ভ্রমণ
নিসার আলী ছিলেন অত্যন্ত ভ্রমণ বিলাসী। দেশ ভ্রমণে তাঁর আনন্দ ছিল প্রচুর।
আনন্দ ছিল বিচিত্র দেশ ঘুরে ফিরে দেখায়।
আনন্দ ছিল সেসব দেশ থেকে বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ে।
কলকাতায় থাকতেও নিসার আলী তাঁর প্রিয় শিক্ষক হাফেজ নিয়ামতুল্লাহর সাথে বিহার শরীফসহ বিভিন্ন দেশ এবং জায়গা ভ্রণ করেছিলেণ।
মক্কায় এসেও পেলেন আর এক উস্তাদ সাইয়েদ আহমদ বেরেলভীকে।
সাইয়েদ আহমদের নিত্যসঙ্গী ছিলেন নিসার আলী।
তাঁর সাহচর্যে থেকেই তিন বিভিন্ন দেশ ও গুরুত্বপূর্ণ স্থান ভ্রমণ করেন। এসবের মধ্যে ছিল মক্কা, মদীনা, কূফা, কারবালা, দামেশক, ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তান প্রবৃতি দেশ, পবিত্র স্থান এবং পবিত্র শহর।
তাঁর এই ভ্রমণের ফলে তিনি বিভিন্ন দেশ থেকে বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন।
পরিচিত হন অনেক বুজুর্গানে দীনের সাথে।
তাঁদের কাছ থেকে অর্জন করেন ইসলামের বাস্তব শিক্ষা।
তিনি ভ্রমণ কালে যিয়ারত করেন শহীদানদের কবর। সেখান থেকেও সঞ্চয় করেন সাহসের দৃ্ত চেতন। জিহাদের অনুপ্রেরণা।
হজ্জ শেষে, ভ্রমণ শেষে, একদিন দেশে ফেরার ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন সাইয়েদ নিসার আলী।
কথাটি জানালেন তাঁর প্রাণপ্রিয় মুর্শিদ সাইয়ে আহমদ বেরেলভীকে।
নিসার আলীর ইচ্ছার কথা জেনে সাইয়েদ আহমদ খুশি হলেন। হেসে বললেণ- হ্যাঁ। এবার আমাদের ফেরার পালা।
স্বদেশের পথে
নিসার আলীর শিক্ষা, যোগ্যতা এবং তাঁর আদর্শও আচরণে অত্যন্ত মুগ্ধ হলেন সাইয়েদ আহমদ বেরেলভী। তিনি বুঝলে, নিসারআলী তাঁর সামান্য কোনো মুরীদ নন। তিনি নিশ্চিন্তে নির্ভর করতে পারেন নিসার আলীর ওপর।
তাঁর এই বিশ্বাস থেকেই তিনি নিসার আলীর ওপর এক বিরাট গুরু দায়িত্ব তুলে দিলেন।
সেই দায়িত্বের নাম- সংস্কার এবং জিহাদী আন্দোলনের নেতৃত্ব।
সাইয়েদ আহমদ নিসার আলীকে দায়িত্ব দেন বাংলাদেশের ধর্মীয় এবং সমাজ সংস্কারের।
দায়িত্ব দেন বাংলার শোষিত এবং লাঞ্ছিত জনগণকে জাগাবার।
সাইয়েদ আহমদের এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল- দেশকে ইংরেজ মুক্ত করা এবং যাবতীয় কুসংস্কার থেকে ইসলামকে হেফাজত করা।
সাইয়েদ আহমদ তাঁর সঙ্গী-সাথীদেরকে সর্বদা উদ্বুদ্ধ করতেন এই আন্দোলনের ধারায়।
মক্কা থেকে ফেরার সময় সাইয়েদ আহমদ বেরোলভী তাঁর খলীফা মাওলানা শাহ মুহাম্মদ ইসমাইল ও মাওলানা ইসহাককে একটি নির্দেশ দেন। সাইয়েদ আহমদের সেই নির্দেশটি ছিল:
“তোমরা আপন আপন বাড়ি পৌঁছে দিন পনেরো বিশ্রাম নেবে। তারপর তোমরা বেরেলী পৌঁছলে তোমাদের নিয়ে ভারতের বিভিন্ন স্থান সফল করবো। পাটনায় কয়েকদিন বিশ্রামের পর কলকাতা যাবো।”
আর বাংলাদেশের খলীফাদের প্রতি তাঁর নির্দেশ ছিল:
“আমি পাটনায় পৌঁছে মাওলানা আবদুল বারী খাঁ (মাওলানা আকরাম খাঁর পিতা), মাওলানা মুহাম্মদ হোসেন, মাওলানা হাজী শরীয়তুল্লাহ, মাওলানা সাইয়েদ নিসার আলী, মাওলানা সুফী খোদাদাদ সিদ্দিকী ও মাওলান কারামত আলীকে খবর দেব। আমার কলকাতা পৌঁছার দিন-তারিখ তোমরা তাদের কাছে জানতে পারবে। কলকাতায় আমাদের যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে তাতে আমাদের চূড়ান্ত কর্মসূচী গৃহীত হবে।”
সাইয়েদ আহমদের এই বিদায়ী ভাষণের পর তাঁরা সকলেই মক্কা থেকে স্বদেশের দিকে রওয়ানা দিলেন।
সাইয়েদ আহম ফিরে গেলেন পাঞ্জাবে।
আর নিসার আলী ফিরে এলেন বাংলা। কলকাতার তালতলায়। তাঁর পূর্বের অবস্থানে।
সময়টা ছিল আঠারো শো সাতাশ সাল।
মক্কায় ছিলেন তিনি দীর্ঘ চার বছর।
দেশেফিরে চমকে উঠলে নিসার আলী। চমকে উঠলেন দেশের করুণ অবস্থা দেখে। শিউরে উঠলৈণ মানুষের সীমাহীন দুঃখ-দুর্দশা আর শোষণ নিপীড়নের করুণ চিত্র দেখে। অন্যদিকে আঁতকে উঠলেন নিসার আলী-
ইংরেজ ও অত্যাচারী হিন্দু জমিদারদের পশুসুলভ আচরণে।
কেমন ছিল তখনকার বাংলার অবস্থা?
