বাংলাদেশে মুসলিম শাসন
বাংলাদেশের মুসলিমদের রয়েছে এক সমৃদ্ধ ইতিহাস। প্রথম পর্যায়ে মুসলিমগণ এই দেশ শাসন করেছিলেন একাধারে পাঁচশত চুয়ান্ন বছর।
এই নিবদ্ধে আমরা অতি সংক্ষেপে মুসলিম শাসন কালের ভুলে যাওয়া ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
১. ইখতিয়ারউদ্দীন মুহাম্মদ বাখতিয়ার খালজী
ইখতিয়ারউদ্দীন মুহাম্মদ বাখতিয়ার খালজী ছিলেন বাংলাদেশে মুসরিম শাসনের স্থপতি।
ইখতিয়ারউদ্দীন মুহাম্মদ উত্তর আফগানিস্তানের একটি জনপদে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন বেঁটে। তাঁর হাত দুইটি ছিলো বেশ লম্বা। তাঁর চেহারা আকর্ষনীয় ছিলো না। তবে তিনি ছিলেন একজন প্রতিভাবান ব্যক্তি।
খৃষ্টীয় ১১৯৩ সনে তিনি ভারতে আসেন। দিল্লীতে তখন কুতবুদ্দীন আইবেকের শাসন। তিনি উত্তর ভারতের বাদায়ূনে এসে সেনাপতি মালিক হিযবারুদ্দীনের অধীনে চাকুরী গ্রহণ করেন। অতপর তিনি অযোধ্যা এসে গভর্ণর মালিক হুসামুদ্দীনের সুনজরে পড়েন ও মির্যাপুর জিলায় একটি জাগীর লাভ করেন।
ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ তৃর্ক মুসলিমদেরকে নিয়ে একটি সৈন্যদল গড়ে তোলেন। এর সাহায্যেূ তিনি নিকটতম অঞ্চলগুলো জয় করতে শুরু করেন।
খৃষ্টীয় ১২০২ সনে ইখতিয়ারউদ্দীন মুহাম্মদ বিহারের দিকে অগ্রসর হন। তখন বিহারের নাম ছিলো মগধ। উদন্তপুরী ছিলো মগধের রাজধানী। তিনি সসৈন্যে উদন্তপুরী পৌঁছে তা জয় করেন। তখন থেকে মগধ বিহার নামে অভিহিত হতে থাকে।
খৃষ্টীয় ১২০৩ সনে দিল্লীর সুলতান কুতবুদ্দীন আইবেক বাদায়ূন সফরে আসেন। ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বাদায়ূনে গিয়ে সুলতানের সাথে সাক্ষাত করেন। কুতবুদ্দীন আইবেক তাঁকে গৌড় বা লক্ষণাবতী জয় করতে উদ্বদ্ধ করেন। লক্ষণাবতীতে তখন ছিলো হিন্দু সেন বংশের শাসন।
সেনদের পূর্ব পুরুষ সামন্ত সেন দক্ষিণ ভারতের কর্ণাট থেকে এসে পশ্চিম বঙ্গের বর্ধমান অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন। সামন্ত সেনের পুত্র হেমন্ত সেন রাঢ় অঞ্চলে একটি ছোট্ট রাজ্য গড়ে তোলেন। হেমন্ত সেনের পুত্র বিজয় সেন রাঢ় রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটান। বিজয় সেনের পুত্র বল্লাল সেন এই রাজ্য আরো সুসংহত করেন। বল্লাল সেনের পুত্র ছিলেন লক্ষণ সেন।
সেনগণ ছিলেন উগ্র ব্রাহ্মণ্যবাদী, সাম্প্রদায়িক, পরমত বিদ্বেষী ও অত্যাচারী। তাঁরা বৌদ্ধ প্রজাদের উপর সীমাহীন নির্যাতন চালান। লক্ষণ সেন শাসিত গৌড় বা লক্ষণাবতী রাজ্যের রাজধানী ছিলো নদীয়া ও লক্ষণাবতী।
খৃষ্টীয় ১২০৩ সনে ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ তাঁর অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে গৌড় রাজ্য অভিমুখে রওয়ানা হন। তিনি এতো দ্রুততার সাথে চলছিলেন যে তাঁর অশ্বারোহী সৈন্যরাও তাঁর সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারছিলো না। তিনি যখন নদীয়া শহরে পৌঁছেন তখন তাঁর সাথে ছিলেন মাত্র আঠার জন অশ্বারোহী।
ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ ছিলেন অসীম সাহসের অধিকারী। আঠার জন যোদ্ধা নিয়েই তিনি রাজ-প্রাসাদের দিকে এগিয়ে চলেন। অতর্কিত হামলা চালিয়ে তিনি রক্ষীদেরকে পরাস্ত করে প্রাসাদে ঢুকে পড়েন। ভীত-বিহ্বল হিন্দু সৈন্যরা চীৎকার করতে থাকে। রাজা লক্ষণ সেন দুপুরের খাওয়া খেতে বসেছিলেন। মুসলিমদের আগমেনর খবর পাওয়ার সাথে সাথে তিনি খালি পায়ে প্রাসাদের পেছন দরওয়াজা দিয়ে পালিয়ে যান। অবশেষে বংগ রাজ্যের বিক্রমপুরে এসে তিনি অবস্থান গ্রহণ করেন।
ইখতিয়ারউদ্দীন মুহাম্মদ নদীয়া দখলের কয়েকদিন পর গৌড় বা লক্ষণাবতী আসেন।
ইখতিয়ারউদ্দীন মুহাম্মদ বাখতিয়ার খালজীর নেতৃত্বে মুসলিম শাসন কায়েম হওয়ার পর গৌড় রাজ্য প্রধানতঃ লাখনৌতি নামে আখ্যায়িত হতে থাকে।
ইখতিয়ার উদ্দীন মুহামম্দ লাখনৌতি রাজ্যকে তিনটি প্রধান প্রশাসনিক অঞ্চলে বিভক্ত করেন। অযোধ্যার মির্যাপুর জিলা, দক্ষিণ বিহার (মগধ) ও উত্তর বিহারের (মিথিলা) কিছু অংশ নিয়ে গঠিত ছিলো পশ্চিম অঞ্চল। এই অঞ্চলের প্রশাসক নিযুক্ত হন হুসামুদ্দীন আইওয়াদ খালজী। বীরভূমের লাখনূরকে কেন্দ্র করে গঠিত ছিলো দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল। এই অঞ্চলের প্রশাসক নিযুক্ত হন মুহাম্মদ শিরান খালজী। রাজমহল (বর্তমানে বিহারের অন্তর্ভূক্ত), মালদাহ, দিনাজপুর, রংপুর, রাজশাহী, বগুড়া, যশোরের কিয়দাংশ ও নদীয়া নিয়ে গঠিত ছিলো উত্তর-পূর্ব অঞ্চল। এই অঞ্চলের প্রমাসক নিযুক্ত হন আলী মারদান খালজী।
আঞ্চলিক প্রশাসকগণ আইন-শৃংখলা উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। যথারীতি রাজস্ব আদায় শুরু করেন। ইখতিয়ারউদ্দীন মুহাম্মদ একজন দীনদার ব্যক্তি ছিলেন। তিনি নিজেই কয়েকটি মাসজিদ ও ইসলামী শিক্ষালয় স্থাপন করতে থাকেন।
আভ্যন্তরীণভাবে লাখনৌতিকে সুসংহত করার পর ইখতিয়ারউদ্দীন মুহাম্মদ তিব্বত রাজ্য-জয়ের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। প্রথমে গৌড় বা লক্ষণাবতী শহরে ছিলো তাঁর রাজধানী। পরে তিনি দিনাজপুর জিলার দেওকোট নামক স্থানে একটি সেনানিবাস গড়ে তোলেন। তখন থেকে দেওকোটই হয় লাখনৌতি রাজ্যের রাজধানী। এখানে অবস্থান গ্রহণ করে তিনি তিব্বত অভিযানের প্রস্তুতি নেন। তিনি দশ হাজার তুর্ক মুসলিম নিয়ে একটি অশ্বারোহী বাহিনী গড়ে তোলেন।
খৃষ্টীয় ১২০৬ সনে তিনি সসৈন্যে দেওকোট থেকে রওয়ানা হন। প্রথমে তিনি পৌঁছেন কুচবিহার। এই অঞ্চলে তখন মেচ, কুচ, থারো ও থিহারো উপজাতি বসবাস করতো। তিনি তাদের সাথে মেলামেশা শুরু করেন। তাঁর ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে মেচ উপজাতির প্রধান ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁর নাম রাখা হয় আলী মেচ। তাঁর মাধ্যমে ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ অন্যান্য উপজাতির প্রধানদেরও সহযোগিতা লাভ করেন।
কুচবিহারে কিছুকাল অবস্থানের পর তিনি কামরূপের (আসাম) পথে অগ্রসর হন। আলী মেচ পথ প্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেন। ব্রহ্মপুত্র নদের উত্তর তীর ধরে তাঁরা সামনে অগ্রসর হতে থাকেন। আসামের গৌয়াহাটির নিকট দিয়ে প্রবাহিত বারনাদি নদীল ওপর ছিলো পাথরের তৈরী একটি পুল। আলী মেচ এই পুল পর্যন্ত ইখতিয়ারউদ্দীন মুহাম্মদকে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসেন। অতপর তিনি কুচবিহার ফিরে যান।
ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ পুলের ওপর দিয়ে বারনাদি নদী পেরিয়ে যান। তাঁর গন্তব্যস্থল তখনো বহু দূর। তবে একজন দুরদর্শী সমর বিশারদ হিসেবে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে তাঁর সৈন্যদের গমনপথের এই পুলটি নিরাপদ রাখা প্রয়োজন। তাই তিনি কিছুসংখ্যক সৈন্যকে এইপুল পাহারা দেয়ার জন্য রেখে যান।
আসাম-রাজ লাখনৌতির এই শক্তিধর শাসকের প্রতি বন্ধুসুলভ মনোভাব প্রদর্শন করেন।
আঁকাবাঁকা দুর্গমপতে পাহাড়ের চড়াই উৎরাই পেরিয়ে বীর যোদ্ধাদেরকে নিয়ে সামনে অগ্রসর হতে থাকেন ইখতিয়ারউদ্দীন মুহাম্মদ। হিমালয় পর্বতের পূর্ব কিনারা ধরে তিনি পনর দিন পর্যন্ত পত চলেন। ষোলতম দিনে তিনি পৌছেন তিব্বত সীমান্তে।
