৪২। মৃমিনের আত্মসমালোচনা
এক ব্যক্তি উয়াইস কারনীর [একমাত্র মুমিন, যিনি রাসূল (সা) এর জীবদ্দশায় ইসলাম গ্রহণ করেও রাসূল(সা) এর সাথে সাক্ষাতের সুযোগ পাননি] সাথে সাক্ষাত করে বললোঃ “কেমন আছেন, হে উয়াইস?”
উয়াইসঃ আলহামদুল্লিাহ, ভাল আছি।
আগন্তুকঃ আজকাল কিভাবে আপনার সময় কাটে?
উয়াইসঃ সে কথা শুনিতে না চাওয়াই উত্তম। আজকাল দুনিয়ায় কোন মুমিনের সাথে শান্তিতে জীবন যাপনের সুযোগ সংকুচিত হয়ে আসছে। কুরআনের জ্ঞান অর্জন করলে সম্পদশালী হওয়া যায় না। এমনকি সততার সাথে জীবনযাপন করলে দুনিয়ার বন্ধু ও মেলে না।
আগন্তুকঃ রাসূল(সা) এর কাছ হতে শুনেছেন এমন একটি হাদীস আমাকে শোনান।
উয়াইসঃ আমি রাসূল(সা) এর সাক্ষাত পাই নি যে তোমাকে তাঁর হাদীস শোনাবো। তবে অন্যের মাধ্যমে পাওয়া রাসূল(সা) এর একটি উপদেশ তোমাকে শোনাচ্ছি। তিনি বলেছেনঃ “তোমরা আল্লাহর দরবারে গিয়ে হিসাব নিকাশের সম্মুখীন হবার আগে নিজেদের হিসাব নিজেই গ্রহণ কর। আল্লাহ দুনিয়াটাকে তোমাদের জন্য একটা পুল স্বরূপ বানিয়েছেন। কাজেই তোমরা এই পুল পার হবার চেষ্টা কর।”
শিক্ষাঃ আত্মসমালোচনা করা মুমিনের একটি অপরিহার্য গুণ। অন্যের সমালোচনার পাশাপাশি নিজের সমালোচনাও সব সময় অব্যাহত রাখা উচিত। রাসূল(সা) বলেছেনঃ “তোমাদের কাজের হিসাব নেয়ার আগে নিজেরাই নিজেদের কাজের সমালোচনা কর।
৪৩। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের অগ্নিপরীক্ষায় মুমিনের দৃঢ়তা
(ক) হযরত আবু আবদুল্লাহ ইবনে জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা) বলেনঃ একবার রাসূলুল্লাহ(সা) আমাদের কিছু জোয়ানকে কুরাইশদের একটি দলের মোকাবিলার জন্য পাঠালেন। আমাদের সেনাপতি ছিলেন আবু উবাইদা। রাসূলুল্লাহ(সা) আমাদের রসদ হিসেবে এক ব্যাগ খুরমার অতিরিক্ত কিছুই দিতে পারলেন না। ক্ষুধা লাগলে আবু উবাইদা আমাদের প্রত্যেককে একটি করে খোরমা দিতেন। শিশুরা যেমন চুষে চুষে অনেক্ষণ ধরে খায়, আমরাও তেমনিভাবে খেতাম এবং খাওয়া শেষে বেশি করে পানি খেয়ে নিতাম। এতেই আমাদের পুরো একদিন চলে যেত। কখনো কখনো আমরা উটের খাদ্য ‘খাবাত’ নামক গাছের পাতা লাঠি দিয়ে পেড়ে পানি দিয়ে ভিজিয়ে খেযে নিতাম। এভাবে চলতে চলতে আমরা সমুদ্রের কিনারে গিয়ে উপনীত হলাম। সমুদ্রতীরে আমাদের সামনে পড়লো একটা বিরাট আকারের বস্তু। দূর থেকে দেখে মনে হলো বালুর স্তূপ। কাছে গিয়ে দেখি আম্মার নামক এক প্রকান্ড সামুদ্রিক জন্তু। আবু উবায়দা প্রথমে বললেনঃ ওটা মৃত। কিন্তু পরক্ষণেই আবার বললেন, আমরা এখন আল্লাহর রাসূলের প্রতিনিধি হিসেবে আল্লাহর পথে জেহাদরত। এখন আমরা অনন্যোপায়। কাজেই, চল ওটাকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা যাক। অতঃপর আমরা ৩০০ জন মোজাহেদ ঐ জন্তুটার উপর নির্ভর করে এক মাস কাটালাম। ওর গোশত খেয়ে আমরা বেশ মোটাসোটা হয়ে গেলাম। শুধু তাই নয়, ওর চোখের কোটর হতে আমরা কলসি কলসি চর্বিও সংগ্রহ করলাম এবং এত বড় এক টুকরো গোশত কেটে আলাদা করলাম যে, যার প্রত্যেকটা এক একটা ষাড়ের মত দেখতে। আবু উবাইদা আমাদের মধ্য থেকে ১৩ ব্যক্তিকে ওর চোখের কোটরের ওপর বসিয়ে দিলেন এবং তার বিভিন্ন অঙ্গ বিচ্ছিন্ন করে আমাদের সবচেয়ে বড় উটটার ওপর চড়িয়ে দিলেন। এই বোঝা বহন করে উটটি রওনা হল। আমরাও অনেক গোশত কেটে নিয়ে চললাম। মদীনায় যখন রাসূল(সা) কে পুরো ঘটনা জানালাম, তখন তিনি বললেনঃ “ওটা তোমাদের খাদ্য হিসেবে আল্লাহ সরবরাহ করেছিলেন। ওর কিছু গোশত কি তোমাদের সাথে আছে, যা আমাদেরকেও খেতে দিতে পার?” তখন আমরা তার কিছু গোশত রাসূলুল্লাহ(সা) এর কাছে পাঠালাম এবং তিনি তা খেলেন। (মুসলিম)।
(খ) হযরত জাবের বর্ণনা করেন যে, খন্দক যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসাবে আমরা যখন মদীনার চারিপাশে পরিখা খনন করছিলাম, তখন এক পর্যায়ে এমন শক্ত মাটি পাওয়া গেল যার ভেতর কোদাল বসতেই চায় না। সবাই এসে রাসূল (সা) কে ব্যাপারটা জানালে তিনি বললেনঃ আমি আসছি। অতঃপর তিনি রওনা হলেন। অথচ তখনও রাসূল(সা) এর পেটে পাথর বাঁধা ছিল। তিনিসহ আমরা তিন দিন যাবত কোন খাবার মুখে তুলিনি। রাসূল(সা) কোদাল দিয়ে কোপ দিতেই তা নরম মাটিতে পরিণত হয়ে গেল। আমি বললামঃ হে রাসূল! আমাকে একটু বাড়ি যাওয়ার অনুমতি দিন।” বাড়ী গিয়ে আমি আমার স্ত্রীকে বললেনঃ রাসূল(সা) কে এমন অবস্থায় দেখেছি, যা সহ্য করার মত নয় (পেটে পাথর বাঁধা)। তোমার কাছে খাবার কিছু আছে কি? সে বললঃ আমার কাছে কিছু যব ও ছোট একটা ভেড়ার বাচ্চা রয়েছে। আমি ভেড়ার বাচ্চাটা যবাই করলাম আর আমার স্ত্রী যব পিষতে শুরু করল। যখন গোশত ডেগচিতে করে চুলোর ওপর চড়ানোর পর প্রায় সিদ্ধ হয়ে এসেছে এবং যব অনেকখানি পিষ্ট হয়ে গেছে, তখন আমি গিয়ে বললামঃ “হে আল্লাহর রাসূল! আমার কাছে অল্প কিছু খাবার প্রস্তুত আছে। আপনি এবং একজন বা দু’জন চলুন।” তিনি বললেনঃ “খাবারে পরিমাণ কতটুকু?” আমি সঠিক পরিমাণ জানালাম। তিনি বললেনঃ “যথেষ্ট পবিত্র খাবার। তোমার স্ত্রীকে গিয়ে বল, আমি না আসা পর্যন্ত যেন চুলোর ওপর থেকে রুটি ও গোশত না নামায়।” অতঃপর বললেনঃ “ তোমরা সবাই চল।” মোহাজেরগণ ও আনসারগণ সবাই চললেন। আমি আমার স্ত্রীর কাছে আগেভাগে গিয়ে পৌঁছলাম। আমি বললামঃ তোমার ওপর আল্লাহ সদয় হোন! রাসূল(সা) সকল আনসার ও মোহাজেরগণ নিয়ে সদলবলে এসে গেছেন। সে বললোঃ খাবার পরিমাণ কেমন তা কি তোমার কাছে জিজ্ঞাসা করেছিলেন? আমি বললাম, হ্যাঁ।
