শিক্ষাজীবন
নিসার আলী যখন জন্মগ্রহণ করেছিলেন, সেই সময়ে মুসলিম সম্ভ্রান্ত পরিবারে একটি সুন্দর নিয়ম চালু ছিঃল। নিয়মটি হলো- শিশুর বয়স যখন পাঁচ বছর পূর্ণ হতো তখনই তাদেরকে ধর্মীয় শিক্ষা দেয়া শুরু হয়ে যেত।
নিয়মটি ছিল চমৎকার। এর ফলে মুসলিম পরিবারে ধর্মীয় শিক্ষার প্রসার ঘটতো ব্যাপকভাবে।
আসলেই তো শিক্ষা ছাড়া সব কিছু অন্ধকার।
যার মধ্যে শিক্ষার আলো নেই, তার মধ্যে জ্ঞানের প্রদীপ কিভাবে জ্বলবে? মনুষত্ব কিভাবে বিস্তার লাভ করবে?
এই মৌলিক কথাগুলো জানতেন নিসার আলীর পিতা হাসান আলী। জানতেন তাঁর মা- আবেদা রোকাইয়া খাতুন। জানতের বৃদ্ধা দাদীও।
সতেরো শো ছিয়াশি সাল।
নিসার আলীল বয়স তখন মাত্র চার বছর চার মাস চারদিন।
চমৎকার মিল!
ঠিক এই সময়ে পরিবারের সবাই বসে গেলেন গোল হয়ে। পরামর্শ করলেন। সবারই এক কথা। নিসার আলীকে এখন, এই বয়সেই লেখাপড়া শেখানো শুরু করতে হবে।
দাদীও মহা খুশি। বললেণ, আমার আদরে তিতামীরকে জলদি লেখাপড়া শেখাবার ব্যবস্থা করো।
যে কথা সেই কাজ।
পরামর্শ শেষ করলেন হাসান আলী। তিনি যেমন ছিলেন সচেতন, তেমনি ছিলেন শিক্ষানুরাগী।
মা রোকাইয়াও ছিলেন তেমনি। শিক্ষার ব্যাপারে তাঁরও ছিল দারুণ আগ্রহ।
ঠিক সেই দিনই কথা মতো পিতা-মাতা অত্যন্ত আনন্দের সাথে নিসার আলীর হাতে তুলে দিলেন তখতী।
সূচনা হলো নিসার আলীর শিক্ষাজীবন। আর এক নতুন জীবন।
সেই সময় একজন বিখ্যাত শিক্ষক ছিলেন। নাম- মুনশী মুহাম্মদ লাল মিয়া। মুনশী লাল মিয়া নামেই তিনি সবার কাছে অধিক পরিচিত ছিলেন।
লাল মিয়ার ছিল বিশাল জ্ঞানের বহর। আরবী, উর্দু এবং ফারসী ভাষায় তাঁর দক্ষতা ছিল ব্যাপক। তাঁর শিক্ষা দেবার পদ্ধতিও ছিল অত্যন্ত চমৎকার। যার কারণে তখনকার দিনে মুনশী লাল মিয়ার পরিচিতি ছিল অত্যন্ত চমৎকার। যার কারণে তখনকার দিনে মুনশী লাল মিয়ার পরিচিতি ছড়িয়ে পড়েছিল চারদিকে। সবার মুখে মুখে ছিল তাঁর সুনাম সুখ্যাতি।
যোগ্য শিক্ষক মুনশী লাল মিয়া। নিসার আলীর আরবী, উর্দু এবং ফারসী ভাষা শিক্ষা দেবার জন্যে হাসান আলী নিযুক্ত করলেন মুনশী লাল মিয়াকে।
লাল মিয়া খুব যত্ন আর আন্তরিকতার সাথে নিসার আলীকে পড়ান। পড়ান দরদ দিয়ে। তিনিও তাঁকে ভালোবাসেন প্রাণ দিয়ে।
পিতা হাসান আলী এবং মা রোকাইয়া সব সময় খোঁজ-খবর রাখেন ছেলের লেখাপড়ার।
নিসার আলীর বয়স তখন খুবই অল্প। তবুও সেই অল্প বয়সে তাঁর শিক্ষার প্রতি ছিল দারুণ আগ্রহ।
খান্দানী পরিবারের সন্তান হবার কারণে পরিবারের সেই উজ্জ্বল আদর্শ ও ঐতিহ্য ছিল নিসার আলীর অনিবার্য ভূষণ।
লেখাপড়ায় খুবই মনোযোগী ছিলেন নিসার আলী। সেই সাথে ছিল তাঁর ক্ষুরধার মেধা। খুব সহজেই, অল্প সময়ের মধ্যে তিনি আরবী, উর্দু এবং ফারসী ভাষার নানান দিকগুলো শিখে নিতে পারতেন।
তাঁর লেখাপড়ার প্রতি অসীম আগ্রহ দেখে খুশি হলেন পিতা। খুশি হলেন মা-ও।
তখনও ঐ তিনটি ভাষা শিখছেন নিসার আলী। তখনও চলছে মুনশী লাল মিয়ার প্রতিদিনের তালিম। নিসার আলীও একটু একটু করে অনেক দূর এগিয়ে গেছেন শিক্ষার ক্ষেত্রে।
কিন্তু এতোটুকুতে সম্পূর্ণ খুশি নন নিসার আলীর পিতা-মাতা। তাঁরা চান- শুধু বিদেশী ভাষা নয়, শুধু ধর্মীয় শিক্ষাই নয়, আধুনিক শিক্ষায়ও ছেলেকে শিক্ষিত করে তুলতে হবে। তাঁকে যোগ্য করে গড়ে তুতে হবে অন্যান্য ভাষার পাশাপাশি মাতৃভাষা বাংলাতেও।
কারণ, এই বিখ্যাত পরিবারটি বাংলা ভাষাতেও ছিল পূর্ব থেকেই শিক্ষিত। বাংলা ভাষার প্রতি তাই তাঁদের ছিল অকৃত্রিম হৃদয়ের টান। মাতৃভাষার প্রতি তাঁরা ছিলেন অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল।
ভাবতে থাকলে তাঁরা। ভাবলেন, কাকে নিযুক্ত করা যায় নিসার আলীকে বাংলা ভাষা শেখাবার জন্যে? তেমন যোগ্য বাংলা শিক্ষক কোথায় পাওয়া যায়?
