অধ্যায় এগার
মানুষের স্বরূপ
আল-কুরআনে নানা ধরনের দ্বীনি বিষয়ের বর্ণনার সাথে সাথেমানুষের বিভিন্ন প্রকার স্বভাব ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কেও সংক্ষিপ্ত চিত্র পেশ করা হয়েছে। আশ্চর্যের কথা হচ্ছে একটি কিংবা দুটি বাক্যের মাধ্যমে এমনভাবে মানুষের স্বরূপ উদ্ঘাটন করা হয়েছে, যেন তা জীবন্ত ও সচল হয়ে আমাদের সামনে এসে হাজির হয়।
সম্ভবত এটি সমস্ত মানুষের প্রকৃত স্বরূপের চিত্রায়ণ। এমন কিছু বৈশিষ্ট্য ও স্বরূপে মানুষের চিত্র উপস্থাপন করা হয়েছে- যাদেরকে পৃথিবীতে অধিক সংখ্যক দৃষ্টিগোচর হয়। মানুষের এ স্বরূপগুলো স্থায়ী। কোন জাতি বা কোন গোত্রই এ সকল বৈশিষ্ট্যের বাইরে নয়। (কোন না কোন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী তাকে অবশ্যই হতে হবে)।
এ আয়াতগুলো মূলত একটি বিশেষ অবস্থার প্রেক্ষিতে অবতীর্ণ হয়েছিল, কিন্তু এর মাধ্যমে মানুসের জীবন্ত ও বাস্তব এমন কিছু চিত্র অংকিত হয়েছে যা বিষয়বস্তুর দিকে অলৌকিক এবং চিরন্তনী। কেননা এ চিত্রগুলো স্থান ও কালের আবর্তনে শতাব্দীর পর শতাব্দী চক্রাকারে আবর্তিত হচ্ছে এবং তা সর্বদাই জীবন্ত-প্রাণবন্ত ও মূর্তমান।
এখন আমরা সংক্ষিপ্ত ভাবে কিছু উদাহরণ পেশ করছি, যেভাবে আল-কুরআনে পেশ করা হয়েছে। অবশ্য এ ধরনের কিছু উদাহরণ ইতোপূর্বে আমরা ‘শৈল্পিক চিত্র’ শিরোনামে উপস্থাপন করেছি। এর প্রকৃত জায়গা অবশ্য সে অধ্যায়টি-ই ছিল। তবু ঘটনা বা কাহিনীর সাথে এর সামঞ্জস্য আছে বিধায় আমর একে বক্ষমান অধ্যায়ে আলোচনা করার ইচ্ছে পোষণ করছি।
১. মানব প্রকৃতি
নিম্নোক্ত আয়াতটিতে এমন এক চিত্র অংকিত হয়েছে। যে চিত্রের সাথে সমস্ত মানুষিই সম্পৃক্ত। ইরশাদ হচ্ছে:
মানুষ যখন কোন বিপদ-মুসিবতে নিমজ্জিত হয় তখন সে দাঁড়িয়ে শুয়ে-বসে সর্ববস্থায় আমাকে ডাকতে থাকে। যখন তার বিপদকে দূর করে দেই তখন সে এমন আচরণ করে, মনে হয় সে বিপদে পড়ে আমাকে কখনো ডাকেনি। (সূরা ইউনুস: ১২)
উল্লেখিত সংক্ষিপ্ত দৃষ্টান্তে সত্য, সুন্দর এবং শৈল্পিক সৌন্দর্যের যাবতীয উপকরণের একত্রে সমাবেশ ঘটেছে। প্রকৃতপক্ষে মানুষের প্রকৃতি ও ধরনই এরূপ। মানুষের ফিতরাত হচ্ছে- যখন সে বিপদগ্রস্ত হয়েজীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে পৌঁছে যায় তখন মহাপরাক্রমশালী ও সর্বশক্তিমান আল্লাহর নাম এমনভাবে স্মরণ করতে থাকে, মনে হয় এর প্রতিকার তাঁর নিকট ছাড়া আর কারো নিকট নেই। বিপদ-মুসিবতদূর হয়ে গেলেই সে সত্য ও সুন্দরের পথ থেকে ছিটকে পড়ে আগের মতোই চলতে থাকে। মনে করে, তার উপর আদৌ কোন বিপদ আসেনি। পেছনের দিকে একবার ফিরে দেখার ফুরসৎটুকুওতার থাকে না। তার কষ্টের অবস্থাকে শৈল্পিক নিপুণতায় তুলে ধরা হয়েছে এভাবে:
(আরবী*********)
তারা তখন শুয়ে, বসে দাঁড়িয়ে (পেরেশান হয়ে) আমাকে ডাকে। (সূরা ইউনুস: ১২)
অতপর যখন বিপদ দূরীভূত হয়, তখনকার এক শৈল্পিকচিত্র উপস্থাপন করা হয়েছে এভাবে।
(আরবী*********) (যখন) বিপদ দূর হয়ে যায় তখন এমন আচরণ করে, মনে হয় তারা কখনো আমাকে ডাকেনি। (সূরা ইউনুস: ১২)
এ দুটো চিত্র থেকে প্রতীয়মান হয়, যখন মানুষ বিপদ-মুসিবতে পতিত হয় তখন তাদের জীবনেরগতি থেমে যায়। কখনো কখনো এ বাধা দীর্ঘতরহয়। আবর যখন বিপদ-মুসিবত দূর হয়ে যায় তখন জীবন তরী আবার চলতে শুরু করে। যেন কখনো তা বাঁধার সম্মুখীন হয়নি।
আল-কুরআনে এ ধরনের দৃশ্য বড় আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করা হয়েছে। যদিও তার ধরন এক নয়। তবু সবগুলের মূলচরিত্র একই। একটি কেন্দ্রে এসে সবগুলো একত্রিত হয়ে যায়। যেমন: (আরবী*********)
আমি মানুষকে নিয়ামত দান করলে সে মুখক ফিরিয়ে নেয় এবং অহংকারেদূরে সরে যায়, যখন তাকে কোন অনিষ্ট স্পর্শ করেতখন সে একেবারে হতাশ হয়ে যায়। (সূরাবনী ইসরাঈল: ৮৩)
(আরবী*********)
আর যদি আমি মানুষকে আমার রহমতের স্বাদ-অস্বাদন করতে দেই অতপর তা তার থেকে ছিনিয়ে নেই, তাহলে সে হতাশও কৃতঘ্নহয়। আর যদি তার ওপর আপতিতদুঃখ-কষ্টের পর তাকে সুখ ভোগ করতে দেই, তবে সে বলতে থাকে: আমার অমঙ্গলদূর হয়ে গেছে।তখন সে আনন্দে আত্মহারাহয়ে যায় এবং অহংকারে উদ্ধত হয়ে পড়ে। (সূরা হুদ: ৯-১০)
(আরবী*********)
মানুষকে তো সৃষ্টি করা হয়েছে অধৈর্য স্বভাবের করে। যখন তাকে অনিষ্টট স্পর্শকরে তখন সে হা-হুতাশ করে। আর যখন কল্যাণপ্রাপ্ত হয়, তখন কৃপণ হয়ে যায়। (সূরা আল-মা’আরিজ” ১৯-২১)
এ ধরনের আয়াত আল-কুরআনে অনেক। উদ্দেশ্য মানুষের চিরন্তনীস্বভাবগুলোবিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষের সামনে উপস্থাপন করা। কিন্তু মানুষের জীবনের এ তৎপরতা এক জায়গায় এসে মিলেমিশে এককাহর হয়ে যায়,তা হচ্ছে মানুষের শক্তি ও প্রদর্শনীতে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার প্রবণতা। যখন সে পুরোপুরি এ অবস্থায়জড়িয়ে যায় তখন সে মূল্যবান হায়াতটাকে এ কাজে নিয়োজিতকরে। আর যদি কোন বিপদ-মুসিবত এসে সে আশার অন্তরায় হয়ে যায় তবে পিছুটান দিতেও সে কুণ্ঠাবোধ করে না।
২. ঠুনকো বিশ্বাসী
