সাহাবাদের ইজমা
কোরআন এবং সুন্নাহর পর সাহায়ে কেরামের ইজমা বা মতৈক্য হলো তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সমস্ত নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক বর্ণনা থেকে প্রমাণ হয় যে, রসূলুল্লাহর (স)। ইন্তেকালের অব্যবহিত পরেই যেসব লোক নবুয়্যাতের দাবী করে এবং যারা তাদের নবুয়্যাত স্বীকার করে নেয়, তাদের সবার বিরুদ্ধে সাহাবায়ে কেরাম সম্মিলিতভাবে যুদ্ধ করেছিলেন। এসম্পর্কে মুসাইলামা কাজ্জাবের ব্যাপারটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সে রসূলুল্লাহর (স) নবুয়্যাত অস্বীকার করছিল না; বরং সে দাবী করছিল যে, রসূলুল্লাহ্র নবুয়্যাতে তাকেও অংশীদার করা হয়েছে। রসূলুল্লাহর ইন্তেকালের পূর্বেসে তাঁর নিকট যে চিঠি পাঠিয়েছিল তার আসল শব্দ হলো এই:
“অর্থাৎ আল্লাহর রসূল মুসাইলামার তরফ হতে আল্লাহর রসূল মুহাম্মদের নিকট। আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। আপনি জেনে রাখুন, আমাকে আপনার সাথে নবুয়্যাতের কাজে শরীক করা হয়েছে।”
এভাবে স্পষ্ট করে রিসালাতে মুহাম্মদীকে স্বীকার করে নেবার পরও তাকে ইসলাম বহির্ভূত বলে ঘোষণা করা হয়েছে এবং তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হয়েছে। ইতিহাস থেকে একথাও প্রমাণ হয় যে, বনূ হোনায়পা সরল অন্তঃকরণে তার ওপর ঈমান এনেছিল। অবশ্য তারা এই বিভ্রান্তির মধ্যে পড়েছিল যে, মুহাম্মদ (স) নিজেই তাকে তার নবুয়্যাতের কাজে শরীক করেছেন। এ ছাড়াও আর একটা কথা হলো এই যে, মদীনা তাইয়েবা থেকে এক ব্যক্তি কোরআনের শিক্ষা গ্রহণ করেছিল এবং বনু হোনায়ফার নিকটে গিয়ে সে কোরআনের আয়াতকে মুসাইলামার নিকট অবতীর্ণ আয়াতরূপে পেশ করেছিল।
(আরবী *********)
কিন্তু এ সত্ত্বেও সাহাবায়ে কেরাম তাকে মুসলমান বলে স্বীকার করেননি এবং তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। [শেষ নবুয়্যাতে অবিশ্বাসীরা নবী করিমের (স)-হাদীসেরবিপরীতে হযরত আয়েশার (রা) বলে কথিত নিম্নোক্ত বর্ণনা উদ্ধৃতি দেয়: “বল নিশ্চয়ই তিনি খাতামুন নাবিয়ীন, এ কথা বলো না যে তার পর নবী নেই।” প্রথমত নবী করিমের (স) সুস্পষ্ট আদেশকে অস্বীকার করার জন্রহযরত আয়েশার (রা) উদ্ধৃতি দেয়া একটা ধৃষ্টতা। অধিকন্তু হযরত আয়েশার (রা) বলে কথিত উপরোক্ত উদ্ধৃতি মোটেই নির্ভরযোগ্য নয়। হাদীস শাস্ত্রের কোন প্রামাণিক গ্রন্থেই হযরত আয়েশার (রা) উপরোক্ত উক্তির উল্লেখ নেই। কোন বিখ্যাত হাদীস লিপিবদ্ধকারী এ হাদীসটি লিপিবদ্ধ বা উল্লেখ করেননি।
উপরোক্ত হাদীসটি ‘দার-ই মানহুর’ নামক তাফসীর এবং ‘তাকমিলাহ মাজমা-উল-বিহার’ নামক অপরিচিত হাদীস সংকলণ থেকে নেয়া হয়েছে; কিন্তু এর উৎপত্তি বা বিশ্বস্ততা সম্বন্ধে কিছুই জানা নেই। রসূল (স) সুস্পষ্ট হাদীস বা বিখ্যাত হাদীস বর্ণনাকারীরা খুবই নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে বর্ণনা করেছেন, তাকে অস্বীকার করার জন্য হযরত আয়েশার (রা) কথার উল্লেখ চূড়ান্ত ধৃষ্টতা মাত্র।] অতঃপর একথা বলার সুযোগ নেই যে, ইসলাম বহির্ভূত হবার কারণে সাহাবাগণ তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেননি বরং বিদ্রোহ ঘোষণা করার কারণেই তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হয়েছিল। ইসলামী আইনের দৃষ্টিতে বিদ্রোহী মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হলেও তাদের যুদ্ধবন্দীদেরকে গোলামে পরিণত করা যেতে পারে না। বরং শুধু মুসলমানই নয়, জিম্মীও (অমুসলিম) বিদ্রোহ ঘোষণা করলে, গ্রেফতার করার পর তাকে গোলামে পরিণত করা জায়েজ নয়। কিন্তু মুসাইলামা এবং তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় হযরত আবুবকর সিদ্দীক (রা) ঘোষণা করেন যে, তাদের মেয়েদের এবং অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলেদেরকে গোলাম বানানো হবে এবং গ্রেফতার করার পর দেখা গেলো, সত্যি সত্যিই তাদেরকে গোলাম বানানো হয়েছে। হযরত আলী (রা) তাদের মধ্যথেকেই জনৈক যুদ্ধ বন্দিনীর মালিক হন। এই যুদ্ধ বন্দিনীর গর্ভজাত পুত্র মুহাম্মদ ইবনে হানিফাই হলেন পরবর্তীকালে ইসলামের ইতিহাসে সর্বজন পরিচিত ব্যক্তি।