খোঁজ করতে থাকলেন তাঁরা চারপাশ।
হঠাৎ তাঁদের খেয়াল হলো- পণ্ডিত রাম কমল ভট্টাচার্যের কথা।
রাম কমল ভট্টাচার্য ছিলেন একজন মস্ত বড়ো পণ্ডিত। বাংলা ভাষায় তিনি খুব দক্ষ। তাঁর বাড়িটি ছিল শেরপুর গ্রামে। গ্রামটি চাঁদপুরের পাশেই।
একদিন পণ্ডিত রাম কমল ভট্টাচার্যকে ডেকে পাঠালেন হাসান আলী। রাম কমল এলে তাঁকে বললেন, আমি নিসার আলীর বাংলা ভাষা শেখাবার দায়িত্ব আপনাকে দিতে চাই। আপনি কি সময় করতে পারবেন?
রাম কমল খুব খুশি হলেন হাসান আলীর কথায়।
এতো বড়ো খান্দানী পরিবারের ছেলের শিক্ষক হওয়াটাকে তিনি গৌরবজনক বলে মনে করলেন।
হাসান আলীর প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলেন পণ্ডিত রাম কমল।
আরবী, উর্দু এবং ফারসী ভাষার পাশাপাশি এবার চলতে থাকলো নিসার আলীল বাংলা ভাষার চর্চা। নিসার আলীর বাংলা ভাষার প্রতিও ছিল দারুণ ঝোঁক।
শিক্ষার প্রতি তাঁর গভীর মনোযোগ আর আগ্রহ অবাক হলেন পণ্ডিত রাম কমল। বাংলার পাশাপাশি তিনি ধারাপাত, অংক প্রভতি বিষয়েও শিক্ষা দিতে থাকলেন নিসার আলীকৈ।
ঠিক এমনি সময়।
এমনি সময়ে সুদূর বিহার শরীফ থেকে একদিন চাঁদপুর গ্রামে এলন একজন বিখ্যাত আলেম। নাম- হাফেজ নিয়ামতুল্লাহ।
হাফেজ নিয়ামতুল্লাহ ছিলেন একজন মস্তবড়ো আলেম। ছিলেন শিক্ষাবিদ।
তিনি চাঁদপুর গ্রামে এলে খবরটি ছড়িয়ে পড়লো চারদিকে। খবরটি শুনলেন নিসার আলীর পিতা হাসান আলীও।
হাসান আলীর হৃদয়ে ছিল একটি সুপ্ত বাসনা। তাঁর স্বপ্ন ছিল চাঁদপুর গ্রামে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা। যোগ্য লোকের অভাবে এতোদিন তিনি সেটা করতে পারেননি।
হাফেজ নিয়ামতুল্লাহকে পেয়ে হাসান আলীর বুকটা আনন্দে ভরে উঠলো। ভাবলেন, এবার তাঁর স্বপ্নের প্রদীপটি জ্বালানো হয়তোবা সম্ভব হবে।
তিনি ডাকলেণ গ্রামের সকল মানুষকে। হাসান আলী ছিলেন একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি। সমাজে তার শ্রদ্ধা এবং সম্মান ছিল অনেক অনেক বেশি।
শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি হাসান আলীর আহ্বানে একত্রিত হলেন গ্রামের লোক।এবার তিনি তাঁদের সামনে একে একে তুলে ধরলেন শিক্ষার গুরুত্ব। শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা। সেই সাথে বুঝালেন গ্রামে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব সম্পর্কে।
উপস্থিত সবাই হাসান আলীর কথায় খুব খুশি হলেন। তাঁরা একমত হলেন মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে। সিন্ধান্ত হলো- চাঁদপুরে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা হবে। এবং সেই মাদ্রাসার দায়িত্বগ্রহণ করবেন বিহার শরীফ থেকে আগত বিখ্যাত আলেম হাফেজ নিয়ামতুল্লাহ।
কথা মতো চাঁদপুরে গ্রামের একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা হলো। সেই মাদ্রাসার দায়িত্বভার দেয়া হলো হাফেজ নিয়ামতুল্লাহর ওপর। তিনিই হলেন এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক।
মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠিত হবার পর হাসান আলী আল্লাহকে শুকরিয়া জানালেন। বহুদিনের একটি মহৎ স্বপ্ন-সাধ এবার তাঁর পূরণ হলো।
নিসার আলী ততোদিনে শিক্ষার ক্ষেত্রে এগিযে গেছেন আরও অনেক দূর। আরবী, ফারসী এবং উর্দু ভাষায় তিন যথেষ্ট জ্ঞান লাভ করেছেন। জ্ঞান লাভ করেছেন বাংলা ভাষাতেও। মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠার পর হাসান আলী এবার নিসার আলীকে তুলে দিলেন হাফেজ নিয়ামতুল্লাহর হাতে।
নিয়ামতুল্লাহ ছিলেন অত্যন্ত যোগ্য শিক্ষক। তাঁর ছিল একটি সূক্ষ্ম দৃষ্টি। শত শত ছাত্রের ভেতরও তিনি প্রকৃত প্রতিভাকে চিনে নিতে পারতেন। আর অপরদিকে নিসার আলীও ছিলেন তুখোর ছাত্র। যেমন ছিলেন লেখা-পড়ায় ভালো, তেমনি ছিল তাঁর চরিত্র এবং ব্যক্তিত্ব। সহজেই চোখে পড়ার মতো। দারুণ যোগত্যতাসম্পন্ন ছিলেন নিসার আলী। ফলে প্রিয় শিক্ষক নিয়ামতুল্লাহর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে তাঁর এতটুকুও সময় লাগেনি।
আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত নিসার আলী একটানা লেখা-পড়ার ভেতর সময় কাটান। অর্থাৎ তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভের সময়-কাল ছিল আঠারো বছর। এই আঠারো বছর শিক্ষা জীবনে নিসার আলী নিজেকে ধাপে ধাপে যোগ্য করে গড়ে তলেছিলেন। গড়ে তুলেছিলেন আর দশজনের চেয়েও শ্রেষ্ঠ করে।
তিনি তাঁর এই শিক্ষা জীবনেই কুরআনের হাফেজ হয়েছিলেন। তাছাড়াও আরবী ব্যাকরণ, ফারায়েজ, হাদীস, দর্শন, তর্কশাস্ত্র, তাসাউফ, আরবী-ফারসী কাব্য ও সাহিত্যে তিনি বিশেষভাবে দক্ষতা অর্জন করে ছিলেন। সেই সাথে যুক্ত হয়েছিল তাঁর বাংলাভাষায় অসাধারণ পাণ্ডিত্য।
এসব ভাষায় নিসার আলী এতোটাই যোগ্যতা এবং দক্ষতা অর্জন করেছিলেন যে তিনি আরবী, ফারসী, উর্দু, বাংলা প্রভৃতি ভাষায় অনর্গল বক্তৃতা দিতেও পারতেন।
লেখা-পড়ার ফাঁকে ফাঁকে প্রিয় শিক্ষক হাফেজ নিয়ামতুল্লাহর সাথে নিসার আলী বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করতেন। সেই সময়ে তিনি ভ্রমণ করেছেন বাংলার বাইরে- বিহার শরীফ এবং তার আশ-পাশের বেশ কয়েকটি দেশ।
এই ভ্রমণের ফলে নিসার আলী অর্জন করেন ব্যাপক বাস্তব অভিজ্ঞতা। যে অভিজ্ঞতা ছিল তাঁর শিক্ষা জীবনের আর একটি উজ্জ্বল অধ্যায়।
নিসার আলীর শিক্ষা জীবন ছিল খুবই বর্ণাঢ্য। যেমন বর্ণাঢ্য ছিল তাঁর পরবর্তী জীবন-সংগ্রামের অম্লান ইতিহাস।
বিবাহ
সফলতার সাথে শিক্ষা জীবন শেষ করার পর নিসার আলী বিয়ে করেন।
তিনি বিযে করেন সেই সময়ের আর এক খান্দানী পরিবারে। এই পরিবারটি ছিল পূর্ব থেকেই আলেম, দীনদার এবং ঐতিহ্যমণ্ডিত পরিবার। দীনের চর্চা ছিল তাদের পারিবারিক বৈশিষ্ট্য।
এই খান্দানী পরিবারে একজন বিখ্যাত আলেম ছিলেন। তিনি দরবেশ এবং বুজুর্গ হিসাবেও অত্যন্ত পরিচিত ছিলেন। নাম- শাহ সুফী মুহাম্মদ আসত উল্লাহ সিদ্দিকী।
দরবেশ আসমত উল্লাহর ছিল এক ছেলে। নাম- শাহ সুফী মুহাম্মদ রহীমুল্লাহ। তিনিও ছিলেন আলেম। তিনিও দরবেশ এবং বুজুর্গ ব্যক্তি হিসাবে সমাজে পরিচিত ছিলে।
নিসার আলী বিয়ে করেন এই দরবেশ পরিবারে। তাঁর স্ত্রীর নাম- মায়মুনা সিদ্দিকা।
মায়মুনা সিদ্দিকা ছিলেন শাহসুফী মুহাম্মদ আসমত উল্লাহর সিদ্দিকীর পৌত্রী এবং তাঁর সুযোগ্য পুত্র শাহ সুফী মুহাম্মদ রহীমুল্লাহর সিদ্দিকীর আদরের কন্যা।
মায়মুনা সিদ্দিকাও ছিলেন দাদা এবং পিতার সুযোগ্যা উত্তরসূরী।
তাঁর দাদা এবং পিতা ন্যায়নিষ্ঠ, দরবেশ ও ইসলারেম খাদেম হবার কারণে তাঁদের গোটা পরিবারটি ছিল ইসলামী আদর্শে উজ্জীবিত।
পরিবারের সেই আদর্শ এবং ঐতিহ্য ছিল মায়মুনা সিদ্দিকার ব্যক্তিগত জীবনেও।
তিনিও ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপরায়ণা ও পর্দানশীল। ছিলেণ আচার-ব্যবহারে মার্জিত এবং শালীন।
এক খান্দানী পরিবার থেকে আর এক খান্দানী পরিবারে আসার কারণে মায়মুনা সিদ্দিকা দারুণ খুশি হলেন। খুশি হলেন নিসার আলীর মতো এক সচ্চরিত্র এবং আদর্শবান শিক্ষিত যুবকের সাথে বিয়ে হবার কারণে।
যুবক নিসার আলীর হৃদয়েও বয়ে গেল আনন্দের তুফান। মায়মুনার মতো একটি মেয়েকেই যেন তাঁর পরিবার খোঁজ করছিলেন। খোঁজ করছিলেন নিসার আলীর জীবন সঙ্গিনী করার জন্যে।
হাসান আলীর গোপা পরিবারে ছড়িযে পড়লো খুশির বন্যা।
এক দরবেশ পরিবারের কন্যা মায়মুনা সিদ্দিকাকে নিসার আলীর স্ত্রী হিসাবে ঘরে আনার কারণে খুশি হলেন মা রোকাইয়া। খুশি হলেন ছোট দাদা- সাইয়েদ ওমর দারাজ রাজীসহ সকলেই।
নিসার আলীর পরিবারে তখনো চলছে বিয়ের আনন্দে মৌ মৌ উৎসব। চলছে খুশির উল্লাস।
ঠিক এমনি সময়ে ঘটে গেল একটি মারাত্মক দুর্ঘটনা।
শোকের নদী
নিসার আলীর বিয়ের মাত্র চৌদ্দ দিন পর। তখনি ঘটে গেল দুঃখজনক ঘটনাটি।
নিসার আলীর ছোট দাদা সাইয়েদ ওমর দারাজ রাজী হঠাৎ করে ইন্তিকাল করলেন।
