দ্বিতীয় খন্ডঃ ইসলামী অর্থব্যবস্থার কতিপয় দিক
এ খণ্ডে আছে
৬ ভূমির মালিকানা
৭ সুদ
৮ যাকাতের তাৎপর্য এবং গুরুত্ব
৯ ইসলাম সামাজিক সুবিচার
১০ শ্রম, বীমা ও মূল্য নিয়ন্ত্রণ
১১ অর্থনৈতিক পুনর্ববিন্যাস ও তার মূলনীতি
ষষ্ঠ অধ্যায়ঃ ভূমির মালিকানা
[ভূমির মালিকানা সমস্যা আধুনিককালের বড় বড় সমস্যাগুলোর অন্যতম। এর উপর এতো বেশী আলোচনা, পর্যালোচনা, গবেষণা ও বিশ্লেষণ হয়েছে যে, এখন মতভেদের স্তূপের নীচে প্রকৃত সত্য চাপা পড়ে গেছে। এ স্পর্কে চিন্তা গবেষণার সঠিক সমকোণ এখন স্পর্শকাতর। হয়ে রয়েছে । একদিকে কিছু লোক সমর্থন করে পুঁজিবাদী ব্যক্তিমালানাকে। অপরদিক অন্য কিছু লোক সমর্থন করে বিপরীত প্রান্তে অবস্থিত জাতীয় মালিাকানার সমাজতান্ত্রিরক ধারণাকে। ব্যক্তি মালিকানার সমর্থকদের জমিদারী ও জায়গীরদারীর বিরোধী, তারা এ প্রথার সংস্কারের জন্যে বিকল্প হিসেবে জাতীয় মালিকানা ছাড়া অন্য কিছু লোকের পক্ষে ইসলামের মালিকানা সংক্রান্ত ধারণা অনুধাবন করাই কঠিন হ য়ে পড়েছে। এ বিষয়ে শ্রদ্ধাস্পদ গ্র্থকার বিস্তারিত লিখেছেন। আমরা তাঁর লেখা থেকে কিছু অংশ নতুনভাবে বিন্যাস করে এ গ্রন্থ সংকলিত করে দিয়েছি যাত এ বিষয়ে ইসলামের দৃষ্টিভংগি পাঠকদের সামনে পরিষ্কার হয়ে ওঠে। ইসলামের মালিকানা ব্যবস্থার উপর চিন্তা করতে হবে ইসলামী জীবন ববস্থা ও ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে, অন্য কোনো ব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে নয়।
এ প্রসংগে আরেকটি কথা সামনে রাখতে হবে। তা হলো, ব্যক্তিমালিকানা ব্যবস্থা পুঁজিবাদী ববস্থা ব্যক্তিমালিকানা ব্যবস্থাকে ব্যবহার করেছে এবং একটি বিশেষ আকৃতি দান করেছে। এক্ষেত্রে যেসব বিকৃতি ও বিপর্যয় দেখা দিয়েছে তা মূলতপুঁজিবাদী ববস্থারই অন্তর্নিহিত ভাবধারা, মৌল উদ্দেশ্য এবং রূপ-আকৃতি ও প্রাতিষ্ঠানিকতার কারণেই সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এ প্রসংগে চিন্তা করার সময় ‘ব্যক্তিমালিকানা’ এবং ‘পুঁজিবাদী ব্যবসত্থার অধীনে এর বিকৃত রূপ’-এর মাঝে সৃষ্ট সেই ভ্রান্ত জটিলতা থেকে মুক্ত থাকতে হবে, সমাজতান্ত্রিক তাত্ত্বিকরা যার মধ্যে লোকদের নিমজ্জিত কতে চায়।–[সংকলক]
১. কুরআন এবং ব্যক্তিমালিকানা
সর্বপ্রথম আমি এ মুলনীতি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, যখন কোনো প্রচলিত প্রতার ব্যাপারে মৌনতা অবলম্বন করা হয়, তখন তাকে সবসময়ই সম্মতি ও বৈধতার সমর্থক বলে ধরে নেয়া হয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ, যদি কোনো এলাকার লোকেরা জনসাধারণের চলাচলে জন্য কোনো জমির উপর দিয়ে পথ বানিয়ে নেয় এবং সেখান দিয়ে যাতয়াত নিষিদ্ধ বলে কোনো নোটিশ লাগানো না হয়, তাহলে এর অরথ হবে ঐ পথে যাতায়াতের অনুমতি আছে। এই বৈধতার জন্য নতুনভাবে কোনো ইতিবাচক অনুমতির প্রয়োজন হয় না। কারণ যে পথে যাতায়াত নিষিদ্ধ না হওয়াটাই অনুমতির অর্থ সৃষ্টি করছে। ভূমির মালিকানার ব্যাপারটাও ঠিক তাই। ইসলঅরেম পূর্বে হাজার হাজার বছর ধরে দুনিয়ায় এ প্রথা জারি ছিল। কুরআন তা নিষিদ্ধ করেনি, তা রহিত করার জন্য কোনো স্পষ্ট নির্দেশও দেয়নি, এর পরিবর্তে তা নিষিদ্ধ করেনি, তা রহিত করার জন্য কোনো ইশারা ইঙ্গিতে কোথাও এর সমালোচনাও করেনি। এর অর্থ এই যে, আল্লাহ তা‘আলা এই পুরাতন রেওয়াজকে বৈধ রেখেছেন। এই অর্থ গ্রহণ করেই মুসলমানগণ কুরআন নাযিল হবার পর থেকে আজ পর্যন্ত ভূমিকে সেভাবেই ব্যক্তিমালিকানায় রাখছে যেভাবে ইতিপূর্বে তা ব্যক্তিমালিকানয় ছিল। এখন যদি কেউ এটা নাজায়েয হওয়ার দাবী করে, তবে তাকে এর পক্ষে দলীল পেশ করতে হবে- আমার কাছে সে এর প্রমাণ পারেনা।
কিন্তু কথা শুধু এতটুকুই নয় যে, কুরআন প্রাচীন প্রথাকে রহিত করেনি, বরং আপনি যদি গভীরভাবে কুরআন অধ্যয়ন করেন, তবে জানতে পারবেন যে, কুরআন এ প্রথাকে ইবিাচকভাবেই বৈধ হিসেবে সমর্থন করেছে এবং এরই ভিত্তিতে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে হুকুম দিয়েছে। দেখুন! ভূমির সাথে মানুষের দুটি উদ্দেশ্য জড়িত; হয় ‘চাষাবাদ’ অথবা ’বসবাস’। এ দুটি উদ্দেশ্যে কুরআন জমির ব্যক্তি মালিকানা স্বীকার করে।
সূরা আন’আমে বলা হয়েছে-
كُلُوا مِنْ ثَمَرِهِ إِذَا أَثْمَرَ وَآتُوا حَقَّهُ يَوْمَ حَصَادِهِ
“এর ফলমূল থেকে খাও যখন তা ফলে এবং এর ফসল কাটার সময় তাঁর (আল্লাহর) হক আদায় কর।”
এখানে আল্লাহর হক আদায় করার অর্থ দান-খয়রাত ও যাবাক প্রদান। প্রকাশ থাকে যে, ভূমির উপর সামাজিক মালিকানা হলে যাকাত দেয়া বা নেয়ার প্রশ্নই উঠতে পারে না। এ হুকুম তো কেবল তখনই দেয়া যেতে পারে যখন কিছু লোক ভূমির মালিক হবে এবং তারা এর উৎপাদন থেকে আল্লাহর হক পৃথক করে ভূমিহীন নিঃস্বদের মধ্যে বিতরণ করে দেবে। এখন বলুন- যাকাতের নির্দেশ জারি করে কুরআন ভূমির ব্যক্তিমালিকানার প্রাচীন প্রথার প্রত্যয়ন করেছে কিনা? অন্য আর এক আয়াত থেকেও এর সমর্থন পাওয়া যায়।
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَنْفِقُوا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا كَسَبْتُمْ وَمِمَّا أَخْرَجْنَا لَكُمْ مِنَ الْأَرْضِ
“হে ঈমানদারগণ! নিজেদের পবিত্র উপার্জন থেকে খরচ কর এবং সেইসব জিনিস থেকে যা আমি জমি থেকে তোমাদের জন্য উৎপন্ন করেছি।” [বাকারা: ২৬৭]
জমির উৎপাদন থেকে খরচ করার যে হুকুম এখানে দেয়া হয়েছে সে সম্পর্কে সকলেই একমত যে, তা হলো যাকাদ ও দান-খয়রাত। যারা উৎপাদিত জিনিসের মালিক হেবে তাদেরকেই এ হুকুম পালন করতে হবে। আর এ দান তাদের জন্য করতে হবে যারা সহায় সম্পত্তির মালিক নয়। বস্তুত দানখয়রাত কার প্রাপ্য কুরআনে তাও বলে দেয়া হয়েছে।
لِلْفُقَرَاءِ الَّذِينَ أُحْصِرُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ لَا يَسْتَطِيعُونَ ضَرْبًا فِي الْأَرْضِ
“এটা অভাবগ্রস্তদের প্রাপ্য যারা আল্লাহর পথে এমনভাবে ব্যাপৃত যে, তারা দেশময় ঘোরাফেরা কতে পারে না।” [বাকারা: ২৭৩]
إِنَّمَا الصَّدَقَاتُ لِلْفُقَرَاءِ وَالْمَسَاكِينِ
“যাকাত তো কেবল নিঃস্ব, অভাবগ্রস্ত প্রাপ্য।” [তওবা: ৬০]
এখন দ্বিতীয় উদ্দেশ্য সম্পর্কে সূরা নূরে বলা হয়েছে।
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَدْخُلُوا بُيُوتًا غَيْرَ بُيُوتِكُمْ حَتَّى تَسْتَأْنِسُوا وَتُسَلِّمُوا عَلَى أَهْلِهَا …. فَإِنْ لَمْ تَجِدُوا فِيهَا أَحَدًا فَلَا تَدْخُلُوهَا حَتَّى يُؤْذَنَ لَكُمْ
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদের বাড়ী ছাড়া অন্যের বাড়ীতে বিনানুমতিতে প্রবেশ করো না। আর প্রবেশ করেই বাড়ির মালিককে সালাম করবে….. যদি সেখানে কাউকে না পাও, তবে অনুমতি না পাওয়া পর্যন্ত ভিতরে প্রবেশ করো না।” [নূর : ২৭-২৮]
এ আয়াত থেকে বুঝা গেলো যে, কুরআন মজীদ বসবাসের জন্যেও ভূমির ব্যক্তিগত দখল ও মালিকানার স্বীকৃতি দান করে িএবং মালিকের এই অধিকার স্বীকার করে যে, তার অনুমতি ছাড়া কেউ তার দখলীভুক্ত এলাকায় পা রাখতে পারবে না।
এখন হাদীস সম্পর্কে আলোচনা করা যাক। যদি সামগ্রিকভাবে এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর হাদীস এবঙ তাঁর যুগের কর্যক্রম ও খেলাফতে রাশেদার যুগের কার্যক্রম এবং নবী করীম (সা) এ নিকটবর্তীকালের ইমামগণ, কুরআন, হাদীস ও সাহাবাদের বাণীর উপরে ব্যাপক পর্যবেক্ষণ চালিয়ে দেখা যায় যে, ভূমির মালিকানার ব্যাপারে তার ইসলামের আইন কিভাবে বুঝেছিলেন, তাহলে এ সম্পর্কে মোটেই সন্দেহের অবকাশ থাকবে না যে, ইসলাম শুধু ব্যক্তিমালিকানাই জায়েয রাখে না, বরং ইসলাম ব্যক্তিমালিকানার কোনো নির্দিষ্ট সীমাও নির্ধারণ করে না। এবং জমির মালিককে এই অধিকার দেয় যে, যে ভূমি কোনো ব্যক্ত নিজে চাষাবাদ করতে পারবে না, তা অপরকে মুজারায়ায় (ভাগচাষে) অথবা কিরায়ায় (নগদ অর্থের বিনিময়ে) চাষাবাদ করতে দিতে পারবে। এখন আসুন এ বিষয়ে আমরা ইসলামী আইনের মুল উৎস সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করে দেখি।
২. রাসূল (সা) ও খেলাফতে রাশেদার যুগের দৃষ্টান্ত