(আরবী *********) এ থেকে একথা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, সাহাবায়ে কেরাম যে অপরাধের কারণে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন, তা কোন বিদ্রোহের অপরাধ ছিলনা বরং সে অপরাধ ছিল এইযে, এক ব্যক্তি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের পরে নবুয়্যাতের দাবী করে এবং অন্য লোকেরা তার নবুয়্যাতের ওপর ঈমান আনে। রসূলুল্লাহর ইন্তেকালের অব্যবহিত পরেই এই পদক্ষেপ গৃহীত হয়। এর নেতৃত্ব করেন হযরত আবুবকর সিদ্দীক (রা) এবং সাহাবাদের সমগ্র দলটি একযোগে তাঁর নেতৃত্বাধীনে এ কাজে অগ্রসর হন। সাহাবাদের ইজমার এর চাইতে সুস্পষ্ট দৃষ্টান্ত আর কি হতে পারে।
আলেম সমাজের ইজমা
শরীয়াতে সাহাবাদের ইজমার পর চতুর্থ পর্যায়ের সব চাইতে শক্তিশালী দলিল হলো সাহাবাগণের পরবর্তী কালের আলেম সমাজের ইজমা। এদিক দিয়ে বিচার করলে দেখা যায়, হিজরীর প্রথম শতাব্দী থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত প্রত্যেক যুগের এবং সমগ্র মুসলিম জাহানের প্রত্যেক এলাকার আলেম সমাজ হামেশাই এ ব্যাপারে একমত রয়েছেন যে,
“মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের পরে কোনো ব্যক্তি নবী হতে পারে না। এবং তাঁর পর যে ব্যক্তি নবুয়্যাতের দাবী করবে এবং যে ব্যক্তি এই মিথ্যা দাবীকে মেনে নেবে, সে কাফের এবং মিল্লাতে ইসলামের মধ্যে তার স্থান নেই।”
এ ব্যাপারে আমি কতিপয় প্রমাণ পেশ করছি:
(১) ইমাম আবু হানিফার যুগে (৮০-১৫০হি) এক ব্যক্তি নবুয়্যাতের দাবী করে এবংবলে: “আমাকে সুযোগ দাও, আমি নবুয়্যাতের সংকেত চিহ্ন পেশ করব।”
একথা শুনে ইমাম সাহেব বলেন: যে ব্যক্তি এর কাছ থেকে নবুয়্যাতের কোনো সংকেত চিহ্ন তলব করবে সেও কাফের হয়ে যাবে। কেননা রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন: (******) আমার পর আর কোন নবী নেই।
(আরবী *********)
(২) আল্লামা ইবনে জারীর তাবারী (২২৪-৩১০ হি) তাঁর বিখ্যাত কোরআনের তাফসীরে (আরবী *******) আয়াতটির বর্ণনা প্রসঙ্গে লিখেছেন:
(আরবী *******)
অর্থাৎ “যে নবুয়্যাতকে খতম করে দিয়েছে এবং তার ওপর মোহর লাগিয়ে দিয়েছে, কিয়ামত পর্যন্ত এর দরজা আর কারুর জন্য খুলবেনা।” (তাফসীরে ইবনে জারীর, দ্বাবিংশ খণ্ড, ১২ পৃষ্ঠা)
(৩) আল্লামা ইবনে হাজাম আন্দালুসী (৩৮৪-৪৫৬ হি) লিখেছেন: নিশ্চয়ই রসূলুল্লাহর (স) পর অহীর সিলসিলা খতম হয়ে গেছে। এর সপক্ষে যুক্তি এই যে, অহী আসে একমাত্র নবীর কাছে এবং মহান আল্লাহ বলেছেন, “মুহাম্মদ তোমাদের পুরুষদের মধ্যে কারুর পিতা নয়। কিন্তু সে আল্লাহর রসূল এবং সর্বশেষ নবী।” (আল মুহাল্লা, প্রথম খণ্ড, ২৬ পৃষ্ঠা)।
(৪) ইমাম গাজ্জালী (৪৫০-৫০৫ হি) বলেন: “সমগ্র মুসলিম সমাজ এই বাক্য থেকে একযোগে এই অর্থ নিয়েছে যে, রসূলুল্লাহ (স) তাঁর পরে কোন রসূল এবং নবী না আসার কথাটি স্পষ্ট করে ব্যক্ত করেছেন এবং এর কোনো বিশেষ অর্থ গ্রহণ অথবা বাক্যটিকে উল্টিয়ে পাল্টিয়ে এবং টেনে-হিঁচড়ে এ থেকে কোনো দ্বিতীয় অর্থ গ্রহণের সুযোগই এখানে নেই। অতঃপর যে ব্যক্তি টেনে-হিঁচড়ে এথেকে কোনো দ্বিতীয় অর্থ গ্রহণ করবে, তার বক্তব্য হবে উদ্ভট ও নিছক কল্পনা প্রসূত এবং তার বক্তব্যের ভিত্তিতে তার ওপর কুফরীর ফতোয়া দেবার ব্যাপারে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। কেননা কোরআনে যে আয়াত সম্পর্কে সমগ্র মুসলিম সমাজ একযোগে এই মত পোষণ করেন যে, তার কোনো দ্বিতীয় অর্থ গ্রহণ করা যেতে পারে না এবং টেনে-হিঁচড়ে অন্য কোনো অর্থও তা থেকে বের করা যেতে পারেনা, সে আয়াতকে সে মিথ্যা প্রমাণ করেছে।” (আল ইকতিসাদ ফিল ইতিকাদ, ১১৩ পৃষ্ঠা)
(৫) মুহিউদ সূন্নাহ বাগাবী (মৃত্যু ৫১০ হি) তাঁর তাফসীরে আলিমুত তানজীল-এ লিখেছেন: রসূলুল্লাহ্র (স) মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা নবুয়্যাতের সিলসিলা খতম করেছেন। কাজেই তিনি সর্বশেষ নবী এবং ইবনে আব্বাস বলেন যে, আল্লাহতায়ালা এই আয়াতে ফায়সালা করে দিয়েছেন যে, মুহাম্মদের (স) পর কোন নবী নেই। (তৃতীয় খণ্ড, ১৫৮ পৃষ্ঠা)
(৬) আল্লাম জামাখশরী (৪৬৭-৫৩৮ হি) তাফসীরৈ কাশ্শাফে লিখেছেন: যদি তোমরা বল যে, রসূলুল্লাহ (স) শেষ নবী কেমন করে হলেন, কেননা হযরত ঈসা(আ) শেষ যুগে অবতীর্ণ হবেন, তাহলে আমি বলবোযে, রসূলুল্লাহর শেষ নবী হবার অর্থ হলো এই যে, তাঁর পরে আর কাউকে নবীর পদে প্রতিষ্ঠিত করা হবেনা। হযরত ঈসাকে (আ) রসূলুল্লাহর (স) পূর্বে নবী বানানো হয়েছে। অবতীর্ণ হবার পর তিনি রসূলুল্লাহর অনুসারী হবেন এবং তাঁর কেবলার দিকে মুখ করে নামায পড়বেন। অর্থাৎ তিনি হবেন রসূলুল্লাহর উম্মতের মধ্যে শামিল। (দ্বিতীয় খণ্ড, ১১৫ পৃষ্ঠা)
