বিদ্রোহী শাহজাদা
ছোটটো একটি গ্রাম। তাও আবার আমাদের এই বাংলাদেশে নয়। একেবারে পশ্চিম বাংলার বর্ধমান জেলার অজপাড়াগাঁয়ে। চারদিকে ধান কাউনের উম উম গন্ধ। পাখ-পাখালির কিচির মিচির আওয়াজ। সন্ধ্যায় শোনা যায় ঝিঁ ঝিঁ পোকার ঝাঁঝাল ডাক। কি সুন্দর তাই না? এই গ্রামের মানুষ আবার লেটো গান ভালবাসতো। একদিন রাতে তারা ‘লেটো’ গানের আসর বসালো। আশ-পাশের বিশ গ্রামের মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়লো সে গান শুনতে!
গানতো নয়, লড়াই! পুরোপুরি দুই দলের লড়াই। তবে গোলা বন্ধুক দিয়ে নয়, কবিতা দিয়ে। কি মজার কান্ড বলতো। তুমুল লড়াইয়ের পর এক পক্ষ হারে হারে অবস্থা ঠিক তখনি ঐ দলের এক পুঁচকে ছেলে লাফ দিয়ে উঠলো। এই ধরো তোমাদেরই মত বয়স বা তারও কম। হাত পা নাচিয়ে মাথার চুল দুলিয়ে গান শুরু করলো। এক এক করে বিপক্ষ দলের সব কটি প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিল। কি তাজ্জব ব্যাপার। ঐ অতটুকু ছেলে এতকিছু জানে কারোরই বিশ্বাস হয় না। সবারই মনে উঁকিঝুঁকি মারছে নানা প্রশ্ন। এ শাহজাদা কোত্থেকে এল? কি তার পরিচয়? শাহজাদাটি কিন্তু বিপক্ষ দলের প্রশ্নের উত্তর দিয়েই ক্ষান্ত হলো না। সে নিজেই প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে বিপক্ষ দলকে হারিয়ে দিলো। সমস্ত আসর উল্লাসে ফেটে পড়ল। পুচকে শাহজাদাটি ততক্ষণে মানুষের মাথার উপর পুতুলের মত নাচছে। দলের সরদার জিতে যাওয়ার আনন্দে বাগ বাগ হয়ে জড়িয়ে ধরলেন শাহজাদাকে। বললেন-
‘ওরে আমার ব্যাঙাচি
বড় হয়ে তুই একদিন সাপ হবি।’
সরদারের কথা কিন্তু ঘটেছিল, সে খুউব বড় কবি হয়েছিল। কি তোমরা পরিচয় জানার জন্য উসখুস করছো তাই না? অবশ্য করার কথা। তবে এসো তোমাদের সাথে তাঁর পরিচয় করিয়ে দিই-তিনি হচ্ছেন আমাদের সবার পরিচিত এবং প্রিয় কবি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। যিনি আমাদের জাতীয় কবি।
১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৪মে (১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন কাজী নজরুল ইসলাম। চুরুলিয়া গ্রামটি আসানসোল মহকুমার জামুরিয়া ব্লকে অবস্থিত। পিতামহ কাজী আমিন উল্লাহর পুত্র কাজী ফকির আহমদের দ্বিতীয়া পত্নী জাহেদা খাতুনের ষষ্ঠ সন্তান তিনি। তার বাবা ছিলেন স্থানীয় এক মসজিদের ইমাম| তারা ছিলেন তিন ভাই এবং বোন। তার সহোদর তিন ভাই ও দুই বোনের নাম হল: সবার বড় কাজী সাহেবজান, কনিষ্ঠ কাজী আলী হোসেন, বোন উম্মে কুলসুম। কাজী নজরুল ইসলামের ডাক নাম ছিল “দুখু মিয়া”।
তোমরা হয়তো ভাবছ শাহজাদাদেরতো হাতী শালে হাতী, ঘোড়াশালে ঘোড়া, পাইক, বরকন্দাজ ইত্যাদি কত কিছু থাকে, এ শাহজাদাটিরও নিশ্চয়ই আছে। আসলে এ শাহজাদার এসব কিছুই নেই। বরং বলা যায় সম্পূর্ণ বিপরীত, একেবারে মিসকীনি হালত। কিন্তু হলে কি হবে? তাঁর মনটাতো আর মিসকিন নয়, একেবারে শাহজাদার শাহজাদা। ঐ যে তোমরা শুনছো না পাতালপুরির ঐ ঘুমন্ত শাহজাদার কথা। সেই যে রূপার কাঠি আর জিয়ন কাঠির পরশে রাজকন্যার ঘুম ভাঙলো! আমাদের আজকের শাহজাদা সেই পাতালপুরীতে যেতে চান কিন্তু ঐ রকম ঘুমাতে না, সবকিছুকে ভেঙে চুরে নিজের হাতের মুঠোয় নেবার জন্য। যেমন তিনি বলেছেন-
পাতাল ফুঁড়ে নামবো আমি
উঠবো আমি আকাশ ফুঁড়ে
বিশ্বজগত দেখব আমি
আপনা হাতের মুঠোয় পুরে।
মাত্র আট বছর বয়সে আব্বা মারা যাওয়ায় সংসারের হাল ধরতে হয় তাঁকে। এ জন্য লেখাপড়ার ইতি টেনে ঐ বয়সেই কখনো মসজিদের ইমামতি, কখনো মক্তবের শিক্ষকতা করে সংসার চালাতে থাকেন। কিন্তু যারা চিরবিদ্রোহী তাঁরা চায় স্বাধীন জীবন। গ্রাম হতে চলে এসে আসানসোল শহরে রুটির দোকানে চাকরি নেন। কষ্টের কথা ছড়ায় বলতেন এভাবে-
মাখতে মাখতে গমের আটা
ঘামে ভিজতো আমার গা’টা।
এখান হতে চাকরি ছেড়ে দিয়ে দরিরামপুর স্কুলে ভর্তি হন। এরপর ভর্তি হন রাণীগঞ্জ সিয়ারসোল হাই স্কুলে। যখন দশম শ্রেণীর ছাত্র ঠিক সেই সময়েই শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। সেনাবাহিনীতে নাম লিখিয়ে কিছুদিনের মধ্যেই হাবিলদার হন। এইখান হতেই তাঁর কবি প্রতিভার বিকাশ ঘটতে থাকে। পত্র-পত্রিকায় প্রচুর কবিতা ছাপা হতে থাকে তাঁর। ১৯১৯ সালে ভয়ঙ্কর এই যুদ্ধ শেষ হয়। দেশে ফিরেই লিখেন বিখ্যাত কবিতা ‘বিদ্রোহী’। কি পড়নি-
বল বীর-
বল উন্নত মম শির।
হ্যাঁ এই কবিতা আমাদের কবি শাহজাদাকে এক রাতের মধ্যেই বিদ্রোহী শাহজাদাতে পরিণত করে। এরপর দু’হাতে লিখতে থাকেন অজস্র লেখা। এ লেখাগুলোর প্রায় সবগুলিই ছিল অন্যায়, অবিচার আর শোষণের বিরুদ্ধে। সে সময়কার ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধেও তিনি শক্ত হাতে কলম ধরেন। তাঁর কলমের ডগা দিয়ে বেরুতে থাকে লকলকে আগুন। তিনি লেখেন-
এদেশ ছাড়বি কিনা বল
নইলে কিলের চোটে হাড় করিব জল।
আরও লেখেন ‘ভাঙার গান’, ‘বিষের বাঁশী’, ‘প্রলয় শিখার’ মত বিদ্রোহী কাব্য। ইংরেজ সরকার রেগে গেলেন, কবিকে ঢোকালেন জেলে। কিন্তু জেলে ঢোকালে কি হবে? তিনি সেখান থেকেই অন্যান্যদেরকে সঙ্গে নিয়ে ঘোষণা করলেন-
এই শিকল পরা ছল মোদের
এই শিকল পরা ছল
এই শিকল পরেই শিকল তোদের
করবো রে বিকল।
তিনি আরো বললেন-
কারার ঐ লৌহ–কপাট
ভেঙ্গে ফেল্ কর্ রে লোপাট রক্ত –জমাট
শিকল –পূজার পাষাণ –বেদী!
ওরে ও তরুণ ঈশান!
বাজা তোর প্রলয় –বিষাণ ! ধ্বংস –নিশান
উঠুক প্রাচী –র প্রাচীর ভেদি’।। ইত্যাদি।
গানের ক্ষেত্রে বিদ্রোহী শাহজাদা সবার ওপরে। গানের মুকুটহীন এই সম্রাট এর রেকর্ডকৃত গানের সংখ্যা অন্য সকলের চেয়ে বেশি।
তিনি ছোটদের মনের কথাটা খুলে বলতে পারতেন। আর কেউ তাঁর মত সুন্দর করে বলতে পারেন নি। তাই তিনি সবার মত ছোটদেরও আত্মার আত্মীয়, একান্ত আপনজন। যেমন-
“আমি হব সকাল বেলার পাখি
সবার আগে কুসুম বাগে উঠব আমি ডাকি।
“সুয্যি মামা জাগার আগে উঠব আমি জেগে,
‘হয়নি সকাল, ঘুমোও এখন’, মা বলবেন রেগে।
বলব আমি- ‘আলসে মেয়ে ঘুমিয়ে তুমি থাক,
হয়নি সকাল, তাই বলে কি সকাল হবে নাক’?
আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে ?
তোমার ছেলে উঠবে মা গো রাত পোহাবে তবে।
‘খুকু ও কাঠ বেড়ালী’ ছড়াটি কি তোমাদের মনে পড়ে? হ্যাঁ! কি যেন-
কাঠবেড়ালি! কাঠবেড়ালি! পেয়ারা তুমি খাও?
গুড়-মুড়ি খাও? দুধ-ভাত খাও? বাতাবি-নেবু? লাউ?
বেড়াল-বাচ্চা? কুকুর-ছানা? তাও-
ডাইনি তুমি হোঁৎকা পেটুক,
খাও একা পাও যেথায় যেটুক!
বাতাবি-নেবু সকলগুলো
একলা খেলে ডুবিয়ে নুলো!
তবে যে ভারি ল্যাজ উঁচিয়ে পুটুস পাটুস চাও?
ছোঁচা তুমি! তোমার সঙ্গে আড়ি আমার! যাও!
‘ভোর হলো’ কবিতাটি তোমাদের সবারই একান্ত প্রিয়, কি বলো? সবার মুখস্ত আছে নিশ্চয়ই-
ভোর হল, দোর খোল,
খুকুমণি ওঠ রে।
ঐ ডাকে জুঁই শাখে,
‘ফুল খুকী ছোট রে।
খুলি’ হাল তুলি’ পাল
ঐ তরী চলল।
এই বার এই বার
খুকু চোখ খুলল।
এত বড় কবি হয়েও তিনি ছিলেন খুব হাসি-খুশী ও রসিক মানুষ। হো হো করে অট্টহাসি হাসতেন। ছোটরা যে নানা দাদার সাথে হাসি তামাশা করে কবি সেটা তাঁর ‘খাঁদু দাদু’ কবিতায় সুন্দর করে তুলে ধরেছেন।
যেমন-
অমা! তোমার বাবার নাকে কে মেরেছে ল্যাং?
খাঁদা নাকে নাচছে ন্যাদা নাক ড্যাঙা ড্যাং ড্যাং।
ওঁর নাকটাকে কে করল খাঁদা র্যাঁদা বুলিয়ে?
চামচিকে ছা বসে যেন ন্যাজুড় ঝুলিয়ে!
বুড়ো গরুর পিঠে যেন শুয়ে কোলা ব্যাং!
অমা! আমি হেসেই মরি নাক ড্যাঙা ড্যাং ড্যাং
ওঁর খ্যাদা নাকের ছেঁদা দিয়ে টুকি কে দেয় ‘টু’।
ছোড়দি বলে সর্দি ওটা, এরাম! ওয়াক থুঃ।
কাছিম যেন উপুর হয়ে ছাড়িয়ে আছেন ঠ্যাং।
অমা! আমি হেসেই মরি, নাক ড্যাঙা ড্যাং ড্যাং।
দাদুর নাকি ছিল না মা অমন বাদুড়- নাক
ঘুম দিলে ঐ চ্যাপটা নাকেই বাজতো সাতটা শাঁখ।
দিদিমা তাই থ্যাবড়া মেরে ধ্যাবড়া করেছেন!
অ মা! আমি হেসে মরি, ন্যাক ডেঙ্গাডেং ড্যাং।
বিয়ের মত খোশ খবর পেলে ছোটরা যে কি মজা পায়, নিজেরাই বিয়ে করার জন্য বায়না ধরে। ‘খোকার খুশী’ কবিতায় কবি সুন্দর করে ছোটদের মনের ভাবটা তুলে ধরেছেন-
কি যে ছাই ধানাই পানাই ,
সারাদিন বাজছে সানাই।
এদিকে কারুর গা নাই
আজিনা মামার বিয়ে!
বিবাহ! বাহ কি মজা
সারাদিন গন্ডা গজা
গপাগপ খাওনা সোজা
দেয়ালে ঠৈসান দিয়ে।।
এই কবিতারই শেষে বলেছেন-
সত্যি, কওনা মামা
আমাদের অমনি জামা
অমনি মাথায় ধামা
দেবেনা বিয়ে দিয়ে?
মামীমা আসলে এ ঘর
মোদেরও করবে আদর?
বাহ! কি মজার খবর।
আমি রোজ করব বিয়ে।।
ওদিকে ‘খোকার বুদ্ধি’ কবিতা পড়লে তো হাসিতে দম আটকে আসতে চাইবে।
সাতটি লাঠিতে ফড়িং মারেন
এমনি পালোয়ান।
দাঁত দিয়ে সে ছিঁড়লো সেদিন
আস্ত আলোয়ান!
ন্যাংটা-পুঁটো দিগম্বরের দলে তিনিই রাজা,
তাঁরে কিনা বোকা বল? কি এর উচিত সাজা?
‘খোকার গল্প বলা’ কবিতাটাতো আরো মজার, আরো আনন্দের। বলতে গেলে তোমাদের জন্য এক থালা গরম সন্দেশ।
মা ডেকে কন, ‘ খোকন-মণি! গপ্প তুমি জান?
কও তো দেখি বাপ!’
কাঁথার বাহির হয়ে তখন জোর দিয়ে এক লাফ
বললে খোকন, গপ্প জানি, জানি আমি গানও!’
ব’লেই ক্ষুদে তানসেন সে তান জুড়ে জোর দিল-
‘একদা এক হাঁড়ের গলায় বাঘ ফুটিয়াছিল!’
এই কবিতার অন্যত্র বলেছেন-
একদিন না রাজা-
হরিণ শিকার করতে গেলেন খেয়ে পাঁপড় ভাজা
রাণী গেলেন তুলতে কলমি শাক
বাজিয়ে বগল টাক ডুমাডুম টাক
রাজা শেষে ফিরে এলেন ঘরে-
হাতীর ম-মতন একটা বেড়াল বাচ্চা শিকার করে।
‘পিলে পটকা’ কবিতাটিতেও প্রচুর হাসির খোরাক মিলে-
উটমুখো সে সুঁটকো হাশিম
পেট যেন ঠিক ভুটকো কাছিম।
চুলগুলো সব বাবুই দড়ি-
ঘুসকো জ্বরের কাবুয় পড়ি।
তিন কেনা ইয়া মস্ত মাথা,
ফ্যাচকা চোখে; হন্ত? হাঁ তা
ঠিক গরিলা, লোবনে ঢ্যাঙা!
নিট পিঠে ঠ্যাং সজনে ঠ্যাঙা।
কল্পনাপ্রবণ শিশুরা কল্পনায় সাত সমুদ্র তের নদী পাড়ি জমায়।
যেমন-
থাকব না’ক বদ্ধ ঘরে
দেখব এবার জগৎটাকে
কেমন করে ঘুরছে মানুষ
যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে।
দেশ হতে দেশ দেশান্তরে
ছুটছে তারা কেমন করে,
কিসের নেশায় কেমন করে
মরছে যে বীর লাখে লাখে।
কিসের আশায় করছে তারা
বরণ মরণ যন্ত্রণাকে।
কবির এই সংকল্প কবিতাটি শিশু মনের চিরন্তন খোরাক। কবিতাটিতে শিশু মনের নানা কথা বলা হয়েছে, যা শিশুদের জন্য একান্ত আপন। কবিতাটির শেষ দু’লাইন হচ্ছে-
পাতাল ফেড়ে নামব আমি
উঠব আমি আকাশ ফুঁড়ে,
বিশ্বজগৎ দেখব আমি
আপন হাতের মুঠোয় পুরে।
অন্যত্র ‘সাত ভাই চম্পা’ কবিতায় কবি লিখেছেন-
সপ্ত সাগর পাড়ি দেব আমি সওদাগর
সাত সাগরে ভাসবে আমার সপ্ত-মধুকর।
সব কালের সব ধরনের শিশুদের ফলমূল চুরি করে খাওয়ার মত রোমাঞ্চকর অভ্যেস প্রচলিত আছে। আম, জাম, লিচু এগুলো তাদের কাছে লোভনীয়ও বটে। তবে এ সমস্ত কাজ নির্বিঘ্নে করা সম্ভব নয়, বিপদ আপদ এসে ঘাড়ে চাপে। সে কথাটি কবির ‘লিচুচোর’ কবিতায় অত্যন্ত নিপুণভাবে ফুটে উঠেছে।
বাবুদের তাল-পুকুরে
হাবুদের ডাল-কুকুরে
সে কি বাস করলে তাড়া,
বলি থাম একটু দাড়া।
পুকুরের ঐ কাছে না
লিচুর এক গাছ আছে না
হোথা না আস্তে গিয়ে
য়্যাব্বড় কাস্তে নিয়ে
গাছে গো যেই চড়েছি
ছোট এক ডাল ধরেছি,
ও বাবা মড়াত করে
পড়েছি সরাত জোরে।
পড়বি পড় মালীর ঘাড়েই,
সে ছিল গাছের আড়েই।
ব্যাটা ভাই বড় নচ্ছার,
ধুমাধুম গোটা দুচ্চার
দিলে খুব কিল ও ঘুষি
একদম জোরসে ঠুসি।
তাঁর ঝিঙে ফুল কবিতা অপূর্ব ছন্দে রচিত। ছোটরা যখন কবিতা পড়ে তখন তারা ছন্দের দোলায় দুলে ওঠে-
ঝিঙে ফুল। ঝিঙে ফুল।
সবুজ পাতার দেশে
ফিরোজিয়া ফিঙে ফুল
ঝিঙে ফুল—-।
গুল্মে পর্ণে
লতিকার কর্ণে
ঢল ঢল স্বর্ণে
ঝলমল দোলে দুল
ঝিঙে ফুল।।
মোটকথা কবির ছিল একটা সুন্দর শিশু মন। যে মন দিয়ে তিনি বাংলার প্রতিটি শিশুর মনের কথা বুঝতে পারতেন।
কাল ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে কবি লেখার কাজ বেশিদিন চালাতে পারেন নি। কলম গেল বন্ধ হয়ে, মুখের ভাষাও আর শুনতে পেলনা কেউ। এরপরও দীর্ঘ ছত্রিশ বছর বেঁচে থাকার পর আমাদের রাজধানী ঢাকা শহরের পিজি হাসপাতালে ১৯৭৬ সালের ২৯শে অগাস্ট তারিখে ‘বিদ্রোহী শাহজাদা’ সবার সাথে বিদ্রোহ করে সর্বশ্রেষ্ঠ বাদশাহ সবার যিনি সৃষ্টিকর্তা সেই আল্লাহর দরবারে পাড়ি জমালেন। ইন্নালিল্লাহে ———-রাজিউন।
কবির একান্ত ইচ্ছা ছিল মৃত্যুর পর তার কবর যেন মসজিদের পাশে হয়।
মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই
যেন গোরে থেকেও মুয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই।
তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশেই তাঁকে কবর দেয়া হয়েছে। একবার এসে তোমাদের প্রিয় ‘বিদ্রোহী শাহজাদার’ কবরটি যিয়ারত করে যেও। কেমন?
