৫৫। হযরত উরওয়া ইবনে যুবাইরের পরহেজগারী ও কৃতজ্ঞতা
বিশিষ্ট সাহাবী হযরত উরওয়া ইবনে যুবাইর(রা) একবার উমাইয়া বংশীয় বাদশাহ আবুদল মালেকের সাথে দেখা করতে যান। তাঁর সাথে ছিল তাঁর ছেলে। ছেলের আব্দারক্রমে তাঁরা শাহী আস্তাবল দেখতে গেলেন। ছেলেটি কৌতুহলবশতঃ একটা ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হলে ঘোড়া তাকে এমন জোরে ফেলে দিল যে, সে ঘটনাস্থলেই মারা গেল। উরওয়া বাদশার দরবার হতে ক্ষুন্ন মনে বাড়ী চলে গেলেন। কয়েকদিন পর তার পায়ে এমন এক মারাত্মক ফোঁড়া হলো যে, চিকিৎসকরা তাঁর পা কেটে ফেলার পরামর্শ দিল। নচেৎ সমস্ত দেহ তা দ্বারা সংক্রমিত হতে পারে।
হযরত উরওয়া পা এগিয়ে দিলেন কাটার জন্য। ডাক্তার বললো, “সামান্য মদ খেয়ে নিন যাতে অস্ত্রোপচারের কষ্ট কম অনুভূত হয়।” হযরত উরওয়া বললেন, “আমি কোন অবস্থাতেই কোন হারাম জিনিসের সাহায্য নেব না।”
চিকিৎসক অস্ত্রোপচার করে পা কেটে দিল। হযরত উরওয়া শান্তভাবে বসে দোয়া দরূদ পড়তে লাগলেন। যখন রক্ত বন্ধ করার জন্য ক্ষতস্থানে লোহা পুড়িয়ে দাগানো হলো, তখন যন্ত্রণার তীব্রতা সইতে না পেরে বেহুঁশ হয়ে গেলেন। হুঁশ ফিরে এলে কাটা পা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বলতে লাগলেনঃ
“ওহে পা, যে আল্লাহ তোমাকে আমার বোঝা বহন করার জন্য সৃষ্টি করেছেন, তিনি ভালো করেই জানেন যে, আমি তোমার সাহায্যে হেঁটে কোন হারাম কাজ করতে যাই নি। হে আল্লাহ, তোমার শোকর যে, আমার চার হাত পার মধ্যে মাত্র একখানা তুমি নিয়েছ এবং বাকী তিনখানা অক্ষত রেখেছ; আর চার ছেলের মধ্যে মাত্র একজনকে নিয়েছ এবং তিনজনকে জীবিত রেখেছ। তুমি যদি কিছু কেড়েও নিয়ে থাক, তবে অনেক কিছু অবশিষ্টও রেখেছ। কিছুদিন যদি কষ্টও দিয়ে থাক, তবে অনেকদিন সুখ শান্তিও দিয়েছ।”
৫৬। ইমাম আবু হানিফার মহানুভবতা
ইমাম আবু হানিফার পাড়া প্রতিবেশীদের মধ্যে একজন দিনমজুর বাস করতো। দিনের বেলায় সে নিজের কুঁড়েঘরে বসে নানা রকম কুটির শিল্পের কাজ করতো। অশালীন গান গাইতো ও প্রলাপ বকতো। তার হৈ চৈ তে ইমাম সাহেব এর গভীর রাতের নামায, যিকির ও চিন্তা গবেষণা পর্যন্ত ব্যাহত হতো। তিনি তাকে ঐ বদঅভ্যাস ত্যাগ করার জন্য প্রায়ই অত্যন্ত মিষ্ট ভাষায় উপদেশ দিতেন। কিন্তু সে তাতে কর্ণপাত করতো না। ইমাম অগত্যা নীরবে সবকিছু সহ্য করতেন।
একদিন রাত্রে তিনি লক্ষ্য করলেন যে, ঐ লোকটির কুড়েঘর হতে কোন হৈ চৈ এর আওয়াজ আসছে না। তিনি আজ নির্বিঘ্নে এবাদত জিকির ও চিন্তা গবেষণা চালালেন বটে, কিন্তু তাঁর মন অস্থির ও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো।
ভোরবেলা ইমাম সাহেব তার খোঁজ খবর নিতে গেলেন। তিনি শুনতে পেলেন যে, পুলিশ ঐ মাতাল লোকটিকে ধরে নিয়ে জেলে আটক করেছে।
তৎকালে বাগদাদের সিংহাসনে আসীন ছিলেন উমাইয়া বংশীয় বাদশাহ মানসুর্। ইমাম সাহেব বাদশাহর দরবার কঠোরভাবে এড়িয়ে চলতেন। বাদশাহ নিজেই ইমাম সাহেব এর সাথে কখনো কখনো দেখা করে যেতেন। কিন্তু আজ ইমাম সাহেব তাঁর দরিদ্র প্রতিবেশীর বিপদে অধীর হয়ে বাদশাহর দরবারে চলে গেলেন।
বাদশাহ ও তাঁর আমীর ওমরাহগণ ইমাম সাহেবকে দরবারে আসতে দেখে অবাক হয়ে গেলেন। তারা পরম শ্রদ্ধা সহকারে তাঁকে বসালেন।
তিনি বললেন, “মহামান্য বাদশাহ, আপনার লোকেরা আমার এক প্রতিবেশীকে ধরে এনে জেলে পুরেছে। আমি তার মুক্তি চাইতে এসেছি।”
বাদশাহ এক মুহুর্ত ভেবে জবাব দিলেন, “মান্যবর ইমাম সাহেব, আপনি আজ আমার দরবারে উপস্থিত হয়ে আমাকে যে ধন্য করলেন, সেই আনন্দে ও আপনার সম্মানের খাতিরে আপনার প্রতিবেশীসহ জেলের সকল কয়েদীকে মুক্তি দিলাম।” ইমাম সাহেব তার প্রতিবেশীকে নিয়ে বাড়ীতে ফিরলেন। দিনমজুর এরপর আর মদ স্পর্শ করে নি।
৫৭। ইমাম আবু হানিফা ও নাস্তিক
একবার খলিফা হারুনুর রশীদের নিকট এক নাস্তিক এসে বললেন যে আপনার সাম্রাজ্যে এমন কোন জ্ঞানী ব্যক্তিকে ডাকুন আমি তাকে তর্ক করে প্রমান করে দেব যে এই পৃথীবির কোন স্রস্টা নেই।এগুলো নিজে নিজে সৃস্টি হয়েছে এবং আপনা থেকেই চলে ।খলিফা হারুনুর রশীদের কিছুক্ষন ভেবে একটি চিরকুট মারাফত ইমাম আবু হানিফাকে ডাকলেন ও এই নাস্তিকের সাথে বিতর্কে অংশ নিতে অনুরোধ করলেন।
ইমাম আবু হানিফা দুত মারাফত খবর পাঠালেন যে তিনি আগামীকাল যোহরের সময় আসবেন খলিফার প্রাসাদে নামায পড়ে তারপর বির্তকে অংশ নেবেনপরদিন যোহরের নামাযের সময় খলিফা তার সভাসদ বর্গ ও নাস্তিক তি অপেক্ষা করতে লাগল।কিন্তু যোহরের নামায তো দুরের কথা আসর শেয় হয়ে গেল তিনি মাগরীবের নামাযের সময় আসলেন।নাস্তিকটি তার কাছে এত দেরীতে আসার কারন জনতে চাইল
তিনি বললেন আমি দজলা নদীর ওপারে বাস করি।আমি খলীফার দাওয়াত পেয়ে নদীতে এসে দেখি কোন নৌকা নেই।অনেকক্ষন অপেক্ষা করেও কোন নৌকা পেলাম না। সহসা আমি দেখলাম একটি গাছ আপনা-আপনা উপরে পড়ল্তার পর সেটি চেরাই হয়ে নিজ থেকেই তক্তায় পরিনত হল।তারপরএটি নিজেনিজে একটি নৌকায় পরিনত হল।অত:পর আমি এটায় চড়ে বসলাম।নৌকাটি নিজে নিজে চলতে চলতে আমাকে এপারে পৌছিয়ে দিল।
নাস্তিকটি একথা শুনে হো হো করে হেসে ফেলল।তাপর বলল ইমাম সাহেব আমাকে কি বোকা পেয়েছেন যে আমি এমন গাজাখুরি গল্প বিশ্বাস করব। একটা গাছ আপনা থেকে নৌকায় পরিনত হবে, এটা কি করে সম্ভব? ইমাম আবু হানিফা বললেন ওহে নাস্তিক সাহেব একটা গাছ যদি আপনা থেকে নৌকায় পরিনত না হতে পারে এবং নদী পরাপার না হতে পারে, তাহলে কিভাবে এই বিশাল আকাশ চন্দ্র সূর্য নক্ষত্র আপনা আপনি তৈরী হতে এবং চালু থাকতে পারে ??
