্য মুফাসসিরগণ এখা (আরবী****************) শব্দের সম্পর্কে (*************) শব্দের সাথে স্থাপন করেছেন এবং এর অর্থ করেছেনঃ পূর্ণ চারদিনে আল্লাহ তা’আলা এ কাজ করেছেন। যেসব মুফাসসির (আরবী****০ শব্দের সম্পর্ক (আরবী********) শব্দের সাথে স্থাপন করেছেন তারা এর অর্থ করেছেনঃ “সব প্রার্থীর জন্যে সরবরাহ করেছেন” অথবা “সব প্রার্থীর প্রার্থনা অনুযায়ী।” অধিক ব্যখ্যার জন্যে দ্রষ্টব্যঃ তাফহীমুল কুরআন, সূরা হামীম আস সাজদা, টীকাঃ ১২।]
সেক্ষেত্রেও “সব প্রার্থী” দ্বারা শুধু মানুষ অর্থ করা সঠিক হতে পারেনা। মানুষ ছাড়া সেইসব প্রাণীও প্রার্থ যাদের জীবিকার উপকরণ আল্লাহ তা’আলা এই পৃথিবীতেই রেখে দিয়েছেন। এ আয়াতের দৃষ্টিতে সব প্রার্থীর অংশ যদি সমান সমানই হয়, তবে এই সাম্যের অধিকার কেবলমাত্র মানুষের জন্যে নির্দিষ্ট হবার কোনো দলীল নেই। এমনি করে কুরআনের যেসব আয়াতে দুঃস্থদের জীবিকা পৌঁছানের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে, সেসব আয়াত দ্বারাও এ যু্ক্তি গ্রহণকরা যেতে পারেনা যে, এ উদ্দেশ্যে কুরআন জাতীয় মালিকানার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চায়। কুরআন যেখানে এই প্রয়োজনের কথা উল্লেখ কছে, সেখানেই তা পূরণ করার জন্যে একটিই মাত্র প্রক্রিয়ার কথা বলে দিয়েছে। তা হলো, সমাজে সচ্ছল ব্যক্তিরা নিজেদের দরিদ্র আত্মীয় স্বজন, এতীম, মিসকীন এবং অন্যান্য বঞ্চিত ও অসচ্ছল লোকদের জন্যে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে নিজেরাও ব্যক্তিগতভাবে উঁদার প্রাণে ব্যয় করবে আর রাষ্ট্রও তাদের অর্থসম্পদ থেকে একটি নির্দিষ্ট অংশ আদায় করে এ কাজে ব্যয় করবে। উল্লেখিত উদ্দেশ্য পূরণের জন্যে এই বাস্তব কর্মপন্থা অবলম্বন করা ছাড়া অপর কোনো পন্থা পদ্ধতর ধারণাটুক পর্যন্ত কুরআনে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত।
সন্দেহ নেই, কোনো বিশেষ জিনিসকে ব্যক্তিগত পরিচালনা পরিবর্তে জাতীয় পরিচালনায় নেয়ার প্রয়োজন অনুভূত হলে কুরআনের কোনো নির্দেশ প্রতিবন্ধকও নয়। তবে ব্যক্তিমালিকানার সম্পূর্ণ অস্বীকৃত এবং জাতীয় মালিকানার দৃষ্টিভংগিকে একটি দর্শন ও ব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করা—কুরআন মানুষের জন্যে যে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা দিয়েছে, তার সাথে মোটেও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আর কুরআন মানব সমাজের জন্যে যে রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রস্তাব করেছে, তার দৃষ্টিতে কোনো জিনিসকে ব্যক্তিমালিকানার পরিবর্তে জাতীয় মালিকানায় নেয়া প্রয়োজন বলে সিদ্ধান্ত নেয়া কোনো দল বা পার্টির কাজ নয়। বরঞ্চ জনগণের স্বাধীন মতামতের ভিত্তিতে নির্বাচিত সদস্যদের একটি মজলিসে শূরাই কেবল এরূপ সিদ্ধন্ত নিতে পারে। [কুরআনের প্রস্তাবিত রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিস্তারিত রূপ অবগত হবার জন্যে আমার প্রণীত ‘খেলাফত ও রাজতন্ত্র’ গ্রন্থের প্রথম অধ্যায় দ্রষ্টব্য।]
৪. অর্থনৈতিক সাম্যের অস্বাভাবিক ধারণা
মহান আল্লাহ্র সৃষ্ট প্রকৃতির একটি অপরিহার্য দিক হিসেবেই কুরআন এ সত্যকে উপস্থাপন করেছ যে, অন্য সব জিনিসের মতোই মানুষের মাঝে জীবিকা এবং জীবনোপকরণের সমতা অর্তমান। বিভিন্ন সমাজব্যবস্থার কৃত্রিম অসাম্য নয়, িএই প্রাকৃতিক অসাম্য কুরআন মহান আল্লাহর কৌশলগত বিবেচনা এবং তাঁর বন্টন ব্যবস্থা [Dispensation] ফলশ্রুতি বলে আখ্যায়িত করে। তাঁর গোটা স্কীমের মধ্যে কোথাও এমন ধারণার চিহ্ন পর্যন্ত পাওয়া যায় না যে, এই অসাম্যকে নির্মূল করে এমন একটি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করা তাঁর কাম্য, যেখানে সবাই সাম্যের ভিত্তিতে জীবিকার উপায় উপকরণ লাভ করবে। এ ব্যাপারে কুরআনের ভাষণঃ وَهُوَ الَّذِي جَعَلَكُمْ خَلَائِفَ الْأَرْضِ وَرَفَعَ بَعْضَكُمْ فَوْقَ بَعْضٍ دَرَجَاتٍ لِيَبْلُوَكُمْ فِي مَا آتَاكُمْ
“তিনি আল্লাহ্ই , যিনি পৃথিবীতে তোমাদের খলিফা বানিয়েছেন এবং তোমাদের একজনকে আরেকজনের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। উদ্দেশ্য হলো, তোমাদের তিনি যা কিছুই দিয়েছেন, এভাবে তাম মাধ্যমে তিনি তোমাদের পরীক্ষা করবেন।” [আল আন’আনমঃ ১৬৫]
انْظُرْ كَيْفَ فَضَّلْنَا بَعْضَهُمْ عَلَى بَعْضٍ وَلَلْآخِرَةُ أَكْبَرُ دَرَجَاتٍ وَأَكْبَرُ تَفْضِيلًا
“চেয়ে দেখো, আমরা কিভাবে কিছূ লোককে অপর কিছু লোকের উপর মর্যাদা দান করেছি। আর পরকাল তো শ্রেণী মর্যাদার পর্থক্যের দিক থেকে আরো অনেক বড়।” [বনী ইসরাঈলঃ ২১]
أَهُمْ يَقْسِمُونَ رَحْمَتَ رَبِّكَ نَحْنُ قَسَمْنَا بَيْنَهُمْ مَعِيشَتَهُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَرَفَعْنَا بَعْضَهُمْ فَوْقَ بَعْضٍ دَرَجَاتٍ لِيَتَّخِذَ بَعْضُهُمْ بَعْضًا سُخْرِيًّا وَرَحْمَتُ رَبِّكَ خَيْرٌ مِمَّا يَجْمَعُونَ
“ওরা কি তোমার প্রভুর অনুগ্রহ [নবুওয়ত]-কে বন্টন করতে চায়? পার্থিব জীবনে আমরা তাদের মাঝে তাদের জীবিকা বন্টন করে দিয়েছি। তাদের কিচু লোককে অপর কিছু লোকের উপর মর্যাদা দান করেছি। এটা এজন্য করেছি যাতে তাদের কিছু লোক অপর লোকদের দ্বারা কাজ করিয়ে নিতে পারে। আর তোমার মনিবের রহমত [অর্থাৎ নবুয়ত] তো তাদের পুঞ্জিভূত অর্থসম্পদ থেকে উত্তম।”[যে ঘটনার প্রেক্ষিতে কথাটি বলা হয়েছে, তা হলোঃ মুহাম্মদ (সা)-এর বিরুদ্ধবাদীরা বলতো, মক্কা এবং তায়েফের কোনো বড় সরদারকে কেন নবী বানানো হলোনা। আল্লাহ যদি নবী পাঠানের দরকারই হয়ে থাকে, তবে সেজন্যে মুহাম্মদকে (সা) মনোনীত করার কী কারণ থাতে পারে?] [সূরা যুখরুফঃ ৩২]
إِنَّ رَبَّكَ يَبْسُطُ الرِّزْقَ لِمَنْ يَشَاءُ وَيَقْدِرُ إِنَّهُ كَانَ بِعِبَادِهِ خَبِيرًا بَصِيرًا
“মূলত, তোমার মালিক যার জন্যে ইচ্ছা জীবিকা প্রশস্ত করে দেন, আর যাকে ইচআ মাপাঝোপা দিয়ে থাকেন। তিনি তাঁর দাসদের সব খবর রাখেন এবং তাদের সকল অবস্থার উপর দৃষ্টি রাখেন।” [বনী ইসরাঈলঃ ৩০]
لَهُ مَقَالِيدُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ يَبْسُطُ الرِّزْقَ لِمَنْ يَشَاءُ وَيَقْدِرُ إِنَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ
“আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর চাবিকাঠি তাঁরই মুষ্টিবদ্ধে। তিনি যাকে ইচ্ছা জীবিকা প্রশস্ত করে দেন আর যাকে ইচ্ছা মাপাঝোপা প্রদান করেন। তিনি সর্ববিষয়ে জ্ঞঅনের মালিক।” [আশ শূরাঃ ১২]
وَيَقُولُونَ مَتَى هَذَا الْوَعْدُ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ
“হে নবী, বলে দাওঃ আমার মনিব তাঁর দাসদের যাকে চান জীবিকা প্রশস্ত করে দেন আর যাকে চান মাপাঝোপা করে দেন।” [আস সাবাঃ ৩৯]
কুরআন এই প্রাকৃতিক অসাম্যকে ঠাণ্ডা মাথায় মেনে নেয়ার জন্যে মানুষকে উপদেশ দিয়েছ। আল্লাহ অন্যদেরকে যে মর্যাদা ও অনুগ্রহ দান করেছেন, তার জন্যে ইর্ষান্বিত না হবারও পরামর্শ দিয়েছেনঃ
وَلَا تَتَمَنَّوْا مَا فَضَّلَ اللَّهُ بِهِ بَعْضَكُمْ عَلَى بَعْضٍ لِلرِّجَالِ نَصِيبٌ مِمَّا اكْتَسَبُوا وَلِلنِّسَاءِ نَصِيبٌ مِمَّا اكْتَسَبْنَ وَاسْأَلُوا اللَّهَ مِنْ فَضْلِهِ إِنَّ اللَّهَ كَانَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمًا
“তোমাদের একজনের চেয়ে আরেকজনকে আল্লাহ যা কিছু বেশী দিয়েছেন, তোমরা তার জন্যে লোভ করোনা। যা পুরুষের উপার্জন করেছে, সে অনুযায়ী তাদের অংশ রয়েছে আর যা নারীরা উপার্জন করেছে, সে অনুযায়ী তাদের অংশ নির্দিষ্ট। আল্লাহর কাছে তাঁর অনুগ্রহ লাভের জন্যে প্রার্থনা কর। অবশ্যি আল্লাহ সব বিষয়ে জ্ঞান রাখেন।” [আন নিসাঃ ৩২]
وَاللَّهُ فَضَّلَ بَعْضَكُمْ عَلَى بَعْضٍ فِي الرِّزْقِ فَمَا الَّذِينَ فُضِّلُوا بِرَادِّي رِزْقِهِمْ عَلَى مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُمْ فَهُمْ فِيهِ سَوَاءٌ أَفَبِنِعْمَةِ اللَّهِ يَجْحَدُونَ
“আল্লাহ তোমাদের কিছু লোককে অপর কিছু লোকের তুলনায় অধিক জীবিকা দিয়েছেন। যাদেরকে বেশী দেয়া হয়েছে তারা তাদেরই এই জীবিকা এই ভয়ে তাদের অধীনস্থ ভৃত্যদের প্রতি প্রত্যাবর্তন করাতে চায়না যে, এই জীবিকার ক্ষেত্রে তারা উভয়ই সমান সমান অংশীদার হয়ে যাবে। তাহলে এটা কি আল্লাহর অনুগ্রহই অস্বীকার করছে।” [আন নহলঃ ৭১]
ضَرَبَ لَكُمْ مَثَلًا مِنْ أَنْفُسِكُمْ هَلْ لَكُمْ مِنْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ مِنْ شُرَكَاءَ فِي مَا رَزَقْنَاكُمْ فَأَنْتُمْ فِيهِ سَوَاءٌ تَخَافُونَهُمْ كَخِيفَتِكُمْ أَنْفُسَكُمْ كَذَلِكَ نُفَصِّلُ الْآيَاتِ لِقَوْمٍ يَعْقِلُونَ
“আল্লাহ তোমাদের নিজেদের (অবস্থা) থেকে তোমাদের জন্যে একটি দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন। তোমাদের মালিকানাধীন ভৃত্যদের মাঝে এমন ভৃত্যও কি আছে যারা— আমি তোমারেদ যে জীবিকা দিয়েছি তাতে তোমাদের সমান অংশীদার হবে? আর তোমরা কি তাদেরকে সেরকম ভয় করবে, যেমন ভয় কর নিজেদের সমমানের লোকদের? আমরা এভাবেই বুদ্ধি বিবেক রাখে এমন লোকদের জন্যে নিদর্শনসমূহ পরিষ্কার করে বর্ণনা করি।” [আর রূমঃ ২৮]
শেষোক্ত আয়াত দুটির শব্দাবলী থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় এবং যে প্রেক্ষিতে কথা বলা হয়েছে, তা থেকেও একথা স্পষ্ট যে, এখানে অর্থনৈতিক অসাম্যকে নিন্দা করা এবং তা নির্মূল করে সাম্য প্রতিষ্ঠা করার শিক্ষা দেয়া হয়নি। বরঞ্চ প্রকৃত ব্যাপা হলো, মানুষের মধ্যে যে শিরক পাওয়া যায় তার বিরুদ্ধে দলীল হিসেবেই দৃষ্টান্তগুলো পেশ করা হয়েছে। অর্থাৎ এ যুক্তি পেশ করা হযেছে যে, তোমরা যখন আল্লাহ প্রদত্ত জীবিকার মধ্যেই তোমাদের ভৃত্যদেরকে নিজেদের সমান অংশীদার বানাতে প্রস্তুত নও, তখন আল্লাহ সম্পর্কে এ ধারণা কেমন করে পোষণ কর যে, তাঁর সৃষ্টি তাঁর খোদায়ীতে অংশীদার হতে পারে? [সূরা আন নহলের ৭১ থেকে ৭৬ এবং সূরা আর রূমের ২০ থেকে ৩৫ আয়াত অধ্যয়ন করলে এ কথাগুলো পূর্ণরূপে স্পষ্ট হবে। উভয় আয়াতেই আলোচ্য বিষয় হলো শিরক বাতিল এব তাওহীদকে সঠিক প্রমাণিত করা। উভয়স্থানের ব্যাখ্যার জন্যে দ্রষ্টব্য তাফহীমুল কুরআন মূল দ্বিতীয় খন্ড ৫৫৪ থেকে ৫৫৮ পৃষ্ঠা এবং মূল তৃতীয় খন্ড ৭৪২ থেকে ৭৫৬ পৃষ্ঠা।]
৫. বৈরাগ্যনীতির পরিবর্তে মধ্যপন্থা এবং বিধিনিষেধ
কুরআন অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বারবার এ সত্য বর্ণনা করছে যে, মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাহদের ভোগ ব্যবহারের জন্যেই পৃথিবীতে তাঁর যাবতীয় নিয়ামত সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ ইচ্ছা কখনো এ নয় এবং এমনটি হতে পারেনা যে, মানুষ এসব নিয়ামত পরিত্যাগ করে বৈরাগ্যনীতি অবলম্বন করবে। তবে তিনি যা চান, তা হলো, মানুষ পবিত্র এবং অপবিত্রের মধ্যে পার্থক্য করবে। বৈধ এবং অবৈধ পন্থার মধ্যে পরখ করবে। ভোগ ব্যবহার এবং লাভস্বার্থ কেবল হালাল ও পবিত্র পর্যন্ত সীমিত রাখবে এবং এক্ষেত্রেও মধ্যমপন্থার সীমা অতিক্রম করবে না।
هُوَ الَّذِي خَلَقَ لَكُمْ مَا فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا
“তিনিই সেসবই তোমাদের জন্যে সৃষ্টি করেছেন, যা পৃথিবীতে রয়েছে।” [আল বাকারাঃ ২৯]
قُلْ مَنْ حَرَّمَ زِينَةَ اللَّهِ الَّتِي أَخْرَجَ لِعِبَادِهِ وَالطَّيِّبَاتِ مِنَ الرِّزْقِ
“হে নবী, ওদের জিজ্ঞেস কর, আল্লাহ সেসব সৌন্দর্য কে হারাম করেছে, যা তিনি তাঁর বান্দাহদের জন্যে বের করেছেন আর জীবিকার পবিত্র জিনিস সমূহকে?” [আল আরাফঃ ৩২]
وَكُلُوا مِمَّا رَزَقَكُمُ اللَّهُ حَلَالًا طَيِّبًا وَاتَّقُوا اللَّهَ الَّذِي أَنْتُمْ بِهِ مُؤْمِنُونَ
“আল্লাহ যেসব হালাল ও পবিত্র জীবিকা তোমাদের দিয়েছেন তা থেকে খাও। আর সেই আল্লাহর অসন্তুষ্টি থেকে আত্মরক্ষা কর যাঁর প্রতি তোমরা ঈমান এনেছো।” [আল মায়িদাঃ ৮৮]
يَا أَيُّهَا النَّاسُ كُلُوا مِمَّا فِي الْأَرْضِ حَلَالًا طَيِّبًا وَلَا تَتَّبِعُوا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُبِينٌ
“হে মানুষ পৃথিবীতে যা কিছু হালাল ও পবিত্র তা খাও আর শয়তানে পদাংক অনুসরণ করোনা। কারন, সেতো তোমাদের সুস্টষ্ট শত্রু।” [আল বাকারাঃ ১৬৮]
وَكُلُوا وَاشْرَبُوا وَلَا تُسْرِفُوا إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُسْرِفِينَ
“আহার কর। পান কর। সীমালংঘন করোনা। আল্লাহ সীমালংঘনকারীদের পছন্দ করেন না।” [আল আ’রাফঃ ৩১]
وَرَهْبَانِيَّةً ابْتَدَعُوهَا مَا كَتَبْنَاهَا عَلَيْهِمْ إِلَّا ابْتِغَاءَ رِضْوَانِ اللَّهِ فَمَا رَعَوْهَا حَقَّ رِعَايَتِهَا
“আর বৈরাগ্য [সংসার ত্যাগ ও বাস্তব জীবন থেকে পলায়ন] নীতি তারা [অর্থাৎ ঈসা ইবনে মরিয়মের (আ) অনুসারীরা] নিজেরাই উদ্ভাবন করে নিয়েছে। এটা আমি তাদের প্রতি লিখৈ দিইনি। আমি তো লিখে দিয়েছিলাম কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির অনুসন্ধান। কিন্তু তারা সে কর্তব্য যথার্থভাবে পালন করেনি।” [আল হাদীদঃ ২৭]
৬. অর্থসম্পদ উপার্জনে হারাম হালাল বিবেচনা করা
এ উদ্দেশ্যে কুরআন বিধিনিষেধ আরোপ করে বলে দিয়েছে, অর্থসম্পদ শুধুমাত্র বৈধ পন্থায় অর্জন করতে হবে, আর অবৈধ পন্থা সম্পূর্ণরূপে বর্জন করতে হবেঃ
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَأْكُلُوا أَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ إِلَّا أَنْ تَكُونَ تِجَارَةً عَنْ تَرَاضٍ مِنْكُمْ وَلَا تَقْتُلُوا أَنْفُسَكُمْ إِنَّ اللَّهَ كَانَ بِكُمْ رَحِيمًا “হে লোকেরা, যারা ঈমান এনেছো! তোমরা নিজেদের মধ্যে অন্যায়াবে একে অপরের সম্পদ ভক্ষণ করোনা। তবে পারস্পরিক সন্তুষ্টির ভিত্তিতে তিজারত [এখানে কুরআনে —-তিজারাত শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। এর অর্থ আদান প্রদানের ভিত্তিতে দ্রব্যসামগ্রী এবং সেবা বিনিময় করা [দ্রষ্টব্যঃ জাস্সাসঃ আহকামুল কুরআন, ২য় খণ্ড ২১০ পৃষ্ঠা, আলবাহীয়া সংস্করণ মিশর ১৩৪৭ হিজরী। ইবনুল আরবীঃ আহকামুল কুরআন প্রথম খণ্ড ১৭০ পৃষ্ঠা, আস সায়াদা সংস্কারণ মিশর ১৩৩১ হিজরী]
‘পারস্পরিক সন্তুষ্টি’র শর্তারোপ থেকে স্পষ্ট বুঝা যায়, এ বিনিময়ে কোনো প্রকার দমনপীড়ন, ধোঁকা প্রতারণা কিংবা ছলচাতুরী থাকবেনা, যা অপর পক্ষের গোচরীভূত হলে যে অসন্তুষ্ট হবে।]করতে পারো। আর নিজেকে নিজে [কিংবা পরস্পরকে] তোমরা হত্যা করোনা। আল্লাহ অবশ্যি তোমাদের প্রতি কৃপাময়।” [আন নিসাঃ ২৯]
৭. অর্থসম্পদ উপার্জনের অবৈধ পন্থা
রাসূলে করীমের (সা) হাদীসে এবং ফকীহ্গণ কর্তৃক ফিকাহ গ্রন্থাবলীতে অর্থোপার্জনের অন্যায় অবৈধ পন্থাসমূহের বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু কিচু কিছু অন্যায় অবৈধ পন্থার কথা কুরআনেও সুস্পষ্টভাবে বলে দেয়া হয়েছেঃ
وَلَا تَأْكُلُوا أَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ وَتُدْلُوا بِهَا إِلَى الْحُكَّامِ لِتَأْكُلُوا فَرِيقًا مِنْ أَمْوَالِ النَّاسِ بِالْإِثْمِ وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ
[ক] “তোমরা নিজেদের পরস্পরের অর্থসম্পদ অন্যায় অবৈধভাবে ভক্ষণ করোনা। আর জেনে বুঝে অপরাধমূলক পন্থায় অপরের সম্পদের কিচু অংশ ভক্ষণ করার উদ্দেশ্যে তা শাসকদের কাছে উপস্থাপন করোনা। [ শাকসদের সামনে উপস্থাপন করা মানে অপরের অর্থসম্পদের মিথ্যা মালিকনা দাবী করে শাসকদের দ্বারস্থ হওয়াও হতে পারে, আবার শাসকদের ঘুষ দিয়ে অন্যদের মালিকানাধীন অর্থসম্পদ অধিকারমূলকভাবে কবজা করে নেয়াও হতে পারে। [আলূসীঃ সূহুল মুয়ানী, ২য় খণ্ড, ৬০ পৃষ্ঠা।] [আল বাকারাঃ ১৮৮]
فَإِنْ أَمِنَ بَعْضُكُمْ بَعْضًا فَلْيُؤَدِّ الَّذِي اؤْتُمِنَ أَمَانَتَهُ وَلْيَتَّقِ اللَّهَ رَبَّهُ
[খ] “তোমাদের কেউ যদি অপরের উপর আস্থা স্থাপন করে তার দায়িত্বে কোনো আমানত রাখে, তবে যার উপর আস্থা স্থাপন করা হযেছে, সে যেন আস্থাস্থাপনকারীর আমানত ফেরত দেয় এবং নিজের মনিব আল্লাহ্র অনসন্তুষ্টি থেকে যেন আত্মরক্ষা করে।” [আল বাকারাঃ ২৮৩]
وَمَنْ يَغْلُلْ يَأْتِ بِمَا غَلَّ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ثُمَّ تُوَفَّى كُلُّ نَفْسٍ مَا كَسَبَتْ
[গ] “আর যে আত্মসাত [জনগণের অর্থসম্পদরে খিয়ানত] করবে, কিয়ামতের দিন সে অবশ্যি এ আত্মসাতসহ হাযির হবে। অতঃপর প্রত্যেক ব্যক্তি সেখানে তার কৃতকর্মের পরিপূর্ণ প্রতিফল প্রদান করা হবে।” [আলে ইমরানঃ ১৬১]
وَالسَّارِقُ وَالسَّارِقَةُ فَاقْطَعُوا أَيْدِيَهُمَا
[ঘ] “চোর পুরুষ এবং চোর নারী উভয়ের হাত কেটে দাও।” [আল মায়িদাঃ ৩৮]
إِنَّمَا جَزَاءُ الَّذِينَ يُحَارِبُونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَيَسْعَوْنَ فِي الْأَرْضِ فَسَادًا أَنْ يُقَتَّلُوا ……………..
!যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে লড়াই করে এবং পৃথিবীতে বিপর্য ঘটায়[অর্থাৎ সেসব লোক, যারা ডাকাতি রাহাজানির মতো অপরাধ করে বেড়ায়।]তাদের দণ্ড হলো তাদের হত্যা করে ফেলা কিংবা শূলে চড়ানো…।” [আল মায়িদাঃ ৩৩]
إِنَّ الَّذِينَ يَأْكُلُونَ أَمْوَالَ الْيَتَامَى ظُلْمًا إِنَّمَا يَأْكُلُونَ فِي بُطُونِهِمْ نَارًا وَسَيَصْلَوْنَ سَعِيرًا
[ঙ] “যারা অন্যায়ভাবে এতীমের অর্থসম্পদ ভক্ষণ করে তারা মূলত নিজেরেদ পেটে আগুন ভর্তি করে। অচিরেই তারা জাহান্নমে নিক্ষিপ্ত হবে।” [আন নিসাঃ ১০]
إِذَا السَّمَاءُ انْفَطَرَتْ () وَإِذَا الْكَوَاكِبُ انْتَثَرَتْ () وَإِذَا الْبِحَارُ فُجِّرَتْ
[চ] “ধ্বংস সেইসব ঠকবাজদের জন্যে, যারা অপর লোকদের কাছ থেকে গ্রহণ করবার সময় পূর্ণমাত্রায় গ্রহণ করে, কিন্তু তাদের ওজন বা পরিমাপ করে দেবার সময় কম দিয়ে থাকে।” [আল মুতাফফিফীনঃ ১-৩]
إِنَّ الَّذِينَ يُحِبُّونَ أَنْ تَشِيعَ الْفَاحِشَةُ فِي الَّذِينَ آمَنُوا لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ
[ছ] “যারা চায় যে, ঈমানদার লোকদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার ঘটুক, তাদের জন্যে পৃথিবীর জীনে এবং পরকালে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে।” [আন নূরঃ ১৯]
وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَشْتَرِي لَهْوَ الْحَدِيثِ لِيُضِلَّ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَيَتَّخِذَهَا هُزُوًا أُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ مُهِينٌ
“এমন কিছু লোকও আছে, যারা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে বিভ্রান্ত করার জন্যে মনভুলানো কথা ক্রয় করে নানে…. এমন লোকদের জন্যে অপমানকর শাস্তি রয়েছে। [এখানে মনভুলানো কথা মানে গানবাদ্য, গল্পগুজব ও এমনসব খেলাধুলা যা মনুষকে আল্লাহর পথ থেকে বিভ্রান্ত করে। [ইবনে জরীর আত-তাবারীঃ জামেউল বয়ান ফী তাফসীরিল কুরআন, ২১শ খন্ড, ৩৯-৪১ পৃষ্ঠা আল আমেরীয়া সংস্করণ, মিশর, ১৩২৮ হিজরী।]] [সূরা লুকমানঃ ৬]
وَلَا تُكْرِهُوا فَتَيَاتِكُمْ عَلَى الْبِغَاءِ إِنْ أَرَدْنَ تَحَصُّنًا لِتَبْتَغُوا عَرَضَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا
[জ] “বৈষয়িক স্বার্থে নিজেদের দাসীদেরকে বেশ্যাবৃত্তির জন্যে বাধ্য করোনা, যখন তারা নিজেরা এরূপ কাজ থেকে আত্মরক্ষা করতে চায়।” [ এ আয়াতের প্রকৃত লক্ষ্য পতিতাবৃত্তির উচ্ছে। দাসীর কথা উল্লেখ করার কারণ হলো, প্রাচীন আরবে দাসীদের দিয়েই পতিতাবৃত্তির [Prostitution] ব্যবসা চালানো হতো। লোকেরা তাদের যুবতী সুন্দরী দাসীদেরকে গেলিতে বসিয়ে দিতো এবং তাদের উপার্জন ভক্ষণ করতো। [ইবনে জরীর তাবারী ১৮শ খণ্ড, ৫৫-৫৮, ১০৩-১০৪ পৃষ্ঠা। তাফসীর ইবনে কাসীরঃ ৩য় খণ্ড ২৮৮-২৮৯ পৃষ্ঠা, মুস্তফা মুহাম্মদ সংস্করণ মিশর ১৮৪৪ ইং। ইবনে আবদুল বারঃ আল ইসতিয়াবঃ ২য় খণ্ড, ৭৬২ পৃষ্ঠা, দায়েরাতুল মা’আরেফ, সংস্করণ হায়দারাবাদ ১৩৩৭ হিজরী।] [আন নূরঃ ৩৩]
وَلَا تَقْرَبُوا الزِّنَا إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَسَاءَ سَبِيلًا
“ব্যভিচারের কাছেও যেয়োনা। এ এক চরম অশ্লীলতা আর নোংরা নিকৃষ্ট পথ।” [বনী ইসরাঈলঃ ৩২]
الزَّانِيَةُ وَالزَّانِي فَاجْلِدُوا كُلَّ وَاحِدٍ مِنْهُمَا مِائَةَ جَلْدَةٍ
ব্যভিচারী পুরুষ এবং ব্যভিচারী নারী- তাদের প্রত্যেককে একশ’টি করে কশাঘাত কর।” [ জিনাকে অপরাধ বলে ঘোষণা করার সাথে সাথে ইসলাম জিনার মাধ্যমে উপার্জিত অর্থকেও হারাম করে দিযেছে। নবী করীম (সা) এ উপার্জনকে নিকৃষ্ট ধরনের উপার্জন বলে আখ্যায়িত করেছন। দ্রষ্টব্যঃ বুখারীঃ ৩৪ অধ্যায় ১১৩ অনুচ্ছেদ, ৩৭ অধ্যায় ২০ অনুচ্ছেদ, ৬৮ অধ্যায় ৫ অনুচ্ছেদ, ৭৬ অধ্যায় ৪৬ অনুচ্ছেদ, ৭৭ অধ্যরয় ৯৬ অনুচ্ছেদ। মুসলিমঃ ২২ অধ্যায় হাদীসের ক্রমিক সংখ্যা৩৯-৪১। আবু দাউদঃ ২২ অধ্যায় ৩৯-৬৩ অনুচ্ছেদ। তিরমিযীঃ ৯ অধ্যায় ৩৭ অনুচ্ছেদ, ১২ অধ্যায় ৪৬ অনুচ্ছেদ, ২৬ অধ্যায় ২৩ অনুচ্ছেদ। নাসায়ীঃ ৪২ অধ্যায় ৫ অনুচ্ছেদ, ৪৪ অধ্যায় ৯০ অনুচ্ছেদ। ইবনে মাজাহঃ ১২ অধ্যায় ৯ অনুচ্ছেদ।] [আন নূরঃ ২]
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْأَنْصَابُ وَالْأَزْلَامُ رِجْسٌ مِنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
[ঝ] “হে মুমিনরা! মদ, জুয়া, আসতানা ও পাশা এসবই নোংরা শয়তানী কাজ। অতএব তোমরা এসব পরিত্যাগ কর।” [কুরআনে যেসব জিনিস নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে, সেগুলোর উৎপাদন এবং ব্যবসাও নিষিদ্ধ। কেননা, কোনো জিনিস নিষিদ্ধ হবার দাবিই হলো, সে জিনিস দ্বারা কোনোভাবেই লাভবান হওয়া যাবেন। [আল জাস্সাস্: আহকামুল কুরআন, দ্বিতীয় খণ্ড ২১২ পৃষ্ঠা।] [আল মায়িদাঃ ৯০]
أَحَلَّ اللَّهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا
[ঞ] “আল্লাহ ব্যবসায়কে বৈধ করেছেন আর সুদকে নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন।” [এ থেকে বুঝা গেলো, ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তি মূলধনের উপর যে মুনাফা অর্জন করবে, কিংবা যৌথ ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে অংশহারে যে মুনাফা অংশীদারদের মধ্যে বন্টন করা হবে তা বৈধ। কিন্তু ঋণের ক্ষেত্রে ঋণদাতা যদি ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে মূলের চেয়ে কিছু বেশী আদায় করে, তবে তা হারাম। এটাকে আল্লাহ তা’আলা ব্যবসায়িক মুনাফার মতো বৈধ মুনাফা বলে ঘোষণা করেননি।]
