রব
আভিধানিক তত্ত্ব
—— -ধাতু থেকে শব্দটি নিষ্পন্ন। এর প্রাথমিক ও মৌলকি অর্থ প্রতিপালন। তারপর তা থেকে ভোগ-ব্যবহার, তত্ত্বাবধান, অবস্থান পরিবর্তন সাধন, সমাপ্তিকরণ ও পরিপূর্ণতা বিধানের অর্থ সৃষ্টি হয়েছে। এরই ভিত্তিতে সৃষ্টি হয়েছে প্রাধান্য, নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব, অধিপত্য ও প্রভুত্বের অর্থ। অভিধানে এর ব্যবহারের কয়েকটি উদাহরণ এইঃ
একঃ প্রতিপালন করা, ক্রমবিকাশ ও ক্রমোন্নতি সাধন এবং বর্ধিত করণ। উদাহরণস্বরূপ-পালক পুত্রকে রবীব (–) ও পালক কন্যাকে (–) রবীবা বলা হয়। বিমাতার গৃহে প্রতিপালিত শিশুকেও রবীবী (–) বলা হয়। লালন-পালনকারী দাইকেও রবীবা (–) বলা হয়। বিমাতাকে বলা হয় রাব্বাহ(–)। কারণ তিনি মাতা না হলেও শিশুর লালন-পালন করেন। এ কারণেই সৎ-পিতাকে বলা হয়— (রাব্বুনা)। যে ঔষধ হেফাযত করে রাখা হয়, তাকে বলা হয় মোরাব্বাব বা মোরাব্বা (—)। ———-এর অর্থ সংযোজন করা, বর্ধিত করা এবং সমাপ্তিতে নিয়ে যাওয়া। যথাঃ —এর অর্থ -অনুগ্রহে সংযোজন করেছে বা অনুগ্রহের শেষ সীমায় পৌছেছে।
দুইঃ সংকুচিত করা, সংগ্রহ করা এবং একত্র করা। যেমন, বলা হয় —- অর্থাৎ অমুক ব্যক্ত লোকদেরকে একত্র করে বা তার কাছে সব লোক জড়ো হয়। একত্রে মিলিত হওয়ার স্থানকে বলা হবে(–) মারাব্ব সংকুচিত হওয়া এবং সংগৃহীত হওয়াকে বলা হবে তারাব্বুব (–)
তিনঃ তত্ত্বাবধান করা, অবস্থার সংশোধন ও পরিবর্তন সাধন করা, দেখাশোনা করা এবং জামিন হওয়া। যেমন, —- এর অর্থ হবে অমুক ব্যক্তি তার সম্পত্তির দেখাশোনা এবং তত্ত্বাবধান করেছে। আবু সুফিয়ানকে সাফওয়ান বলেছিলেনঃ
হাওয়াজেনের কোন ব্যাক্ত আমাকে লালন-পালন করার চেয়ে কোরাইশের কোন ব্যক্তি আমাকে পৃষ্ঠপোষকতায় গ্রহণ করা আমার কাছে অধিক প্রিয়।
আলকামা ইবনে ওবায়দার একটি কবিতাঃ
————————– তোমরা পূর্বে যে সত্তারা আমার মুরুব্বী ছিলো, আমি তাকে খুইয়ে বসেছি, অবশেষে আমার লালন-পালনের ভার তোমার হাতে এসেছে।
কবি ফরযদাক বলেনঃ
————————– এ কবিতায় ———- এর অর্থ, যে চামড়ার লোম পৃথক করা হয় নি, যে চামড়াকে দাবাগত করে পরিষ্কার করা হয়নি। ———————- এর অর্থ হবে-অমুক ব্যক্তি অমুক ব্যক্তির কাছে আপন পেশার কাজ করে অথবা তার কাছে কারিগরী শিক্ষা লাভ করে।
চারঃ প্রাধান্য, কর্তৃত্ব, সর্দারী, হুকুম চালানো, ব্যবহার করা, যথাঃ —————- অর্থাৎ অমুক ব্যক্তি আপন জাতিকে নিজের অনুগত করে নিয়েছে। ——- আমি জাতির ওপর হুকুম চালিয়ে কর্তা সেজে বসেছি। লবীদ ইবনে রবীয়া বলেনঃ
——————- এখানে —- মানে কিন্দার সর্দার, সে কবীলায় যার হুকুম চলতো। এ অর্থেই নাবেঘা যুবইয়ানীর কবিতাঃ
পাঁচঃ মালিক হওয়া। যেমন হাদীস শরীফে আছে, নবী (স) এক ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করেছেন ——- তুমি কি বকরির মালিক, না উটের? এ অর্থে ঘরের মালিককে —- (রব্বুদ্দার) উষ্ট্রীর মালিককে —- (রব্বুন্নাকাহ) এবং সস্পত্তির মালিককে ——– (রববুয-যাইয়াহ) বলা হয়। মুনিব অর্থেও রব শব্দটি ব্যবহৃত হয় এবং আব্দ (–) বা গোলামের বিপরীত অর্থে বলা হয়। অজ্ঞতাবশত রব শব্দকে শুধু পরওয়ারদিগার, প্রতিপালকের অর্থের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। রুবুবিয়াতের সংজ্ঞা দিয়ে বলা হয়েছে- ————— একটি জিনিসকে পর্যায়ক্রমে তরক্কী দিয়ে পূর্ণ অর্থ নয়। এর পূর্ণ ব্যাপকতা পর্যালোচনা করলে জানা যায় যে, শব্দটি নিম্নোক্ত অর্থ সমূহ প্রকাশ করেঃ
একঃ প্রতিপালক, প্রয়োজনীয় বস্তু সরবরাহকারী, তরবিয়ত ও ক্রমবিকাশ দাতা।
দুইঃ জিম্মাদার, তত্ত্বাবধায়ক, দেখাশোনা এবং অবস্থার সংশোধন- পরিবর্তনের দায়িত্বশীল।
তিনঃ যিনি কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেন। যাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন লোক সমবেত হয়।
চারঃ নেতা- সর্দার, যার আনুগত্য করা হয়, ক্ষমতাশালী কর্তা ব্যক্তি, যার নির্দেশ চলে, যার কর্তৃত্ব স্বীকার করে নেয়া হয়, হস্তক্ষেপ ও বল প্রয়োগের অধিকার আছে যার।
পাঁচঃ মালিক-মুনিব।
কোরআনে রব শব্দের ব্যবহার
কোরআন মজীদে রব শব্দটি এসব অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। কোথাও এসবের কোন এক বা দুই অর্থ উদ্দেশ্য; কোথাও এর চেয়েও বেশী, আর কোথাও পাঁচটি অর্থই এক সাথে বোঝান হয়েছে। কোরআনের আয়াত বিভিন্ন উদাহরণ দিয়ে আমরা ও বিয়য়টি স্পস্ট করবো।
প্রথম অর্থেঃ সে বললো, আল্লাহ্র আশ্রয়! যিনি আমাকে ভালোভাবে রেখেছেন, তিনিই তো আমার রব।১-ইউসুফ-২৩
(১) কেউ যেন ধারনা করে না বসে যে, হযরত ইউসুফ (আঃ) আজীজ মিসরকে তাঁর রব বলেছেন। কোন কোন তফসীরকার এমন সন্দেহও করেছেন। মূলত ‘সে’ বলে আল্লাহর দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে, তিনি যাঁর আশ্রয় চেয়েছেন। বলেছেন- ——— আল্লাহ্কে ইঙ্গিত করা হয়েছে তা যখন নিকটে উল্লিখিত রয়েছে, তখন অনুল্লিখিত ‘মুশারুন ইলাইহে’ খুঁজে বেড়াবার দরকার বা কিসের?
দ্বিতীয় অর্থেঃ প্রথম অর্থের ধারণাও যাতে অল্প-বিস্তর শামিল রয়েছেঃ
——————————————————————- বিশ্ব জাহানের রব, যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন, আমাকে পথ প্রদর্শন করেন, পানাহার করান, আমি পীড়িত হলে আরোগ্য দান করেন, তিনি ব্যতীত তোমাদের এ সকল রব তো আমার দুশমন।-শোয়ারা-৭৭-৮০
তোমরা যে নিয়ামত সম্ভোগই লাভ করেছো, তা লাভ করছো আল্লাহর তরফ থেকে। তারপর তোমাদের ওপর কোন বিপদ আপতিত হলে হতচকিত হয়ে তোমরা তাঁর হুজরেই প্রত্যাবর্তন করো। কিন্তু তিনি যখন তোমাদের বিপদ কেটে নেন, তখন তোমাদের মধ্যে এমন কিছু লোক আছে, যারা (নিয়ামত দান ও দুর্যোগ মুক্তিতে) আপন রব-এর সাথে অন্যদেরকেও শরীক করতে শুরু করে। আন- নাহাল-৫৪
——————————————- বল, আল্লাহ ছাড়া আমি কি অপর কোন রব তালাশ করবো? অথচ তিনিই তো হচ্ছেন সব কিছুর রব। -আল-আন আম-১৬৪
————————————– তিনি মাশরিক-মাগরিব-প্রাচ্য-প্রতীচ্যের রব। তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই, সুতরাং তাঁকেই তোমার উকিল (নিজের সকল ব্যাপারে জামিন ও জিম্মাদার) হিসাবে গ্রহণ করো। -আল-মুজ্জাম্মিল- ৯
———————- তিনিই তো তোমাদের রব, তোমরা ঘুরে ফিরে তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তিত হবে।
—————————————— অতপর তোমাদের রব- এর কাছেই তোমাদের প্রত্যাবর্তন।- যুমার-৭
————————- বল, আমাদের উভয় দলকেই একত্র করবেন। -সাবা-২৬
———————————– ———————- যমীনের বুকে বিচরণশীল যতো প্রাণী রয়েছে, আর দুটো পাখায় ভর করে যেসব পাখী উড়ছে, সে সবের মধ্যে এমন কিছুই নেই, যা তোমাদের মতো দল নয়। আমার দপ্তরে কোন বিষয়ে সন্নিবেশেই ত্রুটি করি নি। অবশেষে তাদের সকলকেই আপণ রব-এর দিকে হাঁকিয়ে নেয়া হবে। -আল-আনআম-৩৮
———————————————– সিঙ্গায় ফুঁক দেয়া মাত্রই তারা নিজ নিজ ঠিকানা থেকে আপণ রব-এর দিকে বেরিয়ে পড়বে।-ইয়াসীন-৫১
তৃতীয় ও চতুর্থ অর্থে:
————————- তারা আল্লাহ্র পরিবর্তে নিজেদের দরবেশ, ওলামা-পাদ্রী-পুরোহিতদেরকে নিজেদের রব বানিয়ে নিয়েছে। (তওবা-৩১)
—————- আর আমাদের কেউ যেন আল্লাহ ছাড়া কাউকে নিজের রব না বানায়।
দুটি আয়াতেই আরবাব (রব-এর বহুবচন) অর্থ সে সব ব্যক্তি, জাতি ও জাতির বিভিন্ন দল, যাদেরকে সাধারণভাবে নিজেদের পথ প্রদর্শক ও নেতা স্বীকার করে নেয়া হতো, যাদেরকে রীতিমত আদেশ- নিষেধের অধিকারী মনে করা হতো।
—————————————————- (ইউসুফ বললেন) অবশ্য তোমাদের একজন তার রবকে শরাব পান করাবে-। তাদের দু’জনের মধ্যে যার সম্পর্কে ইউসুফের ধারণা ছিল, সে মুক্তি লাভ করবে। ইউসুফ তাকে বললেনঃ তোমরা রব- এর কাছে আমার কথা বলো। কিন্তু শয়তান তাকে ভুলিয়ে দিলো, তাই আপন রব-এর কাছেইউসুফের কথা উল্লেখ করতে তার স্মরণ ছিল না। (ইউসুফ-৪১-৪২)
———————- বার্তাবাহক ইউসুফের কাছে হাযির হলে ইউসুফ তাকে বললোঃ তোমার রব-এর কাছে ফিরে যাও এবং তাকে জিজ্ঞেস করো, যেসব মহিলারা নিজেরাই নিজেদের হাত কেটেছিল, তাদের কি অবস্থা। আমার রবতো তাদের চক্রান্ত সম্পর্কে ওয়াকিফহাল আছেনই।-ইউসুফ-৫০
এসব আয়াতে হযরত ইউসুফ (আঃ) মিসরীয়দের সাথে কথাবার্তাকালে মিসরের শাসনকর্তা ফিরাউনকে তাদের রব বলে বারবার উল্লেখ করেছেন। কারণ তারা তখন তার কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব, সার্বভৌমত্ব স্বীকার করতো, তাকে আদেশ-নিষেধের মালিক মনে করেন।
পঞ্চম অর্থেঃ ——————————————————— সুতরাং তাদের উচিত, এ ঘরের মালিকের ইবাদত করা, যিনি তাদের রিজিক সরবরাহের ব্যবস্থা করেছেন এবং ভয়-ভীতি থেকে তাদের নিরাপদ রেখেছেন। কোরাইশ-৩-৪
————– তোমার রব- যিনি সম্মান ও ক্ষমতার মালিক-ওরা তাঁর সম্পর্কে যেসব দোষ- ত্রুটির কথা বলছে, তিনি সেসব থেকে মুক্ত-পবিত্র।
————————- আল্লাহ, যিনি আরশের মালিক-তারা যেসব দোষ-ত্রুটির কথা বলছে তিনি সে সব হতে মুক্ত পবিত্র। আল-আম্বিয়া-২২
———– জিজ্ঞেস কর, সপ্ত আসমান ও মহান আরশের মালিক কে?
