লেখকের কথা
আমি কুরআনকে কিভাবে পেয়েছি?
এ মুহূর্তে আপনার হাতে যে বইটি আছে তা শুরু করার আগে এর আনুসাঙ্গিক একটি ঘটনা বলে নেয়া দরকার। যতোক্ষণ এ বইটি আমার স্মৃতিপটে সংরক্ষিত ছিল, নির্দিষ্ট কোন আকার আকৃতিতে ছিল না, ততোক্ষণ সে ঘটনাটিকে বর্ণনা করার তেমন প্রয়োজনও ছিল না। যখন এটি অস্তিত্ব লাভ করার জন্য ছাপাখানার টেবিলে গেল, তখন ঘটনাটিও আর নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ রিইলো না। এখন তা প্রকাশ হওয়াই দরকার।
তখন আমি খুব ছোট্ট। সবেমাত্র কুরআন পড়া শুরু করেছি, কিন্তু এর মর্মার্থ বা পাঠোদ্ধার ছিল আমার আয়ত্বের বাইরে। তাছাড়া এর উচ্চমানের বিষয়বস্তুগুলো আমার জ্ঞানের পরিসীমায় আবদ্ধ করা, তাও ছিল অসম্ভব। তবু আমি এর প্রতি তীব্র আকর্ষণ বোধ করেছি। তিলাওয়াতের সময় আশ্চর্যজনক বহু ঘটনা আমার মনের পর্দায় উঁকি মারতো। এ ছবিগুলো ছিল সাদাসিদা ও রঙহীন। তবু আমি তা আগ্রহ উদ্দীপনার সাথে বার বার কল্পনা করতাম। দীর্ঘ সময় পর্যন্ত সে ধারা অব্যাহত ছিল এবং আমাকে তা আনন্দ দিত।
সাদাসিদা এ ছবিগুলোর মধ্যে যেগুলো আমার মনমগজে বদ্ধমূলণ হয়ে ছিল তার একটি ছবি নিম্নোক্ত আয়াতটি তিলাওয়াত করা মাত্র আমার সামনে ভেসে উঠতো।
(আরবী**********)
মানুষের মধ্যে এমন কতিপয় লোক আছে যারা প্রান্তিক অবস্থানে দাঁড়িয়ে আল্লাহর ইবাদত করে। যদি পার্থিব কোন স্বার্থ দেখে, সেদিকে ঝুকে পড়ে। আর যদি কোন বিপদ পরীক্ষায় নিমজ্জিত হয় তখন তাদের চেহারাকে ঘুরিয়ে ফেলে। প্রকৃতপক্ষে তারা ক্ষতিগ্রস্ত দুনিয়ায় এবং আখিরাতে। (সূরা আল-হাজ্জ : ১১)
এই খেয়ালী ছবিটি যদি আমি কারো সামনে উপস্থাপন করি, তার হাসা উচিত নয়। এ আয়াত শোনা মাত্র আমার স্মৃতিপটে যখন এ ধরনের ছবি ভেসে ওঠতো তখন আমি এক গ্রামে থাকতাম। গ্রামের পাশে উপত্যকার মাঝে একটি টিলার ওপর দাঁড়িয়ে নামায পড়ছে কিন্তু সে সংকীর্ণ টিলার মাথায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না, তা থর থর করে শুধু কাঁপছে। যে কোন মুহূর্তেই ভেঙ্গে পড়তে পারে। আমি দূরে দাঁড়িযে এ অবস্থা দেখেছি এবং মনে মনে আশ্চর্য ও রোমাঞ্চিত হয়েছি।
এ রকম যে সমস্ত কল্পিত ছবি আমার মানসপটে ভেসে বেড়াতো তার একটি ছবি নিম্নোক্ত আয়াত পাঠে প্রতিভাত হয়ে উঠতো। আয়াতটি হলো:
(আরবী**************)