নিসার আলীর সংগ্রাম সম্পর্কে জানবার আগে বাংলার সেই করুণ চিত্রের দিকে একবার তাকানো যাক।
একটু আগের কথা
নিসার আলী এমন এক দুঃসময়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, বাংলার মুসলমানরা যাখন ছিল একেবারে দিশেহারা।
ইংরেজদের ষড়যন্ত্রের জালে আর তাদের কূটকৌশলের নামপাশ তখন কম্পমান ছিল মুসলমানরা। শুধু মুসলমানই বা বলি কেন।তাদের হাত থেকে রক্ষা পেতেনা নিম্নমানের হিন্দুরাও।
ইংরেজদের দোসর ও হাতের লাঠি ছিল এদেশের উচ্চ বর্ণের হিন্দু এবং জমিদাররা।
ষড়যন্ত্র এবং কূটকৌশলের মাধ্যমে ইস্ট ইন্টিয়া কোম্পানী বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা ক্ষমতা দখল করে নিয়েছিল।
সাত সমুদ্র তের নদীর ওপার থেকে উড়ে আসা এই শ্বেত ভল্লুকেরা জুড়ে বসলো সবুজ-শ্যামল বাংলায়। এখানে তারা প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলো তাদের অসহনীয় দুঃশাসন।
কিন্তু বাংলার জনগণ তাদের এই শাসন ও শোষণ কখনই মেন নিতে পারেনি।
ইংরেজরা ছিল খুবই চতুর এবং ধূর্ত। তারাও খুব ভালভাবে জানতো একথা। আর জানতো বলেই তারা প্রাথমিক দিকে সরাসরি ক্ষমতা প্রয়োগ না করে বেছে নিল মীর জাফরের মতো কিছু বিশ্বাসঘাতককে। তাদের মাধ্যমে ইংরেজরা ধাপে ধাপে এগিয়ে গেল।
লোভী মীরজাফরদের কারণে ইংরেজরা সহজেই বাংলার বুকে চেপে বসতে সাহসী হলো। ক্রমে তাদের শাসন আর শোষণে নিষ্পেষিত হলো সাধারণ জনগণ। তাদের অত্যাচার আর উৎপীড়নে, তাদের হত্যা আর লুণ্ঠনে বাংলার মানুষ ছিল দিশাহারা। মুহূর্তে তারা সম্পদ হরিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেল। হয়ে গেল অসহায় বস্তুহারা।
বাংলার ধনসম্পদ লুট করার মূল চাবিকাঠি নিজেদেরে হাতে রেখে দিত ইংরেজ কোম্পানী। তাদের কারণে ক্রমান্বয়ে বাংলঅর জনগণ হয়ে পড়লো পথের ভিখারী।
কিন্তু তাদের চাতুর্যে মানুষের অবর্ণনীয় দুঃখ দুর্দার কারণ হিসাবে মীর জাফরের মতো এদেশের কতিপয় লোভী ও বিশ্বাসঘাতকের মাথায় অপবাদটা একচেটিয়াভাবে চেপে বসেলা।
আশ্চর্যের ব্যাপারই বটে!
ক্লাইভ এইসব অককর্মের মূল নায়ক হয়েও তার চাতুর্যের কারণে সে গেল ভালো মানুষের কাতারে।
ছদ্মবেশী এই দূর্ত ইংরেজের কারণে সেদিন নেমে এসেছিল বাংলার আকাশে দুর্যোগের ঘনঘটা।
দেশ বিজয়ের সাথে লর্ড ক্লাইভ ও তার দোসররা বাংলার ওপর কায়েম করলো লুন্ঠন ও অত্যাচারের এক ভয়াবহ বিভীষিকা।
সতেরো শো সাতান্ন সালে পলাশী যুদ্ধের পর মীর জাফরের কাছ থেকে উৎকোচ হিসাবে ক্লাইভ গ্রহণ করেছিল দু লক্ষ্য চৌত্রিশ হাজার পাউন্ড।
বাংলার এই বিপুল অর্থ লুটে নিয়ে ক্লাইভ রাতারাতি হয়ে গেল শ্রেষ্ঠ ধনী।
এখানেই শেষ নয়।
নবাবী লাভের ইনাম হিসেবে কোম্পানীর কর্মচারীরা মীর জাফরের কাছ থেকে আদায় করলো ত্রিশ লক্ষ পাউন্ড। সেই সাথে চব্বিশ পরগনা জিলার জমিদারীও।
সতেরো শো ছেষট্টি সালে বৃটিশ পার্লামেন্ট কর্তৃক নিযুক্ত অনুসন্ধান কমিটি ইংরেজ কর্মচারীদের উৎকোচ গ্রহণের একটি তালিকা তৈরি করে। সেই তালিকায় দেখা যায়, সতেরো সাতান্ন সাল থেকে সতেরো শো ছেষট্টি সাল পর্যন্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কর্মচারীরা বাংলা ও বিহার থেকে মোট নয় কোটি টাকা উৎকোট গ্রহণ করেছিল।
শোষণের করুণ চিত্র
বাংলা ও বিহারকে ইংরেজরা শোষণ করে ফেলেছিল। তাদের লোমহর্ষক শোষণে বাংলার মানুষ হয়ে উঠেছিল অতিষ্ঠ।