পল্লীকবি জসীম উদ্দীন
আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা ফুল তুলিতে যাই
ফুলের মালা গলায় দিয়ে মামার বাড়ি যাই।
হ্যাঁ। এ জসীম উদ্দীনে কবিতার লাইন। জসীম উদ্দীনের কবিতার ধরনই আলাদা, স্বাদই আলাদা। তিনি গ্রাম বাংলার সাধারণ আষয় বিষয়, সাধারণ মানুষের জীবন অত্যন্ত সহজ সরল ভাষায় পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। সত্যিকার অর্থে এমনটি আর কোন কবি সাহিত্যিক করেন নি। যার কারণে বাংলার মানুষ তাদের এই প্রিয় কবিকে পল্লীকবি বিশেষণে বিশেষিত করেছে।
১৯০৩ সালে ১ জানুয়ারী ফরিদপুর সংলগ্ন তাম্বুলখানা গ্রামে মামার বাড়িতে জসীম উদ্দীন জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈত্রিক নিবাসও ফরিদপুর জেলা শহরের উপকন্ঠ গোবিন্দপুর গ্রামে। কবির পিতার নাম মৌলভী আনসার উদ্দীন। তিনি অত্যন্ত সুপুরুষ ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন। আনসারউদ্দীন সাহেব এর হাত দু’টি ছিল আজানুলম্বিত এবং মুখ ভরা ছিল চাপ দাড়ি। এতে করে কবির পিতাকে অসম্ভব সুপুরুষ ও সুদর্শন মনে হত। তা’ছাড়া সাদা ধুতি পরে, গায়ে পাঞ্জাবী চাপিয়ে যখন মাথায় টুপি দিতেন তখন তাঁকে আরো আকর্ষণীয় চেহারার মানুষ মনে হত। সাদা পরিপাটি ও পরিচ্ছন্ন কবির পিতা গ্রামের এম.ই স্কুলের শিক্ষক ছিলেন।
জসীম উদ্দীনের লেখাপড়ার হাতে খড়ি হয় তাঁর পিতা আনসার উদ্দীনের হাতে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় পার্শ্ববর্তী শোভারামপুরের আম্বিকা পন্ডিতের পাঠশালায়। এখান থেকে তিনি গ্রামের এম.ই স্কুলে চলে আসেন এবং পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠ গ্রহণ করেন। ঐ পঞ্চম শ্রেণীতে পড়াকালে তাঁকে ফরিদপুর জেলা স্কুলে ভর্তি করা হয়। আজন্ম রসিক জসীম উদ্দীন এ স্কুলে ভর্তি হবার পর স্কুলের শিক্ষক ও ছাত্ররা তাঁকে কিভাবে গ্রহণ করেছিল তা অত্যন্ত রসিয়ে বর্ণনা করেছেন। তিনি লিখেছেন, “সন্নাসীর ভক্ত হইয়া আমি পায়ে জুতা পরিতাম না। পাড়হীন সাদা কাপড় পড়িতাম। ক্লাসের ছাত্ররা প্রায় সবাই শহরবাসী। আামকে তাহারা গ্রাম্য ভূতের মতই মনে করিত। আমি কাহারো কাছে যাইয়া বসিলে সে অন্যত্র বসে। আমি শত চেষ্টা করিয়াও কাহারো সাথে ভাব জমাতে পারি নাই। আমি সঙ্কোচে পেছনের বেঞ্চে আমার চাচাতো ভাই নেহাজ উদ্দীনের সঙ্গে জড়সড় হইয়া বসিয়া থাকিতাম। শিক্ষকেরা অন্য ছাত্রদের লইয়া কতো হাসি তামাসা করিতেন, এটা ওটা প্রশ্ন করিতেন। আমাদিগকে কিছুই জিজ্ঞাসা করিতেন না।”
বুঝতেই পারছো, কবির এ বর্ণনার মধ্যে তাঁর ছোটকালের ব্যথাতুর মনের পরিচয় পাওয়া যায়। শত অবহেলার মধ্যেও এ স্কুল হতেই কবি ১৯২১ সালে দ্বিতীয় বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ হতে ১৯২৪ সালে আই.এ এবং ১৯২৯ সালে বি.এ পাশ করেন। বিএ পাশ করার পর তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং ১৯৩১ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এম.এ পাশ করেন।
জসীম উদ্দীনের বাল্যকাল খুবই আর্থিক অনটনের মধ্য দিয়ে কেটেছে। তিনি নিজেই লিখেছেন, “আমাদের দু’খানা খড়ের ঘর। চারিধারে নলখাগড়ার বেড়া। চাটাইয়ের কেয়ার বা ঝাঁপ বাঁধিয়া ঘরের দরজা আটকানো হয়। সেই ঘরের অর্ধেক খানিতে বাঁশের মাচা। মাচায় ধানের বেড়ি, হাড়ি-পাতিল থরে থরে সাজানো। সামনে সুন্দর কারুকার্য্ খচিত বাঁশের পাতলা বাখারী দিয়া নক্সা করা একখানি বাঁশ টাঙান।…………এই ঘরের মেঝেতে সপ বিছাইয়া আমরা শুইয়া থাকিতাম।—–বাজান ঘর-সংসারের কাজ ফেলিয়া স্কুলে যাওয়া আসা করিতেন বলিয়া দাদা ছমির উদ্দীন মোল্লা বাজানের ওপর বড়ই চটা ছিলেন। বাজান তাঁহার একমাত্র পুত্র। বৃদ্ধ বয়সে তিনি সংসারের সকল কাজ দেখাশুনা করিতে পারিতেন না। কোনো কঠিন কাজ করিতে কষ্টসাধ্য হইলে তিনি বাজানকে খুব গালমন্দ করিতেন।” সত্যিই কবি সবদিক থেকে এদেশের মানুষের হৃদয়ের অত্যন্ত কাছাকাছির মানুষ ছিলেন।
কবির পিতা আনছারউদ্দীন সাহেব যেমন অত্যন্ত পরিপাটি ও ছিমছাম মানুষ ছিলেন, কবি ঠিক তার উল্টো অর্থাৎ অগোছালো ছিলেন। বাল্যকালে কবি এক সাধুর শিষ্য হয়েছিলেন। সাধুর প্রতি অগাধ বিশ্বাসের কারণে তিনি সাধুর জীবন গ্রহণের মানসে ঐ বাল্যকালেই পায়ে জুতা পরিতেন না, গায়ে জামা পরতেন না। শুধুমাত্র পাড়হীন একখন্ড সাদা ধুতির মত কাপড় দিয়েই সব কাজ চালাতেন। কখনো যদি জামা পরেছেন তো সে জামা হতো বোতামহীন।
কবির বাবা আনসারউদ্দীন ও একজন স্বভাব কবি ছিলেন। তিনি কথায় কথায় কবিতা ছড়া বাঁধতে পারতেন বলে জানা যায়। এ প্রসংগে ইসলামী বিশ্বকোষ লিখেছে, “বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ছিল তাঁর অগাধ অনুরাগ। তাঁহার কবিত্বও শক্তিও ছিল। গাজীপুর উপজেলার কবি গোবিন্দদাসের ন্যায় তিনি স্বভাব কবি ছিলেন। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে পদ্য রচনা করিতে পারিতেন। জসীমউদ্দীন উত্তরাধিকার সূত্রে সকল পৈতৃক গুণের অধিকারী হয়েছিলেন।”
দশম শ্রেণীতে পড়াকালীন জসীম উদ্দীন রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত ‘কবর’ কবিতা যা ১৯২৬ সালে ‘কল্লোল’ পত্রিকার তৃতীয় সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। ‘কবর’ পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর রাতারাতিই জসীম উদ্দীনের কবিখ্যাতি বাঙালী পাঠকের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। রবীন্দ্র-নজরুল যুগে সম্পূর্ণ ভিন্ন সুরের এ কবিতা পড়ে ডঃ দীনেস চন্দ্র সেন কবিকে লিখেন, “দুরাগত রাখালের বংশী ধ্বনির মত তোমার কবিতা আমার অন্তরকে স্পর্শ করেছে। তোমার কবিতা পড়ে আমি কেঁদেছি।” ডঃ সেন ইংরেজী পত্রিকা Forward এ জসীম উদ্দীনের ওপর একটি পুরো ইংরেজী প্রবন্ধ লিখেন, যার শিরোনম ছিল `An young mohammadan poet’.
সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনা হলো, কবি যখন বিএ ক্লাসের ছাত্র তখনই এই ‘কবর’ কবিতাটি পুস্তকে সংকলিত হয় এবং ম্যাট্রিক ক্লাসে পাঠ্য হয়।
ছাত্রাবস্থায়ই কবি কর্মজীবনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯২৪ সালে তিনি ৭০ টাকা আর্থিক মাসোহারার বিনিময়ে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন পল্লী সাহিত্য সংগ্রাহক নিযুক্ত হন। এম.এ পাস করার পূর্ব পর্যন্ত এ কাজে নিযুক্ত ছিলেন। এরপর ড. দীনেস চন্দ্র সেনের অধীনে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রামতন লাহিড়ী রিসার্চ এসিস্ট্যান্ট নিযুক্ত হন এবং ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত নিযুক্ত ছিলেন।
১৯৩৭ সালে কবি বিবাহ করেন। পরের বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন এবং ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত কৃতিত্বের সাথে শিক্ষকতা করেন। ১৯৪৪ সালে অবিভক্ত বাংলার প্রাদেশিক সরকারের প্রচার বিভাগের পাবলিসিটি অফিসার পদে যোগ দেন এবং ১৯৬৮ সালে ডেপুটি ডিরেক্টর হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। এ সময়ে কন্ঠশিল্পী আব্বাস উদ্দীন তাঁর সহকর্মী ছিলেন।
কবির মনটি ছিল আকাশের মত উদার। আর সে মানুষ যদি হয় গায়ের লোক, বা তোমাদের শিশু কিশোর তা’হলে তো কথাই নেই। ছোট সুন্দর ফুটফুটে খুকী দেখলে কবি অমনি খলবলিয়ে বলে উঠেন-
“এই খুকীটি আমায় যদি একটু আদর করে
একটি ছোট কথা শোনায় ভালবাসায় ভরে;
তবে আমি বেগুন গাছে টুনটুনিদের ঘরে,
যত নাচন ছড়িয়ে আছে আনব হরণ করে;
তবে আমি রূপকথারি রূপের নদী দিয়ে,
চলে যাব সাত সাগরে রতন মানিক নিয়ে;
তবে আমি আদর হয়ে জড়াব তার গায়,
নুপুর হয়ে ঝুমুর ঝুমুর বাজত দুটি পায়।”
আসমানী কবিতায় দরিদ্র, অভাব অনটনে জর্জরিত শিশুদের নিয়ে তিনি লিখেছেন-
“পেটটি ভরে পায় না খেতে, বুকের কখান হাড়,
সাক্ষী দিছে অনাহারে ক’দিন গেছে তার।
মিষ্টি তাহার মুখটি হ’তে হাসির প্রদীপ রাশি
তারপরেতে নিবিয়ে গেছে দারুণ অভাব আসি।”
এমনি দরদ দিয়ে লিখতে পারা সত্যি সবার পক্ষে সম্ভব নয়।
ছোটদেরকে তাঁর বাড়িতে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে লিখেছেন-
“আমার বাড়ি যাইও পথিক
বসতে দেবো পিঁড়ে
জলপান যে করতে দেবো
শালি ধানের চিড়ে।
উড়কি ধানের মুড়কি দেব
বিন্নী ধানের খই
ঘরে আছে ফুল বাতাসা
চিনি পাতা দই।”
কি জিহবায় পানি এসে যাচ্ছে, তাই না? আবার শহুরে বন্ধুকে নিমন্ত্রণ করে লিখেছেন-
“তুমি যাবে ভাই যাবে মোর সাথে
আমাদের ছোট গায়
গাছের ছায়ায় লতায় পাতায়
উদাসী বনের বায়।”
ইত্যাদি হাজারো উদ্ধৃতি দেওয়া যাবে তাঁর লেখা হতে।
তাঁর শিশুতোষ লেখার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বইগুলো হচ্ছে- হাসু, একপয়সার বাঁশি, ডালিম কুমার এবং বাংগালীর হাসির গল্প ১ম ও দ্বিতীয় খন্ড। তিনি শুধু ছোটদের জন্যই লিখেন নি, বড়দের নিয়েও প্রচুর লিখেছেন। তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা কাব্য ২০ খানা, নাটক ১৩ খানা, জারী ও মুর্শিদী গানের সম্পাদনা করেছেন দু’খানা বই।
কবির বহুল পাঠ্য কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে নকশী কাঁথার মাঠ, সোজন বাদিয়ার ঘাট ও রাখালী। যা দেশে বিদেশে কবিকে বহুল পরিচিতি ও খ্যাতির আসনে সমাসীন করেছে।
নকশী কাঁথার মাঠ, বেদের মেয়ে, বাংলাদেশের হাসির গল্প ও জসীম উদ্দীনের নির্বাচিত কবিতা ইংরেজী ভাষায় অনূদিত হয়েছে। কবি বিশ্বের বহু দেশ ভ্রমণ করেছেন। তিনি ‘হলদে পরীর দেশ’ নামক গ্রন্থের জন্য ইউনেসকো পুরস্কার লাভ করেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলেও সত্য যে বাঙালীর এই প্রিয় কবি, পল্লী কবিকে বাংলা একাডেমী কোন সম্মানে ভূষিত করেনি। এটা বাংলা একাডেমী ও এ জাতির জন্য সত্যিই লজ্জার। অবশ্য তাঁর বাসস্থান ‘পলাশ বাড়ি’ যে রোডে অবস্থিত তার নাম ‘কবি জসীম উদ্দীন স্মরণী’ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আবাসিক হলের নাম ‘কবি জসীম উদ্দীন হল’ রাখা হয়েছে।
কবি জসীম উদ্দীন তাঁর নিজ বাসভবন ‘পলাশ বাড়ি’তে ১৯৫৩ সাল হতে একটি সাহিত্য সভার আয়োজন করে আসছিলেন, যা আমৃত্যু জারি রেখেছিলেন। ১৯৭৬ সালের ১৪ মার্চ তারিখে সাহিত্য সভায় উপস্থিত হওয়ার জন্য সাহিত্যিক সাংবাদিক মোদাব্বের ও কবি আজিজুর রহমান উপস্থিত হয়ে সাহিত্য সভার বদলে কবির জানাযা পড়েছিলেন। অর্থাৎ ১৯৭৬ সালের ১৪ মার্চ তারিখে বাংলার আপামর জনসাধারণের নয়নের মণি পল্লীকবি জসীমউদ্দীন ইন্তিকাল করেন। এ সময়ে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর।
বন্দে আলী মিয়া
তোমাদেরকে এখন এমন এক ব্যক্তিত্বের কথা বলব যিনি তাঁর সিংহভাগ সময় এবং শ্রম তোমাদের জন্যই ব্যয় করেছেন। তিনি হলেন কবি বন্দে আলী মিয়া। জানি এ নামটি তোমাদের পরিচিত ও প্রিয়। বন্দে আলী মিয়া ১৯০৬ সালের ১৭ জানুয়ারী পাবনা শহরের শহরতলীর রাধানগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কবির পিতার নাম মুনসী উমেদ আলী মিয়া এবং মাতার নাম নেকজান নেছা। সাহিত্যে প্রায় সকল বিষয়ে-ছড়া, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, জীবনী, রহস্য-রোমান্স, রূপকথা, উপকথা ইত্যাদি নিয়ে তিনি লিখেছেন। এসব বিষয়ে তিনি বড়দের জন্য যেমন লিখেছেন, ছোটদের জন্য লিখেছেন তার ঢের বেশি। তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থে একজন স্বার্থক শিশু সাহিত্যিক।