তিব্বত-রাজ একটি দক্ষ সেনাদল এখানে মোতায়েন রেখেছিলেন। দীর্ঘ পাহাড়ী পথ অতিক্রম করে মুসলিম সৈনিকগণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের মনোবল ছিলো অটুট। তাঁরা তিব্বত বাহিনীর সাথে যুদ্ধ শুরু করেন। কিন্তু তিব্বত বাহিনীকে পিছে হটিয়ে দেয়া সম্ভব হলো না। লাখনৌতি বাহিনী আর অগ্রসর হতে পারচিলেনা। এমতাবস্থায় অচেনা পাহাড়ী অঞ্চলে অবস্থান করাটাও ছিলো বিপজ্জনক। তাই ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নেন।
ইখতিয়ারউদ্দীন মুহাম্মদ তিব্বত বাহিনীকে পরাজিত করতে পারেননি, এই খবর শুনে কামরূপ রাজ তাঁর মনোভাব পরিবর্তয়ন করেন। তিনি মিত্রতার পথ পরিহার করে শক্রতার পথ বেছে নেন। তাঁর নির্দেশে কামরূপের সৈন্যরা বারনাদি নদীর ওপরে অবস্থিত পাথরের পুল পাহারায় নিযুক্ত মুসলিম সৈন্যদের ওপর অতর্কিত হামলা চালিয়ে তাদেরকে হত্যা করে। তারা পাথরের পুলটি ভেংগে ফেলে।
গৌয়াহাটির নিকটে পৌঁছে ইখতিয়ারউদ্দীন মুহাম্মদ নাজুক অবস্থার সম্মুখীন হন। পুল ভেংগে দেয়া হয়েছে। সামনে খরস্রোতা বারনাদি নদী। সৈন্যগণ ক্লান্ত-শ্রান্ত। নদী পাড়ি দেয়ার বিকল্প কোন ব্যবস্থা নেই।
এবারও এক দুঃসাহসিক সিদ্ধান্ত নিলেন লাখনৌতির অধিপতি। ঘোড়ার পিঠে বসেই খরস্রোতা নদী পার হতে হবে। তিনি সৈন্যদেরকে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন নদীতে। নদীল খরস্রোতের সাথে লড়াই করে এগুতে পারেনি ঘোড়াগুলো। ঘোড়াসহ সৈন্যগণ পাণিতে ডুবে প্রাণ হারান। দশহাজার অশ্বারোহী প্রায় সকলেই হারিয়ে যান।
ইখতিয়ারউদ্দীন মুহাম্মদ ও এক শতের কিছু বেশি অশ্বারোহী নদী পেরিয়ে আসতে সক্ষম হন।
সেরা সৈন্যদের হারিয়ে ইখতিয়ারউদ্দীন মুহাম্মদ মনভাংগা হয়ে পড়েন। বেদনা ভরা মন নিয়ে তিনি দেওকোট পৌঁছেন। তিনি জ্বরাক্রান্ত হন। দেওকোট ফিরে আসার তিনমাস পর তিনি ইন্তিকাল করেন।
২. ইযযুদ্দীন মুহাম্মদ শিরান খালজী
খৃষ্টীয় ১২০৬ সনে লাখনৌতির প্রথম মুসলিম শাসক ইখতিয়ারউদ্দীন মুহাম্মদ বাখতিয়ার খালজীর ইন্তিকাল হলে উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের প্রশাসক আলী মারদান খালজী লাখনৌতির কর্তৃত্ব লাভের চেষ্টা করেন। কিন্তু দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের প্রশাসক ইযযুদ্দীন মুহাম্মদ শিরান খালজী দ্রুত সসৈন্যে এগিয়ে আসেন। তাঁর মুকাবিলা করতে গিয়ে আলী মারদান খালজী পরাজিত ও বন্দী হন। এই অবস্থায় খালজী নেতৃবৃন্দ ইযযুদ্দীন মুহাম্মদ শিরান খালজীকেই লাখনীতির শাসক নির্বাচিত করেন।
বন্দীদশা থেকে কৌশলে পালিয়ে আলী মারদান খালজী দিল্লী চলে যান এবং দিল্লীর সুলতান কুতবুদ্দীন আইবেকের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করেন। কুতবুদ্দীন অযোধ্যার গভর্ণর কায়-মায রুমীকে লাখনৌতির দিকে সামরিক অভিযান চালাবার নির্দেশ দেন।
আলী মারদান খালজী দিল্লীতেই অবস্থঅন করতে থাকেন। পশ্চিম অঞ্চলের প্রশাসক হুসামউদ্দীন আইওয়াদ খালজী এতদিন চুপচাপ ছিলেন। কায়-মায রুমীল আক্রমণ কালে তিনি তাঁর সহযোগী হন ও দেওকোটের দিকে অগ্রসর হন। ইযযুদ্দীন মুহাম্মদ শিরান খালজী দেওকোট ছেড়ে পূর্ব দিকে সরে যান। কায়-মায রুমী দেওকোট পৌঁছে হুসামউদ্দীন আওয়াদ খালজীকে লাখনৌতির শাসক নিযুক্ত করেন। মুহাম্মদ শিরান খালজী বগুড়ার মাহিগঞ্জে নিজের লোকদের হাতে নিহত হন।
৩. হুসামউদ্দীন আইওয়াদ খালজী
খৃষ্টীয় ১২০৮ সনে হুসামউদ্দীন আইওয়াদ খালজী দেওকোটের মসনদে বসেন। এই সময় আলী মারদান খালজী গজনীর তাজউদ্দীন ইয়ালদুজের বিরুদ্ধে কুতবুদ্দীন আইবেককে সাহায্য করে তাঁল আরো বেশি প্রিয় হয়ে উঠেন। সুলতান কুতবুদ্দীন আইবেক আলী মারদান খালজীকে লাখনৌতির গভর্ণর নিযুক্ত করেন। আলী মারদান খালজী সসৈন্যে লাখনূতির দিকে অগ্রসর হন। হুসামউদ্দীন আইওয়াদ খালজী যুদ্ধের পথে না গিয়ে ১২১০ সনে দিল্লীর সুলতানের নমিনির নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।
৪. আলী মারদান খালজী
খৃষ্টীয় ১২১০ সনে আলী মারদান খালজ লাখনৌতির শাসক হন। ঐ বছর নভেম্বর মাসে দিল্লীর সুলতান কুতবুদ্দীন আইবেক ইন্তিকাল করেন।
লাহোর ভিত্তিক আমীরগণ কুতবুদ্দীন আইবেকের পুত্র আরামশাহকে ও দিল্লী ভিত্তিক আমীরগণ কুতবুদ্দীনের জামাতা ইলতুতমিসকে সুলতান হিসেবে গ্রহণ করেন। এই গোলযোগের সময় সিনধের গভর্ণর নাসিরউদ্দীন কাবাচা স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
আলী মারদান খালজী সুলতান আলাউদ্দীন আলী মারদান খালজী উপাধি দারণ করে লাখনৌতিতে স্বাধীনভাবে শাসনকার্য চালাতে শুরু করেন। তিনি বিহারেও তাঁর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করেন।
খৃষ্টীয় ১২১২ সনে সুলতান ইলতুতমিস অন্য সব প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাস্ত করে দিল্লীতে তাঁর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করেন।
এই সময় হুসামউদ্দীন আইওয়াদ খালজী দিল্লীর সুলতান ইলতুতমিসের অনোমোদন লাভ করে আলী মারদান খালজী বিরোধী আমীরদেরকে সংগঠিত করেন। তাঁরা আলী মারদান খালজীকে হত্যা করে হুসামউদ্দীন আইওয়াদ খালজীকে লাখনৌতির শাসনকর্তা নির্বাচিত করেন।
৫. গিয়াসউদ্দীন আইওয়াদ খালজী
খৃষ্টীয় ১২১৩ সনে হুসামউদ্দীন আইওয়াদ খালজী গিয়াসুদ্দীন আইওয়াদ খালজী উপাধি ধারণ করে দেওকোটের মসনদে বসেন।
প্রথম ছয় বছর তিনি দিল্লীর প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন। পরবর্তী বছরগুলোতে তিনি নিজের নামে মুদ্রা জারি করেন। এই মুদ্রাগুলোর এক পিঠে কালেমা ও অপর পিঠে ‘আসসুলতানুল আযম’, ‘সুলতানুল মুয়াযযাম’, ‘নাসের আমীরুল মুমিনীন’ ও ‘সুলতানুস সালাতীন’ উপাধিসহ তাঁর নাম অংকিত থাকতো।
তাঁর শাসনকালে লাখনৌতি রাজ্যের বৃস্তিতি ঘটে। জাযনগর (উড়িশা), বংগ, কামরূপ (আসাম) ও তিরহুতের (উত্তর বিহার) রাজাগণ তাঁর জন্য মূল্যবান উপহার সামগ্রী পাঠাতেন। তিনি অনেকগুলো রণ-তরীও তৈরি করেছিলেন।
তিনি দেওকোট থেকে গৌড়ে রাজধানী স্থানান্তারিত করেন। গৌড়ে অনেকগুলো সুন্দর অট্টালিকা নির্মিত হয়। উত্তর-পূর্ব দিকে সত্তর মাইল দূরে অবস্থিত দেওকোট ও দক্ষিণ-পম্চিম দিকে পঁচাশি মাইল দূরে অবস্থিত লাখনূর শহরের সাথে উচ্চ সড়ক দ্বারা রাজধানী সংযুক্ত ছিলো।
গিয়াসুদ্দীন আইয়াদ খালজী দেশের বিভিন্ন স্থানে বহু মাসজিদ নির্মাণ করেন। বিশিষ্ট আমিদের জন্য তিনি ভাতা বরাদ্দ করেন। কখনো কখনো বিশিষ্ট আলিমদেরকে এতে তিনি প্রাসাদ কক্ষে ওয়াযের ব্যবস্থা করতেন।
গিয়াসউদ্দীন আইওয়াদ খালজী স্বাধীনভাবে লাখনৌতি শাসন করছিলেন। খৃষ্টীয় ১২২৫ সনে দিল্লীর সুলতান ইলতুতমিস লাখনৌতির ওপর দিল্লীর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন। গিয়াসউদ্দীন আইওয়াদ খালজী যুদ্ধে না নেমে তাঁর সাথে সন্ধি করেন।
সুলতান ইলতুতমিস বিহারকে আলাদা করে আলাউদ্দীন মাসউদ জানিকে সেখানকার গভর্নর নিযুক্ত করন। সুলতান ইলতুতমিস দিল্লী ফিরে গেলে গিয়াসউদ্দীন আইওয়াদ খালজী বিহার থেকে মাসউদ জানিকে তাড়িয়ে দেন। খবর পেয়ে সুলতান ইলতুতমিস প্রিন্স নাসিরুদ্দীনের সেনাপতিত্বে লাখনৌতির দিকে সৈন্য প্রেরণ করেন। এই সময় গিয়াসউদ্দীন আইওয়াদ খালজী বংগ রাজ্যের দিকে এক সামরিক অভিযান পরিচালনা করছিলেন। দিল্লীর সৈন্যদের আগমনের খবর পেয়ে তিনি দ্রুত ফিরে চলেন। গৌড়ের নিকট উভয় বাহিনীর মুকাবিলা হয়। যুদ্ধে তিনি পরাজিত হয়ে ধৃত ও নিহত হন।
