মহাকবি আল্লামা ইকবাল
‘আরব হামারা চীন হামারা হিন্দুস্তাঁ হামারা
মুসলিম হ্যায় হাম,–ওতন হ্যায়
সারা জাঁহা হামারা।’
কোন কোন মানুষকে আল্লাহ বিশেষভাবে সৃষ্টি করেন দেশ ও জাতির খেদমতের জন্য। শত ঝড়ঝঞ্জা বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে সেসব মানুষ তাঁদের কাজ বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করে যান। আমরা আজকে এমন এক ব্যক্তিত্ব ও কবি পুরুষ সম্বন্ধে আলোচনা করবো।
তোমরা হয়ত কোন না কোনভাবে শুনে থাকবে মহাকবি আল্লামা ইকবাল সম্পর্কে। হয়ত কথাটা এজন্য বললাম যে, বর্তমানে আমাদের দেশে কবি ইকবালকে জানার তেমন সুযোগ নেই। সত্যি কথা বলতে কি এই মহান কবিকে ইচ্ছে করেই এড়িয়ে চলার চেষ্টা করা হচ্ছে।
কবি ইকবাল পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের শিয়ালকোট নামক স্থানে ১৮৭৭ সালের ৯ নভেম্বর এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম শেখ নুর মোহাম্মদ এবং মাতার নাম ইমাম বীবী। কবির পিতা মাতা উভয়ই অত্যন্ত দ্বীনদার ও পরহেজগার মানুষ ছিলেন। কবির পূর্বপুরুষগণ কাশ্মীরবাসী সাপ্রু গোত্রীয় ব্রাহ্মণ পন্ডিত ছিলেন। তাঁরা সুলতান জয়নুল আবেদীন ওরফে বুদ শাহ(১৪২১-১৪৭৩ খৃ) এর রাজত্বকালে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তাঁর দাদা শিয়ালকোটে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন এবং ষাট বছর বয়সে ইন্তিকাল করেন।
কবির পিতা শেখ নূর মোহাম্মদ উচ্চশিক্ষিত কোন মানুষ ছিলেন না কিন্তু তিনি একজন স্বনামধন্য পন্ডিত ছিলেন। যার কারণে শামসুল উলামা সৈয়দ মীর হাসান তাঁকে(কবির পিতাকে) অশিক্ষিত দার্শনিক উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।
ইকবালের জন্মের ব্যাপারে কথিত আছে যে, একদিন তাঁর পিতা স্বপ্নে দেখলেন, আকাশচারী একটি অসম্ভব সুন্দর কবুতর তার কোলে এসে পড়ল। পরে তিনি স্বপ্ন বিশারদের কাছে জানতে পারলেন অদূর ভবিষ্যতে তিনি একজন ভাগ্যবান পুত্রের বাপ হতে যাচ্ছেন। আরও কথিত আছে যে, সদ্যজাত ইকবালকে যখন পিতা নূর মোহাম্মদের কোলে দেওয়া হয় তখন তিনি সদ্যজাত শিশুপুত্রকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, “বড় হয়ে দ্বীনের খেদমত করলে বেঁচে থাক, নচেৎ এখনি মরে যাও।” বুঝতে পারছ তাঁর স্নেহময় পিতা তাঁর কাছ হতে ইসলাম ও মুসলমানদের খেদমতের জন্য কি আশা করেছিলেন?
পিতা নূর মোহাম্মদের ইচ্ছা ছিল পুত্রকে মাদরাসায় পড়ানোর কিন্তু উস্তাদ শামসুল উলামা মীর হাসানের পরামর্শে তাঁকে ইংরেজি স্কুলে ভর্তি করা হয়। প্রাইমারী শিক্ষা শেষ হলে তাঁকে শিয়ালকোট স্কচ মিশন স্কুলে ভর্তি করা হয়। এ স্কুল হতে তিনি ১৮৯৩ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। স্কচ স্কুলের ছাত্র থাকাকালীন তিনি একদিন দেরীতে ক্লাসে আসেন, ক্লাস টিচার তাঁর দেরিতে ক্লাসে আসার কারণ জানতে চাইলে বালক ইকবাল তৎক্ষণাত উত্তর দেন, “ইকবাল(সৌভাগ্য) দেরিতে আসে স্যার।” উত্তর শুনে পন্ডিত শিক্ষক তো ‘থ’। তিনি যে শুধু উপস্থিত বুদ্ধিতে দক্ষ ছিলেন তা নয়। ছাত্র হিসেবে তিনি ছিলেন প্রচন্ড মেধাবী। ১৮৮৮, ১৮৯১ ও ১৮৯৩ সালে যথাক্রমে প্রাথমিক বৃত্তি, নিম্ন মাধ্যমিক বৃত্তি ও প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে তিনি স্বর্ণপদক ও মাসিক বৃত্তি লাভ করেন। ১৮৯৩ সালে স্কচ মিশন স্কুল কলেজে উন্নীত হলে ইকবাল এখানে এফ. এ. শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৮৯৫ সালে অনুষ্ঠিত এফ.এ. পরীক্ষাতেও তিনি প্রথম বিভাগে পাস করেন এবং যথারীতি বৃত্তিসহ স্বর্ণপদক লাভ করেন।
১৮৯৫ সালে তিনি শিয়ালকোট হতে লাহোরে এসে লাহোর সরকারী কলেজে বি.এ ভর্তি হন। এখানে একটা খবর দিয়ে রাখি, ইকবাল যখন বি.এ পড়ার জন্য পিতার নিকট অনুমতি চাইলেন তখন তাঁর পিতা তাঁকে বলেছিলেন, ‘ছাত্র জীবন শেষ করার পর অবশিষ্ট জীবন ইসলামের খিদমতে ওয়াকফ করে দিতে হবে।’
হ্যাঁ, তিনি তাতেই রাজী হয়েছিলেন। আর সত্যি সত্যিই তাঁর সারাটা জীবন ইসলামের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন। লাহোর সরকারী কলেজে অধ্যয়নকালে তিনি টি.ডব্লউ এর মত ভূবন বিখ্যাত একজন সুযোগ্য শিক্ষক পান যিনি ছিলেন আরবী ভাষায় সুপন্ডিত, দর্শনের অধ্যাপক ও প্রখ্যাত সাহিত্যিক। প্রতিভাবান ইকবালকে ছাত্র হিসেবে পেয়ে আরনল্ড সাহেব তাঁকে আপন করে নিয়েছিলেন এবং মনের মত করে গড়ে তুলেছিলেন। ১৮৯৭ সালে তিনি আরবী ও ইংরেজিতে সমগ্র পাঞ্জাবে প্রথম স্থান নিয়ে বি.এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। যে কারণে তিনি এবার দুটি স্বর্ণপদক লাভ করেন। এরপর ১৮৯৯ সালে দর্শনশাস্ত্রে এম.এ পাস করেন। সাথে সাথে তিনি লাহোর ওরিয়েন্টাল কলেজে ইতিহাস ও দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপক নিযুক্ত হন। এর সামান্য কিছুকাল পরই তিনি লাহোর সরকারী কলেজ ও ইসলামিয়া কলেজের ইংরেজি ও দর্শনশাস্ত্রের খন্ডকালীন সহকারী অধ্যাপক নিযুক্ত হন। এ সময়ে উর্দু ভাষায় অর্থশাস্ত্র সম্বন্ধে তাঁর সর্বপ্রথম পুস্তক রচনা করেন। তাঁর জীবন ছিল ছকে বাঁধা। এ সম্বন্ধে ইসলামী বিশ্বকোষ লিখেছে, “তিনি ভোরে ওঠে ফজরের সালাত আদায় করতেন, অতঃপর উচ্চস্বরে কোরআন তিলাওয়াত করতেন। তারপর কিছুক্ষণ শরীরচর্চা করতেন এবং কিছু না খেয়ে কলেজে যেতেন। দুপুরে বাড়ি ফিরে আহার করতেন। অনেক সময় গভীর রাতে ওঠে তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করতেন। একবার তিনি একাধারে দুই মাস এই রাত্রিকালীন সালাত আদায় করেন।’
১৯০৫ সালে তিনি উচ্চশিক্ষা গ্রহণের মানসে লন্ডন গমন করেন। পথিমধ্যে তিনি খাজা নিযামুদ্দীন আউলিয়া, সূফী কবি আমীর খসরু ও মহাকবি গালিবের মাযার জিয়ারত করেন। কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় হতে তিনি দর্শনশাস্ত্রে এম.এ ডিগ্রী লাভ করেন। এ সময় তিনি শিক্ষক হিসেবে পান বিশ্ব খ্যাত দার্শনিক ডঃ এম সি ট্যাগার্টকে। এরপর তিনি পশ্চিম ইউরোপ ভ্রমণে বের হন। শেষে জার্মানীর মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয় হতে পারস্যের দর্শন শাস্ত্র বিষয়ক সন্দর্ভ লিখে ১৯০৭ সালে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন। এরপরের বছর লিংকন ইন হতে ব্যারিস্টারী পাস করেন। এ সময় তাঁর প্রিয় শিক্ষক স্যার আর্নল্ড লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবীর অধ্যাপক ছিলেন। তিনি বিশেষ কারণে কয়েক মাসের ছুটিতে গেলে ইকবাল ৬ মাসের জন্য তাঁর স্থানে আরবীর অস্থায়ী অধ্যাপক নিযুক্ত হন।
১৯০৮ সালের ২৭ শে জুলাই তিনি দেশে ফিরে এলে লাহোরের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ তাঁকে বিপুলভাবে সংবর্ধিত করেন। তিনি লাহোরে ফিরে স্বপদে পুনর্বহাল হন এবং সরকারের অনুমতিক্রমে আইনব্যবসা শুরু করেন। অবশ্য দেড় বছর পর চাকরি ছেড়ে দিয়ে স্থায়ীভাবে তিনি আইনব্যবসা শুরু করেন। তবে একটা কথা জেনে রাখা দরকার, তিনি কখনই মাসিক খরচের পরিমাণ টাকা রোজগারের পর কোনও মোকদ্দমা গ্রহণ করতেন না। আরও একটা কথা, তিনি যদি বুঝতেন কোন মোকদ্দমায় মক্কেলের তেমন কোন উপকার করতে পারবেন না তা’হলেও তিনি সে কেস গ্রহণ করতেন না। শেষ জীবন পর্যন্ত তিনি এভাবে তাঁর সিদ্ধান্তে অটল থাকেন।
ছাত্রাবস্থায় ১৮৯৬ সালে শিয়ালকোটের এক কবিতানুষ্ঠানে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে তাঁর কবি প্রতিভার বিকাশ লাভ করতে শুরু করে। এরপর তিনি বেশ কিছু কবিতা লিখে হায়দারাবাদের প্রখ্যাত কবি দাগের নিকট পাঠিয়ে দেন সংশোধনের জন্য। কবি দাগ কিশোর কবির এ কবিতাগুলি পেয়ে মনোযোগ সহকারে পড়েন ও চমৎকার একটি মন্তব্য লিখে পাঠান। কবি দাগ লিখেছিলেন, ‘এ কবিতাগুলি সংশোধন করার কোন দরকার নেই। এগুলো কবির স্বচ্ছ মনের সার্থক, সুন্দর ও অনবদ্য ভাব প্রকাশের পরিচয় দিচ্ছে।’ কবি ইকবাল এ চিঠি পেয়ে তো খুব উৎসাহ পেলেন। তাঁরপর হতে চললো তাঁর বিরামহীন কাব্যসাধনা। এরপর ১৯০০ সালে তিনি লাহোরে অনুষ্ঠিত আঞ্জুমানে হিমায়েতে ইসলাম-এর বার্ষিক সাধারণ সভায় জীবনের প্রথম জনসমক্ষে তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘নালা ইয়াতীম’ বা অনাথের আর্তনাদ পাঠ করেন। কবিতাটি পড়ার পর চারিদিকে ধন্য ধন্য পড়ে যায়। মানে কবিতাটি এত জনপ্রিয়তা অর্জন করে যে, তাৎক্ষণিকভাবে কবিতাটি ছাপা হয় এবং এর প্রতিটি কপি সে সময় চার টাকা দামে বিক্রি হয়। বিক্রয়লব্ধ প্রচুর পরিমাণ টাকা ইয়াতিমদের সাহায্যার্থে চাঁদা হিসেবে গৃহীত হয়। ১৯০১ সালে তিনি ছোটদের জন্য লেখেন-মাকড়সা ও মাছি, পর্বত ও কাঠবিড়ালি, শিশুর প্রার্থনা, সহানুভূতি, পাখীর নালিশ, মায়ের স্বপ্ন প্রভৃতি কবিতা।
এরপর তিনি দু’হাতে অসংখ্য কবিতা লিখেছেন। তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু ছিল, ‘স্বদেশপ্রেম, মুসলিম উম্মাহর প্রতি মমত্ববোধ, ইসলামের শ্বাশত আদর্শে তাওহীদভিত্তিক বিশ্বরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন, জাতির উত্থান-পতন, দলীয় কলহ ও অন্তর্দ্বন্ধ নিরসন প্রভৃতি বিষয় কবিতায় স্থান পেতো। ঘুমন্ত মুসলিম জাতিকে তিনি বেলালী সুরে আহবান জানাতেন ক্লান্তিহীনভাবে। স্বকীয় আদর্শের সন্ধানে যুব সমাজকে উদ্বুদ্ধ করে তোলাই তাঁর লক্ষ্য ছিল।’