নাস্তিকটি লা-জওয়াব হয়ে মুখ কাচুমাচু করে বিদায় নিল। খলিফা হারুনুর রশীদ তার তাৎক্ষনিক জবাবে মুগ্ধ হয়ে ইমাম সাহেব কে সসম্মানে বিদায় দিলেন। কোন তর্কে যাওয়ার আগেই নাস্তিকটি শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে গেল।
শিক্ষাঃ নাস্তিক ও খোদাদ্রোহীদের কোন যুক্তি থাকে না। বিচক্ষণতা ও সাহস নিয়ে তাদের মোকাবিলা করলেই তারা পরাজিত হতে বাধ্য। তবে এ যুগের নাস্তিক ও খোদাদ্রোহীরা যুক্তির অভাবে সন্ত্রাসের আশ্রয় নিয়ে অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। তাদেরকে প্রতিহত করার জন্য মুসলমানদেরকে মাথা ঠান্ডা রেখে সুপরিকল্পিতভাবে শক্তি অর্জন করে জেহাদের জন্য প্রস্ততি নিতে হবে।
৫৮। কে বেশি দানশীল
একবার এক প্রখ্যাত দানশীল সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে জাফর নিজের একটা জমি দেখতে গেলেন। সেখানে একটি গোত্রের খেজুর গাছের ছায়ায় বসলেন এবং একজন নিগ্রো ক্রীতদাসকে দেখতে পেলেন। সে বাগানটি পাহারা দিচ্ছিল। কিছুক্ষণ পর সে খাওয়ার জন্য তিনটি রুটি বের করলো। সে রুটি খাওয়া শুরু করার আগেই একটা কুকুর এসে তাঁর কাছে ঘেঁসে বসলো। ক্রীতদাসটি একটি রুটি কুকুরকে দিল। কুকুর তা খেয়ে ফেললো। সে তাকে আরো একটি দিল। কুকুর তাও খেয়ে ফেললো। অতঃপর সে তৃতীয় রুটিটিও দিল এবং এক নিমিষেই কুকুর তাও খেয়ে ফেললো। আবদুল্লাহ তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলেন।
আবদুল্লাহ বললেনঃ তুমি প্রতিদিন কয়টি রুটি খাও?
ক্রীতদাস বললোঃ তিনটি।
আবদুল্লাহ বললেনঃ তুমি নিজে না খেয়ে সব ক’টা রুটি কুকুরকে দিয়ে দিলে কেন?
ক্রীতদাস বললোঃ এ অঞ্চলে কোন কুকুর নেই। এ কুকুরটা নিশ্চয়ই অনেকদূর থেকে এসেছে এবং নিশ্চয়ই সে ক্ষুধার্ত। তাই তাকে ফিরিয়ে দেয়া পছন্দ করি নি।
আবদুল্লাহ বললেনঃ আজ তুমি কী খাবে?
ক্রীতদাসঃ আজ আমি উপোষ করবো।
আবদুল্লাহ ইবনে জাফর মনে মনে বললেন, এতো আমার চেয়েও দানশীল। অতঃপর ঐ খেজুরের বাগান এবং ক্রীতদাসকে কিনে নিলেন এবং ক্রীতদাসকে স্বাধীন করে বাগানটি তাকে উপহার দিলেন।
৫৯। একজন আরব শেখের মহানুভবতা
তখন স্পেনে মুসলিম শাসন চলছে। আমীর আবদুর রহমান স্পেনের শাসনকর্তা। জনৈক আরব শেখ কর্ডোভার এক গোত্রের সরদার ছিলেন। তার বিপুল ধনসম্পদ ও জমিজমা ছিল।
একদিন তিনি নিজ বাগানে পায়চারী করে বেড়াচ্ছেন। এই সময় জনৈক স্পেনীয় যুবক আকস্মিকভাবে তার বাগানে ঢুকলো এবং তার পায়ে পড়ে জীবনের নিরাপত্তা চাইল।
শেখ তাকে টেনে তুললেন এবং কারণ জানতে চাইলেন। যুবক বললো, “মহানুভব শেখ, পথিমধ্যে এক যুবকের সাথে আমার কথা কাটাকাটি হয়েছিল। আমি ক্রোধে দিশাহারা হয়ে তার মাথায় একটা আঘাত করলাম। যুবকটি তৎক্ষনাত মারা গেল। তার সঙ্গীরা আমাকে ধাওয়া করেছে। আমি জীবনের নিরাপত্তার জন্য পালাচ্ছিলাম। আপনার দরজাটা খোলা দেখে ঢুকে পড়েছি। ঐ ওরা ধেয়ে আসছে। ওদের কোলাহল শোনা যাচ্ছে। দোহাই আপনার, আমাকে প্রাণে বাঁচান।” এই কথা বলে যুবকটি পুণরায় শেখের পা জড়িয়ে ধরলো। সরদার এবারও তাকে টেনে তুললেন এবং বললেন, “তোমাকে নিরাপত্তা দিচ্ছি। কেউ তোমার কিছু করবে না। এসো আমার সঙ্গে।” অতঃপর তিনি যুবকটিকে তার বাড়ীর একটি গোপন কক্ষে সবার অলক্ষ্যে তালা দিয়ে রাখলেন।
যুবককে নিরাপদ কক্ষে তালাবদ্ধ করে বাগানে ফিরে আসতেই তিনি দেখতে পান একটি অকল্পনীয় দৃশ্য। তারা এক সুন্দর সুঠামদেহী যুবকের সদ্য মৃত লাশ ধরাধরি করে নিয়ে এসেছে। লাশ দেখে সরদার এক প্রচন্ড আর্তচিৎকার দিয়েই সটান হয়ে পড়ে গেলেন। কারণ যুবকটি ছিল তাঁরই একমাত্র পুত্র সন্তান। উত্তেজিত জনতার মধ্য হতে একজন বললো, “মান্যবর শেখ, একটা বখাটে স্পেনীয় যুবক এই হত্যাকান্ডটা ঘটিয়েছে। সে এই পর্যন্ত এসে উধাও হয়ে গিয়েছে। আমরা তাকে ধাওয়া করে এসেছিলাম। কিন্তু ধরতে পারলাম না।”
সরদার নিঃসন্দেহে বুঝতে পারলেন যে, তাঁর আশ্রিত যুবকই তাঁর প্রাণপ্রিয় সন্তানকে হত্যা করেছে। জনতা তাঁর সমস্ত বাগান তন্নতন্ন করে খুঁজলো। কিন্তু কোথাও তার সন্ধান পেল না। অবশেষে তারা নিরাশ হয়ে শেখকে স্বান্তনা দিয়ে চলে গেল।
আশ্রিত যুবকটি তার কক্ষ হতে এসব কিছু দেখলো এবং শুনলো। সে উপলব্ধি করতে পারলো যে, তার মৃত্যু আসন্ন। সে তার গোপন কক্ষে চরম আতংকের মধ্যে সময় কাটাতে লাগলো।
লাশটি যথারীতি গোসল, কাফন ও জানাযা শেষে সমাহিত করা হলো। শেখের বাড়িতে কান্নার রোল পড়ে গেল। এই কান্না ও আহাজারীর মধ্য দিয়ে কখন সন্ধ্যা হয়ে গেল কেউ জানে না।
সন্ধ্যা ক্রমশ গাঢ় হয়ে এলো। রাত গভীর হতে গভীরতর হলো। বাড়ীর লোকজন কান্নাকাটি করে ক্লান্ত হয়ে এক সময়ে গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়লো। কিন্তু সরদারের চোখে ঘুম নেই। তিনি তার বিছানা থেকে উঠলেন, ধীর পায়ে অপরাধী যুবকের কক্ষের কাছে গেলেন এবং তার দরজার তালা খুলে দিলেন। তখন ভয়ে কম্পমান যুবককে লক্ষ্য করে তিনি বললেনঃ “তোমার ভয়ের কোন কারণ নেই। তুমি আমার মেহমান। মুসলমান প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে না। এই নাও, এই পোটলায় তোমার পথে খাওয়ার জন্য কিছু খাবার আছে। আর আস্তাবল হতে একটি ঘোড়া নিয়ে এখনি এখান হতে বিদায় হও। আমার ভয় হয়, কখন আবার শয়তানের কুপ্ররোচণায় বিদ্রোহী হয়ে তোমাকে হত্যা করে বসি।”
