শিক্ষা সম্পর্কে ইসলামী দৃষ্টিকোণ
ইসলামের শিক্ষা দর্শন বা শিক্ষা সম্পর্কে ইসলামের ধারণা বা দৃষ্টিকোণ কি, তার সংজ্ঞা ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য কি সে বিষয়ে কোন চূড়ান্ত ও স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হলে প্রথমেই মানুষ সম্পর্কে ইসলামের ধারণা ও দৃষ্টিকোণকে মৌলিকভাবে বিচার-বিবেচনা করতে হবে। এ পর্যায়ে আমার বক্তব্য হলোঃ
মানুষ দুনিয়ার অন্যান্য জীবজন্তু ও বস্তুর ন্যায় একটি সৃষ্টি হলেও সে একটা বিশেষ সৃষ্টি। জন্ম, বৃদ্ধি (Growth), খাদ্য ও অন্যান্য প্রাকৃতিক উপাদান গ্রহণ করে দুনিয়ায় বেঁচে থাকার দিক দিয়ে মানুষ অন্যন্য জীবের মতো হলেও সে ঐ সব থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ও বিশেষত্বের অধিকারী। মানুষ মাটি বা প্রস্তরের ন্যায় নির্জীব, নিষ্প্রাণ বা স্থবির নয়। মানুষ প্রাণবান, সচেতন ও চলৎশক্তিসম্পন্নও বটে। এখানেই শেষ নয়, সাধারণ জীব-জন্তু ও প্রাণীকূল থেকে মানুষ এই দিক দিয়েও ভিন্নতর যে, মানুষের রয়েছে চিন্তাশক্তি, স্মরণশক্তি ও বাকশক্তি- আছে মনের কথা প্রকাশ করার ভাষা। সে ভাষা যেমন মুখে ব্যবহৃত হয়, তেমনি হয় লেখনীর দ্বারা। এই কারণে সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রশ্ন কেবল মানুষের বেলায়ই আসে, অন্যান্য জীব-জন্তুর ক্ষেত্রে তেমন প্রশ্ন উঠতেই পারে না। সর্বোপরি মানুষের রয়েছে ন্যায়-অন্যায়, ভাল-মন্দ ও পাপ-পূণ্য বোধ। এই বোধ মানুষের স্বভাবগত-জন্মগত। কিন্তু সাধারণ জীব-জন্তু এই বোধ থেকে সম্পূর্ণ বঞ্ছিত।
মানুষের চিন্তা-ভাবনা, বিচার-বিবেচনার ক্ষমতা রয়েছে। এ কারণেই তার মনে তীব্রভাবে জেগে ওঠে কঠিন জিজ্ঞাসা- নিজের সম্পর্কে এবং বিশ্বলোক সম্পর্কে।
বিশ্বলোক সম্পর্কিত প্রশ্ন হচ্ছে, এই বিশ্বলোক কি কোন বাস্তব সত্য, না সম্পূর্ণ অলীক ও অস্তিত্বহীন ছায়ামাত্র? যদি সত্য ও বাস্তব হয়, তাহলে এই বিশ্বলোক কি স্বয়ম্ভু, না এর কোন স্রষ্টা আছে, স্রষ্টা থাকলে সে কি এক ও অনন্য, না একাধিক- বহুসংখ্যক? এবং স্রষ্টার সাথে মানুষের সম্পর্কই বা কি?
মানুষের নিজের সম্পর্কে যে সব প্রশ্ন জাগে, তা মোটামুটি তিন পর্যায়ের। প্রথম পর্যায়ের প্রশ্ন তার নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে- সে কে? সে কি দুনিয়ার অন্যান্য জীব-জন্তু-বস্তুর মতই কিছু, না ঐ সব থেকে তার কোন স্বাতন্ত্র্য আছে? সে নিজের বিবেচনায়ই যখন সর্বক্ষেত্রে নিজের সুস্পষ্ট স্বাতন্ত্র্য দেখতে পায়, তখন এর কারণ ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে তার মনে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে। দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রশ্ন হচ্ছে, এই দুনিয়ায় তাকে যে জীবন দেয়া হয়েছে, সেই জীবনটাকে সে কোন কাজে, কোন ক্ষেত্রে এবং কিভাবে ও কি পদ্ধতিতে অতিবাহিত করবে? তার আশে-পাশে অবস্থিত অসীম ও অশেষ প্রাকৃতিক শক্তি-সম্পদ ও উপকরণকে নিজের ও অন্যান্য মানুষের কল্যাণে কিভাবে ব্যবহার করবে? কোন্ অধিকারে ও কোন্ মৌল দৃষ্টিকোণ নিয়ে এবং কোন উদ্দেশ্যে সেগুলো ব্যবহার করবে? আর তৃতীয় প্রশ্ন হচ্ছে, তার জীবনের যাবতীয় দায়দায়িত্ব কি এই দুনিয়ায়ই শেষ হয়ে যাবে? না মৃত্যুর পরও তার কোন জের চলবে? যদি তা চলেই তাহলে তার সাথে এই জীবনের ও জীবনব্যাপী কর্মধারার কি সম্পর্ক? বস্তুত এ সব প্রশ্ন কোন জীব-জন্তুর মনে জাগে না। তাদের ক্ষেত্রে এ সব প্রশ্ন কখনই ওঠে না। তাই তাদের প্রসঙ্গে এসব প্রশ্নের জবাব দেয়ারও কোন প্রয়োজন নেই। এই সব প্রশ্ন জাগে কেবল মানুষের মনে- মানুষের ক্ষেত্রে। অতএব, মানুষের পক্ষে এই সব প্রশ্নের জবাব পাওয়া একান্তই অপরিহার্য। কেননা এসব প্রশ্নের সুস্পষ্ট ও অকাট্য জবাব না পেলে এই দুনিয়ায় মানুষের পক্ষে সুষ্ঠুভাবে জীবন যাপন করা কোনক্রমেই সম্ভব হতে পারে না। এসব প্রশ্ন মানব মন থেকে কখনই নিঃশেষ হয়ে যাবে না। মানুষ যতদিন ‘মানুষ’ থাকছে এই প্রশ্নসমূহ ততদিন তার মনে চির-জাগরুক হয়েই থাকবে।
কিন্তু এসব প্রশ্নের জবাব মানুষ কোথায় পাবে? এ জবাব সে পেতে পারে অর্জিত জ্ঞানের মাধ্যম। অতএব, জ্ঞানার্জন মানুষের জন্যে অপরিহার্য। জ্ঞানার্জনের জন্যে যে যোগ্যতা থাকা আবশ্যক, তা স্বভাবগতভাবে কেবল মানুষেরই রয়েছে। মানব-প্রকৃতি নিহিত সেই যোগ্যতাকে সম্পূর্ণরূপে ব্যবহার করতে হবে এই জ্ঞান-অর্জনের জন্যে।
এই বিশ্লেষণের আলোকে বলা যায়, মানুষকে মৌলিকভাবে জানতে হবেঃ
১. স্রষ্টা ও সৃষ্টিকর্মের নিয়ম-ধারা এবং সৃষ্টিলোকে সদা কার্যকর সূক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম বিশেষত্ব।
২. বিশ্বলোক ও বিশ্বলৌকিক বস্তুনিচয়ের গুণাগুণ ও বৈশিষ্ট্য-বিশেষত্ব এবং মানুষের কল্যাণে সে সবের প্রয়োগের নির্ভুল পদ্ধতি।
৩. এ দুনিয়ায় মানুষের দায়িত্ব-কর্তব্য, জীবন যাপন পদ্ধতি এবং পরকালীন জবাবদিহির ধারণা ও পরিণাম।
এই পরিপ্রেক্ষিতে জ্ঞানের সংজ্ঞায় বলা যায়
স্রষ্টার (আল্লাহর) অস্তিত্ব, তাঁর গুণাবলীর তত্ত্ব ও বাস্তবতা, বিশ্বলোকে সদা কার্যকর নিয়ম, বস্তুর গুণাবলী ও মানুষের কল্যাণে তার প্রয়োগ-পদ্ধতি এবং সর্বোপরি নিজের বিশেষত্ব, অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যত, নিজের দায়িত্ব-কর্তব্য এবং জবাবদিহি সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান অর্জন যেন তার মন-মগজও জীবন-স্রষ্টার অনুগত এবং স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জনে নিয়োজিত হতে পারে; কেননা, তার শেষ পরিণতি তাতেই।
বস্তুত যে মানুষ স্রষ্টাকে জানেনা- জানেনা তাঁর মহান গুণাবলী, তার অসীম ও অসাধারণ অনুগ্রহের অবদান, সে মূলত কিছুই জানে না; কেননা সব জ্ঞানের মূল এখানেই নিহিত। যে লোক তার নিজের জীবন-যাপন পদ্ধতি ও ভাল-মন্দ জানে না, জানেনা তার পরিণতি কি হতে পারে ও শুভ পরিণতি লাভ কিভাবে সম্ভব, সেতো সম্পূর্ণ অন্ধ ও অজ্ঞ। আর অন্ধ ও অজ্ঞ কখনো দৃষ্টিমানের মতো হতে পারে না।
অন্ধত্ব ও অজ্ঞানতার অন্ধকারে মানুষের জীবন কিছুতেই চলতে পারে না। সাধারণভাবে প্রতিটি জীব-জন্তুর চোখে একটা নিজস্ব আলো আছে। তার সাহায্যে তারা অন্ধকারেও নিজেদের পথ দেখে চলতে পারে। এজন্যে তারা বাইরের আলোর মুখাপেক্ষী নয়। কিন্তু মানুষের চোখে নিজস্ব কোন আলো নেই। এ কারণে দেখার জন্যে সে বাইরের আলোর মুখাপেক্ষী। কিন্তু বাইরের আলো তার বৈষয়িক জীবন-পথে চলার জন্যে যথেষ্ট হলেও মানবোপযোগী জীবন যাপনের জন্যে তা কিছুমাত্র যথেষ্ট নয়। মানুষের জন্যে প্রয়োজন অর্জিত জ্ঞানের প্রোজ্জল আলো। এ আলোই তাকে অর্জন করতে হবে- অর্জন করতে হবে একমাত্র নির্ভুল ও সর্বপ্রকার সংশয়মুক্ত সূত্রে। অর্জনযোগ্য এ জ্ঞানের কয়েকটি পর্যায় রয়েছেঃ
মানুষের সর্বপ্রথম কর্তব্য হচ্ছে, তার স্রষ্টাকে জানা- স্রষ্টা সম্পর্কিত পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান অর্জন। স্রষ্টাই স্বীয় অনুগ্রহে এবং স্বীয় ইচ্ছা ও কুদরতে তাকে সৃষ্টি করেছেন। তিনি সৃষ্টি না করলে মানুষের পক্ষে এ জীবন লাভ করা- এ দুনিয়ার সুখ-সম্ভোগের সুযোগ পাওয়াই সম্ভবপর হতো না। তাই স্রষ্টার গুণ-বৈশিষ্ট্য ও দয়া-অনুগ্রহের কথা তাকে জানতে হবে। জানতে হবে, তিনি কোন্ মহান উদ্দেশ্যে এ দুনিয়ায় মানুষ সৃষ্টি করেছেন এবং কিসে তিনি সন্তুষ্ট আর কিসে অসন্তুষ্ট। তা জানতে না পারলে মানুষের পক্ষে এ দুনিয়ায় স্রষ্টার মর্জী অনুযায়ী জীবন যাপন করা সম্ভব হবেনা-সম্ভব হবে না পরকালে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন। আর তা-ই যদি না হয়, তাহলে মানুষের এ জীবনটাই যেমন চরমভাবে ব্যর্থ হয়ে যাবে, তেমনি পরকালীন জীবনে তাকে অনন্ত দুঃখ, দুর্দশা ও আযাবে নিক্ষিপ্ত হতে হবে। তা থেকে সে কিছুতেই নিষ্কৃতি লাভ করতে পারবে না। তাই স্রষ্টা সংক্রান্ত এই জ্ঞান লাভ করতে হবে মানুষের প্রতি স্রষ্টার সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান পবিত্র কুরআন মজীদ থেকে, যা তিনি নাযিল করেছেন তাঁর সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ সা.- এর ওপর। তিনি স্রষ্টার নির্দেশে তাঁর এই মহাগ্রন্থকে দুনিয়ার মানুষের নিকট পৌঁছিয়েছেন, এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে বুঝিয়েছেন এবং নিজে তদনুযায়ী আমল করে তার বাস্তবতা দেখিয়ে দিয়েছেন। কুরআন এবং রাসূলের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এই হচ্ছে স্রষ্টা-প্রদত্ত নির্ভুল জ্ঞানের মাধ্যম ও একমাত্র নির্ভরযোগ্য জ্ঞান-উৎস। এই জ্ঞান-মাধ্যম ও জ্ঞান-উৎস থেকেই মানুষ তার মনুষ্যত্বকে জানতে পারে-জানতে পারে কিভাবে তাকে একক ও সামষ্টিক জীবন যাপন করতে হবে। বিশ্বলোক নিহিত জ্ঞান লাভের মৌল প্রেরণাও সে এ থেকেই পেতে পারে। কেননা স্রষ্টা, সৃষ্টিলোক এবং মানুষ সম্পর্কে সম্পূর্ণ নির্ভুল জ্ঞান কেবলমাত্র স্রষ্টারই থাকতে পারে। তাই তাঁর দেয়া জ্ঞানের তুলনায় অপর কোন উৎস থেকে পাওয়া জ্ঞান কখনই অধিক নির্ভুল, যথার্থ ও নির্ভরযোগ্য হতে পারে না। কিন্তু আধুনিক শিক্ষাদর্শনে কেবলমাত্র বিশ্বলোক ও বস্তু-জগত সংক্রান্ত জ্ঞানকেই একমাত্র শিক্ষণীয় বিষয় বলে দাবি করা হয়েছে। তাতে মহান স্রষ্টাকে যেমন অস্বীকার করা হয়েছে, তেমনি তাঁর দেয়া নির্ভুল জ্ঞান-উৎসকেও সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হয়েছে। এই জ্ঞানের প্রথম সূত্র হচ্ছে, মানুষের ইন্দ্রিয়লব্ধ তথ্যভিত্তিক চিন্তা-গবেষণার ফসল। অথচ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগত নিতান্তই বাহ্যিক জগত। আসল ও প্রকৃত সত্য নিহিত রয়েছে এই দৃশ্যমান জগতের অন্তরালে। সেই অন্তরালবর্তী নিগূঢ় সত্যের ভিত্তিতেই ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানের সত্যাসত্য যাচাই করা সম্ভব। আর সে জ্ঞান মহান সৃষ্টিকর্তা ভিন্ন আর কারোরই থাকতে পারেনা। ফলে নিছক ইন্দ্রিযগ্রাহ্য জ্ঞান-উৎসের ওপর নির্ভরশীল মানুষ প্রকৃত জ্ঞান থেকে বঞ্ছিত থাকে। সে যা কিছু জানে, তা ভুলভাবে জানে। এ কারণেই বিশ্বলোক সম্পর্কিত জ্ঞান মানুষের পক্ষে যতটা কল্যাণকর হতে পারতো, তা হয়নি; বরং সে জ্ঞান মানুষের মনুষ্যত্বকে নানাভাবে ক্ষুণ্ন ও ব্যাহত করেছে। স্রষ্টাহীন বস্তু-জ্ঞান মানুষকে বৈষয়িক সুখ-শান্তি অনেক দিয়েছে; কিন্তু এই জ্ঞানই একদিকে যেমন মানুষকে ধ্বংস করার সামগ্রী রচনা করেছে, তেমনি তাকে নৈতিকতার দিক দিয়ে চরম শূণ্যতার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। এই জ্ঞান মানুষকে বুঝিয়েছে যে, মানুষও অন্যান্য জীব-জন্তুর মতোই একটা জীবমাত্র। বস্তুগত সুখ-শান্তিই তার একমাত্র কাম্য আর এই বস্তুগত জীবন ভিন্ন তার এমন কোন জীবন নেই, যেখানে তার কারোর নিকট জবাবদিহি করতে হতে পারে। কিন্তু এ ধারণা যেমন নিছক ইন্দ্রিয়লব্ধ, তেমনি বস্তুর সর্বাধুনিক বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের দৃষ্টিতেও একান্তভাবে ভুল। আধুনিক বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব নাস্তিক্যবাদকে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন প্রমাণ করেছে এবং এই সত্য অনস্বীকার্যভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে যে, বিশ্বলোকের অন্তরালে এক মহান স্রষ্টার অস্তিত্ব অপরিহার্য, তাছাড়া এই বিশ্বলোকের অস্তিত্ব অসম্ভব। সেই সৃষ্টিকর্তা যেমন সব কিছুর নিয়ামক, তেমনি সমস্ত বিষয়ে নির্ভুল জ্ঞানের উৎসও একমাত্র তিনিই। মানুষের জীবন এক অবিভাজ্য ইউনিট। একে নানাভাবে খণ্ড-ছিন্ন করে নানা বিধি-ব্যবস্থার অধীন করার অবকাশ নেই। তাই জীবনের সকল দিক ও বিভাগকে এক অবিভাজ্য এককের অংশ হিসেবে সমান গুরুত্ব সহকারে ও পূর্ণ ভারসাম্য রক্ষা করে যাপন করতে হবে। মানুষ বস্তু ও রূহের সমন্বয়ে গঠিত; অতএব তার যেমন বস্তুগত চাহিদা আছে, তেমনি আছে রূহ বা আত্মার চাহিদা- যা পূরণ করতে হয়, আল্লাহ-বিশ্বাস, ধর্ম-বিশ্বাস ও পরকাল-বিশ্বাস এবং তদনুযায়ী কাজের মাধ্যমে। বাহ্যত দেহের চাহিদা প্রবল হলেও মানব সত্ত্বার ওপর আসল কর্তৃত্ব হচ্ছে রূহ বা আত্মার। তাই আত্মার দাবি পূরণের সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করেই তার দেহের চাহিদা পূরণ করতে হবে। আত্মা এবং দেহের চাহিদা পূরণে যেমন সামঞ্জস্য রক্ষা করা প্রয়োজন, তেমনি আবশ্যক ভারসাম্য রক্ষা করাও। এ দুয়ের মধ্যে বৈপরীত্য বা দ্বন্দ্ব মানব জীবনের জন্য মারাত্মক। তাই শিক্ষা ব্যবস্থাকে হতে হবে ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন কল্যাণ সমন্বিত। পরকালের কথা বিস্মৃত হয়ে বা তার প্রতি উপেক্ষা দেখিয়ে যে শিক্ষা ব্যবস্থা রচিত তা মানুষের অখণ্ড ও অবিভাজ্য জীবনের পক্ষে কল্যাণময় হতে পারে না। কুরআনের শিক্ষা হচ্ছেঃ
رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الْآخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ
‘‘হে আমাদের রব্ব! তুমি আমাদের এই দুনিয়ার কল্যাণ দান করো এবং আখিরাতেও আমাদেরকে কল্যাণ দাও। আর তুমি আমাদেরকে জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা কর।’’ (সূরা বাকারাঃ ২০১)
কেননা এ জগতে দেহ ভিন্ন আত্মা অবাস্তব আর আত্মাবিহীন দেহ মৃত লাশ ছাড়া আর কিছুই নয়। কাজেই মানুষকে এমন জ্ঞান অর্জন করতে হবে যার ফলে সে দেহ ও আত্মার তথা ইহকাল ও পরকালের দাবি একই সঙ্গে ও পূর্ণ সামঞ্জস্য ও ভারসাম্য রক্ষা করে পূরণ করতে সক্ষম হবে। অতএব আল্লাহর দেয়া জীবন বিধান ও পরকালীন কল্যাণের উপায় যেমন তাকে জানতে হবে, তেমনিভাবে জানতে হবে আল্লাহর দেয়া দ্রব্য-সামগ্রীর গুণাবলী ও ব্যবহার পদ্ধতি, যেন মানুষের বৈষয়িক জীবন সামগ্রিকভাবে নির্ভুল পথে চালিত ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য সহকারে অতিবাহিত হতে পারে।
মানুষ একাকী দুনিয়ায় জন্মলাভ করতে পারেনি, একাকী বেঁচে থাকাও তার পক্ষে সম্ভবপর নয়। একারণেই মানুষকে বলা হয়েছে সামাজিক জীব। মানুষের এই সামজিক জীবন শুরু হয় তার জন্মের সূচনা থেকেই। প্রথমত পিতার ঔরসে ও মায়ের গর্ভে তার জন্ম হয়। এই পিতা ও মাতার দাম্পত্য জীবন সূচিত হয় শরী’আতসম্মত বিবাহ ও সামাজিক সমর্থনের মাধ্যমে। জন্ম লাভের পর তাকে লালিত-পালিত ও ক্রমশ বড় হয়ে উঠতে হয় পিতৃ-আশ্রয়ে, মায়ের কোলে এবং ভাই-বোন, চাচা-চাচী, ফুফা-ফুফী ও দাদা-দাদীর পরিবেষ্টনে। এখানেই মানুষের পারিবারিক ও সামষ্টিক জীবন যাপনের প্রশিক্ষণ সূচিত হয়। অতএব একদিকে পিতা-মাতার হক তাকে জানতে হবে, সেই সঙ্গে জানতে হবে অন্যান্য নিকট ও দূরবর্তী আত্মীয়-স্বজনের অধিকার এবং তাদের প্রতি তার কর্তব্যের কথা।
এ হচ্ছে মানুষের সামাজিক জীবনের প্রথম ধাপ। এরপর তার সামাজিক সম্পর্ক ক্রমশ বিস্তার লাভ করে তা স্থানীয় জনমণ্ডলীকে অতিক্রম করে যে দেশে সে বাস করে সেই দেশের বিপুল জনতার মধ্যে সম্প্রসারিত হয়। মানব জীবনের বহু গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারই এই বিপুল জনতা-সমন্বিত বৃহত্তর সমাজের সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। এই সামাজিক সম্পর্কের সাথে জড়িত রয়েছে মানুষের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবন।
মানুষ যে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের অধীনে নিরাপদে জীবন যাপন করে তা এই সামাজিক সম্পর্কের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র-ব্যবস্থার সাহায্যেই অর্জন করা সম্ভবপর। মানুষ যে অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলে বৈষয়িক সুখ-সুবিধা ও আয়েশ-আরাম ভোগ করে,তা একদিকে যেমন এই বৃহত্তর সামাজিক সম্পর্কের ওপর প্রতিষ্ঠিত অর্থ-ব্যবস্থা থেকে অর্জন করে, তেমনি সেই অর্থ-ব্যবস্থা এই রাষ্ট্র-ব্যবস্থা কর্তৃকই নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়। তাই মানুষকে জানতে হবে বৃহত্তর সমাজের সাথে তার কি সম্পর্ক, সমাজের ওপর তার কি অধিকার এবং সমাজের প্রতি তার কি কর্তব্য ও দায়িত্ব। অনুরূপভাবে তাকে জানতে হবে কোন ধরনের রাষ্ট্রনীতি তাকে ব্যক্তি স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার সুষ্ঠু ও নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা দিতে সক্ষম। কেননা দুনিয়ায় এমন সব রাষ্ট্র ব্যবস্থা রয়েছে যা মানুষের মৌল অধিকারগুলো হরণ করে তাকে নিতান্ত গোলাম বানিয়ে রেখেছে, তাকে পরিণত করেছে বল্গাহীন পশুতে কিংবা নির্বাক জন্তুতে। সাধারণ মানুষকে কথা বলার, মত প্রকাশ করার, ভাল-মন্দ বিচার করার কিংবা সরকারী কর্তৃপক্ষের সমালোচনা করার কোন অধিকারই দেয় না। এইরূপ রাষ্ট্র-ব্যবস্থা মানুষের মনুষ্যত্বের পক্ষে খুবই অপমানকর। অনুরূপভাবে দুনিয়ায় এমন অর্থ-ব্যবস্থাও রয়েছে যা সম্পদের ওপর ব্যক্তির মালিকানা অধিকার স্বীকার করে না। তা সমাজ-সমষ্টির দোহাই দিয়ে মানুষের সবকিছু কেড়ে নেয়; তার স্বতন্ত্র মানবিক সত্ত্বাকেও অস্বীকার করে। মানুষ সেখানে নিজের জন্যে অর্থোপার্জনের কোন পন্থা নিজেই বাছাই করে নিতে পারে না। অর্থ ও রাষ্ট্র এই উভয় শক্তিরই একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে বসে মুষ্টিমেয় নরপিশাচ। তারা দেশের মানুষকে এমনভাবে দমিয়ে রাখে এবং নিয়ন্ত্রিত করে যেমন তারা বিরাট একটা যন্ত্রের অংশমাত্র কিংবা নির্জীব কাঁচামাল বিশেষ। এরূপ অর্থব্যবস্থায় মানুষ মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলে নিতান্ত জীব-জন্তুতে পরিণত হয়। কাজেই মানুষকে এই বিশ্বের বুকে তার জন্যে ঘোষিত মর্যাদার দৃষ্টিতে স্রষ্টা ও সৃষ্টি এবং তার সঙ্গে মানুষের সঠিক সম্পর্ক রক্ষা করে সুষ্ঠু বৈষয়িক জীবন গঠন সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানার্জন এবং ব্যক্তিক ও সামষ্টিক জীবনে সেই জ্ঞানের বাস্তব অনুশীলন সম্পর্কে নির্ভুল ধারণা লাভ করতে হবে।
যে শিক্ষা ব্যবস্থা এই সব দিক দিয়েই মানুষকে সুশিক্ষিত ও সৎকর্মশীল বানাতে পারে মানুষের জন্যে কেবলমাত্র সে শিক্ষা ব্যবস্থাই সর্বাত্মক কল্যাণ বয়ে আনতে পারে। আর এই শিক্ষা ব্যবস্থা হতে পারে কেবলমাত্র তা-ই, যা আল্লাহর অবতীর্ণ কিতাব পবিত্র কুরআনের সার্বিক দর্শনের ভিত্তিতে রচিত।
বড়ই দুঃখের বিষয়, সাধারণভাবে গোটা বিশ্ব-সমাজে ও বিশেষভাবে গোটা মুসলিম জাহানে এই কুরআন-ভিত্তিক সার্বিক শিক্ষা ব্যবস্থা বর্তমানে চালু নেই। সারা দুনিয়ায় বর্তমানে যে শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত ও কার্যকর তা থেকে মানুষ নিজেকে, নিজের স্রষ্টাকে, তাঁর অশেষ অবদানকে এবং তাঁর সাথে মানুষের সম্পর্ককে নির্ভুলভাবে চিনতে পারেনা- নিজের উপরিউক্ত দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথাও জানতে পারে না। সে জানতে পারে এটুকু যে, মানুষ সাধারণ জীব-জন্তু থেকে ভিন্নতর কোন বিশেষ সত্তা নয়- জানতে পারে, কিভাবে, কি উপায়ে ও কি পদ্ধদিতে এ বিশ্বের পরতে পরতে সঞ্চিত উপকরণাদি নিঃশেষে কুড়িয়ে নিয়ে নিজের জৈব সুখ-সম্ভোগের আয়োজন করা সম্ভব। কিন্তু এ জানা-ই মানুষের উপযোগী জানা নয়। এ জানা কেবলমাত্র জীব-জন্তুর জন্যে শোভন। তাই বর্তমান মুসলিম জাহানের প্রধান কর্তব্য ছিল কেবলমাত্র কুরআন-ভিত্তিক সর্বাত্মক শিক্ষা-ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে ও সর্বস্তরে চালু করা। কিন্তু মুসলমানরাও এই শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পূর্ণত বা অংশত পরিহার করে ধর্মহীন ব্যক্তিদের রচিত ও তাদের দ্বারা সারা দুনিয়ায় প্রচলিত শিক্ষা-ব্যবস্থাকেই অনুসরণ করে চলেছে। ফলে তাদের বংশধররা মুসলিম হিসেবে গড়ে উঠতে পারছে না; বরং ধর্মপ্রাণ মুসলিম পরিবারের ছেলে-মেয়েরাও এ শিক্ষা অর্জন করে একই সাথে ঈমান ও চরিত্র উভয়ই হারিয়ে ফেলে। এর ফলে ভবিষ্যতে ‘মুসলিম’ দুনিয়ায় সসম্মানে বেঁচে থাকবে কিনা, সে প্রশ্নই এখন তীব্র হয়ে দেখা দিয়েছে।
ইসলামের শিক্ষা–দর্শন
১৯৫১ সালের নভেম্বর মাসে ইংল্যান্ডের শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তা মিঃ ঊড্ (Mr. Wood) বিশ্ব-পর্যটন ব্যপদেশে পাকিস্তানের তৎকালীন রাজধানী করাচী আগমণ করেন। এ সময় তিনি নগরীর একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘শিক্ষা’ (Education) বিষয়ে একটি বক্তৃতা প্রদান করেন। বক্তৃতা শেষে তাঁর নিকট প্রশ্ন করা হয়ঃ ইংল্যান্ডের সামনে শিক্ষার উদ্দেশ্য কি? এবং আপনার দৃষ্টিতে পূর্ণাঙ্গ ও সফল জীবনের ধারণা (Conception) ও লক্ষ্য কি, যা সামনে রেখে ও যা অর্জনের উদ্দেশ্যে আপনি বর্তমান বংশধরদের শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করে যাচ্ছেন?
এর জবাবে সুযোগ্য বক্তা প্রথমে তো নিজ জাতির বৈষয়িক ও বস্তুগত উন্নতি সম্পর্কিত ধারণা ব্যাখ্যা করলেন। পরে তিনি বললেনঃ ‘আমাদের দেশের কোন কোন শিক্ষাবিদ এই মত পোষণ করেন যে, বালক-বালিকাদের শিক্ষা-প্রশিক্ষণে কোন বিশেষ উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের প্রাধান্য থাকা উচিত নয়; বরং তাদেরকে অবাধে ও পূর্ণ স্বাধীনতা সহকারে লালন-পালন ও ক্রমবিকাশ লাভের সুযোগ দেয়া উচিত। বস্তুত তাঁর প্রথম ও দ্বিতীয় কথায় কোন মৌলিক তারতম্য নেই। কেননা, বাচ্চাদের সবচাইতে বড় শিক্ষক হচ্ছে তাদের পরিবেশ, যা সব সময়ই তাদের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য হয়ে থাকে।
কেবল মিঃ উড্ (কাষ্ঠ)-এর কথাই নয়, অন্য কোন দেশের Iron (লৌহ) কিংবা Steel (ইস্পাত)-ও যদি হতো, তবু তাদের কাছ থেকেও এই একই ধরণের জবাবই পাওয়া যেত। ইউরোপ, আমেরিকা, জাতিসংঘ প্রভৃতি দেশ ও সংস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা-বিশেষজ্ঞদের রচিত গ্রন্থাবলী এবং সে সব দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাসমূহ এই মতের বহু সংখ্যক ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছে। আর এসব শিক্ষাব্যবস্থার অধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মূলগত দিক দিয়ে বিশেষ কোন পার্থক্য নেই। কতিপয় প্রাথমিক সূত্র (Formula) ও মৌলনীতি (Fundamental Principles)-ই পাশ্চাত্য দেশসমূহের শিক্ষাব্যবস্থার সাধারণ ভিত্তি (Common basis)। পাশ্চাত্য দেশসমূহের শিক্ষা সংক্রান্ত এসব প্রথমিক সূত্র ও মৌলনীতির পর্যালোচনা ও যাচাই করার পূর্বে নীতিগতভাবে একটা দেশের শিক্ষাব্যবস্থার অন্তর্নিহিত মহাসত্য এবং শিক্ষার মূলনীতি ও মতাদর্শের বাস্তব রূপায়নের পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করা দরকার।
শিক্ষা–দর্শন ও জীবন–দর্শন
বস্তুত শিক্ষা ও জীবন এক অখণ্ড ও অবিচ্ছেদ্য সত্য। এর একটিকে অন্যটি থেকে বিচ্ছিন্ন করে সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপে চিন্তা ও বিবেচনা করার সম্ভবপর নয়। একটি জাতির শিক্ষা সংক্রান্ত মতাদর্শ ও মূলনীতি তা-ই যা তার জাতীয় জীবন-দর্শন ও জাতীয় জীবন-আদর্শ। জীবন-দর্শন এবং শিক্ষা-দর্শন এ দুটিই মূলের দিক দিয়ে এক ও অভিন্ন। শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা-পারদর্শীদের শিক্ষা-সম্পর্কিত মত-পার্থক্য মূলত জীবন-দর্শনেরই পার্থক্য। জীবন-দর্শন বিভিন্ন হওয়ার কারণের শিক্ষা-দর্শনও বিভিন্ন ও পরস্পরবিরোধী হতে বাধ্য। প্রত্যেক জাতিই শিশুদের শিক্ষা-দীক্ষার ব্যবস্থা করে সে পন্থা ও পদ্ধতিতে, যা তার জীবনাদর্শ ও জীবন-লক্ষ্য বাস্তবায়নের অনুকূল এবং পরিপূরক। যে পথে চলে শিক্ষার্থীর জীবন তাদের জাতীয় লক্ষ্যের দৃষ্টিতে সফল ও চরিতার্থ হতে পারে, সেই পথটিই হচ্ছে শিক্ষার্থীদের কাঙ্ক্ষিত পথ ও পন্থা। কাজেই যে জাতির জীবন-লক্ষ্য নিছক বৈষয়িক বা বস্তুগত এই নশ্বর জীবনের জন্যে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও উন্নতি বিধানই যাদের উদ্দেশ্য, তাদের শিক্ষাব্যবস্থা, পাঠ্য-বিষয় এবং শিক্ষার্থী, শিক্ষাদাতা, শিক্ষালয় ও শিক্ষার পরিবেশ ঠিক তা-ই হবে, যা তাদের এ দৃষ্টিকোণকে চরিতার্থ ও পরিতৃপ্ত করতে সক্ষম এবং তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। পক্ষান্তরে যে জাতির দৃষ্টিতে এই জীবনটা লক্ষ্যপথের একটা মনযিল ও স্তর মাত্র এবং অবিনশ্বর ও চিরন্তন জীবনের সাফল্য ও সার্থকতাই যাদের চরম লক্ষ্য, তাদের সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষা-পদ্ধতি এমন ভঙ্গিতে তৈরী হতে হবে, যার সামান্য পর্যবেক্ষণেও পরকালীন লক্ষ্যাদর্শ ও উদ্দেশ্যপরায়ণতা অনুভূত হতে পারবে। অনুরূপভাবে যে-জাতির লক্ষ্য শুধু দৈহিক ও মানসিক শক্তিনিচয়ের উন্নতি ও পূর্ণত্ব বিধান, তাদের শিক্ষা-ব্যবস্থায় অনুরূপ দৃষ্টিকোণেরই পূর্ণ প্রতিফলন ঘটবে। জাতীয়তাবাদী কিংবা দেশমাতৃকাবাদী, বস্তুবাদী কিংবা বৈরাগ্যবাদী- যা-ই হোক না কেন, প্রত্যেক জাতিই নিজস্ব দৃষ্টিকোণ ও দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ীই শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলে এবং এ সব ব্যবস্থায়ই তাদের জীবন-দর্শনের বাস্তব প্রতিফল ঘটে অনিবার্যভাবে। তাদের জীবন-দর্শন কি- তা ভালো কি মন্দ, ত্রুটিপূর্ণ কি নিখুঁত যা-ই হোক না কেন- এসব ব্যবস্থাপনাই হয় তার নির্মল দর্পন বিশেষ। এ দর্পনে তার সব কিছু প্রতিবিম্বিত হয় এবং তা দেখে তার অন্তঃস্থল পর্যন্ত এক দৃস্টিতে দেখে নেয়া ও সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করা খুবই সহজ।
জীবন–লক্ষ্যের বাস্তবতা ও গুরুত্ব
এক কথায়, মানুষের বাস্তব ভূমিকা এবং তার ইচ্ছামূলক কার্যক্রমের পথ ও পন্থা থেকেই সুনির্দিষ্ট হয় তার জীবন-লক্ষ্য ও জীবনাদর্শ।
