অষ্টম পরিচ্ছেদ
দায়িত্বই প্রতিদান চায়
জেনে রাখুন, মানুষের জন্য রয়েছে যেমন কর্ম তেমন ফল। ভাল কর্মে তারা ফল পাবে, মন্দ কাজে পাবে মন্দ ফল। এ ক্ষেত্রে চারটি অবস্থা দেখা দেয়।
এক, জাতিগত স্বভাবের চাহিদা। যেমন গরু-ছাগল ঘাস খাবে ও বাঘ-শিয়াল মাংস খাবে। তা হলেই তাদের স্বভাব ঠিক থাকবে। তা না খেয়ে যদি বাঘ-শিয়াল ঘাস খায় ও গরু-ছাগল মাংস খায়, তখন তাদের স্ববাব খারাপ হবেই।
মানুষও তেমনি। যদি তারা এমন সব কাজ করে যাতে আল্লাহর কাছে বিনয়, দেহের পাক-পবিত্রতা, মনের সারল্য ও খোদাভীরুতা, এবং বিবেকের ইনসাফ ও ন্যায়ানুগতা প্রকাশ পায়, তা হলেই তা তার ফেরেশতা স্বভাবের পরিপোষক হবে। পক্ষান্তরে যখন তার পরিপন্থী সব কাজ করবে, তখন তার স্বভাব নষ্ট হয়ে যায়। তারপর প্রাণ যখন তার দেহভার মুক্ত হবে, তখন ভাল কাজে সুখের প্রলেপ ও মন্দ কাজে দহন জ্বালা লাভ করবে।
দুই, মালা-ই আলার প্রভাবেও মানুষের দুঃখ বা সুখানুভূতি লাভ হয়। কারো পায়ের নীচে আগুন বা বরফ থাকলে তার অনুভূতি শক্তি যেরূপ প্রভাবিত হয়, উচ্চতম পরিষদের ফেরেশতাদের খুশী-অখুশী দ্বারাও সে তেমনি প্রভাবিত হয়। এ প্রভাব মূলত দেখা দেয় স্বরূপ জগতের আদি মানুষটির, তথা মানবের জাতিগত আদি সত্তার ভেতর। সেই সত্তার সেবায় নিয়োজিত রয়েছেন ফেরেশতারা। মানব গোত্রের ওপর বিশেষ অনুগ্রহ হিসেবে তাদের সৃষ্টি করা হয়েছে। কায়া মানব যেভাবে অনুভূতি ও উপলব্ধি ছাড়া চলতে পারেনা তেমনি ছায়া মানব সেই ফেরেশতাদের ছাড়া চলতে পারে না। কোন মানুষ যখন একটি ভাল কাজ করে, তখন সেবক ফেরেশতারা খুশী হয় এবং তা থেকে আলোকরশ্মি বিচ্ছুরিত হয়। তেমনি যদি কেউ কোন খারাপ কাজ করে, সেবক ফেরেশতারা অসন্তুষ্ট ও ক্ষুব্ধ হয় এবং তা থেকে আঁধার ধোয়ার কুণ্ডুলী নির্গত হয়। এ দুটোই সেই মানব সত্তাটিকে প্রভাবিত করে এবং তাকে সুখ কিংবা দুঃখ দান করে।
কখনও সেই রশ্মি বা ধোঁয়া কিছু ফেরেশতা এবং বিশেষ একদল লোকের স্বভাবে প্রবিষ্ট হয়।ফলে তার স্বাভাবিক ইলহাম হয় ভাল কাজের মানুষটিকে ভালবাসার ও মন্দ কাজের মানুষটিকে ঘৃণা করার জন্য। সেই অনুসারে তারা সদ্ব্যবহার কিংবা দুর্ব্যবহার করে থাকে। এ অন্তর্লীন প্রভাবটির উদাহরণ এই, যখন কোন মানুষের পায়ের নীচে আগুন থাকে, তার অনুভূতি ঘটে দহন জ্বালায়। এ অনুভূতি তার মগজ থেকে বিষাদময় ধোঁয়া নির্গত করে ও তা তার অন্তরকে আচ্ছাদিত করায় দুঃখানুভূতি দেখা দেয়। ফলে স্বভাবেও বিমর্ষতা ফুটে ওঠে। অনুভূতি ও উপলব্ধি শক্তিগুলো যেভাবে দেহকে প্রভাবিত করে, ঠিক তেমনি প্রভাবিত করে সেই ফেরেশতারা আমাদের মন-মানসকে। আমাদের কারো যদি দুঃখ বা লাঞ্ছনার আশংকা দেখা দেয়, তখন সে ভয়ে কাঁপে এবং তার দেহ বিবর্ণ ও অবসন্ন হয়। কখনও বা কামনা লোপ পেয়ে প্রস্রাব লাল হয়ে যায়। এমনকি পায়খানা-প্রস্রাবও বেরিয়ে আসে। এ সবই ঘটে তার স্বভাবের ওপর অনুভূতি ও উপলব্ধির প্রভাবের কারণে। এ প্রভাব তার মগজের মাধ্যমে মনে রেখাপাত করে। বনী আদমের সাথে নির্দিষ্ট ফেরেশতার ঠিক দেহের সাথে অনুভূতির সম্পর্কের মতই সংযোগ। তাদের তরফ থেকে মানুষের ও নিম্নস্তরের ফেরেশতাদের ওপর স্বভাবজাত প্রভাব ও প্রকৃতিগত বিবর্তন চলতেই থাকে।
তারপর যেভাবে ভালর আলো ও মন্দের আঁধার ওপর থেকে নীচে নেমে আসে, তেমনি নীচ থেকেও তা ওপরে উঠে এমনকি পবিত্র দরবারে পর্যন্ত পৌঁছে যায়। তার ফলে আল্লাহর জ্যোতিতে বিশেষ এক অবস্থার সৃষ্টি হয়, যাকে রহমত বা গজব বলা হয়। আগুনের তাপে যেমন পানি উত্তপ্ত হয়, যুক্তিজাল বিন্যাসের পর সিদ্ধান্ত বের হয় এবং দোয়া করলে কবুলের কারণ সৃষ্টি হয়, এও ঠিক তেমনি ব্যাপার। বস্তুত আল্লাহ জ্যোতিতে উক্ত অবস্থা সৃষ্টির পর আত্মিক জগতে নতুন নতুন অবস্থা ও বিবর্তনের সৃষ্টি হয়।
কখনও ক্ষোভ ও আক্রোশ সৃষ্টি হয়। তওবা হলে তা আবার লোপ পায়। কখন আবার রহমান দেখা দেয়। রহমত আবার অপরাধ হলে আজাবে রূপান্তরিত হয়। স্বয়ং আল্লাহ পাক বলেনঃ
(আরবী*****************************************************************)
সূরা রা’দঃ ১১
“নিশ্চয় আল্লাহ কোন জাতির ভাগ্য বদলান না, যতক্ষণ তারা নিজেদের ভাগ্য নিজেরা না বদলায়”।
মহানবী (সঃ) বিভিন্ন হাদীসে বলেছেন, আদম সন্তানের যা কিছু কাজ ফেরেশতারা আল্লাহর সমীপে নিয়ে যান। কিংবা আল্লাহপাক ফেরেশতাদের জিজ্ঞেস করেন, আমার বান্দাদের কি অবস্থায় রেখে এসেছ? অথবা আল্লাহর কাছে রাতের কার্যাবলীর আগে দিনের কার্যাবলী পৌঁছে থাকে। এ সব বক্তব্য থেকে বুঝা যায়, জ্যোতির্ময় আল্লাহ ও তাঁর বান্দাদের ভেতর পবিত্র পরিষদের মাধ্যমে যে সম্পর্ক বিদ্যমান, ফেরেশতারা সে সম্পর্ক রক্ষার দায়িত্বই পালন করেন।
তিন, মানুষের ওপর যা কিছু অপরিহার্য করা হল তা শরীয়তেরই দাবী। এক জ্যোতির্বিদ যেমন জানেন, নক্ষত্রমণ্ডলীর যখন নিজ নিজ গতিপথ ও অবস্থানগুলোর বিশেষ এক স্থান লাভ ঘটে, তখন সেই স্থানের বিশেষ শক্তির প্রভাবে এক ধরনের আত্মিক ও আধ্যাত্মিক পরিমণ্ডল সৃষ্টি হয়। সে অবস্থাটি আকাশের কোথাও কেন্দ্রিভূত হয়ে ছায়ারূপ ধারণ করে। তারপর যখন আকাশের রীতিনীতির নিয়ন্তা জগৎ উদ্ভাসিনী পূর্ণ চন্দ্রের সেই আত্মিক কথা গ্রহণের অবস্থাটিকে পৃথিবীতে প্রতিভাত করেন, তখন পৃথিবীর মানুষ সেই শীতল চন্দ্রালোক দ্বারা আকৃষ্ট ও অভিভূত হয়।
ঠিক এভাবেই এক আল্লাহ প্রাপ্ত ব্যক্তি জানেন, বিশেষ এক সময় আসে যেটাকে লায়লাতুল কদর বা বরকতের রাত বলে আখ্যায়িত করা হয় এবং যে সময়ে সমস্ত হিকমতপূর্ণ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গৃহীত ও সেগুলো বণ্টিত হয়, তখনও মানুষের সাথে সম্পৃক্ত আত্মিক জগতে এক বিশেষ অবস্থার সৃষ্টি হয়। তাই প্রয়োজন ও সময়ের চাহিদা মোতাবেক সেই যুগের উত্তম ও শ্রেষ্ঠ মেধাসম্পন্ন ব্যক্তির কাছে ইলহাম বা ওহী অবতীর্ণ হয়। তাঁর মাধ্যমে সে সব ইলহাম পৌঁছানো হয় তাঁদের কাছে যাদের ব্যক্তিত্ব ও মেধা ঠিক তাঁরই কাছাকাছি রয়েছে। তারপর অন্যান্য সাধারণ লোকের অন্তরে এ ইলহাম পৌঁছানো হয় যে অবতীর্ণ ইলহামগুলোকে মেনে চলে এবং ভাল জানে। তারপর সে সব ইলহামের সমর্থক ও সহায়কদের সাহায্য করা হয়। পক্ষান্তরে সেগুলোর বিরোধীদের লাঞ্ছিত ও পরাভূত করা হয়। নিম্ন জগতের ফেরেশতাদের ইলহাম পৌঁছানো হয় অবতীর্ণ বিধানাবলীর অনুসারীদের সাথে সদ্ব্যবহার ও বিরোধীদের সাথে দুর্ব্যবহার চালাতে। তারপর এক ধরনের উজ্জ্বল দ্যুতি ও প্রভাব সাধারণ পরিষদ ও উচ্চতম পরিষদে পৌঁছে যায়। ফলে সেখান থেকে সন্তুষ্টি কিংবা অসন্তুষ্টি প্রকাশ পেয়ে থাকে।
চার, নবীর আনুগত্য। আল্লাহ পাক যখন কাউকে মানুষের মাঝে নবী করে পাঠান এবং এ কাজের মাধ্যমে তিনি মানুষের কল্যাণ সাধন ও তাদের ওপর অনুগ্রহ বর্ষন করতে চান, তখন মানুষের ওপর তাঁর আনুগত্য অপরিহার্য করেন। তখন নবীর কাছে তাঁর যে সব ওহী আসে সেগুলো নির্দিষ্ট বিদ্যায় রূপ লাভ করে। সে বিদ্যা নবীর হিম্মৎ ও দোয়ার ফলে সুদৃঢ় ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে চলে। আল্লাহ পাকেরও নির্দেশ হয় তা সুপ্রতিষ্ঠিত হবার ব্যাপারে সহায়তার জন্য।
যেমন কর্ম তেমন ফলের এ চার ধরনের প্রয়োজনের ভেতর প্রথম দু’ধরনের প্রয়োজন অর্থাৎ জাতিগত স্বাভাবিক চাহিদা ও উচ্চতম পরিষদের প্রভাবগত চাহিদা মানুষের সৃষ্টিগত প্রকৃতিরই চাহিদা মাত্র। যে প্রকৃতি দিয়ে আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তা চির অপরিবর্তনীয়।
তবে পাপ ও পুণ্যের বিধান মানব প্রকৃতিতে সামগ্রিকভাবে বিধৃত রয়েছে, বিস্তারিত ভাবে নয়। এ প্রকৃতিগত মানবিক ধর্মটি কলোত্তীর্ণ ও সার্বজনীন। সব নবীই এ মৌলিক ধর্মের ক্ষেত্রে এক ও অভিন্ন মতাবলম্বী। যেমন আল্লাহ বলেনঃ
(আরবী**********************************************************************)
সূরা মু’মিনুনঃ আয়াতঃ ৫২
“এই হল তোমাদের উম্মতের পরিচয়, এ উম্মত সবাই এক”।
মহানবী (সঃ) বলেন, ‘নবীরা সবাই বৈমাত্রেয় ভাই। বাপ তাদের এক, মা পৃথক’। এ প্রকৃতিগত মানব ধর্মটুকুর জন্য প্রতিটি মানুষকে জবাবদিহি করা হবে। নবী তাঁর কাছে আসুক বা না আসুক।
তৃতীয় ধরনের প্রতিদান দাবী (শরীয়তের চাহিদা) যুগের পরিবর্তনের সাথে পরিবর্তিত হয়ে চলে। এ জন্যেই যুগে যুগে ভিন্ন ভিন্ন নবী ও রাসূল পাঠাতে হয়েছে। মহানবীর (সঃ) হাদীসে এর ইংগিত এ ভাবে রয়েছে, ‘আমার ও আমার ওপর অবতীর্ণ বিধানের অবস্থা হল এই,কোন লোক যেন এক জাতির কাছে এসে বলল, হে জাতি! আমি নিজ চোখে শত্রু সৈন্য দেখে এলাম। তাই খোলাখুলি তোমাদের সাবধান করছি। তোমরা এক্ষুণি পালিয়ে প্রাণ বাঁচাও। তখন সেই জাতির একটি দল তার খবর শুনে মেনে নিল এবং শত্রু সৈন্য পৌঁছার আগেই ভোর না হতে পালিয়ে বাঁচল। অন্য দল তার খবরকে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিয়ে সকাল পর্যন্ত আরামে নিদ্রা গেল এবং সকালেই শত্রু সেনারা এসে তাদের মেরে ফেলল। ঠিক তেমনি আমাকে যারা মানল ও আমার বিধানকে সত্য জানল, তারা বেঁচে গেল এবং যারা আমাকে মিথ্যা জানল ওআমার বিধানকে অমান্য করল, তারা মারা পড়ল।
এখন রইল চতুর্থ ধরনের প্রতিদান প্রকৃতি। সেটা হল নবী প্রেরণের চাহিদা। এ চাহিদা নবী প্রেরিত না হওয়া পর্যন্ত দেখা দেয় না। নবী এসে সবার কাছে সে বিধানগুলো পৌঁছে দেবার ও তাদের সব সংশয় সন্দেহ নিরসনের পর যারা জেনে শুনে বাঁচতে কিংবা ধ্বংস হতেচায়, তাদের বেলায় এ প্রয়োজন দেখা দেয়। তখন আর এ প্রয়োজন অস্বীকার করার তাদের কোন অজুহাত অবশিষ্ট থাকেনা।
নবম পরিচ্ছেদ
বিভিন্ন স্বভাবের বিচিত্র মানুষ
মানুষের স্বভাবের বিভিন্নতার কারণেতাদের কার্য-কলাপ, নৈতিকতা ও মর্যাদার পার্থক্য দেখা দেয়। এর সপক্ষে পাই মহানবীর (সঃ) এ হাদীসটি “যদি তুমিশোন কোন পাহাড় এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলে গেছে, তা হলে তুমি তা বিশ্বাস করলেও করতে পার। কিন্তু যদি শুনতে পাও অমুক ব্যক্তির স্বভাব প্রকৃতি বদলে গেছে, তাকে কখনও বিশ্বাস করো না। কারণ, অবশেষে সে তার মূল স্বভাবেই ফিরে আসবে”। অন্যত্র তিনি বলেন, “দেখ, আদম সন্তানের বিভিন্ন প্রকৃতি দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে। তাদের ভেতর কিছু লোক মু’মিন হিসেবে জন্ম নিয়েও কাফের হয়ে মারা যায় ইত্যাদি”। এ হাদীসটি পুরোপুরি বর্ণনার পর ক্ষোভ, অধিকার, ঋণ প্রকাশ ও আদায়ের ব্যাপারে বিভিন্ন স্বভাবের মানুষের ভিন্ন ভিন্ন অবস্থার উল্লেখ করেন। এক স্থানে তিনি বলেছেন, সোনা ও রূপার খনি যেমন পৃথক হয়, তেমনি (গোত্র ও ঈমানের বিচারে) মানুষ বিভিন্ন প্রকৃতির হয়ে জন্ম নেয়।
স্বয়ং আল্লাহপাক বলেনঃ-
(আরবী****************************************************************************)
সূরা বনী ইস্রাঈলঃ আয়াতঃ ৮৪
“(হে মুহাম্মদ) বলে দাও, প্রত্যেকেই যার যার স্বভাব মতে কাজ করে”।
উপরোক্ত হাদীসগুলোর যে অর্থ ও তাৎপর্য আমার কাছে ধরা দিয়েছে, যদি আপনিও তা হৃদয়ংগম করতে চান, তা হলে শুনে নিন, মানুষের ভেতরে দু’ধরনের ফেরেশতা খাসলাত পয়দা করা হয়েছে। তার ভেতর একটি উচ্চ পরিষদের অনুকূল জ্ঞানে পরিপূষ্ট থাকা, রহস্যময় স্রষ্টার গভীর ও সূক্ষ্ম রহস্যাবলীর খবর রাখা এবং নিখিল সৃষ্টির উত্তম ব্যবস্থাপনার রীতি-নীতি ভালভাবে আয়ত্ত করা। উদ্দেশ্য হল, সে সব জ্ঞান আয়ত্ত করে বাস্তবে রূপায়ণের জন্য সেদিকে সর্ব প্রয়াসে নিয়োজিত থাকা। দ্বিতীয়টি নিম্ন পরিষদের অনুকূল ও উপযোগী হয়। নিম্ন পরিষদের কাজই হল ওপরের হুকুম তামিল করা। তা আয়ত্তের চিন্তা করে না এবং সেদিকে সাহস ও প্রয়াস ব্যয় করে না, কেন্দ্রিভূতও করে না। তাই তারা সেগুলোর ব্যাপারে ওয়াকেফহাল থাকে না এবং আল্লাহর গুণাবলী ও নামাবলীর জ্ঞান থেকেও তারা বঞ্চিত। অবশ্য তাদের ভেতরে নূরের দ্যুতি রয়েছে। ফলে জৈব স্বভাব থেকে তারা পবিত্র ও উন্নত থাকে।