——————— তিনি আসমান-যমীন এবং আসমান-যমীনে যা কিছু আছে, তৎসমুদয়ের মালীক। যেসব বস্তুর ওপর সূর্য উদয় হয়, তিনি তারও মালিক।
———— আর তিনিই তো শি’য়রা (নক্ষত্র বিশেষের নাম)-এর মালিক, রব।
রুবুবিয়াত সম্পর্কে পথভ্রষ্ট জাতিসমুহের ভ্রান্ত ধারণা
এসব সাক্ষ্য -প্রমাণ দ্বারা রব শব্দের অর্থ একান্ত সন্দেহাতীতভাবে নির্ণীত হয়েছে। এখন আমাদের দেখা উচিত, রুবুবিয়াত সম্পর্কে গোমরাহ জাতিসমূহের কি সব ভ্রান্ত ধারণা ছিলো, যার অপনোদনের জন্যে কোরআনের আবির্ভাব ঘটেছে এবং কোন্ জিনিসের দিকে কোরআন ডাকছে। কোরআন যেসব গোমরাহ জাতির উল্লেখ করেছে, পৃথক পৃথকভাবে সেসব বিষয়ে আলোচনা করা এ ব্যাপারে অধিক সমীচীন হবে, যাতে বিষয়টি সম্পূর্ণ স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে।
নূহ (আঃ) -এর জাতি
কোরআন সর্বপ্রথম যে জাতির উল্লেখ করেছে, তা হচ্ছে হযরত নুহ (আঃ)-এর জাতি। কোরআনের বর্ণনা থেকে স্পষ্ট জানা যায় যে, এরা আল্লাহ্র অস্তিত্বে অবিশ্বাসী ছিল না- তাঁর অস্তিত্ব অস্বীকার করতো না। হযরত নুহ (আঃ) -এর দাওয়াতের জবাবে তাদের এ উক্তি স্বয়ং কোরআনই নকল করছেঃ
————————————————– এ ব্যক্তি তো তোমাদেরই মতো একজন মানুষ বৈ কিছুই নয়, মূলত সে তোমাদের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করতে চায়। তা না হলে আল্লাহ যদি কোন রাসূল প্রেরণ করতে চাইতেন তবে ফেরেশতাই পাঠাতেন।
আল্লাহ যে খালেক-স্রষ্টা, প্রথম ও দ্বিতীয় অর্থে তিনি যে রব তাও তারা অস্বীকার করতো না। হযরত নূহ (আঃ) যখন তাদেরকে বলেছিলেনঃ
——————————– তিনিই তোমাদের রব। তাঁরই নিকট তোমাদের ফিরে যেতে হবে।
——————————————– তোমাদের রব-এর নিকট ক্ষমা চাও; তিনি বড়ই ক্ষমাশীল।
———————————————————————————– তোমরা কি দেখছো না যে, আল্লাহ কিভাবে স্তরে স্তরে সপ্ত আসমান সৃষ্টি করেছেন, আর তার মধ্যে চন্দ্রকে নূর ও সূর্যকে চেরাগ করেছেন, তোমাদেরকে পয়দা করেছেন যমীন থেকে। -নূহ-১৫-১৬
তখন তাদের কেউ এমন কথা বলেনি- আল্লাহ আমাদের রব নয় অথবা আসমান-যমীন ও আমাদেরকে তিনি সৃষ্টি করেন নি অথবা আসমান-যমীনের এসব ব্যবস্থাপনা তিনি পরিচালনা করছেন না।
আল্লাহ তাদের ইলাহ-একথাও অস্বীকার করতো না। এজন্যেই হযরত নূহ (আঃ) তাদের সামনে তাঁর দাওয়াত পেশ করেছেন এ ভাষায়ঃ
———— ‘তিনি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোন ইলাহ নেই’;
অন্যথায় তারা যদি আল্লাহ্কে ইলাহ বলে স্বীকার না করতো- তাহলে দাওয়াতের ভাষা হতোঃ
——————- ‘তোমরা আল্লাহকে ইলাহ বলে স্বীকার করো’।
এখন প্রশ্ন দাঁড়ায়, তাহলে তাদের সাথে হযরত নূহ (আঃ) -এর বিরোধ ছিলো কি নিয়ে-কোন বিষয়ে? কোরআনের আয়াত সন্ধান করে জানা যায় যে, বিরোধের কারণ ছিলো দুটিঃ
একঃ হযরত নূহ (আঃ) এর শিক্ষা ছিলো এই যে, যিনি রব্বুল আলামীন, তোমরাও যাকে তোমাদের ও সমগ্র বিশ্ব-জাহানের স্রষ্টা বলে স্বীকার করো, যাকে তোমরা সকল প্রয়োজন পূরণকারী বলে বিশ্বাস করো, কেবল তিনিই তোমাদের ইলাহ-অন্য কেউ নয়। তিনি ব্যতীত আর কোন ইলাহ নেই। তোমাদের অভাব-অভিযোগ পূরণ করতে পারে, সংকট-সমস্যা দূর করতে পারে, দোয়া শুনতে পারে এবং সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারে-এমন কোন সত্তা নেই। সুতরাং তোমরা কেবল তাঁরই সামনে মস্তক অবনত করো-তাঁকেই আনুগত্য লাভের যোগ্য বলে স্বীকার করোঃ
————– হে আমার জাতির লোকেরা! তোমরা আল্লাহ্র ইবাদত করো; তিনি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোন ইলাহ নেই। ……….. কিন্তু আমি রাব্বুল আলামীনের তরফ থেকে রাসূল। আপন রব-এর পয়গাম তোমাদের নিকট পৌছাই।-আল-আরাফ-৫৯-৬০
অপর পক্ষে তারা জিদ ধরে বসেছিলো, আল্লাহ্র ব্যবস্থাপনায় অন্যদেরও কম-বেশী দখল আছে। তাদের সাথেও আমাদের নানাবিধ প্রয়োজন জড়িত রয়েছে। সুতরাং আমরা আল্লাহ্র সাথে অন্যদেরকেও ইলাহ স্বীকার করবোঃ
————————– তাদের নেতা-কর্তারা বললো, লোক সকল!তোমাদের ইলাহকে কিছুতেই ছাড়বে না-ছাড়বে না ওয়াদ্দ, সুয়া, ইয়াগুস, ইয়াউক ও নাসর-কে।-নূহ-২৩
দুইঃ আল্লাহ তাদের স্রষ্টা-খালেক, আসমান-যমীনের মালিক এবং বিশ্বজাহানের প্রধান ব্যবস্থাপক-নিয়ন্ত্রক-পরিচালক – কেবল এ অর্থেই তারা আল্লাহ্কে রব স্বীকার করতো। কিন্তু তারা এ কথা স্বীকার করতো না যে, নৈতিক চরিত্র, সমাজ, তমুদ্দুন, রাজনীতি ও জীবনের সকল ব্যাপারেও সার্বভৌমত্ব ও সর্বোচ্চ ক্ষমতা লাভের অধিকার একমাত্র তাঁরই, তিনিই পথ প্রদর্শক, আইন প্রণেতা, আদেশ-নিষেধের অধিকার একমাত্র তাঁরই, তিনিই পথ প্রদর্শক, আইন প্রণেতা, আদেশ-নিষেধের অধিকারী; আনুগত্যও হবে একমাত্র তাঁরই, এসব ব্যাপারে তারা নিজেদের সর্দার ও ধর্মীয় নেতাদেরকে রব বানিয়ে নিয়েছিলো। পক্ষান্তরে হযরত নূহ (আঃ) -এর দাবী ছিলো-রুবুবিয়াত অবিভাজ্য, তাকে বিভক্ত ও খন্ডিত করো না। সকল অর্থে কেবল আল্লাহ্কেই রব স্বীকার করো। তাঁর প্রতিনিধি হিসাবে আমি তোমাদের যেসব আইন- বিধান পৌছাই, তোমরা তা মেনে চলোঃ
————————————————- আমি তোমাদের জন্যে আল্লাহ্র বিশ্বস্ত রাসূল। সুতরাং আল্লাহ্ কে ভয় করো এবং আমার আনুগত্য করো। -আশ-শোয়ারা-১০৭-১০৮
আদ জাতি
নূহ (আঃ) -এর জাতির পরে কোরআন আদ জাতির কথা আলোচনা করেছেন। এ জাতিও আল্লাহর অস্তিত্ব অস্বীকার করতো না। হযরত নূহ (আঃ)-এর জাতি যে অর্থে আল্লাহ্কে রব স্বীকার করতো, সে অর্থে এরাও আল্লাহ্কে মানত। অবশ্য দুটি বিষয় বিরোধের ভিত্তি ছিলো, যা ওপরে নূহ (আঃ)-এর জাতির প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে, কোরআনের নিম্নোক্ত স্পষ্ট ঘোষণা এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট প্রমাণ দিচ্ছেঃ
—————————————– এবং তাদের প্রতি আমরা তার ভাই হূদকে পাঠিয়েছি। তিনি বললেন, হে আমার জাতির লোকেরা! তোমার আল্লাহ্র ইবাদত করো। তিনি ব্যতীত তোমাদের কোন ইলাহ নেই।………… তারা বললো! আমরা কেবল আল্লাহ্র ইবাদত করবো, আমাদের বাপ-দাদার যুগ থেকে যেসব মাবুদের ইবাদত চলে আসছে, তাকে পরিত্যাগ করবো-এর জন্যই কি তোমার আগমন?- আল- আরাফ-৬৫-৭০
—————————– তারা বললো, আমাদের রব ইচ্ছা করলে ফেরেশতা প্রেরণ করতেন।
———————————- এরাই তো আদ, যারা তাদের রব-এর বিধান মানতে অস্বীকার করেছিলো, তাঁর রাসূলের আনুগত্য কবূল করে নি এবং সত্যের দুশমন ঔদ্ধত্যপরায়ণের অনুসরণ করেছিল। হূদ-৫৯
সামুদ জাতি
এবার সামুদ জাতি সম্পর্কে শুনুন। আদের পর এরা ছিলো সবচেয়ে ঔদ্ধত্যপরায়ণ জাতি। নূহ (আঃ) ও আদ জাতির গোমরাহীর কথা আলোচনা করা হয়েছে। মূলত এদের গোমরাহীও ছিলো সে ধরনেরই। আল্লাহ-ই একমাত্র ইলাহ, কেবল তিনিই ইবাদতের অধিকারী, রুবুবিয়াত সকল অর্থে কেবল আল্লাহ্র জন্যেই নির্দিষ্ট – এ কথা তারা স্বীকার করতো না। তারা আল্লাহ ছাড়া অন্যকেও ফরিয়াদ গ্রহণকারী, সংকট মুক্তকারী এবং অভাব পূরণকারী বলে স্বীকার করতে জিদ ধরে বসেছিলো। নিজেদের নৈতিক ও তমুদ্দুনিক জীবনে আল্লাহ ছাড়া সর্দার, মাতব্বর এবং নেতা-কর্তা ব্যক্তিদের আনুগত্য করতে এবং তাদের কাছ থেকে নিজেদের জীবন বিধান গ্রহণ করতে তারা বদ্ধপরিকর ছিলো। শেষ পর্যন্ত এটাই তাদের ফাসাদকারী জাতি-বিপর্যয় সৃষ্টিকারী কওম এবং পরিণামে আজাবে নিপতিত হওয়ার কারণ হয়েছে। নিম্নোক্ত আয়াতসমুহ থেকে এর স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়ঃ
————- (হে মুহাম্মদ !) এরা যদি তোমার আনুগত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে তাদের বলে দাও যে, আদ-সামুদ যে শাস্তি পেয়েছিলো, তেমনি এক ভয়ংকর শস্তি সম্পর্কে আমি তোমাদের ভয় প্রদর্শন করছি। সেসব জাতির নিকট যখন তাদের অগ্র-পশ্চাৎ থেকে রাসূল এসেছিলেন আর বলেছিলেন, আল্লাহ ছাড়া আর কারো ইবাদত-বন্দেগী করো না, তখন তারা বলেছিলো, আমাদের রব ইচছা করলে ফেরেশতা পাঠাতেন; সুতরাং যা কিছু নিয়ে তোমাদের আগমন, আমরা তা মানি না- স্বীকার করি না।
————————————- আর সামুদের প্রতি প্রেরণ করেছিলাম আমরা তাদের ভাই ছালেহকে। তিনি বললেন; হে আমার জাতির ভাইয়েরা! আল্লাহর ইবাদত করো, তিনি ছাড়া তোমাদের কোন ইলাহ নেই। তারা বললো; ছালেহ! আগে তো তোমার সম্পর্কে আমাদের বিরাট আশা ভরসা ছিলো। বাপ -দাদার যুগ থেকে যাদের ইবাদত চলে আসছিলো, তুমি কি আমাদেরকে তাদের ইবাদত থেকে বারণ করছো?- (ছুরা হূদ-৬১-৬২)
———————————————- যখন তাদের ভাই ছালেহ তাদেরকে বলছিলো; তোমাদের কি নিজেদেরকে রক্ষা করার কোন চিন্তা নেই? দেখ, আমি তোমাদের জন্যে আল্লাহর নির্ভরযোগ্য রাসূল। সুতরাং আল্লাহর অসন্তুষ্টি থেকে নিবৃত্ত থাকো, আর আমার আনুগত্য করো। ……. সেসব সীমা লংঘনকারীর আনুগত্য করো না, যারা পৃথিবীতে বিপর্যয় র্সৃষ্টি করে, কোন কল্যাণই সাধন করে না।
ইবরাহীম (আঃ) — এর জাতি ও নমরূদ
এরপর আসে হযরত ইবরাহীম (আঃ) -এর জাতির কথা। এ জাতির ব্যাপারটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সাধারণ্যে একটি ভুল ধারণা প্রচলিত আছে যে, তাদের বাদশা নমরূদ আল্লাহ অস্বীকার করতো এবং নিজেকে খোদা বলে দাবী করতো। অথচ সে আল্লাহর অস্তিত্ব স্বীকার করতো, তাঁকে খালেক-স্রষ্টা এবং বিশ্ব-নিয়ন্তা বলে বিশ্বাস করতো। কেবল তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম অর্থে নিজেকে রব বলে দায়ী করতো। এ ভূল ধারণাও ব্যাপক দেখা যায় যে, এ জাতি আল্লাহ সম্পর্কে সম্পুর্ণ অনবহিত ছিল-তাঁকে রব ও ইলাহ বলে আদৌ স্বীকারই করতো না, অথচ নূহ, আদ-সামুদ থেকে এদের ব্যাপার মোটেই ভিন্ন ছিল না। তারা আল্লাহর অস্তিত্ব স্বীকার করতো। তিনি যে রব, আসমান-জমীনের স্রষ্টা ও বিশ্ব জাহানের নিয়ন্তা-তাও তারা জানতো, তাঁর ইবাদতকেও তারা অস্বীকার করতো না। অবশ্য তাদের গোমরাহী ছিল এই যে, রুবুবিয়াতের প্রথম ও দ্বিতীয় অর্থে তারা গ্রহ-নক্ষত্রকেও অংশীদার মনে করতো, আর এ ভিত্তিতে সে সবকেও আল্লাহর সাথে মাবুদ বলে ধরে নিতো। রুবুবিয়াতের তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম অর্থে তারা নিজেদের বাদশাদেরকে রব বানিয়ে রেখেছিল। এ ব্যাপারে কোরআনের স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন উক্তি সত্ত্বেও মানুষ কি করে আসল ব্যাপারটি বুঝতে পারল না তা দেখে অবাক হতে হয়। সর্বপ্রথম হযরত ইবরাহীম (আঃ) -এর বোধেদয়ের ঘটনাটি দেখুন। এতে তাঁর নবুয়াত-পূর্ব জীবনের সত্যানুসন্ধানের চিত্র অংকিত হয়েছেঃ
——————————————–
রাত যখন তাঁর উপর আঁধারের আবরণ ছড়িয়ে দিলো, তিনি একটি তারকা দেখতে পেলেন, বলে উঠলেন; এই তো আমার রব; কিন্তু তা ডুবে গেলে তিনি বললেন; ডুবন্ত জিনিসকে আমি পছন্দ করি না। আবার যখন দেখলেন, চাঁদ ঝলমল করছে, বললেন; এই তো আমার রব ! কিন্তু তাও যখন ডুবে গেলো, তখন বললেন; আমার রব যদি আমাকে হেদায়েত না করেন তাহলে আশংকা হচ্ছে আমিও সেসব গোমরাহ লোকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়বো। আবার সূর্যকে রওশন দেখে বললেন; এই তো আমার রব-এতো দেখছি সবচেয়ে বড়! কিন্তু তাও যখন ডুবে গেলো তখন তিনি চিৎকার করে বলে উঠলেন; হে আমার জাতির লোকেরা। তোমরা যে শিরক করেছো, তার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। আমি সকল দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে সে মহান সত্তার দিকে একাগ্র মনে নিবিষ্ট হলাম, যিনি আসমান-যমীন সৃষ্টি করেছেন। আমি মুশরিকদের পর্যায়ভুক্ত না। -আল-আনআম-৭৭-৮০
রেখা চিহ্নিত বাক্যাংশগুলো থেকে স্পষ্টত জানা যায় যে, যে সমাজে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) চক্ষু খুলেছিলেন, সে সমাজে আসমান-যমীনের স্রষ্টা মহান সত্তার রব হওয়া এবং সেসব গ্রহ-নক্ষত্রের রুবুবিয়াতের ধারণা এক ছিলো না। এরূপ হবে না কেন, যেসব মুসলমান হযরত নূহ (আঃ) -এর ওপর ঈমান এনেছিলো, তারা ছিলো সে বংশেরই লোক। তাদের নিকটাত্মীয়, প্রতিবেশী জাতিসমূহ (আদ-সামুদা)-এর মধ্যে উপর্যুপরি আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামের মাধ্যমে দীন ইসলামের নবায়নের কাজও চলছিলো।