রাসূলে করীম (সা) এবং খেলাফতের রাশেদার যুগে ভুমি ব্যবস্থাপনা কোন পদ্ধতিতে করা হয়েছিল তা বুঝার জন্য মনে রাখতে হবে যে, শরীয়তের দৃষ্টিতে ইসলামী রাষ্ট্রের কর্তৃত্বাধীনে আসা ভূমি চারটি বৃহৎ ভাগে বিভক্ত ছিলঃ
(১) যে ভূমির মালিক ইসলাম কবুল করেছিল।
(২) যে ভূমির মালকি নিজেদের ধর্মেই বহাল থেকে যায়, কিন্তু একটি চুক্তির মাধ্যমে নিজেকে ইসলামী রাষ্ট্রের অধীন করে দেয়।
(৩) যে ভূমির মালিক যুদ্ধে পরাজিত হয়েছে।
(৪) যে ভূমি কারো মালিকানায় ছিল না।
এসব ব্যাপারে রাসূল (সা) ও তাঁর খলিপাগণ কি কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করেছেন তা আমরা পৃথক পৃথকভাবে বর্ণনা করবো।
প্রথম প্রকারে ভূমির মালিকানা বিধান
প্রথম প্রকারের ভূমির মালিকানার ব্যাপারে রাসূলে করীম (সা) যে নীতিমালা অনুসরণ করেছেন তা হলোঃ
(আরবী*************)
“মানুষ ইসলাম গ্রহণ করার সাথে সাথে নিজের জীবন ও সম্পদ নিরাপদ করে নেয়।”
(আরবী*******)
“ইসলাম গ্রহণ করার সময় মানুষ যে সম্পদের মালিক ছিল তা তারই মালিকানায় থাকবে।”
এ নীতিমালা স্থাবর ও অস্থাবর সব সম্পদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হত। অকৃষিজ ও কৃষিজ উভয় জমির বেলায় একইরূপ নীতি অনুসরণ করা হতহ। হাদীস ও আছারের গোটা সংগ্রহ এ কথার সাক্ষী যে, রাসূলুল্লাহ (সা) আরবের কোথাও ইসলাম গ্রহণ কারীদের সম্পদের মালিকানার ব্যাপারে কোনো আপত্তি তোলেননি। ইসলাম গ্রহণ করার পূর্বে যে লোক যে জমির মালিক ছিল, ইসলাম ছিল, ইসলাম গ্রহণ কারার পর তাকে সেই জমির মালিক রাখা হয়েছে।
এ ব্যাপারে ইমাম আবু ইউসুফ (রা) ইসলামী আইনের ব্যাখ্যা এভাবে দিয়েছেনঃ
“যেসব লোক ইসলাম গ্রহণ করবে তাদের রক্ত (হত্যা করা) হারাম। ইসলাম গ্রহণ করার সময় তাঁরা যে সম্পদরে মালিক ছিল তা তাদেরই থাকবে। এভাবে তাদের ভূমি তাদের মালিকানায়ই থাকবে। আর এ ভূমিকে ‘উশরী’ ভূমি বলে অভিহিত করা হবে। এর নজীর হলে মদীনা। মদীনাবাসী রাসূলে করীম (সা)-এ হাতে ইসলাম কবুল করেন এবং তারা তাদের ভূমিরও মালিক থাকেন। এ ভূমির উপর ‘উশর’ ধার্য করা হয়েছিল। তায়েফ ও বাহরাইনের লোকদের ব্যাপারেও এই ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হয়েছে। যেসব বেদুঈন ইসলাম কবুল করেছে তাদেরকেও নিজ নিজ কূপ ও এলাকার মালিক হিসেবে মেনে নেয়া হয়েছে। তাদের জমি ‘উশরী’। তা থেকে তাদেরকে বেদখল করা যাবে না। এ জমিকে তারা বিক্রি করতে পারবে এবং তাদের উত্তরাধিকারীগণ এর সকল অধিকার ভোগ করতে পারবে। অনুরূপভাবে কোনো এলাকার অধিবাসীগণ ইসলাম কবুল করলে তারা তাদের সম্পদের মালিক থাকবে।” (কিতাবুল খারাজ, পৃ. ৩৫)
ইসলামের অর্থনীতি বিষয়ক আইনের আরেক বিশেষজ্ঞ ইমাম আবু ওবায়েদ আল কাসেম ইবনে সাল্লাম লিখেনঃ
“হযরত রাসূলে করীম (সা) এবং তাঁর খলীফাদের নিকট হতে য ‘আছার’ আমাদের পর্যন্ত পৌছেছে, তা ভূমির ব্যাপারে তিন ধরনের বিধান বহন করে এনেছে। এক প্রকার বিধান হলো, ওইসব ভূমি সম্পর্কে যার মালিকগণ ইসলাম কবুল করে। ইসলাম গ্রহণের সময় তারা যে ভূমির মালিক ছিল তা তাদেরই মালিকানায় থাকবে। এসব ভূমিকে ‘উশরী’ ভূমি বলে অভিহিত করা হবে। ‘উশর’ ছাড়া এসব ভূমির উপর আর কোনোরূপ কর আরোপিত হবে না।” [কিতাবুল আমওয়অল, পৃঃ ৫৫]
সামনে এগিয়ে তিনি আরও লিখেছেনঃ
“যে এলাকার অধিবাসীরা ইসলাম গ্রহণ করেছে তারা নিজেদের জমির মালিক থাকবে। যেমন মদীনা, তায়েফ, ইয়েমেন ও বাহরাইন। এভাবে মক্কাও, যদি মক্কা অস্ত্রবলে জয় করা হয়েছে, কিন্তু রাসূলে করীম (সা) মক্কাবাসীদের প্রতি দয়া করেছেন এবং তাদের জীবনের উপর হস্তক্ষেপ করেননি এবং তাদের সম্পদকে গনীমতের মাল হিসেবে ঘোষণা দেননি। অতএব ধনসম্পদ যখন তাদের মালিকানায় ছেড়ে দেয়া হলো তখন তারা পরে মুসলমান হয়ে গেলো। তাদের মালিকানার ব্যাপারে সেই হুকুমই থাকলো যা অন্যান্য ইসলাম গ্রহণকারীদের মালিকানা সম্পর্কেত ছিল। আর তাদের জমি ‘উশরী’ জমি হিসেবে পরিগণিত হলো।” (ঐ, পৃষ্ঠা ৫১২)
আল্লামা ইবনুল কাইয়েম (র) যাদুল মাআদে লিখেছেন:
“রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নীতি এই ছিল যে, ইসলাম গ্রহণকালে যে ব্যক্তি যে সম্পদের মালিক ছিল তা তারই মালিকানায় থাকবে। ইসলাম গ্রহণের পূর্বে তা কিভাবে তার দখলে এসেছে তার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করা হয়নি, বরং তা তার হাতে সেভাবেই থাকতে দেয়া হয়েছে যেভাবে আগে থেকে চলে আসছিল।” [২য় খণ্ড, পৃঃ ৯৬]
এটা এমন এক মৌলনীতি যাতে ব্যতিক্রমের একটি উদাহরণও রাসূলুল্লাহ (সা) ও খেলাফতে রাশেদার যুগে পাওয়া যায় না। ইসলাম এর অনুসারীদের অর্থনৈতিক জীবনে যেসব সংশোধনই জারি করেছে তা করেছে ভবিষ্যতের জন্য। কিন্তু আগে থেকেই যে মালিকানা লোকদের দখলে ছিল তা বিলোপ করা হয়নি।
দ্বিতীয় প্রকারের ভূমির মালিকানা বিধান
দ্বিতীয় প্রকারের লোক ছিল তারা, যারা ইসলাম গ্রহণ করেনি; কিন্তু সন্ধির মাধ্যমে ইসলামী রাষ্ট্রের অনুগত হয়ে বসবাস করাকে মেনে নিয়েছে। এদের ব্যাপাপারে রাসূলুল্লাহ (সা) যে নীতি নির্ধারণ করেন তা এই যে, যেসব শর্তের ভিত্তিতে তাদের সাথে সন্ধি হয়েছে কোনোরূপ রদবদল ছাড়াই তা পূর্ণ করতে হবে। রাসূলে করীম (সা) ইরশাদ করেছেন:
(আরবী******************)
যদি কোনো জাতির সাথে তোমাদের যুদ্ধ বাধে এবং তারা ধন সম্পদের বিনিময়ে তোমাদের নিকট তাদের নিজের ও সন্তনের জীবন রক্ষা করতে তৈরী হয়ে যায় এবং তোমরা তাদের সাথে সন্ধি কর, তাহলে সন্ধিচুক্তির চেয়ে বেশী কিছু তোমরা তাদের নিকট আদায় করো না। কারণ তা তোমাদের জন্য জাযেয হবে না।”
(আরবী***************)
“সাবধান! যে ব্যক্তি কোনো চুক্তিদ্ধ যিম্মির যুল্ম করবে অথবা চুক্তি অনুসারে তার যে অধিকার আছে তা ক্ষুণ্ণ করবে, অথবা তার উপর তার সামর্থ্যের বেশী বোঝা আরোপ করবে অথবা সম্মাতি ছাড়া তার থেকে কোনো বস্তু আদায় করবে- কিয়ামতের দিন আমি স্বয়ং তার বিরুদ্ধে ফরিয়াত জানাবো।” [আবু দাউদ]
এ নীতিমালা অনুযায়ী নাজরান, আয়লা, আযরুআত, হিজনসহ অন্যান্য যেসব এলাকা ও গোত্রের সাথে সন্ধি করা হয়েছিল রাসূলুল্লাহ (সা) সেসব এলাকা ও গোত্রের জায়গা জমি, ধসম্পদ, শিল্প কারখানা, ব্যবসা বাণিজ্য ইত্যাদির উপর এলাকাবাসী গোত্রের লোকদের মালিকানা পূর্ববৎ বহাল রাখেন এবং তাদের নিকট থেকে চুক্তি মোতাবিক শুধু জিযিয়া ও খাজনা আদায় করেই ক্ষান্ত হন। খেলাফকে রাশেদাও এ নীতির উপরই আমল করেছেন। ইরাক, সিরিয়া, আল জাযিরা, মিসল, আরমেনিয়া, মোটকথা, যেখানে যেখানে শহর বা জনপদের লোকেরা সন্ধির ভিত্তিতে নিজেদেরকে ইসলামী রাষ্ট্রের অধীন করে দিয়েছে, তাদের যথারীতি তাদের দখলেই রাখা হয়েছে এবং যে মালের বিনিময়ে সন্ধি হয়েছে তা ব্যতীত তাদের কাছ থেকে আর কিছুই আদায় করা হয়নি। হযরত উমর (রা)-এর সময়ে সার্বিক কল্যাণ চিন্তা করে নাজরানের অধিবাসীসেরকে আরবের অভ্যন্তর থেকে সিরিয়া ও ইরাকে বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু তাদের যার কাছে নাজরানের যে পরিমাণ কৃষিজ ও বসবাসযোগ্য ভূমি ছিল তার বিনিময়ে অন্যত্র শুধু ওই পরিমাণ ভূমিই তাদেরকে দেয়া হয়নি, বরং হযরত উমরা (রা) সিরিয়া ও ইরাকের গভর্ণরদের সাধারণ নির্দেশ লিখে পাঠান যে, “তারা যে যে এলাকায় গিয়ে বসতি স্থাপন করবে সেখানে (আরবী********) তাদেরকে প্রশস্ত মানে উর্বব জমি দিয়ে দাও।” [কিতাবুল আমওয়াল, আবু উবায়েত, পৃ. ১৮৯]
এই মূলনীতির ক্ষেত্রেও রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সময়ে ও খেলাফতে রাশেদার কালেও কোনো ব্যতিক্রম করার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না। ইসলামের ফিকাহবিদদের এটাও সর্বসম্মত রায়। ইমাম আবু ইউসুফ (রা) তাঁর কিতাবুল খারাজে’ এটাকে আইনের একটি দফা হিসেবে এভাবে বিধৃত করেছেন:
“অমুসলিমদের মধ্যে যে জাতির সাথে ইমামের এ শর্তে সন্ধি স্থাপিত হয় যে, তারা ইসলামী রাষ্ট্রের অনুগত থাকবে এবং কর প্রদান করবে তাহলে তারা যিম্মী। তাদের ভূমি খারাজের (কর) অন্তর্ভুক্ত ভূমি। যে শর্তে সন্ধি হয়েছে তাদের নিকট হতে ঠিক তাই নেয়া হবে।তাদের সাথে অঙ্গীকার পুরা করতে হবে। শর্তের অতিরিক্ত কোনো কিছু করা যাবে না।” [পৃ. ৩৫]
তৃতীয় প্রকারের ভূমির মালিকানা বিধান
