আল–কুরআনের শিক্ষা দর্শন
মুসলিম সমাজের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের দিক দিয়ে কুরআনই হচ্ছে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কিতাব, এ কথা অনেকের নিকটই বিস্ময়কর মনে হয়। কেননা এ দৃষ্টিতে খুব কম লোকই চিন্তা-ভাবনা করেছেন আর এই দৃষ্টিতে কুরআন মজীদ অধ্যয়ন করেছেন, এমন লোকও খুব বেশী পাওয়া যায় না। আমাদের তথাকথিত চিন্তাবিদদের অনেকেই কুরআন মজীদ পাঠ করেন নি আর করে থাকলেও তা না বুঝে-শুনেই পাঠ করেনে। অথচ প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে, কুরআন মজীদ মানবতার জন্যে শিক্ষা ও সংস্কৃতির এক তুলনাহীন আকর বিশেষ। সাধারণভাবে গোটা মানব জাতির জন্যে এই কিতাবখানি জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা-সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রথম গ্রন্থ রূপে গণ্য হতে পারে এবং বিশেষভাবে সামাজিক ও সামষ্টিক এবং নৈতিক ও আধ্যাত্মিক প্রেরণার উৎস হতে পারে।
সমস্ত বিষয়ের শুরু ও শেষ এবং মানুষ ও বিশ্বলোক তথা মানুষ ও সৃষ্টিকর্তার পারস্পরিক সম্পর্ক সম্বন্ধে আলোচনা ও পর্যালোচনাই যদি দর্শনের বিষয়বস্তু হয়ে থাকে, তাহলে কুরআন মজিদই হচ্ছে সেই দর্শনের উৎসমূল। আর ব্যক্তির অন্তর্নিহিত শক্তি-সামর্থ্যের লালন ও উৎকর্ষ সাধন এবং মানব প্রজাতি হিসেবে তাকে গড়ে তোলাই যদি প্রশিক্ষণের লক্ষ্য হয়, তাহলে কুরআন মজীদই এই লক্ষ্য অর্জনের প্রধান সহায়ক। কেননা মানুষ ও সৃষ্টলোকের লালন ও প্রশিক্ষণের কথা কুরআন মজীদই বলেছে অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভাষায়। আমরা যখনই বলিঃ ‘আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামীন’ তখনই আমরা বলি, সমগ্র বিশ্বলোকের প্রভূ ও প্রতিপালক হচ্ছেন মহান আল্লাহ তা’আলা। তিনি কেবল মানুষেরই নন, সমস্ত সৃষ্টিলোকেরই প্রতিপালক। সৃষ্টিলোকের অস্তিত্ব ও ক্রমবিকাশ লাভ এবং মানুষের লালন-পালন, ক্রমবৃদ্ধি ও মানবীয় প্রকৃতি সম্পর্কে কুরআন স্পষ্টত কথা বলে। গোটা প্রকৃতি ও সমাজ-সমষ্টির মধ্যে মানুষের অস্তিত্বের কথা কুরআনই বিশ্লেষণ করে। সেই সঙ্গে প্রশিক্ষণের লক্ষ্য অর্জনের জন্যে সে মানুষকে তাগিদ দেয়। মানুষের মন-মানস পরিচ্ছন্নকরণ ও তার আচার-আচরণ সুসংবদ্ধকরণে কুরআনের অবদান তুলনাহীন। কুরআনের প্রশিক্ষণ-দর্শনের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সাধারণভাবে সব কিছুর প্রশিক্ষণ দান। আলাদা আলাদাভাবে প্রতিটি সত্তার স্বতন্ত্র প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সার্বিক জ্ঞান অর্জনের ব্যবস্থা কুরআন গ্রহণ করেছে। পরিবর্তন, বিবর্তন ও বিকাশ লাভে কথাও কুরআনে বাদ পড়েনি।
কুরআনের প্রশিক্ষণ সমগ্র বিশ্ব-ভূমণ্ডল, আকাশলোক, বস্তুলোক, আত্মার জগত ইত্যাদি সব কিছুতেই পরিব্যাপ্ত; সব কিছুর শুরু ও শেষ, বাহির ও ভিতর এবং স্থান ও কাল পর্যায়ের সব কিছুতেই তা শামিল করেছে। কুরআনের প্রথম ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা হচ্ছে, এই বিশ্বলোকের সৃষ্টিকর্তা আছেন এবং তিনি বহু নন, এক ও একক। কুরআন-উপস্থাপিত ‘তওহীদ’-এ আবেদন সর্বাত্মক ও সব কিছুর সাথে সামঞ্জস্যশীল। কুরআন বস্তু ও আত্মার সমন্বয় সাধন করেছে-ঈমান ও বিবেকের মধ্যে সামঞ্জস্য স্থাপন করেছে। তা দ্বীন দুনিয়াকে অভিন্ন করে দিয়েছে এবং চিন্তা ও কর্মের ঐক্য বিধান করেছে। তা স্বাদ ও কষ্ট, চেষ্টা ও ইবাদত, আদর্শ ও বাস্তব, মানুষ ও বিশ্বলোক এবং বিশ্বলোক ও বিশ্বস্রষ্টার মধ্যে সম্পর্ক নির্ধারণ করে দিয়েছে সুস্পষ্টভাষায়।
কুরআন মানুষকে এক অবিভাজ্য ‘একক’ রূপে পেশ করেছে। বস্তু ও আত্মার মাঝে বিরোধ ও পার্থক্যকারী দর্শনকে কুরআন বাতিল করে দিয়েছে। কেবল আধ্যাত্মিক জীবন নিয়ে মশগুল থাকা এবং বৈষয়িক জীবন পরিহার কিংবা উপেক্ষা করার সাথে কুরআনের কোন সম্পর্ক নেই। দ্বীন ও রাষ্ট্রের মধ্যে পার্থক্যকারী দর্শনকে ইসলাম সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করেছে। একই মানব সত্তাকে তাকওয়া ও ফাসিকী এ দ্বিমুখী ধারায় গড়ে তোলাকে এবং একই সমাজ-সমষ্টিকে বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্তকরণকে কুরআন বাতিল করে দিয়েছে। মানুষ মসজিদে ‘মুত্তাকী’ হবে আর নিজেদের পারস্পরিক লেন-দেনে প্রতারণা করবে, বাহ্যত নিজেকে বড় পরহেযগার হিসেবে জাহির করবে আর গোপনে সে মাদক দ্রব্য ব্যবহার করবে কিংবা জুয়া খেলবে- কুরআন তা মেনে নিতে আদৌ প্রস্তুত নয়। সমাজের কিছু লোক মহা সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে লিপ্ত হবে আর অবশিষ্ট লোক নিজেদের দেহ ও আত্মার সম্পর্ক রক্ষার মত খাদ্যও পাবে না-কুরআন এই নীতি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করেছে। এক কথায় বলা যায়, কুরআনের দর্শন মানব সত্ত্বার পরম ঐক্য ও একত্বের দর্শন। বিবেক-বুদ্ধি, দয়া-মায়া, সহানুভূতি ও বাস্তব কাজ পরস্পর অবিচ্ছিন্ন। কুরআনের দর্শন ঐক্য ও শৃংখলার দর্শন। ব্যক্তি ও সমাজ, ব্যক্তি এবং মানুষ ও বিশ্বলোক ও বিশ্বস্রষ্টার পারস্পরিক সম্পর্ক রচনা হচ্ছে কুরআনের দর্শন। কুরআনের ব্যাপকতা ও সর্বাত্মকতা, তথা তওহীদ বলতে আমরা এটাই বুঝি।
বিকাশ, ক্রমবৃদ্ধি ও উন্নয়ন কুরআনী প্রশিক্ষণের সাথে পুরোপুরি সামঞ্জস্যশীল। কুরআনের উন্নয়ন উচ্চতর আদর্শের দিকে-উচ্চতর আদর্শিক জীবনের দিকে মানুষের অব্যাহত অগ্রগতি। মহত্ত ও পূর্ণত্বের দিকে কুরআনের অগ্রসরতাই কল্যাণকর উন্নয়্ন। যে উন্নয়ন মানুষকে মনুষ্যত্ব থেকে দুরে সরিয়ে নেয়, তাকে পশুত্ব ও পাশবিকতার নিকটে পৌঁছে দেয়, কুরআনের নিকট তা সমর্থনযোগ্য নয়। অতএব আত্মিক, নৈতিক ও সামষ্টিক উন্নয়নের জন্যে কাজ করাই কুরআনী প্রশিক্ষণের সার কথা।
কুরআনী প্রশিক্ষণের লক্ষ্য, প্রশিক্ষণের পথ ও পন্থা এবং সর্বশেষে কুরআনী প্রশিক্ষণ-পদ্ধতি ও নিয়ম জানাই প্রকৃত প্রশিক্ষণের আসল উদ্দেশ্য।
কুরআনী শিক্ষা প্রশিক্ষণের লক্ষ্য
কুরআন যে প্রশিক্ষণ-লক্ষ্য উপস্থাপন করেছে, বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা উদ্দেশ্যে তাকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারেঃ
১. মানুষের সংজ্ঞা ও পরিচয়। সৃষ্টিলোকে ব্যক্তি মানুষের স্থান এবং এই পার্থিব জীবনে তার দায়িত্ব ও কর্তব্য।
২. ব্যক্তি মানুষের সামাজিক পরিচিতি, সমাজ-সমষ্টিতে ব্যক্তির দায়িত্ব ও কর্তব্য।
৩. বিশ্বপ্রকৃতির সাথে ব্যক্তি মানুষের পরিচিতি, স্রষ্টার সৃষ্টিকুশলতা, সৃষ্টির উদ্দেশ্য এবং বস্তুর ভোগ-ব্যবহারে মানুষের প্রতিষ্ঠা।
৪. বিশ্বস্রষ্টার সাথে ব্যক্তি মানুষের পরিচিতি এবং তাঁর ইবাদত ও আনুগত্যে উদ্বুদ্ধকরণ।
এ চারটি লক্ষ্য বাহ্যত ভিন্ন ভিন্ন ও স্বতন্ত্র মর্যাদাসম্পন্ন মনে হলেও মূলত এগুলো পরস্পর সম্পৃক্ত- কোনটাই বিচ্ছিন্ন ও স্বতন্ত্র নয়। অন্য কথায় বলা যায়, প্রথমোক্ত তিনটির লক্ষ্য চূড়ান্ত পরিণতি লভ করে চতুর্থ লক্ষ্যটিতে। প্রথমোক্ত তিনটির লক্ষ্য পূর্ণত্ব লাভ করে চতুর্থ লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার মাধ্যমে। সে চতুর্থ লক্ষ্যটি হচ্ছে, আল্লাহর পরিচিতি লাভ এবং তাঁর আনুগত্য তথা আদেশ ও নিষেধ মেনে চলার প্রবণতা অর্জন। এ দৃষ্টিতে বলা যায়, ইসলামী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে আল্লাহর পরিচিতি লাভ এবং তাঁর আনুগত্য তথা আদেশ-নিষেধ মেনে চলা। আত্মোপলব্ধি বা আত্মসচেতনা, সমাজ-সচেতনতা ও বিশ্বলোক ব্যবস্থা অনুধাবন এ প্রশিক্ষণের মূল লক্ষ্য নয়, এ সব হচ্ছে মূল লক্ষ্য পর্যন্ত পৌঁছার উপায় ও উপকরণ মাত্র। এ থেকে বোঝা যায়, ইসলামী প্রশিক্ষণের কাজ হচ্ছে আল্লাহর আনুগত্যের ভিত্তিতে মানুষের পুনর্গঠন এবং তাঁর আদেশাবলী পালন ও নিষেধসমূহ পরিহার করার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তোষ অর্জনের ইচ্ছা-বাসনা মানব মনে জাগিয়ে তোলা। বিশ্বপ্রকৃতি যেসব আইনের ভিত্তিতে চালিত হচ্ছে এবং যেসব নৈতিক বিধিবিধান গ্রহণ ও অনুসরণের জন্যে কুরআন মজীদ আহ্বান জানায়, এই উভয়বিধ আইন-বিধানই মানুষকে প্রকৃত কল্যাণ, মহাসত্য ও পরম সৌভাগ্য লাভ পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। এই সবকিছুর মাধ্যমেই মহান আল্লাহর ইচ্ছা প্রতিফলিত হয়। এ থেকে জানা গেল যে, বিশ্বস্রষ্টা প্রবর্তিত ‘সিরাতুল মুস্তাকীম’- এ পদচারণা কেবল মুমিন ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব। আর আল্লাহর নিয়ম-বিধান অনুসরণ করে চলার নামই হচ্ছে ইবাদত-সে নিয়ম-বিধান প্রকৃতিগত হোক কি আধ্যাত্মিক ও নৈতিক হোক, বৈষয়িক কিংবা ইহলৌকিক কি হোক পরলৌকিক।
অতঃপর আমরা মূল কুরআনের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করছি। এখানে আমরা এমন কতক আয়াত উদ্ধৃত করব যা মানুষের মর্যাদা এবং ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক দায়িত্বের কথা সুস্পষ্ট করে তোলে। তারপর আমরা এমন কতিপয় আয়াত উদ্ধৃত করব যা থেকে বিশ্বলোক ও বিশ্বস্রষ্টা সম্পর্কে কুরআন কি ধারণা দেয, তা সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে।
ব্যক্তি মানুষ সম্পর্কে কুরআন
কুরআন মজীদে মানুষ সম্পর্কে যে ধারণ দেয়া হয়েছে, তা সর্বাত্মক, বৈশিষ্ট্য নির্ধারক ও পুরোমাত্রায় ভারসাম্যপূর্ণ। বস্তুবাদী দার্শনিকরা মানুষকে নিছক একটা রক্ত মাংসের জীব, নানা রাসায়নিক পদার্থের সমন্বয় এবং নিছক যন্ত্র-সর্বস্ব মনে করেছে। কিন্তু কুরআন তা স্বীকার করেনি। কুরআনের দৃষ্টিতে মানুষ বস্তুসর্বস্ব নয়-নয় বস্তুনিরপেক্ষ নিছক আত্মা-সর্বস্ব। কুরআন মানুষকে বস্তু ও রূহের সমন্বিত সত্তারূপে পেশ করেছে। আর এ দুটি জিনিস পরস্পর গভীরভাবে সম্পৃক্ত, সম্পর্ক-সংশ্লষ্ট এবং পরস্পর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সম্পন্ন। মানুষ নিছক জন্তু বা জীব নয়। জন্তু ও জীবগুলোর আয়ুষ্কালের যাবতীয় দায়-দায়িত্ব মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই নিঃশেষ হয়ে যায়। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে তা হয় না। দেহ-সত্তার বস্তুনিষ্ঠ বিচারে মানুষ ও অন্যান্য জীব-জন্তুর মধ্যে কোন মৌলিক পার্থক্য নেই। মানুষ এমন সত্তাও নয়, যার ওপর অধিক সম্মানার্হ আর কেউ নেই বলে মনে করা যেতে পারে। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’ কথাটি কুরআনের দৃষ্টিতে কিছুমাত্র সত্য নয়।
