১। বিশ্বনবীর একটি স্বপ্ন
হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রীতি ছিল এই যে, প্রতিদিন ফজরের নামাযের পর সাহাবীদের দিকে মুখ করে বসতেন এবং কেউ কোনো স্বপ্ন দেখেছে কি না বা কারো কিছু জিজ্ঞাসা আছে কি না জানতে চাইতেন। কেউ কিছু জানতে চাইলে তাকে তিনি যথাযথ পরামর্শ দিতেন।
একদিন এরূপ জিজ্ঞাসা করার পর কেউ কিছু বলছে না দেখে তিনি নিজেই বলতে আরম্ভ করলেন। আজ আমি অতি সুন্দর ও আশ্চর্য স্বপ্ন দেখেছি। দেখলাম, দুই ব্যক্তি আমার হাত ধরে আমাকে এক পবিত্র স্থানের দিকে নিয়ে চললো। কিছুদূর গিয়ে দেখলাম, এক ব্যক্তি বসে আছে আর অপর ব্যক্তি তার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়ানো লোকটির হাতে করাতের মত একখানা অস্ত্র আছে। সেই করাত দিয়ে সে বসে থাকা লোকটির মাথা চিরে ফেলছে। একবার মুখের দিক দিয়ে করাত ঢুকিয়ে দিয়ে কেটে ফেলছে।
আবার বিপরীত দিক দিয়েও তদ্রুপ করছে। এক দিক দিয়ে কাটার পর যখন অপর দিক দিয়ে কাটতে যায় তখন আগের দিক জোড়া লেগে স্বাভাবিক হয়ে যায়। এ অবস্থা দেখে আমি আমার সঙ্গীদ্বয়কে জিজ্ঞেস করলাম, এ কি ব্যাপার? তারা বললো, সামনে চলুন।
কিছুদূর গিয়ে দেখলাম, একজন লোক শুয়ে আছে। অপর একজন একখানা ভারী পাথর নিয়ে তার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়ানো লোকটি ঐ পাথরের আঘাতে শোয়া লোকটির মাথা চূর্ণবিচূর্ণ করে দিচ্ছে। পাথরটি সে এত জোরে মারে যে, মাথাকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে সে অনেক দূরে গিয়ে ছিটকে পড়ে। অতঃপর লোকটি যে পাথর কুড়িয়ে আনতে যায়, অমনি ভাঙ্গা মাথা জোড়া লেগে ভাল হয়ে যায়। সে ঐ পাথর কুড়িয়ে এনে পুনরায় মাথায় আঘাত করে এবং মাথা আবার চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যায়। এইভাবে ক্রমাগত ভাঙ্গা ও জোড়া লাগার পর্ব চলছে। এই লোমহর্ষক দৃশ্য দেখে আমি আতংকিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ব্যাপারটা কি আমাকে খুলে বলুন। তারা কোনো জবাব না দিয়ে পুনরায় বললেন, আগে চলুন। কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে দেখি, একটি প্রকান্ড গর্ত। গর্তটির মুখ সরু, কিন্তু অভ্যন্তর ভাগ অত্যন্ত গভীর ও প্রশস্ত। এ যেন একটি জ্বলন্ত চুলো, যার ভেতর দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। আর তার ভেতরে বহুসংখ্যক নর-নারী দগ্ধীভূত হচ্ছে। আগুনের তেজ এত বেশী যেন তাতে ঢেউ খেলছে। ঢেউয়ের সাথে যখন আগুন উচু হয়ে ওঠে, তখন ঐ লোকগুলো উথলে গর্তের মুখের কাছে চলে আসে। আবার যেই আগুন নীচে নেমে যায়, অমনি তারাও সাথে সাথে নীচে নেমে যায়। আমি আতংকিত হয়ে সঙ্গীদ্বয়কে বললাম, বন্ধুগণ! এবার আমাকে বলুন ব্যাপারটি কি? কিন্তু এবার তারাও কোনো জবাব না দিয়ে বললেন, আগে চলুন।
আমরা সামনে এগুতে লাগলাম। কিছুদূর গিয়ে দেখলাম, একটি রক্তের নদী বয়ে চলছে। তীরে একটি লোক দাঁড়িয়ে। তার কাছে স্তুপীকৃত রয়েছে কিছু পাথর। নদীর মধ্যে হাবুডুবু খেয়ে একটি লোক অতি কষ্টে কিনারের দিকে আসার চেষ্টা করছে। কিনারের কাছাকাছি আসামাত্রই তীরবর্তী লোকটি তার দিকে এত জোরে পাথর ছুঁড়ে মারছে যে, সে আবার নদীর মাঝখানে চলে যাচ্ছে। এভাবে ক্রমাগত তার হাবুডুবু খেতে খেতে কুলে আসার এবং কুল থেকে পাথর মেরে তাকে মাঝ নদীতে হটিয়ে দেয়ার কার্যক্রম চলছে। এমন নির্মম আচরণ দেখে আমি স্তম্ভিত হয়ে আমার সঙ্গীকে বললামঃ বলুন, এ কি ব্যাপার? কিন্তু এবারও তারা জবাব না দিয়ে বললেন, সামনে চলুন।