(৭) কাজী ইয়অয (মৃত্যু: ৫৪৪ হি) লিখেছেন: যে ব্যক্তি নিজে নবুয়্যাতের দাবী করে অথবাএ কথাকে বৈধ মনে করে যে, যে কোনো ব্যক্তি নিজের প্রচেষ্টায় নবুয়্যাত হাসিল করতে পারে এবং অন্তত পরিশুদ্ধির মাধ্যমে নবীর পর্যায়ে উন্নীত হতে পারে (যেমন কোনো কোনো দার্শনিক এবং বিকৃতমনা সূফী মনে করেন) এবং এভাবে যে ব্যক্তি নবুয়্যাতের দাবীকরেনা অথচ একথার দাবী জানায় যে, তার ওপর অহী নাযিল হয়, -এ ধরনের সমস্ত লোক কাফের এবং তারা রসূলুল্লাহর নবুয়্যাতকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করছে। কেননা তিনি খবর দিয়েছেন যে, তিনি শেষ নবী এবং তাঁর পর কোনো নবী আসবে না এবং তিনি আল্লাহতায়ালার তরফ থেকে এ খবর পৌঁছিয়েছেন যে, তিনি নবুয়্যাতকে খতম করে দিয়েছেন এবং সমগ্র মানব জাতির জন্য তাঁকে পাঠানো হয়েছে। সমগ্র মুসলিম সমাজ এ ব্যাপারে একমত যে, এখানে কথাটির বাহ্যিক অর্থটিই গ্রহণীয় এবং এ ব্যাপারে একমত যে, এখানে কথাটির বাহ্যিক অর্থটিই গ্রহণীয় এবং এর দ্বিতীয় কোনো অর্থ গ্রহণ করার সুযোগই এখানে নেই। কাজেই উল্লিখিত দলগুলোর কাফের হওয়া সম্পর্কে কোরআন, হাদীস এবং ইজমার দৃষ্টিতে কোনো সন্দেহ নেই। (শিফা দ্বিতীয় খণ্ড, ২৭০-২৭১ পৃষ্ঠা)
(৮) আল্লামা শাহারিস্তানী (মৃত্যু: ৫৪৮ হি) তাঁর মশহুর কিতাব আল মিলাল ওয়ান নিহালে লিখেছেন: এবং যে এভাবেই বলে যে, “মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের পরও কোনো নবী আসবে (হযরত ঈসা (আ) ছাড়া) তাহলে তার কাফের হওয়া সম্পার্কে যে কোন দু’জন ব্যক্তি মধ্যেই কোনো মতবিরোধ থাকতে পারে না। (তৃতীয় খণ্ড ২৪৯ পৃষ্ঠা)
(৯) ইমাম রাজী (৫৪৩-৬০৬ হি) তাঁর তাফসীরে কবীরে ‘খাতিমুন নাবিয়ীন’ শব্দের ব্যাখ্যা প্রসংগে বলেন: এ বর্ণনায় খাতিমুন নামিয়ীন শব্দ এজন্য বলা হয়েছে যে, যে নবীর পর অন্য কোনো নবী আসবেন তিনি যদি উপদেশ এবং নির্দেশাবলীর ব্যাখ্যার ব্যাপারে কিছু অতৃপ্তি রেখে যান, তাহলে তাঁর পর আগমনকারী নবীতা পূর্ণ করতে পারেন। কিন্তু যার পর আর কোনো নবী আসবে না, তিনি নিজের উম্মতের ওপর খুব বেশী স্নেহশীল হন এবং তাদেরকে সুস্পষ্ট নেতৃত্ব দান করেন। কেননা তাঁর দৃষ্টান্ত এমন একটি পিতার ন্যায় যিনি জানেন যে, তাঁর মৃত্যুর পর পুত্রের দ্বিতীয কোনো অভিভাবক এবং পৃষ্ঠপোষক থাকবে না। (ষষ্ঠ খণ্ড, ৫৮১ পৃষ্ঠা)
(১০) আল্লামা বায়জাবী (মৃত্যু: ৬৮৫ হি) তাঁর তাফসীরে আনওয়ারুত্ তানজীল-এ লিখেছেন: অর্থাৎ তিনিই শেষ নবী। তিনি নবীদের সিলসিলা খতম করে দিয়েছেন। অথবা তাঁর কারণেই নবীদের সিলসিলার ওপর মোহর লাগানো হয়েছে। এবং তাঁর পর হযরত ঈসার (আ) নাযীল হবার কারণে খতমে নবুয়্যাতের ওপর কোনো দোষ আসছে না। কেননা তিনি রসূলুল্লাহর (স) দ্বীনের মধ্যেই নাযিল হবেন। (চতুর্থ খণ্ড, ১৬৪ পৃষ্ঠা)
(১১) আল্লামা হাফিজ উদ্দীন নাসাফী (মৃত্যু: ৮১০ হি) তাঁর তাফসীরে মাদারেকুত তানজীল-এ লিখেছেন: এবং রসূলুল্লাহ (স) খাতিমুন নাবিয়ীন। অর্থাৎ তিনিই সর্বশেষ নবী। তাঁর পর আর কোনো ব্যক্তিকে নবী করা হবে না। হযরত ঈসা (আ) হলো এই যে, তাঁকে রসূলুল্লাহ্র পূর্বে নবীর পদে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল। এবং পরে যখন তিনি নাযিল হবেন, তখন তিনি হবেন রসূলুল্লাহর শরীয়তের অনুসারী। অর্থাৎ তিনি হবেন রসূলুল্লাহর উম্মত। (৪৭১ পৃষ্ঠা)
(১২) আল্লামা আলাউদ্দীন বাগদাদী (মৃত্যু: ৭২৬ হি) তাঁর তাফসীরে ‘খাজিন’-এ লিখেছেন: (আরবী *****) অর্থাৎ আল্লাহর রসূলুল্লাহ্র নবুয়্যাত খতম করে দিয়েছেন। কাজেই তাঁর পরে আর কোনো নবুয়্যাত নেই এবং এ ব্যাপারে কেউ তাঁর অংশীদারও নয়।
(আরবী ********) অর্থাৎ আল্লাহ একথা জানেন যে, তাঁর পর আর কোনো নবী নেই’ (৩৭১-৪৭২ পৃষ্ঠা)
(১৩) আল্লামা ইবনে কাসীর (মৃত্যু: ৭৭৪ হি) তাঁর মশুহর তাফসীরে লিখেছেন: অতঃপর আলোচ্য আয়াত থেকে একথা স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, যখন রসূলুল্লাহ্র পর কোনো নবী নেই, তখন অপর কোনো রসূলের প্রশ্নই উঠতে পারে না। কেননা রিসালাত একটা বিশেষ পদমর্যাদা এবং নবুয়্যাতের পদমর্যাদা এর চাইতে বেশী সাধারণধর্মী। প্রতেক রসূল নবী হন, কিন্তু প্রত্যেক নবী রসূল হন না। রসূলুল্লাহর পর যে ব্যক্তিই এই পদমর্যাদার দাবী করবে, সেই হবে মিথ্যাবাদী, প্রতারক, দাজ্জাল এবং গোমরাহ। যতোই সে প্রাকৃতিক নিয়মে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী ও যাদুর ক্ষমতাসম্পন্ন হোক না কেন, তার দাবী মানবার নয়। কিয়ামত পর্যন্ত যেসব ব্যক্তি এই পদমর্যাদার দাবী করবে, তাদের প্রত্যেকেরই অবস্থা হবে এই ধরনের। (তৃতীয় খণ্ড, ৪৯৩-৪৯৪ পৃষ্ঠা)