তবে কুরআনে মানুষের বিশেষ সম্মান ও মর্যাদার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু মানুষ সে সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী হবে কেবল তখন, যখন সে নিজেকে সঠিক ও যথার্থভাবে জানতে ও চিনতে পারবে এবং জ্ঞান ও বিবেক-বুদ্ধি সমন্বিত হবে। মানুষ যদি এই গুণাবলী থেকে বঞ্চিত হয়ে নিষ্প্রাণ প্রস্তরবৎ হয়ে যায়, তাহলে তার মনুষ্যত্বই বিলুপ্ত হয়ে গেছে বলে মনে করতে হবে।
কুরআন ব্যক্তি মানুষের মূল্য ও মর্যাদা স্বীকার করে। সে প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিগতভাবে দায়বদ্ধ হওয়া ও আল্লাহর নিকট জবাবদিহি করতে বাধ্য হওয়ার কথা সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছে। কুরআনের দৃষ্টিতে সমাজ-সমষ্টি গড়ে ওঠে এসব দায়িত্বশীল ও সামজিক চেতনাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে। কুরআন ব্যক্তি-সত্তা ও ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যকে কিছুমাত্র উপেক্ষা করেনি, ক্ষুণ্ন বা চূর্ণ করেনি তার সম্মান ও মর্যাদা। তার অস্তিত্বকে কোন দিক দিয়েই অস্বীকার করা হয়নি- অর্থহীন বা অন্তঃসারশূণ্যও বলা হয়নি। অনুরূপভাবে সে ব্যক্তিসত্তাকে সমাজ-সমষ্টির যাঁতাকলেও নিষ্পেষিত হতে দিতে প্রস্তুত নয়। অবশ্য কুরআন ব্যক্তিকে সমাজ সত্তার অঙ্গ বলে উল্লেখ করেছে আর এ সমাজ গঠিত হয় সমাজপ্রবণ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে। মানুষ সম্পর্কে ধারণা দানকারী কয়েকটি আয়াত এখানে উল্লেখ করা যাচ্ছে।
মানুষ বস্তু ও রূহ সমন্বিতঃ
إِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلَائِكَةِ إِنِّي خَالِقٌ بَشَرًا مِّن طِين – فَإِذَا سَوَّيْتُهُ وَنَفَخْتُ فِيهِ مِن رُّوحِي فَقَعُوا لَهُ سَاجِدِينَ
‘‘(তখনকার কথা চিন্তা করে দেখ) তোমার রব্ব যখন ফেরেশতাদেরকে বললেবঃ আমি মৃত্তিকা দ্বারা মানুষ সৃষ্টি করব। তারপর তাকে যখন ভারসাম্যপূর্ণ করে তুললাম এবং তার মধ্যে আমার রূহ ফুঁকে দিলাম, তখন তারা (ফেরেশতারা) তার উদ্দেশে সিজদায় পড়ে গেল।’’ (সূরা সা’দঃ ৭১–৭২)
কুরআনের ঘোষণানুযায়ী মানুষ আল্লাহর খলীফা এই পৃথিবীর বুকে। আর তা শুধু এজন্যে যে, মানুষ জ্ঞান ও শিক্ষাসম্পন্ন সত্তা। বলা হয়েছেঃ
وَإِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلَائِكَةِ إِنِّي جَاعِلٌ فِي الْأَرْضِ خَلِيفَةً ۖ قَالُوا أَتَجْعَلُ فِيهَا مَن يُفْسِدُ فِيهَا وَيَسْفِكُ الدِّمَاءَ وَنَحْنُ نُسَبِّحُ بِحَمْدِكَ وَنُقَدِّسُ لَكَ ۖ قَالَ إِنِّي أَعْلَمُ مَا لَا تَعْلَمُون- وَعَلَّمَ آدَمَ الْأَسْمَاءَ كُلَّهَا ثُمَّ عَرَضَهُمْ عَلَى الْمَلَائِكَةِ فَقَالَ أَنبِئُونِي بِأَسْمَاءِ هَٰؤُلَاءِ إِن كُنتُمْ صَادِقِين-قَالُوا سُبْحَانَكَ لَا عِلْمَ لَنَا إِلَّا مَا عَلَّمْتَنَا ۖ إِنَّكَ أَنتَ الْعَلِيمُ الْحَكِيم-قَالَ يَا آدَمُ أَنبِئْهُم بِأَسْمَائِهِمْ ۖ فَلَمَّا أَنبَأَهُم بِأَسْمَائِهِمْ قَالَ أَلَمْ أَقُل لَّكُمْ إِنِّي أَعْلَمُ غَيْبَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَأَعْلَمُ مَا تُبْدُونَ وَمَا كُنتُمْ تَكْتُمُون-
‘‘(সে সময়ের কথা চিন্তা করে দেখ) যখন তোমরা রব্ব ফেরেশতাদের বললেব, আমি পৃথিবীতে একজন খলীফা বানাব। তখন তারা বলল, তুমি কি পৃথিবীতে এমন কিছু বানাবে যা সেখানে অশান্তির সৃষ্টি করবে এবং রক্তপাত করবে? আমরাই তো তোমার প্রশংসা করছি ও তোমার পবিত্রতা বর্ণনা করছি? জবাবে আল্লাহ বললেন, আমি যা জানি তোমরা তা জাননা। অতঃপর তিনি আদমকে সমস্ত জিনিসের নাম শিক্ষা দিলেন, তারপর সেগুলো ফেরেশতাদের সামনে পেশ করলেন। বললেন, এগুলোর নাম আমাকে জানিয়ে দাও, যদি তোমরা তোমাদের ধারণায় সত্যবাদী হয়ে থাক। তারা বললঃ হে আল্লাহ! পবিত্র ও মহান তুমি। আমরা তো শুধু ততটুকুই জানি যতটুকু তুমি আমাদের জানিয়েছে। আসলে তুমিই সূক্ষ্ণদর্শী, মহাবিজ্ঞানী। অতঃপর তিনি বললেনঃ হে আদম! তুমি এদেরকে এই জিনিসগুলোর নাম জানিয়ে দাও। সে যখন তাদেরকে সেই নামগুলো জানিয়ে দিল, তখন আল্লাহ বললেনঃ আমি কি তোমাদের বলিনি যে, আমিই আকাশমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের সকল অদৃশ্য বিষয় জানি; তোমরা যা প্রকাশ কর আর যা গোপন কর তা-ও জানি।’’ (সূরা বাকারাহঃ ৩০–৩৩)
এই সৃষ্টিলোকের বহু কিছুরই ওপর মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা স্বীকৃত। ঘোষণা হয়েছেঃ
وَلَقَدْ كَرَّمْنَا بَنِي آدَمَ وَحَمَلْنَاهُمْ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ وَرَزَقْنَاهُم مِّنَ الطَّيِّبَاتِ وَفَضَّلْنَاهُمْ عَلَىٰ كَثِيرٍ مِّمَّنْ خَلَقْنَا تَفْضِيلًا
‘‘আদম বংশকে আমরা বিশেষ সম্মান ও মর্যাদা দিয়েছি, তাদেরকে যানবাহন দিয়েছি স্থল ও জল ভাগে (চলাচলের জন্য) এবং তাদেরকে পবিত্র-পরিচ্ছন্ন-উৎকৃষ্ট দ্রব্যাদি রিযিক হিসেবে দিয়েছি এবং আমাদের সৃষ্টিসমূহের অনেকেরই ওপর শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রাধান্য দিয়েছি।’’ (সূরা বনী–ইসরাঈলঃ ৭০)
এ আয়াতে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ও বিশেষত্ব ঘোষিত হওয়া সত্ত্বেও তাকে যথার্থ ও ভারসাম্যপূর্ণ মর্যাদায় ভূষিত ও প্রতিষ্ঠিত করার কথাও ঘোষিত হয়েছে। তাকে সব কিছুর ওপর তুলে দেয়ার বা সব কিছুর নিম্নে রাখার মতো কোন বাড়াবাড়ি করা হয়নি, বরং যথার্থ স্থানই তার জন্যে নির্দিষ্ট হয়েছে।
মানুষের ব্যক্তি–স্বাতন্ত্র্যের ঘোষণা
إِن كُلُّ مَن فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ إِلَّا آتِي الرَّحْمَٰنِ عَبْدًا- لَّقَدْ أَحْصَاهُمْ وَعَدَّهُمْ عَدًّا- وَكُلُّهُمْ آتِيهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَرْدًا
‘‘আকাশমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের মাঝখানে যাকিছুই রয়েছে, তা সবই দয়াময় আল্লাহর নিকট উপস্থিত হবে বান্দাহ্ হিসেবে। তিনি সর্বব্যাপক এবং তাদের সকলকে গণনা করে ও প্রস্তুত করে রেখেছেন। তাদের সকলেই কিয়ামতের দিন তাঁর সামনে উপস্থিত হবে স্বতন্ত্র ব্যক্তি হিসেবে।’’ (সূরা মরিয়ামঃ ৯৩–৯৫)
মানুষ ব্যক্তিগতভাবেই আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্যঃ
وَلَا تَكْسِبُ كُلُّ نَفْسٍ إِلَّا عَلَيْهَا ۚ وَلَا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِزْرَ أُخْرَىٰ ۚ ثُمَّ إِلَىٰ رَبِّكُم مَّرْجِعُكُمْ فَيُنَبِّئُكُم بِمَا كُنتُمْ فِيهِ تَخْتَلِفُونَ
‘‘প্রতিটি মানুষ যা কিছুই উপার্জন করবে, তা সে-ই পাবে। কোন বোঝা বহনকারীই অপর কারো বোঝা বহন করবে না। শেষ পর্যন্ত তোমাদের সকলকেই নিজেদের রব্বের নিকট প্রত্যাবর্তন করতে হবে। তখন তিনি তোমাদের সেই বিষয়ে সঠিক কথা জানিয়ে দিবেন যে বিষয়ে তোমরা পরস্পর মতবিরোধ করছিলে।’’ (সূরা আন’আমঃ ১৬৪)
وَكُلَّ إِنسَانٍ أَلْزَمْنَاهُ طَائِرَهُ فِي عُنُقِهِ ۖ وَنُخْرِجُ لَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ كِتَابًا يَلْقَاهُ مَنشُورًا – اقْرَأْ كِتَابَكَ كَفَىٰ بِنَفْسِكَ الْيَوْمَ عَلَيْكَ حَسِيبًا
‘‘প্রতিটি মানুষের গলদেশে তার আমলনামা বেঁধে ঝুলিয়ে দেব। আর কিয়ামতের দিন তার জন্যে একখানি লিপিকা প্রকাশ করব, যাকে উন্মুক্ত কিতাব রূপে পাবে। (তাকে বলা হবে) তুমি পড় তোমার নিজের কিতাব। আজ তোমার নিজের হিসাব গ্রহণকারী হিসেবে তুমি নিজেই যথেষ্ট।’’ (সূরা বনী ইসরাঈলঃ ১৩–১৪)
সামষ্টিক প্রশিক্ষণে কুরআন
কুরআন মজীদ একটা সামাজিক ও সামষ্টিক ব্যবস্থা উপস্থাপন করেছে। এ সামাজিক ও সামষ্টিক ব্যবস্থাটি কুরআনী আইনের নির্দেশনা এবং ঐক্য, সংহতি, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও পারস্পরিক সাহায্য, সহযোগিতা ও পরামর্শের ওপর স্থাপিত। কুরআনের দৃষ্টিতে এ-ই হচ্ছে সঠিক ও নির্ভুল মানবিক ব্যবস্থার মৌলিক ভাবধারা। কুরআন মজীদ ডিক্টেটরী বা একনায়কত্বমূলক শাসন পদ্ধতি সমর্থন করেনি, যেমন সমর্থন করেনি গণতান্ত্রিক হট্টগোল ও উচ্ছৃঙ্খলতা।
কুরআন পারিবারিক ব্যবস্থাকে একটা সুদৃঢ় নৈতিক ও আধ্যাত্মিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে। ধনতন্ত্র বা ধর্মনিরপেক্ষতা তা স্থাপন করেছে নিছক জৈবিক চাহিদার ওপর আর কমিউনিজম বা সমাজতন্ত্র তা প্রতিষ্ঠিত করেছে অর্থনৈতিক সম্পর্কের ওপর। কুরআন পারস্পরিক চুক্তি-প্রতিশ্রুতি রক্ষা এবং স্বাভাবিক বিবেক-বুদ্ধি, চিন্তার স্বাধীনতা ও প্রগতিশীল ধ্যান-ধারণা প্রয়োগের আহ্বান জানিয়েছে। তবে এ সবই সামাজিক দায়িত্ববোধ ও জবাবদিহির চেতনা সহকারেই সম্পন্ন করতে বলেছে। এক কথায় ইসলামী সমাজ কুরআনের দৃষ্টিতে অত্যন্ত সুদৃঢ় ও ভারসাম্যপূর্ণ ভিত্তির ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত। তাতে অগ্রগামিতার ওপর গুরুত্ব আরোপিত হয়েছে, গোঁড়ামি ও রক্ষণশীলতা বা প্রতিক্রিয়াশীলতাকে কোন স্থান দেয়া হয়নি। তা বাড়াবাড়ি, সীমালঙ্ঘন ও লোকদের মধ্যে শ্রেণী সংগ্রাম সৃষ্টির প্রচেষ্টাকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছে। বস্তুত ইসলামী সমাজ অতীব উচ্চমানের ও যথার্থ তাৎপর্যসম্পন্ন একটি মানবিক সমাজ। তাতে যুক্তিগ্রাহ্য ও বাস্তবসম্মত মানবীয় সাম্য পুরোপুরি স্বীকৃত। দার্শনিক ও চিন্তাবিদগণ আজ পর্যন্ত মানবীয় সামাজিকতা পর্যায়ে যত উন্নত চিন্তা করতে সমর্থ হয়েছে, ইসলামী সমাজব্যবস্থা তার চাইতেও অনেক ঊর্ধ্বে অবস্থিত। অথচ তাতে না আছে কোনরূপ বাড়াবাড়ি, সীমালংঘন আর না তা প্রয়োজনীয় মানেরও নিম্নে অবস্থিত। এই সব বৈশিষ্ট্য ও বিশেষত্ব নিয়েই ইসলামী সমাজ আল্লাহর পরিচিতি পর্যন্ত পৌঁছায়। কুরআন উপস্থাপিত সমাজ সংগঠন ও প্রশিক্ষণে কুরআনের লক্ষ্য বুঝবার জন্যে নিম্নোদ্ধৃত আয়াতসমূহ বিবেচ্যঃ
সামাজিক ঐক্য ও একাত্মতা
