বাদীউয্ যামান সাঈদ নুরসী (রহ)
সুফী মিরযা আফিন্দীর পরিবার
তুর্কীর বিত্লিস অঞ্চলের ছোট্ট একটি গ্রামের নাম নুরস। এই গ্রামের একটি কুর্দ পরিবারের প্রধান ছিলেন মিরযা আফিন্দী। তিনি একজন নিষ্ঠাবান মুসলিম ছিলেন। খুবই পরিচ্ছন্ন ছিলো তাঁর জীবনধারা। লোকেরা তাঁর নাম দিয়েছিলো সুফী মিরযা। তাঁর স্ত্রীও ছিলেন একজন নেক মহিলা। এই মহিলার নাম ছিলো নুরিয়া হানিম।
এই দম্পতির ছিলো সাত সন্তানঃ দুররিয়া, হানিম, আবদুল্লাহ, সাঈদ, মাহমুদ, আবদুল মাজীদ ও মারজান। সকলেই ছিলেন সুসন্তান। তবে ইসলামী জাগরণের ইতিহাসে সাঈদ অনেকটুকু স্থান দখল করে রয়েছেন।
সাঈদ নুরসী
খৃস্টীয় ১৮৭৭ সনে সাঈদ জন্মগ্রহণ করেন। নুরস গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলে তিনি সাঈদ নুরসী নামে পরিচিত হন। পরবর্তীকালে তাঁর অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় পেয়ে মোল্লা ফাত্হুল্লাহ আফিন্দী নামক একজন বিশিষ্ট ইসলামী ব্যক্তিত্ব তাঁকে ‘বাদীউয্যামান’ আখ্যা দেন। তখন থেকে তিনি বাদীউয্যামান সাঈদ নুরসী নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেন।
সাঈদ নুরসীর শিক্ষা জীবন
নয় বছর বয়সে তাঁর শিক্ষা জীবন শুরু হয়। তাঁর প্রথম শিক্ষালয়ের নাম মোল্লা আমীন আফিন্দী মাদ্রাসা। পরবর্তীকালে মীর হাসান ওয়ালী মাদ্রাসা, বায়েজিদ মাদ্রাসাসহ বেশ কয়েকটি শিক্ষালয়ে তিনি শিক্ষা গ্রহণ করেন।
সাঈদ নুরসী একজন মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিলো খুবই প্রখর। যেই কোন বিষয় তিনি অতি সহজে আয়ত্ব করতে পারতেন। তাঁর উপস্থিত বুদ্ধিও ছিলো প্রশংসনীয়। তাঁর যুক্তিপূর্ণ কথা শুনে লোকেরা অবাক হয়ে যেতো। উল্লেখ্য যে শরীর চর্চাতেও তিনি পারদর্শী ছিলেন।
সাঈদ নুরসী ছিলেন একজন সাহসী মানুষ। আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে তিনি ভয় কতেন না। তবে তিনি কখনো অবিজ্ঞজনোচিত কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন নি।
জিযর সফর
সাঈদ নুরসী তখন একজন উদীয়মান যুবক। এক রাতে স্বপ্নে দেখেন যে আল্লাহর এক নেক বান্দা তাঁর কাছে এসেছেন ও তাঁকে জিযর অঞ্চলের মিরান গোত্রের যালিম সরদার মুসতাফা পাশার কাছে গিয়ে তাঁকে ইসলামের পথে আসা এবং যুল্মের পথ পরিহার করার আহ্বান জানাতে বলছেন। ঘুম থেকে জেগে সাঈদ সুরসী আমর বিল মা’রূফ ওয়া নাহি আনিল মুনকার-র কাজ শুরু করার সিদ্ধান্ত নেন। মিরান গোত্র ছিল একটি শক্তিশালী গোত্র। এই গোত্রের লোকসংখ্যা ছিলো অনেক। গোত্রের সরদার মুসতাফা পাশা দুর্ধর্ষ প্রকৃতির লোক ছিলেন। তিনি এলাকাতে লুণ্ঠন ও অত্যাচার চালাতেন। তুর্কীর সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামীদ রুশদের হামলা ঠেকাবার জন্য যেই অশ্বারোহী বাহিনী গঠন করেন তিনি ছিলেন সেই বাহিনীর একজন কমাণ্ডার।
সফরের প্রস্তুতি নিয়ে সাঈদ নুরসী বের হন। যথাসময়ে তিনি জিযর এসে পৌঁছেন। তিনি সরাসরি মুসতাফা পাশার শিবিরে চলে যান। মুসতাফা পাশা তখন অন্যত্র ছিলেন। সাঈদ নুরসী একটি তাঁবুতে বিশ্রাম নিতে থাকেন। কিছুক্ষণ পর সরদার শিবিরে এসে একজন আগন্তুকের খবর পান ও তাঁর তাঁবুতে আসেন। তিনি সাঈদ নুরসীর পরিচয় ও আগমণের উদ্দেশ্য জানতে চান। পরিচয় প্রদানের পর নির্ভীক সাঈদ বলেন, ‘‘আমি আপনাকে সঠিক পথ দেখাবার জন্য এসেছি। আপনি যুল্ম-অত্যাচার ত্যাগ করুন। আল্লাহর নির্ধারিত ফারযগুলো প্রতিপালন করতে শুরু করুন।’’
সরদার মুসতাফা পাশা তরুণ সাঈদ নুরসীর নির্ভীকতা দেখে বিস্মিত হন। তবে ভেতরে ভেতরে তিনি একটি ফন্দি আঁটেন। তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে জিযরের আলিমদের সাথে সাঈদের একটি বাহাসের ব্যবস্থা করতে হবে, বাহাসে পরাজিত হলে এই তরুণ ব্যক্তিটি কেটে পড়বে।
চরণভূমি থেকে ঘোড়ার চড়ে তাঁরা তাইগ্রীস নদীর তীরবর্তী বানীহান নামক স্থানে পৌঁছেন। সাঈদ নুরসীর বিশ্রামের ব্যবস্থা করা হয়। তিনি যখন ঘুম থেকে উঠেন দেখেন একদল আলিম বই-কিতাব হাতে নিয়ে অপেক্ষা করছেন। আলিমগণ সাঈদ নুরসীকে জিজ্ঞেস করার জন্য চল্লিশটি প্রশ্ন তৈরী করেন। প্রশ্নগুলো উত্থাপিত হলে তরুণ সাঈদ সন্তোষজনক জবাব দিয়ে সকলকে মুগ্ধ করেন।
সাঈদের প্রতি মুসতাফা পাশার রাগ আর থাকলো না। তিনি সাঈদকে একটি রাইফেল উপহার দেন।
মুসতাফা পাশা ছালাত আদায় করা শুরু করেন। বদভ্যাসগুলো ত্যাগ করতে থাকেন।
কিছুদিন জিযরে অবস্থান করার পর সাঈদ নুরসী তাঁর এক ছাত্রকে নিয়ে মরু অঞ্চলের দিকে চলে যান। ওখানে যাবার পর তিনি খবর পান যে সরদার মুসতাফা পাশা আবার তাঁর খারাপ অভ্যাসে ফিরে গেছেন। সাঈদ নুরসী পাশাকে শুধরাবার জন্য দ্বিতীয় বার জিযরে আসেন। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও পাশাকে আর সৎ পথে আনা সম্ভব হয়নি। সাঈদ নুরসী আবারো ফিরে যান মরু অঞ্চলে।
মারদিন সফর
কিছুকাল পর সাঈদ নুরসী মারদিন পৌঁছেন। এখানে তিনি শায়খ আইউব আনসারীর মেহমান হিসেবে অবস্থান করতে থাকেন। একটি মাসজিদে তিনি দারস দেয়া শুরু করেন। লোকেরা তাঁকে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করতো। তিনি জ্ঞানগর্ভ জবাব দিতেন। মারদিনে অবস্থানকালে সাঈদ নুরসী ‘ইয়াং তুর্কস’ আন্দোলনের অন্যতম নেতা নামিকজ কামালের তাত্ত্বিক লেখার সাথে পরিচিত হন। মানুষের অধিকার, মুক্তি ও স্বাধীনতার পক্ষে লেখা নামিক কামালের পুস্তিকাগুলো স্বাধীনচেতা সাঈদ নুরসীর মনে আলোড়ন সৃষ্টি করে। তিনি অনুভব করেন যে এই আন্দোলনের শক্তি বৃদ্ধি হওয়া প্রয়োজন। তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৮৯২ সনে তিনি রাজনৈতিক বক্তব্য রাখা শুরু করেন।
মারদিন থেকে বহিষ্কার
তাঁর তৎপরতার কথা গেলো মারদিনের গভর্ণর নাদির বে-র কনে। তিনি সাঈদ নুরসীকে গ্রেফতার করেন। তাঁর হাতে-পায়ে বেড়ি লাগানো হয়। তাঁকে মারদিন থেকে বহিষ্কার করা হয়। পুলিশ প্রহরায় তাঁকে পাঠিয়ে দেয়া হয় বিতলিস।
বিতলিসের গভর্ণরের সাথে সুসম্পর্ক
বিত্লিসের গভর্ণর উমার পাশার সাথে সাঈদ নুরসীর আলাপ হয়। উমার পাশা সাঈদ নুরসীর জ্ঞানের গভীরতার পরিচয় পেয়ে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে পড়েন এবং সাঈদ নুরসীকে তাঁর বাড়িতেই রাখার ব্যবস্থা করেন। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের আসা-যাওয়া হতো এই বাড়িতে।
সাঈদ নুরসী আলাপচারিতার ভেতর দিয়ে তাঁদের নিকট ইসলামের আলো ছড়াতে থাকেন।
একদিন তিনি খবর পান যে গভর্ণর উমার পাশা ও আরো কিছু সরকারী কর্মকর্তা একটি মদের আসর বসিয়েছেন। সাঈদ নুরসী সোজাসুজি সেখানে চলে যান। তিনি মদ সম্পর্কে আল কুরআন ও আল হাদীসের বিধানগুলো শুনিয়ে দিয়ে তাঁদেরকে এই হারাম কাজ থেকে বিরত থাকার উপদেশ দেন। এরপর তিনি সেখান থেকে চলে আসেন।