যেসব লোক শেষ সময় পর্যন্ত ইসলামী রাষ্ট্রের সাথে যুদ্ধ করবে এবং অস্ত্রের মুখে পরাজিত হবে তাদের সম্পদের ব্যাপারে রাসূলে করীম (সা) ও খেলাফতে রাশেদার সময়ে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন কর্মপন্থা গৃহীত হয়েছে:
এক- প্রথম কর্মপন্থা নবী করীম (সা) মক্কা বিজয়কালে গ্রহণ করেছেন। মক্কা বিজয়ের পর (আরবী*******) ( আজ তোমাদের উপর কোনোরূপ প্রতিশোধ য়ো হবে না)। এ মর্মে সাধারণ ক্ষমা ঘোসণার মাধ্যমে বিজিতদের জানমালের পূর্ণ যথারীতি মালিক থেকে যায়। আর ইসলাম গ্রহণ করার পর তাদের এসব জমি ‘উশরী ভূমি’ হিসেবে পরিগণিত হয়।
দুই- দ্বিতীয় কর্মপন্থা খায়বারে অবলম্বন করা হয়েছিল। এক্ষেত্রে বিজিত ভূমির সাবেক মালিকদের মালিকানা বিলুপ্ত করা হয়েছে। অতঃপর এর এক অংশ নিয়ে নেয়া হয়েছে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলে (সা্) জন্য। বাকী জমি খায়বারের যুদ্ধে যারা ইসলামী সেনাবাহিনীর সদস্য ছিলেন তাদের মধ্যে বন্টন করা হয়েছে। এ বন্টিত ভূমি যাদের ভাগে পড়ে তারাই এর মালিক গণ্য হন। এ ভূমিতে ‘উশর’ ধার্য হয়। [কিতাবুল আমওয়াল, আবু উবায়েদ, পৃঃ ৫১৩]
তিন- তৃতীয় কর্মপন্থা সিরিয়া ও ইরাক বিজয়ের পর হযরত উমর ফারুক (রা) অবলম্বন করেছিলেন। তিনি বিজিত এলাকার জমি বিজয়ী সৈনিকদের মধ্যে বন্টন করার পরিবর্তে এসব ভূমিকে মুসলমানের সামষ্টিক মালিকানাভুক্তি করেন; আর এর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব মুসলমানদের তরফ থেকে প্রতিনিধি হিসেবে নিজের হাতে নিয়ে নেন। তিনি এসব এলাকার অধিবাসীদেরকে আগের মত তাদের ভূমির মালিক হিসেবে বহাল রাখেন। তাদের যিম্মী ঘোষণা করে তাদের জিযিয়া ও খারাজ (কর) ধার্য করেন এবং জিযিয়া ও খারাজ সাধারণ মুসলমানদের জনকল্যাণমুখী কাজে ব্যয়ের ঘোষণা দেন। কেননা, মৌলিক দৃষ্টিকোণ থেকে তারাই ছিল বিজিত এলাকসমূহের মালিক।
এ শেষ পদ্ধতিতে দৃশ্যত ‘সমষ্টিগত মালিকানা’ ধারণার ইংগিত পাওয়া যায়। কিন্তু গোটা ব্যাপারটা যেভাবে চূড়ান্ত হয়েছিল, তার বিস্তারিত দিকের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে পরিষ্কার বুঝা যায় যে, এ সমষ্টিগত মালিকানার সাথে সমাজতান্ত্রিক মতবাদের দূরতম সম্পর্কও নেই। আসল কথা হলো মিসর, সিরিয়া ও ইরাকের বিরাট এলাকা বিজিত হওয়ার পর হযরত যুবাযের (রা) ও হযরত বিলাল (রা) এবং তাঁদের সমমনা ব্যক্তিগণ গোটা এলাকার সমস্ত ভূমি ও বিষয় সম্পত্তি খায়বারের ভূমির মত বিজয়ী সৈনিকদের মধ্যে বন্টন করার জন্য হযরত উমর (রা) এর নিকট দাবী পেশ করেন। হযরত উমর (রা) তাদের এ দাবী মঞ্জুর করেননি। হযরত আলী (রা), হযরত উসমান (রা), হযরত তালহা (রা) ও হযরত মু’আয বিন জাবাল (রা)-এর মত প্রবীন সাহাবীগণ এ ব্যাপারে হযরত উমর (রা) কে সমর্থন করেন। এ দাবী মঞ্জুর না করার কারণ উল্লেখিত সাহাবীগণের বক্তব্য হতে বুঝা যায়। হযরত মু‘আজ (রা) বলেন:
“আপনি যদি তা বন্টন করে দেন তাহলে আল্লাহর কসম তার এমন ফল হবে যা আপনি কখনও পসন্দ করবেন না। বিরাট বিরাট ও মূল্যবান ভূমিখণ্ড সৈনিকদের মধ্যে বন্টিত হয়ে যাবে। এরপর এসব সৈনিকদের মৃত্যুর পর কারো ওয়ারিস হবে কোনো নারী এং কারো ওয়ারিস হবে কোনো শিশু। পরে যারা ইসলামী রাষ্ট্রের হাতে অবশিষ্ট থাকবে না। অতএব আপনি এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করুন যাতে আজকের লোকদের জন্যও সুযোগ থাকে এবং ভবিষ্যতের লোকদের জন্যও সুযোগ থাকে।”
হযরত আলী (রা) বলেন:
“দেশের কৃষিভূমি তার স্বঅবস্থায় থাকতে দিন যাতে তা সকল মুসলমানের অর্থনৈতক শক্তির উৎস হতে পারে।”
হযরত উমর (লা) বলেন:
“এটা কিভাবে হতে পারে যে, আমি তোমাদের মধ্যে জমি ভাগ করে দেবো, আর পরর্তী বংশধরগণের জন্য এতে কোনো অংশ থাকবে না।” অবশেষে ভবিষ্যৎ বংশধরগণের জন্য কি থাকবে?…… তোমরা কি চাও, ভবিষ্যত বংশধরদর জন্য কিছুই না থাকুক? আর আমার আরো আশংকা হচ্ছে যে, আমি যদি তোমাদের মধ্যে ভাগ করে দিই তাহলে তোমরা পানি নিয়ে পরস্পর বিবাদের লিপ্ত হবে।”
এর ভিত্তিতে যে ফয়সালা করা হয়েছিল তা ছিল এই যে, জমি তার সাবেক মালিকদের হাতেই থাকতি দিতে হবে, তাদের যিম্মী ঘোষণা করে তাদের উপর জিযিয়া ও খারায (কর) ধার্য করতে হবে এবং খারাজ মুসলমানদের সাধারণ কল্যাণের কাজে খরচ করতে হবে। এ ফয়সালার খবর হযরত উমর (রা) তাঁর ইরাকের গভর্ণর হযরত সা’দ বিন আবু ওয়াক্কাস (রা)- এর নিকট যে ভাষায় পাঠিয়েছিলেন তা নীচে উল্লেখ করা হলো: (আরবী*****************)
“যুদ্ধ চলাকালে গনীমত হিসেবে সৈনিকরা যেসব অস্থাবর সম্পদ জমা করেছে এবং সৈনিকদের মধ্যে জমা হয়েছে, এসব মাল তুমি যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সৈনিকদের মধ্যে ভাগ করে দাও। কিন্তু নদী, নালা, জায়গা জমি যেসব লোকের কাছেই থাকতে দাও- যারা তাতে চাষাবাদ করত। তাহলে মুসলমানদের বেতনের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। নতুবা যদি এসবও আমরা বর্তমান লোকদের মধ্যে বন্টন করে দিই, তাহলে পরবর্তী বংশধরদের জন্য আর কিছুই থাকবে না। [গোটা আলোচনার জন্য দেখুন কিতাবুল খারাজ পৃঃ ২০-২১ এবং কিতাবুল আমওয়াল, পৃঃ ৫৭-৬৩।]
এ নতুন বন্দোবস্ত দানের বুনিয়াদী মতবাদ তো এই ছিলো যে, ভূমির মালিক হবে সকল মুসলমান এবং সাবেক মালিক আসল অবস্থঅন হবে কৃষক হিসেবে। আর ইসলামী রাষ্ট্র মুসলমানদের প্রতিনিধি হিসেবে তাদের সাথে লেনদেন করবে। [এই মতবাদরে ব্যাখ্যা নিম্নোক্ত ঘটনা থেকে পাওয়া যায় যে, একবার উতবা বিন ফারকাদ (রা) হযরত উমার (রা) এর সাথে সাক্ষাত করতে এস বললেন, আমি ফোরাতের কিনারে এক খণ্ড জমি খরিদ করেছি। হযরত উমার (রা) জিজ্ঞেস করলেন, কার কাছ থেকে? উতবা (রা) বললেন, এর মালিকের কাছ থেকে। উমার (রা) তখন মুহাজির ও আনসারদের দিকে ফিরে বললেন, এর মালিক তো এখানে বসা আছেন। (কিতাবুল আমওয়াল, পৃ. ৭৪)। হযরত আলী (লা)-এর একটি কথাও এই মত সমর্থন করে। এরাকের পুরানো জমিদারদের একজন এসে তাঁর সামনে ইসলাম কবুল করার ঘোষণা দিলে তিনি বললেন, এখন তোমার উপর থেকে জিযিয়া বিলুপ্ত হয়ে গেলো। কিন্তু তোমার জমি খারাজী জমি হিসেবেই থাকবে। কেননা তা আমাদের। (কিতাবুল আমওয়াল, পৃঃ ৮০)। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে যিম্মী ঘোষণার পর সাবেক মালিকদের যে অধিকার দেয়া হয়েছিল তা মালিকানার অধিকার থেকে কিছুমাত্র ভিন্ন ছিল না। সেসব ভূমি তাদের দখলে থাকবে যা আগে তাদের দখলে ছিল। এদের উপর মুসলমান বা রাষ্ট্রের তরফ থেকে খারাজ (কর) ছাড়া আর কিছু ধার্য করা হয়নি। জমির উপর তাদের বেচা-কেনা, বন্ধক দেয়া এবং ওয়ারিশী স্বত্বের সমস্ত অধিকার আগের মতই বহাল ছিল। এ ব্যাপারটিকে ইমাম আবু ইউসুফ (রা) একটি আইনের ধারাকে আকারে এভাবে বলেছেন:
“যে দেশ রাষ্ট্রপ্রধান অস্ত্রবলে জয় করেন সেই এলাকার ব্যাপারে তাঁর পূর্ণ এখতিয়ার রয়েছে যে, তিনি ইচ্ছা করলে তা বিজয়ী সৈনিকদের মধ্যে বন্টন করে দিতে পারেন। এ অবস্থায় তা ‘উশরী’ জমি হিসেবে গণ্য হবে। আর যদি তিনি বন্টন করা সমীচীন মনে না করেন এবং জমি এর পূর্বতন মালিকদের হাতে রেখে দেয়াই ভল মনে করেন, যেমন হযরত উমর (রা) ইরাকে করেছেন, তাহলে তিনি তা-ও করতে পারেন। এ অবস্থায় তা হবে ‘খারাজী’ জমি। খারাজ আরোপিত হওয়ার পর তা দখলভোগীদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেবার অধিকার কারো থাকবে না, এর মালিক তারাই হবে। উত্তরাধিকার সূত্রে তারা একে অপরের কাছে হস্তান্তর করতে পারবে, পারবে বেচাকেনা করতে; তাদের উপর খারাজ ধার্য করা হবে এবং তাদের সামর্থ্যের অতিরিক্ত বোঝা তাদের উপর চাপানো যাবে ন।” (কতাবুল খারাজ, পৃঃ ৩৫, ৩৬)
চতুর্থ প্রকারের ভূমির মালিকানার বিধান
উপরে বর্ণিত তিনটি শ্রেণী তো ছিল সেইসব ভূমি সম্পর্কে যা প্রথম থেকেই বিভিন্ন শ্রেণীর লোকের মালিকানায় ছিল। আলোচনায় দেখা যায় যে, ইসলামী ব্যবস্থা কায়েম হওয়ার পর অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব ভূমির সাবেক মালিকানাই স্বীকার করে নেয়া হয়েছে; আর কোনো কোনো ক্ষেত্রে এতে কিছুটা রদবদল করা হয়েছে। কিন্তু একথা স্পষ্ট যে, এ রদবদল কেবল মালিকানার ব্যাপারেই করা হয়েছে, মালিকানা ব্যবস্থার মধ্যে হবে যে, মালিকানাহীন জমির ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (সা) ও তাঁর খলীফাগণ কি কর্মপন্থা অবলম্বন করেছেন।