তেমনি জৈব স্বভাবও দু’ধরনের। এক, প্রবল ও শক্ত স্বভাব। যেমন, অতি আদর-যত্নে পালিত ষাঁড়। তার যেমন বপু বিশাল, আওয়াজ বিকট, শক্তি বিপুল ও দেহ মেদুল হয়ে থাকে, তেমনি সে তীব্র কামপ্রবণ, ভীষণ হিংসুটে, প্রবল বিজয় বাসনা, কঠিন প্রতিশোধ স্পৃহা ও ভয়ানক বেপরোয়া প্রকৃতির হয়।
দুই, অত্যন্ত দুর্বল স্বভাব। তার উদাহরণ হল, জন্মগত ত্রুটিপূর্ণ কিংবা খাসী করা পশু। তা ছাড়া দুর্ভিক্ষ পীড়িত, অনশনক্লিষ্ট ও অযত্নে পালিত জীব। তার বপু কৃশ, আওয়াজ ক্ষীণ, প্রকৃতি দুর্বল ও সে প্রতিশোধ স্পৃহা বা বিজয় কামনাহীন হয়ে থাকে। প্রত্যেক মানুষের ভেতর এর যে কোন একটি জৈব শক্তির অস্তিত্ব রয়েছে। ফলে যার ভেতর যে শক্তি ঠাঁই পায়, সে লোকটি সেভাবেই চিহ্নিত পরিচিত হয়। ফেরেশতা কি পশু শক্তি উভয়ের বেলায়ই এ দু’টো স্তরের পরিচয় মিলবে।
মানুষ তার কার্যকলাপ দ্বারা এ সব অন্তর্নিহিত প্রাকৃতিক শক্তিকে অধিকতর শক্তিশালী বা দুর্বল হতে সহায়তা করে থাকে। ফেরেশতা ও পশু প্রবৃত্তির একই সংগে মানুষের ভেতরে অবস্থানের ফলে দুটো অবস্থা দেখা দেয়। এক, উভয় শক্তির ভেতরে টানা-পোড়ন চলতে থাকে। প্রত্যেকটি শক্তিই যখন নিজের দিকে মানুষটিকে টানতে থাকে ও তার দ্বারা নিজের দাবী প্রতিষ্ঠা করতে ও ইচ্ছা প্রতিফলিত করতে চায়, তখন এ টাগ-অফ-ওয়ার নিতান্তই স্বাভাবিক। এর যে শক্তিই বিজয়ী হোক অপর শক্তিটির প্রভাব মুছে ফেলবে। দ্বিতীয় অবস্থাটি হল, উভয়ের ভেতর সমঝোতা ও একতার। এ অবস্থায় ফেরেশতা প্রকৃতি প্রতিদ্বন্দ্বিতা পরিহার করেতার দাবীর কাছাকাছি কিছু মেনে নিয়ে কোন মতে গা বাঁচিয়ে চলে। যেমন বিবেক, মহানুভবতা, উদারতা, নিঃস্বার্থপরতা, পবিত্রতা ও ত্যাগ-তিতিক্ষার থেকে কিছুটা শিথিলতা নিয়ে কাজ করা। পক্ষান্তরে পশু শক্তিও তার মূল অবস্থান থেকে কিছুটা উপরে উঠে এসে সাধারণের মতামতের সাথে মোটামুটি তাল মিলিয়ে চলে। এরূপ ক্ষেত্রে পরস্পর বিরোধী মত দুটো দ্বন্দ্বের বদলে সন্ধি করে নেয়। এ সন্ধি অবস্থায় মূলত উভয় প্রকৃতি মিলে গিয়ে এক তৃতীয় প্রকৃতির সৃষ্টি হয়। তারপর পশু শক্তি, ফেরেশতা শক্তি ও তৃতীয় মিশ্র শক্তির প্রত্যেকেরই দুটো চরম দিক ও একটি মধ্যপন্থা থাকে। তারপর চরমের কাছাকাছি, মধ্য পথের কাছাকাছি ইত্যাকার রূপে তিন প্রকৃতি বহু প্রকৃতিতে রূপান্তরিত হয়ে হয়ে চলে। তার ভেতর প্রধান হল আটটি। এ আটটির পরিচয় পেলে তা থেকে অন্যান্যগুলোও জানা যায়। তার ভেতরে চারটি সৃষ্টি হয় মূল শক্তি দুটোর পারস্পরিক আকর্ষণ-বিকর্ষণ থেকে।
এক, প্রবলতম ফেরেশতা খাসলত ও প্রবলতম পশু স্বভাবের মিলনে এ শক্তির অভ্যুদয় ঘটে।
দুই, প্রবলতম ফেরেশতা শক্তি ও দুর্বলতম পশু শক্তির মিলনে উৎপত্তি।
তিন, দুর্বলতম ফেরেশতা স্বভাব ও প্রবলতম পশু স্বভাবের মিলনে এর জন্ম।
চার, দুর্বলতম ফেরেশতা শক্তি ও দুর্বলতম পশু শক্তির মিলনে এর উদ্ভব ঘটে।
এভাবে এগুলোর পারস্পরিক সন্ধি ও মিলন থেকে অপর চারটি প্রকৃতি জন্ম নেয়। সেগুলোও স্বতন্ত্র রীতি ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী এবং অপরিবর্তনীয়।
কেউ যদি এ সব স্বভাবের বৈশিষ্ট্য ও রীতি জানতে পায়, সে অনেক হয়রানি থেকে বেঁচে যায়। আমি শুধু এখানে সে সব ব্যাপারই বলব যা এ গ্রন্থে প্রয়োজন হবে।
স্মরণ রাখা প্রয়োজন, যার পশু শক্তি সবলতম, তাকে কঠিন আত্মিক সাধনায় লিপ্ত হতে হবে। বিশেষত যার ভেতর তৃতীয় বা মিশ্র শক্তির সমাবেশ রয়েছে, তার জন্য এ সাধনা অপরিহার্য। মানবতার পূর্ণত্ব প্রাপ্তি তারই ঘটবে যার ভেতর ফেরেশতা শক্তি বা বিবেক বিজয়ী রয়েছে। মিলিত স্বভাবের লোক আচরণ ও কাজ-কর্মে সব চাইতে ভাল হয়। টানা-পোড়েন ক্লিষ্ট ব্যক্তিত্ব যদি পশু শক্তি থেকে মুক্তি পায়, তা হলে ইলম ও মা’রেফতে উত্তম হয়। কিন্তু আমলের ক্ষেত্রে উদাসীন হয়। যে কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজে তারই উৎসাহ থাকেনা যার ভেতর পশু দুর্বল ভাবে সক্রিয়।
তেমনি প্রবল উন্নত (ফেরেশতা) স্বভাবের লোক সব কিছু ছেড়ে আল্লাহর দিকে মনোনিবেশ করবে। দুর্বল উন্নত স্বভাবওয়ালা যদি সুযোগ মিলে ও পশু স্বভাব থেকে রেহাই পায়, আখেরাতের জন্যই পার্থিব কাজ-কর্ম ত্যাগ করবে, পার্থিব অলসতা বা আয়েশের জন্য নয়। বড় বড় কাজে সে ব্যক্তি দেহ-মন নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে যার পশু প্রকৃতির প্রাবল্য রয়েছে। পক্ষান্তরে উন্নত প্রকৃতির লোকেরা নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের কাজে বেশী আত্মনিয়োগ করবে। মিশ্র প্রকৃতির লোক সব ধরনের কাজেই লিপ্ত হয়। দুর্বল বিবেকের মানুষ যুদ্ধ-বিগ্রহ ও দাংগা-হাংগামার কাজে বেশী নিয়োজিত থাকে।
বিবেক ও প্রবৃত্তির টানা-পোড়েনে বিক্ষত ব্যক্তি যদি প্রবৃত্তির অনুসারী হয়, শুধুই পার্থিব কাজে লেগে যাবে এবং যদি বিবেকের অনুগত হয়, শুধুই অপার্থিব কাজ ও সাধনায় ডুবে থাকবে। আপোষমূলক স্বভাবের লোকেরা পার্থিব ও অপার্থিব উভয় কাজে সমানে অংশ রাখবে। একই সঙ্গে পাপ ও পুণ্য দুটোই চালাবে।
এ সব প্রকৃতির ভেতর বিবেক যাদের খুবই উন্নত হবে, সে পার্থিব ও অপার্থিব, উভয় নেতৃত্বের উপযোগী হবে। আল্লাহর মর্জীতে তারা সব সময় সে ক্ষেত্রে জেঁকে বসবে। সার্বিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব যথা লেখাফত (রাষ্ট্রপরিচালনা) ও ইমামত (জাতীয় নেতৃত্ব) তাদের হাতেই থাকবে। এ ধরনের লোকরাই নবী, নায়েবে নবী, ধর্মীয় দিকপাল, যুগনায়ক ও রাষ্ট্রনায়ক হয়ে থাকেন। যাদের জন্য আল্লাহর দ্বীন অনুসরণ অপরিহার্য করা হয়েছে, তারা মিশ্র স্বভাবের এবং ফেরেশতা প্রকৃতির জোর তাদের কিছুটা বেশী। পক্ষান্তরে মিশ্র প্রকৃতিতে ফেরেশতা প্রকৃতি যাদের অপেক্ষাকৃত দুর্বল, তারা উপরোক্ত দলের অত্যন্ত অনুগত হয়। কারণ এ ধরনের লোক আল্লাহর রহস্য পুরোপুরি লাভ করে। এদের কিছুটা দূরে থাকে টানা-পোড়েন বা দ্বিধা-দ্বন্দ্বের দল। কারণ, এ দলটি সরাসরি প্রকৃতিগত আঁধারে হাবুডুবু খেয়ে সত্যের ওপর সঠিক ভাবে স্থির থাকতে পারে না। তবে এ দলের লোক যখন দ্বিধা কাটিয়ে ওঠে, তখন যদি উন্নত খেয়ালের লোক হয় তা হলে শরীয়তের রহস্য নিয়ে তারা গবেষণায় ডুবে থাকে। শরীয়তের বাহ্যিক রূপ ছেড়ে তারা সম্পূর্ণ শক্তি ও সাধনা ব্যয় করবে মা’রেফতের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম রহস্য অবহিত হওয়ার ও সেই রঙে নিজকে রঞ্জিত করার জন্য। যদি তত উন্নতমনা না হয় তা হলে শুধু আধ্যাত্মিক সাধনায় কষ্ট-ক্লেশ করে কাশফ-ইশরাফ (অপরের মনের কথা জানা) ও দোয়া কবুলের মত ফেরেশতা স্বভাবের ঔজ্জ্বল্য নিয়েই সন্তুষ্ট থাকবে। কিন্তু আল্লাহর আসল রহস্যাবলী তার অন্তরে ঠাঁই পাবে না। তা জানতে পারে শুধু প্রকৃতির ওপর জোর খাটিয়ে কিংবা প্রকৃতিগত আলোর আশ্রয় নিয়ে।
আমার প্রতিপালক আমাকে এ সব রীতি-নীতি জানিয়েছেন। এগুলো যারা গভীরভাবে অনুধাবন করবে, আল্লাহ প্রেমিকদের অবস্থাগুলো তাদের কাছে সুস্পষ্ট হয়ে যাবে এবং তাদেরকে কতটুকু কামেল তা জানতে পাবে। তাদের রীতি-নীতির মর্তবাও তারা জানতে পাবে।
এ বিদ্যা আল্লাহ তা’লা শুধু আমাকেই দেন নি, আরও অনেককেই এরূপ অনেক জ্ঞান দান করেছেন। কিন্তু অধিকাংশ লোকই এ দানের কৃতজ্ঞতা আদায় করে না।
দশম পরিচ্ছেদ
কর্ম প্রেরণার উৎস
জানা দরকার, মানুষের যে সব মনোগত ও মস্তিষ্ক প্রসূত ভাব তাদের বিভিন্ন কাজে উস্কানী দেয় ও অনুপ্রেরণা জোগায়, অবশ্যই সেগুলো উদয়ের পেছনে কোন না কোন কারণ রয়েছে। কারণ, সব কিছুই সৃষ্টি হওয়ার ব্যাপারে আল্লাহর কার্য কারণ রীতি সক্রিয় রয়েছে। প্রত্যক্ষ উদাহরণ, অভিজ্ঞতা ও সঠিক চিন্তা-ভাবনা থেকে এ কথা সুস্পষ্ট হয়ে ধরা দেয় যে, সত্যিই সে সব মনোগত ভাবের পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে।
মোট কথা সে সব কারণের সেরা কারণ হল আল্লাহদত্ত মানব প্রকৃতি। এর আগে এ সম্পর্কিত একটি হাদীস উদ্ধৃত হয়েছে (পাহাড় টললেও স্বভাব টলেনা হাদীস)। তার ভেতরও মানুষের প্রকৃতিগত প্রবণতার কথা রয়েছে।
খানা-পিনার মত বিভিন্ন অবস্থার প্রভাবে সেগুলোর অবস্থার পরিবর্তন ঘটে থাকে। তাই দেখি, ক্ষুধার্ত খেতে চায়, তৃষ্ণার্ত পানি চায়, কামাতুর নারী চায় ইত্যাদি। কখনও মানুষ এমন বস্তু খায় যা তার কাম প্রবণতা বাড়িয়ে দেয়। ফলে সে নারী ঘেঁষা হয়ে যায়। তাই তার গোটা ভাবনা-চিন্তা নারী কেন্দ্রিক হয়ে যায়। এ থেকেই সে অনেক অঘটন ঘটিয়ে থাকে। কখনও এমন রূঢ় বস্তু খায় যা তার অন্তরে রূঢ়তা সৃষ্টি করে। ফলে সে মানুষকে হত্যা করার মত কঠিন কাজ করতেও দ্বিধান্বিত হয় না। এ স্বভাবের কারণে সে এমন সব সাধারণ ব্যাপারেও ক্ষেপে যায় যাতে অন্য সবাই ক্ষিপ্ত হবার চিন্তাও করে না।
এ দু’ধরনের লোক যখন নামায-রোযার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধির চেষ্টা চালায় কিংবা বেশ বৃদ্ধ হয়ে যায়, অথবা কঠিন পীড়াগ্রস্ত হয়, তখন তার আগের অবস্থা অনেকটা বদলে যায়। তার অন্তর নম্র এবং প্রকৃতি সরল হয়ে যায়। এ কারণেই যুবক ও বৃদ্ধের অবস্থার তারতম্য সুপ্রকট হয়ে থাকে। এ পার্থক্যের কারণেই মহানবী (সঃ) রোজা থাকা অবস্থায় বৃদ্ধদের স্ত্রীকে চুমু খাওয়া বৈধ করেছেন, অথচ তরুণদের বেলায় তা নিষিদ্ধ রেখেছেন।
মোট কথা কারো কোন কিছুর অভ্যেস হওয়ার বা কিছু ভাল লাগার পেছনে কারণ হল, সে সেটা বেশী করে করার ফলে মনের পাতায় তা বিচিত্র হয়ে যায়। ফলে অধিকাংশ সময়ই সেটার ভাবনা তাকে পেয়ে বসে।
কখনও মানবিক প্রবৃত্তি পশু প্রকৃতির খপ্পর থেকে বেরিয়ে গিয়ে উচ্চ পরিষদ থেকৈ সাধ্যানুসারে দ্যুতিময় হয়ে থাকে। তার ফলে ভাল কাজের প্রেরণা ও প্রীতি এবং মানসিক শান্তি ও স্বস্তি দেখা দেয়। এ থেকেও কখনও কোন উন্নত মানের ভাল কাজ করার দৃঢ় সংকল্প দেখা দেয়।
কখনও জৈবিক প্রবৃত্তি শয়তানের সাহচর্যে পড়ে তারই রঙে রঞ্জিত হয়। তখন মন মগজে যে সব খেয়ালের উদ্ভব হয় তা থেকে মানুষের খারাপ কাজগুলো দেখা দেয়।
স্মরণ রাখা প্রয়োজন, স্বপ্নও অধিকাংশ ক্ষেত্রে মন-মগজের খেয়াল থেকে জন্ম নেয়। পার্থক্য শুধু এই, স্বপ্নের জন্য মন পরিস্কার ও নির্ভেজাল থাকা চাই।তা হলেই তা তে স্বপ্নের কথাগুলো বিচিত্র ও রূপায়িত হতে পারে। (জাগরণে খেয়ালগুলো শতধা বিক্ষিপ্ত থাকে ও স্বপ্নে সেগুলো সুবিন্যস্ত হয়।) বিশেষত ইবনে সিরীনবলেন, স্বপ্ন তিন ধরনের। এক, অন্তরের স্বগতোক্তি। দুই, শয়তান ভীতি। তিন, আল্লাহর সুসংবাদ।
একাদশ পরিচ্ছেদ
যার কাজ তার সাথেই থাকে
সংখ্যাও সুরক্ষিত হয়
আল্লাহ পাক বলেনঃ
(আরবী**********************************************************************)
সূরা বনী ইস্রাঈলঃ আয়াতঃ ১৩-১৪
“আমি প্রত্যেক মানুষের কাজ তার গলায় ঝুলিয়ে রেখেছি। কিয়ামতের দিন সেগুলো গ্রন্থাকারে তাদের সামনে খুলে ধরব। তারপর বলব, পড়ে নাও তোমার কাজের ফিরিস্তি। এটাই তোমার হিসেব-নিকেশের জন্য যথেষ্ট”।
মহানবী (সঃ) আল্লাহ পাক থেকে বর্ণনা করেন, “কেয়ামতের দিন আল্লাহ পাক বলবেন, এই হল তোমাদের আমলনামা। আমি এটা সযত্নে সুরক্ষিত রেখেছি”। এরই বিনিময় তুমি পাবে। তাই সুফল যে পাবে, আল্লাহর কাছে তার কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত। কুফল যে পাবে, তার নিজেকেই ধিক্কার দেয়া উচিত”।
তিনি আরও বলেন, প্রবৃত্তির বাসনা-কামনা জাগে। অংগ-প্রত্যংগ হয় তা বাস্তবায়িত করে, নয় তো মিথ্যা করে দেয়।