গভর্ণর উমার পাশা এই বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে খুবই রেখে যান। কিন্তু গভীরভাবে চিন্তা করে দেখলেন যে সাঈদই তো ঠিক।
তিনি সাঈদকে নিয়ে আসার জন্য দুইজন পুলিশম্যান পাঠান। সাঈদ নুরসী তাদের সাথে গভর্ণরের ঘরে প্রবেশ করেন। তিনি দুর্ব্যবহারের আশংকা করছিলেন। কিন্তু তিনি ঘরে প্রবেশ করার সাথে সাথে গভর্ণর উমার পাশা দাঁড়িয়ে তাঁকে খোশ আমদেদ জানান ও বলেন, ‘‘প্রত্যেক ব্যক্তিরই কোন না কোন আধ্যাত্মিক পথ প্রদর্শক থাকে। আপনি আমার আধ্যাত্মিক পথ প্রদর্শক। আপনি আমার সাথেই থাকবেন।’’
উমার পাশার বাড়িতে অবস্থানকালে সাঈদ নুরসী ব্যক্তিগত পড়াশুনায় গভীর মনোযোগ দেন। তিনি ব্যাপকভাবে আত্ তাফসীর, আল হাদীস ও আল ফিক্হ অধ্যয়ন করতে থাকেন। তিনি সিদ্ধান্ত নেন আল কুরআন হিফয্ করবেন। পুরো আল কুরআন হিফয করা সম্ভব হয়নি। তবে অধিকাংশ তিনি হিফয করতে সক্ষম হন। প্রাচ্যবিদেরা ইসলামী জীবন বিধান সম্পর্কে বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য যেই সব লেখালেখি করেছে সেইগুলো তিনি ভালোভাবে পড়েন এবং আল কুরআন ও আল হাদীসের জ্ঞানানুশীলনের মাধ্যমে সেইগুলোর জবাবও তিনি জেনে নেন।
ওয়ান (Van) আগমণ ও অবস্থান
ইসলামী জ্ঞান জগতের একজন উদীয়মান তারকা হিসেবে সাঈদ নুরসীর খ্যাতি বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে। ওয়ান প্রদেশের গভর্ণর হাসান পাশা তাঁকে তাঁর কাছে যাবার জন্য আমন্ত্রণ জানান। সাঈদ নুরসী ওয়ান পৌঁছে হাসান পাশার মেহমান হন। তিনি যুগপৎভাবে জ্ঞান আহরণ ও জ্ঞান বিতরণের কাজ করতে থাকেন।
কিছুকাল পর ওয়ানের গভর্ণর হয়ে আসেন তাহির পাশা। তিনি একজন বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর একটি সমৃদ্ধ লাইব্রেরী ছিলো। তিনি সাঈদ নুরসীর জন্য তাঁর লাইব্রেরী উন্মুক্ত করে দেন।
দূরদর্শী সাঈদ নুরসী উপলব্ধি করেন যে বর্তমানে প্রচলিত বিদ্যার সাথে নতুন বৈজ্ঞানিক জ্ঞানও হাছিল করা প্রয়োজন। সেই জন্য তিনি নিজেই ভূগোল, দর্শন ও ইতিহাস ব্যাপকভাবে অধ্যয়ন করেন। এই ক্ষেত্রে তিনি নিজেই ছিলেন নিজের শিক্ষক।
ওয়ান শহরে তিনি হরহর মাদ্রাসা নামে একটি শিক্ষালয় স্থাপন করেন। এই মাদ্রাসা তিনি নিজেই পরিচালনা করতেন।
বাস্তবে শিক্ষাদান করতে গিয়ে তিনি উপলব্ধি করেন যে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থা পুনর্গঠন একান্ত প্রয়োজন। এই উপলব্ধিই তাঁকে তুলনামূলকভাবে অনুন্নত পূর্ব আনাতোলিয়ায় ‘মাদ্রাসাতুয্ যাহরা’ নামে একটি মডেল ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ নিতে উদ্বুদ্ধ করে। তাঁর পরিকল্পনা ছিলো, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি শিক্ষার্থীদেরকে ইসলামী জীবন দর্শন ও আধুনিক প্রযুক্তিতে পারদর্শী করে তুলবেন। মাদ্রাসাতুয্ যাহরার পরিকল্পনা নিয়ে তিনি রাজধানী কনস্ট্যান্টিনোপল যান। কিন্তু সুলতানের কাছে তা পেশ করার সুযোগ না পেয়ে ওয়ান ফিরে আসেন।
আল কুরআনের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের সংকল্প
একদিন গভর্ণর তাহির পাশা পত্রিকায় প্রকাশিত একটি রিপোর্টের দিকে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এইটি ছিলো বৃটিশ পার্লামেন্টে সেক্রেটারী ফর কলোনীজ মিঃ গ্ল্যাডস্টোনের ভাষণ সংক্রান্ত রিপোর্ট। এই ভাষণে তিনি বলেছিলেন,
‘So long as the Muslims have the Quran, we shall be unable to dominate them. We must either take it from them, or make them lose their love of it.’
অর্থাৎ ‘যতদিন মুসলিমদের হাতে আল কুরআন থাকবে আমরা তাদেরকে বশ করতে পাবো না। হয় আমাদেরকে তাদের কাছ থেকে ঐটি নিয়ে নিতে হবে অথবা তারা যেন এর প্রতি ভালোবাসা হারিয়ে ফেলে তার ব্যবস্থা করতে হবে।’
এই ভাষয়ে আল কুরআনের প্রতি বৃটিশ সরকারের দৃষ্টিভংগি সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয় এবং মুসলিমদের প্রতি অনুসৃতব্য পলিসির আভাস পাওয়া যায়।
মিঃ গ্ল্যাডস্টোনের এই বক্তব্য সাঈদ নারসীর মনে দারুণ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। তিনি বলেন, ‘‘I shall prove and demonstrate to the world that the Quran is an undying, inextinguishable Sun.’’
অর্থাৎ ‘আমি প্রমাণ করবো ও দুনিয়াকে দেখাবো যে আল কুরআন মৃত্যুহীন, এবং নিভিয়ে ফেলা যায় না এমন এক সূর্য।’’
তাঁর এই লক্ষ্য হাছিলের জন্য তিনি দুইটি পথ অবলম্বনের চিন্তা করেন। একটি ছিলো মাদ্রাসাতুয যাহরা স্থাপনের প্রয়াস, অন্যটি রিসালা-ই-নূর নামক পুস্তিকা সিরিজ রচনা করে আল কুরআনের জীবন দর্শন ও জীবন বিধান সম্পর্কে লোকদেরকে সজাগ করে তোলা।
সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামীদের মুখোমুখি
সাঈদ নুরসী আবার উনিশ শত আট সনে কনস্ট্যান্টিনোপাল আসেন। এবার তিনি সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামীদের সাক্ষাৎ পান। তিনি সুলতানকে মাদ্রাসাতুয যাহরার পরিকল্পনা সম্পর্কে অবহিত করেন। তাছাড়া সাক্ষাতের এই সুযোগে তিনি সুলতানের ব্যর্থতার কিছু দিক সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেন। সুলতান ও তাঁর সহকারীগণ আর কোনদিন এমন প্রত্যক্ষ সমালোচনার সম্মুখীন হননি। ফলে ইলদিজ প্রাসাদের মেহমান কোর্ট মার্শালের সম্মুখীন হন।
বিচারক তাঁকে নিয়ে বিপাকে পড়েন। অবশেষে কয়েকজন ডাক্তারের কাছ থেকে সাঈদ নুরসী মানসিকভাবে সুস্থ নন-এই সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে তার ভিত্তিতে তাঁকে একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য তোপতাসি মেন্টাল হসপিটালে পাঠিয়ে দেন।
স্যালোনিকায় আগমণ
তোপতাসি মেন্টাল হাসপাতাল থেকে রিলিজ হওয়ার পর তাঁর শুভাকাংখীগণ তাঁকে স্যালোনিকা নিয়ে আসেন। ‘কমিটি অব ইউনিয়ান এণ্ড প্রগ্রেস’- এর অন্যতম নেতা রফিক বে-র বাড়িতে তিনি মেহমান হিসেবে অবস্থান করতে থাকেন। কমিটি অব ইউনিয়ান এণ্ড প্রগ্রেসে এমন সদস্যও ছিলেন যাঁরা ইসলামের প্রতি ইতিবাচক মনোভংগি পোষণ করতেন। আবার এমন সদস্যও ছিলেন যাঁরা ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করতেন। সাঈদ নুরসী তাদেরকে বুঝাবার চেষ্টা করতেন যে তুর্কীর সংহতি, অগ্রগতি ও গণ মানুষের স্বাধীনতা ইউরোপীয় নয়, ইসলামী বিধানের অনুসরণের মাঝে নিহিত। স্যালোনিকার লোকেরাও সাঈদ নুরসীর জ্ঞানের গভীরতা টের পায়। এই সুযোগ্য ব্যক্তিটিকে নিজের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজে লাগাবার অভিপ্রায় নিয়ে ইয়াহুদী নেতা ইমানুয়েল কারাসো সাঈদ নুরসীর সংগে দেখা করতে আসেন। দীর্ঘ সময় ধরে আলাপ চলতে থাকে। ইয়াহুদী নেতা হঠাৎ আলোচনা বন্ধ করে ওঠে পড়েন। বাইরে এসে তিনি সংগীদেরকে বলেন, ‘‘আমি যদি আরো কিছুক্ষণ আলোচনা চালাতাম, তাহলে ও আমাকে মুসলিম বানিয়ে ছাড়তো।’’