দেখা যায় যে, এই শ্রেণীর ভূমি দুটি বড় ভাগে বিভক্ত ছিলঃ
এক- ‘মাওয়অত’ অর্থাৎ অনাবাদী ভূমি। ‘আদিউল আবাদ’ (যে জমির মালিক মরে গেছে) বা যার কোনো মালিকই ছিল না, অথবা যে ভূমি ঝোপ ধাড়, কাদা মাটির ফাঁক এবং প্লাবনের নীচে পড়ে গেছে তা-ই হচ্ছে মাওয়াত।
দুই- ‘খালসা’ ভূমি খাস জমি। যার উপর সরকারী মালিকান ঘোষণা করা হয়েছিল। এর মধ্যে কয়েক প্রকার ভূমি শামিল; প্রথমত, যে ভূমির মালিকগণ স্বেচ্ছায় মালিকানা স্বত্ব ত্যাগ ক’রে তা রাষ্ট্রের অধীন ছেড়ে দিয়েছে যাতে রাষ্ট্র যেভাবে ইচ্ছা তা ব্যবহার করতে পারে।[ইবনে আব্বাস (রা)-এর বর্ণনায় আছে—রাসূলে করীম (সা) মদীনায় আগমন করলে আনসারগণ যেসব জমিতে সেচ ব্যবস্থার মাধ্যমে পানি পৌঁছানের যেতো না, সেসব জমি রাসূল (রা)- কে দিয়ে দিলেন যেন তিনি যেভাবে খুশী তা ব্যবহার করেন। (কিতাবুল আমওয়াল, পৃঃ ২৮২)।] দ্বিতীয়ত, ইসলামী রাষ্ট্র যে জমি থেকে মালিককে বেদখল করে খাস জমি ঘোসষণা করেছে। যেমন মদীনার চার পাশে বনি নজিরের জমি। তৃতীয়ত, বিজিত এলাকর যে জমি খাস জমি হিসেবে ঘোষিত হয়েছে। যেমন ইরাকে পারস্য সম্রাট ও তার পরিবারের অধিকারভুক্ত ভূমি অথা যেসব জমির মালিক যুদ্ধে মারা গেছে বা পালিয়ে গেছে; হযরত উমর (রা) এ ধরনের জমিকে ‘খালিসা’ (খাস জমি) ঘোষণা করেছেন।[ইমাম আবু ইউসুফ ও আবু উবায়েদ এই শ্রেণীল ভূমি দশ প্রকার বলে নিজ নিজ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন।]
এ দু’শ্রেণীর জমির মালিকানা বিধান সম্পর্কে আমি ভিন্ন ভিন্নভাবে বর্ণনা করবো।
চাষাবাদের ভিত্তিতে মালিকানার অধিকার
মাওয়াত-এর ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (সা) প্রাচীন রীতিই বহাল রাখন যার ভিত্তিতে দুনিয়ার জমির মালিকানার সূচনা হয়েছে। মানুষ যখন এ ভূমন্ডলে বসবাস শুরু করে তখন থেকেই এ নিয়ম চলে আসছে যে, যেখানে যে আছে, সে জায়গা তার। আর, কোনো জমি যে ব্যক্তি যে কোনো প্রকারের ব্যবহারের উপযোগী করেছে তা কাজে লাগাবার অধকার তারই বেশল। প্রকৃতরি সকল অবদানের উপর মানুষের মালিকানার অধিকাররের এটাই হলো বুনিয়াদী নীতি। রাসূলে করীম (সা) বিভিন্ন সময়ে নিজের বক্তব্যের মাধ্যমে এ কথারই সমর্থন করেছেন। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে: (আরবী***************)
“হযরত আয়েশা (রা) বলেলেছেন, রাসূলে করীম (সা) ইরশাদ করেছেন: যে ব্যক্তি মালিকানাহীন কোনো জমি আবাদযোগ্য করে, সে ব্যক্তিই সে জায়গার হকদার। উরওয়া বিন যাবায়ের বলেছেন, হযরত উমরা (রা) তাঁর খেলাফতকালে এর উপরই আমল করেছেন।” (বুখারী, আহমাদ, নাসাঈ)
(আরবী**********)
“জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা) বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেছন : যে ব্যক্তি মৃত (অনাবাদী) ভূমি জীবিত (আবাদযোগ্য) করেছে, সে জমি তার।” (তিরমিযী, নাসাঈ, আহমাদ, ইবনে হ্বিাবন)
(আরবী****************)
“সামুরা বিন জুনদুব (রা) হতে বর্ণিত। রাসূলে করীম (রা) ইরশাদ করেছন: যে ব্যক্তি কোনো অনাবাদী ভূমির উপর নিজের সীমারেখা টেনে নেয় সে ভূমি তার।” (আবু দাউদ)।
(আরবী*******)
“আসমার বিন মাদুররিস (রা) হতে বর্ণিত। নবী করীম (রা) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি এমন কোনো কূপ পায় যা এর আগে কোনো মুসলিমের দখলে আসেনি, সে কূপ তার।” (আবু দাউদ)।
(আরবী****************)
“উরওয়া বিন যুবায়ের (তাবেঈ) বলেছেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, রাসূলুল্লাহ (সা) ঘোষণা দিয়েছেন, জমি আল্লাহর, আর বান্দারাও আল্লাহর। যে ব্যক্তি কোনো পতিত জমি আবাদ করে, সে ব্যক্তিই সে জমির হকদার। যেসব প্রবীণ ব্যক্তির মাধ্যমে আমাদের কাছে পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের কথা এসে পৌঁছেছে, তাদের মাধ্যমেই (অর্থাৎ সাহাবায়ে কিরাম) রাসূল (সা)-এর নিকট হতে এ নীতি আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছে।” (আবু দাউদ)।
এই প্রকৃতির নীতিমালা পুনর্বহাল করার সাথে সাথে রাসূলুল্লাহ (সা) এর জন্য দুটি বিধান নির্দিষ্ট করেনছেন। একটি হলো, যে ব্যক্তি অন্যের মালিকানার জমি চাষাবাদ করে, এ চাষাবাদের কারণে সে জমির মালিকানার হকদার বলে দাবী করতে পারবে না। দ্বিতীয় হলো, যে ব্যক্তি অযথা কোনো ভূমির চৌহদ্দি টেনে বা নিশান টাঙ্গিয়ে ভূমিকে নিজের মালিকানায় আটকিয়ে রাখে, এতে কোনো প্রকার চাষাবাদ করে না, তিন বছর পর তার মালিকানার অধিকার বাতিল হয়ে যাবে। প্রথম বিধানকে তিনি এভাবে বর্ণনা করেছেন: (আরবী*********)
“হযরত সাঈদ বিন যায়েদ (রা) বলেছেন, রাসূল করীম (সা) ইরশাদ করেছেন: যে ব্যক্তি অনাবাদী জমি জীবিত (আবাদযোগ্য ) করেছে সে জমি তার। আর অপরের জমিতে নাজায়েয পদ্ধতি আবাদকারীর জন্য কোনো কিছু নেই।” (আবু দাউদ, তিরমিযী, আহমাদ)
দ্বিতীয় বিধানের উৎস হলো নিম্নবর্ণিত হাদীস: (আরবী************************)
“তাউস তাবেঈ বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা) এরশাদ করেছেন: মালিকবিহীন পতিত জমি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলৈর (সা), এরপর তা তোমাদের জন্য। অতএব যে কেউ পতিত জমি আবাদযোগ্য করবে, তা তার। তিন বছর পর্যন্ত অনাবাদী ফেলে রাখার পর মালিকের এতে কোনো হক থাকে না।” (আবু ইউসুফ, কিতাবুল খারাজ)।
(আরবী*******************)
“হযরত সালেম বিন আবদুল্লাহ (রা)বর্ণনা করেছেন, হযরত উমর (রা) মিম্বারে উঠে এক ভাষণে বলেছেন: যে ব্যক্তি কোনো পতিত অনাবাদী জমিকে চাষাবাদযোগ্য করে সে জমি তার। কিন্তু অনাহুতভাবে যারা জমি আটকে রাখে, তিন বছর পর এতে তার কোনো অধিকার থাকবে না। সে সময় কেউ কেউ কোনো চাষাবাদ না করে এমনিতেই জমি আটকিয়ে রাখতো; এ কারণে এ ঘোষণা দেয়া প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল।” (আবু ইউসুফ, কিতাবুল খারাজ)
এ ব্যাপারে ফকীহগণ একমত। মতভেদ যদি থাকে তবে আছে এ ব্যাপারে যে, আবাদযোগ্য করার দ্বারাই কি কোনো ব্যক্তি পতিত মালিক হয়ে যায়? অথবা মালিকানা প্রমাণের জন্য সরকার থেকে অনুমতি প্রয়োজন? এ ব্যাপারে ইমাম আবু (র) রাষ্ট্রের অনুমতি প্রয়োজন মনে করেছেন। কিন্তু ইমাম আবু ইউসুফ (র). ইমাম মুহাম্মদ (র), ইমাম শাফেঈ (র) ও ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (র) প্রমুখের মত হলো যে, এ সম্পর্কে হাদীস একেবারেই সুস্পষ্ট। তাই আবাদকারীর মালিকানার অধিকারের জন্য রাষ্ট্রের নিকট হতে অনুমতি নেবার প্রয়োজন নেই। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দেয়া হক অনুযায়ী আবাদকারী এ জমির মালিক হয়ে যাবে। এরপর ব্যাপারটা যখন রাষ্ট্রের নিকট পেশ হবে তখন এ কাজ হবে আবাদকারীর হককে মেনে নেয়া। আর যদি এ নিয়ে কলহ বাধে তাহলে রাষ্ট্র তার হকই বলবৎ রাখবে। ইমাম মালিক (র) জনবসতির নিকটবর্তী জমি ও দূরবর্তী অনাবাদী জমির মধ্যে পার্থক্য করেছেন। তাঁর মতে প্রথম প্রকারের জমি এ নির্দেশের আওতাধীন নয়। আর দ্বিতীয় প্রকারের জমির জন্য অনুমোদন শর্ত নয়। শুধু আবাদ করার মাধ্যমেই আবাদকারী এ মালিক হয়ে যাবে।
এ ব্যাপারে হযরত উমর (রা) ও হযরত উমর বিন আবদুল আযীয (র)-এর কর্মনীত এই ছিল : “যদি কোনো ব্যক্তি কোনো জমি পরিত্যক্ত মনে করে আবাদ করে নেয় এবং এর পর কেউ এসে এর মালিকানা দাবী করে বসে, তবে শেষোক্ত ব্যক্তিকে এখতিয়ার দেয়া হবে যে, হয় সে আবাদ করার জন্য প্রথমোক্ত ব্যক্তিকে পারিশ্রমিক দিয়ে জমি নিজে নিয়ে নেবে, অথবা জমির মূল্য নিয়ে মালিকানার অধিকার ব্যক্তির নিকট হস্তান্তর করবে। [বিস্তারিত অবগত হবার জন্য িইমাম আবু ইউসুফের কিতাবুল খারাজ’ পৃঃ ৩৬ ৩৭এবং আবু উবায়েদের ‘কিতাবুল আমওয়াল’ পৃঃ ২৮৫-২৮৯ দেখুন। কানযুল উম্মালে শায়খ আলী মোত্তাকী এ বিষয়ের উপর বর্ণিত সব হাদীস এক স্থানে জমা করেছেন। যারা এ বিষয়ের বিস্তারিত বর্ণনা অবগত হতে চান, উল্লিখিত কিতাবের ২য় খন্ড এহইয়ায়ে মাওয়াত অধ্যায় দেখে নিন।]