আমরা আবার এগুতে লাগলাম। কিছুদূর গিয়ে দেখলাম একটি সুন্দর সবুজ উদ্যান। উদ্যানের মাঝখানে একটি উঁচু গাছ। তার নীচে একজন বৃদ্ধ লোক বসে আছে। বৃদ্ধকে বেষ্টন করে বসে আছে বহুসংখ্যক বালক বালিকা। গাছের অপর পারে আরো এক ব্যক্তি বসে রয়েছে। তার সামনে আগুন জ্বলছে। ঐ লোকটি আগুনের মাত্রা বাড়িয়ে চলেছে। সঙ্গীদ্বয় আমাকে গাছে উঠালেন। গাছের মাঝখানে গিয়ে দেখলাম একটি মনোরম প্রাসাদ। এত সুন্দর ভবন আমি আর কখনো দেখি নি। ঐ ভবনে বালক বালিকা ও স্ত্রী পুরুষ-সকল শ্রেণীর মানুষ বিদ্যমান। সঙ্গীদ্বয় আমাকে আরো উপরে নিয়ে গেলেন। সেখানে আরো একটি মনোরম গৃহ দেখতে পেলাম। তার ভেতরে দেখলাম শুধু কিছু সংখ্যক যুবক ও বৃদ্ধ উপস্থিত। আমি সঙ্গীদ্বয়কে বললাম, আপনারা আমাকে নানা জায়গা ঘুরিয়ে অনেক কিছু দেখালেন। এবার এ সবের রহস্য আমাকে খুলে বলুন।
সঙ্গীদ্বয় বলতে লাগলেনঃ প্রথম যে লোকটির মাথা করাত দিয়ে চেরাই করতে দেখলেন, তার মিথ্যা বলার অভ্যাস ছিল। সে যে সব মিথ্যা রটাতো, তা সমগ্র সমাজে প্রসিদ্ধ হয়ে যেতো। কিয়ামত পর্যন্ত তার এরূপ শাস্তি হতে থাকবে।
তারপর যার মাথা পাথরের আঘাতে চূর্ণ বিচূর্ণ হতে দেখলেন, সে ছিল একজন মস্ত বড় আলেম। নিজে কুরআন হাদীস শিখেছিল, কিন্তু তা অন্যকে শিখায়নি এবং নিজেও তদনুসারে আমল করে নি। হাশরের দিন পর্যন্ত তার এ রকম শাস্তি হতে থাকবে।
তারপর যাদেরকে আগুনের বদ্ধ চুলায় জ্বলতে দেখলেন তারা ব্যভিচারী নারী ও পুরুষ। কিয়ামত পর্যন্ত তাদের এই আযাব চলতে থাকবে।
রক্তের নদীতে হাবুডুবু খাওয়া লোকটি দুনিয়ায় সুদ ও ঘুষ খেতো এবং এতিম ও বিধবার সম্পদ আত্মসাৎ করতো।
গাছের নীচে যে বৃদ্ধকে বালক বালিকা পরিবেষ্টিত দেখলেন, উনি হযরত ইবরাহীম এবং বালক বালিকারা হচ্ছে নাবালক অবস্থায় মৃত ছেলেমেয়ে। আর যাকে আগুন জ্বালাতে দেখলেন, তিনি দোযখের দারোগা মালেক। গাছের উপর প্রথম যে ভবনটি দেখেছেন, ওটা সাধারণ ঈমানদারদের বেহেশতের বাড়িঘর। আর দ্বিতীয় যে প্রাসাদটি দেখেছেন, তা হচ্ছে ইসলামের জন্য আত্মত্যাগকারী শহীদদের বাসস্থান। আর আমি জিবরাঈল এবং আমার সংগী ইনি মিকাইল। অতঃপর জিবরীল আমাকে বললেন, উপরের দিকে তাকান। আমি ওপরের দিকে তাকিয়ে একখন্ড সাদা মেঘের মত দেখলাম। জিবরীল বললেন, ওটা আপনার বাসস্থান। আমি বললাম, আমাকে ঐ বাড়িতে যেতে দিন। জিবরীল বললেন, এখনো সময় হয় নি। পৃথিবীতে এখনো আপনার আয়ুকাল বাকী আছে। দুনিয়ার জীবন শেষ হলে আপনি ওখানে যাবেন।
শিক্ষাঃ এ হাদীসটিতে রাসূল(সা) কে স্বপ্নের মাধ্যমে বিভিন্ন অপরাধের পরকালীন শাস্তির নমুনা দেখানোর বিবরণ রয়েছে। নবীদের স্বপ্ন ওহীর অন্তর্ভুক্ত এবং অকাট্য সত্য। সুতরাং এ শাস্তির ব্যাপারে আমাদের সুদৃঢ় ঈমান রাখা এবং এগুলিকে স্মরণে রেখে এসব অপরাধ থেকে নিবৃত্ত থাকা উচিত। বিশেষতঃ এমন কয়েকটি অপরাধের ওপর এখানে আলোকপাত করা হয়েছে, যা সামাজিক অপরাধের অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ যা গোটা সমাজকে অন্যায় ও অনাচারের কবলে নিক্ষেপ করে। যেমনঃ মিথ্যাচার, সুদ, ঘুষ ও পরের অর্থ আত্মসাৎ করা এবং ইসলামের প্রত্যক্ষ জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও তা প্রচারে বিমুখ হওয়া ও সে অনুসারে আমল না করা। একজন মিথ্যাবাদী যেমন মিথ্যা গুজব, অপবাদ ও কুৎসা রটিয়ে জনমতকে বিভ্রান্ত, বিপথগামী ও গোটা দেশবাসীকে অন্যায় সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্ররোচিত করে থাকে। একজন আলেম তেমনি তার নিষ্ক্রিয়তা ও বদআমলী দ্বারা অন্য যে কোনো খারাপ লোকের চেয়ে সমাজকে অধিকতর অপকর্মে প্ররোচিত করে থাকে। আর পরের সম্পদ আত্মসাৎকারী এবং সুদখোর ও ঘুষখোর যে গোটা সমাজকে কিভাবে জুলুম, নিপীড়ন ও শোষণ করে তা ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না।
২। মিরাজের ঘটনাঃ
মিরাজ হচ্ছে রাসূলুল্লাহ(সা) এর জীবনের সবচেয়ে বিস্ময়কর, অলৌকিক ও শিক্ষামূলক ঘটনা। রাত্রে সংঘটিত হয়েছে বলে অনেকে একে স্বপ্ন ভেবে বিভ্রান্ত হয়েছে। আসলে এটি একটি বাস্তব ঘটনা। রাসূলুল্লাহ (সা) সম্পূর্ণ জাগ্রত ও সচেতন অবস্থায় ফেরেশতাদের সাহচর্যে প্রথমে বায়তুল মোকাদ্দাস এবং পরে সেখান থেকে সাত আসমান ও তারও উর্ধ্ব জগত পরিভ্রমণ করেন। এই ঘটনা সম্পর্কে নিম্নে সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম হতে সমন্বিত বিবরণ উদ্ধৃত করা হচ্ছে।
রাসূলুল্লাহ(সা) একদিন সকালে সাহাবায়ে কেরামের মজলিশে বললেন, “গত রাত্রে আমার প্রতিপালক আমাকে বিশেষ সম্মানে ভূষিত করেছেন।গত রাত্রে আমি যখন মসজিদুল হারামে ঘুমিয়ে ছিলাম, তখন তিনজন ফেরেশতা আমার কাছে আসলেন। তাঁরা আমাকে জাগিয়ে আমাকে তুলে নিয়ে যমযম কুয়ার কাছে নিয়ে রাখলেন। অতঃপর জিবরীল আমার গলা থেকে বুক পর্যন্ত চিরে ফেললেন এবং আমার বুক ও পেটের ভেতর থেকে সমুদয় বস্তু বের করলেন। তারপর নিজ হাতে জমযমের পানি দ্বারা ধুয়ে আমার পেট পবিত্র করলেন। অতঃপর একটি সোনার পাত্র আনা হলো। ঐ পাত্র থেকে ঈমান ও হিকমত নিয়ে বুক ও গলার ধমনীগুলো পূর্ণ করলেন এবং জোড়া লাগিয়ে দিলেন। অতঃপর আমাকে মসজিদুল হারামের দরজায় আনা হলো। সেখানে জিবরীল আমাকে বহন করার জন্য খচ্চর সদৃশ বোরাক নামক একটি জন্তু পেশ করলেন। জন্তুটি ছিল শ্বেত বর্ণের। আমি যখন তাতে আরোহণ করলাম, তখন তা এত দ্রুত গতিতে চলতে লাগলো যে, তার পেছনের পা দুটি যে স্থানে স্পর্শ করে, সেখান থেকে সামনের পা যেখানে পড়ে তার দূরত্ব দৃষ্টিসীমার দূরত্বের সমান। এভাবে তা আমাকে বিদ্যুৎবেগে নিয়ে বায়তুল মাকদাসে গিয়ে উপনীত হলো। এখানে জিবরীলের ইংগীতে বোরাকটিকে মাসজিদুল আকসার দরজার কাছে একটি বিশেষ জায়গায় বেঁধে রাখা হলো। বনী ইসরাঈলের নবীগণ এই মসজিদে নামায পড়তে এসে তাদের বাহনকে এ জায়গায় বেঁধে রাখতেন।
অতঃপর আমি মসজিদুর আকসার ভিতর প্রবেশ করে দু’রাকাত নফল নামায পড়লাম। কোনো কোনো বর্ণনা অনুসারে, পূর্ববর্তী সকল নবীগণের ইমাম হয়ে জামায়াতে নামায পড়লাম। তারপর সেখান হতে উর্ধ্বজগতে আরোহনের প্রস্তুতি শুরু হলো। প্রথমে জিবরীল আমার সামনে দু’টি পেয়ালা পেশ করলেন। এর একটিতে দুধ ও অপরটিতে মদ ছিল। আমি দুধের পেয়ালা গ্রহণ করলাম এবং মদের পেয়ালা ফেরত দিলাম। তা দেখে জিবরীল বললেন, আপনি দুধের পেয়ালা গ্রহণ করে স্বাভাবিক দ্বীনকে গ্রহণ করেছেন। অতঃপর উর্ধ্বজগতের ভ্রমণ শুরু হলো। আমাকে ও জিবরীলকে নিয়ে বোরাক