‘ইয়াং তুর্কস ও ‘কমিটি অব ইউনিয়ান এন্ড প্রগ্রেস’
মুহাম্মাদ বে ও নামিক কামালের নেতৃত্বে শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের দাবিকে ইয়াং তুর্কস নামে একটি সংগঠন গড়ে উঠে। সুলতান আবদুল আযীয এই সংগঠনের প্রতি দমননীতি অবলম্বন করেন। পরবর্তী সুলতান পঞ্চম মুরাদও এই সংগঠনটিকে সুনজরে দেখতেন না। ফলে উভয় সুলতানের শাসনকালে তুর্কীর বাইরে অবস্থান করে এই সংস্থার নেতৃবৃন্দ তৎপরতা চালাতে থাকেন। পরবর্তী সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামীদ তাঁদের প্রতি নমনীয় মনোভাব দেখান। ফলে তাঁরা বিদেশ থেকে কনস্ট্যান্টিনোপল ফিরে আসেন।
ইয়াং তুর্কস রাজধানীর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রভাবশালী ব্যক্তির সমর্থন হাছিল করতে সক্ষম হয়। সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামীদ ইয়াং তুর্কসের নেতা মিদহাত পাশাকে উযীরে আযম নিযুক্ত করেন। খৃস্টীয় ১৮৭৬ সনে সুলতান ফরমানের মাধ্যমে তুর্কীর জন্য একটি সংবিধান ঘোষণা করেন। কিছুকাল পর সুলতানের সাথে মিদহাত পাশার সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায়। সুলতান তাঁকে উযীর আযম পদ থেকে বরখাস্ত করেন। সংবিধান মূলতবী ঘোষণা করা হয়। ইয়াং তুর্কস এর নেতৃবৃন্দ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গিয়ে নিজেদের অনুকূলে জনমত গঠনের জন্য গোপনে কাজ করতে থাকেন।
১৯০৬ সনে স্যালোনিকাতে আনোয়ার পাশার নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘কমিটি অব ইউনিয়ান এণ্ড প্রগ্রেস’। তাঁর প্রধান সহযোগী ছিলেন তালাত পাশা ও জামাল পাশা। পরবর্তীতে এই কমিটি ইয়াং তুর্কসের সাথে মিলিত হয়ে কাজ করতে থাকে।
তুর্কীকে ইউরোপীয় ধাঁচে গঠন, শাসনতান্ত্রিক সংস্কার, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, মানবাধিকার ঘোষণা, প্রগতিশীল রাষ্ট্রগুলোর সাথে সহযোগিতা ইত্যাদি ছিলো কমিটি অব ইউনিয়ান এণ্ড প্রগ্রেস এর কর্মসূচী।
কমিটি অব ইউনিয়ান এণ্ড প্রগ্রেস–এর প্রথম সরকার
১৯০৮ সনে কমিটি অব ইউনিয়ান এণ্ড প্রগ্রেস এর পক্ষ থেকে আনোয়ার পাশা মেসিডোনিয়াতে তুর্কীর জন্য একটি সংবিধান ঘোষণা করেন। সেনাবাহিনীর বিরাট অংশ আনোয়ার পাশার প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে। সুলতান আবদুল হামীদ কমিটি অব ইউনিয়ন এণ্ড প্রগ্রেস এর সাথে সমঝোতা করতে বাধ্য হন।
তিনি উক্ত সংবিধান অনুমোদন করেন। তিনি হন রাষ্ট্রের সাংবিধানিক প্রধান। কমিটির মনোনীত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত হয় উযীর পরিষদ।
বহু সংখ্যক ইসলামী ব্যক্তিত্ব কমিটি অব ইউনিয়ান এণ্ড প্রগ্রেস এর সরকার মেনে নিতে পারেননি। এই সরকারের কার্যক্রমের মাঝে তাঁরা ইসলামের পতন দেখতে পান।
এই সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও তুর্কীর দুরবস্থা অব্যাহত থাকে। রণাংগনে সৈন্য বাহিনী পরাজিত হতে থাকে। এতে লোকেরা নাখোশ হয়।
কমিটির সমর্থিত পত্রিকাগুলো সুলতানকে আক্রমণ করে লেখালেখি করতে থাকে। এতে বহু লোক মানসিকভাবে আহত হয়।
সুলতানের বিশ্বস্ত কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ লোক এই সময় আততায়ীর হাতে প্রাণ হারান।
কমিটি সরকার পুরাতন অফিসারদেরকে সরিয়ে শূণ্য পদে তাদের পছন্দসহ ব্যক্তিদেরকে বসাতে থাকে।
সেনাবাহিনীতেও একই পলিসি অনুসরণ করা হয়। প্রায় আট হাজার সামরিক অফিসার তাঁদের পদ হারান।
নতুন অফিসারগণ সাধারণ সৈন্যদের ইসলামপ্রীতি নিয়ে হাসাহাসি করতো। দীনী কাজকর্মে বাধা দিতো। ফলে সৈনিকদের মধ্যেও অসন্তোষ সৃষ্টি হয়।
কমিটি অব ইউনিয়ান এণ্ড প্রগ্রেস এর দ্বিতীয় সরকার
১৯০৯ সনের এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে কনস্ট্যান্টিনোপলের সৈন্যরা অফিসারদেরকে তাঁদের ঘরে তালাবদ্ধ করে ক্যান্টনমেন্টের নিয়ন্ত্রণ হাতে তুলে নেয়। তারা পার্লামেন্ট ভবনও দখল করে। আয়া সোফিয়া মাসজিদে সমাবেশ করে। তারা শরীয়াহর পক্ষে শ্লোগান দেয়। অবস্থা বেগতিক দেখে কমিটি অব ইউনিয়ান এণ্ড প্রগ্রেস সরকার পদত্যাগ করে। কমিটির নেতৃবৃন্দ পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করেন।
স্যালোনিকা ছিলো কমিটি অব ইউনিয়ান এণ্ড প্রগ্রেস এর সবচে বেশি মজবুত ঘাঁটি। মাহমুদ শাওকাত পাশার নেতৃত্বে একদল সৈন্য রাজধানী অভিমুখে রওয়ানা হয়। ২৪শে এপ্রিল তারা কনস্ট্যান্টিনোপল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনে। সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামীদকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। নতুন সুলতান বানানো হয় মাহমুদ রাশাদ বা পঞ্চম মুহাম্মাদকে। ১৯১৮ সনে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সুলতান ছিলেন। আবার কমিটি সরকার কায়েম হয়। মার্শাল ল জারি করা হয়। অন্য সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হয়। ইত্তিহাদ-ই-মুহাম্মাদী জামিয়াতি নামক সংস্থাটিও নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়।
কমিটি সরকার ও ইত্তিহাদ–ই–মুহাম্মাদী জামিয়াতী
১৯০৯ সনের গোড়ার দিকে হাফিয দারবিশ ওয়াহদাতি বে-র নেতৃত্বে ইত্তিহাদ-ই-মুহাম্মাদী জামিয়াতী নামে একটি সংগঠন কায়েম হয়। আয়া সোফিয়া মাসজিদে একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে যাত্রা শুরু হয় এই সংগঠনের। সেই অনুষ্ঠানে সাঈদ নুরসী দুই ঘন্টা বক্তৃতা করেন।
কনস্ট্যান্টিনোপলের সেনা বিদ্রোহ দমন করার পর শত শত লোক গ্রেফতার করা হয়। কমিটি অব ইউনিয়ান এণ্ড প্রগ্রেস এর বিশ্বাস ছিলো যে ইত্তিহাদ-ই-মুহাম্মাদী জামিয়াতীর উসকানিতেই এই বিদ্রোহ ঘটে। আর যেহেতু সাঈদ নুরসী এই জামিয়াতীর সাথে জড়িত, সেহেতু তিনিও অপরাধী। এই অজুহাতে সরকার সাঈদ নুরসীকে গ্রেফতার করে।
কোর্ট মার্শালে বিচার হয় ইত্তিহাদ-ই-মুহাম্মাদী জামিয়াতীর নেতৃবৃন্দের। খৃস্টীয় ১৯০৯ সনের উনিশে জুলাই একটি কালো দিন। ঐদিন হাফিয দারবিশ ওয়াহদাতি বে ও আরো বারো জনকে ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলানো হয়। শেষাবধি এই সংগঠনের দুইশত সাইত্রিশ জন ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।
কোর্ট মার্শালে সাঈদ নুরসীর বিচার
বন্দী সাঈদ নুরসীকে বায়েজিদ নামক স্থানে কোর্ট মার্শালে উপস্থিত করা হয়। যেই কক্ষে তাঁর বিচার হচ্ছিলো সেই কক্ষের জানালা দিয়ে পনরজনের ঝুলন্ত লাশ দেখা যাচ্ছিলো।
কোর্ট মার্শালের প্রিজাইডিং অফিসার সাঈদ নুরসীকে বলেন, ‘‘আপনি শারীআহ চাচ্ছেন? যারা শারীয়াহ চায় তারা বাইরে ঝুলে থাকা ঐ লোকগুলোর মতো ফাঁসিতে ঝুলে।’’