স্বয়ং লর্ড মেকলও ইংরেজ শোষণ উৎপীড়নে শিউরে উঠেছিলেন। তিনিও একসময় মুখ খুলেতে বাধ্য হলেন। তাঁর হৃদয়টা ব্যথায় ভরে উঠলো। বাংলার সেই বীভৎস করুণ চিত্র সম্পর্কে লর্ড মেকল বলেন:
“ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর স্বার্থে নয়, নিজেদেরে জন্যেই কোম্পানীর কর্মচারীরা এদেশের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য ক্ষেত্রে নিজেদের একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। দেশীয় লোকদের তারা দেশীয় উৎপন্ন দ্রব্য অল্প দামে বিক্রি এবং বৃটিশ পণ্যদ্রব্য বেশি দামে ক্রয় করতে বাধ্য করতো। কোম্পানীর আশ্রয়ে প্রতিপালিত দেশীয় কর্মচারীরা সমগ্র দেশে সৃষ্টি করেছিল শোষণ ও অত্যাচারের বিভিষিকা। কোম্পানীর প্রতিটি কর্মচারী ছিল তার প্রভুর (লর্ড ক্লাইভ) শক্তিতে শক্তিমান। আর এইসব প্রভুর শক্তির উৎস ছিল স্বয়ং ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানী। কলকাতায় ধন-সম্পদের পাহাড় তৈরি হলো। অপর দিকে তিন কোটি মানুষ দুঃখ দুর্দশার শেষ স্তরে উপনীত হলো। সত্য কথা যে, বাংলার মানুষ শোষণ-উৎপীড়ন সহ্য করতে অভ্যস্ত; কিন্তু এমন ভয়াবহ শোষণ-উৎপীড়ন তারা কোনোকালে দেখেনি”।
লর্ড মেকলের এই বক্তব্য থেকে পরিষ্কার হয়ে ওঠে, তখনকার বাংলার করুণ চিত্রটি ছিল কত ভয়াবহ।
বাস্তুহারা কৃষক
ইংরেজদের সর্বগ্রাসী শোষণ-উৎপীড়নে বাংলার কৃষকরা সর্বাস্বান্ত হয়ে গেল। এই অত্যাচারীদের সাথে যোগ দিয়েছিল হিন্দু জমিদাররা। অনিবার্য ধ্বংসের মুখে এসে দাঁড়ালো মুসলিম পরিবার। বংলার হতবাগ্য দরিদ্র কৃষক মানেই মুসলমান। আর জমিদার এবং বিত্তবান মানেই হিন্দু। এটা ছিল তখনকার দিনে অতি পরিচিত একটি সত্য।
ইংরেজ শাসনের আগে শাসকগণ রাজস্ব আদায় করতো। তারা রাজস্ব আদায় করতো গ্রাম-সমাজের কাছ থেকে। কোনো ব্যক্তি বিশেষের কাছ থেকে নয়। কৃষক রাজস্ব দিতো তার উৎপাদিত ফসল দিয়ে।
কিন্তু অত্যাচারী ইংরেজ বেনিয়া কোম্পানীর শাসকরা গ্রাম-সমাজের কাছ থেকে রাজস্ব আদায়ের নিয়মটা বাতিল করে দিল।
তারা কৃষকদের কাছ থেকে ব্যক্তিগতভাবে রাজস্ব আদায়ের প্রথা চালু করলো। আর তাদের রাজস্ব আদায়ের গ্রহণযোগ্য মাধ্য হয়ে গেল ফসলের পরিবর্তে মুদ্রা।
রাজস্ব আদায়েল জন্যে কৃষকরা এতো নগদ অর্থ সংগ্রহ করতে হিমশিম খেতো।
খাজনা বা রাজস্ব আদায়ের জন্যে চতুর ইংরেজরা নিয়োগ করলো বাংলার লোভী গোমস্তাদেরকে।
সর্বপ্রথমে তারা মোগল আমলের কিছু সংখ্যক জমিদার ও রাজস্ব আদায়কারী গোমস্তাদের জমির মালিক বলে ঘোষণা করলো।
যেখানে জমিদার বা গোমস্তা ছিল না, সেখানে জমির মালিক হিসেবে ঘোষিত হলো গ্রাম-সমাজের প্রধান বা সম্পদশালী ব্যক্তি।
পরবর্তীকালে এরাই জমিদার হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠে। তারা ছিল সবাই উচ্চবর্ণের হিন্দু।
এই জমিদারদের প্রধান কাজ ছিল- কৃষকদের শোষণ করা।
ইচ্ছা মতো যতো খুশি কৃষকদের কাছ থেকে তারা খাজনা আদায় করতো এবং তার একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ রাজস্ব হিসাবে ইংরেজ সরকারের হাতে তুলে দিতো।
শুধু তাই নয়।
ইংরেজদের প্রত্যক্ষ মদদে পুষ্ট এই সব জমিদাররা তাদের ইচ্ছা মতো জমি বিকি, নতুন ভাবে জমিবন্টন ও বন্ধক রাখার ক্ষমতাও হস্তগত করলো।
জমিদাররা জমির বিলি-ব্যবস্থার মারফত সৃষ্টি করলো তাদের সমর্থক গাঁতিদার, পত্তনিদার, দরপত্তনিদার, তালুকদার নাম উপস্বত্বভোগী।
