ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ
প্রথম সংগঠন
এ সংগঠনের প্রথম ভিত্তি হল ভাষা। ভাষার মাধ্যমেই মানুষ তার ভাবের আদান-প্রদান ঘটায়। ভাষার মূলে রয়েছে কাঠামো, প্রকৃতি ও প্রক্রিয়া। এ সব মিলেই কোন না কোন ধ্বনি সৃষ্টি হয়। এ ধ্বনি অবশ্যই কোন না কোন সম্পর্ক বা কারণ থেকে হয়ে থাকে। ঐ ধ্বনিই হুবহু ভাষা হয়ে প্রকাশ পায়। তারপর তার অর্থের দিক থেকে শব্দ উদ্ভাবন করে তা বিন্যস্ত করা হয়। তার ফলে যে ব্যাপারটি সামনে ভেসে উঠে কিংবা ব্যক্তির মনের যে ভাবের উদ্রেক করে, সেটাকেই প্রথম সংগঠনের ভিত্তি মূল ভাষা নাম দেয়া হয়। তখন সেই ভাষার অনুরূপ ভাষা তৈরী করা হয় এবং কোন সম্পর্ক বা সামঞ্জস্যের কারণে তাকে ব্যঞ্জনার দিক থেকে বেশ প্রসারতা দেয়া হয়। ভাষা সম্পর্কিত আরও কিছু মূলনীতি আপনারা আমার অন্যান্য বক্তব্যে কোথাও কোথাও পাবেন।
এ প্রথম সংগঠনের ভেতর ভাষা ছাড়া ক্ষেত-খামার করা, গাছপালা লাগানো, কূপ খনন, খানা পাকান এবং রুটি ও বিভিন্নরূপ খাদ্য তৈরী রয়েছে। বিভিন্ন পাত্র তৈরী এবং প্রয়োজনীয় নানা যন্ত্রপাতি উদ্ভাবনও এর অন্তর্ভুক্ত। চতুষ্পদ জীবকে অনুগত করে কাজ লাগানো, তা বাহনরূপে ব্যবহার, তার দুধ-গোশত ভক্ষণ, হাড় ও লোমের ব্যবহার এবং বংশাবলী রক্ষা ও ব্যবহার এরই অন্তর্ভুক্ত। এ পর্যায়ে মানুষ শীত-গ্রীষ্ম থেকে বাঁচার জন্য গুহা কিংবা ঘরের ব্যবহার জানতে পায়। চতুষ্পদ জীবের চামড়া, গাছের বল্কল কিংবা পাতা দিয়ে কাপড় তৈরীও এ কালের কাজ। মানুষের জন্য তা পাখীর পালকের মতই কল্যাণ দেয়। নির্দিষ্ট বিয়ে-শাদীও এ অধ্যায়ে আসে। অপরের কুৎসা বা হস্তক্ষেপ থেকে বাঁচার জন্য তা করা হয়। এ থেকে মানুষ তারকামনা চরিতার্থের সাথে বংশধারাও অব্যাহত রাখে। তার ঘরকন্না ও সন্তান পালনের কাজ দেয়। মানুষ ছাড়া অন্যান্য জীব এভাবে স্ত্রী নির্দিষ্ট করতে পারে না। সেগুলোর জোড় বাঁধার ব্যাপারটি নেহাৎ আকস্মিক। হয় সে দু’টো একই সাথে জন্ম নেয় বলে পূর্ণত্ব লাভ করা পর্যণ্ত এক সঙ্গে থাকে কিংবা অন্য কোন কারণে তারা জোড় বেঁধে থাকতে বাধ্য হয়।
এ সমাজ ব্যবস্থায় কারিগরীর দিকেও নজর পড়ে। যেমন, কৃষি খামার, বাগান তৈরী, কূপ খনন, পশু পালন এবং পানি সিঞ্চনের জন্য ফোয়াড়া, মশক ইত্যাদির উদ্ভাবন। তা’ছাড়া পরস্পরের সামগ্রিক প্রয়োজন মিটানোর জন্য পারস্পরিক দ্রব্য বিনিময় পদ্ধতির সূত্রপাত হয় এবং বিভিন্ন কাজে পারস্পরিক সহযোগিতার প্রচলন হয়।
এ ব্যবস্থায় এমন লোকও দেখা যায় যিনি সঠিক সিদ্ধান্ত দিতে পারতেন। তিনি নিজ শক্তিতে অন্যান্যকে আয়ত্ত করতে পারেন এবং কোন না কোন উপায়ে নিজ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। এমন কি অনুবর্তীদের সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারেন।
এ ধরনের লোকদের কতগুলো সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত থাকে। তার সাহায্যে তাঁরা বিরোধ-বিসম্বাদ মিটিয়ে থাকেন। তা দিয়ে অত্যাচারী ও উচ্ছৃঙ্খলদের দমিয়ে রাখেন। তাঁদের বিরোধী শক্তির সাথে লড়তে পারেন। প্রত্যেক গোত্র ও সম্প্রদায়ের ভেতর এরূপ লোক থাকা এক অপরিহার্য ব্যাপার। যে কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে তাঁরা ভেবে-চিন্তে এরূপ রীতি-নীতি উদ্ভাবন করে থাকেন যা সবাই অনুসরণ করে থাকে। তাঁদের একদল বেশ মার্জিত রুচির হন। তাঁরা কোন না কোন উপায়ে শান্তিপূর্ণ জীবন যাপন পসন্দ করেন। কিছু লোক তাঁদের চারিত্রিক মহত্ত্ব, বীরত্ব, দানশীলতা, পাণ্ডিত্য ও শিল্প-সাহিত্যে গৌরবময় ভূমিকা নেন। এমন লোকও থাকেন যাঁর দুনিয়া জোড়া খ্যাতির চমক জাগে। তিনি নিজ শান শওকত বাড়িয়ে সবার শীর্ষে ঠাঁই নেন।
এটা অবশ্য বান্দার ওপর আল্লাহর বিরাট অনুগ্রহ যে, তিনি কুরআন পাকে মানবীয় জীবন ধারার সর্ব ইলহামী (স্বভাবগত) শাখাগুলো সুস্পষ্ট করে দিয়েছেন। কারণ আল্লাহ জানতেন, কুরআনের পাঠক সব ধরনের লোকই হবে। তাই সব মানুষের জীভন ধারাই তাতে রয়েছে এবং সেগুলোই এখানে বলা হল।
বিংশ পরিচ্ছেদ
জীবিকা-পদ্ধতি
জীবিকা-পদ্ধতির বিষয়টি এমন বিদ্যা যা জীবন ধারার দ্বিতীয় রূপ রেখায় বর্ণিত হয়েছে। তার সারকথা এই, প্রথম পর্যায়ের জীবন ধারার প্রয়াসগুলোকে সঠিক অভিজ্ঞতার কষ্টি পাথরে যাচাই করে বিশেষ রূপ দান। সেগুলো একদিকে যেমন ক্ষতিমুক্ত হবে, অন্যদিকে হবে কল্যাণকর। যা কিছু ক্ষতিকর বা কল্যাণমুক্ত প্রমাণিত হয়েছে তা বর্জন করা হবে। তা ছাড়া প্রথম পর্যায়ের পদ্ধতিগুলো সে সব চারিত্রিক মানদণ্ডে যাচাই করা প্রয়োজন, যা পূর্ণাঙ্গ ও সুস্থ স্বভাবের মানুষের প্রকৃতিতে জন্মগত ভাবেই সুরক্ষিত রয়েছে। সে সব পূর্ণাঙ্গ চরিত্রের অনুকূল ও আকাঙ্ক্ষিত রূপ রেখাই হবে সঠিক জীবিকা-পদ্ধতি। সেটাই গ্রহণ করে অন্যগুলো বর্জন করা উচিত। তারপর সে রীতিগুলোকে সর্বসাধারণের ভেতর উত্তম সংসর্গ ও সুন্দর আদান-প্রদানের মানদণ্ডে উতরে নিতে হবে। এভাবে সেগুলোর নির্ভুলতা সম্পর্কে অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে হবে। সাধারণ সংস্কারের জন্য সর্বসম্মত অভিমতের আলোকে তা করতে হবে।
জীবিকা ও জীবন পদ্ধতির গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো হল খানা-পিনা, চলা-ফিরা, উঠা-বসা, মেহমানদারী, প্রস্রাব-পায়খানা, স্ত্রী-সহবাস, পোশাক-পরিচ্ছদ, ঘর-বাড়ী, পাক-পবিত্রতা, সাজ-সজ্জা, আলাপ-আলোচনা, সেবা-শুশ্রূষা, ওষুধ-তাবিজ, মহামারী ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধ প্রয়াস, সন্তান-সন্ততি হওয়া, বিয়ে-শাদী করা, ঈদ উদযাপন, অতিথি-মুসাফির খাওয়ানো, বিয়ের ওলিমা কিংবা মেহমানদারীর ভোজোৎসব, বিপদাপদে হা-হুতাশ ও কান্নাকাটি, মৃতের দাফন-কাফন ব্যবস্থা ইত্যাদি।
প্রধান প্রধান শহর ও জনপদের সুস্থ প্রকৃতির বিবেক সম্পন্ন লোক এ ব্যাপারে একমত যে, অপবিত্র ও অপরিচ্ছন্ন জিনিস খাওয়া উচিত নয়। যেমন, মৃত পশু, দুর্গন্ধময় বস্তু এবং অপ্রকৃতিস্থ ও জঘন্য স্বভাবের জীব-জন্তু। তাই এগুলো থেকে বাঁচা প্রয়োজন। সকল রুচি সম্পন্ন বিবেকবান ব্যক্তিই চান যে, খানা বরতনে রাখা হোক এবং বরতন রাখার জন্য দস্তরখানা বিছানো হোক ইত্যাদি। এটাও সবাই পসন্দ করে যে খাবার আগে হাত-মুখ ধোয়া হোক। এটাও সর্বসম্মত রীতি যে, উগ্রতা, ক্রোধ কিংবা এ ধরনের যে সব কাজে সংগী-সাথীদের অন্তরে বিষাদ আসে তা বর্জন করা চাই। এটাও সার্বজনীন অভিমত যে, দুর্গন্ধময় পানি পান করা ঠিক নয়। তেমনি গোগ্রাসে পানি পান করাও উচিত নয়।
বিবেক সম্পন্ন ও রুচি মার্জিত ব্যক্তিরা এ ব্যাপারেও একমত যে, দু’ধরনের পংকিলতা থেকে দেহ, বসন ও আসন পবিত্র থাকা প্রয়োজন। এক, দুর্গন্ধময় বস্তু থেকে। দুই, প্রকৃতিগত পংকিলতা থেকে। যেমন বাসিমুখ দাঁতন দিয়ে ধোয়া, কিংবা অনভিপ্রেত লোম থেকে দেহকে মুক্ত রাখা। এভাবে কাপড়ের ময়লা ও বাড়ী-ঘরের আবর্জনা দূর করা।
সুস্থ প্রকৃতির লোক এ ব্যাপারেও দ্বিমত রাখেন না যে, মানুষ মানুষের মাঝে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন ও রুচি মার্জিত ভাবে থাকবে। সুন্দর পোশাক পরবে। মাথার চুল ও দাড়ি সুন্দর করে রাখবে। বিবাহিতা নারী হাত-পা রাংগিয়ে অলংকার ভূষিতা হয়ে থাকবে।
এ ব্যাপারেও তারা মতৈক্য রাখেন যে, নগ্নতা লজ্জাকর। পোশাক সৌন্দর্য বাড়ায় লজ্জাস্থান আবৃত থাকা অপরিহার্য গোটা দেহকে ঢেকে রাখে যে পোশাক সেটাই পূর্ণাঙ্গ পোশাক। লজ্জাস্থান ঢেকে রাখার জন্য অপরিহার্য পোশাক ও গোটা অংগ ঢাকার পোশাকের আলাদা পরিমাপও তারা নির্ধারণ করে থাকেন।
এটাও তাঁদের সর্বসম্মত মত যে, স্বপ্ন, জ্যোতির্বিদ্যা, ফালনামা ইত্যাদি দ্বারা ভবিষ্যতের ঘটনাবলী সম্পর্কে আগাম কিছু জানা যায়।
তা ছাড়া রুচি মার্জিত বিবেকবান ব্যক্তি মার্জিত ভাষায় কথা পছন্দ করেন। শ্রুতিমধুর বাক-বিন্যাস ও সংযত ভাষাপ্রয়োগ তাঁর বৈশিষ্ট্য হবে ও বাকভংগী আকর্ষনীয় হবে। তার কথাবার্তা ও বিবৃতি ভাষণ মানুষকে মুগ্ধ ও আকৃষ্ট করবে। এ ধরনের লোকই ভাষা ও সাহিত্যের মানদণ্ড হয়ে থাকে।
মোট কথা, প্রত্যেক ক্ষেত্রেই এমন কতগুলো সর্বসম্মত রীতি থাকে যা শহর ও জনপদ সমানে প্রতিপাল্য ও সর্বজন মান্য হয়। যে কোন দূর দূরান্তরের শহর ও জনপদে এ রীতি অনুসৃত হয়ে থাকে। যেমন, চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা চিকিৎসা শাস্ত্রের বিধি-বিধান অনুসরণ করা পছন্দ করেন, তেমনি জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা নক্ষত্রের গতিবিধির আলোকে নিজেদের জীবন ধারা নিয়ন্ত্রিত করেন। আর আল্লাহ বিশ্বাসীরা ইসলাম ও ইহসানের ভিত্তিতে তাদের জীবনধারা গড়ে তোলেন এবং ঐশী গ্রন্থে সে জীবন পদ্ধতির পরিপূর্ণ রূপরেখা সবিস্তারে বিবৃত রয়েছে। ফলে প্রত্যেক সম্প্রদায়ের মন-মেজাজ, চাল-চলন ও রীতি-নীতিতে সুস্পষ্ট পার্থক্য পরিদৃষ্ট হয়।
একবিংশ পরিচ্ছেদ
পারিবারিক ব্যবস্থা
এটা এমন বিদ্যা যাতে ব্যক্তি দ্বিতীয় ধাপে পৌঁছে একই ঘরে বাসিন্দা হিসেবে সম্পর্ক সংস্থাপন ও সংরক্ষণের পদ্ধতি পরিজ্ঞাত হয়। এ সম্পর্ক চার ভাগে বিভক্ত। এক, দাম্পত্য সম্পর্ক। দুই, পিতা-মাতা ও সন্তানের সম্পর্ক। তিন, গৃহকর্তা ও অধীনস্থদের সম্পর্ক। চার, সকলের পারস্পরিক সম্পর্ক ও সাহচর্য।