[আল বাকারা:২৭৫]
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَذَرُوا مَا بَقِيَ مِنَ الرِّبَا إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ () فَإِنْ لَمْ تَفْعَلُوا فَأْذَنُوا بِحَرْبٍ مِنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ وَإِنْ تُبْتُمْ فَلَكُمْ رُءُوسُ أَمْوَالِكُمْ لَا تَظْلِمُونَ وَلَا تُظْلَمُونَ () وَإِنْ كَانَ ذُو عُسْرَةٍ فَنَظِرَةٌ إِلَى مَيْسَرَةٍ وَأَنْ تَصَدَّقُوا خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ
“হে লোকেরা, যারা ঈমান এনেছে! আল্লাহকে ভয় কর আর তোমাদের যে সুদ অনাদায়ী রয়ে গেছে, তা পরিত্যাগ কর যদি তোমরা [সত্যি] মুমিন হয়ে থাকো। আর তা যগি না কর, তবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা গ্রহণ কর। আর এখনো তওবা কর; তবে তোমরা মূলধন ফিরিয়ে নেবার অধিকার লাভ করবে। না তোমরা যুল্ম করবে, আর না তোমাদের প্রতি যুল্ম করা হবে। আর তোমাদের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণকারী যদি অভাবগ্রস্ত হয়, তবে সচ্ছল হওয়া পর্যন্ত তাকে অবকাশ দাও। আর যদি মাফ করে দাও, তবে এটাই হবে তোমাদের জন্যে উত্তম, যদি তোমরা বুঝ।” আয়াতের শব্দাবলী থেকে একথা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, এ নির্দেশ ঋণের সাথে সম্পর্কিত। ঋণের ক্ষেত্রে ঋণদাতা ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে মূলের অধিক কিছু নেয়ার শর্তারোপ করলে তা হবে সুদ। এই জিনিসটি সুদ হবার ক্ষেত্রে পরিমাণের কমবেশী কিংবা কোনো বিশেষ কাজ করার জন্যে গ্রহণ করা দ্বারা কোনো পার্থক্য হয়া। আজকাল যারা সুদ হারাম হওয়াকে শুধুমাত্র ব্যক্তিগত প্রয়োজনে নেয়া ঋণের ক্ষেত্রে সীমিত করার চেষ্টা করে আর ব্যবসয়িক ঋণের সুদ এবং ব্যাংকের সুদ বৈধ বলে, তাদের এককথার পক্ষে কুরআন, হাদীস ও ফিকাহর কোথাও কোনো দলীল নেই।] [আল বাকারাঃ ২৭৮-২৮০]
এভাকে কুরআন অর্থসম্পদ লাভের যেসব উপায় পন্থাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে, সেগুলোর সংক্ষিপ্ত তালিকা নিম্নরূপঃ
১. কারো অর্থসম্পদ তার ইচ্ছা ও বিনিময় ছাড়া গ্রহণ করা, কিংবা বিনিময় দিয়ে ও রাজি করিয়ে অথবা বিনিময় ছাড়া রাজি করিয় নেয়া। এমনভাবে রাজি করিয়ে নেয়া, যে রাজি করানো পিছে থাকে দমন পীড়ন এবং চাপ প্রয়োগ।
২. ঘুষ।
৩. জবরদখল, লুণ্ঠন ও আত্মসাত।
৪. খিয়ানত, চাই তা ব্যক্তির অর্থসম্পদ হোক, কিংবা জনগণের অর্থসম্পদ।
৫. চুরি, ডাকাতি।
৬. এতীমের অর্থসম্পদের বল্গাহীন ভোগ ব্যবহার।
৭. মাপ ও ওজনে কমবেশী করা।
৮. অশ্লীলতা প্রসারকারী উপায় উপকরণের ব্যবসা।
৯. গান বাজনার পেশা।
১০. পতিতাবৃত্তি ও ব্যভিচার।
১১. মদ উৎপাদন, তার ব্যবসা ও পরিবহণ।
১২. জুয়া এবং এমনসব উপায় পন্থা, যেসবের মাধ্যমে কিছু লোকের অর্থ অন্যদের হাতে কেবলমাত্র ভাগ্য বা ঘটনাচক্রের মাধ্যমে চলে যায়।
১৩. মূর্তি তৈরী, মূর্তির ক্রয় বিক্রয় এবং মন্দিরের সেবা।
১৪. ভাগ্য গণনা ও শকুন বিদ্যা প্রভৃতির ব্যবসা।
১৫. সুদ, পরিমাণ বেশী হোক কিংবা কম; ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ঋণ নেয়া হয়ে থাকুক কিংবা ব্যবসা, শিল্প বা কৃষি কাজের জন্য ঋণ নেয়া হোক সর্বাবস্থায় সুদ নিষিদ্ধ।
৮. কার্পণ্য ও পুঞ্জিভূত করার উপর নিষেধাজ্ঞা
অর্থসম্পদ লাভের ভ্রান্ত উপায় পন্থা নিষিদ্ধ করার সাথে সাথে কুরআন বৈধ পন্থায় অর্জিত অর্থসম্পদ পুঞ্জিভূত করে রাখাকেও তীব্রভাবে নিন্দা করেছে। কুরআন বলছে কার্পণ্য এক জঘন্য মন্দ কাজঃ
وَيْلٌ لِكُلِّ هُمَزَةٍ لُمَزَةٍ () الَّذِي جَمَعَ مَالًا وَعَدَّدَهُ () يَحْسَبُ أَنَّ مَالَهُ أَخْلَدَهُ () كَلَّا لَيُنْبَذَنَّ فِي الْحُطَمَةِ
“ধ্বংস এমন প্রত্যেক ব্যক্তির জন্যে, যে মানুষের দোষ প্রচার করে এবং গালাগাল করে। যে সম্পদ পুঞ্জিভূত করেছে এবং গুণে গুণে রেখেছে। সে মনে করে তার অর্থসম্পদ চিরদিন তার কাছে থাকবে। কখনো নয়। সে তো চূর্ণবিচূর্ণকারী স্থানে নিক্ষিপ্ত হবে।” [আল হুমাযা: ১-৪]
وَالَّذِينَ يَكْنِزُونَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلَا يُنْفِقُونَهَا فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَبَشِّرْهُمْ بِعَذَابٍ أَلِيمٍ
“সেইসব লোকদের কঠিন যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দাও, যারা সোনারূপা পুঞ্জিভূত করে রাখে, অথচ তা আল্লাহর পথে খরচ করেনা।” [আত-তাওবা:৩৪]
وَمَنْ يُوقَ شُحَّ نَفْسِهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ
“যারা মনের সংকীর্ণতা [বা মনের কার্পণ্য] থেকে মুক্ত থেকেছে, তারাই সফলকাম হবে।” [আত তাগাবুন: ১৬]
وَلَا يَحْسَبَنَّ الَّذِينَ يَبْخَلُونَ بِمَا آتَاهُمُ اللَّهُ مِنْ فَضْلِهِ هُوَ خَيْرًا لَهُمْ بَلْ هُوَ شَرٌّ لَهُمْ سَيُطَوَّقُونَ مَا بَخِلُوا بِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
“যারা আল্লাহ প্রদত্ত অনুগ্রহের ক্ষেত্রে কার্পণ্য করে, তারা যনো মনে না করে যে, এটা তাদের পক্ষে ভাল। না, বরঞ্চ এটা তাদের পক্ষে অত্যন্ত খারাপ। তারা কৃপণতা ক’রে যা কিছু সঞ্চয় করেছে, কিয়ামতের দিন তা-ই তাদের গলার রশি হয়ে দাঁড়াবে।” [এ কথাটি কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ভংগিতে বর্ণিত হয়েছে। উহাররণ স্বরূপ দ্রষ্টব্যঃ সূরা মুহাম্মদঃ ৩৮, আল হাদীদ: ২৪, আনকাবূত: ৩৪, মায়ারিজ: ২১, মুদ্দাসসির: ৪৫, আল ফাজর: ১৫-২০, আল লাইল: ১১, আল মাউন: ১, ২, ৩, ৭।] [আলে ইমরান: ১৮-]
৯. অর্থপূজা ও লোভ লালসার নিন্দা
এ প্রসংগে কুরআন আমাদের এ শিক্ষাও দেয় যে, অর্থপূজা, বৈষয়িক অর্থসম্পদের প্রতি আসক্তি এবং প্রাচুর্যের কার ণে গর্ব অহংকার মানুষের পথভ্রষ্টতা এবং অবশেষে তার ধ্বংসের অন্যতম বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায়ঃ
أَلْهَاكُمُ التَّكَاثُرُ () حَتَّى زُرْتُمُ الْمَقَابِرَ () كَلَّا سَوْفَ تَعْلَمُونَ
“তোমাদেরকে অধিক অধিক অর্থস্পদ সঞ্চিত করার চিন্তা চরমভাবে নিমগ্ন করে রেখেছে। কবরে পা দেয়া পর্যন্ত এ চিন্তায় তোমরা বিভোর থাক। কখনো নয়, অতি শীঘ্রি তোমরা জানতে পারবে।” [আত তাকাসুরঃ ১-৩]
وَكَمْ أَهْلَكْنَا مِنْ قَرْيَةٍ بَطِرَتْ مَعِيشَتَهَا فَتِلْكَ مَسَاكِنُهُمْ لَمْ تُسْكَنْ مِنْ بَعْدِهِمْ إِلَّا قَلِيلًا وَكُنَّا نَحْنُ الْوَارِثِينَ
“এমন বহু জনপদকে আমরা ধ্বংস করে দিয়েছি, যার অধিবাসীরা নিজেদের জীবিকার গর্বে অহংকারী হয়ে পড়েছিল। এখন দেখ, তাদের বসতবাটিগুলো বিরান হয়ে পড়ে আছে। তাদের পরে খুব কম লোকই সেখানে বসবাস করেছে। শেষ পর্যন্ত আমিই তাদের উত্তরাধিকারী হয়েছি।” [আল কাসাস: ৫৮]
وَمَا أَرْسَلْنَا فِي قَرْيَةٍ مِنْ نَذِيرٍ إِلَّا قَالَ مُتْرَفُوهَا إِنَّا بِمَا أُرْسِلْتُمْ بِهِ كَافِرُونَ () وَقَالُوا نَحْنُ أَكْثَرُ أَمْوَالًا وَأَوْلَادًا وَمَا نَحْنُ بِمُعَذَّبِينَ
“আমরা যে জনপদেই কোনো সতর্ককারী পাঠিয়েছি, সেখানকার সম্পদশালী লোকেরা বলেছেঃ তোমরা যে বাণী নিয়ে প্রেরিত হয়েছো আমরা তা মানিনা। তারা আরো বলেছেঃ আমরা তোমারেদ চেয়ে অধিক অর্থসম্পদ ও সন্তান সন্ততির অধিকারী এবং আমরা কখনো শস্তি ভোগ করবোনা।” [আস সাবা: ৩৪-৩৫]
১০. অপব্যয়ের নিন্দা
কুরআন মজীদ বৈধ পন্থায় অর্জিত অর্থসম্পদ অবৈধ কাজে উড়িয়ে দেয়া, কিংবা বিলাসিতা, আমোদ প্রমোদ ও আনন্দ উপভোগে ব্যয় করা এবং দিন দিন জীবন যাপনের মান বাড়ানোর একমাত্র ধান্দায় বল্গাহীন অর্থ ব্যয় করাকে তীব্র ভাষায় নিন্দা করেছেঃ
وَلَا تُسْرِفُوا إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُسْرِفِينَ
“অর্থ ব্যয়ে সীমালংঘন করোনা। আল্লাহ অবপ্যয়কারীদের পছন্দ করেননা।” [আল আন’আম: ১৪১]
وَآتِ ذَا الْقُرْبَى حَقَّهُ وَالْمِسْكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ وَلَا تُبَذِّرْ تَبْذِيرًا () إِنَّ الْمُبَذِّرِينَ كَانُوا إِخْوَانَ الشَّيَاطِينِ وَكَانَ الشَّيْطَانُ لِرَبِّهِ كَفُورًا
“অপব্যয় করোনা। অপব্যয়কারীরা শয়তানদের ভাই। আর শয়তান তার মনিবের চরম অকৃতজ্ঞ।” [বনী ইসরাঈল: ২৬-২৭]
وَكُلُوا وَاشْرَبُوا وَلَا تُسْرِفُوا إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُسْرِفِينَ
“পানাহার কর, কিন্তু সীমালংঘন করোনা। আল্লাহ সীমালংঘনকারীদের পছন্দ করেননা।” [আল আ’রাফ: ৩১]
কুরআনের দৃষ্টিতে মানুষের সঠিক কর্মনীতি হলো এই যে, সে নিজের জন্যে এবং নিজের পরিবার পরিজনের জন্যে ব্যয় করার ক্ষেত্রে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করবে। তার অর্থসম্পদের উপর তার নিজের এবং তার সাথে যারা সম্পর্কিত তাদের অধিকার রয়েছে। এই অধিকার প্রদান করতেই অন্যান্যদের বঞ্চিত করে সব অর্থসম্পদ উজাড় করে দেয়াও যাবেনা।:
وَلَا تَجْعَلْ يَدَكَ مَغْلُولَةً إِلَى عُنُقِكَ وَلَا تَبْسُطْهَا كُلَّ الْبَسْطِ فَتَقْعُدَ مَلُومًا مَحْسُورًا
“আর নিজের হাতকে [কৃপণতা করে] গলায় বেঁধে রেখোনা, আবার সম্পূর্ণ প্রসারিতও করে দিওনা। এমনটি করলে তোমরা তিরষ্কৃত হবে এবং খালি হাতে বসে পড়বে।” [বনী ইসরাঈল: ২৯]
وَالَّذِينَ إِذَا أَنْفَقُوا لَمْ يُسْرِفُوا وَلَمْ يَقْتُرُوا وَكَانَ بَيْنَ ذَلِكَ قَوَامًا
“[এবং আল্লাহর প্রিয় বান্দা তারাই] যারা ব্যয় করার ক্ষেত্রে সীমালংঘনও করেনা, আবার কৃপণতাও করেনা, বরঞ্চ তারা উভয় চরম পন্থার মধ্যবর্তী অবস্থান করে।” [আল ফুরকান: ৬৭]
وَابْتَغِ فِيمَا آتَاكَ اللَّهُ الدَّارَ الْآخِرَةَ وَلَا تَنْسَ نَصِيبَكَ مِنَ الدُّنْيَا وَأَحْسِنْ كَمَا أَحْسَنَ اللَّهُ إِلَيْكَ وَلَا تَبْغِ الْفَسَادَ فِي الْأَرْضِ
“আল্লাহ তোমাকে যে অর্থসম্পদ দান করেছেন, তার মাধ্যমে পরকালের ঘর অন্বেষণ কর। তবে তোমার পার্থিব অংশের কথাও ভুলে যেয়োনা। আর [আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি] অনুগ্রহ কর, যেমন আল্লাহ তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। [অর্থসম্পদ দ্বারা] পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টির চেষ্টা করোনা।” [আল কাসাস:৭৭]
১১. অর্থ ব্যয়ের সঠিক খাত
যুক্তিসংগত সীমার মধ্যে থেকে নিজের প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহের পর বৈধ পন্থায় অর্জিত অর্থসম্পদের যে অংশ হাতে অবশিষ্ট থাকবে, তা যেসব খাতে ব্যয় করা উচিত সেগুলো হলো:
وَيَسْأَلُونَكَ مَاذَا يُنْفِقُونَ قُلِ الْعَفْوَ
“লোকেরা তোমার কাছে জানতে চায়, তারা [আল্লাহর পথে] কি [পরিমাণ] খরচ করবে? তুমি বলো: যা তোমারেদ প্রয়োজনের অতিরিক্ত।” [আল বাকারাঃ ২১৯]
لَيْسَ الْبِرَّ أَنْ تُوَلُّوا وُجُوهَكُمْ قِبَلَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ وَلَكِنَّ الْبِرَّ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالْكِتَابِ وَالنَّبِيِّينَ وَآتَى الْمَالَ عَلَى حُبِّهِ ذَوِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ وَالسَّائِلِينَ وَفِي الرِّقَابِ……..