৬. প্রিন্স নাসিরুদ্দীন
খৃষ্টীয় ১২২৭ সনে গৌড়ের নিকটে গিয়াসউদ্দীন আইওয়াদ খালজীকে পরাজিত করে প্রিন্স নাসিরুদ্দীন লাখনৌতির শাসক হন। তিনি অযোধ্যার সাথে বিহার ও লাখনৌতিকে যুক্ত করে নেন। গৌড় বা লক্ষণাবতীই ছিলো এই যুক্ত রাজ্যের রাজধানী। নাসিরুদ্দীন দেড় বছর শাসন কার্য পরিচালনা করেন। এই সময় তিনি ইসলামী ভাবধারা বিকাশের জন্য প্রচেষ্টা চালান। তিনি আলিমদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। তাঁর পিতা সুলতান ইলতুতমিস বাগদাদের খালীফার নিকট থেকে স্বীকৃতি ও কিছুসংখ্য মূল্যবান পোষাক পান। দিল্লীর শাসকদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম বাগদাদের খালীফার নিযুক্তি পত্র পান। তিনি একপি পোষাক নাসিরুদ্দীনের জন্য পাঠান এবং তাঁকে ‘মালিকুশশারক’ বা পূর্বাঞ্চলের রাজা উপাধি দেন। খৃষ্টীয় ১২২৯ সনে নাসিরুদ্দীন অসুস্থ হড়ে পড়েন ও ইন্তিকাল করেন।
৭. মালিক ইখতিয়ারউদ্দীন বলকা খালজী
খৃষ্টীয় ১২২৯ সনে প্রিন্স নাসিরুদ্দীন ইন্তিকাল করলে গিয়াসউদ্দীন আইওয়াদ খালজীর অন্যতম ভক্ত মালিক ইখতিয়ারউদ্দীন বলকা খালজী লাখনৌতির শাসনভার হাতে তুলে নেন। তিনি নিজের নামে ও দিল্লীর সুলতানের নামে মুদ্রা জারি করেন। কিন্তু তিনি ইলতুতমিসের সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারেন নি। ইলতুতমিস সসৈন্যে লাখনৌতি আসেন। উভয় পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে বলকা খালজী নিহত হন।
৮. মালিক আলাউদ্দীন মাস’উদ জানী
খৃষ্টীয় ১২৩১ সনে দিল্লীর সুলতান ইলতুতমিস মালিক আলাউদ্দীন মাস’উদ জানীকে লাখনৌতির গভর্ণর নিযুক্ত করেন। কিন্তু এক বছর পরই তাঁকে বদলি করা হয়।
৯. মালিক সাইফুদ্দীন আইবেক
খৃষ্টীয় ১২৩২ সনে মালিক সাইফুদ্দীন আইবেক লাখনৌতির গভর্ণর নিযুক্ত হন। মালিক সাইফুদ্দীন আইবেক বংগ রাজ্যের দিকে সামরিক অভিযান পরিচালনা করেছিলেন।
খৃষ্টীয় ১২৩৬ সনে দিল্লীর সুলতান ইলতুতমিস ইন্তিকাল করেন। একই সনে মালিক সাইফুদ্দীন আইবেকও লাখনৌতিতে ইন্তিকাল করেন। তাঁর অন্যতম সাথী আওর খান ক্ষমতা দখল করেন। কিন্তু বিহারের গভর্ণর তুগ্রল তুগান খান তাঁকে পরাজিত ও নিহত করে যুগপৎ বিহার ও লাখনৌতির শাসক হন।
১০. তুগ্রল তুগান খান
খৃষ্টীয় ১২৩৬ সনে তুগ্রল তুগান খান লাখনৌতির মসনদে বসেন। ঐ সময় দিল্লীর শাসক ছিলেন সুলতানা রাজিয়া। তুগ্রল তুগান খান তাঁর অনুমোদন হাছিল করেন। তুগ্রল তুগান খান একজন সুযোগ্য শাসক ছিলেন। তিনি লাখনৌতির সামরিক শক্তি বৃদ্ধির প্রতি মনোযোগ দেন। তিনি বিরাট পদাতিক ও অশ্বারোহী বাহিনী গড়ে তোলেন। তাঁর শাসনকালে নৌ-বাহিনী আরো বেশি শক্তিশালী করা হয়।
খৃষ্টীয় ১২৪০ সনে সুলতানা রাজিয়া ইন্তিকাল করেন। আলাউদ্দীন মাস’উদ জানী হন দিল্লীর সুলতান। তিনি তুগ্রল তুগান কানকে বিহার ও লাখনৌতির শাসক হিসেবে স্বীকৃতি দান করেন।
তাঁর শাসন কালে ইসলামের অন্যমত মুবাল্লিগ মাখদুম শাহ দৌলা পাবনার শাহজাদপুরে এসে ইসলাম প্রচার করেন। তিনি ছিলেন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (সা) অন্যতম সাহাবী মুয়ায ইবনু জাবালের (রা) বংশধর। স্থানীয় হিন্দুরাজা আক্রমণ চালিয়ে তাঁকে ও তাঁর একুশজন সাথীকে হত্যা করেন। শেষ পর্যন্ত অবশিষ্ট মুসলিমগণ বিজয়ী হন। তাঁরা ঐ অঞ্চলে জোরেশোরে ইসলাম প্রচারের কাজ চালাতে থাকেন।
১১. মালিক তামার খান
খৃষ্টীয় ১২৪৫ সনে অযোধ্যার গভর্ণর মালিক তামার খান লাখনৌতির শাসক তুগ্রল তুগান খানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন। তুগ্রল পরাজিত হয়ে পালিয়ে যান। মালিক তামার খান লাখনৌতির শাসক হন। তিনি দিল্লীর অনুমোদন ছাড়াই এই সামরিক অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। কিন্তু দিল্লীর দুর্বল সুলতান আলাউদ্দীন মাস’উদ শাহ মালিক তামার খানের এই ধৃষ্টতার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেন নি।
খৃষ্টীয় ১২৪৬ সনে মালিক তামার খান ইন্তিকাল করেন।
১২. মালিক জালালুদ্দীন মাস’উদ জানী
খৃষ্টীয় ১২৪৭ সনে মালিক জালালূদ্দীন মাস’উদ জানী লাখনৌতির গভর্ণর নিযুক্ত হন। তিনি মালিকুশ শারক’ বা পূর্বাঞ্চলের রাজা উপাধি ধারণ করেন।
খৃষ্টীয় ১২৫১ সনে তিনি অযোধ্যায় বদলি হয়ে যান।
১৩. মালিক ইখতিয়ারউদ্দীন ইউজবাক
খৃষ্টীয় ১২৫১ সনের শুরুতে দিল্লীর সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদ মালিক ইখতিয়ার উদ্দীন ইউজবাককে লাখনৌতির গভর্ণর নিযুক্ত করেন।
খৃষ্টীয় ১২৫৫ সনের দিকে দিল্লীতে রাজনৈতিক গোলযোগ দেখা দেয়। এই সময় মালিক ইখতিয়ারউদ্দীন ইউজবাক আসসুলতান, উপাধি ধারণ করে নিজের নামে মুদ্রা জারি শুরু করেন। ঐ বছর তিনি অযোধ্যা দখল করেন। ফলে তিনি অযোধ্যা-বিহার-লাখনৌতির শাসক হন।
খৃষ্টীয় ১২৫৭ সনে তিনি কামরূপের (আসাম) দিকে সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন। এই সময় কামরূপ জিলা ও আরো কিছু অংশের ওপর কোচ হাজো নামক একব্যক্তি কর্তৃত্বশীল ছিলেন। মুসলিম বাহিনী এগিয়ে এলে কোচ হাজো পূর্ব দিকে সরে যান। মালিক ইখতিয়ারউদ্দীন ইউজবাক কোচ হাজোর রাজধানী দখল করে সেখানে অবস্থান করতে থাকেন। এটি ছিলো একটি ভুল সিদ্ধান্ত। কিন্তু কাল পর ঐ অঞ্চলে প্রবল বৃষ্টিপাত শুরু হয়। চারদিক পানিতে ডুবে যায়। এই সুযোগে কোচ হাজো তাঁর বাহিনী নিয়ে এগিয়ে এসে মুসলিম বাহিনীর ওপর অতর্কিত হামলা চালান। মুসলিম বাহিনী বিধ্বস্ত হয়। যুদ্ধে মালিক ইখতিয়ারউদ্দীন ইউজবাক মারাত্মকভাবে আহত হন। অল্পকাল পরে তিনি ইন্তিকাল করেন।
১৪. মালিক ইযযুদ্দীন বলবন ইউজবাকী
খৃষ্টীয় ১২৫৭ সনে মালিক ইখতিয়ারউদ্দীন ইউজবাকের অন্যতম আত্মীয় মালিক ইযযুদ্দীন বলবন ইউজবাকী লাখনৌতির মসনদে বসেন। তিনি দিল্লীর সুলতানের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন।
খৃষ্টীয় ১২৫৯ সনে মালিক ইযযুদ্দীন বলবন ইউজবাকী বংগ রাজ্যের দিকে একটি সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন। বংগ রাজ্য জয়ের জন্য এটি ছিলো লাখনৌতি রাজ্যের দ্বিতীয় প্রচেষ্টা। কিন্তু এবারও অভিযান সফল হয়নি। লাখনৌতির সৈন্যরা যখন বংগ অভিযানে ব্যস্ত তখন আল্লাহাবাদের গভর্ণর মালিক তাজউদ্দীন আরসালান লক্ষণবাতী আক্রমণ ও দখল করেন। ফলে বংগ অভিযান মুলতবী রেখে মালিক ইযযুদ্দীন বলবন ইউজবাকী লক্ষণাবতীর দিকে ফিরে আসেন। উভয় পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে তিনি নিহত হন।
১৫. মালিক তাজউদ্দীন আরসালান
খৃষ্টীয় ১২৫৯ সন থেকে ১২৬৫ সন পর্যন্ত মালিক তাজউদ্দীন আরসালান লাখনৌতি শাসন করেন।
১৬. তাতার খান
খৃষ্টীয় ১২৬৫ সনে মালিক তাজউদ্দীন আরসালানের পুত্র তাতার খান লাখানৌতির মসনদে বসেন।
খৃষ্টীয় ১২৬৬ সনে দিল্লীর সুলতান হন বলবন। তাতার খান তাঁর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। খৃষ্টীয় ১২৬৮ সনে তাতার খান ইন্তিকাল করেন।