শোষক ও উৎপীড়কদের ভূমিকায় বাংলার কৃষকদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো তারাও। চেপে বসলো কৃষকদের ঘাড়ের ওপর।
আর সবার ওপরে থাকলো মহা অত্যাচারী শোষক ইংরেজ বণিকরাজ।
ফসলের পরিবর্তে মুদ্রার মাধ্যমে রাজস্ব আদায়েল নিয়ম চালু হবার কারণে কৃষকদের মাথায় হাট উঠলো।
রাজস্ব আদায়ের জন্যে মুদ্রার প্রয়োজন। আর এই মুদ্রার জন্যে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফসলের সিংহভঅগ পানির দামে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হতো।
ইংজেররা ছিল খুবই হিসাবী। তারা জানতো কৃষকদের এমন অবস্হা হবে। তারা তাই ফসল কেনার জন্যে ইংরেজ বণিকরা বাংলা ও বিহারে কয়েকটি কেন্দ্র খুললো। সুযোগ বুঝে ইংরেজ বণিকরা কৃষকদের কাছ থেকে খুব কম দামে ফসল কিনতো। আর সেইসব কেনা ফসল নিয়ে তারা গুদামজাত করে রাখতো। পরে সময় সুযোগ বুঝ অধিক চড়াদামে তারা এগুলো বিক্রি করতো। সেইসব কৃষকের কাছেই। কারণ ততোদিনে তারা শোষণে-শোষণে হত দরিদ্র হয়ে পড়েছিল।
ইংরেজদের এই ফসল গুদামজাত করার ফলে বাংলার কৃষক হয়ে পড়ল সর্বস্বান্ত। তারা হয়ে গেল সম্পদহারা ও গৃহহারা। আর এভাবেই এক সময় দেখা দিল বাংলার মাটিতে এক মহা দুর্ভিক্ষ।
সেই দুর্ভিক্ষের করুণ কাহিনীর কথা আমরা একটু পরে জানবো। তার আগে জেনে নিই তখনতার তাঁতীদের অবস্থা।
তাঁতীদের অবস্থা
নিম্নবিত্ত মুসলমান জনসাধারণের মধ্রে তাঁতীরা ছিল সংখ্যার দিক থেকেও উল্লেখযোগ্য।
তাঁত শিল্প ছিল বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী একটি শিল্প। প্রত্যেক জিলায় তাঁত শিল্পের একটি নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ছিল। বাংলাদেশের তাঁত শিল্প এতোই সমৃদ্ধ ছিল যে এখানে প্রচুর তুলা উৎপন্ন হওয়া সত্ত্বেও সুরাট থেকে তুলা আমদানী করতে হতো।
দেশে তৈরি মোটা কাপড় দেশী মানুষেরা ব্যবহার করতো। আর ঢাকায় তৈরি সূক্ষ্ম মসলিন কাপড় রপ্তানী করা হতো ইউরোপের বিভিন্ন দেশে।
ঢাকার মসলিন ছিল পৃথিবীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ কাপড়। এই মসলিনের নাম ছিল বিশ্ব জোড়া।
তখনকার দিনে বাংলাদেশের তাঁতীদের ঘরে সুখ ছিল। সুখ ছিল তাদের হৃদয়েও।
কিন্তু তাঁতীদের এই সুখের সংসার বেশি দিন স্থায়ী হতে পারেনি। তাদের সুখের ঘরে আকস্মাৎ হানা দিল ইংরেজ দস্যুরা। ঈর্ষায় জ্বলে উঠলো তাদের বুক।
তাদের হিংস্র থাকা আছড়ে পড়লো তাঁতীদের ওপর।
ইংরেজ কোম্পানীদের ঈর্ষার কারণ হলো- মুসলমান কেন সুখে-শান্তিতে থাকবে? তারা সুখে থাকলো তো ইংরেজদের অনেক সমস্যা। সমস্যা হবে তাদেরকে গোলাম বানাতে। সমস্যা হবে তাদেরকে দাবিয়ে রাখতে।
সুতরাং ইংরেজ কোম্পানীর কর্মচারীরা এদেশের তাঁতীদেরকে উচ্ছেদ করার জন্যে উঠে পড়ে লেগে গেল।
নানাভাবে শুরু করলো তারা ষড়যন্ত্র।
দেশীয় তাঁতীদের এবং শিল্প কল-কারখানাকে অকেজো করার জন্যে তারা ইংল্যান্ড থেকে বিপুল পরিমাণ বস্ত্র আমাদানী করতে থাকলো।
বিভিন্নভাবে তারা বাংলা তাঁতীদের মেরুদন্ড বেঙ্গে দেবার কূটকৌশল বাস্তবায়ন করলো।
এ প্রসঙ্গে উইলিয়াম বোলেটের বলেন:
“কোম্পানীর আমলে প্রথম দিকে তাঁতীদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়েছিল। ইংরেজ ব্যবসায়ীরা তাদের আশ্রিত হিন্দু বেনিয়া এবং এ দেশীয় গোমস্তাগণ প্রত্যেক তাঁতীকে নির্দিষ্ট পরিমাণে কাপড় সরবরাহের জন্য বাধ্য করতো। কেউ অস্বীকার করলে তার কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যাওয়অ হতো এবং চবুক-পেটা করা হতো।