“তোমরা পূর্ব কিংবা পশ্চিম দিকে মুখ ফিরালে, তা কিন্তু প্রকৃত পুণ্যের কাজ নয়। বরং প্রকৃত নেক কাজ হলো, মানুষ ঈমান আনবে আল্লাহর প্রতি, পরকালের প্রতি, ফেরেশতাদের প্রতি, আল কিতাবের প্রতি, নবীদের প্রতি; আর আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় অর্থসম্পদ ব্যয় করবে আত্মীয়দের জন্যে, এতীমদের জন্যে, মিসকীনদের ও পথিকদের জন্যে, সাহায্যপ্রার্থীদের জন্যে এবং মানুষকে গোলামীর চিঞ্জির থেকে মুক্ত করার জন্যে….;.।” [আল বাকারা: ১৭৭]
لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّى تُنْفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ شَيْءٍ فَإِنَّ اللَّهَ بِهِ عَلِيمٌ
“তোমরা কখনো পুণ্যের মর্যাদা লাভ করতে পারবেনা, যতোক্ষণ না তোমরা নিজেদের পছন্দনীয় জিনিস আল্লাহর পথে ব্যয় করবে। আর তোমরা যা কিছুই ব্যয় কর, সে সম্পর্কে আল্লাহ পূর্ণ জ্ঞাত।” [আলে ইমরান: ৯২]
وَاعْبُدُوا اللَّهَ وَلَا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا وَبِذِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينِ وَالْجَارِ ذِي الْقُرْبَى وَالْجَارِ الْجُنُبِ وَالصَّاحِبِ بِالْجَنْبِ وَابْنِ السَّبِيلِ وَمَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ مَنْ كَانَ مُخْتَالًا فَخُورًا () الَّذِينَ يَبْخَلُونَ وَيَأْمُرُونَ النَّاسَ بِالْبُخْلِ وَيَكْتُمُونَ مَا آتَاهُمُ اللَّهُ مِنْ فَضْلِهِ وَأَعْتَدْنَا لِلْكَافِرِينَ عَذَابًا مُهِينًا () وَالَّذِينَ يُنْفِقُونَ أَمْوَالَهُمْ رِئَاءَ النَّاسِ وَلَا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَلَا بِالْيَوْمِ الْآخِرِ وَمَنْ يَكُنِ الشَّيْطَانُ لَهُ قَرِينًا فَسَاءَ قَرِينًا
“আল্লাহর দাসত্ব কর। তাঁর সাথে কাউকেও শরীক করোনা। দয়া ও সহানুভূতিমূলক আচরণ কর পিতামাতার সাথে, আত্মীয় স্বজনের সাথে, এতীমদের সাথে, মিসকীনদের সাথে, আত্মীয় প্রতিবেশীদের সাথে, অনাত্মীয় প্রতিবেশীদের সাথে, সাথী বন্ধুদের সাথে, পথিকদের সাথে এবং তোমাদের অধীনস্থ ভৃত্যদের সাথে। মূলত আল্লাহ গর্ব ও অহংকারী লোকদের ভালবাসেন না, যারা নিজেরা কার্পণ্য করে, অন্যদেরকেও কৃপণতার শিক্ষা দেয় এবং আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদের যা দান করেছেন তা লুকিয়ে রাখে। এরূপ অকৃতজ্ঞ লোকদের জন্যে আমরা অপমানকর শাস্তির ব্যবস্থা করে রেখেছি। আর [ঐ লোকদেরও আল্লাহ পছন্দ করেননা।] যারা কেবল লোক দেখানো উদ্দেশ্যে নিজেদেরও আল্লাহর পছন্দ করেননা।] যারা কেবল লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে নিজেদের অর্থ ব্যয় করে।” [আন নিসাঃ ৩৬-৩৮]
لِلْفُقَرَاءِ الَّذِينَ أُحْصِرُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ لَا يَسْتَطِيعُونَ ضَرْبًا فِي الْأَرْضِ يَحْسَبُهُمُ الْجَاهِلُ أَغْنِيَاءَ مِنَ التَّعَفُّفِ تَعْرِفُهُمْ بِسِيمَاهُمْ لَا يَسْأَلُونَ النَّاسَ إِلْحَافًا وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ خَيْرٍ فَإِنَّ اللَّهَ بِهِ عَلِيمٌ
“আল্লাহর পথে বিশেষভাবে অর্থসাহায্যের অধিকারী হলো সেইসব দুঃস্থ লোক, যারা আল্লাহর কাজে এমনভাবে জড়িত হয়ে পড়েছে যে, নিজেদের ব্যক্তিগত জীবিকা উপার্জনের জন্যে তারা কোনো প্রকার চেষ্টা সাধনা করার সুযোগ পায়না [রাসূলুল্লাহর (সা) সময় এর দ্বারা বুঝা হতো সেই চারশ’ স্বেচ্ছাসেবী সাহাবীকে, যারা আরবের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নিজেদের ঘরবাড়ী ত্যাগ করে মদীনায় এসে উপস্থিত হন এবং দীনের জ্ঞান লাভ, দীন প্রচার, দীনের শিক্ষা দান এবং রাসূলুল্লাহ (সা) যখন জিহাদের যে দায়িত্বে পাঠাতে চন, তা যেন পাঠাতে পারেন, সেজন্যে নিজেদেরকে সার্বক্ষণিক সমর্পণ রাখেন। এসব কাজে নিজেদের পূরো সময় নিয়োগ করার কারণে তারা নিজেদের জীবিকার জন্যে চেষ্টা সাধনা করার সুযোগ পেতেন না। [যমখশরীঃ আল কাশশাফ, ১ম খণ্ড, ১’২৬ পৃষ্ঠা, আল বাহীয়া সংস্কররণ, মিশর ১৩৪০ হিজরী]। একই ভাবে বর্তমানকালেও যেসব লোক নিজেদের পূরো সময় দীনের জ্ঞান লাভ, শিক্ষাদান, দীনের প্রচার এবং সমাজের অন্যান্য কল্যাণমূলক কাজে নিয়োগ করে এবং ব্যক্তিগত আয় রোজগারের দিকে দৃষ্টিপাত করার সুযোগ পায়না, তারাও এ আয়াতে উল্লেখিত কথিত লোকদের অন্তর্ভুক্ত।]তাদের ব্যক্তিত্ব ও আত্মসম্মানবোধের কারণে অজ্ঞ লোকেরা তাদের সচ্ছল অবস্থার লোক মনে করে। চেহারা দেখলেই তুমি তাদের চিনতে পারবে। তারা কারো কাছে গিয়ে কিছু চায়না। তাদের কল্যাণে তোমরা যা কিছুই ব্যয় করবে, আল্লাহ তা জ্ঞাত থাকবেন।” [আল বাকারা: ২৭৩]
وَيُطْعِمُونَ الطَّعَامَ عَلَى حُبِّهِ مِسْكِينًا وَيَتِيمًا وَأَسِيرًا () إِنَّمَا نُطْعِمُكُمْ لِوَجْهِ اللَّهِ لَا نُرِيدُ مِنْكُمْ جَزَاءً وَلَا شُكُورًا
“[আর সৎলোকেরা] আল্লাহর ভালবাসায় খাবার খাওয়অয় মিসকীন, এতীম এবং বন্দীদের, আর বলে: আমরা কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যেই তোমাদের আহার করাচ্ছি। তোমাদের কাছ থেকে কোনো প্রকার বিনিময় বা কৃতজ্ঞতা লাভের আমরা আকাঙ্ক্ষী নই।” [আদ দাহর: ৮-৯]
وَالَّذِينَ فِي أَمْوَالِهِمْ حَقٌّ مَعْلُومٌ () لِلسَّائِلِ وَالْمَحْرُومِ
“আর সেইসব লোকেরাই [জাহান্নামের আগুন থেকে নিষ্কৃতি পাবে], যাদের অর্থসম্পদে সাহায্যপ্রার্থী এবং বঞ্চিত লোকদের জন্যে নির্দিষ্ট অংশ রয়েছে [অর্থাৎ নিজেদের অর্থস্পদে তারা এইসব লোকের জন্যে নিয়মমাফিক একটি অংশ নির্দিষ্ট করে রাখে।]” [আল মায়ারিজ: ২৪-২৫]
وَالَّذِينَ يَبْتَغُونَ الْكِتَابَ مِمَّا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ فَكَاتِبُوهُمْ إِنْ عَلِمْتُمْ فِيهِمْ خَيْرًا وَآتُوهُمْ مِنْ مَالِ اللَّهِ الَّذِي آتَاكُمْ
“তোমাদের ক্রীতদাসদের মধ্যে যারা [ফিদইয়া প্রদান করে মুক্তি অর্জনের জন্যে] চুক্তি সম্পদান করতে চায়, তোমরা তাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হও যদি তাদের মধ্যে কোনো কল্যাণ আছে বলে তোমরা মনে কর। আর [ফিদইয়া পরিশোধের জন্যে] তাদেরকে আল্লাহর সেই অর্থসম্পদ থেকে দান কর, যা তিনি তোমাদের দান করেছেন।” [আন নূর: ৩৩]
এইসব খাতে ব্যয় করাকে কুরআন কেবল একটি মৌলিক নেক কাজ বলেই ক্ষান্ত হয়নি, বরঞ্চ অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে একথাও বলে দিয়েছে যে, এমনটি না করলে সামগ্রিকভাবে সমাজের ধ্বংস অনিবার্য:
وَأَنْفِقُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَلَا تُلْقُوا بِأَيْدِيكُمْ إِلَى التَّهْلُكَةِ وَأَحْسِنُوا إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ
“আল্লাহর পথে ব্যয় কর আর নিজেদের হাতেই নিজেদেরকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিওনা। মানুষের প্রতি অনুগ্রহ-ইহসান কর। আল্লহ অনুগ্রকারীদের ভালবাসেন।” [আল বাকারা: ১৯৫]
১২. আর্থিক কাফফারা
আল্লাহর পথে সাধারণ ও স্বেচ্ছামূলক দান ছাড়াও কুরআন মজীদ কিছু কিচু গুনাহ ও দোষত্রুটির ক্ষতি পূরণের জন্যে আর্থিক কাফফারাও নির্ধারণ করে দিয়েছে। যেমন, যে ব্যক্তি কসম খেয়ে তা ভংগ করে তার জন্যে নির্দেশ হলো:
فَكَفَّارَتُهُ إِطْعَامُ عَشَرَةِ مَسَاكِينَ مِنْ أَوْسَطِ مَا تُطْعِمُونَ أَهْلِيكُمْ أَوْ كِسْوَتُهُمْ أَوْ تَحْرِيرُ رَقَبَةٍ فَمَنْ لَمْ يَجِدْ فَصِيَامُ ثَلَاثَةِ أَيَّامٍ
“তার কাফফারা [প্রায়শ্চিত্ত] হলো, দশজন মিসকীনকে খাবার খাওয়ানো, যেমন মধ্যম ধরনের খাবার খাওয়াও তোমরা নিজেদের পরিবার পরিজনক; কিংবা তাদেরকে পরিধেয় দান করা; অথবা একজন দাস মুক্ত করা। কিন্তু যে এমনটি করতে পারবেনা সে তিন দিন রোযা রাখবে।” [আল মায়িদা: ৮৯]
এমনি করে যে ব্যক্তি নিজের স্ত্রীকে (মা বোনের তুলনা করে) নিজের জন্যে হারাম করে নেবে এবং পুনরায় তাকে স্ত্রীত্বে গ্রহণ করতে চাইবে, তার জন্যে বিধান হলো:
وَالَّذِينَ يُظَاهِرُونَ مِنْ نِسَائِهِمْ ثُمَّ يَعُودُونَ لِمَا قَالُوا فَتَحْرِيرُ رَقَبَةٍ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَتَمَاسَّا ذَلِكُمْ تُوعَظُونَ بِهِ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ () فَمَنْ لَمْ يَجِدْ فَصِيَامُ شَهْرَيْنِ مُتَتَابِعَيْنِ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَتَمَاسَّا فَمَنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَإِطْعَامُ سِتِّينَ مِسْكِينًا ذَلِكَ لِتُؤْمِنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَتِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ وَلِلْكَافِرِينَ عَذَابٌ أَلِيمٌ
“একজন আরেকজনকে স্পর্শ করার পূর্বে [স্বামী] একজন দাস মুক্ত করবে, তা সম্ভব না হলে অনবরত দুইমাস রোযা রাখবে.,.. তাও সম্ভব না হলে ষাটজন মিসকীনকে কাবার খাওয়াবে।” [মুজাদালা: ৩-৪]
হজ্জের ক্ষেত্রেও কিছু কিছু ত্রুটি বিচ্যুতির জন্যে অনুরূপ কাফফারার বিধান দেয়া হয়েছে [দেখুন, আল বাকারা: ১৯৬, আল মায়িদা: ৯৫]। রোযার ক্ষেত্রেও এ ধরনের কাফফারা নির্ধারণ করা হয়েছে। [আল বাকারা: ১৮৪]।
১৩. দান কবুল হবার আবশ্যিক শর্তাবলী
এযাবত যেসব দানের কথা বলা হলো, সেগুলো কেবল তখনই ‘আল্লাহর পথে ব্যয়’ বলে কবুল হবে, যখন দানের ক্ষেত্রে কোনো প্রকার স্বার্থ উদ্ধারের চিন্তা থাকবেনা, আত্মপ্রচার ও প্রদর্শনেচ্ছা থাকবেনা, খোঁটা দেয়া এবং কষ্ট দেয়ার চেষ্ট থাকবেনা এবং ছাঁটাই বাছাই করে মন্দ ও নিকৃষ্ট ধরনের মাল দেয়া হবেনা। বরঞ্চ দানের সময় মন মগজে আল্লাহর ভালবাসা ও সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য কোনো চিন্তা না থাকলেই সে দান কবুল হবে আশা করা যায়।
وَالَّذِينَ يُنْفِقُونَ أَمْوَالَهُمْ رِئَاءَ النَّاسِ وَلَا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَلَا بِالْيَوْمِ الْآخِرِ وَمَنْ يَكُنِ الشَّيْطَانُ لَهُ قَرِينًا فَسَاءَ قَرِينًا
“[আর আল্লাহ ঐ লোকদের পছন্দ করেন না] যারা লোক দেখানোর জন্যে নিজেদের অর্থসম্পদ ব্যয় করে এবং আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখেনা। বস্তুতঃ শয়তান যার সাথী হলো, সে অত্যন্ত নিকৃষ্ট সাথীই লাভ করলো।” [আন নিসা: ৩৮]