১৭. শের খান
খৃষ্টীয় ১২৬৮ সনে মালিক তাজউদ্দীন আরসালানের অন্যতম আত্মীয় শেরখান লক্ষণাবতীর মসনদে বসেন। তিনি চার বছর লাখনৌতি শাসন করেন।
১৮. আমির খান, মুগীসু্দ্দীন তুগ্রল
খৃষ্টীয় ১২৭২ সনে শের খান ইন্তিকাল করেন। দিল্লীর সুলতান বলবন অযোধ্যার গভর্ণর আমিন খানকে অযোধ্যার সাথে লাখনৌতিরও গভর্ণর নিযুক্ত করেন। ডেপুটি গভর্ণর নিযুক্ত হন মুগীসুদ্দীন তুগ্রল। প্রকৃত পক্ষে মুগীসুদ্দীন তুগ্রলই ছিলেন লাখনৌতির শাসক।
মুগীসুদ্দীন তুগ্রলের অন্যতম প্রধান কৃতিত্ব হচ্ছে বংগ রাজ্য জয়। তিনি সেন বংশের শেষ রাজাকে পরাজিত করে বংগরাজ্য লাখনৌতি রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। সোনারগাঁও অঞ্চলও তাঁর শাসনাধীন হয়। তিনি ঢাকার পঁচিশ মাইল দক্ষিণে লারিকল নামক স্থানে একটি দুর্গ নির্মাণ করেন। এই দুর্গের নাম ‘কিলা-ই তুগ্রল। বরিশাল জিলার দনুজ মাধব ছাড়া এই অঞ্চলে আর কোন হিন্দু রাজা ছিলেন না।
মুগীসুদ্দীন তুগ্রলের আরেকটি বড়ো কৃতিত্ব হচ্ছে ত্রিপুরা রাজ্যে সামরিক অভিযান পরিচালনা। ত্রিপুরা রাজ্যের যুবরাজ রত্ম-ফা তাঁর ভাই রাজা-ফা-এর বিরুদ্ধে মুগীসুদ্দীন তুগ্রলের সাহায্য চান। মুগীসুদ্দীন তুগ্রল সসৈন্যে ত্রিপুরা পৌঁছেন। উভয় পক্ষে যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে রাজা-ফা নিহত হন। মুগীসুদ্দীন তুগ্রল রত্ন-ফাকে ত্রিপুরার মসনদে বসান। রত্ন-ফা মুগীসুদ্দীনকে একটি ভেক-মনি ও একশত হাতী উপহার দেন। মুগীসুদ্দীন তুগ্রল রত্ন-ফা কে ‘মানিক্য’ উপাধি দেন। তখন থেকে ত্রিপুরার রাজাগণ ‘মাণিক্য’ উপাধি ধারণ করতেন।
ইতিমধ্যে দিল্লীর সুলতান গিয়াসুদ্দীন বলবন মুগল আক্রমণ প্রতিহত করা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। অবস্থা এতোখানি নাজুক হয়ে পড়ে যে তিনি দিল্লী থেকে রাজধানী লাহোরে সরিয়ে নিতে বাধ্য হন। এই সময় গিয়াসুদ্দীন বলবন মারা গেছেন বলে গুজব ছড়িয়ে পড়ে।
খৃষ্টীয় ১২৭৭ সনে মুগীসুদ্দীন তুগ্রল লাখনৌতির স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, সুলতান উপাধি ধারণ করেন এবং নিজের নামে মুদ্রা জারি করেন।
খৃষ্টীয় ১২৭৮ সনে গিয়াসুদ্দীন বলবন অযোধ্যার গভর্নর মালিক তুরমাতি-র নেতৃত্বে মুগীসুদ্দীন তুগ্রলের বিরুদ্ধে একটি সেনাদল পাঠান। তিরহুতের নিকট যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে মালিক তুরমাতি পরাজিত হন।
খৃষ্টীয় ১২৭৯ সনে গিয়াসুদ্দীন বলবন আরেকটি বাহিনী প্রেরণ করেন লাখনৌতির দিকে। এই বাহিনীও পরাজিত হয়।
খৃষ্টীয় ১২৮০ সনে গিয়াসুদ্দীন বলবন নিজেই বিপুল সংখ্যক সৈন্য নিয়ে লাখনৌতি পৌঁছেন। মুগীসুদ্দীন তুগ্রল দিল্লীর সুলতানের মুকাবিলা না করে লারিকল দুর্গে সরে আসেন। তুগ্রল যাতে আরো দক্ষিণে সরে যেতে না পারেন সেই পথ বন্ধ করার জন্য গিয়াসুদ্দীন বলবন বরিশালের রাজা দনুজ মাধবের সাথে চুক্তি করেন। তুগ্রল লারিকল দুর্ঘ থেকে বেরিয়ে জাযনগনের (উড়িশা) দিকে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করেন। পথিমধ্যে তিনি বলবনের অন্যতম সেনাপতি মালিক শের আন্দাজের হাতে নিহত হন।
১৯. সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদ বুগরা খান
খৃষ্টীয় ১২৮২ সনে গিয়াসুদ্দীন বলবন তাঁর পুত্র নাসিরুদ্দীন বুগরা খানকে লাখনৌতির গভর্নর নিযুক্ত করে যান। দিল্লীতে ফিরে যাবার আগে তিনি শাহজাদা নাসিরুদ্দীন বুগরা খানকে ‘দিয়ার-ই-বাঙালাহ’ দখল করার নির্দেশ দিয়ে যান। ‘দিয়ার-ই- বাঙালাহ’ বলতে তিনি সম্ভবত বংগ রাজ্যের অবশিষ্ট দুইটি অংশ মোমেনশাহী ও বরিশালকে বুঝিয়েছেন।
খৃষ্টীয় ১২৯০ সনে দিল্লীতে বলবন বংশের শাসন খতম হয় ও খালজী বংশের শাসন শুরু হয়। দিল্লীতে আপন বংশের শাসন খতম হয়ে যাওয়ায় শাহজাদা বুগরা খান সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদ বুগরা খান উপাধি ধারণ করে স্বাধীন ভাবে লাখনৌতি শাসন করতে থাকেন। তিনি তাঁর শাসিত দেশটিকে চারটি প্রশাসনিক অঞ্চলে বিভক্ত করেন। এইগুলো ছিলোঃ বিহার অঞ্চল, লক্ষণাবতী-দেওকোট অঞ্চল, সাতগাঁও-হুগলী অঞ্চল ও সোনারগাঁও অঞ্চল।
খৃষ্টীয় ১২৯০ সনে সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদ বুগরা খান ইন্তিকাল করেন।
২০. সুলতান রুকনুদ্দীন কাইকাউস
খৃষ্টীয় ১২৯০ সনে সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদ বুগরা খানের পত্র রুকনুদ্দীন কাইকাউস লাখনৌতির সুলতান হন। তিনিও নিজের নামে মুদ্রা জারি করেন।
তাঁর একটি রৌপ্য মুদ্রায় “এই রৌপ্য মুদ্রা বংগ থেকে প্রাপ্ত খারাজ দ্বারা লক্ষণাবতী টাকশাল থেকে মুদ্রিত” বাক্যটি উৎকীর্ণ ছিলো। এ থেকে এটা প্রমাণিত হয় যে বংগ রাজ্য তাঁর কর্তৃত্বাধীন ছিলো। মুসলিমের দ্বারা বংগ শব্দটির এইটিই প্রথম ব্যবহার।
তাঁর শাসনকালের একটি মুদ্রায় দেওকোটে একটি মাসজিদ ও আরেকটি মুদ্রায় বিহারের মুংগের জিলার লাখিসরাই জামে মাসজিদ নির্মাণের উল্লেখ রয়েছে। তাঁর শাসনকালে হুগলীর শাসনকর্তা ত্রিবেনীতে ‘দারুল খাইরাত’ নামে একটি মাদ্রাসা স্থাপন করেন।
উল্লেখ্য যে সম্ভবত খৃষ্টীয় ১২৭৮ সনে ইসলামের অন্যতম সেরা মুবাল্লিগ শায়খ শারফুদ্দীন আবু তাওয়ামাহ সোনারগাঁও এসে বসতি স্থাপন করেন। তিনি ইসলামের নির্ভেজাল জ্ঞান বিতরণের জন্য এখানে একটি মাদ্রাসা স্থাপন করেন।
তাঁর ছাত্র ও জামাতা শায়খ শারফুদ্দীন ইয়াহইয়া মানেরীও এই মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। অবশ্য ১২৯৩ সনে তিনি তাঁর জন্মভূমি বিহারের অন্তর্ভুক্ত মানের নামক স্থানে ফিরে যান। শায়খ শারফুদ্দীন আর তাওয়ামাহা খৃষ্টীয় ১৩০০ সনে সোনারগাঁওয়ে ইন্তিকাল করেন।
২১. সুলতান শামসুদ্দীন ফিরোজশাহ
খৃষ্টীয় ১৩০১ সনে সুলতান রুকনুদ্দীন কাইকাউসের ইন্তিকাল হলে শামসুদ্দীন ফিরোজশাহ লাখনৌতির সুলতান হন।
তাঁর শাসন কালেন অন্যতম প্রধান কৃতিত্ব হচ্ছে সিলেট বিজয়। এই সময় গৌরিগোবিন্দ নামক একজন হিন্দু রাজা সিলেট শাসন করতেন। তিনি ছিলেন মুসলম নির্যাতক।
সুলতান শামসুদ্দীন ফিরোজশাহ সেনাপতি সিকান্দার গাজীর নেতৃত্বে একদল সৈন্য প্রেরণ করেন গৌরগোবিনেদর বিরুদ্ধে। দুইবার হামলা চালিয়েও সিকান্দার গাজী তাঁকে পরাজিত করতে পারেননি। পরে অন্যতম সেনাপতি সাইয়েদ নাসিরুদ্দীন তাঁর হাত শক্তিশালী করেন। তদুপরি ইসলামের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুবাল্লিগ শাহ জালাল তাঁর তিনশত জন সাথী নিয়ে মুসলিম বাহিনীতে যোগদান করেন। আবারো সামরিক অভিযান পরিচালিত হয় গৌর গোবিন্দের বিরুদ্ধে। পরাজিত হয়ে গৌর গোবিন্দ গহীন জংগলের দিকে পালিয়ে যান। খৃষ্টীয় ১৩০৩ সনে সিলেট লাখনৌতি রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। উল্লেখ্য যে এই সময় দিল্লীর সুলতান ছিলেন আলাউদ্দীন খালজি। সিলেট বিজয়ের পর শাহ জালাল তাঁর সাথীদেরকে নিয়ে সিলেট অঞ্চলে থেকে যান। তাঁরা মানুষের সামনে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব ও সৌন্দর্য উপস্থাপনের কাজ করতে থাকেন। তাঁদের নিরলস প্রচেষ্টার ফলে ঐ অঞ্চলের বহু লোক ইসলাম গ্রহণ করে।
