তৃতীয় অধ্যায়ঃ ইসলামী অর্থব্যবস্থা ও পুঁজিবাদের মধ্যে পার্থক্য
পুঁজিবাদ ও কমিউনিজমের মধ্যবর্তী পর্যায়ে ইসলাম যে ভরসাম্যপূর্ণ অর্থনৈতিক মতাদর্শ অবলম্বন করেছ তার ভিত্তিতে একটি কার্যকর অর্থনৈতিক ব্যবস্থাগড়ে তোলার জন্য ইসলাম নৈতিক শক্তি ও আইন- এ উভয়ের সাহাড্য নিয়েছে। নৈতিক শিক্ষার সাহায্যে ইসলাম সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তির মন মানসকে এ ব্যবস্থার স্বতস্ফূর্ত আনুগত্য করার জন্য তৈরী করে। অন্যদিকে আইনের বলে মানুষের উপর এমন সব বিধি নিষেধ আরোপ করে যার ফলে মানুষ এ ব্যবস্থার চৌহদ্দীর মধ্যে নিজেদেরকে আটকে রাখতে বাধ্য হয় এবং এর সুদৃঘ প্রাচীর ভেদ করে যেতে পারেনা। এ নৈতিক বিধি বিধান ও আইনসমূহ হচ্ছে ইসলামী অর্থব্যবস্থার মূল স্তম্ভ। নৈতিকতা, আইন এবং ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রকৃতি সম্পর্কে সঠিক ধারণা লাভ করার জন্য এসবের বিস্তারিত আলোচনা প্রয়োজন।
এক: উপার্জনে বৈধ অবৈধের পার্থক্য
এ প্রসঙ্গে প্রথম কথা হচ্ছে, ইসলাম এর অনুসারীদেরকে অর্থ উপার্জন করার অবাধ সুযোগ দেয় না; বরং উপার্জনের পন্থা ও উপায়ের ক্ষেত্রে সামাজিক স্বার্থের পরিপ্রেক্ষিতে বৈধ ও অবৈধতরা পার্থক্য সৃষ্টি করে। এ পার্থক্যের একটা মূলনীতি রয়েছে। তা হচ্ছে এই যে, ধন উপার্জনের যেসব পন্থা ও উপায় অবলম্বিত হলে এক ব্যক্তির লাভ ও অন্য ব্যক্তির বা ব্যক্তিবর্গের ক্ষতি হয় তা সবই অবৈধ। অন্যদিকে যেসব উপায় অবলম্বন করলে ধন-উপার্জন প্রচেষ্টার সাথে জড়িত প্রত্যেক ব্যক্তিই তার ন্যায়সংগত সুফল ভোগ করতে পারে তা সবই বৈধ। এ মূলনীতিটি কুরআন মজীদে নিম্নোক্তভাবে নিবৃত হয়েছেঃ
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَأْكُلُوا أَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ إِلَّا أَنْ تَكُونَ تِجَارَةً عَنْ تَرَاضٍ مِنْكُمْ وَلَا تَقْتُلُوا أَنْفُسَكُمْ إِنَّ اللَّهَ كَانَ بِكُمْ رَحِيمًا () وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ عُدْوَانًا وَظُلْمًا فَسَوْفَ نُصْلِيهِ نَارًا
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা পরস্পরের ধনসম্পদ অবৈধ উপায়ে ভক্ষণ করো না। তবে পারস্পরিক সম্মতি অনুযায়ী ব্যবসায়িক লেন-দেন করতে পারো। আর তোমরা নিজেরা নিজেদেরকে (অথবা পরস্পর পরস্পরকে) ধ্বংস করোনা। আল্লাহ তোমাদের অবস্থার প্রতি করুণাশীল। যে ব্যক্তি সীমা অতিক্রম ক’রে যুল্ম সহকারে এরূপ করবে তাকে আমি অগ্নির মধ্যে নিক্ষেপ করবো।” [আন নিসা: ২৯-৩০]
এ আয়াতে পারস্পরিক লেন দেনকে ব্যবসা বলা হয়েছে। পারস্পরিক সম্মাতিকে এর সাথে শর্ত হিসাবে সংযুক্ত করে এমন সব লেন-দেন অবৈধ গণ্য করা হয়েছে যার মধ্যে চাপ সৃষ্টি ও প্রতরণার কোনো উপকরণ থাকে অথবা এমন কোনো চালবাজিী থাকে যা দ্বিতীয় পক্ষ জানতে পালে এ লেনস দেনে নিজের সম্মতি প্রকাশে কোনোদিনই প্রস্তুত হবে না। এর পর আরো জোর দেয়ার জন্য বলা হয়েছে “তোমরা পরস্পরকে ধ্বংস করোনা।” এর দু’টি অর্থ হতে পারে। এ দু’টি অর্থই এখানে প্রযোজ্য। একটি অর্থ হচ্ছে, তোমরা একে অন্যকে ধ্বংস করোনা এং দ্বিতীয় অর্থটি হচ্ছে, তোমরা নিজেরা নিজেদেরকে ধ্বংস করো না। এর অর্থ হচ্ছে এই যে, যে ব্যক্তি নিজের লাভের জন্য অন্যের সর্বনাশ করে সে যেন রক্তপাণ করে এবং পরিণামে সে এভাবে নিজের ধ্বংসের পথ উন্মুক্ত করে।
এ নীতিগত নির্দেশ ছাড়াও কুরআনের বিভিন্ন স্থানে অর্থ উপার্জনের নিম্নোক্ত পদ্ধতিগুলোকে হারাম গণ্য করা হয়েছেঃ
উৎকোচ (আল বাকারা ১৮৮ আয়াত)
ব্যক্তি, সমষ্টি নির্বিশেষে সবার আত্মসাত (আল বাকারা ২৮৩ ও আলে ইমরা ন ১৬১ আয়াত)
চুরি (আল মায়িতা ৩৮ আয়াত)
এতীমের অর্থ অন্যায়বাবে তসরূপ (আন নিসা ১০ আয়াত); ওজনে কম করা (আল মুতাফ্ফিফীন ৩ আয়াত)
চারিত্রিক নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী উপকরণসমূহের ব্যবসা (আন নূর ১৯ আয়াত)
জুয়া ও এমন সব উপায় উপকরণ যেগুলোর মাধ্যমে নিছক ঘটনাচক্রে ও ভাগ্যক্রমে একদল লোকের সম্পদ অন্য একদল লোকের হস্তান্তরিক হয় (আল মায়িদা ৯০ আয়অত)
মূর্তি গড়, মূর্তি বিক্রয় ও মূর্তি উপাসনালয়ের সেবা (আল মায়িদা ৯০ আয়াত)
ভাগ্য গণনা ও জ্যোতিষির ব্যবসা (আল মায়িতা ৯০ আয়াত)
সুদ খাওয়া (আল বাকারা ২৭৫, ২৭৮ থেকে ২৮০ এবং আলে ইমান ১৩০ আয়াত)
দুই: ধন সঞ্চয়ের নিষেধাজ্ঞা
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ হচ্ছে যে, বৈধ উপায়ে যে ধন উপার্জন করা হবে তা পুঞ্জীভীত ক’রে রাখা যাবে না। কারণ এর ফলে ধনের আবর্তন বন্ধ হয়ে যায় এবং ধন বন্টনের ভারসাম্য বিনষট হয়। যে ব্যক্তি ধন সঞ্চয় করে রাশিকৃত ও পুঞ্জীভূত করে রাখে সে নিজে যে কেবল মারাত্মক নৈতিক রোগে আক্রান্ত হয় তাই নয় বরং মূলত সে সমগ্র মানব সমাজের বিরুদ্ধে একটি জঘন্যতম অপরাধ করে। এর ফল তার নিজের জন্যও খারাপ হয়। এজন্য কুরআন কার্পণ্য এবং কারুনের ন্যায় সম্পদ কুক্ষিগত ও পুঞ্জীভূত করে রাখার বিরোধিত করেছে কঠোরভাবে। কুরআন বলে