সীমাহীন কৃতজ্ঞতায় অশ্রুভরা চোখে যুবক তাকালো শেখের দিকে। অতঃপর সালাম জানিয়ে ঘোড়া হাঁকিয়ে দ্রুত চম্পট দিল।
৬০। দুঃসাহসী বীর বিশর বিন আমরের ইসলাম গ্রহণের কাহিনী
দশম হিজরীর কথা। কতিপয় সাহাবী রাসূল(সা) এর পাশে বসেছিলেন। সহসা বিশর বিন আমর আল জারূদের আবির্ভাবে রাসূল(সা) এর পবিত্র মুখমন্ডল উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। সাহাবীগণ এই বিশরের রহস্য নিয়ে কৌতুহলী হয়ে উঠলেন। তারা কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই রাসূল(সা) পূর্বদিকে ইঙ্গিত করে বললেন, “এখানে একটু পরেই উপস্থিত হবে সেই কাফেলা, যাতে শ্রেষ্ঠ প্রাচ্যবাসীদের সমাবেশ ঘটেছে।”
সাহাবীগণ পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলেন। এই কাফেলার পরিচয় জিজ্ঞাসা করতে তাদের সকলের মন আকুপাকু করছিল যে, তারা কোন্ গোত্র এবং কোন্ এলাকার লোক। কিন্তু লজ্জ্বায় কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারলেন না। তবে হযরত ওমর(রা) আর দেরী সইতে পারলেন না। তিনি নিজের ঘোড়ায় চড়ে দূর হতে যে কাফেলাটি ধূলা উড়িয়ে আসছে তা দেখতে এগিয়ে এলেন। একেবারে কাজে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেনঃ আপনারা কোন্ গোত্রের লোক?
তাদের নেতা জবাব দিলেন, “বনু আবদিল কায়েস গোত্রের”।
হযরত ওমর(রা) পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, “আপনারা কেন এসেছেন? ব্যবসার জন্য?”
তারা বললো, না।
রাসূল(সা) এইমাত্র আপনাদের কথা উল্লেখ করেছেন এবং খুব ভালো বলেছেন।
অনতিবিলম্বে কাফেলা রাসূল(সা) এর সামনে উপনীত হলো। তিনি তাদেরকে মোবারকবাদ জানালেন, ইসলামী নিয়মে সালাম দিলেন এবং তাদের আগমনে আনন্দ প্রকাশ করে বললেনঃ “আগন্তুক কাফেলাকে অভিনন্দন; সসম্মানে ও নিঃসঙ্কোচে আসুন।” কাফেলার নেতা ছিলেন আবু গিয়াস বিশর বিন আমর বিন আল মুয়াল্লা আল আবদী। তিনি বনু আব্দুল কায়েসের শাখা বনু আবসের প্রবীণতম নেতা, সরদার ও সর্বাপেক্ষা সম্মানিত ব্যক্তি। প্রতিপক্ষীয় এক গোত্রের ওপর আক্রমণ করে তাদেরকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার কৃতিত্বের জন্য তারা তাকে জারুদ বা নিপাতকারী নামে আখ্যায়িত করে। তারা এসেছিলেন আরব সাগরের উপকূলবর্তী এলাকা হতে। তার বীরত্ব ও সাহসিকতার খ্যাতি সমগ্র আরব উপকূলে ছড়িয়ে পড়েছিল।
জারুদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে উপস্থিত হয়ে আলাপ আলোচনা শুরু করলো, তিনি তার নিকট ইসলাম পেশ করলেন এবং তাকে ইসলাম প্রহণের দাওয়াত ও উপদেশ দিলেন। জারুদ বললো, “ইয়া রাসূলুল্লা। আমার একটা ধর্ম আছে। এখন আপনার ধর্ম গ্রহণের উদ্দেশ্যে আমি নিজ ধর্ম ত্যাগ করতে রাজী আছি। তবে নিজ ধর্ম ত্যাগ করায় আমার কোন ক্ষতি হবে না- আমাকে এ নিশ্চয়তা আপনি দিতে পারেন কি?” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হ্যা, আমি তোমাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি ইসলাম গ্রহণের অর্থ দাঁড়াবে এই যে, আল্লাহ তোমার ধর্মের চেয়েও ভাল ধর্ম গ্রহণ করার সুযোগ দিলেন।”
এ কথা শুনে জারুদ ও তার সঙ্গীরা ইসলাম গ্রহণ করলো। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে দেশে ফিরে যাওয়অর জন্য সওয়ারী [বাহন] প্রার্থনা করলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সওয়ারী প্রদানে অক্ষমতা প্রকাশ করলেন। তখন জারুদ বললো, “ইয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের স্বদেশ গমনের পথে অনেক লাওয়ারিশ পথভ্রষ্ট উট পাওয়া যায়। সেগুলোতে চড়ে আমরা যেতে পারি কি?” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “না,খবরদার। এগুলোতে আরোহণ করো না। ওগুলো দোযখে যাওয়ার বাহন হবে।”
অতঃপর জারুদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ থেকে বেরিয়ে স্বদেশ মুখে রওনা হলেন। তিনি মৃত্যুকাল পর্যন্ত ইসলামের ওপর অবিচল ছিলেন এবং খুবই ভালো মুসলমান ছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তিকালের পর যখন কিছু লোক ইসলাম ত্যাগ করে, সে সময়ও তিনি বেঁচে ছিলেন।
তাঁর গোত্রের এক ব্যক্তি বলে উঠলোঃ “মুহাম্মদ(সা) যদি নবী হতেন, তাহলে মরতেন না।”
সঙ্গে সঙ্গে গোত্রের আরো অনেকে তাকে সমর্থন করলো এবং মুরতাদ হয়ে যেতে লাগলো।
জারুদ তাদের সবাইকে এক জায়গায় সমবেত করে বললেনঃ “হে বনু আবদুল কায়েস, আমি তোমাদের কাছে একটি কথা জিজ্ঞেস করছি। যদি তোমাদের জানা থাকে জবাব দিও, নচেত জবাব দিওনা।”
তারা বললোঃ “ঠিক আছে, জিজ্ঞেস করুন।”
জারুদ বললেন, “তোমরা কি জান যে, অতীতেও আল্লাহর বহু নবী এসেছেন?”
তারা বললোঃ শুনেছি।
জারুদঃ তারা এখন কোথায়?