উল্লেখ্য যে এই সময় ইসলামের অন্যতম বিশিষ্ট মুবাল্লিগ সাইয়েদ আহমাদ তান্নুরী লক্ষীপুর জিলার কাঞ্চনপুরে কেন্দ্র স্থাপন করে ইসলাম প্রচার করতে থাকেন। তিনি ছিলেন আবদুল কাদির জিলানীর (রহ) পৌত্র। আবার, শাহ বাখতিয়ার মাইসুর নামক আরেকজন মুবাল্লিগ সন্দীপে অবস্থান করে দ্বীপাঞ্চলে ইসলামের মর্মবাণী মানুষের নিকট পৌঁছাতে থাকেন।
খৃষ্টীয় ১৩১৩ সনে সেনাপতি জাফর খান সাতগাঁও জয় করেন। ইসলামের অন্যতম মুবাল্লিশ শাহ শফীউদ্দীন এই অভিযানে তাঁকে সহযোগিতা করেন।
শামসুদ্দীন ফিরোজ শাহের রাজ্য সীমা পশ্চিমে বিহারের শোন নদী থেকে শুরু করে পূর্বে সিলেট পর্যন্ত এবং উত্তরে দিনাজপুর থেকে দক্ষিণে সুন্দরবন পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো।
খৃষ্টীয় ১৩২২ সনে সুলতান শামসুদ্দীন ফিরোজ শাহ ইন্তিকাল করেন।
২২. নাসিরুদ্দীন ইব্রাহীম
খৃষ্টীয় ১৩২২ সনে সুরতান শামসুদ্দীন ফিরোজশাহের ইন্তিকাল হলে তাঁর পুত্র শিহাবুদ্দীন মসনদে বসেন। কিন্তু তাঁর ভাই গিয়াসুদ্দীন বাহাদুর শাহ বিদ্রোহী হয়ে যুদ্ধে নামেন। শিহাবুদ্দীন পরাজিত হন। অপর ভাই নাসিরুদ্দীন ইবরাহীম লাখনৌতির কর্তৃত্ব হাতে নেন। আর গিয়াসুদ্দীন বাহাদুর শাহ সোনারগাঁওতে সরে গিয়ে নিজের কর্তৃত্ স্থাপন করেন।
এই গোলযোগের সময় খৃষ্টীয় ১৩২৪ সনে দিল্লীর সুলতান গিয়াসুদ্দীন তুগলক লাখনৌতির উদ্দেশ্যে বের হয়ে তিরহুত দখল করেন। নাসিরুদ্দীন ইবরাহীম সেখানে গিয়ে তাঁর বশ্যতা স্বীকার করেন। গিয়াসুদ্দীন তুগলক সেনাপতি বাহরাম খান ওরফে তাতার খানকে গিয়াসুদ্দীন বাহাদুর শাহের বিরুদ্দে প্রেরণ করেন। বাহাদুর শাহ পরাজিত ও বন্দী হন। গিয়াসুদ্দীন তুগলক নাসির উদ্দীন ইবরাহীমকে লাখনৌতির গভর্ণর হিসেবে স্বীকৃতি দেন। তবে তিনি সোনারগাঁও ও সাতগাঁও অঞ্চল বাহরাম খান ওরফে তাতার খানের হাতে ন্যস্ত করে যান।
২৩. বাহরাম খান, বাহাদুর শাহ
খৃষ্টীয় ১৩২৫ সনে দিল্লীর সুলতান গিয়াসুদ্দীন তুগলক ইন্তিকাল করেন। তাঁর পুত্র মুহাম্মদ তুগলক দিল্লীর সুলতান হন।
মুহাম্মদ তুগলক লাখনৌতিতে বন্দী বাহাদুর শাহকে মুক্ত করে তাঁকে ও বাহরাম খানকে যৌথ ভাবে লাখনৌতির গভর্ণর নিযুক্ত করেন।
বাহরাম খানের সিলাহদার ফাখরুদ্দীন ভুলূয়া (নোয়াখালী), চট্টগ্রাম অঞ্চলে মুসলিম শাসন সম্প্রসারিত করেন। তিনি ভুলূয়াতেই তাঁর প্রশাসনিক কেন্দ্র স্থাপন করেন।
খৃষ্টীয় ১৩২৮ সনে বাহাদুর শাহ দিল্লীর কর্তৃত্ব অস্বীকার করেন। ফলে বাহরাম খান তাঁর বিরুদ্ধে হামলা চালান। যদ্ধে তিনি পরাজিত ও নিহত হন।
অতপর মুহাম্মদ তুগলক লাখনৌতি রাজ্যকে তিন ভাগে বিভক্ত করে প্রতি ভাগে একজন শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। লক্ষণাবতীর শাসনকর্তা হন কাদার খান, সাতগাঁওয়ের শাসনকর্তা হন ইযযুদ্দীন ইয়াহইয়া। আর বাহরাম খান নিযুক্ত হন সোনারগাঁওয়ের শাসনকর্তা।
২৪. ফাখরুদ্দীন মুবারক শাহ, কাদার খান
খৃষ্টীয় ১৩৩৬ সনে সোনারগাঁওয়ের শাসনকর্তা বাহরাম খানের ইন্তিকাল হলে তাঁর সেনাপতি ফাখরুদ্দীন ‘আবুল মুযযাফফার ফাখরুদ্দীন মুবারক শাহ’ উপাধি ধারণ করে সোনারগাঁওয়ের মসনদে বসেন এবং স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। সোনারগাঁও থেকে তাঁর জারিকৃত মুদ্রাতে ‘ইয়ামীনুল খালীফাহ’ ও ‘নাসির আমীরুল মুমিনীন’ শব্দগুলো উৎকর্ণ ছিলো।
ফাখরুদ্দীন মুবারকশাহ কর্তৃক সোনারগাঁওয়ের স্বাধীনতা ঘোষিত হলে দিল্লীর সুলতান মুহাম্মদ তুগলক লক্ষণাবতীর শাসনকর্তা কাদার খান ও সাতগাঁওয়ের শাসনকর্তা ইযযুদ্দীন ইয়াহইয়াকে সোনারগাঁও আক্রমণের নির্দেশ দেন। তাঁরা সসৈন্যে এগিয়ে এলে ফাখরুদ্দীন মুবারক শাহ যুদ্দ না করে পূর্ব দিকে সরে যান। কাদার খান সোনারগাঁও দখল করেন। তবে মালে গানীমাহ বিতরণে অবিচার করায় সৈন্যগণ তাঁর প্রতি অসন্তুষ্ট হয়। এই দিকে শুকনো মওসুম শেষ হয়ে যায় ও বর্ষা কাল শুরু হয়। কাদার খানের সৈন্য ও ঘোড়া দল অসুস্থ হয়ে পড়তে থাকে। এই সুযোগে ফাখরুদ্দীন মুবারক শাহ নৌপথে ফিরে এসে কাদার খানকে অবরুদ্ধ করে ফেলেন। কাদার খানের প্রতি সৈন্যরা বিদ্রোহী হয়ে তাঁকে হত্যা করে। ফাখরুদ্দীন মুবারক শাহ আবার সোনারগাঁওতে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন।
খৃষ্টীয় ১৩৪৯ সন পর্যন্ত তিনি স্বাধীনভাবে রাজ্য শাসন করেন।
২৫. আলাউদ্দীন আলী শাহ, ইখতিয়ারউদ্দীন গাজী শাহ
আলী মুবারক ছিলেন লাখনৌতির শাসক কাদার খানের অন্যতম সেনাপতি। কাদার খান সোনারগাঁওয়ে নিহত হয়েছেন খবর পেয়ে আলী মুবারক আলাউদ্দীন আলী শাহ উপাধি ধারণ করে লাখনৌতির মসনদে বসেন। আলাউদ্দিন আলী শাহ লক্ষণাবতী থেকে পাণ্ডুয়াতে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন।
খৃষ্টীয় ১৩৪৯ সনে সোনারগাঁওয়ের শাসক ফাখরুদ্দীন মুবারক শাহের ইন্তিকাল হলে তাঁর পুত্র ইখতিয়ারউদ্দিন গাজী শাহ মসনদে বসেন।
উল্লেখ্য যে লাখনৌতি ও সোনারগাঁওয়ের মধ্যে বারবার যুদ্ধ হতে থাকে।
খৃষ্টীয় ১৩৪২ সনে হাজী ইলিয়াস লাখনৌতির শাসক আলাউদ্দীন আলী শাহকে এবং খৃষ্টীয় ১৩৫২ সনে হাজী ইলিয়াস লাখনৌতির শাসক আলাউদ্দীন আলী শাহকে এবং খৃষ্টীয় ১৩৫২ সনে সোনারগাঁওয়ের শাসক ইখতিয়ার উদ্দীন গাজী শাহকে পরাজিত করে উভয় রাজ্য একত্রিত করে স্বাধীন সুলতান হিসেবে পান্ডুয়া থেকে দেশ শাসন করতে থাকেন।
২৬. শাহ-ই-বাঙালাহ
শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ
সাতগাঁওয়ের শাসনকর্তা ইযযুদ্দীন ইয়াহইয়ার ইন্তিকাল হলে হাজী ইলিয়াস সাতগাঁওয়ের মসনদে বসেন।
খৃষ্টীয় ১৩৪২ সনে হাজী ইলিয়াস লাখনৌতির শাসনকর্তা আলাউদ্দীন আলী শাহকে পরাজিত করেন ও সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ উপাধি ধারণ করে পাণ্ডুয়ার মসনদে বসেন। কিছুকাল পর তিনি তিরহুত দখল করেন।
খৃষ্টীয় ১৩৪৬ সনে তিনি নেপাল অভিমুখে সামরিক অভিযান চালিয়ে রাজধানী কাঠমণ্ডু পর্যন্ত পৌছেন। অবশ্য তিনি সেখানে বেশি দিন থাকেন নি। তবে দক্ষিণ বিহারে তিনি তাঁর অবস্থান সুদৃঢ় করেন। তিনি উড়িশাও জয় করেন।
খৃষ্টীয় ১৩৫২ সনে শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ সোনারগাঁওয়ের সুলতান ইখতিয়ার উদ্দীন গাজী শাহকে পরাজিত করে সোনারগাঁও দখল করেন।
শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ স্বাধীন বাঙালাহ সালতানাতের স্থপতি। বাঙালাহর সকল অঞ্চল তাঁর সালতানাতের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং বাঙালাহ নামে অভিহিত হয়।
দিল্লীর সুলতান ফিরোজশাহ তুগলক বাঙালাহ আক্রমণ করেন। সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ কৌশলগত কারণে পাণ্ডুয়া থেকে একডালা দুর্গে সরে আসেন, কিন্তু বশ্যতা স্বীকার করেননি। পরে একটি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করে ফিরোজশাহ তুগলক দিল্লী ফিরে যান।
ইতিহাসবিদ শামস-ই-সিরাজ আফীফ তাঁর গ্রন্হে শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহকে “শাহ-ই-বাঙালাহ” ও “সুলতান-ই-বাঙালাহ” নামে অভিহিত করেছেন। শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ পান্ডুয়াতে অবস্থান করে বাঙালাহ সালতানাত শাসন করেন।
শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ একজন নিষ্ঠাবান মুসলিম ছিলেন। তিনি আলিমদের কদর করতেন। তাঁর শাসন কালে শায়খ আখি সিরাজুদ্দীন উসমান পাণ্ডুয়াতে অবস্থান করে ইসলাম প্রচার করতে থাকেন। শায়খ রিযা বিয়াবনী ছিলেন আরেকজন মুবাল্লিগ। তাঁদের প্রচেষ্টায় রাজধানীর নিকটবর্তী অঞ্চলে ইসলাম ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ দীর্ঘ পনর বছর বাঙালাহ সালতানাত পরিচালনা করেন।
খৃষ্টীয় ১৩৫৭ সনে তিনি ইন্তিকাল করেন।
২৭. আবুল মুজাহিদ সিকান্দার শাহ
খৃষ্টীয় ১৩৫৮ সনে সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহের পুত্র আবুল মুজাহিদ সিকান্দার শাহ বাঙালাহ সালতানাতের সুলতান হিসেবে পাণ্ডয়ার মসনদে বসেন। তাঁর শাসনকালে দিল্লীর সুলতান ফিরোজশাহ তুগলক দ্বিতীয়বার বাঙালাহ আক্রমণ করেন। আবুল মুজাহিদ সিকান্দার শাহ পিতার অনুরূপ রণকৌশল অবলম্বন করেন। শেষ পর্যন্ত উভয় পক্ষে সন্ধি হয়। খৃষ্টীয় ১৩৫৯ সনে ফিরোজ শাহ তুগলক দিল্লী ফিরে যান।
আবুল মুজাহিদ সিকান্দার শাহ সালতানাতের বিভিন্ন স্থানে বহু মাসজিদ নির্মাণ করেন। রাজধানী পাণ্ডূয়াতে নির্মিত আদিনা মাসজিদ তাঁর অমর কীর্তি। এই বিশাল মাসজিদ নির্মাণ করতে চার বছর সময় লেগেছিলো।
তাঁর শাসন কালে ইসলামের অন্যতম সেরা মুবাল্লিগ শায়খ আলাউল হক পাণ্ডুয়াতে অবস্থান করে দীনের মর্মবাণী মানুষের নিকট পৌঁছাতে থাকেন। এক সময় এই সম্মানিক মুবাল্লিগের সংগে তাঁর সম্পর্কের অবনতি ঘটে। তিনি সোনারগাঁও চলে যান। অবশ্য পরে তিনি আবার পাণ্ডুয়াতে ফিরে আসেন।
আল মুজাহিদ সিকান্দার শাহের কোন কোন মুদ্রায় ‘আল মুজাহিদ ফী সাবীলির রাহমান’ ও ‘ইমামুল আযম’ শব্দগুলো উৎকীর্ণ দেখা যায়। এইগুলোতে ইসলামের অনুশীলন ও ইসলামের পৃষ্ঠপোষকতার ব্যাপারে তাঁর মনোভংগির পরিচয় মেলে
২৮. গিয়াসুদ্দীন আযম শাহ
খৃষ্টীয় ১৩৯০ সনে গিয়াসুদ্দীন আযম শাহ তাঁর পিতা আবুল মুজাহিদ সিকান্দার শাহের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। উভয় পক্ষেু যুদ্ধ হয়। সিকান্দার শাহ আহত হন ও পরে ইন্তিকাল করেন।
গিয়াসুদ্দীন আযম শাহ বাঙালাহর সুলতান হিসেবে পাণ্ডুয়ার মসনদে বসেন।
গিয়াসুদ্দীন আযম শাহ একজন নিষ্ঠাবান মুসলিম ছিলেন। তিনি একনিষ্ঠভাবে শারীয়াহ অনুসরণ করতেন। তিনি ছিলেন ইসলামী জ্ঞান চর্চার বিশিষ্ট পৃষ্ঠপোষক। বিশিষ্ট ইসলামী পণ্ডিত শায়খ আলাউল হক তাঁর শাসনকালে পাণ্ডয়াতে বসবাস করেন। শায়খ আলাউল হকের সুযোগ্য পুত্রও পাণ্ডুয়াতে থেকে সুলতানের পৃষ্ঠপোষকতায় ইসলামের জ্ঞান বিস্তারে মূল্যবান অবদান রাখেন।
সুলতান গিয়াসুদ্দীন আযম শাহ নানাভাবে হাজ যাত্রীদের খিমাত করতেন। তাঁর অর্থানুকূল্যে মাক্কায় একটি ও মাদীনায় আরেকটি মাদ্রাসা ভবন নির্মিত হয়েছিলো। সুলতান নিজে আরবী ও ফার্সী ভাষায় কবিতা লিখতেন। ইরানের কবি হাফিজের সংগে তিনি চিঠি বিনিময় করতেন।
তিনি ছিলেন একজন ন্যয়া পরায়ন সুলতান। তিনি আইনের শাসনে বিশ্বাসী ছিলেন। একবার তাঁর নিক্ষিপ্ত একটি তীর এক বিধবার ছেলেকে আঘাত করে। বিধবা কাজী সিরাজুদ্দীনের আদালতে বিচার প্রার্থী হন। সম্মানিত কাজী সুলতানকে আদালকে ডেকে পাঠান। সুলতান আদালতে এলে কাজী তাঁকে উক্ত বিধবার প্রতি কৃত অন্যায়ের প্রতিকার করতে বলেন। সুলতান বিধবাকে প্রচুর অর্থ প্রদান করে সন্তুষ্ট করেন। কাজী যখন জানতে পারলেন যে বিধবা সন্তুষ্ট হয়েছেন তখন তিনি উঠে দাঁড়ান ও সুলতানকে তাঁর পাশে বসান। সুলতান তার পোশাকের ভেতর থেকে একটি তলোয়ার বের করে বলেন যে যদি কাজী আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে ব্যর্থ হতেন তাহলে এই তলোয়অর দিয়ে তাঁর মাথা কেটে ফেলতেন। কাজী তাঁর আসনের নীচ থেকে একটি বেত বের করে সুলতানকে দেখিয়ে বলেন যে তিনি আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে ব্যর্থ হলে এই বেত তাঁর পিঠে পড়তো। সুলতান কাজীর কথা শুনে খুবই খুশী হন। রিয়াদুস সালাতীন নামক গ্রন্হে এই কাহিনী লিপিবদ্ধ রয়েছে।
গিয়াসুদ্দীন আযম শাহ মুসলিম দেশের শাসকদের সাথে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষা করতেন। চীন দেশের সাথেও তিনি দূত বিনিময় করতেন।
বাংলা ভাষার পৃষ্ঠপোষক হিসেবে বাংলা ভাষায় রামায়ণ অনুবাদের জন্য তিনি কৃত্তিবাসকে আনুকূল্য প্রদান করেন।
গিয়াসুদ্দীন আযম শাহের শাসনকালে বাঙালাহ সালতানাত শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ দেশ ছিলো। মানুষ সুখে জীবন যাপন করতো।
খৃষ্টীয় ১৪১২ সনে তিনি ইন্তিকাল করেন।
২৯. সাইফুদ্দীন হামযা শাহ,
শিহাবুদ্দীন বায়োজিদ শাহ,
রাজা কংস
খৃষ্টীয় ১৪১২ সনে সুলতান গিয়াসুদ্দীন আযম শাহের ইন্তিকালের পর তাঁর পুত্র সাইফুদ্দীন হামযা শাহ বাঙালাহর সুলতান হিসেবে পাণ্ডুয়ার মসনদে বসেন। তিনি পিতার যোগ্য ছেলে ছিলেন। সুলতানের সভাসদদের মধ্যে একটি ইসলামী গ্রুপ ছিলো। এই গ্রুপের নেতৃত্বে ছিলেন রাজা কংস বা গনেশ। রাজা কংস সাইফুদ্দীন হামযা শাহকে হত্যা করেন।
হামযা শাহের অনুগত ব্যক্তিত্ব শিহাবুদ্দীন রাজা কংসের চক্রান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। তিনি রাজা কংসের শক্তি খর্ব করতে সক্ষম হন। তিনি শিহাবুদ্দীন বায়েজিদ শাহ নামে পাণ্ডুয়ার মসনদে বসেন। রাজা কংস মরিয়া হয়ে উঠেন। তিনি তাঁর সমমনা ব্যক্তিদেরকে সংগঠিত করে সুলতানের ওপর হামলা চালান ও তাঁকে হত্যা করেন।
রাজা কংস এবার নিজেই পান্ডুয়ার মসনদে বসেন। ক্ষমতাসীন হয়ে তিনি মুসলিমদের ওপর অত্যাচারের স্টীম রোলার চালাতে থাকেন। বিশিষ্ট ইসলামী ব্যক্তিবর্গকে হত্যা করা হয়। শায়খ বদরুল ইসলাম ও তাঁর পুত্র শায়খ ফায়েদুল ইসলামকে রাজ-দরবারে নিয়ে হত্যা করা হয়। একদল ইসলামী ব্যক্তিত্বকে নৌকাতে উঠিয়ে নদীতে ডুবিয়ে মারা হয়। বহু মসজিদ ভেংগে ফেলা হয়।
মুসলিমগণ শায়খ নূর কুতবুল আলমের নেতৃত্বে সংগঠিত হন। শায়খ জৌনপুরের শাসক ইবরাহীম শার্কীকে বাঙালায় সামরিক অভিযান চালাবার আহ্বান জানান। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ইবরাহীম শার্কী সসৈন্যে পাণ্ডুয়া পৌঁছেন। অবস্থা বেগতিক দেখে রাজা কংস শায়খ নূর কুতবুল আলমের শরণাপন্ন হন। শায়খ তাঁকে ইসলাম গ্রহণ করতে বলেন। প্রথমে রাজি হয়ে তিনি পরে আবার অসম্মতি প্রকাশ করেন। তবে আপন পুত্র যদুকে ইসলামে দীক্ষত করে মসনদে বসাবার জন্য শায়খকে অনুরোধ করেন। শায়খ যদুকে মুসলিম বানিয়ে তাঁর নাম রাখেন জালালুদ্দীন মুহাম্মদ। শায়খ ও তাঁর সাথীগণ তাঁকেই মসনদে বসান। পরিস্থিতি শান্ত হয়ে এলে ইবরাহীম শার্কী জৌনপুরে ফিরে যান।
জৌনপুর বাহিনী চলে যাওয়ার পর রাজা কংস আবার চক্রান্ত শুরু করেন। তিনি পুত্র যদুকে ইসলাম ত্যাগ করার জন্য চাপ দেন। কিন্তু যদু আন্তরিকভাবেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন বিধায় পিতার অন্যায় নির্দেশ মেনে নেননি। রাজা কংস তাঁর অনুগত ব্যক্তিদেরকে নিয়ে হামলা চালিয়ে আবার মুসলিম হত্যায় মেতে উঠেন। তিনি শায়খ নূর কুতবুল আলমের পুত্র শায়খ আনোয়ার ও ভাতিজা শেখ জাহিদকে পাণ্ডুয়অ থেকে বের করে দেন। কিছুকাল পর রাজা কংসের নির্দেশে সোনারগাঁওয়ে শায়খ আনোয়ারকে হত্যা করা হয়।
আর ঐ দিনই সুলতান জালালুদ্দিন তাঁর যালিম পিতা রাজা কংসকে হত্যা করে পাণ্ডুয়াতে শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করেন।