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُبْطِلُوا صَدَقَاتِكُمْ بِالْمَنِّ وَالْأَذَى كَالَّذِي يُنْفِقُ مَالَهُ رِئَاءَ النَّاسِ وَلَا يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ
“হে ঈমান গ্রহণকারীরা! তোমরা খোঁটা ও কষ্ট দিয়ে ঐ ব্যক্তির মতো নিজেদের দানসমূহকে বিনষ্ট করোনা, যে লোক দেখাবার জন্যে স্বীয় অর্থ ব্যয় করে এবংয় আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখেনা।” [আল বাকারা: ২৬৪]
الَّذِينَ يُنْفِقُونَ أَمْوَالَهُمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ ثُمَّ لَا يُتْبِعُونَ مَا أَنْفَقُوا مَنًّا وَلَا أَذًى لَهُمْ أَجْرُهُمْ عِنْدَ رَبِّهِمْ وَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ () قَوْلٌ مَعْرُوفٌ وَمَغْفِرَةٌ خَيْرٌ مِنْ صَدَقَةٍ يَتْبَعُهَا أَذًى وَاللَّهُ غَنِيٌّ حَلِيمٌ
“যারা আল্লাহর পথে নিজেদের অর্থসম্পদ দান করে এবং দানের পর খোঁটা ও কষ্ট দেয়না, তাদের মালিকের কাছে তাদের জন্যে রয়েছে পুরষ্কার, তাছাড়া তাদের কোনো ভয় এবং দুশ্চিন্তা থাকবেনা। একটি ভালো কথা আর ক্ষমাসুন্দর ব্যবহার, সেই দানের চেয়ে উত্তম, যার অনুগামী হয় কষ্টদান। মূলত আল্লাহ মুখাপেক্ষিতাহীন পরম সহিষ্ণু।” [আল বাকারাঃ ২৬২-২৬৩]
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَنْفِقُوا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا كَسَبْتُمْ وَمِمَّا أَخْرَجْنَا لَكُمْ مِنَ الْأَرْضِ وَلَا تَيَمَّمُوا الْخَبِيثَ مِنْهُ تُنْفِقُونَ وَلَسْتُمْ بِآخِذِيهِ إِلَّا أَنْ تُغْمِضُوا فِيهِ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ غَنِيٌّ حَمِيدٌ
“হে ঈমান গ্রহণকারী লোকেরা! আল্লাহর পথে ব্যয় কর সেই উত্তম অর্থসম্পদ যা তোমরা উপার্জন করেছো এবং যা আমরা তোমাদের জন্যে যমীন থেকে উৎপন্ন করে দিয়েছি। বেছে বেছে তা থেকে মন্দটা আল্লাহর পথে দিওনা। কারণ এমনটি যদি তোমাদেরকে কেউ দেয়, তবে অবজ্ঞা প্রদর্শন করা ছাড়া তোমরাও তা গ্রহণ করবেনা। জেনে রেখো, আল্লাহ মুখাপেক্ষিতামুক্ত এবং প্রশংসিত গুণাবলীর অধিকারী।” [আল বাকারা: ২৬৭]
إِنْ تُبْدُوا الصَّدَقَاتِ فَنِعِمَّا هِيَ وَإِنْ تُخْفُوهَا وَتُؤْتُوهَا الْفُقَرَاءَ فَهُوَ خَيْرٌ لَكُمْ وَيُكَفِّرُ عَنْكُمْ مِنْ سَيِّئَاتِكُمْ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ
“তোমরা যদি প্রকাশ্যে দান কর, তাও ভালো। আর যদি গোপনে দরিদ্রদের দাও, তাবে তা অধিকতর ভালো। এমনটি করলে, তোমাদের বহু পাপ মুছে দেয়া হবে। তোমরা যা-ই কর, আল্লাহ সে সম্পর্কে অবহিত।” [আল বাকারা: ২৭১]
১৪. আল্লাহর পথে অর্থব্যয়ের বাস্তব গুরুত্ব
আল্লাহর পথের ব্যয়কে কুরআন কখনো ইনফাক, কখনো ইনফাক ফী সাবীলিল্লাহ, কখনা সাদাকা, আবার কখনো যাকাত শব্দ দিয়ে ব্যাখ্যা করেছে। এটা কেবল একটা নেক ও কল্যাণকর কাজই নয়, বরঞ্চ একটি ইবাদত এবং ইসলামের পঞ্চস্তম্ভ ঈমান, নামায, যাকা, রোযা ও হজ্জের মধ্যে তৃতীয় স্তম্ভ। কুরআনে সাইত্রিশ বার এটাকে নামাযের সংগে উল্লেখ করে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বলা হয়েছে, এ দুটি জিনিসই ইসলামের অপরিহর্য বিধান এবং মুক্তির মানদণ্ড। [উদাহরণ স্বরূপ কুরআন মজীদের নিম্নোক্ত আয়াতগুলো দ্রষ্টব্য: আল বাকারা: ৩, ৪৩, ৮৩, ১১০, ১৭৭, ২৭৭। আন নিসা: ৭৭, ১৬২। আল মায়িদা: ১২, ৫৫ । আল আনফাল: ৩। আত তাওবা: ৫, ১১, ১৮, ৭১। আর রা’দ: ২২। ইব্রাহীম : ৩১। মরিয়ম: ৩১, ৫৫। আম্বিয়া: ৭৩। আল হজ্জ: ৩৫, ৪১, ৭৮। আল মু’মিনূন: ২। আন নূর: ৩৭, ৫৬। আন নমল: ৩। লুকমান: ৪। আল আহযাব: ৩৩। ফাতির: ৩৯। আশ শূরা: ৩৮। আল মুজাদালা: ১৩। আল মায়ারিজ: ২৩। আল মুয্যামমিল: ২০। আল মুদ্দাস্সির: ৪৩। আল বাইয়্যেনা: ৫। আল মাউন: ৫।] কুরআন বলে, যাকাত সব সময়ই ইসলামের স্তম্ভ ছিলোঃ
وَجَعَلْنَاهُمْ أَئِمَّةً يَهْدُونَ بِأَمْرِنَا وَأَوْحَيْنَا إِلَيْهِمْ فِعْلَ الْخَيْرَاتِ وَإِقَامَ الصَّلَاةِ وَإِيتَاءَ الزَّكَاةِ وَكَانُوا لَنَا عَابِدِينَ
“আর আমরা তাদেরকে [অর্থাৎ ইব্রাহীম, লূত, ইসহাক ও ইয়াকুব (আ)-বে] নেতা বানিয়েছি। তারা আমাদের নির্দেশ অনুযায়ী মানুষকে সঠিক পথ দেখতো। তাদের কাছে আমরা নির্দেশ পাঠিয়েছিলাম কল্যাণমূলক কাজ করার, সালাত কায়েম করার এবং যাকাত দান করার। আর তারা ছিলো আমাদের অনুগত।” [আল আম্বিয়া: ৭৩]
وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ حُنَفَاءَ وَيُقِيمُوا الصَّلَاةَ وَيُؤْتُوا الزَّكَاةَ وَذَلِكَ دِينُ الْقَيِّمَةِ
“আহলে কিতাবকে এছাড়া আর কোনো নির্দেশই দেয়া হয়নি যে, তোমরা একনিষ্ঠভাবে দীনকে আল্লাহর জন্যে একমুখী করে তাঁর দাসত্ব কর, সালাত কায়েম কর এবং যাকাত প্রদান কর। এটাই সঠিক দীন।” [আল বাইয়্যেনা: ৫]
وَاذْكُرْ فِي الْكِتَابِ إِسْمَاعِيلَ إِنَّهُ كَانَ صَادِقَ الْوَعْدِ وَكَانَ رَسُولًا نَبِيًّا () وَكَانَ يَأْمُرُ أَهْلَهُ بِالصَّلَاةِ وَالزَّكَاةِ وَكَانَ عِنْدَ رَبِّهِ مَرْضِيًّا
“আর এ কিতাবে ইসমাঈলের কথা স্মরণ কর। সে ছিলো ওয়াদা পালনে সত্যবাদী, আর ছিলো একজন রাসূল, একজন নবী। সে তার সাথে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিল সালাতে এবং যাকাতের; আর আল্লাহর কাছে সে ছিলো অত্যন্ত পছন্দনীয়।” [মরিয়ম: ৫৪-৫৫]
وَإِذْ أَخَذْنَا مِيثَاقَ بَنِي إِسْرَائِيلَ لَا تَعْبُدُونَ إِلَّا اللَّهَ ……….وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ ثُمَّ تَوَلَّيْتُمْ إِلَّا قَلِيلًا مِنْكُمْ وَأَنْتُمْ مُعْرِضُونَ
“সেই সময়ের কথা স্মরণ কর, যখন আমরা বনী ইসরাঈল থেকে শপথ নিয়েছিলাম যে, তোমরা আল্লাহ ছাড়া অপর কারো দাসত্ব করবেনা…… আর সালাত কায়েম করবে এবং যাকাত পরিশোধ করবে।” [আল বাকারা: ৮৩]
قَالَ إِنِّي عَبْدُ اللَّهِ آتَانِيَ الْكِتَابَ وَجَعَلَنِي نَبِيًّا () وَجَعَلَنِي مُبَارَكًا أَيْنَ مَا كُنْتُ وَأَوْصَانِي بِالصَّلَاةِ وَالزَّكَاةِ مَا دُمْتُ حَيًّا
“সে [ঈসা ইবনে মরিয়ম] বললো: আমি আল্লাহর দাস। তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন এং নবী বানিয়েছেন; আর আমি যতোদিন জীবিক থাকি ততোদিন আমাকে সালাত কায়েমের এবং যাকাত পরিশোধের নির্দেশ দিয়েছেন।” [মরিয়ম: ৩০-৩১]
একইভাবে যাকাত মুহাম্মদ (সা)-এর শিক্ষাদান কর্মসূচীতেও দীন ইসলামের একটি স্তম্ভ। কোনো ব্যক্তির মুসলিম উম্মাহর অন্তর্ভুক্ত হবার জন্যে যেমন ঈমান এবং নামায অপরিহার্য:
إِنَّ اللَّهَ يُدَافِعُ عَنِ الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ كُلَّ خَوَّانٍ كَفُورٍ
“[আল্লাহ তোমারেদ জন্যে] তোমারেদ পিতা ইব্রাহীমের তরীকা ধার্য করে দিয়েছেন। তিনি তোমাদের নাম রেখেছেন মুসলিম।….. অতএবং সালাত কায়েম কর, যাকাত দিয়ে দাও এবং আল্লাহর রশি শক্ত করে ধর।” [আল হজ্জ: ৭৮]
ذَلِكَ الْكِتَابُ لَا رَيْبَ فِيهِ هُدًى لِلْمُتَّقِينَ () الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِالْغَيْبِ وَيُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنْفِقُونَ
“এটি আল্লাহর কিতাব। এতে কোনো শোবা সন্দেহ নেই। মুত্তাকীদের পর্থ প্রদর্শনকারী, যারা গায়েবে বিশ্বাস করে, সালাত কায়েম করে এবং আমরা যে জীবিকা তাদের দিয়েছি, তা থেকে ব্যয় করে।” [আল বাকারা: ২-৩]
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللَّهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ ……. (2) الَّذِينَ يُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنْفِقُونَ (3) أُولَئِكَ هُمُ الْمُؤْمِنُونَ حَقًّا لَهُمْ دَرَجَاتٌ عِنْدَ رَبِّهِمْ وَمَغْفِرَةٌ وَرِزْقٌ كَرِيمٌ
“মুমিন তো তারাই, যাদের সামনে আল্লাহর কথা আলোচিত হলে তাদের অন্তর কেঁপে উঠে… যারা সালাত কায়েম করে এবং আমারেদ প্রদত্ত জীবিকা থেকে ব্যয় করে। এরাই সত্যিকারের মুমিন।” [আনফাল: ২-৪]
إِنَّمَا وَلِيُّكُمُ اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَالَّذِينَ آمَنُوا الَّذِينَ يُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَهُمْ رَاكِعُونَ
“তোমারেদ প্রকৃত বন্ধু তো আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং সেইসব লোক, যারা ঈমান এনেছে, যারা সালাত কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং তারা আল্লাহর সামনে সদা মাথা নত করে আছে।” [আল মায়িদা: ৫৫]
فَإِنْ تَابُوا وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ فَإِخْوَانُكُمْ فِي الدِّينِ وَنُفَصِّلُ الْآيَاتِ لِقَوْمٍ يَعْلَمُونَ
“অতএব যদি [মুশরিকরা তাদের শিরক থেকে] তওবা করে, সালাত কায়েম করে এবং যাকাত পরিশোধ করে, তবে তারা তোমাদের দীনি ভাই।” [আত তাওবা: ১১]
যাকাত যে কেবল সমাজ কল্যাণের জন্যেই প্রয়োজন তা নয়, বরঞ্চ দাতাদের আধ্যাত্মিক উন্নতি, নৈতিক সংশোধন এবং তাদের সাফল্য ও মুক্তির জন্যেও দরকার। এটা কোনো ট্যাক্স নয়, বরং সালাতে মতোই একটি ইবাদত। মানুষের আত্মসংশোধনের জন্যে কুরআন যেসব বিধিবদ্ধ আইন দিয়েছে, যাকাত তার একটি অপরিহার্য অংগ:
خُذْ مِنْ أَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً تُطَهِّرُهُمْ وَتُزَكِّيهِمْ بِهَا وَصَلِّ عَلَيْهِمْ إِنَّ صَلَاتَكَ سَكَنٌ لَهُمْ وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ
“[হে নবী] তাদের অর্থসম্পদ থেকে একটি সাদাকা উূল করে তারেদকে পবিত্র কর এবং তাদের মধ্যে প্রশংসনীয় গুণাবলী বিকশিত কর আর তাদের জন্যে কল্যাণের দোয়া কর। তোমার দোয়া অবশ্যি সান্ত্বনার কারণ হবে।” [তাওবা: ১০৩]
لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّى تُنْفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ شَيْءٍ فَإِنَّ اللَّهَ بِهِ عَلِيمٌ
“তোমরা কিছুতেই কল্যাণ লাভ করতে পারবেনা, যতোক্ষণ না নিজেদের প্রিয়বস্তু ব্যয় করবে।” [আলে ইমরান: ৯২]
وَأَنْفِقُوا خَيْرًا لِأَنْفُسِكُمْ وَمَنْ يُوقَ شُحَّ نَفْسِهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ
“দান কর। এতে তোমাদের নিজেদের জন্যেই কল্যাণ রয়েছে। আর যারা মনের সংকীর্ণতা থেকে মুক্তি পেলো, এমন লোকেরাই সাফল্য লাভ করবে।” [আত তাগাবুন: ১৬]