তারা বললোঃ তারা মারা গেছেন।
জারুদঃ তারা যেমন মারা গেছেন, মুহাম্মদ(সা)ও তেমনি মারা গেছেন। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোন মা’বুদ নেই এবং মুহাম্মদ(সা) আল্লাহর রাসূল। আমি হযরত আবু বকরের কথার পুনরাবৃত্তি করছি যে, মুহাম্মদ(সা) যদি মারা গিয়ে থাকেন, তাতে কিছু যায় আসে না। আল্লাহ চিরঞ্জীব ও চিরস্থায়ী।
এবার তাঁর গোত্রের লোকেরাও কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে বললোঃ “আমরাও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল”।
এরপর হযরত জারুদের আর একটি সৌভাগ্য লাভ করা বাকী ছিল। সেটি হলো শাহাদাত। আল্লাহ তাঁর সে আশাও পূর্ণ করলেন। একুশ হিজরীতে হযরত ওমরের(রা) আমলে পারস্যে প্রেরিত একটি সেনাবাহিনীর সেনাপতি হিসেবে লড়াই করতে করতে তিনি শহীদ হন।
৬১। হযরত জুলকিফল(আ) এর ক্রোধ সংবরণঃ
পূর্বতন নবী আল-ইয়াসা‘ বার্ধক্যে উপনীত হ’লে একজনকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত নিযুক্ত করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এতদুদ্দেশ্যে তিনি তার সকল সাথীকে একত্রিত করে বললেন, যার মধ্যে তিনটি গুণ বিদ্যমান থাকবে, তাকেই আমি আমার খলীফা নিযুক্ত করব। গুণ তিনটি এই যে, তিনি হবেন (১) সর্বদা ছিয়াম পালনকারী (২) আল্লাহর ইবাদতে রাত্রি জাগরণকারী এবং (৩) তিনি কোন অবস্থায় রাগান্বিত হন না।
এ ঘোষণা শোনার পর সমাবেশ স্থল থেকে ঈছ বিন ইসহাক্ব বংশের জনৈক ব্যক্তি উঠে দাঁড়ালেন। সে নবীর প্রতিটি প্রশ্নের জওয়াবে হাঁ বললেন। কিন্তু তিনি সম্ভবতঃ তাকে বিশ্বাস করতে পারলেন না। তাই দ্বিতীয় দিন আবার সমাবেশ আহবান করলেন এবং সকলের সম্মুখে পূর্বোক্ত ঘোষণার পুনরাবৃত্তি করলেন। কিন্তু সবাই চুপ রইল, কেবল ঐ একজন ব্যক্তিই উঠে দাঁড়ালেন। তখন আল-ইয়াসা‘ (আঃ) উক্ত ব্যক্তিকেই তাঁর খলীফা নিযুক্ত করলেন, যিনি তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর নবুঅতী মিশন চালিয়ে নিবেন এবং মৃত্যুর পরেও তা অব্যাহত রাখবেন। বলা বাহুল্য, উক্ত ব্যক্তিই হ’লেন ‘যুল-কিফল’ (দায়িত্ব বহনকারী), পরবর্তীতে আল্লাহ যাকে নবুঅত দানে ধন্য করেন (কুরতুবী, ইবনু কাছীর)।
‘যুল-কিফল’ উক্ত মর্যাদাপূর্ণ দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হয়েছেন দেখে ইবলীস হিংসায় জ্বলে উঠল। সে তার বাহিনীকে বলল, যেকোন মূল্যে তার পদস্খলন ঘটাতেই হবে। কিন্তু সাঙ্গ-পাঙ্গরা বলল, আমরা ইতিপূর্বে বহুবার তাকে ধোঁকা দিতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছি। অতএব আমাদের পক্ষে একাজ সম্ভব নয়। তখন ইবলীস স্বয়ং এ দায়িত্ব নিল।
যুল-কিফল সারা রাত্রি ছালাতের মধ্যে অতিবাহিত করার কারণে কেবলমাত্র দুপুরে কিছুক্ষণ নিদ্রা যেতেন। ইবলীস তাকে রাগানোর জন্য ঐ সময়টাকেই বেছে নিল। একদিন সে ঠিক দুপুরে তার নিদ্রার সময় এসে দরজার কড়া নাড়লো। কাঁচা ঘুম থেকে উঠে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কে? উত্তর এল, আমি একজন বৃদ্ধ মযলূম। তিনি দরজা খুলে দিলে সে ভিতরে এসে বসলো এবং তার উপরে যুলুমের দীর্ঘ ফিরিস্তি বর্ণনা শুরু করল। এভাবে দুপুরে নিদ্রার সময়টা পার করে দিল। যুল-কিফল তাকে বললেন, আমি যখন বাইরে যাব, তখন এসো। আমি তোমার উপরে যুলুমের বিচার করে দেব’।
যুল-কিফল বাইরে এলেন এবং আদালত কক্ষে বসে লোকটির জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। কিন্তু সে এলো না। পরের দিন সকালেও তিনি তার জন্য অপেক্ষা করলেন, কিন্তু সে এলো না। কিন্তু দুপুরে যখন তিনি কেবল নিদ্রা গেছেন, ঠিক তখনই এসে কড়া নাড়ল। তিনি উঠে দরজা খুলে দিয়ে তাকে বললেন, আমি কি তোমাকে বলিনি যে, আদালত কক্ষে মজলিস বসার পর এসো। কিন্তু তুমি কালও আসনি, আজও সকালে আসলে না। তখন লোকটি ইনিয়ে-বিনিয়ে চোখের পানি ফেলে বিরাট কৈফিয়তের এক দীর্ঘ ফিরিস্তি পেশ করল। সে বলল, হুযুর! আমার বিবাদী খুবই ধূর্ত প্রকৃতির লোক। আপনাকে আদালতে বসতে দেখলেই সে আমার প্রাপ্য পরিশোধ করবে বলে কথা দেয়। কিন্তু আপনি চলে গেলেই সে তা প্রত্যাহার করে নেয়’। এইসব কথাবার্তার মধ্যে ঐদিন দুপুরের ঘুম মাটি হ’ল।
তৃতীয় দিন দুপুরে তিনি ঢুলতে ঢুলতে পরিবারের সবাইকে বললেন, আমি ঘুমিয়ে গেলে কেউ যেন দরজার কড়া না নাড়ে। বৃদ্ধ এদিন এলো এবং কড়া নাড়তে চাইল। কিন্তু বাড়ীর লোকেরা তাকে বাধা দিল। তখন সে সবার অলক্ষ্যে জানালা দিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল এবং দরজায় ধাক্কা-ধাক্কি শুরু করল। এতে যুল-কিফলের ঘুম ভেঙ্গে গেল। দেখলেন সেই বৃদ্ধ ঘরের মধ্যে অথচ ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। তিনি বুঝে ফেললেন যে, এটা শয়তান ছাড়া কেউ নয়। তখন তিনি বললেন, তুমি তাহ’লে আল্লাহর দুশমন ইবলীস? সে মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। আমি আজ আপনার কাছে ব্যর্থ হ’লাম। আপনাকে রাগানোর জন্যই গত তিনদিন যাবত আপনাকে ঘুমানোর সময় এসে জ্বালাতন করছি। কিন্তু আপনি রাগান্বিত হলেন না। ফলে আপনাকে আমার জালে আটকাতে পারলাম না। ইতিপূর্বে আমার শিষ্যরা বারবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। আজ আমি ব্যর্থ হ’লাম। আমি চেয়েছিলাম, যাতে আল-ইয়াসা‘ নবীর সাথে আপনার কত ওয়াদা ভঙ্গ হয়। আর সে উদ্দেশ্যেই আমি এতসব কান্ড ঘটিয়েছি। কিন্তু অবশেষে আপনিই বিজয়ী হলেন’। (ইবনে কাছীর)।