(১৪) আল্লামা জালালুদ্দীন সিউতী (মৃত্যু: ৯১১ হি) তাঁর তাফসীরে জালালায়েন-এ লিখেছেন: ‘অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা জানেন যে রসূলুল্লাহর (স) পর আর কোনো নবী নেই। এবং হযরত ঈসা (আ) নাযীল হবার পর রসূরুল্লাহর শরীয়ত মোতাবেকই আমল করবেন।’ (৭৬৮ পৃষ্ঠা)
(১৫) আল্লামা ইবনে নাজীম (মৃত্যু: ৯৭০ হি) উসুলে ফিকাহর বিখ্যাত পুস্তক আল ইশবাহ ওয়ান নাজায়েরে ‘কিতাবুস সিয়ারের’ ‘বাবুর রুইয়ায়’ লিখেছেন: যদি কেউ একথা না মনে করে যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম শেষ নবী, তাহলে সে মুসলমান নয়। কেননা কথাগুলো জানা এবং স্বীকার করে নেয়া দ্বীনের অত্যধিক প্রয়োজনের মধ্যে শামিল। (১৭৯ পৃষ্ঠা)
(১৬) মুল্লা আলী কারী (মৃত্যু: ১০১৬ হি) ‘শারহে ফিকহে আকবর’-এ লিখেছেন: ‘আমাদের রসূলের (স) পর অন্য কোনো ব্যক্তির নবুয়্যাতের দাবী করা সর্ববাদীসম্মতভঅবে কুফর। (২০২ পৃষ্ঠা)
(১৭) শায়খ ইসমাইল হাক্কী (মৃত্যু: ১১৩৭ হি) তাফসীরে রুহুল বয়ান-এ উল্লিখিত ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে লিখেছেন: আলেম সমাজ ‘খাতাম’ শব্দটির তে-এর উপর জবর লাগিয়ে পড়েছেন, -এর অর্থ হয় খতম করবার যন্ত্র, যার সাহায্যে মোহর লাগানো হয়।
অর্থাৎ রসূলুল্লাহ (স) সমস্ত নবীর শেষে এসেছেন এবং তাঁর সাহায্যে নবীদের সিলসিলার ওপর মোহর লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। ফারসীতে আমরা একে বলবো ‘মোহর পয়গম্বর’ অর্থাৎ তাঁর সাহায্যে নবুয়্যাতের দরজার মোহর লাগিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে এবং পয়গম্বরদের সিলসিলা খতম করে দেয়া হয়েছে। অন্য পাঠকরাতো এর নীচে জের লাগিয়ে পড়েছেন ‘খাতিমুন নাবিয়ীন’। অর্থাৎ রসূলুল্লাহ্ ছিলেন মোহর দানকারী। অন্য কথায় বলা যাবে পয়গম্বরদের ওপর মোহরকারী। এভাবে এ শব্দার্থ ‘খাতাম’-এর সমার্থক হয়ে দাঁড়াবে। তাহলে রসূলুল্লাহর (স) পর তাঁর উম্মতের আলেম সমাজ তাঁর কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাবেনএকমাত্র তাঁর প্রতিনিধিত্ব। তাঁর ইন্তেকালের সাথে সাথেই নবুয়্যাতের উত্তরাধিকারেরও পরিসমাপ্তি ঘটেছে এবং তাঁর পরে হযরত ঈসার (আ) নাযিল হবার ব্যাপারটি তাঁর নবুয়্যাতকে ত্রুটিযুক্ত করবেনা। কেননা খাতিমুন নাবিয়ীন হবার অর্থ হলো এই যে, তাঁর পর আর কাউকে নবী বানানো হবেনা এবং হযরত ঈসাকে (আ) তাঁদের পূর্বেই নবী বানানো হয়েছে। কাজেই তিনি রসূলুল্লাহ্র অনুসারীর মধ্যে শামিল হবেন, রসূলুল্লাহর কিবলার দিকে মুখ করে নামায পড়বেনএবং তাঁরই উম্মতের অন্তর্ভুক্ত হবেন। তখন হযরত ঈসার (আ) নিকট অহী নাযীল হবেনা এবং তিনি কোনোনতুন আহকামও জারি করবনে না, বরং তিনি হবেন রসূলুল্লাহর প্রতিনিধি। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত এ ব্যাপারে একমত যে, আমাদের নবীর পর আর কোনো নবী নেই। কেননা আল্লাহতায়ালা বলেছেন: মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম শেষ নবী। এবং রসূলুল্লাহ বলেছেন: আমার পরে কোনো নবী নেই। কাজেই এখনযে বলবে যে মুহাম্মদ (স) এর পর নবী আছে, তাকে কাফের বলা হবে। কেননা সে কোরআনকে অস্বীকার করেছে এবং অনুরূপভবেসেই ব্যক্তিকেও কাফের বলা হবে যে এ ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করবে। কেননা সুস্পষ্ট যুক্তি প্রমাণের পর হক বাতিল থেকে পৃথক হয়ে গেছে। এবং যে ব্যক্তি মুহাম্মদ (স)-এর পর নবুয়্যাতের দাবী করবে, তার দাবী বাতিল হয়ে যাবে। (দ্বাবিংশ খণ্ড, ১৮৮ পৃষ্ঠা)
(১৮) শাহানশাহ আওরঙ্গজেব আলমগীরের নির্দেশে বার’শ হিজরীতে পাক-ভারতের বিশিষ্ট আলেমগণ সম্মিলিতভাবে ‘ফতোয়া আলমগিরী’ নামে যে কিতাবটি লিপিবদ্ধ করেন তাতে উল্লিখিত হয়েছে: যদি কেউ মনে করে যে, মুহাম্মদ (স) শেষ নবী নয়, তাহলেসে মুসলমান নয় এবং যদি সে বলে যে, সে আল্লাহর রসূল অথবা পয়গম্বর, তাহলে তার ওপর কুফরীর ফতোয়া দেয়া হবে। (দ্বিতীয়খণ্ড, ২৬৩ পৃষ্ঠা)