৩০. জালালুদ্দীন আবুল মুযাফফর মুহাম্মদ শাহ
খৃষ্টীয় ১৪১৫ সনে জালালুদ্দীন আবুল মুযাফফর মুহাম্মদ শাহ পাণ্ডুয়াতে তাঁর অবস্থান সুসংহত করেন।
বাঙালাহর বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ছিলো অমুসলিম। কিন্তু তারা মুসলিম শাসনের সুফল ভোগ করে সুখে-শান্তিতে বসবাস করতো। মুসলিম সুলতানগণ কখনো তাদের ওপর যুলুম করতেন না। তাই উগ্র হিন্দু রাজা কংস ও তাঁর অন্ধ অনুসারীরা যেই অরাজকতা সৃষ্টির প্রয়াস চালান তাতে সাধারণ হিন্দুগণ অংশ নিতে প্রস্তুত ছিলো না।
সুলতান জালালুদ্দীন নিষ্ঠাসহকারে ইসলামের অনুসরণ করতে থাকেন। রাজা কংস যেই সব মাসজিদ ধ্বংস করেছিলেন, তিনি সেইগুলো আবার তৈরি করেন। যেই সব মাসজিদের ক্ষতি করা হয়েছিলো সেই গুলো মেরামত করেন। তাছাড়া তিনি কয়েকটি নতুন মাসজিদও নির্মাণ করেন।
সুলতান জালালুদ্দীন পান্ডুয়া থেকে গৌড়ে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। তিনি গৌড় শহরে দীঘি, মাসজিদ ও সরাইখানা নির্মাণ করেন।
জালালুদ্দীন নিজের জন্য ‘সুলতান’ ও ‘আমীর’ উভয় শব্দই ব্যবহার করতেন। খৃষ্টীয় ১৪৩১ সনে মুদ্রিত মুদ্রাতে ‘খালীফাতুল্লাহ’ উপাধি উৎকীর্ণ দেখা যায়।
সুলতান জালালুদ্দীন প্রায় বিশ বছর দেশ শাসন করেন। তাঁর শাসনকালে দেশে শান্তি বিরাজিত ছিলো। খৃষ্টীয় ১৪৩৪ সনে তিনি ইন্তিকাল করেন।
৩১. শামসুদ্দীন আবুল মুজাহিদ আহমাদ শাহ
খৃষ্টীয় ১৪৩৪ সনে সুলতান জালালূদ্দীনের ইন্তিকাল হলে তাঁর চৌদ্দ বছরের ছেলে আহমাদ ‘শামসুদ্দীন আবুল মুজাহিদ আহমাদ শাহ’ উপাধি ধারণ করে বাঙালাহ সালতানাতের রাজধানী গৌড়ের মসনদে বসেন।
আহমাদ শাহ একজন অযোগ্য ব্যক্তি ছিলেন। কিছুকাল পর দুইজন ভৃত্য শাদী খান ও নাসির খান কর্তৃক তিনি নিহত হন। আবার, নাসির খান শাদী খানকে হত্যা করে মসনদে বসেন। কিন্তু বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ তাঁর এই ধৃষ্টতা মেনে নিতে পারেন নি। এক সপ্তাহের মধ্যেই নাসির খান নিহত হন।
৩২. নাসিরুদ্দীন আবুল মুযাফফর মাহমুদ শাহ
খৃষ্টীয় ১৪৩৯ সনে গৌড়ের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগণ ইলিয়াস শাহের অন্যতম বংশধর মাহমুদকে বাঙালাহ সালতানাতের সুলতান নির্বাচিত করেন। তিনি নাসিরুদ্দীন আবুল মুযাফফর মাহমুদ শাহ উপাধি ধারণ করে গৌড়ের মসনদে বসেন।
তাঁর সুযোগ্য শাসনে দেশে আবার শান্তি স্থাপিত হয়। তাঁর শাসনকালে খান জাহান আলী দক্ষিণ বংগের বাগেরহাট অঞ্চলে আসেন। তিনি ছিলেন ইসলামের শ্রেষ্ঠ মুবাল্লিগদের একজন। তাঁর প্রচেষ্টায় এই অঞ্চলে অতিদ্রুত ইসরামের আলো ছড়িয়ে পড়ে। লোকেরা দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে। বিভিন্ন স্থানে মাসজিদ স্থাপন করে তিনি নও মুসলিমদের নৈতিক মান সমুন্নত করার ব্যবস্থা করেন। বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মাসজিদ খান জাহান আলীর স্মৃতিকে অম্লান করে রেখেছে। সেখানে জনগণের কল্যাণে দুইটি বড়ো দীঘিও খনন করেন।
নাসিরুদ্দীন আবুল মুযাফফার মাহমুদের শাসন কালে দেশের অন্যান্য স্থানেও বহু মাসজিদ নির্মিত হয়। অনেকগুলো ইসলামী শিক্ষালয় স্থাপিত হয়।
তিনি গৌড় শহরে প্রাসাদ ও দুর্গ নির্মাণ করেন। একটি মুদ্রাতে তাঁকে ‘খালীফা’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
খৃষ্টীয় ১৪৫৯ সনে তিনি ইন্তিকাল করেন।
৩৩. রুকনুদ্দীন বারবাক শাহ
খৃষ্টীয় ১৪৫৯ সনে সুলতান নাসিরুদ্দীনের পুত্র রুকনুদ্দীন বারাবাক শাহ বাঙালাহ সালতানাতের সুলতান হিসেবে গৌড়ের মসনদে বসেন। তাঁর শাসনকালে আরব দেশ থেকে শাহ ইসমাঈল গাজী একশত বিশজন মুবাল্লিগ নিয়ে গৌড় আসেন। শাহ ইসমাঈল ও তাঁর সাথীগণ একদিকে ছিলেন মুবাল্লিগ, অন্যদিকে ছিলেন মুজাহিদ।
তাঁরা উড়িশা অঞ্চলে মুসলিম প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার যুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেন। কামরূপের রাজা বাঙালাহর সীমান্তের ওপর চাপ সৃষ্টি করলে তাঁকে প্রতিহত করার জন্য সুলতান শাহ ইসমাঈল গাজীকে সসৈন্যে প্রেরণ করেন। তিনি বড় পাইকা ও জলা মাকাম দুর্গ নির্মাণ করেন। কামরূপের রাজার একজন সেনাপতি শাহ ইসমাঈল গাজীর চরিত্র মাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন।
তবে একজন হিংসুটে হিন্দুর হীন চক্রান্তে তিনি শহীদ হন। হিন্দু ব্যক্তিটি সুলতানকে এই মিথ্যা খবর দেয় যে শাহ ইসমাঈল গাজী কামরূপের রাজার সাথে মৈত্রী গড়ে তুলে সীমান্ত অঞ্চলে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠন করতে চান। এই খবরে বিভ্রান্ত হয়ে সুলতান একদল সৈন্য পাঠিয়ে তাঁর উপর হামলা চালান। খৃষ্টীয় ১৪৭৪ সনে শাহ ইসমাঈল গাজী শাহাদাত বরণ করেন।
সিলেটেও সুলতান রুকনুদ্দীন বারবাক শাহের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত ছিলো। তাঁর শাসন কালে আরাকানের রাজা মুসলিমদের হাত থেকে চট্টগ্রাম ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হন।
তাঁর শাসনকালে বহু সংখ্যক হাবশী বাঙালাহ সালতানাতে আসে। সুলতান আট হাজার হাবশীকে তাঁর সেনাবাহিনীতে ভর্তি করেন।
সুলতান রুকনুদ্দীন একজন উদারচিত্ত, বিচক্ষণ ও ন্যায়পরায়ণ শাসক ছিলেন। তাঁর শাসনকালেও দেশে বহু মসজিদ নির্মিত হয়। খৃষ্টীয় ১৪৭৫ সনে তিনি ইন্তিকাল করেন।
৩৪. শামসুদ্দীন আবুল মুযাফফার ইউসুফ শাহ
খৃষ্টীয় ১৪৭৫ সনে রুকনুদ্দীন বারবাক শাহের ইন্তিকাল হলে তাঁর পুত্র ইউসূফ ‘শামসুদ্দীন আবুল মুযাফফার ইউসূফ শাহ’ উপাধি ধারণ করে বাঙালাহ সালতানাতের সুলতান হিসেবে গৌড়ের মসনদে বসেন। সুলতান ইউসূফ ইসলামী শারীয়াহর একনিষ্ঠ অনুসারী ছিলেন। তিনি সালতানাতে ইসলামী বিধি বিধান সঠিক ভাবে পালিত হচ্ছে কিনা তা দেখার জন্য বহু আলিমের ওপর দায়িত্ব ন্যস্ত করেন।
তাঁর শাসনকালে বাঙালাহ একটি ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত হয়। মদপান কঠোরভাবে নিষিদ্ধ হয়। লোকদের নৈতিক মানোন্নয়নের প্রয়োজনে বহু মসজিদ নির্মাণ করা হয়। তাঁর শাসনকালে দেশে শান্তি বিরাজমান ছিলো। একটি লিপিতে সুলতান ইউসূফ শাহকে ‘খালীফাতুল্লাহ’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।সম্ভবতঃ খৃষ্ঠীয় ১৪৮১ সনে তিনি ইন্তিকাল করেন।
৩৫. জালালুদ্দীন আবুল মুযাফফার ফাতেহ শাহ
খৃষ্টীয় ১৪৮১ সনে গৌড়ের বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ সুলতান মাহমুদ শাহের অন্যতম পুত্র ফাতেহ শাহকে বাঙালাহর সুলতান নির্বাচিত করেন। তিনি জালালুদ্দীন আবুল মুযাফফার ফাতেহ শাহ উপাধি ধারণ করে গৌড়ের মসনদে বসেন।
তাঁর শাসনকালেও সালতানাতে বহু সংখ্যক মাসজিদ তৈরি হয়্ দেশের সর্বত্র দ্রুততার সাথে ইসলামের প্রসার ঘটে ও মুসলিম বসতি গড়ে উঠে।
তবে রাজধানীতে হাবশী সৈন্যরা প্রতাপশালী হয়ে উঠে। প্রাসাদ রক্ষীদের হাবশী কমাণ্ডার শাহজাদা সুলতানের বিরুদ্ধে চক্রান্তে মেতে ওঠে। একদিন সে সুলতানকে হত্যা করে বসে।
খৃষ্টীয় ১৪৮৭ সনে সুলতান ফাতেহ শাহ শহীদ হন।
৩৬. সুলতান বারবাক শাহ
খৃষ্টীয় ১৪৮৭ সনে হাবশী সৈন্যদের কমাণ্ডার সুলতান বারবাক শাহ উপাধি ধারণ করে গৌড়ের মসনদে বসেন। কিন্তু সাবেক সুলতানের অনুগত হাবশী কমাণ্ডার মালিক আনদিল ছয় মাসের মধ্যেই তাঁকে হত্যা করেন।