মানুসের মধ্যে এক ধরনেরমানুষ আছে, যাদের বিশ্বাস খুবই ঠুনকো।যারা তাদের বিশ্বাসের ওপর দৃঢ় থাকতে পারে না। এরা ততোক্ষণ ঈমানের পথে থাকে যতোক্ষণ নিরাপদ ও নির্ঝামেলায় তা থেকে ফায়দা লাভ করা যায়। আর যদি কোনরূপ পরীক্ষা বাকাঠিন্য আরোপ করা হয়, সাথে সাথে তারা ঈমান ত্যাগ করতে দ্বিধা করে না।
(আরবী*********)
মানুষের মধ্যে কেউকেউ দ্বিধা-দ্বন্দ্বে জড়ি হয়ে আল্লাহর ইবাদত করে। যদি সেকল্যাণপ্রাপ্ত হয় তবে ইবাদতের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকে আর যদি কোন পরীক্ষায় পড়ে, ত বে পূর্বাবস্তায় ফিরে যায়। সে দুনিয়া ও আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্ত। বস্তুত এতো সুস্পষ্ট বিষয়।(সূরা আল-হাজ্জ: ১১)
(আরবী*********)
কতক লোক বলে: আমরা আল্লাহর ওপর বিশ্বাস স্থাপন করেছি, কিন্তু আল্লাহর পথে যখন তারা নির্যাতিত হয় তখন তারামানুষের নির্যাতনকে আল্লাহর আযাবের মতো মনে করে। যখন তোমার প্রতিপালকের কাছ থেকে কোন সাহায্য আসে তখন তারাবলতে থাকে: আমরা তো তোমাদের সাথেই ছিলাম। বিশ্বাসীর অন্তরে যা আছে আল্লাহ কি তা অবহিত নন? (সূরা আল-আনকাবুত: ১০)
৩. সুবিধাবাদী ধূর্ত প্রকৃতির লোক
কিছু লোক আছে, যারা সুবিধাবাদী ধূর্ত প্রকৃতির। সত্যের ওপর প্রতিষ্টিত কোনকাজ নিজেরাকরবে এব তা থেকে ফায়দা নেবে যখনই সেই কাজ অন্য কেউ করে তখন তা অস্বীকার করে বসে।
(আরবী*********)
যখন তাদের কাছে আল্লাহর কাছ থেকে কিতাব এসে পৌঁছল, যা সেই বিষয়ের সত্যায়ন করে যা তাদেরকাছে রয়েছে এবং সর্বদা কাফিরদের ওপরতারা বিজয় কামন করতা। যখন তাদের কাছে পৌঁছল যাকে তারা চিনে রেখেছিল তখন তারা জেনেশুনে অস্বীকার করে বসলো। তাই অস্বীকারকারীদের ওপর আল্লাহর লানত। (সূরা আল-বাকারা: ৮৯)
ফয়সালা করার জন্য যখনতাদেরকে আল্লাহর ও রাসূলের দিকে আহ্বান করা হয়তখন তাদের একদল মুখ ফিরিয়ে নেয়। আর সত্য তাদের স্বপক্ষে হলে তারা বিনীতভাবে রাসূলের কাছে ছুটে আসে। (সূরা আন-নূর: ৪৮-৪৯)
৪. ভীরুকাপুরুষ
কিছু লোক এমনও আছে যারা সত্যকে ঘৃণা ও অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখে থাকে, সত্যের সাথে পরিচিত হতে চায় না। ফলে একদিকে তাদের জিদ ও হঠকারিতা সত্য থেকে বিরত রাখে, অপরদিকে তাদেরকে কাপুরুষতায় পেয়েবসে। যার কারণে তারা কখনো সত্যেরমুখোমুখি হওয়ার সাহস পর্যন্ত পায় না।
(আরবী*********)
তারা সত্য ও ন্যায় প্রতিভাত হওয়ার পরও তোমার সাথে ঝগড়া করছিল, যেন তাদেরকে মৃত্যুর দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়াহচ্ছিল এবংতারা তা দেখছিল। (সূরা আল-আনফাল: ৬)
৫. হাসি-কৌতুক উদ্রেককারী লোক