উক্ত ঘটনার কারণেই তাঁকে ‘যুল-কিফল’ (ذو الكفل)। উপাধি দেওয়া হয়। যার অর্থ, দায়িত্ব পূর্ণকারী ব্যক্তি।
শিক্ষাঃ ঈমান ও তাকওয়ার ওপর অবিচল থাকতে সংকল্পবদ্ধ হলে শয়তানের কুপ্ররোচণা ও চক্রান্ত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
৬২। মুক্তির জন্য নিজের সৎলোক হওয়াই যথেষ্ট নয়
তাফসীরে বাহরে মুহীতে বর্ণিত আছে যে, হযরত ইউশা ইবনে নূনের নিকট একবার ওহী এল যে, তোমার জাতির এক লক্ষ লোককে আযাবের মাধ্যমে ধ্বংস করা হবে। এদের মধ্যে চল্লিশ হাজার সৎলোক এবং ষাট হাজার অসৎলোক। ইউশা(আ) বললেনঃ হে রাব্বুল আলামীন! অসৎ লোকদের ধ্বংস করার কারণ তো জানি, কিন্তু সৎলোকদেরকে কেন ধ্বংস করা হবে। জবাব এলঃ এই সৎ লোকগুলিও অসৎলোকদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতো। তাদের সাথে পানাহার, উঠাবসা ও হাসি তামাসায় যোগদান করতো। আমার অবাধ্যতা ও পাপাচার দেখে কখনো তাদের চেহারায় অসন্তোষের চিহ্ন ফুটে উঠতো না।
শিক্ষাঃ এই ঘটনা থেকে শিক্ষা পাওয়া যায় যে, আল্লাহর আযাব ও অসন্তোষ হতে মুক্তি পাওয়ার জন্য নিরেট সৎলোক হওয়াই যথেষ্ট নয়, বরং নিজের পার্শ্ববর্তী লোকদেরকেও সৎ বানাবার নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। অবশ্য অসৎ লোকদেরকে সৎ পথে আনার জন্য সাময়িকভাবে তাদের সাথে খোলামেলা ও বন্ধুত্ব করা অবৈধ ও অন্যায় হবে না। তবে এই সময়ে তাদেরকে মন দিয়ে ভালোবাসা যাবে না এবং অন্যায় কাজ হতে তাদেরকে ফেরানো বা বাধা সৃষ্টি করার জন্য প্রতিটি সুযোগকে কাজে লাগিয়ে চেষ্টা করতে হবে।
৬৩। মসজিদুল আকসা নির্মাণের ঘটনা
হযরত দাউদ(আ) এর আমলে একবার কলেরা মহামারীতে প্রায় এক লক্ষ সত্তুর হাজার লোক মারা যায়। যারা এই মহামারী থেকে রক্ষা পায় তাদেরকে হযরত দাউদ(আ) বললেনঃ তোমরা যে আল্লাহর রহমতে এই ভয়াবহ গযব হতে রক্ষা পেলে, সেজন্য আল্লাহর শোকর আদায় কর। তবে শোকর আদায় করার সর্বোত্তম পন্থা হলো মসজিদ নির্মাণ করা।
হযরত দাউদ(আ) এর নির্দেশে লোকেরা মসজিদ নির্মাণের জন্য জমি খুঁড়তে শুরু করে দিল। মসজিদের প্রাচীর মানুষ সমান গাঁথা হলে আল্লাহর নিকট হতে ওহী হলঃ হে দাউদ, আমি বনী ইসরাঈলের শোকরিয়া গ্রহণ করলাম। আমি এ কাজ তোমার ছেলে সোলায়মানকে দিয়ে সম্পন্ন করবো। এখন এ কাজ স্থগিত রাখ।
মসজিদুল আকসার নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার আগেই খ্রিস্টপূর্ব ৯৬৩ সালে হযরত দাউদ(আ) এর মৃত্যু হয়ে যায়। (আতলাসুল কোরআন)। মৃত্যুর আগে ছেলে নবী সোলায়মানকে নির্মাণকাজ সম্পন্ন করার জন্য বলেন। পুত্র সোলায়মান পিতার বাদশাহির উত্তরাধিকারী হয়ে অসিয়ত অনুযায়ী বায়তুল মুকাদ্দাস নির্মাণের অসম্পূর্ণ কাজে হাত দেন। (আল কামিল ফিত তারিখ)। সোলায়মান এর বায়তুল মুকাদ্দাস নির্মাণ ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তার বাদশাহি যেমন বিশাল ছিল, মসজিদুল আকসাও নির্মাণ করেছিলেন তেমনই আলিশান করে। (আতলাসু তারিখিল আম্বিয়া)। এ নির্মাণে মানুষ ও জিন উভয় জাতি সমানভাবে অংশ নিয়েছে বলে আব্রাহামিক ধর্মগুলোতে বলা হয়েছে। পাথর কাটা, দেয়াল গড়া, স্তম্ভ তৈরি_ প্রতিটি কাজের ছিল পৃথক বাহিনী। জিনদের এক দলের দায়িত্ব ছিল সাগরতল থেকে মণি-মুক্তা তুলে আনা। বায়তুল মুকাদ্দাসের পেছনে নবী সোলায়মান সামর্থ্যের সবটুকু ব্যয় করেছিলেন।
দীর্ঘ পরিশ্রমের পর সোলায়মান বনি ইসরাইলকে সমবেত করে এ মসজিদের মর্যাদা তুলে ধরেন। নির্মাণ শেষে শুকরিয়াস্বরূপ এক বিরাট ভোজের আয়োজন করেন তিনি। বায়তুল মুকাদ্দাসের এলাকাকে সোলায়মান রাজধানী বানিয়ে নিয়েছিলেন। তাই আলকুদস শহরও গড়ে তুলেছিলেন সুপরিকল্পিতভাবে। (আল উনসুল জলিল)। সেখানেই খ্রিস্টপূর্ব ৯২৩ সালে তার মৃত্যু হয়। কিন্তু জিনেরা যাতে কাজ শেষ করে চলে না যায়, সেজন্য আল্লাহ তাঁর মৃত্যুর ব্যাপারটা তাঁদের কাছে গোপন রাখলেন। তাঁর মৃতদেহটি লাঠির ভর দিয়ে দাঁড়িয়েই রইল। এভাবে তাঁর মৃত্যুর পরও প্রায় এক বৎসর যাবত কাজ চলে ও নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়।
হযরত সোলায়মানের(আ) লাঠিটি উইপোকায় খেয়ে ফেলায় একদিন তা ভেঙ্গে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে হযরত সোলায়মানের লাশও মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
বর্ণিত আছে যে, জিনদের একটি দল এরূপ ধারণ করতো যে, তারা গায়েব অর্থাৎ অদৃশ্যের খবরাদি জানে। তাদের এই ধারণা ভ্রান্ত প্রমাণ করা ও দর্প চূর্ণ করার উদ্দেশ্যেই আল্লাহ এই কৌশল অবলম্বন করলেন। তারা যদি গায়েব জানতো, তাহলে মৃত হযরত সোলায়মান(আ) এর ভয়ে দীর্ঘ এক বছর অত পরিশ্রম করে মসজিদ নির্মাণ সম্পন্ন করতেন না।
শিক্ষাঃ এই ঘটনা হতে নিম্নোক্ত শিক্ষা লাভ করা যায়।
১. নির্দিষ্ট সময়েই মানুষের মৃত্যু হয়। এই সময়ের কোন হেরফের হয় না এবং কাউকে এক মুহুর্তও সময় বাড়িয়ে দেওয়া হয় না।
২. গায়েব এর খবর একমাত্র আল্লাহ জানেন। জিন, মানুষ বা অন্য কোন সৃষ্ট জীব গায়েব বা অদৃশ্যের খবর জানে না।
৩. আল্লাহর নিয়ামতের শোকর আদায় করার জন্য মৌখিকভাবে আলহামদুলিল্লাহ বলাই যথেষ্ট নয়, বরং কাজের মাধ্যমে বিশেষতঃ আল্লাহর পথে ত্যাগ ও সম্পদ ব্যয়ের মাধ্যমে শোকর আদায় করা কর্তব্য।
৬৪। হযরত উযাইর (আ) এর কাহিনী
