শিক্ষা সাহিত্য ও সংস্কৃতি
মওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রহীম (রহ)
প্রসঙ্গ–কথা
শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি একটি জাতির স্বরূপ অন্বেষায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশ্বের জাতিসমূহের দরবারে একটি বিশেষ জাতির অবস্থান কোথায়, তা চিহ্নিত করা যায় তার শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি আলোক সম্পাৎ করে। কারণ শিক্ষা একটি জাতির অবয়ব নির্মাণ করে, সাহিত্যে সে অবয়বের প্রতিফলন ঘটে আর সংস্কৃতি তাকে পূর্ণতা দান করে। এভাবেই একটি জাতির পরিচয় বিধৃত হয় তার শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে। তাই যে-কোন জাতির বৈশিষ্ট্য ও স্বকীয়তার সাথে তার শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। বলা বহুল্য যে, মুসলিম জাতির বেলায়ও কথাটি হুবহু প্রযোজ্য।
দুনিয়ায় সাধারণত বর্ণ, গোত্র, ভাষা বা ভূখণ্ডকে কেন্দ্র করে এক-একটি জাতির অবয়ব নির্মিত হয়। তাদের শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতেও তাই এসব বৈশিষ্টের প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়; এগুলোকে কেন্দ্র করেই তাদের জীবন-চক্র আবর্তিত হয়। ফলে তাদের স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তা উপলব্ধি করতে কিছুমাত্র বেগ পেতে হয় না; বরং অনেক ক্ষেত্রে বাহ্যিক অবয়ব ও অভিব্যক্তি দেখেই তাদের জাতিসত্তার প্রকৃত স্বরূপটি উপলব্ধি করা যায়। কিন্তু ইসলামের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি একটু ভিন্নতর।
ইসলাম দুনিয়ায় এক মহত্তম আদর্শের উদ্বোধক। বর্ণ, গোত্র, ভাষা ও ভূখণ্ডের কৃত্রিম ভেদ-রেখার ঊর্ধ্বে এটি এক বিশ্বজনীন চেতনা। এক আল্লাহর অকৃত্রিম বন্দেগী ও অখন্ড মানবিক সমতা হচ্ছে এই আদর্শের ভিত্তিভূমি আর এটাই মুসলিম জাতিসত্তার মূল উপাদান। তাই একটি আদর্শবাদী মুসলিম জাতির শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে ওঠে ইসলামী চিন্তা-দর্শনের ভিত্তিতে, তার সাহিত্যে প্রতিফলিত হয় ইসলামী ভাবাদর্শের সার-নির্যাস আর তার সংস্কৃতিতে বাঙ্ময় হয়ে ওঠে ইসলামের সূক্ষ্ণ নান্দনিকতা। এ কারণে মুসলিম জাতিসত্তা দুনিয়ার অন্যান্য জাতিসত্তা থেকে গুণগতভাবে পৃথক ও স্বতন্ত্র ভাবাদর্শে সমুজ্জ্বল।
ইসলামের সোনালী যুগে মুসলিম জাতিসত্তার এটাই অনন্য বৈশিষ্ট্য আর এ বৈশিষ্ট্যের কারণেই দুনিয়ার জাতিসমূহের দরবারে মুসলিম জাতির অবস্থান ছিল আপন স্বকীয়তায় ভাস্বর। জ্ঞানচর্চা, জীবন-সাধনা, রাষ্ট্র-শাসন সর্বত্রই মুসলমানদের হাতে ছিল ‘আলাদীনের জাদুর চেরাগ’। তাদের নির্মিত নতুন সমাজ ও সভ্যতার স্পর্শে মাত্র চার দশকের মধ্যেই এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের বিরাট অঞ্চলে মানবতার নব-জাগৃতি ঘটেছিল এবং যুগ-যুগান্ত কালের অজ্ঞতার যবনিকা অপসৃত হয়েছিল। কোন বর্ণ, গোত্র, ভাষা বা অঞ্চলের কারণে নয়, শুধুমাত্র ইসলামের জাদু-স্পর্শেই এই অভাবনীয় বিপ্লব সংঘটিত হতে পেরেছিল। এমনকি প্রথম তিন দশকের সংক্ষিপ্ত সময়-পরিসরে তৎকালীন দুনিয়ার বড় বড় রাজা-বাদশাহ এবং রোম ও পারস্যের ন্যায় দু’দুটি পরাশক্তি তাদের পদতলে এসে লুটিয়ে পড়েছিল।