চলে গেলেন একটি নক্ষত্র। চলে গেলেন আপনজন এবং প্রিয়জনদেরকে অকূল শোক-সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে। চলে গেলেন তিনি পরপারে। আর এক অনন্ত জীবনে।
ছোট দাদার ইন্তিকালে তখনো গোটা পরিবার শোকে মুহ্যমান। তখনো তাঁদের বুকে কেঁপে কেঁপে উঠছে বেদনার বিশাল ঢেউ।
ঠিক এমনি সময়ে।
ছোট দাদার ইন্তিকালের মাত্র ছয় মাস পরে। ঘটে গেল আর একটি মস্ত বড়ো দুর্ঘটনা।
আকস্মিকভাবে ইন্তিকাল করলেন- পিতা হাসান আলী।
একটি শোকের আগুন নিভতে না নিভতেই জ্বলে উঠলো আর একটি কষ্টের দাবানল।
হাসান আলীও ছিলেন একজন ইসলামের নিবেদিত খাদেম। ছিলেন দরবেশ সমতুল্য।
নিসার আলীর জন্মের আগেই ইন্তিকাল করেন তাঁর আপন দাদা সাইয়েদ শাহ কদম রসূল।
দাদার ছোট ভাই ওমর দারাজ রাজীর হাতেই মুরীদ হন নিসার আলীর পিতা- হাসান আলী।
হাসান আলী ছিলেন চাঁদপুর গ্রামের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি। তাঁর পরিচিতি ছিল গ্রামের বাইরে আরও ওদু দশ গ্রাম ব্যাপী। ইসলাম প্রচার প্রসারের জন্য তাঁর অবদান ছিল অনেক। সমাজ সেবক হিসেবেও ততোধিক খ্যাতি ছিল হাসান আলীর।
এই প্রাণপ্রিয় পিতার ইন্তিকালে মেযন নিসার আলী ব্যথিত হলেন, তেমনি ব্যথিত হলেণ মা রোকাইয়া, স্ত্রী মায়মুনা, গোটা পরিবার এবং চাঁদপুরসহ আশ-পাশের সকল মানুষ। তাঁদের হৃদয়ের দুকূল ছাপিয়ে উঠলো বেদনার তুফান।
আখড়ার দলনেতা
সতেরো শো বিরাশি সাল। নিসার আলীর জন্মের সাল। সেই সময়ে বাংলার কিশোর-যুবকরা খেলা-ধুলার পাশাপাশি নিয়মিত শরীর চর্চা করতো।
তাদের শরীর চর্চার জন্যে ছিল বিভিন্ন আখড়া বা কেন্দ্র।
সেসব আখড়ায় শরীরচর্চা শিক্ষা দেবার জন্যে থাকতেন অভিজ্ঞ প্রশিক্ষক। তাঁরা সেইসব কিশোর-যুবককে ব্যায়মসহ শরীরচর্চার বিভিন্ন কলা-কৌশল শেখাতেন। কিশোর যুবকরাও শিখতো অত্যন্ত আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে। গভীর মমতার সাথে।
নিসার আলীর পিতা হাসান আলীর প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসার নিয়মটি ছিল বেশ কড়া। মেযন ছিল সেখানকার লেখাপড়ার উন্নত পদ্ধতি, তেমনি ছিল অন্যান্য বিষয়েও অনেক নিয়ম-কানুন।
মাদ্রাসার প্রাঙ্গণটি ছিল সেই সময় শরীরচর্চার একটি নামকরা আখড়া।
এই আখড়ায় যুবকদেরকে শিক্ষা দেয়া হতো ডন-কুস্তী, হাডুডু, লাঠি খেলা, ঢাল শড়কী খেলা, তরবারি ভাঁজা, তীর গুলতী, বাঁশের বন্দুক চালনা প্রভৃতি।
ছেলেদের এসব শেখাবার জন্যে নিযুক্ত করা হলো একজন অভিজ্ঞ প্রশিক্ষক।তাঁর নাম মুহাম্মদ হানি। তাঁর বাড়ি ছিল চাঁদপুর গ্রামের পাশের গ্রাম- হায়দারপুর।
শরীরচর্চা সহ নানান বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যাপারে হানিফের নামডাক ছিল দুচার গ্রামব্যাপী। তাঁকে একনামে সবাই চিনতো।
মুহাম্মদ হানিফ নিজেও ছিলেন একজন যোগ্য খেলোয়ার। এই সকল বিষয়ে ছিলতার দারুণ দক্ষতা।
এই আখড়ায় একদিন ভর্তি হলেন এক যুবক। তিনি আর কেউ নন- নিসার আলী তিতুমীর।
অন্যান্য যুবকদের সাথে নিসার আলীও শরীর চর্চা শিক্ষায় অংশ নেন। অংশ নেন খেলাধুলাসহ অন্যান্য প্রশিক্ষণেও।
নিসার আলীদের শরীরচর্চা আখড়ায় আর একজন যোগ্য প্রশিক্ষক ছিলেন তাঁর নাম- হাফেজ নিয়ামতুল্লাহ।
তিনি ছিলেন ঐ মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক। ছিলেন কুরআন, হাদীস, আরবী এবং ফারসীর একজন নামকরা উস্তাদ।
আশ্চর্যের ব্যাপারই বটে!
হাফেজ নিয়ামতুল্লাহ কেবল একজন মাদ্রাসা শিক্ষকই ছিলেন না। তাঁর ছিল আরও অনেক গুণ। ছিল শিক্ষকতার বাইরেও অনেক যোগ্যতা।
এইসব যোগ্যতার মধ্রে অন্যতম ছিল বিভিন্ন খেলাধুলা এবং শরীরচর্চা।
লেখাপড়ার ফাঁকে কিংবা অবসরে হাফেজ নিয়ামতল্লাহ তাঁর ছাত্রদেরকে নানাবিধ খেলার কসরতও শিক্ষা দিতেন।
প্রতিদিন ভোরে এবং সন্ধ্যা-রাত্রিতে তিনি তাঁর ছাত্রদেরকে শরীর চর্চার পাশাপামি অস্ত্রচালনার নানা প্রকার কলাকৌশলও শেখাতেন।
হাফেজ নিয়ামতুল্লাহ তাঁর ছাত্রদেরকে কেন অস্ত্র চালনা শেখাতেন? কি কারণ ছিলতাঁর এই প্রশিক্ষণের পেছনে?