তাঁতীরা সব চাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়- যখন কোম্পানীর ডাইরেক্টরগণ নির্দেশ দেন যে, তাঁতীরা শুধু কাঁচামাল এবং রেশম সরবরাহ করবে। তারা নিজেদের হাতে কোনো কাপড় বুনতে পারবে না।
তারা রেশম উৎপাদনকারীদেরকে নিজেদের তাঁত বন্ধ করে কোম্পানীর কারখানায় কাঁপড় বুনতে বাধ্য করে। ফলে এদেশের কাপড় রপ্তানীর পরিমাণ কমে যায়।… কোম্পানীর চাপের মুখে মসলিন কাপড়ের বুনন একেবারে বন্ধ হয়ে যায় এবং বঙ্গদেশের বস্ত্রশিল্পের সমৃদ্ধি লোপ পায়।”
এভাবে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ইংরেজরা বাংলাদেশের তাঁতীদেরকে ভিক্ষুকে পরিণত করে দিল। তাদের সর্বগ্রাসী অত্যাচার আর শোষণে একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেল বাংলার তাঁতীরা।
কুঠিয়ালদের কুঠারাঘাত
নিসার আলীর সময়কালের আর এক ভয়ংকর বিভীষিকা ছিল কুঠিয়ালদের অত্যাচার।
বাংলাদেশের চাষীদের জন্যে তারা ছিল এক মহা আতংকের দাবানল। তারা ছিল মস্ত বড়ো এক অভিশাপ।
সমগ্র বাংলা ধ্বংস করার জন্যে ইংরেজদের ষড়যন্ত্রের আর একটি কৌশল ছিল নীলচাষ।
এদেশের কৃষকদেরকে তারা নীল চাষে বাধ্য করতো।
বাংলার মুসলিমপ্রধানজিলাগুলোতে কুঠিয়ালদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাধানে নীল চাষ করা হতো। ইংরেজ কুঠিয়ালরা ছিল যেমন অত্যাচারী তেমিন শোষক।
তাদের জুলুমের কোনো শেষ ছিলনা। তারা একদিকে নীল চাষের জন্যে মুসলিম কৃষকদের চাপ দিত অপরদিকে তারা সেই নীলের দাম দিতো খুবই কম। দেখা যেত নীল চাষ করতে কৃষকদের যে টাকা খরচ হতো, কুঠিয়ালদের সেই খরচের চেয়েও সাত/আট টাকা কম দামে তাদের কাছে বিক্রি করতো নীল চাষীদেরকে বাধ্য করতো।
অভাব আর অসহায়তার সুযোগ নিয়ে কুঠিয়ালরা মুসলিম গরীব চাষীদের স্বার্থ বিরোধী চুক্তিতে আবদ্ধ করতো। তাদের হালের বলদ এবং লাঙ্গল জোয়াল বন্ধক রেখে তারা নীল চাষের জন্যে টাকা লগ্নী করতো।
কেউ নীল চাষ করতে না চাইলে তাকে কয়েদখানায় বন্দী করা হতো। নির্মমভাবে বেত মেরে রক্তাক্ত করে দিত। কেউ নীল চাষের চুক্তিতে আবদ্ধ হতে না চাইলে তার ক্ষেতের রোয়া কিংবা পাকা ধান, আখ, রবিশস্য- সকল ফসল তারা উপড়ে ফেলতো। সম্পূর্ণ ভাবে তা নষ্ট করে দিত।
অনেক সময় হিন্দু জমিদাররা এইসব দুর্বল মুসলিম চাষীদেরকে জোর করে ধরে নিয়ে কুঠিয়ালদের হাতে তলে দিত। আর কুঠিয়ালরা চাবুকের আঘাতে জর্জরিত করে দিত বাংলার অসহায় কৃষককে।
কুঠিয়ালদের প্ররোচনায় হিন্দু জমিদাররা মুসুলিম চাষীদের সর্বস্ব লুট করার সুযোগ গ্রহণ করতো।
কুঠিয়ালতের এতো যে অত্যাচার আর জুলুম চলতো, কিন্তু বাংলার কৃষকদের অভিযোগ করার মতো কোনো জায়গা ছিল না। তাদরে বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কেন, টু-শব্দটিও করার কোনো উপায় ছিল না। এই কুঠিয়ালদের ভয়ে সব সময় সন্ত্রস্ত থাকতো বাংলার কৃষক। না জানি হিংস্র বাঘের মতো অতর্কিতে কখন ঝাঁপিটয়ে পড়ে তাদের জীর্ণ-শীর্ণ দেহের ওপর।
থানার দারোগা, ম্যাটিষ্ট্রেটরাও ছিল কুঠিয়ালদের আস্থাভাজন। প্রিয়পাত্র। তারাও কোনো পদক্ষেপ নিত না গরীবে অত্যাচারিত কৃষকদের পক্ষে।
ইংরেজ কুঠিয়ালরা ছিল আইনের উর্ধে। বিচারের নাগালের বাইরে।