وَلَا يَحْسَبَنَّ الَّذِينَ يَبْخَلُونَ بِمَا آتَاهُمُ اللَّهُ مِنْ فَضْلِهِ هُوَ خَيْرًا لَهُمْ بَلْ هُوَ شَرٌّ
“যারা আল্লাহ প্রদত্ত অনুগ্রহে কৃপণতা করে, তারা যেন একথা মনে না করে যে, তাদের এ কাজ তাদের জন্য মঙ্গলজনক; বরং প্রকৃতপক্ষে এটা তাদের জন্য ক্ষতিকর।” [আলে ইমরান : ১৮০]
وَالَّذِينَ يَكْنِزُونَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلَا يُنْفِقُونَهَا فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَبَشِّرْهُمْ بِعَذَابٍ أَلِيمٍ
‘যারা স্বর্ণ রৌপ্য সঞ্চয় করে রাখে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদেরকেজ যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সংবাদ দাও।’ [আত তাওবা: ৩৪]
এই ঘোষণা পুঁজিবাদের ভিত্তি-তে আঘাত হানে। উদ্বৃত্ত অর্থ জমা করে রাখা এবং জমাকৃত অর্থ আরো অধিক অর্থ সংগ্রহে খাটানো- এটিই হচ্ছে পুঁজিবাদের মূলকথা। কিন্তু ইসলাম আদতে প্রয়োজনের অতিরিক্স অর্থ জমা করে রাখা পছন্দ করেনা।
তিন : অর্থ ব্যয় করার নির্দেশ
সঞ্চয় করার পরিবর্তে ইসলাম অর্থ ব্যয় করার শিক্ষা দেয়। কিন্তু ব্যয় করার অর্থ বিলাসিতা ও আয়েম আরামের জীবন যাপন করে দু-হাতে অ্থ লুটানো নয়; বরং ব্যয় করার ক্ষেত্রে ‘আল্লাহর পথে’র শর্ত আরোপ করে। অর্থাৎ সমাজের কোনো ব্যক্তির নিকট প্রয়োজনের অতিরিক্ত যে উদ্বৃত্ত অর্থ থাকে সমাজের জন্য কল্যাণমূলক কাজে তা ব্যয় করতে হবে। এটিই হবে আল্লাহর পথে ব্যয়।
وَيَسْأَلُونَكَ مَاذَا يُنْفِقُونَ قُلِ الْعَفْوَ
“তারা তোমাকে জিজ্ঞেস করছে যে, তারা কী ব্যয় করবে? তাদেরকে বলে দাও, যা তোমাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত (তাই ব্যয় কর)।” [আল বাকারা: ২১৯]
وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا وَبِذِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينِ وَالْجَارِ ذِي الْقُرْبَى وَالْجَارِ الْجُنُبِ وَالصَّاحِبِ بِالْجَنْبِ وَابْنِ السَّبِيلِ وَمَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ
“আর সদ্ব্যবহার কর নিজের মা বাপ, আত্মীয়স্বজন, অভাবী মিসকীন, আত্মীয় প্রতিবেশী, অনাত্মীয় প্রতিবেশী, নিজের মোলাকাতি বন্ধুবর্গ, মুসাফির ও মালকনাধীন দাসদাসেীদের সাথে।” [আন নিসা: ৩৬]
وَفِي أَمْوَالِهِمْ حَقٌّ لِلسَّائِلِ وَالْمَحْرُومِ
“তাদের অর্থসম্পদে প্রার্থী ও বঞ্চিতদের অধিকার আছে।” [আয যারিয়াত আয়াত: ১৯]
এখানে এসে ইসলাম ও পুঁজিবাদের দৃষ্টিকোণ সম্পূর্ণ পৃথক হয়ে যায়।
বিত্তবান মনে করে, অর্থ ব্যয় করলে অর্থ কমে যাবে না বরং এতে বরকত হবে ও বৃদ্ধি হবে।
الشَّيْطَانُ يَعِدُكُمُ الْفَقْرَ وَيَأْمُرُكُمْ بِالْفَحْشَاءِ وَاللَّهُ يَعِدُكُمْ مَغْفِرَةً مِنْهُ وَفَضْلًا
“শয়তান তোমাদেরকে দারিদ্রের ভয় দেখায় এবং কার্পণ্যের ন্যায় লজ্জাকর কাজের হুকুম দেয়; কিন্তু আল্লাহ তোমাদের নিকট মাগফিরাত ও অতিরিক্স দানের ওয়াদা করেন।” [আল বাকারা: ২৬৮]
বিত্তবান মনে করে কোনো কিছু ব্যয় করা হলে তা নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু ইসলাম বলে, না, তা নষ্ট হয়ে যায়নি বরং তার সর্বোত্তম লাভ তোমাদের নিকট ফিরে আসবে।
وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ خَيْرٍ يُوَفَّ إِلَيْكُمْ وَأَنْتُمْ لَا تُظْلَمُونَ
“সৎ কাজে তোমরা যা কিচু ব্যয় করবে তা তোমরা পুরোপুরি ফেরত পাবে এবং তোমাদের উপর কোনোক্রমেই যুল্ করা হবেনা।” [আল বাকারা: ২৭২]
وَأَنْفَقُوا مِمَّا رَزَقْنَاهُمْ سِرًّا وَعَلَانِيَةً يَرْجُونَ تِجَارَةً لَنْ تَبُورَ () لِيُوَفِّيَهُمْ أُجُورَهُمْ وَيَزِيدَهُمْ مِنْ فَضْلِهِ
“যারা আমার প্রদত্ত রিযিক থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে তারা এমন একটি ব্যবসয়ের আশা রাখে, যাতে কোনক্রমেই লোকসানের সম্ভাবনা নেই। আল্লাহ তাদেরকে এর বিনিময়ে পুরোপুরি ফল প্রদান করবেন বরং মেহেরবানী করে তাদেরকে আরো বেশী দান করবেন।” [ফাতির: ২৯-৩০]
বিত্তবান মনে করে, সম্পদ আহরণ করে সুদী ব্যবসায় বিনিয়োগ করলে সম্পগদ বেড়ে যায়। কিন্তু ইসলাম বলে, না, সুদের মাধ্যমে বরং সম্পদ কমে যায়। সৎকাজে অর্থ বিনিয়োগ করলেই সম্পদ বৃদ্ধি পায়।
يَمْحَقُ اللَّهُ الرِّبَا وَيُرْبِي الصَّدَقَاتِ
‘আল্লাহ সুদ নির্মূল করেন এবং দান-সাদকাকে প্রতিপারণ ও ক্রমবৃদ্ধি দান করেন।’ [আল বাকারা: ২৭৬]
وَمَا آتَيْتُمْ مِنْ رِبًا لِيَرْبُوَ فِي أَمْوَالِ النَّاسِ فَلَا يَرْبُو عِنْدَ اللَّهِ وَمَا آتَيْتُمْ مِنْ زَكَاةٍ تُرِيدُونَ وَجْهَ اللَّهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُضْعِفُونَ
“তোমরা এই যে সুদ দাও মানুষের ধনসম্পদ বৃদ্ধির আশায়, জেনে রাখ, আল্লাহর নিকট তা কখনো বৃদ্ধি লাভ করেনা। তোমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে যাকাত বাবদ যে অর্থ দান করে থাক একমাত্র তার মধ্যেই ক্রমবৃদ্ধি হয়ে থাকে।” [আর রূম : ৩৯]