——————————–
সুতরাং আল্লাহ্র আসমান-যমীনের স্রষ্টা এবং রব হওয়ার ধারণা হযরত ইবরাহীম (আঃ) আপন সমাজ থেকেই লাভ করেছিলেন। অবশ্য তাঁর মনে যেসব প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছিলো, তা ছিলো এই যে, প্রতিপালন ব্যবস্থায় আল্লাহ্র সাথে চন্দ্র-সূর্য ও গ্রহ-নক্ষত্রের অংশীদার হওয়ার যে ধারণা তাঁর জাতির মধ্যে পাওয়া যেতো এবং যার ভিত্তিতে তারা ইবাদতেও আল্লাহ্র সাথে শরীক করতো, তা কতটুকু বাস্তবানুগ।১ নবুয়াতের পূর্বে তিনি এ সত্যেরই সন্ধান করে বেড়িয়েছেন, উদয়-অস্ত বিধান তাঁর জন্যে এ বাস্তব তত্ত্বে উপনীত হতে সহায়ক হয়েছে যে, আসমান-যমীনের স্রষ্টা ছাড়া আর কোন রব নেই। এ কারণে চন্দ্রকে ডুবতে দেখে তিনি বলেন, আমার রব অর্থাৎ আল্লাহ্ যদি আমাকে পথ প্রদর্শন না করেন তবে আশংকা হচ্ছে আমিও বাস্তব সত্যে উপনীত হতে ব্যর্থ হবো। আমার আশেপাশের লাখ লাখ মানুষ যেসব দৃশ্য দেখে প্রতারিত হচ্ছে, আমিও তা দ্বারা প্রতারিত হয়ে পড়বো।
অতপর হযরত ইবরাহীম (আঃ) নবুয়াতের পদে অভিষিক্ত হলেন এবং তিনি আল্লাহ্র পথে আহ্বানের কাজ শুরু করেনঃ তখন যে ভাষায় তিনি দাওয়াত পেশ করেন, তা নিয়ে চিন্তা করলে আমাদের উপরিউক্ত উক্তি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তিনি বলেনঃ
১. এখানে একটি বিষয়ের উল্লেখ অপ্রাসঙ্গিক হবে না। হযরত ইবরাহীম (আঃ) -এর দেশ ‘উর’ সম্পর্কে প্রত্বতাত্ত্বিক খোদাই করে যেসব তথ্য উদঘাটিত হয়েছে, তা থেকে জানা যায় যে, সেখানে চন্দ্র-দেবতার উপাসনা হতো। তাদের ভাষায় একে বলা হতো নান্নার (–) আর তাদের আশেপাশের এলাকায়-যার কেন্দ্র ছিলো লারসা (–) সূর্য দেবতার পূজা হতো। তাদের ভাষায় একে বলা হতো শামাশ (—-)। সে দেশের শাসক বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিল আরনামু (—)। আরবে গিয়ে তার নাম হয়েছে নমরূদ। তার নামানুসারে সেখানকার উপাধি হয়েছে নমরূদ, যেমন নিযামুল মূলক-এর স্থলাভিষিক্তকে বলা নিযাম।
———————————————- তোমরা যাকে আল্লাহ্র শরীক করছো, শেষ পর্যন্ত আমি তাকে কি করে ভয় করতে পারি? অথচ তোমরা আল্লাহ্র সাথে তাদেরকে শরীক করতে ভয় করছো না, উলুহিয়াত-রুবুবিয়াতে তাদের অংশীদারিত্বের ব্যাপারে আল্লাহ্ তোমাদের প্রতি কোন প্রমাণ নাযিল করেন নি।
——————————- আল্লাহ্ ছাড়া আর যাদের নিকট তোমরা দোয়া করো, আমি তাদের কাছ থেকে হাত গুটিয়ে নিচ্ছি। -মরিয়াম-৪৮
—————————————- সে বললো, তোমাদের রব তো শুধু আসমান যমীনের রব, যিনি এসব কিছু সৃষ্টি করেছেন।… বললো, তবে কি তোমরা আল্লাহ্কে বাদ দিয়ে এসব রবের ইবাদত করছো, তোমাদের কল্যাণ-অকল্যাণের কোন ইখতিয়ারই যাদের নেই?-আল-আম্বিয়া-৫৬-৬৬
———————————– যখন ইবরাহীম তাঁর পিতা এবং জাতিকে বললেন, এ তোমরা কার ইবাদত করছো? আল্লাহ্কে বাদ দিয়ে নিজেদের বানানো ইলাহ’র বন্দোগী করতে চাও? তাহলে রাব্বুল আলআমীন সম্পর্কে তোমাদের কি ধারণা?-সাফ্ফাত-৮৫-৮৭
——————————————- ইবরাহীম ও তাঁর সাথী মুসলমানরা তাঁর জাতির লোকদের পরিষ্কার বলে দিয়েছিলেন, তোমাদের এবং আল্লাহ্ ছাড়া আর যাদের তোমরা ইবাদত করো, তাদের সাথে আমার কোন সম্পর্কে নেই। আমি তোমাদের নিয়ম-নীতি মানতে অস্বীকার করছি। তোমরা যতক্ষন না এক আল্লাহ্র ঈমান আনবে, ততক্ষণ তোমাদের ও আমাদের মধ্যে চিরতরে শত্রুতা ও বিদ্বেষের বুনিয়াদ রচিত হলো।-মুমতাহেনা-৪
হযরত ইবাহীম (আঃ)- এর এসব উক্তি থেকেই স্পষ্ট জানা যায় যে, যারা আল্লাহ সম্পর্কে সর্ম্পূণ অনবহিত ছিলো, তাঁকে রব্বুল আলামীন ও মাবুদ বলে স্বীকার করতো না অথবা যাদের অন্তরে কোন ধারনাই বদ্ধমূল ছিলো না তিনি এমন লোকেদের সম্বোধন করেন নি, বরং তিনি সম্বোধন করেছেন সেসব লোকেদের, যারা আল্লাহ্র সাথে রুবুবিয়াত (প্রথম ও দ্বিতীয় অর্থে) ও উলুহিয়াতে অন্যদেরকেও শরীক করতো। এজন্যেই সমগ্র কোরআনের একটি স্থানেও হযরত ইবরাহীম (আঃ) -এর এমন উক্তিও বিদ্যমান নেই, যাতে তিনি তাঁর জাতিকে আল্লাহ্র অস্তিত্ব এবং তাঁকে ইলাহ-রব স্বীকার করবার চেষ্টা করেছেন, বরং সর্বত্রই তিনি এ দাওয়াত দিয়েছেন যে, আল্লাহ্-ই রব ও ইলাহ।
এবার নমরূদের ব্যাপারটি দেখুন। তার সাথে হযরত ইবরাহীম (আঃ) -এর যে কথাবার্তা হয়েছে, কোরআন তাকে উল্লেখ করেছে এভাবেঃ
————————————— তুমি কি সে ব্যক্তিকে দেখেছো, যে ইবরাহীমের সাথে তার রব-এর ব্যাপারে বিতর্ক করেছে? তা করেছিলো এ-জন্যে যে, আল্লাহ্ তাকে রাষ্ট্র-ক্ষমতা দান করেছিলেন। ইবরাহীম যখন বললেন, জীবন-মৃত্যু যাঁর হাতে তিনি আমার ইখতিয়ারাধীন।ইবরাহীম বললেন, সত্য কথা এই যে, আল্লাহ্ পূর্ব দিক থেকে সূর্য উদিত করেন এবার দেখি, তুমি তা পশ্চিম দিক থেকে উদিত করাও তো! একথা শুনে সে কাফের হতভম্ব হয়ে পড়লো।-বাকারা-২৫৮
এ কথাবার্তা থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, আল্লাহ্ আছেন বা নেই-তা নিয়ে বিরোধ ছিলো না, বরং বিরোধ ছিলো ইবরাহীম (আঃ) কাকে রব স্বীকার করেন, তা নিয়ে। যে জাতি আল্লাহ্র অস্তিত্ব স্বীকার করতো, প্রথমত, সে জাতির সাথে নমরূদের সম্পর্ক ছিলো। দ্বিতীয়ত, একেবারেই পাগল না হয়ে যাওয়া পযর্ন্ত সে এমন স্পষ্টত নির্বোধসুলভ উক্তি করতে পারে না যে,সে নিজেই আসমান-যমীনের স্রষ্টা, চন্দ্র-সূর্যের আবর্তন-বিবর্তনকারী। আমিই আল্লাহ্, আসমান যমীনের রব-মূলত তার এ দাবী ছিল না, বরং তার দাবী ছিল এই যে, আমি সে রাজ্যের রব, ইবরাহীম যে রাজ্যের সদস্য। রুবুবিয়াতের প্রথম ও দ্বিতীয় অর্থেও নিজের রব হওয়ার এ দাবী তার ছিলো না; কারণ এ অর্থের সে নিজেই চন্দ্র-সূর্য এবং গ্রহ-নক্ষত্রের রব আল্লাহ্কে স্বীকার করতো। অবশ্য তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম অর্থে সে নিজেকে নিজ রাজ্যের রব বলে দাবী করতো অর্থাৎ তার দাবী ছিলো এই যে, আমি এ রাজ্যের মালিক, রাজ্যের সকল অধিবাসী আমার বান্দা-দাসানুদাস। আমার কেন্দ্রীয় ক্ষমতা তাদের সম্মিলনের ভিত্তিমূল। আর আমার নির্দেশ -ফরমান তাদের জন্যে আইন-বিধান। তার রুবুবিয়াতের দাবীর ভিত্তি ছিলো বাদশাহীর অহমিকা,————– (এজন্যে যে, আল্লাহ্ তাকে রাজ্য-ক্ষমতা দান করেছেন) বাক্যটি এ দিকে স্পষ্ট ইঙ্গিত করছে। সে যখন জানতে পারলো যে, তার রাজ্যে ইবরাহীম নামক জনৈক নওজোয়ানের আবির্ভাব হয়েছে, সে চন্দ্র-সূর্য ও গ্রহ-নক্ষত্রের অতি প্রাকৃতিক রুবুবিয়াত স্বীকার করে না, স্বীকার করে না যুগসম্রাটের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক রুবুবিয়াত তখন অবাক-স্তম্ভিত হয়ে সে হযরত ইবরাহীম (আঃ) -কে ডেকে জিজ্ঞেস করলো, তাহলে তুমি কাকে রব বলে স্বীকার করো? হযরত ইবরাহীম (আঃ) প্রথমে বললেন, আমার রব তিনি, জীবনমৃত্যুর ইখতিয়ার যার হস্তে নিহিত। কিন্তু এ জবাব শুনে সে ব্যাপারটির গভীর প্রবেশ করতে পারলো না। এ বলে সে আপন রুবুবিয়াত প্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্টা করলো যে, জীবন-মৃত্যুর ইখতিয়ার তো আমারও আছে; যাকে খুশী হত্যা করতে পারি, আর যাকে খুশী জীবন দান করতে পারি। তখন ইবারাহীম (আঃ) তাকে বললেন, আমি কেবল আল্লাহ্কেই রব বলে স্বীকার করি; রুবুবিয়াতের সকল অর্থের বিচারে কেবল আল্লাহ্ই আমার রব। বিশ্বজাহানের পরিচালনা ব্যবস্থায় অন্য কারো রুবুবিয়াতের অবকাশ-ই বা কোথায়? সূর্যের উদয়-অস্তে তাদের তো বিন্দুমাত্রও প্রভাব নেই-নেই কোন কর্তৃত্ব। নমরূদ ছিল ধূরন্ধর। এযুক্তি শোনে তার কাছে এ সত্য উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো যে, বস্তুত আল্লাহ্র এ রাজ্যে তাঁর রুবুবিয়াতের দাবী বাতুলতা বৈ কিছুই নয়! তাই সে হতভম্বঃ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লো। কিন্তু আত্মশ্লাঘা এবং ব্যক্তিগত ও বংশগত স্বার্থের মোহ স্বেচ্ছাচারী রাজত্ব-কর্তৃত্বের আসন ত্যাগ করে আল্লাহ্ ও তার রসূলের আনুগত্য গ্রগণ করার জন্যে উদ্বুদ্ধ হলো না। এ কারণেই কথাবার্তা উল্লেখ শেষে আল্লাহ্ তায়ালা বলেনঃ
————- কিন্তু জালেম জাতিকে আল্লাহ্ হেদায়েত দান করেন না। অর্থাৎ সত্য উদ্ভাসিত হওয়ার পর তার যে পন্থা অবলম্বন করা উচিত ছিলো, তা অবলম্বরন করতে সে যখন প্রস্তুত হলো না, বরং ঔদ্ধত্যপরায়ণ কৃর্তত্ব দ্বারা সে যখন দুনিয়া ও আপন আত্মার ওপর যুলুম করাই শ্রেয় জ্ঞান করলো, তখন আল্লাহ্ও তাকে হেদায়েতের আলো দান করলেন না। কারণ যে ব্যক্তি হেদায়েত লাভ করতে আগ্রহী নয়, তার ওপর জোর করে হেদায়েত চাপিয়ে দেয়া আল্লাহ নীতি নয়।
লুত জাতি
হযরত ইবরাহীম (আঃ) -এর জাতির পর আমাদের সামনে আসে এমন এক জাতি যাদের সংস্কার–সংশোধনের জন্য হযরত ইবরাহীম (আঃ) -এর ভাইপো হযরত লূত (আঃ) আদিষ্ট হয়েছিলেন। এ জাতি সম্পর্কেও আমরা কোরআন থেকে জানেত পারি যে, তারা আল্লাহ্র অস্তিত্ব অস্বীকার করতো না। আল্লাহ্ স্রষ্টা এবংপ্রথম ও দ্বিতীয় অর্থে রব-এ কথাও তারা অস্বীকার করতো না। অবশ্য তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম অর্থে তাঁকে রব স্বীকার করে তাঁর বিশ্বস্ত প্রতিনিধি হিসাবে রসূলের নেতৃত্ব গ্রহণ করতে তাদের আপত্তি ছিলো। নিজেদের মনের অভিলাষ অনুযায়ী যেভাবে খুশী তারা কাজ করতে চাইতো, এ -ই ছিলো তাদের মূল অপরাধ। এ কারণেই তারা আজাবে নিপতিত হয়েছিলো। কোরআনের নিম্নোক্ত স্পষ্টোক্তি তার প্রমাণঃ
———————————– যখন তাদের ভাই লূত তাদের বললো, তোমরা কি তাকওয়া অবলম্বন করবে না? দেখ, আমি তোমাদের জন্যে বিশ্বস্ত রসূল। সুতরাং আল্লাহ্র গজব থেকে বিরত থাকো এবং আমার আনুগত্য কর। এ কাজের জন্যে আমি তোমাদের কাছে কোন বিনিময় চাই না। আমার বিনিময় তো কেবল আল্লাহ্ রববুল আলামীনের জিম্মায়। দুনিয়ার মানুষের মধ্যে তোমরা কি কেবল ছেলেদের নিকটই ছুটে যাও? তোমাদের রব তোমাদের জন্যে যে নারী সৃষ্টি করেছেন, তাদের পরিত্যাগ কর? তোমরা তো দেখছি একান্তই সীমালংঘনকারী জাতি!-আশ-শোয়ারা-১৬১-১৬৬
এ কথা স্পষ্ট যে, আল্লাহ্র অস্তিত্ব তিনি যে স্রষ্টা ও প্রতিপালক তা অস্বীকার করে না- এমন জাতির উদ্দেশ্যই এ সম্বোধন হতে পারে। তাই আমরা দেখতে পাই, জবাবে তারাও বলে নি যে, আল্লাহ্ আবার কি জিনিস অথবা কে সে স্রষ্টা অথবা সে আবার কোথা থেকে আমাদের রব সেজে বসলো? বরং তারা বলছেঃ
————————- লূত! তুমি যদি তোমার বক্তব্য থেকে নিবৃত্ত না হও, তা হলে দেশ থেকে বিতাড়িত হবে। -আশ-শোয়ারা-১৬৭
অন্যত্র এ ঘটনা এভাবে বিবৃত হয়েছে:
——————————————— “ আর আমরা লূতকে প্রেরণ করেছি! য”খন তিনি নিজের জাতিকে বললেন; তোমরা এমন দুষ্কর্ম করছো, যা তোমাদের আগে দুনিয়ায় কেউ করে নি। তোমরা কি পুরুষদের সাথে যৌন-কর্ম করছো? রাস্তায় লুন্ঠন চালাও এবং প্রকাশ্য মজলিসে একে অন্যের সামনে কুকর্ম কর? তখন তাঁর জাতির জবাব এছাড়া আর কিছুই ছিলো না- তুমি সত্য হলে আমাদের ওপর আল্লার আজাব নিয়ে এসো। -আনকাবুত-২৮-২৯ কোন আল্লাহ্ বিরোধী জাতির কি এ জবাব হতে পারে? সুতরাং জানা কথা যে, উলুহিয়াত ও রুবুবিয়াত-অস্বীকার করা তাদের আসল ছিলো না, বরং তাদের মূল “অপরাধ ছিল এই যে, অতি- প্রাকৃতিক অর্থে তারা আল্লাহ্কে ইলাহ ও রব বলে স্বীকার করলেও নৈতিকথা, তমুদ্দুন ও সমাজ জীবনে আল্লাহ্র আনুগত্য রাসূলের হেদায়াত অনুযায়ী চলতে প্রস্তুত ছিলো না তারা।
শোয়াইব জাতি
