হযরত মওলানা শাহ মোহাম্মদ আবদুল করীম(রহ.)
সমগ্র দক্ষিণ বঙ্গের ইসলাম প্রচারের ইতিহাসে শাহ মোহাম্মদ আবদুল করীম(রহ) এক চির উজ্জ্বল নক্ষত্র। যখন দক্ষিণ বঙ্গের অলিতে গলিতে চলছিলো হিন্দু ও খৃস্টান মিশনারীদের অপদৌরাত্ম, যখন ইসলামের বিরুদ্ধে তারা অপপ্রচারের ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি করেছিলো তখনই এই মহান সূফী ইসলামের বাণী মানুষের কাছে পৌছে দেন।
মওলানা মুহাম্মদ আবদুল করীমের(রহ.) পূর্বপুরুষ ছিলেন-হযরত শাহসূফী সুলতান আহমদ। তিনি মুঘল সম্রাট আকবরের সময় যশোর অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করে প্রসিদ্ধ হয়ে আছেন। জানা যায়, সম্রাট আকবরের সেনাপতি রাজা মানসিংহের পদাতিক বাহিনীর প্রধান হিসেবে তিনি যশোর আগমন করেন এবং যশোর অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ও ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে যশোর থেকে যান। সে সময়ে যশোরের চাঁচড়ার রাজা ছিলেন শূকদেব সিংহ রায়।
রাজা শূক দেব সিংহ রায় রাজা মানসিংহকে এবং সম্রাট আকবরকে খুশী করার উদ্দেশ্যে শাহ সূফী সুলতান আহমদকে বসবাসের জন্য রাজবাড়ীর খিড়কীর দিকে বেশ কিছু লাখেরাজ সম্পত্তি প্রদান করেন। খিড়কী এলাকা পরে খড়কী এলাকায় পরিণত হয়। বর্তমানে খড়কী যশোর এলাকার একটি অংশ। যশোর সরকারী এম.এম. কলেজ এই খড়কীতে অবস্থিত।
মুগল আমল থেকে বর্তমান প্রজন্ম পর্যন্ত মওলানা শাহ আবদুল করীম সাহেবের বংশের লোকেরা যশোর অঞ্চলে ইসলামের সুমহান বাণী প্রচার করে আসছেন।
যশোর শহরতলীস্থ খড়কী গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পীর পরিবারে হযরত মওলানা মুহাম্মদ আবদুল করীম ১৮৫২ খৃস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা শাহ মুহাম্মদ সালীম উদ্দীন চিশতী একজন কামিল পীর ছিলেন।
শাহ আবদুল করীম বাল্যকালেই পিতৃহারা হন এবং দাদা শাহ কালিম উদ্দীন চিশতী(রহ)এর তত্ত্বাবধানে লালিত পালিত হন।
দাদা শাহ কালিম উদ্দীন চিশতী দীনি ইলমের প্রাথমিক সবক দিয়ে তাঁর হাতেখড়ি দেন। পরে স্থানীয় বিদ্যালয় হতে ছাত্র বৃত্তি পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। এই সময়ে তিনি দাদাকে হারান। দাদাকে হারিয়েও শাহ আবদুল করীম তাঁর শিক্ষা জীবনের ইতি টানেন নি। তিনি পরবর্তীতে কলকাতা আলিয়া মাদরাসা থেকে অত্যন্ত সম্মানজনকভাবে জামা’আতে উলা পাস করেন।
শিক্ষা জীবন শেষে এই মহান মণীষী যশোর জেলা স্কুলে হেড মৌলবী হিসেবে চাকরি গ্রহণ করেন।
শিক্ষকতা করা অবস্থায় তাঁর ভেতর ‘ইলমে তাসাওউফ’ সম্বন্ধে জানার কৌতুহল জাগে এবং সে সম্বন্ধে জানার জন্য তিনি বেরিয়ে পড়েন। তিনি ভারতের পূর্ব পাঞ্জাব প্রদেশের হুসিয়ারপুর জেলার খালিক(রহ.) এর নিকট মুরীদ হন। এখানে দীর্ঘ বার বছর তিনি তাসাওউফ চর্চায় নিজেকে নিমগ্ন রাখেন এবং ইলমে তাসাওউফের উচ্চ স্তরে উত্তীর্ণ হন। তাঁর পীর তাঁকে নকশ বন্দীয়া মুজাদ্দীদিয়া, কাদিরিয়া, চিশতিয়া এবং সুহরাওয়ার্দিয়া তরিকার খিলাফত প্রদান করে স্বদেশ ইসলাম প্রচারের নির্দেশ হন।
স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করার পর তিনি ইসলাম প্রচার শুরু করেন এবং সমাজে কুসংস্কার দূর করার প্রচেষ্টা চালান। এ সময় অনেক বিধর্মীই তাঁর সংস্পর্শে এসে ইসলাম গ্রহণ করেন।
ব্যক্তিগত জীবনে শাহ আবদুল করীম অত্যন্ত সাদাসিধেভাবে চলাফেরা করতেন। পিতার বিশাল সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়েও তিনি আড়ম্বরহীন, বিনয়ী ও নম্র জীবন যাপন করেছিলেন।
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এক সময় যশোর জেলা স্কুলে কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। তিনি এই সময় শাহ আবদুল করীমের একান্ত সান্নিধ্যে আসেন এবং তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। তাঁর লেখা আধ্যত্ম পুণ্যময় লকখী ছাড়া গল্পটি পীর আবদুল করীম সাহেবকে লক্ষ্য করে (রমনার পীর সাহেব) লেখা। গল্পের নায়ক রমজানকে ডক্টর শহীদুল্লাহ সাহেবের সমকালীন প্রতিনিধি বলা যেতে পারে।
শাহ মোহাম্মদ আবদুল করীম একজন উচ্চস্তরের সাহিত্যিকও ছিলেন। ইলমে তাসাওউফের ওপর তিনি এরশাদে খালেকিয়া বা খোদা প্রাপ্তিতত্ত্ব নামক প্রায় তিন’শ পৃষ্ঠা একখানি পান্ডিত্যপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেন। এ গ্রন্থ সম্পর্কে বলতে গিয়ে বিশিষ্ট গবেষক ও সাহিত্যিক জনাব মুহম্মদ আবূ তালিব লিখেছেন, “বইখানি সম্পর্কে সংক্ষেপে বলতে গেলে বলা যায়, এ যাবত বাংলা ভাষায় সূফী বা তাসাউফ তত্ত্বমূলক যত বই লেখা হয়েছে, তন্মধ্যে এ খানি শ্রেষ্ঠ। আবদুল করীম সাহেব ব্যক্তিগতভাবে একজন নিষ্ঠাবান সূফী, তাই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা জ্ঞানে এই রঙিন বইখানি সাধারণ পাঠকের জন্য এক অনাস্বাদিত জগতের সন্ধান এনে দিয়েছে।