বাদীউয্যামান সাঈদ নুসরীর নির্ভীকতা ছিলো বিস্ময়কর। এই নাজুক পরিস্থিতিতেও ইসলাম বিদ্বেষী সামরিক অফিসারকে সম্বোধন করে তিনি বললেবন, ‘‘আমার যদি এক হাজার জীবন থাকতো, আমি শারীয়ার এক একটি অংশের জন্য আমার জীবনগুলো কুরবান করে দিতাম। কারণ শারীয়াহ-ই হচ্ছে সমৃদ্ধি, কল্যাণ, সুবিচার ও সততার পথ।’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘বীর ব্যক্তিরা অপরাধ করে না। যদি তারা অভিযুক্ত হয় তারা শাস্তিকে ভয় পায় না। আমি যদি অন্যায়ভাবে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হই আমি দুইজন শহীদের পুরস্কার পাবো। আমি যদি জেলখানায় থাকি তবে সম্ভবত জেলখানাই হচ্ছে স্বৈরাচারী সরকারের অধীনে সবচে’ বেশি আরামপ্রদ স্থান। যালিম হয়ে বাঁচার চেয়ে মাযলুম হয়ে মরা উত্তম।’’
কোর্ট মার্শাল তাঁকে মুক্তি দেয়। কোর্টের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে সাঈদ নুরসী প্রস্থান করেন।
সিরিয়া ও লেবানন সফর
১৯১০ সনে সাঈদ নুরসী সমুদ্র পথে তাঁর জন্মভূমিতে পৌঁছেন। বহু স্থানে লোকেরা তাঁকে দেখতে আসে। তিনি তাদের উদ্দেশ্যে জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য রাখেন।
১৯১১ সনে তিনি সিরিয়া সফরে আসেন। দিমাসক শহরের উমাইয়া মাসজিদে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। প্রায় দশ হাজার শ্রোতা তাঁর বক্তৃতা শোনে। সেখান থেকে তিনি বৈরুতে যান। বৈরুত থেকে যান কনস্ট্যান্টিনোপল বা ইসতামবুল।
নতুন সুলতানের কাছে মাদ্রাসাতুয্ যাহরা পরিকল্পনা উত্থাপন
তাঁর মাথায় মাদ্রাসাতুয যাহরা ঘুরপাক খাচ্ছিলো। নতুন সুলতান পঞ্চম মুহাম্মাদ বা মাহমুদ রাশাদের সাথে তিনি এই বিষয়ে আলোচনা করতে আগ্রহী ছিলেন।
সুলতান মাহমুদ রাশাদ ও কমিটি অব ইউনিয়ন এণ্ড প্রগ্রেস সরকারের কর্তা ব্যক্তিরা ইউরোপীয় প্রদেশগুলোতে সফরে যাচ্ছিলেন। তিনিও তাঁদের সাথে যুক্ত হন। তাঁরা স্কপজি ও প্রিস্টিনা হয়ে কসোভা পৌঁছেন। কসোভাতে একটি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিষয় আলোচনা হচ্ছিলো। এই সুযোগে সাঈদ নুরসী পূর্ব আনাতোলিয়াতে তাঁর পরিকল্পিত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব উত্থাপন করেন।
১৯১২ সনে বলকান যুদ্ধে তুর্কী পরাজিত হওয়ায় কসোভাতে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সম্ভাবনা রহিত হয়ে যায়।
১৯১৩ সনে সাঈদ নুরসী কসোভা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ মাদ্রাতুয্ যাহরা স্থাপনের জন্য বরাদ্দ করার আবেদন পেশ করেন। এই আবেদন গৃহীত হয়।
ওয়ান (Van) হ্রদের তীরে ভিত্তি প্রস্তরও স্থাপিত হয়। কিন্তু ১৯৪১ সনের নভেম্বর মাসে প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার তাঁর পরিকল্পিত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ভবন নির্মাণের কাজ স্থগিত হয়ে যায়।
রণাংগনে সাঈদ নুরসী
প্রথম মহাযুদ্ধে জার্মেনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে গ্রেট বৃটেন, ফ্রান্স ও রাশিয়া। তুর্কী জার্মেনীর পক্ষে যোগ দেয়। এই নাজুক সময়ে যেইসব ইসলামী চিন্তাবিদের ফতোয়া মুসলিমদেরকে জিহাদী প্রেরণায় উদ্দীপিত করে তাঁদের একজন ছিলেন বাদীউয্যামান সাঈদ নুরসী।
সাঈদ নুরসী ছিলেন একজন কর্ম-বীর। তাই ফতোয়া দিয়েই তিনি ক্ষান্ত থাকতে পারেন নি। তিনি অনুভব করলেন উম্মাহর এই সংগীন সময়ে তাঁরও হাতিয়ার নিয়ে লড়াইয়ের ময়দানের ঝাঁপিয়ে পড়া উচিত।
আনোয়ার পাশা তখন যুদ্ধ মন্ত্রী। তিনি আনোয়ার পাশার সাথে দেখা করে রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য একটি মিলিশিয়া বাহিনী গড়ে তোলার অনুমতি হাছিল করেন। বাহিনী গঠন করে তিনি রণাংগনে নেমে পড়েন। বিতলিস রণাংগনে তিনি ও তাঁর মিলিশিয়া বাহিনী বীরের মতো লড়েন। কিন্তু ১৯১৬ সনের মার্চ মাসে রাশিয়ার বিশাল সেনাবাহিনী প্রচণ্ড হামলা চালিয়ে বিত্লিস দখল করে নেয়। সাঈদ নুরসী বন্দী হন। দুই বছর তিনি কাটান বন্দীশালায়। ১৯১৮ সনে তিনি বন্দীশালা থেকে পালিয়ে ওয়ারশ ও বার্লিন হয়ে কনস্ট্যান্টিনোপল পৌঁছেন। তাঁকে বীরোচিত সম্বর্ধনা দেয়া হয়। যুদ্ধ মন্ত্রী আনোয়ার পাশা নিজে তাঁকে অন্যান্য সামরিক অফিসারের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। তাঁকে একটি ওয়ার মেডাল দেয়া হয়।
দারুল হিকমাহ ইসলামীয়া ও সাঈদ নুরসী
১৯১৮ সনে ওয়াহিদ উদ্দীন সুলতান ষষ্ঠ মুহাম্মাদ নামে মসনদে বসেন।
১৯১৮ সনের ১২ই অগাস্ট সরকার দারুল হিকমাহ ইসলামীয়া নামে একটি সংস্থা গঠন করে। মুহাম্মাদ আকিফ এই সংস্থার সেক্রেটারী নিযুক্ত হন। এই সংস্থার নয়জন সদস্যের মধ্যে সাঈদ নুরসী ছিলেন একজন।
মুসলিম জাহানের সমস্যাবলীর সমাধান চিহ্নিতকরণ, মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে পরিচালিত বুদ্ধিবৃত্তিক আক্রমণগুলোর জবাবদান, দীন ইসলামকে হেয় করার প্রচেষ্টা প্রতিহত করণ, প্রকাশ্যে ইসলামী নৈতিকতা বিরোধী কাজ হতে দেখলে যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ, প্রকাশনার মাধ্যমে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবদান, অভ্যন্তরীণ ও বহির্দেশীয় বিপদগুলো জনগণকে অবহিতকরণ এবং তাদের দীনী প্রয়োজন পূরণের লক্ষ্যে স্থাপিত হয়েছিলো দারুল হিকমাহ ইসলামীয়া। ১৯২২ সনের নভেম্বর মাসে আংকারা ভিত্তিক তুর্কীর নতুন সরকার সুলতান পদ বিলুপ্ত করে। ঐ সরকার দারুল হিকমাহ ইসলামীয়ার কার্যক্রমও বন্ধ করে দেয়। সংস্থাটি বিলুপ্ত না হওয়া পর্যন্ত চার বছর সাঈদ নুরসী এর সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন।
জামিয়াতুল মুদরারেসীন ও সাঈদ নুরসী
১৯১৯ সনের জামিয়াতুল মাদরারেসীন নামে একটি সংগঠন গঠিত হয়। শিক্ষকতা পেশার মানোন্নয়ন, শিক্ষকদেরকে যুগপৎভাবে ইসলামী ও আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কে ওয়াকিফহাল করণ, ভ্রাতৃত্ব বোধ দৃঢ়করণ, শিক্ষকদের অধিকার সংরক্ষণ ইত্যাদি ছিলো এই সংগঠনের লক্ষ্য। সাঈদ নুরসী এই সংগঠনের একজন নিষ্ঠাবান সদস্য ছিলেন।
গ্রীন ক্রিসেন্ট সোসাইটি ও সাঈদ নুরসী
১৯২০ সনের প্রথমভাগেই শাইখুল ইসলাম ইবরাহীম আফিন্দী, ডঃ তাওফীক রুসতু আরাস, আশরাফ এদিপ, ফাখরুদ্দীন করীম গোকে ও সাঈদ নুরসীর উদ্যোগে গ্রীন ক্রিসেন্ট সোসাইটি গঠিত হয়।
ইতোমধ্যে তুর্কীর বিস্তৃত অঞ্চলে এমন কি রাজধানী কনস্ট্যান্টিনোপলে ইউরোপীয় দখলদার বাহিনীর কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়। দখলদার শক্তিগুলো মুসলিম যুবকদের নৈতিক মেরুদণ্ড ভেংগে দেয়ার জন্য সর্বত্র মদ ও অন্যান্য মাদক দ্রব্য ছড়িয়ে দিচ্ছিলো। এই চক্রান্ত প্রতিহত করার উদ্দেশ্যেই গঠিত হয়েছিলো গ্রীন ক্রিসেন্ট সোসাইটি। সাঈদ নুরসী এর সদস্য হিসেবে সোচ্চার ভূমিকা পালন করেন।