এবার মাদইয়ান ও আইকাবাসীদের কথা ধরুন। এদের প্রতি হযরত শোয়াবই (আঃ) প্রেরিত হয়েছিলেন। এদের সম্পর্কে আমরা জানি এরা হযরত ইবরাহীম (আঃ) -এর বংশধর ছিলো। সুতরাং তারা আল্লাহ্র অস্তিত্বে বিশ্বাস করতো কিনা? তাঁকে ইলাহ-রব স্বীকার করতো কিনা? সে প্রশ্নই ওঠে না। বম্তুত তাদের পজিশন ছিলো এমন জাতির, ইসলাম থেকেই যাদের সূচনা হয়েছিলো, পরে আকীদা-বিশ্বাস ও কর্মের বিকৃতিতে পড়ে তারা পরিবর্তিত হয়ে যায় বরং তারা মুমিনের দাবীদারছিলো বলেও কোরআন থেকে অনেকটা মনে হয়। তাইতো আমরা দেখতে পাই, হযরত শোয়াইব (আঃ) তাদের বারবার বলেছেন, ‘তোমরা মুমিন হলে, তোমাদের এ করা উচিত।’ হযরত শোয়াইব (আঃ) -এর সকল বক্তৃতা এবং তাদের জবাবসমূহ দৃষ্টে স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় যে, তারা এমন এক জাতি ছিল, যারা আল্লাহ্কে মানতো। তাঁকে মাবুদ-পরওয়ারদেগারও স্বীকার করতো। অবশ্য দু’ধরনের গোমরাহীতে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিলো। একঃ অতি প্রাকৃতিক অর্থে তারা আল্লাহ্ ছাড়া অন্যদেরকেও ইলাহ ও রব মনে করে বসেছিলো, তাই তাদের ইবাদত নিছক আল্লাহ্র জন্যে নিদির্ষ্ট ছিলো না। দুইঃ তাদের মতে, মানুষের নৈতিক চরিত্র, সমাজ-নীতি, অর্থনীতি ও রাজনীতি-সংস্কৃতির সাথে আল্লাহ্র রুবুবিয়াতের কোন সম্পর্ক ছিল না। এজন্যেই তারা বলতো যে, তমুদ্দনিক জীবনে আমরা স্বাধীন। যেভাবে খুশী, নিজেদের কাজ-কর্ম আঞ্জাম দেবো।
কোরআনের নিম্নোক্ত আয়াতগুলো আমাদের এ উক্তির যথার্থতা প্রতিপন্ন করেঃ
——————– এবং মাদইয়ানের প্রতি আমরা তাদের ভাই শোয়াইবকে প্রেরণ করেছি। তিনি বললেন হে আমার জাতির ভাইয়েরা! আল্লাহ্র ইবাদত কর; তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন ইলাহ নেই। তোমাদের রব-এর তরফ থেকে তোমাদের কাছে স্পষ্ট হেদায়েত এসেছে। সুতরাং ওজন-পরিমাপ ঠিক করে করবে। লোকেদেরকে তাদের জিনিস কম দেবে না। যমীনে শান্তি-শৃংখলা স্থাপিত হওয়ার পর বিপর্যয় সৃষ্টি করো না। তোমরা যদি মুমিন হও, এতেই তোমাদের জন্যে কল্যাণ নিহিত রয়েছে…. যে হেদায়েতসহ আমি প্রেরিত হয়েছি, তোমাদের একটি ক্ষুদ্র দলও যদি তার ওপর ঈমান আনে, আর অন্যরা ঈমান না আনে তবে অপেক্ষা কর যতক্ষন না আল্লাহ্ আমাদের মধ্যে ফয়সালা করেছেন। আর তিনিই তো হচ্ছেন উত্তম ফয়সালাকারী। আল-আরাফ ৮৫-৮৭ ——————————————————-
হে আমার জাতির লোকেরা! মাপে-ওজনে ইনসাফ কায়েম করো, ঠিক ঠিকভাবে মাপ-ওজন করো, লোকদেরকে জিনিসপত্র কম দেবো না। জমীনে বিপর্যয় সৃষ্টি করে বেড়ায়োনা। আল্লাহ্র অনুগ্রহে কাজ-কারবারে যা অবশিষ্ট থাকে তা-ই তোমাদের জন্যে উত্তম, যদি তোমরা মুমিন হও। আমি তো তোমাদের ওপর পাহারাদার -রক্ষক নই। তারা জবাব দিলোঃ শোয়াইব! বাপ-দাদার কাল থেকে যে সকল মাবুদের ইবাদত চলে আসছে, আমরা তাদের ইবাদত ত্যাগ করি-তোমর নামায কি তোমাকে এ নির্দেশই দিচ্ছি? আমাদের মর্জি মতো ধন-সম্পদ ভোগ-ব্যবহার করা ত্যাগ করবো? কেবল তুমিই তো একজন ধৈর্যশীল ও ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি হিসাবে অবশিষ্ট রইলে! -সূরা-হুদ-৮৫-৮৬
রুবুবিয়াত ও উলুহিয়াতের ব্যাপারে তাদের আসল গোমরাহী কি ছিলো, শেষের চিহ্নিত লাইনগুলো তা স্পষ্ট করে তুলে ধরছে।
ফেরাঊন ও তার জাতি
এবার আমরা ফিরাঊন ও তার জাতির কথা আলোচনা করবো। এ ব্যাপারে নমরূদ ও তার জাতির চেয়েও বেশী ভুল ধারণা পাওয়া যায়। সাধরণ ধারণা এই যে, ফিরাউন কেবল আল্লাহ্র অস্তিত্বেই ছিলো না, বরং নিজে খোদা বলে দাবীও করেছিলো। অর্থাৎ তার মস্তিষ্ক এতো খারাপ হয়ে গিয়েছিলো যে, সে দুনিয়ার সামনে প্রকাশ্যে দাবী করেছিলো, আমি আসমান যমীনের সৃষ্টিকর্তা। আর তার জাতি এমন পাগল হয়ে গিয়েছিলো যে, তার এ দাবীর প্রতি তারা ঈমান এনেছিলো। অথচ কোরআন ও ইতিহাসের সাক্ষ্য থেকে প্রকৃত তত্ত্ব অবগত হওয়া যায়। তা এই যে, উলুহিয়াত ও রুবুবিয়াতের ব্যাপারে তার গোমরাহী নমরূদের গোমরাহীর চেয়ে স্বতন্ত্র ছিলো না, তার জাতির গোমরাহীও নমরূদের জাতির গোমরাহীরর চেয়ে ভিন্ন ছিলো না। পার্থক্য শুধু এটুকু ছিলো যে, রাজনৈতিক কারণে বনী ইসরাঈলদের সাথে জাতিপূজাসূলভ একগুঁয়েমী এবং পক্ষপাতমূলক হঠকারিতা সৃষ্টি হয়ে যায়। তাই নিছক বিদ্বেষবশত আল্লাহ্র রব ও ইলাহ বলে গ্রহণ করতে অস্বীকার করা হয়। অবশ্য অন্তরে তাঁর স্বীকৃতি লুক্কায়িত ছিলো। যেমন আজকালকার অধিকাংশ জড়বাদীরা করে থাকে।
আসল ঘটনা এই যে, হযরত ইউসুফ (আঃ) মিশরে ক্ষমতা লাভ করে ইসলামী শিক্ষা বিস্তারের জন্যে সর্বশক্তি নিয়োজিত করেন। তিনি মিশর ভূমিতে এত অধিক ছাপ অংকিত করেন, যা কিছুতেই কেউ নিশ্চিত করতে পারে না। তখন মিসরের সকল অধিবাসী হয়তো সত্য দীন কবুল করে নি, কিন্তু তাই বলে মিসরের কোন ব্যক্তি আল্লাহ্কে জানতে না, তিনিই আসমান-যমীনের স্রষ্টা একথা মানতো না, এটা অসম্ভব। শুধু তাই নয়, বরং তাঁর শিক্ষার অন্তত এতটুকু প্রভাব প্রত্যেক মিসেরবাসীর ওপর থাকবে যে, অতি প্রাকৃতিক অর্থে সে আল্লাহ্কে ‘ইলাহুল ইলাহ’ ও ‘রবুল আরবাব’ বলে স্বীকার করতো। কোন মিসরবাসীই আল্লাহ্র উলুহিয়াতের বিরোধী ছিলো না। অবশ্য তাদের মধ্যে যারা কুফরীতে অবিচল ছিলো তারা উলুহিয়াত ও রুবুবিয়াতে আল্লাহ্র সাথে অন্যদেরকেও অংশীদার করতো। হযরত মূসা (আঃ) -এর আবির্ভাব পর্যন্ত এর প্রভাব অবশিষ্ট ছিলো।১ ফিরাউনের দরবারে জনৈক কিবতী সরদার যে ভাষণ দিয়েছিলো, তা থেকেই এর স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। ফিরাউন হযরত মূসা (আঃ)-কে হত্যা করার অভিপ্রায় প্রকাশ করলে তার দরবারের এই আমীর-যিনি গোপনে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন- অস্থির হয়ে বলে ওঠলেনঃ
—————————————-
১ তাওরাতের ঐতিহাসিক বর্ণনায় নির্ভর করলে ধারণা করা যায় যে, মিসরের মোট জনসংখ্যায়র প্রায় এক পঞ্চমাংশ ইসলাম গ্রহণ করেছিলো। তওরাতে বনী-ইসরাঈলের যে আদমশুমারী সন্নিবেশিত হয়েছে তার আলোকে বলা চলে, হযরত মূসা (আঃ)-এর সাথে যারা মিসর ত্যাগ করেছিলো, তাদের সংখ্যা ছিলো প্রায় ২০ লক্ষ। মিসরের জনসংখ্যা তখন এক কোটির বেশী ছিলো না। তওরাতে এদের সকলকে বনী-ইসরাঈল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু হযরত ইয়াকুব (আঃ) -এর ১২ পুত্রের সন্তানরা পঁচিশ বছরে বৃদ্ধি পেয়ে ২০ লক্ষে পৌছেছিলো-কোন হিসাবেই তা সম্ভব বলে মনে হয় না। সুতরাং অনুমিত হয় যে, মিসরের জনগণের এক বিরাট অংশ ইসলাম গ্রহণ করে বনী-ইসরাঈলে শামিল হয়ে থাকবে। দেশ ত্যাগ কালে এ মিসরীয় মুসলমানরাও ঈসারাঈলীদের সাথে যোগ দিয়েছিলো। হযরত ইউসুফ (আঃ) ও তাঁর প্রতিনিধিরা মিসরে যে প্রচারমূলক কাজ করেছিলেন, এ থেকেই তা অনুমান করা যায়।
————————————
“আল্লাহ্ আমার রব”-একথা বলার অপরাধে তোমরা কি লোককে হত্যা করছো? অথচ সেতো তোমাদের সামনে স্পষ্ট নিদর্শনসমূহ নিয়ে এসেছে। সে যদি মিথ্যাবাদী হয়, তবে যেসব পরিণতি সম্পর্কে সে তোমাদের ভয় দেখাচ্ছে তার কিছু না কিছু তোমাদের ওপর অবশ্যই বর্তাবে। সীমাতিক্রমকারী মিথ্যাবাদীকে আল্লাহ্ কল্যাণের পথ দেখান না- একথা সত্য জানো। হে আমার জাতির লোকেরা! আজ রাষ্ট্র-ক্ষমতা তোমাদের হাতে, যমীনে আজ তোমরা প্রবল বিজয়ী। কিন্তু কাল আমাদের ওপর আল্লাহ্র আজাব আপতিত হলে কে আমাদেরকে রক্ষা করবো? হে আমার জাতির লোকেরা! আমি আশংকা করছি, বড় বড় জাতির ওপর যেদিন গজব আপতিত হয়েছিলো তাদের যে পরিণতি হয়েছিলো, তোমাদেরও যেন সে পরিণতি না হয়।…. এর পূর্বে ইউসুফ তোমাদের কাছে স্পষ্ট নিদর্শন নিয়ে হাযির হলে তাঁর উপস্থাপিত বিষয়ে তোমরা সংশয়ে পড়ে রইলে। পড়ে তাঁর তিরোধার হলে তোমরা বললে, আল্লাহ্ তার পরে কোন রসূলই পাঠাবেন না। …হে আমার জাতির লোকেরা! আমি তোমাদেরকে মুক্তির দিকে-এতো দেখছি এক অবাক কান্ড! তোমরা আমাকে ডাকছো, আল্লাহ্র সাথে আমি যেন কুফরী করি, তাঁর সাথে আমি যেন তাদেরকেও শরীক করি, যাদের শরীক হওয়ার আমার কাছে কোন বিজ্ঞানভিত্তিক প্রমাণ নেই। আর আমি তোমাদের ডাকছি তাঁর দিকে, যিনি মহা পরাক্রমশালী ও অতি ক্ষমাশীল। -(আল-মুমিন-২৮-৪২)
কয়েক শতাব্দী অতিবাহিত হওয়ার পরও হযরত ইউসুফ (আঃ) – এর মহান ব্যক্তিত্বের প্রভাব তখনও বিদ্যমান ছিলো – এ দীর্ঘ ভাষণ থেকে এ কথার প্রমাণ পাওয়া যায় এ মহান নবীর শিক্ষা দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার ফলে যে জাতি অজ্ঞতার এমন স্তরে ছিলো না, যাতে আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কেই তারা অনবহিত ছিলোও অথবা তারা জানতো না যে, আল্লাহই ইলাহ ও রব; প্রাকৃতিক শক্তির ওপর তাঁর প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত। তাঁর গজবও একটা ভয় করার বিষয়-একথাও যে তারা জানাতো না, তা নয়। সে জাতি যে, আল্লাহর উলুহিয়াত ও রুবুবিয়াতে আদৌ অবিশ্বাসী ছিলো না- ভাষণের শেষাংশ থেকে একথাও স্পষ্ট জানা যায়, বরং তাদের গোমরাহীর কারণ তা ছিলো, যা অন্যান্য জাতির গোমরাহী সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে অর্থাৎ উলুহিয়াত ও রুবুবিয়াতে আল্লাহর সাথে অন্যান্যের শরীক করা। যে কারণে সন্দেহ সৃষ্টি হয় তা এই যে, হযরত মূসা (আঃ) – এর ভাষায় ————————– -নিশ্চয়ই আমি রাব্বুল আ’লামীনের রাসুল -একথা শুনে ফিরাউন জিজ্ঞেস করেছিলো, ——– -রাব্বুল আলামীন আবার কি বস্তু? স্বীয় উজীর হামানকে সে বলেছিলো; আমি যাতে মূসার খোদাকে দেখতে পারি, আমার জন্য একটা উঁচু প্রাসাদ নির্মাণ করো। হযরত মূসা (আঃ) – কে ধমক দিয়ে বললো, আমি ছাড়া অন্য কাউকে ইলাহ বানালে তোমাকে বন্দী করবো। সারা দেশে ঘোষণা করে দিয়েছিলো যে, আমি তোমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ রব। আপন সভাসদদের বলেছিলো, আমি নিজেকে ছাড়া অন্য কাউকে তোমাদের ইলাহ বলে জানি না। এহেন বাক্যাবলী দৃষ্ট মানুষ ধারণা করে বসেছে যে, সম্ভবত ফিরাউন আল্লাহর অস্তিত্বই অস্বকার করতো, রব্বুল আলামীনের কোন ধারণাই তার মনে ছিলো না। কেবল নিজেকেই একমাত্র মাবুদ বলে মনে করতো। কিন্তু আসল ব্যাপার এই যে, তার এ সকল উক্তিই ছিলো জাতীয়তাবাদী হঠকারিতার কারণে। হযরত ইউসূফ (আঃ) এর যামানায় তাঁর প্রবল ব্যক্তিত্বের প্রভাবে ইসলামের শিক্ষা মিসরভুমিতে প্রসার লাভ করেছিলো, শুধু তাই নয়, বরং রাষ্ট্রের শাসন ক্ষমতায় তাঁর যে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠত হয়েছিলো, তার ফলে বনী-ইসরাঈল মিসরে বিরাট প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিল। বনী ইসরাঈলীদের এ ক্ষমতা দীর্ঘ তিন -চার শ’ বছর যাবৎ মিসরে প্রতিষ্ঠিত ছিলো। অতপর সেখানে বনী ইসরাঈলীদের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী ভাবধারা জন্মলাভ করতে থাকে। অবশেষে তাদের ক্ষমতা উৎপাটিত হয়। মিসরের জাতীয়তাবাদী একটি বংশ শাসকের আসনে অধিষ্টিত হয়। এই নয়া শাসকদল কেবল বনী-ইসরাইলদের দমন-মূলোৎপাটন করেই ক্ষান্ত হলো না বরং হযরত ইউসুফ (আঃ) – এর শাসনকালের এক একটি চিহ্ন বিলীন করে নিজেদের প্রাচীন জাহেলী ধর্মের ঐতিহ্যকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস পায়। এ অবস্থায় হযরত মূসা (আঃ) – এর আবিভাব ঘটলে তারা আশংকা করলো, আবার শাসন-ক্ষমতা যেন আমাদের হাতছাড়া হয়ে না যায়! এ বিদ্বেষ ও হটকারিতার কারণেই ফিরাউন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে হযরত মূসা (আঃ) -কে জিজ্ঞেস করেছিলো, রব্বুল আলামীন আবার কে? আমি ছাড়া আর কে ইলাহ হতে পারে? আসলে সে রব্বূল আলামীন সম্পর্কে অনবহিত ছিলো না। তার ও তার সভাসদদের যেমন কথোপকথন এবং হযরত মূসা (আঃ) -এর যে ভাষণ-বিবৃতি কোরআনে উল্লিখিত হয়েছে, তা থেকে এ সত্য একান্ত স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়। মূসা (আঃ) আল্লাহর পয়গম্বর নয়-দরবারের লোকদের এ ধারণা দেয়ার জন্যে একদা সে বলেছিলোঃ
————————————————————- তাহলে তার জন্যে সোনার কঙ্কন অবতীর্ণ হয় নি কেন অথবা দলবদ্ধ হয়ে তার সাথে কেন ফেরেশতা আগমন করে নি? – আয-যুখরোফ-৫৩