সরকার কর্তৃক দানকৃত জমি
অতপর ‘মাওয়াত’ (পতিত) ও খালিসা (খাস) উভয় প্রকারের ভূমি থেকে প্রচুর পরিমাণ জমি রাসূলে করীম (সা) নিজে মানুষকে দান করেছেন এবং তাঁর পর খোলাফায়ে রাশেদীনও হামো এ ধরনের দান করতেন। এসব দানের অনেক দৃষ্টান্ত হাদীসের গ্রন্থাবলীতে বিদ্যমান আছে। কয়েকটি দৃষ্টান্ত এখানে উদ্ধৃত করা হলো:
(১) উরওয়াহ বিন যুবায়ের (রা) বর্ণা করেছন, হযরত আবদুর রহমান বিন আওফ (রা) বলেছেন: রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁকে ও হযরত উমর (রা)-কে কিছু জমি দান করেছিলেন। হযরত উসমান (রা)-এর সময়ে হযরত যুবায়ের (রা) উমারের ওয়ারিসগণ থেকে তাদের অংশের জমি খরিদ করে নিয়েছিলেন। আর এ খরিদকে মজবুত করার জন্য হযরত উসমান (রা)-এর নিকট তিনি হাজির হলেন এবং বললেন, হযরত আবদুর রহমান বিন আওফ (রা) সাক্ষ্য দিচ্ছেন, রাসূলে করীম (সা) এ জমিগুলো আমাকে ও হযরত উমর (রা) বিন খাত্তাবকে দান করেছিলেন। অতঃপর আমি উর (রা)-এর বংশধরদের নিকট হতে তাঁর অংশ খরিদ করে নিয়েছি। একথা শুনে হযরত উসমান (রা) বললেন, ‘আবদুর রহমান সত্য সাক্ষ্য দেবার মতো লোক। সে সাক্ষ্য তার পক্ষে হোক অথবা বিপক্ষে। (মুসনাদে ইমাম আহমদ)।
(২) আলকামা বিন ওয়ায়েল তাঁর পিতা হযরত ওয়ায়েল বিন হুজার (লা) থেকে বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁক হাদরামাউতে এক খন্ড জমি দান করেছিলেন। (আবু দাউদ, তিরমিযী)।
(৩) হযরত আবু বকর (লা)-এর কন্যা হযরত আসমা (রা) বলেছেন, রাসূলে রীম (সা) তাঁর স্বামী যুবায়েরকে খায়বারে এক খন্ড জমি দান করেছিলেন। এতে খেজুর গাছসহ অন্যান্য গাছপালাও ছিল। তাছাড়া উরওয়া বিন যুবায়ের বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলে করীম (সা) তাকে বনী নযীবের জমি থেকে এক খন্ড খেজুর বাগান দান করেছিলেন। আবদুল্লাহ বিন উমর (রা) বর্ণনা করেছেন যে, জমির একটি বড় খন্ড রাসূলুল্লাহ (সা) হযরত যুবায়েরকে দান করেছিলেন। এ দান ছিল এত বড় যে, রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁকে বললেন, ‘ঘোড়া দৌড়াতে থাক। যেখানে গিয়ে তোমার ঘোড় থেমে যাবে ততদূর পর্যন্ত সব জমি তোমাকে দিয়ে দেয়া হবে। তাই তিনি ঘোড়া দৌড়ালেন। এক জায়গায় গিয়ে ঘোড়া থামলে তিনি তার হাতের চাবুক সামনে নিক্ষেপ করলেন। তখন রাসূল (সা) বললেন, বেশ, চাবুক যেখানে গিয়ে পড়েছে সেখান পর্যন্ত ভূমি তাকে দিয়ে দেয়া হোক’ (বুখারী, আহমদ, আবু দাউদ, আবু ইউসুফের কিতাবুল খারাজ, আবু উবায়েদের কিতাবুল আমওয়অল।)
(৪) হযরত উমর বিন দীনার বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা) মদীনায় আগমেনর পর হযরত আবু বকর (রা) ও হযরত উমর (রা) উভয়কে ভূমি দান করেছিলেন। (কিতাবুল খারাজ, ইমাম আবু ইউসুফ)।
(৫) হযরত আবু রাফে’ (রা) বর্ণনা করেছেন, নবী করীম (সা) তাঁর খান্দানের লোকজনের একটি জমি দান করেছিলেন, কিন্তু তারা তা আবাদযোগ্য করতে পারেননি। হযরত উমর (রা) তাঁর খিলাফতকালে সে জমি আট হাজার দীনার মূল্যে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। (কিতাবুল খারাজ)।
(৬) ইবনে সিরীন হতে বর্ণিত, নবী করীম (সা) আনসার সম্প্রদায়ের এক জয়তুতন ব্যবসায়ীকে এক খন্ড জমি দান করেছিলেন। ভূমি খন্ডটির দেখাশুনার জন্য তিনি প্রায়ই বাইরে যেতেন। ফিরে এসে শুনতে পেতেন যে, তিনি বাইরে যাবার পর মহানবী (সা)-এর উপর উতটুকু কুরআন নাযিল হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা) এই হুকুম জারি করেছেন, এতে তাঁর মনে দুঃখ হতো। অবশেষেএকদিন তিনি রাসূলে করীম (সা) এর নিকট উপস্থি হয়ে আরোচ করলেন, এ জমি আমার আর আপনান মধ্যে বাধার প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই জমিটি আপনি আমার কাছ থেকে নিয়ে নিন। সুতরাং তাঁর কাছ থেকে জমি ফেরত নেয়া হলো। এর পর হযরত যুবায়ের (রা) জমিটির জন্য আবেদন করলে রাসূল (সা) তা তাঁকে দিয়ে দিলেন। (কিতাবুল আমওয়াল)
(৭) হযরত বিলাল বিন হারেস মুযানী (রা) বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁকে আকীকের সমস্ত জমি দান করে দিযৈছিলেন। (কিতাবুর আমওয়াল)
(হযরত আদী বিন হাতিম (রা) বর্ণা করেছেন।, রাসূলুল্লাহ (সা) ফোরাত বিন হাইয়ান আজালীকে ইয়ামার এক খন্ড জমি দান করেছিলেন। (কিতাবুল আমওয়াল)
(৯) আরবের বিখ্যাত চিকিৎসক হারিস বিন কালদাহর ছেলে নাফে’ হযরত উমর (লা)-এর নিকট বসরা এলাকার এমন একটি জরি জন্য আবেদন জানালেন যা খারাজমুক্ত ভূমির অন্তর্ভুক্ত ছিল না, আবর মুসলমানদের কোনো স্বার্থের সাথেও সম্পৃক্ত ছিল না। তিনি বললেন, আমি এ ভূমিতে ঘোড়ার জন্য ঘাসের চাষাবাদ করবো। হযরত উমর (রা) বসরার গভর্ণর আবু মূসা (রা)-এর নিকট ফরমান লিখে জানালেন, যদি নাফে’র বর্ণনা ঠিক হয় তাহলে জমিটি তাকে দিয়ে দেয়া হোক। (কিতাবুল আমওয়াল)
(১০) মূসা বিন তালহা (র) বলেছেন, হযরত উসমান (রা) তাঁর খিলাফতকালে যুবায়ের (লা) বিন আওয়াম, সাআদ (রা), ইবনে আবু ওয়াক্কাস, আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (া), উসমা (লা) বিন যায়েদ (লা), খাব্বাব বিন আরাত (রা), আম্মার বিন ইয়াসির এবং সা’দ নি মালিককে জমি দান করেছিলেন। (কিতাবুল খঅরাজ, কিতাবুল আমওয়াল)
(১১) আবদুল্লাহ বিন হাসান (র) বর্ণনা করেছেন, হযরত আলী (রা) আবেদন জানালেন হযরত (রা) তাঁকে ইয়াম্বু’র এলাকা দান করেছিলেন। (কানযুল উম্মাল)।
(১২) ইমামা আবু ইউসুফ (র) বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সূত্র হতে বর্ণনা করেছেন, পারস্যের শাসক কিসরা ও তার বংশধরগণের যেসব জমি অনাবাদী পতিত ছিল অথবা যে জমির মালিক পালিয়ে গিয়েছিল সেব জমিকে ‘খালসা’ হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। যাকে তিনি জমি দান করতেন এসব জমি হতেই দান করতেন। (কিতাবুল খারাজ)
ভূমি দান করার শরয়ী বিধান
ভূমি প্রদানের এ রীত শুধু রাজকীয় এনাম ও বখশিশ ধরনেরই ছিল না বরং এর কিছু নীতিমালা ছিল যা আমরা হাদীসের গ্রন্থাবলীতে পাই। এ নীতিমালাগুলো হচ্ছে:
১। কোনো ব্যক্তি ভূমি লাভ করে তা কোনো কাজে না লাগালে এই দান বাতিল গণ্য হবে। দৃষ্টান্তরূপ ইমাম আবু ইউসুফ এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) ‘মুযাইনা’ ও ‘জুহাইনার’ লোকেরা উমর (রা) এর খিলাফতকালে তাঁর নিকট দাবী নিয়ে এলো। যহরত উমর (রা) বললেন, “এ জমি যদি আমার অথবা আবু বকর (রা)-এ দান হতো তাহলে আমি এ দান বাতিল করে দিতাম। কিন্তু এ দান তো স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা)-এর। অতএব আমি অপরাগ। অবশ্য পদ্ধতি হলো এই: (আরবী************)
“যার কোনো ভূমি থাকবে। আর তিন বছর পর্যন্ত সে তা অনাবাদী ফেলে রাখবে এরপর যদি কেউ তা আবাদ করে নেয় তাহেল সে-ই এ ভূমির হকদার।”
২। যে দান সঠিকভাবে ব্যবহৃদ হয় না সেই দানে ব্যপারে পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে। নজীর হিসেবে আবু উবাযেদ তঁর কিতাবুল আমওয়ালে এবং ইয়াহ্ইয়া বিন আদাদ তঁর খারাজ গ্রন্থে এ ঘটনা উল্লেখ করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বিলাল বিন হারিস মুযানীকে গোটা আকীক উপত্যকা দান করেছিলেন। কিন্তু তিনি তার একটা বড় অংশ আবাদ করতে পারেননি। এ অবস্থঅ দেখে হযরত উমর (রা) তাঁর খিলাফতকালে তাঁকে বললেন, রাসূলুল্লাহ (সা) এ জমি তোমাকে এজন্য দান করেননি যে, তুমি নিজেও তা ব্যবহার করবে না, আর অন্যদেরকেও তা ব্যবহার করতে দিবে না। এখন তুমি শুধু এতটুকু জমি রাখ যতটুকু ব্যবহার করতে পারবে। বাকী জমি আমার কাছে ফিরিয়ে দাও। আমি এগুলোকে মুসলমানদের মধ্য বিতরণ করে দেই। বিলাল নি হারিস (রা) তাতে অসম্মত হলেন। হযরত উমর (রা) তাঁকে আবার বললেন। অবশেষে যতটুকু জমি তাঁর চাষের আওতায় ছিল ততটুকু রেখে বাকী জমি তাঁর থেকে ফেরত নিয়ে অন্যান্য মুসলমানদের মধ্যে ভাগ করে দিলেন।
৩। রাষ্ট্র শুধু ‘মাওয়াত’ (পতিত) এবং ‘খালিসা’ (খাস) জমি থেকেই দান করতে পারে। অন্যথায় এক ব্যক্তির ভূমির ছিনিয়ে নিয়ে অপর ব্যক্তিকে দান করার অধিকার রাষ্ট্রের নেই অথবা মূল মালিকদের মাথার উপর অনাহুত আর এক ব্যক্তিকে জায়গীরদার বা জমিদার হিসেবে বসিয়ে দিয়ে এবং তাকে মালিকানা অধিকার দান করে তার অধীনে মূল মালিকদেরকে চাষাবাদ কারী হিসেবে গণ্য করার অধিকারও নেই।