যা হোক, রাসূল(সা) সমবেত আনসার ও মোহাজেরগণকে বললেনঃ “তোমরা ভিড় করো না। একে একে প্রবেশ কর।” অতঃপর রাসূল(সা) এক এক টুকরো রুটি ছিঁড়ে নিতে লাগলেন, তার সাথে গোশত যুক্ত করে চুলো ও ডেকচি ঢেকে দিয়ে সাহাবীগণকে দিতে লাগলেন। এভাবে দিতে দিতে সবাই পেট পুরে খেল এবং আরো অবশিষ্ট রইল। অন্য রেওয়ায়াতে আছে যে, রাসূল(সা) গোশত ও রুটিতে সামান্য থুথু ছিটিয়ে দিলেন। এক হাজার সাহাবী পেট পুরে খেলেন এবং তারপরও ডেকচি থেকে এমন আওয়াজ এসেছিল যে, তাতে তখনো অনেক গোশত রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছিল। অতঃপর রাসূল(সা) হযরত জাবেরের স্ত্রীকে বললেনঃ তোমরা খাও এবং অন্যদেরকে খাওয়ায়। কারণ বহু লোক ক্ষধার্ত রয়েছে। (বোখারী ও মুসলিম)।
শিক্ষাঃ এই দুটি ঘটনা থেকে শিক্ষা পাওয়া গেল যে, ইসলামের জন্য যারা সংগ্রাম করে তাদেরকে কঠিন অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়; বিশেষত ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের পরীক্ষা অনিবার্য। এ পরীক্ষায় ধৈর্যের পরিচয় দিলে আল্লাহর সাহায্যও আসবে ইনশাল্লাহ। আল্লাহ বলেছেনঃ আমি তোমাদেরকে ভীতি, ক্ষুধা, জান-মাল ও ফসলের ক্ষয়ক্ষতি দিয়ে অবশ্যই পরীক্ষা করবো। যারা এতে ধৈর্যধারণ করবে, তাদেরকে সুসংবাদ দাও।”
৪৪। কুফরীর আস্তাকূঁড়ে ঈমানের রক্তগোলাপ
“মক্কা বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত আবু জাহলের ছেলে ইকরামা কুফরীর উপর বহাল ছিল। বদরের ময়দানে তার পিতা শোচনীয়ভাবে নিহত হওয়ার পর সে পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে কম চেষ্টা করেনি। ওহুদ, খন্দক সর্বত্রই সর্বশক্তি দিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়েছে। শেষ পর্যন্ত মক্কা বিজয়রে দিন সমস্ত কুরাইশ বংশ যখন আত্মসমর্পণ করলো সেদিনও তিনি প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। কিন্তু বীর কেশরী খালিদ বিন ওয়ালিদ ইকরামার প্রতিরোধ চূর্ণ করে দেন এবং ইকরামা ইয়েমেন পালিয়ে যান।
তখন ইকরামা আত্মানুশোচনায় নিমজ্জিত হল। মুসলমান্দের হাতে মক্কার পতন হওয়ার পর সেখানে আর তার অবস্থানের সুযোগ রইল না। এদিকে কুরাইশরা রাসূলুল্লাহ(সাঃ) এর সাথে যা করেছিল তিনি তা মাফ করে দিলেন।তবে তিনি তাদের কয়েকজনকে তাদের থেকে বাদ দিলেন। তিনি তাদের নাম ঘোষণা করে দিলেন এবং নির্দেশ দিলেন, কাবার গিলাফের নিচেও তাদের পাওয়া গেলে হত্যা করা হবে। এই দলের শীর্ষে ছিলেন ইকরামা ইবনে আবু জাহল। তাই অত্যন্ত সন্তর্পণে আত্মগোপ্ন করে মক্কা থেকে বেরিয়ে পড়ল এবং ইয়ামেনের পথে ছুটে চলল। কারণ সেখানে তার আর কোন আশ্রয়স্থল ছিল না। তখন ইকরামার স্ত্রী উম্মে হাকীম এবং আবুসুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর নিকট বাইয়াত গ্রহণ করতে যায়।তাদের সাথে ছিল আরো দশজন মহিলা।তারা সকলেই ইসলাম গ্রহণ করেন।ইসলাম গ্রহণ করার পর ইকরামার স্ত্রী উম্মে হাকীম দাঁড়িয়ে বলেন-‘ইয়া রাসূলুল্লাহ ! ইকরামা ইয়ামেনে পালিয়ে গেছে।আপনি তাকে হত্যা করবেন এই তার ভয়। সুতরাং আপনি তাকে অভয় দিন, আল্লাহ্ আপনাকে অভয় দান করবেন।’ তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, ‘ সে নিরাপদ ‘। সাথে সাথে উম্মে হাকীম তার স্বামীর সন্ধানে বেরিয়ে পড়লেন । অনেক খুঁজাখুঁজির পর তিনি ইকরামাকে তিহমা অঞ্চলের নদীর তীরে পেলেন। তিনি ইকরামাকে মক্কায় ফিরিয়ে নিতে চাইলেন,কিন্তু ইকরামা যেতে চাইল না,কারণ সে তার প্রাণ নাশের আশংকা করছিল। কিন্তু যখন উম্মে হাকীম তাকে বলল যে ,সে নিজে সরাসরি মহানবী(সাঃ) এর কাছ থেকে তার জন্য নিরাপত্তার আশ্বাস নিয়ে এসেছেন, তখন ইকরামা রাজি হল। কিছুক্ষনের মধ্যে ইকরিমা সেখানে প্রবেশ করলেন যেখানে রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) বসে ছিলেন। নবী, তাঁর উপর আল্লাহর শান্তি ও রহমত বর্ষিত হোক, উঠে দাড়ালেন এবং উষ্ণ আলিঙ্গনে ইকরিমাকে স্বাগত জানালেন।
“মুহাম্মাদ”, ইকরিমা বললেন, “উম্মু হাকীম আমাকে জানিয়েছে যে আপনি আমাকে নিরাপত্তা দিয়েছেন।”
“হ্যাঁ, সে সত্য বলেছে।” রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) বললেন, “তুমি নিরাপদ।”
“আপনি মানুষকে কিসের দিকে ডাকছেন?”
