পোশাকের ব্যাপারে হাসান
হাসান ছিলেন তাঁর ক্লাসের ফাস্ট বয়। তিনি পরীক্ষায় সব সময় প্রথম হতেন। একারণে তাঁকে স্কুলের প্রিন্সিপালের রুমে গিয়ে অনুপস্থিত ছাত্রদের তালিকা দিয়ে আসতে হত। একদিন তিনি অনুপস্থিত ছাত্রদের তালিকা নিয়ে প্রিন্সিপালের রুমে গেছেন। হাসানের পোশাকের দিকে তাঁর নজর পড়ে। কেননা হাসানের মাথায় ছিল পাগড়ি, হজ্বের সময় যে রকম জুতা পরা হয় তাই ছিল তার পায়ে। পরনে ছিল ঢিলা ঢালা জামা। আর জামার উপর ছিল কালো রুমাল। ডিপি আই সাহেব হাসানের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-তুমি কি এই স্কুলের ছাত্র?
-জ্বী।
-তুমি এমন পোশাক কেন পরেছো?
-কেননা এ ধরনের পোশাক পরা সুন্নত।
-তুমি কি অন্য সব সুন্নত মেনে চলছো- শুধুমাত্র এই একটি সুন্নতই বাকী রয়ে গেছে?
-না। অন্য সুন্নতগুলো তেনম করে পালন করতে পারছি না। অনেক ভুল ত্রুটি হচ্ছে। তবে আমার সাধ্যমত মেনে চলছি।
-এমন অদ্ভূত পোশাক পরে আসায় তুমি স্কুলের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করছো।
-তা’ কিভাবে? কেননা নিয়মিত স্কুলে উপস্থিত হওয়া আর নিয়মিত পাঠ মুখস্থ করাই হচ্ছে স্কুলের শৃঙ্খলা। আমি স্কুলে কখনোই অনুপস্থিত থাকি না। আমি নিয়মিত পাঠ মুখস্থ করি। আমি আমার সেকশনে প্রথম। তাহলে স্কুলের শৃঙ্খলা কিভাবে ভংগ হলো?
-দেখ, তুমি যখন এই স্কুল থেকে পাশ করে বের হবে এবং এই ধরনের পোশাক পরবে তখন শিক্ষা অধিদপ্তর শিক্ষক হিসেবে তোমাকে গ্রহণ করবেন না। কারণ তুমি পোশাকের কারণে ছাত্রদের কাছে হাসি তামাশার পাত্র হবে।
-এখনো সে সময় হয়নি। সময় হলে শিক্ষা অধিদপ্তরে তার সিদ্ধান্তের ব্যাপারে স্বাধীন থাকবে আর আমিও আমার সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে স্বাধীন থাকবো। জীবিকা কারো হাতে নেই। এটা কেবল আল্লাহর হাতে।
ডিপি আই সাহেব চুপ করে গেলেন। প্রিন্সিপাল সাহেব এসময় অন্য কথা জুড়লেন। তিনি ডিপি আই এর কাছে হাসানের পরিচয় দিলেন। আর হাসানকে ক্লাসে যেতে বললেন।
বৃটিশ খেদাও আন্দোলন
১৯১৯ সাল। মিসর জুড়ে চলছে তীব্র আন্দোলন। বৃটিশ রাজ খতম করতে হবে আর মিসরকে স্বাধীন করতে হবে। এ সময় সর্বাত্মক হরতালে সারা দেশ অচল। দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত বিক্ষোভ মিছিল চলছে। বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এসব মিছিলে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ইংরেজ সৈন্যরা গ্রামে গঞ্জে আর শহর জনপদে শিবির স্থাপন করে জনগণের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে জনগণ এসময় নিজেদের **** থেকে ন্যাশনাল গার্ড গঠন করে। ন্যাশনাল গার্ডের স্বেচ্ছাসেবকরা রাতের বেলা এলাকা পাহারা দেয়- যাতে ইংরেজ সৈন্যরা কারো ঘরে লুটপাট আর কারো ইজ্জত সম্মান নষ্ট করতে না পারে। হাসান তখন তের বছরের এক স্কুল ছাত্র। তিনি এসময় স্বাধীনতার জন্য ডাকা হরতালে যোগ দেন আর রাজনতিক নেতাদের বক্তৃতা শোনেন। তখন দেশপ্রেম মূলক একটি গানের দুটি লাইন হাসানকে নাড়া দেয়। সে দু’টি লাইন ছিল।