পরিবারের মূল ভিত্তি রচিত হয় যৌন প্রয়োজনে নারী ও পুরুষের সম্পর্ক ও সাহচর্যের মাধ্যমে। উভয়ের সম্পর্ক নিবিড়তর হয় এবং পারস্পরিক সহায়তার দ্বার উন্মুক্ত হয়। নারী সন্তানাদি প্রতিপালনের ক্ষেত্রে প্রকৃতিগত ভাবেই অধিকতর দক্ষ এ ব্যাপারে বিভিন্ন কলা-কৌশলের অধিকারিণী। এ কারণে অন্যান্য ক্ষেত্রে তার জ্ঞান-বুদ্ধি নগণ্য থাকে। দৈহিক কোমলতার জন্য কঠিন কাজ এড়িয়ে চলে। সে অধিকতর লজ্জাশীল হয়। ফলে স্বভাবতঃই ঘরকুনো হয়। ঘরের ছোট-খান ও খুঁটিনাটি কাজেই সে গলদঘর্ম হয়। সাধারণতঃ পুরুষের অনুগত হয়।
পক্ষান্তরে পুরুষের বৃহত্তর ক্ষেত্রে ব্যাপক কাজের প্রয়োজনে প্রকৃতিগত ভাবে তারা নারীর তুলনায় জ্ঞানী, আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন, সাহসী, সৌজন্য বোধের অধিকারী, শক্তিশালী ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী হয়ে থাকে। পুরুষের জীবনে নারীর প্রয়োজন রয়েছে। পুরুষের আত্মমর্যাদাবোধ ও কষ্ট স্বীকারের দাবী এটাই যে, কোন এক নারী নির্দিষ্টভাবে তারই সহচরী হিসেবে সাক্ষীদের সামনে নির্ধারিত হয়ে থাকবে।
তেমনি নারীর প্রতি পুরুষের আকর্ষণ ও নির্ভরতা দাবী করে যে, পুরুষ নারীর জন্য মহরানা দেবে, প্রস্তাব পাঠাবে ও অভিভাবকদের মাধ্যমে নারীর সম্মতি নেবে। অভিভাবকরা নারীর জন্য মাহরাম হওয়ায় এটা সম্ভব হবে। পক্ষান্তরে নারীর অভিভাবক যদি নারীর গায়ের-মাহরম হত তাহলে নারীর জন্য তা ক্ষতিকর হত। সে ক্ষেত্রে অভিভাবক নারীর অভিপ্রেত পুরুষ থেকে তাকে জোর করে ফিরিয়ে রাখত। তাছাড়া তখন নারীর অধিকার আদায় করে দেয়ার কেউ থাকত না। ফলে অধিকার বঞ্চিতা নারীর জীবন দুর্বিষহ হয়ে যেত। পরন্তু পারস্পরিক দাবী-দাওয়ার কলহে রক্তের সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যেত। তেমনি মার্জিত রুচির দাবী এটাই যে, পুরুষ তার গর্ভধারিণীর কিংবা ঔরসজাত নারীর অথবা এই ঔরসে জন্মগ্রহণ কারিণীর সাথে যৌন সম্পর্কের অভিলাষী হতে পারে না।
তারপর বিয়ের আলোচনায় যদিও মানবিক লজ্জা-শরম পারস্পরিক যৌন সম্পর্কের কথা উল্লেখ করতে দেয় না, তথাপি সেটাই যে এর আসল উদ্দেশ্য তা সকলের কাছে সুস্পষ্ট থাকে। ঘর সাজিয়ে, মাইক বাজিয়ে যেভাবে তার জোর প্রচার করা হয়, তাতে লোকদের ওলিমা না খাইয়ে উপায় থাকে না। মোটকথা এ ক্ষেত্রে অনেক পদ্ধতি অনুসৃত হয়। তার কিছু অংশ এখানে উল্লেখ করলাম। আর অবশিষ্টগুলো বুঝে নেয়ার জন্য রেখে দিলাম।
বস্তুতঃ বিয়ের জন্য জরুরী হল গায়ের-মাহরমের সাথে বিয়ে হবে, মজলিস অনুষ্ঠিত হবে, প্রস্তাব অনুমোদন হবে, অভিভাবকগণ নিঃস্বার্থ অভিভাকত্বের দায়িত্ব পালন করবে, কুফু রক্ষিত হবে, ওলিমা করা হবে, স্বামী সর্বদা স্ত্রীর জিম্মাদার হবে ও তার খাওয়া-পরার ব্যবস্থা করবে, স্ত্রী সর্বদা স্বামীর ঘর সংসারের কাজে নিয়োজিত থাকবে, সন্তানাদি লালন-পালন করবে ও স্বামীর অনুগত হয়ে থাকবে। গোটা মানব সমাজে এগুলোই বিয়ের অপরিহার্য শর্ত ও স্বতঃসিদ্ধ রীতি-নীতি। আল্লাহ তাআলা মানুষকে যে স্বভাব দিয়ে তৈরী করেছেন এগুলো তারই স্বাভাবিক দাবী। তাই আরব-আজমের কোথাও এর ব্যতিক্রম দেখা যায় না।
এভাবে যখন দুজন এক হয়ে যায় এবং একে অপরের ভাল-মন্দের সাথে জড়িয়ে যায় ও পরস্পর অবিচ্ছেদ্য সহযোগী হয়ে দাঁড়ায়, তখন বুঝা যায় যে, উভয়ই মনে-প্রাণে এ বিয়ে মেনে নিয়েছে। পক্ষান্তরে যদি এর বিপরীত দেখা দেয়, তখন তা থেকে মুক্তি লাভের পন্থাও অপরিহার্য হয়ে দেখা দেয়। অবশ্য তালাক ব্যবস্থা সকল বৈধ কাজের ভেতর সবচেয়ে অপ্রিয় কাজ। তাই তালাকের শর্ত রাখা হয়েছে এবং পরে ইদ্দত পালনের ব্যবস্থা অপরিহার্য করা হয়েছে। একই কারণে স্বামীর মৃত্যুর পরে ইদ্দত পালন শর্ত করা হয়েছে যেন বিয়ের গুরুত্ব ও মর্যাদা অন্তরে অবশিষ্ট থাকে, তাছাড়া বংশ ধারার সংমিশ্রণের আশংকাও যেন তিরোহিত হয়।
পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের মুখাপেক্ষিতা ও সন্তানের প্রতি মাতা-পিতার বাৎসল্যের দাবী এটাই যে, তারা তাদের এমন তালীম-তরবিয়ত দেবে, যা হবে সর্বতোভাবে প্রকৃতি সম্মত। সন্তান বয়স্ক ও অভিজ্ঞতা সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত মাতা-পিতার অভিভাবকত্বের দায়িত্ব অব্যাহত থাকবে। তাঁদের পুণ্য চরিত্রের সাহচর্য সন্তানদেরও পুণ্য চরিত্রের অধিকারী করবে। সন্তানের শিক্ষা-দীক্ষায় মাতা-পিতার শ্রম ও ত্যাগস্বীকার ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। এসব কারণেই মা-বাপের সঙ্গে সুসম্পর্ক ও সদাচরণ সন্তানদের জন্য অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়।
আদম সন্তানদের মেধা ও যোগ্যতার যেহেতু প্রকৃতিগত তারতম্য থেকে যায়, তাই তাদের কেউবা নেতা হয়, মনীষী হয়, বিত্তশালী হয়, এমনকি তার ভেতরে প্রকৃতিগতভাবেই সাংগঠনিক ও প্রশাসনিক যোগ্যতা এবং জনকল্যাণের প্রবণতা দেখা দেয়। পক্ষান্তরে কেউ আবার প্রকৃতিগতভাবেই ভৃত্য, নির্বোধ, অনুগত ও অন্ধ অনুসারী হয়ে থাকে। এ দু’ব্যক্তির জীবন স্বভাবতঃই পরস্পর নির্ভরশীল ও একে অপরের সম্পূরক। এ দু’জন তখনই একে অপরের সুখ-দুঃখের অংশীদার হবে, যখন দু’জনের পারস্পরিক সম্পর্ককে অন্তরে স্থায়ীভাবে ঠাঁই দেবে।
মানুষের ভেতর আরেকটি সম্পর্ক শাসক ও শাসিতের। তখন শাসক শাসিতের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব বহন করে। মালিক ও গোলাম, প্রভু ও ভৃত্য কিংবা রাজা ও প্রজার সম্পর্কটা এই স্তরের। মানব সমাজে এ ব্যবস্থাটাও চালু রাখা হয়েছে। এই শাসক ও শাসিতের সম্পর্কের একটা বিধি-বিধান থাকা অপরিহার্য। সে বিধানের অনুসরণ উভয়ের জন্য জরুরী হবে ও ব্যত্যয় ঘটা নিন্দনীয় অপরাধ বলে গণ্য হবে। তেমনি মালিক ও গোলামের সম্পর্কের ক্ষেত্রে গোলামের মুক্তির কোন শর্ত বা বিধান থাকা চাই, হোক সে টাকা দিয়ে কিংবা অন্য কোন উপায়ে যেন মুক্তি পেতে পারে।
তারপর অনেক সময় আবার মানুষ বিভিন্ন প্রয়োজনের শিকার হয়, রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে, অচলাবস্থার মুখোমুখি হয়। এক কথায় এমন সব অবস্থার সৃষ্টি হয়, যাতে করে অন্য মানুষের সহায়তা ছাড়া তার চলাই অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। এ সব সমস্যা সৃষ্টির ব্যাপারে সব মানুষই সমান। মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক ও সম্প্রীতি বজায় রাখা অপরিহার্য হয়। এ কারণেই অভাবী মানুষের সমস্যার সমাধান ও উৎপীড়িতদের উৎপীড়ন রোধের জন্য বিশেষ রীতি-নীতি ও বিধি-বিধান অত্যাবশ্যক। সে বিধান অবশ্য পাল্য হতে হবে এবং তা বর্জনকারী নিন্দনীয় ও তিরস্কৃত হবে। মানবিক প্রয়োজনের এই সমস্যার সমাধানের জন্য দুটো দিক প্রয়োজন। এক দিকে প্রত্যেকে অপরের লাভ-লোকসান ও ভাল-মন্দকে নিজের লাভ-লোকসান ও ভাল-মন্দবলে বিবেচনা করবে। অপর দিকে প্রত্যেকে অপরের জন্য নিজের যথাসাধ্য শক্তি-সামর্থ্য ব্যয় করবে, এমনকি নিজের আয় ও সম্পদের অধিকার দান করবে।
সারকথা, পারস্পরিক সহযোগিতার এ সম্পর্কের ক্ষেত্রে সাহায্যদাতা ও সাহায্য গ্রহীতা উভয়ের সহায়তা প্রয়োজন। দাতা যেন তার ক্ষতি স্বীকারের যথাযথ বিনিময় পেয়ে যেতে পারে। দান ও সহায়তার ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য দাবী হল নিকটাত্মীয়ের। কারণ তাদের সাথে নৈকট্য ও সম্প্রীতি সম্পর্কটা সহজাত ও প্রকৃতিগত। দ্বিতীয় ধাপটি সাধারণ মানুষের। স্বভাবতঃই প্রথম ধাপের চেয়ে এর গুরুত্ব অপেক্ষাকৃত কম। তবে বিপদগ্রস্তদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া মানুষের একটি স্বীকৃত রীতি হয়ে গেছে। অবশ্য আত্মীয়ের খবরদারী করার ব্যাপারটা সব চাইতে মজবুত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত।
মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল পারিবারিক তথা দাম্পত্য সম্পর্কের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে অবহিত হওয়া। যেমন, বিয়ে ও বিচ্ছেদের শর্ত ও কারণসমূহ জ্ঞাত হওয়া, পুরুষ ও স্ত্রীর প্রয়োজনীয় গুণাবলী জানা, পারস্পরিক সু-সম্পর্ক ও হৃদ্যতা সৃষ্টির পদ্ধতি বিদিত হওয়া, স্ত্রীর ইজ্জত-আবরু রক্ষার ক্ষেত্রে পুরুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কিত জ্ঞান অর্জন করা, নিজের পবিত্রতা রক্ষা ও স্বামীর আনুগত্যের মাধ্যমে স্ত্রী সংসারের কতখানি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করবে তা জ্ঞাত হওয়া, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার সৃষ্ট অসন্তোষ ও বিরাগের অবসান ঘটানোর উপায় অবহিত হওয়া, তালাকের পন্থা এবং স্বামী বিয়োগের শোক পালনের উপায় সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান রাখা ইত্যাদি।