সুবিস্তৃত দশটি অধ্যায়ে তিনি তাসাওউফের দার্শনিক তত্ত্ব, বিবিধ সূফী-খান্দানের ইতিকথা, শাজরানামা(পীর-পরম্পরা) ইত্যাদির সুন্দর পরিচয় দিয়েছেন। শেষ বা দশম অধ্যায়ে তিনি তাসাউফ তত্ত্বের মর্মকথা, অমুসলিম ধর্ম সম্প্রদায়ের ধর্মগ্রন্থাদি, যথা-বেদ উপনিষদ পুরানাদির সঙ্গে ইসলামী সূফীতত্ত্বের তুলনামূলক আলোচনা করে বিষয়টিকে আরো স্পষ্ট করে তুলেছেন।”
শাহ আবদুল করীম সাহেব গ্রন্থটি রচনা করেছেন তাঁর পীর হযরত খাজা আবু সা‘আদ মোহাম্মদ আবুদল খালেক সাহেব এর অনুপ্রেরণায়।
এ সম্বন্ধে শাহ আবদুল করীম সাহেব উক্ত গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন, “পীর সাহেব বলেছেন, তুমি নিজ ভাষায় স্পষ্টভাবে যেমত আমার শিক্ষা পাইয়াছ সেইরূপ একখন্ড কিতাব লিখ। যাহা বুঝিতে লোকের কষ্ট না হয় এবং সন্দেহ ভঞ্জন হয়। কারণ তাসাউফের বিদ্যা ক্রমশ লোপ পাইয়া যাইতেছে; কাহাকেও কোন কথা জিজ্ঞেস করিলে স্পষ্টভাবে তাহার উত্তর পাওয়া সুকঠিন হইয়াছে; সুতরাং লোকের মূল উদ্দেশ্য পরম সৃষ্টিকর্তা খোদাতালাকে চেনার পথ একেবারে সংকীর্ণ হইয়া যাইতেছে। অতএব তুমি সত্ত্বর কিতাব লিখিতে প্রবৃত্ত হও।”
পীরের নির্দেশ মোতাবিক লেখক তাঁর কিতাবখানি সর্বসাধারণ বোধ্য ভাষায় লিখেছেন। বলাবাহুল্য, ইসলামী চিন্তাধারার এক মৌলিক উৎসের সন্ধান দিয়েছে কিতাবখানি।
গ্রন্থটি সম্পর্কে প্রখ্যাত সাহিত্যিক জনাব শাহাদাত আলী আনসারী বলেন, ‘মওলানা মুহাম্মদ আবদুল করীম সাহেব নকশবন্দীয়া তরীকার একজন কামেল সূফী ছিলেন। সূফী তত্ত্ব সম্পর্কে তাঁর গভীর জ্ঞান ছিল। তাঁর গ্রন্থখানিতে প্রথম হতে চতূর্থ অধ্যায় পর্যন্ত তিনি তাসাওফের দার্শনিক তত্ত্বের ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন; পঞ্চম হতে নবম অধ্যায়ে সূফী সাধনায় কাদেরীয়া, নকশবন্দীয়া এবং চিশতীয়া তরিকার বিশ্লেষণ করেছেন এবং দশম হতে শেষ অধ্যায়ে বেদ, পুরান প্রভৃতিতে প্রচলিত বিষয়বস্তুর তত্ত্ব তিনি উদঘাটন করেছেন এবং সূফী মতবাদের সাথে তার তুলনামূলক সমালোচনা করেছেন। তাসাওফ সম্পর্কে বাংলাভাষায় লিখিত এইরূপ দ্বিতীয় কোন বই পাওয়া যায় না।”
শাহ আবদুল করীম(রহ.) এর জীবদ্দশায় গ্রন্থটির দু’টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় শাহ সাহেবের মৃত্যুর পর। প্রকাশক ছিলেন মুনশী শেখ জমির উদ্দীন। গ্রন্থের বিজ্ঞাপনে শাহ সাহেবের পুত্রদ্বয়(শাহ মুহাম্মদ আবু নাঈম এবং শাহ মুহাম্মদ আবুল খায়ের) লিখেছেন, “পিতৃবন্ধু প্রসিদ্ধ ইসলাম প্রচারক রেভারেন্ড মওলানা শাহ সূফী মোহাম্মদ জমিরুদ্দীন বিদ্যাবিনোদ সাহেবকে অত্র সংস্করণ দান করিলাম। টাইটেল পেজে কেবলমাত্র প্রকাশকের স্থানে তাঁহার নাম থাকিবে।”
গ্রন্থটির তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হওয়ার দীর্ঘ ৪০ বছর পর প্রখ্যাত সমাজসেবক ও সাহিত্যিক মরহুম মৌলভী ওয়াহেদ আলী আনসারী ১৩৫৬ সালে এর চতূর্থ সংস্করণ প্রকাশ করেন। এতে ভূমিকা লেখেন শাহ সাহেবের পুত্র জনাব শাহ মুহাম্মদ আবুল খায়ের। পরবর্তীতে ১৩৮১ সালে তাঁর পৌত্র শাহ মোহাম্মদ আবদুল মতিন বইটির পঞ্চম সংস্করণ বের করেন। এর ৬ষ্ঠ সংস্করণ বের হয়েছে ৩০ শে মার্চ ১৯৮৬। এ সংস্করণের প্রকাশক শাহ মোহাম্মদ আবুদল মতিন। তিনি বর্তমানে খড়কীর গদ্দীনশীন পীর।
এরশাদে খালেকিয়া বা খোদাপ্রাপ্তি তত্ত্ব নামক তাসাওউফের উপর এই গ্রন্থটি বাংলা ভাষায় সর্বপ্রথম প্রকাশিত বিস্তারিত ও তত্ত্ব এবং তথ্যবহুল গ্রন্থ। বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত নামক গ্রন্থে প্রফেসর সৈয়দ আলী আহসান এই গ্রন্থখানি সম্পর্কে বলেছেন “মোহাম্মদ আবুদল করীরেম খোদাপ্রাপ্তি তত্ত্ব সম্পর্কে বাংলায় তাসাওউফ সম্পর্কিত বই আর দ্বিতীয় দেখা যায় না।” বিশিষ্ট দার্শনিক অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ বলেন, “প্রকৃতপক্ষে এ পুস্তকখানা সাধনার পথিকদের জন্য একখানি মূল্যবান গ্রন্থ। শাহ মোহাম্মদ আবদুল করীম(রহ.) আমাদের ইতিহাসে এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। তিনি এদেশে ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে যে অনন্য অবদান রেখে গেছেন তা অবিস্মরণীয়।”
শাহ মোহাম্মদ আবদুল করীম (রহ.) ১৩২২ বাংলা সনের ৩০ অগ্রহায়ণ খড়কীস্থ নিজ খানকা শরীফে ইন্তিকাল করেন। এখানেই তাঁর মাযার রয়েছে। প্রতিদিন বহু যিয়ারতকারী আসেন। তাঁর নামে যশোর শহরে ‘শাহ আবদুল করীম সড়ক’ রয়েছে। তাঁর বংশধররা আজও ইসলামের খেদমতে নিয়োজিত আছেন। খড়কীর বর্তমান পীর হযরত মাওলানা শাহ আবদুল মতিন শাহ আবদুল করীমের পৌত্র।
মহাকবি কায়কোবাদ
কে ঐ শোনাল মোরে
আজানের ধ্বনি
মর্মে মর্মে সেই সুর বাজিল কি সুমধুর
আকুল হইল প্রাণ
নাচিল ধমনী
কি মধুর
আজানের ধ্বনি।