জেনে রাখুন, মানুষ স্বেচ্ছায় যে কাজগুলো করে সেগুলো এবং তার ভেতর দানা বেঁধে থাকা অভ্যেস ও চরিত্রগুলো তার সব কিছুর উৎস ক্ষেত্র মানবিক প্রাণ থেকে নির্গত হয়ে সেখানেই আবার ফিরে এসে সঞ্চিত ও সুরক্ষিত হয়ে থাকে। এখন প্রশ্ন থেকে যায়, প্রাণ থেকে সেগুলোর সৃষ্টি হয় কি ভাবে? এর কারণগুলো আমি আগেই বলে এসেছি। তা এই, মানব দেহের অভ্যন্তরে ফেরেশতা প্রকৃতি ও পশু প্রকৃতির এবং এ দুয়ের সংঘাত ও সংমিশ্রণে সৃষ্ট অন্যান্য প্রকৃতির প্রত্যেকটিই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। মানুষের স্বভাবগত প্রবণতা, ফেরেশতা ও পশু প্রকৃতির প্রভাব এবং এ ধরনের যে সব কারণ মানুষের কাজের প্রেরণা জোগায়, সবগুলোই মানব প্রকৃতি থেকে আত্মপ্রকাশ করে এবং সেখানেই নিহিত থাকে। সুতরাং বুঝা গেল, মানুষের মূল প্রাণই সব কিছুর উৎসভূমি। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে তার থেকেই সবার জন্ম।
এর জ্বলন্ত উদাহরণ নিন। শিশু যদি শুরুতেই খুব দুর্বল প্রকৃতির হয়, তা হলে যে কোন মনস্তত্ত্ববিদ সহজেই বলে দেবেন, যদি এ শিশু এখনকার প্রকৃতি নিয়ে যুবক হয়, তা হলে অবশ্যই তার নারীসুলভ স্বভাব, আচরণ ও কীর্তিকলাপ দেখা দেবে। তেমনি যে কোন দেহতাত্ত্বিক ডাক্তারও জানে, অমুক শিশু তার জন্ম লগ্নের প্রকৃতি অনুসারে যুবক হলে এবং লালন-পালনের সময়ের কোন অসুখ বিসুখ ইত্যাদি দেখা না দিলে, সে চতুর ও সাহসী হবে কিংবা বোকা ও দুর্বল চিত্ত হবে।
তখন প্রশ্ন থাকে, কাজগুলো নির্গত হয়ে মূল প্রাণে আবার ফিরে আসে কেন? তার কারণ এই, মানুষ যখন কোন কাজ বেশী করে, তখন এরূপ অভ্যস্ত হয় যে, বিনা চিন্তা-ভাবনায় স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে তার থেকে সে কাজ হয়ে থাকে। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, তার অন্তর উক্ত কাজের রঙে রঞ্জিত হয়ে গেছে। এ সহজাত প্রভাব সমগোত্রীয় অন্যান্য কাজকেও আকৃষ্ট করে থাকে। হোক সে প্রভাব যত সূক্ষ্ম বা হাল্কা। মহানবীর (সঃ) নিম্ন হাদীসটি এ বক্তব্যের সমর্থন জানাবেঃ
“বিভ্রান্তির চিন্তা ও প্রবণতা মানুষের অন্তরকে মাদুরের বুননীর মত ঘিরে নেয়। যে অন্তর তার প্রভাব গ্রহণ করে, তার ওপর একটি কালো দাগ পড়ে যায়। পক্ষান্তরে যে অন্তর তা গ্রহণ করে না, তার ওপর একটা সাদা দাগ পড়ে। এভাবে দাগ পড়ে দু’অন্তরের অবস্থা এই দাঁড়ায়, একটি সাদা মর্মরের মত ঝকঝকে ও তেলতেলে হয়ে যায়। ফলে তাতে আর কখনও কোন খারাপ প্রভাবে ক্ষতির আশঙ্কা থাকে না। অপরটি এরূপ মসীবর্ণ ও পিচ্ছিল হয় যে তাতে খেয়াল খুশীল চরিতার্থতা ছাড়া ভালমন্দের কোন তারতম্য বোধই অবশিষ্ট থাকে না”।
এখন প্রশ্ন থেকে যায়, কাজ কি করে সঙ্গে জড়িয়ে থাকে? তার কারণ এই, মানবিক প্রবৃত্তি (অন্তর) গোড়ার দিকে সাদা ও পরিচ্ছন্ন এক পাত্র রূপে তৈরি হয়। কোনরূপ চিহ্ন বা রঙ তাতে থাকে না। তারপর শক্তি তাকে চালিত করে কাজের দিকে এবং দিন দিন সেদিকে সে এগিয়ে চলে। এ ক্ষেত্রে তার প্রতিটি পশ্চাতের অবস্থা পরবর্তী অবস্থার কারণ হয় এবং কার্য সৃষ্টি করেই কারণ লোপ পায়। এ কার্যকারণ ব্রতটি ধারাবাহিক চলতে থাকে এবং কখনও তাতে আগেরটি পেছনে ও পেছনেরটি আগে আসার জো-নেই। তাই আজ যে অন্তর বর্তমান, তাতে অতীতের প্রতিটি কারণের প্রভাব বিদ্যমান। যদিও বিভিন্ন বাহ্যিক ব্যস্ততার কারণে অন্তরে তার পূর্ণ উপলব্ধি থাকে না।
শুধু দুটো অবস্থাতেই এ প্রভাব হবার সম্ভাবনা রয়েছে। এক, কার্য সৃষ্টির মূলে যে শক্তিটি সক্রিয় যদি সেটা বিলুপ্ত হয়। যেমন বৃদ্ধ ও রুগ্নের অবস্থার কথা আমি বলে এসেছি যে, তাদের বিশেষ কর্ম প্রবণতাই বিলুপ্ত হয়। দুই, যদি উপর থেকে কোন (দৈব) প্রভাব এসে কারো বিশেষ প্রবণতাটি বৃদ্ধ ও রুগ্নের মতই বিলুপ্ত করে দেয়। এ অবস্থা সম্পর্কেই আল্লাহ পাক বলেনঃ
(আরবী***************************************************************************)
সূরা হুদঃ আয়াতঃ ১১৪
“নিশ্চয় ভাল কাজ মন্দ কাজকে বিলুপ্ত করে”।
তিনি আরও বলেনঃ
(আরবী******************************************************************)
সূরা যুমারঃ আয়াতঃ ৬৫
“যদি তুমি শির্ক কর, তোমার ভাল কাজ বরবাদ হবে”।
এখন প্রশ্ন থাকে, কাজগুলো কেন সুরক্ষিত রাখা হবে? এর জবাব আমি নিজে যতটুকু বুঝতে পেরেছি তা হল এই, উর্ধলোকের ব্যবস্থাপনার দান অনুসারে উন্নততর স্বরূপ জগতের স্তরে প্রত্যেকটি মানুষের আসল রূপ প্রকাশ পায়। আল্লাহকে প্রভু মেনে আসার কাহিনীতে যে সত্তারা উপস্থিত ছিল এরা তারাই। তারপর যখন সে সত্তা রূপ জগতে এসে দেহ ধারণকরে, তখন স্বরূপ ও রূপ যুক্ত ও একাত্ম হয়। তাই যখন কোন ব্যক্তি ভাল কাজ করে, তখন স্বতঃস্ফুর্ত ভাবেই তার স্বরূপ খুশীতে উজ্জ্বল হয় কিংবা স্বরূপের সাথে কাজটি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যায়। মৃত্যুর পর বিচার দিবসে কখনও দেখা যাবে তার কাজগুলো যত্নে সুরক্ষিত রয়েছে। আমলনামা পাঠের তাৎপর্য এটাই। কখনও বা দেখা যাবে, কাজগুলো তার অংগ-প্রত্যংগে জড়িয়ে রয়েছে। হাত-পা সাক্ষী দেবে কথাটির তাৎপর্যই তাই।
এও একটা কথা যে, কাজের আকৃতি ও প্রকৃতিই তাদের পার্থিব ও অপার্থিব ফলাফল সাফ সাফ বলে দেয়। মানে তাদের দেখেই ফলাফল বুঝা যায়। ফেরেশতারা কখনও তাদের আকৃতি ও প্রকৃতি সৃষ্টিতে দ্বিধান্বিত হয়ে বিলম্ব করে থাকে। তখন আল্লাহর ফরমানী আসে, যা আছে তাই হুবহু চিত্রিত কর (তোমাদের গবেষণার প্রয়োজন নেই)।
ইমামা গাজ্জালী (রঃ) বলেন, “সৃষ্টির শুরু থেকে শেষ পর্যণ্তযত সব বস্তু সৃষ্টির জন্য আল্লাহ পাক পরিমাপ নির্ধারিত করেছেন, তা সবই আদি সৃষ্টিটিতে লিখে নিয়েছেন। আল্লাহর সেই আদি সৃষ্টিটিকে কখনও ‘লওহে মাহফুজ’ কখনও ‘কিতাবে মুবীন’ কখনও বা ‘ইমামে মুবীন’ নামে কুরআনে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এগুলোর অর্থ যথাক্রমে ‘সুরক্ষিত পাত’ ‘সুস্পষ্ট গ্রন্থ’ ও ‘সুস্পষ্ট চালক’। সৃষ্টি জগতে যা কিছু হয়েছে কিংবা হবে, সবই লওহে মাহফুজে এরূপ ভাবে অংকিত রয়েছে যা সাধারণ চোখে দেখার সাধ্য নেই।
আপনি মনে করবেন না যে, লওহে মাহফুজ লোহার পাত কিংবা কাঠ বা হাড়ের তক্তা। কিতাবে মুবিনকেও কাগজের কোন বই ভাববেন না। বরং আপনার মনে রাখতে হবে, আল্লাহর অস্তিত্ব ও গুণাবলীর যেরূপ কোন তুলনা নেই, এ তক্তা ও গ্রন্থেরও তেমনি কোন তুলনা নেই।যদি আপনি তার কোন কাছাকাছি তুলনা নিয়ে বুঝতে চান তো সেটাকে হাফেজে কুরআনের অন্তর ও মেধার মতই একটা কিছু ভাবতে পারেন। কারণ, হাফেজের মন মগজে কুরআন এরূপ সুস্পষ্টভাবে লেখা থাকে যে, যখনই সে পাঠ করে, পরিস্কারভাবে লেখাগুলো দেখতে পায়। অথচ অপর কেউ সে রেখা দেখে না। তেমনি লওহে মাহফুজের সব বস্তুর আল্লাহ নির্ধারিত পরমাপের রেকর্ড এমন ভাবে লিখে রাখা হয়েছে যা লিখক ব্যতীত অন্য কেউ দেখতে পায় না”।
ইমাম গাজ্জালীর (রঃ) বক্তব্য এখানেই শেষ হল। মানুষের ‘আমল’ সুরক্ষিত রাখার সপক্ষে এও এক যুক্তি যে, সে ভাল বা মন্দ যাই করুক না কেন, অধিকাংশ সময়ে তা তার স্মরণে পড়ে এবং স্বভাবতই সে ভাল কাজের পুরস্কারের আশা ও মন্দ কাজের জন্য শাস্তির আশংকা রাখে।
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
কাজের সাথে স্বভাবের সংযোগ
জেনে রাখুন, কাজ হল মনোগত ভাবের বহিঃপ্রকাশ, তাদের সাধারণ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ এবং তাদের শিকারের বস্তু। সাধারণের ধারণা মতে কাজ ও মনোগত ভাবে কোন প্রভেদ নেই। তাই অধিকাংশ মানুষই কাজ বলতে মানুষের স্বভাব-চরিত্রকে বুঝে থাকে। তার কারণ এই, যখন কোন আন্তরিক অভিলাষ কাউকে কোন কাজে উদ্ধুদ্ধ করে এবং প্রবৃত্তি সেটাকে পছন্দ করে, তখন সে খুশীতে বাগ বাগ হয়। যদি স্বভাবের সেটা অপছন্দনীয় হয়, তখন সে বিমর্ষ ও হতাশ হয়। তারপর যখন সে কাজটি করে ফেলে, তখন সে অভিলাষের উৎস ফেরেশতা স্বভাব হোক কিংবা পশু স্ববাব, স্বতন্ত্র ও শক্তিশালী হয়ে যায়। তখন তার বিপরীত পশু কিংবা ফেরেশতা প্রবৃত্তি অধীন ও দুর্বল হয়ে যায়। এ দিকেই ইংগিত দিয়ে মহানবী (সঃ) বললেন, ‘মানুষের প্রবৃত্তি যখন কিছুর অভিলাষ করে, তার অংগ-প্রত্যংগ সেটাকে বাস্তবায়িত করে কিংবা ব্যর্থ করে দেয়’।
যে চরিত্র বা অভ্যেসই দেখুন না কেন, এটাই দেখতে পাবেন যে, তার পেছনে বিশেষ কিছু কাজ ও অবস্থা সক্রিয় রয়েছে। সেগুলোই চরিত্র ও অভ্যেসের ইংগিত দেয় এবং সেগুলোর মাধ্যমেই তাদের পরিচয় মিলে। ফলে কাজ ও অবস্থা চরিত্র ও অভ্যেস প্রকাশের বাহন হয়ে দাঁড়ায়। কেউ যদি কাউকে বীর বলে আখ্যায়িত করে এবং তার কাছে বীরত্বের পরিচয় জানতে চাওয়া হয়, তা হলে অবশ্যই সে তার বড় বড় আক্রমণ ও অভিযানের উল্লেখ করবে। কেউ যদি তার দানশীলতা ও দরাজ হস্তের বর্ণনা দেয়, তা হলেও সে জিজ্ঞাসিত হয়ে তারমুক্ত হস্তে বিরাট বিরাট দান কার্যের ও অর্থ ব্যয়ের উল্লেখ করবে। এখন কেউ যদি তার বীরত্ব ও দানশীলতা কল্পনা করতে চায়, তা হলে তার সামনে তার বীরত্বের ও দানের কার্যাবলী ও অবস্থাগুলোই ভেসে উঠবে।
হ্যাঁ এটা অন্য কথা যে, মানুষকে আল্লাহ যে প্রকৃতি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন, সে প্রকৃতিই বদলে যাবে। (অর্থাৎ মানবীয় স্বাভাবিক রীতি-নীতির ঊর্ধে থেকে কেউ যদি চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই কোন কিছুর চিত্র প্রয়োজন মতে সামনে দেখতে পায়, তার কথা স্বতন্ত্র)।
যদি কেউ নতুন কোন চরিত্র বা অভ্যেস চেষ্টা করে অর্জন করতেচায়, তা হলে তার জন্য সঠিক সুযোগের অপেক্ষায় থাকা ছাড়া উপায় নেই। সে যেন তার চরিত্রের সাথে অন্তত সম্পর্ক রাখে, এমন কিছুর জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালায় এবং যারা এ দরনের কাজ করে গেছেন, তাদের ঘটনাবলী বারংবার স্মরণে আনে। সে কাজগুলোই কেবল আয়ত্তে আনা যেতে পারে এবং সেগুলো করার জন্যই সময় নির্ধারণ করা চলে। চোখেও চরিত্র ধরা দেয়না, দেয় চরিত্রের কাজ। বর্ণনাও দেয়া যায় কাজের, অভ্যেসের নয়। তাই তার উপরেই শর্ত আরোপ করা যায়। সেটাই অনুসরণ করা যায়। ক্ষমতা ও এখতিয়ারে অন্তর্ভুক্ত সেটাই এবং পুরস্কার বা তিরস্কার সেটার ভিত্তিতেই হবে।
প্রশ্ন থাকে, সব মানুষ তো কাজ করার ও দক্ষতা অর্জনের বেলায় এক নয়? কারো কারো তো এরূপ ক্ষমতা রয়েছে যে, কাজের চাইতেও পরিকল্পনা দানে সিদ্ধ হস্ত। জবাব এই, যদিও তার ক্ষমতা রয়েছে নিজের ভেতর স্বভাব ও দক্ষতা সৃষ্টি করার, তথাপি তার ভাবনায় কাজের চিত্রও এসে যায়। কারণ, কাজই হল স্বভাব ও দক্ষতার ধারক। তাই স্বভাব ও দক্ষতা আয়ত্তে থাকার মানেই কাজ আয়ত্তে থাকা। তবে এ ক্ষেত্রে কাজের সংরক্ষণ কিছুটা কম হয়।
চোখে যা দেখা যায় না, সেটার চিত্র সামনে দেখা যেন স্বপ্ন যোগে কোন তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার বাস্তব ঘটনার মাধ্যমে দেখা। যেমন, একজন স্বপ্নে দেখল, সে মানুষের মুখে ও লজ্জাস্থানে তালা লাগাচ্ছে। (ইবনে সিরীনের কাছে এর ব্যাখ্যা জানতে চাওয়া হলে তিনি বললেন, লোকটি মুআজ্জিন। রোযার দিনে ফজরের আজান ওয়াক্তের আগেই দেয় বলে মানুষের খাওয়া-দাওয়া ও স্ত্রী সংসর্গ নেয়া বন্ধ হয়ে যায়।)
কিছু লোক তো এরূপ দুর্বল হয় যে, নিজের যা কিছু কাজকেই দক্ষতা ভেবে বসে। কারণ, তার কাছে অন্তর্নিহিত অবস্থাগুলো সুবিন্যস্ত হয়ে ধরা দেয় না। সব কিছু দেখে কাজের আবরণে। তাই তাদের ভেতর যা কিছু যোগ্যতা কাজ থেকে জন্মে (স্বতন্ত্র দক্ষতা থাকে না) অধিকাংশ লোকই-এ শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। তাদের নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট কার্যসূচী অনুসরণ অত্যাবশ্যক। শরীয়তের তাৎপর্য ও অন্তর্নিহিত অবস্থার চিন্তা ছেড়েতাদের আমলের ওপর বেশী জোর দিতে হয়।