আইন ও বিচারের উর্ধে তাকার কারণে কুঠিয়ালদের সাহস বেড়ে গিয়েছিল বহুগুণে। অত্যাচারের মাত্রাও বাড়িয়ে দিয়েছিল সেই পরিমাণ। কখনোবা পাড়া, মহল্লা এবং গোটা গ্রামকেই তারা আগুন লাগিয়ে পুড়েয়ে দিত। দাউ দাউ ্োগুনে জ্বলে পুড়ে ভস্মিভূত হয়ে যেত বিশাল জনপদ, ঘর-বাড়ি ফসলের ক্ষেত- সব কিছু।
এক অত্যাচারী কুঠিয়ালরা একটি গ্রামে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়।
আব্দুল গণি নামক এক দফাদার তাদের এই অত্যাচারের প্রতিবাদ করায় কুঠিয়ালরা তাকে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করেছিল।
শারীরিক নির্যাতন চালিয়েও ক্ষান্ত হয়নি নরপশু কুঠিয়াল বাহিনী। তারা আব্দুল গনিকে জোর করে ধরে নিয়ে চর মাস যাবত একটি অন্ধ কোঠায় আবদ্ধ করে রেখেছিল।
এভাবে কুঠিয়ালদের অত্যাচার আর শোষণে বাংলার কৃষকরা হয়ে গিয়েছিল অসহায় এবং নিঃস্ব। তাদের চাষের জমি হলো বেদখল। ফসল হলো বেহাত। আর জীবন হয়ে উঠলো বিপন্ন।
বাংলার চাষীদের ওপর কুঠিয়ালদের শোষণ আর অত্যাচারের লোম হর্ষক দৃশ্যে ব্যথিত হয়ে স্বয়ং এশলে ইডেনও শিউরে উঠেছিলেন। ব্যথিত হৃদয়ে তিনি বলতে বাধ্য হয়েছিলেন:
“ইংল্যান্ডে এমন কোনো নীলের বাক্স পোছায় না, যার মধ্যস্থিত নীলে বাংলাদেশের লোকের রক্ত মিশে থাকে না। আর এই রক্ত হলো মুসলিম চাষী সম্প্রদায়ের রক্ত।”
মহা দুর্ভিক্ষের কবলে
কৃষব, তাঁতী, নীল চাষীসহ বাংলার মানুষের অবস্থা যখন খুবই শোচনীয়, তখনই ইংরেজরা তৈরী করলো সুপরিকল্পিত এক মহা দুর্ভিক্ষের নীল-নকশা।
বাংলা এগারো শো ছিয়াত্তর সালের কথা।
ইংরেজ কোম্পানী সরকার ফসলের পরিবর্তে মুদ্রায় খাজনা আদায়ের নিয়ম চালু করলো। তাদের খাজনা দেবার জন্যে চাষীকে ফসল বিক্রি করতে হতো। চাষীদের ফসল মানেই তো খাদ্যশস্য।
একমাত্র মুখের গ্রাস- এই খাদ্যশস্য বিক্রি করে চাষীকে খাজনার টাকা সংগ্রহ করতে হতো।
চাষীদের এই জীবন-মরণ সমস্যার মধ্যেই ইংরেজ বণিকরা মুনাফা লোটার আর একটি হাতিয়ার পেয়ে গেল। সুযোগ বুঝে তারা বাংলা ও বিহারের বিভিন্ন স্থানে খুলে বসলো ধন-চালের একচেটিয়া ব্যবসা কেন্দ্র।
চাষীরা খাজনা আদায়েল জন্যে বাধ্য হয়ে ধান-চাল বিক্রি করতো, আর তা অল্প দামে কিনে গুদামজাত করে রাখতো ইংরেজ ব্যবসায়ীরা। পরে সময় ও সুযোগ বুঝে আবার অধিক চড়া দামে বিক্রি করতো চাষীদের কাছেই।
পেটের দায়ে চাষীরা যখন স্বাভাবিক উপায়ে খাদ্যদ্রব্য কিনতে অক্ষম হয়ে পড়লো, তখন তারা বাধ্য হলো মহাজনদের কাছে যেতে। মহাজনদের কাছে এইসব নিঃস্ব চাসীরা তাদের ঘটিবাটি, ব্যবহার্য অন্যান্য জিনিসপত্র বন্ধক রেখে তার বিনিময়ে যে সামান্য টাকা পেতো তা দিয়েই কিনতো চড়া দামের ধান-চাল,খাদ্য শস্য।
চাষীদের উৎপাদিত ফসল চাষীদেরই কিনতে হয় অধিক দামে! যে ফসল ফলাতে তারা সর্বস্বান্ত হয়ে পড়তো, সেই ফসলই আবার খাজনা আদায়ের জন্যে বিক্রি করে দিতে হতো পানির দামে! এর চেয়ে দুর্ভোগ্য আর কি হতে পারে?
কিন্তু কিছুতেই তাদের পেটের ভাতের সংস্থান হতো না।
মহাজনদের ঘরে তাদের ঘটিবাটি জমি জায়গা- একে একে সবই গেল। তাতেই শেষ রক্ষা হলো না।
চাষীদের ঘরে ঘরে জ্বলে উঠলো অভাবের তীব্র আগুন। তাদের হাহাকারে ভারী হয়ে উঠলো বাংলার আকাশ। কিন্তু তবুও ইংরেজ বণিকদের পাষণ্ড হৃদয় এতোটুকুও কেঁদে উঠলো না। ধান-চালের গুদামে তারা তালা ঝুলিয়ে পা দুলাতে থাকলো। আর দেখতে থাকলো বাংলার মানুষের বুকফাটা আহাজারী। ক্ষুধার্ত শিশুদের গগন বিদারী চিৎকার।
নেমে এলো এক মহা দুর্ভিক্ষ।
ভয়ঙ্কর এক মৃত্যুর ছোবল!