পুঁজিবাদের সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী এটি আর একটি নতুন মতবাদ। ব্যয় করলে অর্থ বেড়ে যাবে এবং ব্যয়িত অর্থ নষ্ট হবে না তাই নয় বরং কিছুটা অতিরিক্স লাভ ও কল্যাণসহ পূর্ণমাত্রায় ফিরে আসবে; অন্যদিকে সুদী ব্যবসা অর্থ বৃদ্ধির পরিবর্তে অর্থ হ্রাস ও লোকসানের সূচনা করবে এবং যাকাত ও সাদকার মাধ্যমে অর্থ হ্রাসের পরিবর্তে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হবে- এ মতবাদটি আপাতদৃষ্টিতে অদ্ভূত ও বিস্ময়কর মনে হবে। শ্রোতা মনে করে সম্ভবত এগুলো নিছক আখেরাতের সওয়াবের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যাপার। নিঃসন্দেহে আখেরাতের সওয়াবের সাথে এসব কথার সম্পর্ক রয়েছে এবং ইসলারেম দৃষ্টিতে এটিই আসল গুরুত্বের অধিকারী। কিন্তু গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে যে, এ দুনিয়াতেও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে এ মতাদর্শ একটি শক্তিশালী ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। ধন সঞ্চয় করে সূদী ব্যবসায় নিয়োগ করার অবশ্যম্ভাবী ফল স্বরূপ চতুর্দিক থেকে ধন আহরিত হয়ে মুষ্টিমেয় কয়েকজনের হাতে চলে আসবে। সাধারণ মানুষের ক্রয়-ক্ষমাত প্রতিদিন কমে যেতে থাকবে। কৃষি, শিল্প ও ব্যবসা সর্বত্র মন্দভাব দেখা দেবে। জাতীয় অর্থনৈতিক জীবন ধ্বংসের শেষ সীমায় পৌছে যাবে। অবশেষে এমন অবস্থার সৃষ্টি হবে যার ফলে পুঁজিপতিরাও নিজেদের সীমায় পৌছে যাবে। অবশেষে এমন অবস্থার সৃষ্টি হবে যার ফলে পুঁজিপতিরাও নিজেদের সঞ্চিত ধনসম্পদ অর্থ উৎপাদনের কাজে লাগাবার সুযোগ পাবেনা।[রাসূলে করীম (সা) নিম্নোক্ত হাদীসটিতে একথার প্রতিই ইংগিত করেছেন: (আরবী**************)
অর্থাৎ “সুদের পরিমাণ যত বেশী হোক না কেন অবশেষে তা কম হতে বাধ্য।”]
বিপরীত পক্ষে অর্থসম্পদ ব্যয় করলে এবং যাকাত ও সাদকা দান করলে জাতির সকল ব্যক্তির হাতে এ সম্পদ ছড়িয়ে পড়ে, পত্যেক ব্যক্তি যথেষ্ট ক্রয়- ক্ষমতার অধিকারী হয়, শিল্পোৎপাদন বেড়ে যায়, সবুজ ক্ষেতগুলো শস্যে ভরে ওঠে, ব্যবসা বাণিজ্যে অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়। এতে হয়তো কেউ লাখপতি-কোটিপতি হয় না কিন্তু সবার অবস্থা সচ্ছল হয় এবং পরিবার হয় সমৃদ্ধশালী। এ শুভ পরিণামসম্পন্ন অর্থনৈতিক মতাদর্শটির সত্যতা যাচাই করতে হলে আমেরিকার বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা যেতে পারে। [এ গ্রন্থ প্রণয়নের সময় আমেরিকায় যে ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দাভাব দেখা দিয়েছিল সেদিকে ইংগিত করা হয়েছে।] সুদ ভিত্তিক অর্থব্যবস্থার কারণে সেখানে ধন বন্টনের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেছে এবং শিল্প ও বাণিজ্যের মন্দাভাব জাতির অর্থনৈতিক জীবনকে ধ্বংসের প্রান্তসীমায় পৌঁছে দিয়েছে। এর তুলনায় ইসলামী যুগের প্রথম দিকের অবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যখন সেখানে পূর্ণাংগরূপে প্রতিষ্ঠিত করা হয় তখন মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে জাতীয় সচ্ছলতা ও সমৃদ্ধি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যার ফলে লোকেরা যাকাত গ্রহীতা খুঁজে বেড়াতো কিন্তু কোথাও তাদের সন্ধান পাওয়া যেত না। এমন একজন লোকের সন্ধান পাওয়া যেতোনা, যে নিজেই যাকাত দেয়ার যোগ্যতা ও ক্ষমতা অর্জন করেনি। এ দুটি অবস্থাকে পাশাপাশি রেখে তুলনা করলে আল্লাহ সুদকে কিভাবে নিশ্চিহ্ন করে দেন এবং সাদকাকে ক্রমোন্নতি ও ক্রমবৃদ্ধি দান করেন তা দ্ব্যর্থহীনভাবে উপলব্ধি সম্ভব হবে।
ইসলাম পূঁজিবাদী মানসিকতা থেকে সম্পূরণ ভিন্নতর এক মানসিকতা সৃষ্টি করে। পুঁজিপতি একথা কল্পনাই করতে পারেনা যে, সুদ ছাড়া এক ব্যক্তি অর্থসম্পদের আরেক ব্যক্তিকে কেমন কর দিতে পারে। সে অর্থ ঋণ দিয়ে তার বিনিময়ে কেবল সুদই আদায় করেনা, বরং নিজের মূলধন ও তার সুদ আদায় করার জন্য ঋণগ্রহীতার বস্ত্র ও গৃহের আসবাবপত্রদি পর্যন্ত ক্রোক করে নেয়। কিন্তু ইসলামের শিক্ষা হচ্ছে, অভাবীকে কেবল ঋণ দিলেই হবে না, বরং তার আর্থিক অনটন যদি বেশী থাকে তাহলে তার নিকট কড়া তাকাদা করা যাবেনা, এমনকি, ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা না থাকলে তাকে মাফ করে দিতে হবে।
وَإِنْ كَانَ ذُو عُسْرَةٍ فَنَظِرَةٌ إِلَى مَيْسَرَةٍ وَأَنْ تَصَدَّقُوا خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ
“ঋণ গ্রহীতা যদি অত্যধিক অনটন পীড়িত হয়, তাহলে তার অবস্থা সচ্ছল না হওয়া পর্যন্ত তাকে সুযোগ দাও; আর যদি তাকে মাফ করে দাও তাহলে তা হবে তোমার জন্য উত্তম। যদি তোমরা কিছু জ্ঞান রাখতে, তাহলে এর কল্যাণকারিতা উপলব্ধি করতে পারতে।” [আল বাকারা: ২৮০]