স্বদেশ প্রেম ঈমানের অঙ্গ –আল্লাহর ফেরেশতা ডাকছে মোদের
স্বাধীনতার ছায়াতলে জমা হতে না পারলেও জান্নাতুল ফিরদাউসে দেখা হবে নিশ্চয়ই।
হাসান ইবাদত বন্দেগীতে ডুবে থাকলেও দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনেও যথাযথ ভূমিকা পালন করতে ভোলেননি। হরতাল বিক্ষোভের সময় পুলিশের সাথেও তাদের সংঘর্ষ হত। হাসানের স্কুলের প্রিন্সিপাল হরতাল আর বিক্ষোভে ভয় পেতেন। তিনি হাসানকে এসব কাজ থেকে বিরত রাখার জন্যে মাহমুদ পাশা আব্দুর রাজ্জাকের কাছে নিয়ে গেলেন। প্রিন্সিপাল বললেন, হাসানেই এ হরতালের জন্য দায়ী। সে ইচ্ছা করলে ছাত্রদের হরতাল থেকে বিরত রাখতে পারে। মাহমুদ পাশা হাসানকে অনেক ভাবে বোঝালেন। তিনি কখনো লোভ দেখালেন আবার কখনো হুমকি আর উপদেশের মাধ্যমে হরতাল করা থেকে হাসানকে বিরত থাকতে বললেন। বিষয়টি নিয়ে হাসানকে চিন্তা ভাবনা করার কথা বলে তিনি হাসানকে ছেড়ে দিলেন।
পুলিশ অফিসার মুগ্ধ হলেন।
আরেক দিনের কথা। সেদিনও ছাত্ররা হরতাল করে। ছাত্রদের সংগ্রাম কমিটি হাসানের বাসায় এক সমাবেশের আয়োজন করে। পুলিশ কেমন করে যেন এই সমাবেশের কথা জানতে পারলো। সমাবেশ চলাকালে হঠাৎ পুলিশ বাসা ঘেরাও করে ফেলে। বাসার মালিক হাজন শয়ীরা পুলিশ দেখে বাইরে বের হন। পুলিশ তাকে সমবেত ছাত্র নেতাদের সম্পর্কে প্রশ্ন করে। হাজন শরীয়া পুলিশের অত্যাচারের ভয়ে মিথ্যা কথা বললেন। তিনি জানান, ছাত্র নেতারা খুব ভোর বেলা এখান থেকে বের হয়ে গেছে। আর ফিরে আসেনি। এই অসত্য কথা শুনে হাসান রেগে গেলেন। তিনি পুলিশ অফিসারের কাছে গিয়ে সত্য কথা বললেন। আর সাথে সাথে একথাও বললেন, আমরা আর আপনারা আলাদা কেউ নই। আমরা সকলেই মিসরীয়। স্বাধীনতা আমাদের অধিকার। আমাদের এই আন্দোলনে যোগ দেয়া আপনাদেরও কর্তব্য। আমাদের সংগ্রাম ব্যর্থ করার জন্য ধরপাকড় করা আপনাদের উচিৎ নয়।
পুলিশ অফিসার হাসানের কথা শুনে মুগ্ধ হলেন। তিনি নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। হাসানের কথা এত তীব্রভাবে তার অন্তরে গেঁথে গেল যে তিনি ছাত্রনেতাদের আর ধরার চেষ্টা করলেন না। বরং তখনি সেখান থেকে পুলিশ বাহিনী নিয়ে ফিরে গেলেন।
আব্বার সাথে ঘড়ি মেরামত ও বই বাঁধাই
হাসান দামান হুরের স্কুলে পড়তেন। সেখানে শনিবার থেকে বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত তাকে থাকতে হত। বৃহস্পতিবার স্কুল হাফ- ডে এজন্য তিনি স্কুল করে জোহরের সময় মাহমুদিয়ায় চলে আসতেন। মাহমুদিয়অ তাঁর আব্বা, আম্মা, ভাই-বোন ও আরও সকলে থাকতেন। শুক্রবার রাতে শায়খ শালবীর রিজালের বাসায় সামষ্টিক পাঠ হত। এসময় ইহইয়াউল উলুম, আহওয়ালুল আওলিয়া ও আল ইয়াকুত ওয়াল হাওয়াহের-এর মত মূল্যবান বই নিয়ে আলোচনা হত। হাসান এতে যোগ দিতেন। এর পর ভোর পর্যন্ত আল্লাহর জিকর হত। হাসান স্কুল ছুটির দিনে তাঁর আব্বার সাথে ঘড়ি মেরামত ও বই বাঁধাইয়ের কাজ করতেন। এ দু’টি কাজ তিনি ভালভাবে করতে পারতেন। রাতে হোছাফী এখওয়ানদের সঙ্গে আল্লাহর জিকর করতেন। হাসান সোমবার ও বৃহস্পতিবার নিয়মিত নফল রোজা রাখতেন।