১৫. আবশ্যিক যাকাত ও তার ব্যাখ্যা
কুরআন শিক্ষা ও নির্দেশনার দ্বারা সমাজের লোকদের মধ্যে আল্লাহর পথে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত দানের একটি সাধারণ প্রাণস্পন্দন সৃষ্টি করেই ক্ষান্ত হয়নি, বরঞ্চ রাসূলুল্লাহকে (সা) এ নির্দেশও প্রদান করেছে যে, তুমি এই দানের একটি ন্যূনতম সীমা পরিমাণ নির্ধারণ করে ফরয হিসেবে সেটা ইসলামী রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আদায় ও বন্টনের ব্যবস্থা করঃ
خُذْ مِنْ أَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً
“[হে নবী] তাদের অর্থসম্পদ থেকে একটি সাদাকা উসূল কর।” [আত তওবা : ১০৩]
“একটি সাদাকা” শব্দ দ্বারা এই ইংগিতই প্রদান করা হয়েছিলো যে, লোকেরা সাধারণভাবে ব্যক্তিগত পর্যযায়ে যেসব সাদাকা দিয়ে থাকে, এটা সেসব সাদাকার মতো নয়, বরঞ্চ সেগুলোর বাইরে একটি বিশেষ পরিমাণের সাদাকা তাদের উপর ফরয করে দেয়ার নির্দেশ। আর এর পরিমাণ নির্ধারণ করার দায়িত্বও রাসূলুল্লাহর (সা) উপরই ন্যস্ত করা হয়েছে। সুতরাং এই নির্দেশ অনুযায়ী রাসূলুল্লাহ (সা) বিভিন্ন ধরনের মালিকানার উপর একটি ন্যূনতম সীমা পরিমাণ নির্ধারণ করে দেন, যার চেয়ে কম পরিমাণের উপর যাকাত ধার্য হবেনা। অতঃপর নির্দিষ্ট পরিমাণ বা তার চেয়ে অধিক মালিকানার উপর অর্থসম্পদের প্রকারভেদে যাকাতের পরিমাণ নিম্নরূপ নির্ধারণ করা হয়।[আশ শওকারীঃ নায়লূল আওতার, ৪র্থ খণ্ড, ৯৮-১২৬ পৃষ্ঠা, মুস্তফা আল বাবী মিশর ১৩৪৭ হিঃ।]
১. সোনা, রূপা এবং নগদ মুদ্রা আকারে যে অর্থসম্পদ জমা হবে, [পরবর্তীতে ইজমার মাধ্যমে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ কা হয় যে, বাণিজ্যিক স্পদেও বার্ষিক ২.৫% হিসেবে যাকাত ধার্য করতে হবে। আশ শওকানী : ৪র্থ খণ্ড ১১৭ পৃষ্ঠা। বাণিজ্যিক যাকাতের এই মুলনীতি সেইসব কলকারখানার উপরও আরোপিত হবে, যেগুলো বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পণ্য উৎপাদন করে।] তার যাকাত বার্ষিক ২.৫% ভাগ।
২. জমির উৎপাদিত ফসলের উশর ১০%ভাগ, যদি প্রাকৃতিক বর্ষণের দারা ফসল উৎপাদিত হয়।
৩. আর কৃত্রিম সেচের মাধ্যমে উৎপাদিত হলে ৫% ভাগ ফসল উশর হিসেবে দিতে হবে।
৪. ব্যক্তিমালিকানাধীন খনিজ৮ সম্পদ েএবং প্রোথিত সম্পদের ২০% ভাগ যাকাত ধার্য হবে;
৫. যেসব গৃহপালিত পশু বংশবৃদ্ধি ও ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে পালন করা হয়, সেগুলোর যাকাত দিতে হবে। ভেড়া, চাগল, গাভী, উট প্রভৃতি পমুর ক্ষেত্রে যাকাতের নিসাব ও পরিমাণ ভিন্ন ভিন্ন। এগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্যে ফিকাহ্র গ্রন্থাবলী দেখা যেতে পারে।
যাকাতের এই পরিমাণ আল্লাহর নির্দেশে নবী করীম (সা) ঠিক সেইভাবে ধার্য [ফরয] করে দিয়েছেন, যেভাবে তিনি তাঁর নির্দেশে নামাযের রাকা’আত সংখ্যা ধার্য [ফরয] করে দিয়েছেন। দীনি দায়িত্ব ও গুরুত্বের দিক থেকে এতদুভয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। সালাত ও যাকাত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা কুরআন মজীদ ইসলামী রাষ্ট্রের মৌলিক উদ্দেশ্যের মধ্যে গণ্য করেছে:
الَّذِينَ إِنْ مَكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ أَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ وَأَمَرُوا بِالْمَعْرُوفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنْكَرِ
“[এই মুমিনরা, যাদেরকে প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হয়েছে, তারা এমন লোক] তাদেরকে যদি আমরা পৃথিবীতে রাষ্ট্রক্ষমতা দান করি, তবে তারা সালাত কায়েম করবে, যাকাত প্রদান করবে এবং কল্যাণের নির্দেশ দেবে আর অন্যায় অকল্যাণ থেকে ফিরিয়ে রাখবে।” [আল হজ্জ: ৪১]
وَعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنْكُمْ وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْأَرْضِ ………() وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ
“তোমাদের মাঝে যারা ঈমান এনেছে এবং কল্যাণকর কাজ করেছে, আল্লাহ তাদের সাথে এই ওয়াদা করেছেন যে, তিনি অবশ্যি তাদেরকে পৃথিবীতে খলীফা বানাবেন।….. তোমরা সালাত কায়েম কর, যাকাত দাও আর রাসূলের আনুগত্য কর, যাতে করে তোমাদের প্রতি দয়া করা হয়।” [আন নূর: ৫৫-৫৬]
উপরে যে আয়াতগুলো উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো থেকে স্পষ্টভাবে জানা যায় যে, ফরয যাকাত আদায় ও বন্টন করা ইসলামী রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত: কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্র যদি বর্তমান না থাকে এবং মুসলিম সরকারও যদি এ ব্যাপারে অবহেলা প্রদর্শন করে তবু মুসলমানদের উপর থেকে ফরয রহিত হয়ে যায়না, ঠিক যেমনি রহিত হয়ে যায়না সালাত আদায়ের ফরযিয়াত। কোনো আদায়কারী ও বন্টনকারী সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান পাওয়া না গেলে প্রত্যেকজ ‘সাহেবে নিসাব’ মুসলমানদের নিজেকেই নিজের অর্থসম্পদ থেকে যাকাত বের করে বন্টন করে দিতে হবে।
১৬. মালে গনীমতের এক পঞ্চমাংশ
ফরয যাকাত আরোপের মাধ্যমে যে তহবিল সংগ্রহ হয়, কুরআন তার সাথে আরো একটি আয় সংযোজন করেছে। তা হলো, মালে গনীমতের [Spoils of war] একটি অংশ। কুরআন আইন করে দিয়েছে যে, যুদ্ধে সৈন্যরা যে গনীমতের মাল লাভ করবে, তা কোনো সৈনিকই ব্যক্তিগতভাবে লুটে নিতে পারবেন না। বরঞ্চ য কিছুই পাওয়া যাবে তার সবই কমাণ্ডারের কাছে জমা দিতে হবে। কমাণ্ডার মোট জমাকৃত সম্পদকে পাঁচ ভাগ করে চার ভাগ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সৈনিকদের মধ্যে বন্টন করে দেবেন। আর এক পঞ্চমাংশ পৃথক রেখে তা রাষ্ট্রীয় তহবিলে জমা দেবেন:
اعْلَمُوا أَنَّمَا غَنِمْتُمْ مِنْ شَيْءٍ فَأَنَّ لِلَّهِ خُمُسَهُ وَلِلرَّسُولِ وَلِذِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينِ وَابْنِ السَّبِيلِ
“জেনে রেখো, তোমরা যে গনীমতই লাভ কর, তার এক পঞ্চমাংশ থাকবে আল্লাহ, রাসূল, আত্মীয়স্বজন, [রাসূলুল্লাহর (সা) জীবদ্দশায় তিনি গনীমতের এক পঞ্চমাংশ নিজের এবং নিজের সাথে সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজন পূরণের জন্যে গ্রহণ করতেন। কেননা যাকাতের তাঁর এবং তাঁর আত্মীয় স্বজনদের কোনো অংশ ছিলনা। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর রাসূল ও তাঁর আত্মীয়স্বজনের অংশ কাকে দেয়া হবে সে বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দেয়। কেউ কেউ মত দেন, রাসূল এ অংশটি পেতেন রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে। সুতরাং তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর খলীফা ও খলীফার আত্মীয়স্বজন হবে এর অধিকারী। অন্য কিছু লোকের মত হলো রাসূলুল্লাহর (সা) মৃত্যুর পর তাঁর আত্মীয়স্বজনই হবেন এর অধিাকারী। অবশেষে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয় যে, রাসুল (সা) এবং তাঁর আত্মীয়স্বজন যে অংশ পেতেন, এখন থেকে তা রাষ্ট্রীয় সামরিক খাতে ব্যয় হবে। [আল জাস্সাস: ৩য় খণ্ড, ৭৫- ৭৭ পৃষ্ঠা।] এতীম ও মুসাফিরদের জন্যে।”
১৭. যাকাত ব্যয়ের খাত
উপরোক্ত দটি [যাকাত ও গনীমত] উৎস থেকে যে অর্থসম্পদ সংগৃহীত হতো, কুরআনের দৃষ্টিতে তা রাষ্ট্রীয় কোষাগারের [Public Exchequer] কোনো অংশ নয়। কারণ রাষ্ট্রীয় কোষাগারের লক্ষ্য তো যাকাতদাতা সহ সকল জনগণের সুবিধা ও প্রয়োজনীয় সেবা প্রদান। তাই কুরআন যাকাত তহবিলের ব্যয়ের খাত নিম্নরূপ নির্দিষ্ট করে দিয়েছে:
إِنَّمَا الصَّدَقَاتُ لِلْفُقَرَاءِ وَالْمَسَاكِينِ وَالْعَامِلِينَ عَلَيْهَا وَالْمُؤَلَّفَةِ قُلُوبُهُمْ وَفِي الرِّقَابِ وَالْغَارِمِينَ وَفِي سَبِيلِ اللَّهِ وَابْنِ السَّبِيلِ فَرِيضَةً مِنَ اللَّهِ وَاللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ
“এই সাদাকা নির্দিষ্ট করে দেয়া হলো ফকীরদের [ [এমন প্রত্যেক ব্যক্তিই ফকীর, যে প্রয়োজনের কম জীবিকা লাভ করার কারণে সাহায্যের মুখাপেক্ষী। [লিসানুল আর: ৫ম খণ্ড, ৬০-৬১ পৃষ্ঠা, বৈরুত ১৯৫৬ ইং]] জন্যে, মিসকীনদের [উমর (রা) বলেছেন, মিসকীন সেই ব্যক্তি যে উপার্জন করতে পারেনা, কিংবা উপার্জন করার সুযোগ পায়না। [জাস্সাস : ৩য় খণ্ড, ১৫১ পৃষ্ঠা]। এই সংজ্ঞার আলোকে সেইসব গরীব শিশু যারা এখনো উপার্জনের যোগ্য হয়নি, সেইসব বিকলাংগ ও বৃদ্ধ যারা উপার্জন করার যোগ্য নয় এবং সেইসব বেকার ও রোগী যারা সাময়িকভাবে উপার্জনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত— তারাই মিসকীন। জন্যে, সাদাকা আদায়-বন্টন বিভাগের কর্মচারীদের জন্যে, তাদের জন্যে যাদের মন আকৃষ্ট করা উদ্দেশ্য হবে, [রাসূলুল্লাহ (সা) যুগে মন আকৃষ্ট করার জন্যে তিন ধরনের লোককে অর্থদান করা হতো: [১] যেসব ইসলাম বিরোধী ব্যক্তি দুর্বল মুসলমানদের কষ্ট দিতো, কিংবা ইসলামের বিরুদ্ধে কঠোর শত্রুতা করতো। অর্থদান করে তাদের নম্র আচরণে রাজী করা হতো। [২] যারা শক্তি প্রয়োগ করে নিজ বংশ গোত্রের লোকদেরকে ইসলাম গ্রহণে বাধা দিতো, অর্থদান করে তাদেরকে এ আচরণ থেকে নিবৃত্ত করা হতো, [৩] যেসব নতুন নতুন লোক ইসলাম গ্রহণ করতো, তাদের আর্থিক সাহায্য করা হতো, যাতে করে তাদের হতাশা দূর হয় এবং নিশ্চিন্তে মুসলিম দলের সাথে অবস্থান করে। [জাস্সাস ৩য় খন্ড ১৫২]] দাস মুক্তির জন্যে, [ সেইসব মুসলমানও এর অন্তর্ভুক্ত, বিভিন্ন যুদ্ধে শত্রুরা যাদেরকে বন্দী করে দাস বানিয়ে নেয় এবং সেইসব অমুসলিমও এর অন্তর্ভুক্ত যারা মুসলমানদের হাতে বন্দী হয়ে ফিদইয়া দিয়ে মুক্তি লাভের চেষ্টা করে। তাছাড়া সেইসব দাসও এর অন্তর্ভুক্ত যারা পূর্ব থেকেই দাসত্বের শৃংখলে আবদ্ধ ছিলো।] ঋণে নিমজ্জিতদের সাহায্যের জন্যে, আল্লাহর পথে [আল্লাহর পথ মানে জিহাদ ও হ্জ্জ। স্বেচ্ছাসেবী মুজাহিদ যদি নিজ প্রয়োজনীয় সামগ্রী সংগ্রহের মতো প্রভৃতি খরচের জন্যে ব্যক্তির অর্থ যথেষ্ট হতে পারেনা। একই ভাবে হজ্জের সফরেও যদি কারো পাথেয় শেষ হয়ে যায়, তবে তিনিও যাকাত লাভের অধিকারী। [জাস্সাস : ৩য় খন্ড, ১৫৬-১৫৭ পৃষ্ঠা। নায়লুল আওতার : ৪র্থ খণ্ড, ১৪৪-১৪৬ পৃষ্ঠা]।] এবং পথিকদের সাহায্যের জন্যে [ পথিক যদি তার বাড়ীতে ধনী ব্যক্তিও হয়ে থাকেন, কিন্তু ভ্রমণকালে যদি সাহায্যের মুখাপেক্ষ হয়ে পড়েন, তবে তিনি যাকাত পাওয়ার অধিকারী হন। [আল জাস্সাস: ৩য় খণ্ড, ১৫৭ পৃষ্ঠা]।] এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে আরোপিত একটি ফরয।” [আত তাওবা: ৬০]