পুঁজিবাদী ব্যবস্থা পারস্পরিক সাহায্যের অর্থ হচ্ছে এই যে, প্রথমে পারস্পরিক সাহাড্য সমিতির তহবিলে অর্থ জমা কর আপনাকে এ সদস্য হতে হবে, তারপর আপনার যদি কখনো অর্থের প্রয়োজন হয়, তাহলে সমিতির বাজারে প্রচলিত সাধারণ সুদের হারের তুলনায় কিছু কম হারে আপনাকে সুদী ঋণ দেবে। যদি আপনার কাছে অর্থ না থাকে তাহলে পারস্পরিক সাহায্য সমিতি থেকে আপনি কোনোই সাহায্য পাবেন না। বিপরীত পক্ষে ইসলাম যে পারস্পরিক সাহায্যের পরিকল্পনা দিয়েছে তা হচ্ছে এই সামর্থবান লোকেরা প্রয়োজনের সময় তাদের কম সামর্থবান ভাইদেরকে কেবল ঋণই দেবে না বরং তাদের ঋণ আদায় করার ব্যাপারেও সামর্থ অনযায়ী তাদেরকে সাহায্য করবে। তাই ‘আলগারেমীনা’ অর্থাৎ ঋণগ্রস্তদের ঋণ আদায় করে দেয়াকেও যাকাতের অন্যতম ব্যয়ের খাত হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
পুঁজিপতি কখনো সৎকাজে কোনো অ্থ ব্যয় করলে নেহায়েত লোক দেখানোর উদ্দেশ্যেই তা করে থাকে। কারণ এ সংকীর্ণচেতা ব্যক্তি মনে করে যে, অর্থ ব্যয়ের বিনিময়ে কমপক্ষে সুনাম ও সুখ্যাতি তার অবশ্যই প্রাপ্য। কিন্তু ইসলাম বলে, লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে অর্থ ব্যয় করা উচিত নয় এবং প্রকাশ্যে বা গোপনে যা-ই ব্যয় করা হোক না কেন, সত্বর কোনো না কোন আকারে এর প্রতিদান পাওয়া যাবে-এ ধরনের কোনো উদ্দেশ্যও যেন এর পিছনে না থাকে। বরং কাজের পরিণতির প্রতি দৃষ্টি রাখতে হবে। এ দুনিয়া থেকে আখেরাত পর্যন্ত যতদূর দৃষ্টি প্রসারিত করা যাবে সর্বত্রই দেখা যাবে, এ ব্যয়িত অর্থ সম্প্রসারিত হচ্ছে এবং একের পর এক তা মুনাফা দিয়েই চলছে। “যে ব্যক্তি লোক দেখাবার উদ্দেশ্যে নিজের অর্থ ব্যয় করে, তার এ কাজকে এমন একটি প্রস্তরখণ্ডের সাথে তুলনা করা যেতে পারে যার উপর ছিল মাটির অস্তরণ, সে এ মাটির মধ্যে বীজ বপন করেছিল কিন্তু পানির একটি প্রবাহ আসলো এবং সমস্ত মাটি ধুয়ে নিয়ে চলে গেলো। আর যে ব্যক্তি নিজের নিয়ত ঠিক রেখে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে অর্থ ব্যয় করে, তার এ কাজকে এমন একটি উৎকৃষ্ট জমির সাথে তুলনা করা যেতে পারে, যেখানে একটি উদ্যান রচনা করা হয়েছে, বৃষ্টি হলে সেখানে দ্বিগুণ ফল উৎপন্ন হয়, আর বৃষ্টি না হলে নিছক ছোটখাট একটি স্রোতধারা তার জন্য যথেষ্ট।” [বাকারা: ৩৬]
إِنْ تُبْدُوا الصَّدَقَاتِ فَنِعِمَّا هِيَ وَإِنْ تُخْفُوهَا وَتُؤْتُوهَا الْفُقَرَاءَ فَهُوَ خَيْرٌ لَكُمْ
“যদি প্রকাশ্যে সাদকা দাও তাও ভালো; কিন্তু যদি গোপনে দাও এবং দরিদ্রদের নিকট পৌঁছিয়ে দাও, তাহলে এটিই উত্তম হবে।” [আল বাকারা: ২৭১]
পুঁজিপতি যদি কখনো সৎকাজে কোনো অর্থ ব্যয় করে তাহলে তার পিছনে তার আবেগ ও সদিচ্ছা থাকে না; বরং অনিচ্ছাকৃতভাবেই তা করে থাকে এবং এজন্য সে সবচেয়ে নিকৃষ্টমানের সম্পদ ব্যয় করে; তারপর নিজের শাণিত বাক্য-বাণে বিদ্ধ করে অর্থগ্রহীতার অর্ধেক প্রাণ বের করে নেয়। বিপরীতপক্ষে ইসলাম সবচেয়ে ভালো সম্পদ ব্যয় করা এবং এজন্য নিজের অনুগ্রহ প্রকাশ না করা, এমনকি প্রতিতানে কেউ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে এ আশাও পোষণ না করার শিক্ষা দেয়।
أَنْفِقُوا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا كَسَبْتُمْ وَمِمَّا أَخْرَجْنَا لَكُمْ مِنَ الْأَرْضِ وَلَا تَيَمَّمُوا الْخَبِيثَ مِنْهُ تُنْفِقُونَ
“তোমরা যা কিছু উপার্জন করেছো, আর যা কিচু আমি জমি থেকে তোমাদের জহন্য বের করেছি, তা থেকে উৎকৃষ্ট সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় কর; আর বাছাই করে নিকৃষ্টতর বস্তু ব্যয় করোনা।” [আল বাকারা: ২৬৭]
لَا تُبْطِلُوا صَدَقَاتِكُمْ بِالْمَنِّ وَالْأَذَى
“অনুগ্রহ প্রকাশ করে ও কষ্ট দিয়ে তোমাদের সাদকাসমূহ ধ্বংস করো না।” [আল বাকারা: ২৬৪]
وَيُطْعِمُونَ الطَّعَامَ عَلَى حُبِّهِ مِسْكِينًا وَيَتِيمًا وَأَسِيرًا () إِنَّمَا نُطْعِمُكُمْ لِوَجْهِ اللَّهِ لَا نُرِيدُ مِنْكُمْ جَزَاءً وَلَا شُكُورً
“আর তারা আল্লাহর প্রতি ভালবাসায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মিসকীন এতীম ও কয়েদীকে আহার করায় এবং বলে, আমরা তোমারেদ খাওয়াচ্ছি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে, (এজন্য) আমরা তোমাদের নিকট থেকে কোনো প্রতিদান ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের প্রত্যাশী নই।” [আদ দাহর: ৮-৯]
নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এ দুটি মানসিকতার মধ্যে যে বিপুল ব্যবধান রয়েছে সে প্রশ্ন না হয় বাদই দিলাম। নিছক অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলেও দু’টি মতাদর্শের মধ্যে ইসলামই হচ্ছে অধিক শক্তিশালী এবং সুদূরপ্রসারী ফলাফলের পরিপ্রেক্ষিতে অধিকতর নির্ভুল। অতঃপর কল্যাণ ও ক্ষতি প্রসঙ্গে ইতিপূর্বে আমি ইসলামের যে আদর্শ তুলে ধরেছি সেসব সামনে রেখে, ইসলাম কোনো অবস্থায় সুদী কারবারকে বৈধ গণ্য করতে পারে- এ কথা চিন্তা করার কোনো অবকাশ আছে কি?
