ছোটদের শহীদ হাসানুল বান্না
মিশরের ছোটছেলে হাসান
দেশের নাম মিসর। সে দেশের এক ছেলে। নাম তার হাসান। আলেম পরিবারে তার জন্ম। ছোট বেলা থেকে আল্লাহর বাণী আর রাসূলের হাদিসের মধ্যে মানুষ। তার আব্বা ঘড়ির কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। আব্বার কাছে পবিত্র কোরআন শেখেন আর ঘড়ির কাজ করা দেখেন।
হাসান আর পাঁচটা ছেলের মত হেসে খেলে জীবন কাটতে ভালোবাসেন না। তিনি ভাল থাকতে চান আর অপরেও যাতে ভাল থাকে সে চেষ্টা করেন। ছোট বেলা থেকেই অন্যায় আর খারাপ কাজের প্রতি তার প্রচন্ড ঘৃণা। তিনি অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করেন। সমাজে যাতে কেউ খারাপ পথে না যায় তিনি সে চেষ্টা চালান।
নীল নদের সেই মজার ঘটনা
মিসর দেশের উপর দিয়ে নীল নদ বয়ে গেছে। নীল নদে ভেসে চলে কত রকমের পাল তোলা নৌকা। এসব নৌকা তৈরীর একটা কেন্দ্র ছিল নদীর তীরে। জায়গার নাম মাহমুদিয়া। সেখানে নৌকা তৈরী হত। একবার হাসান স্কুলে যাওয়ার পথে একটা নৌকার মাস্তুল খুব খারাপ একটি মূর্তি দেখলেন। ন্যাংটা এই মূর্তি দেখে তিনি মনে খুবই দুঃখ পেলেন। তিনি চাইলেন মূর্তিটি সরাতে। কিন্তু তার কথাতো সেই নৌকার লোকেরা শুনবে না। তাই তিনি ভাবলেন পুলিশকে জানালে হয়তো এর একটা বিহিত করা যাবে। নিকটেই রয়েছে পুলিশ ফাঁড়ি। তিনি ছুটে গেলেন সেখানে। ফাঁড়িতে বসেছিলেন পুলিশের ইনচার্জ। তিনি ছোট একটি ছেলেকে তার কাছে আসতে দেখে তাকে কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন”:
কি নাম তোমার খোকা?
আমার নাম হাসান
কোথায় থাক
নিকটেই
তুমি কিছু বলতে চাও?
জ্বী হ্যাঁ।
বল তোমার কোন ভয় নেই।
নদীর তীরে একটা নৌকায় খুব খারাপ একটা মূর্তি টাংগিয়ে রেখেছে। ওটা সরিয়ে ফেললে ভাল হয়।
ঠিক আছে। আমি নিজেই যাচ্ছি।
চল।
হাসানের সাথে পুলিশের ইনচার্জ নদীর তীরে গেলেন। হাসান তাকে খারাপ মূর্তিটা দেখালো। তখন ইনচার্জ নৌকার মালিককে বেশ ধমমের সূরে মূর্তিটা সরিয়ে ফেলতে বললেন। লোকটি পুলিশ দেখে ভয় পেয়ে তখনই মূর্তিটা সরিয়ে ফেলল। এতে বালক হাসানের মুখে হাসি ফুটলো। তিনি খুব খুশী হয়ে স্কুলে ফিরলেন। এদিকে পুলিশের ইনচার্জ এঘটনায় খুবই অবাক হলেন। তিনি এই সৎ আর ভাল ছেলেটির ব্যাপারে আরো মনোযোগী হওয়ার প্রয়োজন মনে করলেন। তিনি পরদিন হাসানের স্কুলে গিয়ে তার প্রধান শিক্ষককে আগের দিনের ঘটনা খুলে বললেন। প্রধান শিক্ষক মুহাম্মদ আফেন্দি এ ঘটনা শুনে খুব খুশী হলেন। তার স্কুলে হাসানের মত একটা ভাল ছেলে আছে জেনে তিনি গৌরব বোধ করলেন। তিনি হাসানকে নিজের কাছে ডেকে নিয়ে তার সৎ সাহসের জন্য তাকে বাহবা দিলেন। আর স্কুলের সব ছাত্রকে ডেকে এ ঘটনা জানালেন।