“আমি তোমাকে আহ্বান জানাচ্ছি আল্লাহ্ ছাড়া কোন ইলাহ্ নাই এবং আমি আল্লাহর বান্দা ও রাসুল এ কথার সাক্ষ্য দেবার জন্য, সালাত কায়েম করার জন্য, যাকাত আদায় করার জন্য এবং ইসলামের অন্যান্য বিধিনিষেধগুলো মেনে চলার জন্য।”
“আল্লাহর শপথ”, ইকরিমা বলে চললেন, “আপনি কেবলমাত্র তার দিকেই ডেকেছেন যা সত্য এবং আপনি কেবলমাত্র সৎকাজেরই আদেশ দান করেছেন। আপনার মিশন শুরু করার আগেও আপনি আমাদেরই মাঝে ছিলেন এবং তখন আপনি কথায় ছিলেন সবচেয়ে সত্যবাদী এবং কাজে ছিলেন সবচেয়ে সঠিক।” ইকরিমা রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) এর দিকে তার হাত প্রসারিত করে দিলেন এবং বলে চললেন, “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ্ নাই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর বান্দা ও রাসুল”। এরপর বললেন,
“ইয়া রাসুলুল্লাহ্ , আপনি আল্লাহর কাছে আমার জন্য প্রার্থনা করুন, তিনি যেন আমাকে ইসলামের বিরুদ্ধে আমার সকল শত্রুতা ক্ষমা করে দেন এবং আপনার উপস্থিত ও অনুপস্থিত অবস্থায় আমি আপনার নামে যে সকল নিন্দা করেছি আর কুৎসা রটনা করেছি সেগুলো যেন তিনি ক্ষমা করে দেন।”
রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) আল্লাহর কাছে এ বলে প্রার্থনা করলেন যে, “হে প্রতিপালক, আমার বিরুদ্ধে যত শত্রুতা সে করেছে এবং তোমার আলোকে নিভিয়ে দেবার যত চেষ্টা সে করেছে তার জন্য তাকে ক্ষমা করে দাও। আমার সামনে বা পেছনে আমার সম্মানহানীর জন্য যা কিছু সে বলেছে তার জন্যও তাকে ক্ষমা করে দাও।”
ইকরিমার মুখ গভীর আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। তিনি বললেন, “আল্লাহর শপথ ইয়া রাসুলুল্লাহ্, আমি শপথ করছি, যা কিছু আমি আল্লাহর পথের শত্র“তার জন্য ব্যয় করেছি, তার দ্বিগুন আমি ব্যয় করব আল্লাহর পথে, এবং ইসলামের বিরুদ্ধে যত যুদ্ধ আমি করেছি তার দ্বিগুন আমি আল্লাহর পথে যুদ্ধ করব।”
সেদিন থেকে ইকরিমা একনিষ্ঠভাবে ইসলামের প্রবেশ করলেন। মুসলিম হিসাবে প্রতিটি যুদ্ধে তিনি জীবন বাজী রেখে অংশ নিতে লাগলেন এবং তাঁর দ্রুতগামী ঘোড়া অবিশ্বাসীদের হৃদয়ে কাঁপন ধরিয়ে তুলতে লাগল। যুদ্ধ ময়দানে না থাকলে অধিকাংশ দিন তাঁর দিনের বেলা কাটত রোজা রেখে, মসজিদে ও কুরআন অধ্যয়ন করে, আর রাত কাটত নিভৃতে আল্লাহর কাছে কেঁদে কেঁদে। তখন কুরআন কোন বই আকারে ছিল না, তা ছিল চামড়া, বড় উটের হাড়, উপযুক্ত কোন পাথর ইত্যাদিতে লিখিত অবস্থায়। কুরআনের সে সংরক্ষিত অংশগুলোকে বলা হয় মুসাফ। ইকরিমা প্রয়ই এ মুসাফগুলোকে নিজের চুমু খেয়ে, মুখের উপর রেখে অঝোর ধারায় কাঁদতেন আর বলতেন, ”কিতাবু রাব্বী, কালামু রাব্বী”, ”এ আমার রবের কিতাব, এ আমার রবের ভাষা”।
ইসলাম গ্রহণের সময় ইকরিমা যে ওয়াদা রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) এর সাথে করেছিলেন, তার প্রতিটি অক্ষরে অক্ষরে পালন করার জন্য তিনি ভীষণ কঠোর ও দৃঢ় ছিলেন। তার ইসলাম গ্রহণের পর যতগুলো যুদ্ধ মুসলিম বাহিনী অংশগ্রহণ করেছে তার প্রতিটিতেই তিনি ছিলেন সেনাবাহিনীর অকুতোভয় প্রথম সারির যোদ্ধা।
আবু বকর(রা) এর খেলাফতকালে সংঘটিত ইয়ারমূকের যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবার পর দেখা গেল, মুসলিমদের মধ্যে যারা শাহাদাত বরণ করেছে তাদের মধ্যে তিনজন মুমূর্ষু অবস্থায় কাতরাচ্ছেন। এই তিনজন ছিলেন আল হারিস ইবন্ হিশাম, আইয়াশ ইবন্ রাবিয়া এবং ইকরিমা ইবন্ আবু জাহল। ইকরিমার খোঁজ পেয়ে খালিদ বিন ওয়ালিদ তার মাথা নিজ কোলে তুলে নিলেন। তাঁর দুচোখ বেয়ে ক্রমাগত অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিলো। ইকরিমা এবং আল হারিস পানির জন্য ডাকছিলেন। তাঁদের জন্য দ্রুত পানির ব্যবস্থা করা হল। পানি আনার পর আইয়াশ তাঁদের দিকে তাকালেন। তারা বললেন, “এ পানি আইয়াশকে দাও।” আইয়াশের কাছে পানি নিয়ে যাবার পর দেখা গেল তিনি ততক্ষনে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে ফেলেছেন। আবার পানি যখন ইকরিমা এবং আল হারিসের দিকে নিয়ে যাওয়া হল, তখন দেখা গেল তাঁরা দুজনও ততক্ষনে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নিয়েছেন।
তাই আবু জাহলের ছেলে ইকরামাকে বলা হয় কুফরীর আস্তাকূঁড়ে ঈমানের একটি রক্তগোলাপ।
শিক্ষাঃ পিতা ও বংশপরিচয় ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ গুরুত্বহীন। কোন ব্যক্তির নিজস্ব ঈমান ও আমলই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের সাথে বিবেচনা করার দাবি রাখে। আবু জাহলের ছেলে হওয়া সত্ত্বেও ইকরামা নিজের ঈমান ও আমলের বলে মুসলমানদের সেনাপতি পর্যন্ত হয়েছিল। আল্লাহর কাছেও সাহাবীর মর্যাদা পেয়েছিলেন।
৪৫। ভিক্ষাবৃত্তি একটি কলংক
একবার আনসারদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ(সা) এর কাছে এসে খাবার চাইল। রাসূল(সা) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বাড়িতে কি কিছুই নেই? সে বললো একটা কম্বল আছে যার একাংশ পরিধান করি এবং অপরাংশ বিছিয়ে শুই। আর একটা পেয়ালা যা দিয়ে আমি পানি খাই। রাসূল(সা) বললেনঃ যাও, ঐ দুটি জিনিস আমার কাছে নিয়ে এস। লোকটি তৎক্ষণাত গিয়ে জিনিস দুটি নিয়ে এল।
রাসূল(সা) জিনিস দুটি তার কাছ হতে নিয়ে নিলেন এবং সমবেত সাহাবীগণকে বললেনঃ এই জিনিষ দুটি তোমরা কেউ কিনবে নাকি? একজন সাহাবী বললেনঃ আমি এক দিরহামে নিতে পারি। অপর একজন বললেনঃ আমি দুই দিরহামে নিতে পারি। রাসূল(সা) শেষোক্ত ব্যক্তিটিকে পেয়ালা ও কম্বলটি দিলেন এবং তার কাছ হতে দুই দিরহাম নিয়ে আনসারটিকে দিলেন। তাকে বললেনঃ এক দিরহাম দিয়ে খাবার কিনে তোমার পরিবারকে দাও। আর এক দিরহাম দিয়ে একখানা কুঠার কিনে আমার কাছে এস। লোকটি কুঠার কিনে নিয়ে এলে রাসূল(সা) তাতে আছাড় লাগিয়ে দিয়ে বললেনঃ “যাও এদিয়ে কাঠ কাটগে। ১৫ দিনের মধ্যে যেন তোমাকে আমি না দেখি।” সে নির্দেশ মোতাবেক কাজ করলো। একদিন এসে জানালো যে, দশ দিরহাম মুনাফা হয়েছে। এর কিছু দিয়ে সে খাবার এবং কিছু দিয়ে কাপড় কিনলো।
রাসূল(সা) তাকে বললেন, ভিক্ষার কলঙ্ক মুখে নিয়ে কেয়ামতের ময়দানে হাজির হওয়ার চাইতে তোমার এই কাজ অনেক ভাল।
শিক্ষাঃ কাজ করে অর্থ উপার্জনের ক্ষমতা রাখে এমন সবল ও সুস্থ লোককে ভিক্ষা দেওয়া উচিত নয়। এ ধরনের লোকের ভিক্ষা চাওয়াও মস্ত বড় গুনাহ।
৪৬। পরোপকারী মানুষই শ্রেষ্ঠ মানুষ
একবার হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) মসজিদে নববীতে ইতিকাফরত ছিলেন। এই সময় এক ব্যক্তি এসে তাঁকে সালাম করলো ও তাঁর কাছে বসে পড়লো। হযরত ইবনে আব্বাস তাঁকে বললেন, “তোমার কি হয়েছে? তোমাকে তো খুবই চিন্তিত মনে হচ্ছে।”
আগন্তুক জবাব দিলঃ “অমুকের কাছে ঋণগ্রস্ত আছি। অথচ তা পরিশোধ করতে পারছি না।”
ইবনে আব্বাস(রা) বললেনঃ আমি কি তোমার সম্পর্কে ঐ ব্যক্তির সাথে কিছু আলোচনা করবো?
আগন্তুক বললেনঃ যদি ভাল মনে করেন করতে পারেন।
হযরত ইবনে আব্বাস তৎক্ষণাত জুতো পরলেন ও মসজিদ থেকে বের হলেন। আগন্তুক বললোঃ এ কী? আপনি করছেন কী? ইতিকাফের কথা কি ভুলে গেছেন?