চার: যাকাত
ইতিপূর্বে আলোচিত হয়েছে যে, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ইসলাম যে দৃষ্টিভংগি পেশ করেছে তার সারমর্ম হচ্ছে এই যে, ধন একস্থানে পুঞ্জীভূত ও কুক্ষিগত হয়ে থাক পারবে না; ইসলামী সমাজের যে কয়জন লোক তাদের উতচ্চতর যোগ্যতা ও সৌভাগ্যের কারণে নিজেদের প্রয়োজনের অতিরিক্স ধনসম্পদ আহরণ করবে, ইসলাম চায় তারা যেন এই সম্পদ পুঞ্জীভূত করে না রাখে, বরং এগুলো ব্যয় করে এবং এমন সব খঅতে ব্যয় করে যেখান থেকে ধনের আবর্তনের ফলে সমাজের স্বল্পবিত্তের লোকেরাও যথেষ্ট অংশ লাভ করতে সক্ষম হবে। এ উদ্দেশ্যে ইসলাম একদিকে উন্নত নৈতিক শিক্ষা প্রদান, উৎসাহ দান ও ভীতি প্রদর্শনের শক্তিশালী অস্ত্র প্রয়োগ করে দানশীলতা ও যথার্থ পারস্পরিক সাহায্য সহযোগিতার প্রবণতা সৃষ্টি করে। যাতে লোকেরা নিজেদের মনের স্বাভাবিক ইচ্ছা আকাংখা অনুযায়ী ধনসম্পদ সঞ্চয় করাকে খারাপ জানবে এবং তা ব্যয় করতে উৎসাহী আগ্রহী হবে। অন্যদিকে ইসলাম এমনসব আইন প্রণয়ন করে, যার ফলে বাদান্যতার এ শিক্ষা সত্ত্বেও নিজেদের অসৎ মনোবৃত্তির কারণে যেসব লোক সম্পদ আহরণ ও পুঞ্জীভূত করে রাখতে অভ্যস্ত হয় অথবা যাদের নিকট কোনো না কোনোভাবে সম্পদ সঞ্চিত হয়ে যায় তাদের সম্পদ থেকে সমাজের কল্যাণ ও উন্নতি বিধানার্থে কমপক্ষে একটি অংশ অবশ্যই কেটে নেয়া হবে। একেই যাকাত বলা হয়। ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এ যাকাতকে অত্যধিক গুরুত্ব দান করা হয়েছে, এমনকি একে ইসলামের একটি মূলস্তম্ভের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। নামাযের পরে এ যাকাতের উপরই সবেচেয়ে বেশী জোর দেয়া হয়েছে এবং দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করা হয়েছে যে, যে ব্যক্তি অর্থসম্পদ সঞ্চয় করে, যাকাত না দেয়া পর্যন্ত তার ঐ সম্পদ হালাল হতে পারে না।
خُذْ مِنْ أَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً تُطَهِّرُهُمْ وَتُزَكِّيهِمْ بِهَا
“(হে নবী!) তাদের ধনসম্পদ থেকে একটি সাদকা গ্রহণ কর, যা ঐ ধনসম্পদকে পাক পবিত্র ও হালাল করে দেবে।” [আত তাওবা: ১০৩]
এখানে ‘একটি সাদকা’ শব্দটি থেকে সাদকার একটি বিশেষ পরিমাণ বুঝা যায়। এ সঙ্গে রাসূলে করীম (সা)-কে এটি আদায় করার নির্দেশ দেয়ার ফলে একথা সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে, সাধারণ স্বেচ্ছাপ্রদত্ত সাদকা থেকে আলাদা এটি একটি ওয়াজিব ও ফরয সাদকা অর্থাৎ যাকাত এবং বিত্তশালী লোকদের নিকট থেকে এ সাদকা অবশ্যই আদায় করতে হবে। কাজেই এ নির্দেশ অনুযায়ী রাসূলে করীম (সা) বিভিন্ন প্রকার সম্পদের জন্য নিসাবের (যে সর্বনিম্ন পরিমাণের উর্ধে যাকাত অপরিহার্য) একটি পরিমাণ নির্ধারণ করেছেন। অতঃপর নিসাব পরিমাণ বা তদূর্ধ বিভিন্ন প্রকার সম্পদের উপর যাকাতের বিভিন্ন হার নির্ধারণ করেছেন। সোনা, রূপা ও নগদ টাকা পয়সার উপর শতকরা আড়াই ভাগ এবং কৃষি উৎপাদনের উপর সেচ ব্যবস্থার আওতাধীন জমি হলে শতকরা ৫ভাগ ও সেচ ব্যবস্থার আওতা বহির্ভূত জমি হলে শতকরা ১০ ভাগ, ব্যবসায়িক পণ্যের উপর শতকরা আড়াই ভাগ, খনিজ দ্রব্যাদি (নিজস্ব মালিকানাধীন) ও গুপ্তধনের উপর শতকরা ২০ ভাগ যাকাত ধার্য করেছেন। এভাবে ব্যবসায়িক পণ্য হিসেবে ব্যবহৃত গবাদি পশু প্রভৃতি চতুষ্পদ প্রাণীর উপর বিভিন্ন হারে যাকাত ধার্য করেছেন।
আয়াতের শেষ শব্দটি থেকে সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে, বিত্তশালী ব্যক্তির নিকট যে অর্থসম্পদ সঞ্চিত হয় ইসলামের দৃষ্টিতে তা অপবিত্র এবং তার মালিক তা থেকে প্রতিবছর কমপক্ষে একটি বিশেষ পরিমাণ আল্লাহর পথে ব্যয় না করা পর্যন্ত তা পবিত্র হতে পারেনা। ‘আল্লাহর পথে’ শব্দটির অর্থ কি? আল্লাহ কারো মুখাপেক্ষী নন। তাঁর অর্থসম্পদের প্রয়োজন নেই, তিনি অভাবীও নন। কাজেই তাঁর ‘পথ’ বলে একথাই বুঝানো হয়েছে যে, বিত্তশালীদের সম্পদ ব্যয় করে জাতির দরিদ্র ও অভাবী লোকদেরকে সচ্ছল করার চেষ্টা করতে হবে এবং এমনসব কল্যাণমুলক কাজে এ সম্পদ নিয়োগ করতে হবে যা থেকে সমগ্র লাভবান হবে।
إِنَّمَا الصَّدَقَاتُ لِلْفُقَرَاءِ وَالْمَسَاكِينِ وَالْعَامِلِينَ عَلَيْهَا وَالْمُؤَلَّفَةِ قُلُوبُهُمْ وَفِي الرِّقَابِ وَالْغَارِمِينَ وَفِي سَبِيلِ اللَّهِ وَابْنِ السَّبِيلِ فَرِيضَةً مِنَ اللَّهِ وَاللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ
“মূলত সাদকা-যাকাত হচ্ছে ফকির [ফকির এমন সব লোকদের বলা হয় যারা নিজেদের প্রয়োজনের চেয়ে কম রোজগার করার কারণে অন্যের সাহায্যের মুখাপেক্ষী। (লিসানুল আরব)] মিসকীনদের [মিসকীনদের সংজ্ঞা বর্ণনা করে হযরত উমর (রা) বলেছেন: যারা অর্থ উপার্জন করতে পারে না অথবা অর্থ উপার্জনের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এ সংজ্ঞার প্রেক্ষিতে যে দরিদ্র শিশু এখনো অর্থ উপার্জনের যোগ্যতা রাখে না এবং যেসব বেকার ও রুগ্নব্যক্তি সাময়িকভাবে উপার্জনের যোগ্যতা বঞ্চিত— তারা সবা ই মিসকীন।] জন্য এবং তাদের জন্য যাদেরকে সাদকা আদায়ের কাজে নিযুক্ত করা হয, তাদের জন্য যাদের হৃদয়কে শক্তিশালী করার প্রয়োজন হয়, [এ দলের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে এমনসব নওমুসলিম যারা কুফর থেকে ইসলামে প্রবেশ করার কারণে সংকট জর্জরিত হয়েছে।]