যদি তোমাদেরকে এখন প্রশ্ন করি এ কবিতাটি কার লিখা তোমরা নিশ্চয় এক বাক্যে বলবে কবি কায়কোবাদের। হ্যাঁ কবি কায়কোবাদের ‘আজান’ কবিতার প্রথম স্তবক এটি। তিনি মহাকবি কায়কোবাদ নামেই সবার কাছে পরিচিত। আসলে তার প্রকৃত নাম মোহাম্মদ কাজেম আল কোরেশী। জানা যায়, হাফিজ উল্লাহ আল কোরেশী নামে তাঁর জনৈক পূর্ব পুরুষ বাদশাহ শাহাজানের সময়ে বাগদাদ নগরীর নিকটবর্তী কোন স্থান থেকে দিল্লীতে এসে বসতি স্থাপন করেন। হাফিজ উল্লাহ আল কোরেশী ছিলেন আরবী ও ফারসী ভাষায় সুপন্ডিত। যে কারণে তিনি সহজেই বাদশাহ শাহজাহানের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। বাদশাহ তাঁর গুণে মুগ্ধ হয়ে দিল্লী জামে মসজিদের সহকারী ইমামের পদে তাঁকে নিয়োগ দেন। এই হাফিজ উল্লাহ আল কোরেশীর প্রপৌত্র মাহবুব উল্লাহ আল কোরেশী দিল্লী হতে বাংলাদেশে চলে আসেন এবং ফরিদপুর জেলার গোড়াইল গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। আমাদের আলোচ্য কবি এই মাহবুব উল্লাহ আল কোরেশীর প্রপৌত্র। তাঁর দাদার নাম নেয়ামত উল্লাহ আল কোরেশী এবং আব্বার নাম শাহমত উল্লাহ আল কোরেশী ওরফে এমদাদ আলী।
মহাকবি কায়কোবাদ ১৮৫৭ খৃস্টাব্দে ঢাকা জেলার নওয়াবগঞ্জ থানার আগলা পূর্বপাড়া গ্রামে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মায়ের নাম জরিফউন্নেছা খাতুন। কায়কোবাদ ছিলেন বাবা মায়ের প্রথম পুত্র। তাঁর অন্য দু’জন ভাই হলেক আবদুল খালেক ও আবদুল বারী যারা যথাক্রমে সাবডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট এবং ঢাকা মিটফোর্ড হাসপাতালের সার্জন ছিলেন।
কায়কোবাদের লেখাপড়া শুরু হয় পিতা শাহমত উল্লাহর কর্মস্থল ঢাকাতে। তিনি ঢাকার পগোজ স্কুলের ছাত্র ছিলেন। অবশ্য ১১ বছর বয়সে মা এবং ১২ বছর বয়সে আব্বা মারা যাওয়ায় ইয়াতিম কবি নানাবাড়ি আগলাপাড়া গ্রামে ফিরে যান এবং সেখানে এক বছর সময় কাটান। পরে তিনি পুনরায় ঢাকাতে ফিরে এসে ঢাকা মাদ্রাসায় ভর্তি হন। এ সময়ে মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক ছিলেন বাবু রাজেন্দ্র চন্দ্র দত্ত এবং সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন স্যার হাসান সোহরাওয়ার্দীর পিতা মওলবী ওবায়দুল্লাহ আল ওবায়দী সোহরাওয়ার্দী। অপরদিকে কবির সহপাঠী ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পিতা জাস্টিস জাহিদ সোহরাওয়ার্দী। ঢাকা মাদ্রাসায় কায়কোবাদ এন্ট্রাস পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। মাদ্রাসার শিক্ষা জীবন শেষ হলে তিনি ১৮৮৭ সালে ডাক বিভাগে চাকুরি নিয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন এবং ১৯১৯ সালে চাকুরী জীবন হতে অবসর গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য যে, ছাত্র জীবনেই তার ‘কুসুম কানন’ ও ‘বিরহ গোলাপ’ নামে দুটি কাব্য গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।
আনন্দের কথা হলো, এ কাব্য গ্রন্থ দুটি প্রকাশিত হলে তা পড়ে কাশিম বাজারের মহারাণী দশ টাকা এবং কাশীর ভূবন মোহিনী চতুর্ধারিণী পাঁচ টাকা পাঠিয়ে কিশোর কবি কায়কোবাদকে বরণ করে নেন। ঘটনাটি ছিল নিঃসন্দেহে কবির জন্য উৎসাহ অনুপ্রেরণার ক্ষেত্রে বড় ধরনের ব্যাপার।
কর্মজীবনে প্রবেশ করার আগেই তিনি অভিভাবকদের মতানুযায়ী মামা হেদায়াত আলী সাহেবের বড় মেয়ে তাহেরউন্নেছা খাতুনকে বিয়ে করেন।
১৩০২ বঙ্গাব্দে ঢাকা হতে সৈয়দ এমদাদ আলীর তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত হয় ‘অশ্রু মালা’ খন্ড কাব্যগ্রন্থটি। এ সময়ে কবি ময়মনসিংহের জামুরকী পোস্ট অফিসে কর্মরত ছিলেন। অশ্রুমালা প্রকাশিত হওয়ার পরপরই কায়কোবাদের কবি খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি ঐ সময়কার সেরা কবি নবীনচন্দ্র সেন আলিপুর হতে কবিকে লিখে পাঠান-
‘মুসলমান যে বাংলা ভাষায় এমন সুন্দর কবিতা লিখতে পারে, আমি আপনার উপহার না পাইলে বিশ্বাস করিতাম না। অল্প সুশিক্ষিত হিন্দুরই বাংলা কবিতার উপর এরূপ অধিকার আছে।”
১৩১১ বাংলা সনে কবির সর্বশ্রেষ্ঠ কৃতি ‘মহাশ্মশান’ মহাকাব্য প্রথম প্রকাশিত হয়। এটিই বাংলা সাহিত্যের সর্ববৃহৎ মহাকাব্য। বাংলা ভাষায় মাইকেল মধুসূদন দত্ত, হেমচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়, নবীনচন্দ্র সেন, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, শেখ হবিবর রহমান সাহিত্যরত্ন ও ফররুখ আহমদ মহাকাব্য রচনা করেন। তবে ঐতিহাসিক বিষয় নিয়ে কায়কোবাদই মহাকাব্য রচনা করেন। পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ নিয়ে এ মহাকাব্য রচিত। তিনখন্ডে বিভক্ত ৮৭০ পৃষ্ঠাব্যাপী এ মহাকাব্য রচনায় দীর্ঘ দশ বছর সময় লেগেছিল।
এ মহাকাব্য সম্বন্ধে আবুল কালাম শামসুদ্দীন লিখেছেন, “মহাশ্মশান কাব্য বঙ্গীয় মুসলমান সমাজে একটি উজ্জ্বল রত্ন। মহাশ্মশানের ন্যায় বৃহদাকার কাব্য বোধহয় বঙ্গ সাহিত্যে আর নেই।”
এই কাব্যের মাধ্যমে কবি মুসলমানদের জাগরণের বাণী শুনিয়েছেন-
“পড়ে নাকি মনে সেই অতীত গৌরব?