আজ সেই মুসলিম জাতি শুধু নিজের প্রভাব প্রতিপত্তিই হারায়নি, অমুসলিম জাতিগুলোর কাছে সে করুণার পাত্রেও পরিণত হয়েছে। সময়ের বিবর্তনে তার আকার-আকৃতি বৃদ্ধি পেয়েছে বটে; কিন্তু তার আদর্শিক বৈশিষ্ট্য ও নৈতিক গুণাবলী বহুলাংশেই লোপ পেয়েছে। কারণ ইসলামের সুমহান আদর্শের পরিবর্তে মুসলমানরা আজ বর্ণ, ভাষা ও অঞ্চলের ভিত্তিতে খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে পড়েছে যা তাদের জাতিসত্তাকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলেছে। তারা ইসলামী শিক্ষা-দর্শন পরিহার করে পাশ্চাত্যের জড়বাদী শিক্ষাদর্শনকে গ্রহণ করেছে; তাদের সাহিত্যে নৈতিক মূল্যবোধের পরিবর্তে ভোগবাদী চিন্তা-দর্শনের প্রতিফলন ঘটছে; তাদের কৃষ্টি সংস্কৃতিতে নির্মল সৌন্দর্য-বোধের পরিবর্তে উৎকট নগ্নতা ও অশ্লীলতা ছায়াপাত করছে। এর ফলে আজকের মুসলিম জনগোষ্ঠী নৈতিক ও আদর্শিক মূল্যবোধ হারিয়ে কার্যত এক বিশৃংখল জনারণ্যে পরিণত হয়েছে। এই চরম বিপর্যয় থেকে মুসলিম জাতিকে উদ্ধার করার জন্যে আজকে প্রয়োজন হয়ে পড়েছে তার প্রকৃত স্বরূপ অন্বেষার; তার হারানো বৈশিষ্ট্য ও স্বকীয়তাকে ফিরিয়ে এনে তাকে নতুনভাবে বিশ্বের দরবারে উপস্থিত করার। বলা বাহুল্য যে, এই সুমহান দায়িত্ববোধে উদ্বুদ্ধ হয়েই হযরত মওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রহীম র. শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি প্রসঙ্গে এই মূল্যবান গ্রন্থটি রচনা করেন ষাট, সত্তর ও আশির দশকে। বিগত দিনগুলোতে এ গ্রন্থের বিভিন্ন অংশ প্রকাশিত হয়েছে দেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও সাময়িকীতে। এক্ষণে সময়ের দাবি অনুধাবন করে আমরা গ্রন্থটিকে তুলে দিচ্ছি বিদগ্ধ পাঠকদের হাতে। গ্রন্থটি পাকিস্তান ও বাংলাদেশ এই দুটি স্বতন্ত্র পর্বে রচিত হলেও এর বিষয়-বিন্যাস ও দৃষ্টিভঙ্গিতে কোন পার্থক্য সূচিত হয়নি বিষয়বস্তুর অভিন্নতার কারণে। তবে বর্তমানে প্রয়োজন বিবেচিত হওয়ায় এর বিভিন্ন স্থানে কিছু পাদটীকা সংযোজিত হয়েছে।
গ্রন্থকার আমাদের শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির নানা দিক নিয়ে অত্যন্ত বিস্তৃত ও মনোজ্ঞ আলোচনা করেছেন গ্রন্থের বিভিন্ন অধ্যায়ে। সে আলোচনায় যেমন ইসলামের ইতিবাচক দিকটি ফুটে ওঠেছে চমৎকারভাবে তেমনি পাশ্চাত্য দৃষ্টিভঙ্গির চুলচেরা বিশ্লেষণও স্থান পেয়েছে যথোচিতরূপে। বিশেষত ‘আধুনিকতা’র নামে পাশ্চাত্য শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি যে মুসলিম জাতিকে একটি মেরুদণ্ডহীন জনগোষ্ঠীতে পরিণত করছে এবং তাদেরকে ধ্বংসের অতল গহ্বরে ঠেলে দিচ্ছে, এ সত্যটির বলিষ্ঠ প্রতিফলন ঘটেছে গ্রন্থের বিভিন্ন অধ্যায়ে। গ্রন্থকার তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে আপন বক্তব্যকে বিন্যস্ত করেছেন অকাট্য, যুক্তি ও তথ্যের ভিত্তিতে এবং পাঠক-চিত্তকে নাড়া দেয়ার জন্যে অত্যন্ত বলিষ্ঠ বাকভঙ্গির আশ্রয় নিয়েছেন। সে দিক থেকে বাংলা ভাষায় এটি এক অসামন্য সুখপাঠ্য গ্রন্থ, একথা প্রায় নির্দ্বিধায়ই বলা চলে।
বাংলাদেশের শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে বর্তমানে এক নিদারুণ বন্ধ্যাত্ব চলছে। এ বন্ধ্যাত্বের অবসান ঘটানোর জন্যে আজ প্রয়োজন সাহসী লোকদের এক বলিষ্ঠ উদ্যমের- প্রয়োজন ইসলামী চেতনায় উজ্জীবিত একটি গণ-বিস্ফোরণের। কাংখিত সেই গণ-বিস্ফোরণকে সম্ভব করে তোলার লক্ষেই আমরা এই অসামান্য গ্রন্থটি নিয়ে হাজির হয়েছি দেশের সচেতন পাঠকদের কাছে। এদেশে ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র কায়েমের সংগ্রামে নিবেদিত সৈনিকরা এ গ্রন্থ থেকে কিছুমাত্র অনুপ্রাণিত হলে আমাদের শ্রমকে সার্থক মনে করব।
বর্তমান মুদ্রণ-ব্যয় দিনদিন হুহু করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তথাপি গ্রন্থটির অঙ্গসজ্জা ও মুদ্রণ পারিপাট্য উন্নত করার জন্যে আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। এর মূল্যও ক্রেতাদের নাগালের মধ্যে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। মহান আল্লাহ গ্রন্থকারকে উত্তম প্রতিফল দান করুন, এটাই আমাদের সানুনয় প্রার্থনা।
মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান
চেয়ারম্যান
মওলানা আবদুর রহীম ফাউন্ডেশন
ঢাকাঃ ১০ জুন, ২০১২