নিশ্চয় কারণ ছিল। মস্ত বড়ো এক কারণ।
সেই কারণটি হলো- বাংলার মানুষ তখন একদিকে স্থানীয় হিন্দু জমিদারদের দ্বারা আক্রান্ত ছিল। অপরদিকে ইংরেজদের শোষণ আর উৎপীড়নে তারা ছিল জর্জরিত।
হাফেজ নিয়ামতুল্লাহ ছিলেন খুব সচেতন পণ্ডিত। তিনি জানতেন, বাংলার মানুষকে যদি এই অত্যাচার আর শোষণ থেকে মুক্ত করতে হয়, তাহলে সশস্ত্র সংগ্রামের প্রয়োজন অনিবার্য। আর সেই সশস্ত্র সংগ্রমের পূর্ব প্রস্তুতি হিসাবে তিনি তাঁর ছাত্রদেরকে সেইভাবে যোগ্যকরে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।
হাফেজ নিয়ামতুল্লাহ এই প্রশিক্ষণ দান সম্পর্কে যেন কোনো রকম ভুল ধারণা না জন্মে, সেই জন্যে এখানে তখনকার পরিবেশ সম্পর্কে মাত্র এতোটুকুই উল্লেখ করা হলো।
ইংরেজদের অত্যাচারের কথা আরা আর একটু পরে বিস্তারিতভাবে জানবার চেষ্টা করবো।
এখন আবার ফিরে যাই সেই আখড়ার কথায়। ফিরে যাই শরীরচর্চাসহ সেইসব খেলার প্রশিক্ষণের কথায়।
মাদ্রাসার সেই শরীরচর্চা আখড়ায় নিসার আলী নিয়মিত প্রশিক্ষণ নিতেন।
ধীরে ধীরে তিনি আখড়ার একজন শ্রেষ্ঠ ছাত্রে পরিণত হলেন।
শুধু তাই নন। কালে কালে তিনিই হয়ে উঠলেণ আখড়ার ছাত্রদের মধ্যে দলনেতা বা সর্দার।
কলকাতার দিকে
বিয়েল দেড় বছর পর।
প্রিয় শিক্ষক হাফেজ নিয়ামতুল্লাহ একদিন নিসার আলীকে বললেণ, আমি কলকাতা যাবো। তুমিও আমার সাথে যেতে পারো।
নিসার আলী তাঁর শিক্ষ নিয়ামতুল্লাহর সাথে ছায়ার মতো চলতেন। হাফেজ সাহেবও তাঁর প্রিয় ছাত্রটিকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। দুজনের মধ্যে মিল ছিল দারুণ। ছিল সখ্যতা। ছিল শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসার এক অসামান্য পর্বত।
হাফেজ সাহেবের কলকাতা যাবার কথা শুনে মুহূর্তেই রাজি হয়ে গেলেন নিসার আলী। তাঁর হৃদয়ে তখন দেশ ভ্রমণের এক উত্তাল তরঙ্গ কেবলই দুলে দুলে উঠেছে। দুলে উঠেছে নতুন নতুন দেশ ভ্রমণ এবং নতুন নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের এক দুর্বার স্বপ্ন।
নিসার আলী তাঁর শিক্ষককে বললেন, জ্বী। আমি আপনার সাথে কলকাতা যেতে চাই। আমাকে সাথে করে নিলে আমি খুব খুশিহবো।
হাফেজ সাহেবও খুশি হলেন নিসার আলীর কথায়।
তাঁরা দুজন একদিন যাত্রা করলেন কলকাতার দিকে।
হাফেজ সাহেব নিসার আলীকে সাথে নিয়ে পৌঁছলেন কলকাতার তালিব টোলায়। জায়গাটির বর্তমান নাম তালতলা।
তালতলায় বাস করতেন একজন বিখ্যাত ব্যক্তি। তাঁর নাম মুহাম্মদ ইসরাঈল। তিনিও ছিলেন কুরআনে হাফেজ। তাঁর আদি নিবাস ছিল হাফেজ নিয়ামতুল্লাহর মতো- বিহার শরীফে।
সেই সূত্রেই তাঁর সাথে পরিচয় ছিল নিয়ামতুল্লাহ সাহেবের।
তালতলা পৌঁছে হাফেজ সাহেব তাঁর ছাত্রকে নিয়ে ওঠেন সেই পূর্ব পরিচিত বন্ধু হাফেজ মুহাম্মদ ইসরাঈলের বাসায়।
হাফেজ ইসরাঈল বিহার শরীফ থেকে তালতলায় আসেন বেশ আগে। তিনি তালতলা জামে মসজিদের পেশ ইমাম নিযুক্ত হন। এখানে বিয়ে করে তিনি ঘর সংসার করতে থাকেন। এভাবে হাফেজ ইসরাঈল কলকাতার অধিবাসী হয়ে যান।
তালিব টোলা বা তালতলার একটি অংশকে বলা হতো মিসরী গঞ্জ।
মিসরী গঞ্জে ছিল কুস্তি প্রতিযোগিতার একটি মস্ত বড় আখড়া। আখড়াটির নাম ডাক ছিল খুব।
এই আখড়ায় প্রায়ই কুস্তি প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হতো। চারপাশে থেকে ছুটে আসতো হাজারে হাজার মানুষ। তারা উপভোগ করতো সেই প্রতিযোগিতা। তালতলার এই নামকরা আখড়াটির সভাপতি ছিলেন একজন বিখ্যাত ব্যক্তি। নাম- জালাল উদ্দীন আফেন্দি।
নিসার আলী তালতলায় অবস্থান কালে যুক্ত হয়ে পড়েন এই আখড়ার সাথে যুক্ত হয়ে যান আখড়ার রোমাঞ্চকর কুস্তি প্রতিযোগিতায়।
কুস্তিগীর হিসাবে মুহূর্তেই চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো নিসার আলীর নাম।
কুস্তিগীড় নিসার আলী
নিসার আলী তাঁর নিজগ্রাম চাঁদপুরে থাকতেই কুস্তিখেলায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন।
কলকাতার তালতলায় আসার পর তিনি যোগ দেন কুস্তির আখড়ায়। যোগ দেন জালাল আফেন্দী পরিচালিত সেই বিখ্যাত কুস্তি প্রতিযোগিতার কেন্দ্রে।