إِنَّ هَٰذِهِ أُمَّتُكُمْ أُمَّةً وَاحِدَةً وَأَنَا رَبُّكُمْ فَاعْبُدُونِ
‘‘তোমাদের এই উম্মত এক ও অভিন্ন উম্মত আর আমিই তোমাদের রব্ব-প্রতিপালক। অতএব তোমরা আমার বান্দাহ হয়ে বসবাস কর।’’ (আম্বিয়াঃ ৯২)
ঐক্য, সংহতি ও পারস্পরিক দায়িত্বশীলতা
وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا
‘‘তোমরা সকলে মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে আল্লাহর রজ্জু শক্ত করে ধরে থাক এবং কখনো ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ো না।’’ (আলে–ইমরানঃ ১০৩)
সমাজের লোকদের পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ
‘‘মুমিনরা সব ভাই ভাই।’’ (সূরা হুজুরাতঃ ১০)
সমাজের সব অংশের-দল-উপদল, জাতি ও নারী-পুরুষের সাম্য স্বীকৃত
يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُم مِّن ذَكَرٍ وَأُنثَىٰ وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا ۚ إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِندَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ
‘‘হে মানুষ! আমরা তোমাদের সৃষ্টি করেছি একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে আর তোমাদের বানিয়েছি বহু গোত্র ও বিভাগ সমন্বিত, যেন তোমরা পরস্পরের পরিচিতি লাভ করতে পার। আসলে তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট অধিক সম্মানিত ব্যক্তি সে, যে তোমাদের মধ্যে অধিক আল্লাহভীরু।’’ (সূরা হুজুরাতঃ ১৩)
وَمِنْ آيَاتِهِ مَنَامُكُم بِاللَّيْلِ وَالنَّهَارِ وَابْتِغَاؤُكُم مِّن فَضْلِهِ ۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَاتٍ لِّقَوْمٍ يَسْمَعُونَ
‘‘আর তাঁর নিদর্শনাদির মধ্যে রয়েছে তোমাদের রাত্রে ও দিনে নিদ্রা গমন এবং তোমাদের তাঁর অনুগ্রহ সন্ধান করা। বস্তুত তাতে বিপুল নিদর্শন রয়েছে সেই লোকদের জন্যে যারা (গভীর মনোযোগ সহকারে) শোনে।’’ (সূরা রূমঃ ২৩)
সামাজিক ও সামষ্টিক সহযোগিতা
وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَىٰ ۖ وَلَا تَعَاوَنُوا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ ۚ وَاتَّقُوا اللَّهَ
‘‘তোমরা সকলে পরস্পরের সহযোগিতা কর পূণ্যময় ও আল্লাহভীতিমূলক কাজে এবং সহযোগিতা করো না পাপাচার, সীমালঙ্ঘন ও আল্লাহদ্রোহিতামূলক কাজে আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর।’’ (সূরা মায়িদাহঃ ২)
পরামর্শ জীবনের ভিত্তি
فَبِمَا رَحْمَةٍ مِّنَ اللَّهِ لِنتَ لَهُمْ ۖ وَلَوْ كُنتَ فَظًّا غَلِيظَ الْقَلْبِ لَانفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ ۖ فَاعْفُ عَنْهُمْ وَاسْتَغْفِرْ لَهُمْ وَشَاوِرْهُمْ فِي الْأَمْرِ
‘‘(হে নবী!) আল্লাহর রহমতেই তুমি তাদের জন্যে খুব নম্র হয়েছে। তুমি যদি রূঢ়ভাষী ও পাষাণ-হৃদয় হতে তাহলে লোকেরা তোমার পাশ থেকে ছিন্নভিন্ন হয়ে দূরে সরে যেত। অতএব তুমি ওদেরকে ক্ষমা কর, ওদের জন্যে আল্লাহর নিকট মাগফিরাত চাও এবং ওদের সাথে সামষ্টিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদিতে পরামর্শ কর।’’ (সূরা আলে–ইমরানঃ ১৫৯)
وَمَا عِندَ اللَّهِ خَيْرٌ وَأَبْقَىٰ لِلَّذِينَ آمَنُوا وَعَلَىٰ رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ – وَالَّذِينَ يَجْتَنِبُونَ كَبَائِرَ الْإِثْمِ وَالْفَوَاحِشَ وَإِذَا مَا غَضِبُوا هُمْ يَغْفِرُونَ – وَالَّذِينَ اسْتَجَابُوا لِرَبِّهِمْ وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَأَمْرُهُمْ شُورَىٰ بَيْنَهُمْ وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنفِقُونَ
‘‘আল্লাহর নিকট যাকিছুই রয়েছে তা-ই অতীব উত্তম ও স্থায়ী তাদের জন্যে যারা ঈমান এনেছে এবং নিজেদের রব্ব্-এর ওপর নির্ভরতা গ্রহণ করে, যারা বড় বড় গুনাহ ও নির্লজ্জতার কাজ পরিহার করে চলে আর যখন ক্রুদ্ধ্ব হয় ক্ষমা করে দেয়, যারা নিজেদের রব্ব্-এর ডাকে সাড়া দেয়, নামায কায়েম করে ও নিজেদের পারস্পরিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদিতে পরামর্শ করে এবং আল্লাহর দেয়া রিযিক থেকে ব্যয় করে।’’ (আশ্–শুরাঃ ৩৬–৩৮)
প্রেম–ভালোবাসা ও সহৃদয়তাই পারিবারিক জীবনের ভিত্তি
وَمِنْ آيَاتِهِ أَنْ خَلَقَ لَكُم مِّنْ أَنفُسِكُمْ أَزْوَاجًا لِّتَسْكُنُوا إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُم مَّوَدَّةً وَرَحْمَةً ۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَاتٍ لِّقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ
‘‘আল্লাহর অন্যতম নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্যে তোমাদের মধ্য থেকে জুড়ি সৃষ্টি করেছেন, যেন তোমরা তার নিকট থেকে সান্ত্বনা ও মনের প্রশান্তি লাভ করতে পার এবং তিনি তোমাদের পরস্পরের মধ্যে ভালবাসা ও সহৃদয়তার অনুভূতির সৃষ্টি করে দিয়েছেন। নিঃসন্দেহে এর মধ্যে চিন্তাশীল লোকদের জন্যে রয়েছে বিপুল নিদর্শনাদি।’’ (আর–রূমঃ ২১)
ন্যায়পরায়ণতামূলক ধন–বণ্টন ব্যবস্থা
وَالَّذِينَ يَكْنِزُونَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلَا يُنفِقُونَهَا فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَبَشِّرْهُم بِعَذَابٍ أَلِيمٍ – يَوْمَ يُحْمَىٰ عَلَيْهَا فِي نَارِ جَهَنَّمَ فَتُكْوَىٰ بِهَا جِبَاهُهُمْ وَجُنُوبُهُمْ وَظُهُورُهُمْ ۖ هَٰذَا مَا كَنَزْتُمْ لِأَنفُسِكُمْ فَذُوقُوا مَا كُنتُمْ تَكْنِزُونَ
‘‘আর যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য (অর্থাৎ সম্পদ) সঞ্চিত করে রাখে, তা আল্লাহর পথে ব্যয় করেনা, তাদেরকে সুসংবাদ দাও পীড়াদায়ক আযাবের। একদিন এইসব স্বর্ণ ও রৌপ্য জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করা হবে এবং তা দিয়ে চিহ্ন দেয়া হবে তাদের কপাল, পার্শ্বদেশ ও পিঠে। বলা হবে, তোমরা নিজেদের জন্যে যে সম্পদ সঞ্চয় করেছিলে এ হচ্ছে তা-ই। অতএব এখন তোমরা তোমাদের সঞ্চয়ের স্বাদ আস্বাদন কর।’’ (আত–তাওবাঃ ৩৪–৩৫)
وَفِي أَمْوَالِهِمْ حَقٌّ لِّلسَّائِلِ وَالْمَحْرُومِ
‘‘তাদের ধন-সম্পদে অভাবগ্রস্থ ও বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে।’’ (সূরা যারিয়াতঃ ১৯)
وَالَّذِينَ فِي أَمْوَالِهِمْ حَقٌّ مَّعْلُومٌ – لِّلسَّائِلِ وَالْمَحْرُومِ
‘‘আর যাদের ধন-সম্পদে একটা সুনির্দিষ্ট হক্ রয়েছে অভাবগ্রস্থ ও বঞ্চিতদের জন্যে।’’ (সূরা মা’আরিজঃ ২৪–২৫)
وَأَحَلَّ اللَّهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا
‘‘আল্লাহ ব্যবসা-বাণিজ্যে ক্রয়-বিক্রয় হালাল করেছেন আর সুদের লেন-দেন হারাম করেছেন।’’ (সূরা বাকারাহঃ ২৭৫)
يَمْحَقُ اللَّهُ الرِّبَا وَيُرْبِي الصَّدَقَاتِ
‘‘আল্লাহ সুদকে নির্মুল করে দেন এবং দান-সদকায় ক্রমবৃদ্ধি দান করেন।’’ (সূরা বাকারাহঃ ২৭৬)
الَّذِينَ يُنفِقُونَ أَمْوَالَهُم بِاللَّيْلِ وَالنَّهَارِ سِرًّا وَعَلَانِيَةً فَلَهُمْ أَجْرُهُمْ عِندَ رَبِّهِمْ وَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ
‘‘যারা নিজেদের ধন-সম্পদ রাত-দিনে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে, তাদের জন্যে নিজেদের রব্ব্-এর নিকট অনেক শুভ ফল রয়েছে এবং তাদের কোন ভয় নেই- নেই কোন দুঃখ।’’ (সূরা বাকারাহঃ ২৭৪)
وَأَن لَّيْسَ لِلْإِنسَانِ إِلَّا مَا سَعَىٰ – وَأَنَّ سَعْيَهُ سَوْفَ يُرَىٰ – ثُمَّ يُجْزَاهُ الْجَزَاءَ الْأَوْفَىٰ
‘‘মানুষের জন্যে কিছুই নেই, আছে শুধু ততটা যার জন্য সে চেষ্টা ও শ্রম করেছে আর তার চেষ্টা-প্রচেষ্টা অবশ্যই নিরীক্ষণ করা হবে। অতঃপর তার পূর্ণমাত্রায় প্রতিফল দেয়া হবে।’’ (সূরা আন–নাজমঃ ৩৯–৪১)
চুক্তি অনুযায়ী কাজ করার বাধ্যবাধকতা
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَوْفُوا بِالْعُقُودِ
‘‘হে ঈমানদার লোকেরা! তোমরা চুক্তিসমূহ পূর্ণ করো।’’ (সূরা মায়িদাহঃ ১)
সামষ্টিক জবাবদিহি ও দায়িত্ব বহন, পরস্পরের জন্য দায়িত্ব গ্রহণ
كُنتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ وَتُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ
‘‘তোমরাই উত্তম জনগোষ্ঠী, তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে লোকদের কল্যাণের উদ্দেশ্যে। তোমরা ভাল কাজের আদেশ কর, মন্দ কাজে নিষেধ কর, এবং এক আল্লাহর প্রতি ইমান রাখ।’’ (সূরা আলে–ইমরানঃ ১১০)
وَلَوْ أَنَّ أَهْلَ الْقُرَىٰ آمَنُوا وَاتَّقَوْا لَفَتَحْنَا عَلَيْهِم بَرَكَاتٍ مِّنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ وَلَٰكِن كَذَّبُوا فَأَخَذْنَاهُم بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ
‘‘জনপদের অধিবাসীরা যদি ঈমান আনত ও আল্লাহর প্রতি তাকওয়া পোষণ করত, তাহলে আমরা তাদের জন্যে আকাশমণ্ডল ও ভূমণ্ডল থেকে অফুরন্ত বরকতের দ্বার উন্মুক্ত করে দিতাম। কিন্তু তারা উল্টা অমান্য ও অস্বীকার করল। ফলে আমরাও তাদের কাজের শাস্তি স্বরূপ তাদেরকে পাকড়াও করলাম।’’ (সূরা আ’রাফঃ ৯৬)
وَضَرَبَ اللَّهُ مَثَلًا قَرْيَةً كَانَتْ آمِنَةً مُّطْمَئِنَّةً يَأْتِيهَا رِزْقُهَا رَغَدًا مِّن كُلِّ مَكَانٍ فَكَفَرَتْ بِأَنْعُمِ اللَّهِ فَأَذَاقَهَا اللَّهُ لِبَاسَ الْجُوعِ وَالْخَوْفِ بِمَا كَانُوا يَصْنَعُونَ
‘‘আল্লাহ একটি দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। একটি জনপদ বড়ই শান্তি, নিশ্চিন্ততা ও নিরাপত্তায় ভরপুর ছিল। তার নিকট সর্বদিক দিয়ে প্রশস্ত রিযিক আসছিল। তারপর তারা আল্লাহর নিয়ামতসমূহের প্রতি না-শোকরী ও অমর্যাদা প্রদর্শন শুরু করল। ফলে আল্লাহ তাদের ওপর ক্ষুধা ও ভয়ের মুসীবত চাপিয়ে দিলেন আর এভাবে তারা তাদের কৃতকর্মের স্বাদ গ্রহণ করল।’’ (সূরা নাহলঃ ১১২)
সমাজ সংস্কারের কাজ অব্যাহতভাবে চালাতে হবে
وَمَا كَانَ رَبُّكَ لِيُهْلِكَ الْقُرَىٰ بِظُلْمٍ وَأَهْلُهَا مُصْلِحُونَ
‘‘যে জনপদের লোকেরা সংশোধন ও সংস্কারের কাজ অব্যাহতভাবে চালাতে থাকে, তোমার আল্লাহ সে জনপদকে জুলুমের কারণে ধ্বংস করেন না।’’ (সূরা হূদঃ ১১৭)
আত্মরক্ষার চেষ্টা–প্রচেষ্টা চালানও কর্তব্য
وَقَاتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ الَّذِينَ يُقَاتِلُونَكُمْ وَلَا تَعْتَدُوا ۚ إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْمُعْتَدِينَ
‘‘তোমরা আল্লাহর পথে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করো যারা তোমাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে লিপ্ত। তবে এ ব্যাপারে সীমালংঘন করো না। কেননা আল্লাহ সীমালংঘনকারীদের ভলবাসেন না।’’ (সূরা বাকারাহঃ ১৯০)
শত্রুর মুকাবিলায় সদা সতর্ক ও পূর্ণ মাত্রায় প্রস্তুত থাকতে হবে
وَأَعِدُّوا لَهُم مَّا اسْتَطَعْتُم مِّن قُوَّةٍ وَمِن رِّبَاطِ الْخَيْلِ تُرْهِبُونَ بِهِ عَدُوَّ اللَّهِ وَعَدُوَّكُمْ وَآخَرِينَ مِن دُونِهِمْ لَا تَعْلَمُونَهُمُ
‘‘তোমরা শত্রুদের সাথে মুকাবিলা করার জন্যে সাধ্যমত প্রস্তুতি গ্রহণ করো, চলাচলের ঘোড়া (অর্থাৎ যানবাহন) ইত্যাদি তৈরী রাখ। এসবের দ্বারা তোমরা আল্লাহর এবং নিজেদের শত্রুদেরকে ভয় দেখাবে এবং এমন সব শত্রুকেও ভীত শঙ্কিত করবে …যাদেরকে তোমরা জানো না, কিন্তু আল্লাহ জানেন।’’ (সূরা আনফালঃ ৬০)
নরহত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ
وَلَكُمْ فِي الْقِصَاصِ حَيَاةٌ يَا أُولِي الْأَلْبَابِ
‘‘হে বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন লোকেরা! নরহত্যার অপরাধের শাস্তি স্বরূপ ‘কিসাসেই’-হত্যাকারীকে হত্যা করাতেই-তোমাদের জন্য জীবন নিহিত।’’ (সূরা বাকারাহঃ ১৭৯)
সুখ–স্বাচ্ছন্দ্যে ভারসাম্য রক্ষা
يَا بَنِي آدَمَ خُذُوا زِينَتَكُمْ عِندَ كُلِّ مَسْجِدٍ وَكُلُوا وَاشْرَبُوا وَلَا تُسْرِفُوا ۚ إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُسْرِفِينَ
‘‘হে আদম বংশ! তোমরা প্রতিটি মসজিদের ক্ষেত্রে নিজেদের ভূষণে সুসজ্জিত হও এবং খাও, পান কর; কিন্তু সীমা ছাড়িয়ে যেওনা। কেননা আল্লাহ্ সীমালংঘনকারীদের ভালবাসেন না।’’ (সূরা আ’রাফঃ ৩১)
মদ ও জুয়াখেলা নিষেধ
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْأَنصَابُ وَالْأَزْلَامُ رِجْسٌ مِّنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
‘‘হে ঈমানদার লোকেরা! মদ্যপান, জুয়াখেলা, বলিদানের আস্তানা ও ভাগ্য জানা কলাকৌশল-এসবই শয়তানী কার্যক্রমমূলক অপবিত্রতাবিশেষ। অতএব তোমরা এর প্রতিটি কাজই পরিহার কর; তাহলে আশা করা যায়, তোমরা সাফল্য লাভ করতে পারবে।’’ (সূরা মায়িদাহঃ ৯০)
পরিবর্তন ও উন্নয়ন এবং স্থবিরতা প্রতিরোধ
إِنَّ اللَّهَ لَا يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّىٰ يُغَيِّرُوا مَا بِأَنفُسِهِمْ
‘‘কোন জাতি নিজেরাই যদি নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন না করে তাহলে আল্লাহও তাদের অবস্থার পরিবর্তন করেন না।’’ (সূরা রা’দঃ ১১)
وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ تَعَالَوْا إِلَىٰ مَا أَنزَلَ اللَّهُ وَإِلَى الرَّسُولِ قَالُوا حَسْبُنَا مَا وَجَدْنَا عَلَيْهِ آبَاءَنَا ۚ أَوَلَوْ كَانَ آبَاؤُهُمْ لَا يَعْلَمُونَ شَيْئًا وَلَا يَهْتَدُونَ
‘‘তাদেরকে যখন বলা হয়, আর আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তার দিকে এবং রাসূলের দিকে, তখন তার বলে আমাদের জন্যে তা-ই যথেষ্ট যার ওপর চলমান পেয়েছি আমাদের পূর্বপুরুষকে-যদি তাদের পূর্বপুরুষ কিছু না-ও জানত ও হেদায়েতপ্রাপ্ত না-ও হয়ে থাকত……তা সত্ত্বেও।’’ (সূরা মায়িদাহঃ ১০৪)
চিন্তা–বিশ্বাসের পূর্ণ স্বাধীনতা
لَا إِكْرَاهَ فِي الدِّينِ ۖ قَد تَّبَيَّنَ الرُّشْدُ مِنَ الْغَيِّ
‘‘দ্বীন বা ধর্মের ব্যাপারে কোনরূপ জোর-জবরদস্তির অবকাশ নেই। কেননা প্রকৃত ও নির্ভুল সত্য-পথ অজ্ঞতা ও মূর্খতা থেকে ভিন্নতরভাবে সুস্পষ্ট ও শুভ্র সমুজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।’’ (সূরা বাকারাহঃ ২৫৬)
أَفَأَنتَ تُكْرِهُ النَّاسَ حَتَّىٰ يَكُونُوا مُؤْمِنِينَ
‘‘তুমি কি লোকেদের ওপর জোর-জবরদস্তি চালাবে যেন তারা মুমিন হয়?’’ (সূরা ইউনূসঃ ৯৯)
قُلْ يَا أَيُّهَا النَّاسُ قَدْ جَاءَكُمُ الْحَقُّ مِن رَّبِّكُمْ ۖ فَمَنِ اهْتَدَىٰ فَإِنَّمَا يَهْتَدِي لِنَفْسِهِ ۖ وَمَن ضَلَّ فَإِنَّمَا يَضِلُّ عَلَيْهَا ۖ وَمَا أَنَا عَلَيْكُم بِوَكِيلٍ
‘‘বল হে জনগণ! তোমাদের নিকট মহাসত্য উপস্থিত হয়েছে তোমাদের রব্ব্-এর নিকট থেকে। কাজেই যে লোক হেদায়েত গ্রহণ করবে, সে হেদায়েত গ্রহণ করবে নিজেরই কল্যাণের উদ্দেশ্যে। আর যে লোক গুমরাহ হয়ে গেল, তার গুমরাহীর কুফল তাকেই ভোগ করতে হবে। আমি তোমাদের উকীল নই।’’ (সূরা ইউনূসঃ ১০৮)
এই আয়াতসমূহ থেকে মানুষের সমাজ জীবনের কোন-না-কোন দিক সম্পর্কে সুস্পষ্ট পথ-নির্দেশ পাওয়া যায়। এতদ্ব্যতীত কুরআন মজীদের একটি সূরায় এক সঙ্গে ‘দশটি উপদেশ’ উদ্ধৃত হয়েছে। হযরত মূসা’র শরী’আতের দশটি উপদেশ থেকে তা সম্পূর্ণ ভিন্নতর; কাজেই কুরআনে বিশ্বাসী লোকদের এ দশটি উপদেশ মন-প্রাণ দিয়ে শোনা ও গ্রহণ করা কর্তব্য। বস্তুত তাদের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবন পুনর্গঠনের জন্যে এ ‘দশটি উপদেশ’ যাতে ভিত্তি প্রস্তরের কাজ করতে পারে সে উদ্দেশেই এগুলো কুরআনে উদ্ধৃত হয়েছে। উপদেশগুলো হচ্ছেঃ
১. আল্লাহর সাথে একবিন্দু শিরক করবে না, তা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
২. পিতা-মাতার সাথে অতীব উত্তম ব্যবহার করতে হবে।
৩. দারিদ্রের কারণে সন্তান হত্যা করতে পারবে না- সন্তানের জন্মও বন্ধ করতে পারবে না। কেননা আমিই তোমাদের রিযিক দিয়ে বাঁচিয়ে রাখছি-তাদেরকেও আমিই দেব।
৪. নির্লজ্জতা ও অশ্লীলতার নিকটেও যেও না, তা প্রকাশমান হোক কি গোপনীয়।
৫. নরহত্যা করবে না; কেননা আল্লাহ তা নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন। তবে সত্য বিধানের ভিত্তিতে হত্যা করা হলে স্বতন্ত্র কথা; তা করা যাবে। তোমরা বুঝবে ও অনুধাবন করবে, এই আশায়ই তোমাদেরকে এই উপদেশ দেয়া হচ্ছে।
৬. ইয়াতীমের ধন-সম্পদের নিকটেও যাবে না। তবে উত্তম পন্থায় কিছু করতে হলে স্বতন্ত্র কথা-যতক্ষণ না তারা পূর্ণবয়স্ক ও বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন হচ্ছে।
৭. পরিমাপ ও ওজন পূর্ণ মাত্রায় সুবিচার সহকারে করবে। তবে মানুষের সাধ্যায়ত্ত যতটুকু ততটুকু করারই দায়িত্ব, তার বেশীর জন্যে কোন চাপ নেই।
৮. তোমরা যখন কথা বলবে, ভারসাম্য, সুবিচার ও ন্যায়নীতিপূর্ণ কথা বলবে, যদিও তা তোমাদের নিকটাত্মীয়দের বিরুদ্ধেই বলা হোক-না কেন।
৯. আল্লাহর সাথে কৃত চুক্তি-প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করবে। তোমরা এ উপদেশ গ্রহণ করবে, এই আশায়ই এসব কথা তোমাদেরকে বল হচ্ছে।
১০. এই হচ্ছে আমার নির্দেশিত পথ ও জীবন পদ্ধতি। এটা সহজ, সরল ও সুদৃঢ়। অতএব তোমরাও এই উপদেশ মেনে চল-এই পথেরই অনুসরণ কর। এ ছাড়া আর যত পথ ও পন্থা রয়েছে, তার কোনটিরই অনুসরণ করো না। যদি কর, তাহলে তোমরা আল্লাহর দেখানো ও রাসূলের অবলম্বিত এই পথ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। তোমাদেরকে এ উপদেশ দেয়া হচ্ছে এই আশায় যে, তোমরা এটি গ্রহণ করে ধ্বংস ও বিপর্যয় থেকে আত্মরক্ষা করতে পারবে।’’
(সূরা আল আন’আমঃ ১৫১–১৫৩)
এসব আদেশ ও উপদেশ থেকে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, কুরআনী প্রশিক্ষণ বাস্তবায়নের ক্ষেত্র হচ্ছে সমাজ এবং এ সবের মূলে নিহিত রয়েছে ‘তাক্ওয়া’- আল্লাহ-বিশ্বাস ও আল্লাহর ভয়। আর এ তাক্ওয়ার পরিণাম হচ্ছে সামাজিক সুবিচার। এ সমাজ গঠিত হবে ব্যক্তিদের পারস্পরিক ভালোবাসা, দয়া-মায়া, সহানুভূতি, অগ্রাধিকার দান, কল্যাণ কামনা, ক্ষমাশীলতা ও ভ্রাতৃত্বের পবিত্র ভাবধারার সমন্বয়ে। তাতে অবশ্যই চিন্তার স্বাধীনতা থাকবে, তবে সেক্ষেত্রে অবশ্যই কার্যকর থাকবে দায়িত্ব ও জবাবদিহির ব্যবস্থা। ব্যক্তি স্বাধীনতার আসল ও সঠিক ভাবধারা এখানেই কার্যকর হওয়া সম্ভব হবে। আর এ কারণেই এরূপ এক আদর্শ ও উন্নত সমাজই বিশ্বমানবতার লক্ষ্য হওয়ার যোগ্য বিবেচিত হতে পারে। এরূপ সমাজে যেমন জুলুম-শোষণ থাকতে পারে না, তেমনি আল্লাহদ্রোহিতা, সীমালংঘন, ধ্বংস-বিপর্যয় ও বঞ্চনারও কোন স্থান থাকবেনা। কুরআন যে সমাজ ব্যবস্থা ও সামাজিক আদর্শ উপস্থাপন করেছে, তার সাথে মানব রচিত কোন সমাজ ব্যবস্থারই তুলনা হতে পারেনা।
বিশ্বলোক সম্পর্কে কুরআন
কুরআন মজীদ বারবার মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে বিশ্বচরাচর ও তার অন্তর্নিহিত ব্যবস্থাদির দিকে। বিশ্বলোক সম্পর্কে চিন্তা-বিবেচনা ও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম গবেষণা চালিয়ে অতি সহজেই নিম্নোদ্ধৃত সত্যসমূহ লাভ করা যায়ঃ
ক. এই বিশ্বলোক এক মহাসত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এখানে একটা স্থায়ী প্রাকৃতিক বিধান সদা কার্যকর এবং তাতে নিহিত রয়েছে শাশ্বত দৃঢ়তা, অবিচলতা ও অকাট্য যৌক্তিকতা তথা কার্যকারণ পরম্পরা। এই বিশ্বলোকের একটা নিয়ম ও ব্যবস্থা রয়েছে; সুনির্দিষ্ট কার্যক্রমও আছে। এ কারণেই বলা যায়, এই বিশ্বলোক কিছুমাত্র অর্থহীন বা উদ্দেশ্যহীন নয় এবং এটি নিতান্তই খেলার ছলে সৃষ্টি করা হয় নি।
খ. সমগ্র বিশ্বলোক ও তার মধ্যে অবস্থিত সমস্ত জিনিস, ব্যবস্থাপনা, তত্ত্ব ও তথ্য যতদূর সম্ভব অধ্যয়ন করা মানুষের কর্তব্য। তাহলে প্রতিটি ক্ষেত্রেই মহান স্রষ্টার অত্যন্ত নিপূণ, কুশলী ও দয়ালু হস্ত ও কুদরতের সন্ধান লাভ করা মানুষের পক্ষে সম্ভবপর হবে।
গ. এই বিশ্বলোকে মানুষ ও সমগ্র সৃষ্টবস্তুর (Beings) মাঝে একট অটুট সম্পর্ক বিদ্যমান। আল্লাহ মানুষকে এই বিশ্বলোকের অনেক কিছুই নিজের আয়ত্তাধীন ও নিয়ন্ত্রণাধীন করার এবং প্রকৃতির বহু শক্তিকে নিজের কল্যাণে ব্যবহার করার শক্তি ও যোগ্যতা দিয়েছেন, যদিও এ ব্যবহারে কোনরূপ বাহুল্য ব্যয়ের অবকাশ থাকা উচিত নয়।
ঘ. বিশ্বপ্রকৃতির গভীর ও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অধ্যয়ন ও অনুসন্ধানের মাধ্যমে মানুষ নিজের বিবেক-বুদ্ধি ও বিস্ময়াবিষ্টতা (Astonishment) প্রয়োগ করে মহান আল্লাহর প্রতি ঈমান গ্রহণের মন-মানসিকতা লাভ করবে।