সমিতির নেতা হাসানুল বান্না
হাসানের স্কুলের অংকের শিক্ষক ছিলেন একজন ভাল লোক। তাঁর নাম মুহাম্মদ আফেন্দি আব্দুল খালেক। তিনি ছাত্রদের চরিত্র গঠনের লক্ষ্যে একটি সমিতি গঠন করেন। সমিতিটি উঁচু ক্লাশের ছাত্রদের দ্বারা পরিচালিত হত। তিনি এই সমিতিকে সহায়তা দিতেন। সবার সাথে ভাল ব্যবহার করাই ছিল এই সমিতির মূল লক্ষ্য। কোন ছাত্র যদি তার ভাইকে গালি দেয় তবে তাকে এক মিলিয়াম জরিমানা দিতে হবে। মিলিয়াম হচ্ছে মিসর দেশের মুদ্রার নাম। আর ক্রোশ হচ্ছে ওদের টাকা। কোন ছাত্র তার আব্বাকে গালি দিলে তাকে দু’মিলিয়াম জরিমানা দিতে হবে। মায়ের সঙ্গে বেয়াদবি করলে এক ক্রোশ জরিমানা দিতে হবে। ইসলাম সম্পর্কে আজে বাজে কথা বললে তাকে দু’ক্রোশ জরিমানা দিতে হবে। কারো সঙ্গে ছগড়া- ফ্যাসাদ করলে দু’ক্রোশ জরিমানা দিতে হবে। জরিমানার অর্থ ভাল কাজে ব্যয় করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সমিতির সদস্যরা একে অন্যকে ভাল কাজে উৎসাহ দেবে। সকলে আল্লাহর কথা মেনে চলবে। আব্বা আম্মা যা বলবেন তাই করবে। বড়দের সম্মান করবে। হাসান এই সমিতির সদস্য হলেন। অল্প দিনের মধ্যে তিনিই হলেন এই সমিতির আসল নেতা। তাঁর চমৎকার ব্যবহার আর সুন্দর কথাবার্তায় সকলেই মুগ্ধ। তাই সব ছাত্র মিলে তাকেই সভাপতি করলো। সমিতির অনেক সদস্য সমিতির লক্ষ্য অনুাযয়ী চলেনি। একারণে তাদের জরিমানা দিতে হল। ফলে সমিতির কাছে অনেক অর্থ জমা হল। এ থেকে কিছুটা ব্যয় করা হয় সমিতির একজন সদস্যের বিদায়ী অনুষ্ঠানে। তার নাম লবীব ইস্কান্দার। তার ভাই ছিলেন ডাক্তার। তিনি অন্য জায়গায় বদলী হন। ফলে লবীবকে বাধ্য হয়ে ভাইয়ের সাথে চলে যেতে হয়। আর কিছু অর্থ একজন অসহায় লোকের দাফন কাফনের জন্য খরচ করা হয়। লোকটির লাশ নীলনদের পানিতে ভেসেআসে।
ইমাম সাহেবকে চিঠি
হাসানদের স্কুলের কাছে ছিল একটি মসজিদ। অধিকাংশ ছাত্রই সেখানে যোহরের নামাজ আদায় করতো। মসজিদের ইমাম ছিলেন শায়খ মুহাম্মদ সাঈদ। একদিন তিনি দেখেন একজন ছাত্র আযান দিচ্ছে। আযান শেষ হলে ছাত্ররা জামায়াত করে নামাজ আদায় করলো। ইমাম সাহেবের ভয় হল- ছাত্ররা এভাবে মসজিদে এলে মসজিদের পানি বেশী খরচ হতে পারে আর চাটাইও