(১৯) আল্লামা শওকানী (মৃত্যু: ১২৫৫ হি) তাঁর তাফসীর ফাতহুল কাদীরে লিখেছেন: সমগ্র মুসলিম সমাজ ‘খাতিম’ শব্দটির তে-এর নীচে জের লাগিয়ে পড়েছেন এবং একমাত্র আসে জবরের সাথে পড়েছেন। প্রথমটা অর্থ হলো এই যে, রসূলুল্লাহ সমস্ত পয়গম্বরকে খতম করেছেন অর্থাৎ তিনি সবার শেষে এসেছেন এবং দ্বিতীয়টির অর্থ হলো এই যে, তিনি সমস্ত পয়গম্বরদের জন্য মোহর স্বরূপ্ এবং এর সাহায্যে নবীদের সিলসিলা মোহর এঁটে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ফলে তাঁদের দলীটর সর্বাঙ্গসুন্দর হয়েছে। (চতুর্থ খণ্ড, ২৭৫ পৃষ্ঠা)
(২০) আল্লামা আলুসি (মৃত্যু: ১২৮০ হি) তাফসীরে রুহুল মায়ানীতে লিখেছেন: নবী শব্দটি রসূলের চাইতে বেশী সাধারণ অর্থব্যঞ্জক। কাজেই রাসূলের খাতিমুন নাবিয়ীন হবার অর্থ হলো এই যে, তিনি খাতিমুল মুরসালীনও। তিনি শেষ নবী এবং শেষ রসূল-একথার অর্থ হলো এই যে, দুনিয়ায় তাঁর নবুয়্যাতের গুণে গুণান্বিত হবার পরেই মানুষ এবং জিনের মধ্য থেকে এ গুণটি চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। (দ্বাবিংশ খণ্ড, ৩২ পৃষ্ঠা)
রসূলুল্লাহর পর যে ব্যক্তি নবুয়্যাতের অহীর দাবী করবে, তাকে কাফের বলে গণ্য করা হবে। এ ব্যাপারে মুসলমানদের মধ্যে দ্বিমতের অবকাশ নেই। (দ্বাবিংশ খণ্ড, ৩৮ পৃষ্ঠা)
“রসূলুল্লাহ শেষ নবী-একথাটি কোরআন দ্ব্যার্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছে, রসূলুল্লাহর সুন্নাত এটিকে সুস্পষ্টরূপে ব্যাখ্যা করেছে এবং সমগ্র মুসলিম সমাজ এর ওপর আমল করেছে। কাজেই যে ব্যক্তি এর বিরোধী কোনো দাবী করবে, তাকে কাফের বলে গণ্য করা হবে।” (দ্বাবিংশ খণ্ড, ৩৯ পৃষ্ঠা)
বাংলা পাক-ভারত উপমহাদেশ থেকে মররোক্ত ও আন্দালুসিয়া এবং তুর্কী থেকে ইয়েমেন পর্যন্ত মুসলিম জাহানের শ্রেষ্ঠ আলেম, ফকীহ, মুহাদ্দিস এবং তাফসীরকারগণের ব্যাখ্যা এবং মতামত আমি এখানে উল্লেখ করলাম। তাঁদের নামের সাথে সাথে তাঁদের জন্ম এবং মৃত্যু তারিখও উল্লেখ করেছি। এ থেকেই ধারণা করা যাবে যে, হিজরীর প্রথম শতাব্দী থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত ইসলামের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ আলেমগণ এর মধ্যে শামিল আছেন। হিজরীর চতুর্দশ শতাব্দীর আলেম সমাজের মতামতও আমি এখানে উল্লেখ করতে পারতাম, কিন্তু ইচ্ছা করেই তাঁদেরকে ছেড়ে দিয়েছি। কেননা তাঁরা মীর্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর সমসাময়িক। এবং হয়তো অনেকে বলতে পারেন যে, মীর্জা সাহেবের বিরোধিতার মনোভাব নিয়েই তাঁরা খতমে নবুয়্যাতের এই অর্থ বিবৃত করেছেন। এজন্য মীর্জা সাহেবের পূর্ববর্তী যুগের আলেম সমাজের মতামতের উদ্ধৃতিই এখানে পেশ করেছি- যেহেতু মীর্জা সাহেবের সাথে তাঁদের বিরোধের প্রশ্নই উঠতে পারে না। এইসব মতামত থেকে একথা চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, হিজরীর প্রথম শতাব্দী থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত সমগ্র মুসলিমজাহান একযোগে খাতিমুন নাবিয়ীন শব্দের অর্থ নিয়েছে শেষ নবী। প্রত্যেক যুগের মুসলমানই এই একই আকীদা পোষণ করেছেন যে, রসূলুল্লাহর পর নবুয়্যাতের দরজা চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে। একথা তাঁরা একযোগে স্বীকার করে নিয়েছেন যে, যে ব্যক্তি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের পর নবী অথবা রসূল হবার দাবী করেএবং যে তার দাবীকে মেনে নেয়, সে কাফের হয়ে যায়, এ ব্যাপারে মুসলমানদের মধ্যে কোনো যুগে তুচ্ছতম মতবিরোধেরও সৃষ্টি হয়নি। কাজেই এই আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রত্যেক বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিই ফায়সালা করতে পারেন যে, ‘খাতিমুন নাবিয়ীন’ শব্দের যে অর্থ আরবী অভিধান থেকে প্রমাণিত হয়, কোরআনের আয়াতের পূর্বাপর বর্ণনা থেকে যে অর্থ প্রতীয়মান হয়, রসূলুল্লাহ (স) নিজেই যা ব্যাখ্যা করেছেন, সাহাবায়ে কেরাম যে সম্পর্কে মতৈক্য পোষণ করেছেন এবং সাহাবায়ে কেরামের যুগ থেকে আজ পর্যন্ত সমগ্র মুসলিমসমাজ একযোগে দ্ব্যার্থহীনভাবে যা স্বীকার করে আসছেন, তার বিপক্ষে দ্বিতীয় কোনো অর্থ গ্রহণ অর্থাৎ কোনো নতুন দাবীদারের জন্য নবুয়্যাতের দরজা উন্মুক্ত করার অবকাশ ও সুযোগ থাকে কি? এবং এই ধরনের লোকদেরকে কেমন করে মুসলমান বলে স্বীকার করা যায়, যারা নবুয়্যাতের দরজা উন্মুক্ত করার নিছক ধারণাই প্রকাশ করেনি বরং ঐ দরজা দিয়ে এক ব্যক্তি নবুয়্যাদের দালানে প্রবেশ করেছে এবং তারা তার ‘নবুয়্যাতের’ ওপর ঈমান পর্যন্ত এনেছে?