আকাশের দিকে উড়ে চলল। আমরা প্রথম আসমানে পোঁছলে জিবরীল দ্বাররক্ষী ফেরেশতাদেরকে দরজা খুলে দিতে বললেন। রক্ষী ফেরেশতারা জিজ্ঞেস করলেন, কে? জিবরীল উত্তর দিলেন, আমি জিবরীল। ফেরেশতারা জিজ্ঞেস করলেন, আপনার সংগে কে? জিবরীল উত্তর দিলেন, হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। ফেরেশতারা পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, তিনি কি আল্লাহর নিমন্ত্রণ পেয়ে এসেছেন? জিবরীল বললেন, অবশ্যই। ফেরেশতারা দরজা খুলতে খুলতে বললেন, এমন ব্যক্তির আগমন মোবারক হোক। আমরা যখন প্রথম আকাশে প্রবেশ করলাম, প্রথমেই হযরত আদম(আ)এর সাথে দেখা হল। জিবরীল আমাকে বললেন, ইনি আপনার পিতা আদম আলাইহিস সালাম। আমি তাঁকে সালাম করলাম। তিনি আমার সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, স্বাগতম, হে সম্মানিত পুত্র ও সম্মানিত নবী। অতঃপর দ্বিতীয় আসমানে পৌঁছলাম। এখানে প্রথম আসমানের মত প্রশ্নোত্তরের পালা অতিক্রম করে দরজা দিয়ে প্রবেশ করলাম। সেখানে হযরত ইয়াহিয়া ও ঈশা(আ) এর সাথে সাক্ষাত হলো। জিবরীল আমাকে তাঁদের উভয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং বললেন, আপনিই আগে সালাম করুন। আমি সালাম করলে তাঁরা উত্তর দিয়ে বললেন, “স্বাগতম, হে সম্মানিত ভাই ও সম্মানিত নবী।” অতঃপর তৃতীয় আসমানে পৌঁছলে পূর্বের মত ঘটনাই ঘটলো এবং সেখানে হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালামের সাথে সাক্ষাত হলো। জিবরীল আমাকে বললেন, আপনিই আগে সালাম করুন। আমি সালাম করলে হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, “স্বাগতম, হে সম্মানিত ভাই ও সম্মানিত নবী।” অতঃপর চতূর্থ আসমানে একইরকম প্রশ্নোত্তর পর্ব অতিক্রম করে হযরত ইদরীস আলাইহিস সালামের সাক্ষাত হলো। অতঃপর পঞ্চম আসমানে হযরত হারূন (আ) ও ষষ্ঠ আসমানে হযরত মূসা (আ) এর সাথে একইভাবে সাক্ষাৎ অনুষ্ঠিত হলো। কিন্তু হযরত মূসার(আ) কাছ হতে বিদায় নেয়ার সময় তাঁর চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠলো। আমি কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, আপনার এই অসাধারণ মর্যাদার জন্য আমার ঈর্ষা হচ্ছে যে, আপনার উম্মত আমার উম্মতের তুলনায় বহু গুণ বেশী বেহেশতবাসী হবে। অতঃপর পূর্বোক্ত প্রশ্নোত্তর পর্ব অতিক্রম করে আমরা যখন সপ্তম আসমানে পৌঁছলাম, তখন সেখানে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের সাথে সাক্ষাত হলো। তিনি সেখানে বায়তুল মা’মুরের দেয়ালের সাথে পিঠ লাগিয়ে বসেছিলেন। এই বায়তুল মা’মুরে প্রতিদিন সত্তর হাজার নতুন নতুন ফেরেশতা প্রবেশ করেন।
তিনি আমার সালামের জবাব দিয়ে বললেন,“স্বাগতম, হে সম্মানিত ভাই ও সম্মানিত নবী।” অতঃপর সেখান থেকে আমাকে সিদরাতুল মুনতাহায় (শাব্দিক অর্থে সীমান্তের বরই গাছ, তবে এটি আসলে কি গাছ তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেন না) নিয়ে যাওয়া হলো।