ভেঙ্গে যেতে পারে। কাজেই নামাজ শেষ হলে তিনি জোর করে ছাত্রদের মসজিদ থেকে বের করে দিলেন। হাসান এতে খুবই কষ্ট পেলেন। কেননা আল্লাহ পাক এটা পছন্দ করেন না। কেউ মসজিদে এবাদত করতে গেলে তাকে জোর করে বের করা উচিত নয়। হাসান ছোটবেলা থেকে পবিত্র কোরআন পড়েছেন। তিনি তার অর্থও শিখেছেন। এ ব্যাপারে কোরআনের একটি আয়াতের কথা তার মনে পড়লো। সুরা আল আনআমের ৫২ নং আয়াতে আল্লাহ পাক বলেছেন, ‘যারা নিজের প্রভুকে খুশি করার জন্যে সকাল সন্ধায় তাদের পালনকর্তাকে ডাকে, তুমি তাদেরকে তাড়িয়ে দেবেনা। তাদের হিসাব নেয়া তোমার দায়িত্ব নয় আর তোমার হিসাব নেওয়াও তাদের কাজ নয়। তাদেরকে তাড়িয়ে দিলে তুমি জালেমদের অন্তর্ভুক্ত হবে।’ হাসান মসজিদের ইমাম শায়খ মুহাম্মদ সাঈদের কাছে একটা চিঠি লিখলেন। চিঠিতে এই আয়অতেরও উল্লেখ করলেন। চিঠিটা তাঁর কাছে বিয়ারিং করে পাঠানো হল। এ চিঠি পেয়ে ইমাম সাহেব বুঝতে পারলেণ কে তার কাছে এই চিঠি লিখেছেন। তিনি হাসানের আব্বার সাথে দেখা করলেন। আব্বা সব কথা শুনে বললেন, ছোটদের সাথে ভাল ব্যবহার করা উচিত। ইমাম সাহেব নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। এ ঘটনার পর থেকে তিনি ছোটদের সাথে আর খারাপ ব্যবহা করেননি। বরং সব সময় তাদের সাথে হাসি খুশী ব্যবহার করতন। তবে তিনি হাসানকে ডেকে বললেন,
-ঠিক আছে তোমরা যতক্ষণ খুশী মসজিদে থাকতে পার। তবে একটা শর্ত আছে।
-আলহামদুলিল্লাহ। দয়া করে আপনার শর্তটি বলুন।
-মসজিদ থেকে বের হওয়ার আগে ট্যাংকে পানি ভরে দেবে আর চ্যাটাই ভেঙ্গে ফেললে চাঁদা তুলে চ্যাটাই কিনে দিতে হবে।
-ঠিক আছে আরা রাজি। এ দুটি শর্ত মেনে চলবো।
হাসান স্কুলের পরীক্ষায় ভালভাবে পাশ করেন। তিনি তার কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে একটি সমিতি গঠন করেন। অন্যায় কাজের প্রতিবাদ জানিয়ে তা বন্ধ করার জন্যই এ সমিতি গঠন করা হয়। এ সমিতির নাম রাখেন হারাম প্রতিরোধ সমিতি। এ সমিতির সদস্যেদের মধ্যে ছিলেন, মোহাম্মদ আলী বোদাইর, লবীব আফেন্দি নাওয়ার, আবদুল মুতাআল আফেন্দি ও আব্দুর রহমান। পরবর্তীকালে তাদের মধ্যে কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ শিক্ষক, কেউ ব্যবসায়ী হন। সদস্যদের প্রতি সপ্তাহে ৫ মিলিয়াম থেকে ১০ মিলিয়াম চাঁদা দিতে হত। যারা সঠিক ভাবে নামায আদায় করেনা বা রমযান মাসে রোজা রাখে না তাদের কাছেও চিঠি দেয়া হত। কোন পুরুষকে সোনার হার বা আংটি বা সোনার অন্য কোন জিনিস ব্যবহার করতে দেখলে পত্র মারফত তাকে সে কাজ থেকে বারণ করা হত। ছোট বড় সকলের কাছেই সমিতির পক্ষ থেকে চিঠি দিয়ে হারাম কাজ ছেড়ে দেয়ার জন্য অনুরোধ করা হত। এ ভাবে হাসান তার বন্ধুদের সাথে নিয়ে সমাজ সেবামূলক কাজে অংশগ্রহণ করেন।