তাঁর কাব্যে এ ধরনের চিরন্তন আবেদন থাকার কারণে তিনি অল্প সময়ের মধ্যেই সারা বিশ্বে খ্যাতি লাভ করতে সক্ষম হন। নানামুখি প্রতিভার অধিকারী এ মহান ব্যক্তিত্ব তাই জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সর্বমহল হতে অকুন্ঠ সম্মান অর্জন করেন। মহীশুর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের একজন হিন্দু অধ্যাপক বলেছিলেন, “মুসলমানগণ ইকবালকে লক্ষবার তাঁদের সম্পদ বলে দাবি করতে পারেন। কিন্তু তিনি কোন ধর্ম বা শ্রেণীবিশেষের সম্পদ নন-তিনি একান্তভাবে আমাদেরও।’’
১৯০১ সালে ‘হিমালাহ’ নামক কবিতাটি তৎকালীন সময়ের উর্দু ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ পত্রিকা ‘মাখযানে’ ছাপা হয়। এটিই পত্রিকায় প্রকাশিত কবির প্রথম কবিতা। মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবিতে তিনি এসময় অনেকগুলো পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন। ১৯০৩ সালে লাহোর হতে অর্থনীতির ওপর তাঁর প্রথম পুস্তক ‘আল ইলমুল ইকতেসাদ’ প্রকাশিত হয়।
১৯২৪ সালে ‘বাঙ্গেদারা’ বা ঘন্টাধ্বনি নামক তাঁর বিখ্যাত কবিতার সংকলন প্রকাশিত হয়। এ পর্যন্ত এ গ্রন্থটির বহু সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। ১৯১৫ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘আসরার-ই-খুদী’ বা ব্যক্তিত্বের গূঢ় রহস্য। এ কাব্যগ্রন্থটি ১৯২০ সালে ইংরেজি ভাষায় অনুদিত হয়ে প্রকাশিত হয়। অনুবাদ করেন ডঃ আর.এ.নিকোলসন। সাথে সাথে সমগ্র পশ্চিমা বিশ্বে মহাকবি ও বিশ্বকবি আল্লামা ইকবালের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৪৫ সালে ‘আসরার-ই-খুদী’ বাংলা ভাষায় অনুবাদ করা হয়। বিশ্বের বহু ভাষায় এ কাব্যগ্রন্থটি অনূদিত ও প্রকাশিত হয়েছে।
১৯১১ ও ১৯১২ সালে পঠিত তাঁর বিশ্ববিখ্যাত কবিতা ‘শিকওয়াহ’ বা অভিযোগ ও ‘জওয়াব-ই-শিকওয়াহ’ বা অভিযোগের জবাব উর্দু ভাষায় রচিত। এ দীর্ঘ দুটি কবিতার কাব্যগ্রন্থ দু’টির বাংলা ভাষায় একাধিক অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ১৯১২ সালে প্রকাশিত হয় ফারসী ভাষায় রচিত ‘পায়াম-ই-মাশরিক’ প্রাচ্যের বাণী কাব্যগ্রন্থটি। গ্রন্থটি আরবী, ইংরেজী, তুর্কী, জার্মান ও রুশ ভাষায় অনূদিত হয়। ১৯১৮ সালে প্রকাশিত হয় ফারসী ভাষায় ‘রামূয-ই-বেখুদী’ বা আত্মবিলোপের গুঢ়তত্ত্ব কাব্যগ্রন্থটি। মূলত এ গ্রন্থটি ‘আসরারে খুদী’র দ্বিতীয়াংশ। শুনলে আশ্চর্য হতে হয় যে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত এ গ্রন্থটির ৮৪ তম সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর ‘বালে জিবরীল’ বা জিবরাঈলের ডানা উর্দু ভাষায় প্রকাশিত হয় ১৯৩৫ সালে। ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত হয় ‘দরবারে কালীম’ বা মূসার লাঠির আঘাত কাব্যগ্রন্থটি। উর্দু ভাষায় রচিত এ কাব্যগ্রন্থটি আরবী ও রুশ ভাষায় অনূদিত হয়েও প্রকাশিত হয়।
এর আগে ১৯২৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘যাবুরে আজম’ বা প্রাচ্যের ধর্ম সংগীত কাব্যগ্রন্থটি। ১৯৩২ সালে প্রকাশিত হয় ফারসী ভাষায় রচিত ‘জাবীদ নামা’ বা অমর লিপি কাব্যগ্রন্থটি। এমনিভাবে একের পর এক তাঁর কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। তাঁর রচিত কাব্যগ্রন্থগুলি বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়ে অসংখ্য সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। সম্ভবত তিনি প্রাচ্যের সেই ভাগ্যবান কবি ব্যক্তিত্ব যার রচনা এত ব্যাপকভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত ও প্রকাশিত হয়েছে। সত্যিই যদি বিশ্বকবি বিশেষণে কাউকে বিশেষিত করতেই হয় তবে সে সম্মানের অধিকারী নিঃসন্দেহে কবি আল্লামা ইকবাল। কবি নিজেও ছিলেন বহু ভাষাবিদ পন্ডিত। তিনি উর্দু, ফারসী, ইংরেজি প্রভৃতি ভাষায় লেখনি চালিয়েছেন।
কবি The Development of Metaphysics in Iran বা ‘প্রজ্ঞান চর্চায় ইরান’ এই বিষয়ের ওপর ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯০৮ সালে লন্ডন হতে এ থিসিস প্রকাশিত হয়।
এতক্ষণ তাঁকে কবি হিসেবে পরিচয় দিলাম। আসলে তিনি শুধুই কবি ছিলেন না। তিনি সমাজসেবী, রাজনীতিবিদ, প্রখ্যাত দার্শনিক আইনজ্ঞ প্রভৃতি গুণে গুণান্বিত ছিলেন। ১৯২৬ সালে তিনি পাঞ্জাব আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৩০ সালে নির্বাচিত হন মুসলিম লীগের সভাপতি হিসেবে। ১৯৩১ ও ১৯৩২ সালে তিনি বিলেত গমন করেন ‘গোল টেবিল’ বৈঠকে যোগদানের জন্য। এই বৈঠকে তিনি ভারতীয় মুসলমানদের জন্য বিভিন্ন দাবি দাওয়া পেশ করেন। অবশ্য এর আগে মুসলিম লীগের এলাহাবাদ অধিবেশনে ১৯৩০ সালের ২৯শে ডিসেম্বর সভাপতির ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি চাই যে-পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু ও বেলুচিস্তান একটি রাষ্ট্রে পরিণত হউক। পৃথিবীর এই অংশে বৃটিশ সাম্রাজ্যের ভিতরে হোক বা বাইরে হউক-অন্ততপক্ষে উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে একটি মুসলিম রাষ্ট্র সংগঠনই আমার মতে মুসলমানদের শেষ নিয়তি।’ এই মত অনুযায়ীই পরবর্তীকালে পাকিস্তান রাষ্ট্র জন্মলাভ করে। এ জন্য তাঁকে পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টা ও রূপকার বলা হয়। অবশ্য তিনি ১৯৩৭ সালের ২১শে জুন পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘আমি যেভাবে প্রস্তাব করছি সেভাবে পুনর্গঠিত মুসলিম সংখ্যাগুরু প্রদেশসমূহের একটি পৃথক যুক্তরাষ্ট্রই হল একমাত্র উপায়, যদ্বারা একটি শান্তিপূর্ণ ভারত গড়ে উঠতে পারে এবং সাথে সাথে অমুসলিম আধিপত্য থেকে মুসলিম সম্প্রদায়কে রক্ষা করা যেতে পারে। উত্তর পশ্চিম ভারত এবং বাংলার মুসলমানদেরকে কেন একটি স্বতন্ত্র জাতিরূপে স্বীকৃতি দেয়া হবে না-যাতে তারা ভারতের এবং ভারতের বাইরের অন্যান্য জাতিসমূহের ন্যায় আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার পেতে পারে?’ এ উদ্ধৃতিতে তিনি যে বাংলাদেশের মুসলমানদের জন্যও একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেয়ার কথা বলেছিলেন তা নিশ্চয় বুঝা যায়। মূলত আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্ত্বও তাঁরই চিন্তার ফসল। অথচ এ মহান ব্যক্তিত্ত্বকে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পর হতে অস্বীকার করার চেষ্টা করা হচ্ছে, একথা আগেই বলেছি। তাকে অস্বীকার করা হচ্ছে যে কারণে তিনি নাকি পাকিস্তানপন্থী ছিলেন। অথচ তিনি পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ারও বেশ আগে ১৯৩৮ সালের ২১শে এপৃল ইন্তিকাল করেন। আশা করি বুঝতে মোটেই কষ্ট হচ্ছে না যে, আমরা এ মহান ব্যক্তিত্ত্বকে অস্বীকার করে কি পরিমাণ মূর্খতায় ও ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত। সত্যি কথা আমাদের দেশের তথাকথিত কিছু অনুদার বুদ্ধিজীবি এর জন্য দায়ী।
উপমহাদেশের এ প্রখ্যাত দার্শনিক কবি অসম্ভব দেশপ্রেমিক একজন মানুষ ছিলেন। লেখার শুরুতেই যে কবিতাটির উদ্ধৃতি দিয়েছি তার কাব্যানুবাদ এ রকমের-
‘আরব আমার, ভারত আমার, চীনও আমার-
নহে তো পর-
মুসলিম আমি,- জাহান জুড়িয়া
ছড়ানো রয়েছে আমার ঘর।’
দুঃখের বিষয় বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সচেতনভাবে এ কবিকে বর্জন করা হয়। তার প্রমাণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের নাম পরিবর্তন করে জহুরুল হক নামকরণ করা, পাঠ্যতালিকা হতে তাঁর রচনা ও জীবনী বাদ দেয়া।
আমরা আশা করবো এখন হতে নতুন করে আবার আমরা ইকবাল চর্চায় ফিরে যাব। কবিকে তাঁর প্রকৃত সম্মানে সম্মানিত করবো। দেশের সব শ্রেণীর পাঠ্য পুস্তকে তাঁর রচনা অন্তুর্ভুক্ত হওয়া এ জাতির কল্যাণের জন্য অবশ্যই প্রয়োজন, সে দিকটা দেখার জন্য সরকারের প্রতি আহবান রইলো।
ইসমাইল হোসেন সিরাজী
আর ঘুমিও না নয়ন মেলিয়া,
উঠরে মোসলেম উঠরে জাগিয়া,
আলস্য জড়তা পায়েতে ঠেলিয়া,
পূত বিভূ নাম স্মরণ করি।
সিরাজগঞ্জ শহরের ছোট্ট এক কামরায় বসে লিখে চলেছেন এক তরুণ তার আপন কওমকে জাগিয়ে তোলার জন্য। লিখে চলেছেন বৃটিশ বেনিয়াদের এদেশ হতে চিরতরে উৎখাত করার জন্য। এই বেনিয়া গোষ্ঠী সমস্ত ভারত উপমহাদেশ মুসলমানদের কাছ হতে ছিনিয়ে নেয়। ক্ষোভে দুঃখে মুসলমানগণ ইংরেজদের প্রবর্তিত অনেক কিছুই ত্যাগ করে। এমনকি ইংরেজী শিক্ষা গ্রহণ হতেও নিজেদেরকে সরিয়ে রাখে। অপরদিকে হিন্দুরা এ সুযোগ গ্রহণ করে শিক্ষা দীক্ষায় মুসলমানদের চেয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। মুসলমানরা হয়ে পড়ে পঙ্গু কি শিক্ষা দীক্ষায়, কি সম্পদ বৈভবে। ঠিক এ সময়েই কলম তুলে নেন সৈয়দ ইসমাঈল হোসেন শিরাজী। ১৮৮০ সালের ১৩ জুলাই তারিখে তিনি তৎকালীন পাবনা জেলার অন্তর্গত সিরাজগঞ্জ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম সৈয়দ আবদুল করীম এবং মাতার নাম নুরজাহান বেগম। তারা উভয়েই ছিলেন অত্যন্ত দ্বীনদার ও পরহেজগার মানুষ।