ঙ. মানুষকে আহ্বান জানান হয়েছে, সে যেন সৃষ্টির দাসত্ব ও বন্দেগীতে নিমজ্জিত না হয়; বরং সে যেন মহান স্রষ্টার দাসত্ব গ্রহণ করে এবং তারই আরাধনা ও উপাসনায় ব্রতী হয়।
এ পর্যায়ে মনে রাখা আবশ্যক যে, কুরআন মজীদ কোন প্রকৃতি-বিজ্ঞানের (Natural Science) গ্রন্থ নয়। কেউ কেউ অবশ্য তা-ই মনে করে মারাত্মক বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে গেছে। কুরআন প্রাকৃতিক ও সমাজতাত্ত্বিক জ্ঞান-বিজ্ঞান অধ্যয়নের জন্যে প্রেরণা দেয়-উদ্বোধন সৃষ্টি করে। এই মহাগ্রন্থে জ্যোতির্বিদ্যা, অংকশাস্ত্র, জীব-জন্তু, প্রাণিবিদ্যা, উদ্ভিদ বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল ও আইন শাস্ত্র অধ্যয়নের জন্যে তাগিদ দেয়া হয়েছে বটে; কিন্তু আসলে কুরআন এ সবেরও ঊর্ধ্বস্থ এক মর্যাদাসম্পন্ন মহাগ্রন্থ। কুরআন মানুষকে বস্তুলোকের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অধ্যয়ন ও গবেষণার স্তর পেরিয়ে আরও ঊর্ধ্বে, আরো উচ্চতর স্তরে নিয়ে যায় এবং বাহ্যিক দৃশ্যমান জগতের অন্তরালে যে গভীর রহস্য প্রচ্ছন্ন রয়েছে তা মানুষের অবাক দৃষ্টির সম্মুখে উদঘাটিত করে দেয়। কুরআনে যেসব বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক তত্ত্ব ও জ্ঞানের কথা উল্লেখিত হয়েছে তা স্বতঃই কোন লক্ষ্য নয়, তা মাধ্যম বা প্রসঙ্গত বলা কথা মাত্র। আসলে মানুষের আধ্যাত্মিক ও নৈতিক শিক্ষণ-প্রশিক্ষণের তুলনাহীন গ্রন্থ হচ্ছে এই কুরআন। বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ব যন্ত্র আবিষ্কারের প্রক্রিয়া শিখানোর উদ্দেশ্যে এই কিতাব নাযিল হয়নি। তবে বিশ্বলোক সৃষ্টি এবং এর মধ্যে নিহিত তত্ত্ব-রহস্য ও বিজ্ঞানসম্মত কথা-বার্তার উল্লেখ রয়েছে এর কোন কোন আয়াতে। আমরা এখানে সে পর্যায়ের কয়েকটি আয়াত তুলে দিচ্ছিঃ
خَلَقَ السَّمَاوَاتِ بِغَيْرِ عَمَدٍ تَرَوْنَهَا ۖ وَأَلْقَىٰ فِي الْأَرْضِ رَوَاسِيَ أَن تَمِيدَ بِكُمْ وَبَثَّ فِيهَا مِن كُلِّ دَابَّةٍ ۚ وَأَنزَلْنَا مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَأَنبَتْنَا فِيهَا مِن كُلِّ زَوْجٍ كَرِيمٍ
‘‘তিনি আকাশমণ্ডল সৃষ্টি করেছেন কোন দৃশ্যবান খুঁটি ছাড়াই এবং জমিনের বুকে পর্বতমালা শক্ত করে বসিয়ে দিয়েছেন যেন তোমাদেরকে নিয়ে তা হেলতে দুলতে না পারে। আর তাতে নানা প্রকার জীব-জন্তু ছড়িয়ে দিয়েছেন। আমরা আকাশ থেকে পানি বর্ষন করিয়েছি ও তার সাহয্যে নানাপ্রকার সুন্দর ভাল জুড়ির উদ্ভিদ সৃষ্টি করেছি।’’ (সূরা লুকমানঃ ১০)
এ আয়াতটি অতি সংক্ষেপে আকাশমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সৃষ্টি এবং সেই সঙ্গে অসংখ্য প্রকার জীব-জন্তু ও উদ্ভিদ সৃষ্টি ও এ দুয়ের পারস্পরিক সম্পর্কের দিকে ইঙ্গিত করছে।
خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ بِالْحَقِّ وَصَوَّرَكُمْ فَأَحْسَنَ صُوَرَكُمْ ۖ وَإِلَيْهِ الْمَصِيرُ
‘‘তিনি আকাশমমণ্ডল ও ভূমণ্ডলকে পরম সত্যতা সহকারে সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদেরকে দৈহিক কাঠামো দান করেছেন অতীব উত্তম ও সুন্দর আকার-আকৃতিতে। শেষ পর্যন্ত তোমাদেরকে তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে।’’ (সূরা তাগাবুনঃ ৩)
إِنَّ اللَّهَ فَالِقُ الْحَبِّ وَالنَّوَىٰ ۖ يُخْرِجُ الْحَيَّ مِنَ الْمَيِّتِ وَمُخْرِجُ الْمَيِّتِ مِنَ الْحَيِّ ۚ ذَٰلِكُمُ اللَّهُ ۖ فَأَنَّىٰ تُؤْفَكُونَ – فَالِقُ الْإِصْبَاحِ وَجَعَلَ اللَّيْلَ سَكَنًا وَالشَّمْسَ وَالْقَمَرَ حُسْبَانًا ۚ ذَٰلِكَ تَقْدِيرُ الْعَزِيزِ الْعَلِيمِ – وَهُوَ الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ النُّجُومَ لِتَهْتَدُوا بِهَا فِي ظُلُمَاتِ الْبَرِّ وَالْبَحْرِ ۗ قَدْ فَصَّلْنَا الْآيَاتِ لِقَوْمٍ يَعْلَمُونَ – وَهُوَ الَّذِي أَنشَأَكُم مِّن نَّفْسٍ وَاحِدَةٍ فَمُسْتَقَرٌّ وَمُسْتَوْدَعٌ ۗ قَدْ فَصَّلْنَا الْآيَاتِ لِقَوْمٍ يَفْقَهُونَ – وَهُوَ الَّذِي أَنزَلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَأَخْرَجْنَا بِهِ نَبَاتَ كُلِّ شَيْءٍ فَأَخْرَجْنَا مِنْهُ خَضِرًا نُّخْرِجُ مِنْهُ حَبًّا مُّتَرَاكِبًا وَمِنَ النَّخْلِ مِن طَلْعِهَا قِنْوَانٌ دَانِيَةٌ وَجَنَّاتٍ مِّنْ أَعْنَابٍ وَالزَّيْتُونَ وَالرُّمَّانَ مُشْتَبِهًا وَغَيْرَ مُتَشَابِهٍ ۗ انظُرُوا إِلَىٰ ثَمَرِهِ إِذَا أَثْمَرَ وَيَنْعِهِ ۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكُمْ لَآيَاتٍ لِّقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ –
‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ জীব ও আঁটি থেকে অঙ্কুর সৃষ্টিকারী। তিনি মৃত থেকে জীবিতকে বের করেন এবং মৃতকে বের করেন জীবিত থেকে। …..এই সব কাজেরই আসল কর্তা হচ্ছেন তোমাদের আল্লাহ। তাহলে তোমরা কোথায় বিভ্রান্ত হচ্ছ? রাত্রির আবরণ দীর্ণ করে তিনি প্রভাত-রশ্মির উন্মেষ করেন। তিনি রাত্রিকালকে শান্তিময় বানিয়েছেন এবং সূর্য ও চন্দ্রের আবর্তনের হিসাব নির্দিষ্ট করেছেন। এ হচ্ছে পরাক্রমশালী ও মহাজ্ঞানী আল্লাহর নির্ধারিত পরিমাপ। তিনিই তোমাদের জন্যে নক্ষত্ররাজি সৃষ্টি করেছেন, যেন তোমরা সেসব দ্বারা স্থল ও জলভাগের পুঞ্জীভূত অন্ধকারে পথ বের করে নিতে পার। নিশ্চয়ই আমরা নিদর্শনাবলীকে খোলাখুলিভাবে বর্ণনা করেছি জ্ঞানী-গুণী লোকদের জন্য। তিনিই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন একটিমাত্র প্রাণী (ব্যক্তি) থেকে। অতঃপর প্রত্যেকের জন্যে একটি স্থিতি লাভের স্থান ও একটি গচ্ছি রাখার স্থান নির্দিষ্ট রয়েছে। আমরা সমঝদার লোকদের জন্যে এই নিদর্শনসমূহ ভিন্ন ভিন্ন ভাবে পেশ করলাম। তিনিই ঊর্ধ্বলোক থেকে পানি বর্ষণ করিয়েছেন। অতঃপর তার সাহায্যে আমরা প্রতিটি উদ্ভিদ সাজিয়েছি। অতঃপর তা থেকে বের করেছি সবুজ-শ্যামল ক্ষেত-খামার এবং তা থেকে বের করেছি নানা কোষসম্পন্ন দানা আর খেজুর মোচা থেকে তার ভারনত ছড়াগুচ্ছ বানিয়েছি এবং আঙ্গুর, জয়তুন ও আনারের বাগান সাজিয়ে দিয়েছি, যেখানে ফলসমূহ পরস্পর সদৃশ কিংবা পরস্পর বিভিন্ন। তোমরা এ সবের ফল লক্ষ্য করে দেখ যখন তা বাহির হবে ও পাকবে। নিশ্চয়ই এ সবের মধ্যে ঈমানদার লোকদের জন্যে নিদর্শনাদি রয়েছে।’’ (সূরা আল–আন’আমঃ ৯৫–৯৯)
وَمَا خَلَقْنَا السَّمَاءَ وَالْأَرْضَ وَمَا بَيْنَهُمَا لَاعِبِين – لَوْ أَرَدْنَا أَن نَّتَّخِذَ لَهْوًا لَّاتَّخَذْنَاهُ مِن لَّدُنَّا إِن كُنَّا فَاعِلِينَ – بَلْ نَقْذِفُ بِالْحَقِّ عَلَى الْبَاطِلِ فَيَدْمَغُهُ فَإِذَا هُوَ زَاهِقٌ ۚ وَلَكُمُ الْوَيْلُ مِمَّا تَصِفُونَ
‘‘আকাশমণ্ডল ও ভূমণ্ডল এবং এ দুয়ের মাঝে যা কিছু রয়েছে তা আমরা নিতান্ত খেলার ছলেই সৃষ্টি করিনি। আমরা যদি এই সব খেলার সামগ্রীরূপে বানাতে চাইতাম, তাহলে আমরা তা-ই করতাম যদি তা করতে আমরা প্রস্তুত হতাম; বরং আমরা প্রকৃত সত্যকে দিয়ে বাতিলের ওপর আঘাত হানি, তা তার মস্তক চূর্ণ করে দেয় এবং চোখের সামনেই তা বিলীন ও নির্মূল হয়ে যায়। ….তোমরা যেসব কথা-বার্তা বলে বেড়াও সে জন্যে ধ্বংস তোমাদের জন্য অবশ্যম্ভাবী।’’ (সূরা আম্বিয়াঃ ১৬–১৮)
স্রষ্টা সম্পর্কে কুরআনের ভাষ্য
কুরআন সর্বপ্রথম সর্বাধিক গুরুত্ব সহকারে যে কাজটি করে, তা হচ্ছে স্রষ্টা ও সৃষ্টির মাঝে প্রকৃত সম্পর্ক নিরূপন ও নির্ধারণ করা। এই মহাগ্রন্থ মানুষের পরিচিতি প্রসঙ্গে বলেছে, মানুষ ও সৃষ্টিলোকের অস্তিত্ব শেষ পর্যন্ত মহান সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের দিকে, তাঁর নবোদ্ভাবন নীতির দিকে এবং তাঁর সুষ্ঠু সৃজনশীলতা ও অপার দয়া-মায়ার অসীম সমুদ্রের দিকে প্রত্যাবর্তন করবে। অতএব জীবন পরিশীলিত ও পরিচ্ছন্ন করে গড়ে তোলার জন্যে মহান স্রষ্টার সঠিক পরিচিতি লাভ এবং তাঁর প্রতি আনুগত্য ও ভয়ভীতির অনুভূতি অর্জনই উচ্চতর প্রশিক্ষণের লক্ষ্য আর ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামষ্টিক জীবনের তাঁর আদেশাবলী ও নিষেধসমূহ কার্যকর করণই হচ্ছে তাঁর ইবাদতের মর্মার্থ। কুরআন আল্লাহর মহান গুণাবলীর মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে তাওহীদী সিফাতের ওপর। তাতে মহান আল্লাহকে সর্বতোভাবে এক ও একক বলে মেনে নেয়া এবং সর্বপ্রকার শিরক থেকে তাঁর মুক্ত ও পবিত্র থাকার কথা স্বীকার করে নেয়ার প্রবল আহ্বান জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে, আল্লাহর স্থান কালের সীমার মধ্যে আবদ্ধ নয়। তিনি অপরিবর্তনশীল। তাঁর শরীক বা সদৃশ কেউ নেই-নেই কেউ সমতুল্য, প্রতীক বা দৃষ্টান্ত কেউ নেই, প্রতিদ্বন্দী কেউ নেই; তিনি কারো জাত নন, তাঁর জাতও কেউ নেই। তিনি চিরঞ্জীব, শাশ্বত, অক্ষয়; তিনি এক ও একক, স্বতন্ত্র, অনন্য-নিরপেক্ষ; তিনি অমুখাপেক্ষী, সবই তাঁর মুখাপেক্ষী; তিনি যা চান তা-ই করতে সক্ষম, করতে পারার অধিকারী; তাঁর ক্ষমতা অপ্রতিরোধ্য, তাঁর কর্মকুশলতা তুলনাহীন, জ্ঞান সীমাহীন, শেষহীন ও সর্বব্যাপী। সত্য, কল্যাণ ও সৌন্দর্যে তিনি অতুলনীয়। এসব কথা প্রমাণকারী কতিপরয় আয়াত এখানে উদ্ধৃত করা যাচ্ছেঃ
ذَٰلِكُمُ اللَّهُ رَبُّكُمْ ۖ لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ۖ خَالِقُ كُلِّ شَيْءٍ فَاعْبُدُوهُ ۚ وَهُوَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ وَكِيلٌ – لَّا تُدْرِكُهُ الْأَبْصَارُ وَهُوَ يُدْرِكُ الْأَبْصَارَ ۖ وَهُوَ اللَّطِيفُ الْخَبِيرُ –
‘‘এই হচ্ছেন তোমাদের আল্লাহ। তিনি ছাড়া কেহ ইলাহ নাই। তিনি প্রতিটি জিনিসেরই স্রষ্টা, তিনি প্রতিটি জিনিসেরই দায়িত্বশীল; অতএব, তাঁর দাসত্ব কবুল কর। দৃষ্টিসমূহ তাঁকে দেখতে পারেনা, তিনিই বরং দৃষ্টিসমূহকে আয়ত্ব করেন। তিনি খুবই সূক্ষ্ণদর্শী ও সর্ববিষয়ে অবহিত।’’ (সূরা আন’আমঃ ১০২–১০৩)
فَاطِرُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۚ جَعَلَ لَكُم مِّنْ أَنفُسِكُمْ أَزْوَاجًا وَمِنَ الْأَنْعَامِ أَزْوَاجًا ۖ يَذْرَؤُكُمْ فِيهِ ۚ لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ ۖ وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ
‘‘আকাশমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সৃষ্টিকারী; তিনি তোমাদের প্রজাতির মধ্য থেকেই তোমাদের জন্যে জুড়ি বানিয়েছেন; জন্তুদের মধ্য থেকেও জুড়ি বানিয়ে দিয়েছেন। এভাবে তিনি তোমাদের মধ্যে বংশবৃদ্ধি করে থাকেন। বিশ্বলোকে তাঁর সদৃশ কোন জিনিসই নেই। তিনিই সর্বশ্রোতা ও সর্ব স্রষ্টা।’’ (সূরা শুরাঃ ১১)
سَبَّحَ لِلَّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۖ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ – لَهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۖ يُحْيِي وَيُمِيتُ ۖ وَهُوَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ – هُوَ الْأَوَّلُ وَالْآخِرُ وَالظَّاهِرُ وَالْبَاطِنُ ۖ وَهُوَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ
‘‘আকাশমণ্ডল ও ভূমণ্ডলে যা কিছুই আছে সবই তাঁর তসবীহ-পবিত্রতা বর্ণনা করে। তিনিই মহাপরাক্রান্ত ও মহাবিজ্ঞানী। আকাশমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের রাজত্ব ও সার্বভৌমত্বের নিরংকুশ কর্তৃত্ব তাঁরই। তিনিই জীবন দান করেন এবং মৃত্যু দেন। তিনিই সব কিছুর ওপর ক্ষমতাবান। তিনিই প্রথম এবং তিনিই শেষ। তিনিই প্রকাশমান এবং তিনিই অপ্রকাশিত। তিনিই প্রতিটি বিষয়ে অবহিত।’’ (সূরা হাদীদঃ ১–৩)
وَهُوَ مَعَكُمْ أَيْنَ مَا كُنتُمْ ۚ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ
‘‘তোমরা যেখানেই থাক তিনি তোমাদের সঙ্গেই রয়েছেন। তোমরা যা কিছুই কর, তিনি তা দেখেন।’’ (সূরা হাদীদঃ ৪)
لَوْ كَانَ فِيهِمَا آلِهَةٌ إِلَّا اللَّهُ لَفَسَدَتَا ۚ فَسُبْحَانَ اللَّهِ رَبِّ الْعَرْشِ عَمَّا يَصِفُونَ
‘‘যদি আকাশ ও পৃথিবীতে এক আল্লাহ ছাড়া আরও বহু ইলাহ হতো তাহলে এ দুয়ের শৃংখলা ব্যবস্থাই চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যেত। অতএব আরশ অধিপতি মহান আল্লহ পবিত্র, সেই সব থেকে যা এই লোকেরা যা বলে।’’ (সূরা আম্বিয়াঃ ২২)
قُل لَّوْ كَانَ مَعَهُ آلِهَةٌ كَمَا يَقُولُونَ إِذًا لَّابْتَغَوْا إِلَىٰ ذِي الْعَرْشِ سَبِيلًا – سُبْحَانَهُ وَتَعَالَىٰ عَمَّا يَقُولُونَ عُلُوًّا كَبِيرًا
‘‘লোকদেরকে বল, আল্লাহর সাথে আরও যদি মা’বুদ বা উপাস্য থাকত, তাহলে তারা আরশ-অধিপতির নিকট পর্যন্ত পৌঁছতে অবশ্যই চেষ্টা করত; অতএব আল্লাহ মহান ও পবিত্র, সেই সব বড়বড় কথাবার্তা থেকে যা এই লোকেরা বলে।’’ (সূরা বনী ইসরাঈলঃ ৪২–৪৩)
مَا اتَّخَذَ اللَّهُ مِن وَلَدٍ وَمَا كَانَ مَعَهُ مِنْ إِلَٰهٍ ۚ إِذًا لَّذَهَبَ كُلُّ إِلَٰهٍ بِمَا خَلَقَ وَلَعَلَا بَعْضُهُمْ عَلَىٰ بَعْضٍ ۚ سُبْحَانَ اللَّهِ عَمَّا يَصِفُونَ
‘‘আল্লাহ কোন সন্তান গ্রহণ করেননি এবং তাঁর সাথে অন্য কোন মা’বুদ বা উপাস্যও নেই। যদি থাকত, তাহলে প্রত্যেক উপাস্যই তার সৃষ্টদের নিয়ে আলাদা হয়ে যেত এবং তাদের কতিপয় অপর কতিপয়ের ওপর চড়াও হয়ে বসত। আল্লাহ মহান পবিত্র সে সব পরিচিতি থেকে যা এই লোকেরা তার প্রসঙ্গে বলে।’’ (সূরা মুমিনুনঃ ৯১)
قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَد – اللَّهُ الصَّمَدُ – لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ – وَلَمْ يَكُن لَّهُ كُفُوًا أَحَدٌ.
‘‘বল তিনি আল্লাহ এক ও একক। তিনি কারোর মুখাপেক্ষী নন, বরং সবই তাঁর মুখাপেক্ষী। তিনি কাউকে জন্ম দেননি, তাঁকেও কেউ জন্ম দেয়নি। তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই।” (সূরা ইখলাস)
اللَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ ۚ لَا تَأْخُذُهُ سِنَةٌ وَلَا نَوْمٌ ۚ لَّهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ ۗ مَن ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِندَهُ إِلَّا بِإِذْنِهِ ۚ يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ ۖ وَلَا يُحِيطُونَ بِشَيْءٍ مِّنْ عِلْمِهِ إِلَّا بِمَا شَاءَ ۚ وَسِعَ كُرْسِيُّهُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ ۖ وَلَا يَئُودُهُ حِفْظُهُمَا ۚ وَهُوَ الْعَلِيُّ الْعَظِيمُ
‘‘আল্লাহ ছাড়া আর কেউ ইলাহ নেই। তিনি চিরঞ্জীব ও শাশ্বত সত্তা। সমগ্র বিশ্বলোককে তিনি দুঢ়ভাবে ধারণ করে আছেন। তাঁকে নিদ্রা বা তন্দ্রা কখনো স্পর্শ করেনা। আকাশমণ্ডল ও ভূমণ্ডলে যা কিছু আছে সব তাঁরই। তাঁর অনুমতি ব্যতিরেকে তাঁর নিকট কে সুপারিশ করতে পারে? তিনি জানেন যা লোকদের সামনে আছে আর যা আছে তাদের পিছনে সে বিষয়েও তিনি অবহিত। তারা কেউ তাঁর জ্ঞান থেকে কোন কিছুই আয়ত্ত করে নিতে পারেনা- তবে তিনি নিজে যদি চান। তাঁর আসন সমগ্র নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলে পরিব্যপ্ত হয়ে আছে। এ দুটির সংরক্ষণ তাঁকে ক্লান্ত করে না। তিনি মহান সুউচ্চ-বিরাট।’’ (সূরা বাকারাঃ ২৫৫)
কুরআন মজীদ উপস্থাপিত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের চরম লক্ষ্য কি? সংক্ষেপে বললে তা হচ্ছে, মানুষের নিজেকে নিজের চেনা-জানা, অনুধাবন ও উপলব্ধি করা, ইসলামের সামাজিক ও সামষ্টিক ব্যবস্থা জেনে নেয়া, মানুষের সামষ্টিক দায়-দায়িত্ব ও জবাবদিহির বিষয়ে জানা ও তদনুসারে কাজ করার যেগ্যতা অর্জন করা, বিশ্বলোকের অবস্থান ও সৃজন পদ্ধতি সম্পর্কে অবহিতি লাভ করা এবং তাকে মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করার প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি জানা। সর্বোপরি বিশ্বস্রষ্টার সঠিক ও নির্ভুল পরিচিতি লাভ, তাঁর সম্পর্কে যথাসাধ্য জ্ঞান অর্জন এবং তাঁর বন্দেগী দাসত্ব বা উপাসনা করা, তাঁর আদেশাবলী পালন ও অনুসরণ এবং তাঁর সব নিষিদ্ধ কার্যাবলী পরিহার করা ও সেসব থেকে বিরত থাকা।
আমাদের কাংক্ষিত শিক্ষার স্বরূপ
‘শিক্ষা’ বলতে বুঝায় যা জানা নেই- যে বিষয়ে কোন জ্ঞান ও ধারণা নেই, সেই বিষয়ে জানা, জ্ঞান অর্জন ও ধারণা লাভ করা। অবশ্য এই জানা-বুঝা, জ্ঞান অর্জন ও ধারণা লাভের জন্যে স্বাভাবিক যোগ্যতা থাকা একান্তই জরুরী। সে যোগ্যতা না থাকলে জানা-বুঝা ও জ্ঞান অর্জন অসম্ভবই থেকে যাবে।
মানুষ মাত্রই এরূপ শিক্ষার মুখাপেক্ষী। কেননা সে যখন এই দুনিয়ায় আসে তখন এই দুনিয়ার জীবন ও পরিবেশ এবং এখানে জীবন ধারণের নিয়ম-কানুন, রীতি-নীতি ইত্যাদি সম্পর্কে তার কিছুই জানা থাকেনা। তাকে সবকিছুই এখানে এসে শিখতে হয়, জানতে হয়, বুঝতে হয়- নানাবিধ জ্ঞান আহরণ করতে হয় এবং সেই অর্জিত জ্ঞানের আলোকে তাকে ধারণা পোষণ করতে হয় এই জগত সম্পর্কে-যেখানে সে বসবাস করে, নিজ সত্তা সম্পর্কে-কেননা জীবন যাপন তো তাকেই করতে হয় এবং নিজের ভবিষ্যত সম্পর্কে, কেননা সে ভবিষ্যত একান্তভাবে তার নিজের-তাকে নিজেকেই সে ভবিষ্যতের দায় বহন করতে হবে। অতএব নিজের ভবিষ্যত সম্পর্কে সুস্পষ্ট ও নির্ভুল ধারণার ভিত্তিতেই তাকে বর্তমানের জীবন অতিবাহিত করতে হবে।
প্রকৃতিগতভাবে মানুষের দুটি দিক। এক দিক দিয়ে সে একটি জীব বা প্রাণী মাত্র। অতএব জীব হিসেবে জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান তাকে অর্জন করতে হয়। এ জ্ঞান ব্যতীত দুনিয়ায় শুধু বেঁচে থাকাও সম্ভবপর হয় না। তার এ পর্যায়ের জ্ঞান অর্জন শুরু হয় মায়ের কোল থেকেই; মা-বাবা, ভাই-বোন প্রভৃতি নিকটাত্মীয়দের পরিমণ্ডল থেকেই সে এ পর্যায়ের জ্ঞান-সচেতন বা অচেতনভাবে অর্জন করে। আমরা বলতে পারি এটি হচ্ছে নেহাত বস্তুগত ও বৈষয়িক জ্ঞান।
কিন্তু মানুষ তো শুধু জীবমাত্র নয়। তাই শুধু জৈবিক জ্ঞান, নিছক বেঁচে থাকার জন্যে জরুরী জ্ঞান অর্জনই তার জন্যে যথেষ্ট নয়- যথেষ্ট নয় পরিমণ্ডল থেকে অর্জিত স্থূল জ্ঞান। তাছাড়া তাকে এই জৈবিক জ্ঞানও খুব সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ ও উচ্চতর মানে অর্জন করতে হয়। নেহাত পরিমণ্ডল থেকে অর্জিত যে জ্ঞান, তা জীব বা প্রাণীকুলের জন্যে যথেষ্ট, মানুষের জন্যে নয়। উপরন্তু মানুষকে পূর্ণ মানবিক মর্যাদা নিয়ে জীবন-যাপন করতে হলে শুধু পরিমণ্ডল থেকে অর্জিত জৈবিক জ্ঞানটুকুই যথেষ্ট হতে পারে না; এমন কি, তৎসম্পর্কিত সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ জ্ঞানও যথেষ্ট হবে না। কেননা সে জ্ঞান দ্বারা মানুষ হয়ত শুধু উন্নত মানের জীব হিসেবেই বাঁচতে পারে-পারে সুখ-সম্ভোগের বিলাস-সামগ্রী সংগ্রহ করতে; কিন্তু তাতে তার জৈবিকতা থেকে মুক্তি ও মানবীয় পর্যায়ে উন্নতি লাভ সম্ভব হয় না। তাই মানবিক মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে হলে তার মানব প্রজাতীয় স্বাতন্ত্র্য ও জীব-ঊর্ধ্ব বিশেষ উদ্দেশ্যমূলক সত্তা হিসেবে বেঁচে থাকা ও যথাযথভাবে মানবীয় দায়িত্ব পালন করে ভবিষ্যতের পরিপ্রেক্ষিতে সার্থক জীবন যাপন করার জন্যে যে জ্ঞান একান্ত অপরিহার্য, সেই জ্ঞান নির্ভুল ও নির্ভরযোগ্য সূত্রে অর্জন ও তা হৃদয়ঙ্গম করা এবং তার ভিত্তিতে নিজ সত্তা ও এই বিশ্বলোক সম্পর্কে স্বচ্ছ ও সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করা অনস্বীকার্য প্রয়োজন।
প্রথম পর্যায়ের জ্ঞান মানুষ সাধারণভাবে অর্জন করতে পারছে। বর্তমান সভ্যতা মানুষকে সেই জ্ঞান সরবরাহের জন্যে ব্যাপক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, তাতে সন্দেহ নেই। তার ফলে আজকের মানুষ প্রকৃতি জয়ে ও নিয়ন্ত্রণে তাকে কাজে লাগানোর দিক দিয়ে অনেক দূর অগ্রসর হয়ে গেছে, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই জ্ঞান কি মানুষের সঠিক মানবীয় বিশেষত্ব, প্রজাতীয় বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদা রক্ষার জন্যে যথেষ্ট? এ জ্ঞান দ্বারা কি মানুষ নিছক জীবত্বের অক্টোপাশ থেকে মুক্তিলাভ করতে সক্ষম হয়েছে? …..নাকি এ জ্ঞান দ্বারা মনুষ্যত্বকে পদদলিত করে জীবত্বের গৌরব অর্জন করেছে? …..এখনকার জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত মানুষের কি হিংস্র-বন্য পশুর চাইতেও নিকৃষ্ট ভূমিকা পালন করছে না?