দারুল উলুমে ভর্তি
গ্রীষ্মের ছুটিতে হাসান সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রস্ধি আলেম শায়খ মুহাম্মদ খালফ্ নূহ এর বাসায় থাকতেন। এসময় তিনি আরবী ব্যাকরণের বই আলফিয়া মুখস্ত করা শুরু করেন। এ বইটির ব্যাখ্যা গ্রন্থ ইবনে আকীল এর পাঠও এসময় তিনি নিতে শুরু করেন। আর ফিক্হ উসূল ও হাদীসের অনেক কিতাবও তিনি পড়তে থাকেন। এর ফলে তিনি দারুল উলূমে ভর্তি হওয়ার যোগ্য হন। দারুল উলূম মিশরের প্রসিদ্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এটি রাজধানী কায়রোতে অবস্থিত। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মেধাবী ও ভাল ছাত্ররা এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে আসে। এজন্যে তাদের ডাক্তারী পরীক্ষা এবং অন্যান্য পরীক্ষা দিতে হয়। হাসান দারুল উলূমে ভর্তি হতে চান। তাই তিনি কায়রো গেলেন। তখন তার বয়স ষোল বছর। আসরের সময় তিনি কায়রোর বাবুল হাদীদে নামলেন। সেখান থেকে ট্রামে উঠলেন। গন্তব্যস্থল আতবা থেকে টমটম যোগে সাইয়্যেদুনা হুসাইন –এ গেলেন। সেখানে তাঁর আব্বার এক বন্ধু থাকেন। ভদ্রলোক কিতাব বিক্রির ব্যবসা করেন। সাথে ছিল আব্বার দেয়া চিঠি। তার হাতে হাসান চিঠিটা দিলেন। তিনি চিঠি দেখলেন না। কেননা হাসানকে আগে থেকে চিনতেন। একজন কর্মচারীর ওপর হাসানের দেখাশুনার ভার দিলেন। কর্মচারীর সঙ্গে তিনি তাঁর বাসায় গেলেন। সেখানে ইফতার করেন। তার কাছ থেকে দারুল উলূম পৌঁছার পথ জেনে নিয়ে তিনি টমটমে চরে ‘আতাবা’ পৌছেন। সেখান থেকে ট্রামে করে কাছরুল আইনী সড়কে যান। সামনেই ছিল দারুল উলূমের ভবন। সেখান থেকে ছাত্ররা বের হচ্ছিল। হাসান তার বন্ধু ওস্তাদ মুহাম্মদ শরফ হাজ্জাজের জন্য অপেক্ষা করলেন। তিনি একবছর আগে দারুল উলূমে ভর্ত হন। কিছুক্ষণ পর বন্ধুর সাথে হাসানের দেখা হল। বন্ধু তাকে বারাকাতুল ফীল- এ নিয়ে যায়। সেখানেই ছিল আব্দুল বাকী মহল্লা। এই মহল্লার একটি বাসায় বন্ধু থাকতেন। হাসান সেখানেই উঠলেন। পরে তিনি ছাত্রদের পরামর্শে একজন মহিলা ডাক্তারের ক্লিনিকে যান। তিনি হাসানের চোখ পরীক্ষা করেন। পরীক্ষার ফিস নেন ৫০ ক্রোশ। এরপর নাম্বার দিয়ে চশমার দোকানে পাঠান। দোকানদার হাসানের চশমা বানিয়ে দিল। এজন্য তাকে ১শ ৫০ ক্রোশ দিতে হল। মেডিকেল পরীক্ষায় হাসান সফল হলেন। এবার তিনি ভর্তি পরীক্ষার জন্য ভালভাবে প্রস্তুত হতে থাকেন।
আবার রাতের স্বপ্ন