যার মনে আল্লাহ ও ফেরেশতার কোন ধারণা নেই – সে ব্যক্তি কি এমন কথা বলতে পারে? অপর এক প্রসঙ্গে ফিরাউন ও হযরত মূসা (আঃ) – এর মধ্যে নিম্মোক্ত কথোপকথন হয়ঃ
——————————————————————– তখন ফিরাউন তাকে বললো; মূসা! আমার মনে হচ্ছে, তুমি যাদুগ্রস্ত হয়ে পড়েছো, তোমার জ্ঞান-বুদ্ধি লোপ পেয়েছে! মূসা জবাব দিলেন; তুমি ভালভাবেই জানো যে, এসব শিক্ষাপ্রদ নির্দশনরাজি আসমান-যমীনের রব ছাড়া অন্য কেউ নাযিল করে নি। আমার মনে হচ্ছে, ফিরাউন! তোমার বিপদ ঘনিয়ে এসেছে। – বনী-ইসরাঈল-১০১-১০২
অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা ফিরাউনের দলের লোকদের চিত্তের অবস্থা বর্ণনা করে বলেছেনঃ
——————————————————– তারপর তাদের সামনে আমাদের নিদর্শনসমূহ বাহ্যত স্পষ্ট হয়ে উঠলে তারা বললো, এ তো দেখছি স্পষ্ট যাদু! তাদের অন্তর ভেতর থেকে ভালভাবেই তা স্বীকার করতো, কিন্তু নিছক দুষ্টামি, অভিমান ও অবাধ্যতার কারণেই তারা তা মানতে অস্বীকার করলো। – আল-নামল-১৩-১৪
অপর একটি অধিবেশনের চিত্র অংকন করছে কোরআন এবাবেঃ —————————————————- মূসা তাদের বললেন; তোমাদের জন্যে আফসোস! তোমরা আল্লাহর ওপর মিথ্যা দোষারোপ করো না। এমন কাজ করলে তিনি কঠিন আজাবে তোমাদেরকে ধবংস করে ছাড়বেন। আল্লাহর ওপর যেই মিথ্যা দোষারোপ করেছে, সে ব্যর্থকামই হয়েছে। এ কথা শুনে তারা নিজেরা পরস্পরে বিবাদ-বিসম্বাদে পড়ে গেলো! গোপনে পরামর্শ করলো! এতে অনেকে বললো; এরা দু’জন (মূসা ও হারূন) তো যাদুকর! তারা যাদুবলে তোমাদেরকে দেশছাড়া করতে চায়, আর চায় তোমাদের আদর্শ (অনুকরণীয়) জীবন ব্যবস্থাকে নিশ্চিহ্ন করতে। -ত্ব-হা-৬১-৬৩
স্পষ্ট যে আল্লাহ তায়ালার আজাব সম্পর্কে ভীতি প্রদশৃন এবং মিথ্যা আরোপের পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করার পর তাদের মধ্যে বাক-বিতন্ডা সৃষ্টি হয় -এজন্যে যে, তাদের অন্তরে আল্লাহর ভয়-ভীতি এবং তাহার মাহাত্ম্যের প্রভাব অল্পবিস্তর বিদ্যমান ছিলো। কিন্তু তাদের জাতীয়তাবাদী শাসকশ্রেণী রাজনৈতিক বিপ্লবের হুমকি দিয়ে যখন বললো যে, মুসা-হারুন (আঃ) এর বক্তব্য স্বীকার করে নেয়ার পরিনতি এ দাঁড়াবে যে, মিসর পুনরায় ইসরাঈলের করতলগত হয়ে পড়বে। এ কথা শুনে তাদের হৃদয় আবার কঠোর হয়ে গেলো। সকলেই রাসূলের বিরোধিতা করার জন্যে সংকল্পবদ্ধ হলো।
এ সত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর আমরা সহজে দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি যে, হযরত মূসা (আঃ) ও ফিরাউনের মধ্যে কি নিয়ে মূল বিরোধ ছিলে, ফিরাউন ও তার কওমের আসল গোমরাহী-ই বা কি ধরনের ছিলো। কোন অর্থে ফিরাউন উলুহিয়াত -রুবুবিয়াতের দাবীদার ছিল। এ উদ্দেশ্যে কোরআনের নিম্নোক্ত আয়াতগুলো এক এক করে প্রণিধান করুনঃ
একঃ ফিরাউনের সভাসদদের মধ্যে যারা হযরত মূসা (আঃ) -এর দাওয়াতের মূলোৎপাটনের ওপর গুরুত্বারোপ করতো, তারা এই উপলক্ষে ফিরাউনকে সম্বোধন করে বলছেঃ
———————————- আপনি কি মুসা আর তার কওমকে ছেড়ে দেবেন যে, তারা আপনাকে ও আপনার ইলাহগুলোকে পরিত্যাগ করে দেশের অভ্যন্তরে বিপর্যয় সৃষ্টি করে বেড়াবে? -আল-আ’রাফ-১২৭
অপরদিকে সেসব সভাসদদের মধ্যে যে ব্যক্তিটি হযরত মূসা (আঃ) -এর প্রতি ঈমান এনেছিলো, সে তাদেরকে লক্ষ্য করে বলেছেঃ
———————————————– তোমরা কি আমাকে সেদিন ডাকছো, যাতে আমি আল্লাহ্র সাথে কুফরী করি;আর তাঁর সাথে এমন কাউকে শরীক করি, যার শরীক হওয়ার আমার কাছে কোন বৈজ্ঞানিক যুক্তি প্রমাণ নেই। -আল-মুমিন-৪২
ইতিহাস ও প্রত্নতাত্তিক নিদের্শনসমূহের সাহায্যে তদানীন্তন মিসরবাসীদের সম্পর্কে আমাদের লব্ধ জ্ঞানের সাথে আলোচ্য আয়াতদ্বয়কে মিলিয়ে দেখলে আমরা স্পষ্ট জানতে পারি যে, ফিরাউন নিজে ও তার কওমের লোকেরা রুবুবিয়াতে প্রথম ও দ্বিতীয় অর্থে কোন কোন দেবতাকে খোদায়ীতে অংশীদার করতো, তাদের ইবাদত করতো। এটা স্পষ্ট যে, অতি-প্রাকৃতিক (Supernatural) অর্থে ফিরাউন যদি খোদায়ীর দাবীদার হতো অর্থাৎ তার দাবী যদি এই হতো যে, কার্যকারণ-পরম্পরার ওপরও তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত, সে ছাড়া আসমান-যমীনের অপর কোন রব-ইলাহ নেই, তা হলে সে নিজে অন্য ইলাহ-র পূজা করতো না।১
দুইঃ ফিরাউনের এ বাক্যগুলো কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছেঃ
———————————————– ১. ফিরাউন নিজে ‘ইলাহুল আলামীন’ (বিশ্ব-জাহানের ইলাহ) বলে দাবী করেছিলো- নিছক এ ধারণার বশবতী হয়ে কোন কোন তফসীরকার সূরায়ে আরাফের উপরিউক্ত আয়াতে ——— এর স্থলে —————- পাঠ (কেরাআত) গ্রহণ করেছেন। আর—- এর অর্থ নিয়েছেন ইবাদত। এ পাঠ অনুযায়ী আয়াতের তরজমা হবে-আপনাকে ও আপনার ইবাদতকে পরিত্যাগ করে। কিন্তু প্রথমত এ পাঠটি বিরল ও প্রসিদ্ধ-পরিচিত পাঠের পরিপন্থি। দ্বিতীয়ত, যে ধারণার ভিত্তিতে এ পাঠ করা হয়েছে, সে ধারণা আদপেই ভিত্তিহীন, অমূলক। তৃতীয়ত, – এর অর্থ ইবাদত ছাড়া মাবুদ বা দেবীও হতে পারে। জাহেলী যুগে আরবে সূর্যের জন্যে এ শব্দটি ব্যবহৃত হতো। এটা জানা কথা যে, সাধারণত মিসরীয়দের বড় মূর্তি ছিল সূর্য। মিসরী ভাষায় সূর্যকে বলা হতো রা (-)। আর ফিরাউনের অর্থ ছিল, রা’-এর কণ্যা-সন্তান, রা’-এর অবতার-অন্য কথায় সূর্যের অবতার। সুতরাং ফিরাউন যে জিনিসটির দাবি করতো, তা ছিলো এই যে, আমি সূর্য দেবতার কায়িক বিকাশ মাত্র।
অমাত্যবর্গ! আমি নিজেকে ছাড়া তোমাদের অন্য কোন ইলাহ সম্পর্কে অবহিত নই। -আল-কাসাস-৩৮
————————— মূসা! আমি ব্যতীত অন্য কাউকে তুমি যদি ইলাহ হিসাবে গ্রহণ করো, তবে আমি তোমাকে কয়েকদীদের মধ্যে শামিল করবো। -আশ-শোয়ারা-২৯
এ বাক্যগুলোর অর্থ এ নয় যে, ফিরাউন নিজেকে ছাড়া অন্য সব ইলাহকে অস্বীকার করতো, বরং তার আসল উদ্দেশ্য ছিলো, হযরত মূসা (আঃ)-এর দাওয়াত প্রত্যাখান করা। যেহেতু হযরত মূসা (আঃ) এমন এক ইলাহর দিকে দাওয়াত দিচ্ছিলেন, যিনি শুধু অতি- প্রাকৃতিক (Supernatural) অর্থেই মাবুদ নন, বরং তিনি রাজনৈতিক, তমদ্দুনিক অর্থেও আদেশ-নিষেধের মালিক এবং সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। তাইতো সে আপন কওমকে বলেছিলো, আমি ছাড়া তো তোমাদের এমন কোন ইলাহ নেই। হযরত মূসা (আঃ) -কে ধমক দিয়ে বলেছিলো, এ অর্থে আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে ইলাহ বলে গ্রহণ করলে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হবে।
কোরআনের আয়াত থেকে এও জানা যায় এবং ইতিহাস ও প্রত্নতাত্তিক নিদের্শন থেকে তার সমর্থন পাওয়া যায় যে, মিসরের ফিরাউন সম্প্রদায় কেবল নিরংকুশ সার্বভৌমত্বের (Absolute Sovereignty) দাবীদারই ছিলো না, বরং দেবতার সাথে সম্পর্কে স্থাপন করে এক ধরনের পবিত্রতাও দাবী করতো, যেন প্রজাদের দিল-দেমাগে তাদের শক্ত আসন গেড়ে বসতে পারে। এ ব্যাপারে কেবল মিসরের ফিরাউন সম্প্রদায়ই কোন বিরল দৃষ্টান্ত নয়, বরং দুনিয়ার অধিকাংশ দেশেই রাজকীয় খান্দান রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব (Political Sovereignty) ছাড়াও অতিপ্রাকৃতিক অর্থে (supernatural Meaning)উলুহিয়াত ও রুবুবিয়াতে ভাগ বসাবার অল্পবিস্তর চেষ্টা করেছে। প্রজারা যাতে তাদের সামনে দাসত্বের কোননা কোন রীতিনীতি পালন করে তা-ও তাদের জন্যে বাধ্যতামূলক করেছে। কিন্তু আসলে এটি নিছক প্রাসঙ্গিক বিষয়। আসল উদ্দেশ্য, রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব সুদৃঢ় কর। অতি-প্রাকৃতিক উলুহিয়াতের দাবীকে এর একটি উপায় হিসাবে ব্যবহার করা হয়। এজন্যে মিসরে ও জাহেলী ধ্যান-ধারণার পুজারী অন্যান্য দেশেও রাজনৈতিক পতনের সাথে সাথে রাজকীয় খান্দানের উলুহিয়াতও সব সময় নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে। ক্ষমতার মসনদ যাদের হাতে গিয়েছে, উলুহিয়াতও আবর্তিত হয়েছে।
তিনঃ অতিপ্রাকৃতিক খোদায়ী ফিরাউনের আসল দাবি ছিল না, বরং রাজনৈতিক খোদায়ীই ছিল তার মূল দাবী। রুবুবিয়াতের তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম অর্থে সে বলতো যে, আমি মিসর ভূমি, তার অধিবাসীদের সব চেয়ে বড় রব (Over Lord) এ দেশ ও তার সকল-উপাদান- উপকরণের মালিক আমি। এ দেশের নিরংকুশ সার্বভৌমত্বের অধিকার কেবল আমারই; আমার সামগ্রিক ব্যক্তিসত্তাই এ দেশের সমাজ-সংগঠন ও সভ্যতা-সংস্কৃতির ভিত্তিমূল।এখানে আমি ছাড়া অন্য কারো আইন-বিধান চলবে না।
কোরআনের ভাষায় তার দাবীর ভিত্তি ছিলো এইঃ
——————– আর ফিরাউন তার কওমের মধ্যে ডাক দিয়ে বললো; হে আমার কওমের লোকেরা! আমি কি মিসর দেশের মালিক নই? মিসরের রাজত্ব কি আমার নয়? তোমরা কি দেখছো না যে, এসব নদী-নালা আমার নিদের্শ চলছে?-আয-যুখরুফ-৫১
নমরূদের রুবুবিয়াতের দাবীও প্রতিষ্ঠিত ছিলো এ ভিত্তির ওপর।
(———————) এ ভিত্তিতেই হযরত ইউসুফ (আঃ)-এর সমকালীন নৃপতিও আপন দেশবাসীর রব সেজে বসেছিলো।
চারঃ হযরত মূসা (আঃ) -এর দাওয়াত-যার কারণে ফিরাউন ও ফিরাউনের বংশের সাথে তার ঝগড়া ছিলো-মূলত এই ছিলো যে, আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন ছাড়া অন্য কেউ কোন অর্থেই ইলাহ নেই। অতি-প্রাকৃতিক অর্থেও তিনিই একমাত্র ইলাহ, বরং সামাজিক, রাজনৈতিক অর্থেও। অর্চনা ও বন্দেগী-আনুগত্য তাঁরই হবে; কেবল তাঁরই আইন-বিধান মেনে চলতে হবে। তিনিই আমাকে স্পস্ট নিদর্শনসমূহ দিয়ে তাঁর প্রতিনিধি নিয়োগ করেছেন; আমার মাধ্যমেই তিনি আদেশ-নিষেধের বিধি-বিধান দেবেন। সুতরাং তাঁর বান্দাদের ক্ষমতার রজ্জু তোমার হাতে নয়, বরং আমার হাতে থাকা ব্ঞ্ছনীয়। এর ভিত্তিতেই ফিরাউন ও তার রাজনৈতিক সহযোগীরা বারবার বলতো যে, এরা দু’ভাই আমাদেরকে দেশ থেকে বিতাড়িত করে নিজেরা ক্ষমতার সামনে অধিষ্ঠিত হতে চায়। আমাদের দেশের ধর্ম ও তম্মুদ্দুন ব্যবস্থাকে নিশ্চিহ্ন করে নিজেদের ধর্ম ও তমুদ্দুন প্রতিষ্ঠার জন্যে উঠে-পড়ে লেগেছে।
———————– এবং আমরা মূসাকে আমাদের আয়াত ও প্রত্যাদিষ্টের স্পষ্ট নিদর্শন সহকারে ফিরাউন ও তার কওমের সর্দারদের প্রতি প্রেরণ করেছি। কিন্তু তারা ফিরাউনের নির্দেশ অনুসরণ করলো। অথচ ফিরাউনের নির্দেশ ন্যায়সঙ্গত ছিলো না। -হুদ-৯৬-৯৭
——————– এবং তাদের পূর্বে আমরা ফিরাউনের কওমকে পরীক্ষায় ফেলেছিলাম। তাদের কাছে এসেছিলো একজন সম্মানিত রসূল। তিনি বললেন, আল্লাহ্র বান্দাদের আমায় সোপর্দে করো। আমি তোমাদের জন্যে আমানতদার রসূল। আল্লাহ্র মোকাবিলায় ঔদ্বত্য করো না। আমি তোমাদের সামনে প্রত্যাদিষ্টের স্পষ্ট নির্দশন পেশ করছি।-আদ-দোখান-১৭-১৯
——- (মক্কাবাসী) আমরা তোমাদের প্রতি একজন রাসূল প্রেরণ করেছি। তিনি তোমাদের ওপর সাক্ষ্যদাতা। ঠিক তেমনি, যেমন ফিরাউনের প্রতি একজন রসূল প্রেরণ করেছিলাম। অতপর ফিরাউন রসূলের নাফরমানী করলে আমরা তাকে কঠোরভাবে পাকড়াও করেছিলাম। -আল-মুয্যাম্মিল- ১৫-১৬
———————- ফিরাউন বললো, মূসা! (দেবতা, শাহী খান্দান-এর কোনটাকেই যদি তুমি স্বীকার না করো) তবে তোমার রব কে? মূসা জবাব দেন; যিনি প্রতিটি বস্তুকে বিশেষ আকার-আকৃতি দান করেছেন, অতপর তাকে কার্য সম্পাদনের পন্থা নির্দেশ করেছেন-তিনিই আমার রব।-ত্বাহা-৪৯-৫০
————————— ফিরাউন বললো; এ রব্বুল আলামীন আবার কি? মূসা জবাব দিলেন, আসমান-যমীন এবং তার অভ্যস্তরে যত সব বস্তু আছে, তার রব-যদি তোমরা বিশ্বাস করো। ফিরাউন তার আশপাশের লোকদের বললো; তোমরা শুনেছো? মূসা বললেন; তোমাদেরও রব, তোমাদের বাপ-দাদারও রব। ফিরাউন বললো; তোমাদের এ রসূল সাহেব-যে তোমাদের প্রতি প্রেরিত হয়েছে-একেবারেই পাগল। মুসা বললেন,মাশরিক-মাগরিব, প্রাচ্য-প্রতীচ্য এবং তার মাঝখানে যা কিছু আছে, সমুদয় বস্তুরই রব-অবশ্য যদি তোমাদের সামান্য জ্ঞানও থাকে। এতে ফিরাউন বলে উঠলো; আমি ছাড়া আর কাউকে যদি তুমি ইলাহ বানাও তাহলে তোমাকে কয়েদীদের শামিল করবো। -আশ-শায়ারা-২৩-২৯