অন্যান্যদের সাথে আখড়ায় নিয়মিত যেতেন নিসার আলী। নিয়মিত চর্চা করতেন কুস্তি খেলায়।
সে যুগে তখনো পেশাদার কুস্তি প্রতিযোগিতার প্রচলন হয়নি।
যারা ধনবান- তাঁরা শারীরিক শক্তি আর বীরত্ব অর্জনে প্রেরণা দেবার জন্যে বিজয়ী ব্যক্তিকে পুরষ্কার ও খেলাত দান করতেন। আর পরাজিত ব্যক্তিকে দিতেন শুধু পুরষ্কার।
তখনকার কুস্তি প্রতিযোগিতার এটাই ছিল অনেকটা নিয়মের মতো।
আর যারা কুস্তি লড়তেন- তারাও ধন সম্পদের আশায় লড়তেন না। লড়তেন সম্মান এবং মর্যাদার জন্যেই। খেলাটি তাঁদের পেশা ছিলনা। ছিল বীরত্বের নেশা। মনের আনন্দে তাঁরা এই বীরত্বপর্ণ খেলায় অংশ নিতেন। নিসার আলীও তাই করতেন।
নিয়মিত শরীর চর্চার ফলে নিসার আলীর দেহটাও হয়ে উঠেছিল মজবুত। শৈশবে যে ছেলেটি ছিলেন রোগাটে। যিনি ছিলেন খিটখিটে মেজাজের। বয়সকালে তিনিই হয়ে উঠলেন- একজন সেরা কুস্তিগীর।
চাঁদপুরে থাকতেই নিসার আলী স্থানীয় কুস্তির আখড়ায় বিভিন্ন সময়ের প্রতিযোগিতায় অংশ নিতেন। অংশ নিতেন এবং বিজয়ী হতেন। তাঁর গ্রাম বিজয়ী পাহলোয়ানকে প্রচুর পরিমাণে পুরষ্কার দেয়া হতো। তিনিও অনেক বার পেয়েছেন এসব পুরষ্কার।
নিসার আলী চাঁদপুরের একজন সেরা কুস্তিগীর হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
সেই বিখ্যাত কুস্তিগীর নিসার আলী তালতলায় এলৌ তাঁর পূর্বের নাম অক্ষুণ্ণ রাখলেন। বিজয়ী হলেন অনেক কুস্তি প্রতিযোগিতায়। এভাবে অল্প কিছু দিনের মধ্যে তালতলা সহ কলকাতায় ছড়িয়ে পড়লো সেরা কুস্তিগীর নিসার আলীর নাম।
ছড়িয়ে পড়লো চারদিকে সূর্যের কিরণের মতো নিসার আলীর শ্রেষ্ঠত্বের উজ্জ্বল রোদ্দুর।
কিন্তু এখানেই শেষ নয়।
সবাই তাঁর বিজয়ে বাহবা দিলেও যেন সম্পূর্ণ তৃপ্ত হতো না নিসার আলীর হৃদযেল গভীর সমুদ্র। সেই সমুদ্রে যেন লাফিয়ে উঠতো এক অজানা তুফান।
কিসের তুফান?
কি সেই অব্যক্ত স্বপ্ন?
কোন্ সেই নতুন আর এক জগতের দিকে কেবলই টানতো নিসার আলীর হৃদয়-মন?
আমরা এখন সেই রহস্যের ভেতরই প্রবেশ করবো।
আলোর খোঁজে উথাল-পাথাল
মিসরী গঞ্জের কুস্তি প্রতিযোগিতার তখন অনেক নামডাক। অনেক সেটার ভক্ত-অনুরাগী।
এই অনুরাগী আর উৎসাহীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন হাফেজ নিয়ামতুল্লাহ, হাফেজ মুহাম্মদ ইসরাঈল এবং মির্জা গোলাম আম্বিয়া।
মির্জা গোলাম আম্বিয়া ছিলেন শাহী খান্দানের একজন বিখ্যাত ব্যক্তি।
তিনি নিজে চিলেন একজন মস্ত বড়ো জমিদার।
কিন্তু এতো বড়ো জমিদার হওয়া সত্ত্বেও তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। তাঁর কোনো ছেলেমেয়ে ছিল না।
ছেলেমেয়ে না থাকার কারণে গোলাম আম্বিয়ার মনে যে আদৌ কোনো কষ্টের মেঘ জমতো না, তা নয়। জমতো বটে। কিন্তু মুহূর্তেই তিনি সেই কষ্টের মেঘকে দূরে ঠেলে দিতেন আর এক আনন্দের কোমল বাসাসে।
সেই কোমল বাতাসের নাম- দান-সাদকা এবং সৎ কাজে ব্যয়।
জমিদার হবার কারণে গোলাম আম্বিয়া ছিলেন অনেক ধন-সম্পদের মালিক। জমিদারী থেকে তাঁর আয় হতো প্রচুর অর্থ।
কিন্তু তিনি কৃপণ বা কঞ্জুস ছিলেন না। তিনি ছিলেন উদার মানুষ। বিশাল জমিদারী থেকে উপার্জিত সকল অর্থই তিনি ব্যয় করতেন সৎ কাজে।
ভালো কাজে ব্যয় করার আনন্দই আলাদা। এতে তৃপ্ত হয় হৃদয়। শীতল হয় মনের চাতাল। ভুলে থাকা যায় যাবতীয় দুঃখ-বেদনা।
গোলাম আম্বিয়া নিজেও ছিলেন একজন সৎ মানুষ। প্রজা বৎসল। সততা, মানবিকতা এবং উদারতা ছিল তাঁর উজ্জ্বল ভূষণ। দুহাতে ব্যয় করতেন তিনি সকল ভাল কাজে। অকাতরে। এতো বড়ো জমিদার হয়েও তাঁর মনে ছিলনা এতোটুকু অহংকার। ছিল না গর্বের এতোটুকু ধুলোকণা। এই কারণে সেই সময়ে মির্জা গোলাম আম্বিয়ার নামটি ছড়িয়ে পড়েছিল চারদিকে। ছড়িয়ে পড়েছিল তাঁর খ্যাতির সুবাতাস।
তখনো ভারত ভাগ হয়নি।
ভারত ভাগ হবার আগেও কলকাতা শহরের মির্জাপুর আমহার্স্ট স্ট্রীট অঞ্জলে ছিল গোলাম আম্বিয়ার বিশাল জমিদার বাড়িটি।
তাঁর বাড়ির নাম ছিল ‘মির্জা মঞ্জিল’।