অতঃপর আল্লাহ আমাকে সম্বোধন করে হুকুম দিলেন যে, আপনার ও আপনার উম্মতের উপর ৫০ ওয়াক্ত নামায ফরয হলো। অতঃপর আমি নিচের দিকে নামতে শুরু করলাম। পথিমধ্যে হযরত মূসা(আ) এর সাথে সাক্ষাত হলো। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, এই মিরাজের সফরে আপনি কি উপঢৌকন পেলেন? আমি বললাম, ৫০ ওয়াক্ত নামায। তিনি বললেন, আপনার উম্মত এই ভারী বোঝা বহন করতে পারবে না। সুতরাং আপনি আবার ফিরে যান এবং আরো কমিয়ে দেয়ার আবেদন জানান। কেননা আমি আপনার পূর্বে নিজের উম্মাতকে পরীক্ষা করেছি। এ কথা শুনে আমি আল্লাহর দরবারে ফিরে গেলাম এবং মিনতি জানানোর পর ৫ ওয়াক্ত কমিয়ে দেয়া হলো। অতঃপর মূসার কাছে আসলে তিনি পুনরায় বললেন, এখনো অনেক বেশী রয়েছে, আবার যান এবং আরো কমিয়ে আনুন। আমি আবার গেলাম। এবারও আরো ৫ ওয়াক্ত কমানো হলো। অতঃপর মূসার পীড়াপীড়িতে আবার যাই এবং আবার ৫ ওয়াক্ত কমিয়ে আনি। এভাবে কয়েকবার গিয়ে কমাতে কমাতে যখন মাত্র ৫ ওয়াক্ত বাকী রইল, তখনও মূসা আমাকে বললেন, আমি বনী ইসরাঈলের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, আপনার উম্মাত ৫ ওয়াক্তও সহ্য করতে পারবে না। সুতরাং আবার যান এবং কমিয়ে আনুন। কেননা প্রতিবার ৫ ওয়াক্ত কমানো হয়েছে। এবার গেলেও হয়তো ৫ ওয়াক্ত কমানো হবে। তখন আমার হাতে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। আমি এখন পুনরায় কমানোর আবেদন জানাতে লজ্জাবোধ করছি।”
বুখারী শরীফের রেওয়ায়াতে আরো বলা হয়েছে যে, শেষবারেও রাসূলুল্লাহ(সা) আল্লাহর কাছে যান এবং বলেন, হে প্রতিপালক! আমার উম্মাতের শরীর, মন, শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি খুবই দুর্বল। অতএব আমার প্রতি এ নির্দেশকে আরো হালকা করে দিন। তখন আল্লাহ তায়ালা বললেনঃ হে মুহাম্মদ! রাসূল (সা) জবাব দিলেনঃ হে প্রভু, আমি হাযির। আল্লাহ বললেনঃ আমার নির্দেশের কোনো রদবদল হয় না। আমি তোমাদের প্রতি যা ফরয করেছিলাম, তা উম্মুল কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে। প্রত্যেক সত কাজের নেকী দশগুণ। উম্মুল কিতাব বা লওহে মাহফুযে পঞ্চাশ ওয়াক্তই লিখা থাকলো। শুধু তোমার ও তোমার উম্মাতের জন্য তা ৫ ওয়াক্ত করা হলো। এরপর তিনি নেমে এলেন এবং নিজেকে জাগ্রত অবস্থায় মসজিদুল হারামে উপনীত দেখতে পেলেন।
শিক্ষাঃ মিরাজের ঘটনার শিক্ষা অনেক। এখানে তার মাত্র কয়েকটি উল্লেখযোগ্য শিক্ষা তুলে ধরছি।
(১) নামায যে ইসলামী ইবাদতগুলির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তা এই ঘটনা হতে দিবালোকের মত স্পষ্ট। আল্লাহ অন্যান্য সকল ইবাদত ফরয করার জন্য ওহী নাযিল করাই যথেষ্ট মনে করেছেন। কিন্তু নামায ফরয করার জন্য ১১৩ বার নির্দেশ দেয়া সত্ত্বেও তাকে যথেষ্ট মনে করেন নি। বিশেষভাবে দাওয়াত দিয়ে রাসূল(সা) কে নিজের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে নিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামায এমন ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় ফরয করলেন যে, প্রতি ওয়াক্তের নামায দশটি ওয়াক্তের সমান বলে ধারণা দেয়া হলো। যাতে এর একটি ওয়াক্তও কেউ তরক করার সাহস না পায়।
(২) রাসূলুল্লাহ(সা) সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হওয়া সত্ত্বেও তাঁর পূর্ববর্তী সকল নবীকে প্রথমে সালাম দিয়েছেন। এ দ্বারা ইসলামের এ শিক্ষাই প্রতিফলিত হয়েছে যে, কোন জায়গায় আগে থেকে উপস্থিত ব্যক্তি এবং পরে আগত ব্যক্তির মধ্যে শেষোক্ত ব্যক্তির কর্তব্য প্রথমোক্ত ব্যক্তিকে সালাম করা, চাই মর্যাদার দিক দিয়ে যিনিই শ্রেষ্ঠ হোন না কেন।