এ প্রশ্নের প্রথমাংশের ‘না’ এবং শেষাংশের জবাবে ‘হ্যাঁ’ না বলে উপায় নেই। কেননা, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত জাতিসমূহ এবং বিভিন্ন দেশের শীর্ষ ব্যক্তিগন তাদের ব্যক্তিগত, দলগত ও রাষ্ট্রীয় কার্যাবলী দ্বারা পশুর চাইতেও অধিক হিংস্রতার পরিচয় দিচ্ছে। দুনিয়ার সাম্প্রতিক ঘটনাবলীই তা অকাট্যভাবে প্রমাণ করছে। সর্বত্রই দেখা যাচ্ছে পাশবিকতার জয়-জয়কার। সভ্য দুনিয়ার নানা অঞ্চলে চলছে দানবীয় শক্তি তাণ্ডব; প্রশান্ত পৃথিবী থর থর করে কাঁপছে তাদের পাশবিকতার দাপটে। সর্বত্র মানবীয় মূল্যমান, ন্যায়পরতা, সুবিচার ও নৈতিকতা তথা মানুষের মৌলিক অধিকার পদদলিত ও চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে। আজকে সভ্যতার ধ্বজাবাহীরাই হচ্ছে মানুষের বড় দুশমন। তার একমাত্র কারণ, এই তথাকথিত সভ্য মানুষেররা বস্তুগত জ্ঞানে চূড়ান্ত মাত্রায় দক্ষতা অর্জন করছে বটে; কিন্তু মনুষ্যত্ব ও মানবিকতা কাকে বলে, সে জ্ঞান তারা পায়নি। তারা মানুষকে পশুর বংশধর বলে গণ্য করেছে, নিজেদেরকেও তারা তা-ই মনে করছে। ফলে ‘পশুকুলে’র প্রতি ‘পশুদের’ আচরণ পাশবিক হবে, তা-ই তো স্বাভাবিক। কাজেই আজকের দুনিয়ার মানুষের অবস্থা দেখে হাঁ-হুতাশ করার কোন কারণ নেই। কেননা যা কিছু দেখা যাচ্ছে, তা সব মানুষের নিজেরই উপার্জন। তেঁতুলের বীজ বপন করা হলে গাছটা তেঁতুলেরই হবে-এর ব্যতিক্রম হওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়।
মানুষের মানবোচিত জীবন যাপনের জন্যে বস্তুগত জ্ঞান যদি যথেষ্ট না হয়ে থাকে-যদি সে জ্ঞান দ্বারা পাশবিকতারই চরম উন্নতি হয়ে থাকে, তাহলে মানবোচিত জ্ঞান কোথায় পাওয়া যাবে এবং কি ধরণের সে জ্ঞান? এখন এ প্রশ্নেরেই জবাব আমি দিতে চাই।
আমরা স্পষ্টত দেখতে পাচ্ছি, মানবীয় সত্তা দুটি মৌল উপাদান সমন্বয়ে গঠিত। একটি তার দেহ, অপরটি তার রূহ্ বা প্রাণ। দেহ মাটির নির্যাস থেকে তৈরী আর তারই মধ্যে ফুঁকে দেয়া হয়েছে ‘রূহ’। রূহ্ মহান সৃষ্টিকর্তার একান্ত নিজস্ব একটি জিনিস। আধুনিক বস্তুবিজ্ঞান প্রাণতত্ত্ব নিয়ে অনেক গবেষণা চালিয়েছে; কিন্তু তার কোন স্বরূপ নির্ণয় করতে পারেনি। হার্বার্ট স্পেন্সারের মতো লব্ধপ্রতিষ্ঠ ও প্রথিতযশা বিজ্ঞানী জীবনের সংজ্ঞা নির্ণয় করতে এবং এর উৎস অন্বেষণ করতে গিয়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা সাজিয়েছেন, অক্ষরের পিঠে অক্ষরেই শুধু বসিয়েছেন; কিন্তু কোন সমাধানে পৌঁছা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। বিজ্ঞানীরা প্রাণ বা জীবনের একটা যান্ত্রিক ধারণা বা বস্তুগত বিশ্লেষণ দিয়েছেন বটে; কিন্তু প্রাণ বা জীবন ‘বস্তু’ নয় বলে তাঁদের সব চিন্তা-গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। ঠিক যেমন মানুষকে ‘পশু’ বা পশুর অধস্তন মনে করে মানবীয় সমস্যাবলী চিহ্নিত করতে ও তার সমাধান দিতে চেষ্টা করা হয়েছে। ফলে ‘মানুষ’ নামক সত্তাটি তাদের চিন্তা-গবেষণার সম্পূর্ণ বাইরে রয়ে গেছে; তার নাগাল পাওয়া সম্ভব হয়নি।
তাই ‘মানুষ’ সম্পর্কিত জ্ঞান শুধু বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে অর্জন করতে চাওয়া কার্যত লাঠি দ্বারা ঊর্ধ্বাকাশে উড্ডয়নশীল এ্যারোপ্লেনকে ঘায়েল করতে চাওয়ার মত পণ্ডশ্রমই হয়েছে। কোন ফলই তাতে পাওয়া যায়নি।
অতএব, মানুষ সম্পর্কিত জ্ঞান পেতে হবে মানুষের স্রষ্টার নিকট থেকে, যিনি শুধু মানুষেরই নন; বরং সমগ্র সৃষ্টিলোকেরই একক স্রষ্টা ও প্রতিপালক। একালের সভ্যতাগর্বী ও বিজ্ঞানদর্শী মানুষের চরম দুর্ভাগ্যই এই যে, তারা মহান সৃষ্টিকর্তার দেয়া জ্ঞানকে অগ্রাহ্য করে শুধু নিজেদের ইন্দ্রিয়লব্ধ ও কার্যকারণ-ভিত্তিক জ্ঞানের ওপর নির্ভর করেছে। ফলে আজ জ্ঞানের জগতে চরম দীনতাই প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। এসব জ্ঞানগর্বী বড় বড় মূর্খ, অজ্ঞ ও জাহিল ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রকৃত জ্ঞান বলতে ওদের কিছু নেই।
মহান স্রষ্টা এই বিশ্বলোক সৃষ্টির পর মানুষকে এক বিশেষ উদ্দেশ্যমূলক সৃষ্টি হিসেবেই এ দুনিয়ায় প্রেরণ করেছেন। তিনি মানুষকে শুধু জীব হিসেবে বেঁচে থাকার জন্যে প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি দিয়েই ক্ষান্ত হননি; বরং তাকে মানুষ হিসেবে-মানুষের মর্যাদা নিয়ে, মানবীয় দায়িত্ব পালনসহ জীবন যাপনের জন্যে প্রয়োজনীয় জ্ঞানও দান করেছেন। সে জ্ঞান কেবল মানুষের জন্যে, অন্য কোন সৃষ্টির জন্যে নয়।
আল্লাহ ‘রাব্বুল আলামীন’- এর অর্থ তিনি কেবল সৃষ্টিকর্তা এবং লালন-পালন ও রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থাপক নন; বরং তিনি সবকিছুর জন্যে প্রয়োজনীয় জ্ঞানেরও শিক্ষাদাতা। তাই তাঁর নিকট থেকে দুটি ধারা প্রবাহিত। একটি ধারা প্রাকৃতিক জগতের মাধ্যমে প্রদত্ত বস্তুগত জ্ঞান-শুধু প্রাণী হিসেবে বেঁচে থাকার জ্ঞান। আর দ্বিতীয়টি তাঁরই প্রেরিত নবী-রাসূলগণের মাধ্যমে ‘অহী’ সূত্রে প্রদত্ত জ্ঞান। এই জ্ঞান মানুষের মানবীয় মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন।
অতএব, মানুষ যদি এই দুনিয়ায় মানুষের মত বাঁচতে চায়-চায় মানবীয় মর্যাদা নিয়ে ও মানবীয় দায়িত্ব-কর্তব্য পালনের মাধ্যমে বেঁচে থাকতে, তাহলে তাকে নবী-রাসূলগণের মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞানকে প্রধান অবলম্বন রূপে গ্রহণ করতে হবে। এই জ্ঞানে মাধ্যমেই সে জানতে পারবে এই বিশ্বলোক কি, কি তার উৎস-এই জগতে মানুষের স্থান কোথায়, তার দায়িত্ব ও কর্তব্য কি, তার জন্যে ভালো বা মন্দ কি, তার ভবিষ্যত কিসে উজ্জল ও নিশ্চিন্ত হবে, কিসে হবে মর্মান্তিক ও দুঃসহ পরিণতি!