ক্ষুধার তীব্র দাহনিকায় ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো বাংলার কোটে কোটি মানুষ।
ইংরেজদের সৃষ্ট এই দুর্ভিক্ষটি ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ নামেই ইতিহাসখ্যাত।
কোম্পানীর সরকারের চাকুরি নীতিতে ছিল আর এক মারাত্মক ধোঁকা।
তাদের চাকুরীনীতি, শিক্ষানীতি ও বিভেদ নীতির ফলেই মুসিলম জনসাধারণ এক চরম দুর্দশা ও অভাবের মধ্যে কাল যাপন করেছিল।তার ওপর এই দুর্ভিক্ষ! গ্রামের শতকরা পঁচানব্বই ভাগ মানু কৃষিজীবি। তাদের অধিকাংশই হতভাগ্য মুসলমান।
দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে এই দরিদ্র মুসলমানদের সেদিন মরা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।
সেই দুর্ভিক্ষ এতাই ভয়াবহ ছিল যে, ইংরেজ লেখক মিঃ হান্টারও সেদিন শিউরে উঠেছিলেন। তিনি এই দুর্ভিক্ষের করুণ পরিণতি সম্পর্কে বলেন:
“১৭৭০ সালের সারা গৃষ্মকাল ব্যাপী লোক মারা গেছে। কৃষকেরা তাদের গরু-বাছুর, লাংগল জোয়াল বেচে ফেলেছৈ এবং বীজধান খেয়ে ফেলেছে। অবশেষে তারা ছেলে-মেয়ে বেচতে শুরু করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত একসময় আর ক্রেতাও পাওয়া গেলো না। তারপর তারা গাছের পাতা আর ঘাস খেতে শুরু কর{লো। ১৭৭০ সালের জুন মাসে কোম্পানীর রেসিডেন্ট স্বীকার করেন যে, জীবিত মানুষ মরা মানুষের গোশত খেতে শুরু করে। অনশনে শীর্ণ, রোগক্লিষ্ট কঙ্কালসার মানুষ দিনরাত সারি বেঁধে বড় বড় শঞরে জমা হতো। বছরের গোড়াতেই সংক্রমক রোগ শুরু হয়েছিল। মার্চ মাচে মুর্শিদাবাদে পানিবসন্ত দেখা দেয় এবং বহু লোক এ রোগে মারা যায়। মৃত ও মরণাপন্ন রোগী স্তূপাকার হয়ে পড়ে থাকায় রাস্তাঘাটে চলাচল অসম্ভব হয়ে পড়ে। লাশের সংখ্যা এতো বেশি ছিল যে, তা পুঁতে ফেলার কাজও দ্রুত সম্পন্ন করা সম্ভব ছিল না। প্রাচ্যের মেথর, শিয়াল ও শকুনের পক্ষেও এতো লাশ নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব ছিল না। ফলে দুর্গন্ধযুক্ত গলিত লাশ মানুষের অস্তিত্বকে বিপ্ন করে তুলেছিল।”
সেই সময়ের বিখ্যাত ইতিহাস- “সিয়অরে মুতাআখ্খারীন” এর রচয়িতা ইংরেজ দস্যু ও তার দেশীয় দালালদের শোষন-উৎপীড়ন এবং তাদেরই সৃষ্ট দুর্ভিক্ষে কোটি কোটি মানুষের দুঃখ দুর্দশা আর মৃত্যু যন্ত্রওণার দৃশ্যে উদ্বিগ্ন ও ব্যথিত হয়ে লিখেছেন:
“হে খোদা, তোমার দুর্দশাগ্রস্ত বান্দাদের সাহায্যের জন্যে একটি বার তুমি ধরা পৃষ্ঠে নেমে এসো। এই অসহনীয় উৎপীড়ন আর দুর্দশা থেকে তাদের রক্ষা করো।”
এই দুর্ভিক্ষে বাংলার কতো মানুষ মারা গিয়েছিল, তার সঠিক হিসাব পাওয়া যায় না। তবে কিছুটা অনুমান করা যায় হান্টারের উক্তিতে। তিনি বলেন:
“সরকারী হিসাবে ১৭৭০ সালের মে মাস শেষ হবার আগেই জনসংখ্যার তিন ভাগের এক ভাগ শেষ হয়ে গিয়েছিল। জুন মাসে প্রতি ষোল জনের ছয়জন মারা গিয়েছিল। শেষাবধি জমিতে আবাদ করার মতো পর্যাপ্ত লোকও আর অবশিষ্ট ছিল না।”
কিন্তু তার পারও ক্ষুদা মেটেনি ইংরেজ কোম্পানীর। তখনও চলছিল তাদের শোষণ পীড়ন। শকুনের মতো লাশের ওপর বসেও কোম্পানীর কর্মচারীরা নিজেদের হীনস্বার্থ সিদ্ধির জন্যে অবর্ণনীয় অত্যাচার চালিয়েছিল। অত্যাচার চালিয়েছিল তারা বাংলার নিরীহ মানুষ- মূলত গরীব, কৃষক শ্রেণীর মুসলমানের ওপর।
মুসলমানের এই কুরণ অবস্থা দেখে মিঃ হান্টার আফসোস রে বলেছিলেন:
“একশো সত্তার বছর আগে বাংলার কেনো সম্ভ্রান্ত মুসলমান পরিবারের দরিদ্র হয়া ছিল এক অসম্ভব ব্যাপার, আর বর্তমানে তাদের পক্ষে ধনী হওয়াই অসম্ভব ব্যাপার।”
বাংলার বুকে ইংরেজরা এই মহা দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি করেছিল বাংলা এগারো শো ছিয়াত্তর সালে।
নিসার আলীর জন্মের কিছুটা আগে হলেও, তিনি যখন ভূমিষ্ট হলেন তখনো সেই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের ছাপ অবশিষ্ট ছিল বাংলার বুকে।
তখনো মুছে যায়নি সেদিনর সেই ক্ষত চিহ্ন।
তখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেনি বাংলার মুসলমান।
তখনো এতোটুকু সোজা হয়নি তাদের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড। ফিরে আসেনি ভাগ্যের সেই সোনালী দিন।
শুধু ইংরেজদের চাপিয়ে দেয়া দুর্ভিক্ষেই নয়। ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক দিক দিয়েও মুসলমানরা ছিল চরম নির্যাতনের শিকাল ইংরেজদের হিংস্র থাবায় রক্তাক্ত হয়েছিল মুসলমানের বুক।
নিসার আলীর জন্মের সময়ে কেমন ছিল বাংলার ধর্মীয়, সাংস্কৃকিত এবং সামাজিক পরিবেশ?