হোছাফি ইথওয়ানে মাহফিলে হাসান
হাসান যেখানে থাকেন তার কাছে একটি মসজিদ আছে। সেখানে একদল লোক প্রতিদিন এশার নামাজের পর আল্লাহর জিকির করেন। এরাই হচ্ছেন হোছাফি ইখওয়অন। হাসানও এই জিকিরের মাহফিলে শরীক হন। ছোট বড় সব বয়সের লোক আর শিক্ষিত ও অশিক্ষিত সব ধরনের মানুষ এতে যোগ দেয়। এতে শিশুরাও আসে। এখানে বড়রা শিশুদের খুব আদর করেন। হাসান নিয়মিত এই মাহফিলে আসেন। এখানে হোছাফি ইখওয়ানদের অনেকেরে সাথে তাঁর গভীর বন্ধুত্ব হয়। এদের তিন জন ছিলেন, শায়খ শালবীর রিজাল, শায়খ মুহাম্মদ আবু শোশা এবং শায়খ মুহাম্মদ ওসমান।
শায়খ হাসনাইন আল হোছাফী ইখওয়ানের প্রতিষ্ঠাতা। হাসানের বয়স যখন চার বছর তখন তাঁর ইন্তেকাল হয়। এ কারণে হাসান তাঁর সাথে সাক্ষাতের সুযোগ পাননি। কিন্তু তাতে কি? তিনি শায়খ হোছাফীর লেখা বই পত্র পড়া শুরু করলেন। বই পড়েই তিনি তার সম্পর্কে অনেক কিছু জানলেন। শায়খ হোছাফী কায়রোর আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা লাভ করে আলেম হন। তিনিখুবই মনযোগ সহকারে ইসলাম সম্পর্কে পড়াশুনা করন। তিনি বেশীরভাগ সময় আল্লাহর জিকির করতেন। তিনি রসূল (সা) এর অনুসরণ করতেন। দুনিয়ার চেয়ে আখেরাতের প্রতি তিনি বেশী খেয়াল রাখতেন। তাঁর সঙ্গী সাথীরা সকলেই বলেছেন, শায়খ হোছাফী ফরজ, সুন্নত ও নফল খুব ভাল ভাবে আদায় করতেন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি এভবে চলেছেন। তিনি মানুষকে আল্লাহর দিকেও ডাকতেন। তিনি সব সময় শুধুমাত্র আল্লাহর কিতাব আর রসূল (সা) এর সুন্নাহকেই গ্রহণকরতেন। তিনি ভাল কাজের আদেশ দিতেন আর মন্দ কাজ থেকে বারণ করতেন। এ ব্যাপারে তিনি কোন আপোস করেননি। এমনকি বড় বড় দরবারেও তিনি সত্য কথা বলতে ভয় পেতেন না। হাসান শায়খ হোছাফীর এই গুন জানতে পেরে মুগ্ধ হন। রিয়াজ পাশা তখন মিসরের প্রধানমন্ত্রী। একবার কোন কারণে শায়খ হোছাফী তাঁর সাথে দেখা করতে যান। এমন সময় পাশার কাছে একজন আলেম আসেন। তিনি পাশাকে সম্মান দেখানোর জন্য এমন ভাবে ঝুঁকে পড়েন যেন রুকু করছেন। কোন মানুষকে আল্লাহ ছাড়া আর কোন মানুষের সামনে