তাছাড়া মা-বাপের সাথে কিভাবে সুসম্পর্ক রাখা যায়, ভৃত্য ও কর্মচারীর সাথে কিরূপে সদ্ভাব রাখতে হয়, ভৃত্যরা কিভাবে মালিকের যথার্থ সেবা করতে পারে, গোলাম কি করে প্রভুর কাছে থেকে মুক্তি পাবে, আত্মীয়, পাড়া-পড়শীর সাথে কি ধরনের আচার-আচরণ করতে হবে, অসহায় নাগরিকদের কিরূপ সহানুভূতি দেখাতে হবে, আর তাদের বিপদ মুক্তির জন্য কি কি চেষ্টা করতে হবে, জাতীয় নায়কদের আচার-আচরণ কেমন হবে, আর তারা কিভাবে জাতিকে পরিচালনা করবে, কি ভাবে মীরাছ বণ্টন হবে, কি ভাবেই বা বংশধারা সংরক্ষিত হবে, তা সবই অবগত হওয়া অপরিহার্য।
এ কারণেই মানব জাতির ভেতর এমন কোন সম্প্রদায় বা গোষ্ঠী মিলবে না, যারা উপরোক্ত ব্যাপারসমূহের নির্ধারিত রীতিনীতি অনুসরণ করে চলে না। অথচ তারা বিভিন্ন জাতি আর বিভিন্ন দেশের লোক।
দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ
অর্থনৈতিক ব্যবস্থা
অর্থনীতি এমন এক বিদ্যা যাতে মানুষের বৈষয়িক সহযোগিতার লেনদেন ও আয়-ব্যয়ের অবস্থা পর্যালোচিত হয়। অর্থনীতির মূলনীতি হল এই, মানুষের চাহিদা যতই খুব বেড়ে গেল আর প্রত্যেকেই নিজ নিজ প্রয়োজন মনের মত করে পূরণ করার জন্য উদগ্রীব হল, ততই দেখতে পেল কারো পক্ষেই বিচ্ছিন্ন থেকে একাকী তা পূরণ করা সম্ভব নয়। কারণ, কারো কাছে হয়তো প্রয়োজনাতিরিক্ত পানি রয়েছে কিন্তু খাবার নেই। ফলে একে অপরের মুখাপেক্ষী হতে বাধ্য হয়। এক্ষেত্রে বিনিময় ছাড়া তাদের গত্যন্তর নেই। তাই এ বিনিময়ের কাজটি অভাব পূরণের জন্য অপরিহার্য বলে বিবেচিত হয়। তখন এটা অপরিহার্য মনে হল যে, প্রত্যেক ব্যক্তি নির্দিষ্ট কোন এক প্রয়োজনীয় বস্তু উৎপাদন বা তৈরীর কাজে আত্মনিয়োগ করবে এবং সেটাকেই সুদৃঢ় ভিত্তিতে গড়ে তুলবে ও তার সর্ববিধ উপকরণ সংগ্রহ ও সরবরাহ করবে। এমনকি সেটাকে অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের বিনিময়ের মাধ্যম করার উপযোগী করবে। এ ভাবে বার্টার সিস্টেম অর্থনীতির এক সর্বজন স্বীকৃত মূলনীতি হয়ে দাঁড়াল। কিন্তু পরবর্তীকালে যখন দেখা গেল, একজনের পছন্দনীয় জিনিসটি অপর ব্যক্তির পছন্দ হচ্ছে না, তাই দ্রব্য বিনিময় কোন কোন ক্ষেত্রে অচল হয়ে পড়ছে, তখন তারা এ ব্যবস্থার বিকল্প আবিস্কারে আত্মনিয়োগ করল। ফলে তারা স্থায়ীত্ব লাভকারী খনিজ দ্রব্য বিনিময় কোন কোন ক্ষেত্রে অচল হয়ে পড়ছে, তখন তারা এ ব্যবস্থার বিকল্প আবিস্কারে আত্মনিয়োগ করল। ফলে তারা স্থায়িত্ব লাভকারী খনিজ দ্রব্য উত্তোলনপূর্বক মুদ্রা তৈরী করে বিনিময়ের মাধ্যম বানাল। তখন এটাই সর্বজন স্বীকৃত মাধ্যম হয়ে দাঁড়াল। খনিজ দ্রব্যের ভেতর সোনা ও রূপা এ কাজে ব্যবহৃত হয়। এগুলো মুদ্রাকারে তৈরী বিধায় মানুষের বহনের জন্যও সহজসাধ্য হল। তাছাড়া সোনা বা রূপার কোন গুণগত তারতম্য না থাকায় পছন্দ অপছন্দের বিরোধ দেখা দিল না। ফলে এ দুটোই সাধারণতঃ স্থায়ী সমাধান হয়ে দাঁড়াল। অন্য মাধ্যমটি শুধু উভয় পক্ষের স্বীকৃতির ভিত্তিতে অব্যাহত থাকল।
উপার্জনের পন্থা হিসেবে মানুষ কৃষি, পশুপালন ও পশু শিকার, কাষ্ঠ ও ফলমূল সংগ্রহ এবং খনিজ দ্রব্য আহরণকে গ্রহণ করল। তাছাড়া কামার, সূতার, তাঁতী ইত্যাদি শিল্পজাত পেশাজীবী গড়ে উঠল। এর মাধ্যমে মানুষ তার আল্লাহ প্রদত্ত প্রতিভাবে কাজে লাগাল। ব্যবসা-বাণিজ্য এক গুরুত্বপূর্ণ পেশ হিসেবে দেখা দিল।
তারপর শহর পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য মেথর ও ঝাড়ুদার নামক পেশাদার সৃষ্টি হল। অতঃপর মানুষের নানাবিধ চাহিদা ও প্রয়োজন মেটাবার জন্য বিভিন্ন পেশাদার জন্ম নিল। এ ভাবে মানুষ যতই ভোগ-বিলাস ও আড়ম্বরের দিকে অগ্রসর হল, তত বেশী পেশাদার সৃষ্টি হয়ে চলল। এমনকি এক এক পেশায় এক এক শ্রেণী নির্দিষ্ট হয়ে গেল।
এর কারণ দুটো। প্রথমতঃ প্রত্যেকে তার নিজ নিজ দক্ষতা ও ক্ষমতা অনুসারে নির্দিষ্ট পেশ গ্রহণ করল। সাহসী বাহাদুরেরা সামরিক পেশায়, মেধাবী ও ধীশক্তি সম্পন্নরা অফিস-আদালতের পেশায় এবং দৈহিক শক্তিধর ও পরিশ্রমীরা বোঝা বহন ও শ্রমের পেশায় নিয়োজিত হল। দ্বিতীয়তঃ সুযোগ-সুবিধার কারণেও পেশা নির্ধারিত হয়। যেমন, একজন কামারের ছেলের কিংবা তার সহচরদের জন্য কামার হওয়া যেরূপ সহজ, অন্যের জন্য সেরূপ সহজ নয়, তেমনি কামারের ছেলের জন্য অন্য কোন পেশাও সহজ সাধ্য নয়। যেভাবে নদীর কূলের বাসিন্দাদের জন্য জেলে হওয়া যত সহজ, অন্য কিছু হওয়া তার জন্য তত সহজ নয়।
এসব পেশাদার ছাড়াও কিছু লোক থাকে যাদের কোন ভাল পেশার সুযোগ বা শক্তি থাকে না। তখন তারা নাগরিকদের জন্য ক্ষতিকর পেশায় নিয়োজিত হয়। যেমন চুরি, জুয়া, ডাকাতি, ভিক্ষাবৃত্তি ইত্যাদি।
বিনিময় কার্যের আবার বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে। কখনও দ্রব্য দিয়ে দ্রব্যের বিনিময় হয়। সেটাকে বেচা-কেনা বলা হয়। কখনও দ্রব্যের বিনিময়ে কাজ নেয়া হয়। সেটাকে মজুরী বা ভাড়া বলা হয়। শহরবাসী কিংবা জনবহুল এলাকার নাগরিকদের ভেতর যেহেতু আত্মীয়তা বা প্রতিবেশী সুলভ বন্ধুত্ব গড়ে উঠে, তাই তাদের ভেতর হেবা, উপহার ও ধার-কর্জের আদান-প্রদান ও লেনদেন চালু হয়। দরিদ্র শ্রেণীর জন্য দান-খয়রাতের রীতি প্রবর্তিত হয়।
মূলতঃ যে কোন সমাজে কিছু লোক জ্ঞানী হয়, কিছু লোক বোকা হয়, কিছু লোক সবল হয়, কিছু লোক কর্মঠ হয়, কিছু লোক বিলাসী হয়, কিছু হিসেবী হয়, এবং এর ফলে সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি হয়। তাই একে অপরের সহযোগিতা ছাড়া চলতে পারে না। এ সহযোগিতার ক্ষেত্রে চুক্তি, শর্ত ও সমঝোতার প্রশ্ন দেখা দেয়।
এ সবের জন্যই বর্গা প্রথা, সমবায় প্রথা, শেয়ারের ব্যভসা, পাওয়ার অব এটর্নী; ইজারা প্রথা ইত্যাদি রীতি চালু হয়। এ ক্ষেত্রে ধার-কর্জও জরুরী হয়। কখনও আমানতের লেনদেন হয়ে থাকে এসব ক্ষেত্রে বিশ্বস্ততার অভাব দেখা দেয়ায় সাক্ষী-সাবুদ, লেখা-পড়া, দলীল-দস্তাবীজ, জামীন-জামানত ইত্যাদি ব্যবস্থা অনুসৃত হয়। মানুষ যত বেশী সম্পদ আহরণ করতে থাকল, তত বেশী পারস্পরিক সহযোগিতার রীতি-নীতি চালু হতে লাগল।
এভাবে সকল জাতি ও সম্প্রদায়ের ভেতর লেনদেনের এসব রীতি-নীতির বিস্তার লাভ ঘটেছে। আপনার এও দেখতে পাবেন, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ভাল-মন্দের ভিত্তিতেই ন্যায়বান ও নিপীড়ক নির্ণীত হয়।
ত্রয়োবিংশ পরিচ্ছেদ
রাজনীতি
রাষ্ট্রবিজ্ঞান সেই বিদ্যাকে বলে, যাতে নাগরিকদের পারস্পরিক সম্পর্ক বর্ণনা করা হয়। কোন রাষ্ট্রের নাগরিক বলতে তাদের বুঝায়, যারা ভিন্ন ভিন্ন থাকা সত্ত্বেও সম ভাবধারায় উদ্ধুদ্ধ ও জীবন-জীবিকার যাবতীয় কায়কারবারে পরস্পর সম্পৃক্ত।
মূলতঃ যে কোন রাষ্ট্রের নাগরিকগণ একই ব্যক্তি সদৃশ, যার বিভিন্ন অংগ-প্রত্যংগ মিলে একক দেহ গঠিত হয়েছে। প্রত্যেকটি যৌগিক বস্তুর যে কোন অংশে ক্ষতি দেখা দেয়ার সম্ভাবনা থাকে কিংবা তাতে কোন ব্যাধি সৃষ্টি হতে পারে। অর্থাৎ, তাতে যথাযথ অবস্থার বদলে কোন অব্যবস্থা দেখা দিতে পারে। অথবা তাতে যথাযথ অবস্থা বহাল থাকতে পারে এবং তা সুন্দর ও সুস্থ মনে হতে পারে। মোটকথা, বিভিন্ন অংশের সমন্বয়ে সৃষ্ট যে কোন বস্তুতে এদুটো অবস্থা দেখা দিতে পারে।
যে কোন রাষ্ট্রে বহু লোক বাস করে। ভাল-মন্দ ভাবনার ব্যাপারে নানা মুনির নানা মত হওয়া স্বাভাবিক। কোন উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন পরিষদ ছাড়া কেউ কারো নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রাখে না। কারণ, তা করতে গেলে ঝগড়া-বিবাদ ও দাংগা-হাংগামা সৃষ্টি হবে। তাই গোটা রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ এমন এক ব্যক্তির হাতে থাকতে হবে যার আনুগত্য রাষ্ট্রের ভাংগা-গড়ার ক্ষমতাসম্পন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ মেনে নেয়। অর্থাৎ, তিনি হবেন তাদেরই নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধান। রাষ্ট্র প্রধানকে পূর্ণ ক্ষমতাবান হতে হবে। তার অধীনে সামরিক বাহিনী থাকতে হবে! সংকীর্ণমনা উগ্র স্বভাবের দাংগা-হাংগামা প্রিয় লোকদের জন্য রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন সর্বাধিক।
এই ব্যবস্থার অবর্তমানে দেখা যায় যে, দুষ্ট প্রকৃতির লোকেরা ক্ষমতার অধিকারী হয়ে বসে এবং তখন তারা ইনসাফের বিধি-বিধান বর্জন করে খেয়ালখুশী মত সমাজ পরিচালিত করে। এ ধরনের সংগঠনকে ডাকাত সংঘের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। তাদের উদ্দেশ্য থাকে শুধু জনসাধারণের সম্পদ লুণ্ঠন করা। অথবা তাদের কাজ হয় হিংসা-বিভেদ ছড়ানো, শত্রুতা উদ্ধার করা ও যে কোন মূলে ক্ষমতায় জেঁকে বসা। এদের হাতে মানুষের চরম দুর্গতি নেমে আসে। এরূপ অবস্থায় তাদের বিরুদ্ধে জনগণকে উদ্ধুদ্ধ ও সংঘবদ্ধ করে তাদেরকে উৎখাতের জন্য জেহাদ করা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়।
সঠিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার অবর্তমানে অন্যান্য যে সব জটিলতা ও অকল্যাণ দেখা দেবে তা হল এইঃ
কোন দুর্ধর্ষ লোক যদি কাউকে হত্যা কিংবা আহত করে, অথবা নির্যাতন করে, কিংবা কারো স্ত্রী, কন্যা, ভগ্নির ইজ্জত নষ্ট করতে চায়, অথবা তার ধন-সম্পদ গায়ের জোরে ছিনিয়ে নেয় বা রাতের আঁধারে চুরি করে কিংবা কারো সম্মান হানি ঘটায়, অপবাদ রটায় ও নানা ভাবে ক্ষতি করে চলে, তখন তার প্রতিকারের কোন উপায় থাকে না।