মির্জা মঞ্জিলের দক্ষিণে ছিল মির্জা তালাব ও মির্জাবাগ।
এই মির্জাবাগও পরে ‘মির্জাপুর পার্ক’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।
জমিদার মির্জা গোলাম আম্বিয়ার যেখানে খান্দানী বৈঠকখানাটি ছিল, সেটারও পরে ‘বৈঠকখানা রোড’ নাম দেয়া হয়।
মির্জা গোলাম আম্বিয়া ছিলেন ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত পরহেজগার ব্যক্তি। জমিদার হয়েও তিনি ছিলেন সরল সহজ। অনাড়ম্বর ছিল তাঁর জীবন যাপন।
তিনি সাধারণ জীবন যাপন করতেন। সব সময় মশগুল থাকতেন আল্লাহর ইবাদাতে। মশগুল থাকতেন ইসলামের খেদমতে।
এই নির্লোভ এবং আল্লাহ-প্রেমিক অসামান্য পরহেজগার জমিদার ব্যক্তিটি সব সময় আল্লাহকে রাজি-খুশির জন্যেই তিনি বৃদ্ধ বয়সে তাঁর ‘মির্জাপুর’ ও ‘বৈঠকখানা রোডের’ মির্জা তালাব, মির্জাবাগ প্রভৃতি এলাকার বিশাল সম্পত্তি দান করে দেন কলকাতা মিউনিসিপালে।
তারপর তাঁর অন্যান্য বিষয় সম্পত্তি বিক্রি করে তিনি যাত্রা করেন মক্কার পথে।
এই অসাধারণ এক আল্লাহ প্রেমিকের নাম মির্জা গোলাম আম্বিয়া।
পরহেজগার এবং আল্লাহ-প্রেমিক হলেও তিনি ছিলেন মিসরীগঞ্জ কুস্তি প্রতিযোগিতা আখড়ার একজনউৎসাহী ও অনুরাগী ব্যক্তি।
নিসার আলী ছিলেন এই আখড়ার একজন নামকরা কুস্তিগীর।
কুস্তির আখড়াতেই মির্জা গোলাম আম্বিয়ার দৃষ্টি সীমায় পড়ে যান নিসার আলী।
গোলাম আম্বিয়া ক্রমশ কাছে টেনে নেন নিসার আলীকে। তাঁর উন্নত চরিত্র, বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব এবং মধুর আচরণে মুগ্ধ হয়ে যান মির্জা গোলাম আম্বিয়া। অতি অল্প সময়ের মধ্যে তিনি একান্ত আপন করে নেন নিসার আলীকে।
নিসার আলীও গোলাম আম্বিয়ার আচার-ব্যবহারে অভিভূত হয়ে যান। অবাক হয়ে যান তাঁর ব্যক্তিত্ব এবং দীনদারী ও পরহেজগারীতে। পরিচিত হবার পর থেকেই প্রায়ই নিসার আলী ছুটে যেতেন গোলাম আম্বিয়ার কাছে। ছুটে যেতেন তাঁর সান্নিধ্যে।
মূলত মির্জা গোলাম আম্বিয়ার সান্নিধ্যে এসে সম্পূর্ণ বদলে যায় নিসার আলীর ভেতরের সত্তা। বদলে যায় তাঁর আমূল হৃদয়। জেগে ওঠে তাঁর ভেতর ঈমানের আর এক মহান সাগর।
এই সময়ে নিসার আলীর ভেতরের মানুষটি ক্রমাগত ছুটতে থাকে। ছুটতে থাকে দ্রুত গতিতে আলোর খোঁজে।
তাঁর ইচ্ছা জাগে- একজন কামেল মুর্শিদের হাতে বাইয়াত হবার। কথাটি একদিন তিনি জানালেণ মির্জা গোলাম আম্বিয়াকে।
গোলাম আম্বিয়া একজন সেরা কুস্তিগীরের এই কথায় একটুও বিস্মিত বা হতবাক হলেন না। বরং তিনি নিসার আলীর আমূল পরিবর্তনের জন্যে প্রাণ খুলে দোয়া করলেন। দোয়া করলেন খুশি মনে তাঁর সুপ্রিয় কুস্তিগীর নিসার আলীর জন্যে।
ঠিক এই সময়।
এই সময়ে কলকাতা তালিব টোলায় এলেন বিখ্যাত দরবেশ- জাকী শাহ।
একদিন নিসার আলী হৃদযের অদম্য টানে ছুটে গেলেন দরবেশ জাকী শাহর দরবারে। দরবেশকে জানালেন তিনি তাঁর একান্ত বাসনার কথা। জানালেন মুরীদ হিসাবে দরবেশের হাতে বাইয়াত হবার কথা।
নিসার আলীর মুখের দিকে অপলকে তাকিয়ে থাকলেন দরবেশ জাকী শাহ। এভাবে অনেক্ষণ।
মন দিয়ে শুনলেণ এক সুঠামদেহী কুস্তিগীর হৃদযের আকুতি। শুনলেন তাঁর ভেতরের উজ্জ্বল সত্তাকে। দেখছেন নিসার আলীর ভবিষ্যত সম্ভাবনাকে।
দেখছেন আর ভাবছেন দরবেশ।
ভাবছেন- এই যুবক কোনো সাধারণ যুবক নয়। এর ভেতর আছে এক সুপ্ত আগ্নেয়গিরি। আছে সম্ভাবনার এক বারুদ-স্ফুলিঙ্গ।
ধীরে ধীরে চোখ খুললেন দরবেশ জাকী শাহ। মনোযোগী হলেন নিসার আলীর প্রতি। খুব শান্তভবে বললেন দরবেশ: পীরের সন্ধান চাও? ভালো কথা। কিন্তু বায়তুল্লাহ শরীফ যিয়ারত না করলে তুমি তোমার নিযুক্ত পীরের সন্ধান পাবে না কখনো।
দরবেশ জাকী শাহর কথায় ঝড় বয়ে গেল নিসার আলীর ভেতরে। তিনি অস্থির হয়ে উঠলেন। অস্থির হয়ে উঠলেন প্রকৃত পীরের সন্ধান লাভের জন্যে।
মক্কার পথে
দরবেশ জাকী শাহর কথা খুব মন দিয়ে শুনলেন নিসার আলী।
তাঁর হৃদয়ে তখন উত্তাল তরঙ্গ। তিনি কেবলই ছুটছেন আলোর খোঁজে। কিন্তু কোথায় সেই আলো? কোথায় সেই মুর্শিদ? যিনি দেখাতে পারেন তাঁর গন্তব্যের মঞ্জিল?