বস্তুত শিক্ষা জীবনের জন্যে প্রস্তুতি-বিশেষ- জীবনের প্রস্তুতিরই অপর নাম শিক্ষা। এ বিষয়ে দুনিয়ার সব শিক্ষাবিদই সম্পূর্ণ একমত। কিন্তু এই জীবনটার উদ্দেশ্য কি, কোন্ কাজে ও তৎপরতায় নিয়োজিত হবে এই জীবনটা? ….এ প্রশ্নের জবাব খুজলে দেখা যাবে যে, জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও কর্মতৎপরতা নিয়েই দুনিয়ায় সৃষ্ট হযেছে আকাশ-পাতালের মত বৈষম্য। এই মত-বৈষম্য সত্ত্বেও জীবন-উদ্দেশের অবিচল প্রত্যয় অনুযায়ীই সাধিত হয় মানুষের স্বভাব-প্রকৃতি ও হৃদয়াবেগের প্রশিক্ষণ এবং চিন্তা-বিশ্বাস ও মতামতের লালন ও বিকাশ। এই হৃদয়াবেগ ও চিন্তা-চেতনা থেকেই বাস্তব কর্মগত ভূমিকা স্বতঃস্ফূর্তভাবে উৎসারিত হয়। এই মানস-প্রকৃতি ও মানস-পরিবেশই মূলত মানুষের সমগ্র চিন্তা-চেতনা ও হৃদয়াবেগের প্রকৃত কেন্দ্রবিন্দু এবং তার সমস্ত কর্মতৎপরতা ও গতিবিধির উৎসমুখ। হাদীস শরীফে এ মর্মস্থলের নাম দেয়া হয়েছে ‘ক্বল্ব্’ বা হৃদয়-মন। হাদীস অনুযায়ী মানুষের সমস্ত কর্মতৎপরতার যথার্থতা ও ত্রুটি-বিচ্যুতি এরই সুস্থতা ও রুগ্নতার ওপর নির্ভরশীল। হাদীসের ভাষা হলঃ
‘‘জেনে রাখ, মানবদেহে এমন একটা মাংসপিণ্ড বর্তমান, যা সুস্থ হলে সমস্ত দেহ সুস্থ থাকে। আর তা রোগাক্রান্ত হলে সমস্ত দেহ অসুস্থ হয়ে পড়ে। তা হল হৃদয় বা অন্তর।’’
মানুষের বাস্তব কর্মতৎপরতায় তার মানসিক অবস্থা, অন্তর্গত ভাবধারা ও মৌল বিশ্বাস বা প্রত্যয়ের প্রভাব কতটা এবং বাস্তব কর্মের দৃষ্টিতে এর গুরুত্ব কতখানি, মনোবিজ্ঞানীরা তা বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁরা বিষয়টির ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করেছেন। কেননা, তা মানবীয় শক্তিসামর্থের পথিকৃৎ শুধু নয়, তা মানুষের শাসক ও নিয়ন্ত্রকও। মানুষ তারই নির্দেশ বাস্তবায়নে ও পরিপূরণে নিজের ধন-সম্পদ ও সর্বাধিক প্রিয় জিনিস নিজের জীবনটাও অকাতরে বিলিয়ে দিতে কুণ্ঠিত হয় না। দুনিয়ার কঠোরতম সমাজ ব্যবস্থায়ও এসব চুম্বক শক্তিই অধিক সক্রিয় হয়ে থাকে। কমিউনিজম কিংবা সমাজতন্ত্র- সকল ক্ষেত্রেই হৃদয় মনে গভীরতর গহনে লুক্কায়িত এসব ভাবধারার হাতেই থাকে সমস্ত কর্তৃত্ব নিবদ্ধ। এগুলোই জাতির প্রকৃত নেতা- তার চালিকাশক্তি। জাতীয় নেতৃত্ব সুপথগামী হলে গোটা জাতিই নির্ভুল পথযাত্রী হবে আর তা যদি ভ্রান্ত পথের পথিক হয়, তাহলে জাতির প্রতিটি মানুষই ভুলপন্থী হবে। বর্তমানে দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে, জাতিতে ও গোত্রে বিরাজমান পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত মূলত জাতীয় ও সামষ্টিক জীবনাদর্শের বিভিন্নতারই সংঘাত। এক ব্যক্তি বা একটি দলে দৃঢ়তা ও স্থিতি এ চুম্বক শক্তির ওপরই একান্তভাবে নির্ভরশীল। আর এ শক্তির দুর্বলতা হচ্ছে এক ব্যক্তি, একটি দল ও একটি জাতির ধ্বংসের উৎসমুখ। দীর্ঘকালব্যাপী আদর্শহীন শিক্ষা-দীক্ষা ও পরিবেশের ফলেই মুসলিম জাতির ঈমান ও প্রত্যয়ে দুর্বলতার এ নৈরাশ্যজনক বাস্তবতা দৃশ্যমান।
আধুনিক শিক্ষার পরিণতি
এ প্রেক্ষিতে ইউরোপ, আমেরিকা ও অন্যান্য সভ্যতাগর্বী দেশের উন্নততর শিক্ষা ব্যবস্থা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠাসমূহের অবস্থা পর্যালোচনা করলে আমাদের সামনে একটি সত্য প্রতিভাত হয়ে ওঠে। এসব ব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠান যে সব মৌলিক ধারণা ও চিন্তা-ভাবনার ওপর প্রতিষ্ঠিত, তা হল এই বাস্তব ও ক্ষয়িষ্ণু দুনিয়ায় উন্নতি ও প্রাধান্য লাভ। এছাড়া তাদের সামনে আর কোন মহৎ লক্ষ্য নেই। এটাই তাদের জাতীয় পর্যায়ের চূড়ান্ত লক্ষ্য- তাদের সামগ্রিক ভাবনা-চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু। স্মর্তব্য যে, বৈষয়িক জীবনকে অন্য কোন মহত্তর ও চিরন্তর জীবনের জন্যে প্রস্তুতিক্ষেত্র এবং লক্ষ্য-পথ ও মাধ্যমরূপে গ্রহণকারী মানুষ এবং এ জীবনকেই আসল ও প্রকৃত জীবন তথা চরম ও পরম জীবনরূপে গ্রহণকারী মানুষের জীবনে আকাশ-পাতালের পার্থক্য অবশ্যম্ভাবী। লক্ষ্যস্থলের স্বরূপ ও দূরত্বের আলোকেই সফরের প্রস্তুতি ও পাথেয় গ্রহণের অভ্যাস প্রতিটি মানুষের। যাত্রাপথে সেসব জিনিসই সঙ্গে নেয়া হয়, যা পথিমধ্যে ও চূড়ান্ত মনযিলে পৌঁছার পর প্রয়োজনীয় মনে হবে। এটাই স্বাভাবিক। এ দুনিয়ার জীবনই যাদের চরম লক্ষ্য, তারা কি ধরণের জিনিসপত্র সংগ্রহে নিজেদের শক্তি-সামর্থ্য ব্যয় করবে এবং সাফল্য ও সার্থকতা বলতে তারা কি বুঝে থাকে, তা সহজেই অনুমেয়। এ ধরণের যাত্রীরা যে এই নশ্বর দুনিয়ার সমস্ত বস্তুগত উপায়-উপকরণ দুই হাতে কুড়াবে এবং সে সবকেই অতীব প্রয়োজনীয় ও পরম নির্ভরযোগ্য মনে করবে আর সেজন্যেই নিজেদের যাবতীয় শক্তি-সামর্থ্য নিয়োজিত করবে, তাকেই নিজেদের সমস্ত চেষ্টা তৎপরতা ও ব্যতিব্যস্ততার লক্ষ্য রূপে গ্রহণ করবে- এ ছাড়া জীবনের সূচনা সম্পর্কে তাদের অন্য কোন চিন্তা-ভাবনা হবে না- এক বিন্দু চিন্তা হবে না জীবনের পরিণাম সম্পর্কে- এতে কোনই সন্দেহ নেই। যাদের শিক্ষাব্যবস্থার প্রাসাদ পুরোপুরি বস্তুগত ভিত্তির ওপর স্থাপিত, তারা উন্নতমানের ‘জীব’ সৃষ্টি ছাড়া আর কি-ই বা করতে পারে!
আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার চূড়ান্ত লক্ষ্যস্থল হল এই নশ্বর ও বস্তু-জীবনের চাকচিক্য, জাঁকজমক, আনন্দস্ফূর্তি ও স্বাদ আস্বাদন। এছাড়া শিক্ষার আর কোন উদ্দেশ্য নেই। এ শিক্ষায় মানুষের যতই ঊর্ধগমন হোক না কেন, ব্যক্তিগত, সমষ্টিগত, জাতীয় ও দেশভিত্তিক উন্নতি লভই কেবল তার পক্ষে সম্ভব। আর মৌখিক দাবিতে আরো ঊর্ধ্বগমন সম্ভব হলে সমগ্র মানবতার কয়েকদিনের পাশবিক জীবনের লক্ষ্য এবং মানুষ সম্পর্কে এ ধারণা পাশবিক জীবন বিকাশের একটা ধারাবাহিকতা-অপেক্ষাকৃত উন্নততর জীব কিংবা উচ্চমানের জৈবিক আকাঙ্ক্ষা মাত্র। পিছনের দিকে তার কোন দৃষ্টি নেই, তার সৃষ্টির পিছনে কোন শক্তি বা সত্তার ইচ্ছার সক্রিয়তা ছিল না বলে তার সমস্ত সত্তাই উদ্দেশ্যহীন, বিশেষ কোন লক্ষ্য বলতেও কিছু নেই তার। ভবিষ্যতের দিকে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ নয়। উপস্থিত জীবন শেষে নেই তার কোন হিসাব-নিকাশ-শাস্তি ও পুরস্কার। অবস্থা যখন এই, তখন শুরু ও সমাপ্তি সম্পর্কে সম্পূর্ণ নির্ভীক ও বেপরোয়া মানসিকতাই প্রধান ও প্রভাবশালী হয়ে থাকে মানব জীবনের সমস্ত তৎপরতার ওপর। আর উপস্থিত বস্তুগত জীবনের চর্ব-চোষ্য-লেহ্য-পেয় তথা লোভ-লালসা ও কামনা-বাসনার চরিতার্থতা, তারই জাঁকজমক, চাকচিক্য, শ্রেষ্ঠত্ব-প্রাধান্য বিধান এবং তা অর্জনের জন্যে ব্যাপক প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বীতায় অবতরণ এবং তাকেই জীবনের উন্নতি ও উৎকর্ষের চরম সার্থকতা মনে করে-এটাই স্বাভাবিক। আর বর্তমান দুনিয়ায় ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত বিপদ-আপদ ও অশান্তি-উৎপীড়নের মূল উৎসই হল আধুনিক শিক্ষা-দর্শন ও শিক্ষা ব্যবস্থা। আল্লাহর সন্তোষ ও পরকালীন সাফ্যল্য যে মানুষের জীবন-লক্ষ্য হতে পারে তা সম্পূর্ণরূপে বিস্মৃত হওয়া এবং সে সব কিছুকে জীবনের তৎপরতা থেকে বিতাড়িত করে বৈষয়িক সুখ-সুবিধা, মান-সম্মান, ধন-সম্পদ, রাষ্ট্র-ক্ষমতা, ব্যবসায়িক উন্নতি, সর্বোপরি মানসিক ও জৈবিক স্বাদ-আস্বাদনকে জীবনের চরম লক্ষ্যরূপে গ্রহণ করাই এ শিক্ষার অনিবার্য পরিণতি।
ইসলামের দৃষ্টিতে আধুনিক শিক্ষা–দর্শন
বিদ্যার্জন ও শিক্ষা সংক্রান্ত এই নিরেট বস্তুবাদী ও পাশবিক দৃষ্টিকোণ সম্পর্কে আল্লাহ ও রাসূল তথা ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি কি, মুসলমান হিসেবে তা আমাদের সর্বপ্রথম জেনে নেয়া দরকার। এ পর্যায়ে কুরআন মজীদের ঘোষণাবলী লক্ষ্যণীয়। একটি আয়াতে বলা হয়েছেঃ
فَأَعْرِضْ عَن مَّن تَوَلَّىٰ عَن ذِكْرِنَا وَلَمْ يُرِدْ إِلَّا الْحَيَاةَ الدُّنْيَ – ذَٰلِكَ مَبْلَغُهُم مِّنَ الْعِلْمِ ۚ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِمَن ضَلَّ عَن سَبِيلِهِ وَهُوَ أَعْلَمُ بِمَنِ اهْتَدَىٰا
‘‘হে নবী! সেই লোকের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে রাখ, যে আমাদের নাযিল করা জীবন বিধানের প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করেছে এবং নিতান্তই বৈষয়িক জীবন ছাড়া যার লক্ষ্য আর কিছুর ওপর নিবদ্ধ নয়। এই শ্রেণীর লোকদের জ্ঞানের পরিধির চূড়ান্ত সীমা এ পর্যন্তই। আল্লাহর পথ থেকে কে ভ্রষ্ট হয়েছে এবং কে তাঁর হেদায়েত গ্রহণ করেছে, এই উভয় ব্যক্তিকে তোমার খোদা-ই অধিক ভালো জানেন।’’ (সূরা নাজমঃ ২৯–৩০)
এরই পূর্ববর্তী আয়াতে বলা হয়েছেঃ
إِنَّ الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِالْآخِرَةِ لَيُسَمُّونَ الْمَلَائِكَةَ تَسْمِيَةَ الْأُنثَى- وَمَا لَهُم بِهِ مِنْ عِلْمٍ ۖ إِن يَتَّبِعُونَ إِلَّا الظَّنَّ ۖ وَإِنَّ الظَّنَّ لَا يُغْنِي مِنَ الْحَقِّ شَيْئًاٰ
‘‘যারা পরকাল বিশ্বাস করে না, তারা ফেরেশতাদেরকে দেবীদের নামে অভিহিত করে। অথচ এ ব্যাপারে তাদের কিছুই জানা নেই। তারা তো নিছক আন্দাজ-অনুমানের অনুসরণ করে চল। কিন্তু নিছক আন্দাজ-অনুমান তো প্রকৃত সত্যের বিকল্প হতে পারে না।’’ (সূরা নাজমঃ ২৭–২৮)
প্রথমোদ্ধৃত আয়াতটির বক্তব্য হলঃ যারা আল্লাহর বিধান পরিহার করে চলে- জীবন-ব্যবস্থার ভিত্তি হিসেবে তাকে গ্রহণ করে না, নিতান্ত বৈষয়িক ও বস্তুবাদী এই জগত ভিন্ন অন্য কিছুতে যাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ নয়, তারা শুধু এই জীবন ও এই জগত সম্পর্কেই হয়ত কিছুটা জানতে পারে। এর বাইরের জগত তাদের দৃষ্টিরও আড়ালে, তাদের জ্ঞান-সীমারও বহির্ভূত। এ ধরণের বস্তুবাদী ও আল্লাহবিমুখ লোকদের পক্ষে ইহকাল ও পরকালব্যাপী সম্যক ও পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান অর্জন করা সম্ভবপর নয়। তাদের চিন্তা-বিবেচনা সর্বাত্মক ও ভারসাম্যপূর্ণ নয়- বরং একদেশদর্শী। প্রকৃত জ্ঞান তাদের আওতা বহির্ভূত। নিছক বাহ্যিক ও ভাসাভাসা জ্ঞানই তাদের একমাত্র সম্বল।
আর দ্বিতীয় আয়াতের প্রতিপাদ্য হলঃ পরকাল অনিবার্য ও অবশ্যম্ভাবী- এ বিশ্বাস যাদের নেই, কেবলমাত্র এ জীবনটাকেই যারা চূড়ান্ত ও একমাত্র বলে মনে করে নিয়েছে, তারা প্রকৃত জ্ঞান থেকে বঞ্ছিত। প্রকৃত ব্যাপার জানবার কোন সাধ্য তাদের নেই বলে তারা ফেরেশতাদেরকে দেব-দেবী ইত্যাদি মনে করে চরম অজ্ঞতা ও নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিচ্ছে। মানুষ বস্তু ও আত্মার সমন্বয়ে গড়া একটি পরিপূর্ণ সত্তা আর এই সত্তা সম্পর্কিত জ্ঞানই সত্যিকার জ্ঞান- যথার্থ ও সম্যক জ্ঞান। একটি গোটা সত্তার শুধু এক দিক সম্পর্কে যার জ্ঞান তার সে জ্ঞান যথার্থ বা সত্যভিত্তিক নয়; তা নিতান্তই আন্দাজ-অনুমান ভিত্তিক। আর আন্দাজ-অনুমান দ্বারা কখনো প্রকৃত সত্য জানা যেতে পারে না। অথচ মানুষের জন্যে প্রকৃত সত্য জ্ঞানই অপরিহার্য প্রয়োজন। প্রকৃত সত্যকে জানবার জন্যে সর্বপ্রথম দৃষ্টি প্রসারিত করতে হবে দুনিয়ার এপার থেকে পরকালের ওপার পর্যন্ত এবং এই সত্য পরিপ্রেক্ষিতকে সামনে রেখেই জ্ঞান আহরণ করতে হবে। এপার-ওপার দুপারেরই প্রেক্ষিতে যা কল্যাণকর তাকেই কল্যাণকর রূপে গ্রহণ এবং যা অকল্যাণকর তাকেই অকল্যাণকর মনে করে পরিহহার করে চলতে হবে।
প্রকৃতপক্ষে বস্তুনিবর্ভর ও বস্তুসর্বস্ব জ্ঞান নিতান্তই বাহ্যিক জ্ঞান। বস্তুর গভীরে যে আত্মা নিহিত, তাকে না দেখে বা তাকে বাদ দিয়ে যে জ্ঞান তা নিতান্তই ভুল জ্ঞান। তাই আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থা বস্তু সম্পর্কিত জ্ঞান শিখালেও বস্তু ও আত্মার সমন্বিত সত্তা সম্পর্কিত কোন জ্ঞানই শেখায় না। এ জন্যে সে জ্ঞান চিরকালই ভুল থেকে যায়। কুরআনে এহেন জ্ঞানবানদের সম্পর্কেই বলা হয়েছেঃ
يَعْلَمُونَ ظَاهِرًا مِّنَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَهُمْ عَنِ الْآخِرَةِ هُمْ غَافِلُونَ
‘‘ওরা কেবল বৈষয়িক জীবনের বাহ্যিক দিকটাই মাত্র জানে। আর পরকাল সংক্রান্ত ব্যাপার ও জ্ঞানের দিকে দিয়ে তারা একেবারেই অনবহিত-অসতর্ক।’’ (সূরা রূমঃ ৭)
এরূপ সংকীর্ণ দৃষ্টি ও বৈষয়িক জীবনকেন্দ্রিক জ্ঞানে পরিণাম কি? এ সম্পর্কে কুরআনে বলা হয়েছেঃ
اعْلَمُوا أَنَّمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا لَعِبٌ وَلَهْوٌ وَزِينَةٌ وَتَفَاخُرٌ بَيْنَكُمْ وَتَكَاثُرٌ فِي الْأَمْوَالِ وَالْأَوْلَادِ
‘‘খুব ভালভাবেই জেনে রাখ, এ দুনিয়ার জীবনটা একটা খেল-তামাসা, মন-ভুলানো উপায়, বাহ্যিক চাকচিক্য এবং তোমাদের পারস্পরিক গৌরব-অহংকার প্রকাশ আর ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে পরস্পরের তুলনায় অধিক অগ্রসর হয়ে যাওয়ার চেষ্টা ও প্রতিযোগিতা ছাড়া আর কিছু নয়।’’ (সূরা হাদীদঃ ২০)
إِنَّمَا هَٰذِهِ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا مَتَاعٌ وَإِنَّ الْآخِرَةَ هِيَ دَارُ الْقَرَارِ
‘‘এই দুনিয়ার জীবনটা তো কয়েক দিনের ক্ষয়িষ্ণু সামগ্রী মাত্র। আর চিরকাল অবস্থানে জায়গা তো হল পরকাল।’’ (সূরা মুমিনঃ ৩৯)