এ সব প্রকাশ্য অপরাধ ছাড়াও বেশ কিছু অপ্রকাশ্য ও পরোক্ষ অপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকে। যেমন, যাদু করা, বিষ খাওয়ানো, মানুষকে ক্ষতিকর ব্যবহার শিক্ষা দান, মানুষে মানুষে ঝগড়া বাঁধানোর ষড়যন্ত্র করা, রাষ্ট্রপতি ও নাগরিক, কর্মচারী ও মালিক, স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক নষ্ট করার চক্রান্ত চালাতো ইত্যাদি।
তেমনি চরিত্র ধ্বংসকারী কার্যকলাপ যথা পুরুষ কিংবা নারীর সমকামিতা অথবা পশুর সংগে পাশবিকতার মত বদ-অভ্যেস মানব সমাজের সামাজিক রীতি-নীতির বিপর্যয় ঘটায়। এর ফলে স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য জীবনে ভাংগত সৃষ্টি হয়, কিংবা তারা অসুখী হয়।
তেমনি সে সব বদঅভ্যেস যা মানব সমাজের বিবেক ও রুচির পরিপন্থী। যেসব পুরুষরা নারী সেজে নারী সুলভ আচরণ চালায় কিংবা নারীরা পুরুষ সেজে পুরুষকে আচরণ দেখায়।
তেমনি সেসব স্বভাব যা বড় রকমের ঝগড়ার সৃষ্টি করে। যেমন, এরূপ কোন নারী লাভের জন্য কয়েকজনে জুটে কাড়াকাড়ি করা যে নারী মূলতঃ কারো জন্যই নির্ধারিত নয়, কিংবা মদ পান করে মাতলামী করা।
তেমনি নাগরিক জীবন দুর্বিষহ করার বিভিন্ন গর্হিত কাজে লিপ্ত হওয়া। যেমন, জুয়া খেলা, ঘুষের আদান-প্রদান, মাপে কম দেয়া, ভেজাল মেশানো, দুর্মূল্য সৃষ্টির জন্য গুদামজাত করা, কিংবা ফটকাবাজারী করা, অন্যকে ফাঁসানোর জন্য দাম বাড়ানোর দালালী করা ইত্যাদি।
তেমনি নাগরিক জীবন অতীষ্টকারী ঘৃণ্য কার্যকলাপে লিপ্ত থাকা। মিথ্যা মামলা, বানোয়াট ও জাল দলীল প্রণয়ন, মিথ্যা সাক্ষী, মিথ্যা শপথ ইত্যাদি। কারণ, এসব কারণে সত্য উদঘাটন ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা দুরূহ হয়ে পড়ে। পরন্তু নাগরিক নৈতিকতাও কলুষিত হয়।
তেমনি শহরবাসী শহুরে পেশা ছেড়ে গ্রামে গিয়ে চাষাবাদ শুরু করে কিংবা গ্রামবাসী চাষাবাদ ছেড়ে সবাই ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করাও একটা ক্ষতিকর দিক। কারণ, যে পেশায় যারা দক্ষ তারা হঠাৎ পেশা বদল করলে সব ক্ষেত্রেই অদক্ষতা ও ব্যর্থতা দেখা দেয়। এ কারণে খাদ্য উৎপাদকদের যেমন খাদ্য উৎপাদনে থাকা উচিত, তেমনি অন্যান্য পেশাদারদের নিজ নিজ পেশায় দক্ষতা প্রয়োগে লেগে থাকা কর্তব্য। মূলতঃ কৃষিকাজ যেন খাদ্য আর অন্যান্য পেশ লবণ। একটি ছাড়া অপরটি বিস্বাদ ও অর্থহীন হয়ে যাবে।
তেমনি হিংস্র জন্তু ও ক্ষতিকর এবং কীট-পতংগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়া। অথচ সেগুলো ধ্বংস করে ফেলা অপরিহার্য।
এসব তো গেল রাষ্ট্রের নাগরিক জীবনের নিরাপত্তার জন্য নাগরিকদের নীতি-নৈতিকতার বিভিন্ন দিক। এখন আলোচ্য হচ্ছে তাদের বৈষয়িক সংরক্ষণ ও উন্নয়নের দিকসমূহ। যেমন, রাজধানী ও কেন্দ্রীয় শহরগুলোয় জাতীয় প্রয়োজনের বিভিন্ন সৌধ নির্মাণ, প্রাচীর ও দূর্গ তৈরী, সারাইখানা, বাজার, রাস্তা-ঘাট, ও পুল তৈরী, পুস্করিণী, খাল ও কূপ খনন, নদী বন্দর ও জাহাজ তৈরী করে পণ্য আমদানী-রফতানী ও যোগাযোগের ব্যবস্থা করা, চাকরী, ব্যবসা ও শিল্পের সৃষ্টি করা, স্বদেশ ও বিদেশী মূলধন বিনিয়োগের আকর্ষণ ও সুযোগ সৃষ্টি করা ইত্যাদি।
তাছাড়া প্রত্যেক পেশার লোকজনকে নিজ নিজ পেশার কাজের উৎসাহ, পরিবেশ ও প্রশিক্ষণ দিতে হবে। বেকারদের কাজের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। শিল্পখাতে দ্রব্য যাতে উন্নতমানের হতে পারে তার জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কারিগরি শিক্ষার উপর বিশেষ জোর দিতে হবে। কৃষি বিদ্যালয় গড়ে তুলতে হবে। ভূমি অনাবাদী রাখা যাবে না। ইঞ্জিনিয়ারিং ও প্লানিংয়ে পারদর্শী লোক তৈরী করতে হবে, দেশের নাগরিকদের সামগ্রিক অবস্থা জানার ব্যবস্থা থাকতে হবে। তাহলে কার কোথায় কি প্রয়োজন তা যথাসময়ে নিরসনের ব্যবস্থা নেয়া যাবে। বিত্তবানদের সহায়তায় বিত্তহীনদের অবস্থার প্রতিকার করতে হবে।
বিশেষতঃ রাষ্ট্রীয় তহবিল যেন বেকারভাতা আর ওলামা, সেনানায়ক, কবি-সাহিত্যিক ইত্যাকার অনুৎপাদনশীল লোকের ভার বহন করে নিঃশেষ না হয়। তাহলে পেশাদার কৃষক ও ব্যবসায়ীদের ওপর অতিরিক্ত ট্যাক্স বসিয়ে তাদের নিরুৎসাহ করা হবে। ফলে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় ভাণ্ডার অধিকতর দুর্বল হয়ে পড়বে। এ দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বিদ্রোহ-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। তাই কর্মহীন সব লোককেই বেকারভাতা না দিয়ে কর্মক্ষমদের উৎপাদনশীল কাজে নিয়োগ করতে হবে এবং সামরিক ও পুলিশ বাহিনীতে প্রয়োজন মোতাবেক নিয়োগ করতে হবে। রাষ্ট্রনায়কদের উপরোক্ত ব্যবস্থাগুলো সতর্কতার সাথে অনুধাবন করতে হবে।
চতুর্বিংশ পরিচ্ছেদ
রাষ্ট্রপতিগণের চরিত্র ও গুণাবলী
রাষ্ট্রপতিকে অবশ্যই যথোপযোগী চরিত্র ও গুণাবলীর অধিকারী হতে হবে। অন্যথায় তিনি রাষ্ট্রের জন্য আপদ ও বোঝা হয়ে দাঁড়াবেন। তিনি যদি সাহসী না হন তা হলে তাঁর প্রতিপক্ষের সাথে যথাযথভাবে মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হবেন। ফলে জনগণ তাকে হেয় চোখে দেখবে। তেমনি যদি তিনি ধৈর্যশীল না হন, তাহলে জনগণ তাঁর হাতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। তেমনি যদি তিনি বিজ্ঞ না হন, তাহলে জনগণের কল্যাণ সাধনে তিনি অপারগ হবেন।
রাষ্ট্রপতিকে অবশ্যই জ্ঞানী, প্রাপ্ত বয়স্ক, স্বাধীন ও পুরুষ হতে হবে। আরও হতে হবে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণক্ষম। তাঁকে দৃষ্টি, শ্রবণ ও বাক শক্তির অধিকারী হতে হবে। জনগণ তাঁর ব্যক্তিত্ব ও খান্দানকে যেন মর্যাদার চোখে দেখে। তাঁর নিজের ও বাপ-দাদার এরূপ ভাল পরিচিতি থাকা চাই যা থেকে জনগণ তাঁর ওপর আস্থা স্থাপন করতে পারে। তারা যেন বিশ্বাস করতে পারে যে, তার দ্বারা দেশ ও জাতির যথার্থ কল্যাণ হবে।
রাষ্ট্রপতির এসব গুণাবলীর প্রয়োজনীয়তা জ্ঞানী মাত্রই উপলব্ধি করবেন। আর এ ব্যাপারে সকল বনী আদম একমত। যে দেশে আর যে সম্প্রদায়ের লোকই হোক না কেন, এ ব্যাপারে তাদের কোন মতানৈক্য নেই। কারণ তারা জানে, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তা উপরিবর্ণিত চরিত্র ও গুণাবলী ছাড়া অর্জিত হতে পারে না। সে ক্ষেত্রে জনগণ স্বভাবতঃই তার প্রতি বিরূপ হবে এবং তাঁর বিরুদ্ধে গণ-অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়বে। যদি তারা প্রকাশ্যে কিছু নাও বলে, তথাপি তারা অসন্তোষের কারণে রাষ্ট্রীয় কাজে উদাসীন থাকবে।
তাই রাষ্ট্রপতির জন্য প্রয়োজন হল গণমনে তাঁর প্রভাব ফেলা ও তা সর্বক্ষণ অক্ষুণ্ন রাখা। তেমনি যে সব কাজ তাঁর মর্যাদা ক্ষুণ্ন করে সেগুলোর ব্যাপারে তাঁর সার্বক্ষণিক সতর্কতা প্রয়োজন। যে রাষ্ট্রপতি তাঁর প্রভাব সৃষ্টি করতে আর তা অক্ষুণ্ন রাখতে চান, তাঁকে অবশ্যই উপরোক্ত চরিত্র ও গুণাবলীর অধিকারী হতে হবে। তাছাড়া রাষ্ট্রনায়ক সুলভ সব ধরনের গুণাবলীর অধিকারী হতে হবে। তাছাড়া রাষ্ট্রনায়ক সুলভ সব ধরনের গুণাবলীই তাকে অর্জন করতে হবে। যেমন, সাহসিকতা, বিজ্ঞতা, বদান্যতা, ক্ষমাপরায়ণতা, ঔদার্য্য সার্বজনীন কল্যাণ প্রবণতা।
জনগণের ভেতরে প্রভাব বিস্তার করে তাদের মুঠোয় আনার জন্য রাষ্ট্রপতিকে শিকারীর ভূমিকা নিতে হবে। শিকারী যেরূপ জংগলে বিভিন্ন কলাকৌশলের মাধ্যমে হরিণ শিকার করে থাকে, ঠিক সেরূপ করতে হবে। শিকারী জংগলে গিয়ে যখন কোন হরিণ দেখতে পায়, তখন সে হরিণের স্বভাব ও মেজাজের উপযোগী পন্থা ও কলাকৌশল ভেবে নেয়। তারপর সে শিকারের জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। যখন শিকার দৃষ্টিগোচর হয়, তখন সেটার চোখ-কান থেকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা চালায়। যখন সন্দেহ হয় যে শিকার তার উপস্থিতি টের পেয়েছে তখনই নিষ্প্রাণ পাথরের মত নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। যখন বুঝতে পায়, শিকার তার ব্যাপারে উদাসীন হয়েছে, তখনই আগে বেড়ে যায়। কখনও শীশ দিয়ে সেটাকে খুশী করে আর তার সামনে তার প্রিয় বস্তু এগিয়ে দেয়, তা সে এমনবাবে দেয় যেন সেটাকে মায়া করেই খাওয়ার জন্য দেয়, শিকার করার ইচ্ছে তার আদৌ নেই। এভাবে দাতা ও গ্রহীতার ভেতর প্রীতি বেড়ে যায়। এ প্রীতির শৃঙ্খল লোহার শিকরের চেয়ে শক্ত। এভাবে সেটা শিকারীর সহজ শিকারে পরিণত হয়। ঠিক এভাবেই যে ব্যক্তি নিজেকে জনগণের সামনে পেশ করতে চায় তার উচিত জনগণের পছন্দনীয় পোশাক, কথাবার্তা ও আচার-আচরণ অবলম্বন করা। তারপর আস্তে আস্তে তাদের কাছাকাছি হতে থাকবে আর ছল চাতুরীমুক্ত নিঃখাত প্রীতি ও ভালবাসা তাদের বিলিয়ে চলবে। তারা যেন ঘুনাক্ষরেও সন্দেহ করতে না পারে যে, তাঁর এ প্রীতি, অনুগ্রহ তাদের শিকার করার জন্যই দেখানো হচ্ছে। তাদের অন্তরে এটা মজবুত ভাবে বসিয়ে দিতে হবে যে, তাদের জন্য তার মত হিতাকাঙ্ক্ষী আর কেউ হতে পারবে না। এভাবে তাদের অন্তর যেন তার প্রীতিতে ভরপুর হয়ে যায়। ফলে যেন তারা তার ব্যাপারে অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ে।