কথা থেকে যায় যে, কোন কোন কাজ এমন রয়েছে যার পছন্দ যা অপছন্দের ব্যাপারটি কারো নিজস্ব মনোভাব থেকে হয় না, হয় উচ্চ পরিষদের সরাসরি প্রভাব থেকে। এ ভাবে কোন ভাল কাজ করা যেন সর্বোচ্চ পরিষদের এ ইলহাম গ্রহণ করা ‘আমারে নৈকট্য লাভ কর, আমাদের মত হও এবং আমাদের আলোকে উজ্জ্বল হও’। তেমনি কোন খারাপ কাজ করার ক্ষেত্রে এর বিপরীত প্রভাব আসে।
সর্বোচ্চ পরিষদে কয়েকটি কারণে এভাবে কাজ নিয়ন্ত্রিত ও নির্ধারিত হয়।
এক, আল্লাহ পাকের তরফ থেকে তাঁরা জানতে পান, অমুক অমুক কাজগুলো না করা হলে কিংবা অমুক অমুক কাজ বর্জিত না হলে মানবীয় জীবন ধারায় পরিবর্তন ও সংস্কার আসবে না। তখন সর্বোচ্চ পরিষদে সে কাজগুলোর রূপরখা অংকিত হয়। তারপর বিশেষ বিশেষ লোকের কাছে তা আল্লাহর নির্ধারিত বিধান রূপে অবতীর্ণ হয়।
দুই, এ অবতীর্ণ পুণ্য কাজগুলো যখন এক দল মানুষ অহরহ করেচলে, তখন তাতে তাদের পূর্ণ দক্ষতা অর্জিত হয়। তারপর যখন তারা এভাবে সর্বোচ্চ পরিষদের নৈকট্য লাভ করে তখন তাদের এ পছন্দ-অপছন্দ বোধ সুদৃঢ় ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়। এ অবস্থায় বেশ কিছুদিন কাটাবার পর সেই ভাল ও মন্দ কাজগুলো তাঁদের কাছেও যথার্থ রূপ নিয়ে স্থির হয়ে ধরা দেয়। সেক্ষেত্রে তাঁদের কাজ বা আমলগুলো অতীতের বুযুর্গদের পরীক্ষিত ও বর্ণিত তাবীজ ও ঝাড়-ফুঁকের মতই প্রভাব করে। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
শাস্তি ও পুরস্কারের কারণ
মনে রাখবেন, শাস্তি ও পুরস্কারের কারণ অনেক। তবে তার ভেতর দুটোই মূল কারণ।
এক, মানুষের সুপ্রবৃত্তি (বিবেক) তার কোন খারাপ কাজ বা স্বভাবের প্রতি রুষ্ট থাকে তার এ বিরূপ অনুভূতিই তাকে লজ্জিত, অনুতপ্ত ও আত্মগ্লানিতে বিদগ্ধ করে। অনেক সময় এ কারণে স্বপ্নে কি জাগরণে ভয়াবহ চিত্র তার সামনে ভেসে ওঠে এবং তাকে ভীষণ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে তোলে। কোন কোন লোক যেভাবে ইলহামে অন্যান্য জ্ঞান অর্জন করেন, তেমনি তার কাজে ভাল-মন্দ সম্পর্কেও ইলহামে জ্ঞাত হবার যোগ্যতা রাখেন। সে অবস্থায় ফেরেশতাদের মাধ্যমে ঘোষিত হয়, কাজের চিত্রটি তাকে দেখিয়ে ও বুঝিয়ে দাও। এ সম্পর্কেই আল্লাহ পাক বলেনঃ
(আরবী****************************************************************)
সূরা বাক্বারাঃ আয়াতঃ ৮১
“হ্যাঁ, যারা পাপ অর্জন করল এবং স্খলন-পতন যাদের ঘিরে ফেলল, তারাই জাহান্নামের সহচর এবং সেখানকার তারা স্থায়ী বাসিন্দা”।
দুই, সর্বোচ্চ পরিষদের ফেরেশতারা বনি আদমের দিকে নিবিষ্ট থাকেন। সর্বোচ্চ পরিষদের সামনে মানবীয় প্রবৃত্তি, চরিত্র ও ভাল-মন্দ কাজের চিত্র মওজুদ থাকে। তাঁরা আল্লাহর কাছে এ প্রার্থনা জানান, ‘প্রভু! নেক বান্দাদের শান্তি ও বদ চরিত্রদের শাস্তি দাও’। তাদের এ প্রার্থনা মঞ্জুর হয়। তখন আদম সন্তানদের ওপর ইলহাম অবতীর্ণ হওয়ার মতই শান্তি ও শাস্তি অবতীর্ণ হয়। এ থেকেই মানুষ সুখকর ও দুঃখদায়ক ঘটনার সম্মুখীন হয়। এ পথেই তাঁরা তাঁদের সন্তোষ ও অসন্তোষ প্রকাশ করে থাকেন।
কখনও সর্বোচ্চ পরিষদের অসন্তোষের প্রভাবে মানুষ অসুস্থ ও অবসন্ন হয়ে পড়ে। কখনও তাঁদের সন্তোষের প্রভাব এসে মানুষের স্বভাবের দুর্বলথা দূর করে তাতে দৃঢ়তা এনে দেয়। এভাবে তাঁদের প্রভাবে ফেরেশতাও মানুষ ভাল লোককে শান্তি দেয় ও মন্দ লোককে শাস্তি দেয়। কখনও মানুষের কৃতকর্মই অঘটন কিংবা শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করে তার শান্তি ও শাস্তির কারণ হয়।
আসল সত্য হল এই, যে মানুষকে আল্লাহ ভালবেসে সৃষ্টি করেছেন, তাদের তিনি লাগাম ছাড়া হতে দিতে চান না। তাদের কাজের তিনি ভাল-মন্দ দেখবেন না, তা হতে পারে না। যেহেতু আল্লাহ কিভাবে এ ভাল বা মন্দ কাজের প্রতিদান দিবেন তা বুঝা কিছুটা দুষ্কর, তাই ফেরেশতার নেক দোয়া ও বদ দোয়ার ফলাফল রূপে তা দেখানো হল। বাদ বাকী আল্লাহই জানেন ভাল।
আমার দ্বিতীয় যুক্তিটির দিকেই আল্লাহ পাকের ইংগিত পাই-
(আরবী*********************************************************************)
সূরা বাকারাঃ আয়াতঃ ১৬০
“নিশ্চয় যারা কাফের ও কাফের থেকেই মারা যায়, তাদের ওপর আল্লাহ, ফেরেশতা ও মানুষ সবার অভিসম্পাত বর্ষিত হয়। এ অভিসম্পাতে তারা চির কাল কাটায় এবং এ শাস্তি তাদের কমে না আদৌ ও কেউ তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে না”।
এ দু’ধরনের কারণের সান্নিধ্য ও সংমিশ্রণে মানব প্রকৃতির যোগ্যতার বিভিন্নতা অনুসারে নানা ধরনের অদ্ভুত কারণ সৃষ্টি হয়েছে। তবে প্রথম কারণটিই মানুষের ব্যক্তিগত স্বভাব ও কাজের ক্ষেত্রে অধিক প্রভাবশালী। সেটি মানুষের স্বভাব ও কাজকে কল্যাণময় ও ধ্বংসকর দুইই করতে পারে। তাই অধিকাংশ (বিবেকবান) জ্ঞান-গুণীগণ এটাই সমর্থন করেন। এর প্রয়োজনীয়তা কেউই অস্বীকার করতে পারে না।
দ্বিতীয় কারণটি দ্বারা এমন সব কাজ ও স্বভাব নিয়ন্ত্রিত হয় যেগুলো সামগ্রিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন এনে থাকে। অর্থাৎ যে সব স্বভাব ও কাজ সর্বসাধারণের কল্যাণ ও শান্তির পরিপন্থী এবং মানবীয় জীবন ব্যবস্থা পরিশুদ্ধির অন্তরায় হয়। ফেরেশতা স্বভাব বা বিবেক যাদের দুর্বল, যারা পাপী তাদের স্বভাব ও কাজগুলোই এ ব্যবস্থা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।
শান্তি ও পুরস্কারের এ দুটো কারণের প্রভাব সৃষ্টির পথে কিছু অন্তরায়ও রয়েছে। সেগুলো নির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্রভাব ঠেকিয়ে রাখে। প্রথম কারণটির অন্তরায় হল মানুষের দুর্বল বিবেক ও কুপ্রবৃত্তি। এ অবস্থা বেড়ে গিয়ে এমন পর্যায়ে পৌঁছে, যখন মানুষের ভেতর পশুত্ব ছাড়া আর কিছুই থাকে না। তখন তার বিবেক অনুভূতিহীন হয়। কোন কিছুই সেটাকে ব্যথিত করে না। তাই তার দংশনও থাকেনা। তারপর যখন তার স্বভাব থেকে পশুত্বের প্রভাব দূর হয় ও সেখানে বিবেক মাথা চাড়া দিতে থাকে, তখন তার দুঃখ দেখা দিয়ে থাকে।
দ্বিতীয় কারণের প্রভাব ততক্ষন মুলতবী থাকে যতক্ষণ তাদের ওপর আল্লাহর আজাবের পথে অন্তরায় মওজুদ থাকে। যখন তা দূর হয়ে নির্ধারিত সময় আসে (পুণ্যাত্মার বিলুপ্তি বা পাপাত্মার পূর্ণত্ব প্রাপ্তি ঘটে), তখন আজাবের রাস্তা উন্মুক্ত হয়। চারদিক থেকৈ তখন বন্যার প্রবাহে আজাব এসে তাদের ভাসিয়ে নেয়। আল্লাহর এ আয়াত তারই সাক্ষ্য বয়ে চলছেঃ-
(আরবী***********************************************************************)
“প্রত্যেক দল বা জাতির (পতনের) জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় রয়েছে। তাদের সময় যখন এসে যাবে, তখন তার এক মুহুর্ত ও আগ-পিছ হবে না”।
দ্বিতীয় অধ্যায়
পার্থিব-অপার্থিব শাস্তি-পুরস্কারের রূপরেখা
প্রথম পরিচ্ছেদ (১৪)
পার্থিব শাস্তি-পুরস্কার
আল্লাহ পাক বলেনঃ
(আরবী******************************************************************)
সূরা শূরাঃ আয়াতঃ ৩০
“অনন্তর যা কিছু বিপর্যয় তোমাদের ওপর নেমে আসে, তা তোমাদেরই স্বহস্তে উপার্জিত বৈ নয়। এবং অনেককে রেহাইও দেয়া হয়ে থাকে”।
অন্যত্র তিনি বলেনঃ-
(আরবী**************************************************************************)
সূরা মায়েদাঃ ৬৬
“যদি তারা তাওরাত, ইঞ্জীল কিংবা যা কিছু তাদের কাছে অবতীর্ণ হয়েছে তা বাস্তবায়িত করত তা হলে আকাশ ও পৃথিবীর সব কিদ থেকে তারা অফুরন্ত নেয়ামত ভোগ করতে পেত”।
কৃপণ বাগানের মালিক প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা (সূরা নূহে) যে ঘটনার উল্লেখ করেছেন তা প্রণিধানযোগ্য। (বাগানের মালিক তিন ভাই প্রতি মৌসুমে ফসল কাটার সময়ে উপস্থিত ভিক্ষুকদের ভেতর কিছু অংশ বিতরণ করত। একবার রাতারাতি ফসল কেটে ভিক্ষুকদের পৌঁছার আগেই তা ঘরে তোলার অভিলাষ নিয়ে গিয়ে দেখল বাগান জ্বলে গেছে।) মহানবী (সঃ) কুরআনের
(আরবী**********************************************************************************)
সূরা বাক্বারাঃ ২৮৪
(এবং তোমরা যা খুলে বল বা গোপন রাখ, সব কিছুর হিসাব আল্লাহ নেবেন)
(আরবী*******************) (এবং খারাপ কাজ করবে তাকে শাস্তি পেতে হবে) আয়াত দুটির ব্যাখ্যা প্রসংগে বলেন, ‘এ হিসাব নেয়া ও শাস্তি দেয়া আল্লাহর অসুখ-বিসুখ ও অন্যান্য বিপদাপদের দ্বারা কার্যকরী করেন। পকেটের কিছু হারিয়ে যে দুর্ভাবনা ও মনোকষ্ট দেখা দেয় তাও তার ভেতরে শামিল। এ ভাবের বিপদাপদের ভেতর দিয়ে মানুষ তার ছোট-খাট পাপগুলো কাফফারা দিয়ে দিয়ে এরূপ নিষ্পাপ হবে যেন আগুনে জ্বালিয়ে সোনা খাঁটি করা হল।
জেনে রাখুন, বিবেক রিপুর হাতে মার খেও আবার মাথা তুলে দাঁড়ায়। একটি উপায় হল তার স্বাভাবিক মৃত্যু। দ্বিতীয় উপায় হল তার ইচ্ছা করে মরার মত হওয়া। স্বাভাবিক মৃত্যুতে রিপুগুলোর রুজী রুটি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে তার বেঁচে থাকার শক্তি এভাবে বিলুপ্ত হয় যা আর ফিরে পাবার নয়। এ অবস্থায় ক্ষুৎ-পিপাসা, লোভ-লালসা ও রাগ-দ্বেষ কিছুই তার থাকে না বলে তার ওপর আত্মিক জগতের প্রভাব জমতে থাকে (তাই বিবেক চাংগা হয়)। ইচ্ছা করে মৃত সাজা মানে হল, আত্মিক সাধনা দিয়ে রিপুকে মেরে মেরে নিস্তেজ করা এবং আত্মিক জগতের দিকে মনোনিবেশ করে সেখানকার চিত্রগুলো অন্তরে চিত্রিত করতে থাকা। এর ফলে তার অন্তরে ফেরেশতা স্বভাব বা বিবেকের আলো দেখা দেবে।
এটাও স্মরণ রাখতে হবে যে, সব কিছুই অনুকূল অবস্থায় খুশীতে ফুলে ফেঁপে যায়। তেমনি প্রতিকূল পরিবেশে তা দুঃখে ও হতাশায় ভেংগে পড়ে। (বিবেকের দশাও তাই।)
এও জানা প্রয়োজন, প্রতিটি দুঃখ-কষ্ট এবং আনন্দ-খুশীর নিজ নিজ বিশেষ আকৃতি-প্রকৃতি রয়েছে। তারাসেই বিশেষ রূপ ধরেই প্রকাশ পায়। যেমন, রক্ত দূষিত হওয়ার প্রকাশ ঘটে দেহে খুজলী পাচড়া রূপে। তেমনি পিত্ত গরবের কষ্ট প্রকাশিত হয় দেহের অস্থিরতা ও স্বপ্নে আগুন দেখার মাধ্যমে। কফের কষ্ট সর্দীর প্রচণ্ডতায় স্বপ্নে বরফ দেখায় প্রকাশ পায়।
তেমিন বিবেক প্রাধান্য পায় এবং মানুষ তার অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি করে অর্থাৎ নিজের ভেতর পবিত্রতা ও বিনয় সৃষ্টি করে, তখন স্বপ্ন কি জাগরণে আনন্দ ও প্রীতির বিশেষ বিশেষ দৃশ্য ও চিত্র দেখতে পায়। যদি তার বিপরীত কাজ করে তা হলে সে সব অসামঞ্জস্য কাজগুলো এরূপ দৃশ্য ও চিত্রের সৃষ্টি করবে যাতে লাঞ্ছনা ও ভীতির ব্যাপার থাকে। যেমন হিংস্র বাঘকে দেখবে শিকার ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে ক্রোধ প্রকাশ করতে কিংবা সাপকে দেখবে দংশন উদ্যত কিংবা দংশন করতে ইত্যাদি।
বাহ্যিক তথা পার্থিব পুরস্কার-শাস্তির মূলনীতি হল এই, কারণ সৃষ্টি হলেই কেবল সে কাজগুলো দেখা দেবে। যে ব্যক্তি কার্যকারণ রীতি বুঝে নিবে এবং কোন কারণে কোন কাজ দেখা দেয় তা খেয়ালে রাখবে, তা হলে সে সুস্পষ্ট জানতে পাবে, আল্লাহ পাক পার্থিব জীবনেও পাপীকে শাস্তি থেকে রেহাই দেননা। তবে সংগে সংগে দুনিয়া পরিচালনার (কার্যকারণ) রীতি বাহ্যত করে তিনি তা করেন না (বরং পরকালের জন্য মুলতবী রাখেন)।