وَمَا هَٰذِهِ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا لَهْوٌ وَلَعِبٌ ۚ وَإِنَّ الدَّارَ الْآخِرَةَ لَهِيَ الْحَيَوَانُ ۚ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ
‘‘এ দুনিয়ার জীবনটা খেল-তামাসা ও অন্তঃসারশূণ্য আনন্দ-স্ফূর্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। আসল ও প্রকৃত জীবন হল পরকাল। অবশ্য যদি তারা এ তত্ত্ব জানতে পারে।’’ (সূরা আনকাবুতঃ ৬৪)
প্রথম আয়াতটি সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করছে, এই বৈষয়িক জীবন নিতান্তই অস্থায়ী। এখানকার আনন্দ-স্ফূর্তি ও চাকচিক্য এ জীবনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এখানেই তার সবটুকু নিঃশেষ হয়ে যাবে। এগুলো বাহ্যত ও উপস্থিত যতই আনন্দ এবং তৃপ্তিদায়ক হোক না কেন, এগুলোর কোন প্রকৃত ও স্থায়ী মূল্য নেই। এখানে এক-একটা জিনিসকে যত বড়ই মনে করা হোক না কেন, আসলে তা খুবই সামান্য ও নগণ্য। মানুষ নিজের দৃষ্টি সংকীর্ণতা, সীমাবদ্ধতা ও মনোবৃত্তির হীনতা-নীচতার দরুণই এখানকার এক-একটা জিনিসকে খুবই বিরাট, মূল্যবান ও আকর্ষণীয় মনে করে বসেছে। মানুষ নিতান্ত ধোঁকায় পড়েই এগুলোকে লাভ করার জন্যে পাগল হয়ে ছুটেছে এবং এগুলো পাওয়াকেই জীবনের চরম সাফল্য ও সার্থকতা মনে করছে।
দ্বিতীয় পর্যায়ে উদ্ধৃত আয়াতদ্বয়ের দ্যোতনা আরো সুস্পষ্ট- আরো মর্মস্পর্শী। তাতে চোখা চোখা কথায় বলে দেয়া হয়েছে, এ দুনিয়ার জীবনটা অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী ও দ্রুত অবক্ষয়মান সম্পদ মাত্র। আসলে এটা কোন জীবনই নয়। এটা এখানেই ফেলে যেতে হবে ছেঁড়া জুতার মতো। আসল চিরস্থায়ী জীবন তো পরকালীন জীবন। কাজেই এ দুনিয়ার জীবনটাকে যদি কেউ চিরস্থায়ী মনে করে, তাহলে সে মৃত্তিকাকে স্বর্ণ মনে করার মতোই চরম নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দেবে। সে একজন অজ্ঞ-মূর্খ ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রকৃত ও নির্ভুল জ্ঞানের সাথে পরিচিত হওয়া তার পক্ষে আদৌ সম্ভবপর নয়।
এ দুনিয়াকে চরম ‘লক্ষ্য’ রূপে গ্রহণ করার এবং এ ক্ষণিক সুখ-শান্তি ও উন্নতি-স্থিতিকেই চরম সার্থকতা মনে করার পরিণাম খুবই ভয়াবহ। এটি বিশ্বলোকে মানুষের আসল অবস্থান ও মর্যাদাকে পর্বতের উচ্চ শিখর থেকে নিক্ষেপ করে পাশবতার নিম্নতম পংকে পৌঁছে দেয়ার শামিল। দৃষ্টি ও চিন্তার পরিধিকে সংকীর্ণতর করে ঠিক-বেঠিক, সত্য-মিথ্যা, সহীহ-গলদ ও ভাল-মন্দ হওয়ার সিদ্ধান্ত এই অস্থায়ী জীবনের লাভ-অলাভ, সুখ-দুঃখ ও স্বাদ-বিস্বাদের নিক্তিতে ওজন করে গ্রহণ করার পরিণতি মানবতার পক্ষে কতখানি মারাত্মক, সে সম্পর্কে সম্যক ধারণা করাও এ দুনিয়ায় সম্ভব নয়। অথচ আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষা মানুষকে এই দৃষ্টিভঙ্গিই দিয়েছে- এই মানসিকতাকেই প্রবল করে তুলেছে। পরিণামে তা মানুষকে নিতান্ত ‘পশু’ বানিয়ে ছেড়েছে- মানুষ থাকতে দেয়নি। এটা যে পাশ্চাত্য সভ্যতার এক বিরাট ‘অবদান’, তা কোনক্রমেই অস্বীকার করা যায় না।
পাশ্চাত্য শিক্ষার সমাজদৃষ্টি
দুনিয়ার সমস্ত মানুষ একই পিতামাতার সন্তান, সকলে একই বংশোদ্ভূত, সকলের ধমনীতে একই মা-বাবার রক্ত প্রবাহমান। রক্ত-বর্ণেল দৃষ্টিতে তাদের মাঝে কোনরূপ ভেদাভেদ থাকতে পারে না। কিন্তু মানব জাতির এ স্বাভাবিক একত্বতা ও অভিন্নতাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়ে তাদেরকে বিভিন্ন সাংঘর্ষিক দল-উপদলে বিভক্ত করে দেয়াও পাশ্চাত্য সভ্যতার সংকীর্ণ ও সীমাবদ্ধ জীবন-দৃষ্টিরই অনিবার্য পরিণতি। কেননা দুনিয়ার বস্তুগত উপায়-উপকরণ, ধন-সম্পদ, আরাম-আয়েশের সামগ্রী খুবই সীমাবদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও বর্তমান শিক্ষা এগুলোকেই মানুষের একমাত্র লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। অথচ মানুষের জৈবিক লোক-লালসা অন্তহীন-সীমালঙ্ঘনকারী। শুধু ব্যক্তিগত চিন্তাই নয়, জাতীয় ও সামষ্টিক মতাদর্শের ভিত্তিও এ সব বস্তুগত জিনিসের ওপর সংস্থাপিত। পাশ্চাত্য জাতিসমূহের সমাজ ও জাতি সংক্রান্ত ধারণা (Concept of Society and Nation) বর্ণ-গোত্র ও দেশমাতৃকার সীমাভিত্তিক এবং তা নিতান্তই বস্তুগত নিগড়ে আষ্টে-পৃষ্ঠে বাঁধা। পাশ্চাত্য জাতি-দর্শনে দেশমাতৃকা বা ভূগোল-সীমার মধ্যে বসবাসকারী এক নির্দিষ্ট বর্ণের বা গোত্রের লোক বা এক ভাষাভাষী লোকেরা এক-একটা জাতি। এ জাতি অন্যান্য সব মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন ও সর্বতোভাবে স্বতন্ত্র। এই বস্তুগত বা অঞ্চলভিত্তিক জাতীয়তাই এক পর্যায়ে মানুষের মধ্যে শ্রেণী-চেতনা তীব্রতর করে তোলে। ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’, ‘দুনিয়ার মালিকরা এক হও’ প্রভৃতি শ্লোগান ও পাল্টা শ্লোগান এ সংকীর্ণ ও বিষাক্ত শ্রেণী চেতনারই ফসল। বর্তমান দুনিয়ায় মানুষে মানুষে, জাতিতে জাতিতে, শ্রেণীতে শ্রেণীতে, বর্ণে গোত্রে ও ভাষায় ভাষায় যে দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ প্রচণ্ড রূপ পরিগ্রহ করেছে এবং হিংসা-বিদ্বেষের যে আগুন চারিদিকে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে গোটা মানব সভ্যতাকে ছারখার করে দিতে চাইছে, তা বর্তমান বিশ্বব্যাপী প্রচলিত বস্তুবাদী শিক্ষা-প্রশিক্ষণের অনিবার্য পরিণতি ছাড়া আর কিছুই নয়। এমন কি জাতিসংঘ (U.N.O) থেকে বিশ্ব-মানবতার সংরক্ষণ, কল্যাণ সাধন ও উন্নতি বিধানের লক্ষ্যে বড় বড় দাবি সহকারে যে সব বই-পুস্তক প্রচার করা হয়, দুঃখের বিষয়, তাও এই ধরণের অতীব সংকীর্ণ দ্বান্দ্বিক ও সাংঘর্ষিক ভাবধারা ও বিদ্বেষাত্মক দৃষ্টিভঙ্গিতে ভরপুর।
এটা হচ্ছে আধুনিক সভ্যতা ও তার প্রধান গার্জিয়ান পাশ্চাত্য প্রবর্তিত শিক্ষা-ব্যবস্থা সৃষ্ট জীবন-দৃষ্টি ও তার জ্ঞানগত মানের পরিধি। এ জীবন-দর্শন ও জ্ঞানগত মান অর্জন এবং তা বিতরণের জন্যেই এসব দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ সদাব্যস্ত ও প্রচণ্ডভাবে কর্মতৎপর। আমরা প্রাচ্যবাসীরাও অন্ধভাবে তাদেরই পদাংক অনুসরণ করে এ ধরণেরই জীবন-দৃষ্টি ও মানস প্রস্তুতি গ্রহণে সর্বশক্তি নিযুক্ত করেছি। এ পথে চলার মধ্যেই জীবন ও জন্মের চরম সার্থকতা নিহিত বলে দৃঢ় প্রত্যয় রাখি। পাশ্চাত্যের চাকচিক্যময় সভ্যতা যে আমাদের চোখকেই ঝলসে দিয়েছে এবং দৃষ্টিশক্তিকে হরণ করেছে, তাতে কোনই সন্দেহ নেই।
ইসলামের জীবন দৃষ্টি
ইসলামের জীবন দৃষ্টি সংক্রান্ত আলোচনায় সর্বপ্রথম উল্লেখ করতে হয় এই বিশ্বলোকে মানুষের স্থান সম্পর্কে। ইসলামের ঘোষণানুযায়ী বিশ্বলোকে মানুষের স্থান সর্বোচ্চে। মানুষের কল্যাণে ও তার ব্যবহারে আসার জন্যে সদাপ্রস্তুত এই গোটা বিশ্বলোক। বাহ্যিক অবয়বের দিক দিয়ে মানুষকে সর্বোত্তম আকার-আকৃতি এবং দেহ কাঠামো ও দেহ-সংস্থা দান করা হয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে মানুষকে দেয়া হয়েছে খিলাফতের মর্যাদা-প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব। মানুষ এ দুনিয়ায় প্রথমে আল্লাহর বান্দাহ। আল্লাহর বন্দেগী, দাসত্ব ও হুকুমবরদারী করাই মানুষের আসল দায়িত্ব ও কর্তব্য। দ্বিতীয়ত, মানুষ এখানে আল্লাহর খলীফা-তার প্রতিনিধি। মানুষকে এই মার্যাদা ও দায়িত্ব দিয়েছে কেবলমাত্র ইসলাম। দুনিয়ার সমাজ ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে অপর কোন একটিতেও মানুষকে এই মর্যাদা দেয়া হয় নি- দেয়া হয়নি তাদেরকে এই সুমহান দায়িত্ব। এ ব্যাপারে ইসলাম একক ও অনন্য ব্যবস্থা-এর কোন তুলনা নেই। আল্লাহর নিকটতম ও অতি সম্মানার্হ সৃষ্টি হল ফেরেশতা। এই ফেরেশতাদেরও নির্দেশ দেয়া হয়েছে মানুষকে সিজদা করার জন্যে। এ-ই যখন অবস্থা, তখন মানুষ আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে সিজদা করতে-অন্য কারোর সামনে মাথানত করতে পারে কিভাবে? মানুষের সেবায় বাধ্য করা হয়েছে সমস্ত সৃষ্টিলোককে-বিশ্বলোকের সমস্ত শক্তিকে। সব কিছুকেই মানুষের ব্যবহারাধীন বানিয়ে দেয়া হয়েছে। কুরআনের ঘোষণা হলঃ
وَسَخَّرَ لَكُم مَّا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا مِّنْهُ ۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَاتٍ لِّقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ
‘‘আকাশমণ্ডলে যা-কিছু আছে আর যা-কিছু রয়েছে পৃথিবীতে, সেই সব কিছুকেই আল্লাহ তা’আলা (হে মানুষ! কেবল) তোমাদেরই কল্যাণে ও ব্যবহারে দৃঢ়ভাবে নিয়োজিত করে দিয়েছেন। আল্লাহর এই ব্যবস্থাপনায় চিন্তাশীল বিবেকবান লোকদের জন্যে অনেক চিন্তা-ভাবনার বিষয় নিহিত রয়েছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই।’’ (সূরা যাসিয়াহঃ ১৩)
আল্লাহ তা’আলা মানুষের সম্মান ও মর্যাদা সম্পর্কে ঘোষণা করেছেনঃ
وَلَقَدْ كَرَّمْنَا بَنِي آدَمَ وَحَمَلْنَاهُمْ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ وَرَزَقْنَاهُم مِّنَ الطَّيِّبَاتِ وَفَضَّلْنَاهُمْ عَلَىٰ كَثِيرٍ مِّمَّنْ خَلَقْنَا تَفْضِيلًا
‘‘নিঃসন্দেহে মানবজাতিকে আমরা বহু সম্মান ও মর্যাদা দান করেছি এবং তাদের বহন করে নিয়েছি স্থলভাগে ও নদীসমুদ্রে আর তাদের রিযিকের ব্যবস্থা করেছি অতীব পবিত্র ও উত্তম উৎকৃষ্ট জিনিস দিয়ে। আর আমার সৃষ্টিকুলের অনেকেরই ওপরে তাদেরকে উচ্চমর্যাদায় অভিষিক্ত করেছি।’’ (সূরা বনী ইসরাঈলঃ ৭০)
সৃষ্টিকুলে মানুষের এই উচ্চতর মর্যাদার পরিপ্রেক্ষিতেই তাদেরকে অতীব উত্তম আকার-আকৃতি দান করা হয়েছে। কুরআন মজিদে বলা হয়েছেঃ
لَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنسَانَ فِي أَحْسَنِ تَقْوِيمٍ
“নিশ্চিতই আমরা মানুষকে অতীব উত্তম কাঠামো ও আকার-আকৃতিতে সৃষ্টি করেছি”। (সূরা ত্বীনঃ ৪)
অতঃপর মানুষকে এই ভুবনে আল্লাহ খলীফা নিযুক্ত করা হয়েছে। মানবসৃষ্টির পূর্বেই তার সৃষ্টির উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা ঘোষণা করেছিলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি দুনিয়ার বুকে খলীফা বানাব’। অর্থাৎ দুনিয়ায় মানুষকে খিলাফতের মর্যাদা দিয়ে- খিলাফতের দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করা হয়েছে। মানুষকে চিন্তা-শক্তি, বিবেক-বুদ্ধি ও ন্যায়-অন্যায় বোধ দেয়া হয়েছে জন্মগতভাবেই। এসব বৈশিষ্ট্য অন্য কোন সৃষ্টিকে দেয়া হয়নি। এর উদ্দেশ্য হল মানুষ এখানে আল্লাহর ‘নায়েব’ বা প্রতিনিধি হয়ে সেই সমস্ত কাজই সুসম্পন্ন করবে, যেগুলো সম্পাদনের জন্যে স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা তাকে নির্দেশ করেছেন। এজন্যে মানুষকে কর্মক্ষমতা দেয়া হয়েছে, সেই সঙ্গে দেয়া হয়েছে কর্ম-বিধান। মানুষকে এখানে বুদ্ধি-বিবেচনা প্রয়োগের অধিকার দেয়া হয়েছে, স্বেচ্ছাচারিতার নয়। তাকে দৈহিক সৌন্দর্য ও শক্তিমত্তার সঙ্গে সঙ্গে আধ্যাত্মিক শক্তি-সামর্থেও বলীয়ান করা হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা ঘোষণা করেছেন, “আমি তাদের দেহে আমারই রূহ ফুঁকে দিয়েছি।“
মানবদেহে যে রূহ বিরাজমান, তা সৃষ্টিকুলের অন্যান্য জীব-জন্তু থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর। আল্লাহ তাকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে মণ্ডিত করেছেন-যেমন মানুষ জীব-জন্তু ও ইতর-প্রাণীকুলের ন্যায় নিছক প্রকৃতি ও প্রবৃত্তি দ্বারা চালিত না হয়, যেন সাধারণ জীব-জন্তু ও পোকা-মাকড়ের ন্যায় নিছক জৈব কার্যাদি সম্পন্ন করেই সে মাটির সাথে মিশে না যায়; বরং তারও ঊর্ধ্বস্থিত খোদায়ী খিলাফতের দায়িত্বও যেন সে পালন করতে পারে। বিশ্বলোকের পরতে পরতে লুক্কায়িত সব সম্পদ ও শক্তি যেন পূর্ণ মাত্রায় ব্যয়িত হতে পারে মানুষের এই খিলাফতের মহান দায়িত্ব পালনে। আর এই সব কাজ করতে গিয়ে মানুষ যেন মুহূর্তের তরেও বিস্মৃত না হয় আল্লাহর সম্মুখে তার আসল মর্যাদার কথা-সে একমাত্র আল্লাহর বান্দাহ্-দাসানুদাস, একমাত্র আল্লাহই তার মা’বুদ। তার হৃদয়ে যেন সর্বদা জাগ্রত থাকে আল্লাহর এই ঘোষণাঃ
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ
‘‘আমি জিন ও মানুষকে কেবলমাত্র আমারই বন্দেগী করার উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছি।’’ (সূরা যারিয়াতঃ ৫৬)
জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে আল্লাহর বন্দেগী করা-আল্লাহর দেয়া বিধান অনুযায়ী দুনিয়ায় সমাজ ও সভ্যতা গড়ে তুলে খিলাফতের দায়িত্ব পালন করাই মানুষের একমাত্র জীবন-উদ্দেশ্য। এ জন্যেই তাকে একটা নির্দিষ্ট মেয়াদের জীবনকাল এবং দুনিয়ার এই বিশাল কর্মক্ষেত্র দান করা হয়েছে। এরূপ সমুচ্চ ও সমুন্নত মর্যাদার অধিকারী মানুষ এক আল্লাহ ছাড়া আর কার সামনে নতি স্বীকার করতে পারে-আনুগত্য স্বীকার করতে পারে আর কোন্ সার্বভৌম শক্তির?