লোকদেরকে বন্দীত্ব থেকে মুক্ত করার জন্য, ঋণগ্রস্তদের ঋণমুক্ত করার জন্য, আল্লাহর পথে ব্যয় করার জন্য এবং মুসাফিরদের [মুসাফির ব্যক্তির গৃহে সম্পদের প্রাচুর্য থাকলেও সফর অবস্থায় অর্থ সংকটে পড়লে অবশ্যিই সে যাকাত গ্রহণের হকদার।]
জন্য।” [আত তাওবা: ৬০]
এটিই মুসলমানদের কো-অপারেটিভ সোসাইটি, তারেদ ইনসিউরেন্স কোম্পানী এবং প্রতিভেন্ট ফান্ড। এখান থেকেই মুসলিম সমাজের বেকারদেরকে সাহায্য করা হয়। তাদের অক্ষম, বিকলাংগ, রুগ্ন, এতীম, বিধবা ও কর্মহীনদেরকে এ ব্যবস্থার মাধ্যমেই প্রতিপালন করা হয়। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে এই যে, এ ব্যবস্থা মুসলমানদেরকে ভবিষ্যত অন্য সংস্থানের চিন্তা থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত করে। এর সহজ নীতি হচ্ছে, আজ এক ব্যক্তি বিত্তবান কাজেই সে অন্যকে সাহায্য করবে, আগামীকাল যখন সে অভাবী হয়ে পড়বে তখন অন্যেরা তাকে সাহায্য করবে, আগামীকাল যখন সে অভাবী হয়ে পড়বে তখন অন্যেরা তাকে সাহায্য করবে। দরিদ্র হয়ে পড়লে আমার অবস্থ কি হবে. একথা চিন্তা করার কোনো প্রয়োজন নেই। মরে গেলে স্ত্রী ও ছেলে মেয়েদের কি অবস্থা হবে? কোনো আকস্মিক দুর্ঘটনার কবলে পড়লে, পীড়িত হয়ে পড়লে, ঘরবাড়ীতে আগুন লেগে গেলে, বন্যাকবলিত হয়ে পড়লে, দেউলিয়া হয়ে গেলে তখন কি অবস্থা দাঁড়াবে এবং এসব বিপদের হাত থেকে উদ্ধারের কি উপায় হবে—এসব চিন্তা করার আদৌ কোনো প্রয়োজন নেই। সফল অবস্থায় টাকা পয়সা শেষ হয়ে গেলে জীবিকা নির্বাহের কি উপায় হবে? একমাত্র যাকাত ব্যবস্থাই এ সমস্ত চিন্তা থেকে মানুষকে চিরন্তন মুক্তি দান করে। এক্ষেত্রে ইসলামী সমাজের একজন সদস্যের কাজ কেবল এতটুকুই থাকে যে, সে প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থসম্পদের একটি অংশ আল্লাহর ইনসিউরেন্স কোম্পানীতে জমা দিয়ে বীমা করে নেবে। প্রকৃতপক্ষে এ সময় এ অর্থের তার কোনো প্রয়োজন নেই। এ অর্ত এখন যাদের প্রকৃত প্রয়োজন তাদের কাজে লাগবে। কাল যখন তার বা তার সন্তান সন্তদের প্রয়োজন দেখা দেবে তখন কেবল তার নিজের প্রদত্ত সম্পদই নয় বরং তার চেয়ে অনেক বেশী সম্পদ ফেরত পাবে।
এখানে আবার দেখা যায়, পুঁজিবাদ এবং ইসলামের নীতি ও পদ্ধতির মধ্যে পরিপূর্ণ বৈপরীত্য। পুঁজিবাদের দাবি হচ্ছে, অর্থ সঞ্চয় করতে হবে এং তার পরিমাণ বাড়াবার জন্য সুদ নিতে হবে। যার ফলে এ নালা দিয়ে গড়িয়ে আশেপাশের লোকরেদ সবার টাকা পয়সা এ পুকুরে এসে পড়বে। বিপরীতপক্ষে ইসলাম নির্দেশ দেয়,. প্রথমত টাকা পয়সা জমা করে বা আটকে রাখা যাবে না; আর যদি কখনো জমা হয়ে যায়, তাহলে এ পুকুর থেকে নালা কেটে দিতে হবে যাতে শুকিয়ে যাওয়া ক্ষেত্রগুলোতে পানি পৌঁছে যায় এবং আশেপাশের জমি তরতাজা হয়ে সবুজে শ্যমল ভরে ওঠে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ধন আবদ্ধ ও জমাটব্ধ থাকে; কিন্তু ইসলামী ব্যবস্থায় ত মুক্ত, স্বাধীন ও অবাধ গতিশীল। পুঁজিবাদের পুকুর থেকে পানি নিতে হলে প্রথমে আপনর পানি সেখানেই অবশ্যই থাক হবে, নয় তো এক কাতরা পানি আপনি সেখান পেতে পারেন না। কিন্তু ইসলামী অর্থব্যবস্থার পুকুরের নিয়ম হচ্ছে যে, যার নিকট প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি থাকবে সে তার বাড়তি পানি ঐ পুকুরে ঢেলে দিয়ে যাবে, আর যার পানির প্রয়োজন হবে সে ওখান থেকে পানি নিয়ে যাবে। বলাবাহুল্য, মৌলিকত্ব ও স্বভাগ প্রকৃতির দিক দিয়ে এ দু’টি পদ্ধতি পরস্পরের সম্পূর্ণ বিপরীত। একটি অর্থব্যবস্থায় এ দুই বিপরীতধর্মী মতাদর্শকে একত্রিত করা কোনোক্রমেই সম্ভবপর নয়। কোনো বুদ্ধিমান ব্যক্তি এ ধরনের বিপরীতধর্মী মতাদর্শের একত্র সমাবেশের কথা কল্পনাই করতে পারেনা।
পাঁচ: মীরাসী আইন