সুদূর আরব ভূমে যে বীর জাতি
মধ্যাহ্ন মার্তন্ড প্রায় প্রচন্ড বিক্রমে
যাইত ছুটিয়া কত দেশ দেশান্তরে
আফ্রিকার মরুভূমে বালুকা প্রান্তরে
বিসর্জিয়া আত্মপ্রাণ কেমন বিক্রমে
স্থাপিয়াছে ধর্মরাজ্য ‘আল্লা’ ‘আল্লা’ রবে
আজিও ধ্বনিত সেই নীলনদ তীরে।”
১৩২৮ বংগাব্দে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘বিশ্বমন্দির’ কাব্য। এই কাব্যের বিষয়বস্তু অত্যন্ত বেদনাদায়ক। ভাওয়াল এলাকার মুসলমান জমিদার নুরুউদ্দিন হায়দারের একমাত্র পুত্র আলাউদ্দীন হায়দরকে তারই দেওয়ান সুধীর চন্দ্র জমিদারীর লোভে কূপে ফেলে হত্যা করে এবং এই কূপের উপর নির্মাণ করে শিবমন্দির। এই দুঃখজনক ঐতিহাসিক ঘটনাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে বিশ্বমন্দির কাব্য।
১ ফাল্গুন ১৩২৯ বংগাব্দে প্রকাশিত হয় ‘অমিয় ধারা’ খন্ড কাব্য। এ কাব্যে অনেকগুলি কবিতা রয়েছে। তবে কাব্যের প্রথম কবিতা ‘আজান’ খুবই জনপ্রিয় একটি কবিতা। যার প্রথম স্তবক আজকের লেখার শুরুতেই উল্লেখ করছি।
১৩৩৯ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হয় কায়কোবাদের আরেকখানি মহাকাব্য ‘মহরম শরীফ’। কারবালার যুদ্ধের কারণ ও ইতিহাস বিবৃত হয়েছে এ কাব্যে। ৩ খন্ডে সমাপ্ত এ কাব্য অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত।
অমিত্রাক্ষর ছন্দে লেখা ‘শ্মশান ভস্ম’ কাব্য উপন্যাসখানি ১৩৪৫ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হয়। কায়কোবাদের মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় –প্রেম পারিজাত, প্রেমের ফুল, প্রেমের রাণী, মন্দাকিণী ধারা প্রভৃতি কাব্য।
২ সেপ্টেম্বর ১৯২৫ খৃস্টাব্দে নিখিল ভারত সাহিত্য সংঘ কায়কোবাদকে ‘কাব্যভূষণ’, ‘বিদ্যাভূষণ’ ও ‘সাহিত্য রত্ন’ উপাধিতে ভূষিত করে। তাঁকে ‘মাইকেল দি সেকেন্ড’ ও বলা হতো।
কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাথে দেখা করার জন্য কায়কোবাদ কলকাতাও গিয়েছিলেন। কাজী সাহেবের সাথে দেখা হলে তিনি কায়কোবাদের পা ছুঁয়ে সালাম করে বলেছিলেন, ‘ইনিই মহাকবি কায়কোবাদ, মহাশ্মশান অমর কাব্যের স্রষ্টা-আমাদের অগ্রপথিক।’ এ ঘটনা হতেই বুঝা যায় কায়কোবাদ কত বড় কবি ছিলেন।
ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর সভাপতিত্ত্বে ১৩৫২ বঙ্গাব্দের ২রা বৈশাখ কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ হলে কায়কোবাদকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
কবি ইসমাইল হোসেন শিরাজী কায়কোবাদকে সম্মাননা হিসেবে সোনার দোয়াত কলম উপহার দেয়ার আয়োজন করেছিলেন, কিন্তু বিশেষ কারণে তা আর দেওয়া হয় নি।
ব্রঙ্কো নিউমেনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ২১ জুলাই ১৯৫১ খৃষ্টাব্দে মহাকবি কায়কোবাদ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ইন্তিকাল করেন। ঢাকার আজিমপুর গোরস্তানে তাকে দাফন করা হয়।
মুনসী মহম্মদ মেহেরউল্লা
ঘাস, লতা, ফুল, পাখি দিয়ে ঘেরা একটি জেলা। সমস্ত জায়গায় প্রায় সমতল। সাইক্লোন, বন্যা, ঝড় কোন কিছুই সেখানে তেমন একটা আঘাত হানে না। অধিবাসীদের ভেতর শান্ত সৌম্যভাব। সবাই যেন কবি। কথায় কথায় কাব্য ঝড়ে পড়ে। এমনিতেই তাদের কথাগুলি দারুণ মিষ্টি। সেই জেলাটির নাম যশোর। এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন জেলা অর্থাৎ প্রথম জেলা। ১৭৮৬ সালে তৎকালীন ইংরেজ সরকার এই যশোরকে জেলা ঘোষণা করে। তারও আগে যশোর স্বাধীন রাজ্য ছিল। তখন নাম ছিল যশোর রাজ্য বা যশোরাদ্য দেশ। এদেশের শাসনকর্তা ছিলেন রাজা বিক্রমাদিত্য, রাজা প্রতাপাদিত্য, রাজা সীতারাম রায়, রাজা মুকুট রায়, হযরত বড়খান গাজী, হযরত খান জাহান আলীর মত ব্যক্তিত্বরা। অবশ্য যশোর কবি সাহিত্যিকদের দেশ হিসাবে আবহমান কাল ধরে সকলের নিকট পরিচিত। সেই রূপ সনাতন, শ্রীজীব গোস্বামী হতে শুরু করে মাইকেল মধুসূদন দত্ত, গোলাম মোস্তফা, ফররুখ আহমদ, ডাঃ লুৎফর রহমান, সৈয়দ আলী আহসান, ড. জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, ড. এম. সমশের আলী, সৈয়দ আলী আশরাফ পর্যন্ত সবাই এ জেলারই সুসন্তান। এজন্য যশোরকে কবি সাহিত্যিকদের তীর্থক্ষেত্র বলা হয়। আজ আমরা সেই যশোরেরই এক কৃতি সন্তান যিনি একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সমাজসেবী ও সংগ্রামী তাঁর কথা বলবো, তাঁর নাম মুনসী মেহেরউল্লা।