এ ব্যাপরে তিনটি কথা বিবেচনা করতে হবে।
আমাদের ঈমানের সংগে খোদার কি কোনো শত্রুতা আছে?
প্রথম কথা হলো এই যে, নবুয়্যাতের ব্যাপারটি বড়ই গুরুত্বপূর্ণ। কোরআনের দৃষ্টিতে এ বিষয়টি ইসলামের বুনিয়াদী আকিদার অন্তর্ভুক্ত, এটি স্বীকার করার বা না করার ওপর মানুষের ঈমান ও কুফরী নির্ভর করে। যদি কোনো ব্যক্তি নবী থাকেন এবং লোকেরা তাঁকে না মানে, তাহলে তারা কাফের হয়ে যায়। আবার কোনো ব্যক্তি নবী না হওয়া সত্ত্বেও যারা তাকে নবী বলে স্বীকার করে, তারাও কাফের হয়ে যায়। এ ধরনের জটিল পরিস্থিতিতে আল্লাহ তায়ালার নিকট থেকে যে কোনো প্রকার অসতর্কতার আশা করা যায় না। যদি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের পর কোনো নবী আসার কথা থাকতো তাহলে আল্লাহ নিজেই কোরআনে স্পষ্ট এবং দ্ব্যার্থহীন ভাষায় তা ব্যক্ত করতেন, রসূলুল্লাহর মাধ্যমে প্রকাশ্যভাবে তা ঘোষণা করতেন এবং রসূলুল্লাহ কখনো এ দুনিয়া থেকে তাশরীফ নিয়ে যেতেন না; যতক্ষণ না তিনি সমগ্র উম্মতকে এ ব্যাপারে পুরোপুরি অবগত করতেন যে, তাঁর পর আরো নবী আসবেন এবং আমরা সবাই তাঁদেরকে মেনে নিতে বাধ্য থাকবো। রসূলুল্লাহর পর নবুয়্যাতের দরজা উন্মুক্ত থাকবে এবং এই দরজা দিয়ে কোনো নবী প্রবেশ করবে, যার ওপর ঈমান না আনলে আমরা মুসলমান থাকতে পারি না অথচ আমাদেরকে এ সম্পর্কে শুধু বেখবরই রাখা হয়নি বরং বিপরীতপক্ষে আল্লাহ এবং তাঁর রসূল একযোগে এমন সব কথা বলেছৈন, যার ফলে তের’শ বছর পর্যন্ত সমস্ত উম্মত একথা মনে করেছিলো এবং আজও মনে করে যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের পর আর কোনো নবী আসবেন না- আমাদের সাথে আল্লাহ এবং তাঁর রসূলের এ ধরনের ব্যবহার কেন? আমাদের দ্বীন এবং ঈমানের বিরুদ্ধে আল্লাহ এবংতাঁর রসূলের তো কোনো শত্রুতা নেই!
তর্কের খাতিরে যদি একথা মেনে নেয়া যায় যে, নবুয়্যাতের দরজা উন্মুক্ত আছে এবং কোনোনবী আসার পর আমরা যদি নির্ভয়ে এবং নিশ্চিন্তে তাঁকে অস্বীকার করে বসি, তাহলে ভয় থাকতে পারে একমাত্র আল্লাহর দরবারে জিজ্ঞাসাবাদের! কিন্তু কিয়ামতের দিনতিনি আমাদের নিকট থেকে এ সম্পর্কে কৈফিয়ত তলব করলে, আমরা সোজাসুজি উল্লিখিত রেকর্ডগুলো তাঁর আদালতে পেশকরবো। এ থেকে অন্তত প্রমাণহয়েযাবে যে, (মায়াযাল্লাহ) আল্লাহ্র কিতাব এবং রসূলের সুন্নাতই আমাদেরকে এই কুফরীর মধ্যে নিক্ষেপ করছে! আমরা নির্ভয়ে বলতে পারি যে, এইসব রেকর্ড দেখার পর কোনো নতুন নবীর ওপর ঈমান না আনার জন্য আল্লাহ আমাদেরকে শাস্তি দেবেন না। কিন্তু যদি সত্যি সত্যি নবুয়্যাতের দরজাবন্ধ গিয়ে থাকে এবং কোনো নবুন নবী যদি না আসতে পারে এবং এইসব সত্ত্বেও কেউ কোনো নবুয়্যাতের দাবীদারদের ওপর যদি ঈমান আনে, তাহলে তার চিন্তা করা উচিত যে, এই কুফরীর অপরাধ থেকে বাঁচার জন্য সে আল্লাহর দরবারে এমনকি রেকর্ড পেশ করতে পারবে, যার ফলে সে মুক্তি লাভের আশা করতে পারে। আদালতে হাযির হবার পূর্বে তার নিজের জবাবদিহির জন্য সংগৃহীত দলিল প্রমাণগুলো এখানেই বিশ্লেষণ করে নেয়া উচিত। এবং আমরা যেসব দলিল-প্রমাণ পেশ করেছি, তার পরিপ্রেক্ষিতে তার বিচার করা উচিত যে, নিজের জন্য যে সাফাইয়ের ওপর নির্ভল করে সে একাজ করছে, কোনো বুদ্ধিশান ব্যক্তি কি এর ওপর নির্ভর করে কুফরীর শাস্তি ভোগ করার বিপদকে স্বাগতম জানাতে পারে?
এখন নবীর প্রয়োজনটা কেন?