এভাবে ঝুঁকতে দেখে তিনি খুবই রেগে গেলন। তিনি কড়া ভাষায় সেই আলেমকে বললেন, মাওলানা সাহেব- সোজা হয়ে দাঁড়ান। আল্লাহ ছাড়া আর কারো সামনে মাথা নত করা জায়েজ নেই। আলেম আর প্রধানমন্ত্রী রিয়াজ পাশা এঘটনায় খুবই অবাহ হয়ে গেলেন। তাদের মুখে কোন কথা নেই। বলারই বা কি আছে। শায়খ হোছাফী তো সত্যি কথাই বলেছেন। আর তাঁর মত আল্লাহ ওয়ালা লোকের পক্ষেই এরকম সাহস দেখানো সম্ভব। আলেমকে চুপ থাকতে দেখেশায়খ হোছাফী আরো বললেন,
-আপনি একজন আলেম। আপনি একথা খুব ভাল করেই জানেন। আর ইসলাম সম্পর্কে জানার পরেও যদি আপনি তার ওপর আমল না করেন তাতে নিজের দ্বীন আর জ্ঞানকে কলঙ্কিত করা হবে। তা’হলে আল্লাহ আপনাকে কলংকিত করবেন।
এমন সময় প্রধানমন্ত্রী কাছে তাঁর একজন বন্ধু এলেন। সেই বন্ধুর হাতে ছিল সোনার আংটি। হাতে ছিল একটি লাঠি যার হাতল ছিল সোনার তৈরী। এটা দেখে শায়খ হোছাফী বললেন,
-প্রিয় ভাই, এভাবে সোনার ব্যবহার পুরুষের জন্য হারাম। সোনার জিনিস পরা মেয়েদের জন্র হালাল। কাজেই আপনি এদু’টিকে কোন মেয়েকে দিয়ে দিন।
একবার শায়খ হোছাফী মিসরের গুরুত্বপূর্ণ সরকারী কর্মকর্তা খেদিভ তাওফিক পাশার কাছে গেলেন। তিনি বেশ জোর গলায় খেদিভকে সালাম দিলেন। খেদিভ হাতের ইশারায় সালামের জবাব দেন। কিন্তু ইসলামের নির্দেশ, সালামের জবাব পরিষ্কার ভাবে দিতে হবে যাতে বোধগম্য হয়। কিন্তু খেদিভ তা’ করেননি। এতে শায়খ হোছাফী বললেন,
-সালামের মতই বা তার চেয়ে উত্তম জবাব দেয়া উচিত। তেবল হাতের ইশারায় জবাব দেয়া জায়েজ নয়।
একথা শুনে খেদিভ আবার মুখে সালামের জবাব দিলেন। তিনি শায়খ হোছাফীর সত্য প্রিয়তার জন্য তাকে বললেন,
-আলহামদুলিল্লাহ। আপনি সত্যি কথাই বলেছেন। সত্য কথা বলতে আপনি ভয় পাননি এতে আপনাকে জানাই মোবারকবাদ।
জরব বিভঅগের কর্মচারীদের মধ্যে একজন ছিলেন শায়খ হোছাফীর অনুসারী। একদিন শায়খ হোছাফী তার অফিসে গেলেন। গিয়ে দেখেন একটি মূর্তি। জিজ্ঞেস করেন, এটা কি? কর্মচারীটি বললেন, এটা একটা মূর্তি। কাজের সময় দরকার হয়। শায়খ বলরেন, এটা হারাম। তিনি মূর্তিটি নিয়ে ভেঙ্গে ফেললেন। সে সময় একজন ইংরেজ পরিদর্শক সেখানে আসেন। তিনি মূর্তি ভাঙ্গার ব্যাপারে তর্ক বিতর্ক শুরু করেন। শায়খ তাকে সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে দেন। তিনি বলেন, খাঁটি তাওহীদ প্রতিষ্ঠার জন্যেই ইসলাম এসেছে। ইসলাম মূর্তি পূজা খতম করতে চায়। পরিদর্শক মনে করেছিলেন, ইসলামেও মূর্তি পূজার সুযোগ আছে। তিনি শায়খের কথা মেনে নিলেন এবং তার প্রশংসা করলেন।