ইবনে আব্বাস রাসূল(সা) এর কবর দেখিয়ে অশ্রু সজল চোখে বললেনঃ না, সেটা ভুলিনি। তবে এই কবরে যিনি শুয়ে আছেন তাঁকে আমি বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের উপকারের জন্য সচেষ্ট হবে এবং উপকার সাধন করবে, সে দশ বছর ধরে ইতিকাফকারীর চেয়েও মর্যাদাবান হবে। অথচ আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে যে ব্যক্তি একদিন ইতিকাফ করে তার মধ্যে ও দোজখের মধ্যে আল্লাহ এমন তিনটি পরীক্ষা স্থাপন করেন, যার একটি থেকে অপরটির দূরত্ব সূর্যের উদয় ও অস্তের জায়গার মধ্যে দূরত্বের চেয়েও বেশি।
শিক্ষাঃ বান্দার হক তথা মানবাধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকলেই পরোপকারী হওয়া সম্ভব। রাসূল(সা) বলেছেন, “কোন ব্যক্তি যতক্ষণ বান্দার সাহায়্যে নিয়োজিত থাকে, ততক্ষণ আল্লাহ তার সাহায্যে নিয়োজিত থাকেন।”
৪৭। মোনাফেকীর পরিণাম
রাসূল(সা) এর নিকট একবার এই মর্মে খবর এল যে, রাসূল মুসতালিক গোত্রের সর্দার হারেস ইবনে যেরার মদীনা আক্রমণের প্রস্ততি নিচ্ছে। হারেস ইবনে যেবার রাসূল(সা) এর অন্যতমা স্ত্রী উম্মুল মুমিনীন হযরত হয়াইবিয়ার পিতা। তারা উভয়ে পরবর্তীকালে ইসলাম গ্রহণ করেন।
খবর পাওয়ামাত্র রাসূল(সা) একদল মুজাহিদকে সঙ্গে নিয়ে তাদের প্রতিরোধের জন্য অগ্রসর হলেন। যারা এই যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য রাসূল(সা) এর সঙ্গী হলো, তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক মুনাফিকও ছিল। এসব মোনাফেকদের উদ্দেশ্য ছিল কাফেররা পরাজিত হলে তাদের ফেলে যাওয়া সম্পদ হস্তগত করা আর মোনাফেক হওয়া সত্ত্বেও তাদের ধারণা ছিল যে, মুসলমানেরা যেহেতু অধিকাংশ যুদ্ধে জয়লাভ করেছে, তাই এই যুদ্ধেও জয়লাভ করবে।
কার্যত হলোও তাই। মুসলমানরা জয়লাভ করলেন এবং প্রতিপক্ষ ইহুদী গোত্র পরাজিত হল। যুদ্ধ সমাপ্ত হওয়ার পর মুসলমান শিবিরে একটি দুর্ঘটনা ঘটে গেল। একজন মুহাজির এবং একজন আনসার এর মধ্যে কুপ হতে পানি তোলা নিয়ে কথা কাটাকাটি ও ঝগড়ার সূত্রপাত হলো। অতঃপর তা হাতাহাতির পর্যায়ে গেল। মুহাজির হাঁক দিলেনঃ “ওহে মুহাজিররা, কে কোথায় আছ আমাকে বাঁচাও।” আর আনসারও অনুরূপ আনসারদের ডাক দিলেন। ফলে উভয়পক্ষে উত্তেজনা ও সাজ সাজ রব পড়ে গেল। এভাবে মুসলমানদের মধ্যে একটি মারামারি বেঁধে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিল।
এই ঝগড়ার খবর পাওয়া মাত্রই রাসূল(সা) কাল বিলম্ব না করে ঘটনাস্থলে ছুটে গেলেন। তিনি আনসার ও মুহাজির উভয়কে বুঝালেন যে, তোমরা উভয়ে এভাবে নিজ নিজ অঞ্চলের লোকদের ডাকছো কেন? এতো জাহিলিয়াতের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। এ এক নোংরা পন্থা। তোমরা এটা পরিত্যাগ করো। কেউ কারো ওপর জুলুম করলে সকল মুসলমানের উচিত মজলুমের সাহায্যে ছুটে যাওয়া এবং যালেমকে নিরস্ত করা-তা সে যেখানকার লোকই হোক না কেন। দেখতে হবে কে যালেম এবং কে মজলুম, কে আনসার কে মোহাজের বা কে কোথাকার বাসিন্দা ও কে কোন বর্ণ ও বংশের লোক তা নয়।
রাসূল(সা) এর ভাষণ শুনে সবাই শান্ত হয়ে যে যার কাজে চলে গেল। সাহাবী উবাদা ইবনে সাবেত ঝগড়ায় লিপ্ত দুই সাহাবীর মাঝে আপোস করিয়ে দিলেন এবং যার বাড়াবাড়ি প্রমাণিত হলো, তাকে দিয়ে মাফ চাইয়ে নিলেন। কিন্তু মুনাফিকরা এই ঝগড়ার সুযোগটাকে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য কাজে লাগাতে চাইল। তারা এই আপোস মীমাংসা মেনে নিল না। মুনাফিকদের নেতা ছিল আবদুল্লাহ ইবনে উবাই। সে মুনাফিকদের একটা গোপন সভা ডেকে সেখানে মদীনাবাসীদেরকে মক্কাবাসী মুহাজিরদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলার উদ্দেশ্যে বললোঃ তোমরাই তো ওদের আস্কারা দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলেছ। তোমরাই খাল কেটে কুমীর এনেছ এবং দুধ কলা দিয়ে এই সাপদের পুষেছ। এখন ওদের এত স্পর্ধা হয়েছে যে, তোমাদেরকেই ওরা দংশন করতে চাইছে। এখনও যদি তোমরা সাবধান না হও এবং ওদেরকে লালনপালন হতে বিরত না হও, তাহলে একদিন ওরাই তোমাদেরকে ধ্বংস করবে। তোমরা মদীনার সম্ভ্রান্ত লোক। আর ওরা হলো বহিরাগত নীচু জাত। মদীনায় গিয়ে তোমাদের উচিত হবে ঐ নীচুজাতদেরকে বিতাড়িত করা। আবদুল্লাহ ইবনে উবাই এভাবে আনসার ও মুহাজিরদের ঐক্য ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলো।
এই গোপন সভায় ঘটনাক্রমে হযরত যায়েদ বিন আরকাম উপস্থিত ছিলেন। তিনি তার উক্ত ভাষণ শেষ হওয়া মাত্রই চিৎকার করে বলে উঠলেনঃ “আল্লাহর কসম, তুইই নীচুজাত। রাসূল(সা) ও তাঁর মুমিন সাহাবীগণ ঈমানের বলে বলীয়ান ও পরস্পরের প্রতি প্রগাঢ় প্রীতি ও ভালোবাসা পোষণ করেন। সুতরাং তারাই প্রকৃত সম্ভ্রান্ত লোক।”
আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ভেবেছিল, পরিস্থিতি প্রতিকূল হলে সে কথার ভিন্ন ব্যাখ্যা দেবে ও সুর পাল্টে ফেলবে। এ জন্য সে কারো নাম উল্লেখ করে নি এবং কিছুটা স্পষ্ট ভাষায় কথা বলেছে। যায়েদ ইবনে আরকামের ক্ষেপে যাওয়া দেখে সে বিপদ গুনলো। পাছে তার কুফরী প্রকাশ হয়ে পড়ে তাই সে যায়েদের কাছে গিয়ে বুঝাতে লাগলো যে, আমি তো ঠাট্টাচ্ছলেই কথাগুলি বলেছিলাম। তুমি ভুল বুঝেছ।
যায়েদ সেখান থেকে উঠে সরাসরি রাসূল(সা) এর কাছে গিয়ে পুরো ঘটনা খুলে বললেন। রাসূল(সা) ঘটনাকে গুরুতর মনে করলেও নিশ্চিত হওয়ার জন্য যায়েদকে জিজ্ঞেস করলেনঃ তুমি ভুল বলছ না তো? যায়েদ বললেনঃ আল্লাহর কসম, আমি নিজ কানে শুনেছি। এরপর আবদুল্লাহ ইবনে উবাই এর কথাবার্তা সমগ্র মুসলিম বাহিনীর কানে চলে গেল। সবাই এ বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে লাগলেন।
এক পর্যায়ে হযরত ওমর রাসূল(সা) এর নিকট এসে বললেনঃ “ইয়া রাসূলুল্লাহ(সা)! আমাকে অনুমতি দিন। মোনাফেকটা গর্দান কেটে ফেলি।” রাসূল(সা) বললেন, “ওমর, লোকে যখন বলবে যে, মুহাম্মদ তাঁর সঙ্গী সাথীদেরকেও হত্যা করে, তখন কী হবে?” অতঃপর তিনি হত্যা করতে নিষেধ করলেন।