কিছু লোক আজব প্রকৃতির। তারা অগ্রপশ্চাৎ না ভেবেই সত্য তেকে পলানোর চেষ্টা করে।
(আরবী*********)
তাদের কি হলো যে, তারা উপদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়? যেন তারা ইস্তত বিক্ষিপ্ত গর্দভ,হট্টগোলের কারণে পলায়নপর। (মুদ্দাসসির: ৪৯-৫১)
৬. শুধু আকৃতিতেই মানুষ
এ যেন চলমান জড় পদার্থ, যা দেখে লোকদের হাসি পায়।
(আরবী*********)
তুমি যখন তাদেরকে দেখ, তখন তাদের দেহাবয়ব অত্যন্ত আকর্ষণীয় মনে হয়। আর যদি তারা কথা বলে, তুমি তাদের কথা শোন। কিন্তু তারা তো প্রাচীরে ঠেকানো কাঠের মতো। (সূরা আল-মুনাফিকুন: ৪)
এটি মুনাফিকদের অত্যন্ত আকর্ষণীয় চিত্র। যা বেদনা মিশ্রিত কৌতুক।
৭. প্রশংসাকাংখী
নিজেরা কিছুই করে না, কিন্তু না করা বিষয়ের জন্য লোকজন তাদের প্রশংসা করুক তা তারা চায়।
(আরবী*********) এবং না করা বিষয়ের জন্য তারা লোকদের প্রশংসা কামনা করে। (সূরা আলে-ইমরান: ১৮৮)
প্রত্যেক যুগে এবং প্রত্যেক জায়গায়ই এ ধরনের লোকের উপস্থিতি দেখা যায়।
৮. সুবিধাবাদী
এমন কিছু লোক আছে, যারা সুবিধা দেখে একদলে ভিড়ে যায় আবার সেখানে অসুবিধা হলে অন্য দলে যোগ দেয়।
(আরবী*********)
এরা এমন ধরনের লোক, যারা সর্বদা তোমাদের কল্যাণ-অকল্যাণের প্রতীক্ষায় ওঁৎ পেতে থাকে। যদি আল্লাহর ইচ্ছায় তোমরা বিজয়ী হওতবে তারা বলে আমরা কি তোমাদের সাথে ছিলাম না? পক্ষান্তরে কাফিরদেরযদি আংশিক বিজয় হয় তবে তাদেরকে বলে, আমরা কি তোমাদের ঘিরে রাখিনি এবং মুসলমানদেরহাত থেকে রক্ষা করিনি?
৯. অদ্ভূত অহংকারী
নিচের আয়াত দুটোতে এক অদ্ভূত প্রকৃতির অহংকারীর চিত্র অংকিত হয়েছে। এদুটো আয়াতে ‘শৈল্পিক চিত্র’ শিরোনামেও উল্লেখ করা হয়েছে।
(আরবী*********)
আমি যদি ওদের সামনে আকাশের কোন দরজাও খুলে দেই আর তারা দিনভর তাতে আরোহন করে, তবু তারা একথাই বলবে, আমাদের দৃষ্টি বিভ্রাট ঘটানো হয়েছে, না হয় আমরা যাদুগ্রস্তহয়ে পড়েছি।(সূরা হিজর১৪-১৫)
(আরবী*********)
যদি আমি কাগজে লিখিত কোন বিষয় তাদের প্রতি অবতীর্ণ করতাম। অতপর তারা তা হাত দিয়ে স্পর্শ করতো তবু কাফিররা এ কথাই বলতো: এটি প্রকাশ্য যাদু ছাড়া আর কিছুই নয়। (সূরা আনআম: ৭)
১০. ভীতু বেহায়া
যে ব্যক্তি ভীত কিন্তু তার সাথে বেহায়া বা নির্লজ্জও, তার দৃষ্টান্ত দেয়া হয়েছে এভাবে:
(আরবী*********)
আর যদি তুমি দেখতে, যখন তাদেরকে জাহান্নামের ওপর দাঁড় করানো হবে! তারা বলবে: কতোই না ভাল হতো যদি আমাদেরকে পুনরায় পৃথিবীতে পাঠান হতো। তাহলে আমরা প্রতিপালকের নিদর্শনসমূহকে মিথ্যে মনে করতাম না এবংয় আমরা ঈমানদার হয়ে যেতাম।তারা ইতোপূর্বে যা গোপন করতো তা তাদের সামনে প্রকাশিত হয়ে পড়েছে। যদি তাদেরকে পুনরায় পাঠান হয়তবু তারা তাই করবে, যা তাদেরকে করতেনিষেধ করা হয়েছিল। বস্তুত তারা মিথ্যেবাদী। (সূরা আন’আম: ২৭-২৮)