জীবন–উদ্দেশ্য ও মানবীয় মহত্ত্ব
এতৎসত্ত্বেও মানুষ যদি ইতর জীব-জন্তুর ন্যায় নিছক প্রকৃতিগত দাবি-দাওয়া ও সহজাত লালসা-বাসনার দাসত্ব করতে শুরু করে এবং বিশ্বলোকের যেসব শক্তি ও সম্পদকে মানুষের সেবা করার উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করা হয়েছিল, সে সবের দাসত্বে নিজের উন্নত যোগ্যতা ও গুণাবলী ব্যয় করতে শুরু করে তাহলে মানুষ অনিবার্যভাবে তার সুমহান মর্যাদা থেকে বিচ্যুত ও বঞ্চিত হবে। সেটা হবে তার পক্ষে চরম অধঃগতি। সেক্ষেত্রে মানুষ ‘সেরাসৃষ্টি’ হওয়ার মর্যাদা হারিয়ে ফেলবে এবং খিলাফতের দায়িত্ব পালনের কোন যোগ্যতাই তার থাকবে না। অতঃপর সে দুনিয়ার বস্তুগত উপায়-উপকরণের- জীব-জন্তু, পশু-পক্ষী, প্রস্তর ও উদ্ভিদকুলের যতই উৎকর্ষ সাধন করুক না কেন, সে যতক্ষণ তার হারানো মর্যাদা পুনরুদ্ধার না করবে এবং স্বীয় আত্মিক, মানসিক ও মানবিক যোগ্যতা-প্রতিভাবে বিকশিত করে না তুলবে, সে তার সুমহান মানবীয় মর্যাদা কখনো ফিরে পাবে না। কেননা, সৃষ্টিকর্তা সমস্ত সৃষ্টিলোককে মানুষের খেদমতের জন্যে এবং মানুষকে আল্লাহর দাসত্ব-আনুগত্য তথা খিলাফতের দায়িত্ব পালনের জন্যে সৃষ্টি করেছেন। এ কারণে দুনিয়ায় নিছক বস্তুগত উন্নতি বিধান কখনও মানুষের জীবন-লক্ষ্য হতে পারে না; বরং সমস্ত বস্তুগত উন্নতি-উৎকর্ষকে আল্লাহর সন্তোষলাভ ও পরকালীন মুক্তি ও সাফল্য অর্জনে নিয়োজিত করার মধ্যেই মানব জীবনের চরম সার্থকতা নিহিত, অন্য কিছুতে নয়। হাদীসে বলা হয়েছেঃ ‘তোমাদের একটা চরম পরিণতি রয়েছে। সেই পরিণতির জন্যে তোমরা পূর্ণ শক্তিতে প্রস্তুতি গ্রহণ কর।’
(আল কুরআনের ঘোষণা হল) ‘আল্লাহতেই হবে তোমার চরম পরিণতি লাভ।’ জীবন-দর্শনের এ মৌল ভাবধারার ভিত্তিতেই গড়ে ওঠে ইসলামের শিক্ষা-দর্শন। যে শিক্ষায় এ ভাবধারা উপেক্ষিত, তা মানবোপযোগী শিক্ষা হতে পারে না ইসলামের দৃষ্টিতে।
ইসলামের দৃষ্টিতে দেহ ও আত্মা
কিন্তু তাই বলে ইসলামের দৃষ্টিতে এই বস্তুগত দুনিয়া কিছুমাত্র উপেক্ষণীয়, বর্জনীয় বা পরিত্যাজ্য নয়; বরং মানবীয় সৌভাগ্য লাভের চূড়ান্ত মন্যিলে পৌঁছার পথ এই বস্তুগত জগতের মধ্য দিয়েই চলে গেছে। ‘ম্যাটার’ (Matter) এবং ‘স্পিরিট’ (Spirit) এই দুয়ের সমন্বয়েই মানব জীবন তথা মানবদেহ গঠিত। একটি ছাড়া অন্যটির অস্তিত্ব এ বাস্তব দুনিয়ায় অসম্ভব। এ দুটির মধ্যে কোন একটির ওপর অপরটির একক প্রধান্যও জীবনে ও সমাজে চরম বিপর্যয় ঘটায় অবশ্যম্ভাবীরূপে। অতএব, দুটির মধ্যে পুরোমাত্রায় ভারসাম্য (Balance) রক্ষা করা মানব জীবনের সার্বিক কল্যাণের দৃষ্টিতেই অপরিহার্য। কিন্তু ‘বস্তু’ ও ‘প্রাণ-শক্তি’র পারস্পরিক সংযোগ ও সম্পর্ক রক্ষায় ইসলাম যে নির্দোষ ও স্বভাবসম্মত ভারসাম্য উপস্থাপন করেছে, দুনিয়ার অন্য কোন ধর্মবিধান ও সমাজ ব্যবস্থা আজ পর্যন্ত তা পেশ করতে পারেনি। ইসলামের স্বভাবসম্মত ভিত্তি এবং ভারসাম্যপূর্ণ প্রকৃতির এটাই অকাট্য প্রামাণ। মানবদেহ-বস্তু বা Matter-স্রষ্টার মহামূল্য অবদান, মানবজাতির জন্যে অতিশয় প্রয়োজনীয় নিয়ামত। এটা মানুষের নিকট আমানত রাখা হয়েছে। এর সংরক্ষণ ও সুস্থতা বিধান এবং এর যাবতীয় অধিকার যথাযথভাবে আদায় করা ইসলামের দৃষ্টিতে প্রতিটি মানুষের কর্তব্য। পক্ষান্তরে এর কোন ক্ষতি সাধন, এর প্রতি একবিন্দু উপেক্ষা প্রদর্শন এবং এর অধিকারসমূহ আদায় না করা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। এই সব মৌল বৈশিষ্ট্যের গভীর ও সূক্ষ্ণ অধ্যয়ন এবং নব নব আবিষ্কার ও উদ্ভাবনীর মাধ্যমে এগুলোর অন্তর্নিহিত ব্যাপক কল্যাণকারিতার বাস্তব প্রকাশ ঘটানো ইসলামী শিক্ষাদর্শনের অন্যতম লক্ষ্য।
বস্তুত দেহ ও আত্মার পারস্পরিক সংযোজন, সহযোগিতা ও অবিচ্ছিন্নতা একান্তই অপরিহার্য। একটিকে বাদ দিয়ে অপরটির অস্তিত্ব এখানে অসম্ভব। আত্মাহীন দেহ একটি লাশ মাত্র এবং দেহহীন আত্মা বস্তু সম্পর্কহীন একটি বিমূর্ত সত্তা। বর্তমান বস্তুজগতে আত্মা দেহের সঞ্জীবনী ও চালিকা শক্তি। তার সমস্ত দায়িত্ব ও কাজ ‘দেহ’ দ্বারাই আঞ্জাম পেয়ে থাকে। দেহ তার একমাত্র হাতিয়ার, উপায়-উপকরণ। ইসলামের দৃষ্টিতে আত্মার জন্যে দেহ উপায় ও হাতিয়ার মাত্র, এর বেশী কিছু নয়। ‘বস্তু’ নশ্বর উপাদান। কিন্তু আত্মা অবিনশ্বর-শাশ্বত ও চিরন্তন সত্য। এর কোন একটিকে উপেক্ষা করার ভাবধারায় যে বিধান রচিত, তা মানবতার জন্যে একবিন্দু কল্যাণ সাধনে অক্ষম। তাই ইসলামের দৃষ্টিতে ইহকালও যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি বা ততোধিক গুরুত্বপূর্ণ পরকাল। কেননা, ইহকাল নির্দিষ্ট সময়ে সীমিত-তা অবসান বা চূড়ান্ত সমাপ্তির জন্যে অপেক্ষমান। আর পরকাল অনন্ত, অশেষ এবং স্থায়ী। মানুষের আসল কল্যাণ লাভ এখানে সম্ভব নয়-তা সম্ভব পরকালীন জীবনে।
ইসলামের দৃষ্টিতে ইহকাল ও পরকাল
এই দুনিয়া ও প্রাকৃতিক জগত যে কিছুমাত্র নিরর্থক নয়-নিষ্ফল ও মূল্যহীন নয়, কুরআন মজীদের বার বার সে কথা উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষিত হয়েছেঃ
وَمَا خَلَقْنَا السَّمَاءَ وَالْأَرْضَ وَمَا بَيْنَهُمَا لَاعِبِينَ
‘‘আমরা আকাশমণ্ডল ও ভূমণ্ডল এবং এসবের মাঝে যা কিছু আছে, নিছক খেলার ছলে সৃষ্টি করি নি।’’ (সূরা আম্বিয়াঃ ১৬)
এ দুনিয়ার সৃষ্টি-রহস্য যারা জানতে পারে তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই ঘোষণা করতে বাধ্য হয়ঃ
رَبَّنَا مَا خَلَقْتَ هَٰذَا بَاطِلًا
“হে আমাদের প্রতিপালক, তুমি এই সৃষ্টিকুল-আসমান, জমিন ও এদের মধ্যবর্তী সবকিছু-নিরর্থক ও উদ্দেশ্যহীন সৃষ্টি করনি।“(আলে ইমরানঃ ১৯১)
বস্তুত এ পৃথিবী কিছুমাত্র নিরর্থক নয়-উদ্দেশ্যহীন নয়। উদ্দেশ্যহীন কোন বস্তু সৃষ্টি করা আল্লাহর পক্ষে অশোভনীয়-অসম্ভব; বরং এর একটা ইতিবাচক উদ্দেশ্য অবশ্যই রয়েছে। সে উদ্দেশ্যকে সম্মুখে রেখেই এ পৃথিবীর, এ বিশ্বলোকের এবং এখানকার জীবন কালের মূল্যায়ন করতে হবে। বস্তুত উদ্দেশ্যের গুরুত্ব ও জীবনের জন্যে তার অপরিহার্যতা কিছুমাত্র উপেক্ষণীয় নয়, এটা আমাদের গভীরভাবে অনুধাবন করতে হবে।
ইসলাম ও পার্থিব জীবনের যথাযথ মূল্য ও গুরুত্ব স্বীকার করেছে এবং একে উপেক্ষা বা ত্যাগ করার প্রবণতা এবং যে ধরণের মতবাদ দুনিয়া ত্যাগের প্রেরণা দেয়, তার প্রতিবাদ করেছে তীব্র ভাষায়। কুরআনে নেতিবাচক ভাষায় বলা হয়েছেঃ
وَرَهْبَانِيَّةً ابْتَدَعُوهَا مَا كَتَبْنَاهَا عَلَيْهِمْ
“বৈরাগ্যবাদ-দুনিয়া ত্যাগের প্রবণতা-তারা নিজেরা ইচ্ছামত রচনা করে নিয়েছে। আমরা তাদের জন্যে এ ব্যবস্থা দেইনি।“(সূরা হাদীদঃ ২৭)
আর ইতিবাচক ভাষায় ইহকাল ও পরকালের ব্যাপারে পূর্ণ ভারসাম্য রক্ষার জন্যে নির্দেশ দেয়া হয়েছেঃ
وَابْتَغِ فِيمَا آتَاكَ اللَّهُ الدَّارَ الْآخِرَةَ ۖ وَلَا تَنسَ نَصِيبَكَ مِنَ الدُّنْيَا
‘‘আর আল্লাহ তোমাকে এই জীবনে যা-কিছু দিয়েছেন-জীবন, বিবেক-বুদ্ধি, চিন্তাশক্তি, ধন-সম্পদ ও প্রাকৃতিক বস্তু-সামগ্রী ইত্যাদি-সেই সবকিছু ব্যয় ও ব্যবহার করে তুমি পরকালীন কল্যাণ লাভে আকাঙ্ক্ষী ও যত্নবান হবে। আর তা করতে গিয়ে তোমার বৈষয়িক জীবনের অংশ ও প্রাপ্য তুমি কিছুতেই ভুলে যাবে না।’’ (সূরা কাসাসঃ ৭৭)
রাসূলে করীম (সা.) ইরশাদ করেছেনঃ
“তুমি দুনিয়ার জন্যে কাজ করবে এমনভাবে যেন তুমি চিরকালই এখানে থাকবে-বসবাস করবে। আর পরকালের জন্য কাজ করবে এরূপ মনোভাব নিয়ে যেন কালই তোমার মৃত্যু হবে।“
অর্থাৎ এ জীবন ও জীবনের যাবতীয় উপায়-উপকরণ, সময়-অবসর, ধন-সম্পদ, যোগ্যতা-কর্মক্ষমতা, মেধা-প্রতিভা, বিবেক-বুদ্ধি ও শক্তি-সামর্থ্য ব্যবহার করবে-কর্মে নিয়োজিত করবে এক সঙ্গে দুটি উদ্দেশ্যে। একটি হল পরকালীন কল্যাণ আর দ্বিতীয়টি ইহকালীন অর্থাৎ এই বৈষয়িক জীবনের কল্যাণ। ক্ষণস্থায়ী বৈষয়িক কল্যাণের পরিবর্তে চিরস্থায়ী পরকালীন কল্যাণই হবে তোমার চূড়ান্ত লক্ষ্য। কিন্তু তাই বলে বৈষয়িক জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের, তৃপ্তি-সাফল্যের, উন্নতি-সার্থকতার স্বাদ-আস্বাদনের ব্যাপারটি কিছুমাত্র উপেক্ষিত ও পরিত্যক্ত হতে পারবে না। এক সঙ্গে ও একই কাজের মাধ্যমে উভয় কালের কল্যাণ লাভই হবে তোমার চরম লক্ষ্য এবং একটির জন্যে অপরটির কিছুমাত্র উপেক্ষ করা হবে অমার্জনীয় অপরাধ। ইসলাম তা আদৌ সমর্থন করে না; বরং একই কাজের মধ্যে ইহকাল ও পরকাল উভয়কে সমন্বিত করা কেবলমাত্র ইসলামেরই অবদান।
বৈষয়িক জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও চাকচিক্য সম্পূর্ণ বর্জন করাই আল্লাহর উপাসনার মাপকাঠি-দুনিয়ার বৈরাগ্যবাদী লোকদের এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে কুরআন মজীদের নেতিবাচক ভাষায় প্রশ্ন করা হয়েছেঃ
قُلْ مَنْ حَرَّمَ زِينَةَ اللَّهِ الَّتِي أَخْرَجَ لِعِبَادِهِ وَالطَّيِّبَاتِ مِنَ الرِّزْقِ
‘‘বল, দুনিয়ার চাকচিক্য ও সৌন্দর্য বৃদ্ধিকর এবং সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিধানকারী দ্রব্যাদি ও পবিত্র-উৎকৃষ্ট খাদ্য-পানীয় তো আল্লাহ তা’আলা তাঁর বান্দাহদের কল্যাণে ব্যবহারের উদ্দেশ্যেই সৃষ্টি করেছেন; সে সবকে হারাম ও নিষিদ্ধ করে দিতে পারে কে?’’ (সূরা আ’রাফঃ ৩২)
অর্থাৎ এই পৃথিবীর জাঁকজমক, স্বাদ আস্বাদন ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জিনিস ভোগ ও ব্যবহার করা আল্লাহর বন্দেগীর পরিপন্থী নয় এবং আল্লাহর ইবাদত করতে হলে এগুলো বর্জন করতে হবে এরূপ মনে করা একেবারেই ভিত্তিহীন। ইসলাম দুনিয়া ত্যাগের এই বৈরাগ্যবাদী মানসিকতাকে আদৌ সমর্থন করে না। উক্ত আয়াতের পরবর্তী অংশে বলা হয়েছেঃ
قُلْ هِيَ لِلَّذِينَ آمَنُوا فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا
“জানিয়ে দাও, এই সব কিছুই এ দুনিয়ার জীবনে ঈমানদার লোকদের ব্যয়-ব্যবহার ও ভোগ-সম্ভোগের জন্যে সৃষ্ট হয়েছে।“(সূরা আ’রাফঃ ৩২)
অর্থাৎ এসব বর্জন করে চলায় ঈমানদারী নেই। ঈমানদারীর দায়িত্ব পালনের জন্যে এই সবকিছু যে উদ্দেশ্যে ও যে কাজে লাগাবার জন্যে সৃষ্ট হয়েছে, সেই উদ্দেশ্যে ও সেই কাজেই ব্যবহার করা আবশ্যক এবং এ ব্যাপারে অন্যান্যের তুলনায় ঈমানদার লোকদের দায়িত্ব সর্বাধিক।
কুরআন ও হাদীসে ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণ ও সৌন্দর্য তথা সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য লাভের জন্যে একসঙ্গে প্রার্থনা করার শিক্ষা দেয়া হয়েছে। এমনকি, এই প্রার্থনায় বিশেষ একটা কালের ওপর গুরুত্ব আরোপ করতেও নিষেধ করা হয়েছেঃ