৩৭. সাইফুদ্দিন আবুল মুযাফফার ফিরোজ শাহ (২য়)
খৃষ্টীয় ১৪৮৭ সনে গৌড়র নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগণ মালিক আনদিলকেই বাঙালাহ সালতানাতের সুলতান নির্বাচন করেন। তিনি সাইফুদ্দীন আবুল মুযাফফার ফিরোজ শাহ (২য়) উপাধি ধারণ করে গৌড়ের মসনদে বসেন।
তিনি একজন যোগ্য ও ন্যায়পরায়ণ সুলতান ছিলেন। তিনি ছিলেন অভাবী মানুষদের বন্ধু। তার পৃষ্ঠপোষকতায় অনেকগুলো মাসজিদ নির্মিত হয়। রাজধানী গৌড় শহরে তিনি একটি মাসজিদ ও একটি উচ্চ মিনার তৈরি করেন। ফিরোজ মিনার এখনো তাঁর স্মৃতি বুকে নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
বাঙালাহ সালতানাতের হাবশী সুলতানদের মধ্যে তিনিই ছিলেন শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তিত্ব।
খৃষ্টীয় ১৪৮৯ সনে তিনি ইন্তিকাল করেন।
৩৮. নাসিরুদ্দীন আবুল মুযাফফার মাহমুদ শাহ (২য়)
খৃষ্টীয় ১৪৯০ সনে তিনি বাঙালাহর সুলতান হন। তিনি রাজধানী গৌড়ে একটি মাসজিদ নির্মাণ করেন।
খৃষ্টীয় ১৪৯১ সনে সিদি বদর তাঁকে হত্যা করেন।
৩৯. শামসুদ্দীন মুযাফফর শাহ সিদি বদর
খৃষ্টীয় ১৪৯১ সনে সিদি বদর শামসুদ্দীন মুযাফফার শাহ উপাধি ধারণ করে বাঙালাহর সুলতান রপে গৌড়ের মসনদে বসেন। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় শায়খ নূর কুতবুল আলমের বংশধর শায়খ গাউস দেশে ইসলামী শিক্ষা বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
সাইয়েদ হুসাইন নামক একজন আরব বংশীয় উচ্চভিলাষী ব্যক্তি তাঁর শাসনকালের শেষভাগে সালতানাতে গোলযোগ সৃষ্টি করেন। অচিরেই গৃহযুদ্ধ শুর হয়। এই গৃহযুদ্ধ চারমাস স্থায়ী হয়। অবশেষে সুলতান বিদ্রোহীদের হাতে প্রাণ হারান।
৪০. আলাউদ্দীন হুসাইন শাহ
খৃষ্টীয় ১৪৯৪ সনে আবর বংশীয় সাইয়েদ হুসাইন ‘আলাউদ্দীন হুসাইন শাহ’ উপাধি ধারণ করে বাঙালাহ সালতানাতের সুলতান হিসেবে গৌড়ের মসনদে বসেন।
তিনি গৌড় থেকে একডালাতে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন।
তিনি হাবশীদের ওপর খুব বিরক্ত ছিলেন। তিনি তাদেরকে বাঙালাহ ছেড়ে চলে যাবার নির্দেশ দেন। তারা দলে দলে দাক্ষিণাত্যে চলে যায়।
আলাউদ্দীন হুসাইন শাহের শাসনকালেই বাঙালাহর উপকূল অঞ্চলে ইউরোপীয় দেশ পর্তুগাল থেকে আগত পর্তুগীজ জলদস্যুদের উপদ্রবের সূচনা হয়।
তাঁর শাসনকালে শ্রী চৈতন্যদেব বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করেন। নবদ্বীপ ছিলো তাঁর প্রধান কেন্দ্র। তবে তিনি স্বাধীনভাবে সারা দেশ ঘুরে বেড়াতেন। ইসলামের প্রসার রোধের উদ্দেশ্যেই তিনি এই আন্দোলন শুরু করেছিলেন। এই আন্দোলন উচ্চ শ্রেণীর হিন্দুদের ওপর তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি। বরং পর্তুগীজ পর্যটক বারবোসা লিখেছেন যে শাসকদের আনুকূল্য লাভের যোগ্যতা সাধারণ কোন ব্যক্তির থাকেনা, সেহেতু প্রতীয়মান হয় যে উচ্চ শ্রেণীর হিন্দুদের মধ্য থেকেই বহু লোক ইসলাম গ্রহণ করতো।
আলাউদ্দীন হুসাইন শাহ হিন্দুদের প্রতি খুবই উদার ছিলেন। তাঁর সভাসদদের মধ্যে বহু হিন্দু ছিলো। তাঁর অন্যতম মন্ত্রী ছিলেন পুরন্দর খান। ত্রিপুরা অভিযানে সেনাপতি নিযুক্ত হয়েছিলেন গৌরমল্লিক। অনুপ ছিলেন মুদ্রাশালার প্রধান কর্মকর্তা। তাঁর দেহরক্ষী ছিলেন কেশব ছত্রী।
ইতিমধ্যে দিল্লীতে লোদী বংশের রাজত্ব কায়েম হয়। দিল্লীর সুলতান সিকান্দার লোদী পার্শ্ববর্তী জৌনপুর সালতানাত আক্রমণ করেন। জৌনপুরের সুলতান হুসাইন শাহ শার্কী বাঙালাহ সালতানাতে এসে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে সিকান্দার লোদী সেনাপতি মাহমুদ খান ও মুবারক খান লোহানীর নেতৃত্বে বাঙালাহ অভিমুখে সৈন্য প্রেরণ করেন। আলাউদ্দীন হুসাইন শাহ বাঙালাহর স্বাধীনতা হিফাজাতের জন্য ছিলেন দৃঢ় সংকল্প। তিনি তাঁর পুত্র দানিয়েলের নেতৃত্বে দিল্লীর সৈন্য বাহিনীর মুকাবিলার জন্য একদল সৈন্য পাঠান। উভয় বাহিনীর মুকাবিলা হয় বিহারে। অবশেষে একটি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এই মর্মে যে দিল্লী সালতানাত বাঙালাহর ব্যাপারে নাক গলাবে না, বাঙালাহ সালতানাতও দিল্লী সালতানাতের ব্যাপারে নাক গলাবে না।
বাঙালাহর গা ঘেঁষে আসামের যেই অংশটি রয়েছে সেইটির নাম ছিলো কামতা (বর্তমান গোয়ালপাড়া অঞ্চল)। আরো এগিয়ে বারনাদি ও মনসা নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলকে বলা হতো কামরূপ। কামতা-কামরূপ রাজ্যে তখন খেন বংশের রাজা নীলম্বর ক্ষমতাসীন ছিলেন। রাজা নীলাম্বরের একজন মন্ত্রীর আহবানে সাড়া দিয়ে আলাউদ্দীন হুসাইন শাহ সামরিক অভিযান চালিয়ে উক্ত রাজ্যের রাজধানী কামতাপুর দখল করেন। আসামের মূলখণ্ডের দিকেও তিনি সৈন্য পাঠান। তবে তা ফলপ্রসূ হয়নি।
ত্রিপুরার রাজা ধান্য মানিক্য বাঙালাহ সালতানাতের পূর্ব সীমান্তের কিছু অংশ দখল করেন। এই সময় ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী ছিলো রাঙামাটি। আরাকানের মগ সৈন্যরা চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো। ত্রিপুরার সৈন্যগণ আক্রমণ চালিয়ে চট্টগ্রাম দখল করে নেয়। যুবরাজ নুসরাত শাহ চট্টগ্রাম পুনর্দখল করে এটিকে দারুল ইসলামে পরিণত করেন। এই যুদ্ধে আলফা হুসাইনী নামক একজন আরব ব্যবসায়ী জাহাজ ও প্রয়োজনীয় উপকরণ দিয়ে নুসরাত শাহকে সাহায্য করেন। খৃষ্টীয় ১৫১৬ সনে চট্টগ্রাম পুনরায় বাঙালাহ সালতানাতের অধীনে আসে। পর্তুগীজ নাবিক জো-দা-সিলভেরিয়া জানান যে খৃষ্টীয় ১৫১৭ সনে চট্টগ্রাম এসে তিনি এটিকে বাঙালাহর সুলতানের অধীনে দেখতে পান।
আলাউদ্দীন হুসাইন শাহ পরাগল খানকে চট্টগ্রামের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। পরাগল খান সীতাকুণ্ড পাহাড়ে ঘাঁটি স্থাপন করে চট্টগ্রাম অঞ্চল শাসন করতে থাকেন। তাঁর পরে ঐ অঞ্চলের শাসনকর্তা নিযুক্ত হন ছুটি খান। কর্ণফুলী নদীর তীরভাগ পর্যন্ত তাঁর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত ছিলো।
সুলতান আলাউদ্দীন হুসাইন শাহ ‘খালীফাতুল্লাহ’, ‘আলমুজাহিদু ফূ সাবীলির রাহমান’, ‘গাউসুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমীন’ ইত্যাদি উপাধি গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর জারিকৃত কোন কোন মুদ্রায় ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’- কালেমা অংকিত ছিলো, কোন কোনটিতে ছিলো ইসলামের সোনালী যুগের চার খলীফার নাম। তাঁর জারিকৃত এমন ত্রিশ মুদ্রা পাওয়া গেছে যেইগুলো মাসজিদ নির্মাণের সাথে সম্পর্কিত। তাঁর সময়ে গৌড়ের ছোট সোনা মাসজিদ নির্মিত হয়। তিনি গৌড়ের নিকটে একটি মাদ্রাসাও স্থাপন করেন ‘লি তাদরীসি উলুমুদদীন ওয়া তা’লীমে আহকামিল ইয়াকীন’।
আলাউদ্দীন হুসাইন শাহ বাংলাভাষা ও সাহিত্যের অগ্রগতির ক্ষেত্রে অবদান রাখেন। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় হিন্দু কবি মালাধর বসু বাংলা ভাষায ভগবৎ গীতা অনুবাদ করেন। কবি মালাধর বসু, বিপ্রদাস ও যশোরাজ খান সুলতানের নাম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতেন। কবি বিজয়গুপ্ত সুলতান আলাউদ্দীন হুসাইন শাহকে ‘নরপতি তিলক’ ও ‘জগৎ ভূষণ’ আখ্যা দেন।