১৮. উত্তরাধিকার আইন
কোনো পুরুষ বা মহিলার মৃত্যুর পর তার পরিত্যক্ত সম্পত্তির ব্যাপারে কুরআনের বিধান হলো, এ সম্পত্তি তার পিতামাতা, সন্তানসন্ততি এবং তার স্ত্রী বা স্বামীর মধ্যে নির্ধারত নিয়মানুযায়ী বন্টিত হবে। পিতামাতা এবং সন্তানসন্ততি না থাকলে তার সহোদনর এবং বৈমাতৃক ও বৈপিতৃক ভাইভোনদের অংশ দিতে হবে। এ সংক্রান্ত বিস্তারিত বিধান সূরা নিসায় আলোচিত হয়েছে। [নবী করীম (সা) এ আইনের যে ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন, তার দৃষ্টিতে নিকটতম আত্মীয়স্বজন বর্তমান না থাকলে কিছুটা দূর সম্পর্কীয় আত্মীয়রা উত্তরাধিকার লাভ করবে, সেরকম কেউ না থাকলে পরবর্তী পর্যায়ের লোকরা পাবে যারা অনাত্মীয়দের তুলনয় তার আত্মীয়। কিন্তু যদি কোনো ধরনের আত্ময়িই বর্তমান না থাকে, তখন তার পূরো সম্পত্তি ইসলামী রাষ্ট্রের কোষাগারে জমা হবে। [নায়লূল আওতার : ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃঃ ৪৭-৫৬]।] [দেখুন, আয়াত : ৭-১২, ১৭৬]। দীর্ঘ হবার ভয়ে এখানে সে আলোচনা উদ্ধৃত করলাম না।
এ ব্যাপারে কুরআনের মূলনীতি হলো, কোনো ব্যক্তির জীবদ্দশায় যে অর্থসম্পদ তার মালিকানাভুক্ত হয়েছে, তার মৃত্যুর পর তা আর কেন্দ্রীভূত থাকতে দেয়া যাবেনা। বরঞ্চ তার আত্মীয়স্বজনের মধ্যে তা ছড়িয়ে দিতে হবে। এই মূলনীতি বড় পুত্রের বা জৈষ্ঠত্বে উত্তরাধিকার প্রথা [Primo geniture], যৌথ পারিবারিক সম্পত্তি [Joint Family System] প্রথা এবং অনুরূপ অন্যান্য প্রধার সম্পূর্ণ বিপরীত, যেসব প্রথার মূল লক্ষ্য হলো, কোনো ব্যক্তির মৃত্যুর পরও তার পুঞ্জিভূত সম্পত্তি কেন্দ্রীভূত রাখা।
এমনি করে কুরআন পালকপুত্র গ্রহণের প্রথাকেও অস্বীকার করেছে। কুরআন আইন করে দিয়েছে যে, সত্যিকার আত্মীয়রাই কেবল উত্তরাধিকার লাভ করবে। কোনো পর মানুষকে পুত্র বানিয়ে কৃত্রিম উপায়ে উত্তরাধিকারী বানানো যাবেনা:
وَمَا جَعَلَ أَدْعِيَاءَكُمْ أَبْنَاءَكُمْ ذَلِكُمْ قَوْلُكُمْ بِأَفْوَاهِكُمْ
“আল্লাহই তোমাদের মুখডাকা [পালক] পুত্রদের তোমাদের পুত্র বানাননি। এটেতো তোমাদের মুখের কথা মাত্র।” [আল আহযাব : ৪]
أُولُو الْأَرْحَامِ بَعْضُهُمْ أَوْلَى بِبَعْضٍ فِي كِتَابِ اللَّهِ
“আল্লাহর কিতাবে আত্মীয়রাই পরস্পরের অধিকতর হকদার। ” [আল আহযাব : ৬]
কিন্তু প্রকৃত উত্তরাধিকারী আত্মীয়দের অধিকার পূর্ণরূপে সংরক্ষণ করার পর কুরআন তাদেরকে উপদেশ দিয়েছে, উত্তরাধিকার বন্টনের সময় ওয়ারিশ নয় এমন আত্মীয়রা উপস্থিত হলে তাদেরকেও যেনো সন্তুষ্টচিত্তে কিছু না কিছু প্রদান করা হয়:
وَإِذَا حَضَرَ الْقِسْمَةَ أُولُو الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينُ فَارْزُقُوهُمْ مِنْهُ وَقُولُوا لَهُمْ قَوْلًا مَعْرُوفًا () وَلْيَخْشَ الَّذِينَ لَوْ تَرَكُوا مِنْ خَلْفِهِمْ ذُرِّيَّةً ضِعَافًا خَافُوا عَلَيْهِمْ فَلْيَتَّقُوا اللَّهَ
“[উত্তরাধিকার] বন্টনের সময় যখন আত্মীয়, এতীম ও মিসকীন ব্যক্তিরা উপস্থি হবে, তখন তা থেকে তাদেরকেও কিছু দেবে এবং তাদের সাথে সুন্দরভাবে কথা বলবে। একথা চিন্তা করে লোকদের ভয় করা উচিত যে, তারা নিজেরাও যদি অসহায় সন্তান রেখে চলে যায়, তবে মৃত্যুর সময় এই সন্তানতের জন্যে কতইনা আশংকা তাদেরকে পীড়িত করে। সুতরাং তারা যেনো আল্লাহকে ভয় করে।” [আন নিসা: ৮-৯]
১৯. অসীয়তের বিধান
কুরআন মজীদ উত্তরাধিকার আিইন নির্ধারণ করার সাথে সাথে মানুষকে উপদেশ দিয়েছে, তারা যেনো মৃত্যুর সময় উপস্থিত হলে নিজেদের পরিত্যক্ত সম্পত্তির অসীয়ত করে:
كُتِبَ عَلَيْكُمْ إِذَا حَضَرَ أَحَدَكُمُ الْمَوْتُ إِنْ تَرَكَ خَيْرًا الْوَصِيَّةُ لِلْوَالِدَيْنِ وَالْأَقْرَبِينَ بِالْمَعْرُوفِ حَقًّا عَلَى الْمُتَّقِينَ
“যখন তোমাদের কারো মৃত্যুর সময় উপস্থিত হয় এবং সে অর্থসম্পত্তি রেখে যেতে থাকে, তখন বাবা মা ও আত্মীয়স্বজনের জন্যে বৈধ পন্থায় অসীয়ত করাটাকে তোমাদের জন্যে লিখে দেয়া হয়েছে। এটি মুক্তাকীদের উপর একটি অধিকার।” [আল বাকারা: ১৮০]
এ নির্দেশের উদ্দেশ্য ব্যাপক। একদিকে মৃত্যুপথযাত্রী ব্যক্তি বিশেষভাবে স্বীয় পিতামাতার সাথে উত্তম আচরণের জন্যে নিজ সন্তানদের অসীয়ত করে যাবে। কেননা তাদের বৃদ্ধ দাদা দাদীকে খেদমতের আশা তাদের থেকে খুব কমিই করা যায়। অপরদিকে তার পরিবার যারা আইনগতভাবে উত্তরাধিকার লাভ করবেনা, সে যদি তাদেরকে সাহায্য পাওয়ার উপযুক্ত মনে করে তবে নিজ পরিত্যক্ত সম্পত্তি থেকে তাদেরকে অংশ দেয়ার জন্যে অসীয়ত করে যাবে। তাছাড়া কোনো ব্যক্তি যখন মৃত্যুর সময় প্রচুর অর্থ সম্পদ রেখে যেতে থাকে, তখন তার পক্ষে জনকল্যাণমূলক কাজেও অসীয়ত করে যাওয়াও বৈধ। কেননা অসীয়তের অনুমতি কেবল পিতামাতা ও আত্মীয়স্বজনের জন্যে সীমাবদ্ধ করাটা উপরোক্ত আয়াতের উদ্দেশ্য নয়। [নায়লুল আওতার : ৬ষ্ঠ খণ্ড, ৩২-৩৩ পৃষ্ঠা। এক্ষেত্রে নবী করীমের (সা) ব্যাখ্যা থেকে কুরআনের বক্তব্যের যে উদ্দেশ্য জানা যায়, তা হলো, নিজেদের আত্মীয়স্বজনকে দরিদ্র ও পরমুখাপেক্ষী রেখে জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করা পছন্দনীয় নয়। নায়লূলা আওতার গ্রন্থে বুযখারী, মুসলিম ও অন্যান্য হাদীস গ্রন্থাবলীর সূত্রে নবী করীমের (সা) যে বাণী উদ্ধৃত হয়েছে তা হলো: “তোমাদের উত্তরাধিকারীদেরকে সুহালে রেখে যাওয়াটা, মুখাপেক্ষী ও পরের কাছে হাত পাততে হবে- এমন অবস্থায় রেখে যাওয়ার চেয়ে উত্তম।”
অসীয়ত ও উত্তরাধিকারের এ আইন থেকে একথা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, ব্যক্তিগত মালিকানার পরিত্যক্ত সম্পত্তির ব্যাপারে ইসলামের স্কীম হলো, অবশ্যি দুই তৃতীয়াংশ উত্তরাধিকার আইনে ভিত্তিতে বন্টন করতে হবে। আর এক তৃতীয়াংশ মৃত্যুমুখী ব্যক্তির স্বাধীন ইচ্ছার উপর ছেড়ে দিতে হবে, যাতে করে সে তা যে কোনো উদ্দেশ্য ব্যয় করার জন্যে অসীয়ত করে যেতে পারে। তবে শর্ত হলো, তা বৈধ পন্থায় হতে হবে। অর্থাৎ যে কাজের জন্যে অসীয়ত করে যাবে সে কাজটি বৈধ হতে হবে এবং তাতে কারো অধিকারও ক্ষুণ্ণ হতে পারবেনা। [অসীয়তের আইনের ব্যাখ্যা প্রসংগে নবী করীম (সা) অসীয়তের অধিকারের উপর তিনটি শর্তারোপ করেছেন। এক. নিজের পুরো সম্পদের এক তৃতীয়াংশের মধ্যে অসীয়তের অধিকার প্রয়োগ করা যাবে। দুই. যারা আইনগত ভাবে উত্তরাধিকা লাভ করবে, তাদের কারো জন্যে অন ওয়ারিশদের অনুমতি ছাড়া অসীয়ত করা যাবেনা। তিন. কোনো ওয়ারিশকে তার উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করার কিংবা তার অংশ কম করার অসীয়ত করা যাবেনা। [নায়লুল আওতার : ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃঃ ৩১-৩৫।]
২০. অজ্ঞ ও নির্বোধের স্বার্থ সংরক্ষণ
অজ্ঞ, বোকা ও নির্বোধ হবার কারণে যারা নিজেদের মালিকানাধীন অর্থসম্পত্তি সঠিক ব্যয় ব্যবহার জানেনা বরং সম্পদ খোয়াতে থাকে, কিংবা নিশ্চিতভাবে আশংকা হয় যে, তারা তাদের সম্পদ খুইয়ে ফেলবৈ, তাদের ব্যাপারে কুরআনের নির্দেশনা হলো, তাদের মালিকানা তাদের হাতে ছেড়ে দেয়া যাবেনা। বরঞ্চ তাদের সহায় সম্পদের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব অভিভাবক কিংবা বিচারকের হাতে ছেড়ে দিতে হবে। তাদের হাতে কেবল তখনই সোপর্দ করা যাবে, যখন আশ্বস্ত হওয়া যাবে যে, তারা নিজেরাই নিজ নিজ বিষয়াদির দায়িত্ব সঠিকভাবে আঞ্জাম দেয়ার উপযুক্ত হয়েছে:
وَلَا تُؤْتُوا السُّفَهَاءَ أَمْوَالَكُمُ الَّتِي جَعَلَ اللَّهُ لَكُمْ قِيَامًا وَارْزُقُوهُمْ فِيهَا وَاكْسُوهُمْ وَقُولُوا لَهُمْ قَوْلًا مَعْرُوفًا () وَابْتَلُوا الْيَتَامَى حَتَّى إِذَا بَلَغُوا النِّكَاحَ فَإِنْ آنَسْتُمْ مِنْهُمْ رُشْدًا فَادْفَعُوا إِلَيْهِمْ أَمْوَالَهُمْ
“তোমরা তোমারেদর সেই অর্থসম্পদ, যা আল্লাহ তোমাদের পরিচালনার উপায় বানিয়েছেন, অজ্ঞ নির্বোধ লোকদের হাতে তুলে দিওনা। অবশ্য তা থেকে তাদের খাওয়া পরার ব্যবস্থা করো এবং তাদের সাথে উত্তম ও বিবেকসম্মত কথা বলো। আর এতীমদের পরীক্ষা করতে থাকো যতোদিন না তারা বিয়ের বয়সে উপনীত হয়। অতঃপর যখন তাদের মধ্যে সঠিক বিবেক বুদ্ধি সৃষ্টি হয়েছে বলে লক্ষ্য করবে, তখন তাদের অর্থসম্পদ তাদের দায়িত্বে ছেড়ে দাও।” [আন নিসা: ৫-৬]
এ আয়াতে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। তা হলো, ব্যক্তিমালিকানাধীন অর্থসম্পত্তিতে সেইসব ব্যক্তিদেরই স্বত্ব স্বীকৃত যারা আইনগতভাবে স্বত্বাধিকার লাভ করে। কিন্তু সে অর্থসম্পত্তি সম্পূর্ণরূপেই তাদের নয়। বরং তার সাথে জাতীয় ও সামাজিক স্বার্থ জড়িত রয়েছে। সে কারণেই কুরআন ‘তাদের সেই অর্থসম্পদ’ না বলে ‘তোমাদের সেই অর্থসম্পদ’ বলেছে। এ দৃষ্টিভংগির ভিত্তিতেই কুরআন অভিভাবক ও বিচারকদের এ অধিকার প্রদান করেছে যে, তারা যেখানেই ব্যক্তিমালিকানাধীন অর্থসম্পদরে অপব্যবহার দ্বারা সমাজের সামগ্রিক ক্ষতি দেখবেন, কিংবা ক্ষতি হবার যক্তিসংগত আশংকা করবেন, সেখানেই ব্যক্তির স্বত্বাধিকার ও স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রেখে তার ব্যয় ব্যবহারের অধিকার নিজের হাতে তুলে নেবেন। [ইবনুল আরাবীঃ আহকামুল কুরআন : ১ম খন্ড ১৩৩ পৃঃ। ইবনে কাসীর : তাফসীরুল কুরআন : ১ম খণ্ড ৪২৫ পৃষ্ঠা। আল জাসসাস: আহকামুল কুরআন: ২য় খন্ড ৭২-৭৩ পৃঃ।]
২১. জাতীয় মালিকানায় সমাজের স্বার্থ সংরক্ষণ
যেসব দ্রব্যসামগ্রী, অর্থসম্পদ এবং আয় আমদানী রাষ্ট্রীয় মালিকানায় থাকবে, সেগুলোর ব্যাপারে কুরআনের নির্দেশ হলো, সেগুলো ব্যয় ও ভোগ ব্যবহার কেবল অর্থশালী শ্রেণীর স্বার্থে হতে পারবেনা, বরঞ্চ সাধারণ জনগণের স্বার্থে হতে হবে, বিশেষ করে, সেগুরো মাধ্যমে দুর্বল শ্রেণীর কল্যাণের প্রতি সার্বিক গুরুত্ব দিতে হবে।