হযরত ওমরের কথাটা আবদুল্লাহ ইবনে উবাই এর পুত্রও জেনে ফেললেন। তার নামও ছিল আবদুল্লাহ এবং তিনি ছিলেন একজন একনিষ্ঠ মুমিন। তিনি রাসূল(সা) এর নিকট হাজির হয়ে বললেনঃ “ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমার পিতার এসব কথাবার্তার কারণে যদি তাকে হত্যা করতে চান, তবে আমাকেই আদেশ করুন, অন্য কাউকে নয়। আমি নিজ হাতে তার মস্তক কেটে আপনাকে এনে দেব। ইয়া রাসূলুল্লাহ, সমস্ত খাররাজ গোত্র জানে আমি তাদের মধ্যে সবচেয়ে পিতৃভক্ত। কিন্তু আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে কোন কথা আমি সহ্য করতে পারি না। আমার আশংকা হয় যে, আপনার আদেশে অন্য কউ আমার পিতাকে হত্যা করলে আমি আমার পিতার হত্যাকারীকে দেখে আত্মসম্বরণ করতে পারবো না। ফলে তাকে আমি হত্যা করে আযাব ভোগ করবো।” রাসূল(সা) বললেনঃ তোমার পিতাকে হত্যা করার আমার কোন ইচ্ছা নেই এবং আমি কাউকে আদেশও দিই নি। এরপর এই অশান্ত পরিস্থিতিতে পরিবর্তন আনার জন্য রাসূল(সা) প্রচলিত নিয়মের বিপরীতে অসময়ে সফরের আদেশ দিলেন। সাহাবায়ে কেরাম রওনা হলে তিনি আবদুল্লাহ ইবনে উবাইকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেনঃ তুমি কি এসব কথা বলেছ? সে অনেক কছম খেয়ে বললো যে, সে এসব কথা বলে নি। অতঃপর সাধারণ সাহাবায়ে কেরাম মনে করলেন, সম্ভবতঃ অল্প বয়স্ক যায়েদ ভুল বুঝেছে। আসলে ইবনে উবাই অমন কথা বলে নি।
এদিকে যায়েদ পড়ে গেলেন মহা ফাঁপরে। সবাই তাকে মিথ্যুক ভাবছে মনে করে তিনি গা ঢাকা দিয়ে থাকতে লাগলেন। কিন্তু মনে মনে আশান্বিত ছিলেন যে, ঘটনার মুখোশ উন্মোচন করে অচিরেই আয়াত নাযিল হবে। বাস্তবিকই এই সফরের মধ্যে সূরা মুনাফিকুন নাযিল হয়ে যায়েদের সত্যতা প্রমাণ করে দিল। রাসূল(সা) যায়েদকে ডেকে বললেনঃ “হে বালক, আল্লাহ তোমাকে সত্যবাদী সাব্যস্ত করেছেন এবং ইবনে উবাই সম্পর্কে পুরো মুনাফিকুন সূরাটাই নাযিল করেছেন।”
ইবনে উবাই যখন মদীনার উপকন্ঠে পৌঁছলো, তখন তার মুমিন পুত্র আবদুল্লাহ তার উটের হাঁটুতে পা রেখে পিতাকে বললেনঃ “আল্লাহর কছম! ‘সম্ভ্রান্ত লোকেরা নীচু জাতের লোকদেরকে বহিষ্কার করবে’ এই কথার ব্যাখ্যা না করা পর্যন্ত তুমি মদীনায় প্রবেশ করতে পারবে না। কে সম্ভ্রান্ত? তুমি না আল্লাহর রাসূল?”
পুত্র কর্তৃক পিতা অবরুদ্ধ এ খবর পেয়ে রাসূল(সা) ছুটে এলেন এবং পুত্রকে বললেনঃ তার পথ ছেড়ে দাও এবং তাকে মদীনায় ঢুকতে দাও।” অতঃপর সে মদীনায় প্রবেশ করলো।
শিক্ষাঃ মুনাফিকরা ইসলামের মারাত্মক দুশমন হলেও তাদের প্রতি মহানুভবতা ও সহিষ্ঞুতা প্রদর্শন করা কর্তব্য। তবে তাদের গতিবিধির ওপর কড়া দৃষ্টি রাখা চাই।
৪৮। রাখাল ছেলের খোদাভীতি
একবার হযরত ওমর গভীর রাতে ছদ্মবেশে মদীনার পথ ধরে হেঁটে বেড়াচ্ছিলেন এবং প্রজাদের খোঁজখবর নিচ্ছিলেন। এই সময়ে দেখতে পেলেন এক রাখাল এক পাল ছাগল নিয়ে তার সামনে দিয়ে যাচ্ছে। তিনি রাখালকে পরীক্ষা করার মানসে বললেনঃ “এই ছাগলগুলির মধ্যে যে কোন একটি ছাগল আমার কাছে বিক্রী করে দাও।”
রাখাল বললো, “এই ছাগলগুলো আমার নয়, আমার মনিবের। আমি তার ক্রীতদাস।”
ওমর বললেন, “আমরা যে জায়গায় আছি, এখানে তোমার মনিব আমাদেরকে দেখতে পাবে না। একটা ছাগল বেঁচে দাও। আর মনিবকে বলে দিও যে, একটি ছাগল বাঘে খেয়ে ফেলেছে।”
রাখাল রাগান্বিত হয়ে চিৎকার করে বলে উঠলোঃ “আল্লাহ কি দেখতে পাচ্ছেন না?”
ওমর চুপ করে রইলেন। রাখাল তার দিকে রাগত চোখে তাকিয়ে গরগর করতে করতে ছাগল হাঁকিয়ে নিয়ে চলে গেল।
পরদিন সকালে ওমর ঐ রাখালের মনিবের কাছে গেলেন এবং তাকে মনিবের কাছ হতে কিনে নিয়ে স্বাধীন করে দিলেন। অতঃপর বললেনঃ “ওহে যুবক! কালকে তুমি আল্লাহর সম্পর্কে যে কথাটি বলেছিলে, তা আজ তোমার দুনিয়ার গোলামী চুকিয়ে দিল। আমি আশা করি তোমার এই খোদাভীতি তোমাকে কেয়ামতের দিন দোজখের আজাব থেকেও মুক্তি দিবে।”
শিক্ষাঃ তাকওয়া ও সততা যত তুচ্ছ ও নগন্য মানুষের মধ্যেই পাওয়া যাক, তাকে উপযুক্ত মর্যাদা দিতে হবে। কেননা আল্লাহ বলেছেনঃ তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই অধিক সম্মানিত, যে তোমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা সৎ ও খোদাভীরু।
৪৯। প্রিয় বস্তুকে আল্লাহর পথে দান করা
বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত আছে যে, সূরা আল ইমরানের “তোমরা কখনো কল্যাণ লাভ করতে পারবে না, যতক্ষণ তোমরা যা ভালোবাস তা দান না কর” এই আয়াত নাযিল হলে সাহাবীগণের মধ্যে এ নিয়ে চিন্তাভাবনা ও প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় যে, তার সম্পত্তির মধ্যে কোন জিনিসটি বেশি প্রিয় এবং তা কত দ্রুত রাসূল(সা) এর কাছে গিয়ে দান করা যায়।
মদীনার আনসারদের মধ্যে সবচেয়ে ধনী ছিলেন আবু তালহা(রা)। মসজিদে নববীর বিপরীত দিকে তার একটি বাগানে “বীরহা” নামে একটি কুয়া ছিল। ক্রমে ঐ কুয়ার নামানুসারে তার বাগানটিও “বীরহা” নামে পরিচিত হয়। রাসূল(সা) মাঝে মাঝে এই বাগানে আসতেন এবং এই কুয়ার পানি খেতেন। এই কুয়ার পানি তার কাছ খুবই প্রিয় ছিল। আবু তালহারও এই কূপসহ বাগানটি অত্যন্ত মূল্যবান, উর্বর ও সর্বাপেক্ষা প্রিয় সম্পদ ছিল। উক্ত আয়াত নাযিল হওয়ার পর তিনি রাসূল(সা) এর নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন যে, “ আমার সমস্ত বিষয় সম্পত্তির মধ্যে বীরহা আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয়। তাই এটি আমি আল্লাহর পথে ব্যয় করতে চাই। আপনি যে কাজে ভালো মনে করেন এটি ব্যয় করুন।”
রাসূল(সা) বললেনঃ “এত বড় বাগান, আমার মতে তুমি নিজের আত্মীয় স্বজনের মধ্যে বন্টন করে দিলেই ভালো হবে।” হযরত আবু তালহা এই উপদেশ অনুসারে বাগানটি স্বীয় আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে ভাগ করে দিলেন।