ব্যাপারটা এই হয়, পৃথিবীতে পুণ্যবানের শান্তি ও পাপীর শাস্তি লাভের বাহ্যিক কারণ-উপকরণ যদি সৃষ্টি ও সরবরাহ না হয়, তখন পুণ্য কাজ করাতে (আত্মিক) শান্তি ও পাপ কাজ করাতেই (আত্মিক) শাস্তি পেয়ে থাকে। যদি কোন পুণ্যবানের শাস্তির জন্য পার্থিব কারণ সৃষ্টি হয় এবং তা বন্ধ করলে তার পুণ্য কাজের কোন ক্ষতি না হয় তাহলে তার পুণ্য সেটাকে পুরোপুরি বন্ধ করতে কিংবা শাস্তির পরিমাণ ও প্রচণ্ডতা কমাতে সহায়ক হয়। তেমনি কোন পাপীর জন্য যদি শাস্তির পার্থিব কারণ সৃষ্টি হয়, তখন তার পাপ সে শাস্তির পথে অন্তরায় হয় এবং তা কার্যকর হতে দেয় না। তবে যদি তার কর্মফলের অনুকূল কারণ-উপকরণ সৃষ্টি হয়, তা হলে শাস্তি ও শান্তি দুটোই যথেষ্ট পরিমাণে মিলে। তা বলে পাপ-পুণ্যের ফলাফল দ্বারা পৃথিবীর রীতিনীতি কখনও বদলানো হয় না। বাহ্যিক ফলাফল দেবার ক্ষেত্রে যেখানে পার্থিব রীতি-নীতি অন্তরায় হয়, সেখানে ফলাফল মুলতবী থাকে। এ কারণেই দেখা যায়, পাপ করেও মানুষ পার্থিব জীবনের স্বল্প পরিসরে বেশ সুখে-শান্তিতে কাটাচ্ছে। পক্ষান্তরে পুণ্য করেও মানুষ যথেষ্ট দুঃখ-কষ্ট ভোগ করছে। পুণ্যবানের এ বাহ্যিক দুঃখ-কষ্ট তার পশু শক্তিকে দুর্বল ও পরাভূত করে থাকে। এভঅবে তাকে তার দুঃখ-কষ্ট তার পশু শক্তিকে দুর্বল ও পরাভূত করে থাকে। এভাবে তাকে তার দুঃখ-কষ্টের কল্যাণ বুঝানো হয়। তখন রোগী যে ভাবে রোগমুক্তির আশায় তিক্ত ওষুধ খেতে রাজী হয়, তেমনি পুণ্যবান পার্থিব দুঃখ-কষ্ট অম্লান বদনে সহ্য করে। মহানবীর (সঃ) নিম্ন হাদীসটির মর্মও তাই।
“মুমিন হল নরম ডালের মত। বাতাস কখনও এদিক হেলায়, ওদিক হেলায়, মাটিতে লুটায়, আকাশে উঠায়, এমনকি তার অন্তিম দশা ঘটায় (তবু সে টিকে যায়)। পক্ষান্তরে মুনাফিক মাথা উঁচু করা শক্ত বিটপীর মত। হাওয়া তাকে এদিক-ওদিক হেলাতে পারে না বটে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভেংগে বা উপড়ে ফেলে”।
এ মর্মেই অপর একটি হাদীস এসেছে। তাতে পাই, ‘যে মুসলমানেরই অসুখ-বিসুখ কিংবা অনুরূপ কোন বিপদাপদ দেখা দেয় তার ছোট-খাট পাপগুলো ঠিক গাছের পাতার মতই ঝরে যায়’।
অনেক দেশেই শয়তানের আনুগত্য ও অর্চনা জোরে-শোরে করা হয়। সে সব এলাকার লোক আয়েশ-আরাম ও অত্যাচার-উৎপীড়নে পশু ও হিংস্র জীবের মত হয়। এ ধরনের লোকের শাস্তিও নির্দিষ্ট সময়ের জন্য মুলতবী থাকে। নিম্ন আয়াতে তারই ইংগিত পাই-
(আরবী********************************************************************)
সূরা আ’রাফঃ আয়াতঃ ৯৪-৯৬
“আমি যখন কোন শহর বা গ্রামে নবী পাঠিয়েছি, তখন সেখানকার লোকদের দারিদ্য ও বালা-মসিবত দিয়ে (আল্লাহর দিকে) ফিরে আসার ব্যবস্থা করেছি। যখন তাতেও ফল হয়নি, তখন তাদের দুঃখ-দুর্দশার স্থলে সুখ-সচ্ছলতা দিয়ে ধন্য করেছি তা দেখে তারা বলাবলি করতে লাগল, আমাদের বাপ-দাদার জীবনেও এভাবে সুদিন-দুর্দিনের পালাবদল হয়েছে (পাপ-পুণ্যের এতে কোন দখল নেই)। তারপর হঠাৎ আমি এমনভাবে পাকড়াও করলাম যে, তারা ভাববারও অবকাশ পেল না। যদি এলাকার লোকরা ঈমান আনত এবং আমার কথা মতে ভাল হয়ে চলত, তা হলে আকাশ ও পৃথিবীর বরকতের ভাণ্ডার তাদের জন্য খুলে দিতাম। কিন্তু তারা আমার কথাকে মিথ্যা বলে উড়াল তাই আমিও তাদের এ পাপের বিনিময়ে আপদ-বিপদের ফাঁদে ফাঁসিয়ে নিলাম”।
মোট কথা, এ দুনিয়ার পুরস্কার ও শাস্তির ব্যাপারটা হল এই, প্রভু যেন ভৃত্যকে যখন তখন পূর্ণ বিনিময় দিতে প্রস্তুত নন। পূর্ণ অবসর নিয়ে তিনি তা করার জন্য সময় নির্ধারিত করে রেখেছেন। সেটা হল শেষ বিচারের দিন। আল্লাহ পাকের নিম্ন বানীতে তারই ইশারা রয়েছেঃ
(আরবী*************************************************)
সূরা আর-রাহমানঃ আয়াতঃ ৩১
“হে জ্বীন ও ইনসান! শীঘ্রই আমি তোমাদের (প্রতিদান দেবার) জন্য অবসর গ্রহণ কর”।
পার্থিব শাস্তি ও পুরস্কারের কয়েকটি অবস্থা দেখা যায়। কখনও এভাবে হয় যে, মানুষের আনন্দ ও স্বস্তি কিংবা দুঃখ ও অস্বস্তি দেখা দেয়। কখনও এমন হয় যে, দুর্ভাবনায় শারীরিক অসুস্থতা বা রোগ-ব্যাধি দেখা দেয়। নবুয়তের আগে মহানবীর (সঃ) একবার দেহাবরণ খসে পড়ায় তিনি লাজে-ভয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। এও ঠিক সেরূপ রোগ-ব্যাধি। তেমনি কখনও পার্থিব পুরস্কার ধন-সম্পদের মাধ্যমে দেয়া হয়। কখনও মানুষ, পশু ও ফেরেশতাদের কাছে ইলহাম আসে, অমুকের সাথে সদ্ব্যবহার বজায় রাখ। কখনও বা মানুষ নিজেই ইলহাম পেয়ে ভাল ও মন্দ অবস্থার সম্মুখীন হয়।
যে ব্যক্তি আমার উপরোক্ত আলোচনা ভাল ভাবে বুঝে নিবে এবং প্রতিটি কথা যথাস্থানে রেখে বিচার বিবেচনা করবে,সে অনেক জটিলতা থেকে বেঁচে যাবে। অন্যথায় সে মহানবীর (সঃ) হাদীসে পরস্পর বিরোধ দেখে মতভেদ ও দ্বিধা-দ্বন্দ্বের শিকার হবে। সে দেখতে পাবে, এক হাদীসে তিনি বলছেন, পুণ্য কাজে রুজী বাড়ে এবং পাপে তা কমে। পক্ষান্তরে অন্য হাদীসে বলছেন, পাপীদের পার্থিব জীবনের স্বল্প পরিসরে সুখ-স্বচ্ছন্দ্য দেয়া হয় এবং পুণ্যবানদের আপদ-বিপদ ও দুঃখ-দুর্দশা দেয়া হয়। এমন কি যে যত বড় পুণ্যবান তাকে তত বেশী পার্থিব দুঃখ-কষ্ট দেয়া হয়। এ ভাবের বিভিন্ন স্তরের আরও বহু হাদীসে আপাত বিরোধ ও তা থেকে উম্মতের ভেতর মতভেদ দেখা যায়। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
মৃত্যুরহস্য
জেনে রাখুন, ধাতম পদার্থ, উদ্ভিদ, পশু ও মানুষ এ সব স্তরের সৃষ্টির চার ধরনের ধারক ও ক্রিয়া-প্রক্রিয়া রয়েছে। যদিও আপাত দৃষ্টিতে কথাটি নিঃসংশয় মনে হয় না। মৌল উপাদানগুলো (আগুন, বায়ু, পানি ও মাটি) যখন অণু-পরমাণু আকারে সংঘাত মিলনের ব্রতে নিরত থাকে, তখন তা থেকে কয়েক ধরনের যৌগিক বস্তু সৃষ্টি হয়। যেমন দুই উপাদানের মিশ্রণজাত তাপ বা বাষ্প, ধূলা, ধোঁয়া, সতেজ মাটি, চাষের জমীন, অংগার, শিখা ইত্যাদি। তিন উপাহাদের মিশ্রণজাত যেমন, ছানা মাটির বস্তু, কাদা মাটি ইত্যাদি। তেমনি চার উপাদানের মিশ্রণজাত বস্তুও রয়েছে।
এ সব জিনিসের বৈশিষ্ট্য বলতে এর অন্তর্ভুক্ত উপাদানেরই বিশেষত্ব বৈ নয়। মিশ্রিত উপাদানের বাইর থেকে কোন গুণ এতে আসতে পারে না, ভেতরেও নতুন কোন গুণের উদ্ভব হতে পারে না। এ ধরনের বস্তুকে শূন্যাবস্থার বা প্রাথমিক সৃষ্টি বলা হয়। (বাষ্প, পানি ও আগুনের এবং ধূলা, মাটি ও বায়ুর মিশ্রণজাত সৃষ্টিগুলো তাদের অন্তর্ভুক্ত।)
এ স্তরের পরে আসে ধাতব যুগ। উক্ত মিশ্রণজাত বস্তুগুলোকে অনুগত বাহক বানিয়ে খনিজ পদার্থের আবির্ভাব ঘটেছে। ধারকের বৈশিষ্ট্যই তার বৈশিষ্ট্য। ধারকের প্রকৃতিকে সে নিজের ভেতর সুরক্ষিত রাখে।
তৃতীয় স্তরে আসে উদ্ভিদ যুগ। ধাতম যুগের ওপর আরোহণ করেই তার আগমন। তবে তার শক্তি এত বেশী যে, অংশের উপাদান ও প্রাথমিক সৃষ্টিগুলোকে বদলে সে নিজ প্রকৃতিতে গড়ে তোলে। ফলে সে সব অংশগত উপাদানাদির প্রয়োজনীয় প্রভাব প্রক্রিয়া প্রকৃতিগতভাবে বিদ্যমান থাকে।
এরপর আসে প্রাণীর স্তর। এ স্তরে বস্তুর ভেতর প্রকৃতিগত প্রাণের (খাদ্যগ্রহণ ও বর্ধন শক্তি) উন্নয়ন দেখা দেয় এবং প্রকৃতিগত প্রাণকে বাহন করেই জৈবিক প্রাণের আগমন ঘটে। এ স্তর প্রকৃতিগত প্রাণে অনুভূতি ও ইচ্ছার সংযোগ ঘটায়। ফলে নিজ আকাঙ্ক্ষিত ও উপকারী জিনিস অর্জনের জন্য প্রাণীর উদ্যোগী ও প্রয়াসী হয়। তেমনি ক্ষতিকারক ব্যাপার থেকে তারা দূরে থাকে।
অবশেষে আসে মানুষের স্তর। জৈবিক প্রাণকে বাহন করে এর আগমন ঘটে। এ স্তরে জৈবিক প্রাণের সাথে বিচার-বুদ্ধিরও সংযোগ ঘটে। তাই এ প্রাণ চরিত্র ও দক্ষতার ওপর জোর দেয়। মানে, ভাল হতে ও ভাল কাজ করতে বলে এবং মন্দ হতে ও মন্দ কাজ করতে নিষেধ করে। এ উদ্দেশ্যে সে নৈতিক অনুভূতি ও চিন্তাশক্তি চাংগা রাখে। এবং তাদের উত্তম নীতি নিয়মের আওতায় সুবিন্যস্ত করে নেয়। এমন কি সেটাকে ঊর্ধ জগত থেকে পাবার সব কিছুর যোগ্য ধারক রূপে গড়ে তোলে।
আপাত দৃষ্টিতে এ কথাগুলো যতই সংশয়মূলক মনে হোক না কেন, ভেবে দেখলে বুঝতে পাবেন, প্রতিটি প্রভাব ও প্রতিক্রিয়াকে তার নিজ স্বতন্ত্র উৎসের সাথে সম্পৃক্ত করতে হয়। তেমনি প্রত্যেক ধরনের সৃষ্টিকে তার নিজস্ব বাহনে বসিয়ে নিতে হয়। এটাও জানা প্রয়োজন, প্রতিটি ধরনের জন্য একটি ভিত্তিমূল থাকা দরকার। তার সাথে যেন সৃষ্টিটি স্থির থাকতে পারে। ধারকটির অবশ্যই ধরনটির উপযোগী হতে হবে। ধরনের ধারকটির প্রয়োজনীয়তা ঠিক মোমের পুতুলের যে ভাবে মোম প্রয়োজন তেমনি।
সুতরাং যে ব্যক্তি বলে, মানবের প্রকৃতিগত প্রাণ মৃত্যুর পর মানব দেহ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক হয়ে যায়, সে ভুল বলে। হ্যাঁ, এ কথা সত্য যে, মানব প্রকৃতির দুটো উপাদান থাকে (যার ভিত্তিতে তার সৃষ্টি) একটি মৌলিক। সেটাকে প্রকৃতিগত প্রাণ বলে। দেহের সাথে তার যোগ প্রত্যক্ষ। দ্বিতীয় উপাদানটি কৃত্রিম। সেটাকে জড়দেহ বলে (তার সাথে থাকে পরোক্ষ সম্পর্ক)। তাই মানুষ যখন মারা যায়, তখন জড় দেহ বিচ্ছিন্ন হয় বটে, তাতে প্রকৃতিগত প্রাণের কোন ক্ষতি হয় না। বরং প্রকৃতিগত প্রাণের সাথে জড় দেহের সম্পর্ক থেকে যায় অবিচ্ছেদ্য। একজন সুদক্ষ শিল্পীর হাত কেটে ফেললেও তার শিল্প ক্ষমতা যেমন যথারীতি অক্ষুণ্ন থাকে এও তেমনি ব্যাপার। তেমনি কোন দ্রুত গতির মানুষের পা কেটে ফেললে কিংবা কোন দৃষ্টি ও শ্রবণ শক্তির মানুষের চোখ ও কান হারালে তার চলার, শোনার ও দেখার শক্তি বহাল থেকে যায়, প্রকৃতিগত প্রাণ-মনেরও ঠিক সেই অবস্থা। উপাদান ছাড়াই শুধু প্রকৃতিগত প্রাণের সাথেই সে সম্পৃক্ত থাকতে পারে।
জানা দরকার, মানুষের কার্যকলাপ কয়েক ধরনের হয়। কিছু কাজ তারা মনের ইচ্ছায় করে থাকে। যদি তাকে বাধা না দেয়া হয়, তা হলে সে তা কার্যকরী করবে এবং খেয়াল-খুশীর বিরুদ্ধে সে কখনও যাবে না। কিছু কাজ তারা প্রকৃতিগত প্রয়োজনের তাগাদায় কিংবা বাইরের কোন প্রভাবে পড়ে করে থাকে। যেমন, ক্ষুধা, তৃষ্ণা ইত্যাদি। যখন সে সবের কারণ চলে যায়, তখন তা করার ইচ্ছাও চলে যায়। অবশ্য সেগুলোকে স্থায়ী অভ্যেসে পরিণত করে নিলে অন্য কথা।
দেখুন, এরূপ অনেক লোক আছে যারা কোন বিশেষ ব্যক্তি কিংবা কবিত্ব অথবা বিশেষ কোন জিনেসের প্রতি আসক্ত হয়। তখন তারা ভালবাসার ব্যক্তি বা বস্তুর অনুকূল পোশাক-আশাক ও চাল-চলন অনুসরণ করতে বাধ্য হয়। কিন্তু যদি তারা স্বাভাবিক অবস্থায় থাকত, তা হলে তা বর্জন করে চললে তাদের কোনই অসুবিধা হত না। কিছু লোক অবশ্য এমন হয় যে, অন্তর থেকেই সে অনুরূপ পোশাক-আশাক ও চাল-চলন পসন্দ করে। তখন তাকে স্বাভাবিক অবস্থায়ও সেই পোশাক ও ঢং অনুসরণ করতে দেখা যাবে।
তেমনি কিছুলোক এরূপ স্মরণ শক্তি রাখে যে, নানা ধরনের কথা-বার্তার ভেতর থেকে সে তার প্রয়োজনীয় কথাগুলো বেছে নিয়ে স্মরণ রাখে। তার দৃষ্টি থাকে আলোচনার দিকে, ফলাফলের দিকে নয়। বাক চাতুর্যই তাকে আকৃষ্ট করে এবং বাক চাতুর্যের দক্ষতা কোত্থেকে এল তা নিয়ে তার ভাবনা নেই। এক ধরনের বেখেয়াল লোক এমন থাকে যে, মূল কথা ছেড়ে আজে বাজে কথায় ডুবে থাকে। তার নজরে কারণ আসে না, আসে শুধু কাজ। ফলে কাজের প্রাণ সম্পর্কে উদাসীন থেকে কাজের রূপই তার স্মরণে রাখে।
জেনে রাখুন, যখন মানুষ মারা যায়, তখন তার জড় দেহটি পচে-গলে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। কিন্তু তার প্রকৃতিগত প্রাণ জৈবিক প্রাণের সাথে সংযোগ রাখে। তবে তার ভেতর (পার্থিব প্রয়োজনে) যে বৈশিষ্ট্যগুলো ছিল, তা থাকে না। ফলে তার উদ্দেশ্যমূলক কাজ ছাড়া পার্থিব প্রয়োজনে যেগুলো করতে হত, তা আর প্রকাশ পায় না। শুধু যে সব উদ্দেশ্যমূলক নৈতিক কাজ তার ব্যক্তিত্বের প্রভাবে দেখা দিত, সেগুলোই তার আসল প্রাণের সাথে থেকে যায়। তখন তার জীবনে বিবেক প্রাধান্য পায় ও রিপু অবদমিত হয়। তারপর যখন ঊর্ধতন জগৎ থেকে তার অন্তরে হাযিরাতুল কুদুস এবং তার সুরক্ষিত কৃতকার্যের আলোকপাত ঘটে, তখন তার বিবেক হয় দুঃখ পায়, নয় আনন্দ লাভ করে।
এটাও জানা দরকার, যখন বিবেক (পার্থিব জীবনে) রিপুর সাথে মিলে-মিশে সমঝোতা করে চলে, তার কিছু না কিছু প্রভাব বিবেকে ঢুকে যায় এবং বিবেককে তা মেনে চলতে হয়। কিন্তু সব চাইতে ক্ষতিকর ও খারাপ ব্যাপার হল এই, বিবেকে তার উদ্দেশ্য ও পরিণতির বিপরীত অভ্যেস ও অবস্থার সৃষ্টি হওয়া। তেমনি সব চাইতে উত্তম ও কল্যাণকর ব্যাপার হল এই, বিবেকে তার অভ্যেস ও অনুকূল অবস্থাকে বহাল তবিয়তে কায়েম রাখা।