مَا أَفَاءَ اللَّهُ عَلَى رَسُولِهِ مِنْ أَهْلِ الْقُرَى فَلِلَّهِ وَلِلرَّسُولِ وَلِذِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينِ وَابْنِ السَّبِيلِ كَيْ لَا يَكُونَ دُولَةً بَيْنَ الْأَغْنِيَاءِ مِنْكُمْ…… لِلْفُقَرَاءِ الْمُهَاجِرِينَ الَّذِينَ أُخْرِجُوا مِنْ دِيَارِهِمْ وَأَمْوَالِهِمْ…… وَالَّذِينَ تَبَوَّءُوا الدَّارَ وَالْإِيمَانَ مِنْ قَبْلِهِمْ…. وَالَّذِينَ جَاءُوا مِنْ بَعْدِهِمْ
“আল্লাহ এই জনপদের লোকদের থেকে যা কিছুই তাঁর রাসূলের দিকে ফিরিয়ে দিয়েছেন, তা আল্লাহর জন্যে, রাসূলের জন্যে, [এর অর্থ ইসলামী রাষ্ট্রের প্রশাসনিক ও প্রতিরক্ষা খাতের ব্যয়। এ উৎস থেকেই নবী করীম (সা) এবং তাঁর খলীফাগণ নিজেদের ভাতা গ্রহণ করতেন এবং সরকারী কর্মচারীদের [যাকাত বিভাগে কর্মচারীদের বাদে] বেতন প্রদান করতেন। যাকাত বিভাগের কর্মচারীদের বেতন যাকাতের অর্থ থেকেই দেয়া হতো।] [তাঁর] আত্মীয়স্বজনের জন্যে, [এর ব্যাখ্যার জন্যে এ অধ্যায়ের ২১ নম্বর টীকা দেখুন।] এতীমদের জন্যে এবং মিসকীন ও পথিকদে জন্যে। [ এ বিধান এজন্যে দেয়া হলো] যাতে করে তা কেবল তোমাদের মধ্যকার ধনীদের মধ্যেই আর্তিত হতে না থাকে। …… তাছাড়া সেইসব দরিদ্র মুহাজিরদের জন্যেও যারা নিজেদের ঘরবাড়ী ও বিষয় সম্পত্তি থেকে বিতাড়িত ও বহিষ্কৃত হয়ে এসেছে। …. আর তাতে সেই আনসারদেরও অধিকার রয়েছে, যারা মুহাজিরদের আগমনের পূল্ব থেকেই ঈমান এনে দারুল ইসলামে বসবাস করছে।…. তাছাড়া পরবর্তীতে আসা লোকদের অধিকারও তাতে রয়েছে।” [আল হাশস: ৭-১০]
২২. করারোপের ক্ষেত্রে ইসলামের মূলনীতি
করারোপের ক্ষেত্রে কুরআনের যে মূলনীতির প্রতি পথনির্দেশনা দান করে তা হলো, করের বোঝা কেবল সেইসব লোকদের ঘাড়ে চাপবে, যারা প্রয়োজনের অতিরিক্স ধনসম্পদের মালিক। তাছাড়া তাদের অর্থসম্পদের সেই অংশের উপরই কেবল কর চাপাতে হবে, প্রয়োজন সেরে যা উদ্বৃত্ত থাকে।
وَالَّذِينَ جَاءُوا مِنْ بَعْدِهِمْ
“তারা তোমার কাছে জানতে চায়, তারা কি ব্যয় করবে? তুমি বলো: যা তোমাদের প্রয়োজন সেরে উদ্বৃত্ত থাকে।” [আন নিসা: ২১৯]
ইসলামী অর্থ ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য
কুরআনের এই ২২ দফা নির্দেশনায় মানুষের অর্থনৈতিক জীবরে জন্যে যে স্কীম প্রণয়ন করা হয়েছে, তার বুনিয়াদী নীতিমালা ও উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যসমূহ হলো:
[১] এই স্কীম এমন প্রক্রিয়ায় অর্থনৈতিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে, যার ফলে একদিকে যেমন সর্বপ্রকার অর্থনৈতিক যাল্ম এবং বল্গাহীন লাভ ও দখরদারী নীতির পথ রুদ্ধ হয়ে যায়, অপরদিকে তেমনি সমাজের উত্তম নৈতিক গুণাবলী বিকশিত হবার সুযোগ লাভ করে। কুরআন এমন কোনো সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চায়না, যেখানে ব্যক্তিগতভাবে কেউ কারো কল্যাণ সাধন করতে সক্ষম হবেনা, যেখানে ব্যক্তির প্রতিটি কল্যাণ সমাজ ব্যবস্থা এ করণে চায়না যে এরূপ ক্ষেত্রে সমাজের নৈতিক গুণাবল বিকশিত হবার কোনো সুযোগ থাকেনা।
পক্ষান্তরে কুরআন এমন সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চায়, যেখানে প্রত্যেক ব্যক্তি অপর ব্যক্তির সাথে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত ও স্বার্থহীন দানশীলতা, সহানুভূতি ও দয়া অনুগ্রহের আচরণ করবে, যার ফলে তাদের মাঝে পারস্পরিক প্রীতি ও ভালবাসার প্রসার ঘটার সুযোগ হবে। এ উদ্দেশ্যে কুরআন মানুষের মধ্যে ঈমান সৃষ্টি করা এবং তাদেরকে জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ দানের মাধ্যমে আদর্শ মানুষ বানাবার পন্থার উপর সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করেছে। এর পরও যদি কিছু ত্রুটি বিচ্যুতি থেকে যায় তাহলে সেসব ত্রুটি দূর করার জন্যে ইসলাম সেইসব বল প্রয়োগমূলক আইনের আশ্রয় নেয় যা সামাজিক সাফল্যের জন্যেঅপিহার্য। [দফা নম্বর: ৮-১৩ এবং ১৫-১৯]
[২] এই স্কীমে অর্থনৈতিক মূল্যবোধকে নৈতিক মূল্যবোধ থেকে পৃথক রাখা হয়নি। বরং উভয় নীতিকে ওতপ্রোতভাবে জাড়িত করে দেয়া হয়েছে। এখানে অর্থনৈতিক সমস্যাকে কেবল অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে সমাধান করা হয়নি। বরঞ্চ সেই পূর্ণাংগ জীবন ব্যবস্থার ইমারত কাঠামোর মধ্যে সমাধান করা হয়েছে, ইসলাম যার ভিত স্থাপন করেছে পরিপূর্ণরূপে খোদার দাসত্ব ভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থাকে, নৈতিক দর্শন ও বিশ্বাসের উপর। [দফা: ১, ২, ৪, ৫]
[৩] এই স্কীমে পৃথিবীর অর্থনৈতিক উপায় উপকরণকে গোটা মানব জাতির উপর মহান আল্লাহর সাধারণ দান ও অনুগ্রহ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। তাই এর লক্ষ্য হলো, ব্যক্তি, গোষ্ঠী কিংবা জাতীয় আধিপত্যের পরিবর্তে আল্লাহর দুনিয়ার সকল মানুষকে জীবিকা উপার্জনের জন্যে যতোটা সম্ভব উন্মুক্ত সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। [দফা: ৫]
[৪] এই স্কীমে ব্যক্তিমালিকানার অধিকার দেয়া হয়েছে। কিন্তু তা বল্গাহীন নয়। ব্যক্তির ব্যক্তিগত মালকানাধিকারের উপর অপরাপর ব্যক্তি ও সমাজের স্বার্থে প্রয়োজনীয় বিধিনিষেধ আরোপ করার সাথে সাথে এই স্কীমে প্রত্যেক ব্যক্তির অর্থসম্পদ আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব, অভাবী, হতভাগা মানুষ এবং সামগ্রিকভাবে গোটা সমাজের অধিকারও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এসব অধিকারে মধ্যে কিছু কিছু আইনগতভাবে কার্যকর, আবার কিছু কিছু বুঝ ও উপলব্ধি সৃষ্টি এবং নৈতিক ও মানসিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কার্যকর করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। [দফা: ৩, ৫, ৭-১৫, ১৭, ১৯. ২০]।
[৫] এই পরিকল্পনার দৃষ্টিতে মানব জীবরে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পরিচালনার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হলো, লোকেরা তা নিজ নিজ স্বাধীন চেষ্টা সাধনার মাধ্যমে পরিচালনা এবং বিকশিত করবে। কিন্তু এই স্বাধীন চেষ্টা সাধনাও আবার বিধিবন্ধনহীন রাখা হয়নি। বরঞ্চ সমাজের এবং স্বয়ং সেই ব্যক্রিদের নৈতিক, তামদ্দুনিক ও অর্থনৈতক কল্যাণের জন্যে কিচু সীমারেখা দ্বারা চেষ্টা সাধনাকে নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছে। [দফা: ৬. ৭,. ১৫, ২২]।
[৬] এতে নারী পুরুষ উভয়কে তাদের নিজ নিজ উপার্জিত, উত্তারিধার সূত্রে অর্জিত এবং অন্যান্য বৈধ পন্থায় প্রাপ্ত অর্থসম্পদের সমান স্বত্তাধিকারী ঘোষণা করা হয়েছে। উভয়কে নিজ নিজ অধিকারবুক্ত অর্থসম্পদ থেকে সমানভাবে উপকৃত হবার অধিকার দেয়া হয়েছে। [দফা : ৩, ৪. ১৮]।
[৭] এ স্কীমে অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্যে একদিকে মানুষকে কৃপণতা ও বৈরাগ্য ত্যাগ করে আল্লাহর নিয়ামতের ভোগ ব্যবহারের জন্যে উৎসাহিত করা হয়েছে, অপরদিকে তাদেরকে অপব্যয়, বাহুল্য খরচ এবং বিলাসিত থেকে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। [৫, ৮-১০]
[৮] অর্থনৈতিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার জন্যে এতে ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। অর্থসম্পদের প্রবাহ যেনো ভ্রান্ত ও অবৈধ উপায়ে কোনো বিশেষ দিকে প্রবাহিত হতে না থাকে এবং বৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থসম্পদও যেনো কোনো একস্থা পুঞ্জিভূযত হয়ে অনুৎপাদনশীল হয়ে পড়ে না থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখা হয়েছে। এই স্কীমে অর্থসম্পদের বেশী বেশী ব্যবহার ও আবর্তেনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর এই আবর্তন থেকে বিশেষভাবে সেইসব লোকেরাই অংশ পাবে, যারা কোনো না কোনো কারণে নিজেদের ন্যায্য অংশ থেকে বঞ্চিত থেকে যাবে। [দফা : ৬-১০,. ১২-১৫, ১৭-১৯, ২১]।
[৯] এই স্কীম অর্থনৈতিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার জন্যে আইন ও রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের উপর অধিক নির্ভরশীর নয়। কতিপয় অপরিহার্য দায়িত্ব রাষ্ট্রের হাতে ছেড়ে দেবার পর অবশিষ্ট সমস্ত প্রক্রিয়ার বাস্তবায়ন ব্যক্তির মানসিক ও নৈতিক প্রশিক্ষণ এবং সমাজ সংশোধনের মাধ্যমে করা হয় যাতে স্বাধীন চেষ্টা সাধনার মাধ্যমে অর্থনীতির যৌক্তিক দাবীসমূহ অক্ষুণ্ণ রেখে অর্থনৈতিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য হাসিল হতে পারে। [দফা: ৫-২২]
[১] সমাজের বিভিন্ন ধরনের মানুষের মধ্যে শ্রেণীগত সংঘাত সৃষ্টি করার পরিবর্তে ও ব্যবস্থা সংঘাতের কার্যকারসমূহকে সম্পূর্ণ নির্মূল করে দিয়ে সাহায্য সহযোগিতা ও সহমর্মিতার স্পিরিট সৃষ্টি করে দেয়। [দফা: ৪, ৬-১১, ১২, ১৫-১৭, ২১, ২২]
এসব বৈশিষ্ট্য ও নীতিমালা যেভাবে নবী করীম (সা) এবং খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগ বাস্তবে রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থায় কার্যকর করা হয়েছিল, তা থেকে বিধান ও দৃষ্টান্ত হিসেবে আমরা আরো অনেক ব্যবস্থায় কার্যকর করা হয়েছিল, তা থেকে বিধান ও দৃষ্টান্ত হিসেবে আমরা আরো অনেক বিস্তারিত রূপরেখা জানতে পারি। কিন্তু সে আলোচনা বর্তমান আলোচ্য বিষয় বহির্খভূত। সে সম্পর্কে হাদী, ফিকা, ইতিহাস ও সীরাতের গ্রন্থাবলীতে ব্যাপক তথ্যাদি মওজুদ রয়েছে। বিশদভাবে জানার জন্যে সেসব গ্রন্থাবলী অধ্যায়ন করা যেতে পারে।
গ্রন্থসূত্র
কুরআনে হাকীম।
বায়দাবী: আনোয়ারুত তানযীল। সংস্করণ: মুস্তফা আলবাবী হালবী, মিশর ১৩৩০ হিঃ ৯১৯১২)।
আলূসী: রূহুল মুয়ানী: সংস্করণ : ইদারাতুত তবায়াতূল মুনীরীয়া, মিশর ১৩৪৫ হিঃ।
আল জাসসাস: আহকামুল কুরআন। আল বাহীয়া সংস্করণ, মিশর ১৩৪৭ হিঃ
ইবনুল আরাবী : আহকামুল কুরআন: আস সায়অদা সংস্করণ, মিশর ১৩৩১ হিঃ।
ইবনে জরীর: জামেউল বয়ান। আল আমীরীয়া সংস্করণ, মিশর ১৩২৮ হিঃ।
ইবনে কাসীর: তাফসীরুল কুরআনিল আযীম। সংস্করণ: মুস্তফা মুহাম্মত, মিশর ১৯৪৭ ইং।
আয যমখশরী: আল কাশশাফ। আল বাহীয়া সংস্করণ, মিশর ১৩৪৩ হিঃ।
আল বুখারী: সহীহ
মুসলিম : সহীত
আবু দাউদ: সুনান।]
তিরমিযী : সুনান।
নাসায়ী: সুনান।
ইবনে মাজাহ: সুনানে মুস্তফা।
আশ শওকানী : নায়লুল আওতার। সংস্করণ: দায়িরাতুল মা’আরিফ, হায়দারাবাদ, ১৩৩৭ হিঃ।
ইবনে আবদুল বার: আল ইসতীয়াব। সংস্করণ: ঐ।
ইবনে মনয়ূব”: লিসানুল আরব, বৈরুত ১৯৫৬ ইং।