— ফিরাউন বললো,মুসা! আপন যাদু বলে আমাদেরকে আমাদের ভুখন্ড থেকে বে-দখল করে দেয়ার জন্যেই কি তোমার আগমন?-ত্বাহা-৫৭
]——————— আর ফিরাউন বললো; ছেড়ে দাও আমাকে, মূসাকে হত্যা করি। সে তার রবকে সাহায্যের জন্যে ডেকে দেখুক। আমি আশংকা করছি, সে তোমাদের দীন (জীবন-যাপনের ধারা) কে পরিবর্তিত করে ফেলবে অথবা দেশে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে।-আল-মুমিন-২৬
—————————— তারা বললো; এরা দু’জন তো যাদুকর। নিজেদের জোরে তোমাদেরকে তোমাদের ভূখন্ড থেকে বে-দখল করতে চায়। চায় তোমাদের আদর্শ জীবন ব্যবষ্থাকে নিশ্চিহ্ন করতে।ত্বাহা-৬৩
এসব আয়াত পর্যায়ক্রমে দেখলে স্পষ্ট জানা যায় যে, রুবুবিয়াতের ব্যাপারে যে গোমরাহীটি শুরু থেকে দুনিয়ার বিভিন্ন কওমের মধ্যে চলে আসছিলো, নীল নদের দেশেও তারই ঘনঘটা ছেয়ে ছিলো। শুরু থেকে সকল নবী-রাসূল যে দাওয়াত দিয়ে আসছিলেন, মূসা ও হারুন (আঃ) -ও সে দিকেই ডাকছিলেন।
ইহুদী ও খৃস্টান
ফিরাউন জাতির পর আমাদের সামনে আসে বনী ইসরাঈল এবং অন্য সব জাতি, যারা ইহুদীবাদ ও খৃষ্টবাদ গ্রহণ করেছিলো। তারা আল্লাহ্র অস্তিত্ব স্বীকার করতো না বা তাঁকে রব-ইলাহ মানতো না-এদের সম্পর্কে এমন ধারণাতো করাই যায় না। কারণ তারা যে আহলে কিতাব ছিলো, স্বয়ং কোরআনই তার সত্যতা প্রতিপন্ন করেছে। তাহলে প্রশ্ন দাড়াঁয়, রুবুবিয়াতের ব্যাপারে তাদের আকীদা-বিশ্বাস ও কর্মধারায় এমন কি অসঙ্গতি, ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিলো, যার কারণে কোরআন তাদেরকে গোমরাহ বলে অভিহিত করেছে? আমরা কোরআন থেকেই এর সংক্ষিপ্ত জবাব পাইঃ
—————————– বল! হে আহলে কিতাব! নিজেদের দীনের ব্যাপারে অন্যায় বাড়াবাড়ি করো না। তোমাদের পূর্বে যেসব কওম গোমরাহ হয়ে পড়েছে, তাদের বাতিল চিন্তাধারার অনুসরণ করো না। তারা অনেককে গোমরাহীতে নিমজ্জিত করেছে, আর নিজেরাও সত্যপথ হতে বিচ্যুত হয়েছে। -(আল-মায়েদা-৭৭)
এ থেকে জানা যায় যে, ইহুদী-খৃস্টান জাতিগুলের গোমরাহীও মূলত সে ধরনের ছিলো, তাদের পূর্ববর্তী জাতিগুলো শুরু থেকে যে গোমরাহীতে নিমজ্জিত হয়ে আসছিলো। তাছাড়া এ থেকে এ কথাও জানা যায় যে, তাদের মধ্যে এ গোমরাহী প্রবেশ লাভ করছিলো “গলু ফিদদীন”- দীনের ব্যাপারে অযথা অন্যায় বাড়াবাড়ির পথ ধরে। এবার দেখুন, কোরআন এ সংক্ষিপ্ত বর্ণনার ব্যাখ্যাটি কিভাবে পেশ করছেঃ
—————————————– ইহুদীরা বলে; ওজাইর আল্লাহর পুত্র, আর নাসারার বলে; মসীহ আল্লহর পুত্র। – তাওবা-৩০
———————————— যেসব খৃস্টানরা বলে যে, মসীহ ইবনে মরিয়ামই আল্লাহ-তারা কুফুরী করেছে। অথচ মসীহ বলেছেন; হে বনী ইসরাঈল! আল্লাহর ইবাদত কেরো যিনি আমারও রব তোমাদেরও রব। -আল-মায়েদা-৭২
——————————- যারা বলে, আল্লাহ তো তিনজনের তৃতীয় জন-তারা কুফুরী করেছে। অথচ এক ইলাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ-ইতো নেই। – আল-মায়েদা-৭৩
————————————————– এবং আল্লাহ যখন জিজ্ঞেস করবেন, হে মরিয়াম তনয় ঈসা! তুমি কি লোকদেরকে বলেছিলে যে, আল্লাহকে ছেড়ে আমাকে ও আমার মাতাকেও ইলাহ বানিয়ে নাও? তখন তিনি জবাবে আরজ করবেন, (সুবহানাল্লাহ) যে কথা বলার আমার কোন অধিকার ছিলো না, এমন কথা বলি আমার সাধ্য কি!” – (আল-মায়েদা-১১৬)
——————————————————- এটা কোন মানুষের কাজ নয় যে, আল্লাহ তাকে কিতাব, বিধান ও নবুয়াত দান করবেন, আর সে লোকদের বলবে, তোমরা আল্লাহকে ত্যাগ করে আমার বান্দায় পরিণত হও, বরং সে তো এই বলবে, রাব্বানী (খোদা পোরোস্ত) হয়ে যাও, যেমন তোমরা খোদার কিতাব পঠন পাঠন করো, আর যার দরস দিয়ে থাকো। ফেরেশতা- পয়গম্বরদের রব বানিয়ে নাও – এমন কথা বলা নবীর কাজ নয়। তোমারা মুসলমান হওয়ার পরও তিনি কি তোমাদেরকে কুফরী শিক্ষা দেবেন? –আলে-ইমরান-৭৯-৮০
এসব আয়াতের আলোকে আহলে কিতাবের প্রথম গোমরাহী এই ছিলো যে, দীনের দৃষ্টিতে যেসব মহান ব্যক্তি-নবী রাসূল-সাধক পুরুষ ও ফেরেশতা প্রমুখ ছিলেন, তারা তাদের সত্যিকার মর্যাদা থেকে বাড়িয়ে তাদেরকে খোদায়ীর মর্যাদায় উন্নীত করেছিলো; আল্লাহর কার্যধারায় তাদেরকে করেছিলো শরীক-অংশীদার। তাদের পূজা-অর্চনা করেছে। তাদের হিসসাদার জ্ঞান করেছে এবং ধারণা করে বসেছিলো যে, ক্ষমা-সাহায্য-সহযোগিতা ও রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষমতাও তাদের রয়েছে। এরপর তাদের দ্বিতীয় গোমরাহী ছিলো এইঃ
———————————————- তারা আল্লাহ ছাড়া নিজের ওলামা-মাশায়েখ –পাদ্রী –পুরোহিতদেরকে রব বানিয়ে নিয়েছিলো। – সুরা -তওবা-৩১
অর্থাৎ ধর্মীয় ব্যবসায় যাদের পজিশন ছিলো শুধু এই যে, তারা আল্লাহর শরীয়তের বিধান বলে দেবে, আল্লাহর মর্জী অনুযায়ী চরিত্র গঠন করবে- ধীরে ধীরে তাদেরকে এমন পজিশন দেয়া হলো যে, নিজেদের ইখতিয়ার অনুযায়ী যা খুশী হারাম-হালাল করে বসে, দীন ও কিতাবের অনুমোদন ছাড়াই যা খুশী নির্দেশ দেয়, যা থেকে খুশী বারণ করে, যে পন্থাই খুশি বারণ করে, যে পন্থাই জারী করতে পারে। এমনি করে এরা দুটি বিরাট মৌলিক বিচ্যুতিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়লো। নূহ, ইবরাহীম, আ’দ, সামুদ, আহলে মাদইয়ান ও অন্যান্য কওম যে বিচ্যুতিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিলো, পূর্ববর্তী জাতিসমূহের মতো এরাও অতি –প্রাকৃতিক অর্থে ফেরেশতা ও মহান ব্যক্তিদেরকে রুবুবিয়াতে আল্লাহর শরীক করছে। তাদের মতো এরাও আল্লাহর অনুমোদনের তোয়াক্কা না করেই মানুষের নিকট থেকে নিজেদের সভ্যতা, সংস্কৃতি, আচার –আচরণ, নীতি-নৈতিকতা ও রাজনীতির বিধি-বিধান গ্রহণ করতে থাকে। এমন কি শেষ পর্যন্ত অবস্থা এই দাঁড়ায়ঃ
—————————————————————- তুমি কি তাদের দেখেছো, যারা আল্লাহর কিতাবের অংশ বিশেষ লাভ করেছিলো? তাদের অবস্থা এই ছিলো যে, তারা জিবত ও তাগুতকে স্বীকার করে নিচ্ছে। -আন-নিসা-৫১
—————————– বল, আল্লাহর নিকট ফাসেকদের চেয়েও নিকৃষ্টতর পরিণতি কাদের, আমি কি তোমাদেরকে বলে দেবো? তারা, যাদের ওপর আল্লাহ লা’নত করেছেন, যাদের ওপর আল্লাহর গজব নিপতিত হয়েছে, যাদের অনেকেই তাঁর নির্দেশে বানর-শূকরে পরিণত হয়েছে, আর তারা তাগুতের ইবাদত-বন্দেগী করেছে। এরাই হচ্ছে নিকৃষ্টতর পর্যায়ের লোক। আর সত্য সরল পথ থেকে ওরা তো অনেক দূরে সরে গিয়েছে। -(আল মায়েদা-৬০)
কল্পনাপ্রসূত সর্বপ্রকার চিন্তা- ভাবনার জন্যে ‘জিবত’ শব্দটি অত্যন্ত ব্যাপক। যাদু-টোনা, টোটকা, ভাগ্য গণনা, ভবিষ্যত বর্ণনা, লক্ষ্মী-অলক্ষ্মীর ধারণা-কল্পনা, অতি-প্রাকৃতিক ক্রিয়াকলাপ-এক কথায় সকল প্রকার মনগড়া ধারণ কল্পনা এর পর্যায়ভুক্ত। আর ‘তগুতের’ অর্থ সে সব ব্যক্তি, দল বা সংগঠন-প্রতিষ্ঠান-যারা, আল্লাহর মোকাবিলায় ঔদ্ধত্য-অবাধ্যতা অবলম্বন করেছে, বন্দেগীর সীমাশর্ত লংঘন করে খোদায়ীর ধজাধারী সেজে বসেছে। ইহুদী-খৃষ্টানরা পূবোর্ক্ত দুটি গোমরাহীতে নিমজ্জিত হয়েছিলো। প্রথম প্রকার গোমরাহীর পরিণতি এই দাড়িয়েছিলো যে, সকল প্রকার ধারণা-কল্পনা তাদের মন-মগজে চেপে বসেছিলো। আর দ্বিতীয় প্রকার গোমরাহী তাদের ওলামা-মাশায়েখ, আলেম-সূফী, পাদ্রী-পুরোহিত, সুফী-সাধক ধর্মগুরুদের বন্দেগী থেকে এগিয়ে সে সব অত্যাচারী-অনাচারীর বন্দেগী-অনুগত্য পর্যন্ত তাদের নিয়ে গিয়েছিল, যারা ছিলো প্রাকশ্য খোদাদ্রোহী।
আরবের মুশরিক সমাজ
এবার আমরা আলোচনা করে দেখবো, এ ব্যাপারে আরবের মুশরিকদের গোমরাহী কোন ধরনের ছিলো। এদের প্রতি রাসূল (স) প্রেরিত হয়েছিলেন, আর এদেরকেই কোরআনে সর্বপ্রথম সম্বোধন করা হয়। তারা কি আল্লাহ সম্পর্কে অনবহিত ছিলো, তাঁর অস্তিত্বে অবিশ্বাসী ছিলো? তাদেরকে আল্লাহর অস্তিত্ব স্বীকার করাবার জন্যেই কি রাসূল প্রেরিত হয়েছিল? তারা কি আল্লাহকে রব-ইলাহ স্বীকার করতো না? তাদেরকে মহান আল্লাহ তায়ালার উলুহিয়াত ও রুবুবিয়াত স্বীকার করাবার জন্যেই কি কোরআন নাযিল হয়েছিলো? তারা কি আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী অস্বীকার করতো? না তারা কি মনে করতো যে, মূলত লাত-মানাত ও হোবাল-ওযযা এবং অন্যান্য মাবুদই বিশ্বজাহানের সৃষ্টিকর্তা, মালিক, রিজিকদাতা ও নিয়ন্ত্রক-পরিচালক? না তারা তাদের এসব মাবুদকে আইনের উৎস, নৈতিক ও তমুদ্দুনিক সমস্যায় হেদায়াতের উৎসমূল বলে স্বীকার করতো?
আমরা কোরআন থেকে এসব প্রশ্নের এক একটি নেতিবাচক জবাব পাই। কোরআন আমাদেরকে বলছে যে, আরবের মুশরিকরা কেবল আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাসীই ছিলো না, বরং তাকে সমগ্র বিশ্ব-চরাচর এবং তাদের নিজেদের মাবুদের্ও স্রষ্টা, মালিক্ও মহান খোদা (Grand Lord) বলে স্বীকার করতো, স্বীকার করতো তাকে রব ও ইলাহ বলে। সংকট-সমস্যা ও দুর্যোগ –দুর্বিপাকে তারা যে দরবারে সর্বশেষ আপীল করতো, তা ছিলো তারই দরবার। তারা আল্লাহ্র ইবাদত-বান্দেগীও অস্বীকার করতো না। নিজেদের দেবতা-মাবুদ (উপাস্য) সম্পর্কে তাদের এ বিশ্বাস ছিলো না যে, তারা তাদের নিজেদের ও বিশ্ব-জাহানের স্রষ্টা-রিজিকদাতা, এসব উপাস্য জীবনের নৈতিক-তমুদ্দনিক সমস্যায় তাদের পথ-নির্দেশ দান করে-এ বিশ্বাসও তারা পোষণ করতো না। নিম্নের্ আয়াতগুলো এর ————————————– হে নবী! তাদের জিজ্ঞেস করো, যমীন এবং তাতে যা কিছু আছে, তা কার মালিকানায়? তোমরা জানলে বলো। তারা বলবে; আল্লাহ্র মালিকানায়। বলো; তবুও তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না? জিজ্ঞেস করো; সাত আসমান ও মহান আরশের রব কে? তারা বলবে, আল্লাহ। তবুও তোমরা ভয় করবে না? বলো, সকল বস্তুর রাজকীয় ক্ষমতা কার হাতে ন্যস্ত? কে তিনি যিনি আশ্রয় দান করেন? অথচ তাঁর মোকাবিলায় আশ্রয় দানের ক্ষমতা কারুর নেই। বলো, যদি তোমরা জানো। তারা বলবে; এই গুন-বৈশিষ্ট্য শুধু আল্লাহর।বলো,তাহলে কোথেকে তোমরা প্রতারিত হচ্ছো? আসল কথা এই যে, আমরা তাদের সামনে বাস্তব সত্য তুলে ধরেছি্ আর তারা নিশ্চয়ই মিথ্যাবাদী। আল মুমিনুন-৮৪-৯০
তিনিই – তো আল্লাহ্, যিনি তোমাদেরকে জলে-স্থলে পরিভ্রমণ করান। এমন কি তোমরা যখন নৌকায় আরোহণ করে অনুকূল বাতাসে আনন্দে সফর করে বেড়াও; অতপর অকস্মাৎ প্রতিকুল বাতাস সজোরে প্রবাহিত হতে থাকে, আর চতুর্দিক থেকে ঢেউ খেলতে শুরু করে-তারা ভাবে ঝড়-ঝঞ্ঝা তাদেরকে বেষ্টন করে ফেলেছে, তখন সকলে আল্লাহ্কেই ডাকে। আপন দীনকে তাঁর জন্যে নিবেদিত করে দো্য়া করতে থাকে; আমাদেরকে এ বিপদমুক্ত করলে আমরা তোমার কৃতজ্ঞ বান্দা হবো। কিন্তু তিনি তাদেরকে বিপদমুক্ত করলে তারাই সত্য থেকে সরে দাঁড়িয়ে যমীনে নাহক বিদ্রোহ করে বসে। -ইউনুস-২২-২৩
————————————— সমুদ্রে তোমাদের কোন বিপদ দেখা দিলে এক আল্লাহ ব্যতীত আর যাদের যাদের তোমরা ডাকতে, তারা সকলেই গায়েব হয়ে যায়। কিন্তু তিনি যখন তোমাদের রক্ষা করে স্থলভাগে পৌছিয়ে দেন, তখন তোমরা তাঁর থেকে বিমুখ হয়ে যাও। সত্য কথা এই যে, ইনসান ব্ই অকৃতজ্ঞ-একান্ত না- শোকর বান্দা। বনী-ইসরাইল-৬৭
নিজেদের মাবুদ (উপাস্য) সম্পর্কে তাদের যে ধারনা ছিল, স্বয়ং তাদেরই জবানীতে কোরআন তা এভাবেই উল্লেখ করেছেঃ
————————————————————— আর যারা তাঁকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে বন্ধু ও কার্যোদ্ধারকারী হিসাবে গ্রহণ করে, তারা বলে; এরা আমাদের আল্লাহ্র নিকটবর্তী করবে-এজন্যেই তো আমরা তাদের ইবাদত করি। -আয-যুমার-৩
———————- আর তারা বলে, এরা আল্লাহ্র হুজুরে আমাদের জন্যে সুপারিশকারী।
নিজেদের মাবুদ (উপাস্য) সম্পর্কে তারা এমন ধারণাও পোষণ করতো না যে, তারা জীবন-সমস্যায় পথ-নির্দেশক। সূরা ইউনুস ৩৫ আয়াতে আল্লাহ আপন নবীকে নিদের্শ দিচ্ছেনঃ
——————————– তাদের জিজ্ঞেস করো, তোমাদের বানানো সেসব শরীকদের কেউ সত্যের দিকে পথ-প্রদর্শনকারীও রয়েছে কি?