মোট কথা, খারাপ ব্যাপারের আরেক দিক হল,অন্তরে সম্পদ ও সন্তান-সন্ততির এরূপ মায়া হওয়া যে, দুটি ছাড়া জীবনে অন্য কোন উদ্দেশ্য আছে বলে মনে না করা। দ্বিতীয় দিক হল, অন্তরে এমন সব সাধারণ খারাপ অভ্যেস ও অবস্থঅ মুদ্রিত হয়ে যাওয়া যা মানুষকে ধার্মিক ও ভাল হওয়া থেকে সরিয়ে রাখে। তৃতীয় দিক হল এই, অন্তরকে এরূপ অপবিত্র ও আল্লাহ সম্পর্কে উদাসীন রাখা যে, না কখনও সে আল্লাহকে জানতে চাইবে, না তাঁর সামনে সবিনয়ে আনত থাকবে। মোট কথা অন্তরে পবিত্রতা ও কল্যাণময়তার বিপরীত কিছু সৃষ্টি হতে দেয়া। চতুর্থ ব্যাপার এই, অন্তরের গতি সত্যের সহায়তা ও আল্লাহ-রাসূলের নির্দেশকে মর্যাদা দান এবং সাধারণ কল্যাণ প্রতিষ্ঠার কাজে ঊর্ধ্বতন জগতের কার্যক্রমের বিরোধী হওয়া। এমন কি তার ফলে তার উপর উর্ধ্বতম জগতের শত্রুতা ও লা’নত আসে।
মোট কথা, ভাল দিকের ভেতর একটি হল এই, এরূপ ভাল কাজ করা যাতে অন্তরের পবিত্রতা ও আল্লাহর সকাশে বিনয় অর্জিত হয়। এমন কি ফেরেশতাদের অবস্থা যেন স্মরণে আসে। তা ছাড়া এমন সব ধর্মীয় ধ্যান-ধারণার দিকে যেন খেয়াল যায় যাতে মানুষ শুধু পার্থিব জীবন নিয়েই তৃপ্ত না থাকে। দ্বিতীয় দিক হল এই, মানুষটির যেন ধার্মিকতা ও ন্যায়পরায়ণতার পুতুল ও নম্র-দয়ার্দ্র অন্তরের হয়ে যায়। তৃতীয় কথা হল, মানুষ যেন এরূপ পবিত্র থাকে যাতে করে ঊর্ধ্বতন জগতের দোয়া এবং তাদের সুনজর বহাল থাকে এবং সে যেন কল্যাণের জীবন বিধান অনুসরণ করে চলে। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
ষষ্ঠদশ পরিচ্ছেদ
কবরে মানুষের অবস্থা
জেনে রাখুন, কবরের অন্তর্বর্তী জীবনে মানুষের বিভিন্ন অবস্থা ও মর্যাদা দেখা দেয়। সে সব অবস্থা ও স্তরের সংখ্যা অশেষ। তবে প্রধান অবস্থা ও স্তর হল চারটি। প্রথম শ্রেণীর লোক সচেতন প্রকৃতির হয়ে থাকে। তাদের সামনে তাদের কৃত ভাল বা মন্দ কাজগুলো স্বরূপে দেখা দিলে তথা অনুকূল বা প্রতিকূল অবস্থা সৃষ্টি হলেই তারা সুখ বা দুঃখ লাভ করে থাকে। নিম্ন আয়াতে সেটাই ইংগিত করা হলঃ
(আরবী***************************************************************************)
সূরা যুমারঃ আয়াত ৫৬
“(যেন কেয়ামতের দিন) কেউ এ কথা না বলে, হায়, আল্লাহর ব্যাপারে কেন ত্রুটি-বিচ্যুতি করে এলাম। তখন তার এ কথা হাস্যকরই হবে”।
আমি এমন এক দল আল্লাহর ওলী দেখেছি, যাদের মন ঠিক শান্ত পানিপূর্ণ পুকুরের মতই প্রশান্ত। বাতাসে সে পানিতে ঢেউ খেলে না। তাই ঠিক দুপুরে মধ্যাহ্ন সূর্যের আলো যখন তার বুকে পড়ে, তখন সেটা এক খণ্ড নূরের টুকরার মতই হয়ে যায়। তাঁদের সে নূর হল পুণ্য কাজ কিংবা পুণ্য স্মৃতি (আল্লাহর ধ্যান) অথবা আল্লাহর রহমতের নূর।
দ্বিতীয় ধরনের লোক তাদেরই কাছাকাছি হয়ে থাকে। কিন্তু তারা স্বাভাবিক নিদ্রায় আচ্ছন্ন থাকে এবং যা কিছু স্বপ্নেই পেয়ে থাকে। স্বপ্নে আমরা স্বভাবতঃ তা-ই দেখি, যা আমাদের মিশ্র অনুভূতিতে মওজুদ তাকে। সজাদ অবস্থায় সেদিকে খেয়াল যায় না কিংবা মনোযোগ থাকে না। শুধু কতিপয় ধারণা রূপে অন্তরে সেগুলো সঞ্চিত হয়ে থাকে। স্বপ্নে সেগুলোই হুবহু রূপ ধরে আমাদের কাছে ধরা দেয়। যেমন, তপ্ত পিত্তের মানুষ স্বপ্নে দেখতে পায়, প্রচণ্ড গ্রীস্মে সে এক জংগলে অবস্থান করছে। ভীষণ গরম হওয়া বয়ে চলছে। হঠাৎ জংগলে আগুন লেগে গেল। সে আগুন চারদিক থেকে তাকে ঘিরে নিল। সে এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করছে। পালিয়ে বাঁচার জন্য। কিন্তু পালাবার জায়গা পাচ্ছে না। ফলে সেই আগুনে সে জ্বলে মরছে। এভাবে তার ভীষণ কষ্ট ভুগতে হয়। তেমনি সর্দী-কাশীতে আক্রান্ত ব্যক্তি স্বপ্নে দেখে যে, শীতের রাতে সে নৌকায় কোথাও যাচ্ছে। হঠাৎ তুফান এসে তার নৌকা উল্টে ফেলল। তখন সে বাঁচার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে লাগল। কিন্তু বাঁচতে পারছিল না। ডুবে মরতে বসে ভীষণ কষ্ট পাচ্ছিল।
মানুষের ভেতর অনুসন্ধান চালিয়ে আপনি এরূপ বিচিত্র অবস্থার লোক পাবেন যারা নিজ জীবনের বিভিন্ন বিক্ষিপ্ত ধারণা ও ঘটনা সুখ বা দুঃখের স্বপ্ন রূপে নিদ্রাবস্থায় অর্জন করে। সেগুলো সাধারণত অভিজ্ঞতা অর্জনকারীর ধ্যান-ধারণা ও স্বভাবের অনুকূল হয়ে থাকে। তেমনি দ্বিতীয় ধরনের ব্যক্তির কবর জীবনে পাপ বা পুণ্যের ফল এভাবে স্বপ্নেই লাভ করবে। পার্থক্য শুধু এতটুকু, এ এমন এক স্বপ্নকাল বা নিদ্রা যা থেকে মানুষ কেয়ামতের আগে মুক্ত হয় না। স্বপ্নদ্রষ্টা কখনও স্বপ্নে জানতে পায় না যে, স্বপ্ন তার বাস্তব নয়, শুধুই স্বপ্ন। এও বুঝতে পায় না যে, আসলে তার কোন সুখ বা দুঃখ হচ্ছে না। বরং স্বপ্নকেই সে সত্য ভেবে থাকে। এখন যদি তার এ স্বপ্ন কেয়ামতের আগে শেষ না হত অর্থাৎ সে জাগ্রত না হত, তা হলে বাস্তব যে অন্যকিছু তা সে কোন দিনই জানতে পেত না। সুতরাং কবর জীবনকে স্বপ্ন জীবন না বলে বাস্তব জীবন বলাই অধিক সংগত।
এ কারণেই হিংস্র প্রকৃতির লোক কবর জীবনে দেখতে পায়, তাকে কোন হিংস্র জীব ছিঁড়ে খাচ্ছে। কৃপণরা দেখতে পায়, তাদের সাপ-বিচ্ছু দংশন করে চলছে।
তারপর ঊর্ধতন জগতের জ্ঞান থেকে যারা বঞ্চিত ছিল, তারা দেখতে পায়, দু’ফেরেশতা (মুনকার-নাকীর) এসে ঊর্ধতন জগতের তত্ত্ব জিজ্ঞেস করল। তারা প্রশ্ন করছে, ‘তোমার প্রভু কে?’ ‘তোমার দ্বীন কি?’ ‘তোমার রাসূল কে?’ ইত্যাদি।
তৃতীয় শ্রেণীর লোকদের ভেতর পশুত্ব ও দেবত্ব দুটোই দুর্বল বলে মরার পর তারা কবর জীবনে নিম্ন স্তরের ফেরেশতাদের সাথে গিয়ে মিলিত হয়। কখনও নিজেদের প্রকৃতিগত ও জন্মগত কারণে, কখনও আবার অন্য কোন কারণে তারা সেরূপ করে থাকে। প্রকৃতিগত কারণ হল এই, তার দেবত্ব পশুত্বের প্রভাবে কমই আচ্ছন্ন হত। তারা না সে নির্দেশ মানত, না প্রভাব স্বীকার করত। অন্য কারণের একটি হল এই, সে ব্যক্তি তার ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষা দাবিয়ে রেখেছে ও ভালভাবে এ পথে স্থির রয়েছে। তারপর আত্মিক সাধনা চালিয়ে দেবত্বের জ্যোতি ও ইলহাম অর্জন করেছে। কখনও দেখা যায়, নপুংসক ব্যক্তি পুরুষ আকারে জন্ম নিয়েও নারী প্রকৃতি ও স্বভাবের হয়ে থাকে। যদিও শৈশবে পুরুষ ও নারীর বাসনা কামনার স্বাতন্ত্র্য সে উপলব্ধি করে না। কারণ, সে বয়সটি হল খাওয়া-দাওয়া আর খেলা-ধূলার বয়স। তখন তার সে সবের দিকে খেয়ালই থাকে না। তখন যদি তাকে পুরুষের চাল-চলতে অভ্যস্ত করা হয় এবং নারীর চাল-চলন রোধ করা হয়, তা হলে সে ইচ্ছায় হোক কি অনিচ্ছায়, পুরুষ স্বভাবেরই হয়ে ওঠে। কিন্তু যখন সে যুবক হয় এবং নিজ স্বভাবে বেপরোয়া হয়, তখন সঠিক ভাবেই সে নারী প্রকৃতির ওপর জমে বসে। ফলে চলনে-বলনে, আচার-আচরণে ও ইচ্ছায় অভিলাষে সে পুরোপুরিই নারী হয়ে যায়। এমন কি যৌন ক্ষেত্রেও সে কর্তার ভূমিকা ভুলে কর্মের ভূমিকা পালন করে চলে। এভাবে বেশ কিছুকাল চলার পর দেখা যাবে, সে পুরুষের সমাজ ছেড়ে নারী সমাজেই বিচরণ করে ফিরছে।
ঠিক এ অবস্থাই দাঁড়ায় মানুষের অন্যান্য ক্ষেত্রেও। মানুষ তার পার্থিব জীবনে খাওয়া-পরা, বাসনা-কামনা এবং অন্যান্য রীতি-নীতিও প্রয়োজন সম্পাদনে নিয়োজিত থাকে। কিন্তু নিম্ন স্তরের ফেরেশতাদের সাথে তাদের আত্মিক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকে। তাই আকর্ষণও সেদিকে থাকে। যখন সে মরে যায় এবং জড় দেহ থেকে মুক্তি পায়, তখন সে সেই মূল স্বভাবে ফিরে যায় এবং ফেরেশতাদের সমাজে গিয়ে ঠাঁই নেয়। তখন তাদেরও ফেরেশতাদের মত ইলহাম হয়। তাদেরও পাখা পালক হয়। হাদীসে আছে, ‘আমি জাফর ইবনে আবু তালিবকে জান্নাতে পাখায় ভর করে ফেরেশতাদের সাথে উড়তে দেখেছি’।
তৃতীয় শ্রেণীর মানুষ কখনও আল্লাহর বাণীকে উচ্চকিত করার কাজে এবং আল্লাহর দলের সহায়তায় নিয়োজিত থাকেন। কখনও বা মানুষের পুণ্যের খেয়াল উদ্রেক করেন। কখনও তাদের কিছু লোকের স্বভাবগত আকাঙ্ক্ষা জাগে দেহ ধারণের। তাই স্বরূপ জগতের দুয়ার খুলে যায়। তখন তার জৈব প্রাণে এক ঐশী শক্তি এসে যায় এবং সেটা একটা জ্যোতির্ময় দেহের অধিকারী হয়। কখনও তাদের কিছু লোক খাওয়া-দাওয়া করতে চায়। তখন তাদের সে ইচ্ছা পূরণের জন্য তারা যা খেতে চায় তার সুব্যবস্থা করা হয়। কুরআন মজীদের নিম্ন আয়াতে তারই ইংগিত দেখতে পাইঃ
(আরবী**********************************************************************)
সূরা আলে ইমরানঃ আয়াতঃ ১৬৯
“আল্লাহর পথে যারা প্রাণ দিল তাদের মৃত ভেব না। বরং তারা জীবিত। নিজ প্রভুর কাছে তারা রুজী পেয়ে থাকে। আল্লাহদত্ত খোরাক খেয়ে তারা খুশীতে মাতোয়ারা থাকে”।
এ সব শ্রেণী ছাড়া শয়তানের প্রভাবিত শ্রেণীও রয়েছে। তারাও স্বভাবগত কিংবা অন্য কারণে এরূপ খারাপ প্রকৃতির হয় যে, তাদের চিন্তা-ভাবনা সর্বদা ন্যায়ের পরিপন্থী, সৃষ্টির নিয়ম-শৃঙ্খলা বিরোধী ও সচ্চরিত্রতার অন্তরায় হয়ে থাকে। তারা ইচ্ছা করেই এ ধরনের হীন ও জঘন্য চিন্তা ও অভ্যেস অনুসরণ করে থাকে। তাই আল্লাহর অসন্তোষ ও অভিশাপ তাদের ঘিরে রাখে। তারা মরে গিয়ে শয়তানের দলে মিলিত হয়। তাদের কালো পোশাক পরানো হয় এবং তাদের ইতর কাজ ও স্বভাবগুলো স্বরূপে তাদের সামনে দেখা দেয়।
প্রথম শ্রেণীর লোকগুলোর অন্তরে আনন্দ থাকেবলে তারা স্বভাবতই তাদের পুরস্কার পেয়ে যায়। দ্বিতীয় শ্রেণী তাদের কৃতকার্যের স্বরূপ ও পরিণতি দেখে দুঃখ ও অনুতাপে দগ্ধ হয় বলে স্বভাবতই শাস্তি ভোগ করে। খোঁজারা যেভাবে নিজেদের মানব সামজের নিকৃষ্টতম পর্যায়ে দেখতে পেয়ে অত্যন্ত মানসিক যাতনা ভুগতে থাকে, তা থেকে কোন মতেই অব্যাহতি পায় না, এও তেমনি ব্যাপার।
শ্রেণী বিন্যাসকারীদের দৃষ্টিতে আরও এক ধরনের লোক রয়েছে। তারা হল সমঝোতাকারীর দল। তাদের ভেতর জৈবিক দিক প্রবল ও আত্মিক দিক দুর্বল থাকে। অধিকাংশ লোকই এ শ্রেণীভুক্ত। তাদের অধিকাংশ কাজই জৈব স্বভাবের হয়ে থাকে। জৈবিক চাহিদা পূরণেই তারা ব্যস্ত থাকে। এ শ্রেণীর লোকের দেহের সাথে প্রাণের সম্পর্ক সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয় না; বরং বাস্তব সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে চৈন্তিক সম্পর্কটা থেকে যায়। তার প্রবৃত্তি কখনও ভাবতে পারে না যে, দেহের সাথে তার সম্পর্কচ্ছেদ ঘটেছে। তাই (মর) দেহটি যদি তার কেটে কুটে টুকরা করা হয় তো ভাবে যে, তাকেই তা করা হচ্ছে। তাদের বৈশিষ্ট্য হল এই, আন্তরিক ভাবেই তারা দেহগত প্রাণ হয় অর্থাৎ দেহকেই প্রাণ ভেবে থাকে। কিংবা মনে করে, দেহছাড়া প্রাণের আলাদা অস্তিত্ব নেই। হয়ত সে বিশেষ সমাজ বা মতাদর্শের আওতায় পড়ে মুখে অন্যরূপ কথা বলে থাকে।
এ ধরনের লোক মারা গেলে স্বরূপে জগতের হাল্কা জ্যোতি তাদের ওপর দেখা দেয়। তাদের ভেতর দেখা দেয় উদভ্রান্ত খেয়াল ও ধ্যান-ধারণা। এখানে আত্মিক সাধনাকারীদের যে অবস্থা দেখা দেয়, তাদেরও ঠিক সেই অবস্থা দেখা দেয়। তাদের কৃত কাজকর্ম কখনও খেয়ালী রূপ নিয়ে, কণও স্বরূপ জগতের অন্যান্য বস্তুর মত বাস্তব রূপনিয়ে তাদের সামনে দেখা দেয়। আত্মিক সাধনাকারীদের সামনে যে ভাবে সব কিছু স্বরূপে দেখা দেয়, এও তেমনি ব্যাপার।
এখানে যদি তারা ফেরেশতা সুলভ কাজ করে থাকে, তা হলে সেগুলো তাদের ফেরেশতা আকরে দেখানো হয়। তাদের হাতে থাকে নরম রেশমী কাপড়। তাদের সাথে তারা খুব নম্র ও ভদ্রভাবে মিলে-মিলে ও কথা-বার্তা বলে। তাদের জন্য জান্নাতের জানালা খুলে ধরা হয়। তাই তারা জান্নাতের ঘ্রাণ পেতে থাকে। যদি তারা পশু সুলভ খারাপ কাজ করে থাকে ও অভিশপ্ত হয়, তা হলে তারা কাজগুলো সে ভয়াবহ ও কুৎসিত ফেরেশতা রূপে দেখতে পাবে। তারা কলো চেহারা নিয়ে বিকট আওয়াজে রূঢ় ভাষায় কথা বলবে। সেখানে যেমন ক্রোধকে হিংস্র জীব ও কাপুরুষতাকে খরগোশ আকারে দেখানো হবে, এও তেমনি দেখানো হবে।