১১. দুর্বল মুনাফিক
এখানে দুর্বল এক মুনাফিকের উদাহরণ পেশ করা হয়েছে। সে নিজে যেমন কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে না ঠিক তেমনিভাবে সত্যকে মেনে নিতেও পারে না। প্রতি মুহূর্তে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে দুদোল্যমান থাকে।
(আরবী*********)
আর যখনই কোন সূরা অবতীর্ন হয়। তখন তারা একে-অন্যের দিকে তাকায় এবং তারা পরস্পর জিজ্ঞেসকরে কোন মুসলমান তোমাদেরকে দেখেছে কিনা, অতপর কেটে পড়ে। আল্লাহ তাদের অন্তরকে সত্যবিমুখ করে দিয়েছেন। নিশ্চয়ই তারা নির্বোধ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। (সূরা আত-তওবা: ১২৭)
]এ ধরনের লোক যখন চুপি চুপি ভাগতে থাকে তখন তা দেখার মতো দৃশ্য বটে।
১২. ওজর-আপত্তিকারী
এখানে এমনকিছু লোকের দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করা হচ্ছে যারা ভীরু, প্রতিশ্রতি ভঙ্গকারী এবং মিথ্যে ওজর-আপত্তিকারী।
(আরবী*********)
যদি নগদ পরওয়ার সম্ভাবনা থাকতো এবং যাত্রাপথ সংক্ষিপ্ত হতো, তবে অবশ্যই তারা তোমার সহযাত্রী হতো। কিন্তু তাদের যাত্রাপথ সুদীর্ঘ মনে হলে তারা এমনভাবে শপথ করে বলবে: আমাদের সাধ্য থাকলে অবশ্যই আমরা আপনাদের সাথে বের হতাম। সত্যিকথা বলতে কি, এরা নিজেরাই নিজেদের ধ্বংসের দিকেক ঠেলে দিচ্ছে। আল্লাহ জানেন এরা মিথ্যেবাদী। (সূরা আত-তওবা: ৪২)
১৩. কিছুলোক আছে যারা প্রতারণা ও ভণ্ডামীতে লিপ্ত। নিজেদেরকে যদিও তারা চালাক মনে করে কিন্তু তাদের মাথায় ভূষি ছাড়া আর কিছুই নেই। তারা মানুষকে ঠকানোর চেষ্টা করে কিন্তু বিধিবাম, তারা নিজেরাই নিজেদেরকে ঠকাচ্ছে।
(আরবী*********)
মানুষের মধ্যে কিছু লোক এমন রয়েছে যারা বলে: আমরা আল্লাহ এবং পরকালের ওপর ঈমান এনেছি অথচা তারা ঈমানদার নয়। তারা আল্লাহ এবং ঈমানদারদেরকে ধোঁকা দেয়। অথচা তারা নিজেদেরকে ছাড়া আর কাউকে ধোঁকা দিতে পারে না, তাদের এ অনুভূতিটুকু নেই।
১৪. বিপর্যয় সৃষ্টিকারী
এক প্রকার লোক আছে, যারা না জেনে না বুঝে বিপর্যয় সৃষ্টি করে বেড়ায় কিন্তু যদি তাদেরকে বিরত থাকারকথা বলা হয় তবে তারা তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে।
(আরবী*********)