যে দিন হাসানের পরীক্ষা তার আগের রাতে তিনি স্বপ্ন দেখেন, কয়েকজন বড় বড় আলেমের সাথে তিনি একটা নৌকায় চড়েছেন। তাদের নৌকা নীল নদের উপর দিয়ে চলছে। তখন মৃদু মন্দ বাতাস বয়ে যাচ্ছে। আলেমদের একজন জিজ্ঞেস করলেন, আলফিয়্যার শরাহ ইবনে আকীল কোথায়? হাসান বললেন, এই তো। তিনি বললেন, এসা এর কোন কোন অধ্যায় আমরা আবার পড়ি।
অমুক পৃষ্ঠা খোল। হাসান পৃষ্ঠাগুলো খুললেন এবং বিষয়গুলো আবার পড়লেন। এরি মধ্যে তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। হাসানের মন ভীষণ আনন্দে ভরে গেল। পরীক্ষার হলে যেসব প্রশ্ন পেলেন সেগুলো আগের রাতে স্বপ্নেই তিনি দেখে নিয়েছেন। তার পরীক্ষা ভাল হল। তিনি দরুল উলূমে ভর্তর জন্য যোগ্য বিবেচিত হলেন। এদিকে কায়রো থেকে ফিরে তিনি টিচার্স ট্রেনিং স্কুলে ডিপ্লোমা পরীক্ষা দিলেন। পরীক্ষার ফল বের হল। স্কুলে তিনি প্রথম হলেন। আর সারা দেশে পঞ্চম স্থান পেলেন। প্রথমিক শিক্ষা বোর্ড হাসানকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক পদে নিয়োগ দিল। তাকে গ্রীষ্মের ছুটির শেষে কর্মে যোগ দিতে বলা হল। এসময় তিনি পড়লেন মহা ফাঁপরে। একদিকে চাকুরী আর অন্যদিকে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ। শেষ পর্যন্ত তিনি উচ্চশিক্ষা গ্রহণকেই বেছে নিলেন। এজন্য তাকে কায়রো যেতে হবে। কেননা দারুল উলূম সেখানেই। আর শায়খ আব্দুল ওয়াহাব হোছাফীর ঠিকানাও কায়রোতে।
কায়রোতে হাসানের পরিবার
পরীক্ষা শেষে হাসান মাহমুদিয়ায় গেলেন। এর আগেই তাদের বাড়ীতে ঐ খবর পৌঁছে গেছে। পরীক্ষার ফল বের হল। হাসান প্রথম হলেন। তার মা চাপ দিলেন, হয় তাকে চাকুরী নিতে হবে না হয় মাকেও কায়রোতে নিয়ে আসতে হবে। হাসান উচ্চ শিক্ষা গ্রহণকেই প্রাধান্য দিলেন। তাই মাকে কায়রো আনার জন্য বাসা ভাড়া নিলেন।
হাসানের ছোট দু’ভাই প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেছে। আব্বার ইচ্ছা আল আজহারে ভর্তি করাবেন। মাহমুদিয়ায় শিক্ষার তেমন সুযোগ নেই। কাজেই তাদের গোটা পরিবারের জন্য কায়রো গমনই উত্তম।
হাসানের আব্বা কায়রো গেলেন। তিনি উপার্জনের চেষ্টা করে সফল হলেন। ফলে গোটা পরিবার কায়রো বদলী হয়ে যায়।
মাহমুদিয়ায় খড়ির দোকান
হাসান মাহমুদিয়ার কথা ভুলতে পারলেন না। কেননা সেখানে তাঁর প্রিয় বন্ধু আহমদ আফেন্দি সাকাফী রয়েছেন। তিনি ব্যবসায়। সেবার এক বছর কায়রোতে এসে তিনি ব্যবসা করেন। ফলে হাসানের সাথে তার দেখা সাক্ষাৎ আগের মতই হল। এরপর তিনি মাহমুদিয়ায় ফিরে যান। হাসানের সাথে চিঠিপত্রের মাধ্যমে তার যোগাযোগ বজায় থাকে। গ্রীষ্মের ছুটি হাসান মাহমুদিয়ায় কাটাতে চাইলেন। এজন্যে আব্বাকে বললেন, তিনি মাহমুদিয়ায় গিয়ে একটি ঘড়ির দোকান দেবেন। এতে এ পেশায় তার বাস্তব অভিজ্ঞতা হবে। তবে হাসানের আব্বা ছেলের মাহমুদিয়ায় যাওয়ার আসল কারণ ভাল ভাবেই জানতেন। কিন্তু ছেলের প্রতি তাঁর অগাধ বিশ্বাস ছিল। তাই তিনি অনুমতি দিলেন। হাসান মাহমুদিয়ায় একটি দোকান নিয়ে ঘড়ি মেরামত করার কাজ শুরু