কবর জগতে এমন সব ফেরেশতা রয়েছেনযাদের নিজ নিজ যোগ্যতা অনুসারে কাজে নিয়োজিত রাখা হয়েছে। এ জগতে আগমনকারী মানুষদের শান্তি বা শাস্তি দেবার কাজেও তাদের ব্যবহার করা হয়। সুতরাং শান্তিপ্রাপ্ত কিংবা শাস্তি প্রাপ্ত ব্যক্তিরা তাদের দেখতে পেত না।
জেনে রাখুন, কবর জগত কোন আলাদা জগত নয়। এ জগতেরই পরিশিষ্ট বা শেষাংশ। সেখানে সে কিছু গায়বী খবর জানতে পায় মাত্র। প্রত্যেকের বিশেষ বিশেষ অবস্থা সেখানে প্রকাশ পায়। বিচার জগতের ব্যাপার অন্যরূপ। সেখানে মানুষের ব্যক্তিগত অবস্থা লোক পেয়ে সকল মানুষের সামগ্রিক অবস্থা প্রকাশ পাবে। অর্থাৎ মানুষের ব্যক্তিগত খুঁটিনাটি কাজগুলোর স্ব স্ব রূপে আত্মপ্রকাশের ব্যাপারটি কবর জীবনেই শেষ হবে। বিচার জীবনে তার কাজের সামগ্রিক বিচার-বিবেচনা হবে। আল্লাহই ভাল জানেন।
সপ্তদশ পরিচ্ছেদ
বিচার জগতের তত্ত্বকথা
জেনে রাখুন, মানব প্রাণের বিশেষ একটি প্রত্যাবর্তন স্থল রয়েছে। লোহাকে যেভাবে চুম্বক টেনে নেয়, তেমনি টেনে নেয় প্রাণকে তার উৎসভূমি। সে জায়গার নাম হল, ‘হাযিরাতুল কুদস’ বা পবিত্র মজলিস। সব প্রাণই দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সেখানকার ধারক প্রাণ বা শ্রেষ্ঠতম প্রাণের সাথে মিলিত হয়। রাসূল (সঃ) সে প্রাণের আখ্যা দিয়েছেন বহুমুখী ও বহু ভাষী প্রাণ। এ সমাবেশ স্থলকে স্বরূপ জগত বা উপমা জগত যা ইচ্ছা বলতে পারেন। সেখানে মানব জাতির আদি নকশা বা চিত্র তৈরী হয়। এখানে ব্যক্তি বিশেষের ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যমূল রীতি-নীতি ও কার্য-কলাপ লোপ পেয়ে তা মানব জাতির সামগ্রিক বৈশিষ্ট্যের ও বিধি-বিধানের সাথে একাত্ম হয়। অন্য কথায়, তার জড় বৈশিষ্ট্যের ওপর আত্মিক বৈশিষ্ট্যের বা রূপের ওপর স্বরূপের প্রাধান্য ঘটে এবং সেটাই অবশিষ্ট থাকে।
কথাটির ব্যাখ্যা এই, কিছু ব্যাপার মানুষের নেহাৎ ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যমূলক। সেগুলোই একটি মানুষকে অপর মানুষ থেকে পৃথক করে দেখায়। তেমনি কতকগুলো ব্যাপার সব মানুষের ভেতর সমানে পাওয়া যায়। সুতরাং যে ব্যাপারগুলো সব মানুষের ভেতরই সমভাবে বিদ্যমান, স্বভাবতই সেগুলো মানবের জাতিগত বৈশিষ্ট্য। সেগুলোই হল মানব প্রকৃতি। ‘প্রতিটি মানব শিশু তার প্রকৃতির ধর্ম (ইসলাম) নিয়ে জন্ম নেয় তার মা-বাপ (পরিমণ্ডল) তাকে অন্যান্য ধর্মে দীক্ষা দেয়’ হাদীসটি এ সত্যেরই প্রমাণ দেয়।
সৃষ্টির প্রত্যেকটি জাতির বিশেষ প্রকৃতি বা রীতি-নীতির দুটি দিক রয়েছে। তার একটি দিক হল বাহ্যিক। যেমন তার জন্ম, আকৃতি, বর্ণ পরিমাপ, স্বর ইত্যাদি। যে সত্তার ভেতর যে শ্রেণীর বৈশিষ্ট্যগুলো পাওয়া যাবে, তাকে সেই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত ধরা হবে। কারণ, উপাদানে অভাব বা ত্রুটি না থাকলে শ্রেণীগত বৈশিষ্ট্য ও চাহিদা মতেই সৃষ্টিটি গড়ে উঠবে। যেমন, মানুষ মাত্রেই সরল আকৃতির, বাকসম্পন্ন ও মসৃণ ত্বকবিশিষ্ট হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে ঘোড়ার বাঁকা গড়ন, হ্রেষারব, রোমশ চর্ম ইত্যাকার বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন হয়।
এ শ্রেণীগত বৈশিষ্ট্য তার অন্তর্ভুক্ত কোন সত্তায়ই অবর্তমান হতে পারে না। হতে পারে যদি ভেতর বা বাইরের কোন কারণ তার প্রকৃতি বদলে দেয়। প্রতিটি শ্রেণীর রীতি-নীতিও ভিন্ন। আপনি কি দেখতে পাচ্ছেন না, মধুমক্ষিকাকে আল্লাহ কিরূপ দিব্যজ্ঞান দিয়েছেন যে, বিভিন্ন গাছের ফল-ফুল থেকে সে খুঁজে খুঁজে মধু আহরণ করে, সুনিপুণ ভাবে ঘর তৈরি করে, ঘরকেই আবার মধুর আকরে পরিণত করে?
পাখীদের দেখুন। আল্লাহ তাদের সহজাত শিক্ষা দিলেন পুং পাখী স্ত্রী পাখীর প্রতি আসক্ত হবে এবং জোড়া মিলে বাসা বানাবে। সেখানে ডিম দেবে। ডিম থেকে বাচ্চা হবে। বাচ্চাকে যথাযথ ভাবে তারা লালন-পালন করবে। বাচ্চা বড় হলে তাদের বাপ-মা শিখিয়ে দেয়, কোথায় পানি পাবে আর কোথায় পাবে খাদ্য। কি ভাবে শত্রু থেকে বাঁচতে হবে তাও শিখিয়ে দেয়। শিকায় কিভাবে বিড়াল আর শিকারী থেকে পালাতে হবে সে পদ্ধতি। কল্যাণ কোন পথে আসবে এবং নিজ জাতি ও মানব জাতির সৃষ্ট অকল্যাণ থেকে বাঁচার উপায় কি, সবই সবিস্তারে বুঝিয়ে দেয়। কোন বিবেক বুদ্ধি সম্পন্ন লোক কি বলতে পারবে, এ সব বিধি-বিধান জাতিগত চাহিদার অনুকূল নয় কিংবা কোন সম্পর্ক নেই এ সবের সেই পাখিকুলের সাথে? জানা দরকার, ব্যক্তি সত্তার সৌভাগ্য নিহিত রয়েছে জাতিগত বা শ্রেণীগত এ সহজাত বিধানের পূর্ণ আনুকূল্যের ভেতর। তাই শ্রেণীগত রীতি-নীতির বিরোধিতা করা কোন ব্যক্তি সত্তার জন্যই কল্যাণকর নয়। এ জাতিগত বিধানের তারতম্যের কারণেই সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্যের প্রশ্নে ব্যক্তি সত্তার ক্রিয়া-কলাপে পার্থক্য দেখা দেয়। যতক্ষণ ব্যক্তি তার শ্রেণীগত রীতির ওপর বহাল থাকে, ততক্ষণ তার কোনই দুর্ভোগ আসে না। কিন্তু বাইরের প্রভাবে যখনই ব্যক্তি জাতীয় স্বভাবের বাইরে চলে যায়, দুর্ভোগ তার জন্য অপরিহার্য হয়। এটা যেন ঠিক মানুষের কোন অংগ-প্রত্যংগ বাইরের কোন আঘাত পেয়ে পংগু বা অচল হয়ে গেল। মহানবীর (সঃ) এ হাদীসটি তারই ইংগিত দেয়ঃ
(আরবী**********************************************************************)
“প্রতিটি মানব শিশু নিজ প্রকৃতি (ইসলাম) নিয়ে জন্মে। তার বাপ-মা তাকে পরে ইহুদী, নাসারা বা মাজুসী করে গড়ে তোলে”।
জানা দরকার, মানব প্রাণের পবিত্র দরবারে (হাযিরাতুল কুদস) উপনীত হবার দুটো পদ্ধতি রয়েছে। কোন প্রাণ নিজ সাহস ও দিব্য সৃষ্টির বদৌলতে সরাসরি সেখানে পৌঁছে। কোন প্রাণকে পুরস্কার বা শাস্তিদানের জন্য সেখানে রূপ দিয়ে নেয়া হয়। সাহস ও দিব্যদৃষ্টি নিয়ে পৌঁছার অর্থ হল এই, যে ব্যক্তি জৈবিক অনাচার ও অপবিত্রতা থেকে মুক্ত রয়েছে, তার প্রাণ সরাসরি পবিত্র দরবারে পৌঁছে যায়। তখন সেখানকার কিছু কিছু ব্যাপার সে জানতেও পায়। মহানবীর (সঃ) এ হাদীস তার ইংগিত দেয়ঃ
“আদম ও মূসা নিজ প্রভুর দরবারে উপস্থিত রয়েছেন”।
এ ছাড়া বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তাঁর কয়েকটি হাদীসেই বলা হয়েছেঃ
“পুণ্যবানদের প্রাণ শ্রেষ্ঠতম প্রাণের (রূহে আজম) পাশে সমবেত হয়”। দ্বিতীয় ধরনের উপনীত হবার ব্যাপারটি হল এই, কেয়ামতের দিন আবার মানব দেহকে প্রাণ দান করে উত্থিত করা হবে। এটা কোন নতুন জীবন নয়। আগের জীবনের এটা উপসংহার মাত্র। বেশি খেয়ে কারো বদ হজম হলে যেমন অসুস্থতার পর নতুন স্বাস্থ্য ফিরে পায়, এও তেমনি ব্যাপার। যদি তা না হত, তা হলে ভিন্ন মানুষ হয়ে যেত। ফলে মৃত্যুপূর্ব মানুষটির জন্য মৃত্যুপরবর্তী নতুন মানুষটির কর্মফল ভোগ সংগত হত না।
বাইরে আমরা যে সব বস্তু দেখছি তার অনেকটাই স্বপ্নে দেখা বস্তুর মত। বস্তু সত্তার ধারণাটি রূপ নিয়ে ধরা দেয়। যেমন হযরত দাউদের (আঃ) কাছে ফেরেশতা ঝগড়ারত অবস্থায় এসে বিচার প্রার্থী হলেন। দাউদ (আঃ) সংগে সংগে বুঝে ফেললেন, উরিয়ার স্ত্রী বিচারের তিনি যে ভুল করেছেন, সেটাকেই বস্তুরূপ দিয়ে ফেরেশতারা তাঁর সামনে তুলে ধরছেন।–[এ ঘটনাটির বিশুদ্ধতা যদিও প্রশ্নাতীত নহে, তথাপি কোন কিছু বুঝাবার জন্য উপমা হিসেবে ব্যবহার করা আপত্তিকর হতে পারে না।]
অমনি তিনি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলেন। এভাবে (শবে মে’রাজ) মহানবীর সামনে ফেরেশতারা এক পেয়ালা দুধ ও এক পেয়ালা শরাব পেশ করলেন। তিনি দুধের পেয়ালাটি গ্রহণ করে শরাবের পেয়ালা প্রত্যাখ্যান করলেন। এখানে তাঁর উম্মতের জন্য দুধকে বিবেক (হেদায়েত) ও শরাবকে রিপুর (গোমরাহীর) প্রতীক হিসাবে উপস্থিত করা হল। দুধ গ্রহণ করে তিনি পুণ্যবান উম্মতের হেদায়েত লাভের ইংগিত দিলেন। তেমনি মহানবী (সঃ) স্বপ্নে দেখলেন, তিনি হযরত আবু বকর (রাঃ) ও উমরকে (রাঃ) নিয়ে একটি কূপের পাড়ে বসে আছেন এবং হযরত উসমান (রাঃ) পৃথক হয়ে অন্যত্র বসেছেন। এটা ছিল তাঁদের দাফন হবার বাস্তব রূপ। তাঁদের তিন জন একই স্থানে ও উসমান (রাঃ) অন্যস্থানে দাফন হবেন বলে জানানো হল। হযরত দাউদ ইবনুল মুসাইয়েবও মহানবী (সঃ) স্বপ্নের এই ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। এ থেকে আরও জেনে নিন, শেষ বিচারে অনেক ব্যাপারই এ ধরনের ঘটবে। গুণাগুণকে বস্তুরূপে দাঁড় করিয়ে কাজ চালানো হবে।
জানা দরকার, সাধারণ লোকের আল্লাহদত্ত প্রাণ ও জৈব প্রাণের ভেতর গভীর সম্পর্ক হওয়ায় স্বরূপ জগতের ব্যাপারগুলো সম্পর্কে তারা জন্মান্ধের মত হয়ে যায়। জন্মান্ধ যেমন আলো ও রূপের মোটামুটি ধারণা নেয়, তেমনি সাধারণ লোকদের ধারণা সৃষ্টির জন্য হাশরের দিন কিছু ব্যাপার আত্মপ্রকাশ করবে।–[তার ফলে তার জৈবিক প্রভাব লোপ পাবে এবং নিজের স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারবে।]
এ উদ্দেশ্যেই যখস সবলোক উত্থিত হবে তখন শুরুতেই একদলকে তাদের পাপ ও পুণ্যের জন্য শাস্তি ও পুরস্কার দেয়া হবে। সে বিচার তাদের হাল্কা ভাবেই করা হোক কিংবা কঠিন ভাবে। কিছু লোককে পুলসিরাত পার হতে বলা হবে। পাপীরা হোঁচট খাবে এবং পুণ্যবানরা স্বচ্ছন্দে পার হবে। কিছু লোককে তাদের নেতার পিছু ধরতে বলা হবে। পুণ্যবান নেতৃত্বের অনুসারীরা মুক্তি পেয়ে যাবে এবং পাপী নেতার অনুসারীরা ধ্বংস হবে। কিন্তু লোকের হাত-পা কথা বলবে এবং কিছু লোক আমলনামা পড়বে। কখনও কৃপণের কার্পণ্য রূপ ধরে এসে তার পিঠে সোয়ার হবে কিংবা দাগ হয়ে বসে যাবে।
মোটকথা, এ সব উপমা-উদাহরণ তার জাতিগত কার্যকলাপেরই বহিঃপ্রকাশ ত্রা। যে ব্যক্তির আল্লাহদত্ত প্রাণ সবল ও জৈবিক প্রাণ উদার, তাদের সামনে উপমা-উদাহরণ আসবে সূক্ষ্মতর হয়ে ও পূর্ণত্ব নিয়ে। মহানবী (সঃ) যে বলেছেন, ‘আমার উম্মতের অধিকাংশের শাস্তি কবরেই হয়ে যাবে’-এ ব্যাপারটি ঠিক উক্ত উপমা-উদাহরণেরই অন্তর্ভুক্ত। হাশর মাঠে এমন কিছু উপমা-উদাহরণও পেশ করা হবে যা সবাই সমানে দেখতে পাবে। যেমন মহানবীর (সঃ) সার্বজনীন নবুয়তের প্রতীক হবে ‘হাউজে কাওছার’। তেমনি মানুষের সুরক্ষিত কার্যকলাপের প্রতীক হবে ‘মীযান’। তেমনি উৎকৃষ্ট পানীয় এ হিসেবে ‘শরাবান তহুরা’। গৌরবের পরিধেয় হিসেবে ‘লেবাছে ফাখেরা’। অনিন্দ্য সহচরী হিসেবে ‘হুরে মাকসূরা’ এবং চিত্তাকর্ষী নিবাস হিসেবে ‘কসূরে দিল নশীন’ পেশ করা হবে। তেমনি পাপের আঁধার থেকে আল্লাহর নিয়ামতের দিকে ফিরে আসার জন্য আশ্চর্য ধরনের সব পদ্ধতি রয়েছে। যেমন মহানবী (সঃ) সবার শেষে জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের ব্যক্তি সম্পর্কে সে সব বিশদ বিবরণ দিয়েছেন। তিনি তার আকৃতি-প্রকৃতিও বলে দিয়েছেন।–[বোখারী ও মুসলিম শরীফের উক্ত হাদীসটি এই –“জনৈক জাহান্নামী আল্লাহর কাছে আরজ করবে, দয়াময় প্রভু! দোযখের আগুন আমাকে ঝলসে ফেলেছে, তাই তোমার দয়া থেকে আমাকে বঞ্চিত রেখ না। আল্লাহ জিজ্ঞেস করবেন, কিরূপ দয়া চাও! সে আরজ করবে, শুধু আমার মুখটাকে আগুন থেকে বাঁচাও, আর কিছু চাইনা। এ কথার ওপর সে প্রতিজ্ঞাও করবে। যখন তার মুখ আগুনথেকে ওপরে উঠে আসবে, তখন সে জান্নাতের ছায়াঘেরা বাগান দেখতে পাবে। অমনি তার ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটবে। আরজ করবে, প্রভু! শুধু আমাকে বাগানটির কাছে যেতে দাও। তাকে ভালভাবে প্রতিজ্ঞা করিয়ে খন গোসল সারিয়ে সেখানে নেয়া হবে, কিছুক্ষণ কোনমতে চুপ থেকেই জান্নাতের লোভনীয় আরাম-আয়েশের সামগ্রী দেখে আবার নতুন আব্দার তুলবে ইত্যাদি।]