মুনসী মেহেরউল্লা ১৮৬১ সালের ২৬ ডিসেম্বর যশোর জেলার ঝিনাইদহ মহকুমার(বর্তমানে জেলা)অন্তর্গত কালিগঞ্জ থানার ঘোপ গ্রামে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। ঘোপ গ্রামটি ঐতিহাসিক বারবাজার সংলগ্ন। এই বারবাজার হতেই সমগ্র দক্ষিণ বঙ্গে ইসলামের সুমহান বাণী প্রথম প্রচার করেন হযরত বড়খান গাজী(গাজী কালু চম্পাবতী)। এরপর যে মহান মনীষীর আগমনে বারবাজার ধন্য হয় তিনি হযরত খানজাহান আলী। তার বারো জন শিষ্যের নাম অনুসা্রেই এই স্থানের নাম হয়েছে বারবাজার। এখান থেকেই তিনি বাগেরহাট অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। মেহেরউল্লার পৈতৃকবাড়ি চুরামনকাটী(বর্তমানে মেহেরউল্লাহ নগর) সংলগ্ন ছাতিয়ানতলা গ্রামে। তাঁর আব্বা মুন্সী মোহাম্মদ ওয়ারেছ উদ্দীন অত্যন্ত ধর্মভীরু মানুষ ছিলেন।
অল্পবয়সেই পিতৃহারা হওয়ার কারণে মুন্সী মেহেরউল্লাহ লেখাপড়া বেশিদূর করতে পারেন নি। তাই মায়ের তত্ত্বাবধানে ও নিজের চেষ্টায় তাঁর লেখাপড়া চলতে থাকে। কৈশোর বয়সে তিনি মৌলভী মেসবাহউদ্দীনের কাছে তিন বছর এবং পরে করচিয়া গ্রামের মুহাম্মদ ইসমাঈল সাহেবের কাছে আরো তিন বছর আরবী, ঊর্দূ, ফারসী ভাষা ও সাহিত্য শিখেন। অত্যন্ত মেধাবী হওয়ায় অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি কোরআন ও হাদীসে মোটামুটি জ্ঞান অর্জন করেন এবং শেখ সাদীর গুলিস্তা, বোস্তা ও পান্দেনামা মুখস্ত করেন।
কর্মজীবনের শুরুতে তিনি যশোর জেলা বোর্ডে একটি চাকুরি পান কিন্তু স্বাধীন মনোভাবের কারণে সে চাকুরী ছেড়ে দর্জির কাজ শুরু করেন। দর্জির কাজে তিনি প্রভূত সুনাম অর্জন ও সাফল্য লাভ করেন। সেই সূত্রে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটও তাঁর খরিদ্দার ছিলেন এবং তাঁকে দার্জিলিং নিয়ে দোকান করে দেন।
যশোর শহরের কেন্দ্রস্থল দড়াটানায় দর্জির দোকানে কাজ করতে করতে মুন্সী মেহেরউল্লাহ দেখতেন খৃস্টান মিশনারীদের কার্যকলাপ। মিশনারীদের ভয়ভীতি ও প্রলোভনের ফলে প্রচুর নিম্নবর্ণের হিন্দু ও দরিদ্র মুসলমান খৃস্টান ধর্মের দীক্ষিত হয়ে যাচ্ছিল। কোনও রাজনৈতিক নেতাকে এগিয়ে আসতে না দেখে এর বিরুদ্ধে তরুণ দর্জি মুন্সী মেহেরউল্লাহ গর্জে উঠলেন সিংহের মত।
দার্জিলিং অবস্থানকালে তিনি বেদ, উপনিষদ, গীতা, বাইবেল, ত্রিপিটক, গ্রন্থসাহেব প্রভৃতি ধর্মগ্রন্থগুলি মনোযোগ দিয়ে পড়লেন। এ সময় তিনি তোফাজ্জল মুকতাদী নামক একটি ঊর্দূগ্রন্থ হতে বিভিন্ন ধর্মের ত্রুটি বিচ্যূতিগুলি জেনে নিলেন। তাছাড়া হযরত সোলায়মান ওয়ার্সীর লেখা ‘কেন আমার পৈত্রিক ধর্ম ত্যাগ করেছিলাম’, ‘প্রকৃত সত্য কোথায়’ বই দুটি তার জ্ঞানের পরিধিকে ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে দিল।
তিনি দার্জিলিং হতে ফিরে এলেন যশোরে। খৃস্টানদের মতই তিনি দড়াটানা মোড় হতে বাংলা আসাম ও ত্রিপুরার অলিতে গলিতে সভা সমাবেশ করে খৃস্টান ধর্মের অসারতা প্রমাণ করার চেষ্টা করলেন। এ প্রচারকে বেগবান করার জন্য কোলকাতার নাখোদা মসজিদে বসে মুনসী শেখ আবদুর রহীম ও মুনসী রিয়াজুদ্দীন আহমদ প্রমুখ বিচক্ষণ ব্যক্তিদের সহযোগিতায় গঠন করলেন নিখিল ভারত ইসলাম প্রচার সমিতি। সমিতির পক্ষ হতে বাংলা ও আসামে ইসলাম প্রচারের দায়িত্ব দেয়া হয় মুনসী মেহেরউল্লা ওপর।
মুনসী মেহেরউল্লার জ্বালাময়ী ও যুক্তিপূর্ণ বক্তৃতায় মানুষ দলে দলে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে স্থান নিতে লাগল। যাদের মনে ঘুণ ধরেছিল তারা আবার মনটাকে ঠিক করে নিল। জনমিরুদ্দীনের মত তুখোড় খৃস্টানও কলেমা পড়ে পুনরায় মুসলমান হয়ে গেলেন।
তিনি যে শুধু বক্তৃতা দিতে পারতেন তা নয়, তাঁর কলমের ধারও ছিল দু’ধারী তলোয়ারের মত। জন জমিরুদ্দীন ১৮৯২ খৃস্টাব্দে খৃস্টান বান্ধব পত্রিকায় ‘আসল কোরআন কোথায়’ শিরোনামে একটি উদ্ধত্যপূর্ণ প্রবন্ধ লিখেন। এতে জন সাহেব প্রমাণ করার চেষ্টা করেন আসল কোরআন কোথাও নেই। এহেন অযৌক্তিক প্রবন্ধের দাঁতভাঙ্গা জবাব দেন মুনসী মেহেরউল্লাহ ‘সুধাকর’ পত্রিকায় ‘ইসায়ী বা খৃস্টানী ধোকা ভঞ্জন’ শিরোনামের এক গবেষণামূলক প্রবন্ধে। এরপর জন জমিরুদ্দীন সুধাকরে অপর একটি ছোট প্রবন্ধ লিখেন। উত্তরে মেহেরউল্লাহ ‘আসল কোরআন সর্বত্র’ শিরোনামের সুধাকরে অন্য একটি সারগর্ভ প্রবন্ধ লেখেন। উক্ত প্রবন্ধ প্রকাশ হওয়ার পর বিরোধী মহলে প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। এই সময়ে নিকোলাস পাদ্রী অঘোরনাথ বিশ্বাস, রেভারেন্ড আলেকজান্ডার প্রমুখ খৃস্টান ধর্মপ্রচারকগণ মুনসী মেহেরউল্লার সাথে তর্কযুদ্ধে পরাজিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।
মুনসী মেহেরউল্লা শুধু খৃস্টানদের অপপ্রচারের বিরুদ্ধেই আন্দোলন করেন নি, তিনি মুসলমানদের মধ্যে যে সমস্ত কুসংস্কার দেখেছেন তার বিরুদ্ধেও ছিলেন খড়গহস্ত। এ সম্বন্ধে শেথ হবিবুর রহমান সাহিত্যরত্ন তাঁর ‘কর্মবীর মুনসী মেহেরউল্লা’ গ্রন্থের ৮৮ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, “মুনসী মেহেরউল্লার নানা দিক দিয়ে উৎসাহ ছিল। তিনি মুসলমান সমাজে ব্যবসা বাণিজ্য প্রচলন করার জন্য চেষ্টা করেছিলেন। উৎসাহ দিতেন কৃষি কাজ করার জন্য। তিনি বলতেন, মুসলমান মিঠাই খাইতে জানে কিন্তু তৈয়ারী করিতে জানে না। পান খাইতে অজস্র পয়সা নষ্ট করে কিন্তু পানের বরজ তৈয়ার করা অপমানজনক মনে করেন। মুনসী মেহেরউল্লা সাহেব মুসলমানগণের মিঠাইয়ের দোকান করিতে, পানের বরজ তৈয়ার করিতে সর্বস্থানে উৎসাহ দিতেন, তাঁহার চেষ্টা বহু স্থানেই ফলবতী হইয়াছিল।”