মোটকথা, রাষ্ট্রপতির এ সব ব্যাপার খুব লক্ষ্য রাখতে হবে। তার তরফ থেকে যেন এমন কাজ প্রকাশ না পায় যাতে উক্ত অবস্থার কোন পরিবর্তন ঘটায়। যদি কোন ভুলত্রুটি হয়ে যায়, তাহলে ভাল কিছু করে সংগে সংগে তার প্রতিকার করবে। তারপর বুঝিয়ে দেবে যে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সেটাকেই তাদের জন্যে ভালবেসে করা হয়েছিল এবং তাদের ক্ষরি জন্যে আদৌ করা হয়নি।
এ’তো গেল এক দিক। অপর দিকে যারা রাষ্ট্রপতির অবাধ্য হয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা ও অশান্তি সৃষ্টি করতে চায় তাদের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা রাখতে হবে। পক্ষান্তরে যারা তার আনুগত্য মেনে নিয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সক্রিয় সহযোগিতা করবে তাদের জন্য পদোন্নতি ও পুরস্কারের ব্যবস্থা রাখতে হবে। তবে খেয়ানতকারী এবং অবাধ্য কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পদোন্নতি ও বেতন হ্রাসের ব্যবস্থা নিতে হবে।
মোটকথা, যে ব্যক্তি জনগণের অকল্যাণ করবে তার অকল্যাণ করতে হবে। তবে কারো বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার আগে পরামর্শ সভায় তা আলোচনা করে তাদের বুঝিয়ে নিতে হবে যে, সে শাস্তি পাবার যোগ্য। রাষ্ট্রপতির বা কোন সরকারী কর্মকর্তার পক্ষে জনগণকে অনুর্বল বা অনাবাদী জমি চাষ করতে কিংবা আবাদের জন্য কোন দূর দূরান্তে যেতে বাধ্য করা উচিত হবে না।
রাষ্ট্রপতিকে অবশ্যই সুস্পষ্ট দৃষ্টিসম্পন্ন ও দূরদর্শী হতে হবে। জনগণের ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষা হৃদয়ঙ্গম করার মত ক্ষমতা তার থাকতে হবে। সব ব্যাপারে তার ধারণা এরূপ স্বচ্ছ থাকতে হবে যেন তিনি সব কিছু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন।
রাষ্ট্রপতির জন্য অপরিহার্য হচ্ছে আজকের কাজ কালকের জন্য ফেলে না রাখা। তেমনি কেউ যদি তার বিরুদ্ধে গোপন ষড়যন্ত্র চালায়, তাহলে যতক্ষণ পর্যন্ত তাকে শায়েস্তা না করা যায়, ততক্ষণ তার ক্ষান্ত হওয়া ঠিক নয়।
পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ
পরামর্শ পরিষদ ও কর্মকর্তাদের গুণাবলী ও দায়িত্ব
রাষ্ট্রপতি যেহেতু রাষ্ট্রের উপরোক্ত ব্যবস্থাপনা ও কল্যাণমূলক কার্যকলাপের সব কিছু একা করতে পারেন না, তাই স্বভাবতঃই সহায়ক ব্যক্তিবর্গ থাকতে হবে। উক্ত সহায়ক লোকদের জন্য পয়লা শর্ত হল তাদের অবশ্যই যোগ্য ও আমানতদার হতে হবে। তেমনি রাষ্ট্রপতির প্রতি বাহ্যিক ও আন্তরিক আনুগত্য ও আস্থা থাকতে হবে। যার ভেতরে উপরোক্ত গুণাবলীর অভাব পরিলক্ষিত হবে তাকে পদচ্যুত করতে হবে। যদি রাষ্ট্রপতি তাকে পদচ্যুত করতে অবহেলা করেন, তা হলে তিনি যেন রাষ্ট্রের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করলেন। পরন্তু নিজের অবস্থাও খারাপ করে ফেললেন।
এ কারণেই রাষ্ট্রীয় কাজে তাঁর এমন লোককে নিয়োগ করা উচিত নয়, যাকে তিনি পদচ্যুত করতে পারবেন না। তেমনি এমন কোন ঘনিষ্ঠ আপনজনকে তাঁর নিয়োগ করা উচিত নয় যাকে অপসারণ করা তাঁর জন্য অশোভন হবে।
রাষ্ট্রপতির উচিত, তাঁর প্রতি যারা আন্তরিক তাদের দিকে নজর রাখা। কারণ কিছু লোক ভয়ে আর কিছু লোক লালসায় তাঁর প্রতি প্রীতি দেখায়। এ ধরনের বন্ধুদের কোন কিছুর মাধ্যমে কৌশলে জড়িয়ে রাখা চাই।
তবে কিছু লোক অত্যন্ত আন্তরিকতা নিয়েই তাঁকে ভালবাসে। তাই তাদের লাভকে নিজের লাভ ও তাদের ক্ষতিকে নিজের ক্ষতি মনে করা উচিত। মূলতঃ এক ধরনের লোক প্রকৃতিগত ভাবেই নিঃস্বার্থ ও সরল স্বভাবের হয়ে থাকে। এরা সেই শ্রেণীর লোক।
রাষ্ট্রপতির উচিত নয় কারো থেকে তার যোগ্যতা ও ক্ষমতার বাইরে কিছু আশা করা। তাঁর সহায়ক ব্যক্তিবর্গ চার শ্রেণীর হতে পারে। একদল হল প্রতিরক্ষা ও শান্তিরক্ষী বাহিনীর লোক। রাষ্ট্রকে বহিঃশত্রু ও অভ্যন্তরীণ দুষ্কৃতকারীদের হাত থেকে রক্ষা করা তাদের দায়িত্ব হবে। তারা দেহের সেই হাত যা সর্বদা সশস্ত্র থাকে। এক দল হবে দক্ষ ও কুশলী কর্মচারী। তারা মানব দেহের দক্ষতা ও কর্মক্ষমতার সাথে তুলনীয়। একদল হবে পরামর্শদাতা, তারা মানব দেহের বুদ্ধিবৃত্তি ও মানবতার সাথে তুলনীয়। রাষ্ট্রপতির সাথে অপরিহার্য যা তা হচ্ছে প্রতি নিয়ত তাদের খবরাখবর রাখা ও ভাল-মন্দ দেখা।
রাষ্ট্রপতি ও তার উক্ত সহায়কবৃন্দ যখন জনগণের কর্মচারী হয়ে অহরহ তাদের কল্যাণে নিয়োজিত হয়, তখন রাষ্ট্রের দায়িত্ব হয়ে যায় তাদের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করা। তবে রাজস্ব ও কর আদায়ের ক্ষেত্রে সহজ সরল পন্থা অনুসরণ করা চাই। তাতে যেন জনগণের ক্ষতি ও হয়রানী দেখা না দেয়। অথচ রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনও যেন মিটে যায়। প্রত্যেক ব্যক্তির কিংবা প্রতিটি মালামালের ওপর ট্যাক্স বসানো উচিত নয়।
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রনায়কগণ এ ব্যাপারে একমত যে, শুধু সচ্ছল লোকের ওপর ট্যাক্স হওয়া উচিত। যেমন পশু সম্পদ কৃষিকাজ দ্রব্য, কিংবা ব্যবসায় মালামালের ওপর ট্যাক্স হতে পারে। তাতেও যদি রাষ্ট্রীয় প্রয়োজন পূরণ না হয়, তা হলে পেশাদার লোকদের ওপর আয়কর ধার্য করা যেতে পারে।
রাষ্ট্রপতির এটাও অপরিহার্য দায়িত্ব যে, সেনাবাহিনীকে তিনি সে ভাবেই গড়ে তুলবেন, যেভাবে এক দক্ষ অশ্বারোহী তার অশ্বকে গড়ে তোলে। কোন ঘোড়ার কি চাল-চলন, কোনটির কোন বদঅভ্যাস, কোনটির দৌড় ও দোলা কিরূপ, কোটি আরোহীকে ঠিকভাবে নেয়, আর কোনটি ফেলে দিতে চায়, তা তার ভাল ভাবে জানা থাকে এবং সে ভাবেই ব্যবস্থা নিয়ে সে সেগুলোকে কাজে লাগায়। কখন আদর করতে হবে, কখন চাবুক মারতে হবে তা সে বুঝতে পারে। তাই যখন তারা ঘোড়া কোন অনুভিপ্রেত স্বভাব প্রকাশ করে, তার শৈথিল্য চলে যায়, অথচ সেটা কোন পেরেশানীর শিকার হয় না। কারণ, কি জন্য তাকে শাস্তি দেয়া হয়েছে সেটা সে অনায়াসেই বুঝতে পায়। এভাবে যখন যে স্বভাবের জন্য সেটাকে শিক্ষা দেয়া হয় সেটা যদি তার সামনে সুস্পষ্ট করে তুলে ধরা যায়, তা হলে সেটা তার অন্তরে স্থায়ীভাবে দাগ কাটে। ফলে সেই স্বভাবের পুনরাবৃত্তির ভয়ে এগিয়ে চলে। তথাপি সেটার এ ভয়টাকে স্বভাবে পরিণত করা পর্যন্ত সে সতর্কতার সাথে এ পরিবর্তন লক্ষ্য করতে থাকে। যখন দেখতে পায় যে, কোনরূপ সতর্কতা ছাড়াই সেটা স্বাভাবিকভাবে সদাচরণ করে চলে, তখনই কেবল সে নিশ্চিত হয়ে থাকে।
ঠিক এ পদ্ধতিতেই সেনাবাহিনীকে সুশৃঙ্খল করে গড়ে তোলা অপরিহার্য। তারা যেন তাদের করণীয় ও বর্জনীয় কাজগুলো যথাযথ ভাবে জানতে পারে এবং সেভাবে নিজেদের পরিপূর্ণভাবে গড়ে তুলতে পারে। সেনানায়কদের সেদিকে সদা-সতর্ক দৃষ্টি থাকতে এবং তাদের থেকেও কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলার বাইরে কিছু প্রকাশ না পায় সেদিকে খেয়াল রাখবে। রাষ্ট্রপতির এ সহায়ক শক্তিগুলোর সংখ্যার নির্দিষ্ট কোন সীমারেখা থাকবে না। রাষ্ট্রের প্রয়োজনে তা কমানো-বাড়ানো হবে। কারণ, কখনও কোন কাজে একজনই যথেষ্ট হয়, কখনও আবার একাধিক লোকের প্রয়োজন দেখা দেয়। তবে মূল কর্মকর্তা হবেন পাঁচ জন।
এক, প্রধান বিচারপতি। তিনি হবেন পুরুষ, প্রাপ্ত বয়স্ক, স্বাধীন, বিজ্ঞ, ধীশক্তি সম্পন্ন ও যোগ্য। তাকে তাঁর বিষয়গত বিদ্যায় পারদর্শী হতে হবে এবং পক্ষ-বিপক্ষের বক্তব্যের মারপ্যাঁচ ও ছলচাতুরী সম্পর্কে ওয়াকিফহাল থাকতে হবে। স্বভাবে দৃঢ়তা ও ধৈর্য্য থাকতে হবে।
বিচার করতে হলে তাকে দুটো ব্যাপার খেয়াল রাখতে হবে। প্রথমেই বিচার্য ঘটনাটি বিশ্লেষণ করে তাঁর দেখতে হবে যে, এটা আদৌ কোন ঘটনা কিনা। যদি সত্যি কোন ঘটনা হয়, তা হলে সেটা জুলুম-বঞ্চনার ব্যাপার, না ভুল বুঝা-বুঝির ফলে সৃষ্ট আপোষযোগ্য ব্যাপার। দ্বিতীয়তঃ তাঁর দেখতে হবে যে, বাদী-বিবাদী মূলত তার প্রতিপক্ষের কাছে কি চায় এবং কার চাওয়াটা সঠিক, আর কারটি সঠিক নয়। তাছাড়া ঘটনা জানার সূত্রগুলোও বিশ্লেষণ করে দেখা চাই। কেননা, একপক্ষের হয়ত এরূপ সুস্পষ্ট দলীল-প্রমাণ রয়েছে যার ওপর কারো কোন সংশয় দেখা দেবে না। পক্ষান্তরে প্রতিপক্ষের দলীল-প্রমাণ অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও সংশয়যুক্ত। এ সবই বিচার-বিশ্লেষণ সাপেক্ষ ও এগুলো পুংখানুপুংখ বিশ্লেষণ করেই রায় দিতে হবে।
দুই, প্রধান সেনাপতি। প্রধান সেনাপতিকে অবশ্যই সেনা সরঞ্জাম, সমরোপকরণ ও সমর কৌশল সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকেফহাল হতে হবে। তাকে সাহসী ও শক্তিশালী লোক সংগ্রহ করতে হবে। প্রতি ব্যক্তির কর্মক্ষমতা ও যোগ্যতা জানতে হবে। সৈন্যদের প্রশিক্ষণ ও গোয়েন্দা নিয়োগের কলাকৌশল ভালভাবে জানা চাই। শত্রুর ঘাঁটিসমূহ ও আক্রমণ পরিকল্পনা সম্পর্কে তাকে ওয়াকেফহাল থাকতে হবে।