৩। মুমিনের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার আল্লাহর উপর নির্ভরশীলতা
হযরত জাবের থেকে বর্ণিত আছে যে, আমরা রাসূল(সা) এর সঙ্গে যাতুর রিকাব অভিযানে গিয়েছিলাম। একটি ছায়াদার বৃক্ষ দেখে সেখানে রাসূল(সা) বিশ্রাম করতে লাগলেন। আর আমরা কিছু দূরে অবস্থান করতে লাগলাম। সহসা শত্রুপক্ষীয় একজন মোশরেক রাসূল(সা) এর কাছে এল। এ সময়ে রাসূল(সা) ঘুমন্ত ছিলেন এবং তাঁর তরবারী গাছের সাথে ঝুলছিল। সে এসেই রাসূলুল্লাহর(সা) তরবারী হাতে নিয়ে বললো, হে মুহাম্মদ! এখন তোমাকে আমার হাত হতে কে রক্ষা করবে? রাসূল(সা) নির্ভীকভাবে দৃপ্ত কন্ঠে উত্তর দিলেন, আল্লাহ। এ কথা শোনামাত্র লোকটির হাত থেকে তরবারী খসে পড়ল। অমনি রাসূল(সা) তরবারী তুলে নিলেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে তাকে জিজ্ঞাসা করলেনঃ বল, এখন কে তোমাকে আমার হাত হতে রক্ষা করবে? সে বললোঃ আপনি মহানুভবতা প্রদর্শন করুন। রাসূল(সা) বললেনঃ তুমি কি সাক্ষ্য দিতে প্রস্তুত আছ যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো মা’বুদ নেই এবং আমি তাঁর রাসূল। সে বললোঃ না। তবে আমি ওয়াদা করছি যে, আমি কখনো আপনার সাথে যুদ্ধ করবো না এবং আপনার শত্রুদের সঙ্গী হয়ে যুদ্ধ করতে আসবো না। রাসূল(সা) তাকে মুক্ত করে দিলেন। সে চলে গেল। নিজ গোত্রের কাছে গিয়ে সে বললোঃ আমি মুহাম্মদের(সা) সাথে সাক্ষাত করে এলাম। পৃথিবীতে তার চেয়ে উত্তম মানুষ আর নেই।
শিক্ষাঃ (১) আল্লাহর প্রতি দৃঢ় ঈমান, অবিচল নির্ভরতা ও সৎসাহস মুমিন ব্যক্তির সবচেয়ে বড় অস্ত্র।
(২) নাগালে পেয়েও শত্রুর প্রতি মহানুভবতা ও ক্ষমা প্রদর্শন ইসলামের দাওয়াত দাতাদের সবচেয়ে মূল্যবান গুণ। এ দ্বারা মানুষের হৃদয় জয় করা যায়।
(৩) শত্রুকে সব সময় স্বমতে দীক্ষিত করার আশা করা ঠিক নয়। কখনো কখনো তার শত্রুতার তীব্রতা হ্রাস পাওয়াকেই যথেষ্ট মনে করা উচিত। তাকে সংঘর্ষের পথ থেকে সরাতে পারাও একটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য।
৪। মহানবীর আখলাক
(ক) একবার এক সফরে থাকাকালে রাসূল(সা) সাহাবীগণকে একটি ছাগল জবাই করে রান্না করতে বললেন। জনৈক সাহাবী বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ, আমি ছাগলটি জবাই করবো। আর এক সাহাবী আরয করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ, আমি ছাগলটির চামড়া খসাব ও গোশত বানাবো। তৃতীয় সাহাবী আবদার করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ, আমি ছাগলটি রান্না করবো। রাসূল(সা) বললেন, ঠিক আছে। আর আমি ছাগলটি রান্নার জন্য জ্বালানী কাঠ কুড়িয়ে আনবো।
সকলে একযোগে বললোঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ(সা), এ কাজটিও আমরা করতে পারবো, আপনার কিছু করতে হবে না। রাসূল(সা) বললেন, আমি জানি, ও কাজটি আমি না পারলেও তোমরা করতে পারবে। কিন্তু আমি তোমাদের মধ্যে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে বসে থাকা পছন্দ করি না। আল্লাহও এটা পছন্দ করেন না যে, তার কোন বান্দা তার সাথীদের মধ্যে স্বতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য নিয়ে বসে থাকুক।
শিক্ষাঃ