মুনসী মেহেরউল্লা শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে পথিকৃতের ভূমিকা রাখেন। তিনি নিজেই ১৯০১ সালে নিজ গ্রামের পাশের গ্রাম মনোহরপুরে মাদরাসায়ে কারামাতিয়া নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন যেটা বর্তমানে মুনসী মেহেরউল্লা একাডেমী। তিনি বাংলা আসামের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ব্যক্তিগতভাবে সহযোগিতা করেছেন। তিনি মুসলিম সমাজকে তাঁর বক্তব্যের মাধ্যমে শিক্ষার গুরুত্ব বুঝানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন।
আমরা এখন সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর জন্য বক্তৃতা বিবৃতি দিই, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের কথা স্মরণ করে ২১শে ফেব্রুয়ারী ভাষা দিবস উদযাপন করি। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, এরও অনেক আগে অল্প শিক্ষিত মুনসী মেহেরউল্লা মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা কি তা হাড়ে হাড়ে বুঝে ছিলেন। যারা মাতৃভাষাকে ছোট করে দেখতো তাদের উদ্দেশ্যে তিনি লিখেছেন, “মাতৃভাষা বাংলায় লেখাপড়ায় এত ঘৃণা যে, তাহারা তাহা মুখে উচ্চারণ করাই অপমানজনক মনে করেন। এই অদূরদর্শিতার পরিণাম যে কি সর্বনাশা তাহা ভাবিলে শরীর শিহরিয়া ওঠে। যে দেশের বায়ু, জল, অন্ন, ফল, মৎস, মাংস, দুগ্ধ, ঘৃত খাইয়া তাহার শরীর পরিপুষ্ঠ সে দেশের ভাষার প্রতি অনাদর করিয়া তাঁহারা যে কি সর্বনাশের পথ উন্মুক্ত করিতেছে তাহা ভাবিলেও প্রাণে এক ভীষণ আতঙ্ক উপস্থিত হয়।”
উপস্থিত বুদ্ধি মুনসী মেহেরউল্লার এত প্রখর ছিল যে, তৎকালীন সময়ে মুসলমান, হিন্দু ও খৃস্টান সমাজে তাহার সমকক্ষ আর কেউ ছিল না বললেই চলে। উপস্থিত তর্কে তিনি কারো কাছে পরাজিত হয়েছেন এমন কোন তথ্য এ যাবত আমাদের হাতে এসে পৌছেনি। বরং বাংলা আসামের বিভিন্ন অঞ্চলে তাঁর উপস্থিত বুদ্ধি সম্বন্ধে নানা কিংবদন্তী ছড়িয়ে আছে। তিনি অত্যন্ত রসিক মানুষ ছিলেন। বন্ধুদের রহস্যমূলক প্রশ্নের উত্তর তিনি রহস্য করিয়াই দিতেন।
এই মহান সমাজ সেবক অনেকগুলি বইও লিখেছেন। তার মধ্যে ‘মেহেরুল এছলাম’, ‘হিন্দু ধর্ম রহস্য ও দেবলীলা’, ‘বিধবা গঞ্জনা’, ‘রদ্দে খৃস্টান’ ও ‘দলিলুল এছলাম’ গ্রন্থগুলি খুবই পরিচিত। তাঁর লেখা সাধারণ পাঠকের কাছে খু্বই জনপ্রিয় ছিল। এ ব্যাপারে তিনি নিজেই লিখেছেন, “যদিও আমি ভালো বাংলা জানি না তথাপি ক্রমে ক্রমে কয়েকখানি পুস্তক পুস্তিকা প্রকাশ করিয়াছি, তদ্বারা সমাজের কতদূর উপকার সাধিত হইয়াছে বলিতে পারি না। তবে এই মাত্র জানি যে, এখন আমি খোদার ফজলে সমুদয় বঙ্গীয় মুসলমানের স্নেহ আকর্ষণ করিয়াছি। আমি দরিদ্র লোকের সন্তান হইলেও আমাকে আর কোন বিষয়ে অভাব অনুভব করিতে হয় না।”
সাহিত্য সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে অনেকেই তাঁর সাহায্য সহযোগিতা পেয়েছেন এবং পরবর্তীকালে তাঁরা প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। এঁদের মধ্যে যে নামগুলি উল্লেখযোগ্য তাঁরা হলেন- সৈয়দ ইসমাঈল হোসেন সিরাজী, শেখ হবিবর রহমান সাহিত্যরত্ন, কবি গোলাম হোসেন, মুন্সী শেখ জমিরউদ্দীন বিদ্যাবিনোদ, মওলানা আকরাম খাঁ প্রমুখ।
তিনি বাংলার জনগণের মাঝে এত জনপ্রিয় ছিলেন যে, নোয়াখালির কবি আবদুর রহিম তাঁর আখলাকে আহমদিয়া নামক বইতে লিখেছেন-
মুনসী মেহেরউল্লা নাম যশোর মোকাম।
জাহান ভরিয়া যার আছে খোশ নাম।
আবেদ জাহেদ তিনি বড় গুণাধার।
হেদায়াতের হাদী জানো দ্বীনের হাতিয়ার।
মুনসী মেহেরউল্লা ১৯০৬ সালে তাঁর ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট (চেয়ারম্যান) মনোনীত হন। পরের বছর মাত্র ৪৫ বছর বয়সে অতিরিক্ত পরিশ্রমের ফলে ইসলামী রেনেসাঁর এ অগ্রনায়ক অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং নিজ বাসভবনে ইন্তিকাল করেন। তাঁর মৃত্যুতে সারা বাংলা ও আসাম শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে। সেই সময়ের পত্রপত্রিকায় তার মৃত্যু সংবাদসহ সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশ করে। সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী তাঁর শোকোচ্ছ্বাস কবিতায় লিখেছেন-
যার সাধনায় প্রতিভা প্রভায় নতুন জীবন ঊষা
উদিল গগনে মধুর লগণে পরিয়া কুসুম ভূষা।
গেল যে রতন হায় কি কখন মিলিবে সমাজে আর?