শিশু ইসমাইল হোসেনের লেখাপড়ার প্রথম সবক দেন তাঁর মা নূরজাহান খানম। নূরজাহান খানম তাঁর শিশুপুত্রকে প্রথমেই কোরআন শিক্ষা দেন। কোরআন শিক্ষা শেষ হলে তাঁকে মধ্য ইংরেজী স্কুলে ভর্তি করা হয়। মেধাবী ইসমাইল হোসেন অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে মধ্য ইংরেজী বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে সিরাজগঞ্জের বিএল উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। কিন্তু মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও দারিদ্র্যের কারণে এ সম্ভাবনাময় তরুণ লেখাপড়ার ক্ষেত্রে আর অগ্রসর হতে পারেন নি। তাছাড়া স্বদেশের পরাধীনতা, সমগ্র মুসলিম জাহানের দুর্দশার জন্য বেদনাবোধ হতে সৃষ্টি উৎকন্ঠাও তাঁকে স্কুলের চার দেয়ালের মধ্যে বসে থাকতে দেয় নি। তোমরা জানলে আশ্চর্য হবে যে, তিনি এ সময়ে নির্যাতিত অবহেলিত, লাঞ্চিত ও পদদলিত মুসলিম জাতির জন্য বেদনাবিধুর, এতই ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন যে, মাত্র ১৬ বছর বয়সেই লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে তুরস্কের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। এ যাত্রায় তিনি তুরস্কে যেতে পারেন নি ঠিক কিন্তু সেই যে মুসলিম জাহানের কল্যাণের মানসে ঘর হতে বের হলেন আর কখনই সুবোধ বালকের মত ঘরে বসে থাকেন নি। অবশ্য তিনি পরবর্তীকালের তাঁর বাল্যকালের স্বপ্নের তুরস্কে গিয়েছিলেন তা অনেক পরের কথা।
ইসমাইল হোসেন সিরাজীর সবচেয়ে পরিচিত কাব্যগ্রন্থ হল ‘অনল প্রবাহ’। এটি ১৮৯৯ সনে মুনসী মেহেরউল্লা প্রথম প্রকাশ করেন। পুস্তিকাটি এত জনপ্রিয় ছিল যে ১৯০০ সালে আরো কিছু কবিতা নিয়ে কাব্যগ্রন্থটি আবার প্রকাশিত হয়। এরপর ১৯০৮ সালে এটি পূর্ণাঙ্গ কাব্যগ্রন্থ হিসেবে প্রকাশিত হয়। আর এ সময়ই ‘অনল প্রবাহ’ ও লেখক বৃটিশ রাজশক্তির আক্রমণের শিকার হন। ‘অনল প্রবাহ’ বাজেয়াপ্ত হয় এবং লেখকের দু’বছর কারাদন্ড হয়। তিনিই প্রথম কবি যার কাব্যগ্রন্থ সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ হয় এবং তিনিই বৃটিশ রাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অভিযোগে কারাদন্ড ভোগকারী উপমহাদেশের প্রথম সাহিত্যিক। সিরাজীর অন্যান্য কাব্যগ্রন্থ হল উচ্ছ্বাস, উৎসব, উদ্বোধন কাব্য, মহাশিক্ষা কাব্য, স্পেন বিজয় কাব্য, প্রেমাঞ্জলী(গীতিকাব্য), সঙ্গীত সঞ্জীবনী ইত্যাদি।
মুসলমানদের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক ও মিথ্যা অপপ্রচার করতো তখন হিন্দু কবি সাহিত্যিকরা। বিশেষ করে চরম মুসলিম বিদ্বেষী ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার লেখায় সুপরিকল্পিতভাবে মুসলমানদের হেয় করার চেষ্টা করতেন। ইসমাইল হোসেন সিরাজী এ সমস্ত কুৎসিৎ লেখার জবাব দিতে গিয়ে উপন্যাসও রচনা করেন। তাঁর উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে তারাবাই, ফিরোজা বেগম, নুরুদ্দীন, রায়নন্দিনী ও বংকিম দুহিতা। না, জবাব দিতে গিয়ে সিরাজী প্রতিআক্রমণ বা সাম্প্রদায়িক উস্কানি বেছে নেননি। সুন্দর ও যুক্তিপূর্ণ ভাষায় উপন্যাসে তাঁর ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে জবাব দিয়েছেন। ইসমাইল হোসেন সিরাজীর শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘রায় নন্দিনী’।
সিরাজী রচিত কাব্য, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনী ও সঙ্গীত বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থের সংখ্যা ৩২টি। এগুলো হলো- কাব্যগ্রন্থ উচ্ছ্বাস (১৯০৭), নব উদ্দীপনা (১৯০৭), উদ্বোধন (১৯০৮), স্পেন বিজয় কাব্য (১৯৮৪), মহাশিক্ষা কাব্য প্রথম খন্ড (১৯৬৯), মহাশিক্ষা কাব্য দ্বিতীয় খন্ড (১৯৭১)। উপন্যাস- রায়নন্দিনী (১৯১৫), তারাবাঈ (১৯১৬), নূরউদ্দীন (১৯১৯)। প্রবন্ধ গ্রন্থ- মহানগরী কর্ডোভা (১৯০৭), স্ত্রীশিক্ষা (১৯০৭), আদব কায়দা শিক্ষা (১৯১৪), সুচিন্তা প্রথম খন্ড (১৯১৬), তুর্কি নারী জীবন (১৯১৩), ভ্রমণ কাহিনী- তুরস্ক ভ্রমণ (১৯১৩)। সঙ্গীত গ্রন্থ- সঙ্গীত সঞ্জীবনী (১৯১৬), প্রেমাঞ্জলী (১৯১৬) প্রভৃতি। অপ্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ- সুধাঞ্জলী, গৌরব কাহিনী, কুসুমাঞ্জলী, আবে হায়াৎ, কাব্য কুসুমোদ্যান, পুস্পাঞ্জলী। অসমাপ্ত উপন্যাস- বঙ্গ ও বিহার বিজয় এবং জাহানারা।
১৯৪০ সালের ২২ মার্চ কলিকাতা ২/১ ইউরোপিয়ান অ্যাসাইলাম লেনে, সিরাজী পাবলিক লাইব্রেরী ও ফ্রি রিডিং রুম- এর উদ্বোধন করা হয়। উক্ত দ্বারোঘাটন অনুষ্ঠানে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম প্রদত্ত সভাপতির ভাষণে বলেন, ‘সিরাজী সাহেব ছিলেন আমার পিতৃতুল্য। তিনি আমাকে ভাবিতেন জ্যেষ্ঠ পুত্র-তুল্য। তাঁহার নিকট যে স্নেহ আমি জীবনে পাইয়াছি তাহা আমার জীবনের পরম সঞ্চয়। ফরিদপুর কনফারেন্সে তাঁহার সহিত আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয়। তাঁহার সমগ্রজীবনই ছিল অনল প্রবাহ এবং আমার রচনায় সেই অগ্নি স্ফুলিঙ্গের প্রকাশ আছে। সাহিত্যিক ও রাজনীতিক ছাড়াও আমার চোখে তিনি প্রতিভাত হয়েছিলেন এক শক্তিমান দরবেশ রূপে। মৃত্যুকে তিনি ভয় করেন নাই, তুরস্কের রণক্ষেত্রে তিনি সেই মৃত্যুর সঙ্গে করিয়াছিলেন মুখোমুখি। তাই অন্তিমে মৃত্যু তাঁহার জন্য আনিয়া দিয়াছিল মহাজীবনের আস্বাদ।’
বাংলাদেশের জন্য বড় দুর্ভাগ্য যে আমাদের রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীরা মহান পুরুষ সিরাজীকে হীনমন্যতার কারণে মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ। দেশের মাদ্রাসা, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল পাঠ্যসূচিতে সিরাজী রচনাবলী উপেক্ষিত। সিরাজীর লেখা থেকে বঞ্চিত এদেশের শিক্ষার্থীরা। সিরাজী সম্পর্কে তরুণ সমাজকে জানতে দেয়া হচ্ছে না। অথচ সিরাজীর অনলবর্ষী বক্তৃতায় প্রকম্পিত হয়েছিলো ব্রিটিশ সিংহাসন। তাঁর কণ্ঠ ও লেখা থেকে বারুদের গন্ধ বের হতো। তাঁর বক্তৃতায় জেগে ওঠেছিলো লাখো লাখো তরুণ। সেখানে মুসলিম বা হিন্দু বলে কোনো প্রশ্নের সৃষ্টি হয় নাই। ব্রিটিশ রাজ শুধু তাঁকে কারাবন্দীই করেনি, তার কবিতাও নিষিদ্ধ করেছিলো। সেই স্বাধীনচেতা মহাকবিকে স্বাধীন রাষ্ট্রের কর্ণধাররা অবমূল্যায়ন করছেন। যারা মুসলমানদেরকে লাইভস্টক বা গৃহপালিত পশু বলে আখ্যায়িত করছে, যারা আমাদেরকে কাক পক্ষী, দস্যু, তস্কর, দানব, অসুর, অনার্য, ইতর, নরপশু, ডাকাত বলে গালি দিয়েছে তাদের জন্ম-মৃত্যু বার্ষিকী ঘটা করে পালন করা হয়। তাদের লেখা গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, নাটক পড়তে বাধ্য করা হচ্ছে কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের। অথচ সিরাজীর মত মহানায়কের রচনাবলী পাঠ্য বহির্ভূতই থেকে যাচ্ছে। বর্তমান বাংলাদেশের ক্রান্তিকালীন দুর্বিষহ অবস্থার প্রেক্ষিতে সিরাজীর মতো বিপ্লবী পুরুষের প্রসঙ্গ টেনে আনা অতীব জরুরী। ভাষাবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. এস. এম. লুৎফর রহমান লিখেছেন, ‘বাংলাদেশী জাতি সৃষ্টির এই গঠনকালে সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীর উদারতা, দৃঢ়তা, অসাম্প্রদায়িকতা, স্বাতন্ত্র্যবাদ, ঐতিহ্য চেতনা, সংস্কৃতি চেতনা, বিজ্ঞান-ইতিহাস ও সাহিত্য-চেতনা প্রভৃতি থেকে প্রেরণা আহরণ একান্ত কর্তব্য। ঊনবিংশ শতাব্দির প্রথম দশক থেকে চল্লিশের দশক পর্যন্ত সারা উপমহাদেশের মুসলমানদের মনে যে জাতীয় ঐক্যবোধ, জাগরণ স্পৃহা আপন জাতীয় সত্ত্বার পরিচয় ফুটিয়ে তোলার আকাক্মখা এবং সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতিতে যে প্রতিষ্ঠা অর্জনের প্রয়াস তীব্র আবেগে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছিল, আজকের স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় জাতীয়তাবোধের প্রেক্ষিতে সেই উদ্যম নিষ্ঠা ও কর্ম-চাঞ্চল্য একান্ত আবশ্যক হয়ে উঠেছে। আবশ্যক হয়ে উঠেছে আজ আবার নতুন করে ঘনিয়ে ওঠা বিভ্রান্তির, দিশাহীনতার দিগন্তের কালো আবরণ ভেদ করে আলোকবন্যা আবাহনের জন্য নতুন করে গর্জে ওঠা হাজার হাজার সিরাজীর।’
মাত্র ৫২ বছর বয়সে ১৯৩১ সালের ১৭ জুলাই দুরারোগ্য পৃষ্ঠব্রণ রোগে আক্রান্ত হয়ে মুসলিম বিশ্বের এই মহান পুরুষ ইন্তিকাল করেন। জীবনের শুরু হতে শেষ পর্যন্ত তিনি সর্বপ্রকার অনাচার, কদাচার, কুসংস্কার, অন্যায় ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সিংহের মত লড়ে গেছেন। না কোথাও কোন কারণে তিনি মাথা নত করেন নি।