কবি বন্দে আলী মিয়ার শিক্ষা জীবন শুরু হওয়ার পূর্বেই তাঁর স্নেহময়ী পিতা ইন্তিকাল করেন। মা নেকজান নেছা ইয়াতীম শিশুপুত্রকে গ্রামের মজুমদার একাডেমীতে ভর্তি করে দেন এবং এখান হতেই ১৯২৩ সালে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ছবি আঁকতে কবি খুব ভালবাসতেন। প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাসের পর তিনি কলকাতার বৌ বাজারে অবস্থিত ইন্ডিয়ান আর্ট একাডেমীতে ভর্তি হন এবং ১৯২৭ সালে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। এরপর বিখ্যাত সাহিত্যিক প্রিন্সিপ্যাল ইব্রাহীম খাঁর উৎসাহে তিনি টাঙ্গাইলের করটিয়া সাদত কলেজে আই.এ ভর্তি হন। কিন্তু কলকাতা ছেড়ে মফস্বলের কলেজ ভাল না লাগায় ১৯২৯ সালে কলেজ ত্যাগ করেন ও তাঁর আর পড়াশোনা সম্ভব হয়ে ওঠে নি। এরপরই বন্দে আলী মিয়া মায়ের একান্ত আগ্রহে বগুড়া শহরের বৃন্দাবন পাড়া নিবাসী রাবেয়া নামের এক সুন্দরী রমনীকে বিয়ে করে সংসারী হয়ে ওঠেন।
কবি বন্দে আলী মিয়া ১৯৩০ সালে কলকাতা কর্পোরেশন পরিচালিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে চাকরি গ্রহণ করেন এবং একটানা কুড়ি বছর এ চাকরিতে বহাল ছিলেন। এই শিক্ষকতার জীবনেই তিনি শিশুদের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং ভালভাবে শিশুমনকে জানার সুযোগ পান। তিনি নিজেও ব্যক্তিগত জীবনে শিশুদের মতই সহজ সরল ছিলেন। তাঁর মুখে সব সময় হাসির একটা মিষ্টি ঝিলিক ছড়িয়ে পড়তো। দেখামাত্রই ছোটদেরকে কাছে টানার তাঁর চমৎকার সম্মোহনী ক্ষমতা ছিল। শিশুদের কাছে তিনি কবি দাদু হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। তিনি ঐ সময়ে ‘ছেলে ঘুমানো’ নামক শিশু অনুষ্ঠানের জন্য প্রতিদিন শিশু উপযোগী গল্প গান ইত্যাদি লিখে দিতেন।
কবি নবম শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালে ‘বেঙ্গল গেজেট’ পত্রিকায় তাঁর ‘ছিন্নমূল’ কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়। ১৯২৭ সালে কবির শিশু কিশোরদের উপযোগী প্রথম বই ‘চোর জামাই’ প্রকাশিত হয়। এ বইয়ের ছবিগুলি কবির নিজের হাতে আঁকা। ‘চোর জামাই’ প্রকাশিত হওয়ার পর কবি ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। ছবি এঁকেও কবি ব্যাপক খ্যাতি লাভ করেছিলেন। দৈনিক আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর আঁকা মোনাজাতের ছবিটি ব্যাপক প্রচার ও প্রশংসা লাভ করে।
কবি বন্দে আলী মিয়ার তোমাদের জন্য লেখা অনেক মনগড়া কবিতা রয়েছে।
যেমন-
আমাদের ছোট গাঁয়ে ছোট ছোট ঘর
থাকি সেথা সবে মিলে নাহি কেহ পর।
পাড়ার সকল ছেলে মোরা ভাই ভাই
একসাথে খেলি আর পাঠশালে যাই।
আমাদের ছোট গ্রাম মায়ের সমান
আলো দিয়ে, বায়ু দিয়ে বাঁচাইছে প্রাণ।
মাঠ ভরা ধান তার জল ভরা দিঘী,
চাঁদের কিরণ লেগে করে ঝিকিমিকি। (আমাদের গ্রাম)।
কি চমৎকার কবিতা, তাই না? কবিতাটি ভিতর কোন যুক্তাক্ষর নেই। কারণ কবি শিশু মন বুঝতেন, তাঁদের কষ্টের কথা বুঝতেন। তাই তিনি যতদূর সম্ভব সহজ সরল অথচ সুন্দর ভাষায় লিখেছেন।
তিনি লিখেছেন-
আয় আয় পিস পিস,
দেখ ভাই ময়না,
চুপ চুপ, গোলমাল
কথা আর কয় না। (আফরোজার পুষি)।
ব্যাঙের বিয়ে ছড়াতে লিখেছেন-
ছোট কোলা ব্যাং
ডাকে গ্যাং গ্যাং।
তার নাকি বিয়ে
টুপি মাথায় দিয়ে।
কবি বন্দে আলী মিয়ার প্রায় পৌণে দুইশত বই এর মাঝে ১২৫ খানা বই-ই ছোটদের উপযোগী। এর মধ্যে ইতিহাস আশ্রয়ী বই, যেমন-ছোটদের বিষাদ সিন্ধু, তাজমহল, কোহিনূর, কারবালার কাহিনী ইত্যাদি। তিনি কোরআন ও হাদীসের কাহিনী নিয়েও গল্প লিখেছেন, আবার গুলিস্তাঁর গল্প, ঈশপের গল্প, দেশ-বিদেশের গল্প, শাহনামার গল্প। তিনি অনেকগুলি জীবনী লিখেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- আমাদের নবী, হযরত আবূ বকর, হযরত ওমর ফারুক, হযরত খাদিজা, হযরত আয়েশা সিদ্দিকা, হযরত ফাতিমা, হযরত মূসা, তাপসী রাবেয়া, সিরাজউদ্দৌলা, হাজী মহসিন, ছোটদের নজরুল ইত্যাদি।
এসব লেখার মধ্য দিয়ে তিনি আগামী দিনের নাগরিক শিশু কিশোরদের চরিত্র গড়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। তিনি ভাল করেই জানতেন-
‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা
সব শিশুরই অন্তরে।’
ইসলামের সুমহান আদর্শ শিশুদের কাছে পরিষ্কার করে তুলে ধরার জন্য পবিত্র কুরআনের ১৫টি কাহিনী নিয়ে তিনি ১৫টি গল্প লিখেছেন। হৃদয়-গ্রাহী ভাষায় লেখা এ গল্পগুলি হল-আদি মানব ও আজাযিল, স্বর্গচ্যুতি, হাবিল ও কাবিল, মহাপ্লাবন, আদ জাতির ধ্বংস, ছামুদ জাতির ধ্বংস, বলদর্পী নমরুদ, হাজেরার নির্বাসন, কোরবানী, কাবা গৃহের প্রতিষ্ঠা, ইউসুফ ও জুলেখা, সাদ্দাদের বেহেশত, পাপাচারী জমজম, কৃপণ কারুন, ফেরাউন ও মূসা ইত্যাদি।
পবিত্র হাদীস হতে ১৪টি কাহিনী নিয়ে তিনি লিখেছেন ১৪টি গল্প। বইয়ের নাম দিয়েছেন-‘হাদীসের গল্প’। এ বইয়ের গল্পগুলি এ রকম-দীন জনে দয়া করো, সত্য নিষ্ঠার পুরস্কার, ক্ষুধাতুরে খাদ্য দাও, স্বল্প কথা, খোড়া শয়তানের বাহাদুরী ইত্যাদি।
তাঁর গল্প লেখার নমুনা এরকম-‘এক দেশের এক রাজা। রাজার হাতীশালে হাতী, ঘোড়াশালে ঘোড়া, রাজকোষে হীরামানিক, তবু রাজার মনে সুখ নেই। রাজার কোন ছেলে পুলে নেই। একটি মেয়েও যদি হতো তবু রাজা-রাণীর মনে সুখ থাকতো।’
অন্যত্র লিখেছেন-
বাঘঃ হালুম-খক খক খেঁকশিয়াল সাহেব। আদাব।
খেঁকশিয়ালঃ মাননীয় বাঘ বাহাদুর যে, আসুন, আসুন, আদাব। আপনি বনের বাদশা, শত কাজ ফেলে সময় করে যে আমার পুত্রের বিবাহে আসতে পেরেছেন-আমার নসিব। আপনার পলাশ ডাংগায় সবাইকে যে দাওয়াত করেছিলুম, তারা এখনো এসে পৌছুলেন না।
বাঘঃ আমি না আসলে তো কউ আগে আসতে পারেন না। ঐ যে আসছেন সবাই। কি হে পন্ডিত এত দেরী যে?