বখতে নসর নামক জনৈক রাজা যখন বায়তুল মুকাদ্দাস ধ্বংস করে বনী ইসরাঈলের অনেক লোককে বন্দী করেছিল, তখন বন্দীদের মধ্যে হযরত উযাইর (আলাহিস সালাম )-ও ছিলেন। তিনি নবী বলে রাজা তাঁকে ছেড়ে দিল।
হযরত উযাইর ( আলাইহিস সালাম )-এর সাথে কিন্তু টাকা, খেজুর, পানি ও একটি গাধা ছিল। সেখান থেকে ফেরার পথে হযরত উযাইর ( আলাইহিস সালাম ) এমন একটি গ্রাম দেখতে পেলেন, যার ইমারত ও অট্টালিকাগুলো ধসে মাটির সাথে মিশে গিয়েছিল এবং সেখানে জন-মানবের কোন চিহ্নও ছিল না। এ অবস্থা দেখে উযাইর ( আলাইহিস সালাম ) মনে মনে ভাবতে লাগলেন, এখানকার অধিবাসীরা তো মারা গেছে। তারা এমনভাবে বিলীন হয়ে গিয়েছে যে, যেন তারা কেউ এখানে ছিল না। আল্লাহ তা’আলা এদের আবার কিভাবে পুনর্জীবিত করবেন।
এই ভাবনা ভেবে উযাইর ( আলাইহিস সালাম ) গাধাটিকে একটি গাছের সাথে বেঁধে একটু বিশ্রামের জন্য মাটিতে পিঠ রাখলেন। তখন আল্লাহ তা’আলা তাঁকে মৃত ও ধবংসপ্রাপ্ত জনপদের মানুষদেরকে কিয়ামতের দিন কিভাবে জীবিত করবেন-দুনিয়াতে তার নজির দেখাতে ইচ্ছে করলেন। সে জন্য তাঁকে সেই অবস্থায়ই মৃত্যু দান করলেন।
এরপর আল্লাহ তা’আলা হযরত উযাইর ( আলাইহিস সালাম )-কে এভাবে একশত বছর পর্যন্ত মৃত অবস্থায় রাখলেন। কিন্তু তাঁর শরীর নষ্ট হয়ে বা পঁচে গলে যায়নি। সাথে সাথে তাঁর গাধটিরও মৃত্যু দান করলেন। তবে গাধাটির দেহ পঁচে গলে মাটির সাথে মিশে গেল। শুধু হাঁড়গুলো খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে পড়ে রয়েছে। অপরদিকে তাঁর সাথে যে খাদ্য ছিল, আল্লাহর কুদরতে তার বিন্দু মাত্রও নষ্ট হল না।
মহান আল্লাহ হযরত উযাইর ( আলাইহিস সালাম )-কে দীর্ঘ একশত বছর পর পুনঃ জীবিত করলেন। অতঃপর তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হল, আপনি এ অবস্থায় কত কাল ছিলেন? তিনি উত্তর দিলেন, একদিন বা দিনের কিছু অংশ হবে। হযরত উযাইর ( আলাইহিস সালাম )-কে আল্লাহ তা’আলা যখন মৃত্যু দিয়েছিলেন, তখন ছিল সকাল আর একশত বছর পর তাঁকে যখন জীবিত করলেন, তখন ছিল বিকেল। উযাইর ( আলাইহিস সালাম )এ সময়কে সেদিনের সময়ই মনে করেছিলেন। তাই একদিন বা দিনের কিছু অংশ বলেছিলেন।
তখন আল্লাহ তা’আলা তাঁকে জানালেন, একদিন বা তার কিছু অংশ নয়, আপনি বরং একশত বছর এ অবস্থায় ছিলেন। আপনি দেখুন আপনার গাধার দিকে, তা মরে পঁচে কিভাবে কিভাবে মাটির সাথে মিশে গিয়েছে। আর আপনার খাদ্য ও পানির দিকে লক্ষ্য করুন, তা সম্পূর্ণ পূর্ণ অবস্থায়ই রয়েছে।
এরপর আল্লাহ তা’আলা বললেন, এখন আপনি দেখবেন, গাধার অঙ্গগুলো কিভাবে জোড়া লাগে। তখন তাঁর সামনে আল্লাহ তা’আলা গাধাটিকে তার সকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ জোড়া করে তাকে পূর্বের ন্যায় জীবিত করলেন।
হযরত উযাইর ( আলাইহিস সালাম ) মহান আল্লাহর এ বিস্ময়কর কুদরত অবলোকন করে হৃদয়ে প্রশান্তি অনুভব করলেন এবং আল্লাহ তা’আলার অশেষ শুকরিয়া আদায় করলেন।
ওই একশত বছর পর সে দেশের মধ্যে অনেক পরিবর্তন ও আবর্তন-বিবর্তন ঘটেছিল। বাইতুল মুকাদ্দাস বনী ইসরাঈলের দখলে পুনরায় চলে এসেছিল এবং তা ঈমানদারদের দ্বারা আবাদ হচ্ছিল। তা দেখে হযরত উযাইর ( আলাইহিস সালাম ) খুব আনন্দিত হলেন।
অতঃপর হযরত উযাইর ( আলাইহিস সালাম ) বাড়ীর দিকে রওয়ানা দিলেন। পথিমধ্যে পেটে ক্ষুধা অনুভব করলেন। তাই তাঁর কাছে যে টাকা ছিল, তা নিয়ে বাইতুল মুকাদ্দাস এলাকায় গিয়ে কিছু কিনতে চাইলেন। কিন্তু দোকানদাররা তাঁকে জানালো যে, এ মুদ্রা একশত বছর পূর্বে ছিল। এখন এ মুদ্রা অচল। এছাড়াও কেউ তাঁকে চিনতে পারল না এবং সবাই তাঁকে আশ্চর্য হয়ে দেখছিল। কেননা তখন তিনি পূর্বের ন্যায় যুবক ছিলেন। তা৬র সমবয়সী কেউ বেঁচে ছিল না।
তিনি তাদের কাছে উযাইর বলে নিজেকে পরিচয় দিলেন। তখন সকলেই বলতে লাগল, হযরত উযাইরকে তো বখতে নসর বন্দী করে নিয়ে গেছে। তিনি আর ফিরে আসেন নি। আমরা ভেবেছি, সম্ভবত তাঁর মৃত্যু হয়েছে। তারা আরো বলল যে, উযাইরের ছেলেরা ছোট ছিল। কিন্তু তারা এখন বৃদ্ধ। উযাইর ( আলাইহিস সালাম ) বললেন, আমাকে তাদের কাছে নিয়ে চলুন।
লোকেরা উযাইর ( আলাইহিস সালাম )-কে তাঁর ছেলেদের কাছে নিয়ে গেল। উযাইর ( আলাইহিস সালাম )-এর ছেলেরা তাঁর কথা শুনে যেন আকাশ থেকে পড়লো। কেউ তাঁর কথা বিশ্বাস করতে চাইলো না। শেষে উযাইর ( আলাইহিস সালাম ) কোন উপায় না পেয়ে বললেন, তোমাদের এখানে কি দুইশ বছর বয়সের কোন বৃদ্ধ লোক আছে? তারা বললো, একজন বৃদ্ধা আছে, সে অন্ধ এবং হাঁটতে পারে না। তিনি বললেন, আমাকে তাঁর কাছে নিয়ে যাও।
উযাইর ( আলাইহিস সালাম )-কে সেই বৃদ্ধার কাছে নিয়ে যাওয়া হল। তখন সেই বৃদ্ধা বলল, আপনি যদি উযাইর হয়ে থাকেন, তবে তাওরাত কিতাব মুখস্থ বলুন। উযাইর তা মুখস্থ পারতেন। আপনি উযাইর হলে এখনই তা প্রমাণ হবে। তখন উযাইর ( আলাইহিস সালাম ) তাওরাত মুখস্থ শুনালেন।
বৃদ্ধা বললেন, আমি প্রথম প্রমাণ পেয়েছি, এবার দ্বিতীয় প্রমাণ হল, উযাইর ( আলাইহিস সালাম ) যদি কোন অন্ধের চোখে হাত বুলিয়ে দিতেন, তাহলে আল্লাহর রহমতে সে ভাল হয়ে যেত। আপনি তা দেখান। উযাইর ( আলাইহিস সালাম ) তখন সেই বৃদ্ধার চোখে হাত রাখলেন। আল্লাহর দয়ায় তৎক্ষনাত তার চোখ ভাল হয়ে গেল।
সবাই তখন বলল, নিঃসন্দেহে আপনি উযাইর। কিন্তু এতদিন আপনি কোথায় ছিলেন? তখন উযাইর ( আলাইহিস সালাম ) তাঁর জীবনে ঘটে যাওয়া পুরো ঘটনা খুলে বললেন। সেই কুদরতী কাহিনী সবাই খুব অবাক হল।