প্রথম মহাযুদ্ধে তুর্কীর পরাজয়ের গ্লানি
প্রথম মহাযুদ্ধে জার্মেনী ও তুর্কী পরাজিত হয়। ১৯২০ সনের ১০ই অগাস্ট বিজয়ী শক্তিগুলো সেভার্স চুক্তির মাধ্যমে তুর্কীর ওপর চরম আঘাত হানে। চুক্তি অনুযায়ী ঈজিয়ান সাগরের কয়েকটি দ্বীপ ও থ্রেস তুর্কীর হাত থেকে কেড়ে নিয়ে গ্রীসকে দেয়া হয়। মিসর, সুদান, সাইপ্রাস, ইরাক, ফিলিস্তিন ও আরব উপদ্বীপ গ্রেটবৃটেনের কর্তৃত্বাধীনে দেয়া হয়। লেবানন, সিরিয়া, মরক্কো, তিউনিসিয়া প্রভৃতি তুলে দেয়া হয় ফ্রান্সের হাতে। কনস্ট্যান্টিনোপল ও আলেকজান্দ্রিয়া নৌবন্দর আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণে নেয়া হয়। তুর্কীর বিমান বহর মিত্র শক্তির হাতে চলে যায়। সুলতান ষষ্ঠ মুহাম্মাদের হাতে থাকে রাজধানী কনস্ট্যান্টিনোপল ও আনাতোলিয়ার পার্বত্যাঞ্চল। তবে কনস্ট্যান্টিনোপলেও মিত্র বাহিনীর সৈন্যরা অবস্থান গ্রহণ করে।
সুলতান ষষ্ঠ মুহাম্মাদ দখলদার বাহিনীর হাতের পুতুলে পরিণত হন। কমিটি অব ইউনিয়ান এণ্ড প্রগ্রেস সরকারের পতন ঘটে। সুলতান সকল ক্ষমতা নিজের হাতে তুলে নেন।
আংকারাতে সমান্তরাল সরকার গঠন
আনাতোলিয়া ছিলো ইয়াং তুর্কসের শক্ত ঘাঁটি। সেখান থেকে ইয়াং তুর্কস ইউরোপীয় শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। স্মার্ণা রক্ষা করতে না পারায় তারা সুলতান ষষ্ঠ মুহাম্মাদের কড়া সমালোচনা করে। তারা কনস্ট্যান্টিনোপল সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন রিফাত রউফ বে ও আলী ফুয়াদ পাশা।
এই নাজুক পরিস্থিতিতে তুর্কীর বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ রাজনৈতিকভাবে দুইটি শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েন। এক ভাগের মত ছিলো, দখলদার শক্তিগুলোর সাথে সহযোগিতা করে তুর্কীর স্বার্থ সংরক্ষণ চেষ্টা চালানো। অপর ভাগের মত ছিলো, আনাতোলিয়া থেকে পরিচালিত আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে একে শক্তিশালী করে তোলা। বাদীউয্যামান সাঈদ নুরসী ছিলেন দ্বিতীয় মত অবলম্বনকারীদের একজন।
১৯১৯ সনে আনাতোলিয়াতে ইয়াং তুর্কস প্রতাপশালী হয়ে উঠলে তাদেরকে দমন করার জন্য সুলতান ষষ্ঠ মুহাম্মাদ সেনাবাহিনীর জাঁদরেল অফিসার মুসতাফা কামাল পাশাকে ইন্সপেক্টার জেনারেল নিযুক্ত করে সেখানে পাঠান। সেখানে গিয়ে মুস্তাফা কামাল পাশা বিদ্রোহীদের দলে ভিড়ে যান।
ঐ বছরই সেপ্টেম্বর মাসে ইয়াং তুর্কস সেখানে একটি নির্বাহী পরিষদ গঠন করে। মুসতাফা কামাল পাশা হন এই পরিষদের চেয়ারম্যান। সদস্য ছিলেন রিফাত রউফ বে, বেকীর সামী বে, রুস্তম বে, মাজহার বে ও হায়দার বে।
এই নির্বাহী পরিষদ আংকারাকে রাজধানী করে আনাতোলিয়া শাসন করতে থাকে। এই ভাবে আংকারায় কনস্ট্যান্টিনোপলের সমান্তরাল সরকার কায়েম হয়ে যায়।
১৯২০ সনের এপ্রিল মাসে মুস্তাফা কামাল পাশা সাম্প্রতিক কালে নির্বাচিত ও সুলতান ষষ্ঠ মুহাম্মাদ কর্তৃক ভেংগে দেয়া পার্লামেন্টের অধিবেশন আহ্বান করেন আংকারাতে। পার্লামেন্টের নাম দেয়া হয় গ্র্যান্ড ন্যাশনাল এসেম্বলী। মুস্তাফা কামাল পাশা এই এসেম্বলীরও চেয়ারম্যান হন।
আংকারা সরকার ঘোষণা করে যে, বিদেশী সৈন্যদের হাতে বন্দী সুলতান ষষ্ঠ মুহাম্মাদের কোন বিধি-বিধান মানা যাবে না। সুলতানের স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলোও তুর্কদের জন্য গ্রহণযোগ্য নয়।
১৯২০ সনেই মুস্তাফা পাশার নেতৃত্বে তুর্ক সৈন্যগণ স্মার্ণা থেকে গ্রীক সৈন্যদেরকে তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়।
১৯২১ সনে সাকারিয়া রণাংগনেও গ্রীকদেরকে পরাজিত করা সম্ভব হয়।
এই দুইটি সামরিক বিজয় আংকারা সরকারের ভাবমর্যাদা বৃদ্ধি করে। কমিউনিস্ট রাশিয়া আংকারা সরকারকে প্রথম স্বীকৃতি দেয়। ফ্রান্স এই সরকারকে স্বীকৃতি দিয়ে সিলিসিয়া থেকে সৈন্য সরিয়ে নেয়। ইতালী এই সরকারকে স্বীকৃতি দিয়ে আদালিয়া ছেড়ে চলে যায়।
খৃস্টীয় ১৯২২ সনে গ্রীস স্মার্ণার ওপর থেকে তার দাবি প্রত্যাহার করে।
কনস্ট্যান্টিনোপলে আংকারা সরকারের কর্তত্ব প্রতিষ্ঠা
ঐ বছর আংকারা সরকার ‘সুলতান’ পদ বিলুপ্তির ঘোষণা দেয়। ‘খালীফাহ’ পদবীটি তখনো বহাল রাখা হয়। ষষ্ঠ মুহাম্মাদ (সুলতান ওয়াহিদ উদ্দীন) কনস্ট্যান্টিনোপল ছেড়ে গ্রেট বৃটেন চলে যান। রিফাত পাশা আংকারা সরকারের পক্ষে কনস্ট্যান্টিনোপলের শাসনভার গ্রহণ করেন। গ্র্যান্ড ন্যাশনাল এসেম্বলী দ্বিতীয় আবদুল মাজিদকে নামকাওয়াস্তে খালীফাহ নির্বাচিত করে।
আংকারাতে সাঈদ নুরসীর সংবর্ধনা
ইয়াং তুর্কস আন্দোলনের সাথে সাঈদ নুরসীর সম্পৃক্ততা ও সমর্থনের কথা মুস্তাফা কামাল পাশা ভালো করেই জানতেন। তিনি তাঁকে আংকারা যাবার জন্য বারবার অনুরোধ জানান। শেষাবধি সাঈদ নুরসী আংকারা পৌঁছেন।
১৯২২ সনের ৯ই নভেম্বর গ্রান্ড ন্যাশনাল এসেম্বলীতে তাঁকে সম্বর্ধনা দেয়া হয়।
মুস্তাফা কামাল পাশার মুখোমুখি
১৯২৩ সনের ১৯শে জানুয়ারী সাঈদ নুরসী দশ দফা দাবি সম্বলিত একটি চিঠি গ্র্যান্ড ন্যাশনাল এসেম্বলীর সদস্যদের নিকট পাঠান। এই চিঠির মাধ্যমে তিনি সকলকে দীনী কর্তব্য সম্পর্কে সজাগ করে দেন। তাঁর এই প্রচেষ্টার সুফল ফলতে শুরু করে। আগে ছালাত আদায় করতো না এমন প্রায় ৬০ জন সদস্য অন্যান্য নামাযী সদস্যদের সাথে যোগ দেন। ছালাত আদায়ের জন্য নির্ধারিত রুমে আর জায়গা হচ্ছিলো না। ফলে আরো বড়ো একটি রুমে জামায়াতের ব্যবস্থা করা হয়।
এসেম্বলীর চেয়ারম্যান মুস্তাফা কামাল পাশা এই তৎপরতা দেখে বিরক্ত হন। একদিন তিনি রাগতস্বরে সাঈদ নুরসীকে বলেন, ‘‘আমাদের প্রয়োজন একজন বীর আলিমের। আপনার উন্নত চিন্তাধারা থেকে উপকৃত হবার জন্যই আপনাকে এখানে ডেকে আনা হয়েছে। অথচ আপনি এখানে এসে ছালাত সম্পর্কে লেখালেখি শুরু করলেন। এইভাবে আমাদের মাঝে অনৈক্য সৃষ্টি করলেন।’’
সাঈদ নুরসী নির্ভীকভাবে জবাব দিলেন, ‘পাশা, পাশা, ঈমানের পর ফারয ছালাতগুলোই তো ইসলামের অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যারা ছালাত আদায় করে না তারা বিশ্বাসঘাতক। আর বিশ্বাসঘাতকের অভিমত গ্রহণ করা যায় না।’’
উপস্থিত সকলেই ঘাবড়ে গেলেন। তাঁরা ভাবলেন, এই সব উক্তির জন্য সাঈদ নুরসীকে চড়ামূল্য দিতে হবে।
কিন্তু চতুর মুস্তাফা কামাল পাশা নিজের রাগ সামলে নিলেন। দুই দিন পর তিনি সাঈদ নুসরীকে তাঁর অফিসে ডেকে নেন ও বিভিন্ন বিষয়ে দুই ঘন্টা আলাপ করেন। তিনি সাঈদ নুরসীকে মাসিক তিনশত লিরার বিনিময়ে পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোতে মুবাল্লিগ হিসেবে কাজ করার প্রস্তাব দেন, তাঁকে এসেম্বলীতে সদস্য পদ দিতে চান ও দারুল হিকমাহ ইসলামীয়ার সদস্য পদের অনুরূপ একটি পদ গ্রহণের প্রস্তাব দেন। সাঈদ নুরসী এইসব পদ প্রত্যাখ্যান করেন।