মধ্যাহ্ন তপন হইল মগন, বিশ্বময় অন্ধকার।
আজ মুনসী মেহেরউল্লা আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু আছে তাঁর কর্মময় জীবন, আছে তাঁর রচিত সাহিত্য। কি করে একজন সামান্য শিক্ষিত এতিম বালক পরিশ্রম আর আত্মবিশ্বাসের জোরে জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠতে পারে, কি করে খৃস্টান মিশনারীদের অপতৎপরতার হাত হতে স্ব-সমাজকে রক্ষা করতে পারে, তার জ্বলন্ত প্রমাণ মুনসী মেহেরউল্লা। ছোট বড় সবার উচিত তাঁর জীবন হতে শিক্ষা গ্রহণ করা। তাঁর কর্মময় জীবনের এবং সাহিত্যের ব্যাপক প্রচারও আমাদের জন্য বিশেষভাবে প্রয়োজন।
মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ
উপমহাদেশের সাংবাদিকতা জগতের দিকপাল, মুসলিম গণজাগরণের নকীব, সুসাহিত্যিক, সাংবাদিক, সমাজসেবী মোহাম্মদ আকরম খাঁ পশ্চিম বঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলার হাকীমপুর গ্রামের এক বিখ্যাত পরিবারে ১৮৬৮ খৃস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন।
প্রথিতযশা সাংবাদিক ও সাহিত্যিক মওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁর আগে এবং তাঁর সমসাময়িককালে উল্লেখযোগ্য অনেক মুসলমান খ্যাতিমান লেখক-সাংবাদিকগণ মাসিক, ত্রৈমাসিক, দৈনিক ইত্যাদি পত্রিকা প্রকাশ করলেও সেগুলো দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। মওলানা আকরাম খাঁ তাঁর প্রকাশিত বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে মুসলিম বাংলা সাংবাদিকতা একটা দীর্ঘস্থায়ী ভীত রচনা করেন, তাঁর প্রকাশিত ‘দৈনিক আজাদ’ (১৯৩৬-১৯৯২) ও মাসিক ‘মোহাম্মদী’ বৃটিশ আমলে আত্মপ্রকাশ করে সুদীর্ঘকাল টিকে থাকে এবং পাকিস্তান আমল এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পরও কিছুকাল এই পত্রিকা দু’টির অস্তিত্ব বর্তমান ছিল। মুসলিম বাংলার নবজাগরণে, বৃটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে, সামাজিক সংস্কারে, লেখক সৃষ্টিতে ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় এবং ১৯৮৪ ও ১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলনে দৈনিক আজাদ ও মাসিক মোহাম্মদী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
শিশুকালে পিতা-মাতাকে হারানোর পর আত্মীয়ের তত্ত্ববধানে তিনি বেড়ে ওঠেন। অতপর তিনি লালিত আত্মীয়-স্বজনের প্রচেষ্টায় লেখাপড়া চালিয়ে যান। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তাঁর খুব বেশি ছিল না। তৎকালীন সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় জটিল পরিস্থিতিই ১৯০০ সালে কলকাতা আলীয়া মাদ্রাসা থেকে এফএম পাস করেন।
কলকাতা আলীয়া মাদ্রাসা থেকে পাস করার পর মওলানা আকরম খাঁ কর্মজীবনে অবতীর্ণ হতে বাধ্য হন। কর্মজীবনের শুরুতেই তিনি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেচে নিন। খুব অল্প বয়সেই আহলে হাদীস ও মোহাম্মদী আকবর পত্রিকার মাধ্যমে তাঁর সাংবাদিকতা পেশায় হাতেখড়ি হয়।
আহলে হাদীস ও মোহাম্মদী আকবর পত্রিকায় সাংবাদিকাতার মাধ্যমে সাংবাদিকতা জীবন শুরু করার পর মওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁ ১৯০৮ সাল থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত দি মোহাম্মদী ও আল-ইহসান পত্রিকার স¤পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তিনি ১৯২০ সাল থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত সময়ে কলকাতা থেকে জামানা ও সেবক পত্রিকা প্রকাশ করেন। ১৯৩৬ সালের ৩১শে অক্টোবর তিনি দৈনিক আজাদ পত্রিকা প্রকাশ করেন এবং এটির সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪০ সালে প্রখ্যাত সাংবাদিক আবুল কালাম শামসুদ্দীনকে এর সম্পদনার দায়িত্ব দিয়ে তিনি অবসর জীবনে চলে যান।
মওলানা আকরাম খাঁ সাংবাদিক, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ, ধর্মশাস্ত্রবেত্তা, সুপ-িত ব্যক্তি এবং শক্তিশালি গদ্যলেখক হিসেবে খ্যাতিমান। বাংলার মুসলমান সমাজের নবজাগরণ তথা রেনেসাঁর তিনি অন্যতম পথিকৃৎ। মওলানা আকরাম খাঁ রচিত গ্রন্থাদি, বিভিন্ন সময়ে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও সম্পাদকীয় রচনা একজন সুপ-িত ব্যক্তি, চিন্তাশীল ও মননশীল লেখক এবং শক্তিমান গদ্যশিল্পীকেই চিনিয়ে দেয়। বিভিন্ন সময়ে তাঁর একাধিক প্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, যা পাঠক শ্রেণী ও বোদ্ধামহলে বেশ প্রশংসিত ও খ্যাত হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্যকয়েকটি হল,-
*** আমপারার বাংলা অনুবাদ
*** মোস্তফা-চরিত
*** মোস্তফা-চরিতের বৈশিষ্ট্য
*** বাইবেলের নির্দেশ ও প্রচলিত খ্রীষ্টান ধর্ম
*** মুসলীম বাংলার সামাজিক ইতিহাস
*** তাফসীরুল কোরআন (১-৫ খন্ড, অনুবাদ)
*** টীকা-ভাষ্য (অনুবাদ)
মৌলিক রচনা ছাড়াও তাঁর বাংলায় অনুদীত গ্রন্থগুলো প্রমাণ করে তিনি যে একজন দক্ষ অনুবাদক এবং সুপ-িত ব্যাক্তি।
মাওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়ে রাজনীতি শুরু করেন। মওলানা আকরাম খাঁ ছিলেন ১৯০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত মুসলিম লীগের একজন অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।
১৯১৮ থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত তিনি খেলাফত এবং অসহযোগ আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৯২০ সালে ঢাকার আহসান মঞ্জিলে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে তিনি নিখিল ভারত খেলাফত আন্দোলন কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। এই সম্মেলনে খেলাফত আন্দোলনের অন্যতম নেতা মওলানা আবুল কালাম আজাদ, মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদি এবং মওলানা মজিবুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। আকরাম খাঁর দায়িত্ব ছিল তুর্কি খেলাফত থেকে ফান্ড সংগ্রহ করা। ১৯২০-১৯২৩ সময়ের মধ্যে তিনি বাংলার বিভিন্ন স্থানে জনসভা বা সম্মেলনের আয়োজন করে খেলাফত আন্দোলন এবং অসহযোগ আন্দোলন গতিশীল করার চেষ্ঠা করেন।
১৯৪১ সালে তিনি প্রাদেশিক মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং একনাগাড়ে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় অত্যন্ত যোগ্যতার সাথে তিনি নেতৃত্ব প্রদান করেন। পরবর্তীতে তিনি নিখিল ভারত মুসলিম লীগ ও পরে পাকিস্তান মুসলিম লীগের ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং গণপরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৫৪ সালে গণপরিষদ ভেঙ্গে গেল তিনি প্রত্যক্ষ রাজনীতি হতে দূরে সরে যান এবং ১৯৬২ সালে আজাদের প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
মোহাম্মদ আকরম খাঁ মুসলিম সমাজে প্রচলিত বিদাতসমূহের চরম বিরোধী ছিলেন। তিনি ব্যক্তি পূজা, কবর পূজা ও অন্যান্য প্রচলিত রসম রেওয়াজের বিরুদ্ধে তাঁর লেখনী ধারণ করেছিলেন।
তিনি ১৯৪৭ সালে স্থায়ীভাবে ঢাকায় চলে আসেন। মওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁ ১০১ বছর বয়সে ১৯৬৯ সালের ১৮ আগষ্ট রাজধানী বংশালে আহলে হাদীস মসজিদে নামাযরত অবস্থায় ইন্তেকাল করেন।
আবদুল করীম সাহিত্য বিশারদ
…………………………………………………………..