করেন। এর ফলে দু’ভাবে তিনি লাভবান হন। একটি হচ্ছে তিনি আত্মনির্ভর হওয়া শিখলেন, আর দ্বিতীয়টা হচ্ছে নিজ হাতে জীবিকা অর্জনের সৌভাগ্য। মাহমুদিয়ায় হাসান বন্ধু আহমদ আফেন্দির বাসায় থাকতেন। এর ফলে তারা দু’জন হোছাফী ভাইদের সাথে জিকর করতেন ও নানান বিষয়ে আলোচনা করতেন। দিনে নীলনদে গিয়ে গোসল করতেন। আর রাতে জিকর ও ইবাদতে পুরাপুরি মগ্ন থাকতেন। এসময় দরুদ ও ওজীফাও আদায় করতেন। কিন্তু তিনি অন্ধ ভক্ত আর অনুসারী ছিলেন না বরং স্বাধীন চিন্তা ভাবনাও করতেন।
কফি শপে দাওয়াত দেবার প্রস্তাব
কফি শপে মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকার প্রস্তাব দিলে বন্ধুরা হাসানের কথা হেসেই উড়িয়ে দিলেন। তারা বললেন, এটা একটা অসম্ভব কথা। কফি শপে কে ধর্মের কথা শুনবে? সেখানে তো মানুষ অবসর কাটাতে আসে। কেউবা চিত্ত বিনোদনের জন্যে আসে। হাসান তাদের অনেক যুক্তি দেখালেন। তিনি বললেন, যারা মসজিদে যায় তাদের চেয়ে কফিশপে গমনকারী লোকেরা বেশি উপদেশ আর নসিহত শুনতে ভালবাসে। তবে এজন্য ভালো আলোচ্য বিষয় বেছে নিতে হবে আর এমনভাবে কথা বলতে হবে যাতে তাদের আবেগ অনুভূতির উপর আঘাত না হানে। এছাড়া সুন্দর ভাবে তাদের কাছে দাওয়াত তুলে ধরতে হবে। তাছাড়া কম সময়ের মধ্যে কথা শেষ করতে হবে।
কফি শপে ইসলামের দাওয়াত
কফি শপে ওয়াজ আর তাবলীগের কাজ শুরু হল। হাসানিই পরিকল্পনাকারী। আবার তিনিই এর বাস্তবায়নকারী। একদিন হাসান তার বন্ধুদের নিয়ে সালাহুদ্দিন পার্কের কফি শপে গেলেন। কফি শপের মধ্যে লোকে লোকে ঠাসা। কোন টেবিল খালি নেই। লোকজন কফি পান করছে আর আলাপ আলোচনা করছে। হাসান সেখানেই গিযে একজনের হাত থেকে জ্বলন্ত সিগারেট নিয়ে ওপর ছুঁড়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। এসময় সিগারেটটি যাতে কারো গায়ে না পড়ে সেজন্য লোজন সতর্ক হয়ে এদিকে ওদিকে সরে গেল। এবার হাসান সকলের উদ্দ্যেশ্যে বললেন, ভাইসব লক্ষ্য করুন, দুনিয়ার এই সামান্য আগুন থেকে বাঁচার জন্যে আমরা সকলে কতইনা পেরেশান। আর মৃত্যুর পর আখিরাতের আগুন থেকে বাঁচার জন্যে আমাদের মধ্যে কোনই চিন্তা ফিকির নেই। অথচ আখিরাতের আগুন দুনিয়ার আগুনের চেয়ে ৭০গুণ বেশী কষ্টদায়ক। হাসানের কথাগুলো তার অন্তর থেকে বের হচ্ছে। এগুলো এতই আন্তরিক যে উপস্থিত লোকজন মুগ্ধ হয়ে ইসলামের দাওয়াত শুনলো। হাসান সময় বেশী নেননি। দশ মিনিটের মধ্যে তাঁর দাওয়াত তুলে ধরে বিদায় নিতে চাইলেন। কিন্তু কফিশপের মালিক তাদের কফি পান করাতে চাইলেন। হাসান কিছুতেই রাজী নন। কেননা তাঁরা তো নবীদের কাজ করছেন। নবীরা ইসলামের দাওয়াত দিয়ে সেজন্য মানুষের কাছ থেকে কোন টাকা পয়সা বা অন্য কোন বিনিময় মূল্য চাইতেন না। শুধুমাত্র আল্লাহকে খুশী করার জন্যেই তারা মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকতেন। কোরআন পাকের সূরা হুদের ১৫১ নং আয়াতে আল্লাহ নবীদের দাওয়াত দেয়ার কথা বলছেন, ‘লোকগণ, এ উপদেশ দানের জন্য আমরা তোমাদের কাছে কোন বিনিময় চাই না।’