فَمِنَ النَّاسِ مَن يَقُولُ رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا وَمَا لَهُ فِي الْآخِرَةِ مِنْ خَلَاق- وَمِنْهُم مَّن يَقُولُ رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الْآخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ- أُولَٰئِكَ لَهُمْ نَصِيبٌ مِّمَّا كَسَبُوا ۚ وَاللَّهُ سَرِيعُ الْحِسَابِ
“লোকদের মধ্যে কেউ কেউ বলেঃ হে আমাদের প্রভূ! আমাদেরকে এই দুনিয়ার জীবনেই দাও…..; এদের জন্যে পরকালে কিছুই প্রাপ্য নেই। আবার এ লোকদের মধ্যে অনেকেই দো’আ করে এই বলেঃ ‘হে আমাদের প্রভূ! আমাদেরকে দুনিয়ায়ও কল্যাণ ও সুন্দর দান কর-সুন্দর ও কল্যাণ দান কর পরকালেও’। এ লোকেরাই তাদের উপার্জনের অংশ পাবে। আর আল্লাহ খুব দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী।“ (সূরা বাকারাঃ ২০০–২০২)
অর্থাৎ ইসলামের দৃষ্টিতে ইহকাল ও পরকাল অবিভাজ্য। যারা এর একটিমাত্র কালকে চাইবে, তারা শুধু অপরটি থেকেই নয় দুটি থেকেই বঞ্চিত হবে। যারা কেবলমাত্র দুনিয়ার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য চাইবে, তারা েএখানেও তা পাবে না এমন কথা বলা হয়নি, বলা হয়েছে-‘পরকালে তারা কিছুই পাবে না।’
বস্তুত মানুষের বৈষয়িক ও জাগতিক জীবনের প্রয়োজনাবলী পূরণ করা এবং স্বীয় অস্তিত্ব রক্ষ ও দ্বীন ইসলাম সংরক্ষণের জন্যে যথাসাধ্য উপায়-উপকরণ, অস্ত্রশস্ত্র ও দ্রব্য-সামগ্রী সংগ্রহ করার আবশ্যকতা ইসলাম শুধু স্বীকার করে নি, তার সুস্পষ্ট নির্দেশও দিয়েছে। একটি আয়াতে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নির্দেশ দেয়া হয়েছেঃ
وَأَعِدُّوا لَهُم مَّا اسْتَطَعْتُم مِّن قُوَّةٍ وَمِن رِّبَاطِ الْخَيْلِ تُرْهِبُونَ بِهِ عَدُوَّ اللَّهِ وَعَدُوَّكُمْ وَآخَرِينَ مِن دُونِهِمْ لَا تَعْلَمُونَهُمُ اللَّهُ يَعْلَمُهُمْ
‘‘আর তোমরা শত্রুদের মুকাবিলা করার জন্যে যতদূর সম্ভব শক্তি-সামর্থ্য ও সজ্জিত ঘোড়া (বাহন) প্রস্তুত করে রাখ। তার দ্বারা তোমরা ভয় দেখাবে আল্লাহর শত্রুদের আর তোমাদের শত্রুদেরও। এদের ছাড়া আরো আরো ভয় দেখাবে সে সব শত্রুকে যাদের কথা তোমরা জাননা, আল্লাহ তাদের জানেন।’’ (সূরা আনফালঃ ৬০)
এ আয়াতের দুটি কথা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। প্রথম কথা, এ আয়াতে সাধারণ বস্তুগত শক্তি সংগ্রহের নির্দেশ দেয়া হয়নি; বরং তার এমন একটা মান ও পরিমাণ সংগ্রহের নির্দেশ দেয়া হয়েছে যদ্দারা সাম্প্রতিক শত্রুদের ভীত-সন্ত্রস্ত করে তোলা যায়। এর ফলে তারা ভয় ও ত্রাসে এতটা দিশেহারা হয়ে পড়বে যে, মুসলিম শিবিরের দিকে চোখ তুলে তাকাতেও সাহস পাবে না। আর দ্বিতীয়, বস্তুগত সরঞ্জাম ছাড়াও একটি জিনিস সংগ্রহ করতে বলা হয়েছে, তা হল ‘কুওয়াৎ’। এ শব্দটি সাধারণ অর্থবোধক। এতে বস্তুগত শক্তি তথা অস্ত্রশস্ত্র ছাড়াও আরো একটি শক্তি বুঝায়, যা নির্বস্তুক এবং ভিন্নতর। এ দ্বারা যেমন নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শক্তি বুঝায়, তেমনি প্রত্যেক যুগের উপযোগী শক্তি-সামর্থ্য ও অস্ত্রশস্ত্রও বুঝায়। সাধারণ সামরিক শক্তির সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক শক্তিও এর অন্তর্ভুক্ত। সাধারণ জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বিশেষ যু্দ্ধ-কৌশল (Strategy) এবং গণ-সমর্থনও এর মধ্যে গণ্য। মোটকথা, শত্রুদমনে ও যুদ্ধজয়ে আদর্শবাদী জনশক্তির সক্রিয় ও সাগ্রহ সহযোগিতা এবং প্রতিটি ব্যাপারে বাস্তব আনুকূল্যের গুরুত্বও অনস্বীকার্য। বস্তুত এ এক সর্বাত্মক ও সর্বমুখী প্রস্তুতি। এর জন্যে যা কিছু দরকার, তা সবই করার জন্যে ইসলামের রয়েছে এক অনমনীয় ও অবশ্য পালনীয় নির্দেশ।
ইসলাম জীবন জীবিকার সুষ্ঠু সন্ধান ও সংগ্রহকে ওয়াজিব করে দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি। তাকে ‘আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান’ নামে অভিহিত করেছে। কেননা, ইহকালের সঙ্গে সঙ্গে পরকালীন সুখ-সুবিধা বিধান এবং ব্যক্তির সঙ্গে সঙ্গে সমাজ ও সমষ্টির সার্বিক কল্যাণ বিধানের জন্যেই ইসলাম এক সর্বাত্মক ও পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। এ জন্যে জীবনের কোন একটা দিকও তার আওতার বাইরে থাকেনি। কুরআন মজীদের এই সব কিছুরই মৌলিক বিধান বলিষ্ঠ ভাষায় ও ভঙ্গিতে উল্লেখিত রয়েছে। কৃষি কাজ, বাগান রচনা, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-সৌকর্য প্রভৃতি কোন কিছুই তাতে বাদ পড়েনি। রাসূলে করীম সা.-এর বাণী সম্পদে (হাদীসে) হস্তশিল্প, ব্যবসা ও জীবিকার্জনের বিভিন্ন পন্থা ও উপায়ের নির্দেশ করার সঙ্গে সঙ্গে পরকালীন মূল্যায়নও ভাস্বর হয়ে রয়েছে।
কিন্তু এতৎসত্ত্বেও অর্থোৎপাদনের সব উপায় ও পন্থা এবং রাষ্ট্র ও দেশ শাসনের সমস্ত পদ্ধতিসহ দুনিয়ার জীবন ইসলামের দৃষ্টিতে পরকালের শাশ্বত ও চিরন্তন জীবনের তুলনায় এক অস্থায়ী ও ক্ষয়িষ্ণু মাধ্যম ছাড়া আর কিছুই নয়। এ দুনিয়ার জীবন একটা পথ মাত্র, চূড়ান্ত মন্যিল নয়। দুনিয়া এবং দুনিয়ার সব কিছুই উপায়-উপকরণ মাত্র-লক্ষ্যস্থল নয়। আসল ও চিরন্তন লক্ষ্যস্থল হল পরকাল। মানুষের প্রকৃতির সাথে এর ধারণার পূর্ণ সঙ্গতি বিদ্যমান।
দুনিয়ায় শুধু ধন-সম্পদের প্রাচুর্যই ইসলামের কাম্য নয়, বৈষয়িক উন্নতিও উন্নতির আসল মানদণ্ড নয়। ইসলামের চূড়ান্ত লক্ষ্য পরকালীন কল্যাণ-সেই কল্যাণের দৃষ্টিতেই এই সব কিছুর মূল্যায়ন অবশ্যম্ভাবী।
‘‘তোমরা তো কেবল বৈষয়িক জীবনকেই অধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে কর। অথচ পরকালীন জীবনটাই আসল কল্যাণের প্রকৃত ক্ষেত্র এবং সেটাই চিরস্থায়ী।’’
تُرِيدُونَ عَرَضَ الدُّنْيَا وَاللَّهُ يُرِيدُ الْآخِرَةَ ۗ وَاللَّهُ عَزِيزٌ حَكِيمٌ
‘‘তোমরা তো দুনিয়ার অস্থায়ী ও ক্ষয়িষ্ণু দ্রব্যাদি লাভ করতে চাও; কিন্তু আল্লাহ (তোমাদের জন্যে) চান পরকাল। আর আল্লাহ্ সর্বজয়ী ও সুবিজ্ঞানী।’’ (সূরা আনফালঃ ৬৭)
أَرَضِيتُم بِالْحَيَاةِ الدُّنْيَا مِنَ الْآخِرَةِ ۚ فَمَا مَتَاعُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا فِي الْآخِرَةِ إِلَّا قَلِيلٌ
‘‘তোমরা পরকাল বাদ দিয়ে কেবল দুনিয়ার জীবন পেয়েই খুশীতে বাগ বাগ হয়ে গেলে? ……. কিন্তু আসলে পরকালের তুলনায় দুনিয়ার জীবনের সমস্ত সামগ্রী নিতান্তই স্বল্প-অপর্যাপ্ত। (এ কথা তোমরা ভুলে যেতে পার কেমন করে?)।’’ (সূরা তওবাঃ ৩৮)
এই প্রেক্ষিতে পরকালকে উপেক্ষা করে কেবল বৈষয়িক জীবনের উন্নতি-উৎকর্ষ ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য অর্জনের জ্ঞানলাভ কখনো যথার্থ ও কল্যাণকর শিক্ষা-নীতি হতে পারে না। মানুষের জন্যে একমাত্র কল্যাণবহ শিক্ষা নীতি তা-ই যা ইহকাল ও পরকাল উভয়ের সার্বিক কল্যাণ-দৃষ্টিতে রচিত। কেননা, ইহকাল-পরকাল সমন্বয়ে মানুষ এক অখণ্ড জীবন-সত্তা। এর এক অংশ উপেক্ষিত হলে অপর অংশ উপেক্ষার আঘাতে পঙ্গু হয়ে যায় অবশ্যম্ভাবীরূপে। দুনিয়ার কোন শিক্ষা দর্শনই মানুষের এই দু পর্যায় সমন্বিত জীবন-সত্তা সম্পর্কে কোন ধারণা লাভ করতে পারেনি। তাই পারেনি এমন শিক্ষা-দর্শন রচনা করতে, যা এই অখণ্ড জীবন সত্তার সার্বিক কল্যাণের বাস্তব দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করতে সমর্থ। ইসলাম-কেবলমাত্র ইসলামই এই ধরণের শিক্ষাদর্শন তথা শিক্ষানীতির উদ্ভাবক।
অখণ্ড মানবতা ও ইসলাম
বিশ্বলোকের অন্তর্নিহিত সত্য ও বাস্তবতা, বিশ্বলোকে মানবজাতির প্রকৃত স্থান ও মর্যাদা (Position) দেহ ও আত্মার পারস্পরিক নিবিড় সম্পর্ক, ইহকাল-পরকালের অবিচ্ছিন্নতা ও অখণ্ডতা এবং বৈষয়িক দুনিয়ার নশ্বরতা ও পরকালীন জীবনের চিরন্তনতা সম্পর্কে ইসলামী দৃষ্টিকোণ ও মতবাদ ওপরে সংক্ষিপ্তভাবে বিবৃত হয়েছে। সেই সঙ্গে ইসলামের বিশ্ব-মানবতা সংক্রান্ত দৃষ্টিকোণও অবশ্যই বিবেচ্য। তাহলেই ইসলামের সামগ্রিক ও পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা-দর্শন ও শিক্ষানীতি আরো সুস্পষ্টরূপে প্রতিভাত হয়ে উঠবে।
ইসলামের দৃষ্টিতে সৃষ্টিকর্তার সন্তোষ বিধানই মানবজীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য। কুরআনের ঘোষণাঃ ‘তোমার আল্লাহর দিকেই চূড়ান্ত পরিণতি’।
কুরআনের সুস্পষ্ট নির্দেশ হলঃ
قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ
‘‘বল, আমার নামায, আমার ইবাদত-বন্দেগী, আমার কুরবানী, আমার জীবন এবং আমার মৃত্যু-সব কিছুই সারে জাহানের রব্ব্ আল্লাহর উদ্দেশ্যেই নিবেদিত।’’ (সূরা আন’আমঃ ১৬২)
বলা বাহুল্য যে, এই চেতনার পূর্ণ বাস্তবায়ন পরকালেই সম্ভব হবে। কেননা, পরকালীন কল্যাণ মানুষের জন্যে শেষ মনযিল রূপে নির্দিষ্ট হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে যে অপরিমেয় সম্পদ ও নেয়ামতের দিকে মানবীয় চিন্তা ও কর্মকে আমন্ত্রিত করা হয়েছে, তাও অসীম-অশেষ। মানুষের মাঝে স্বাভাবিকভাবে যে অসীমতার আকাঙ্ক্ষা প্রবল, তারও পূর্ণ চরিতার্থতার ব্যবস্থা রয়েছে এতে। আর এই লক্ষ্যেই ‘বিশ্ব-মানবতা’র পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও প্রতিযোগিতার পুরোপুরি ব্যবস্থাও গৃহীত হয়েছে। উদ্দেশ্য ও আদর্শের এই সুস্পষ্ট ঐক্য ও বিশাল-বিস্তৃত ভাবধারার দরুন মানুষের বিভিন্ন বংশ-গোত্র ও দেশভিত্তিক জাতীয়তার সংকীর্ণতা স্বতঃই নিঃশেষিত হয়ে গেছে। এ কারণেই ইসলাম সংকীর্ণ বস্তুগত ভিত্তিতে মানব জাতির বিভক্তি-বিভাজন নীতির তীব্র প্রতিবাদ করেছে; বরং এতে সমস্ত মানুষকে একটি বৃহত্তর লক্ষ্যবিন্দুর দিকে চালিত করতে চেষ্টা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে ইসলাম পারস্পরিক সম্বন্ধ-সম্পর্ককে অধিকতর দৃঢ় করে তোলার ওপরও বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে। মানব-জাতির এই আদর্শিক ঐক্য ও অভিন্নতার কোন দৃষ্টান্ত দুনিয়ার অন্য কোন ধর্মে বা মতাদর্শে দেখতে পাওয়া যায় না।
বস্তুত ইসলামী ঐক্য-চেতনা ও সামষ্টিক সাম্যবাদের ভিত্তি আধ্যাত্মিক ও আন্তরিক একাত্মতার ওপর স্থাপিত। কোন বাহ্যিক বা বস্তুগত পার্থক্য এখানে মোটেই বিবেচ্য নয়। অতএব, পাশ্চাত্য সমাজ-দর্শনে নিহিত বর্ণ-ভাষা, ভৌগোলিকতা, দেশমাতৃকা, ধন-সম্পদের পরিমাণ-পার্থক্য এবং বিভিন্ন লৌকিক সভ্যতা-সংস্কৃতি ও সাহিত্য-শিল্পের মনগড়া ঐক্যবন্ধন কি করে ইসলামের মানে উত্তীর্ণ হতে পারে?