রাজা বখতে নসর তাওরাত কিতাব পুড়ে ফেলেছিল। তাই হযরত উযাইর ( আলাইহিস সালাম )-এর মাধ্যমে তা নতুন করে লেখা হল। তিনি মানুষদেরকে আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত দিতে লাগলেন। সবাই উযাইর (আলাইহিস সালাম )-এর দাওয়াতে আল্লাহর দ্বীন পালন করতে লাগল।
৬৫। কাদেসিয়ার এক দূর্ধর্ষ বীরের কথা
চৌদ্দ হিজরীর মুহররম মাসের কথা। মুসলিম বাহিনী সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাসের নেতৃত্বে কাদেসিয়ার ইরানী বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত। ইরানী বাহিনীর সেনাপতি ছিলেন মহাবীর রুস্তম। আজ যুদ্ধের দ্বিতীয় দিন। তুমুল যুদ্ধ চলছে। অনেকে শহীদ হয়েছেন। আবার অনেকে আহত হয়ে শিবিরে চিকিৎসাধীন আছেন। সা‘দ বিন্ আবি ওয়াক্কাছ অসুস্থ, তাই ময়দানে যেতে পারেন নি। কাদেসিয়ার নিজ বাসস্থানের ছাদের উপর থেকে যুদ্ধের দিক নির্দেশনা দিচ্ছিলেন। তাঁর বাড়ির এক কক্ষে এক কয়েদী পায়ে শিকল বাঁধা অবস্থায় আটকা ছিল। মদ্যপানের অপরাধে তাকে শাস্তি দেওয়া হবে। তার চোখে মুখে ছিল ভীষণ উৎকন্ঠা। তাঁর দৃষ্টি কেন্দ্রীভূত রয়েছে রণাঙ্গণের দিকে। হযরত সা’দের স্ত্রী সালমা কোন কাজে ঐ কক্ষের দিকে যাওয়া মাত্রই কয়েদী ভারী শিকল নিয়ে টলতে টলেতে কোন রকমে তাঁর কাছে গিয়ে বললো, “আফসোস! আমাকে মুক্ত করে দাও। তোমার সাথে অঙ্গীকার করছি, যদি রণাঙ্গন থেকে নিরাপদে ফিরে আসি তাহলে নিজেই এসে জিঞ্জিরাবদ্ধ হবো, আর যদি নিহত হই তাহলে তোমরা আমার হাত থেকে রেহাই পেলে।” সালমা অস্বীকার করলেন। কয়েদী গভীর দুঃখে আপনমনে বলছেন, ““আমার জন্যে সবচেয়ে বড় দুঃখ যবে অশ্বারোহীরা ছুটাছুটি করছে
বন্দী-স্থবির পড়ে আছি আমি মহীরূহ সাথে বাঁধা।”
তারপর সা‘দের স্ত্রী সালমা দয়াপরবশ হয়ে তার শিকল খুলে দিলেন। সে উঠে দাঁড়ালো এবং সা‘দের ঘোড়ায় চড়ে বর্শা হাতে নিয়ে রণাঙ্গনে চলে গেলো। সে শত্র“দের যে অংশের ওপরই হামলা করলো তাদেরকেই পরাজিত করলো। লোকেরা (ইসলামী বাহিনীর সৈন্যরা) বলতে লাগলো ঃ “ইসলামের সাহায্যের জন্যে ফেরেশতা এসেছে।” সা‘দ নিজে এ হামলা সমূহের দৃশ্য দেখলেন এবং বললেন ঃ “এ ধরনের লম্ফ আমার ঘোড়ার লম্ফ, কিন্তু যেভাবে বর্শার আঘাত হানা হচ্ছে তা আবু মাহ্জানের বর্শার আঘাত হানার ন্যায়, অথচ ও তো জিঞ্জিরাবদ্ধ আছে।” শত্র বাহিনী পরাজিত হলে আবু মাহ্জান ফিরে আসে এবং পুনরায় নিজের হাতেই নিজের পায়ে জিঞ্জির পরায়। সা‘দের স্ত্রী তাঁর কাছে ঘটনা খুলে বললেন। সা‘দ বললেন ঃ “আল্লাহ্র শপথ, আমি আজ সেই ব্যক্তিকে শরয়ী শাস্তি দেবো না আল্লাহ্ যার মাধ্যমে মুসলমানদের প্রতি এহেন অনুগ্রহ প্রদর্শন করেছেন।” অতঃপর তিনি আবু মাহ্জানকে মুক্ত করে দেন। আবু মাহ্জান বললো ঃ “যে সব দিনে আমার ওপর শরয়ী শাস্তি কার্যকর করা হতো তখন তার মাধ্যমে আমি নিজেকে গুনাহ্ থেকে পবিত্র করতাম, কিন্তু আপনি যখন আমার ওপর থেকে শরয়ী শাস্তি তুলে নিলেন সেহেতু আমি আল্লাহ্র নামে শপথ করছি, আর কোনো দিন মদপান করবো না।”
শিক্ষাঃ শয়তানের প্ররোচনায় কেউ একই অপরাধ করে ফেললে তার তৎক্ষণাত তওবা করা উচিত এবং পরবর্তীতে প্রথম সুযোগেই জিহাদ কিংবা অন্য কোন সৎকাজে অংশগ্রহণের মাধ্যমে কৃত পাপ মোচনে সচেষ্ট হওয়া উচিত। এ প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে যে, আল্লাহর পথে জেহাদই কৃত গুনাহের কাফফারার সবচেয়ে বড় উপায়। আল্লাহ তায়ালা ঈমান এনে জেহাদে অংশগ্রহণকারীদের জন্য একাধিকবার গুনাহ মাফ করার আশ্বাস দিয়েছেন।
৬৬। কে ধনী, কে গরীব
একবার এক ব্যক্তি প্রখ্যাত সুফী সাধক ইবরাহীম আদহামকে বললেন, “আমার একান্ত ইচ্ছা যে, আমার এই জুব্বাটি আপনি হাদীয়া হিসেবে গ্রহণ করুন।”
ইবরাহীম আদহাম বললেনঃ “ তুমি যদি ধনী হও, তবে হাদিয়া গ্রহণ করতে পারি। আর যদি গরীব হও, তাহলে দুঃখ প্রকাশ করছি।”
লোকটি বললোঃ আমি অবশ্যই ধনী।
আদহাম বললেনঃ তোমার কত সম্পদ আছে?
লোকটি বললোঃ দু’হাজার দীনার।
তিনি বললেনঃ তুমি কি চাওনা যে, তোমার আরো দু’হাজার দীনার হোক।
লোকটিঃ তা অবশ্যই চাই।
ইবরাহীম আদহাম বললেনঃ তাহলে তো তুমি গরীব। আমি তোমার হাদিয়া নিতে পারি না।
শিক্ষাঃ একটি হাদীসে রাসূল(সা) বলেছেন, “যে ব্যক্তি মনের ধনী, সে-ই আসল ধনী।” আলোচ্য ঘটনাটি এই হাদীসেরই ব্যাখ্যা স্বরূপ। কেননা এখানে এক ব্যক্তির মনের দারিদ্র্যই ফুটে উঠেছে। সে ধনী বলে দাবী করেছিল। কিন্তু যেহেতু তার যে সম্পদ আছে তাতে সে তৃপ্ত নয়, তাই সে আসল ধনী নয়। সে আসলে গরীব। প্রকৃত ধনী সেই ব্যক্তি, যার আর ধনের লিপ্সা নেই এবং তার যা আছে তাতেই সে তৃপ্ত।
৬৭। উম্মে সুলাইমের দেনমোহর
রাসূল (সাঃ) যখন মদিনায় ইসলামের দাওয়াত নিয়ে যান তখন ঘরে ঘরে নতুন একটি
কালেমার চর্চা শুরু হল।বনু নাজ্জার গোত্রের একজন
মহিলা সবার আগে ইসলাম গ্রহণ
করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিল।সে সাহসী মুসলিম
রমনীর নাম উম্মে সুলাইম (রাঃ)
উম্মে সুলাইম(রাঃ) যখন ইসলাম গ্রহণ করেন তখন
তার স্বামী বিদেশে ছিলেন।তিনি
যখন দেশে ফিরলেন তখন পরিচিতমানুষ,পরিবেশ,সম
াজকে তার খুব অপরিচিত লাগছিল।
ঘরে ঘরে ইসলামের সরব পদচারণা।তিনি দেখলেন তার
ঘরেও ইসলামের ফুলকি আলো
ছড়াচ্ছে।কিন্তু অভাগা স্বামীর কাছে সে আলো অসহ্য
যন্ত্রণার কারণ হল।তিনি প্রচন্ড রাগে
স্ত্রীকে বললেন-
শেষ পর্যন্ত তুমিও সাবী(নক্ষত্র
পুজারী)হয়ে গেলে ??