হাসানও ঠি সেভাবে কাজ শুরু করলেন। কফি শপের মালিক প্রথমে বিরক্তিবোধ করলেও তাদের সুন্দর সুন্দর কথাই খুব মুগ্ধ হন। তিনি আরো বলার অনুরোধ জানান। কিন্তু হাসান রাজী হননি। তারা এক রাতেই সাইয়েদা আয়েশা মহল্লাহ থেকে শুরু করে তুলুন চক ও তরীকুল জাবাল হয়ে সালামা সড়ক ও সাইয়েদা জয়নবের অলি গলিতে ছড়িয়ে থাকা কফি শপে ওয়াজ করেন। সে রাতে হাসান ও তার বন্ধুরা ২০ টির বেশী কফি শপে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে বক্তৃতা করেন। প্রতিটি বক্তৃতা ছিল পাঁচ থেকে দশ মিনিট সময়ের জন্য। শ্রোতারা আগ্রহ সহাকারে হাসানদের কথা শোনে। তারা এসব কথার পর কোন কিছু পান করা বা কোন উপহার না নেয়াতে তাদের কথা শ্রোতাদের অন্তরে ভাল ক্রিয়া করে। হাসান তার পরিকল্পনায় একশ ভাগই সফল হলেন। দাওয়াত দেয়ার পর হাসান তার বন্ধুদের নিয়েশায়খুন কেন্দ্রে ফিরে আসেন। তারা এভাবে দাওয়াতের কাজ চালিয়ে যেতে চাইলেন। এজন্র আরো পদক্ষেপ নিলেন।
সাপ্তাহিক আল ফাতাহ্ প্রকাশ
মিসরে সে সময় ইসলাম বিরোধীতা বেড়ে চলছে। মানুষকে ইসলাম থেকে দূরে সরানোর জন্যে চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এর ফলে আল্লাহর পথ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। হাসান এসব দেশে শুনে খুবই কষ্ট পেলেন। তিনি ইসলাম দরদী জ্ঞানী-গুনীদের কাছে তার মনের ব্যাথা প্রকাশ করেন। অনেক বড় বড় আলেমের কাছে গিয়ে তাদের একতাবদ্ধ করতে চাইলেন। কিন্তু কেউ তার কথা শুনলো আবার কেউ শুনলো না। শেষ পর্যন্ত কয়েকজন আলেম ও বিখ্যাত ব্যক্তি একত্রে এক সভা করলেন। তারা ইসলামের দাওয়াতের কাজ করতে রাজী হলেন। সে সময়ে মিসরে কিবতী খৃষ্টানদের সংবাদপত্র খুব শক্তভাবে ইসলাম ও মুসলমানদের খতমের লক্ষ্যে নানাভাবে চেষ্টা করতো। হাসান তাদের মোকাবেলায় আল ফাতাহ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করলেন। পত্রিকার যাবতীয় কাজের দায়িত্ব দেয়া হয় শায়খ আব্দুল বাকী সারওয়ার নাঈম এবং সাইয়েদ মুহিবুদ্দিন আল খতিবের উপর। পরে শুধুমাত্র মুহিবুদ্দিন আল খতীব একাই এ কাজের দায়িত্ব নেন এবং এটা একটি প্রথম শ্রেণীর পত্রিকাতে পরিণত হয়। শিক্ষিত যুব সমাজ এ পত্রিকা থেকে পথের দিশা লাভ করতো।
শেষ শিক্ষাবর্ষ
১৯২৭ সাল হাসানের শেষ শিক্ষাবর্ষ। শিক্ষা জীবন শেষে হাসান কি করবেন বা কোন পথে যাবেন সেটা নিয়ে তিনি অনেক চিন্তা ভাবনা করতে থাকেন। তিনি শিক্ষক হওয়ার কথা ভাবলেন। এর মাধ্যমে তিনি দিনের বেলা শিশুদের শিক্ষাদেবেন আর রাতে শিশুদের পিতা মাতাকে ইসলামের দিকে ডাকবেন। তাদের শেখাবেন সৌভাগ্য কিভাবে অর্জন করতে হয়। কিভাবেচললে আনন্দ আর সুখ পাওয়া যায়।