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ একটি নাম, একটি ইতিহাস, একটি শতাব্দী। বিশিষ্টি ভাষাতত্ত্ববিদ, গবেষক, বহুভাষাবিদ পন্ডিত, ধর্মবেত্তা ও সূফীসাধক। তিনি ছিলেন একাধারে ভাষাবিদ, গবেষক, লোকবিজ্ঞানী, অনুবাদক, পাঠসমালোচক, সৃষ্টিধর্মী সাহিত্যিক, কবি, ভাষাসৈনিক এবং একজন খাঁটি বাঙালি মুসলিম ও দেশপ্রেমিক। জ্ঞানপ্রদীপ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ছিলেন বাংলা ভাষার গবেষণায় অদ্বিতীয়।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৮৮৫ সালের ১০ জুলাই শুক্রবার পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার পেয়ারা গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন বাবা-মার পঞ্চম সন্তান। তাঁর বাবা মফিজ উদ্দিন আহমদ ছিলেন ইংরেজ আমলে সরকারি জরিপ বিভাগের একজন কর্মকর্তা। শহীদুল্লাহ মাতা হরুন্নেছা খাতুনের শিক্ষার প্রতি ছিল প্রচণ্ড আগ্রহ। তিনি বাড়িতে তাঁর পরিবার ও পেয়ারা গ্রামের অন্যান্য মহিলাদের শিক্ষা দিতেন। প্রথম দিকে মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নাম রাখা হয় মুহম্মদ ইব্রাহীম। কিন্তু পরবর্তীকালে পিতার পছন্দে আকিকা করে তাঁর নাম পুনরায় রাখা হয় মুহম্মদ শহীদুল্লাহ।
ছোটবেলায় ঘরোয়া পরিবেশে শহীদুল্লাহ উর্দু, ফার্সী ও আরবি শেখেন এবং গ্রামের পাঠশালায় সংস্কৃত পড়েন। পাঠশালার পড়া শেষ করে ভর্তি হন হাওড়া জেলা স্কুলে। স্কুলের ছাত্র থাকতেই বই পড়ার এবং নানা বিষয়ে জানার প্রতি ছিল তাঁর দারুণ নেশা। হাওড়া স্কুলের স্বনামখ্যাত ভাষাবিদ আচার্য হরিনাথ দে’র সংস্পর্শে এসে শহীদুল্লাহ ভাষা শেখার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন। স্কুলজীবন থেকেই তিনি আরবী-ফার্সী-উর্দুর পাশাপাশি হিন্দি ও উড়িয়া ভাষা পড়তে শিখেছিলেন। ১৯০৪ সালে হাওড়া জেলা স্কুল থেকে তিনি কৃতিত্ত্বের সাথে সংস্কৃতসহ প্রবেশিকা পাশ করেন। এরপর কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে থেকে ১৯০৬ সালে এফ.এ. পাশ করেন। অসুস্থতার কারণে অধ্যায়নে সাময়িক বিরতির পর তিনি কলকাতা সিটি কলেজ থেকে সংস্কৃতে অনার্সসহ বি.এ. পাস করেন ১৯১০ সালে। বাঙালি মুসলমান ছেলেদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম অনার্স নিয়ে পাস করেন।
সংস্কৃতিতে অনার্স পাস করার পর সংস্কৃত নিয়ে উচ্চতর পড়াশুনা করতে চাইলে তৎকালীন হিন্দু পণ্ডিতগণ তাঁকে পড়াতে অস্বীকার করেন। ফলে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব বিভাগে ভর্তি হন এবং ১৯১২ সালে এ বিভাগের প্রথম ছাত্র হিসেবে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। এর দু’বছর পর ১৯১৪ সালে তিনি আইনশাস্ত্রে বি.এল. ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯২৬ সালে তিনি উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য ইউরোপ গমন করেন। বাংলা ভাষার প্রাচীন নিদর্শণ চর্যাপদাবলি বিষয়ে গবেষণা করে ১৯২৮ সালে তিনি প্যারিসের সোরবন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে প্রথম ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। এ বছরই ধ্বনিতত্ত্বে মৌলিক গবেষণার জন্যে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপ্লোমা লাভ করেন।
হম্মদ শহীদুল্লাহ ১৯১৪ থেকে ১৯১৫ সাল পর্যন্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে সিতাকুন্ডু উচ্চ বিদ্যালয়ে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তিনি কিছুদিন ওকালতি প্র্যাকটিস করেন। তিনি বশিরহাট মিউনিসিপ্যালিটির ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর দিনেশ চন্দ্র সেনের অধীনে শরৎচন্দ্র লাহিরী রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করেন। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে সে বছরের ২ জুন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগে প্রভাষক পদে স্থায়ী চাকুরিতে যোগদান করেন। একইসঙ্গে নিখরচে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক শিক্ষক নিযুক্ত হন। ১৯২৫ সালের ১৯ জানুয়ারি ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত মুসলিম সাহিত্য-সমাজের সভাপতি নিযুক্ত হন। পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে ১৯২৮ সালে দেশে ফিরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগে প্রভাষকের এবং সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক শিক্ষকের পূর্বপদে যোগদান করেন। ১৯৩৪ সালে তিনি রীডার পদে পদোন্নতি লাভ করেন। একই বছর তিনি সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ এবং পরে ১৯৩৭ সালে স্বতন্ত্র বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। ১৯৪৪ সালের ৩০ জুন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে রীডার ও অধ্যক্ষ হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। অবসর গ্রহণের পর তিনি বগুড়া আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৪৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন এবং একইসাথে উক্ত বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও ছয় বছর কলা অনুষদের ডীন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা বিভাগে বাংলা সাহিত্য ও বাংলা ভাষা গড়ে তোলার জন্য মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে আমন্ত্রণ জানানো হলে তিনি সেখানে যোগদান করেন। ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন শেষে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে (ফরাসি ভাষার) খণ্ডকালীন অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের অস্থায়ী প্রাধ্যক্ষের এবং ফজলুল হক হলের প্রাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর ইমেরিটাস নিযুক্ত হন। অধ্যাপনার বাইরে তিনি করাচির উর্দু উন্নয়ন সংস্থার উর্দু অভিধান প্রকল্প, ঢাকায় বাংলা একাডেমীর ‘পূর্ব পাকিস্তান ভাষার আদর্শ অভিধান প্রকল্প’ এবং ইসলামি বিশ্বকোষ প্রকল্পে সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিশনের সদস্য, ইসলামিক একাডেমীর কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য, বাংলা একাডেমীর বাংলা পঞ্জিকার তারিখ বিন্যাস কমিটির সভাপতি, আদমজি সাহিত্য পুরস্কার ও দাউদ সাহিত্য পুরস্কার কমিটির স্থায়ী চেয়ারম্যান ছিলেন। এছাড়া তিনি বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির সম্পাদক ছিলেন এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সভা ও সম্মেলনের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। মাদ্রাজে Seminar on Traditional Culture in South-East Asia -তে তিনি UNESCO -র প্রতিনিধিত্ব করেন এবং এর চেয়ারম্যান মনোনীত হন।
ভাষাবিজ্ঞানের প্রায় সকল ক্ষেত্রেই তিনি সচ্ছন্দে বিচরণ করেছেন, আয়ত্ত করেছিলেন বাইশটি ভাষা। তিনি বাংলা, উর্দু, ইংরেজী, হিন্দী, সংস্কৃত, পালি, আসাম, উড়িয়া, আরবী, ফার্সী, হিব্রু, আবেস্তান, ল্যাটিন,তিব্বর্তী, জার্মান, ফরাসী, প্রাচীন সিংহলী, পশতু, মুন্ডা, সিন্ধী, মারহাটী, মৈথালী ইত্যাদি ভাষা জানলেও ভাষার ব্যাপারে তাঁকে প্রশ্ন করা হলে তিনি সানন্দে বলতেন, আমি বাংলা ভাষাই জানি। বাংলা যে সংস্কৃত ভাষা হতে জন্ম নেয় নি, একথা প্রথম তিনিই প্রমাণ করেন। তিনিই বলেন, “বাংলা সংস্কৃতের দুহিতা নহে; বরং দূর সম্পর্কের আত্মীয়া।”
তাঁর প্রকাশনা গুলি হলো:
গবেষণাগ্রন্থ: সিদ্ধা কানুপার গীত ও দোহা (১৯২৬), বাংলা সাহিত্যের কথা (১ম খণ্ড ১৯৫৩, ২য় খণ্ড ১৯৬৫), বৌদ্ধ মর্মবাদীর গান (১৯৬০)।
ভাষাতত্ত্ব: ভাষা ও সাহিত্য (১৯৩১), বাংলা ব্যাকরণ (১৩৬৫ বঙ্গাব্দ), বাংলা ভাষার ইতিবৃত্ত (১৯৬৫) । প্রবন্ধ-পুস্তক: ইকবাল (১৯৪৫), আমাদের সমস্যা (১৯৪৯), বাংলা আদব কি তারিখ (১৯৫৭), Essay on Islam (1945), Traditional culture in East Pakistan (মুহম্মদ আবদুল হাই-এর সঙ্গে তাঁর যুগ্ম-সম্পাদনায় রচিত;১৯৬১)।
গল্পগ্রন্থ:
রকমারী(১৯৩১)।
শিশুতোষ গ্রন্থ: শেষ নবীর সন্ধানে, ছোটদের রাসূলুল্লাহ (১৯৬২), সেকেলের রূপকথা (১৯৬৫) ।
অনুবাদ গ্রন্থ: দাওয়ানে হাফিজ (১৯৩৮), অমিয়শতক (১৯৪০), রুবাইয়াত-ই-ওমর খয়্যাম (১৯৪২), শিকওয়াহ ও জাওয়াব-ই-শিকওয়াহ (১৯৪২), বিদ্যাপতিশতক (১৯৪৫), মহানবী (১৯৪৬), বাই অতনা মা (১৯৪৮), কুরআন প্রসঙ্গ (১৯৬২), মহররম শরীফ (১৯৬২), অমর কাব্য (১৯৬৩), ইসলাম প্রসঙ্গ (১৯৬৩), Hundred Sayings of the Holly Prophet (1945), Buddist Mystic Songs (1960)।
সংকলন: পদ্মাবতী (১৯৫০), প্রাচীন ধর্মগ্রন্থে শেষ নবী (১৯৫২), গল্প সংকলন (১৯৫৩), তাঁর গবেষণামূলক গ্রন্থ ও প্রবন্ধের সংখ্যা প্রায় ৪০টি। এছাড়া তিনি ৪১টি পাঠ্যবই লিখেছেন, ২০টি বই সম্পাদনা করেছেন। বাংলা সাহিত্যের উপর তাঁর লিখিত প্রবন্ধের সংখ্যা ৬০টিরও বেশি। ভাষাতত্ত্বের উপর রয়েছে তাঁর ৩৭টি রচনা। অন্যান্য বিষয়ে বাংলা ইংরেজী মিলিয়ে সংখ্যা দাঁড়ায় ২৮০টি। এ ছাড়া তিনি তিনটি ছোটগল্প এবং ২৯টি কবিতা ও লিখেছেন।
ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর বহু মননশীল ও জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ নানা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে এবং এ সংক্রান্ত বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা তিনি সম্পদনা করেছেন। তিনি আল এসলাম পাত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক (১৯২৫) ও বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক (১৯২৮-২১) হিসেবে যোগ্যতার প্রমাণ দেন। তাঁরই সম্পাদনা ও প্রকাশনায় মুসলিম বাংলার প্রথম শিশু পত্রিকা ‘আঙ্গুর’ (১৯২০) আত্মপ্রকাশ করে। এছাড়াও তিনি ইংরেজী মাসিক পত্রিকা ‘দি পীস’ (১৯২৩), বাংলা মাসিক সাহিত্য পত্রিকা ‘বঙ্গভূমি’ (১৯৩৭) এবং পাক্ষিক ‘তকবীর’ (১৯৪৭) সম্পাদনা করেন। ১৯২২ সাল থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলা ও ইংরেজী ভাষায় প্রকাশিত পাক্ষিক ও মাসিক জার্নাল সম্পাদনা করেন।
এই চলন্ত বিশ্বকোষ বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ পন্ডিত ব্যক্তিটি ছিলেন পুরামাত্রায় ইসলামী শরীয়তের পাবন্দ। মুমিনের গুণাবলীগুলি তিনি তাঁর জীবনে ধারণ করতে পেরেছিলেন। তিনি ছিলেন ফুরফুরা শরীফের পীর মুজাদ্দিদে যামান হযরত মওলানা শাহ সূফী আবু বকর সিদ্দিকী (রহ.)এর খলীফা। ১৩ই জুলাই ১৯৬৯ খৃস্টাব্দে এই মহান মনীষী ৮৪ বছর বয়সে ঢাকায় ইন্তিকাল করেন। মরহুমের লাশ তাঁরই নামে নামকরণকৃত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের পাশে ঐতিহাসিক মূসা মসজিদ প্রাঙ্গনে দাফন করা হয়।
শেখ হবিবুর রহমান সাহিত্যরত্ন
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষপাদ ও বিংশ শতাব্দীর প্রথমপাদে বাঙালী মুসলমানদের মধ্যে সাহিত্য সংস্কৃতি চিন্তা ও চর্চার একটা গঠনমূলক প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। মীর মোশাররফ হোসেন(১৮৪৭-১৯৯১), মোজাম্মেল হক(১৮৫০-১৯৬১), কায়কোবাদ(১৮৫৮-১৯৫১) যে ধারার সূচনা করেছিলেন পরবর্তীতে মুনসী মুহম্মদ মেহেরউল্লা (১৮৬১-১৯০৭), ইসমাইল হোসেন সিরাজী (১৮৭৯-১৯৩১), শেখ ফজলুল করীম (১৮৮২-১৯৩০), শেখ হবিবর রহমান সাহিত্যরত্ন (১৮৯১-১৯৬২) প্রমুখ কবি, সাহিত্যিক, সংগ্রামীগণ অত্যন্ত যোগ্যতার সাথে এগিয়ে নিয়েছিলেন। তাঁরা চেষ্টা করেছিলেন প্রতিবেশী সম্প্রদায়ের তুলনায় অনগ্রসর মুসলমানদের স্বরূপ সন্ধান, স্বাতন্ত্র্য নির্মাণ ও তাদের জাতীয় সাহিত্য সৃষ্টি করতে। এ ক্ষেত্রে তারা সব দিক হতে বেশি অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন মুসলিম জাতীয় জাগরণের পথিকৃত মুনসী মেহেরউল্লার নিকট হতে। মুনসী মেহেরউল্লা বুঝতে পেরেছিলেন পরাধীন দেশে বৈরী শাসনাধীনে মুসলমান সম্প্রদায়ের সার্বিক উন্নয়নের স্বার্থে প্রয়োজন তাদের মধ্যে নবজাগরণের। আর এ নব জাগরণ সম্ভব করার জন্য তিনি নিজে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, বক্তৃতা, বিবৃতি, লেখালেখির সাথে সাথে গড়ে তুলেছিলেন একটি সাহিত্যিক সম্প্রদায়।
“শেখ হবিবর রহমান সাহিত্যরত্ন ছিলেন সেই সাহিত্যিক সম্প্রদায়েরই একজন। তাঁর জীবন সাধনার আদর্শ ও লক্ষ্য ছিল বাঙালী মুসলমানের জন্য সম্মানজনক ও শ্রদ্ধাশীল আত্মপরিচয় নির্মাণে সহায়তা করা। ইসলামী ইতিহাস-ঐতিহ্য ভিত্তিক নবজাগরণমূলক কাব্য রচনা, ভারতবর্ষের মুসলমানদের গৌরবময় অতীত ও প্রেরণাদায়ক ইতিহাস গ্রন্থ রচনা, ধর্মীয় চেতনা ও মননশীলতা বিকাশে ‘সহায়ক সমৃদ্ধশালী বিদেশী সারাবান সাহিত্যের বঙ্গানুবাদ ও দেশের ভবিষ্যত নাগরিকদের চরিত-মানস গঠন উপযোগী শিশুতোষ সাহিত্য রচনার মাধ্যমে তিনি মুসলমানদের মধ্যে একটি নব চেতনা জাগৃতির প্রত্যাশী ছিলেন। প্রায় অর্ধশতাব্দী কালব্যাপী শিক্ষকতা জীবনের পাশাপাশি তাঁর সৃজনশীল সাহিত্য সাধনার মধ্যে সংকীর্ণতা রহিত মুক্তবুদ্ধি সঞ্জাত সম্প্রদায়গত সমৃদ্ধি কামনা ও সমাজ হিতৈষণার পরিচয় পাওয়া যায়।”(শেখ হবিবর রহমান-মোহাম্মদ আবদুল মজিদ, পৃ.৯)।
শেখ হবিবর রহমান নিজের সাহিত্য সাধনা সম্বন্ধে ‘আমার সাহিত্য জীবন’ গ্রন্থের ১০৫ পৃষ্ঠায় লিখেছেন-
“আমার সাহিত্য বরাবর মোল্লা ধরনের; এইজন্য ইহা অনেকের নিকট উপেক্ষিত। নিয়ামত, আবেহায়াত ইত্যাদি ধরনের পুস্তকের নাম বোধ হয় মুসলমান সমাজে সর্বপ্রথম আমিই রাখিয়াছি। এতদ্ব্যতীত আমার বিবিধ পুস্তকে আরবী, ফারসী শব্দের ব্যবহার এত অধিক যে, আমাদের মধ্যে আর কেহই তত অধিক শব্দ ব্যবহার করিয়াছেন কিনা সন্দেহ। জাতীয়ভাবে জাতীয় শব্দের সংমিশ্রণে জাতীয় সাহিত্যের সৃষ্টি আমার জীবনের প্রধান একটি সাধনা।”
শেখ হবিবর রহমান সাহিত্যরত্ন ১৮৯০ মতান্তরে ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে তদানিন্তন যশোর জেলার বর্তমান মাগুরা জেলার শালিখা উপজেলাধীন ঘোষগাতি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম শেখ দেরাজতুল্লাহ এবং দাদার নাম শেখ হেরাজতুল্লাহ। জানা যায় আরব দেশ হতে তাঁর পূর্ব পুরুষ এদেশে এসেছিলেন এবং ঘোষগাতি গ্রামে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেছিলেন।
শেখ হবিবর রহমানরা দুই ভাই ছিলেন। তাঁর ছোটভাই শেখ ফজলর রহমানও একজন বিখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন। তিনি শিক্ষকতা ও ধর্ম প্রচার করে বিশেষ সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। বিশেষ করে ‘পুলুম আঞ্জুমানে হেমায়তুল ইসলাম’ নামক ধর্মীয় সামাজিক সংগঠনের সম্পাদক ও ‘আলমগীর লাইব্রেরীর পক্ষে বড় ভাই শেখ হবিবর রহমানের বেশ কয়েকখানি পুস্তক প্রকাশ করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।
শেখ হবিবর রহমানের লেখাপড়া গ্রামের পাঠশালায় শুরু হয়। পরে পুলুম প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে উচ্চ প্রাথমিক পাঠ শেষ করে তিনি ফুলতলা ইউনিয়ন হাইস্কুলে ভর্তি হন। আরও পরে ১৯০৭ সালে সেখান হতে ট্রান্সফার সার্টিফিকেট নিয়ে ১৯১০ সালে যশোর জেলা স্কুলে ভর্তি হন এবং ম্যাট্রিক পাশ করেন। ম্যাট্রিক পাশের আগেই ১৯০৯ সালে তাঁর স্নেহময়ী পিতা ইন্তিকাল করেন। এজন্য তাঁর শিক্ষাজীবন দারুণ অর্থকষ্টের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়। পিতৃবিয়োগের পর তাঁকে বহু কষ্টে তাঁর যাবতীয় খরচ নির্বাহ করতে হত। ১৯১৪ সালে তিনি বি.এ. পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে অকৃতকার্য হন। এখানেই তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। বি.এ. ক্লাসের ছাত্র থাকাকালে তিনি সাপ্তাহিক মোহাম্মদী পত্রিকার সহকারী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে তিনি যশোর জেলা স্কুলে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। আরও পরে ১৯২২ সালে কলকাতা ডেভিড হেয়ার ট্রেনিং কলেজে এল.টি. ভর্তি হন এবং ১৯২৩ সালে এল.টি. পাশ করেন।
ঐ বছরই তিনি বারাসাত গভর্নমেন্ট হাইস্কুলে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। নয় মাস পরে তাঁকে মক্তব সাব ইন্সপেক্টর হিসেবে খুলনায় বদলী করা হয়।
শেখ হবিবর রহমান সাহিত্যরত্নকে ১৯২৭ সালে খুলনা হতে হুগলী ব্রাঞ্চ স্কুলে বদলী করা হয় এবং সেখানে ৪ বছর চাকুরী করার পরে ১৯৩০ সালে পুনরায় তাকে বারাকপুর সরকারী হাইস্কুলে বদলী করা হয়। এই স্কুলের সহকারী শিক্ষক হিসেবে ১৯৪৪ সালে তিনি চাকরী হতে অবসর গ্রহণ করেন।
খুলনা শহরে অবস্থানকালে তিনি পুনরায় ১৯৫১ সালে করোনেশন বালিকা বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকের পদে যোগদান করেন এবং কর্মজীবন হতে দ্বিতীয়বারের মত ১৯৬০ সালে অবসর গ্রহণ করেন।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠরত অবস্থায়ই তাঁর মধ্যে সৃজনশীল রচনার প্রেরণা দেখা যায়। এই সময়ে তিনি ‘গো-জাতির প্রতি অত্যাচার’ নামে একটি প্রবন্ধ রচনা করেন। পয়গ্রাম কসবা মাইনর স্কুলে অধ্যয়নরত অবস্থায় মুনসী মুহম্মদ মেহেরউল্লা এক ধর্মসভায় গেলে সেখানে তিনি দুটি কবিতা পাঠ করেন। কবিতা দু’টি শুনে মুনসী মেহেরউল্লা তাঁকে ‘শিশুকবি’ খেতাবে ভূষিত করেন। তাঁর প্রথম প্রকাশিত লেখা ‘পেচক পন্ডিত’ নামের একটি কবিতা। কবিতাটি ১৩১৪ সনের ১৫ আশ্বিন ‘মোসলেম সুহৃদ’ এবং ১৮ আশ্বিন ‘মিহির ও সুধাকর’ পত্রিকায় ছাপা হয়।
মাত্র ১৬ বছর বয়সে ১৯০৬ সালে তিনি রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত ‘কোহিনুর কাব্য’। ফুলতলা(খুলনা) জুনিয়র মাদ্রাসার সেক্রেটারী মৌলভী মোহাম্মদ কাসেমের উপদেশে ‘বাংলা মৌলুদ শরীফ’ রচনা করতে গিয়ে এই মহাকাব্য রচনা করেন।
তাঁর প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের নাম ‘পারিজাত’, এটি ১৯১২ সালে যশোর হতে মৌলভী আলতাফ হোসেন প্রকাশ করেন। এরপর ১৯১৯ সালে দ্বিতীয়, ১৯২৪ সালে তৃতীয় এবং ১৯৩৩ সালে কাব্যগ্রন্থটির চতূর্থ সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এর কবিতাগুলি কবির ছাত্রজীবনে ১৩১২ হতে মাঘ ১৩১৬ সময়ের মধ্যে লিখিত। ‘পারিজাত’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হবার পর তৎকালীন সাময়িক পত্রপত্রিকায় ব্যাপক লেখালেখি হয়। ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকা ‘পারিজাত’কে কবিতা কাননের যথার্থ পারিজাত বলে অভিহিত করে। পারিজাত পাঠ করে শেরে বাংলা একে ফজলুল হক এ কাব্যগ্রন্থকে String of small poems………….verses are melodious and the rhythm admirable বলে মন্তব্য করেন।
তাঁর অন্যান্য গ্রন্থাবলীঃ