দ্বিতীয় কথা হলো এই যে, ইবাদাত এবংনেক কাজে তরক্কী করে কোনো ব্যক্তি নিজের মধ্যে নবুয়্যাতের গুণ পয়দা করতে পারে না। নবুয়্যাতের যোগ্যতা কোনো অর্জন করার জিনিস নয়। কোনো বিরাট খেদমতের পুরস্কার স্বরূপ মানুষকে নবুয়্যাত দান করা হয় না। বরং বিশেষ প্রয়োজনের ক্ষেত্রে আল্লাহতায়ালা কোনো বিশেষ ব্যক্তিকে এই মর্যাদা দান করে থাকেন। এই প্রয়োজনের সময় যখন উপস্থিত হয় তখনই আল্লাহতায়ালা এক ব্যক্তিকে এই মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেন এবং যখন প্রয়োজন পড়ে না অথবা থাকে না, তখন খামাখা আল্লাহতায়ালা এক ব্যক্তিকে এই মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেন এবং যখন প্রয়োজন পড়ে না অথবা থাকে না, তখন খামাখা আল্লাহতায়ালা নবীর পর নবী প্রেরণ করতে থাকেন না। কোরআন মজিদ থেকে যখন আমরা একথা জানবার চেষ্টা করি যে, কোন্ পরিস্থিতিতে নবী প্রেরণের প্রয়োজন দেখা দেয়, তখন সেখানে এ ধরনের চারটি অবস্থার সন্ধান পাওয়া যায়:
** কোনো বিশেষ জাতির মধ্যে নবী প্রেরণের প্রয়োজন এজন্য দেখা যায় যে, তাদের মধ্যে ইতিপূর্বে কোন নবী আসেননি এবং অন্য কোনো জাতির মধ্যে প্রেরিত নবীর পয়গামও তাদের নিকট পৌঁছেনি।
** নবী পাঠাবার প্রয়োজন এজন্য দেখা যায় যে, সংশ্লিষ্ট জাতি ইতিপূর্বৈ প্রেরিত নবীদের শিক্ষা ভুলে যায় অথবা তা বিকৃত হয়ে যায় এবং তাঁদের প্রদর্শিত পথ অনুসরণ অসম্ভব হয়ে পড়ে।
**ইতিপূর্বে প্রেরিত নবীদের মাধ্যমে জনগণের শিক্ষা পূর্ণতা লাভ করতে পারেনি এবং দ্বীনের পূর্ণতার জন্য অতিরিক্ত নবীর প্রয়োজন হয়।
** কোনো নবীল সংগে তাঁর সাহায্য-সহযোগিতার জন্য আর একজন নবীর প্রয়োজন হয়।
উপরের আলোচনা থেকে একথা পরিষ্কার হয়ে গেলো যে, রসূলুল্লাহ্র পর কোনো নবীর প্রয়োজন নেই।
কোরআন নিজেই বলছে যে, রসূলুল্লাহকে সমগ্র দুনিয়ার জন্য হেদায়াতকারী হিসেবে পাঠানো হয়েছে। দুনিয়ার সাংস্কৃতিক ইতহিাস একথা বলে যে, তাঁর নবুয়্যাত প্রাপ্তির পর থেকে সমগ্র দুনিয়ায় এমন অবস্থা বিরাজ করছে, যাতে করে তাঁর দাওয়াত সব সময় দুনিয়ার সকল জাতির মধ্যে পৌঁছতে পারে। এর পরেও প্রত্যেক জাতির মধ্যে পৃথক পৃথক পয়গাম্বর প্রেরণের কোনো প্রয়োজন থাকে না।
কোরআন একথাও বলে এবং একই সংগে হাদীস এবং সীরাতের যাবতীয় বর্ণনাও একথার সাক্ষ্যবহ যে, রসূলুল্লাহর শিক্ষা পুরোপুরি নির্ভুল এবং নির্ভেজাল আকারে সংরক্ষিত রয়েছে। এর মধ্যে কোনো প্রকার বিকৃতি বা রদবদল হয়নি। তিনি যে কোরআন এনেছিলেন, তার মধ্যে আজ পর্যন্ত একটি শব্দেরও কম-বেশী হয়নি। এবং কিয়ামত পর্যন্তও তা হতে পারে না। নিজের কথা ও কর্মের মাধ্যমে যে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তাও আজ আমরা এমনভাবে পেয়ে যাচ্ছি, যেন আমরা তাঁরই যুগে বাস করছি। কাজেই দ্বিতীয় প্রয়োজনটাও খতম হয়ে গেছে।
আবার কোরআন মজীদ স্পষ্টভাষায় একথাও ব্যক্ত করে যে, রসূলুল্লাহর মাধ্যমে খোদার দ্বীনকে পূর্ণতা দান করা হয়েছে। কাজেই দ্বীনের পূর্ণতার জন্যও এখন আর কোনো নবীর প্রয়োজন নেই।
এখন বাকি থাকে চতুর্থ প্রয়োজন। এ সম্পর্কে আমার বক্তব্য হলো এই যে, এজন্য যদি কোনো নবীর প্রয়োজন হতো তাহলে রসূলুল্লাহর যুগে তাঁর সংগেই তাকে প্রেরণ করা হতো।কিন্তু একথা সবাই জানেন যে, এমনকোনো নবী রসূলুল্লাহর যুগে প্রেরণ করা হয়নি কাজেই এ কারণটা বাতিল হয়ে গেছে।
এখন আমরা জানতে চাই যে, রসূলুল্লাহর পর আর একজন নতুন নবী আসবার পঞ্চম কারণটা কি? যদি কেউ বলেন যে, সমগ্র উম্মত বিগড়ে গেছে, কাজেই তাদের সংস্কারের জন্য আর একজন নতুন নবীর প্রয়োজন, তাহলে তাকে আমরা জিজ্ঞেস করবো: নিছক সংস্কারের জন্য দুনিয়ায় আজ পর্যন্ত কি কোন নবী এসেছে যে শুধু এই উদ্দেশ্যেই আর একজন নতুন নবীর আবির্ভাব হলো? অহী নাযিল করার জন্যই তো নবী প্রেরণ করা হয়। কেননা নবীর নিকটেই অহী নাযিল করা হয়। আর অহীর প্রয়োজন পড়ে কোনো নতুন পয়গাম দেবার অথবা পূর্ববর্তী পয়গামকে বিকৃতির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য। আল্লাহর কোরআন এবং রসূলুল্লাহর সুন্নাত সংরক্ষিত হয়ে যাবার পর যখন আল্লাহর দ্বীন পরিপূর্ণ হয়েগেছে এবং অহীর সমস্ত সম্ভাব্য প্রয়োজন খতম হয়ে গেছে, তখন সংস্কারের জন্য একমাত্র সংস্কারকে প্রয়োজনই বাকী রয়ে গেছে- নবীর প্রয়োজন নয়।
নতুন নবুয়্যাত বর্তমানে মুসলমানদের জন্য রহমত নয়, লা’নতের শামিল