আর যখন তাদেরকে বলা হয় পৃথিবীতে ফেতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করো না। তারা বলে আমরা তোসংস্কারের কাজ করছি। জেনে রাখ প্রকৃতপক্ষে তারাই বিপর্যয় সৃষ্টিকারী। কিন্তু সে উপলব্ধিটুকু তাদের নেই।
১৫. পার্থিব জীবনের মোহে মোহগ্রস্ত
এমন কিছু লো আছে, যারা পার্থিব জীবনকেই বেশি গুরুত্ব দেয়। যেখানেই থাকুক না কেন জৈবিক চাহিদাটাই তাদের কাছে বড়। তারা একে এতো বেশি গুরুত্ব দেয়, প্রয়োজনে লাঞ্ছনার জীবন যাপন করতে রাজী (তবু তার প্রতিবাদ করে মৃত্যুর ঝুঁকি নিতে রাজী নয়।)যা কোন স্বাধীনচেতা ব্যক্তির দ্বারা সম্ভবপর নয়। ইরশাদহচ্ছে:
(আরবী*********) তুমি তাদেরকে জীবনের প্রতি সবার চেয়ে বেশি লোভী দেখবে।
১৬. গোঁয়ারও স্থবির প্রকৃতির লোক
কিছু লোক এমনও আছে, মনে হয় তাদের পাগুলো পাথর দিয়ে তৈরী। তারা এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের কোন চেষ্টাই করে না।
(আরবী*********)
আর যখন তাদেরকে বলা হয়, আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তাকে মেনে চলো। তখন তারা বলে: কক্ষণও নয়, আমরা তো সেই বিষয়ই মেনে চলি যার ওপর আমাদের বাপ-দাদাকে পেয়েছি। যদিও তাদের বাপ-দাদারা কিছুই জানতো না। চিনতো না সরল পথ। (সূরা বাকারা: ১৭০)
১৭. স্বেচ্ছাচারী দল
কিছু লোক আছে, যারা কোন নির্দিষ্ট পথের পথিক নয় কিংবা কোন দল বা জামা’আততের অন্তর্ভুক্তও তারা নয়। তাদের সম্পর্কে ইরমাদ হচ্ছে:
(আরবী*********)
কি আশ্চর্য! যখন তারা কোন অঙ্গীকারে আবদ্ধ হয় তখন তাদের একদল তা ছুঁড়ে ফেলে দেয়। বরং অধিকাংশই বিশ্বাসী নয়। (সূরা বাকারা:১০০)
১৮.সত্য হোক কিংবা মিথ্যে, ঝগড়া তারা করবেই
কিছু লোক আছে, যারা সত্য হোক কিংবা মিথ্যে, জেনে হোক কিংবা না জেনে ঝগড়া বা গণ্ডগোল তারা করবেই। মানুষ এ ধরনের লোককে যেখানেই দেখুক না কেন দুঃখিত না হযে পারে না।
(আরবী*********)
শোন! ইতোপূর্বে তোমরা যে বিষয়ে কিছু জানতে, তা নিয়ে বিবাদ করতে। এখন আবার যে বিষয়ে তোমরা কিছুই জান না, সে বিষয়ে কেন বিবাদ করছো? তোমরা যেজান না তা আল্লাহ্ ভাল মতোই জানেন। (সূরা আলে-ইমরান: ৬৬)
(আরবী*********)
কিছু লোকক জ্ঞান, প্রমাণ ও উজ্জ্বল কিতাব ছাড়াই আল্লাহ সম্পর্কে বিতর্ক শুরু করে দেয়। সে পার্শ্ব পরিবর্তন করে বিতর্ক করে যেন আল্লাহর পথ থেকে গুমরাহ করতে পারে। (সূরা আল-হাজ্জ: ৮-৯)
এখানে বিতর্ককারী এবং অহংকারী ব্যক্তির এক নিখুঁত চিত্র উপস্থাপন করা হয়েছে। সে অহংকারের বশবর্তী হয়ে এদিক-সেদিন ঘাড় ঘুরিয়ে বিতর্ক করতে থাকে।
১৯. কৃপণ