শৃগালঃ ক্যাহুয়া, ক্যাহুয়া। একটু দেরী হুয়া। আসবার পথে একটা রামছাগলের বাচ্চা পেলুম। নাশতাটা না সেরে আসি কি করে? জানিতো বিয়ে বাড়িতে কখন বরাতে জুটবে বলা যায় না। (বিড়ালের প্রবেশ)।
বাঘঃ পন্ডিত রসিক লোক, নাশতা হয়েছে ভালই হয়েছে। এই যে সরকার সাহেব, আদাব।
বিড়ালঃ আদাব, খেঁকশিয়াল সাহেব। আপনার পুত্রকে এই ইদুরের মুক্তা মালা ছড়া আমার আশীর্বাদ দেবেন।
খেঁকশিয়ালঃ এসব আবার কেন? নিমন্ত্রণ পত্রে তো উল্লেখ ছিল, ‘লৌকিকতার পরিবর্তে আশীর্বাদ প্রার্থনীয়’। তা মালাছড়া যখন এনেছেন-(কুমীরের প্রবেশ)
‘খেঁক শিয়ালের দাওয়াত’ (টোটো কোম্পানীর ম্যানেজার)।
কার না ভাল লাগে পশুদের এমন চমৎকার সংলাপ? কবি বন্দে আলী মিয়া শিশু কিশোর উপযোগী জীবনী গ্রন্থগুলো রচনা করেছেন অসম্ভব হৃদয়গ্রাহী ও আকর্ষণীয় করে। তিনি ‘আমাদের নবী’ গ্রন্থে মহানবী(সা) সম্বন্ধে লিখেছেন, ‘আকাশে শুক্লা দ্বাদশীর চাঁদ। সেই চাঁদের আলোকে চারিদিক পুলকিত। বিবি আমিনা এক ঘরে ছটফট করেছেন। প্রহরের পর প্রহর কাটতে থাকে। নিখিল বিশ্ব স্তব্ধ নীরব। রাতের শেষ প্রহর, চাঁদ আকাশের গায়ে হেলে পড়েছে। বিবি আমিনার আঁধার ঘর আলোকিত করে একটি ফুটফুটে সুন্দর শিশু ভূমিষ্ট হলেন।
………..বাতাস ছুটে এসে খর্জুর বীথি আর আঙ্গুর গুচ্ছকে খোশ আমদেদ জানিয়ে গেল। জাফরানের খুশবু এই খবর নিয়ে ছুটলো মরু আরবের দিগ দিগন্তে।
এসেছে দীনের নবী
মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লে আলা
তাঁহারি রওশানিতে
জাহান হলো উজ্জ্বালা।।
এ প্রাণস্পর্শী বর্ণনা নিঃসন্দেহে বড়দেরও হৃদয় না কেড়ে পারে না।
কবি বন্দে আলী মিয়ার লেখার প্রশংসা করেছেন বাংলা সাহিত্যের বড় বড় দিকপালেরা। এর মধ্যে রয়েছেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহাকবি কায়কোবাদ, কাজী নজরুল ইসলাম, কবি গোলাম মোস্তফা, কবি জসীম উদ্দীন, কবি সমালোচক আবদুল কাদির প্রমুখ। আর ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তাঁর ওপর জ্ঞানগর্ভ একটি পুরো প্রবন্ধ লিখেছিলেন যা ব্যাপড় সাড়া ফেলেছিল। কবির কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৬২ সালে বাংলা একাডেমী তাঁকে শিশু সাহিত্যে পুরস্কার প্রদান করে। আর ১৯৬৫ সালে তাঁকে বাংলা সাহিত্যে বিশেষ অবদান রাখার জন্য দেয়া হয় প্রেসিডেন্ট পুরস্কার।
এই নিরলস শিশু সাহিত্যিক বন্দে আলী মিয়া ২৮ জুন, ১৯৭৯ সালে সবাইকে শোক সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে ইন্তিকাল করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। আমাদের জানামতে তাঁর ২৫ টা অপ্রকাশিত গ্রন্থ রয়েছে যা বাংলা একাডেমী ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মত প্রতিষ্ঠানের পক্ষ হতে প্রকাশ করা উচিত বলে মনে করি। তাঁর রচনাবলীও প্রকাশ হওয়া একান্ত প্রয়োজন।
রাজপুত্তুর কবি
এই হিং নেবে হিং, কিসমিস, খুবানি, আঙুর, পেস্তা, বাদাম, আখরোটঃ নে-বে। লম্বা পিরহানের জেবে কলসী ভাঙা চাড়া, কড়ি এসব ভরে ঝুমুর ঝুমুর শব্দ তুলে দরাজ গলায় হেঁকে চলেছে এক কিশোর। বড় বড় উজ্জ্বল দুটি চোখ। যেন সে দুটি চোখ দিয়ে ঠিকরে পড়ছে সত্যের দ্যুতি। লম্বা বাঁকানো বাঁশির মত নাক, প্রশস্ক কপাল, ঘাড় অবধি নেমে যাওয়া ঝাঁকড়া চুল-সব মিলিয়ে এক অপরূপ রাজপুত্তুর। কাবুলিওয়ালা সাজার ইচ্ছায় যে রাজপুত্তুর বেশ হাঁক-ডাক করতো।
রাজপুত্তুরটির যেমন ছিল দরাজ গলা, আগুনঝরা চোখ, বাবরীদোলানো চুল, তেমনি ছিল দুরন্ত সাহস। ভয় কখনো তাঁর দিলে বাসা বাঁধেনি। যা সত্য, যা সুন্দর তা সে আজীবনই মেনে চলেছে, সমাজেও প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে।
তোমরা হয়ত ভাবছ, সাত সমুদ্র তের নদীর ওপারের কোন কথা বলছি। না, আসলে তা নয়। এর রাজপুত্তুরটি রাজমহল আমাদের দেশের এক গন্ডগ্রামে। অতীতকালে তাঁর এলাকাটা শাসন করেছে রাজা প্রতাপাদিত্য, রাজা বিক্রমাদিত্য, খান জাহান আলীর মত রাজা বাদশাহরা। হ্যাঁ, দেশটির নাম যশোরাদ্য দেশ। পরে এটা যশোর জেলা নামে পরিচিত হয়। এ জেলারই মাগুরা মহকুমার আওতাধীন মাঝাইল গ্রামে সে রাজমহল। রাজপুত্তুরটির নাম ফররুখ। পুরো নাম সৈয়দ ফররুখ আহমদ।
১৯১৮ সালের ১০ই জুন ফররুখ আহমদ এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আব্বা খান সাহেব সৈয়দ হাতেম আলী ছিলেন এক জাঁদরেল পুলিশ অফিসার। মায়ের নাম বেগম রওশন আখতার। মা-বাবার দ্বিতীয় সন্তান তিনি।
গ্রামের স্কুলেই তাঁর লেখাপড়ার হাতেখড়ি। এরপর কলকাতার তালতলি মডেল স্কুলে, বালিগঞ্জ হাইস্কুলে, খুলনা জেলা স্কুলে পড়াশুনা করেন। খুলনা জেলা স্কুল হতে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন। বালিগঞ্জ হাই স্কুলে পড়াকালে কবি গোলাম মোস্তফাকে তিনি শিক্ষক হিসেবে পান। আর খুলনা জেলা স্কুলে পান কবি আবুল হাশিম ও অধ্যাপক আবুল ফজলকে শিক্ষক হিসেবে। কলকাতার রিপন কলেজ হতে ১৯৩৯ সালে তিনি আইএ পাশ করেন। পরে দর্শনে অনার্স নিয়ে বিএ ভর্তি হন। আরো পরে ইংরেজিতে অনার্স নেন। কিন্তু ঐ পর্য্ন্ত যে কোন কারণেই হোক তাঁর আর অনার্স পরীক্ষা দেওয়া হয় নি।
হ্যাঁ, রাজপুত্তুরটি ছিলেন সত্যি সত্যিই রাজপুত্তুরের মত। যখন হাঁটতেন মনে হত কেশর দুলিয়ে সিংহের বাচ্চা হেঁটে যাচ্ছে। হাঙর কুমিরকে থোড়াই কেয়ার করে দলবল নিয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। তিনি বলতেন, ‘হাঙর কুমির যদি থাকে, আমার ভয়েই তারা পালিয়ে যাবে।’ সারা জীবন এমনই তিনি সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন, কারো কাছে কোনদিন কোন কারণে মাথা নত করেন নি।
রাজপুত্তুরটি ছিলেন খুবই ভাবুক প্রকৃতির। রাতের বেলা যখন আকাশে চাঁদ হেসে উঠতো তখন বিছানা ছেড়ে চলে যেতেন ডাহুক ডাকা বাঁশঝাড়টার কাছে। চুপচাপ শুনতেন ডাহুকের ডাক আর কবিতা লিখেতেন-
রাত্রিভর ডাহুকের ডাক……
এখানে ঘুমের পাড়া, স্তব্ধ দীঘি অতল সুপ্তির
দীর্ঘ রাত্রি একা জেগে আছি।
ছলনার পাশা খেলা আজ পড়ে থাক
ঘুমাক বিশ্রান্ত শাখে দিনের মৌমাছি
কানপেতে শোনো আজ ডাহুকের ডাক।
আবার-
তারার বন্দর ছেড়ে চাঁদ চলে রাত্রির সাগরে
ক্রমাগত ভেসে আসে পালক মেঘের অন্তরালে
অশ্রান্ত ডুবুরি যেন ক্রমাগত ডুব দিয়ে তোলে
স্বপ্নের প্রবাল।