হাসানের বায়াত গ্রহণ
মাহমুদিয়ায় ব্যবসা করতেন শায়খ মোহাম্মদ আবুশোশা। তিনি একজন ভাল লোক ছিলেন। বেশ কয়েকজন ছাত্রকে নিয়ে তিনি কবরস্থানে যেতেন। সেখানে সুন্নাত তরিকা মোতাবেক কবর জিয়ারত করে মসজিদে বসে ওযীফা পাঠ করতেন। শায়খ মোহাম্মদ আবু শোশা ছাত্রেদের ওলী আল্লাহদের জীবন কথা শোনাতেন। এসব কাহিনী শুনে তাদে অন্তর নরম হয়ে যেত আর চোখ থেকে পানি পড়তে থাকতো। তিনি খোঁড়া কবর দেখিয়ে বলতেন, শেষ পর্যন্ত এই কবরেই আমাদের ঠাঁই নিতে হবে। তিনি কবরের অন্ধকার আর তার ভয়াবহ অবস্থার কথা আলোচনা করতেন। শায়খ আবু শোশা এসময় নিজেও অঝোরে কাঁদতেন। এতে হাসান ও অন্যান্য ছাত্রদের চোখ থেকে পানি বের হত। অন্যান্যদের সাথে হাসানও বিনয় ও অন্যান্য ছাত্রদের চোখ থেকে পানি বের হত। অন্যান্যদের সাথে হাসানও বিনয় ও নম্রতার সাথে তাওবা করতেন। হাসান শায়খ হোছাফীর ভক্ত ছিলেন। এ অবস্থায় তিনি দামানহুরে গিয়ে শিক্ষক প্রশিক্ষণ স্কুলে ভর্তি হন। দামানহুর শহরেই রয়েছে শায়খ হোছাফীর কবর। হাসান নিয়মিতভাবে সেই কবর জিয়ারতে যেতেন। এসময় হাসান সেখানকার হোছাফী এখওয়ানদের সাথে তাওবা মসজিদে গিয়ে জিকরের মাহফিলে বসতেন। এখানকার মাহফিলের পরিচালক ছিলেন শায়খ বাসইউনী। তিনি একজন ভাল লোক। ব্যবসা করেন। তার কাছে শায়খ হোছাফীর কাছে বায়াত করাবার জন্য তিনি আবেদন জানান। কোন কামেল আল্লাহর ওলীর কথামত চলার প্রতিশ্রুতি দানের নাম বায়ত হওয়া। কামেল ওলীগণ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা)কে সঠিক ভাবে মেনে চলেন এবং তাদের অনুসারীদেরও সেভাবে চলতে বলেন। শায়খ বাসইউনী হাসানের আবেদন মঞ্জুর করলেন।
সৈয়দ সাহেবের ভবিষ্যদ্বানী
একদিন শায়খ হোছাফী (র) এর পুত্র সৈয়দ আব্দুল ওয়াহাব হোছাফী দামানহুরে এলেন। এখবর পেয়ে হাসান খুব খুশী। তিনি সৈয়দ আব্দুল ওয়াহাব হোছাফীর হাতে বায়াত করেন। তাঁর সাথে থেকে হাসান আরো ভাল হতে পারলেন। আব্দুল ওয়াহাব হোছাফী ছিলেন পূত পবিত্র চরিত্রের লোক। তিনি লেনদেন ও আচার ব্যবহারে সুন্দর ছিলেন। মানুষের ধন- দৌলতের প্রতি তাঁর কোন লোভ ছিল না। তিনি মনের চোখে অনেক সময় অনেক কিছু দেখতে পেতেন। এটাকে বলা কাশ্ফ হওয়া। অনেক ওলী আল্লাহর কাশ্ফ হওয়া নিয়ে অনেক ঘটনা রয়েছে। এটা কোন আজগুবি ঘটনা নয়। বরং বাস্তব সত্য কথা। কেননা যে আল্লাহর আপন হয়ে যায়- তার দেখা বলা ও চলা- সব কিছুই আল্লাহর মর্জি মাফিক হয়। এসময় তার পক্ষে অনেক কিছু দেখা ও জানা সম্ভব হয়।