ওদিকে হযরত যায়েদ বিন হারিসা তার আরোহনের প্রিয় ঘোড়াটিকে নিয়ে রাসূল(সা) এর কাছে হাজির হলেন এবং তা আল্লাহর পথে দান করার ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন। রাসূল(সা) ঘোড়াটি তার কাছ হতে নিয়ে তারই ছেলে উসমানকে দান করলেন। হযরত যায়েদকে এতে কিছুটা দ্বিধান্বিত দেখে তাকে এই বলে আশ্বস্ত করলেন যে, তোমার দান গৃহীত হয়েছে।
শিক্ষাঃ এই দুটি ঘটনা থেকে জানা গেল যে আল্লাহর পথে দান করার অর্থ শুধু ফকীর মিসকীনকে এবং ইসলামের পথে জিহাদরত ব্যক্তি বা সংস্থাকে দান করা নয়, বরং পরিবার পরিজন ও দরিদ্র আত্মীয় স্বজনকে দান করাও আল্লাহর পথে দানের শামিল এবং বিরাট সওয়াবের কাজ।
৫০। একটি নাকের মূল্য
সিরিয়া হতে পরাজিত ও বিতাড়িত রোমক সৈন্যরা তাদের তৎকালীন শক্ত ঘাঁটি মিশরের রাজধানী আলেকজান্দ্রিয়ায় গিয়ে অবস্থান নেয়। মুসলমানদের অগ্রাভিযান রুখে দেওয়ার জন্য তারা এখানে তাদের সকল শক্তি কেন্দ্রীভূত করে। কিন্তু অদম্য সাহাসী মুসলিম সেনাপতি হজরত আমর ইবনে আ’স (রা) এখানেও তাদের সম্মিলিত শক্তি গুড়িয়ে দেন এবং অধিকৃত শহরের শাসনভারের দায়িত্ব নিজের হাতে নেন। তিনি সেখানকার খৃস্টান প্রজাদেরকে তাদের যাবতীয় ধর্মীয় কর্মকান্ডে পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করেন।
একদিন সকালবেলা আলেকজান্দ্রিয়ার খ্রিষ্টান পল্লীতে হইচই পড়ে গেল। সবাই দেখা গেল বাজারে জটলা হয়ে আছে। উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় চলছে। সেখান থেকে খ্রিস্টানদের স্থানীয় আর্চবিশপ আমর ইবনে আ’স এর বাসভবনে গেলেন বাজারের ঘটনা সল্ভ করার জন্য। তাঁর সাথে আরও অনেকেই গেলেন।
সেখানে গিয়ে বিশপ জানালেন, কেউ একজন বাজারের যিশু খ্রিষ্টের মার্বেলের মূর্তির নাক গত রাতে ভেঙে ফেলেছে। এ মূর্তিটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল তাদের জন্য। খ্রিষ্টানরা ধরে নিয়েছে যে এটা মুসলমানদের কাজ। তারা উত্তেজিত হয়ে উঠেছে।
আমর ইবেন আ’স এ কথা শুনে অত্যন্ত দু:খিত হলেন। তিনি বললেন, “আমি খুবই লজ্জিত, ব্যথিত। সত্যি কথা, ইসলামে মূর্তিপূজা জায়েজ না। কিন্তু, অন্য ধর্মের উপাস্যকে গালি দেয়া পর্যন্তও হারাম। প্লিজ, আপনি মূর্তিটা পুননির্মাণ করে নিন। আমি পূর্ণ খরচ দেব।”
কিন্তু বিশপ বললেন, “এ মূর্তি রিপেয়ার করা যাবে না।”
আ’স বললেন, “তবে নতুন করে বানান। আমি খরচ দেব।”
“না, সেটাও হবে না। আপনি জানেন, যীশু ঈশ্বরপুত্র। তাঁর মূর্তির এমন অবমাননা সহ্য করা যায় না। একটাই ক্ষতিপূরণ, আমরা আপনাদের মুহাম্মাদ (স) এর মূর্তি বানিয়ে সেটার নাক ভাঙব।”
রাগে জ্বলে গেল আ’স এর গা। তিনি কিছুক্ষণ নীরব থেকে খ্রিষ্টান বিশপকে বললেন, “আপনি যা বললেন সেটা সম্ভব না। আমাদের সম্পদ, পরিবারের চেয়েও মুহাম্মাদ (স)কে বেশি ভালবাসি। আমার অনুরোধ, এ প্রস্তাব ছাড়া অন্য যেকোনো প্রস্তাব করুন আমি রাজি আছি। আমাদের যেকোনো একজনের নাক কেটে আমি আপনাদের দিতে প্রস্তুত, যার নাক আপনারা চান।”
খ্রিষ্টান নেতারা সবাই এ প্রস্তাবে সম্মত হলো।
পরদিন খ্রিষ্টান ও মুসলমান বিরাট এক ময়দানে জমায়েত হলো। মিসরের শাসক সেনাপতি আমর রা: সবার সামনে হাজির হয়ে বিশপকে বললেন, “এ দেশ শাসনের দায়িত্ব আমার। যে অপমান আজ আপনাদের, তাতে আমার শাসনের দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। তাই এই তরবারি গ্রহণ করুন এবং আপনিই আমার নাক কেটে দিন।”
এ কথা বলেই বিশপকে একখানি ধারালো তরবারি হাতে দিলেন, বিশপ সেটা পরীক্ষা করলেন। জনতা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, খ্রিষ্টানরা স্তম্ভিত। চারদিকে থমথমে ভাব। সে নীরবতায় নি:শ্বাসের শব্দ করতেও যেন ভয় হয়।
হঠাৎ সেই নীরবতা ভঙ্গ করে একজন মুসলিম সৈন্য এগিয়ে এলো। চিৎকার করে বলল, “আমিই দোষী, সেনাপতির কোনো অপরাধ নেই। আমিই মূর্তির নাক ভেঙেছি। এইত, আমার হাতেই আছে সে নাক। তবে মূর্তি ভাঙার কোনো ইচ্ছা আমার ছিল না। মূর্তির মাথায় বসা একটি পাখির দিকে তীর নিক্ষেপ করতে গিয়ে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে।”
সৈন্যটি এগিয়ে এসে বিশপের তরবারির নিচে নাক পেতে দিল। স্তম্ভিত বিশপ! নির্বাক সবাই। বিশপের অন্তরাত্মা রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল।
তরবারি ছুড়ে বিশপ বললেন, “ধন্য সেনাপতি, ধন্য হে বীর সৈনিক, আর ধন্য আপনাদের মুহাম্মদ (সা:), যার মহান আদর্শে আপনাদের মতো মহৎ উদার নির্ভীক ও শক্তিমান ব্যক্তি গড়ে উঠেছে। যীশু খ্রিষ্টের প্রতিমূর্তিই অসম্মান করা হয়েছে সন্দেহ নেই, কিন্তু তার চেয়েও অন্যায় হবে যদি অঙ্গহানি করি।”
শিক্ষাঃ ইসলাম যে বিজয়ী অবস্থায় ও অমুসলিমদের অধিকার সংরক্ষণ করে, এ ঘটনা তার জ্বলন্ত প্রমাণ। ভারতবর্ষে আটশত বছর এবং স্পেনে আটশ বছর ইসলাম শাসন চালু ছিল। অথচ ইসলামী শাসনের পতনের পর এই দুটি দেশে অমুসলিমদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা বহাল রয়েছে। এ থেকেও প্রমাণিত হয় যে, মুসলিম শাসকরা অমুসলিমদের ওপর দমননীতি চালিয়ে নিজেদের শাসন পাকাপোক্ত করার কোন চেষ্টা করে নি। করলে এত দীর্ঘকাল পরেও অমুসলিমদের অস্তিত্ব থাকতো না।
৫১। পশুপাখির প্রতি দয়া মুমিনের কর্তব্য