নাম আবদুল করীম। উপাধি সাহিত্য বিশারদ ও সাহিত্য সাগর। আব্বার নাম মুনশী নুরুদ্দীন এবং দাদার নাম মোহাম্মদ নবী চৌধুরী। আবদুল করীমের পুরো নাম মুনশী আবদুল করীম সাহিত্য বিশারদ। তবে তিনি আবদুল করীম সাহিত্য বিশারদ নামেই পরিচিত। এমনকি শুধু সাহিত্য বিশারদ বললেই তাঁকেই বুঝানো হয়। তিনি ছিলেন একাধারে সংগ্রাহক, গবেষক, প্রবন্ধকার ও সম্পাদক। না, তিনি কবি বা মৌলিক কোন লেখক ছিলেন না। আর এ জন্যেই অনেকের কাছে তিনি কিছুটা অপরিচিত। কিন্তু তাই বলে তিনি মোটেও ছোট খাট কোনো ব্যক্তি নন। তিনি আমাদের বাঙলা সাহিত্য অঙ্গনের এক মহান মনীষী। যাকে বাঙ্গালী হিন্দু মুসলমান যুগ যুগ ধরে স্মরণ করবে। সত্যি কথা বলতে কি পুরো বাঙ্গালি জাতি এই মহান মানুষটির কাছে ঋণী হয়ে আছেন।
সাহিত্য বিশারদ মুন্সি আবদুল করিম ১৮৬৯, মতান্তরে ১৮৭১ সালের ১১ অক্টোবর পটিয়া মহকুমার সুচক্রদন্ডী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন বিখ্যাত কাদির রাজার অধস্তন বংশধর। তাঁর উর্ধ্বতন পূর্বপুরুষ হাবিলাস মল্ল কোন এক সময় চট্টগ্রামের কাছাকাছি এক দ্বীপে এসে বসতি স্থাপন করেন। পরবর্তীতে তাঁর নামানুসারে ঐ দ্বীপের নামকরণ করা হয় হাবিলাস দ্বীপ। দুঃখজনক হলেও সত্য যে আবদুল করীম দুনিয়ার মুখ দেখার আগেই তাঁর পিতা মুনশী নুরউদ্দীন ইন্তিকাল করেন। তাঁর মাতা মিস্রীজান প্রখ্যাত পাঠান তরফদার দৌলত হামজা বংশের মেয়ে ছিলেন।
জন্মের কয়েক মাস আগে পিতার মৃত্যু এবং ১৭ বছর বয়সে মাতৃহীন আবদুল করিম দাদা-দাদি ও চাচা-চাচির স্নেহছায়ায় এন্ট্রান্স পাস করেন এবং সচেষ্টায় বাংলা, সংস্কৃত, আরবি ও ফারসি ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। তার পড়াশোনা শুরু হয়েছিল বাড়ির দহলিজেই। সেখানেই তিনি আরবি-ফারসি ও বাংলায় পড়া শুরু করেন। অতঃপর তিনি সুচক্রদণ্ডী মধ্যবঙ্গ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এক বছর পড়াশোনা করে তিনি পটিয়া উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৮৯৩ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। উল্লেখ্য যে, এন্ট্রান্স পরীক্ষায় তার দ্বিতীয় ভাষা ছিল সংস্কৃত এবং সঙ্গত কারণেই উনিশ শতকে এন্ট্রান্স পাস করতে ইংরেজি ভাষাজ্ঞানেও পারদর্শী হতে হতো। চট্টগ্রাম কলেজে দু’বছর এফএ পড়ার পর ১৮৯৭ সালের ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে চট্টগ্রাম অঞ্চলের অনেক সম্পন্ন পরিবারের মতো তাদের পরিবারেও অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা অনিবার্য করে তোলে। এর সঙ্গে যোগ হয় শারীরিক অসুস্থতা। পরীক্ষার আগে তিনি টাইফয়েড এ আক্রান্ত হন। ফলে তার আর এফএ পরীক্ষা দেয়া হয়নি। এখানেই তার উচ্চ শিক্ষার সমাপ্তি ঘটে।
১৮৯৫ সালে চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল স্কুলের শিক্ষক হিসাবে কর্মজীবনের শুরু করেন। পরবর্তীকালে তিনি সীতাকুণ্ড মধ্য ইংরেজি স্কুলের অস্থায়ী প্রধান শিক হন। চট্টগ্রামে প্রথম সাব-জজ আদালতে অ্যাপ্রেন্টিস হিসেবে কাজ করেন। পরে কবি নবীন সেনের সুপারিশে চট্টগ্রাম কমিশনার অফিসে যোগদান করেন। ১৯৩৪ সালে তিনি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ এমন একজন ব্যক্তি, যিনি আজীবন প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের সেবা করে গেছেন। বাঙালি লেখকেরা যখন পাশ্চাত্য সাহিত্যের প্রভাবে ও অনুরাগে আধুনিক বাংলা সাহিত্য সৃষ্টিতে নিজেদেরকে নিয়োজিত করেছেন, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ তখন প্রাচীন ও মধ্যযুগের পুঁথি সংগ্রহ, পুঁথির রণাবেণ এবং পুঁথি সম্পাদনায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। মূলত পুঁথি সংগ্রহ, পুঁথির রণাবেণ ও পুঁথি সম্পাদন ছিল তার জীবনের ব্রত। বর্ণাঢ্য জীবনে তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রধান উপাদান পুঁথি পত্র ও এদেশের প্রাচীন ও মধ্য যুগের লৌকজ-সাহিত্যের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁর সম্পাদিত নরোত্তম ঠাকুরের ‘রাধিকার মানভঙ্গ’, কবিবল্লভের ‘সত্যনারায়ণের পুথিঁ’, দ্বিজ রতিদেবের ‘মৃগলুব্ধ’ রামরাজার ‘মৃগলুব্ধ সম্বাদ’, দ্বিজ মাধবের ‘গঙ্গামঙ্গল’, আলী রাজার ‘জ্ঞানসাগর’, বাসুদেব ঘোষের ‘শ্রীগৌরাঙ্গ সন্ন্যাস’, মুক্তারাম সেনের ‘সারদামঙ্গল’, শেখ ফয়জুল্লাহর ‘গোরক্ষবিজয়’ ও আলাওলের ‘পদ্মাবতী’ (খণ্ডাংশ) বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ থেকে প্রকাশিত। ‘ইসলামাবাদ’ (চট্টগ্রামের সচিত্র ইতিহাস) ও ‘আরাকান রাজসভায় বাঙ্গলা সাহিত্য’ (মুহম্মদ এনামুল হকের সহযোগে রচিত) তাঁর দুটি মৌলিক গ্রন্থ।
আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ বাল্যকাল থেকেই পুঁথিপত্রের প্রতি খুবই আগ্রহী ছিলেন। সারা জীবন তার নেশা ছিল দৈনিক-সাপ্তাহিক-পাকি-মাসিক ইত্যাদি পত্রিকা পাঠ করা এবং সংগ্রহ করা। তিনি তাঁর বাড়িতে তাঁর পিতামহ কর্তৃক সংগৃহীত কিছু পুঁথির সঙ্গে পরিচিত হন। এই পুঁথিগুলো পড়ে তিনি পুঁথি সংগ্রহে ও এ নিয়ে লিখতে আগ্রহী হন। এ পুঁথিগুলোর মধ্যেই পেয়ে যান ‘চণ্ডীদাসের পদাবলী’। সেসময় তিনি ছিলেন এফএ ক্লাসের ছাত্র। এ সময় তিনি আচার্য অক্ষয় সরকার সম্পাদিত ‘পূর্ণিমা’ পত্রিকায় ‘প্রাচীন পদাবলী’ নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। এই প্রবন্ধ পাঠ করেই মহাকবি নবীন চন্দ্রসেন সাহিত্যবিশারদের প্রতি আকৃষ্ট হন।
একান্ত শিশুকাল হতে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আবদুল করীম সাহিত্য বিশারদকে আমরা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের একজন পাঠক সংগ্রাহক ও তথ্যনিষ্ঠ গবেষক হিসেবে দেখতে পাই। এই মহান মনীষী ৩০ শে সেপ্টেম্বর ১৯৫৩ সালে ৮৩ বছর বয়সে চট্টগ্রামে ইন্তিকাল করেন।