এক মজলিসে সৈয়দ আব্দুল ওয়াহাব হোছাফী হাসান এবং ওস্তাদ আহমদ সাকারীর উদ্দেশ্যে বললেন, আমি এমন অনেক আলামত দেখতে পাচ্ছি যে, আল্লাহ পাক অনেক লোকের অন্তর তোমাদের দিকে ঘুরিয়ে দেবেন, অনেক লোককে তোমাদে সঙ্গী করবেন। যেসব লোক তোমাদের আশেপাশে জড়ো হবেতাদের সময় সম্পর্কে আল্লাহ তোমাদের জিজ্ঞেস করবেন, তোমরা কি তাদের সময়কে ভাল কাজে ব্যয় করেছিলে না সময়ের অপচয় করেছিলে। ভাল কাজে ব্যয় করলে তারা পুরষ্কার পাবে আর তোমরাও পাবে। আর সময়ের অপচয় করলে তোমরাও ধরা পড়বে এবং তারাও। সৈয়দ সাহেব হাসান ও ওস্তাদ আহম্মদ সাকারীকে উদ্দেশ্য করে যা বলেছিলেন পরবর্তীকালে তাই ঘটেছিল। দু’জনেই লক্ষ লক্ষ লোকের নেতা হয়েছিলেন। তাঁরা তাদের অনুসারীদের সময়কে ভাল কাজে ব্যয় করতে সাহায্য করেছিলেন।
আল্লাহর এবাদতে হাসান
হাসান দামানহুরে থাকাকালে আল্লাহর এবাদতে ডুবে থাকেন। এসময় মিসরের মানুষ ইংরেজদের বিরুদ্ধে গন অভ্যুত্থান শুরু করে এবং মিসরের স্বাধীনতা চায়। ফলে বৃটেন মিশরের স্বাধীনতা স্বীকার করে নেয়। গণ অভ্যুত্থান যখন শুরু হয় তখন হাসানের বয়স ছিল ১৪ বছর। আর যখন শেষ হয় তখন বয়স ছিল ১৭ বছর। এসময় তিনি ভাল লোকদের মজলিসে বসতেন। অলী আল্লাহদের কাছে থাকতেন। তাঁরা হাসানকে সবসময় ভাল কাজে উৎসাহিত করতেন।
দামানহুরে মসজিদুল জায়শ ও ফলাকা পুলের কাছে হাতাতেবা মসজিদে হাসান নিয়মিত যেতেন। তিনি কখনো কখনো সারারাত মসজিদে এতেকাফ করতেন। তিনি সামান্য খাওয়া দাওয়া সেরে আল্লাহর জিকর করতেন। এরপর ঘন্টা দু’য়েক ঘুমিয়ে ঠিক মধ্যরাতে তাহাজ্জুদের নামাজের জন্য উঠতেন। আর ফজরের নামাজ পড়তেন। তার পর স্কুলে যেতেন।
আল্লাহর অলীর মাজার জিয়ারত
শুক্রবার ছুটির দিন। এদিন দামানহুরে থাকলে হাসান আশপাশের কোন না কোন অলী আল্লাহর মাজার জিয়ারত করতে যেতেন। ওসুকে যাওয়ার জন্যে ফজরের নামাজের পর পায়ে হেঁটে রওয়ানা হতেন এবং সকাল আটটায় সেখানে পৌঁছতেন। তিন ঘন্টা হেঁটে ২০ কিলোমিটা পথ অতিক্রম করতেন। জিয়ারতের পর সেখানে জুমার নামাজ পড়তেন। হাসান দুপুরের খাবার সেখানে খেয়ে নিয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতেন। পরে আসরের নামাজ পড়ে দামানহুরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হতেন।