কিন্তু এ প্রশ্নটি শুনে তাদের ওপর নীরবতা ছেয়ে যায়। লাত-মানত, ওজ্জা বা অন্য মাবুদ-উপাস্যরা আমাদেরকে চিন্তা ও কর্মের সঠিক পথ নির্দেশ করে; পার্থিব জীবনে তারা আমাদেরকে শান্তি-স্বস্তি্ও ন্যায়ের মূলনীতি শিক্ষা দেয়, তাদের জ্ঞানধারা থেকে আমরা বিশ্বচরাচরের মূলতত্ত্ব সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করি-ওদের কেউই এমন জবাব দেয় নি। তাদের নীরবতা দেখে শেষ পযর্ন্ত আল্লাহ তার নবীকে বলেনঃ
————————————— বল, আল্লাহ্ কিন্তু সত্যের দিকে পথ প্রদর্শন করেন। তবে বল, অনুসরণীয় হওয়ার অধিক যোগ্য কে? যিনি সত্যের পথ প্রদর্শন করেন, না সে, যাকে পথ প্রদশর্ন না করা হলে সে নিজেই কোন সন্ধান লাভ করতে পারে না? তোমাদের হয়েছে কি? কেমন ফয়সালা করেছো তোমরা? ইউনুস-৩৫
এসব স্পষ্ট উক্তির পর এখন একটি প্রশ্নই অমীমাংসিত থেকে যায়। প্রশ্নটি এই যে, তাহলে রুবুবিয়াতের ব্যাপারে তাদের আসল গোমরাহী কি ছিল, যা সংশোধন করার জন্যে আল্লাহ্ তাঁর নবী পাঠিয়েছেন, কিতাব নাযিল করেছেন? এ প্রশ্নের মীমাংসার জন্যে কোরআনের প্র্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে তাদের আকীদা বিশ্বাস এবং কর্মেও আমরা দুটি বুনিয়াদী গোমরাহীর সন্ধান পাই; প্রাচীনকাল থেকে সকল গোমরাহ কওমের মধ্যেও যা পাওয়া যেতো অর্থাৎ একদিকে অতি প্রাকৃতিক অর্থে তারা আল্লাহ্র সাথে অন্যান্য রব-ইলাহকেও শরীক করতো এবং মনে করতো যে, কার্যকারণপরম্পরায় যিনি কর্তৃত্বশীল তাঁর ক্ষমতা ইখতিয়ারে ফিরেশতা, বুযুর্গ-ব্যক্তি ও গ্রহ-নক্ষত্র ইত্যাদির কোন না কোন কর্তৃত্ব রয়েছে। এ কারণেই দোয়া,সাহায্য কামনা ও ইবাদতের রীতি ও নীতি, আচারঅনুষ্ঠানে তারা কেবল আল্লাহ্র দিকেই প্রত্যাবর্তন করতো না, বরং সেসব কৃত্রিম খোদার দিকেও প্রত্যাবর্তন করতো।
অপরদিকে তমুদ্দুনিক-রাজনৈতিক রুবুবিয়াতের ব্যাপারে তারা ছিল একেবারেই শূণ্যমনা। এ অর্থেও কোন রব আছে, তা তাদের মনের কোণেও স্থান লাভ করে নি। এ অর্থে তারা তাদের ধর্মীয় নেতা-কর্তা ব্যক্তি, সর্দার মাতব্বর ও খান্দানের বুযুর্গ (মহান) ব্যক্তিদেরকে রব বানিয়ে বসেছিলো; তাদের কাছ থেকেই নিজেদের জীবন বিধান গ্রহণ করতো। তাদের প্রথম গোমরাহী সম্পর্কে কোরআন সাক্ষ্য দিচ্ছেঃ
————————– মানুষের মধ্যে এমন লোকও আছে, যে খোদাপোরোস্তীর প্রান্ত সীমানায় দাড়িয়ে তার ইবাদত করে। কল্যাণ লাভ হলে তা নিয়ে শান্ত-তুষ্ট হয়ে যায়। অবশ্য কোন অসুবিধা দেখলে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়ায়। এমন ব্যক্তি দুনিয়া-আখেরাত-দু-ই বরবাদ করলো। আর এটাই হচ্ছে স্পষ্ট ক্ষতি। সে আল্লাহ্কে বাদ দিয়ে এমন কাউকে ডাকে, যারা তার কোন অকল্যাণ করার ক্ষমতা রাখে না, ক্ষমতা রাখে না কোন কল্যাণ করারও। এটাই হচ্ছে বড় গোমরাহী-বিরাট পথ-ভ্রষ্টতা। সে সাহায্যের জন্যে এমন কাউকে ডাকে, যাকে ডাকায় লাভের তুলনায় ক্ষতি অনেক নিকটতর। কতই না নিকৃষ্ট বন্ধু আর কতই না নিকৃষ্ট সাথী।-আল-হাজ্জ-১১-১৩
———————– তারা আল্লাহ্কে ছেড়ে এমন কারো ইবাদত করছে, যারা অকল্যাণও করতে পারে না, পারে না কল্যাণও করতে। এবং তারা বলে; আল্লাহ্র হুজুরে তারা আমাদের সুপারিশকারী। বল, আসমান-যমীনে আল্লাহ্র জ্ঞানে নেই১ -তোমরা কি আল্লাহ্কে এমন কিছুর সংবাদ দিচ্ছো? তারা যে শিরক করছে, তা থেকে আল্লাহ্ পবিত্র- মুক্ত।-ইউনুস-১৮
——————————— হে নবী! তাদেরকে বলে দাও, যে আল্লাহ্ দু’দিনে যমীন পয়দা করেছেন, সত্যিই কি তোমরা তাঁর সাথে কুফরী করছো? আর অন্যদেরকে তাঁর সমকক্ষ-প্রতিপক্ষ করছো?-হা-মীম আস-সাজদা-৯
———————————
১. অর্থাৎ তোমরা এমন ভ্রান্ত ধারণায় পতিত হয়েছো যে, আমার কাছে সেসব মাবুদের এমন ক্ষমতা চলে যে, তারা আমার কাছে যে সুপারিশই করবে, তা-ই কবুল না হয়ে পারে না। আর এজন্যেই তোমরা তাদের আস্তনায় মাথা ঠুক, ভেট দাও। আমার দরবারে এত বড় ক্ষমতাধর অথবা আমার এত প্রিয়পাত্র যে, আমি তার সুপারিশ কবুল করতে বাধ্য হবো- আসামন-যমীনে এমন কোন সত্তা তো আমার জানা নেই। তবে কি আমি জানি না -আমাকে এমন সুপারিশকারীদের খবর দিচ্ছো? স্পষ্ট যে, আল্লাহ্র জ্ঞানে কোন জিনিস না থাকার অর্থ আদপে তার অস্তিত্বই নেই।
বল, তোমরা কি আল্লাহ্ ছাড়া এমন কারো ইবাদত করছো? তোমাদের কল্যাণের কোন ইখতিয়ারই যাদের নেই, নেই কোন অ-কল্যাণের ক্ষমতা অথচ একমাত্র আল্লাহ্রই তো শ্রোতা-জ্ঞাতা। -আল-মায়েদা-৭৬
—————————- আর যখন মানুষকে কোন বিপদ স্পর্শ করে তখন একাগ্রে চিত্তে আপন রবকেই ডাকে। কিন্তু তিনি যখন তাকে কোন নিয়ামতে সরফরাজ করেন, তখন যে বিপদে পড়ে ইতিপূর্বে তাঁকে ডেকেছিলো, তা বিস্মৃতি হয়ে যায়; আল্লাহ্র সমকক্ষ নির্ধারণ করতে থাকে১ যেন তাকে আল্লাহ্র পথ থেকে বিচ্যুত করে।-আযযুমার-৮
—————————– যে নিয়ামতই লাভ করেছো, তা করেছো আল্লাহ্র দান-বিখশিশের ফলে। অতপর কোন বিপদ স্পর্শ করলে আল্লাহ্র হুজুরেই ফরিয়াদ নিয়ে হাজির হও। কিন্তু তিনি যখন তোমাদের ওপর থেকে সে বিপদ বিদূরিত করেন, তখন তোমাদের কিছু লোক এ বিপদ মুক্তিতে অন্যদেরকেও শরীক করতে শুরু করে, অনুগ্রহ বিস্মৃতি দ্বারা অনুগ্রহের জবাব দেয়ার জন্যে। আচাছা! মজা লুটে নাও। অনতিবিলম্বে তোমরা এর পরিণতি জানতে পারবে। তোমরা যাদের জানো না, তাদের জন্যে আমাদের দেয়া রিজিকের অংশ নির্ধারণ করো।২ আল্লাহ্র
১. আল্লাহ্র সমকক্ষ করতে থাকে এর অর্থ, বলতে থাকে যে, অমুক বুযুর্গের বরকতে এ বিপদ কেটে গেছে, অমুক হযরতের এনায়াত অনুগ্রহে এ নিয়ামত লাভ হয়েছে।
২. অর্থাৎ যারা বিপদ মুক্তকারী এবং সংকট মোচনকারী ছিল-কোন জ্ঞান -তথ্য দ্বারা যাদের সম্পর্কে এ সত্য প্রতিষ্ঠিত হয় নি, কৃতজ্ঞতা স্বরূপ তাদের জন্যে নজর-নিয়াজ করে নৈবেদ্য নিবেদন করে। মজার ব্যাপার এই যে, এসব কিছুই করে আমাদের দেয়া রিজিক থেকে।
শপথ, তোমরা যেসব উৎকট-উদ্ভট ধারণা-কল্পনা করছো, সে সম্পর্কে তোমরা অবশ্যই খুটিয়ে খুটিয়ে জিজ্ঞাসিত হবে।-আন-নহল-৫৫-৫৬
অবশিষ্ট রইলো তাদের দ্বিতীয় গোমরাহী। সে সম্পর্কে কোরআনের সাক্ষ্য এইঃ ——————- আর এমনি করে অনেকে মুশরিকের জন্যে তাদের মনগড়া শরীকরা নিজেদের সন্তান হত্যাকে মনঃপুত করে দিয়েছে, যেন তাদেরকে ধ্বংসে নিপতিত করে, তাদের দীনকে করে দেয় তাদের জন্য সন্দেহপূর্ণ।
স্পষ্ট যে, এখানে শুরাকা (অংশীদারগণ)-এর অর্থ মূর্তি-দেবতা নয়, বরং যেসব নেতা-কর্তা ব্যক্তি সন্তান হত্যাকে আরববাসীদের দৃষ্টিতে কল্যাণ ও শোভা সৌন্দর্যের কার্য হিসাবে পেশ করেছিলো, এখানে শুরাকা অর্থ তাই। হযরত ইবরাহীম ও হযরত ইসমাঈল (আঃ)-এর দীনে এরাই এহেন উৎকট প্রথার সংমিশ্রণ করেছিলো। আরও স্পষ্ট যে, আরববাসীরা তাদেরকে কার্যকারণপরম্পরায় কর্তৃত্বশীল মনে করতো বা তাদের পূজা করতো অথবা তাদের নিকট প্রার্থনা জানাতো। এসব অর্থে তাদেরকে আল্লাহ্র শরীক বলা হয় নি। রুবুবিয়াত-উলুহিয়াতে তাদেরকে শরীক বলা হয়েছে-তার কারণ এই যে, তমুদ্দুনিক সামাজিক সমস্যা, নৈতিক ও ধর্মীয় বিষয় যেভাবে খুশী তারা প্রণয়ন করতে পারে-আরববাসীরা তাদের এ অধিকার স্বীকার করে নিয়েছিলো।
——————————— তারা কি এমন শরীক বানিয়ে বসেছে, যারা তোদের জন্যে দীনের ব্যাপারে এমন সব আইন-বিধান রচনা করেছে, আল্লাহ্ যার অনুমতি দেন নি, দেন নি কোনহুকুম।-আশ-শূরা-২১
দীন শব্দের ব্যাখ্যা পরে করা হবে। এ আয়াতের অর্থের পূর্ণ ব্যাপকতাও সেখানে সম্পূর্ণরূপে স্পষ্ট হবে। কিন্তু এখানে ন্যূনপক্ষে এতটুকু তো পরিষ্কার জানা যায় যে, আল্লাহ্র অনুমতি ব্যতীত তাদের নেতা-কর্তা ব্যক্তিদের এমন রীতিনীতি নির্ধারণ-যার ধরন-প্রকৃতি দীনের অনূরূপ-আর আরববাসীদের তাকে একান্তে অনুসরণীয় বলে স্বীকার করে নেয়া-এটাই রুবুবিয়াত-ইলাহিয়াতে আল্লাহ্র সাথে তাদের শরীক হওয়া; এটাই ছিলো আরববাসিগণ কর্তৃক তাদের অংশীদারিত্ব স্বীকার করে নেয়া।
কোরআনের দাওয়াত
গোমরাহ জাতিসমূহের ধারণা-কল্পনার যে বিশ্লেষণ ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, তা থেকে এ সত্য একেবারে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে কোরআনের অবতরণকাল পযর্ন্ত যতগুলো জাতিকে কোরআন-জালেম, ভ্রান্ত চিন্তাধারার অধিকারী এবং বিপদগামী বলে উল্লেখ করেছে, তাদের কোন একটি জাতিও আল্লাহ্র অস্তিত্ব অস্বীকার করতো না। অবশ্য তাদের সকলেই আসল ও যৌথ গোমরাহী এই ছিলো যে, তারা রুবুবিয়াতের পাঁচটি অর্থকে-অভিধান ও কোরআনের সাক্ষ্যপ্রমাণ দিয়ে শুরুতেই আমরা যা প্রতিপন্ন করেছি-দুটি ভাগে বিভক্ত করে ফেলেছিলো।
অতি প্রাকৃতিকভাবে তিনি সৃষ্ট জীবের প্রতিপালন, রক্ষণাবেক্ষণ, অভাবঅভিযোগ পূরণ ও দেখাশোনার জন্যে যথেষ্ট-রব এর এ অর্থ তাদের দৃষ্টিতে ভিন্ন অর্থজ্ঞাপক ছিলো। এ অর্থ অনুযায়ী যদিও তারা আল্লাহ্কেই সর্বশ্রেষ্ঠ রব বলে স্বীকার করতো, কিন্তু তার সাথে ফেরেশতা, দেবতা, জ্বিন,অদৃশ্য শক্তি, গ্রহ-নক্ষত্র,নবী-ওলী ও পীর পূরোহিতদেরকেও রুবুবিয়তে শরীক করতো।
তিনি আদেশ-নিষেধের অধিকারী, সর্বোচ্চ ক্ষমতার মালিক, হেদায়াত ও পথ নির্দেশের উৎস, আইন বিধানের মূল, রাষ্ট্রের কর্ণধার এবং সমাজ সংগঠনের কেন্দ্রবিন্দু-রবের এ ধারণা তাদের ছিলো সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। এ অর্থের দিক থেকে তারা হয় আল্লাহ্র পরিবর্তে মানুষকে রব মনে করতো অথবা মতবাদ হিসাবে আল্লাহ্কে রব মনে করলেও কার্যত মানুষের নৈতিক, তমুদ্দুনিক ও রাজনৈতিক রুবুবিয়াতের সামনে আনূগত্যের মস্তক অবনত করতো।