মানুষের সেখানেও মানবিক বাসনা ও কামনা দেখা দেবে। সেমতে আল্লাহর নেয়ামতও বস্তুরূপে ধরা দেবে। মানুষের কামনা-বাসনায় পারস্পরিক স্বাতন্ত্র্যও দেখা দেবে। আল্লাহর দানও সে অনুযায়ী প্রকাশ পাবে। মহানবীর (সঃ) হাদীসে তার ইংগিত পাই। তিনি বলেনঃ জান্নাতে ঢুকে আমি একটি রক্তিম অধরের শ্যামল তরুণী দেখতে পেলাম। প্রশ্ন করলাম, এ কে?-[মহানবী (সঃ) শ্যামল মেয়ে দেখে এ কারণে অবাক হলেন যে, আরবের দৃষ্টিতে তা সুন্দর নয়। সুতরাং তা দেখানো হল কেন?] জবাব পেলাম, জাফর ইবনে আবু তালিব এ ধরনের সহচরী পসন্দ করে বলেই একে সৃষ্টি করা হল।–[জা’ফর ইবনে আবু তালিব হিজরত করে বেশ কিছুদিন আবিসিনিয়া ছিলেন। সেখানে এ ধরনের মেয়েকে সুন্দরী বরা হয়। তাই তিনি তা পসন্দ করতেন।] মহানবী (সঃ) অন্যত্র বলেন, যদি তুমি জান্নাতে গিয়ে চাও যে, ইয়াকুতের লাল ঘোড়ায় চড়ে সর্বত্র ঘুরে বেড়াবে, তক্ষুণি তুমি পেয়ে যাবে এবং তোমার সুখ পূর্ণ হবে। অন্যত্র তিনি বলেন, এক জান্নাতী আল্লাহর কাছে চাষাবাদের অনুমতি চাইবে। তাকে আল্লাহ প্রশ্ন করবেন, তোমার মনের ইচ্ছা কি সব পূরণ করা হয় নি? সে জবাব দিবে হ্যাঁ, সবই পূর্ণ হয়েছে। তবে আমি চাষাবাদ খুব ভালবাসি। তখন সে অনুমতি পেয়ে ফসল বুনবে। দেখতে না দেখতে তা গাছ হয়ে ফুলে ও ফলে সুশোভিত ও পরিপক্ক হয়ে কর্তিত হয়ে যাবে। এমন কি নিমেষে তার চারদিকে ফসলের পাহাড় তৈরী হয়ে যাবে। তখন আল্লাহ বলবেন, নাও হে আদম সন্তান! তোমার পেট তো কিছুতেই ভরে না। অবশেষে মিশকের টিলায় চড়ে আল্লাহর দীদার সবাই পেয়ে ধন্য হবে। তারপর আরও অনেক কিছু ঘটবে। মহানবী (সঃ) যখন সবিস্তারে এ সব বলেন নি, আমিও তা প্রকাশ করা ঠিক মনে করলাম না।
তৃতীয় অধ্যায়
মানব সমাজের বিভিন্ন সংগঠন
অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ
সংগঠন উদ্ভাবন পদ্ধতি
জেনে রাখুন, মানুষ খানা-পিনা,বিয়ে-শাদী, গ্রীষ্মে-বষায় ছত্রছায়া গ্রহণ, শতে গরম কাপড় ব্যবহার ইত্যাকার চাহিদায় সবাই সমান। আল্লাহ তাআলা বিশেষ অনুগ্রহ করে সব শ্রেণীকেই যার যার এ ধরনের প্রয়োজন পূরণের জন্য প্রকৃতিগত ‘ইলহাম’ করে রেখেছেন। তাই তারা জানতে পায়, কি করে কোন উপায়ে সে সব প্রয়োজন মিটাতে হবে। এ গুণগত দিক থেকে সবাই একাকার। কিন্তু যদি কেউ প্রকৃতিগত ভাবেই পংগু ও দুর্বল হয় এবং কোন চাহিদা না-ই থাকে, সেটা স্বতন্ত্র কথা।
লক্ষ্য করুন, মৌমাছি জানে কোন গাছে কি ফুল বা ফল খেতে হবে, কিভাবে মধু আহরণ করতে হবে, কোথায় কিরূপ ঘর বানাতে হবে। অন্য পাখী জানে, কোথা থেকে তাকে খাদ্য ও পানি সংগ্রহ করতে হবে। বিড়াল বা বাজ দেখলে পালাতে জানে। জানে তার প্রয়োজনের পথে অন্তরায় দেখলে তা দূর করার সংগ্রাম চালাতে। যৌন মিলন পদ্ধতিও তাদের অজানা নেই। নিরাপদে বসবাসের জন্য পাহাড়ের টিলায় কিংবা উঁচু গাছে বাসা বাঁধতে হবে তাও জানে। বাসায় ডিম দিয়ে কিভাবে তা হেফাজত করতে হবে তাও বুঝে। মোট কথা, এ সব ব্যাপারে প্রত্যেক শ্রেণীর স্বতন্ত্র পদ্ধতি জানা রয়েছে। শ্রেণীগত স্বাতন্ত্র্যের ভিত্তিতে প্রত্যেক শ্রেণীকেই প্রকৃতিগতভাবেই প্রয়োজনীয় জ্ঞান দান করা হয়।
এভাবেই আল্লাহ তা’আলা মানুষকে তাদের প্রয়োজন মিটাবার ও কল্যাণ সাধনের ক্ষেত্রে সহজতর পথ উদ্ভাবনের জন্য বিশেষ জ্ঞান দান করেছেন। যেহেতু মানব জাতি অন্যান্য জাতি থেকে বড়, তাই তার শ্রেষ্ঠত্ব অনুসারে তাকে তিনটি অতিরিক্ত জিনিস দেয়া হল।
প্রথমত, মানুষ কিছু করতে চাইলে সব দিক বিচার-বিবেচনা করেই তা চায়। পক্ষান্তরে চতুষ্পদ জীব শুধু প্রাকৃতিক তাগাদা দ্বারা পরিচালিত হয়। যেমন ক্ষুধা, তৃষ্ণা, যৌনস্পৃহা ইত্যাকার ব্যাপার। অথচ মানুষ জৈবিক প্রয়োজন ছাড়াই বুদ্ধি বৃত্তির প্রেরণার কাজ করে। কখনও তারা নগর ও রাষ্ট্র সুশাসন পদ্ধতি প্রবর্তনে উদ্যোগী হয়। কখনও তারা চরিত্র উন্নয়ন কিংবা আত্ম সংশোধনের প্রয়াস চালায়। কখনও পরকালের শাস্তির ভয়ে সংযত জীবনে অভ্যস্ত হয়। কখনও মানুষের কাছে মর্যাদা প্রতিষ্ঠা লাভের আকাঙ্ক্ষী হয়।
দ্বিতীয়ত, মানুষ তার প্রয়োজন মিটানোর পদ্ধতিটি শালীন ও সুন্দর করতে চায়। অথচ চতুষ্পদ জীব যে কোন ভাবে তার প্রয়োজন মিটায়। মানুষ প্রয়োজন পূরণের ক্ষেত্রে রুচি ও আনন্দের তাগাদাদা অনুভব করে। যেমন, সে সুন্দরী স্ত্রী, সুস্বাদু খাদ্য, উত্তম পোশাক ও সুরম্য ভবন পছন্দ করে।
তৃতীয়ত, এমন কিছু মানুষও রয়েছেন, যারা জ্ঞানগত উৎকর্ষের ফলে অনেক ভাল ভাল কল্যাণপ্রদ ব্যাপার নিয়ে ভাবেন ও তা অনুসরণে প্রয়াসী হন। এরূপ একদল মানুষও রয়েছে যারা জ্ঞানী লোকদের উদ্ভাবিত ব্যবস্থা ও অনুসৃত পদ্ধতি পসন্দ করে। কিন্তু নিজে তার উদ্ভাবন ক্ষমতা রাখে না। তারা কোন জ্ঞানীর বিশেষ উদ্ভাবন নিজের মোটামুটি জ্ঞানের অনুকূল পেয়ে তা অনুসরণ করতে আগ্রহী হয়। ক্ষুৎ-পিপাসা কাতর অনেক ব্যক্তিকে দেখতে পাবেন তারা নিজেরা তা জুটিয়ে নিতে না পেরে বেশ কষ্ট পেতে থাকে, কিন্তু যখন তা সরবরাহ করা হয়, অমনি অত্যন্ত আগ্রহ সহকারে তা যথারীতি নেবার জন্য প্রয়াসী হয়। ঘটনাক্রমে কোন উপযুক্ত জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তি যদি এ অবস্থায় পড়েন, তা হলে তিনি খাবার যোগ্য তরি-তরকারী নির্বাচন করে তার চাষ করবেন, পানি সেচে যত্ন নেবেন, কেটে-কুটে পরিস্কার করে খেয়ে নিবেন এবং পরবর্তী সময়ে খাবার জন্য কিছু জমিয়ে রাখবেন। এমন কি ফসলের ক্ষেত থেকে পানি দূরে থাকলে পয়ঃপ্রণালী কেটে পানি আনয়নের ব্যবস্থা করবেন কিংবা পুকুর কেটে নেবেন অথবা মশক বানিয়ে ডোংগা তৈরী করে কাজ চালাবেন। এ ভাবে খাদ্য উৎপাদন প্রয়াসের তিনি সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর প্রণালী উদ্ভাবন করবেন। এ ব্যক্তির উদ্ভাবিত এ পদ্ধতি স্বভাবতই উক্ত ক্ষুৎ-পিপাসা কাতর ব্যক্তিরা আগ্রহভরে অনুসরণ করবে।
তেমনি কোন অজ্ঞ ব্যক্তি কাঁচা ফসল বা তরকারী খেয়ে পেট নষ্ট করবে। তাই সে তা এমন উপায়ে খেতে আগ্রহী হবে যাতে পেট খারাপ না হয়। কিন্তু সে পথ তো তার জানা নেই। অবশেষে সে এ ক্ষেত্রে কোন অভিজ্ঞ ব্যক্তিকে পেল। তিনি পাকাতে জানেন, পিষতে জানেন, ভুনতে জানেন ও ভাজতে জানেন। তাই অজ্ঞ ব্যক্তিটি আগ্রহ ভরেই এ সব উদ্ভাবন অনুসরণ করবে এবং এ ক্ষেত্রে তার জ্ঞানের প্রসারতাও বেড়ে যাবে।
এ দুটো উদাহরণের আলোকেই আপনি মানুষের অন্যান্য প্রয়োজন পূরণের ব্যাপারটি অনুমান করুন। মানুষ সমস্যায় ভুগেছে। তাদের এক জ্ঞানী ব্যক্তি ভেবে-চিন্তে সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করেছেন। অন্যান্য মানুষ সেটা অনুসরণ করেছে। এ ভাবেই চলে এসেছে মানুষের প্রয়োজন পূরানোর ব্যবস্থাটি। তাই তার প্রয়োজন পূরণের প্রকৃতিগত জ্ঞানের সাথে এ সব অর্জিত বাড়তি জ্ঞান মিলে কল্যাণ অর্জনের বিপুল জ্ঞান ভাণ্ডার সৃষ্টি হয়েছে। সে সব নিয়মিত অনুসরণ করে তারা পূর্ণ মাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এমন কি সে সব পদ্ধতিতে তারা জীবন ধারণের স্বাভাবিক রীতিতে পরিণত করেছে এবং সেগুলো তাদের বাঁচা-মরার প্রশ্নের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে।
মোট কথা, মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের মতই প্রকৃতিগত জ্ঞান উক্ত তিন ব্যাপারের সাথে সম্পূর্ণ অবিচ্ছেদ্য। মানুষের জন্য মৌলিক শ্বাস-প্রশ্বাস অপরিহার্য। শিরা থাকলে তা নড়া যেমন অপরিহার্য, এও তেমনি। তবে শক্তি ও দুর্বলতা ভেদে শিরা সঞ্চালনে ক্ষিপ্রতা ও মন্থরতা আসে। সেরূপ শ্বাস-প্রশ্বাসও। তবে শ্বাস-প্রশ্বাস দীর্ঘ বা হ্রস্ব করা মানুষের ইচ্ছাধীন।
উক্ত তিনটি ব্যাপার সব মানুষের ভেতর সমানে পাওয়া যায় না। স্বভাব, বুদ্ধি ও অনুভূতির পার্থক্যের কারণে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, পসন্দ-অপসন্দ এবং ভাল-মন্দ বিচার ও অনুসরণের ক্ষেত্রে পার্থক্য দেখা দেয়। তা ছাড়া চিন্তা-ভাবনার সুযোগ-সুবিধার তারতম্যের কারণেও মানুষের অবস্থায় তারতম্য আসে। এ কারণেই জীবন ধারা অনুসরণের দুটো সীমারেখা নির্দিষ্ট করা হয়েছে।
প্রথমটি থেকে সাধারণ ও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মানবগোষ্ঠীও বাদ থাকতে পারে না। মরুর বেদুঈন, পার্বত্য জাতি ও সভ্যজগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন মনুষ্য সমাজ এ প্রাথমিক স্তরের জীবন ধারার অন্তর্ভুক্ত।
দ্বিতীয় ধারায় সভ্য জগতের বড় বড় শহর ও বস্তির বাসিন্দারা অন্তর্ভুক্ত। সেখানে উন্নত চরিত্র ও মনীষা জন্ম নেয়। সে সব শহরে বিভিন্ন মত ও পথের মানুষ বাস করে। জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় উপাদানের প্রাচুর্য থাকে, সেখানে বিভিন্ন মুখী অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান অর্জিত হয়। সে সব জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আলোকে বিভিন্ন মূলনীতি ও আইন প্রণীত হয়। সেখানকার অধিবাসীরা গুরুত্ব সহকারে সেগুলো অনুসরণ করে চলে। এ জীবন ধারার উন্নততম পর্যায় হল রাষ্ট্র ব্যবস্থা। রাষ্ট্রপতিকে কেন্দ্র করে সমবেত হন বিভিন্ন সমাজের জ্ঞানী-গুণীবৃন্দ। তিনি তাঁদের পরামর্শে বিভিন্ন কল্যাণপ্রদ ও সঠিক উপায়-উপকরণের উদ্ভব ঘটান। এ পর্যায়টিকেই আমরা জীবন ধারার দ্বিতীয় স্তর বলে থাকি।
এ দ্বিতীয় স্তর যখন পূর্ণ হয়ে যায়, তখন উন্নয়নের তৃতীয় স্তর প্রয়োজনীয় হয়ে দেখা দেয়। তা এই, যখন মানবমণ্ডলী একত্রে তাদের কাজ-কারবার চালায় তখন পরস্পরের ভেতর কার্পণ্য, লালসা, হিংসা, অবহেলা, মান্যতা ও অমান্যতা জনিত দ্বন্দ্বের বীজ দেখতে পায়। সেগুলো স্বভাবকেও প্রভাবিত করতে উদ্যোগী হয় এবং পরিণামে তাদের ভেতর দ্বন্দ্ব-বিভেদ দেখা দেয়। তাদের ভেতর কলুষ বাসনার লোকও দেখা দেয়। এমনকি স্বভাবগত খুনী ও দাংগাবাজ লোকের উদ্ভব ঘটে। তারা সমাজ ও রাষ্ট্রের রীতি-নীতি ও বিধি-বিধান হয় মেনে নিতে চায় না, নয় মেনে নেবার ক্ষমতা রাখে না কিংবা কেউ তাদের তা মানাতে সাহসী হয় না। তাই মানুষ কোন ইনসাফগার শাসক বা বিচারক নির্বাচন করতে বাধ্য হয়। তিনি যেন অপরাধীকে শাস্তি দেন, বিদ্রোহীকে দমন করেন, সবার কাছ থেকে কর আদায় করে সমাজের সার্বজনীন কল্যাণ ও সংস্কারের কাজে ব্যয় করেন।
এ তৃতীয় স্তরের উন্নয়ন থেকেই চতুর্থ স্তরে উন্নীত হবার তাগাদা সৃষ্টি হয়। তা এভাবে যে, দেশে দেশে যখন শাসক নিযুক্ত হয়ে যায়, তখন ধন-সম্পদের চাবিকাঠি তাঁর মুঠোয় চলে যায়। ফলে সবল ও বিচক্ষণ লোকেরা তাঁর পাশে ভিড় জমায়! তাদের ভেতর কার্পণ্য, সংকীর্ণতা, লোভ-লালসা ও হিংসা-বিদ্বেষের জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে। তার ফলে তাদের ভেতর শুরু হয় ঝগড়া, ফাসাদ ও রক্তারক্তি। তখন শাসকরা বাধ্য হয় এ পারস্পরিক দ্বন্দ্ব এড়াবার জন্য একজন আন্তর্জাতিক নেতা বা খলীফা নির্বাচন করতে। কিংবা এমন একটি আন্তর্জাতিক শক্তির আওতায় সংঘবদ্ধ হতে যাকে উপেক্ষা করা বা ঘায়েল করা কারো পক্ষে সহজসাধ্য নয়। তা করতে হলে অনেক দেশ বা জাতি মিলে করতে হয় এবং অসংখ্য লোক ও অজস্র ক্ষয়-ক্ষতি স্বীকার করেই তা করতে হয়। বলা বাহুল্য, এরূপ আন্তর্জাতিক মহাযুদ্ধের সম্ভাবনা সর্বাধিক কম এবং দীর্ঘকাল পরে হয়ত তা সম্ভব হতে পারে।
এ খেলাফত বা আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রয়োজন সব দেশ ও জাতির জন্য সমান নয়। দেশবাসীর অবস্থা ভেদে তা দেখা দেয়। যে জাতি রূঢ় স্বভাবের এবং নৈতিকতা বর্জিত, তাদের প্রয়োজন সর্বাধিক।পক্ষান্তরে যারা শালীন, উদার ও মহানুভব তাদের প্রয়োজন খুবই কম।
এখন আমি আপনাদের মানবীয় জীবন ধারার বিভিন্ন রীতি-নীতি ও অধ্যায়ের তালিকা সম্পর্কে অবহিত করব। উত্তম চরিত্রের প্রকৃষ্ট জাতির জ্ঞানী-গুণীদের জ্ঞান ও প্রজ্ঞা থেকে তা পাওয়া গেছে। তাঁরা এগুলোকে সর্ববাদি সম্মত নীতি হিসেবে মেনে নিয়েছেন। তাঁদের সমসাময়িক কিংবা কাছাকাছি কালের কেউই এগুলো সম্পর্কে দ্বিমত পোষন করেন নি। এখন আপনাদের সামনে যা কিছু পেশ করা হচ্ছে, অনুধাবন করুন।