নিজের ব্যক্তিগত ও সামাজিক প্রয়োজনে অর্থ ব্যয়, আল্লাহর পথে ব্যয় ও যাকাত আদায় করার পরও যে অর্থসম্পদ কোনো একহাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে যাবে তাকে বিকেন্দ্রীভূত করার জন্য ইসলাম আর একটি পন্থা অবলম্বন করেছে। একে বলা হয় মীরাসী আইন। এ আইনের উদ্দেশ্য হচ্ছে, যে ব্যক্তি অর্থসম্পদ রেখে মৃত্যুবরণ করবে তা যতো কম বা বেশী হোক না কেন, তা কেটে টুকরো টুকরো করা হবে এবং নিকট ও দূরের সকল আত্মীয়ের মধ্যে ক্রমানুসারে বন্টন করা হবে। যদি এমন কোনো ব্যক্তি থাকে, যার কোনো ওয়ারিশ নেই, তাহলে তাকে পোষ্যপুত্র গ্রহণ করার অধিকার দেয়ার পরিবর্তে, তার সম্পদ মুসলমানদের বায়তুলমালে জমা করে দিতে হবে। তাহলে সমগ্র জাতি এ থেকে লাভবান হতে পারবে। মীরাস বন্টনের এ আইনের অস্তিত্ব একমাত্র ইসলামেই দেখা যায়, অন্য কোনো অর্থব্যবস্থায় এর অস্তিত্ব নেই। অন্যান্য অর্থব্যবস্থা এ ব্যাপারে যে নীতি নির্ধারণ করেছে তা এক ব্যক্তি যে অর্থ সঞ্চিত করে রেখে যায়, তার মৃত্যুর পর তা এক বা একাধিক ব্যক্তির নিকট কেন্দ্রীভূত রাখতে চায়।[জ্যেষ্ঠ পুত্রের উত্তরাধিকার (Primogeniture) এবং একান্নবর্তী পরিবার (Joint Family System) প্রথা এ নীতির উপরই প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু ইসলাম সম্পদ কেন্দ্রীভূত করার পরিবর্তে বিকেন্দ্রীকরণেল পক্ষপাতি, এর ফলে অর্থের আবর্তন সহজতর হয়।
ছয়: গনীমতলব্ধ ও সম্পদ ও বিজিত সম্পত্তি বন্টন
এ ক্ষেত্রেও ইসলাম একই দৃষ্টিভংগির অধিকারী। যুদ্ধে সেনাবাহিনী যে গনীমতের অর্থ (শত্রুপক্ষের পরিত্যক্ত সম্পদ) হস্তগত করে, সে সম্পর্কে ইসলাম একটি বিশিষ্ট আইন প্রণয়ন করেছে। এ অর্থসম্পদ পাঁচ ভাগে বিভক্ত করা হয়। চারভাবে সৈন্যদের মধ্যে বন্টন করা হয় এবং অবশিষ্ট একভাগ সাধারণ জাতীয় কল্যাণমূলত কাজে ব্যবহার করার জন্য রেখে দেয়া হয়।
وَاعْلَمُوا أَنَّمَا غَنِمْتُمْ مِنْ شَيْءٍ فَأَنَّ لِلَّهِ خُمُسَهُ وَلِلرَّسُولِ وَلِذِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينِ وَابْنِ السَّبِيلِ
“জেনে রেখো, গনীমত হিসেবে তোমরা যা কিছু হস্তগত কর, তার এক পঞ্চমাংশ হচ্ছে আল্লাহ, তাঁর রাসূল, রাসূলের নিকটাত্মীয়, এতীম, মিসকীন ও মুসাফিরদের জন্য।” [আনফাল: ৪১]
আল্লাহ ও রাসূলের অংশ বলতে এমন অংশকে বুঝানো হয়েছে যা আল্লাহ ও রাসূলের নির্দেশের আওতাধীন ইসলামী রাষ্ট্রের কর্তৃত্বাধীন দেয়া হয়েছে।
যাকাতে রাসূলের নিকটাত্মীয়দের কোনো অংশ ছিল না বলে এখানে তাদের অংশ রাখা হয়েছে।
অতঃপর এতে আরো তিন শ্রেণীর অংশ বিশেষভাবে সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। জাতির এতীম শিশুদের শিক্ষঅ দীক্ষার ব্যবস্থা করা এবং তাদেরকে জীবন সংগ্রামে অংশ নেয়ার যোগ্য করে গড়ে তোলার জন্য এতে তাদের অংশ রাখা হয়েছে। মিসকীনদের অংশ রাখা হয়েছে- বিধবা মহিলা, বিকলাঙ্গ, অক্ষম, রুগ্ন ও অভাবী প্রভৃতি এর অন্তর্ভুক্ত। আর রাখা হয়েছে ইবনুস সাবীর অর্থাৎ মুসাফিরকে আপ্যায়ন করা প্রবণতা সৃষ্টি করেছে। এ সঙ্গে যাকা, সাদকা ও যুদ্ধলব্ধ গনীমতের সম্পদেও তার অংশ রেখেছে। এ ব্যবস্থার কারণে মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য, ভ্রমণ-পর্যটন, শিক্ষা-অধ্যয়ন, প্রত্নতাত্বিক নিদর্শনাবলী পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষনের জন্য যাতায়াত সহজতর হয়েছে।
যুদ্ধের ফলে ইসলামী রাষ্ট্র যেসব সম্পদ সম্পত্তির মালিক হয় ইসলাম সেগুলোকে সম্পূর্ণরূপে ইসলামী রাষ্ট্রের কর্তৃত্বাধীন রাখার বিধান দিয়েছে।
مَا أَفَاءَ اللَّهُ عَلَى رَسُولِهِ مِنْ أَهْلِ الْقُرَى فَلِلَّهِ وَلِلرَّسُولِ وَلِذِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينِ وَابْنِ السَّبِيلِ كَيْ لَا يَكُونَ دُولَةً بَيْنَ الْأَغْنِيَاءِ مِنْكُمْ……. لِلْفُقَرَاءِ الْمُهَاجِرِينَ الَّذِينَ أُخْرِجُوا مِنْ دِيَارِهِمْ وَأَمْوَالِهِمْ…. وَالَّذِينَ تَبَوَّءُوا الدَّارَ وَالْإِيمَانَ مِنْ قَبْلِهِمْ….. وَالَّذِينَ جَاءُوا مِنْ بَعْدِهِمْ
“জনপদের অধিবাসীদের নিকট থেকে আল্লাহ ‘ফায়’ (বিনাযুদ্ধে শত্রুপক্ষের যেসব সম্পদ হস্তগত হয়) হিসেবে যা কিছু দান করেছেন তা আল্লাহ, তাঁর রাসূল, রাসূলের নিকটাত্মীয়, এতীম, মিসকীন ও মুসাফিরদের জন্য, যাতে এগুলো কেবলমাত্র তোমাদের ধনীদের মধ্যে আবর্তিত না হয়।….. আর এর মধ্যে অভাবী মুহাজিরদেরও অংশ রয়েছে, যাদেরকে নিজেদের ঘর-বাড়ী ও সহায় সম্পদ থেকে বেদখল করে নির্বাসিত করা হয়েছে।…. আর তাদের অংশ রয়েছে যারা মুহাজিরদের আসার আগে মদীনায় ঈমান এনেছিল।… আর তাদের পরে ভবিষ্যতে আগমনকারী বংশদরদেরও অংশ রয়েছে।” [আল হাশর: ৭-১০]
এ আয়াতগুলোতে কেবলমাত্র ‘ফায়লব্ধ’ অর্ধের ব্যয়ক্ষেত্রগুলোর বিশদ বর্ণনা করা হয়নি; বরং এইসঙ্গে যে উদ্দেশ্যে ইসলাম ফায়লব্ধ অর্থসম্পদ বন্টন তথা সমগ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পরিচালনা করেছে সেদিকেও সুস্পষ্ট ইংগিত করা হয়েছে। অর্থাৎ (আরবী********)
“অর্থসম্পদ যেন কেবলমাত্র তোমাদের ধনীদের মধ্যে আবর্তিত না হয়।’” কুরআন মজীদ ছোট একটি বাক্যের মধ্যে যে বিষয়বস্তু বর্ণনা করেছে সেটিই হচ্ছে সমগ্র ইসলামী অর্থব্যবস্থার ভিত্তিপ্রস্তর।
সাত: মিতব্যয়িতার নির্দেশ
ইসলাম একদিকে ধনসম্পদ সমগ্র দেশবাসীর মধ্যে আবর্তন করা ও ধনীদের সম্পদ থেকে নির্ধনদের অংশ লাভ করার ব্যবস্থা করেছে, অন্যদিকে প্রত্যেক ব্যক্তিকে অর্থ ও সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে মিতব্যয়ী হবার নির্দেশ দিয়েছে। এভাবে অর্থনৈতিক উপায় উপকরণ ব্যবহার করার ক্ষেত্রে ব্যক্তি কখনো প্রান্তিকতার আশ্রয় নিয়ে অর্থনৈতিক ভারসাম্য বিনষ্ট করবে না। এক্ষেত্রে কুরআনে মৌলিক শিক্ষা হচ্ছে:
وَلَا تَجْعَلْ يَدَكَ مَغْلُولَةً إِلَى عُنُقِكَ وَلَا تَبْسُطْهَا كُلَّ الْبَسْطِ فَتَقْعُدَ مَلُومًا مَحْسُورًا
“আর নিজের হাত না একেবারে গলায় বেঁধে রাখবে, আর না একেবারে তাকে খুলে দিবে, যার ফলে পরবর্তীকালে আক্ষেপ করে বসে থাকার মতো অবস্থার সৃষ্টি হয়।” [বনী ইসরাঈল : ২৯]
وَالَّذِينَ إِذَا أَنْفَقُوا لَمْ يُسْرِفُوا وَلَمْ يَقْتُرُوا وَكَانَ بَيْنَ ذَلِكَ قَوَامًا
“আর আল্লাহর সৎকর্মশীল বান্দারা যখন ব্যয় করে, অপব্যয় করে না, আবার কার্পণ্যও করেনা, বরং এ দুটির মধ্যবর্তী ভারসাম্যপূর্ণ পন্থা অবলম্বন করে।” [আল ফুরকান: ৬৭]
এ শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে, প্রত্যেক ব্যক্তি যেন নিজের আর্থিক সঙ্গতির মধ্যে থেকেই অর্থ ব্যয় করে। তার অর্থব্যয় যেন কখনো এমন পর্যায়ে না পৌঁছায়, যার ফলে তা তার আয়ের অংককে ছাড়িয়ে যায় এবং নিজের আজেবাজে খরচের জন্য তাকে অন্যের দ্বারে হাত পাততে হয়, অথবা অন্যের উপার্জনে ভাগ বসাতে হয় এবং যথার্থ প্রয়োজন ছাড়াই অন্যের নিকট থেকে ঋণ গ্রহণ করতে হয়। অতঃপর গায়ের জোরে সে ঋণদাতাকে কাঁচকলা দেখিয়ে ফিরবে অথবা ঋণ পরিশোধ করার জন্য নিজের সব রকমের অর্থনৈতিক উপকরণ ব্যবহার করে অবশেষে ফতুর হয়ে ফকীর ও মিসকীনদের খাতায় নিজের নাম লেখাবে। আবার সে যেন নিজের অর্থনৈতিক সামর্থ্যের তুলনায় অনেক কম খরচ করার মতো কার্পণ্যও না দেখায়। নিজের আয় ও অর্থনৈতিক উপায় উপকরণের সীমার মধ্যে থেকে ব্যয় করার অর্থ এ নয় যে, সে ভালো আয় উপার্জন করলে নিজের সব টাকা পয়সা কেবলমাত্র ব্যক্তিগত আয়েশ আরাম ও ভোগ বিলাসিতায় উড়িয়ে দেবে, আর অন্যদিকে তার আত্মীয়স্বজন, বন্ধু বান্ধব, পাড়াপ্রতিবেীরা চরম সংকটের মধ্যে দিন যাপন করবে। এ ধরনের স্বার্থান্ধ ব্যয়বাহুল্যকে ইসলাম অপচয় বলে গন্য করেছে।
وَآتِ ذَا الْقُرْبَى حَقَّهُ وَالْمِسْكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ وَلَا تُبَذِّرْ تَبْذِيرًا () إِنَّ الْمُبَذِّرِينَ كَانُوا إِخْوَانَ الشَّيَاطِينِ وَكَانَ الشَّيْطَانُ لِرَبِّهِ كَفُورًا
“নিজের নিকটাত্মীয়কে তার অধিকার পৌঁছে দাও এবং মিসকীন ও মুসাফিরদেরকেও তাদের অধিকার দান কর। বাজে খরচ করো না। যারা অযথা ও বাজে খরচ করে তারা শয়তানের ভাই। আর শয়তান তার রব – প্রতিপালকের প্রতি অকৃতজ্ঞ—নাফরমান।” [বনী ইসরাঈল: ২৬-২৭]
ইসলাম এক্ষেত্রে কেবলমাত্র নৈতিক শিক্ষা দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, বরং এসঙ্গে কার্পণ্য ও অমিতব্যয়িতার চূড়ান্ত অবস্থা প্রতিরোধের জন্য আইনও প্রণয়ন করেছে। ধন বন্টনের ভারসাম্য বিনষ্টকারী সকল পথ রুদ্ধ করার চেষ্টা করেছে। জুয়াকে হারাম ঘোষণা করেছে। মদ্যপান ও ব্যভিচারের পথ রোধ করেছে। অনর্থক ফুর্তিবাজী, তামাশা ও কৌতুকের এমন ব্যয়বহুল অভ্যাস নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে, যেগুলোর অনিবার্য পরিণতি অর্থ ও সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। সঙ্গীতের স্বাভাবিক প্রবণতাকে এমন পর্যায়ে উপনীত হতে দেয়নি যেখানে সঙ্গীতপ্রিয়তা ও সঙ্গীতের মধ্যে ঐকান্তিক মগ্নতা মানুষের মধ্যে বহুবিধ নৈতিক ও আত্মিক ত্রুটি সৃষ্টির সাথে সাথে তার অর্থনৈতিক জীবনেও বিপর্যয় ও বিশৃংখলা সৃষ্টির কারণ হয়। সৌন্দর্য পিপাসার স্বাভাবিক প্রবণতাকেও একটি সীমার মধ্যে নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছে। বহু মূল্যবান পরিচ্ছদ, হীরাও মণি-মাণিক্যের অলংকার, সোনা ও রূপার তৈজসপত্রাদি, চিত্র ও ভাস্কর মূর্তি সম্পর্কে রাসূলে করীম (সা)-এর যে নির্দেশাবলী বিধৃত হযেছে, তার মধ্যে বহুতর কল্যাণ নিহিত রয়েছে। এসব কল্যাণের মধ্যে একট মহত্তর কল্যাণ হচ্ছে এই যে, যে ধনসম্পদ বহুসংখ্যক দরিদ্র ও অভাবী ভাইদের জীবনের নিম্নতম অপরিহার্য প্রয়োজনাদি পূর্ণ করতে পারে এবং তাদের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সংগ্রহ করে দিতে পারে, তাকে নিছক নিজের দেহ ও গৃহসজ্জায় ব্যয় করা সৌন্দর্যপ্রীতি নয়, বরং নিকৃষ্ট পর্যায়ের হৃদয়হীনতা ও স্বার্থপরতার পরিচায়ক।
মোটকথা ইসলাম একদিকে নৈতিক শিক্ষা ও অন্যদিকে সুনির্দিষ্ট আইন কানুনের মাধ্যমে মানুষকে সহজ-সরল-অনাড়ম্বর জীবন যাপনের নির্দেশ দেয়। এ অনাড়ম্বর জীবনে মানুষের প্রয়োজন ও আকাঙ্ক্ষার সীমানা কোনোক্রমেই এতটা ব্যাপকতর হয়ে পড়বে এবং নিজের স্বাভাবিক সীমার বাইরে গিয়ে তাকে অন্যের উপার্জনে ভাগ বসাতে হবে অথবা যাবতীয় অর্থসম্পদ নিজেই ভোগ করবে এবং নিজের অপারগ ভাএদর সাহায্য করবে না, যারা মধ্যম মানের কম উপার্জন করে থাকে।