কোহিনুর কাব্য, চেতনা কাব্য, আবেহায়াত কাব্য, নিয়ামত, বাঁশরী, গুলশান ইত্যাদি। ফারসী কবি শেখ সাদীর ‘গুলিস্তা’ ও ‘বুস্তা’র কাব্যনুবাদও তিনি করেন। এছাড়া আলগীয়, কর্মবীর মুনশী মেহের উল্লাহ, ভারত সম্রাট বাবর, সুন্দর বনের ভ্রমণ কাহিনী, মালাবারে ইসলাম প্রচার, দবরুল মুখতার, আমার সাহিত্য জীবন ইত্যাদি গদ্য রচনাতেও তিনি মননশীলতার স্বাক্ষর রেখেছেন। কিশোর পাঠকদের জন্য তিনি রচনা করেছেন পরীর কাহিনী, মরনের পরে, ছোটদের হযরত মুসা, হাসির গল্প ভূতের বাপের শ্রাদ্ধ, শয়তানের সভা এবং শেখ সাদীর জীবনী ‘‘হায়াতে সাদী’’।
এছাড়া তাঁর অপ্রকাশিত গ্রন্থগুলি হল-আজও মনে পড়ে (গল্প গ্রন্থ), জিন্দাপীর আলমগীর(জীবনী গ্রন্থ), মজার গল্প (নৈতিক কথামূলক), গোঁড়ামি ও অন্ধবিশ্বাস (গদ্যগ্রন্থ), পরলোক প্রসঙ্গে ‘মরণের পরে’ (২য় খন্ড), শের সংহার কাব্য(কাব্যগ্রন্থ), সত্যের সন্ধান, ভাবিবার কথা, খোদাপ্রাপ্তির সোজাপথ ও দাদুর দফতর।
তাঁর উদ্যোগে ১৯১০ সালে ‘যশোর-খুলনা সিদ্দিকিয়া সাহিত্য সমিতি’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এটিই বাঙালী মুসলমানদের প্রথম সাহিত্য সংগঠন। এই সাহিত্য সংগঠনের নিকট হতে উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা লাভ করে পরবর্তীকালে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’ ১৯১২ সালে ও ‘মুসলিম সাহিত্য সমা ‘ ১৯২৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় তিনি কলকাতার পারিজাত সাহিত্য কুটিরের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। বি.এ. ক্লাশের ছাত্র থাকাকালে ১৯১৪ সালে তিনি ‘মাসিক মোহাম্মদীর’ সহকারী সম্পাদক ছিলেন। ১৯১৯ সালে তিনি কলকাতা হতে প্রকাশিত ‘মাসিক বঙ্গনূর’ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯২৫ সালে তিনি ‘নদীয়া সাহিত্য সভা’র পক্ষ হতে ‘সাহিত্যরত্ন’ উপাধি লাভ করেন।
১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে মিলিটারী কনভয়ের নীচে চাপা পড়ায় তাঁর পা ভেঙে যায়। ১৯৫৭ সালে তিনি বাংলা একাডেমীতে ৩০ টি মুদ্রিত ও কয়েকটি অমুদ্রিত গ্রন্থ দান করেন। ১৯৬০ সালে তিনি বাংলা একাডেমীর ফেলো নির্বাচিত হন। ঐ সনেই তিনি কর্মজীবন হতে অবসর গ্রহণ করেন।
১৯৬১ সালে ছোট ভাই শেখ ফজলর রহমানের মৃত্যুতে তিনি মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ১৯৬২ সালের ৭ মে ইন্তিকাল করেন। পরদিন ৮ মে ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সভাপতিত্বে বাংলা একাডেমীতে শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৭০ সালে শেখ হবিবর রহমান গ্রন্থাবলী(১ম খন্ড কাব্যগ্রন্থসমূহ) বাংলা একাডেমী হতে প্রকাশিত হয়।
……………………………………………………………………………………………………
গোলাম মোস্তফাঃ একজন মুসলিম কবির প্রতিকৃতি
কবি গোলাম মোস্তফা বিখ্যাত কবি, সাহিত্যিক ও শিক্ষক। তিনি বৃহত্তর যশোর জেলার ঝিনাইদহ মহকুমার (বর্তমান জেলা) শৈলকুপা থানার মনোহরপুর গ্রামের সম্ভ্রান্ত কাজী পরিবারে ১৮৯৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন কাজী গোলাম রব্বানী। মাতার মোসাম্মাৎ শরীফা খাতুন। তাঁর দাদা কাজী গোলাম সারওয়ার। গোলাম মোস্তফার পূর্বপুরুষ ছিলেন মুগল যুগে বিচার বিভাগের পদস্থ কর্মকর্তা। তাদের উপাধি ছিল কাজী। সেই সূত্রে গোলাম মোস্তফার পিতা, পিতামহ কাজী উপাধি গ্রহণ করেন। কিন্তু গোলাম মোস্তফা নিজে কোন অর্জিত সম্মান বা প্রচলিত কৌলিণ্য প্রথার যৌক্তিকতা খুঁজে না পাওয়ায় কাজী উপাধি গ্রহণ করেননি। বহুকাল পূর্ব থেকেই মনোহর পুরের কাজী পরিবার ছিল আরবি, ফারসি ও বাংলা ভাষাতে সুপণ্ডিত। কবি গোলাম মোস্তফার জন্মসাল নিয়ে একটু কথা আছে। তিনি নিজেই “আমার জীবন স্মৃতি” তে লিখেছেন: ১৮৯৭ খৃস্টাব্দে আমার জন্ম। কিন্তু আমার মনে আছে শৈলকুপা হাইস্কুলে ভর্তি হবার সময় আমার আব্বা আমার বয়স প্রায় দুই বছর কমিয়ে দিয়েছিলেন। কাজেই প্রকৃত জন্ম হয়েছিলো সম্ভবত ১৮৯৫ খৃস্টাব্দে। তবে এটা ঠিক যে, বাংলা তারিখ ছিলো ১৩০৪ সালের ৭ ই পৌষ রবিবার।কবির স্মৃতিকথা থেকেই আমরা কবির সঠিক জন্ম সন, বাংলা মাসের হিসেব এবং দিনের নাম রবিবার পাই। কিন্তু ইংরেজি মাসের হিসেবটা উহ্য থেকে যায়। তাঁর সঠিক জন্ম তারিখটা পরিবার থেকে সংরক্ষণ করা হয়নি। কবির পিতার দুই স্ত্রীর মধ্যে প্রথম স্ত্রীর গর্ভে বড়– নামে এক কন্যা এবং কাজী গোলাম মোস্তফা ও কাজী গোলাম কাওসার নামে দুই পুত্রের জন্ম হয়। দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভে তিনটি সন্তান তাঁরা যথাক্রমে কাজী গোলাম কুদ্দুস, মাজু এবং খুকি। কাজী গোলাম মোস্তফাই আমাদের প্রিয় কবি গোলাম মোস্তফা। এই পরিবারের আদি নিবাস ছিল ফরিদপুর জেলার পাংশা থানার নিবেকৃষ্ণ পুর গ্রামে। কবির মাতা ছিলেন একজন স্বভাব কবি। স্বভাব কবিত্ব ব্যক্তি মায়ের সাথে থেকে কবির মধ্যেও কবিত্ব ভাব বৃদ্ধি পেতে থাকে। দেশ ও জাতির ভবিষ্যতের আশা আকাঙ্খা ও স্বপ্নের পথিকৃত শিশুদের নিয়ে এমন শাশ্বত ও চিরন্তন বাণী সিঞ্জিত লেখা যার কলমের ডগায় বেরিয়ে আসে, তিনিই ইসলামী রেনেসাঁর এক বলিষ্ঠ কণ্ঠ স্বর কবি গোলাম মোস্তফা।
কৈশোর ও বাল্য জীবন
কবির বাল্য জীবন নিজ গ্রাম মনোহর পুরেই কেটেছে। কুমার নদী বিধৌত মনোহরপুর গ্রামের স্নিগ্ধ সৌন্দর্য, সরল আতিথিয়তা বাৎসল্য গায়ে মেখেই কবি বেড়ে উঠে ছিলেন।তাঁর জন্মস্থান মুখরিত ছিল যমুনা, কুমার মধুমতি, চিত্রা, ভৈরব, ভদ্রা চন্দনা, নবগঙ্গা, হানু বারাসিয়া, মাথাভাঙ্গা আর কপোতাক্ষ প্রভৃতি সেকালের খরস্রোত নদীর কলতানে। বাংলাদেশে বোধকরি আর কোন জেলায় এত নদীর রূপালী ধারার মিলন ঘটেনি। এসব বহমান নদীর তীরে নারকেলÑখেজুর কুঞ্জ ঘেরা শ্যামল প্রকৃতি যে কোন ভাবুক মানুষের মনে সঞ্চার করে কাব্যকলার মাধুরি। এ গ্রামীন পাগলকরা সৌন্দর্যই শিশু গোলাম মোস্তফাকে ভাবুক করে গড়ে তোলে ও কবি হতে সাহায্য করে। কবি গোলাম মোস্তফা তাঁর কবিতায় প্রকৃতির বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে :
শারদ প্রভাত চাদিনীর রাত সুপ্তি নীরব ধরা
আতট পূরতি সরসী সলিল পদ্ম পানায় ভরা।
কলমী লতিকা ডাঁটায় ও পাতায় ছাইয়া ফেলেছে জল
মাঝে মাঝে তার নানান রঙের ফুটেছে পুষ্পদল।
এই কবিতায় কবি তাঁর চারপাশের নদী প্রকৃতির এক অপূর্ব বর্ণনার মাধ্যমে কাব্যরস পিপাসুকে উপহার দিয়েছেন নিটোল ছন্দ সৌকর্ষ এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যময়তা। কবিতার মতই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক মোহনীয় রূপ গায়ে মেখেই কবির শৈশব ও কৈশোরের দিনগুলো অতিবাহিত হয়। গ্রামের স্নিগ্ধ শ্যামল সৌন্দর্যই তাঁর প্রাণে প্রথম কবিত্বভাব জাগিয়েছিলো। বস্তুত এই মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশই ছিল A meet nurse for a Poetic Child তাইতো পরিণত বয়সে তিনি লিখতে পেরেছিলেন:
নিখিলের এত শোভা, এত রূপ, এত হাসি গান
ছাড়িয়া মরিতে মোর কভু নাহি চাহে মন প্রাণ।
এ বিশ্বের সবই আমি বাসিয়াছি ভালো
আকাশ বাতাস জল রবি শশী তারকার আলো।
প্রাকৃতিক পরিবেশে সহজ সরল মাটির গন্ধে বেড়ে উঠার কারণেই সারা জীবন কবির মধ্যে সরলতাবোধ, সম্প্রীতিবোধ, আতিথিয়তাবোধ, মানবতাবোধ তার ব্যক্তিত্বের সাথে মিশে ছিলো। কবি হতে পেরেছিল উদার ও সরলতার প্রতিক এক মানসভূমি। কিন্তু কবির বেড়ে ওঠার জীবনটা মোটেই স্বচ্ছন্দ ছিলো না। অনেক ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়েই তাকে সাফল্যের মুখ দেখতে হয়েছিল। কবি কন্যা ফিরোজা খাতুন লিখেছেন: আমার আব্বা কবি গোলাম মোস্তফার হাতের লেখার মত তাঁর ভাষাও অতি সুন্দর ও মিষ্টি স্বচ্ছন্দ গতি একটুও বাধে না কোথাও। কিন্তু তাঁর জীবন অত সহজ ও স্বচ্ছন্দ ছিল না। তাঁর জ্ঞান পিপাসিত প্রতিভার তরীকে উজান পথে অনেক ঝড় ঝাপটার মুকাবিলা করে বেয়ে নিতে হয়েছে লক্ষ্যস্থলে। শৈশব কালেই সৎমা থাকায় স্বভাবতই বাপের অবহেলায় কখনও মামার বাড়ি কখনও নিজের বাড়ি থাকতে হতো। আর্থিক অনটনে শৈশবেই টিউশনি করতে হতো, তারপরও ক্লাসে ফাষ্ট হয়েছেন। তার জীবনকে সংগ্রামের মধ্যে পরিচালিত করার মাধ্যমে শৈশবের সে সংগ্রাম তিনি কাটিয়ে উঠে ছিলেন। জীবনকে সাজিয়েছিলেন বর্ণাঢ্যতায়। নিজ যোগ্যতা ও মেধার কারিশমায় চলমান জীবনকে করেছিলেন উচ্চকিত দ্যুতিময়।
শিক্ষা জীবন ও মানস গঠনঃ
শিক্ষার প্রতি গভীর মনোযোগের কারণেই মাত্র চার বছর বয়সেই পিতা মুন্সি গোলাম রব্বানীর কাছে কবির লেখা পড়ার হাতে খড়ি হয়েছিল। মনোহরপুরের পাশ্ববর্তী দামুদিয়া গ্রামের পাঠ শালাতে প্রথমে শিশু গোলাম মোস্তফাকে ভর্তি করা হয়। এখানে কিছুদিন লেখাপড়ার পর কবিকে নিকটবর্তী ফাজিলপুর গ্রামের পাঠ শালাতে ভর্তি করা হয়।
ফাজিলপুর পাঠ শালায় দুই বছর লেখাপড়া করবার পর তাঁকে ভর্তি করা হয় শৈলকুপা হাই স্কুলের নীচের শ্রেণীতে। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি মেধাবী ছাত্র হিসেবে শিক্ষক ও ছাত্রদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন এবং বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম স্থান দখল করে পুরস্কৃত হন।