যারা প্রয়োজনের মুহূর্তে খরচ করে না, তারা কৃপণ। যদি কেউ খরচ করার পর ক্ষতিগ্রস্ত হয় তখন সে বিজয়ের হাসি হেসে বলে: যাক আমি খরচ না করে ভালই করেছি। আমার টাকাগুলো রয়ে গেল। আর যদি জিহাদে কোন কল্যাণ লাভ হয় তখন আক্বেষপ করে বলে: হায়! যদিও আমিও খরচ করতাম তবে ভাল হতো।
(আরবী*********)
তোমাদের মধ্যে এমন কতিপয় লোক আছে, যারা গড়িমসি করবে এবং তোমাদের ওপর বিপদ হলে বলবে, ভাগ্যিস আমি তাদের সাথে যাইনি, আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। আর যদি তোমাদের ওপর আল্লাহর অনুগ্রহ আসে, তখন তারা এমনভাবে বলতে শুরু করবে যে, তোমাদের সাথে তাদের কোন মিত্রতাই ছিল না। তারা বলবে: হায়! আমি যদি তাদের সাথে থাকতাম তবে আমিও সফলতা লাভকরতাম। (সূরা আল-বাকারা: ২০৪-২০৫)
২০.ভেতর ও বাইরে বৈপরীত্য
কিছু লোক আছে যাদের বাইরের এবং ভেতরের কোন মিল নেই। সম্পূর্ণ বিপরীত্ মনে হয় সে একজন নয় দু’জন মানুষ।
(আরবী*********)
এমন কিছু লোক রয়েছে যাদের পার্থিব জীবনের কথাবার্তা তোমাকে চমৎকৃত করে। আর তারা নিজেদেরমনের কথার ব্যাপারে আল্লাহকে সাক্ষী স্থাপন করে। প্রকৃতপক্ষে তারা ঝগড়াটে লোক। যখন ফিরে যায় তখন সেখানে অকল্যাণ সৃষ্টি করে, শস্যক্ষেত ধ্বংস ও প্রাণনাশের প্রয়াস পায়। অবশ্য আল্লাহ ফাসাদ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা পছন্দ করেন না। (সূরা আল-বাকারা: ২০৪-২০৫)
২১. মুমূর্ষু অবস্থায় তওবাকারী
কতিপয় লোক ইচ্ছেমাফিক গোটাজিন্দেগী যাপন করে মৃত্যু পূর্ব মুহূর্তে তওবা করে। কিন্তু তাদের এ তওবা গ্রহণযোগ্য নয়।
(আরবী*********)
আর এমন লোকদের জন্য কোন ক্ষমা নেই, যারা মন্দ কাজ করতেই থাকে আর যখন তাঁদের মাথার ওপর মৃত্যু পরওয়ানা ঝুলতে থাকে তখন বলে: আমি এখন তওবা করছি। আর তওবা নেই তাদের জন্য যারা কুফুরী অবস্থায় মৃত্যু বরণ করে। (সূরা আন-নিসা: ১৮)
২২. স্বল্প বুদ্ধির লোক
কিছু লোক এমন স্বল্প বুদ্ধির হয়ে থাকে, তাদের সামনে কি বলা হলো, না হলো সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন।
(আরবী*********)
তাদের মধ্যে কতক লোক আপনার কথার দিকে কান পাতে ঠিকই, কিন্তু বাইরে বের হওয়া মাত্র যারা শিক্ষিত তাদেরকে বলে: এইমাত্র তিনি কি বললেন? (সূরা মুহাম্মদ : ১৬)
২৩. প্রকৃত ঈমানদার
এ ধরনের লোকদের সম্পর্কে বলা হয়েছে:
(আরবী*********)
যাদের বলা হয়, তোমাদের সাথে মুকাবিলা করার জন্য বহু লোক সমাগম ঘটেছে এবং বহু জা-সরঞ্জাম জমা করা হয়েছে, তাদেরকে ভয়ড করো। তখন তাদের বিশ্বাস আরো দৃঢ়তর হয় এবং তারা উত্তর দেয়: আমাদের জন্য আল্লাহই যথেস্ট, আর তিনিতো কতো উত্তম অভিভাবক। (সূরা আল-বাকারা: ২৭৩)
২৪. দরিদ্র অথচ অল্পে তুষ্ট