পাশ্চাত্য উদ্ভাবিত আধুনিক শিক্ষা জাতীয়তা, আন্তর্জাতিকতা বা ‘জাতিসংঘে’র যে-ধারণা পেশ করেছে, তার ভিত্তি নিতান্তই দুর্বল ও ক্ষণভংগুর। যে সমাজে সত্য, ন্যায়, সুবিচার, সদাচরণ, দানশীলতা, সহযোগিতা, যুদ্ধ ও সন্ধি এবং অগ্রাধিকার দানের ভিত্তি হচ্ছে মানুষের গায়ের বর্ণ, মাতভাষা ও ভৌগোলিক আঞ্চলিকতা, ইসলামের দৃষ্টিতে তা মানুষের উপযোগী নীতিমালা নয়। এ নীতি মানব সমাজে সম্পূর্ণ অচল, অমানবিক এবং নিতান্তই অবিচারমূলক।
মানবীয় একত্ব ও ব্যাপকতা
আধুনিক শিক্ষাদর্শন ও শিক্ষা সংক্রান্ত যাবতীয় মতাদর্শ খৃস্টবাদের ক্রোড়ে ভূমিষ্ট ও লালিত-পালিত। এ কারণেই এ শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে দ্বীন ও দুনিয়া তথা ধর্ম ও সমাজ এবং ইহকাল ও পরকালেরর দ্বৈততার ওপর। এরই ফলে খৃষ্ট ধর্ম কয়েকটি আকীদা-বিশ্বাস, নৈতিক আচার-আচরণ ও উপাসনা সংক্রান্ত কতিপয় অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ। সমাজ, রাজনীতি, রাষ্ট্রব্যবস্থা ও অর্থনীতির সাথে এ ধর্মের দূরতম কোন সম্পর্কও নেই। তাই ধর্ম সম্পর্কে ব্যাপক কোন ধারণা এ শিক্ষাব্যবস্থায় খুঁজে পাওয়া যায় না। মানুষের ঐক্য, একতা ও অভিন্নতা পর্যায়ে বিন্দুমাত্র ধারণাও এ ব্যবস্থায় ‘শিক্ষাপ্রাপ্ত’ লোকদের মনে-মগজে স্থান পায়নি।
পক্ষান্তরে ইসলাম এক পূর্ণাঙ্গ ও সর্বব্যাপক জীবন-বিধান। মানুষের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবনের সমস্ত ক্ষেত্র ও ব্যাপার সম্পর্কে ইসলামের শিক্ষা অত্যন্ত সমুজ্জ্বল। মানুষের বাস্তব জীবনধারাকে বিশ্লেষণ করা হলে তিনটি পর্যায় সুস্পষ্ট হয়ে ওঠেঃ
ক. ব্যক্তির সম্পর্ক তার স্রষ্টার সঙ্গে-আনুষ্ঠনিক ইবাদতসমূহই হল এ সম্পর্কের বাস্তব রূপ।
খ. ব্যক্তির সম্পর্ক দুনিয়ার অন্যান্য মানুষ ও সৃষ্টিকুলের সঙ্গে- সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবন এই সম্পর্কের অভিব্যক্তি।
গ. ব্যক্তির সম্পর্ক স্বয়ং তার নিজের সঙ্গে- এ সম্পর্কেরই অপর নাম চরিত্র বা নৈতিকতা।
ইসলাম এই সবকটি দিক ও বিভাগেই মানুষকে সুস্পষ্ট বিধান দিয়েছে। এই সব ক’টি বিভাগ সম্পর্কে ইসলাম ‘আঙ্গিক একত্ব ও অবিচ্ছিন্নতার’ ব্যাপক ধারণা পেশ করেছে। দুনিয়ার অন্যান্য ধর্ম ও মতাদর্শ তথা সমাজব্যবস্থার তুলনায় ইসলামের বৈশিষ্ট্য, বিশেষত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব এখানেই অনুধাবনীয়। এতে ঈমান আমলের সমস্ত ভাবধারা এতই সুসংবদ্ধ ও অবিচ্ছিন্ন যে, এই সব ক’টি ক্ষেত্রে ইসলামী আদর্শ কার্যকর না হলে মানুষের ধর্মীয় জীবন ও পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভে ব্যর্থ হতে বাধ্য। তাই ইসলামী শিক্ষা-দর্শনেও এই সামগ্রিক রূপ প্রতিভাত হওয়া একান্তই অপরিহার্য। কিন্তু পাশ্চাত্য শিক্ষা-দর্শন এই সামগ্রিকতার চেতনা থেকে সম্পূর্ণরূপে বঞ্চিত।
ইসলাম মানুষেকে শুধু অধিকারের (Rights) কথাই শিখায় না। সেই সঙ্গে তার কর্তব্যের (Obligations) কথাও বলিষ্ঠভাবে ও বিশেষ গুরুত্ব সহকারে শিক্ষা দেয়। যে শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীরা এক সঙ্গে তাদের কর্তব্য ও অধিকার উভয় দিকে পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান অর্জন করার সুযোগ পায় এবং উভয় দিকের দায়িত্ব এক সঙ্গে পালন করার অদম্য প্রেরণা লাভ করে, তা-ই মানুষের জন্যে ভারসাম্যপূর্ণ (Well-balanced) শিক্ষা ব্যবস্থা। ইসলাম মানুষকে প্রথমে আত্মচেতনায় বলিষ্ঠ করে তোলে। সেই সঙ্গে স্রষ্টা ও সৃষ্টি উভয় দিকের কর্তব্য এবং উভয় দিক সম্পর্কে নিজের দায়িত্বের কথা বিশদভাবে জানিয়ে দেয়। ইমাম আবূ হানীফা র. ইসলামী ব্যবহার শাস্ত্রের সংজ্ঞা দিয়েছেন এই ভাষায়ঃ
‘‘নিজেকে চেনা, সেই সঙ্গে নিজের কি অধিকার এবং অন্যের (স্রষ্টা ও সৃষ্টির) প্রতি তার কি কি দায়িত্ব ও কর্তব্য, তা বিশদভাবে জানতে পারাই ইসলামের ব্যবহারিক শাস্ত্র বা বিধান।’’
মানুষ নিজের ক্ষমতা বা ইচ্ছায় এই জগতে আসতে পারেনি। সে স্রষ্টার সৃষ্টি। স্রষ্টা তাকে বিশেষ ক্ষমতা, যোগ্যতা ও প্রতিভা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন তাঁর বন্দেগী ও মানুষের কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে। ইসলামী শিক্ষা-দর্শনের মৌল ভাবধারা এখানেই বিধৃত। নামায-রোযা, হজ্জ-যাকাত, বিয়ে-তালাক, সন্তান প্রজনন, সন্তান পালন, সামাজিক সদাচার, সুবিচার-ইনসাফ, বিচার-সালিশ ও ন্যায়পরায়ণতা থেকে শুরু করে শিক্ষা-সভ্যতা-সংস্কৃতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, লেন-দেন, নৈতিকতা ও আধ্যাত্মবাদ, কৃষি-শিল্প, রাজনীতি, রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও রাষ্ট্র-শাসন, আইন ও বিচার, অর্থনীতি, অর্থোপার্জন ও ব্যয়-বণ্টন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক-সম্বন্ধ, যুদ্ধ-সন্ধি ও জোটগঠন-এসব কিছুই ইসলামী ব্যবহার শাস্ত্রের আওতাভুক্ত। এতেই রয়েছে মানুষের বস্তুগত, মানসিক, নৈতিক আধ্যাত্মিক-সর্বদিকের লালন-পালন, বিকাশ সাধন ও উন্নয়নের বিপুল প্রেরণা। ইসলামী শিক্ষা-ব্যবস্থা এই ব্যাপক ও অখণ্ড ভিত্তির ওপর সংস্থাপিত ও প্রতিফলিত। একটি মাত্র দিক সম্পর্কিত শিক্ষা মানুষ গড়ার শিক্ষা হতে পারে না। তাই ইসলামী শিক্ষার বাস্তব রূপ বিশ্বনবীর দরবারে লক্ষণীয়। অন্য কোথাও তার ভাবমূর্তি খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। ইসলাম স্রষ্টার আরাধনা-উপাসনার কয়েকটি অনুষ্ঠানের শিক্ষা দিয়ে শিক্ষা দানের দায়িত্ব এড়াতে সম্পূর্ণ নারাজ। পক্ষান্তরে কেবলমাত্র বৈষয়িক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য লাভের উপায় সংক্রান্ত জ্ঞান দিয়েই ইসলাম মনে করে না যে, মানুষের প্রয়োজনীয় শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়ে গেল। দুনিয়ার প্রয়োজনীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থীর অন্তর ও হৃদয় পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র করে তোলার দায়িত্ব এক সঙ্গে পালন করার সংকল্পে ইসলামের দৃঢ়তা অপরিবর্তনীয়। কুরআনের বিশ্ব নবীর শিক্ষাদান পদ্ধতি বর্ণনায়ও তা ধ্বনিত ও ঝংকৃত।
يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ
‘‘তিনি (রাসূল) লোকদের সামনে আল্লাহর নিদর্শনাদি পেশ করেন, তাদের পবিত্র, পরিচ্ছন্ন ও পরিশুদ্ধ করেন। আর তাদের সামগ্রিক বিধানসম্পন্ন কিতাবের শিক্ষাদান করেন এবং শেখান বুদ্ধি-প্রজ্ঞা ও বিবেচনা পদ্ধতি।’’ (সূরা জুম’আঃ ২)
কুরআনের নির্দেশ হলঃ
‘‘বাহ্যিক দিক দিয়ে যা পাপ তাও পরিহার কর-পরিহার কর যা পাপ ভিতরের দিক থেকে।’’
তাই ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থায় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পূণ্যময় কাজের নির্দেশনার সাথে সাথে যাবতীয় বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ পাপ জানিয়ে দেয়া এবং তা থেকে নিজেকে রক্ষা করার প্রবণতা তীব্র করে তোলা অপরিহার্য। পূর্ণাঙ্গ ইসলামী শিক্ষায় জীবনের কোন একটি দিকও অজ্ঞানতার অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকতে পারে না। সকল দিকের সব তত্ত্ব, তথ্য ও বিধান উজ্জ্বল ও উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে শিক্ষার্থীর জ্ঞান-দৃষ্টির পরিধিতে ও পরিমণ্ডলে। এ-ই হচ্ছে ইসলামী শিক্ষার সুফল।
ইসলামী শিক্ষার বিপ্লবী ভাবধারা
ইসলামী শিক্ষা শিক্ষার্থীর স্কন্ধে নিছক তত্ত্ব ও তথ্যের দুর্বহ বোঝা চাপিয়ে দিয়েই ক্ষান্ত হয় না; তা শিক্ষার্থীর মনে-মগজে এক বিপ্লবী ভাবধারাও জাগিয়ে দেয়। ইসলামের দৃষ্টিতে শুধু জানাই লক্ষ্য নয়, প্রকৃত বিষয় জানতে হবে, যথার্থ সত্য ও সনাতনকে জানতে হবে এবং সেই জানার পর যে মহাসত্য উদ্ঘাটিত হবে তাকে নিজের জীবনে, সমাজে ও পরিবেশে বাস্তবায়িত করবার জন্যে প্রাণ-পণ চেষ্টা চালাতে হবে। প্রকৃত সত্যকে জানার পর শিক্ষার্থী তার নিজের মন-মগজের- আকীদা-বিশ্বাসের, আমল ও চরিত্রের, নিজের পরিবেশ-পরিমণ্ডলের অবস্থা যাচাই করবে এবং লব্ধ পরম সত্যের পরিপন্থী যেখানে যা কিছু পাওয়া যাবে তা দূর করার জন্যে উদ্বুদ্ধ হবে। অন্যায়, অসত্য, বাতিল ও মিথ্যার সাথে সে সমঝোতা করতে প্রস্তুত হবে না; বরং তার নিজের জানা চূড়ান্ত সত্যের মানদণ্ডে যা কিছু বিপরীত প্রমাণিত হবে তাকে যথানিয়মে দূর করার জন্যে চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালানোই শিক্ষার্থীর অনিবার্য দায়িত্ব বলে মনে করবে। ইসলামের দৃষ্টিতে নিছক শেখা, শিক্ষার নামে কতকগুলো তত্ত্ব ও তথ্যের আবর্জনা পুঞ্জীভূত করে তোলার নাম শিক্ষা নয়। অন্যকথায়, ইসলামের শিক্ষা উদ্দেশ্যহীন নয়, আদর্শহীন নয়, প্রেরণাহীন নয়; তা প্রকৃতপক্ষেই মানুষের জন্যে সঞ্জীবনী সুধা।
ইসলামী শিক্ষার্থীকে একটি ‘মিশন’ দেয়, জীবনের একটা কাজ দেয়, একটা কার্যসূচী দেয়; একটা বিপ্লবী ভাবধারাপূর্ণ আবেদন জন-সমক্ষে পেশ করার জন্যে তা শিক্ষার্থীকে উদ্বুদ্ধ করে। ইসলাম যে ধরণের শিক্ষার তাকীদ করেছে, যে শিক্ষা না থাকার দরুণ তীব্র আপত্তি তুলেছে, তা হল এই শিক্ষা। কুরআন মজীদে প্রশ্ন তোলা হয়েছেঃ
فَلَوْلَا نَفَرَ مِن كُلِّ فِرْقَةٍ مِّنْهُمْ طَائِفَةٌ لِّيَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ وَلِيُنذِرُوا قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوا إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُونَ
‘‘প্রত্যেক বিচ্ছিন্ন জন-সমষ্টি থেকে কিছুসংখ্যক লোক কেন বের হয়ে যায় না এ উদ্দেশ্যে যে, তারা ‘দ্বীন’ সম্পর্কে গভীর জ্ঞান ও ব্যুৎপত্তি অর্জন করবে এবং তারা যখন নিজেদের জনগণের নিকট ফিরে আসবে, তাখন তারা তাদের প্রকৃত ব্যাপার ও পরিণতি সম্পর্কে সাবধান ও সতর্ক করে তুলবে। …….এভাবেই হয়ত তারা সতর্ক ও সত্য পথগামী হয়ে উঠবে।’’ (সূরা তওবাঃ ১২২)
এ আয়াতের ঘোষণা অনুযায়ী শিক্ষা মৌল উদ্দেশ্য হল ‘দ্বীন’ সম্পর্কে পরিপূর্ন ও ব্যাপক জ্ঞান অর্জন, দ্বীন সম্পর্কে গভীর ব্যুৎপত্তি ও দক্ষতা লাভ। আর দ্বীন বলতে বুঝায় জীবনের সমগ্র দিক ও বিভাগ-স্রষ্টা, আত্মসত্তা, সৃষ্টিলোক, বিশ্ব নিখিল, সমগ্র প্রাকৃতিক জগত তথা ইহকাল ও পরকাল সংক্রান্ত তাবৎ বিষয়। কিন্তু এই জ্ঞান ও ব্যুৎপত্তি লাভই চরম লক্ষ্য নয়। চরম লক্ষ্য হল সাধারণ মানুষের মধ্যে সে জ্ঞান, তত্ত্ব ও তথ্য প্রচার করা, তাদেরকেও সে বিষয়ে পুরোপুরি অবহিত করা এবং তদনুযায়ী জীবন ও সমাজ গঠনের জন্যে তাদেরকে সজাগ ও সক্রিয় করে তোলা।
ইসলামী শিক্ষা দর্শন শিক্ষার্থীদের একটি আহ্বান বাণী শিখিয়ে দেয় এবং সেই আহ্বান লোক সমক্ষে পেশ করার জন্যে অনুপ্রাণিত করে। কুরআনী পরিভাষায় সে আহ্বান দাওয়াতুল হক বা ‘সত্যের আহ্বান’ নাম অভিহিত। এই ‘দাওয়াতের’ মূল্য ও মর্যাদা সম্পর্কে কুরআন মজীদ ঘোষণা করেছেঃ
وَمَنْ أَحْسَنُ قَوْلًا مِّمَّن دَعَا إِلَى اللَّهِ وَعَمِلَ صَالِحًا وَقَالَ إِنَّنِي مِنَ الْمُسْلِمِينَ
‘‘যে লোক আল্লাহর দিকে মানুষকে আহ্বান জানাল, নিজে তদনুযায়ী নেক আমল করল এবং উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করল যে, আমি একজন মুসলমান, তার চাইতে উত্তম কথা আর কেউ বলছে না-এর চেয়ে উত্তম ও অধিক কল্যাণকর আহ্বান আর কিছু হতে পারে না।’’ (সূরা হা–মীম আস্–সাজদাহঃ ৩৩)
বস্তুত ইসলামী শিক্ষা-ব্যবস্থা শিক্ষার্থীদেরকে আল্লাহর দিকে আহ্বান জানাবার এক অতুলনীয় ও অতীব উত্তম মন্ত্রে দীক্ষিত করে। এই মন্ত্রে দীক্ষিত হবার পর প্রথমত এ মহান আহ্বানের পূর্ণ প্রতিফলন ঘটে তার নিজের মনে, জীবনে ও চরিত্রে। অতঃপর তার মন-মানসে স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যয়ের দৃঢ়তা, আদর্শিক বলিষ্ঠতা ও নিজের আদর্শিক পরিচয়ে অকুণ্ঠতার সঞ্চার হয়। ফলে সে উদাত্ত কণ্ঠে ‘ইসলামী আদর্শবাদী’ বা ‘ইসলামী আদর্শানুসারী’ মুসলিম রূপে বিশ্বসমাজে নিজেকে পরিচিত করাতে একবিন্দু সংকোচ বা লজ্জাবোধ করে না। যে শিক্ষা মানুষকে মিনমিনে, সংশয়িত, শংকিত, অকর্মণ্য বা অপদার্থ বানিয়ে দেয়, যে শিক্ষা শিক্ষার্থীর চিত্তকে স্বতঃস্ফূর্ত করে না, যে শিক্ষা মানুষের উন্নত স্বভাব ও চরিত্রের সৃষ্টি করেনা, সর্বোপরি যে শিক্ষা তাকে কথা ও কাজে অভিন্ন, অকৃত্রিম, উদার, নির্ভীক ও সাহসী বানায় না, তা তত্ত্ব ও তথ্যে যতই স্ফীত ও সমৃদ্ধ হোক না কেন, শিক্ষার্থীর নামের শেষে যত বড় বড় ডিগ্রীর লেজুড় জুড়ে দেয়া হোক না কেন, তা মানুষের কোন কল্যাণ সাধনে আদৌ সমর্থ হতে পারে না- না ইহকালীন কল্যাণ না পরকালীন।