দারুল উলুমে হাসান তার শিক্ষা জীবনের শেষ বর্ষে বেশ ভালভাবে পড়া শুনা করতে থাকেন। তিনি ডিপ্লোমা পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়ার জন্য বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কিছুদিন পরেই তাকে এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়তে হবে। এটা ভেবে তিনি মনে বে কষ্ট পেতেন। কেননা এখান কয়েক বছর থেকে পড়া শুনা করায় এই প্রতিষ্ঠানের প্রতি তার একটা ভালবাসা হয়ে গেছে। এসব কথা ভেবে হাসান কখনো কখনো দারুল উলূমের মসজিদে আল মুনীরা ও দারুল উলুমের পাঠ কক্ষের এককোনে চিন্তিত মন দাঁড়িয়ে থাকেন। আল্লাহর নবীর একটি কথা তার মনে ভাসতো এ সময়। এতে বলা হয়েছে। ‘তুমি যাকে ভালবাস- শেষ পর্যন্ত তোমাকে তা ছেড়ে যেতে হবে।’
সে বছরেরই জুলাই মাসে হাসান দারুল উলুম থেকে ডিপ্লোমা লাভ করেন। মৌখিক পরীক্ষা দেয়ার জন্যে হাসানকে দু’জন শিক্ষকের এক কমিটির সামনে উপস্থিত হতে হয়। পদ্য ও গদ্যের বিশাল এক ভান্ডার হাসানের মুখস্ত ছিল। তিনি ১৮ হাজার কবিতা মুখস্ত করেন। তোরফা ইবনে লবীবের গোটা কাব্যগ্রন্থ তার মুখস্ত ছিল। পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য হাসান কঠোর পরিশ্রম করেন। কিন্তু তাতে তার কোন দুঃখ নেই। তিনি তো পরীক্ষা পাশের জন্য পড়ালেখা করেন না, বরং জ্ঞান লাভের জন্যেই এই পরিশ্রম করেন।
পরীক্ষায় পাশ ও চাকুরী
সেকালে দারুল উলুম থেকে যারা কৃতিত্বের সাথে পাশ করতেন তাদের বৈদেশিক বৃত্তি দিয়ে বিদেশে শিক্ষা নিতে পাঠানো হত। হাসান যে বছর পাশ করেন সে বছর এ বৃত্তি দেয়া হয়নি। হাসান শে পরীক্ষায়ও প্রথম হয়েছেন। এ কারণে বৃত্তি দেওয়া হলে তিনিই প্রথম সুযোগ লাভ করতেন। বৃত্তি না দেয়ায় হাসানের সামনে এখন শুধামাত্র চাকুরীর পথই খোলা। তিনি ভেবেছলেন, তিনি হয়তো কায়রোতেই চাকুরী করতে পারবেন। কিন্তু এবছর পাশ করেছ বেশী ছাত্র। আর চাকুরী রয়েছে আটটি। কিন্তু কায়রোতে কোন পদ খালি নেই। এ কারণে হাসান কায়রোতে চাকুরী পেলেন না। তাকে দেয়া হয়েছে ইসমাঈলিয়ার চাকুর। স্থানটি দক্ষিণ মিসরে অবস্থিত। ইসমাঈলিয়াতে চাকুরীর কথা জানতে পেরে হাসান মন ক্ষুন্ন হন। তিনি শিক্ষা দপ্তরে গিয়ে এ নিযুক্তির জন্য আপত্তি জানান। কিন্তু তাতে কোন কাজ হয়নি। উল্টো তাকে বলা হল, ইসমাঈলিয়া ভাল শহরগুলোর মধ্যে একটি। সেটি শান্ত শহর। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা এ শহর খাদ্য শস্য উৎপাদনের জন্যে বিখ্যাত। হাসান নিরুপায় হয়ে বাসায় ফেরেন। আব্বার সাথে এ বিষয়ে আলাপ করেন। আব্বা তাকে আল্লাহর নামে কর্মস্থলে চলে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। হাসান আব্বার কথামত সেখানে যাওয়ার জন্য তৈরী হন। তিনি সেখানে গিয়ে কিভাবে মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকবেন সে চিন্তাতেই বিভোর হলেন। তিনি আরো ভাবলে, আহমদ আফেন্দি সাকারী মাহমুদিয়ায় এ মিশনের দায়িত্ব নেবেন। বন্ধু শায়খ হামেদ আসকারিয়া এবং শায়খ আব্দুল হামিদকে কায়রোর দায়িত্ব দেয়া হবে। শায়খ হামেদ আসকারিয়া আল আজহারের উচ্চ ডিগ্রী নিয়ে যাকাকীকে ওয়ায়েজ নিযুক্ত হন। তিনি সেখানে দাওয়াতের কাজ করবেন। আর শায়খ আব্দুল হামিদ উচ্চতর ডিগ্রী নেয়অর পর চাষাবাদ শুরু করেন। একই সাথে তিনি দাওয়াতেরও কাজ করবেন।