শৈলকুপা স্কুল থেকেই তিনি ১৪১৪ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে খুলনার দৌলতপুর কলেজ হতে ১৯১৬ সালে আই. এ. পাশ করেন। এরপর গোলাম মোস্তফা উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্যে তদানীন্তন বঙ্গ প্রদেশের রাজধানী কোলকাতা গমন করেন। ১৯১৮ সালে তিনি কোলকাতা রিপন কলেজ থেকে বি. এ. পাশ করেন। ঐ কলেজ থেকে ঐ বছর যশোরের কৃতি সন্তান মোহাম্মদ গোলাম হোসেন (১৮৭৩Ñ১৯৬৪ খৃ.) বহিরাগত পরীক্ষার্থী হিসেবে বি.এ. পাশ করেন। লেখক বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় (১৮৯৪Ñ১৯৫০ খৃ.)ও রিপন কলেজে পড়াকালীন সময়ে তাঁর সহপাঠী ছিলেন।
আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে তাঁর আর লেখাপড়া করা সম্ভব হয়নি। শিক্ষকতা পেশা গ্রহণ করার পর ১৯২২ সালে গোলাম মোস্তফা ডেভিড হেয়ার ট্রেনিং কলেজ থেকে বি. টি. পাশ করেন। এরপর আর কোন একাডেমিক ডিগ্রী অর্জন না করলেও সারা জীবন শিক্ষা প্রদান ও শিক্ষা অর্জনের পেছনেই ব্যয় করেছেন।
উনবিংশ শতাব্দীর শেষ লগ্নে যে সময়ের বৃত্তে কবি গোলাম মোস্তফার জন্ম হয়, সেই সময়টা বাঙালী মুসলমানদের জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ সময়Ñকারণ এই পর্বে অন্তত: তিনটি ক্ষেত্রে তাদের অগ্রগতির মাত্রা ছিল অত্যন্ত দ্রুত। এগুলো হল: শিক্ষা, রাজনীতি এবং আর্থিক। অবিভক্ত ভারতের বাংলা প্রদেশে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও রাজনৈতিক দিক থেকে তাদের কোন প্রভাব ছিল না।বিশ ও ত্রিশ দশকে কৃষক প্রজাপার্টির অভ্যূদয় (১৯১৯ খৃ.), বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার নির্বাচনে মুসলমান নেতাদের বিজয় (১৯৩৭ খৃ.) এসবই বাঙালী মুসলমানদের অগ্রগতিতে ভূমিকা রাখে। মুসলমানদের মধ্যে এর আগে যাঁরা নেতৃত্ব পদে ছিলেন তাঁরা প্রধানত অবাঙালী। বাঙালী সংস্কৃতি ও ইসলামী সংস্কৃতির মধ্যে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় যে সমন্বয়ের সুযোগ ছিলো, বরাবরই তাঁরা তা এড়িয়ে গেছেন। বরং বাঙালী মুসলমানদের উপর ইসলামী সংস্কৃতির নামে যা চাপানোর চেষ্টা করেছেন, তা প্রকৃতপক্ষে আরব ও পারস্য দেশের সংস্কৃতি। এ সময়কালে বাঙালী মুসলমানরা বহু মাসিক অর্ধমাসিক ও সাপ্তাহিক পত্র পত্রিকা প্রকাশে যুক্ত হয়ে পড়েন এবং সীমিত পর্যায়ে হলেও তাতে উদার দৃষ্টিভঙ্গি ও যুক্তিবাদীতার স্থান পেতে থাকে। এ প্রেক্ষাপটই কবি গোলাম মোস্তফার বেড়ে ওঠা এবং তাঁর মানস গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
চাকুরি জীবনঃ
বি.এ পাস করার পর তিনি ১৯২০ সালে ব্যারাকপুর সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এই স্কুলে থাকা অবস্থায় তিনি ডেভিড হেয়ার ট্রেনিং কলেজ থেকে বিটি ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯২৪ সালে তিনি ব্যারাকপুর স্কুল থেকে কলকাতার হেয়ার স্কুলে বদলি হন। সেখানে তিনি একটানা নয় বছর শিক্ষকতা করার পর কলিকাতা মাদ্রাসায় বদলী হন এবং এক সময় তিনি প্রধান শিক্ষকের পদ অলংকৃত করেন। উল্লেখ্য যে, আজ পর্যন্ত একমাত্র কবি গোলাম মোস্তফা ছাড়া অন্য কোন মুসলমান শিক্ষক বালিগঞ্জ স্কুলের উক্ত পদে আসীন হননি। তিনি ছিলেন মুসলমানদের মধ্যে একজন উচ্চ শিক্ষিত শিক্ষক।তৎকালে কলিকাতার কোন হাই স্কুলে গোলাম মোস্তফাই ছিলেন প্রথম মুসলমান হেডমাস্টার। তখনকার দিনে এই সম্মান খুব কম মুসলমানই পেয়েছেন। সেখান থেকে কবিকে বদলী করা হয় হুগলী কলেজিয়েট স্কুলে। এরপর ১৯৪০ সালে তাঁকে বাকুড়া জেলা স্কুলে বদলী করা হয়। এ সম্পর্কে কবি কন্যা ফিরোজা খাতুন লিখেছেন: এরপর আব্বা বাঁকুরায় জেলা স্কুলে বদলি হলেন। কলকাতা মানুষের সমুদ্রের মাঝে যেমন জ্ঞানের মুক্তা কুড়াবার আনন্দ পেয়েছেন, তেমনি হুগলীতে নদীর স্রোত বইয়েছেন বিশ্বনবীর প্রবাহে। দেশের বাড়িতে পেতেন সমতার মমতার বিস্তার। বাঁকুড়ার পাহাড় পর্বত ও প্রকৃতির সৌন্দর্যে মুগ্ধ করে কবিকে। সুষনিয়া পাহাড়ে পিকনিকে গিয়ে চূড়ায় বসে কবিতা লেখেন, গান করেন। সেখান থেকে ফরিদপুর বদলি হয়ে যান।
১৯৪৬ সালে তাকে সর্বশেষ ফরিদপুর জেলা স্কুলে বদলী করা হয়।ফরিদপুর জেলা স্কুল থেকেই তিনি ১৯৫০ সালে দীর্ঘ ত্রিশ বছর একটানা শিক্ষকতার মত মহান পেশার দায়িত্ব পালন করার পর স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন।তিনি পাকিস্তান আমলে পূর্ববাংলা ভাষা কমিটির সচিবরূপে কাজ করেন। ১৯৫০ সালে কবি গোলাম মোস্তফা অবসর গ্রহণ করেন এবং নিজের খরিদ করা বাড়ি ঢাকার শান্তিনগরে ১১৮, মোস্তফা মঞ্জিলে স্থায়ী ভাবে বসবাস করতে থাকেন।
একান্ত নিবিড়ভাবে সাহিত্য সাধনায় মনোনিবেশ করার জন্যই তিনি নির্ধারিত সময়ের তিন বছর আগেই শিক্ষকতার মহান পেশা থেকে অবসর নেন।
সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চা ঃ
কবিতা কবির কল্পনা, কবিতা কবির শৈল্পিক উচ্চারণ। কবিতার শিল্পরূপ থেকেই কবির সময়চেতন সুখ দুঃখ, আনন্দ বেদনা, মিলন বিরহ, স্বপ্ন দ্রোহ ইত্যাদির শিল্পমণ্ডিত প্রকাশ। একই কবিতায় সব রকম অনুভূতি থাকে না, কারণ কবির কবিতায় বিশেষ সময়ে বিশেষ চেতনায় প্রকাশিত হয় বিশেষ বিশেষ ভাব। কবি কল্পনায় ধরা পড়ে সেই ভাব, আপন কবিতার ভাষায় কবি তাকে শিল্পরূপ দেন।
কবি কল্পনার উৎস তাই সমাজ, এবং প্রকাশভঙ্গিতে থাকে তার সময়চেতনা। কবিতায় কবি যা বলতে চান তা পরিবেশ ও অবস্থানগত দ্বিধার কারণে কিংবা যে সমাজ কবি চান, আর যে সমাজে কবি বাস করেন, তার মধ্যের ব্যবধানে অতৃপ্ত ও অসহিষ্ণু হয়ে এমন ভাষা ব্যবহার করেন, যা আঙ্গিকগত উৎকর্ষ পায়।
ভাব আর রূপের এক অখণ্ড ও অবিচ্ছেদ্য ঐক্য থেকে জন্ম নেয় একটি কবিতা। এ কবিতা কবি রচনা করেন আপন মহিমায়। জীবনের সত্যকে তিনি যেভাবে আপন সত্ত্বায় ধারণ করেন, সেভাবেই নির্দিষ্ট হয়ে যায় কবিতার প্রকাশভঙ্গি, শৈলী ও রূপ। সৃষ্টিসম প্রজ্ঞা, জৈবিক ক্ষমতা, সমাজ ও সময়ের প্রভাবের সমন্বয়ে কবির মর্মভূমি কবিতা নির্মাণে অদৃশ্য শক্তির মত কাজ করে যায় এমনকি কবির অজ্ঞাতসারে। তেমনি নিতান্ত অজ্ঞাতে অন্তরালে শিশু বয়সেই কবির মধ্যে কাব্য চিন্তার উন্মেষ ঘটে। পিতা, পিতামহের পুঁথি পাঠ , বিয়ের দাওয়াত রচনা ইত্যাদি থেকে তাঁর মধ্যে কবিত্ব ভাব জেগে ওঠে। মুসলিম জাগরণের অগ্রদূত কবি গোলাম মোস্তফার অবদান বাংলা সাহিত্যে এক বিরল দৃষ্টান্ত।গোলাম মোস্তফা ছিলেন মূলত: কবি। কবি আমার জীবন স্মৃতিতে লিখেছেনÑ আমার বেশ মনে পড়ে, আমার কাব্য জীবনের প্রথম উন্মেষ হয় ১৯০৯ সালে। তখন আমি শৈলকুপা হাইস্কুলে পড়ছি। পঞ্চম শ্রেণীতে উঠবার পরই কেমন যেন একটা কাব্যিক ভাব আমার মধ্যে এলো।
১৯১১ সালে কবি যখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র তখন গ্রীষ্মের দীর্ঘ ছুটি কাটানোর পর তাঁর এক বন্ধুকে উদ্দেশ্য করে একটি চিঠি কবিতায় রচনা করেন। এটিই তাঁর প্রথম রচনা । কবিতাটি হল :
এস এস শীঘ্র এস ওহে ভ্রাতধন
শীতল করহ প্রাণ দিয়া দরশন।
ছুটি ও ফুরাল স্কুল ও খুলিল,
তবে আর এত দেরি কিসের কারণ।
পত্রিকায় প্রকাশিত কবির প্রথম কবিতার নাম আদ্রিয়ানোপল উদ্ধার (১৯১৩ খৃ.)। কবি তখন দশম শ্রেণীর ছাত্র। প্রখ্যাত সাংবাদিক মওলানা মুহম্মদ আকরাম খাঁ সম্পাদিত সাপ্তাহিক মোহাম্মাদী তে ১৯১৩ সালে কবিতাটি ছাপা হয়। কবিতাটির রচনা ও প্রেক্ষাপটের বর্ণনা করতে গিয়ে কবি বন্দে আলী মিয়া লিখেছেন,পারিপার্শি¦ক পরিবেশ এবং বন্ধুবর্গের প্রেরণায় গোলাম মোস্তফার অবরূব্ধ কাব্যপ্রবাহ ঝর্ণাপ্রবাহের মত বাইরে আত্মপ্রকাশ করল। সেই সময়ে ইউরোপ ভূÑখন্ডে বলকান যুদ্ধে তুরস্ক সেনাবাহিনী বুলগেরিয়ানদের হাতে শোচনীয় ভাবে পরাজিত হওয়ায় সমস্ত মুসলিম জাহানে একটা বিপর্যয়তার ছায়া নেমে এসেছিলো। এমন সময়ে হঠাৎ সংবাদ পাওয়া গেল, কামাল পাশা বুলগেরিয়ানদের নিকট থেকে আদ্রিয়ানোপল পুনরূদ্ধার করেছেন। এই খবরে স্বজাতি বৎসল কিশোর কবির প্রাণ আনন্দে নেচে উঠলো। তিনি আদ্রিয়ানোপল উদ্ধার নাম দিয়ে এক রাতের মধ্যে একটি নাতিদীর্ঘ কবিতা লিখে ফেললেন। এরপর কবিতাটি তিনি সাপ্তাহিক মোহাম্মাদিতে পাঠিয়ে দিলেন। পরবর্তী সপ্তাহে কবিতাটি মুদ্রিত হলো। কবিতাটি ছিলো এরূপ :
আজিকে প্রভাত কি বারতা নিয়া
ধরায় আসিলো নামিয়া।
সেই সময় কবিতার ছন্দ, ভাব এবং প্রকাশভঙ্গি সবই ছিলো নতুন। তাই এই কবিতাকে কেন্দ্র করে পাঠক মহলে একটা ব্যাপক আলোচনার ঝড় বয়ে গেল।বাংলার মুসলিম সমাজে যে একজন আধুনিক কবির আবির্ভাব হয়েছে একথা সহজেই স্বীকৃতি লাভ করলো। গোলাম মোস্তফাও নব ভাবে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠলেন। সেই থেকে তিনি কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ইত্যাদি লিখতে শুরু করলেন। বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা (১৯১৭ খৃ.), আল এসলাম (১৯১৫ খৃ.), সাধনা ( ১৯১৬ খৃ.), সহচর ( ১৯১৫ খৃ.), সওগাত ( ১৯১৭ খৃ.), মাসিক মোহাম্মদী (১৯১৬ খৃ.), ইসলাম দর্শন (১৯২৭ খৃ.), মাহে নও সত্য বার্তা (১৯৩৮ খৃ.), মোয়াজ্জিন ( ১৯৩৮ খৃ.) প্রভৃতি সাময়িক পত্রিকায় এসব কবিতা নিয়মিত প্রকাশিত হতো। আল এসলাম (২য়ভাগ, ১৩২৩ সাল), (তয় ভাগ, ১৩২৪ সাল), (৪র্থ ভাগ, ১৩২৫ সাল), (৫ম ভাগ, ১৩২৬ সাল) পত্রিকায় নিয়মিত তাঁর কবিতা, প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়।