নিসার আলী মুর্শিদের খোঁজে ঘুরে বেড়ান সমগ্র কলকাতা। ঘুরে বেড়ান ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল।
কিন্তু কোথাও পেলেন না তাঁর যোগ্য রাহবার। যোগ্য মুর্শিদ।
অবশেষে জাকী শাহর পরামর্শ গ্রহণ করলেন নিসার আলী।
স্থির করলেন- তিনি হজ্জ পালনের জন্যে মক্কায় যাবেন।
কিন্তু কিভাবে যাবেন?
ভাবছেন নিসার আলী।
সেই ভাবনার দ্রুত অবসান ঘটলো।
একদিন তিনি রওয়ানা দিলেন মক্কার উদ্দেশ্যে।সময়টা ছিল আঠারো শো তেইশ সাল।
নিসার আলীর বয়স তখন একচল্লিশ বছর।
মক্কায় পৌঁছার পর নিসার আলীর সাক্ষাৎ হয় আর এক সংগ্রামী পুরুষের সাথে।
তাঁর নাম- সাইয়েদ আহমদ বেরেলভী।
বেরেলভী চিলেন একজন বিখ্যাত ব্যক্তি। তাঁর পরিচিতি ছিল অনেক-অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত। দেশের বাইরে। বিদেশের মাটিতেও।
এই ব্যিাত ব্যক্তির সান্নিধ্যে আার পর নিসার আলীর জীবনের মোড় ঘুরে গেল মুহূর্তেই।
তিনি হয়ে গেলেন তখন অন্য এক মানুষ।
মক্কা জীবনে
মক্কায় সাইয়েদ আহমদ বেরেলভীর সাথে পরিচিত হবার পর প্রশান্ত হলেন নিসার আলী।
সাইয়েদ আহমদ কে ছিলেন?
সেই কথাটি আগে একটু জানা যাক। কেনোনো এই বীর পুরুষের সাথে যুক্ত হয়ে আছে নিসার আলীর জীবন-সংগ্রামের সুমহান ইতিহাস।
সাইয়েদ আহমদ জন্মগ্রহণ করেন সতেরো শো ছিয়াত্তর সালে। আরবী সাল হিাবেই ছয়ই সফর। বারো শো এক হিজরী। জন্মস্থানের নাম- এলাহাবাদের রায় বেরেলী।
উনিশ শতকের প্রথম দিকে সমগ্র ভারতে এক বিরাট সুসংগঠিত স্বাধীনতা আন্দোলন গড়ে ওঠে।
এটাকে জিহাদী আন্দোলনও বলা হয়।
আন্দোলনটি পরিচালিত হয়েছিল একমাত্র ভরতীয় জানবাজ সাহসী মুসলমানদের দ্বারাই।
এই জিহাদী আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ছিলেন সাইয়েদ আহমদ বেরেলভী।
নিসার আলী ছিলেন যেমনি মেধাসম্পন্ন তেমনি বুদ্ধিমান। তিনি সাইয়েদ আহমদের সাথে পরিচিত হবার পর থেকেই এই নির্ভীক সত্যের সৈনিককে চিনে ফেলেন।
সাইয়েদ আহমদের তাকওয়া এবং পরহেজগারও নিসার আলীকে মুগ্ধ করলো। মুগ্ধ করলো তাঁর অসামা্য ব্যক্তিত্ব। ক্রমশ তিনি পরিচিত হলেন সাইয়েদ আহমদের জেহাদী আন্দোলন সম্পর্কে।
এবং তারপর যাচাই বাছাই করে তিনি তাঁর যোগ্য মুর্শিদ হিসাবে সাইয়েদ আহমদের হাতে বাইয়াত করলেন।
সাইয়েদ আহমদ ছিলেন নিসার আলীর চেয়ে মাত্র ছয়বছরের বড়ো। তবুও তিনি তা৭র হাতেই বাইয়াত করলেন। সাইয়েদ আহমদের কাছে নিসার আলী বাইয়াত করার মাধ্যমে তিনি প্রমান করলেন যে, বয়সটাই আসল নয়। প্রকৃত ব্যাপার হলো- যোগ্যতা। যার যোগ্যতা আছে, তাঁকে শ্রদ্ধা করতে হবে। নিসার আলীকে দেখার পর থকে সাইয়েদ আহমদও তৃপ্তি বোধ করলেন। তিনি গভীরভাবে দেখলেন নিসার আলীকৈ। তাঁর নতুন শিষ্যকে। দেখার পর তাঁর বুঝতে আর বাকী থাকলো না যে, এই শিষ্য খুব সাধারণ মানুষ নয়। এঁর ভেতর আছে সুপ্ত বারুদ। বুকে আছে পর্বতসমান আল্লাহর প্রেম। আর আছে এক সাদর দুর্বার সাহস।
ভাবলেন সাইয়েদ আহমদ। ভাবলেন, এঁকে জাগাতে পারলে হয়তোবা জেগে উঠবে একটি ঘুমন্ত জাতি। লাফিয়ে উঠবে অলসতার ভাঁজ ভেঙ্গে উত্তাল তরঙ্গ। জ্বলে উঠবে সংগ্রামের দীপ্ত আগুন।
ইংরেজদের শোষণ ও নির্যাতন থেকে দেশ এবং জাতিকে মুক্ত করার জন্যে তখনো সংগ্রাম করে যাচ্ছেন সাইয়েদ আহমদ বেরেলভী।
তিনি সংগ্রাম করে যাচ্ছেন মুসলমানের স্বাধীনতা, ঈমান এবং তাদের অধিকার পুনরুদ্ধারের জন্যে।
সাইয়েদ আহমদ তাঁর প্রিয় শিষ্যের চোখে-মুখে বিশ্বাসের ফুলকী জ্বলে উঠতে দেখলেন। দেখলেন- নিসার আলীর বুকের বেতর গর্জনমুখর সমুদ্রকে।
তিনি আহ্বান জানালেন তাঁকে জিহাদী ও স্বাধীনতা আন্দোলনের দিকে।
নিসার আলী খুবই খুশি হলেন তাঁর মুর্শিদের প্রস্তাবে। তাঁর আহ্বানে তিনি সাড়া দিলেন।
এখান থেকে, সেই মক্কায় অবস্থান কালে সাইয়েদ আহমদ বেরেলভীর জিহাদী আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়ে পড়লেন নিসার আলী।