মাঝে মাঝে তিনি বাড়ির পুচকে পুচকে পাইক বরকন্দাজ নিয়ে বেড়াতে বের হতেন্, যেন রাজপুত্তুরের হরিণ শিকার। হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতেন মধুমতির তীরে। পলকহীনভাবে দেখতেন নৌকা, লঞ্চ, স্টীমার জাহাজের আনাগোনা। শুনতেন মাঝি-মাল্লার দাঁড় ফেলার শব্দ, হাঁক-ডাক। এসব দেখতে দেখতে তন্ময় হয়ে যেতেন। সাথীদেরকে এসময় দিতেন ভূগোলের জ্ঞান। বলতেন, “পাহাড় হতে এসেছে এই নদী। তারপর চলে গেছে দক্ষিণে, সেখানে আছে বঙ্গোপসাগর, তারপর আরব সাগর। নৌকা চড়ে ভেসে যেতে কোনো বাধা নেই, কোনো মানা নেই। কিন্তু সাবধান, হুঁশিয়ার। আসবে ঝড়, উঠবে তুফান, বড় বড় কুমীর আর হাঙর মাতামাতি করবে। আল্লাহ আল্লাহ করে নৌকা ছাড়লে আর কোন ভয় নেই।”
কবি ফররুখ আহমদ চেয়েছিলেন এই ঘূনে ধরা সমাজটাকে ভেঙ্গে একটা সুন্দর সমাজ গড়তে।
তাঁর কথায়-
আল্লাহর দেওয়া বিশ্ববিধান
ইসলামী শরীয়ত
যে বিধানে মোরা গড়িয়া তুলিব
এই পাক হুকুমত।।
তৌহিদে রাখিয়া দৃঢ় বিশ্বাস
আমরা সৃজিব নয়া ইতিহাস
দেবো আশ্বাস দুনিয়ার বুকে
দেখাব নতুন পথ।।
সারা মুসলিম দুনিয়াকে বেঁধে
একতার জিনজিরে
ফিরায়ে আনাব হারানো সুদিন
নয়া জামানার তীরে।।
আলী, উসমান, উমরের দান
নেব তুলে মোরা জেহাদী নিশান
নেব ফেরা মোর আবূ বকরের
সত্য সে খেলাফত।
কবির দৃঢ় বিশ্বাস আগের দিনে যারা জাতির নেতৃত্ব দিয়েছে, তাঁদের ত্রুটির কারণেই আজ মুসলিম জাতি এই খারাপ অবস্থায় পৌছেছে। যেমন-
শুধু গাফলাতে, শুধু খেয়ালের ভুলে
দরিয়া অথই ভ্রান্তি নিয়াছে তুলে
আমাদেরই ভুলে পানির কিনারে,
মুসাফির দল বসি,
দেখেছে সভয়ে অস্ত গিয়াছে তাদের,
সেতারা শশী।
মোদের খেলাধূলায় লুটায়ে পড়ি
কেঁদেছে তাদের দুর্ভাগ্যের বিস্বাদ শর্ববরী। (পাঞ্জেরী)।
সারা দুনিয়ায় আবার নতুন করে মুসলিম জাগরণ শুরু হয়েছে। আবার যেন নতুন সূর্য্ ওঠার একটা আভাস পাওয়া যাচ্ছে। সেদিকে ইঙ্গিত করে তিনি লিখেছেন-
কেটেছে রঙ্গিন মখমল দিন, নতুন
সফর আজ,
শুনছি আবার নোনা দরিয়ার ডাক,……….
…………………………………………
নতুন পানিতে সফর এবার এ
মাঝি সিন্দাবাদ। (সিন্দাবাদ)।
কিন্তু আমাদের জাতির নেতারা যখন হতাশ, সাহসহারা তখনো রাজপুত্তুর তার সাহসে ভর দিয়ে বলেছেন-
আজকে তোমায় পাল ওঠাতেই হবে,
ছেঁড়া পালে আজ জুড়তেই হবে তালি,
ভাঙ্গা মাস্তুল দেখে দিক করতালি,
তবুও জাহাজ আজ ওঠাতেই হবে। (সাত সাগরের মাঝি)।
কবির রাজপুত্তুরটি তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে একটি কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন। এই দৃঢ় প্রত্যয়ী রাজপুত্তুরটি তার জীবনেও ইসলামী অনুশাসন অক্ষরে অক্ষরে পালন করে গেছেন। কোন ঝড়, কোন বিপদ তাঁকে এপথ হতে চুল পরিমাণও সরাতে পারে নি।
তিনি বিপদ মুসিবতের সময় ভেঙ্গে পড়াকে ঘৃণা করতেন। এই সময় আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে সাহায্য চাওয়াটাও মোটেই পছন্দ করতেন না। কবি লিখেছেন-
তোরা চাসনে কিছু কারো কাছে
খোদার মদদ ছাড়া
পরের ওপর ভরসা ছেড়ে
নিজের পায়ে দাঁড়া।
এমনিভাবে তিনি তাঁর লেখার মাধ্যমে দেশ জাতির মঙ্গল কামনা করেছেন। তিনি তোমাদের জন্য অনেক ভাল ভাল বই লিখেছেন। যেমন-‘পাখির বাসা’, ‘হরফের ছড়া’, ‘নতুন লেখা’, ‘ছড়ার আসর’, ‘নয়া জামাত’, ‘চিড়িয়াখানা’ ইত্যাদি। ‘পাখির বাসা’ বইটির জন্য তিনি ১৯৬৬ সালে ইউনেস্কো পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়াও কবি পেয়েছেন-বাংলা একাডেমী পুরস্কার, একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কার ও ইসলামিক ফাউন্ডেশন পুরস্কার।
এক সংগ্রামী চেচেন নেতা জওহর দুদায়েভ
সাবেক সোভিয়েত রাশিয়ার এক মুসলিম জনপদের নাম রাশিয়া। সত্যি কথা বলতে কি ১৯৯১ সালের ১লা নভেম্বরের আগে বাংলাদেশের মানুষ জানতো না এই মুসলিম অধ্যুষিত জনপদ চেচনিয়ার কথা। এমনকি পশ্চিমা বিশ্বের সাধারণ জনগণও এই জনপদটির খবর রাখত না। ১৯৯১ সালের ২৫শে ডিসেম্বর যখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় দেশ রাশিয়া ১৫টি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে তখন চেচনিয়া স্বাধীনতার ডাক দেয়। রাশিয়ার পনেরটি প্রজাতন্ত্রের বাইরে নব্বইটি স্বায়ত্ত্বশাসিত অঙ্গ প্রজাতন্ত্র এবং অঞ্চলগুলোর মধ্যে চেচনিয়া একটি।
৬০০০ বর্গমাইল আয়তনের এ ক্ষুদ্র জনপদের লোকসংখ্যা ১৯৯০ সালের ১লা জানুয়ারী পর্যন্ত ছিল ১২ লাখ ৮৯ হাজার ৭০০ জন। চেচনিয়ার রাজধানীর নাম গ্রোজনী যার লোকসংখ্যা ছিল ৪ লাখের ওপরে। গ্রোজনী শব্দের অর্থ দুর্দম্য, দুর্দান্ত, দুর্ধর্ষ, জাদরেল ইত্যাদি।
বর্তমানে যুদ্ধের কারণে সমগ্র চেচনিয়াতে মাত্র ৪ লাখের মত লোক অবস্থান করছে, বাকীরা পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে। সাম্প্রতিক যুদ্ধে প্রায় ২ লাখের মত চেচেন মারা গিয়েছে বলে জানা যায়। এর আগে ১৯৪৪ সালে স্টালিন সরকার গণহত্যার মাধ্যমে ‘মুসলিম সমস্যা’ সমাধানের লক্ষ্যে জোরপূর্বক ১২ লক্ষ (ঐ সময় চেচনিয়ায় ১২ লক্ষ মুসলমান ছিল) চেচেন মুসলিমকে কাজাখাস্তানে নির্বাসনে পাঠায়। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এই ১২ লক্ষ চেচেন মুসলিমদের মধ্যে ৩ লক্ষ পথেই মারা যায়।
ইতিহাস হতে জানা যায়, চেচনিয়ার পার্শ্ববর্তী দাগাস্থানের দ্বারবন্ধ শহরে ৬৪৩ সালে ইসলামের পতাকা উত্তোলিত হয়। এর আগে ৬৩৯ সালে আরবরা আজরাবাইজান দখল করে নেয়। অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে পুরো দ্বারবন্ধ এলাকায় ইসলাম প্রসার লাভ করে। কিন্তু পার্শ্ববর্তী চেচনিয়াতে ইসলাম প্রবেশ করতে সময় লাগে। পন্ডিতদের মতে, ত্রয়োদশ চতুর্দশ শতকে চেচনিয়ায় ইসলাম প্রবেশ করে। ষোড়শ শতকের শেষ দিকে এসে চেচেন মুসলমানদের ওপর রুশ বাহিনীর আক্রমণ শুরু হয়। ১৫৯৪ সালে মুসলিম বনাম রুশ বাহিনী উত্তর দাগাস্থানের পুলাক নদীর তীরে রুশ বাহিনীর মুখোমুখি হয়। হঠে যায় রুশ বাহিনী। ১৬০৪ সালে রুশ বাহিনী মুসলিম বাহিনীর ওপর আঘাত হেনে আবার শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। সত্যিকার অর্থে মুসলমানরা রুশ খৃস্টানদের বিরুদ্ধে প্রথম যুদ্ধেই বিরাট বিজয় ছিনিয়ে আনে। প্রকৃত পক্ষে মুসলমানদের বিরুদ্ধে রুশ বাহিনীর সেই যুদ্ধের শুরু।