একবার একটি উট রাসূলুল্লাহ(সা) এর সামনে এসে নিজস্ব ভাব ভঙ্গিতে কি যেন বলল। তিনি তখন তাকে লক্ষ্য করে বললেনঃ তোমার অভিযোগ যদি সত্য হয়, তবে তো ভালই, আর যদি মিথ্যা হয় তবে এর পরিণাম তোমাকে ভোগ করতে হবে। আমার দায়িত্ব মজলুমকে আশ্রয় দেয়া। তাই তোমার নিরাপত্তার আশ্বাস দিচ্ছি। এই ঘটনার বর্ণনাকারী হযরত তামীম দারি(রা) বলেন, উটের সাথে নবীজির বাক্যালাপের কিছুই বুঝতে না পারায় আমরা এ বিষয়ে জানতে চাইলে হুজুর(সা) বললেনঃ এই উটের মালিক দীর্ঘদিন এর শ্রম নিয়েছে, বিভিন্ন কাজে খাটিয়েছে। এখন বৃদ্ধ হয়ে পড়ায় শ্রম দিতে পারে না-এ অভিযোগে তাকে জবাই করতে চায়। জবাই হওয়ার ভয়ে উটটি আমার নিকট পালিয়ে এসেছে।ইতিমধ্যে উটের মালিক সেখানে আসলো। নবীজি তাকে বললেনঃ তোমার বিরুদ্ধে এক জঘন্য নালিশ করেছে। সে জানতে চাইল কে তার বিরুদ্ধে কি নালিশ করেছে। তিনি তখন বললেনঃ এই উট দীর্ঘদিন তোমার সেবা করেছে। তুমি নাকি তাকে এখন জবাই করতে ফেলতে চাও? সে বললোঃ এটা এখন আর কোন রকম শ্রম দেয়ার উপযুক্ত নয়, কাজেই জবাই ছাড়া কি আর করা যায়! হুজুর(সা) বললেনঃ জীবন-যৌবন, শক্তি সামর্থ্য দিয়ে সে এতদিন তোমার সেবা করেছে, আর এখন জরাগ্রস্ত হয়ে পড়ায় তুমি তাকে জবাই করতে চাও। তোমার কর্তব্য তার প্রতি সদয় হওয়া। জবাই হতে রক্ষা পাওয়ার জন্য সে তোমার প্রতি করুণ আকুতি জানিয়েছে। কিন্তু সেদিকে কর্ণপাত করো নি, তার আত্মার ফরিয়াদ তুমি বুঝতে পার নি। এহেন অবস্থায় তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা আমার নৈতিক দায়িত্ব। এই বলে তিনি মালিকের কাছ হতে একশ’ মুদ্রায় উটটি কিনে নিলেন আর উটকে লক্ষ্য করে বললেনঃ আমি আল্লাহর ওয়াস্তে তোমাকে সকল প্রকার ভয়ভীতি ও অধীনতা হতে মুক্ত করে দিলাম। (নুজহাতুল মাজালেশ)।
এক হাদীসে আছেঃ একদা একটি কুকুর পিপাসায় কাতর হয়ে কুয়ার পাড়ে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছিল। ঘটনাক্রমে এক দেহপসারিনী পাপীয়সী সেখানে আসলো। কুকুরটি কাতরতা দেখে তার মনে দয়া হলো। সে তার ওড়নার আঁচল ভিজিয়ে কয়েকবার পানি তুলে নিংড়িয়ে কুকুরটিকে পান করিয়ে তার পিপাসা মিটলো। এতে খুশি হয়ে আল্লাহ তা’য়ালা মহিলাটির গত জীবনের সমস্ত ব্যভিচার অপরাধ ক্ষমা করে দিলেন। (বুখারী, মুসলিম)।
৫২। খোদাভীরু সাহাবীর অলৌকিকভাবে জীবন রক্ষা
রাত গভীর হয়ে গেছে। ঘুট ঘুটে অন্ধকারে আচ্ছন্ন মক্কার অলিগলি। ঘুমন্ত নগরীর নিস্তব্ধ পরিবেশে অতি সন্তর্পণে পা রাখলেন মুরছাদ ইবনে আবি মুরছাদ। কাফেররা যে সব মুসলমানকে আটক রেখেছিল এবং অমানুষিক নির্যাতন চালাচ্ছিল, তাদের কয়েকজনকে গোপনে মদীনায় নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি এসেছিলেন। রাসূল(সা) তাকে এই কাজে নিয়োগ করেছিলেন। তিনি অতি সাবধানে যাচ্ছিলেন। সহসা সামনে একটা ছায়া দেখতে পেলেন। মুরছাদ ভয়ে জড়সড় হয়ে আসলেন। ছায়াটা আরো নিকটে এল। অতঃপর ছায়াটা থেকে পরিচিত এক নারী কন্ঠ ভেসে এলঃ
“মুরছাদ! তুমি? আমি চিনে ফেলেছি। কেমন আছ? কিভাবে এলে?”
“কে উনাক নাকি?” প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন মুরছাদ।
“হ্যাঁ, আমি উনাক। তোমার প্রাণপ্রিয় উনাক। একদিন যাকে ছাড়া তোমার দু’দন্ডও চলতো না। এত রাতে কোথায় যাবে তুমি? চল, আমাদের বাড়ীতে। মনে আছে না অতীতের সেই দিনগুলির কথা?” বলতে বলতে মুরছাদের হাত ধরে টানতে লাগলো মুরছাদের জাহেলী যুগের প্রেমিকা ও বাল্য সংগিণী।
মুরছাদ এক ঝটকায় হাত সরিয়ে এমন ভঙ্গিতে দূরে সরে গেলেন যেন তার হাত কোন বিষধর সাপে পেঁচিয়ে ধরেছিল।
“কী হলো? পাগল টাগল হয়ে গেছ নাকি? এ হাত একদিন তোমার কত প্রিয় ছিল, তা কি ভুলে গেলে?” উনাক বিস্ময়জড়িত কন্ঠে বললো।
“থামো উনাক। অতীতের কথা ভুলে যাও। ওটা ছিল আমার জীবনের অন্ধকার যুগ। সে সময় আমি সত্য মিথ্যা, ন্যায় অন্যায় এবং পাক নাপাকির কোন বাছবিচার করতাম না। আমি গোমরাহ ও বিপথগামী ছিলেন। আল্লাহ আমার ওপর অনুগ্রহ করেছেন। আমি মুসলমান হয়েছি। কিন্তু তুমি এখনো মোশরেক। তা ছাড়া তুমি আমার জন্য পরস্ত্রী। পরস্ত্রীর সাথে মেলামেশা ইসলামে হারাম। কাজেই আমাকে মাফ কর। তোমার বাড়ীতে আমি যাবো না।” মুরছাদ দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে বললেন।
“কত বড় আমার সাধু পুরুষগো। আমার সাথে যাবে, না চিৎকার দিয়ে সবাইকে জড় করবো?” উনাক বললো।
“মুরছাদ পবিত্র জীবন ছেড়ে অপবিত্রতার পথ আর মাড়াবে না। জাহেলী যুগের সব কিছু আমি পা দিয়ে পিষে ফেলেছি। যাও, তোমার কাজে তুমি যাও।” মুরছাদ অবিচল কন্ঠে জবাব দিল।
“আমার কাজে আমি চলে যাই, আর তুমি ধর্মচ্যূতদেরকে ভাগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে যাও, তাই না?” ক্রুদ্ধ সর্পিনীর মত ফুঁসতে ফুঁসতে বললো উনাক। তারপর আকাশ বাতাস ফাটিয়ে চিৎকার করে “ওহে মক্কাবাসী, এই দেখ মুরছাদ এসেছে, তোমাদের বন্দীদেরকে ভাগিয়ে নিয়ে যাবে।”
আর যায় কোথায়! সদ্য ঘুমিয়ে পড়া মক্কাবাসী জেগে উঠলো এবং যেদিক থেকে আওয়ায আসছিল, সেই দিকে দলে দলে ছুটলো।
মুরছাদ ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে একটা পাহাড়ের গর্তে আত্মগোপন করলেন। কিছু লোক ঐ গর্তের দিকে ধেয়ে গেল। মুরছাদের ধরা পড়ে যাওয়া প্রায় অবধারিত ছিল। সহসা অনেক দূর হতে এক রহস্যময় আওয়ায ভেসে এলঃ “ওদিকে নয়, এদিকে।”
এরপর মুরছাদ শুনতে পেলেন পায়ের আওয়াযগুলো ক্রমে দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে। আল্লাহ তার সৎ ও পরহেজগার বান্দাকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে অলৌকিকভাবে রক্ষা করেছিলেন।
শিক্ষাঃ পবিত্র কুরআনের সূরা তালাকের একটি আয়াতে আল্লাহ বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে অন্যান্য কাজ হতে বিরত থাকবে, আল্লাহ তাকে সংকট থেকে কোন না কোন উপায়ে উদ্ধার করবেন এবং তাকে অকল্পনীয়ভাবে জীবিকা সরবরাহ করবেন।” আলোচ্য ঘটনা এই আয়াতে বর্ণিত আল্লাহর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের একটি জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। এমন অলৌকিকভাবে বিপদ হতে উদ্ধার পাওয়া সবার ভাগ্যে নাও জুটতে পারে, কিন্তু প্রতিদান আখিরাতে অবশ্যই পাওয়া যাবে এই বিশ্বাসে অবিচল থেকে তাকওয়া ও পরহেজগারী সর্বাবস্থায় বজায় রাখা কর্তব্য।
৫৩। ওমর ইবনে আবুদল আযীযের ন্যায়বিচার