এ গোমরাহী দূর করার জন্যেই শুরু থেকেই নবী-রাসূলদের আবির্ভাব হয়েছে। এর এজন্যেই শেষ পর্যন্ত হযরত মুহাম্মদ (সঃ) আগমন করেছেন। তাঁদের সকলেরই দাওয়াত ছিলো এইঃ এ সকল অর্থে রব কেবল একজন। আর তিনি হচ্ছেন মহান আল্লাহ্ রব্বুল আলামীন। রুবুবিয়াত অবিভাজ্য। কোন অর্থেই কেউই রুবুবিয়াতের কোন অংশ লাভ করতে পারে না। বিশ্ব জাহানের ব্যবস্থাপনা এক পরিপূর্ণ ব্যবস্থার অধীন কেন্দীয় বিধান। এক আল্লাহ্ই তার স্রষ্টা। একই আল্লাহ্ তার ওপর কর্তৃত্ব করছেন। বিশ্ব জাহানের সকল ক্ষমতা ইখতিয়ারের মালিক এক আল্লাহ্। বিশ্ব জাহানের সৃষ্টিতে কারো কোন দখল নেই; পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায়ও নেই তাঁর শরীক। শাসনকার্যেও নেই কেউ তাঁর হিস্সাদার। কেন্দীয় ক্ষমতার অধিকার হিসাবে তিনি একাই তোমাদের অতি প্রাকৃতিক রব। নৈতিক, তমুদ্দুনিক ও রাজনৈতিক রবও তিনিই। তিনিই তোমাদের মাবুদ, তিনিই তোমাদের রুকু-সিজদা পাওয়ার যোগ্য। তিনিই তোমাদের দোয়া-প্রার্থনায় শেষ কেন্দ্রস্থল। তিনিই তোমাদের আশা-ভরসার অবলম্বন। তিনিই তোমাদের অভাব-অভিযোগ পূরণ কারী। এমনিভাবে তিনিই বাদশা, মালেকুল মুলক-রাজাধিরাজ। তিনিই আইন-বিধানদাতা, আদেশ-নিষেধের অধিকারী। রুবুবিয়াতের এ দুটি দিক- জাহেলিয়াতের কারণে তোমরা যাকে পৃথক করে নিয়েছিলে–আসলে আল্লাহ্র অপরিহার্য অংশ এবং আল্লাহ্র বৈশিষ্ট্য বিশেষ; এর কোনটিকেই একে অপর থেকে বিছিন্ন কার যায় না, এর কোন এক প্রকারেই কোন সৃষ্টি জীবকে আল্লাহ্র শরীক করা বৈধ নয়।
কোরআন যে ভাষায় এ দাওয়াত পেশ করেছে, তা স্বয়ং কোরআনের জবানীতেই শুননঃ
—————————————- বাস্তবে তোমাদের রব তো আল্লাহ্ তায়ালা। যিনি ছ’দিনে আসামন-যমীন পয়দা করেছেন, তারপর রাজ্য-সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। তিনি দিনকে রাতের পোশাকে আচ্ছাদিত করেন আর রাতের পেছনে দিন ছুটে চলছে দ্রুত। চন্দ্র-সূর্য-তারকা সব কিছুই তাঁর ফরমানের অধীন। শোন, সৃষ্টি তাঁর, কৃর্তৃত্বও কেবল তাঁই। আল্লাহ্ সারা জাহানের রব-বড়ই বরকতের অধিকারী। আরাফ-৫৪
———————– তাদের জিজ্ঞেস করো; আসমান-যমীন থেকে কে তোমাদের রিজিক দান করেন? কর্ণের শ্রবণ শক্তি এবং চক্ষের দর্শন শক্তি কার ইখতিয়ার-অধিকারে? কে তিনি, যিনি মৃতের মধ্য হতে জীবিত এবং জীবিতের মধ্য হতে মৃত বের করে আনেন? বিশ্ব জাহানের এ কারখানা কে পরিচালনা করছেন? তারা অবশ্যই বলবে, আল্লাহ্। বল, তবুও কি তোমরা ভয় করছো না? এ সবই যখন তাঁর, সুতরাং তিনি তোমাদের সত্যিকার রব। সত্য প্রকাশের পর গোমরাহী ব্যতীত আর কি-ই-বা অবশিষ্ট থাকতে পারে? তবে কোথা থেকে তোমরা এ ঠোকর খেয়ে সত্য থেকে দূরে সরে যাচ্ছো?
——————————– তিনি আসমান-যমীনকে যথাযথভাবে পয়দা করেছেন। তিনিই রাতকে দিনের ওপর এবং দিনকে রাতের ওপর মুড়িয়ে দেন। তিনি চন্দ্র-সূর্যকে এমন এক নিয়ম-শৃংখলার অধীন করে দিয়েচেন, যাতে সকলেই নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত অব্যাহত গতিতে চলছে। ………………. এ আল্লাহই তোমাদের রব। রাজত্ব তাঁরই। তিনি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোন ইলাহ নেই। তাহলে তোমরা কোত্থেকে ঠোকর খেয়ে ফিরে যাচ্ছো? -আজ-জুমার-৫-৬
——————————————— তিনি আল্লাহ যিনি তোমাদের জন্যে রাত বানিয়েছেন, যেন তোমরা তাতে শান্তি লাভ করতে পারো। আর তিনি দিনকে করেছেন রওশন।….. সে আল্লাহই তোমাদের রব, সব বস্তুর স্রষ্টা। তিনি ব্যতীত অন্য কোন মাবুদ নেই। তবে কোথ্থেকে ধোঁকা খেয়ে তোমরা কোথায় ফিরে যাচ্ছ? ….. আল্লাহ, যিনি তোমাদের জন্যে যমীনকে বাসস্থান করেছেন, আসমানের ছাদ ছেয়ে রেখেছেন তোমাদের ওপর, তোমাদের খাদ্যের জন্যে পূত পবিত্র বস্তু সরবরাহ করেছেন। এ আল্লাহই তোমাদের রব। তিনি সারা জাহানের রব, বড়ই বরকতের অধিকারী। তিনি চিরঞ্জীব। তিনি ব্যতীত আর কোন মাবুদ নেই। সুতরাং দীনকে একান্তভাবে তাঁর জন্যে খালেস করে তোমরা সকলে তাঁকেইডাকো।-আল-মুমিন-৬১-৬৫
——————————————- আল্লাহ তোমাদেরকে মাটি থেকে পয়দা করেছেন। …. তিনি রাতকে দিনের মধ্যে প্রবিষ্ট করেন, আর দিনকে করেন রাতের মধ্য। তিনি চন্দ্র -সূর্যকে এমন এক শৃংখলার অধীন করেছেন যে, সকলেই আপন নির্ধারিত সময় পর্যন্ত চলছে। এ আল্লাহই তোমাদের রব। রাজত্ব তাঁরই। তাঁকে ছাড়া আর যাদের তোমরা ডাকো, তাদের হাতে অণুপরিমাণ বস্তুর ইখতিয়ারও নেই। তোমরা ডাকলেই তারা তোমাদের ডাক শুনতে পায় না; আর শুনতে পেলেও তোমাদের দরখাস্তের জবাব দেয়ার ক্ষমতা তাদের নেই। আর তোমরা যে তাদেরকে আল্লাহর শরীক করছো; তারা কিন্তু কেয়ামতের দিন নিজেরাই তার প্রতিবাদ করবে। -ফাতির-১১-১৪
————————————- আসমানের বাসিন্দা হোক বা যমীনের, সকলেই তাঁর গোলাম, সকলেই তাঁর ফরমানের অনুসারী। …. আল্লাহ তোমাদের নিজেদের মধ্য হতে তোমাদের জন্যে একটি উপমা দিচ্ছেন। আমরা তোমাদেরকে যেসব বস্তু দান করেছি তোমাদের কোন গোলাম কি সেসব জিনিসের মালিকানায় তোমাদের শরীক হতে পারে? এ সকল জিনিসের ভোগ-ব্যবহারে তোমরা আর তোমাদের গোলাম কি সমান? তোমরা কি তাদের তেমনি ভয় করো? যেমন করে থাকো তোমাদের সমস্তরের লোকদের? যারা জ্ঞানযুক্তি ছাড়াই নিজেদের ভিত্তিহীন অনুমানের পেছনে ছুটে চলছে। … সুতরাং তুমি একান্ত নিবিষ্ট চিত্তে সত্যিকার দীনের পথে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত-নিয়োজিত করো। আল্লাহর প্রকৃতির ওপর স্থির থাকো, যে প্রকৃতির ওপর তিনি সকল মানুষকেই সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সৃষ্টিতে কোন পরিবর্তন নেই, এটাই সত্য-সঠিক পন্থা, কিন্তু অধিকাংশ লোকই জানে না। -আর-রুম-২৬-৩০
—————————————— আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব-মহত্ত্বের ধারণা যেমন করা উচিত ছিলো, তারা তেমন করে নি। কিয়ামতের দিন তারা দেখবে সম্পূর্ণ পৃথিবী তাঁর -মুঠোর মধ্যে আর আসমান তাঁর হাতে গুটানো পড়ে রয়েছে। তিনি পবিত্র। তাঁর সাথে ওরা যে শরীক করছে তা থেকে তিনি অনেক ঊর্ধ্বে। – আয-যুমার-৬৭
————————————- সুতরাং সমস্ত প্রসংসা আল্লাহর জন্যে, যিনি আসমান-যমীন ও বিশ্ব জাহানের রব। আসমান-যমীনে মহত্ত্ব-শ্রেষ্ঠত্ব কেবল তাঁরই। তিনি সকলের ওপর পরাক্রমশালী, মহাকুশলী অতি জ্ঞানী। -জাসিয়া-৩৬-৩৭
——————————————- তিনি আসমান যমীনের মালিক (রব), মালিক সেসব বস্তুর যা আসমান -যমীনে আছে। সুতরাং তুমি তাঁরই বন্দেগী কর আর তাঁর ওপর দৃঢ় থাকো। তোমার জানামতে আর কেউ কি আছে তাঁর মতো? সুরা-মারইয়াম -৬৫
————————————— আসমান-যমীনের সমুদয় গুপ্ততত্ত্ব আল্লার জ্ঞানে রয়েছে। সকল ব্যাপার তাঁর হুজুরেই পেশ হয়। সুতরাং তুমি তাঁরই বন্দেগী কর, তাঁরই ওপর ভরসা করো। -সুরা -হুদ-১২৩
———————————————– তিনি মাশরিক-মাগরিব -প্রাচ্য-প্রতীচ্যের রব। তিনি ছাড়া কোন মাবুদ নেই। সুতরাং তুমি তাঁকেই তোমার কর্মধারক কর। -মুজ্জাম্মিল-৯
————————————— বস্তুত তোমাদের এ উম্মত একই উম্মত। আর আমি তোমাদের রব। সুতরাং আমারই বন্দেগী করো। লোকেরা রবুবিয়াতের এই কার্য এবং জীবনের কার্যাবলীকে নিজেরাই নিজেদের মধ্যে বন্টন করে নিয়েছে। কিন্তু যা-ই হোক, তাদের সকলকে আমার নিকটেই ফিরে আসতে হবে। -সুরা আন-নিসা-৯৩-৯৬
—————————————- তোমাদের রব-এর পক্ষ থেকে যে কিতাব নাজিল হয়েছে, তোমরা তার অনুসরণ করো। তা ত্যাগ করে অন্য কাউকে কার্যোদ্ধারকারী হিসাবে অনুসরণ করো না। -আল-আ’রাফ-৩
———————————- বল, হে আহলে কিতাব! এমন একটি বিষয়ে অগ্রসর হও, যা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে সমান। তা এইঃ আমারা আল্লাহ ছাড়া আর কারো বন্দেগী করবো না, তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবো না, আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে আমাদের কেউ রব বানাবে না। -আল-ইমান-৬৪
————————— বল, যিনি মানুষের রব, মানুষের বাদশা এবং মানুষের মাবুদ-আমি তাঁর পানাহ চাই। -আননাস-১-৩
——————————- সুতরাং যে ব্যক্তি আপন রব -এর সাক্ষাতের আকাংখী, তার উচিত সৎ কাজ করা এবং আপন রব-এর বন্দেগীতে অন্য কারো বন্দেগীকে শরীক না করা। -আল-কাহাফ- ১১০
এ আয়াতগুলো পর্যায়ক্রমে অধ্যয়ন করলে স্পষ্ট জানা যায় যে, কোরআন রুবুবিয়াতকে সার্বভৌমত্বের সম্পূর্ণ সমার্থক বলে প্রতিপন্ন করছে। আর রব-এর এ ধারণা আমাদের সামনে পেশ করছে যে, তিনি বিশ্ব-জাহানের একচ্ছত্র অধিপতি, নিরংকুশ শাসক এবং লা-শরীক মালিক ও বিচারক।
এ হিসাবে তিনি আমাদের ও সারা জাহানের প্রতিপালক, মুরিব্বী এবং অভাব-অভিযোগ পূরণকারী।
এ হিসাবে তিনি আমাদের তত্ত্ববধায়ক, অভিভাবক, কর্মধারক এবং পৃষ্টপোষক।
এ হিসেবে তাঁর ওফাদারী এমন এক প্রাকৃতিক ভিত্তি, যার ওপর আমাদের সমাজ জীবনের প্রাসাদ সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। তাঁর কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্বের সাথে সংশ্লেষণ সকল বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি এবং দলের মধ্যে এক উম্মতের সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে।
এ হিসাবে তিনি আমাদের ও সমগ্র সৃষ্টিকুলের বন্দেগি, আনুগত্য ও অর্চনা পাওয়ার যোগ্য।
এ হিসাবে তিনি আমাদের ও সমুদয় বস্তুর মালিক, মুনিব ও একচ্ছত্র অধিপতি।
আরববাসী ও দুনিয়ার সকল অজ্ঞ-মূর্খ ব্যক্তিরা সকল যুগে এ ভুলে নিমজ্জিত ছিলো এবং বর্তমানে রয়েছে যে, রুবুবিয়তের এ ব্যাপক ধারণাকে তারা পাঁচটি ভিন্ন ধরনের রুবুবিয়াতে বিভক্ত করে ফেলে। নিজেদের ধারণা কল্পনা দ্বারা তারা সিদ্ধান্ত করেছে যে, বিভিন্ন ধরনের রুবুবিয়াত বিভিন্ন ব্যক্তির সাথে সম্পৃক্ত থাকতে পারে, রবং আছেও। কিন্তু কোরআন স্বীয় বলিষ্ঠ যুক্তি-প্রমাণ দ্বারা প্রতিপন্ন করেছে যে, সার্বভৌম ক্ষমতা যার হাতে ন্যস্ত থাকবে, তিনি ছাড়া রুবুবিয়াতের কোন কর্ম কোনও এক পর্যায়ই অন্য কোন সত্তার হাতে ন্যস্ত হবে- বিশ্বচরাচরের এ পরিপূর্ণ কেন্দ্রীয় ব্যবস্থায় তারা বিন্দুমাত্র অবকাশও নেই। এ ব্যবস্থার কেন্দ্রীকতা নিজেই সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, সকল প্রকার রুবুবিয়াত এক আল্লাহর জন্যে নিদিষ্ট- বিশেষিত, যিনি এ ব্যবস্থাকে অস্তিত্ব দান করেছেন। সুতরাং এ ব্যবস্থার অধীনে অবস্থান করে যে ব্যক্তি রুবুবিয়াতের কোন অংশও কোন অর্থেই আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো সাথে সম্পৃক্ত বলে মনে করে বা কার্যত সম্পৃক্ত করে, বস্তুত সে ব্যক্তি বাস্তবতার সাথে দ্বন্দ্ব -সংঘর্ঙে লিপ্ত হয়, সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। সত্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং বাস্তবতার বিরুদ্ধে কার্য করে স্বয়ং নিজেকেই ধবংসের মধ্যে নিমজ্জিত করে।