তৃতীয় কথা হলো এই যে, যখনই কোনো জাতির মধ্যে নবীর আগমন হবে, তখনই সেখানেই প্রশ্ন উঠবে কুফর ও ঈমানের। যারা ঐ নবীকে স্বীকার করে নেবে, তারা এক উম্মতভুক্ত হবে এবং যারা তাকে অস্বীকার করবে তারা অবশ্যই একটি পৃথক উম্মতের শামিল হবে। এই দুই উম্মতের মতবিরোধ কোনোআংশিক মতবিরোধের পর্যায়ে নেমে আসবে, যার ফলে তাদের একটি দল যতদিন না নিজেদের আকীদা-বিশ্বাসকে পরিত্যাগ করবে, ততদিন পর্যন্ত তারা দুই দল কখনো একত্রিত হতে পারবে না। এ ছাড়াও কার্যত তাদের প্রত্যেকের জন্য হেদায়াত এবং আইনের উৎস হবে বিভিন্ন। কেননা একটি দল তাদের নিজেদের নবীর অহী এবং সুন্নাত থেকে আইন প্রণয়ন করবে এবং দ্বিতীয়দলটি এদু’টিকে তাদের আইনের উৎস হিসেবে মেনে নিতেই প্রথমত অস্বীকার করবে। কাজেই তাদের উভয়ের সম্মিলনে একটি সমাজ সৃষ্টি কখনো সম্ভব হবেনা।
এই প্রোজ্জ্বল সত্যগুলো পর্যবেক্ষণ করার পর যে কোনো ব্যক্তি স্পষ্ট বুঝতে পারবেন যে, ‘খত্মে নবুয়্যাত’ মুসলিম জাতির জন্য আল্লাহ তায়ালার একটি বিরাট রহমত স্বরূপ। এর বদৌলতেই সমগ্র মুসলিম জাতি একটি চিরন্তন বিশ্বব্যাপী ভ্রাতৃত্বে শামিল হতে পেরেছে। এ জিনিসটা মুসলমানদেরকে এখন সব মৌলিক মতবিরোধ থেকে রক্ষা করেছে, যা তাদের মধ্যে চিরন্তন বিচ্ছেদের বীজ পবন করতো। কাজেই যেব্যক্তি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামকে হেদায়াত দানকারী এবং নেতা বলে স্বীকার করে এবং তিনি যে শিক্ষা দিয়েছেন তাছাড়া অন্য কোন হেদায়াত উৎসের দিকে ঝুঁকে পড়তে চায় না, সে আজ এই ভ্রাতৃত্বের অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে। নবুয়্যাতের দরজা বন্ধ না হয়ে গেলে মুসলিম জাতি কখনো এই ঐক্যের সন্ধান পেতোনা। কেননা প্রত্যেক নবীর আগমনের পর এ ঐক্য ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতো।
মানুষের বিবেক-বুদ্ধিও একথাই সমর্থন করে যে, একটি বিশ্বজনীন এবং পরিপূর্ণ দ্বীন দিয়ে দেবার এবং তাকে সকল প্রকার বিকৃতি ও রদবদল থেকে সংরক্ষিত করার পর নবুয়্যাতের দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়াই উচিত। এর ফলে সম্মিলিতভাবে এই শেষ নবীর আগমন করে সমগ্র দুনিয়ার মুসলমান চিরকালের জন্য একই উম্মতের অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারবে এবং বিনা প্রয়োজনে নতুন নতুন নবীদের আগমনে উম্মতের মধ্যে বারবার বিভেদ সৃষ্টি হতে পারবে না। নবী ‘যিল্লী’ হোক অথবা ‘বুরুজী ওম্মতওয়ালা শরীয়ত ওয়ালা এবং কিতাবওয়ালা- যে কোন অবস্থায়ই যিনি নবী হবেন এবং খোদার পক্ষহতে তাঁকে প্রেরণ করা হবে, তাঁর আগমনের অবশ্যম্ভাবী ফল দাঁড়াবে এই যে, তাকে যারা মেনে নেবে, তারা হবে একটি উম্মত আর যারা মানবেনা তারা কাফের বলে গণ্য হবে। যখন নবী প্রেরণের সত্যিকার প্রয়োজন দেখা যায়, তখন-শুধুমাত্র তখনই-এই বিভেদ অবশ্যম্ভাবী হয়। কিন্তু যখন তার আগমনের কোন প্রয়োজন থাকেনা, তখন খোদার হিকমত এবংতাঁর রহমতের নিকট কোনক্রমেই আশা করা যায়না যে, তিনি নিজের বান্দাদেরকে খামাখা কুফর ও ঈমানের সংঘর্ষে লিপ্ত করবেন এবং তাদেরকে সম্মিলিতভাবে একটি উম্মতভুক্ত হবার সুযোগ দেবেননা। কাজেই কোরআন, সুন্নাহ এবং ইজমা থেকে যা কিছু প্রমাণিত হয়, মানুষের বিবেক-বুদ্ধিও তাকে নির্ভুল বলে স্বীকার করে এবং তাথেকে একথাই প্রমাণিত হয় যে, বর্তমান নবুয়্যঅতের দরজা বন্ধ থাকাই উচিত।
‘প্রতিশ্রুত মসীহ’ এর তাৎপর্য
নতুন নবুয়্যাতের দিকে আহ্বানকারীরা সাধারণত অজ্ঞ মুসলমানদের বলে থাকে যে, হাদীসে ‘প্রতিশ্রুত মসীহ’ এর আগমনের খবর দেয়া হয়েছে। আর মসীহ নবী ছিলেন। কাজেই তাঁর আগমনের ফলে খতমে নবুয়্যাত কোনো দিক দিয়ে প্রভাবিত হচ্ছেনা। বরং খত্মে নবুয়্যাত এবং ‘প্রতিশ্রুত মসীহ’ এর আগমন দুটোই সমপর্যায়ে সত্য।
এই প্রসংগে তারা আরো বলে যে, হযরত ঈসা ইবনে মরিয়ম ‘প্রতিশ্রুত মসীহ’ নন। তাঁর মৃত্যু হয়েছে। হাদীসেযাঁর আগমনের খবর দেয়া হয়েছে তিনি হলেন ‘মসীলে মসীহ’ –অর্থাৎ হযরত ঈসার অনুরূপ একজন মসীহ। এবং তিনি ‘অমুক’ ব্যক্তি যিনি সম্প্রতি আগমন করেছেন। তাঁকে মেনে নিলে খত্মে নবয়্যাত বিশ্বাসের বিরোধিতা করা হয়না।
এই প্রতারণার পর্দা ভেদ করবার জন্য আমি এখানে হাদীসের নির্ভরযোগ্য কিতাবগুলো থেকে এই ব্যাপারে উল্লিখিত প্রমাণ্য হাদীস সমূহ সূত্রসহ নকল করছি। এই হাদীসগুলো প্রত্যক্ষ করে প্রত্যেক ব্যক্তি নিজেই বুঝতে পারবেন যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম কি বলেছিলেন এবং আজ তাকে কিভাবে চিত্রিত করা হচ্ছে।