মুস্তাফা কামাল পাশার স্বৈর শাসন
আংকারাতে অবস্থানকালে সাঈদ নুরসী বুঝতে পেরেছিলেন তুর্কীর মুসলিমদের ওপর নতুন কী আপদ জেঁকে বসেছে। ১৯২৩ সনের এপ্রিল মাসে তিনি আংকারা ত্যাগ করে ওয়ান (Van) চলে আসেন।
১৯২৩ সনের অক্টোবর মাসে মুস্তাফা কামাল পাশা তুর্কীকে একটি প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করে তিনি এর প্রেসিডেন্ট হন ও ইসমত ইনুনুকে প্রাইম মিনিস্টার বানান।
১৯২৪ সনে একটি আইনের মাধ্যমে ‘‘খালীফাহ’’ পদ বিলুপ্ত করেন। নামকাওয়াস্তে খালীফা দ্বিতীয় আবদুল মাজিদ পদচ্যুত হন। কামাল পাশা তুর্কীকে একটি সেকুলার রাষ্ট্রে পরিণত করেন। তুর্কীর রাজধানী কনস্ট্যান্টিনোপল থেকে আংকারা স্থানান্তরিত করেন।
মুস্তাফা কামাল পাশা চরম ইসলাম বিদ্বেষী ছিলেন। যা কিছু ইসলামী আইন তখনো প্রচলিত ছিলো সেইগুলো বাদ দিয়ে তিনি সুইস কোড (Swiss Code) প্রবর্তন করেন।
তিনি পর্দা প্রথার বিলোপ সাধন করেন। একাধিক বিবাহ নিষিদ্ধ করেন। সহশিক্ষা প্রবর্তন করেন।
ইসলামী শিক্ষায়তনগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। দেশের সর্বত্র সেকুলার স্কুল-কলেজ স্থাপিত হয়। আরবীতে আযান দেয়া নিষিদ্ধ হয়। আরবী বর্ণমালার পরিবর্তে ল্যাটিন বর্ণমালা চালূ করা হয়। পাগড়ি ও ফেজ টুপি পরা নিষিদ্ধ হয়। হ্যাট পরিধান বাধ্যতামূলক করা হয়। সালাম পরিত্যক্ত হয়।
দেশে সেকুলার পত্র-পত্রিকার সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। সেকুলার ও সমাজতান্ত্রিক বই পুস্তক ব্যাপকহারে প্রকাশিত হতে থাকে। যুব সমাজ উচ্ছৃংখল হয়ে উঠে। বেহায়াপনা উলংগপনা বৃদ্ধি পায়। মদখোরের সংখ্যা বাড়তেই থাকে।
ইসলামকে নিয়ে বিদ্রূপ হতে থাকে। আলিম সমাজ ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়। বিশিষ্ট ইসলামী ব্যক্তিদেরকে নানাভাবে নির্যাতিত করা হয়।
১৯৩০ সনে মুস্তাফা কামাল পাশা ‘রিপাবলিকান পিপলস পার্টি’ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। ১৯৪৬ সন পর্যন্ত এটিই ছিলো তুর্কীর একমাত্র বৈধ রাজনৈতিক দল।
সাঈদ নুরসীর নতুন উপলব্ধি
সাঈদ নুরসীর বয়স তখন তেতাল্লিশ বছর। প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার কষ্ট, বন্দী জীবনের ধকল ও বিরামহীন পরিশ্রম তাঁর দেহের ওপর দারুন প্রভাব ফেলে।
বিভিন্ন রণাংগনে খৃস্টান শক্তিগুলোর নিকট তুর্কীর পরাজয় এবং তুর্কীর ওপর ইউরোপীয় সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক আগ্রাসন বাদীউয্যামান সাঈদ নুরসীর ওপর দারুণ মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। ফলে তাঁর স্বাস্থ্য বেশ ভেংগে পড়ে। তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি লক্ষ্য করে তাঁর ভাইয়ের ছেলে আবদুর রাহমান কারণ জানতে চান। জবাবে সাঈদ নুরসী বলেন, ‘‘আমি আমার নিজের দুঃখগুলো সইতে পারি। কিন্তু ইসলামের দুঃখ আমাকে বিধ্বস্ত করে ফেলেছে। ইসলামী দুনিয়ার ওপর প্রদত্ত প্রতিটি আঘাত আমার অন্তরের ওপর হানা হয় বলে আমি অনুভব করি। তাই আমি এমন ভেংগে গেছি। তবে আমি একটি আলো দেখতে পাচ্ছি। ইনশাআল্লাহ সেই আলো দুঃখগুলো ভুলিয়ে দেবে।’’
বাদীউয্যামান সাঈদ নুরসী দার্শনিক জ্ঞানেসমৃদ্ধ ছিলেন। তাঁর ধারণা ছিলো, দার্শনিক জ্ঞান আধ্যাত্মিক উন্নতির সোপান। কিন্তু শীঘ্রই তিনি অনুভব করেন যে আসলে ব্যাপারটি তা নয়।
এই সময় তিনি আবদুল কাদির জিলানীর (রহ) ‘‘ফুতুহুল গাইব’’ গ্রন্থটি পড়েন। এর পর তিনি পড়েন শায়খ আহমাদ সরহিন্দীর (রহ) ‘‘মাকতুবাত’’। এই অধ্যয়ন তাঁর চিন্তার দিগন্ত আরো প্রসারিত করে।
সন্দেহ নেই, গোড়া থেকেই আল কুরআনই ছিলো তাঁর প্রধান অবলম্বন। এবার তিনি আরো বেশি অভিনিবেশ সহকারে আল কুরআন পড়তে থাকেন। আল কুরআন তাঁকে আরো বেশি আলো দিতে থাকে। জীবন ও জগতের রহস্যগুলো তাঁর কাছে স্পষ্টতর হয়ে উঠে। আল কুরআনের বিধানগুলোর শ্রেষ্ঠত্ব, বলিষ্ঠতা ও কল্যাণময়তা তাঁর ইসলামী চিন্তা-চেতনাকে আরো বেশি শক্তিশালী করে তোলে। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, তাঁর এই উপলব্ধি তিনি ‘রিসালা-ই-নূর’’ শীর্ষক পুস্তিকা সিরিজের মাধ্যমে অপরাপর মানুষের কাছে উপস্থাপন করবেন।
মাউন্ট এরেকে অবস্থান
আংকারা থেকে ওয়ান এসে সাঈদ নুরসী প্রথমে তাঁর ছোট ভাই আবদুল মাজীদের বাসায় উঠেন। কিন্তু তাঁর কাছে বহু সংখ্যক লোক আসা-যাওয়া করতে থাকায় তিনি নুরসিন মাসজিদে স্থানান্তরিত হন। এই মাসজিদ এবার তাঁর ইসলামী জ্ঞান বিতরণের কেন্দ্রে পরিণত হয়।
কিছুকাল পর তিনি মাউন্ট এরেকে চলে যান ও সেখানে যারনাবাদ নদীর উৎসমুখের নিকটে অবস্থান করতে থাকেন। তবে জুমাবার তিনি নুরসিন মাসজিদে এসে খুতবাহ দিতেন। তিনি অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাসায় তাওহীদ, রিসালাত, আখিরাত ইত্যাদি মৌলিক বিষয়ের ওপর বক্তব্য রাখতেন। তাঁর এক ছাত্র মোল্লা হামীদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘‘আমার লক্ষ্য হচ্ছে ঈমানের বুনিয়াদ মজবুতভাবে গড়ে তোলা। যদি বুনিয়াদ মজবুত হয়, কোন তুফানেই তা ভেংগে পড়বে না।’’
মাউন্ট এরেকে তিনি একটি মাসজিদ নির্মাণ করেন। কাছে গাছ-গাছালির মধ্যে ছোট একটি মঞ্চ তৈরী করেন। এখানে বসে তিনি পড়াশুনা ও চিন্তা-গবেষণা করতেন।
রাতে তিনি ছালাতুত্ তাহাজ্জুদ আদায় করতেন। দীর্ঘ সময় ধরে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিকট দুআ করতে থাকতেন।
সশস্ত্র তৎপরতার বিরোধিতা
সাঈদ নুরসী তখন প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে দূরে অবস্থান করছিলেন। তবুও বিভিন্ন গোত্রের সরদার ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা তাঁর নিকট আসা-যাওয়া করতো।
কুর্দদের মধ্যে অনেকেই সরকার-বিরোধী হয়ে উঠে। সরকারের ইসলামী বিরোধী কার্যকলাপ তাদেরকে ব্যথিত করে। অন্য দিকে তাদের অঞ্চলের সমস্যাবলী সমাধানের প্রতি সরকারের উদাসীনতা তাদেরকে বীতশ্রদ্ধ করে তোলে। জনৈক শায়খ সাঈদ এই সময় সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য একটি সশস্ত্র গ্রুপ গড়ে তোলেন। হুসাইন পাশা নামক একজন সরদার সাঈদ নুরসীর সাথে সাক্ষাত করে বলেন, ‘আমার সৈন্য, ঘোড়া, গোলাবারুদ প্রস্তুত। আমরা শুধু আপনার কমাণ্ডের অপেক্ষা করছি।’’
সাঈদ নুরসী বললেন, ‘‘আপনার কার বিরুদ্ধে লড়াই করতে চান?’’। হুসাইন পাশা বললেন, ‘‘মুস্তাফা কামালের বিরুদ্ধে’’। সাঈদ নুরসী বললেবন, ‘‘মুস্তাফা কামালের সৈন্যরা কারা?’’ হুসাইন পাশা বললেন, ‘‘আমি তা জানিনা।’’ সাঈদ নুরসী বললেন, ‘‘ওরা এই দেশেরই ছেলে। ওরা আমার আত্মীয়-স্বজন, আপনার আত্মীয়-স্বজন। আপনি কাদেরকে হত্যা করবেন? তারা কাকে হত্যা করবে? মাথা ঘামান। আপনি কি চান আহমাদ মুহাম্মাদকে আর হাসান হুসাইনকে হত্যা করুক?’’