৪। রাষ্ট্র শুধু তাদেরই জমি দান করতে পারে যারা সত্যিকার অর্থে জনসাধারণের সামষ্টিক কল্যাণের জন্য কোনো উল্লেখযোগ্য খেদমত আঞ্জাম দিয়ে থাকে। অথবা যার সাথে এ ধরনের কোনো সেবামূলত কাজ সংশ্লিষ্ট রয়েছে অথবা যাকে দান করা কোনো না কোনোভাবে জনস্বার্থের জন্য সমীচীন মনে করা হবে। এখন রইলো ভ্রান্ত উদ্দেশ্যে ওইসব রাজকীয় দান যা খোদামোদ প্রিয় ও তোষামোদকরীদেরকে দেয়া হয়, অথবা ওইসব দান যা অত্যাচারী ও উৎপীড়নকরা জনস্বার্থ বিরোধী কাজ আঞ্জাম দেয়ার জন্য দান করে থাকে। এসব দান কোনো অবস্থাতেই বৈধ দানের পর্যায়ে আসতে পারে না।]
জমিদারীর শরয়ী নীতি
শোষোক্ত দুটি মূল নীতির ভিত্তি হলো রাসূলুল্লাহ (সা) ও তাঁর খেলাফতে রাশেদা কর্তৃক অনুসৃত কর্মপদ্ধতি। ইমাম আবু ইউসুফ (র) তাঁর কিতাবুল খারাজে বিষয়টি এভাবে বিশ্লেষণ করেছেন:
“ন্যায় পরায়ন শাসকের অধিকার আছে, যে সম্পদের কোনো মালিক নেই এবং যার কোনো উত্তরাধিকারও নেই, এমন সম্পদ তিনি এমন লোককে দান বা উপঢৌকন হিসেবে দিতে পারেন, ইসলারে খেদমতে যার অবদান আছে। সত্য দীনের উপর প্রতিষ্ঠিত কোনো প্রশাসন যে ব্যক্তিকে কোনো ভূখণ্ড দান করবেন তা ফেরত নেবার অধিকার কারো নেই। কিন্তু কোনো ভূমি কোনো শাসক কারো থেকে ছিনিয়ে এনে অন্যকে দান করলে তা হবে এক জনের জিনিস আত্মাসাৎ করে অন্যকে দান করার শামিল।”
এরপর তিনি আবার লিখেছেন:
“অতিএব শাসক যে ধরনের ভূমি দান করতে পারেন বলে আমি উল্লেখ করেছি, তার থেকে যে ভূমিই ইরাক, আরব. আল জিবাল ও অন্যান্য এলাকায় ন্যায়পরায়ণ ও সত্য দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত শাসক কাউকে দান করে থাকেন, পরবর্তী খলীফাগণের পক্ষে তাদের থেকে সে জমি ফিরিয়ে আনা অথবা তাদের দখল থেকে তা বের করে আনা, যে ভূমি এতদিন তাদের গখলে ছিল, হালাল নয়; চাই তারা এ সম্পদ উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হোক অথবা ওয়ারিস থেকে কিনে থাকুক।”
অবশেষে অধ্যায়টি সমাপ্ত করতে গিয়ে তিনি বলেন:
“অতএব এসব দৃষ্টান্ত প্রমাণ করে যে, রাসুলুল্লাহ (সা) নিজেও জমি দান করেছেন এবং তাঁর খলীফাগণও দান করতেন। রাসূলুল্লাহ (সা) যাকেই জমি দান করেছেন, তার মধ্যে কল্যাণ নিহিত ছিল দেখেই দান করেছন। যেমন কোনো নওমুসলিমের মন জয় করা অথবা জমি আবাদযোগ্য করা। এভাবে খোলাফতে রাশেদাও যাকে জমি দান করেছেন, ইসলামে তার কোনো না কোনো উত্তম খেদমত দেখে অথবা ইসলামের শত্রুদের মোকাবিলায় তা কোনো না কোনো কাজে আসবে মনে করেই করেছেন অথবা এতে কল্যাণ নিহিত আছে বলে করেছেন।” (কিতাবুল খারাজ ৩২-৩৫পৃ. )
শরীয়তের দৃষ্টকোণ থেকে জায়গীরদারীর মূল অবস্থঅন কি? একজন শাসক কি পরিমাণ জায়গীর দিতে পারেন ও বিলোপ করতে পারেন: আব্বসী খলীফা হারুনুর রশীিদের এসব প্রশ্নের উত্তর প্রকৃতপক্ষে ইমাম আবু ইউসুফ দিয়েছেন। ইমাম সাহের এ জবাবের সারমর্ম হলো—রাষ্ট্রের তরফ থেকে ভূমি দান করা তো স্বস্থানে একটি বৈধ কাজ। কিন্ত সকল ভূমি দানকারল এক রকম নয়, আবার সকল ভূমি গ্রহণকারীও এক সমান নয়। এক রকম দান ন্যায় পরায়ণ, দীনদার, সত্যপথের পথিক ও আল্লাহভীরু শাসকগণ করে থাকেন। তারা ইনসাফের দৃষ্টিতে দীন ও মিল্লাতের সঠিক খাদেমদেরকে কল্যাণকামী। এমন উদ্দেশ্যে দান করেন যার ফলাপল সামষ্টিকভাবে দেশ ও জাতিই ভোগ করে থাকে। আর তারা এমন সম্পদ থেকে দান করে থাকেন যার থেকে দান করা তাঁর জন্য বৈধ। দ্বিতীয় প্রকার দান হলা- যা অত্যাচারী, স্বৈরাচারী ও স্বার্থপূজারী শাসকগণ অসৎ উদ্দেশ্যে অসৎ লোকদের দান করে থাকে। তারা অন্ধভাবে এমন সম্পদ থেকে দান করে যা দেয়ার অধিকার তাদের নেই। এ দুটি দুই বিপরীত ধরনের দান। আর এ দুই প্রকার দানের হুকুম একরকম নয়। প্রথম দান বৈধ। এ দানকে বহাল রাখাই ইনসাফের দাব। আর দ্বিতীয় প্রকারের দান অবৈধ এবং ইনসাফের দাবী হলো তা বাতিল করা। যে ব্যক্তি এই উভয় দানকে একই পাল্লায় ওজন করে সে বড়ই যালেম।
মালিকানা অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন
এসব সাক্ষ্য ও নজির সেই গোটা সমায়ের কার্যক্রমের নমুনা পেশ করে যখন কুরআনের মূল উদ্দেশ্য স্বয়ং কুরআন বাহক মাহনবী (সা) এবং তাঁর সরাসরি ছাত্রগণ নিজেদের কথা ও কাজে প্রতিফলিত করেছিলেন। এই নমুনা অবলোকন করার পর কারো পক্ষে এই সন্দেহ প্রকাশ করার বিন্দুমাত্র অবকাশ থাকে না যে, ভূমিকে ব্যক্তিমালিকানা হতে বের করে সামষ্টিক মালিকানায় নিয়ে আসাই ছিল ইসলামের মূলনীতি, বরং এ সম্পূর্ণ বিপরীত এই নমুনা থেকে এ কথা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় যে, ইসলামের দৃষ্টিতে জমি থেকে লাভবান হওয়ার স্বাভাবিক ও সঠিক পন্থা কেবল এই যে, তা জনগণের ব্যক্তিমালিকানায় থাকবে। এ কারণেই রাসূলুল্লাহ (সা) অধিকাংশ সময়ে শুধু সাবেক মালিকানাকেই বহাল রাখেননি বরং যেসব অবস্থায় তিনি সাবেক মালিকানা বাতিল ঘোষণা করেছেন সেখানেও আবার নতুনভাবে ব্যক্তিমালিকানা সৃষ্টি করেছেন এবং ভবিষ্যতের জন্য মালিকানাহীন ভূমির উপরে নতুন মালিকানা প্রতিষ্ঠার পথ খুলে দিয়েছেন এবং সরকারী মালিকানাধীন ভূমি জনগণের মধ্যে বন্টন করে তাদেরকে মালিকানা ব্যবস্থাকে শুধুমাত্র একটি অনুপেক্ষণীয় নিকৃষ্ট পন্থা হিসেবে স্বীকার করে নেয়া হয়নি, বরং একটি সঠিক নীতি হিসেবেই এ ব্যবস্থাকে বহাল রাখা হয়েছে এবং ভবিষ্যতের জন্যও এ ব্যবস্থা অব্যাহত রাখা হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ (সা) মালিকানা অধিকারের মর্যাদা সম্পর্কে যেসব হুকুম দিয়েছেন সেগুলো এ কথার অতিরিক্ত প্রমাণ। বিভিন্ন রবাতে ইমাম মুসলিম (র) এই রিওয়ায়াত উল্লেখ করেছেন েযে, হযরত উমর (রা)-এর ভগ্নিপতি সাঈদ বিন যায়েদ (রা)-এ বিরুদ্ধে এক মহিলা মারওয়ান বিন হাকামের সময়ে দাবী উত্থাপন করেছেন যে, তিনি তার জমির একটি অংশ জবরদখর করে নিয়েছেন। জবাবে সাঈদ (রা) মারওয়ানের আদালতে যে বিবৃত দিয়েছিলেন তা এই যে, “আমি তার জমি কিভাবে ছিনিয়ে নিতে পারি! যেখানে আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর মুবারক জবানে বলতে শুনেছিঃ (আরবী*******************)
‘যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে এক বিঘত পরিমাণ জায়গাও দখল করে নেবে (কিয়ামতের দিন) সাত তবক জমি তার হার বানিয়ে তা ঘাড়ে লটকিয়ে দেয়া হবে।”
ইমাম মুসলিম (র) হযরত আবু হুরাইরা (রা) ও আয়েশা (রা)-এর সূত্রেও এই ইকই বিষয়বস্তু সম্পর্কিত হাদীস বর্ণনা করেছেন –(মুসলিম, কিতাবুল মুসাকাত ও য়অল মুজারা্আ, বাবু তাহরিীমিয যুলমি ওয়া গাসাবিল আরদি)। ইমাম আবু দাউদ, নাসাঈ ও তিরমিযী বিভিন্ন সূত্রে হাদীস বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলে করীম (সা) ইরশাদ করেছেন, “কোন অধিকার ছাড়া (মালিকের অনুমতি না নিয়ে) অন্যের জমি চাষাবাদকারীর কোনো প্রাপ্য নেই।”
রাফে’ বিন খাদীজ (রা) বর্ণনা করেছেন: (আরবী********************)
“কোন ব্যক্তি অন্যের জমি তার অনুমতি ছাড়া চাষাবাদ করলেন ঐ ক্ষেতের ফসল উপর তার কোনো অধিকার থাকতে পারে না অবশ্য তার (চাষাবাদের) খরচ তাকে দিয়ে দিতে হবে।”
(ইবনু মাজাহ, তিরমিযী)
উরওয়া বিন যুবায়ের (রা)-এ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট এই মর্মে একটিচ মোকদ্দমা দায়ের করা হলো যে, এক ব্যক্তি এক আনসারীর জমিতে খেজুর গাছ লাগিয়েছে। এ মোকাদ্দমার রায়ে রাসূলূল্লাহ (সা) ফায়সালা দিলেন- এসব খেজুর গাছ উপড়িয়ে ফে দেয়া হবে এবং জমি মূল মালিককে ফিরিয়ে দেয়া হবে। (আবু দাউদ)
রাসূলুল্লাহ (সা)-এর এসব নির্দেশ কিসের সাক্ষ্য দেয়? এ কথার অর্থ কি এই যে, ভূমির ব্যক্তি মালিকানা কোনো ক্ষতিকর জিনিস চিল যার মূলোৎপাটন করাই ছিল ইসলামের উদ্দেশ্য? আর, অনুপেক্ষণীয় মনে করে বাধ হয়ে ব্যক্তিমালিকানাকে সহ্য করা হয়েছে? অথবা তা এ কথার সাক্ষ্য দেয় যে, এটা ছিল সম্পূর্ণ একটি বৈধ ও যুক্তিসঙ্গত অধিকার যার প্রতি সম্মান ও মর্যাদা প্রদর্শন ব্যক্তি ও রাষ্ট্র উভয়ের জন্য বাধ্যতামূলক করে দেয়া হয়েছে?