জাতীয়তার দিক হতে চেচেনরা আলাদা বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। অধিকাংশ জনসংখ্যা তুর্কী বংশোদ্ভুত মুসলমান। জার শাসন ও পরবর্তীকালে সত্তর বছরে কমউনিস্ট শাসনামলে চেচেন মুসলমানদের চেতনাকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হলেও বাস্তবে তা সম্ভব হয় নি। ইতিহাস সাক্ষী চেচনিয়া কোন কালেই রাশিয়ার অংশ ছিল না। ঊনবিংশ শতাব্দীতে চেচনিয়াকে জোরপূর্বক রুশ সাম্রাজ্যভুক্ত করা হয়। বহুকাল ধরে রুশরা বারবার চেচেনদের ওপর হামলা চালিয়েছে কিন্তু চেচেন মুসলমানরা কোনকালেই এই অন্যায় আধিপত্য মেনে নেয় নি। বরং তাদের বিরুদ্ধে ইমাম শেখ মসুর উশুরমা(১৭৩২), শেখ মোহাম্মদ, গাজী মোহাম্মদ, গামজাতবেক, শে হাজী ইসমাঈল, মোল্লা মোহাম্মদ, জামাল উদ্দীন ও ইমাম শামিলরা আপোসহীন জিহাদ পরিচালনা করেছেন। ১৮৫৯ সালের ২৫ শে অগাস্ট ইমাম শামীল রুশ বাহিনীর কাছে সম্মানজনক আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন। গুনিব গ্রামের এ যুদ্ধে ইমাম শামিলের সর্বশেষ ৪০০ মুরীদের প্রায় সবাই শহীদ হন। তারপরও ১৮৫৯-৬৪ সালে পর্যন্ত চেচেনরা ককেশাসের দুর্গম পাহাড়ী অঞ্চলে আশ্রয় নিয়ে গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে ছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে চেচেনরা জার্মানকে সমর্থন দেয়ায় স্ট্যালিন লক্ষ লক্ষ চেচেনকে অত্যন্ত অমানবিকভাবে কাজাখস্থানে নির্বাসন দন্ড প্রদান করে। এই নির্বাসন চলাকালে ১৯৪৪ সালের ১৫ এপ্রিল শহীদ প্রেসিডেন্ট জওহর দুদায়েভ পিয়ার ভোমায়াস্কা এলাকার ইয়ালখের গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আব্বা ছিলেন মূসা এবং মাতার নাম ছিল আলেপতিনা কেদোরভনা দুদায়েভ। দুদায়েভের আব্বা ছিলেন জাতিতে চেচেন এবং মা ছিলেন রুশ। মোট ৭ ভাই বোনের মাঝে দুদায়েভ ছিলেন সবার ছোট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেয়ায় তাঁর আব্বা ও বড় ভাইকে শহীদ করে দেয় স্টালিনবাহিনী।
দুদায়েভ রাডিকাফ কাজে ইলেক্ট্রনিক্স্রের ওপর দু’বছর পড়াশোনার পর সামরিক বাহিনীতে যোগদান করেন। ১৯৬২ সালের রাশিয়ার তাম্বর শহরের বৈমানিক প্রশিক্ষণ কেনেদ্র তাঁর সামরিক শিক্ষা শুরু হয়। জাতিগতভাবেই রুশরা অন্তর থেকেই চেচেনদের ঘৃণা করে। এরপরও জওহর দুদায়েভ আপন প্রতিভা বলে সমস্ত প্রকার বাধা অতিক্রম করে রাশিয়ার সেরা সামরিক স্কুল ইউরি গ্যাগারিন এয়ারফোর্স একাডেমী, মস্কোতে শিক্ষা লাভের সুযোগ পান। সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার গতানুগতিক নিয়মে দুদায়েভ ১৯৬৮ সাল হতে ১৯৯১ সাল পর্য্ন্ত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। ১৯৭৬-৭৯ পর্যন্ত দুদায়েভ রাশিয়ার এয়ারফোর্স রেজিমেন্ট এর চীফ অব স্টাফ, ১৯৭৯-৯০ কমান্ডার অব ডিভিশন এবং ১৯৯০ সালে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন। এরপর দুদায়েভ ১৯৯০-৯১ সেশনের জন্য চেচেন জাতির মহাসম্মেলনের নির্বাহী কমিটির প্রধান ছিলেন। ১৯৯১ সালে তিনি চেচনিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং ১৯৯২ সালে প্রধানমন্ত্রীর পদ ও অলঙ্কৃত করেন।
জওহর দুদায়েভ আল্লা নাম্নী এক রুশ মহিলাকে বিয়ে করেন এবং তাদের ২ ছেলে ও ১ মেয়ে ছিল।
দুদায়েভ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁর মাঝে জাতীয় চেতনা ও অতীত ঐতিহ্যের পরিপূর্ণ বিকাশ দেখতে পাওয়া যায়। ফলে চেচেত জাতির ভেতর তাঁদের পূর্ণ মুসলিমসত্ত্বা জাগ্রত হয়ে ওঠে। তারা সে বছরেই দুদায়েভের নেতৃত্বে চেচনিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণা করে, যে স্বাধীনতা ছিল চেচেন জাতির আবহমানকালের লালিত স্বপ্ন। ১৯৯৪ সালের ১১ই ডিসেম্বর রুশ প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসিন যখন তার তিন ডিভিশন সৈন্যকে চেচনিয়া আক্রমণের নির্দেশ দেন তখন দুদায়েভ চেচেন জাতির আকাঙ্খার প্রতীক হয়ে ওঠেন। চিরসংগ্রামী চেচেন জনগণ তাঁর নেতৃত্বে সুশিক্ষিত বিশাল রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে যে মরনপণ প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল তা যে কোন স্বাধীনতাকামী জাতির জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
১৯৯৫ সালে দুদায়েভের বড় ছেলে রুশদের অস্ত্রে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে শহীদ হন এবং ১৯৯৬ সালের গোড়ার দিকে তাঁর জামাতা সালমান রাদুয়েভও শহীদ হন।
দুদায়েভের প্রিয় শখ ছিল কারাতে ও সঙ্গীত। তিনি পুশকিন ও লের মগুভের কবিতা পড়তে ভালবাসতেন। কারণ ছিল এ দু’জন কবি ককেশাসকে অত্যন্ত ভালবেসেছিলেন এবং ককেশাসের উপর তাদের অত্যন্ত জনপ্রিয় কবিতা আছে।
দুদায়েভ কুরআন তিলাওয়াত করতে ও শুনতে ভালবাসতেন। তিনি খুব ফুল প্রিয় লোক ছিলেন। যে কারণে ফুলের বাগান পর্যন্ত করেছেন। দৈহিকভাবে ছোটখাট এ মানুষটি ছিলেন প্রাণোচ্ছ্বল জীবন্ত এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। এখনকার কিংবদন্তী।
চেচনিয়াকে নিয়ে ছিল তার সীমাহীন স্বপ্ন। তিনি চেয়েছিলেন চেচনিয়ায় স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে। ব্যক্তিগতভাবে তিনি চেচনিয়ার মানুষের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। চেচনিয়াকে তিনি ১৯৯১-১৯৯৪ পর্যন্ত তিন বছরের কিছু বেশি সময় স্বাধীন রাখতে পেরেছিলেন। সত্যি কথা বলতে কি এক দুদায়েভই ছিলেন চেচেন জাতির স্বাধীনতার প্রতীক। দুর্ধর্ষ ককেশীয় চেচেন জাতির প্রাচীন ঐতিহ্যের সার্থক উত্তরাধিকারী।
আজাদী পাগল চেচেনরা পাহাড়ী অঞ্চলে নিজেদের অবস্থান ঠিক করে বিশাল রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আসছিল। কিন্তু হঠাৎ করে ২১শে এপৃল ১৯৯৬ তারিখে চেচনিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলনের অকুতোভয় মহানায়ক, চেচেনদের নয়নের মনি, চিরসংগ্রামী নেতা জওহর দুদায়েভ স্যাটেলাইট ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে গ্রোজনী হতে ৩০ কিমি দূরে জেখেসু গ্রামের একটি মাঠে শাহাদাতবরণ করেন। এ সময় তিনি চেচেন সংকট নিরসনের জন্য মধ্যস্থতার ব্যাপারে স্যাটেলাইট টেলিফোনে আলাপ করছিলেন। জানা যায়, কাপুরুষ ইয়েলৎসিন বাহিনী কৌশলে স্যাটেলাইট টেলিফোনের অবস্থান জেনে নিয়ে রুশ বিমান থেকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। ইতিহাস বলে চেচেন মুসলমানরা আজাদী পাগল এক যোদ্ধা জাতি। সত্যিই তারা হাসিমুখে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে পারে। আর যারা মৃত্যুকে ভয় পায় না, বিজয় তাদের অনিবার্য। হতে পারে সেটা সময় সাপেক্ষ। প্রেসিডেন্ট জওহর দুদায়েভ শহীদ হলেও চেচনিয়ার ঘরে ঘরে হাজার হাজার দুদায়েভ এখন তৈরী হবে, জন্ম নেবে।
— সমাপ্ত —