সাঈদ নুরসী সরকার পরিবর্তনের জন্য সশস্ত্র তৎপরতা চালানোর ঘোর বিরোধী ছিলেন। তিনি তাঁর শানিত যুক্তি ব্যবহার করে ঐ ধরণের তৎপরতায় আগ্রহী ব্যক্তিদেরকে নিরুৎসাহিত করে চলেন। তথাপিও আবেগ প্রবণ ও ত্বরা প্রবণ লোকেরা ঐ দিকেই ঝুঁকে পড়ে।
১৯২৫ সনের ১৩ই ফেব্রুয়ারী শায়খ সাঈদের নেতৃত্বে সশস্ত্র লড়াই শুরু হয়। রাষ্ট্রশক্তির মুকাবিলায় এটি ছিলো একটি অপ্রতুল প্রয়াস। মুস্তাফা কামাল পাশার সৈন্যরা অভিযান চালিয়ে দুই মাসের মধ্যেই এই বিদ্রোহ দমন করে।
বিদ্রোহ দমনের পর ইনডিপেনডেন্স ট্রাইবুনাল গঠন করা হয়। বিচাররের নামে প্রহসন করা হয়। বহু লোককে শাস্তি দেয়া হয়।
সরকার ওয়ান প্রদেশের প্রভাবশালী ইসলামী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদেরকে গ্রেফতার করে। একদল সৈন্য এসে যারনাবাদ নদীর উৎমের নিকটবর্তী নিভৃত স্থান থেকৈ সাঈদ নুরসীকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। শায়খ মাসূম, কুর হুসাইন পাশা, হাসান আফিন্দী, আবদুল বাকী আফিন্দী, আবদুল্লাহ আফিন্দীসহ কয়েকশত পুরুষ ও মহিলাকে প্রথমে ইজমির ও পরে আন্টালিয়া নিয়ে যাওয়া হয়।
সাঈদ নুরসীর নির্বাসন
(ক) বুরদুরঃ
আন্টালিয়া থেকে সাঈদ নুরসীকে আনাতোলিয়া বুরদুর নামসক স্থানে নির্বাসনে পাঠানো হয়।
একটি ছোট্ট শহর বুরদুর।
১৯২৫ সনের জুন মাসে তিনি বুরদুর পৌঁছেন। হাজী আবদুল্লাহ মাসজিদে তাঁকে থাকতে দেয়া হয়। এই মাসজিদে তিনি প্রত্যেক দিন ছালাতুল আছরের পর দারস দিতেন। ক্রমশঃ শ্রোতার সংখ্যা বাড়তে থাকে।
(খ) ইসপারটাঃ
সাঈদ নুরসীর দারস প্রদান সরকারের মনঃপূত ছিলো না। তাই ১৯২৬ সনের জানুয়ারী মাসে তাঁকে ইসপারটা পাঠিয়ে দেয়া হয়। ওখানে তিনি তাহসিন আফিন্দী মাদ্রাসাতে অবস্থান করতে থাকেন। ছাত্রদের উদ্দেশ্যে তিনি দারস প্রদান শুরু করেন।
(গ) বারলাঃ
ইস্পারটাতে থেকে এইভাবে দারস দিতে থাকার ও বহু লোক তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকায় সরকার সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। ইস্পারটায় তিনি মাত্র বিশ দিন ছিলেন। এবার সরকার তাঁকে নৌকায় চড়িয়ে ইগ্রিদির হ্রদের তীরে একটি ছোট্ট গ্রাম বারলাতে নির্বাসিত করে। তখনো ঐ গামে যাওয়ার পথ তৈরী হয়নি। বিদ্যুৎ পৌঁছেনি। টেলিফোন লাইন স্থাপিত হয়নি।
বারলাতে সাঈদ নুরসী প্রথমে মুহাজির হাফিজ আহমাদের বাড়িতে অবস্থান গ্রহণ করেন। পরে তিনি দুই কক্ষ বিশিষ্ট একটি ঘরে স্থানান্তরিত হন। এই ঘরটি এর আগে গ্রামের লোকদের মিলনায়তন হিসেবে ব্যবহৃত হতো। প্রকৃত পক্ষে এই বাড়িটিই প্রথম নূর মাদ্রাসায় পরিণত হয়।
সাঈদ নুরসীকে বারলাতে থাকতে হয় সাড়ে আট বছর। এই সময়ে তিনি রিসালা-ই নূরের একশত ত্রিশটি অংশ লিখতে সক্ষম হন। আল কুরআনের উপস্থাপিত জীবন দর্শন ও জীবন-বিধান সম্পর্কে গণ মানুষকে অবহিত করার সুমহান লক্ষ্য সামনে নিয়ে তিনি এই প্রয়াস চালাতে থাকেন। বিজ্ঞান, দর্শন ও সভ্যতার নামে ইসলামের বিরুদ্ধে যেইসব আক্রমণ চালানো হচ্ছিলো তিনি সেইগুলোর জবাব লিখেতে থাকেন।
তাঁর নিজের হাতের লেখা খুব ভালো ছিলো না। তবে হাতে লেখা ভালো এমন কয়েকজন ছাত্রকে বসিয়ে দিয়ে মুখে তাঁর বক্তব্য বলতে থাকতেন। ছাত্রগণ তা লিখে নিতো।
তখন ইসলামী বই-পুস্তক মুদ্রণ করা অসম্ভব ব্যাপার ছিলো। তাই তাঁর পুস্তিকাগুলো মুদ্রণের কোন সুযোগ ছিলো না। অথচ যাদের জন্য এইগুলো লেখা তাদের কাছে তো পৌঁছানো প্রয়োজন।
তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, প্রথমে যারা কপি তৈরী করবে তারা আরো কিছু লোকের নিকট ঐগুলো পৌঁছাবে। ঐ লোকেরা নতুন কপি তৈরী করে পৌঁছাবে আরো কিছু লোকের নিকট। এইভাবে এইগুলোর কপির পর কপি তৈরী হতে থাকবে। অল্প সময়ের মধ্যে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে, শহর থেকে শহরান্তরে রিসালা-ই-নূরের কপি পৌঁছে যায়। শুধু ইস্পারটাতেই পাঠকের সংখ্যা কয়েক হাজারে পৌঁছে যায়। এইসব পাঠকদের মধ্যে কিছু সংখ্যক এমন ছিলো যারা একাধারে সাত আট দিন ঘরে বসে রিসালা-ই-নূর কপি করে চলতো।
রিসালা-ই-নূর কপি করার কাজে মহিলাদের অবদানও কম ছিলো না। বালক-বালিকারাও তাদের আব্বা-আম্মার সাথে বসে রিসালা কপি করতো। অনুমান করা হয়, এইভাবে হাতে লেখা রিসালা-ই-নূরের কপি সংখ্যা ছয় লাখে পৌঁছেছিলো।
সাঈদ নুরসী চাচ্ছিলেন ইসলাহ। যাঁরা এই কাজে প্রকৃত ভূমিকা পালন করতে পারতেন তাঁরা ছিলেন উচ্চ পদস্থ সরকারী কর্মকর্তা ও এসেম্বলীর সদস্যবৃন্দ। সাঈদ নুরসী কিছু কপি তাঁদের নিকট পৌঁছাতে সক্ষম হন।
তবে সরকারের বৈরী মনোভাবের কারণে রিসালা-ই-নূর কপি করণ ও বিতরণ সহজ কাজ ছিলো না। সন্দেহ হলেই পুলিশ লোকদের বাড়িতে হানা দিতো। কারো কাছে কপি পাওয়া গেলে তাকে থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতো। মারধোর করতো। কাউকেও বা বন্দী করে রাখতো।
রিসালা-ই-নূর একদিকে আল কুরআনের শিক্ষাকে বাঁচিয়ে রেখেছে অন্য দিকে বাঁচিয়ে রেখেছে আল কুরআনের বর্ণমালাকে।
রিসালা-ই-নূরের প্রভাব বেড়েই চলে। রিসালা-ই-নূরের প্রভাবে নীরবে সৃষ্টি হতে থাকে ইসলামী জাগরণ।
১৯৩৫ সনের ২৭শে এপ্রিল সাঈদ নুরসী ও তাঁর একদল অনুগামীকে ইস্পারটা থেকে গ্রেফতার করা হয়। কয়েকদিনের মধ্যে মিলাস, আন্তালিয়া, বলভাদিন, আইডিন, ওয়ান ও অন্যান্য স্থান থেকে রিসালা-ই-নূরের বহু সংখ্যক পাঠককে গ্রেফতার করা হয়। তাঁদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার জন্য জনগণের ধর্মীয় আবেগের ব্যবহার ও ধর্মের ভিত্তিতে রাজনৈতিক সংস্থা গড়ে তোলার অভিযোগ আনা হয়। পত্রিকাকে অপপ্রচার চালানো হতে থাকে যে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর একটি নেটওয়ার্কের সন্ধান পাওয়া গেছে।
(ঘ) এসকিশেহিরঃ
১৯৩৫ সনের ১২ই মে সাঈদ নুরসী ও তাঁর অনুগামী ৩১ জন ব্যক্তিকে হ্যান্ডকাপ লাগিয়ে লরিতে তুলে এসকিশেহির নিয়ে আসা হয়। জেলখানায় সাঈদ নুরসীকে একটি কক্ষে ও ৩১ জনকে একটি ওয়ার্ডে রাখা হয়। কয়েকদিনের মধ্যেই বন্দীদের সংখ্যা হয় একশত বিশজন। বন্দীদেরকে বারটি দিন খাদ্য দেয়া হয়নি। অত্যন্ত কষ্টদায়ক পরিবেশে তাঁদেরকে থাকতে বাধ্য করা হয়। জেলখানায় তাঁরা জামায়াতে ছালাত আদায় করতেন। পারা ভাগ করে নিয়ে দৈনিক কয়েকবার আল কুরআন অধ্যয়ন সমাপ্ত করতেন। সমবেতভাবে আল্লাহর দরবারে দুআ করতেন।
কারাগার কার্যতঃ শিক্ষাগারে পরিণত হয়। সাঈদ নুরসী ইউসুফ (আ)-এর তৎপরতার অনুরূপ তৎপরতার অনুরূপ তৎপরতার নিরিখে জেলখানাকে মাদ্রাসা-ই-ইউসুফিয়া বলে উল্লেখ করতেন।
এসকিশেহির কোর্টে মামলা দায়ের করা হয়। সাঈদ নুরসীকে এগার মাস ও পনরজন অনুগামীকে ছয় মাসের কারাদন্ড দেয়া হয়। অন্যরা মুক্তি পায়। এই রায় প্রদান করা হয় ১৯৩৫ সনের ১৯শে অগাস্ট। ১৯৩৬ সনের মার্চ মাসে সাঈদ নুরসী এসকিশেহির জেলখানা থেকে মুক্তি পান।
(ঙ) কাসতামনুঃ
সাঈদ নুরসীকে এবার নির্বাসিত করা হয় কাসতামনুতে। প্রথমে তিন মাস তাঁকে থানাতেই একটি কক্ষে কাটাতে হয়। পরে থানার বিপরীত দিকে একটি ভাড়া করা বাড়িতেই তিনি থাকা শুরু করেন।
কাসতামনুতে শীতকালে তীব্র শীত পড়ে। শীতের প্রচণ্ডতায় তিনি রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েন। তিনি বাত রোগে ভুগতে থাকেন। তবে তাঁর কলম চলতে থাকে বিরামহীন। আরো কিছু রিসালা-ই-নূর তিনি লিখতে সক্ষম হন।
পুলিশের হয়রানি সত্ত্বেও তাঁর সাথে দেখা করতে আসতো। তিনি রিসালা-ই-নূরের পাঠক বা ছাত্রদেরকে তাকওয়া অবলম্বনের উপদেশ দিতেন। আত্মম্ভরিতা পরিহার করতে বলতেন। তিনি বলতেন যে কারো সাথে ভালোবাসা হবে শুধু আল্লাহরই জন্য, আবার কারো সাথে শত্রুতা হবে আল্লাহরই জন্য।
রিসালা-ই-নূর দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে যেতে থাকে। সাঈদ নুরসী বলতেন যে এই আলো ভবিষ্যতের দিকে ছুটে যাবে।