৩. ইসলাম ব্যবস্থা এবং একক মালিকানা
ব্যাপারটি এখন ভিন্ন দিক থেকেও দেখা দরকার। ইসলামের বিধানসমূহ পরস্পর বিপরীত বা সংঘর্ষশীল নয়। ইসলামের হেদায়াত ও আইন-কানুনের প্রতিটি জিনিস এর সার্বিক ব্যবস্থার সাথে এমন সুসামঞ্জস্যশীল যে, এক বিভাগের আইন অন্যান্য বিভাগের আইন কানুনের সাথে খাপ খেয়ে যায়। এটা হলো এমন এক সৌন্দর্য – যাকে আল্লাহ তায়ালা, এ দীন যে তাঁরই থেকে আসা, তার একটি সুস্পষ্ট প্রমাণ সাব্যস্ত করেছেন। আমরা যদি তাঁরই তরফ থেকে আসা, তার একটা সুস্পষ্ট প্রমাণ সাব্যস্ত করেছেন। আমরা যদি মেনে নেই যে, শরীয়তে ভাগচাষ নাজায়েয, এবং শরীয়াত প্রণয়নকারী জমির মালিকানাকে নিজে চাষাবাদ করা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রাখতে চান এবং নিজের কাছে বিদ্যমান চাষাবাদের অতিরিক্স জমি হয় কাউকে বিনামূল্যে দিয়ে দিবে অথবা বেকার ফেলে রাখবে, তবে সামান্য চিন্তা করলেই একথা স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, এ হুকুম ইসলামের অন্যান্য মূলনীতি ও আইন কানুনের সাথে সামঞ্জস্যশীল নয় এবং একে ইসলামী ব্যবস্থায় ঠিকভাবে স্থাপনের জন্য ইসলামী ব্যবস্থার মধ্যে অনেক দূর পর্যন্ত এবং অনেক ক্ষেত্রে সংশোধন আনয়ন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বৈপরীত্যের কিছু স্পষ্ট নমুনা দেখুনঃ
(১) ইসলামী ব্যবস্থার মালিকানার অধিকার শুধুমাত্র শক্তিান পুরুষ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ নয়, নারী, শিশু. রুগ্ন এবং বৃদ্ধরাও এ অধিকার প্রাপ্ত হয়। ভাগচাষ যদি নিষিদ্ধ হয়, তাহলে তাদের সকলের জন্য কৃষি মালিকানা সম্পূর্ণ অর্থহীন হয়ে পড়ে।
(২) ইসলামের উত্তরাদিকার আইনের আলোকে একজন মানুষের মৃত্যুর পর যেভাবে তার সম্পদ অনেক লোকের বন্টিত হয়, ঠিক সেভাবে কোনো কোনো সময় অনেক মৃত ব্যক্তির সম্পদও এক ব্যক্তির নিকট জমা হয়ে যেতে পারে। এখন এটা কত আশ্চর্যের কথা যে, ইসলামের উত্তরাদিকার আইন তো এক ব্যক্তিকে শত সহস্র একর জমির মালিক বানিয়ে দিতে পারে। কিন্তু ব্যক্তিমালিকানা যদি নিজে চাষাবাদ করা পর্যন্ত সীমিত হয় তাহলে এই আইন শত সহস্র একজ জমির মালিকের জন্য এই নির্দিষ্ট পরিমাণ জমি ছাড়া বাকী সব জমির মালিকানা হতে লাভবান হওয়াকে হারাম করে দেয়।(৩) ক্রয়-বিক্রয়ের ইসলামী আইন যে কোনো ধরনের জিনিসের ক্ষেত্রে মানুষের উপর এরূপ বিধিনিষেধ আরোপ করেনি যে, সে সর্বাধিক একটা নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্তই তা খরিদ করতে পারবে এবং এই সীমার বেশী খরিদ করার অধিকার তার নেই। বেচা-কেনার এই সীমাহীন অধিকার যেমন সকল বৈধ জিনিসের ব্যাপারে আছে- তেমনি জমির ব্যাপারেও সে অধিকার মানুষের রয়েছে। কিন্তু একথা অত্যন্ত বিস্ময়কর মনে হয় যে, দেওয়ানী আইন অনুযায়ী এক ব্যক্তি তো তার ইচ্ছামত যে কোনো পরিমাণ জমি ক্রয় করতে পারবে, কিন্তু কৃষি আইনানুযায়ী সে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশী ভূমির মালিকানার ফল ভোগ করার অধিকার পাবে না।
(৪) ইসলাম কোনো প্রকার মালিকানার উপরই পরিমাপ ও পরিমাণগত দিক থেকে কোনো সীমা নির্ধারণ করেনি। বৈধ জিনিসের মালিকানার ক্ষেত্রে যখন এর সংশ্লিষ্ট শরয়ী দায়িত্ব ও কর্তব্য পালিত হতে থাকে তখন তা অধিক পরিমাণে রাখা যায়। টাকা-পয়সা, জীব-জন্তু, ব্যবহারের জিনিসপত্র, বাড়ীঘর, যানবাহন, মোটকথা মোনো জিনিসের ব্যাপারেই আইনত মালিকানার পরিমাণের উপর কোনো সীমাবদ্ধ নেই। তাহলে শেষ পর্যন্ত শুধু কৃষি সম্পদের এমন কী বিশেষত্ব রযেছে যার এই একটি মাত্র ক্ষেত্রে শরীয়তের মনোভাব হবে ব্যক্তিমালিকানাকে পরিমাণের দিক থেকে সীমিত করা, অথবা লাভবান হওয়াকে সুযোগ সুবিধা ছিনিয়ে নিয়ে একটি বিশেষ সীমার অধিক মালিকানাকে ব্যক্তির জন্য অকেজো করে দেয়া।[ এখানে ভাল করে বুঝে নিতে হবে যে, ইসলামের মৌলিক বিধান তো তাই যা আমি উপরে বর্ণনা করেছি। অবশ্য কোন বিশেষ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যদি জমির বর্বোচ্চ মালিকানার সীমা নির্ধারণের প্রয়োজন অনুভূত হয়, তাহলে সেই অবস্থা বিরাজমান থাকা পর্যন্ত সাময়িকভাবে তা করা যেতে পারে। কিন্তু এ ধরনের কোন সিদ্ধান্তের কারণে ইসলামের মৌল বিধানে কোন স্থায়ী পরিবর্তন হতে পারে না। সামনে অগ্রসর হয়ে এ বিষয়ের উপর আমি বিস্তারিত আলোচনা করবো।
(৫) জীবনের সর্বক্ষেত্রেই ইসলাম দয়ামায়া ও দানশীলতাকে উৎসাহিত করেছে। কিন্তু অত্যাবশ্যকীয় হক আদায় করার পর আর কোনো ব্যাপারেই আমরা দেখি না যে, ইসলাম ইহসান ও দানশীলতাকে মানুষের উপর অবশ্যকরণীয় করেছে। উদাহরণস্বরূপ যে ব্যক্তি যাকাত পরিশোধ করে তাকে ইসলাম তার প্রয়োজনের অতিরিক্স টাকা পয়সা গরীপ দুঃখীদের দান করার জন্য উৎসাহিত করে; কিন্তু এ দান খয়রাতকে তার উপর ফরয করে না এবং এ কথাও বলে না যে, অভাবীদের ঋণ হিসেবে অথবা মুজারাবাতের ভিত্তিতে টাকা পয়সা দিয়ে তার ব্যবসায়ে শরীক হওয়া হারাম, বরং দান শুধু দানের আকারেই হওয়া বাঞ্ছনীয়। এমনিভাবে কোনো ব্যক্তির প্রয়োজনের অতিরিক্ত ‘বাড়ী’ থাকলে অথবা এমন একটি বড় বাড়ী যদি থাকে যাতে তার ব্যক্তিগত প্রয়োজনের অতিরিক্ত জায়গা আছে তাহলে এ ধরনের অতিরিক্ত বাড়ী ও বাড়ীর অতিরিক্ত জায়গা, যাদের বাড়ীঘর নেই তাদেরকে নিস্বার্থভাবে ব্যবহার কতে দেয়াকে ইসলাম খুবই উৎসাহিত করে। কিন্তু অনিবার্যভাবেই তা বিনামূল্যৈ দিয়ে দিতে হবে এবং বাড়ীভাড়া দেয়া হারাম এমন কথা ইসলাম বলেনি। তদ্রুপ অতিরিক্ত কাপড় চোপড়, থালা বাসন, যানবাহন ইত্যাদির ব্যাপারেও এই একই কথা। এসব জিনিস ব্যবহারের ক্ষেত্রেও দানশীলতার মনোভাব নিয় নিস্বর্থভাবে দিয়ে দেয়াকে অবশ্যই পছন্দ করা হয়েছে, কিন্তু তা ফরয করে দেয়া এবং বিক্রি করা ও ভাড়ায় দেয়া হারাম করা হয়নি। এখন কৃষিজাত জমির ব্যাপারে এমন কী ঘটলো যার কারণে এ ব্যাপারে ইসলাম এর এই সাধারণ মৌল নীতিকে পরিহার করে এর উৎপাদনের উপর যাকাত আদায় করার পরও তাকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত জমি অবশ্যম্ভাবী রেো অপরকে বিনামূল্যৈৗ দিয়ে দিতে বাধ্য করতে এবং অংশীদারী অথবা মুজারাবাতের নীতিমালা অনুযায়ী কোনো কারবার অবশ্যই করতে পারবে না?
(৬) ইসলামী আইন ব্যবসা বাণিজ্য, শিল্প কারখানা ও অর্থনৈতিক কারবারের প্রতিটি বিভাগে মানুষকে অবাধ অনুমতি দিয়েছে যে, সে লাভ-লোকসানে অংশীদারিতত্বের নীতি অনুযায়ী অপরের সাথে কাজ কারবার করতে পারবে। এক ব্যক্তি অন্যকে নিজের টাকা পয়সা দিয়ে ঠিক করে নিতে পারে যে, সে এই টাকা দিয়ে কারাবার করবে; যদি লাভ হয়, তাহলে এর অর্ধেক অথবা এক চতুর্থাংশের মালিক অর্থ সরবরাহকারী হবে। এক বীক্ত কাউকে নিজের পুঁজি কোনো দালানকোঠা রূপে, কিংবা কোনো মেশিন কি ইঞ্জিন হিসেবে, কোনো মোট অথবা নৌকা বা জাহারূপে দিতে পারে এবং বলতৈ পারে যে, তুমি এগুলো কাজে লাগাও। এতে যা লাভ হবে তার এতে অংশ আমাকে দিবে। কিন্তু কোনো ব্যক্তি নিজের পুঁজি জমির আকারে অন্যকে দিয়ে কোনো সংগত কারণে এ কথা বলতে পারে না যে, এতে যে ফসল উৎপন্ন হবে তার এক-তৃতীয়াংশ অথবা এক চতুর্থাংশ বা অর্থেক অংশের মালিক আমি হবো।
৪. কৃষি জমির সীমা নির্ধারণ
প্রশ্ন: জনৈক স্থানীয় আলিম দুটি প্রশ্ন করেছেন। মেহেরবানী করে প্রশ্ন দুটির জবাব দেবেন।
(১) কৃষি সংস্কার প্রসংগে জায়গীর ফেরত নেবার ব্যাপারে নির্দিষ্ট সীমার অতিরিক্ত নেবার পক্ষে দলীল পেশ করুন। বিশেষ করে, যেখানে হযরত যুবায়ের রাযিআল্লাহ আনহুকে রাসূলুল্লা (সা) চাবুক নিক্ষেপের মাধ্যমে নির্দেশিত সমগ্র এলাকার জমি দিয়েছিলেন।
(২) কৃষকদের উচ্ছেদের ব্যাপারে তো একথা সুস্পষ্ট যে, ফসল ফলার আগে তাদেরকে বেদখল করা যাবে না। কিন্তু এছাড়া তাদেরকে জমি থেকে বেদেখল করার কোনো কারণ দেখি না। যদি অন্য কোনো পথ থাকে তাহলে দলীল সহকারে পেশ করবেন।
একজন প্রশ্ন করেছেন, কুরআন পড়ে জানা যায়, দুনিয়ার সৃষ্টবস্তুগুলো থেকে প্রত্যেক ব্যক্তির উপকৃত হওয়া উচিত। এক্ষেত্রে সাধারণের উপকারার্থে জমির মালিকানা রাষ্ট্রের হাতে সোপর্দ করে দিলে তা কুর্আনের উদ্দেশ্যের যথার্থ বাস্তবায়ন বলে মনে হয়।
জবাব: প্রথম প্রশ্নটি ব্যাপারে নীতিগত ভাবে একথা জেনে রাখা উচিত যে, এক ব্যক্তি জমি কিনে বা উত্তরাধিকার সূত্রে জমির মালিকানা লাভ যেভাবে জমির ওপর মালিকানস্বত্ব ঠিক তেমনভাবে কায়েম হয়ে যায় না। জায়গীরের ব্যাপারে সরকার সব সময় পুনর্ববিবেচনা করার অধিকা রাখে। কোনো দান অসংগত বিবেচিত হলেই সরকার তা বাতল করে দিতে পারে। এক্ষেত্রে সরকারী পদক্ষেপ সংশোধনের উর্ধ্বে নয়।
হাদীস ও আছার গ্রন্থগুলো এর কয়েকটি নজির পাওয়া যায়। আবইয়ায ইবনে হাম্মাল মাযনীকে (রা) নবী (সা) মারিব এলাকায় এমন একটি জমি দিয়েছিলেন যেখানে খেতে লবন বের করা হতো। পরে লোকেরা যখন রাসূলুল্লাহকে সেখানে একটি বিরাট লবনের খনির অস্তিত্বের সন্ধান দিলো, তখন তিনি এ ধরনের জমি ব্যক্তিমালিকানয় দেয়া সামাজিক স্বার্থের পরিপন্থী বিবেচনা করে পূর্বের আদেশ বাতিল করে দেন। এ থেকে কেবল একথাই জানা যায় না যে, সরকারী দান সম্পর্কে পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে, বরং এই সংগে একথাও জানা যায় যে, কাউকে সংগত সীমার বেশী দেয়া সামিষ্টিক স্বার্থ বিরোধী, আর এই পর্যায়ে কাউকে কিছু দান করা হয়ে থাকলে তা পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে। আর একটি রিওয়ায়েত থেকেও একই কথা জানা যায়। তাতে বলা হযেছে, হযরত আবুবকর সিদ্দীক (রা) হযরত তালহা (রা)-কে একটি জমি দান করার ফরমান লিখে দেন। কিন্তু এই ফলমানে সাক্ষ্য দিতে অস্বীকার করেন এবং বলেন: (আরবী***************************)