তিন, পুলিশ প্রধান। শান্তিরক্ষী বাহিনীর প্রধানকে অবশ্যই সাহসী ও সুদক্ষ পুরুষ হতে হবে। কিভাবে রাষ্ট্রের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করা যায় ও শান্তি ভংগকারীদের শায়েস্তা করতে হবে, তা তাকে ভালভাবেই জানতে হবে। তার চরিত্রেও দৃঢ়তা ও ধৈর্য্য থাকতে হবে। তাকে অবশ্যই সেই স্বভাবের লোকদের একজন হতে হবে, যারা কোন অন্যায় দেখে চুপ থাকতে পারে না। পুলিশ প্রধান যখন এ স্বভাবের হবেন, তখন স্বভাবতঃই তিনি অনুরূপ স্বভাবের লোকই বেছে বেছে প্রত্যেক এলাকায় দায়িত্বশীলদের শ্রেণীতে নিযুক্ত করবেণ। তারা অবশ্যই স্ব-স্ব এলাকার খবরাখবর সম্পর্কে ওয়াকিফহাল হবেন। তাদের মাধ্যমে তিনি সারা দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করবেন। যখন প্রয়োজন তখনই তাদের কাজের কৈফিয়ত নেবেন।
চার, রাজস্ব সচিব। সমগ্র রাজস্ব বিভাগে কর্মচারী নিয়োগ, সঠিক পাত্র থেকে রাজস্ব আদায় ও যথাযথ ক্ষেত্রে তা বিতরণ, তাঁর দায়িত্বে থাকে।
পাঁচ, প্রাইভেট সেক্রেটারী। রাষ্ট্রপ্রধানের করণীয় ব্যাপারগুলোই তাঁকে সাহায্য করা ও তার ব্যক্তিগত ব্যাপার তদারক করাই তার দায়িত্ব। কারণ রাষ্ট্রীয় সার্বিক দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত করার ফলে রাষ্ট্রপ্রধান তাঁর ব্যক্তিগত দায়িত্ব পালনের অবকাশ পান না।
ষষ্ঠবিংশ পরিচ্ছেদ
আন্তঃরাষ্ট্রিক নীতিমালা
এ অধ্যায়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রের পারস্পরিক সম্পর্ক বিষয়ক নীতিমালা আলোচিত হবে। কি করে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মাঝে সুসম্পর্ক বহাল রাখা যায় সেটাই এ নীতিমালার লক্ষ্য। এ নীতির মাধ্যমে বিভিন্ন রাষ্ট্রের ও জাতির ভেতরে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক কায়েম হবে। যেহেতু প্রত্যেক রাষ্ট্রই স্বাধীন ও তার শাসকই রাষ্ট্রের সব কিছুর অধিকর্তা, তাই স্বভাবতঃই তার ভাণ্ডারে সম্পদ পুঞ্জিভূত হয় এবং লোভী ও উচ্চাভিলাষী লোক তার সভাসদ হয়। ফলে বিভিন্ন স্বভাব ও দক্ষতার শাসকমণ্ডলীর ভেতর মতানৈক্য ও দ্বন্দ্ব দেখা যায়। যে শাসক নিজকে অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী দেখতে পায়, সে শাসক অপেক্ষাকৃত দুর্বল শাসকদের উপর জোর-জুলুম চালাতে চায়। এমন কি তা দখল করে নেয়ার জন্য লালায়িত হয়। তাছাড়া সম পর্যায়ের হলেও পারস্পরিক ঈর্ষা থেকে ছোক-খাট বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। কখনও সীমান্ত ভূখণ্ড নিয়ে, কখনও বা সম্পদ আহরণ নিয়ে এ দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। এ সবের ফলে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে যুদ্ধ-বিগ্রহ দেখা দেয়। এ কারণেই একজন খলীফার প্রয়োজন অপরিহার্য হয়ে যায়।
খলীফা বলতে সেই লোকটিকে বুঝায়, যার কাছে সৈন্য-সামন্ত ও যুদ্ধ সরঞ্জাম এত বেশী রয়েছে যে, তার দিকে কারো হাত বাড়ানো স্বভাবতঃই অসম্ভব। কারণ তার রাষ্ট্রে হস্তক্ষেপ করতে হলে অনেক রাষ্ট্রও তাদের সেনা সম্পদ একত্র করে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তবে হয়ত তা কিছুটা ভাবা যায়। অথচ তার বিরুদ্ধে সব রাষ্ট্র একত্র করা সাধারণ এক অভাবনীয় ব্যাপার।
রাষ্ট্রবর্গের যখন কোন খলীফা নির্ধারিত হয়ে যায় এবং তার মাধ্যমে উত্তম নীতি ও চরিত্র পরিশীলিত হয়, বিদ্রোহীরা অনুগত হয়ে যায় ও শাসকবর্গ তাকে মেনে নেয়, তখন আল্লাহর নিয়ামত পরিপূর্ণভাবে আত্মপ্রকাশ করে। সব রাষ্ট্রে স্বস্তি দেখা দেয় এবং জনগণ আশ্বস্ত হয়ে যায়। খলীফাকে তখন শুধু হিংস্র প্রকৃতির লোকদের শায়েস্তা করতে হয় যারা জনগণের সম্পদ লুটে খায় আর তাদের সন্তানদের কয়েদী বানিয়ে থাকে। তিনি তাদের উৎপাত-উৎপীড়নের মূলোৎপাটন ঘটিয়ে জনগণকে তাদের ক্ষতি ও ভীতি থেকে মুক্ত করেন।
এ কারণেই বনী-ইসরাঈলরা তাদের নবীর কাছে আবেদন করেছিল যে, ‘আমাদের জন্য একজন বাদশাহ পাঠান, তাহলে আমরা আল্লাহর পথে জেহাদে অবতীর্ণ হতে পারব’। যখন প্রকৃতি পূজারী হিংস্র প্রকৃতির লোকগুলো বদ অভ্যেসের বশবর্তী হয়ে দেশে ফেতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করে, তখন তার প্রতিকার ব্যবস্থা সম্পর্কে আল্লাহ পাক নবীদের সরাসরি কিংবা পরোক্ষভাবে এ কথাই জানিয়ে দেন যে, প্রথমে তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি নির্মূল করতে হবে। তাতেও তারা সংশোধিত না হলে তাদের হত্যা করতে হবে। এ ধরনের লোক সমাজ দেহের বিষাক্ত অংগটির মতই আশংকাজনক হয়ে থাকে। তখন খলীফার কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এ ব্যবস্থা সম্পর্কে আল্লাহ বলেনঃ
(আরবী**********************************************************************)
সূরা হাজ্জ্বঃ ৪০
অর্থাৎ, আল্লাহ পাক যদি একদল দ্বারা অন্য দলকে শায়েস্তা না করতেন, তা হলে তারা গীর্জা, মসজিদ সব কিছুই বিধ্বস্ত করত।
আল্লাহ পাক এ কারণেই বলেছেন, “তাদের বিরুদ্ধে ততক্ষণ অভিযান অব্যাহত রাখ যতক্ষণ না ফেতনা-ফাসাদ নির্মূল হয়।
ধন-সম্পদ ও লোক-লশকর ছাড়া খলীফার পক্ষে বিদ্রোহী শাসকদের প্রভাব-প্রতিপত্তি নির্মূল করা সম্ভব নয়। তাই খলীফাকে অবশ্যই যুদ্ধ-বিগ্রহ ও সাজ-সরঞ্জাম সম্পর্কে পারদর্শী ও ওয়াকিফহাল হতে হবে। তেমনি তাকে যুদ্ধ ও সন্ধির রীতি-নীতিও ভালভাবে জানতে হবে। কাদের থেকে রাজস্ব আদায় করতে হবে আর কাদের ওপর জিযিয়া ধার্য করতে হবে তাও জানতে হবে।
খলীফাকে প্রথমে স্থির করতে হবে, কেন তিনি যুদ্ধে নামবেন? তিনি কি কোন প্রকার জুলুম বন্ধ করার জন্য অভিযান চালাবেন না, জালিমকে নিপাত করার জন্য যুদ্ধ করবেন? এ ক্ষেত্রে তাঁর কয়েকটি উদ্দেশ্য হতে পারে। হয় সেরূপ শাসকের দম্ভ চূর্ণ করে অনুগত রাখঅ, নয় ফাসাদ সৃষ্টিকারীদের নায়ককে নির্মূল করে অন্যান্যদের সংযত করা, কিংবা তাকে বন্দী করে শিক্ষা দেয়া, অথবা দেশ ও সম্পদ করায়ত্ত করা, কিংবা সে দেশের জনগণকে তার বিরুদ্ধে লাগিয়ে দেয়া ও তাদের সহায়তা করা।
মূলতঃ খলীফার জন্যে এর চেয়ে বেশী জড়িয়ে পড়া ঠিক নয়। কারণ, আপনজনদের বিরাট এক দলকে রণাংগনে নিঃশেষ করে সম্পদের পাহাড় জমানো খলীফার কাজ হতে পারে না। খলীফার জন্য ফরয হচ্ছে দেশবাসীর অন্তর জয় করা। প্রত্যেকটি কল্যাণের কাজ সম্পর্কে তার ধারণা থাকবে। প্রতিটি ব্যক্তির অবস্থা জেনে নিয়ে তার থেকে তার চাইতে বেশী কিছু আশা করা যাবে না। জ্ঞানী ও নেতৃত্বের অধিকারী লোকদের মর্যাদা দিতে হবে। তাদের উৎসাহ জাগিয়ে ও প্রয়োজনে ভীতি প্রদর্শন করে জিহাদের জন্যে উদ্ধুদ্ধ করতে হবে।
খলীফার প্রথম লক্ষ্য থাকবে আওতাধীন রাষ্ট্রসমূহে অনৈক্য সৃষ্টি করে তাদের বিক্ষিপ্ত করে রাখা। তাহলেই তারা দুর্বল ও সন্ত্রস্ত থাকবে। এমনকি তারা তাঁর সামনে এরূপ অসহায় হয়ে থাকবে যে, নিজে স্বাধীন ভাবে কোন ষড়যন্ত্র করার সাহস দেখাবে না। যখন তাদের এ অবস্থা দেখা দেবে তখন সহজেই তাদের সে সব ব্যবস্থা মানিয়ে নেয়া যাবে না যুদ্ধ করে মানাতে হত। এর পরেও যদি তাদের কেউ কখনো ফাসাদ সৃষ্টি করতে চায়, তা হলে তার ওপর কর ও জিযিয়ার ভারী বোঝা চাপিয়ে দিতে হবে এবং তার সমর শক্তি এরূপ দুর্বল করে দিতে হবে যাতে আর কখনও বিদ্রোহ সম্পর্কে ভাবতেও না পারে।
খলীফাকে যেহেতু বিভিন্ন মন মেজাজ ও চরিত্রের লোকেরা জিম্মাদার হতে হয়, তাই তাঁকে অবশ্যই সচেতন ও সতর্ক দৃষ্টি সম্পন্ন হতে হবে। তাঁর গোয়েন্দা বিভাগ যেসব তথ্য সংগ্রহ করবে, তার আলোকে তাকে অত্যন্ত দূরদর্শীতার সাথে কাজ চালাতে হবে। যদি জানতে পায় যে, একদল সৈন্য বিদ্রোহ করার জন্য সংঘবদ্ধ হয়েছে অমনি তার বিরুদ্ধে আরেক দল এমন সৈন্য নিয়োগ করতে হবে যারা কোন মতেই তাদের সাথে এক মত হতে পারবে না। যদি কাউকে তিনি খেলাফতের অভিলাষী বলে জানতে পান তো সংগে সংগে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে দুর্বল করে দিবেন।
খলীফার জন্য জরুরী হল জনগণকে তার অনুগামী ও মংগলকামী বানিয়ে নেয়া। এ ক্ষেত্রে শুধু তাঁকে মেনে নিচ্ছে এতটুকুতেই তৃপ্ত হলে চলবে না; বরং মেনে নেয়ার সুস্পষ্ট নজীরও পেশ করতে হবে। তাহলে তার প্রভাব জনগণের ওপর পড়বে। যেমন খলীফার জন্যে প্রকাশ্য মজলিসে দোয়া করা, বড় বড় সভা-সমিতিতে তাকে সম্মান দেখানো ও খলীফার নির্দেশ নিজেদের অন্তরে এরূপ অংকিত করে নেয়া যেভাবে একালের মুদ্রার খলীফার নাম অংকিত হয়ে থাকে। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ
সার্বজনীন মানবিক মৌলনীতি
আবাদ পৃথিবীর সকল রাষ্ট্র ও সভ্য জাতিপুঞ্জের প্রতিটি জাতিই বাবা আদম (আঃ) থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত কোন না কোনভাবে মানবিক প্রয়োজনের মৌলনীতিগুলোর মতৈক্য বজায় রেখে চলছে। যদি কেউ তার বিরোধিতা করতে চায় তো সর্বস্তরের লোক তাকে খারাপ জানে। সে নীতিগুলো এরূপ সর্বজনবিদিত ও স্বীকৃত যে, প্রকাশ্য দিবালোকের মতই তা সুস্পষ্ট। হয়ত সেগুলো শাখা-প্রশাখায় কিছুটা মতানৈক্য দেখা যায় সেটাকে আমার বক্তব্যের পরিপন্থী মনে করা যায় না।