এরই অনিবার্য পরিণতিতে ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিতরা বিশ্ব-নেতৃত্বের আসনে সমাসীন হওয়ার মতো যোগ্যতার অধিকারী হয়। কেননা, যারা মহান আদর্শে নিজেরা উজ্জীবিত হয়ে নির্বিশেষ বিশ্বের সমস্ত মানুষের সামনে সে আদর্শ উপস্থাপন করার দায়িত্ব গ্রহণ করে, তারাই তো হয় বিশ্ববাসীর শিক্ষাগুরু, পথ-প্রদর্শক ও অগ্রনেতা। আর তারাই হতে পারে বিশ্বের গোটা জনমানবের মাঝে সর্বোত্তম লোক হওয়ার উপযুক্ত দাবিদার। কুরআনের ঘোষণাঃ
إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ أُولَٰئِكَ هُمْ خَيْرُ الْبَرِيَّةِ
‘‘বস্তুত যারাই ঈমান এনেছে ও তদনুযায়ী নেক আমল করেছে, তারাই সর্বোত্তম সৃষ্টি।’’ (সূরা বায়্যিনাতঃ ৭)
‘সর্বোত্তম’ হওয়ার এই কুরআনী ঘোষণা ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত লোকদের কোন অবাঞ্ছিত অহমিকা কিংবা Superiority Complex জাগায় না- জাগায় গভীর আত্মবিশ্বাস, দায়িত্ব-চেতনা, আদর্শের প্রতি ঐকান্তিক নিষ্ঠা ও অহংবোধ। আর বিশ্বের নেতৃত্ব দানে এ গুণগুলো একান্তই অপরিহার্য। লোকদের মাঝে এ চেতনা জাগ্রত করাই আয়াতটির লক্ষ্য।
ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার একটা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল, তা জনগনের মধ্যে পরিপূর্ণ ঐক্য ও একত্ববোধ জাগিয়ে দেয়। এ ঐক্য ও একত্ববোধ তিনটি ক্ষেত্রেই কার্যকর হয়ঃ
১. ঈমানী ঐক্য ও একত্ব- আকীদা-বিশ্বাস, বিশ্ব-দর্শন ও জীবন-উদ্দেশ্যে অভিন্নতা,
২. কর্মের ঐক্য ও একত্ব- বাস্তব কর্মক্ষেত্রে আঙ্গিকে ও সাংগঠনিক ঐক্য ও একত্ব এবং
৩. মানবীয় ঐক্য ও একত্ব- সব ব্যক্তি মানুষই মৌলিক ও মানবিক দিক দিয়ে অভিন্ন ও সমতুল্য।
এই মনোবৃত্তি ও কার্যধারাই ইসলামী শিক্ষার বিশেষত্ব।
বস্তুত ঈমানী ঐক্য ও একত্বই যে একটা জাতির সর্বাপেক্ষা বড় শক্তি তা সর্বজনবিদিত। ঈমান-আকীদা, ধারণা-বিশ্বাস, উদ্দেশ্য-লক্ষ্য ও মনোভাব-মূল্যবোধের অভিন্নতাই বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত লোকদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে; তাদের সম্মিলন ও সহযোগিতায় গড়ে ওঠে এক অখণ্ড জনসমাজ। এই সমাজেরই বৃহত্তর রূপকে বলা হয় ‘জাতি’। একটা জাতির আদর্শিক অস্তিত্ব তার লোকদের ঈমান-আকীদা, চিন্তা-বিশ্বাস ও মতবাদ-মনোভাবে পরম ঐক্যের ওপর নির্ভরশীল। যে জাতির লোকজনের মধ্যে এ ঐক্য নেই, সে জাতি ‘জাতি’ নামে অভিহিত হওয়ারই যোগ্য নয়। আর যে জাতির মধ্যে এ ঐক্য ও একত্ব রয়েছে, সে জাতিই বিশ্ব-নেতৃত্বের সুউচ্চ আসনে সমাসীন হওয়ার অধিকারী। মুসলিম ব্যক্তি ও সমাজ সমন্বয়ে একদিন যে জাতি গড়ে উঠেছিল, সে জাতির এই গুণটিই ছিল প্রধান এবং উত্তরকালে এ জাতিই হয়েছিল বিশ্বনেতা। এ জাতির প্রতি কুরআনের নিদের্শ ছিলঃ
وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا ۚ وَاذْكُرُوا نِعْمَتَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ إِذْ كُنتُمْ أَعْدَاءً فَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوبِكُمْ فَأَصْبَحْتُم بِنِعْمَتِهِ إِخْوَانًا
‘‘তোমরা সকলে মিলে আল্লাহর ‘রুজ্জু’ দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর নিয়ামতের কথা স্মরণ কর, যখন তোমরা পরস্পরের শত্রু ছিলে। পরে আল্লাহ্ই তোমাদের অন্তরসমূহকে পরস্পর সম্প্রীতিপূর্ণ করে দিলেন; ফলে আল্লাহর অনুগ্রহক্রমেই তোমরা পরস্পরের ভাই হয়ে গেলে।’’ (সূরা আলে ইমরানঃ ১০৩)
‘আল্লাহর রজ্জু’ বলতে কি বোঝান হয়েছে এ আয়াতে? আল্লাহর রজ্জু হল আল্লাহর কিতাব। এই কিতাব সম্পর্কেই বলা হয়েছে অপর আয়াতেঃ
نَزَّلَ عَلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ مُصَدِّقًا لِّمَا بَيْنَ يَدَيْهِ وَأَنزَلَ التَّوْرَاةَ وَالْإِنجِيل- مِن قَبْلُ هُدًى لِّلنَّاسِ وَأَنزَلَ الْفُرْقَانَ
‘‘আল্লাহ্ই তোমাদের প্রতি আল-কিতাব নাযিল করেছেন তা পূর্বে নাযিলকৃত তওরাত ও ইন্জীলের সত্যতা ঘোষণাকারী, তা জন-মানুষের সংবিধান এবং তা (বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীদের মাঝে) পার্থক্য সৃষ্টিকারী রূপে নাযিল করেছেন।’’ (সূরা আলে ইমরানঃ ৩–৪)
ইসলামী আদর্শের মৌল বিশ্বাস ও তার উপদানসমূহ আরো একটি দিক দিয়ে ঐক্য ও একত্বের বাণী বহন করে এনেছে। ইসলামের দাবি এ নয় যে, দুনিয়ায় কখনই কোন দ্বীন আসেনি; বরং তার দাবি হল, মানব সমাজকে ঐক্য ও একত্বের বুনিয়াদে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে মানবসৃষ্টির সূচনা থেকেই খোদায়ী পথ-প্রদর্শনের ধারা সূচিত হয়েছে এবং তা অব্যাহতভাবে চলে এসেছে। আল্লাহর কুরআন এই ধারারই সর্বশেষ নির্দেশিকা। ফলে এই ধারায় কোন অসম্পূর্ণতাই থাকতে পারেনি। উপরি-উদ্ধৃত আয়াত একথাই ঘোষণা করেছে এবং এ ঘোষণায়ও সেই ঐক্য ও একত্বের মহিমাই ঝংকৃত হয়েছে। ইসলামী শিক্ষা দর্শনের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্যও এখানে যে, তা অপূর্ব ও অভিনব হওয়ার দাবি করে না। তাতে ইতিপূর্বে আসা অপরাপর খোদায়ী বিধানের সত্যতা পূর্ণ মাত্রায় স্বীকৃত। কুরআনের দৃষ্টিতে দুনিয়ার এই সমগ্র মানুষ এক অখণ্ড জাতির অন্তর্ভুক্ত। অতএব এ জাতীয় একত্ব ও অখণ্ডতা সর্বপ্রযত্নে রক্ষণীয়ঃ
وَإِنَّ هَٰذِهِ أُمَّتُكُمْ أُمَّةً وَاحِدَةً وَأَنَا رَبُّكُمْ فَاتَّقُونِ
‘‘তোমাদের এই জাতি আসলে এক অখণ্ড জাতি। আর আমি (আল্লাহ) একাই তোমাদের সকলের প্রভু ও মালিক। অতএব তোমরা কেবল এক আমাকেই ভয় ও সমীহ করে চলবে।’’ (সূরা মুমিনুনঃ ৫২)
এরূপই অপর এক আয়াতের শেষ শব্দ হয় ‘ফাঅবুদুন’- ‘অতএব তোমরা কেবলমাত্র আমারই বন্দেগী ও দাসত্ব কবুল কর’। (আল–আম্বিয়াঃ ৯২)
কুরআনের ব্যাখ্যানুযায়ী এ জাতিকে ‘মুসলিম নামে সর্বপ্রথম অভিহিত করেছিলেন হযরত ইবরাহীম আ.। আমাদের জানা ইতিহাসে তিনিই সব নবী-রাসূলের আদি পিতা। তাওহীদ, রিসালাত ও পরকাল প্রভৃতি বিষয়াদি তিনিই সর্বপ্রথম পেশ করেছেন। আর সর্বশেষ রাসূলের নাম পর্যন্ত পূর্বেকার সব নবী-রাসূল ও খোদায়ী গ্রন্থাদি কর্তৃক ঘোষিত। এ জন্যে তাঁর মুখেই উচ্চারিত হয়েছে বিশ্বমানবের প্রতি এ পরম ঐক্যবানীঃ
تَعَالَوْا إِلَىٰ كَلِمَةٍ سَوَاءٍ بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ أَلَّا نَعْبُدَ إِلَّا اللَّهَ وَلَا نُشْرِكَ بِهِ شَيْئًا وَلَا يَتَّخِذَ بَعْضُنَا بَعْضًا أَرْبَابًا مِّن دُونِ اللَّهِ ۚ فَإِن تَوَلَّوْا فَقُولُوا اشْهَدُوا بِأَنَّا مُسْلِمُونَ
‘‘(হে জনসমষ্টি!) তোমরা সকলে এমন একটি মহান বাণীর দিকে এস, যা তোমাদের ও আমাদের মাঝে সমান ও অভিন্ন। সে বাণী হলঃ আমরা এক আল্লাহ ছাড়া অন্য কারোর বন্দেগী করব না, তাঁর সাথে কাউকেই শরীক করব না এবং আমাদের কেউই আল্লাহকে বাদ দিয়ে পরস্পরকে রব্ব্ রূপে গ্রহণ করবনা। ……তোমরা যদি এ মহান ও কল্যাণকর ঐক্যবাণী গ্রহণ করতে পরাঙ্গাম হও, তাহলে তোমরা সাক্ষী থেকো, আমরা কিন্তু এ বাণীতেই আত্মসমর্পিত।’’ (সূরা আলে ইমরানঃ ৬৪)
বস্তুত ইসলামী শিক্ষা-দর্শন এভাবেই চিরন্তন ও শাশ্বত মানবীয় ঐক্য ও একত্বের বাণী প্রচারের মহান দায়িত্ব পালন করেছে। ঈমানী একত্বের এ মহান বাণীতে তার বৈশিষ্ট্য মূর্ত হয়ে উঠেছ। কেবলমাত্র ঈমান-আকীদা ও আদর্শবাদের ক্ষেত্রেই নয়, সাংগঠনিক দিক দিয়েও ইসলামী শিক্ষা-দর্শন এক পূর্ণতা, ব্যাপকতা ও সামগ্রিকতার প্রবর্তক। এর অংশগুলো পরস্পর এমনভাবে সম্পৃক্ত ও অবিচ্ছিন্ন যে, জীবনের সমস্ত দিক ও বিভাগ নিয়ে তা এক অখণ্ড ঐকিক রচনা করে। তার প্রত্যেকটি দিক অপরটির জন্যে অপরিহার্য। ফলে একদিক রক্ষা করা হলেই দায়িত্ব পালিত হয় না; বরং একসঙ্গে ও একই সময়ে রক্ষা করতে হয় জীবনের সবগুলো দিক ও বিভাগ। এ কারণে কেউ শুধু নামায-রোযা ও হজ্জ্ব-যাকাত আদায় করেই যথার্থ মুসলিম হতে পারে না- নিছক কতিপয় সামাজিক নিয়মবিধি পালন করেই দায়িত্ব এড়ান সম্ভব হয় না; সমস্ত ও সম্পূর্ণ জীবনটিকেই ইসলামের আওতাভুক্ত করা অনিবার্য হয়ে পড়ে। এ জন্যেই নির্দেশ দেয়া হয়েছেঃ
ادْخُلُوا فِي السِّلْمِ كَافَّةً وَلَا تَتَّبِعُوا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ
‘‘তোমরা সকলে সম্মিলিতভাবে ইসলামী আদর্শানুগামী হও পরিপূর্ণভাবে এবং জীবনের কোন ক্ষেত্রেই শয়তানের পদাংক অনুসরণ করো না।’’ (সূরা বাকারাঃ ২০৮)
বস্তুত ইসলামী জীবন-ব্যবস্থা মানবদেহের মতোই এক অবিচ্ছিন্ন সংগঠন উপস্থাপন করেছে। ব্যক্তি ও সমাজ যতক্ষণ পর্যন্ত এ সংগঠনের প্রতিটি দিক ও বিভাগের ছাঁচে ঢেলে জীবন গঠন না করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত ব্যক্তি ও সমষ্টি জন্যে প্রতিশ্রুত ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণ বাস্তবায়িত হতে পারে না। ইবাদত এ জীবন-ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ। তার অবিভাজ্যতা ও অখণ্ডতা লক্ষণীয়। রাসূলে করীম সা. বলেছেনঃ ‘যে ব্যক্তি নামায পড়ে না, দ্বীন বলতে তার কিছু নেই’। ‘যে লোক যাকাত দেয় না, তার নামাযও গ্রহণীয় নয়’। ‘নামায-রোযা-হজ্জ্ব-যাকাত এ চারটি ফরয সম্পর্কে ইরশাদ হলঃ ‘এর তিনটি পালন করলেই তার দায়িত্ব পূর্ণ হবে না, যতক্ষণ না সব কয়টি আদায় করবে।’
সমাজ জীবনেও এই ঐক্য, একত্ব ও সাদৃশ্য রক্ষা করা অপরিহার্য। রাসূলের সম্মুখে দুইজন স্ত্রীলোকের কথা আলোচিত হয়। তার একজন খুব বেশী বেশী নফল নামায পড়ে; কিন্তু প্রতিবেশীদের জ্বালা-যন্ত্রণা দেয়। আর অপরজন জরুরী নামাযসমূহ আদায় করে (নফল নামায বেশী পড়ে না); কিন্তু প্রতিবেশীদের কোনরূপ কষ্ট দেয় না। রাসূলে করীম সা. প্রথম স্ত্রী লোককে জাহান্নামী এবং দ্বিতীয়জনকে জান্নাতী বলে ঘোষণা করেন। জীবনের বিশাল ও বিপুল কর্মক্ষেত্রে যে সামঞ্জস্য ও সঙ্গতি অপরিহার্য এবং অসঙ্গতি ও সংকীর্ণতা যে আদৌ থাকা অনুচিত, তারই দ্যোতনা এসব ঘটনায় রয়েছে।
ইসলামী শিক্ষা-দর্শন এই অখণ্ডতা সংস্থাপন করেছে শিক্ষার বিষয়বস্তুতে এবং কর্মজীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগে; যদিও জীবনের অস্বাভাবিক বিভাগ-বণ্টনে মানব ইতিহাসের পৃষ্ঠাগুলে কলংকিত ও ভারাক্রান্ত হয়ে রয়েছে। প্রাচীন গ্রীক, পারসিক ও রোমান সভ্যতা থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত এই বিভাগ-বণ্টনের ফলেই মানবজীবন চূর্ণ-বিচূর্ণ ও অসামঞ্জস্যতার আঘাত জর্জরিত। আর্যদের বর্ণবিভেদ, ইয়াহুদীদের ধর্ম ও বৈষয়িক জীবনের বিভিন্নতা, খৃষ্টানদের খোদা ও কাইজারের মধ্যে বিভেদ এবং শেষোক্ত এ দুটি সমাজের বৈরাগ্যবাদ মানবজীবনকে ভিন্ন ভিন্ন অংশে খণ্ডিত করে দিয়েছে। ধর্মীয় জীবন ও বৈষয়িক জীবনকে দুটি স্বতন্ত্র ও পরস্পর বিরোধী ধারায় বিভক্ত করার দরুণ মানবজীবন ও সমাজ দেহ টুকরা টুকরা হয়ে গেছে। বর্তমান সভ্যতা শেষের দিকে মানবীয় ঐক্য ও অখণ্ডতার গালভরা বুলি প্রচার করতে শুরু করেছে বটে; কিন্তু জীবন-বুনিয়াদের শতধা-বিভক্তি তার এ বুলিকে প্রহসন ও বিদ্রূপে পরিণত করেছে। অথচ মানুষের দেহ-সত্তা বস্তু ও আত্মার সংমিশ্রণ ও অভিন্নতার এক জ্বলন্ত নিদর্শন; তা মানব-প্রেমের দাবিদার বর্তমান সভ্যতার তথাকথিত বৈজ্ঞানিক ভিত্তির তীব্র প্রতিবাদ জানায়। অখণ্ড মানব সত্তার জন্যে অখণ্ড ও অবিভাজ্য জীবন ব্যবস্থা তথা শিক্ষা-দর্শনের প্রয়োজনীয়তা ও অপরিহার্যতা আধুনিক সভ্যতার ধারকরা সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়েছে। সেখানে ধর্ম ও কর্মজীবন বিচ্ছিন্ন; নৈতিকতার সাথে অর্থনীতি সংযোগবিহীন; ইহকালের সাথে পরকাল বিবেচনা-বহির্ভূত। এ সভ্যতা তাই মানুষের জীবনের যেমন চরম বিপর্যয় ডেকে এনেছে, এখনকার শিক্ষাব্যবস্থাও ঠিক তেমনি মানুষের জীবনের কোন কল্যাণই আনতে পারেনি। যে শিক্ষা-দর্শন মানব জীবনের সকল দিক ও বিভাগ সম্পর্কে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং পরস্পরের পরিপূরক জ্ঞানদানে নিবেদিত, একমাত্র সে শিক্ষা দর্শনই সার্বিকভাবে সমস্ত মানুষের জন্যে কল্যাণবহ। মুসলমান তথা সমগ্র মানুষের জন্যে তাই একমাত্র ইসলামী শিক্ষা-দর্শনই গ্রহণীয়- অন্য কিছু নয়।