ইংরেজদের ষড়যন্ত্র কতোদূর পৌঁছেছিল সেদিন?
নিসার আলী কেন বাধ্য হয়েছিলেন সংগ্রামের দাউ দাউ আগুন জ্বালিয়ে দিতে বাংলা ঘরে ঘরে?
তাঁর পরবর্তী সংগ্রামের ইতিহাস জানার আগে এসব বিষয়ে একটু আলোচনা করা যাক।
ধর্মীয় অবস্থা।
সময়টা ছিল খুব খারাপ। মুসলমানদের ধর্মীয় অবস্থা ছিল তার চেয়েও নাজুক।
সে ছিল এক ঘোরতর অন্ধকারের দিন।
হিন্দুরা ইংরেজদের ষড়যন্ত্রে মুসলমানদের কেবল রাজ্যহারা, ক্ষমতাহারাই করেনি- তারা তাদের জীবিকা অর্জনের সকল পন্থা বন্ধ করে দিয়েছিল। তাতেও খুশি হয়নি ইংরেজ এবং উচ্চবর্ণের হিন্দুরা।
শেষ পর্যন্ত তারা মুসলমানের একমাত্র সম্বল ঈমানটুকুও কেড়ে নিতে চেয়েছিল নানা কৌশল এবং প্রলোভনের মাধ্যমে।
তারা মুসলমানদেরকে প্রথমত নামে মুসলমান রেখে ইসলা, ও ঈমানে-আকীদা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে বাধ্য করতো। তাদেরকে দূরে রাখতো ইসলামী জীবন পদ্ধতি ও সংস্কৃতি থেকে। নিম্ন শ্রেণীর হিন্দুর চেয়েও তখনকার মুসলমান জীবন নিকৃষ্ট। তারা তাদের দাসানুদাস বানিয়ে রাখতে চাইতো।
হিন্দু জমিদাররা ছিল ইংরেজদের একান্ত প্রিয় পাত্র। ইংরেজদের তুষ্ট করার জন্যে তারা সব সময় ব্যস্ত থাকতো। তারা জানতো- মুসলমানকে দাবিয়ে রাখতে পারলেই কেবল সর্বগ্রাসী শাসন প্রতিষ্ঠা করা যাবে।
এই জমিদার শ্রেণীর হিন্দুরাই সেদিন ইংরেজদের প্রত্যক্ষ মদদে মুসলমানকে ইসলামের আলো থেকে অনেক-অনেক দূরে সরিয়ে রাখার নানান কূটকৌশল করেছিল। উচ্চ বর্ণের হিন্দুরা গরীব মুসলমানকে বুঝিয়ে বলতো:
“তোরা গরীব। কৃষি কাজ ও দিন মজুরী না করলে তোদের সংসার চলে না। এমন অব্থায় তোদের প্রাত্যহিক, সাপ্তাহিক ও বার্ষিক নামার বা রোজা, হজ্জ, যাকাত, জানাজা, প্রার্থনা, মৃতদেহ স্নান করানো প্রভৃতি ধর্ম কর্ম করবার সময় কোথায়? আর ঐসব ধর্ম কর্ম করে তোরা অর্থোপার্জন করার সময় পাবি কখন এবং সংসার যাত্রাই বা করবি কিভাবে? সুতরাং তোরাও হিন্দু ব্রাহ্মণদের মত একদল লোক ঠিক কর। তারা তোদরে হয়ে ঐসব ধর্মীয় কাজগুলেঅ করে দেবে। তোদেরও আর সময় নষ্ট হবে না।”
উচ্চবর্ণের হিন্দুরা মুসলমানদের দুরাবস্থার সুযোগ নিয়ে আরও বুঝাতো:
“তোমরা বাপু মুসলমান হলেও বাংলাদেশের মুসলমান। আরবদেশের মুসলমানের জন্যে যেমন আরবী নামের প্রয়েঅজন, বাংলঅদেশের মুসলমানের জন্যেও তেমনি বাংলা নামের প্রয়োজন। আবদুর রহমান, আবুল কাশে, রহীমা খাতুন, আয়েশা, ফাতেমা নামের পরিবর্তে বাংলা নামের প্রয়োজন।”
ঠাকুরদের চাপের মুখে অসহায় মুসলমানরা সেদিন তাদের সন্তানদের মুসলমানী নাম বাদ দিযে গোপাল, নেপাল, নবাই, গোবর্ধন, কুশাই, বাদল, পটল প্রভৃতি নাম রাখতে বাধ্য হতো। এছাড়াও তারা কৌশলে মুসলমানকে লুঙ্গি ছেড়ে ধূতি পড়তে বাধ্য করতো। বাধ্য করতো দাড়ি ছেড়ে গোঁফ রাখতে। তারপর তাদের দিয়ে পূজা পার্বনে খাটাতো বিনা পারিশ্রমিকে। তাদের পূজার জন্যে ছাগল, মুরগী, নগদ অর্থসহ বিভিন্ন জিনিস জোর করে আদায় করতো।
মোট কথা, কোনো ভাবেই তারা মুসলমানদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিষয়গুলোকে সহ্যই করতে পারতো না।