উদাহরণ স্বরপ বলা যায়, মৃতের সৎকার নীতিতে সার্বজনীন মতৈক্য রয়েছে। তবে তার পদ্ধতিতে মতানৈক্য দেখা দেয়। কোন সম্প্রদায় তাঁকে মাটির নিচে দাফন করে, কোন সম্প্রদায় তাকে জ্বালিয়ে ভস্ম করাকেই উত্তম মনে করে। তেমনি বিয়ের ব্যাপারটি; সবাইকে জানানোর নীতিতে সবাই একমত। উদ্দেশ্য হল, বিয়ে ও ব্যভিচারের পার্থক্য সৃষ্টি করা। তথাপি তার পদ্ধতিতে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে পার্থক্য দেখা যায়। একদল সাক্ষী, ইজাব-কবুল ও ওলিমা করে তা সম্পন্ন করে, অপর দল আবার গান-বাজনা ও জাঁকজমকের পোশাক দিয়ে তা সম্পন্ন করে। ব্যভিচারী ও চোরকে শাস্তি দেয়ার নীতিতে সবাই একমত। তবে তার পদ্ধতিতে পার্থক্য দেখা যায়। এক সম্প্রদায় প্রস্তরাঘাতে মৃত্যু দণ্ড ও হাত কাটার বিধান দেয়, অন্য সম্প্রদায় কঠোর মারপিট, সশ্রম কারাদণ্ড, মোটা অংকের জরিমানা ইত্যাকার শাস্তির ব্যবস্থা করে।
আলোচ্য সর্বসম্মত মূলনীতির ব্যাপারে দু’শ্রেনীর লোকেরা মতানৈক্য ধর্তব্য নয়। কারণ, তারা সভ্য সমাজের নিম্নস্তরে থেকে জীব-জানোয়ারের আচার-আচরণ অনুসরণ করে। যেমন, মানব সমাজের বড় একটি অংশ মূর্খ ও নির্বোধ হওয়ায় তারা কোন নিয়ম-শৃঙ্খলার বাঁধনে থাকতে নারাজ! তাদের এ বাঁধনমুক্ত উচ্ছৃঙ্খল জীবনের কামনাই প্রমাণ করে যে, তারা আহাম্মক। দ্বিতীয় দল হল, পাপাচারী। তাদের জ্ঞান-বুদ্ধি লোপ করে দেয় পাপাসক্তি! তাই তাদের অন্তর থেকে যদি পাপাসক্তি বিলুপ্ত করা যায়, তাহলে তারাও সুশৃঙ্খল জীবনের পক্ষপাতী হয়ে যায়। তারা তাদের অনিয়ন্ত্রিত প্রবৃত্তির তাড়নায় অস্থির হয়ে অপরের মা-বোনদের ইজ্জত নষ্ট করে থাকে বটে, কিন্তু কেউ যদি তার মা বোনদের ইজ্জত নষ্ট করে, তাহলে ক্রোধে ফেটে পড়ে। এতে বুঝা যায়, উক্ত খারাপ কাজটি যে খারাপ সে ব্যাপারে তার অন্যান্যের মতই উপলব্ধি রয়েছে। সে এটাও বুঝে যে, এ কাজ সামাজিক জীবনকে কলুষিত করে। কিন্তু প্রবৃত্তির তাড়না তাকে ক্ষণিকের জন্য অন্ধ করে ফেলে। চুরি, আত্মসাৎ ইত্যাদির অবস্থাও তাই।
এ ক্ষেত্রে কেউ যেন ভেবে না বসে যে, এ মৌলনীতির মতৈক্যটা ঠিক পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের লোকের রুটি তৈরী করে খাওয়ার মতই একটি ব্যাপার। এরূপ ধারণা হবে এক মস্ত বড় ধোঁকা। কারণ, একটি হল প্রকৃতিগত ঐক্য, অপরটি হল বিবেকগত ঐক্য। এ দুটির ভেতরে আকাশ-পাতাল তফাত। মানবিক বিবেক, ভৌগোলিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক সব ব্যবধান ডিংগিয়ে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছাবে যে, আলোচ্য মৌলনীতিগুলো স্বভাবতই এক হবে। সে মানবিক সহজাত স্বভাব মানুষ হিসেবে মানুষের ভেতরে তা অহরহ ঘটার কারণে এবং মানবিক চরিত্র ও সুস্থ বদ্ধির প্রভাবে সৃষ্ট হয়ে থাকে।
যদি কোন লোক লোকালয় থেকে দূরে কোন জংগলেও লালিত-পালিত হয়, সে যদি লোকালয়ের লোকের অনুসৃত রীতি-নীতি সম্পর্কে কিছুই জানতে না পায়, তথাপি তার ক্ষুধা লাগবে, পিপাসা সৃষ্টি হবে, কামনা-বাসনাও দেখা দেবে। নিঃসন্দেহে তার ভেতরে নারীর প্রতি আকর্ষণ জন্ম নেবে। তারপর সেই সন্তান নিয়ে তারা পারিবারিক জীবন যাপন করবে। ফলে তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক ও আচার-আচরণ প্রকাশ পাবে। এটাই মানব সমাজ ও রাষ্ট্রের পয়লা স্তর। তারপর যখন তাদের সংখ্যা বাড়বে, তখন অবশ্যই তাদের ভেতর মেধাবী ও চরিত্রবান লোক দেখা দেবে। তখন তাদের ভেতর এমন সব কাজ-কারবার হবে, যার ফলে ধীরে ধীরে সমাজ ও রাষ্ট্রের সব স্তরের রীতি-নীতিই অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়।
অষ্টবিংশ পরিচ্ছেদ
মানব সমাজে প্রচলিত রীতি-নীতি
জেনে রেখো, মৌলনীতির সাথে সামাজিক রীতি-নীতির সম্পর্কটা জেনে রেখো, মৌলনীতির সাথে সামাজিক রীতি-নীতির সম্পর্কটা হচ্ছে অন্তর ও দেহের সম্পর্ক। সব ধর্মেরই পয়লা উদ্দেশ্য এটাই। আল্লাহর শরীয়াতের সকল আলোচ্য বিষয় ও নির্দেশাবলী সেটাই কেন্দ্র করে এসেছে।
কয়েকটি কারণে এই রীতি-নীতিগুলো জন্ম নেয়। এক, মনীষীবৃন্দের জ্ঞান-গবেষণা ও ফেরেশতা স্বভাবের আলোকে সাহায্যবদ্ধ আল্লাহদত্ত ইলহাম।
দুই, কোন বড় ধরনের রাজা-বাদশাহ কর্তৃক অনুসৃত পদ্ধতি। তিন, মানব সমাজের পছন্দনীয় মনগড়া পদ্ধতি যা কতগুলো ভ্রান্ত ধ্যান-ধারণার কারণে কঠোরভাবে অনুসৃত হয়। তারা তা অনুসরণে কল্যাণ ও বর্জনের অকল্যাণ দেখতে পায়। ফলে তাদের নেতৃস্থানীয় লোকেরাও তা বর্জন করলে নিন্দা করে থাকে।
আমি যা কিছু বললাম তার সত্যতা যে কোন জ্ঞানীলোক সহজেই মেনে নেবে যখন সে দেখতে পাবে, কোন রাষ্ট্রে হয়ত একটি রুসম রেওয়াজ বা রীতি-নীতি মূলত ভাল। কারণ, তার মাধ্যমেই ব্যক্তি জীবন ধ্যান-ধারণা ও আমলের ক্ষেত্রে পূর্ণতা লাভ করে। সামাজিক রীতি-নীতির শৃঙ্খলমুক্ত জীবন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চতুষ্পদ জীবনের পর্যায়ে নেমে যায়। অনেকেই বিয়ে-শাদী ও অন্যান্য ব্যাপারাদি সামাজিক রীতি অনুসারে যথাযথ ভাবে সম্পাদন করে থাকে। কিন্তু যখন তাদের কাজে এ সব রীতি-নীতির বাঁধন মেনে চলার কারণ জিজ্ঞেস করা হয়, তখন তারা স্বজাতির অনুকরণ করার কথা বলা ছাড়া অন্য কোন জবাব দিতে পারে না, বড় জোর সে রুসমের একটা মোটামুটি ধারণা তাদের থাকে যা তারা স্পষ্ট করে বুঝিয়ে বলতে পারে না। হয়ত তারা সেটার উপকারিতা ও গুণাবলী বলে দেবে। এ ধরনের লোক যদি উক্ত রীতি-নীতি না মানত, তাহলে তাকে পশুর পর্যায়ে মনে করা হত।
এ সব রীতি-নীতির ভেতরে কখনও খারাপ রীতিও ঢুকে পড়ে। ফলে লোকদের পক্ষে ভাল-মন্দ নির্ধারণ করা দুষ্কর হয়ে পড়ে। খারাপ রীতির কারণ এটাই যে, কখ্নও কোন খারাপ লোক নেতা হয়ে যায়, যার দৃষ্টি থাকে সীমিত ও সংকীর্ণ। তার সামনে মানব সমাজের সামগ্রিক কল্যাণের দিকটি থাকে অনুপস্থিত। ফলে সে হিংস্র পশুর আচার-আচরণ চালায়। যেমন, ডাকাতি, আত্মসাৎ ইত্যাদি। কখনও তার থেকে কামনা চরিতার্থতার কাজ প্রকাশ পায়। যেমন, ঘুষ খাওয়া, মাপে কম দেয়া ইত্যাদি। কখনও পোশাক-আশাক ও আনুষ্ঠানিক খাওয়া-দাওয়ার বাহুল্য খরচ চালু করে, যা সংগ্রহ করতে যথেষ্ট আয়োজন করতে হয়। কিংবা তার আমোদ-প্রমোদ ও বিলাস-ব্যসনের ঝোঁক বেড়ে যায়। ফলে ধনভাণ্ডার ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শূন্য ও অচল হয়ে যায়। যেমন, নাচ-গান, জুয়া-পাশা, শিকার ও প্রমোদ বিহার, পশু পাখীর রেস ইত্যাদি। তখন শুন্য ভাণ্ডার পূর্ণ করার জন্য বহিরাগতদের ওপর মোটা কর আরোপ করা হয় ও জনগণ থেকে এত বেশী রাজস্ব আদায় করা হয় যে, তারা নিঃস্ব হয়ে যায়। কিংবা তার মর্মজ্বালা ও হিংসা বেড়ে যায়, ফলে সে লোকদের সাথে এমন দুর্ব্যবহার করে চলে যা তার নিজের বেলায় সে পছন্দ করে না। অথচ তার দাপটের কারণে কেউ তাকে কিছু বলতে পারে না।
এ ধরনের নেতৃত্বের অনুসারী হয় পাপাচারী দুষ্ট চরিত্রের লোকেরা। তারা তার সহায়ক হয়ে উক্ত অনাচারগুলো সমাজে ছড়াতে থাকে। তখন সমাজে এমন জনগোষ্ঠী সৃষ্টি হয়, যাদের ভেতর না ভাল করার উৎসাহ থাকে, আর না মন্দ কাজ বর্জন করার ইচ্ছা হয়। পরবর্তীকালে নেতাদের খারাপ কাজগুলো তাদের ধাতস্থ হয় এবং তারাও তা করতে উদ্যোগী হয়। এক সময় দেখা যায়, ভাল কাজের সে সমাজে কোন পাত্তাই মেলে না। এরূপ সমাজে অবশেষে ভাল চরিত্রের অবশিষ্ট লোকগুলো অগত্যা চুপ মেরে যায়। তাদের এ চুপসে যাওয়ার সুযোগেই মন্দ রীতি-নীতিগুলো সমাজে পাকাপোক্ত ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।
তাই যথার্থ ভাল লোকদের ওপর অপরিহার্য হল সত্যের প্রচার ও প্রসার এবং অসত্যের প্রতিরোধ ও উৎখাতের জন্য আপ্রাণ অব্যাহত প্রয়াস চালানো।
অনেক ক্ষেত্রে এরূপ কাজ ঝগড়া-বিবাদ ও দাংগা লড়াই ছাড়া সম্ভব হয় না। এ কারণেই ন্যায় প্রতিষ্ঠার লড়াইকে সকল পূণ্য কাজের সেরা পূণ্য কাজ বলে গণ্য করা হয়েছে। এভাবে যখন নেক কাজের রীতি-নীতিগুলো চালু হয়ে যায়, তখন তা স্থায়ীভাবে আসন গেড়ে বসে ও যুগ যুগ ধরে লোক জীবনের বাজী ধরে সেটাকে বাঁচিয়ে রাখে। সেটা এমন ভাবে প্রত্যেকের মন-মগজে ঠাঁই নেয় যে, তা কোথাও থাক বা না থাক, যে কোন অবস্থায় সেটাকে সে অপরিহার্য রীতি হিসেবে মেনে চলে। শুধু মাত্র কলুষিত আত্মার লোকেরা, নির্বোধরা কিংবা কামনা-বাসনার দাস ও স্বার্থান্ধরা ছাড়া তার বাইরে কেউ পা রাখতে রাজী হয় না। তবে সে সব লোকজনও যখন তার বাইরে চলতে চায়, তখন অন্তত মনে তার পাপবোধ থেকেই যায়। তখন সে তার সামগ্রিক কল্যাণের পক্ষে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। তারপর সে যখন বেপরোয়াভাবে তা করে চলে, তখন বুঝতে হবে তার আত্মা রুগ্ন ও অসুস্থ হয়ে গেছে। তখন সে তার সমাজ ও রীতি-নীতির জন্য কলংক হয়ে দাঁড়ায়।
যখন কোন সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণময় রীতি-নীতি পুরোপুরি চালু হয়ে যায়, তখন উচ্চ পরিষদের ফেরেশতাগণ এর সহায়কদের জন্যে দোয়া ও বিরোধীদের জন্যে বদদোয়া করতে থাকেন। ফলে সুমহান পবিত্র সত্তা সহায়কদের প্রতি সন্তুষ্ট ও বিরোধীদের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে যায়। যখন এভাবে কোন কল্যাণময় সমাজ ও রাষ্ট্র কায়েম হয়, তখনই সেই মহান উদ্দেশ্য সাধিত হয়, যে উদ্দেশ্যে আল্লাহ পাক মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন।
ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ
মানবিক বৈশিষ্ট্য, বৈশিষ্ট্যের তাৎপর্য
জেনে রেখো, মানুষের কিছু বৈশিষ্ট্য এমন যে, তা মানুষ হিসেবে সে প্রকৃতিগত ভাবেই পেয়ে থাকে। তেমনি কিছু বৈশিষ্ট্য তার বৈষয়িক। যা তার পারিপার্শ্বিকতা ও দূরবর্তী কোন প্রভাব থেকে অর্জিত হয়। মানবিক সচ্চরিত্রতা ও বিবেক যে ব্যাপারটিকে অত্যধিক গুরুত্ব দেয় ও লক্ষ্যবস্তু হিসেবে নেয় তা হলো মানবিক পরিপূর্ণতা বা পূর্ণাঙ্গ মানবতা।
কারণ, কখনও কারও এমন কিছু নিয়ে প্রশংসা করা হয়, যা তার প্রকৃতিগত অবয়বের সাথে সংশ্লিষ্ট। যেমন, তার দৈহিক উচ্চতা কিংবা দেহের বিশালত্বের প্রশংসা। সেটাকেয দি কৃতিত্ব বলা হয়, তাহলে সে কৃতিত্বের পূর্ণতা দেখতে পাবে সুউচ্চ ও সুবিশাল পাহাড়-পর্বতে। কখনও কাউকে প্রশংসা করা হয় এমন কিছুর জন্যে যা গাছ-পালায়ও দেখতে পাওয়া যায়। যেমন, কারো দ্রুত বর্ধন ডগমগে চেহারা, সুন্দর গড়ন ইত্যাদির জন্যে। সেটাই যদি কৃতিত্ব হয়, তাহলে লালা কিংবা গোলাপফুল সে কৃতিত্বের সর্বাধিক দাবীদার। কখনও কাউকে এমন কিছুর জন্যে প্রশংসা করা হয়, যা জীব-জন্তুর ভেতরেও পাওয়া যায়। যেমন, দৈহিক শক্তি, সুউচ্চ কণ্ঠ, খাওয়া, শক্ত হাতে পাঞ্জা লড়া, জেদী ও প্রতিদ্বন্দ্বীতাপরায়ণ হওয়া ইত্যাদি। যদি সেটাকে কৃতিত্ব বলা হয় তা হলে গাধাকে সেক্ষেত্রে সর্বাধিক কৃতিত্বের দাবীদার বলতে হয়। হ্যাঁ, কখনও কাউকে এমন কিছুর জন্যে প্রশংসা করা হয়, যা শুধু মানুষের মধ্যেই পাওয়া যায়। যেমন, মার্জিত চরিত্র, উত্তম কর্মধারা, উন্নতমানের গুণাবলী, উচ্চাংগের শিল্প-নৈপুণ্য ও সুউচ্চ মর্যাদা ইত্যাদি।
মূলত এগুলোকেই বলা হয় মানবিক যোগ্যতা ও কৃতিত্ব। প্রত্যেক জাতির জ্ঞানী মনীষীগণ এগুলোকেই লক্ষ্য বানিয়ে নেন এবং এসব ছাড়া অন্য যেসব গুণের কথা বলা হয়েছে, তারা সেগুলোকে আদৌ কোন প্রশংসনীয় গুণ বলে মনে করেন না। অবশ্য এখনও বিষয়টি সুস্পষ্ট ও পরিশীলিত হয়নি। কারণ, সে গুণাবলীর মূল বস্তু প্রতিটি জীবের ভেতরই পাওয়া যায়। যেমন, বীরত্বের মূলে রয়েছে ক্রোধ সহকারে প্রতিশোধ নেয়া, প্রচণ্ড ভাবে অগ্রসর হওয়া ও বিপজ্জনক কাজে পা রাখা। অথচ এগুলো পুরুষ জীবজন্তুর ভেতরে যথেষ্ট দেখা যায়। কিন্তু সেটাকে তখনই বীরত্ব বলা হয়, যখন কোন মানুষ অত্যন্ত বিজ্ঞতার সাথে কল্যাণকর পথে সেগুলোর উপস্থাপনা, বাস্তবায়ন ঘটায়। তেমনি কলাকৌশল ও কারিগরী কাজের মূল বস্তু জীব জন্তুর ভেতরেও দেখা যায়।
বাউউ পাখী তার নিজের বাসা তৈরী করে। কোন কোন জীবতো স্বভাবগত ভাবে এমন শিল্পকর্ম দেখায় যা মানুষকে অনেক কষ্ট করেও সেরূপ করতে ব্যর্থ হতে হয়।
এ থেকে বুঝা গেল যে, সেগুলোও মানুষের মূল কৃতিত্ব বা মৌলিক গুণ নয়; বরং সেগুলোও প্রকৃতিগত কৃতিত্বের অন্তর্ভুক্ত! মানুষের মূল কৃতিত্ব বা গুণ হল তার ভেতরকার পশু প্রকৃতিতে মানব প্রকৃতির নিয়ন্ত্রণে রাখা, প্রবৃত্তির তাড়নাকে বিবেক-বুদ্ধির বশীভূত রাখা। তারই ফলে মানুষ জীব জগতে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ও কৃতিত্বের অধিকারী হয়ে থাকে।
জেনে রেখো, মানবিক মূল গুণের সাথে যেসব ব্যাপার সম্পৃক্ত তা দু’শ্রেণীতে বিভক্ত। একটি হচ্ছে মানবের জৈবিক প্রয়োজনের কাজগুলো দ্বারা আপন উদ্দেশ্য হাসিল সম্ভব হয় না; বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসবের চাকচিক্যের মোহে ডুবে আসল উদ্দেশ্য বিস্মৃত হয়। এটা যেমন আংশিক লাভেল আশায় সামগ্রিক লাভ থেকে বঞ্চিত হওয়া। এসব ক্ষুদ্র কৃতিত্ব মূল কৃতিত্বের পরিপন্থী হয়ে থাকে। যেমন, কোন লোক নিজের উত্তেজনা সৃষ্টি করে ও কুস্তী লড়ে লড়ে বীরত্ব অর্জন করতে চায়, কিংবা আরবী কবিতা ও ভাষণ মুখস্ত করে বিশুদ্ধ আরবী ভাষী হতে চায়।
মানব চরিত্রের প্রকাশ ঘটে তার স্বজাতির সাথে ঘাত-প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে। তেমনি মানুষের কর্ম কৌশল উদ্ভাবিত হয় তার প্রয়োজনাদি মেটাবার গরজে। তেমনি শিল্প কার্যের প্রয়োজনে যন্ত্রপাতি আবিস্কৃত হয়। তবে এসব কিছুই জীবন সাংগ হবার সাথে সাথেই শেষ হয়ে যায়। তাই কোন ব্যক্তি যদি এ অসম্পূর্ণ গুণ নিয়ে এমনকি তার সাথে সম্পৃক্ত অস্থায়ী ব্যাপারগুলোর প্রতি অসন্তোষ নিয়েও মারা যায়, তথাপি সে মানবিক মূল গুণ থেকে বঞ্চিত থেকেই চলে যায়।
তারপর যদি তার অসম্পূর্ণ গুণ ও কার্যাবলীর পেছনে প্রবৃত্তির তাড়না সৃষ্ট সংকীর্ণ স্বার্থান্ধতা সক্রিয় থেকে থাকে, তাহলে তো লাভের বদলে শুধুই ক্ষতি হল।
দ্বিতীয় শ্রেণী হল, সে ব্যাপারগুলো যার প্রভাবে তার ভেতরকার পশু স্বভাব ফেরেশতা স্বভাবের অনুগত হয়ে যায়, সেটার নির্দেশেই চলে আর তারই রঙে রঞ্চিত হয়। তার ফেরেশতা স্বভাবটি এরূপ শক্তিশালী হতে হবে যা বিন্দুমাত্র পশু স্বভাবের প্রভাব মেনে নেবেনা। কোনমতে সেটার হিংসার ছাপ তার ওপর পড়বে না। মোমের ওপর আংটির ছাপ যেভাবে পড়ে সে ভাবে কোন মতেই পশু স্বভাবের ছাপ ফেরেশতা স্বভাবের ওপর যেন না পড়ে, তার উপায় হল এই, যখনই আত্মিক শক্তিটির কোন কিছুর প্রয়োজন দেখা দেয় আর তা সে তার দৈহিক শক্তির নিকট কামনা করে, তখন জৈবিক শক্তির কাজ হবে সে নির্দেশ পালন করা এবং কোন মনে তা অমান্য না করা। এভাবে আত্মিক শক্তির প্রতিটি নির্দেশ যদি জৈবিক শক্তি পালন করতে থাকে, তাহলে সে স্বভাবতই সেগুলোয় অভ্যস্ত হয়ে যাবে। ফলে সে নিজেই সেগুলোর আকাঙ্ক্ষা হয়ে যাবে। পক্ষান্তরে যে কাজগুলো ফেরেশতা স্বভাব কামনা করে তার পশু স্বভাব তা বাধ্য হয়ে মেনে নেয়, তখন স্বভাতই প্রথমটি সন্তুষ্ট এবং দ্বিতীয়টি অসন্তুষ্ট হয়। এ ব্যাপারটি যে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব মেনে চলে বহিঃশক্তির গতিবিধির প্রতি লক্ষ্য করা। এটাও ফেরেশতা স্বভাত বা বিবেকেরই বৈশিষ্ট্য, পশু স্বভাব বা প্রবৃত্তি এ বৈশিষ্ট্য থেকে অনেক দূরে অবস্থিত।
যখন এ অবস্থা দাঁড়াবে যে, পশু প্রবৃত্তি তার বাসনা-কামনা, স্বাদ-আহলাদ ও আসক্তি-আকর্ষণ বর্জন করবে, তখন তার নাম দেয়া হবে ইবাদাত ও বিয়াযাত বা উপাসনা ও সাধনা। এটাই মানুষের সেই মূল চরিত্র অর্জনের মাধ্যমে হয় যা তার ভেতরে অনুপস্থিত। এ মাকাম বা পর্যায়ের তাৎপর্য এই দাঁড়াল, মানবের সত্যিকারের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ইবাদত ছাড়া অর্জিত হয় না।
এ কারণেই ব্যক্তি মানবের সামগ্রিক কল্যাণের ব্যাপারে মানবিক সত্তার মৌল আলোক বর্তিকা ডাক দিয়ে বলে ও কঠোরভাবে নির্দেশ দেয় যে, ব্যক্তি মানুষের দ্বিতীয় পর্যায়ের পূর্ণতার জন্যে প্রয়োজন মোতাবেক নির্ধারিত গুণের পরিমার্জন ও উন্নয়ন চাই। সে জন্যে স্বীয় প্রকৃতিকে পরিশোধিত ও সুসজ্জিত করে নিজেকে উচ্চ পরিষদের সদস্যদের পর্যায়ে উন্নীত করাকে জীবনের মূল লক্ষ্য ও সাধনা বলে স্থির করতে হবে। এমন কি নিজের ভেতরে এরূপ যোগ্যতা সৃষ্টি করতে হবে যার ফলে জৈবিক ও আত্মিক উভয় শক্তির ভারসাম্যের প্রভাব সে বিমণ্ডিত হতে পারে। সে ক্ষেত্রে জৈবিক শক্তি আত্মিক শক্তির নির্দেশে পরিচালিত হবে এবং সে ফেরেশতা স্বভাতের মূর্তরূপ ধরে প্রতিভাত হবে। কোন মানুষ যখন সুস্থ মানসিকতার অধিকারী হয়, আরতার অস্তিত্ব যখন মানবিক বিধি-বিধান পুরোপুরি ধারণের যোগ্য হয়ে যায়, তখন সে উক্ত দুর্লভ গুণ বা বৈশিষ্ট্যের জন্য উদগ্রীব হয়। লোহকে যেভাবে চুম্বক টেনে নিয়ে যায়, ঠিক তেমনি তখন সেই ব্যক্তি সত্তাকে উক্ত গুণটি টেনে নেয়। এটা একটা প্রকৃতিগত অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার। আল্লাহ পাক এ স্বভাব দিয়েই মানুষ সৃষ্টি করেছেন।
তাই দেখা যায়, যখন কোন জাতি উক্তরূপ ভারসাম্যপূর্ণ স্বভাব আয়ত্ত করে ফেলে, তখন তাদের ভেতর এরূপ মনীষী অবশ্যই দেখা দেয় যিনি তাদের সেই প্রশংসনীয় চরিত্রকে পূর্ণথায় পৌঁছে দিতে যত্নবান হন। মূলত সেটাকেই তখন তারা সর্বোচ্চ সৌভাগ্য বলে ভেবে থাকে। রাষ্ট্রনায়ক ও প্রশাসনের দৃষ্টি সে দিকেই থাকে। জনগণও তাদের প্রভাবে অনুরূপ গড়ে উঠে। সমগ্র দুনিয়ায় তারা মানবতার অত্যুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে বিরাজ করে। সে দেশে সরকার ও জনতা তখন ফেরেশতাদের দলে শামিল হয়ে যায়। সে দেশের মানুষ ও পুণ্যময় অনুশাসনের বরকতে ধন্য হয়ে চলে। দেশে দেশে তাদের স্বাগত সম্ভাষণ শুরু হয়ে যায়। একমাত্র মানবতার সহজাত মানসিক বিধি-বিধান ছাড়া আরব-আজম, সাদা-কালো, ধার্মিক-অধার্মিক, কাছের-দূরের, উঁচু-নীচু সর্বস্তরের সকল দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার আর কোন বিধি-বিধান রয়েছে কী? নেই, তা থাকতেও পারে না। এক মাত্র মানবিক মৌলিক গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্যের ওপরেই দুনিয়ার সকল মানুষকে একমত করা যেতো, কারণ, তুমি দেখতে পেলে যে প্রতিটি মানুষের ভেতর ফেরেশতা স্বভাবের বিবেক বিদ্যমান। তাদের মর্যাদা যে কত বড় আর তাদের ভেতরকার উত্তম চরিত্রের লোকদের আসন যে কত ঊর্ধ্বে তাও তুমি দেখতে পেয়েছ। আল্লাহই সর্বশক্তিমান।