আর আপনি তাদেরকে শুনিয়ে দিন, সেই লোকের অবস্থা, যাকে আমি নিজের নিদর্শনসমূহ দান করেছিলা, অথচ সে তা পরিহার করে বেরিয়ে গেছে। আর তার পেছনে লেগেছে শয়তান, ফলে সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েছে। অবশ্য আমি ইচ্ছে করলে তাদের মর্যাদা বাড়িয়ে দিতাম কিন্তু সেতো জমিনের দিকেই ঝুঁকে থাকে এবং নিজের নফসের খাহেস পূরণেই নিমগ্ন হয়। তার অবস্থা কুকুরের মতো। তার ওপর আক্রমণ করলে জিহ্বা বের করে হাঁপাবে আর যদি ছেড়ে দাও তবু জিহ্বা বের করেই রাখবে। (সূরা আল-আ’রাফ: ১৭৫-১৭৬)
আমি এ আয়াতের অর্থ ও তাৎপর্য বুঝতাম না। কিন্তু তিলাওয়াত করা মাত্রই আমার মনের মুকুরে একটি ছবি এসে উপস্থিত হতো। দেখতাম, এক ব্যক্তি হা করে জিহ্বা বের করে হাঁপাতে হাঁপাতে আমার কাছে এসে দাড়াতো। আমি অপলক নেত্রে তার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। কিন্তু আমি বুঝতে পারতাম না, কেন সে এরূপ করছে। তবে আমি তার কাছে এগিযে যেতে সাহস পেতাম না। এমনি ধরনের হাজারো ছবি আমার খুব ভালো লাগতো। ফলে কুরআন তিলাওয়াতের প্রতি আমার এক তীব্র আকর্ষণ অনুভব করতাম, আর কল্পনার তেপান্তরে সেই ছবি খুঁজে বেড়াতাম।
সেই সময়টি আমার মধুর কল্পনা র বালখিল্যতার সাথেই অতিবাহিত হয়ে গেল। এখন কালের আবর্তনে কিছুটা ইলম ও বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছি। কিছু তাফসীর গ্রন্থ নিজের প্রচেষ্টায় ও শিক্ষকদের সহায়তায় বুঝার চেষ্টা করেছি। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, সুন্দর, সুমধুর ও মহিমান্বিত কুরআন তিলাওয়াতের সময় শৈশবে কী করেছি তার দিকে কোন দৃষ্টি যায় না। তবে কি আজকের কুরআন শৈশবের সেই কুরআন থেকে ভিন্নতর? এর মধ্যে কি কোন-ই সম্পর্ক নেই? সম্ভবত তা ছিল মনগড়া ব্যাখ্যার তেলসমতি।
আল কুরআনের বেশ কিছু তাফসীর দেখার পরেও মনে হলো, কোথায় যেন একটু ফাঁক রয়ে গেছে। তখন আমি সরাসরি কুরআন থেকে কুরআনকে বুঝার চেষ্টায় আত্মনিয়োগ করলাম। আশ্চর্য হলেও সত্যি, তখনই আমি সেই প্রিয় ও সৌন্দর্যমণ্ডিত কুরআনের সন্ধান পেলাম। সেই আকর্ষণীয় মনোরম ছবি আবার আমার সামনে ভেসে ওঠলো। শুধু পার্থক্য ছিল তা আগের মতো সাদাসিদা না হয়ে বুঝের পরিপক্কতার কিছুটা পরিবর্তন হয়েছিল। তখন আমি বুঝতে পারলাম এ ছবি নয়, উপমা। শুধু কুরআন বুঝার জন্য বর্ণনা করা হয়েছে। মূলত তা কোন বাস্তব ঘটনার প্রতিচ্ছবি নয়। তাই বলে তা অবাস্তব কোন কিছুও নয়।
আলহামদু লিল্লাহ! এবার আমি পূর্ণ মনোযোগ সহকারে অধ্যয়ন শুরু করলাম। হঠাৎ আমার মনে খেয়াল সৃষ্টি হলো, আমি যে ছবিগুলো দেখছি তা সাধারণের সামনে উপস্থাপন করবো, যেন তারা এ থেকে কিছু উপকৃত হতে পারে। তাই ১৯৩৯ সনে ‘আল মুকতাতাফ’ নামক পত্রিকার মাধ্যমে ‘আল-কুরআনের কতিপয় ছবি ও তার শৈল্পিক সৌন্দর্য নিয়ে আলোচনা করা হয়।