মহানবী(সা) এর এই গুণটি পদমর্যাদা সম্পন্নসহ নির্বিশেষে সকল মুসলমানের আয়ত্ত্ব করা উচিত। অফিস আদালতে বা ঘরোয়া জীবনে সর্বক্ষেত্রে প্রত্যেকের পরস্পরের সহযোগিতা করা উচিত।
(খ) জনৈক ইহুদীর কাছে রাসূল(সা) এর কিছু ঋণ ছিল। লোকটি নির্দিষ্ট সময়ের আগেই ঋণ পরিশোধের জন্য তাড়া দিতে লাগলো। সে মদিনার এক রাস্তায় রাসূল(সা) এর মুখোমুখি হয়ে বললো, “তোমরা আব্দুল মুত্তালিবের বংশধরেরা সময়মত ঋণ পরিশোধ কর না।”
হযরত ওমর তাঁর এই আচরণ দেখে রেগে গিয়ে বললেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনি অনুমতি দিন, ওর গর্দান কেটে ফেলি।”
রাসূল(সা) বললেন, “হে ওমর, আমার এই ইহুদীর জন্য অন্য রকম আচরণের প্রয়োজন ছিল। তুমি বরং ওকে উত্তম পন্থায় ঋণ ফেরত চাইতে বল, আর আমাকে উত্তম পন্থায় ঋণ পরিশোধ করতে বল।”
অতঃপর তিনি ইহুদীর দিকে ফিরে বললেন, তুমি কালকেই তোমার দেয়া ঋণ ফেরত পাবে।
এদিকে রাসূল(সা) এর ব্যবহারে ইহুদীর মনে ভাবান্তর দেখা দিল। সে এগিয়ে এসে বললোঃ “আমি আসলে আপনার প্রতিক্রিয়া দেখতে চেয়েছিলাম। তাওরাতে শেষ নবীর এ রকম আলামতই লেখা আছে। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনিই আল্লাহর রাসূল।” এই বলে সে ইসলাম গ্রহণ করলো।
শিক্ষাঃ
-স্বচ্ছল ব্যক্তির কোনো অস্বচ্ছল ব্যক্তিকে ঋণ দেয়া খুবই সাওয়াবের কাজ। আর সময় মত ঋণ পরিশোধে অক্ষম হলে তাকে সময় বাড়িয়ে দেয়া আরো মহৎ কাজ। তবে সময় হওয়ার আগে ঋণ পরিশোধের জন্য তাড়া দেয়া ও কটূক্তি করায় ঋণ দেয়ার সাওয়াব কমে যায়।
-কারো আচরণে সহসা উত্তেজিত হওয়া উচিত নয়। ধৈর্য্য ও সহিষ্ঞুতায় কখনো কখনো অকল্পনীয় সুফল পাওয়া যায়।
৫। খলিফার আখলাক
(ক) হযরত আবু বকর ছিদ্দীক(রা) যেদিন খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন সেদিনই সকালে কাপড়ের বড় একটা পুটলি মাথায় করে বাড়ি থেকে বেরুলেন। পথে হযরত ওমরের সাথে তার দেখা হলো। ওমর জিজ্ঞাসা করলেন, ওহে রাসূলুল্লাহর খলীফা, আপনি কোথায় চলেছেন?
হযরত আবু বকর বললেন, বাজারে।
হযরত ওমর বললেন, আপনি মুসলমানদের শাসনভার গ্রহণ করেছেন। এখন বাজারে আপনার কি কাজ?
আবু বকর বললেন, বাজারে না গেলে আমার ছেলেমেয়েকে খাওয়াবো কোত্থেকে? নিজের ছেলেমেয়েদের যদি আমি খাবার দিতে না পারি তাহলে গোটা দেশের মুসলমানদেরও তো আমি খাবার দিতে পারবো না।
ওমর বললেন, চলুন, মসজিদে নববীতে যাই। সবার সাথে আলোচনা করে আপনার ও আপনার পরিবারের খোরপোশের কি ব্যবস্থা করা যায়, যাতে আপনি দেশের কল্যাণ সাধন ও খিলাফতের দায়িত্ব পালনে একাগ্রচিত্তে কাজ করতে পারেন। মসজিদে গিয়ে আবু বকর ও ওমর বাইতুল মালের সচিব আবু ওবায়দা ইবনুল জাররাহ ও আরো কিছু সংখ্যক সাহাবীর সঙ্গে বৈঠকে বসলেন এবং ওমর তাঁর অভিমত প্রকাশ করলেন। তখন সকলে আবু বকর ও তাঁর পরিবারের জন্য প্রচলিত নিয়েমে যতটা দরকার খোরপোষ বরাদ্দ করলেন।
শিক্ষাঃ মুসলমানের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদেরকে এরূপ বেতনভাতা দেওয়া উচিত, যাতে তারা মৌলিক প্রয়োজনের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থেকে একাগ্রচিত্তে কাজ করতে পারেন এবং কোনো দুর্নীতিতে লিপ্ত হতে বাধ্য না হন।
(খ) খলিফা হওয়ার পর হযরত ওমর(রা) রাত জেগে এ বলে কাঁদতেন যে, আল্লাহর কসম, আমার শাসনকালে ছাগলও যদি নদীর কিনারে অযত্নে পড়ে থাকে, তবে আমার আশংকা হয় যে, কিয়ামতের দিন তার সম্পর্কে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