এতগুলো জমি একা তোমাকে দেয়া হবে অন্য সবাইকে বঞ্চিত করে? (দেখুন কিতাবুল আমওয়াল লি আবী উবাইদ, পৃঃ ২৭৫-৭৬)
হযরত যুবায়ের (রা) প্রসংগে বলা যায়, যে নবী করীম (রা) তাকে জমি দেন, তখন বিপুল পরিমাণ জমি অনাবাদী পড়ে ছিল। রাসূলুল্লাহর (সা) সামনে তখনই এই জমি গুলো আবাদ করার সমস্যা ছিল মুখ্য। তাই সে আমলে তিনি এই সব অনাবাদী জমির বিরাট বিরাট খন্ড লোকদের দিয়েছিলেন।
জমি বেদখল করার ব্যাপারে সরকার এমন ধরনের আইন প্রণয়ন করার অধিকার রাখে যার মাধ্যমে একথা নিশ্চিত করে দেয়া যায় যে, যুক্তিংগত কারণ ছাড়া মালিক কখনো কোনো কৃষককে বেদখল করতে পারবে না। এটা নাজায়েয হবার দলীল কি? যদি কোনো ‘নাস’ [আলাহ ও রাসূলের (সা) নির্দশ]-এর বিরোধী না হয়, তাহলে এ অনুমতি ইমামের সেইসব ইখতিয়ারের আওতাভুক্ত হয়ে যায়, যা তাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে দান করা হয়েছে, সাধারণ মানুষের স্বার্থে, লোকদের মধ্যে ইনসাফ ও ন্যায়নীতি কায়েম করা এবং সামষ্টিক ফিতনার পথরোধ করার জন্য বর্তমানে আমাদের দেশের জনগণের বৃহত্তর অংশের জীবন ধারণ যেখানে একমাত্র জমির ওপর নির্ভরশীল, সেখানে মালিকদেরকে এত অবাধ ও ব্যাপক ক্ষমতা দান করার কোনোক্রমেই জনস্বার্থেল অনুকূল নয়, যার ফলে তারা নিজেদের খেয়ালখুশী মতো যে কোনো কৃষককে সংগত কারণ ছাড়াই যে কোনো সময় জমি থেকৈ বেদখল করতে পারে। এর অর্থ দাঁড়াবে, কোনো কৃষক যে কোনো সময় জমি থেকে বেদখল করতে পারে। এর অর্থ দাঁড়াবে, কোনো কৃষক কখনো কোথাও নিশ্চিন্তে বসতে পারবে না। এভাবে লাখো লাখো কৃষিজীবি মানুষের জীবন সবসময় দোদুল্যমান ও ঝুলন্ত অবস্থায় থাকবে।
কুরআন অধ্যয়নের পর অদ্ভুত ফলশ্রুতি আপনি পেশ করেছেন। কুরআন থেকে বের করেছেন মালিকানা ব্যবস্থা রাষ্ট্রের হাতে সোপর্দ করে দিতে হবে। আমি খুবেই খূশী হতাম যদি জানতে পারতাম কুরআনের কোন কোন আয়াত থেকে এগুলা বের হয়েছে। আপনি আমার মাসআলায়ে মিলকিয়াতে যমীন’ বইটর প্রথম দুটি অধ্যায় সেই আলিম সাহেবের সামনি রাখুন, যাতে তিনি সেখানে যে প্রশ্নের মীমাংসা হয়ে গেছে, তার পুনরাবৃত্তি না করেন। সেই প্রশ্নগুলোর পুনরাবৃত্তি করতে চাইলে, অন্তত সেখানে তার জবাব দেয়া হযেছে, তার সাথে কোন্ কোন্ ব্যাপারে তিনি একমত নন, তা জানিয়ে দিতে পারেন। এভাবে আমার ও তাঁর অনেকটা সময় অপচয়ের হাত থেকে বঁচবে। [তরজমানুল কুরআন, জুন-১৯৫১।]
৫. বর্গাচাষ পদ্ধতি এবং ইসলামের সুবিচার নীতি
[জনৈক ব্যক্তির প্রশ্নের জবাবে : তরজামানুল কুরআন, অক্টোবর ১৯৫০ ইং।]
জওয়াবঃ (১) উৎপন্ন ফসল থেকে জমি মালিক ও ভাগচাষী আনুপাতিক হারে অংশ বন্টন করে নেবেন ভাগের এ পদ্ধতিটি নীতিগতভাবে ঠিক। যেমন ধরুন মলিকের ২/৫ এবং চাষীর ৫/৩ অংশ। কিন্তু এ ব্যাপারে ইনসাফের তাগিতে অবশ্যই প্রত্যেক চাষীকে এমন পরিমাণ জমি দিতে হবে যাতে তার মানবিক প্রয়োজন পূর্ণ হয়। উপরন্তু আনুপাতিক অংশ নির্ধারণ করার সময় প্রচলিত ধারা প্রতি নজর না দিয়ে, ইনসাফের প্রতি নজর রেখে দেখতে হবে, ফসল উৎপাদনে জমির মালিকও চাষীর যথার্থ অংশ (Contribution) কতটুকু? এ ব্যাপারে কোনো বিশ্বজনীন আইন কানুন বানানো সম্ভব নয়। কারণ প্রত্যেক এলাকার কৃষির অবস্থা এক রকম নয়। তবে আপাত-দৃষ্টিতে মনে হয়, জমির মালিক যদি কেবল জমি দিয়ে থাকেন এবং হাল, বীজ ও মেহনত সব যদি হয় চাষীর, তাহলে এ অবস্থায় ২/৫ ও ৩/৫ ভাগটা ইনসাফভিত্তিক হবে না। যাই হোক, জমি মালিকরা নিজেদের ব্যাপারটিকে কেবল শরীয়তের বিধান সংশোধন করে নেবেন, তা যথেষ্ট নয়; বরং তাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে খোলা মনে, যথার্থ ইনসাফ কায়েম করার উদ্দেশ্য।
(২) অবশ্যই জমির মালিকের তদারক করার অধিকার আছে। মালিক দেখতে পারেন ফসল ভাগ করার পূর্বে চাষী সম্মিলিত অংশ থেকে অবৈধভাবে কিঠু গ্রাস করে ফেলছে কিনা; অথবা কৃষ হিসেবে সে নিজের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছে কিনা। কিন্তু এই তদারকী ব্যবস্থঅ এত বেশী অগ্রসর না হওয়া উচিত, যার ফলে চাষী কেবলমাত্র কর্মচারী বা মজুরে পরিণত হয়ে যায় এবং মালিকের তদারকী কর্মচারীরা পূরোপুরি নিজেদের হুকুম অনুযায়ী তাকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেয়। নীতিগিতভাবে একচাষী মালিকের কর্মচারী বা মজুর নয়; বরং কারবারের ভাগীদার। আর একথা মেনে নিয়েই তার সাথে ব্যবহার করা উচিত। চাষীদের পক্ষ থেকে আমি যেসব অভিযোগ পেয়েছি, তার মধ্যে এ অভিযোগও আছে যে, জমিদার ও তার কর্মচারীরা হরহামেশা তাদের মাথার ওপর সওয়ার হয়ে থাকে এবং তাদের প্রত্যেকটি কাজে হস্তক্ষেপ করে। এ পদ্ধতির সংশোধনই আমার বক্তব্যের মূল উদ্দেশ্য।
৬. অধিকারভূক্ত সম্পদ ব্যয়ের সীমা
“আর তোমাদের যে ধন সম্পদকে আল্লাহ তোমাদের জীবন ধারণের মাধ্যমে পরিণত করেছেন, তা নির্বোধদের হাতে তুলে দিয়োনা তবে তাদের খাওয়অ পরার ব্যবস্থা কর এবং সদুপদেশ দাও। *****৮
আর এতীমদের পরীক্ষা করতে থাক, যতদিন না তারা বিবাহযোগ্য বয়সে পৌঁছে যায়। ***৯ তারপর যদি তোমরা তাদের মধ্যে যোগ্যতার সন্ধান পাও, তাহলে তাদের সম্পদ তাদের হাতে সোপর্দ করে দাও। ***১০ তারা বড় হয়ে নিজেদের অধিকার দাবী করবে, এ ভয়ে কখনো ইনাসফের সীমানা অতিক্রম করে তাদের সম্পদ তাড়াতাড়ি অবলম্ন করে (অর্থাৎ অর্থ গ্রহণ না করে) আর যে গরীব হবে সে যেন প্রচলিত পদ্ধতিতে খায়। ****১১ তারপর তাদের সম্পদ যখন তাদের হাতে সোপর্দ করতে যাবেব তখন তাতে লোকদেরকে সাক্ষী বানাও। আর হিসাব নেবার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।”
৮. এ আয়াতটি ব্যাপক অর্থবোধক। এর মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহকে একটি পরিপূর্ণ বিধান দেয়া হয়েছে। তাদেরকে বলা হয়েছে: অর্থ জীবন যাপনের একটি মাধ্যম। যে কোনো অবস্থায়ই তা ত্রুটিপূর্ণ ব্যবহারের মাধ্যমে তমদ্দুনিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে এবং শেষ পর্যন্ত নৈতিক ব্যবস্থাকেও ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়। কোনো ব্যক্তির নিজের সম্পদের ওপর তার মালিকানা অধিকার থাকে ঠিকই। কিন্তু তা এতো বেশী সীমাহীন নয় যে, যদি সে ঐ সমস্ত অধিকার সঠিকভাবে ব্যবহার করার যোগ্যতা না রাখে এবং তার ত্রুটিপূর্ন ব্যবহারের কারণে সামাজিক বিপর্যয় দেখা দেয় তারপরও তার কাছ থেকে ঐ অধিকার হরণ করা যাবে না। মানুষের জীবন যাপনের প্রয়োজনীয় সামগ্রীর চহিদা অবিশ্য পূর্ণ হতে হবে। তবে মালিকানা অধিকারে অবাধ ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যি এ বিধিনিধে আরোপিত হওয়া উচিত যে, এ ব্যবহার নৈতিক ও তমদ্দুনিক জীবন এবং সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য সুস্পষ্টভাবে হতে পারবে না। এ বিধান অনুযায়ী প্রত্যেক সমপদ-সম্পত্তির মালিককে ক্ষুদ্র পরিসরে এদিকে অবশ্যি নজর রাখতে হবে যে, নিজের সম্পদ সে যার হাতে সোপর্দ করছে সে তা ব্যবহারেরর যোগ্যতা রাখে কিনা। আর বৃহত্তর পরিসরে এটা ইসলামী রাষ্ট্রের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত হতে হবে যে, যারা নিজেদের সম্পদ ব্যবহারের যোগ্যতা রাখে না অথবা যারা অসৎ পথে নিজেদের ধন সম্পদ ব্যবহার করছে, তাদের ধন সম্পত্তি সে নিজের পরিচালনাধীনে নিয়ে নেবে এবং তাদের জীবন নির্বাহের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর ব্যবস্থা করে দেবে।
৯. অর্থাৎ যখন তারা বালেগ হতে থাকে তখন তাদের বুদ্ধি-জ্ঞঅন কি পর্যায়ে বিকশিত হয়েছে তা দেখতে হবে এবং তারা নিজেদের বিষয়াদি আপন দায়িত্বে পরিচালনা করার যোগ্যতা কতটুকু অর্জন করেছে সে দিকেও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নজর রাখতে হবে।
১০. ধন সম্পদ তাদের হাতে সোপর্দ করার জন্য দুটি শর্ত আরোপ করা হয়েছে। একটি হচ্ছে, সাবালকত্ব আর দ্বিতীয়টি যোগ্যতা অর্থাৎ অর্থসম্পদ সঠিকভাবে ব্যবহার করার যোগ্যতা। প্রথম শর্তটির ব্যাপারে উম্মাতের ফকীহগণ একমত। দ্বিতীয় শর্তটির ব্যাপারে ইমাম আবু হানীফা রহমাতুল্লাহি আলাইহির মত হচ্ছে এই যে, সাবালক হবার পরও যদি এতীমের মধ্যে ‘যোগ্যতা’ না পাওয়া যায়, তাহলে তার অভিভাবককে সর্বাধিক আরো সাত বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তারপর ‘যোগ্যতা’ পাওয়া যাক বা না যাক সর্বাবস্থায় এতীমকে ধনসম্পদের দায়িত্ব দিয়ে দিতে হবে। ইমাম আবু ইউসুফ, ইমাম মুহাম্মদ ও ইমাম শাফেঈ রাহেমাহুমুল্লাহর মতে ধনসম্পদ এতীমের হাতে সোপর্দ করার জন্য অবশ্যি ‘যোগ্যতা’ একটি অপরিহার্য শর্ত। সম্ভবত এঁদের মতে এ ব্যাপারে শরীয়তের বিষয় সমূহের ফয়সালাকারী কাযীর শরণাপন্ন হওয়াই অধিকতর যক্তিযুক্ত। যদি কাযীর সামনে একথা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, সংশ্লিষ্ট এতীমের মধ্যে যোগ্যতা পাওয়া যাচ্ছে না, তাহলে তার বিষয় সম্পত্তি দেখাশুনার জন্য তিনি নিজেএ কোনো ভালো ব্যবস্থা করবেন। [তাফহীমুল কুরআন: সূরা আন নিসা, আয়াত ৫-৬, টীকা ৮-১০।]