আমি সেখানে প্রমাণ করে দেখিয়েছি, আল-কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যে সমস্ত ছবি একেছেন তা কোন রঙ্গিন ক্যামেরায় বা কোন শিল্পীর তুলিতে আঁকা সম্ভব নয়। সে এক সমস্যময় মোহিত ছবি। সেখানে আমি এও বলেছিলাম যে, এ বিষয়ে স্বতন্ত্র একটি পুস্তক রচনা করাও সম্ভব।
তারপর ক’বছর অতিবাহিত হয়ে গেলো। এদিকে কুরআনী ছবিগুলো আমার মনে প্রচণ্ড প্রভাব ফেলতে লাগলো। আমি এর সর্বত্র শৈল্পিক সৌন্দর্যের সন্ধান পেতে থাকলাম। তখন আমি মনে করলাম, আমি একে পরিপূর্ণ ও বিস্তৃত পরিসরে নিয়ে যাই যে বিষয়ে আজও কেউ কলম ধরেনি। এ উদ্দেশ্যে আল-কুরআন অধ্যয়নে গভীরভাবে মনোনিবেশ করি এবং তা থেকে সেই সূক্ষ্ম ছবিগুলো একত্রিত করার চেষ্টা করি। কিন্তু মাঝে মাঝে এমন সত্ত্বেও কাজের গতি মন্থর হয়ে যেতো।
অবশেষে আল্লাহর নাম নিয়ে সংকলনে হাত দিলাম। আমার কাজ ছিল আল-কুরআনের শৈল্পিক ছবিগুলোকে একত্রিত করা এবং তার রচনা শৈলীঅ ও শৈল্পিক সৌন্দর্য সম্পর্কে আলোকপাত করা। আল-কুরআনের শাব্দিক বিশ্লেষণ ও ফিকহী আলোচনা করার কোন উদ্দেশ্য আমার ছিল না।
যখন আমি অগ্রসর হচ্ছি তখন এক নতুন রহস্য আমার সামনে উদ্ভাসিত হলো। লক্ষ্য করলাম আল-কুরআনের আঁকা ছবিগুলো অন্যান্য আলোচনা ও অংশ থেকে পৃথক কিছু নয়। এর আলাদা কোন অবস্থানও নেই। বরং গোটা কুরআনের বর্ণনা ভঙ্গিটাই হচ্ছে দৃশ্য ও ছবির শৈল্পিক বুনিয়াদ। শুধু শরয়ী নির্দেশগুলো এর ব্যতিক্রম। তখন আমি ছবিগুলো একত্রিত করার চেয়ে তার আসল উদ্দেশ্য ও সূত্র উদ্ভাবনে মনোযোগী হলাম, তারপর সেই সূত্র ও তার ব্যাখ্যা প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিলাম। যা আজ পর্যন্ত কেউ স্পর্শও করেনি।
সংকলনের কাজ যখন শেষ, তখন মনে হলো কুরআন এক নতুন রূপে আমার মনে আবির্ভূত হলো। আমি এমন এক কুরআনের সন্ধঅন পেলাম যা ইতোপূর্বে আর কখনো পাইনি। আগেও কুরআন আমার কাছে সৌন্দর্যমণ্ডিত ছিল্ তবে তা ছিল বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত আকারে। এখন পুরো সৌন্দর্য যেন অবিচ্ছিন্ন রূপে দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল। এ যেন এক বিশেষ ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। যার মধ্যে আশ্চর্য ও বিরল সম্পর্ক বিদ্যমান। যা কোন দিন আমি অনুধাবন করতে পারিনি। যার স্বপ্নও আমি কখনো দেখিনি। এমনকি অন্য কেউ কোন দিন তা কল্পনা করেনি।
আল-কুরআনের এসব দৃশ্যাবলী ও চিত্রসমূহের উপস্থাপনে আমার ধ্যান-ধারণা ও চিন্তা-চেতনার যথাযথ দাবি আদায় করার ব্যাপপারে যদি আল্লাহ আমাকে তওফিক দেন তাহলে সেটিই হবে এ পুস্তকের পূর্ণাঙ্গ সাফল্যের মাপকাঠি।