একদিন তিনি একজন সঙ্গীকে নিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে এক মহিলা তাকে ডেকে থামালো। তারপর বললো, একদিন তুমি শিশু ওমর ছিলে, এখন তুমি বয়স্ক ওমর হয়েছ। কাল তুমি ওমর ছিলে, আজ হয়েছ মুসলমানদের খলীফা। হে ওমর, আল্লাহ তোমার ওপর যে দায়িত্ব অর্পণ করেছেন, সে ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর। মহিলার কথা শুনে ওমর অঝোরে কাঁদতে লাগলেন। খলীফার সঙ্গী মহিলাকে বললো, ওহে আল্লাহর বান্দী, একটু সংযত হয়ে কথা বলুন। যিনি এই পৃথিবীতে আল্লাহর রাসূলের খলীফা, তাঁকে আপনি কাঁদিয়ে ফেললেন।
ওমর বললেন, “ওহে আমার সহযাত্রী, এ মহিলাকে বলতে দাও। উনি হচ্ছেন সেই খাওলা বিনতে হাকীম, যার কথা স্বয়ং আল্লাহও শুনেছেন এবং পবিত্র কুরআনে তা বর্ণনাও করেছেন, “হে রাসূল, সেই মহিলার কথা আল্লাহ শুনেছেন যে তোমার সাথে তার স্বামীর ব্যাপারে বাকবিতন্ডা করে এবং আল্লাহর কাছে অভিযোগ করে। আল্লাহ তোমাদের উভয়ের আলোচনা শ্রবণ করেন।” সুতরাং খাত্তাবের পুত্র ওমরকে তার কথা শুনতেই হবে।”
শিক্ষাঃ শাসকদের কর্তব্য প্রজাদের যাবতীয় অভাব অভিযোগ অনুযোগ ধৈর্য সহকারে শ্রবণ করা ও যথাসাধ্য প্রতিকার করা।
৬। হযরত আবু বকরের খোদাভীতি
সহীহ আল বুখারীতে বর্ণিত আছে যে, হযরত আবু বকর(রা) এর একজন গোলাম ছিল। সে হযরত আবু বকরকে মুক্তিপণ হিসেবে কিছু অর্থ দেয়ার শর্তে মুক্তি চাইলে তিনি তাতে সম্মত হন। অতঃপর প্রতিদিন সে তার মুক্তিপণের কিছু অংশ নিয়ে আসতো। হযরত আবু বকর(রা)তাকে জিজ্ঞেস করতেন, কিভাবে এটা উপার্জন করে এনেছ? সে যদি সন্তোষজনক জবাব দিতে পারত তবে তা গ্রহণ করতেন, নতুবা করতেন না। একদিন সে রাতের বেলায় তাঁর জন্য কিছু খাবার জিনিস নিয়ে এল। সেদিন তিনি রোযা ছিলেন। তাই তাকে সেই খাদ্যের উৎস সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করতে ভুলে গেলেন এবং এক লোকমা খেয়ে নিলেন। তাঁরপর তাকে জিজ্ঞেস করলেন, এ খাবার তুমি কিভাবে সংগ্রহ করেছ? সে বললোঃ আমি জাহেলিয়াত আমলে লোকের ভাগ্যগণনা করতাম। আমি ভালো গণনা করতে পারতাম না। কেবল ধোকা দিতাম। এ খাদ্য সেই ভাগ্যগণনার উপার্জিত অর্থ দ্বারা সংগৃহীত। হযরত আবু বকর(রা) বললেনঃ কী সর্বনাশ! তুমি তো আমাকে ধ্বংস করে ফেলার উপক্রম করেছ। তারপর গলায় আঙ্গুল ঢুকিয়ে বমি করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু বমিতে খাওয়া জিনিস বেরুলোনা। তখন তিনি পানি চাইলেন। পানি খেয়ে খেয়ে সমস্ত ভু্ক্ত দ্রব্য পেট থেকে বের করে দিলেন। লোকেরা বললঃ আল্লাহ আপনার উপর দয়া করুন। ঐ এক লোকমা খাওয়ার কারণেই কি এত সব? হযরত আবু বকর(রা) বললেনঃ ঐ খাদ্য বের করার জন্য যদি আমাকে মৃত্যুবরণও করতে হতো, তবুও আমি বের করে ছাড়তাম। কেননা আমি শুনেছি, রাসূল(সা) বলেছেনঃ “যে দেহ হারাম খাদ্য দ্বারা গড়ে ওঠে তার জন্য দোযখের আগুনই উত্তম।” তাই আমি আশংকা করেছিলাম যে এই এক লোকমা খাদ্য দ্বারা আমার শরীরের কিছু অংশ গঠিত হতে পারে।
শিক্ষাঃ আখিরাতের কঠিন ও অবধারিত শাস্তির কথা মনে রেখে সব সময় হালাল হারাম বাছ বিচার করে চলা প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য।