হযরত ওমর ইবনে আবুদল আযীয় খলীফা হবার পর সমরখন্দের এক প্রতিনিধি দল এসে অভিযোগ করলো যে, সেখানকার মুসলিম বাহিনীর অধিনায়ক এলাকার একটি শহর অতর্কিতে দখল করে সেখানকার স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে জোরপূর্বক মুসলমানদের বসতি গড়ে দিয়েছেন। হযরত ওমর বিন আবদুল আযীয সমরকন্দের গভর্নরকে প্রকৃত ঘটনা কি, তার তদন্ত করার নির্দেশ দিলেন। তিনি লিখলেন যে, একজন বিচারক দ্বারা তদন্ত করতে হবে। বিচারক যদি বলেন যে, সেখান হতে মুসলমানদের বেরিয়ে যাওয়া উচিত, তাহলে তৎক্ষণাত শহর খালি করে দিতে হবে।
নির্দেশ মোতাবেক একজন মুসলিম বিচারক তদন্ত করে রায় দিলেন যে, মুসলমানদের শহর ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত। কেননা প্রথমে তাদের শহরবাসীকে সতর্ক করা উচিত ছিল যে এবং ইসলামের সমর বিধি অনুসারে সকল চুক্তি বাতিল করা উচিত ছিল, যাতে তারা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে পারে। তাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ করা উচিত হয় নি।
সমরকন্দবাসী এ রায় শুনে নিশ্চিত হলো যে, ইসলামী সরকার ইনসাফ ও ন্যায়বিচারে অতুলনীয়। এ ধরনের লোকদের সাথে যুদ্ধ করা নিরর্থক এবং এদের শাসন আল্লাহর করুণা স্বরূপ। তাই তারা তাদের এলাকায় মুসলমানদের আবাসন সানন্দে মেনে নিল।
শিক্ষাঃ সুবিচার ও ন্যায় নীতিতে অবিচল থাকার মাধ্যমে মুসলমানরা যে কোন স্থানে অমুসলিমদের সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে। অমুসলিমদের সাথে উত্তম সম্পর্ক বজায় রাখা ইসলাম ও মুসলমানদের স্বার্থে সব সময়ই জরুরী।
৫৪। বায়তুল মাকদাস বিজয়ী প্রথম বীর হযরত ইউশা ইবনে নূনের কাহিনী
হযরত মূসা(আ) বনী ইসরাঈলকে সাথে নিয়ে অলৌকিক উপায়ে লোহিত সাগর পেরিয়ে এক মরুভূমিতে অবস্থান করতে থাকেন। এই সময় আল্লাহ তায়ালা বেহেশত হতে মান্না এবং সালওয়া নামক খাবার পাঠিয়ে এবং আকাশ হতে মেঘের ছায়া দিয়ে তাদের জীবন যাপনের সুব্যবস্থা করেন। ইত্যবসরে আল্লাহর নির্দেশক্রমে মূসা(আ) বনী ইসরাঈলীদেরকে বলেন, “আল্লাহ একটি সুজলা সুফলা নয়নাভিরাম পবিত্র ভূমি ফিলিস্তিন তোমাদের স্থায়ী বসবাসের জন্য নির্ধারণ করেছেন। তোমরা সেখানে গিয়ে বসবাস করতে থাক।” এই সময়ে ফিলিস্তিন ছিল আমালেকা নামক বিশালদেহী একটি জাতির দখলে। বনী ইসরাঈলীরা লোকমুখে তাদের বিবরণ শুনেছিল। তারা জবাব দিল, “হে মূসা! ঐ দেশে একটি অত্যন্ত শক্তিশালী জাতি বাস করে। তাদেরকে লড়াই এর মাধ্যমে পরাজিত করে বহিষ্কার করা ছাড়া আমরা সেখানে প্রবেশ করতে পারবো না। কিন্তু তাদের সাথে আমরা লড়াই করতে অক্ষম।”
হযরত মূসা(আ) এ কথা শুনে তাঁর বিশ্বস্ত সাহাবী হযরত ইউশা ইবনে নূনের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল ফিলিস্তিনে পাঠালেন সেখানকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করার জন্য। প্রতিনিধি দলটি ফিরে আসার পর হযরত মূসা(আ) কে জানালো যে, ঐ লোকগুলি দেখতেই শুধু বিশালদেহী, কিন্তু তেমন সাহসী ও লড়াকু নয়। বনী ইসরাঈলীরা একযোগে আক্রমণ করলে তারা পালিয়ে যেতে বাধ্য হবে।
এবার হযরত মূসা(আ) বনী ইসরাঈলীদেরকে একত্রিত করে এক জ্বালামীয় ভাষণ দিয়ে তাদেরকে ফিলিস্তিনে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু তারা বললো, “ঐ শক্তিমান জাতিটি যতক্ষণ ওখানে আছে, ততক্ষণ আমরা যাবো না। যদি বেরিয়ে যায়, তাহলে আমরা যাবো।”
এই সময় হযরত ইউশা ইবনে নূন ও হযরত মূসার(আ) ভগ্নিপতি কালেব তাদেরকে অনেক বুঝালেন যে, “তোমরা ভয় পেয়না। আল্লাহর ওপর ভরসা করে এগিয়ে চল। তোমরা ঐ দেশটির সীমান্তে পৌঁছামাত্রই ওরা চলে যাবে এবং তোমরা বিজয়ী হবে।”
বনী ইসরাঈল বললো, “হে মূসা! ওরা থাকতে আমরা যাবো না। বরঞ্চ তুমি ও তোমার খোদা গিয়ে লড়াই করে ওদের তাড়িয়ে দিয়ে এস। আমরা ততক্ষণ এখানেই বসে থাকবো।”
এবার মূসা(আ) আল্লাহর কাছে নিবেদন করলেন, “হে আল্লাহ, আমি কেবল আমার ও আমার ভাই এর দায়িত্ব নিতে পারি। তুমি আমার সাথে আমার এ অবাধ্য জাতির সম্পর্ক ছিন্ন করে দাও।”
আল্লাহ বললেন ‘এদেশটি (বায়তুল মুক্বাদ্দাস সহ শামদেশ) চল্লিশ বছর পর্যন্ত তাদের জন্য নিষিদ্ধ করাহল। এ সময় তারা ভূপৃষ্ঠে উদ্ভ্রান্ত হয়ে ফিরবে। অতএব তুমি অবাধ্য কওমের জন্য দুঃখ করো না।‘ মায়েদাহ ৫/২৬।
এরপর বনী ইসরাঈল চল্লিশ বছর ধরে মরুভূমিতে উদ্ভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়াতে থাকে। এই সময়ে মিশর হতে বেরিয়ে আসা বংশধরটি সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। পরবর্তী বংশধরের লোকেরা পূর্ববর্তীদের পরিণতি হতে শিক্ষা নিয়ে জিহাদে অংশগ্রহণ করতে প্রস্তুত হয়। চল্লিশ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর আল্লাহ তায়ালা হযরত মূসা (আ) ও হযরত হারূন(আ) কে নির্দেশ দিলেন যে বনী ইসরাঈলের বারটি গোত্রকে বারোজন সেনাপতির নেতৃত্বে বারোটি সেনাদলে বিভক্ত করে ফিলিস্তিনে পাঠাও। তদনুসারে হযরত মূসা(আ) হযরত ইয়াকূবের(আ) ১২ জন পুত্রের নামে ১২ টি সেনাদল গঠন করে।
বনী ইসরাঈলের এই সম্মিলিত বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন হযরত ইউশা ইবনে নূন। এই বাহিনীর যাত্রার পূর্বেই হযরত মূসা(আ) ও হারূন (আ) একে একে ইন্তিকাল করেন। অতঃপর গোটা বনী ইসরাঈল জাতির সার্বিক নেতৃত্ব দেন হযরত মূসা(আ) এর প্রথম খলীফা হযরত ইউশা ইবনে নূন এবং তাঁর নেতৃত্বে ফিলিস্তিন বিজিত হয়। অতঃপর বাইতুল মাকদাসকে রাজধানী করে ফিলিস্তেনের অধিবাসীদেরকে হযরত ইউশা আল্লাহর কিতাব তাওরাত অনুসারে ২৭ বছর শাসন করেন। তিনি ১২৭ বছর বয়সে ইন্তিকাল করেন বলে বর্ণিত আছে।
শিক্ষাঃ জেহাদ থেকে পিছপা হওয়া অত্যন্ত মারাত্মক পরিণাম ডেকে আনে। পক্ষান্তরে ইসলাম ও মুসলমানদের রক্ষার জন্য আল্লাহর ওপর ভরসা করে জেহাদে অবতীর্ণ হলে প্রতিপক্ষ যত শক্তিশালীই হোক, আল্লাহ বিজয় লাভে সাহায্য করেন।