উম্মে সুলাইম বললেন-
সাবী নয় মুসলমান হয়েছি।
আমি পোত্তলিকতা ছেড়ে দিয়ে শান্তির পথ অবলম্বন
করেছি।মালিক হিসেবে দেখতো অসংখ্য দেব-দেবীর
পূজা করা ভাল,না এক আল্লাহ্র ?
আমি আল্লাহ্কে মাবুদ হিসেবে গ্রহণ করেছি।”
শিশুপুত্র আনাসকে তিনি কালেমা পড়ান। স্বামী মালেক ইবনে নযর মুশরেক ছিলেন। শিশুকে কালেমা পড়াতে দেখে স্বামী ক্রুদ্ধ হয়ে বলেন, ‘‘তুমি আমার শিশুপুত্রকে বেদ্বীন বানাচ্ছ।’’ স্ত্রী তাকেও দ্বীনের দাওয়াত দিতেন। কিন্তু তিনি রাগ করে শ্যামদেশে চলে যান। স্ত্রী তাকে কোনভাবেই আটকাতে পারেননি। সেখানে তার এক দুশমন তাকে হত্যা করে ফেলে। উম্মে সুলাইম বিধবা হয়ে যান। এ সময় তিনি শিশুপুত্র আনাসকে নিয়ে অস্থির ছিলেন। তখন তিনি পুনরায় বিয়ে করলে আপত্তিকর কিছু ছিল না। কিন্তু তিনি অত্যন্ত ধৈর্য্যের সাথে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেন এবং এই বলে বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন যে, ‘‘আমার শিশুপুত্র মজলিসে উঠাবসা এবং কথা বলার যোগ্য না হওয়া পর্যন্ত আমি বিয়ে করবো না। পুত্র যখন আমার বিয়েতে মত দিবে, তখন বিয়ে করবো।’’
ছেলে হযরত আনাস (রাঃ)-এর উপযুক্ত বয়সে তারই কবীলার আবু তালহা উম্মে সুলাইমকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। কিন্তু মালেকের মতো ইনিও ছিলেন মুশরিক। আগে তার ও মালেকের মধ্যে সম্পর্কের অবনতির যে কারণ ছিল, এখানেও তা-ই অন্তরায় হয়ে দেখা দেয়া তাই উম্মে সুলাইম আপত্তি করে বলেন, ‘‘আমিতো মোহাম্মদ (সাঃ)-এর প্রতি ঈমান এনেছি এবং সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তিনি আল্লাহর রাসূল। অবশ্য তোমাদের জন্য আফসোস যে, তোমরা পাথরের ও কাঠের মূর্তি পূজা কর যা তোমাদের ভাল মন্দ কিছুই করতে পারে না।’’ এ কথাগুলো তিনি এমন হৃদয়গ্রাহী ভঙ্গিতে বললেন যার কারণে আবু-তালহার কাছে ইসলামের সত্যতা প্রতিভাত হয়ে পড়ে। তিনি চিন্তা করতে শুরু করেন। দিনরাত তাকে এই চিন্তা পেয়ে বসলো- ‘সত্যিই কি মিথ্যে ধর্ম পালন করছি? মৃত্যুর পর আমাদের জন্য কষ্ট ছাড়া আর কিছুই নেই, ইত্যাদি ইত্যাদি। কয়েকদিন চিন্তা করার পর তিনি উম্মে সুলাইমের কাছে এসে ইসলাম গ্রহণ করেন। উম্মে সুলাইম (রাঃ) আবু তালহার সত্য প্রীতিতে মুগ্ধ হয়ে বলেন, ‘‘আমি তোমাকে বিয়ে করছি, ইসলাম ছাড়া অন্য কোন মোহরানা তোমার কাছ থেকে নেব না।’’ অর্থাৎ আবু তালহার ইসলাম গ্রহণই তার মোহর সাব্যস্ত হয়। এ বিয়ে হয়েছে হযরত আনাস (রাঃ)-এর উদ্যোগে।
হযরত আবু তালহার ঔরসে আবু উমাইর নামে তার এক পুত্র সন্তান জন্ম লাভ করে। অল্প বয়সেই আবু উমাইর মারা যান। তিনি তাকে অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে গোসল করান, কাফন পরান এবং ঘরের একপাশে লাশ রেখে দেন। আবু তালহাকে না জানাবার জন্য তিনি সকলকে বলে রাখেন। আবু তালহা তখন কিছুদিনের জন্য ব্যবসার কাজে বাইরে ছিলেন। এ দিন রাতেই তিনি ঘরে ফিরে আসেন। এসে তিনি আবু উমাইরের অবস্থা জানতে চান, উম্মে সুলাইম বললেন, সে আগের চেয়ে ভাল আছে। এরপর তিনি স্বামীকে খানাদানা করান। উভয়ে বিশ্রাম নেন। ভোর হলে তিনি স্বামীকে অত্যন্ত শান্তভাবে বললেন, আবু তালহা, কাউকে যদি কোন জিনিস ধার দেয়া হয় এবং তার দ্বারা উপকৃতই হয়, এরপর ধার দেয়া জিনিস যদি ফেরত নেয়া হয়, তবে কি তার খারাপ লাগা উচিত?’’ আবু তালহা বললেন, ‘‘এটাতো ইনসাফের কথা নয়’’। তখন উম্মে সুলাইম বললেন, তবে শুন, তোমার শিশুও ছিল আল্লাহর আমানত, তিনি তা ফেরৎ নিয়ে গেছেন।’’ এটা শুনে আবু তালহা খুবই কষ্ট পেয়ে ইন্নালিল্লাহ পড়লেন এবং জানতে চাইলেন স্ত্রী ‘‘ভালো আছে’’ বললেন কেন? উম্মে সুলাইম বললেন ‘‘সে রোগ যন্ত্রণায় যে কষ্ট পাচ্ছিল আল্লাহ তাকে এখন আরাম দিয়ে দিয়েছেন।’’ আল্লাহর রাসূল পিতামাতার এ ধৈর্যের কাহিনী শুনে সন্তোষ প্রকাশ করেন এবং আল্লাহর দরবারে দোয়া করেন যে, ‘‘আল্লহ তায়ালা তোমাদের উপর অনেক খুশি হয়েছেন এবং তোমাদের ধৈর্যের বিনিময়ে আরো ভাল সন্তান দিবেন।” এর কিছুদিন পর আল্লাহ তাদেরকে একটি পুত্র সন্তান দেন। এর নাম রাখা হয় আবদুল্লাহ। আবদুল্লাহর সাতটি পুত্র সন্তান হয়েছিল এবং তারা সকলে কুরআনের হাফেয হয়েছিল। আর উম্মে সুলাইমের অন্য পুত্র হযরত আনাস বিন মালেক তো রাসূল(সা) এর ঘনিষ্ঠতম ও প্রিয়তম সাহাবীদের অন্তুর্ভুক্ত হয়েছিলেন।
শিক্ষাঃ হযরত উম্মে সুলাইম একজন উঁচু স্তরের আদর্শ মহিলা সাহাবী। স্বামী ভক্তির পাশাপাশি তিনি সন্তানসহ গোটা পরিবারের উপর নিজের ইসলামী চরিত্রে প্রাধান্য বজায় রেখেছিলেন। এমনকি নতুন স্বামী গ্রহণ করার পূর্বে তাকেও ইসলামে দীক্ষিত করে নিয়েছিলেন। এই গুণাবলী প্রত্যেক মুসলিম নারীর ভূষণ হওয়া উচিত।