কিছু লোক সম্পর্কে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ইরশাদ:
(আরবী*********)
দান-সাদকা তো ঐসব গরীব লোকদের জন্য। যারা আল্লাহর পথে আবদ্ধ হয়ে গেছে। জীবিকার সন্ধানে অন্যত্র ঘুরাফেরা করতে সক্ষম নয়। অজ্ঞ লোকেরা হাত না পাতার কারণে মতাদের অভাবমুক্ত মন করে। তোমরা তাদের লক্ষণ দ্বারা চিনবে। তারা মানুষের কাছে কাকুতি-মিনতি করে ভিক্ষা চায় না। (সূরা আল-বাকারা: ২৭৩)
২৫. আল্লাহকে ভয়কারী
এ সমস্ত লোকদের ব্যাপারে আল্লাহর ফরমান হচ্ছে:
(আরবী*********)
যারা ঈমানদার তারা এমন, যখন তাদের সামনে আল্লাহর নাম নেয়া হয় তখন তাদের অন্তর ভীত হয়ে পড়ে। আর যখন তাদের সামনে আল্লাহর কালাম পাঠ করা হয় তখন তাদের ঈমান বেড়ে যায়। তারা স্বীয় পরওয়ারদিগারের প্রতি ভরসা রাখে। (সূরা আল-আনফাল: ২)
২৬. আল্লাহর প্রকৃত বান্দা
(আরবী*********)
রহমানের প্রকৃত বান্দা তারা-ই, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফের করে এবং তাদের সাথে যখন মুর্খরা কথা বলতে থাকে, তখন তারা সালাম বলে সরে যায়। (সূরা আল-ফুরকান: ৬৩)
২৭. দানশীল ও উদার
দানশীল লোকদের ব্যাপারে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন:
(আরবী*********)
তারা আল্লাহ প্রেমে অভাবগ্রস্ত, ইয়াতিম ও বন্দীদেরকে আহার করায় এবং বলে আমরা কেবল আল্লাহর সন্তুস্টির জন্য তোমাদেরকে খাদ্য দান করি। তোমাদের কাছে কোন প্রতিদান কিংবা কৃতজ্ঞতা কামনা করি না।
২৮. ধৈর্যশীল
যারা ধৈর্যশীল তাদের ব্যাপারে ঘোষণা:
(আরবী*********)
তাদের ওপর যখন কোন বিপদ-মুসিবত আসে তখন তারা বলে: নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর নিকটই আমাদেরকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে। (সূরা আল-বাকারা: ১৫৬)
২৯. অপর ভাইকে অগ্রাধিকার দানকারী
(আরবী*********)
তারা মুহাজিরদেরকে ভালবাসে, মুহাজিরদেরকে যা দেয়া হয়েছে তার জন্য তারা অন্তরে ঈর্ষা পোষণ করে না এবং নিজেরা অভাবগ্রস্ত হলেও তাদেরকে অগ্রাধিকার দান করে। (সূরা আল-হাশর: ৯)
৩০. ক্রোধ দমনকারী ও অপরকে ক্ষমাকারী
ক্রোধ দমনকারী ও ক্ষমাশীল লোকদের ব্যাপারে আল্লাহর ফরমান-
(আরবী*********) তারা নিজেদের ক্রোধকে সম্বরণ করে এবং মানুষকে ক্ষমা করে দেয়। (সূরা আলে-ইমরান: ১৩৪)
ওপরে যেসব বৈশিষ্ট্যের কথা আলোচনা করা হলো তা সকল কালের এবং সকল মানুষের মধ্যেই পাওয়া যায়। আল-কুরআন তাদেরকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছে শত শত বছর পরও মনে হয় যেন তারা সবাই আমাদের সামনে বর্তমান।