ইসমাঈলিয়ায় রওনা
১৯২৭ সালের ১৯ শে সেপ্টেম্বর। ভোরে হাসান ট্রেনে উঠলেন। ইসমাঈলিয়া গিয়ে সেখানকার সরকারী স্কুলে শিক্ষকতার চার্জ বুঝে নেবেন। স্টেশন তার কযেকজন বন্ধু এসেছিলেন তাকে বিদায় জানাতে। এদের মধ্যে মুহাম্মদ আফেন্দি শরনূবীও ছিলেন। তিনিও ভাল লোক। তিনি বললেন, ভাল মানুষ যেখানেই থাকে সেখানেই ভালো প্রভাব ফেলে। আমরা আশা করি আমাদের বন্ধু হাসান ইসমাঈলিয়া শহরেও ভালো প্রভাব ফেলবে। এ কথাগুলো হাসানের মনে গেঁথে গেল।
গাড়ী ছেড়ে দিল। যোহরের সময় ইসমাঈলিয়ায় পৌঁছার কথা। গাড়ীর মধ্যে সাক্ষাৎ হল কয়েকজন শিক্ষক বন্ধুর সাথে। তারাও একই স্কুলে শিক্ষক নিযুক্ত হয়েছেন। হাসান তাদের সাথে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে আলোচনা করলেন। ট্রেন ইসমাঈলিয়ায় থামলো। হাসান শহর পানে তাকালেন। সুন্দর শহর। তিনি প্রথমেই আল্লাহর কাছে কল্যাণ ও ভালোর জন্য দো’আ করলেন। হাসান একটা থাকার হোটেলে উঠলেন। তিনি সেখানে ম্যানেজারের কাছে তার ব্যাগটা রাখলেন। পরে স্কুলে গেলেন। প্রধান শিক্ষক ও অন্যান্য শিক্ষকদের সাথে দেখা করলেন। পুরাতন শিক্ষক ইবরাহীম বানহাবীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো। তারা দু’জন একই রূমে থাকা শুরু করেন। রূমটি জনৈক ইটালীয় মহিলার সম্পত্তি। তার নাম ম্যাডাম ববিনা। রূমটির জন্য তাকে ভাড়া দিতে হত।
নবাগত হাসান
শহরে হাসান নবাগত। তাই হঠাৎ করে তিনি কোন কিছু করতে চান না। আগে সেখানকার পরিবেশ আর পরিস্থিতি বুঝতে হবে। তারপর কাজের সিদ্ধান্ত নেবেন। এজন্য প্রথম প্রথম তিনি শুধু স্কুল, মসজিদ আর তার রুমেই সময় কাটান। অন্য কোথাও যান না। কোন ধরনের কাজও করেন না। তিনি দেখলেন, শহরে ইংরেজদের বেশ প্রভাব। এখানে আসার পর পুরা ৪০ দিন তিনি বাইরে কোথাও বের হননি। শুধুমাত্র শিক্ষকতা, এবাদত বন্দেগী আর বই পুস্তক পড়ে সময় কাটান।
হাসান মসজিদে গিয়ে শহরটি মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় বিরোধ লক্ষ্য করলেন। শহরটির পশ্চিম দিকে রয়েছে বৃটিশ শিবির আর পূর্বদিকে রয়েছে সুয়েজখাল কোম্পানীর কর্মচারীদের কলোনী। শহরটি যেন এ দু’য়ের মধ্যে আবদ্ধ। বেশীর ভাগ লোক এ দু’টি স্থানেই কাজ করে। ইউরোপীয় জীবন ধারার সাথে শহরবাসীর গভীর সংযোগ রয়েছে।
কিন্তু তারপরেও তাদের মধ্যে রয়েছে ইসলামী জজবা। শহরবাসী আলেমদের কথা শোনে ও মানে। কিন্তু আলেমদের মধ্যে কয়েকটি গ্রুপ রয়েছে। এ কারণে সেখানে মানুষের মদ্রে কোন ঐক্য ও সংহতি নেই। কিন্তু ঐক্য ছাড়া কোন ভাল কাজ করা যায় না।