মৌলিক রচনা এবং পাঠ্যপুস্তকের বাইরে ইংরেজী সাহিত্যেও তাঁর প্রচুর দক্ষতা ছিল। সমসাময়িক The Musalman, The star of India, The Morning News, The Pakistan Observer, The Down প্রভৃতি পত্রিকায় তিনি অনেক তথ্যপূর্ণ প্রবন্ধ লিখেছিলেন। এগুলো পাঠ করলে ইংরেজী ভাষার উপরও যে কবির যথেষ্ট দখল ছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
Morning News তাঁর সর্ম্পকে মন্তব্য করেছিলো He is also a fine prose writer both in Bengali and English. বাঙালী মুসলমানের জাতীয় জাগরণের পথিকৃতদের অন্যতম কবি গোলাম মোস্তফা জীবনের প্রথম থেকেই পরিকল্পিতভাবে তাঁর লেখনি চালনা করেন।
তিনি নিজেই লিখেছেন: “যে যুগে আমার জন্ম সে যুগ বাংলার মুসলমানের অবক্ষয়ের যুগ। সে যুগে আমাদের সাহিত্যের না ছিলো কোন স্বাতন্ত্র, না ছিলো কোন স্বকীয়তা। প্রত্যেক জাতির মননশক্তি, ঐতিহ্য, ধ্যান ধারণা ও আশা আকাংক্ষা রূপায়িত হয় তাঁর মাতৃভাষার মধ্যে। সেই হিসেবে বাংলার মুসলমানদের কোন সাহিত্যই তখন রচিত হয়নি। আমি তাই ছোটবেলা থেকেই চেয়েছিলাম মুসলিমের জাতীয় সাহিত্য রচনা করতে। রবীন্দ্রনাথ ও সত্যেন্দ্রনাথের অনুরাগী হলেও, আমার মনে জেগেছিলো আমাদের নিজস্ব সাহিত্য সৃষ্টির একটা দূর্জয় আকাঙ্খা। সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির তাগিদে নয়Ñসহজ ভাবেই আমি বাংলা সাহিত্যে চেয়েছিলাম ইসলামী কৃষ্টির রূপায়ণ।”
উক্ত দৃষ্টি ভঙ্গিকে সামনে রেখেই ১৯১৩ সালের প্রথম লেখা প্রকাশ থেকে তাঁর পরবর্তী পঞ্চাশ বছরকাল তাঁর লেখালেখির গতি অব্যাহত ছিল। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ, শিশুতোষ সাহিত্য, গান, জীবনী, অনুবাদ সাহিত্য লিখেছেন। পেশাগতভাবে একজন শিক্ষক গোলাম মোস্তফা তাঁর দীর্ঘকালের অভিজ্ঞতার কল্যাণেই শিশু ও কিশোর মনস্তত্ত্বের সংগে ছিলেন নিবিড়ভাবে পরিচিত। এ কারণেই তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছে বহু স্মরণীয় শিশু ও কিশোরÑকবিতা রচনা। তাঁর রচিত আলোকমালা (১৯৫৩ খৃ.), পথের আলো (১৯৫৩ খৃ.), নতুন আলো (১৯৫৪খৃ.) এবং আলোকমঞ্জুরী (১৯৫৪খৃ.) সিরিজগুলো শিশু সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য অবদান।
ধর্ম বিশ্বাসই গোলাম মোস্তফার চিন্তার ভিত্তিভূমি। জগত ও জীবনের প্রতিটি সত্য সম্পর্কে তাঁর ধারণা প্রগাঢ় ইসলামী ভাবধারায় সম্পৃক্ত।গোলাম মোস্তফার সর্বশ্রেষ্ট অবদান বিশ্বনবী (১৯৪২ খৃ.) বহুল সমাদৃত। তাঁর লেখালেখির পঞ্চাশ বছরে প্রকাশিত
দুইটি উপন্যাস ঃ
১. রূপের নেশা (উপন্যাস, ১৩২৬ খৃ.), ২. ভাঙ্গা বুক (উপন্যাস, ১৯২১ খৃ.)।
আটটি মৌলিক কাব্যঃ
১. রক্ত রাগ (কবিতা, ১৯২৪ খৃ.), ২. খোশরোজ (কবিতা, ১৯২৯ খৃ.), ৩. সাহারা (কবিতা, ১৯৩৫ খৃ.), ৪. হাস্না হেনা (কবিতা, ১৯২৮খৃ.), ৫. কাব্যকাহিনী (কবিতা, ১৯৩৮ খৃ.), ৬. তারানা ই পাকিস্তান (কবিতা, ১৯৫৬ খৃ.), ৭. বনি আদম, প্রথম খণ্ড (কবিতা, ১৯৫৮ খৃ.), ৮. আমরা নতুন আমরা কুঁড়ি (কিশোর কবিতা, ১৯৮০ খৃ.)।
৫ টি কাব্যানুবাদ ও ১টি গল্প সংকলনঃ
১. মোসাদ্দস ই হালী (অনুবাদ কবিতা, ১৯৪১ খৃ.), ২. কালাম ই ইকবাল (কবিতা, ইকবাল কাব্যের অনুবাদ, ১৯৫৭ খৃ.), ৩. শিকওয়া (অনুবাদ কবিতা, ১৯৬০ খৃ.), ৪. জবাব ই শিকওয়া (অনুবাদ কবিতা, ১৯৬০ খৃ.), ৫. আল কুরআন (বাংলা কাব্য অনুবাদ, ১৯৫৭ খৃ.), জয় পরাজয় (গল্প, ‘রাসাইলু ইখওয়ানুস্ সাফা ১৯৬৯ খৃ. ১৩৭৬ বঙ্গাব্দ)।
৩টি কাব্য সংকলন ঃ
১.বুলবুলিস্তান (কাব্য সংকলন, ১৯৪৯ খৃ.), ২. কাব্য গ্রন্থাবলী, ১ম খণ্ড (কবিতা আবদুল কাদির সম্পাদিত, ১৯৭১ খৃ.), ৩. কাব্য সংকলন (কবিতা সৈয়দ আলী আশরাফ সম্পাদিত, ১৯৬০ খৃ.)।
৪টি জীবনী গ্রন্থঃ
১.বিশ্বনবী (জীবনী, ১৯৪২ খৃ.), ২. মরু দুলাল (জীবনী, ১৯৪৮ খৃ.), ৩. বিশ্ব নবীর
বৈশিষ্ট্য (জীবনী, ১৯৬০ খৃ.), ৪. হযরত আবুবকর (জীবনী, ১৯৬৫ খৃ.)।
২টি ধর্ম বিষয়ক গ্রন্থঃ
১. ইসলাম ও জিহাদ ( ১৯৪৭ খৃ.), ২. ইসলাম ও কমিউনিজম (ধর্ম, ১৯৪৯ খৃ.)।
৩টি রাজনীতি ও ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থ:
১. ইতিহাস পরিচয় (রাজনীতি, পাঠ্য, ১৯৪৭ খৃ.); ২. পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা (রাজনীতি, তা: বি:)। ৩.অবিস্মরণীয় বই, (ইতিহাস সম্পাদনা, ১৯৬০ খৃ.);
১টি প্রবন্ধ সংকলন:
আমার চিন্তাধারা (প্রবন্ধ সংকলন, ১৯৬২ খৃ.), ও
১টি গানের সংকলন:
গীতি সঞ্চয়ন (গান, ফিরোজা খাতুন সম্পাদিত: ১৯৬৫ খৃ., ১৯৬৮ খৃ. )।
পাঠ্য পুস্তক :
আলোক মঞ্জরী, (১৯৫৩ খৃ.), পথের আলো (১৯৫৩ খৃ.), নতুন আলো (১৯৫৪খৃ.), ইসলামী নীতিকথা (১৯৫৩ খৃ.), মনিমুকুর, ইতিহাস পরিচয় (১৯৪৭ খৃ.), ইতিকাহিনী, নতুন বাংলা ব্যকরণ, নতুন ব্যকরণ, মঞ্জু লেখা ইত্যাদি।
গ্রন্থসমূহ থেকেই বোঝা যায় কবি গোলাম মোস্তফা শুধু একজন কবিই ছিলেন না, সাহিত্যের নানা শাখায় ছিলো তাঁর স্বতস্ফূর্ত বিচরণ। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন তিনি। তিনি ছিলেন একজন চৌকষ লেখক। তাঁর অবদান সাহিত্যের নানা শাখায় পল্লবিত হয়ে আছে। উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ, সাহিত্য, জীবনী, গবেষণা, পাঠ্যপুস্তক, চিন্তাধারাসহ সাহিত্যের সকল বিভাগে তাঁর অবদানঅপরিসীম। তিনি তাঁর কাব্যের বিরাট একটা অংশ, গদ্যের বেশির ভাগ জুড়ে ইসলাম প্রচারের জন্য ব্যয় করে গেছেন। ইসলামী ঐতিহ্য চেতনায় নিজেকে ব্যপ্ত রেখেছেন। কবি গোলাম মোস্তফার প্রতিভা শুধু লেখনি মুখেই প্রকাশ পায়নি, তাঁর সাহিত্য রচনায় তাঁর অবদান অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাঁর শেষ অবদান হযরত আবু বকর সিদ্দিক [রা.] এর জীবনী। একজন কবি, একজন সাহিত্যিক, একজন প্রবন্ধকার, একজন জীবনীকার, একজন উপন্যাসিক, একজন গীতিকার, সর্বোপরি একজন লেখক হিসেবেএখানেই তিনি সার্থক।
তাঁর রচিত শিশুদের মন মাতানো অসংখ্য ছড়া/কবিতা ইত্যাদি রয়েছে-
ক. আমরা নূতন, আমরা কুঁড়ি, নিখিল বন-নন্দনে,
ওষ্ঠে রাঙা হাসির রেখা, জীবন জাগে স্পন্দনে।
……………………………………..
ভবিষ্যতের লক্ষ আশা মোদের মাঝে সন্তরে,
ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে।(কিশোর)।
খ. খুকুমনি জনম নিল যেদিন মোদের ঘরে,
পরীরা সব দেখতে এল কতই খুশী ভরে। (কিশোর)।
গ. এই করিনু পণ মোরা এই করিনু পণ
ফুলের মতো গড়ব মোরা মোদের এই জীবন।
হাসব মোরা সহজ সুখে গন্ধ রবে লুকিয়ে বুকে
মোদের কাছে এলে সবার জুড়িয়ে যাবে মন। (শিশুর পণ)।
ঘ. নুরু, পুশি, আয়েশা, শফি সবাই এসেছে
আম বাগিচার তলায় যেন তারা হেসেছে।
রাঁধুনিদের শখের রাঁধার পড়ে গেছ ধুম,
বোশেখ মাসের এই দুপুরে নাইকো কারো ঘুম।
*****************************
ধূলোবালির কোর্মা-পোলাও আর সে কাদার পিঠে,
মিছিমিছি খেয়া সবাই, বলে- বেজায় মিঠে।
এমন সময় হঠাৎ আমি যেই পড়েছি এসে,
পালিয়ে গেল দুষ্টুরা সব খিলখিলিয়ে হেসে। (বনভোজন)।
বিটিভির এক সময়ের জনপ্রিয় ‘নতুন কুঁড়ি’র সূচনা সঙ্গীত কবির কিশোর কবিতা হতেই নেওয়া হয়েছে।
কবি গোলাম মোস্তফা আমাদের সকলের মনমত করে সূরা ফাতিহার ছন্দোবদ্ধ ভাবানুবাদ লিখেছেন,
অনন্ত অসীম প্রেমময় তুমি
বিচার দিনের স্বামী।
যত গুণগান হে চির মহান
তোমারি অন্তর্যামী।
তাছাড়া তাঁর লেখা হামদ, নাত আমাদের দেশের ছেলে বুড়ো সকলের প্রিয়।
তাঁর প্রকাশিত বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থগুলি হচ্ছে রক্তরাগ, হাস্নাহেনা, খোশরোজ, সাহারা, কাব্যকাহিনী, এবং অনুবাদগ্রন্থ মুসাদ্দাসই হালী, তারানা ই পাকিস্তান, বনি আদম, অনুবাদ কাব্য-আল কুরআন, কালামে ইকবাল ও শিকওয়াও জবাব ই শিকওয়া এবং কবিতা সংকলন বুলবুলিস্তান। এছাড়া লিখেছেন ‘বিশ্বনবী’র মত পাঠক নন্দিত বিশালাকার গদ্য গ্রন্থ। তিনি কবি আল্লামা ইকবালের গোঁড়া ভক্ত ছিলেন। কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাথেও তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তিনি নজরুল ইসলামকে নিয়ে এ ছড়াটি লিখেছেন-
কাজী নজরুল ইসলাম
বাসায় একদিন গেছিলাম
ভায়া গান গায় দিনরাত
সে লাফ দেয় তিন হাত
প্রাণে হর্ষের ঢেউ বয়
ধরার পর তার কেউ নয়।
তিনি বাংলা একাডেমী, টেক্সট বুক বোর্ড, করাচীর বুলবুল একাডেমী, কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড, পূর্ব বাংলা ভাষা কমিটি(১৯৪৯), পাকিস্তান জাতীয় গ্রন্থাগারের গভর্নিং বডি এবং পাকিস্তান লেখক সংঘের সদস্য ছিলেন।
১৯৬০ সালে তিনি রাষ্ট্রীয়ভাবে সিতারা-ই-ইমতিয়াজ খেতাব, প্রেসিডেন্ট পদক ও আরো পাঁচ হাজার টাকা নগদ পুরস্কার লাভ করেন। ঐ ১৯৬০ সালে দিল্লীতে অনুষ্ঠিত ইন্দো-পাক সাংস্কৃতিক সম্মেলনে এবং ১৯৬১ সালে কলম্বোতে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর অধিবেশনে তিনি পাকিস্তানী লেখকবৃন্দের প্রতিনিধিত্ব করেন।
১৩ অক্টোবর ১৯৬৪ সালে সেরিব্রাল থ্রম্বসিস রোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আমাদের প্রাণপ্রিয় এই মহান কবি ইন্তেকাল করেন। আল্লাহ তাঁর রূহের মাগফিরাত দিন।