হযরত মুহাম্মাদ সা. আল্লাহ তা’আলার সর্বশেষ নবী ও রাসূল। তাঁর প্রতি অবতীর্ণ কুরআন মহান আল্লাহর সর্বশেষ কিতাব। দুনিয়ার শেষদিন পর্যন্ত মানুষের প্রতি তাঁর যা কিছু বক্তব্য, সবই তিনি চূড়ান্তভাবে এই মহাগ্রন্থ কুরআনে বলে দিয়েছেন। তিনি নিজস্ব জ্ঞানের ভিত্তিতেই সব কিছু বলেছেন। তাঁর জ্ঞান মানুষের মতো ইন্দ্রিয় ও কার্যকরণ নির্ভর নয়-নয় আপেক্ষিক, পরীক্ষামূলক বা আনুমানিক। তাঁর জ্ঞান যেমন প্রত্যক্ষ, তেমনি কালাতীত- তা সর্বাত্মক, সর্বব্যাপক ও সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ। তাঁর জ্ঞান আয়ত্ত করার সাধ্য কোন মানুষের নেই। তিনি অনুগ্রহ করে সর্বশেষ নবীর মাধ্যমে যতটুকু জ্ঞান দিয়েছেন তা নিশ্চয়ই মানুষের প্রয়োজন পূরণে যথেষ্ট। অতএব নবী করীম সা.-এর নিকট থেকে প্রাপ্ত জ্ঞানকে ভিত্তি করেই রচিত হতে হবে মানুষের জন্যে শিক্ষাব্যবস্থা। তারই আলোকে প্রাকৃতিক জগতকে বিশ্লেষণ করতে ও বুঝতে হবে এবং তদনুসারেই নিয়ন্ত্রিত হতে হবে প্রাকৃতিক শক্তিনিচয়ের প্রতি মানুষের আচরণ। বিশ্বনবী সা. প্রথম ওহী লাভের পর মক্কার সংকীর্ণ পরিসরে ও বিপদ-সঙ্কুল পরিবেশে এই শিক্ষা ব্যবস্থারই সূচনা করেছিলেন। অতঃপর মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর সেই শিক্ষাকে তিনি আরো সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন করেছেন। এভাবে জীবনভর তিনি সেই শিক্ষা-কেন্দ্র থেকে তৈরী করেছেন সর্বপ্রকার মৌলিক তাত্ত্বিক জ্ঞানের অধিকারী ও বিশ্বব্যাপী ইসলামী আদর্শভিত্তিক নেতৃত্ব দানের উপযোগী লোকদেরকে। ফলে তাঁর পরে খুলাফায়ে রাশেদুন ও সাহাবায়ে কিরাম দুনিয়ায় যে উন্নতমানের জ্ঞানের প্রদীপ জ্বালিয়েছিলেন সমগ্র প্রতীচ্য সে জ্ঞানের আলোকে উদ্ভাসিত হয়েছিল। দুনিয়ায় পাশবিকতা ও হিংস্রতামুক্ত এক নতুন যুগের সূচনা হয়েছিল; সর্বত্র মানবিকতার নির্মল ও নিষ্কলঙ্ক পরিবেশে মানুষ স্বকীয় মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার সুযোগ পেয়েছিল।
প্রায় ত্রিশ বছর ধরে এই সোনালী যুগ অব্যাহত থাকার পর জাহিলিয়াত রাজনৈতিকভাবে ইসলামের ওপর বিজয় লাভ করে এবং ইসলামী খিলাফত খতম হয়ে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু রাসূলে কারীম সা.-এর প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাকেন্দ্র থেকে যে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রবাহ চতুর্দিক প্লাবিত করেছিল, তারই পরিণতিতে জ্ঞানচর্চার নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। আধুনিক বিজ্ঞানের ভিত্তি মূলত ঠিক সেই সময়ই রচিত হয়।
মূলত সেই আদর্শিক শিক্ষার ধারাই মুসলিম জাতির জন্যে একমাত্র গ্রহণযোগ্য শিক্ষাব্যবস্থা। মুসলিম বিজয়ের পর এতদঞ্চলেও সে শিক্ষার রেশ চলছিল দীর্ঘকাল ধরে। কিন্তু এদেশে বৃটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সে শিক্ষা ব্যবস্থা ধসে পড়ে এবং পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী শিক্ষা ও জ্ঞানের নিঃছিন্দ্র অন্ধকারে মুসলমানরা নিমজ্জিত হয়। বড়ই দুঃখের বিষয়, এক বারের বদলে দু’বারের স্বাধীনতাও আমাদেরকে পাশ্চাত্য শিক্ষার সে অন্ধকার থেকে মুক্তি দান করতে সক্ষম হলনা। সে অন্ধকার থেকে আমরা আদপেই মুক্তি লাভ করব কি না, সেটাই আজ বড় প্রশ্ন।
শিক্ষা ও প্রশিক্ষণই মানুষকে প্রকৃত অর্থে মানুষরূপে গড়ে তোলার একমাত্র হাতিয়ার। শিক্ষাহীন বা শিক্ষাবঞ্চিত মানুষ কোনদিনই মনুষ্যত্বের সুমহান মর্যাদা অর্জন করতে পারে না। মানুষের সন্তানকে যদি ‘মানুষ’ নামে অভিহিত করতে হয় তাহলে তার জন্যে শিক্ষার সুষ্ঠু ব্যবস্থা অপরিহার্য।
শুধু তা-ই নয়। মানুষকে আপনি যে ধরণের বা যে গুণের অধিকারী দেখতে চান এবং যে স্বভাব-চরিত্রে ভূষিত করতে চান, সেই ধরণের মানুষ গড়ে ওঠে যে ধরণের শিক্ষা পেলে এবং সেই গুণ ও সেই স্বভাব-চরিত্র সৃষ্টি করে যে শিক্ষা, তা-ই তাকে দিতে হবে। এটাই যুক্তি ও বাস্তবতার দাবি।
পিতার ঔরসে মাতৃগর্ভে জন্মগ্রহণ করে মানবাকৃতির যে শিশু, তা একটি স্বভাবজাত সত্তা-যে স্বভাবের ওপর আল্লাহ তা’আলা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। এই স্বভাবজাত সত্তাটি ঠিক পানির মত। পানির নিজস্ব রঙ নেই। পানিকে যে রঙে রঙিন করার ইচ্ছা হবে, সেই রঙই তাতে গুলে মিশিয়ে দিতে হবে। সেই রঙ যখন পূর্ণমাত্রায় গুলে মিশে যাবে, পানি সেই রঙ নিয়ে প্রতিভাত হয়ে উঠবে। মানুষের অবস্তাও ঠিক এই রূপ। মানুষ যেন মৃৎ শিল্পের কাঁচা মাল। কাঁচা মাটি দিয়ে যে-কোন আকার-আকৃতির পাত্র তৈরী করা যায়। মানুষকেও পারা যায় যে-রূপ ইচ্ছা তৈরী করতে। তার জন্যে সেইরূপ শিক্ষা দরকার, যেরূপ মানুষ আপনি তৈরী করতে ইচ্ছুক।
এই প্রেক্ষিতে ‘আমাদের মুসলমানদের শিক্ষা ব্যবস্থার স্বরূপ কি হবে’- প্রশ্নের একটি মাত্র জবাবই হতে পারে। তা হল, যেরূপ মানুষ আপনি তৈরী করতে চান, তার জন্যে সেইরূপ শিক্ষারই ব্যবস্থা করুন। দেখবেন, আপনার ইচ্ছামাফিক লোক তৈরী হয়ে গেছে। কথাটি ঠিক যান্ত্রিক অর্থে নয়, মানবিক দৃষ্টিতেই বলা হয়েছে। নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বলেছিলেনঃ Give me good mothers, I shall give you a good nation. কথাটির যথার্থতায় কোন সন্দেহ নেই। আমার এই কথাটি অনুরূপভাবেই সত্য।
এখন প্রশ্ন, আপনি কোন্ ধরণের মানুষ তৈরী করতে চান? এই প্রশ্নটির পূর্বে আর একটি প্রশ্ন বিবেচ্য। তা হল, আপনি নিজে কিরূপ মানুষ হতে চান? আপনি নিজে যেরূপ মানুষ হওয়া পছন্দ করেন-ভালবাসেন, আপনি নিশ্চয়ই চাইবেন যে, ঘরে ঘরে সেই রূপ মানুষই গড়ে উঠুক। তাহলেই আপনার চাওয়াটা বাস্তবায়িত হবে; আপনার বাসনার প্রতিফলন ঘটবে বাস্তবে।
এই প্রশ্নটি নিয়ে কথা বললে বলা যায়, আপনি নিজে নিশ্চয়ই সৎ মানুষ হতে চান। কেননা সাধারণভাবে কোন মানুষই অসৎ হতে চায় না। যে ব্যক্তি অসৎ, সেও নিজেকে সাধারণভাবে অসৎ মনে করতে প্রস্তুত নয়। নিজের দোষ-ত্রুটি আর ক’জনে দেখে? সে যা-ই হোক, আপনি সৎ হতে চাইলে নিশ্চয়ই চাইবেন যে, ঘরে ঘরে সৎ মানুষ গড়ে উঠুক। তাহলে আপনাকে সৎশিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। এমন শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের ব্যবস্থা করতে হবে, যা লাভ করে ভবিষ্যত বংশধররা সৎ হয়ে উঠবে।
কিন্তু প্রশ্ন হল, সৎশিক্ষা কোন্টি? এ সম্পর্কে যে ধারণাটি শাশ্বত, সে দৃষ্টিতে বলতে হয়, আপনার আমার ও এই বিশ্বলোকের সৃষ্টিকর্তা যাকে সৎ বলেছেন, তা-ই সৎ এবং যাকে অসৎ বলেছেন, তা-ই অসৎ। তাহলে আল্লাহ যেসব গুণকে সদ্গুণ বলেছেন, সেই গুণগুলো সৃষ্টি হতে পারে যে শিক্ষার দ্বারা, লোকদের জন্যে আপনাকে সেই শিক্ষারই ব্যবস্থা করতে হবে। আসলে সৎ-অসৎ বিষয়ে মানুষের চিন্তা-ভাবনা বিভিন্ন– অনেক সময় পরস্পর-বিরোধীও। আপনি যদি আপনার ধারণানুযায়ী সৎ শিক্ষা নিয়ে দাঁড়ান, তাহলে আর একজন দাঁড়াবে তার ধারণানুযায়ী সৎশিক্ষা নিয়ে। তার ফলে উভয়ের মধ্যে সংঘর্ষ অনিবার্য। তাই নিজ নিজ ধারণা পরিহার করে সকলে মিলে আল্লাহর নিকট যা সৎ বলে বিবেচিত, সেই সৎকে সৎ বলে গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয় নয় কি? তাহলে তা নিয়ে কোন ঝগড়া-বিবাদ সৃষ্টি হওয়ার কোন আশঙ্কাই থাকবে না। বলতে পারেন, শিক্ষার ক্ষেত্রে আল্লাহকে নিয়ে এলে তো কুরুক্ষেত্র বা ক্রুশ-যুদ্ধের উদ্ভব হবে। হ্যাঁ, তা হতে পারে, অস্বীকার করছি না; কিন্তু আমরা যত লোক আল্লাহতে বিশ্বাসী রয়েছি, আল্লাহ সম্পর্কে অভিন্ন ধারণা ও বিশ্বাস পোষণ করি- সমস্ত মানুষ না হলেও-অন্তত তারা তো একটি বিন্দুতে ঐক্যমত্য পোষণ বা একতাবদ্ধ হতে পারি। আপাতত সেই ঐক্যমত্যকে ভিত্তি করেই এগুতে হবে। এভাবে একটি দেশে যারা আল্লাহ সম্পর্কে একমত, তারা একটি সৎশিক্ষার ব্যবস্থা করবে। আর এভাবে সারা বিশ্বে যারা আল্লাহ সম্পর্কে একই ধরণের বিশ্বাস পোষণ করে, তারা সকলে মিলে এক অভিন্ন শিক্ষাদর্শন গ্রহণ করলেই, সারাবিশ্বে তদনুযায়ী সৎ মানুষ গড়ে উঠবে।
বর্তমান বিশ্ব-ব্যবস্থার প্রেক্ষিতেই বলতে চাই, এই মুহুর্তে দুনিয়ার মুসলমানদের কর্তব্য হচ্ছে এমন একটা শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা যাতে করে আমাদের ভবিষ্যত বংশধররা সত্যিকার ‘মুসলিম’ হয়ে গড়ে উঠতে পারে। প্রায় সব ক’টি মুসলিম দেশই এককালে পাশ্চাত্য খৃষ্টান বা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিবর্গের অধীন ছিল। সে শক্তিগুলো এসব দেশে শিক্ষা বিস্তারের যে ব্যবস্থাই গ্রহণ করুক না কেন, তাতে দুটি লক্ষ্য অর্জনের বিষয় তারা অবশ্যই স্মরণ রেখেছে। প্রথমত তাদের সামাজিক ও প্রশাসনিক সুবিধার লক্ষ্যে নিজস্ব কাজের উপযোগী ‘শিক্ষিত’ ব্যক্তি তৈরীর জন্যে তারা চেষ্টা করেছে- যেমন উপমহাদেশে বৃটিশেরা তাদের প্রয়োজনীয় কাজগুলো সম্পাদন করে দেয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন লোক তৈরীর উদ্দেশ্যে নিজেদের মনোপুত শিক্ষাব্যবস্থা রচনা ও প্রবর্তন করেছে এবং দ্বিতীয়ত এই মনোভাব তারা বরাবর লালন করেছে যে, কোন দিন তারা যদি এদেশ ত্যাগ করে চলে যেতে বাধ্যও হয়, তাহলেও যেন তাদের ভক্ত-অনুরক্ত, তাদের লালিত চিন্তা-বিশ্বাস ও চরিত্রের প্রতিমূর্তি এবং তাদের অন্ধ সমর্থক ও মানসিক গোলামরা এদেশে প্রাধান্য লাভ করতে পারে। এভাবে তাদের অনুপস্থিতিতেই যেন এ সব দেশে সেই সব কাজ সম্পন্ন হয়, সেই সব নীতি ও আদর্শ বাস্তবায়িত হয় এবং সেই সব অনুষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠান চলতে থাকে, যা তারা নিজেরা করেছে বা থাকলে করত।
এককথায়, বলা যায়, এসব সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তাদের অধীনস্থ দেশগুলোতে তাদের উপযুক্ত গোলাম তৈরীর লক্ষ্যেই গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে তৈরী করেছে, প্রশাসনিক শক্তিবলে তা চালু করেছে এবং এই শিক্ষালাভ করা ছাড়া উন্নতির কোন উপায় নেই বলে অসহায় জনগণকে বুঝিয়েছে। আর শেষ পর্যন্ত তারা এসব দেশ ত্যাগ করে চলে যাওয়ার সময় তাদের তৈরী মানসপুত্রদের হাতেই দেশের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব ছেড়ে দিয়ে-তাদের শূণ্য আসনগুলোতে তাদের তৈরী গোলাম মনোভাব ও গোলাম চরিত্রের লোকদেরকেই বসিয়ে গেছে। ফলে ঐসব দেশ স্বাধীন হওয়া সত্ত্বেও সেখানকার জনগণ প্রকৃত স্বাধীনতার স্বাদ লাভ করতে পারেনি। তারা যে গোলাম ছিল স্বাধীনতার পূর্বে, সেই গোলামই থেকে গেল স্বাধীনতা লাভের পরেও। তাই স্বাধীনতা অর্জনকারী মুসলিম দেশগুলোর জনগণ গোলামীর নাগপাশে কঠিনভাবে বন্দী হয়ে আছে।
কাজেই মানুষ গড়ার আসল হাতিয়ার শিক্ষাব্যবস্থাকে গড়ে তুলতে হবে নিজেদের চিন্তা-বিশ্বাস, আদর্শবাদ ও মূল্যমানের ভিত্তিতে। এর ব্যতিক্রম হলে অবস্থার কোন পরিবর্তনই হবেনা।