তিনি যখন এসকিশেহির নির্বাসনে তখন ১৯৩৮ সনে প্রেসিডেন্ট মুস্তাফা কামাল পাশার মৃত্যু হয়। নতুন প্রেসিডেন্ট হন ইসমত ইনুনু। তিনিও মুস্তাফা কামাল পাশার পদাংক অনুসরণ করেন।
(চ) ডেনিযলিঃ
১৯৪৩ সনের ২রা সেপ্টেম্বর তাঁর বাসস্থানে তল্লাশী চালিয়ে পুলিশ রিসালা-ই-নূরের কিছু পাণ্ডুলিপি পায়। তাকে গ্রেফতার করে ডেনিযলি পাঠিয়ে দেয়া হয়। তাঁর ১২৬ জন অনুগামীকেও গ্রেফতার করা হয়। এদের মধ্য থেকে ৭৩ জনকে জেলে পাঠিয়ে, অন্যদেরকে ছেড়ে দেয়া হয়।
সাঈদ নুরসীকে রাখা হয় ছোট্ট একটি কক্ষে। কক্ষটি এতোই ছোট্ট ছিলো যে অতি কষ্টে সেখানে তাঁর বিছানা পাতা সম্ভব হয়। খুবই ছোট্ট একটি জানালা ছাড়া আলো-বাতাস ঢোকার আর কোন পথ ছিলো না। কক্ষটি এতোই অন্ধকার ছিলো যে পড়াশুনার জন্য দিনের বেলাও মোমবাতি জ্বালাতে হতো।
এসকিশেহির জেলখানার মতো ডেনিযলি জেলখানাও ইসলামী শিক্ষাগারে পরিণত হয়। এটি পরিণত হয় দ্বিতীয় মাদ্রাসা-ই-ইউসুফিয়ায়।
এসকিশেহির কোর্টে তাঁর বিরুদ্ধে যেইসব অভিযোগ আনা হয়েছিলো সেই ধরণের অভিযোগই আনা হয়েছিলো ডেনিযলি কোর্টে। অভিযোগে বলা হলো, তিনি নতুন এক সুফী তরীকাহ তৈরী করছেন, রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তুলছেন, সরকারের সংস্কার কর্মসূচীর বিরোধীতা করছেন, ধর্মীয় আবেগ কাজে লাগিয়ে জননিরাপত্তা বিঘ্নিত করে তুলছেন ইত্যাদি।
সাঈদ নুরসী সবগুলো অভিযোগের দাঁত ভাংগা জবাব দেন।
১৯৪৪ সনের ১৬ই জুন ডেনিযলি কোর্ট সাঈদ নুসরী ও তাঁর অনুগামীদেরকে মুক্তির আদেশ সম্বলিত রায় দেয়। সরকার ডেনিযলি কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আংকারা আপীল কোর্টে মামলা নিয়ে যায়। আংকারা আপীল কোর্ট ডেনিযলি কোর্টের রায় বহাল রাখে।
সাঈদ নুরসী জেলখানা থেকে বেরিয়ে দেখেন অগণিত মানুষ তাঁকে দেখার জনর্য অপেক্ষমান। স্থানীয় লোকেরা তাঁর কারামুক্ত সাথীদেরকে মেহমান হিসেবে ভাগ করে নেয়। সাঈদ নুরসী উঠেন সাহির হোটেলে। প্রতিদিন গড়ে পাঁচশত লোক তাঁর সাথে দেখা করতে আসতো। স্পষ্টতঃ প্রতিয়মান হচ্ছিলো যে রিসালা-ই-নূর ডেনিযলি দখল করে নিয়েছে।
(ছ) আফিওনঃ
আংকারা থেকে নির্দেশ আসে সাঈদ নুরসীকে আফিওন পাঠিয়ে দিতে। ১৯৪৪ সনের ৩১শে জুলাই একজন পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে তিনি আফিওন পৌঁছেন। তাঁকে এখানে অবস্থিত আংকারা হোটেলে থাকতে দেয়া হয়। এখানে তিনি ছিলেন প্রায় তিন সপ্তাহ।
(জ) আমিরদাগঃ
আবার নির্দেশ আসে তাঁকে আমিরদাগ যেতে হবে। ১৯৪৪ সনের অগাস্ট মাসে তিনি আমিরদাগ পৌঁছেন। থানার কাছাকাছি একটি বাড়িতে তাঁকে রাখা হয়। দরজায় পাহারা বসানো হয়। তাঁর সাথে কারো সাক্ষাত করা খুবই কঠিন হয়ে পড়ে। তবে রিসালা-ই-নূর লেখার কাজ তিনি অব্যাহত রাখেন।
উল্লেখ্য যে ডেনিযলি ট্রায়ালের পর রিসালা-ই-নূরের চাহিদা খুব বেড়ে যায়। হাতে কপি করে চাহিদা মেটানো যাচ্ছিলো না। তাঁর দুইজন শিষ্য দুইটি ডুপ্লিকেটিং মেশিন কিনে দ্রুততার সাথে কপি সরবরাহের ব্যবস্থা করে।
আমিরদাগে আসার পর রিসালা-ই-নূর রচনার কাজ কার্যতঃ সমাপ্ত হয়ে যায়।
রিসালা-ই-নূর দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। সাঈদ নুরসী রিসালা-ই-নূরের কপি সরকারী কর্মকর্তাদের নিকট পাঠিয়ে দেশের সার্বিক অবস্থার নিরিখে এইগুলো বিবেচনা করতে অুনরোধ জানান। এতে ইসলামী বিরোধী শক্তি নতুনভাবে তাঁকে হয়রানি করার উদ্যোগ নেয়।
১৯৪৭ সনের শেষের দিকে কামাল পাশার উত্তরসূরী প্রেসিডেন্ট ইসমত ইনুনু আফিওন সফরে আসেন। এখানে প্রদত্ত বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘‘মনে হচ্ছে এই প্রদেশে ধর্মের সাথে সম্পর্কিত একটি গোলযোগ দেখা দেবে।’’
এর পরই বিভিন্ন স্থানে নুরসীর ছাত্রদের ওপর হয়রানি শুরু হয়। আমিরদাগে সাঈদ নুরসীর বাসস্থানে পুলিশ বারবার তল্লাশী চালাতে থাকে। ১৯৪৮ সনের শুরুতে তাঁকে বারবার থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। একবার তিনি খুবই অসুস্থ ছিলেন। তাঁর বয়সও ছিলো সত্তরের ঊর্ধ্বে। এই বৃদ্ধ অসুস্থ মানুষটিকে চার ঘন্টা দাঁড় করিয়ে রেখে যতো সব অবান্তর প্রশ্ন করা হয়।
ধৈর্যের বিমূর্ত রূপ ছিলেন সাঈদ নুরসী। পরম ধৈর্যের সাথে তিনি সব হয়রানি বরদাশত করতে থাকেন।
আবার গ্রেফতার
১৯৪৮ সনের ১৭ই জানুয়ারী তাঁকে ও তাঁর কয়েকজন অনুগামীকে আফিওন এনে প্রথমে একটি হোটেলে রাখা হয়। ২৩শে জানুয়ারী তাঁদেরকে অফিসিয়ালী গ্রেফতার করে জেলখানায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। অন্যান্য স্থান থেকে আরো কিছু লোক বন্দী হয়ে আসে। মোট সংখ্যা দাঁড়ায় ৫৪ জন।
আফিওন কোর্টে ‘‘ধর্মীয় অনুভূতির ব্যবহার ও সরকারের বিরুদ্ধে জনগণকে উস্কানি প্রদান’’ এর অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়। কোর্ট তাঁকে বিশ মাসের ও তাঁর ছাত্রদেরকে বিভিন্ন মিয়াদের কারাদণ্ড দেয়।
সাঈদ নুরসী আংকারা আপীল কোর্টে আফিওন কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপীল পেশ করেন।
কৌশলে এই মামলার শুনানী দীর্ঘায়িত করা হয়। আপীল কোর্টে মামলা শেষ হবার আগেই জেলখানাতে বিশ মাস সময় কেটে যায়। আপীল কোর্ট আফিওন কোর্টের রায় বাতিল করে।
তুর্কীর গণতন্ত্রে উত্তরণ
১৯৩০ সন থেকে একাধারে ১৬ বছর তুর্কীতে একদলীয় শাসন চালু থাকে।
১৯৪৬ সনে বিভিন্ন কারণে সরকার নুতন দল গঠনের অনুমতি দিতে বাধ্য হয়।
১৯৪৬ সনেই গঠিত হয় ডিমোক্রেটিক পার্টি।
১৯৫০ সনের মে মাসে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে ডিমোক্রেটিক পার্টি জয়লাভ করে। মুস্তাফা কামাল পাশা ও ইসমত ইনুনুর স্বৈর শাসনে দেশের জনগণ কেমন বিক্ষুব্ধ ছিলো এই নির্বাচনের ফল তা সুস্পষ্ঠভাবে ব্যক্ত করে।
সরকারের প্রতি উপদেশ
বাদীউয্যামান সাঈদ নুরসী প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে দূরে অবস্থান করছিলেন। কিন্তু রাষ্ট্র নায়কদেরকে সঠিক পথ প্রদর্শনের কর্তব্য পালন করতে ভুলেননি। ইসমত ইনুনুর শাসনকালে ১৯৪৮ সনে তিনি কমিউনিজকম ও ইহুদীবাদের বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করে ও রাষ্ট্রের আদর্শিক বুনিয়াদ হিসেবে আল কুরআনকে গ্রহণ করার আহ্বান জানিয়ে সরকারী কর্মকর্তাদের চিঠি লিখেন।
ডিমোক্রেটিক পার্টি ক্ষমতায় আসলে তিনি সরকারকে ইসলামী নীতির নিরিখে রাষ্ট্রীয় পলিসি নির্ধারণের উপদেশ দেন।
সাঈদ নুরসী তাঁর অনুগামীদেরকেও প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে দূরে রেখেছেন। অর্থাৎ তাঁরা কেউ রাজনীতিতে জড়িত হতে চাইলে হতে পারতো, কিন্তু রিসালা-ই-নূরের প্ল্যাটফরম রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করতে পারতো না।
সাঈদ নুরসী ডিমোক্রেটিক পার্টিকে ‘কম মন্দ’ গণ্য করতেন। ১৯৫৭ সনের নির্বাচনে তিনি তাঁর ছাত্রদেরকে ডিমোক্রেটিক পার্টির পক্ষে ভোট দিতে বলেন। তিনি নতুন প্রেসিডেন্ট জালাল বায়ারকে লিখেন, ‘‘যারা রাজনীতিকে ধর্মহীনতার হাতিয়ার বানিয়ে আমাদের সাথে দুর্ব্যবহার করেছে তাদের মুকাবিলায় আমরা দীনকে রাজনীতির বন্ধু বানিয়ে দেশ ও জাতির কল্যাণ সাধনই করছি।’’
তিনি মুসলিম জাহানের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। পূর্বাঞ্চলের জন্য পরিকল্পিত বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ইসলামী ধাঁচে গড়ে তোলার জন্য তিনি আবেদন জানান। জাতীয়তাবাদ নয় ইসলামী জাতিসত্তার চেতনাকে শক্তিশালী করার জন্য তিনি পরামর্শ দেন।
সাঈদ নুরসী মুসলিম জাহানের ঐক্যের ওপর খুবই গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি ‘ইউনাইটেড ইসলামিক স্টেটস’ এর স্বপ্ন দেখেন।
শান্তিপূর্ণ ও ইতিবাচক ভূমিকা
সাঈদ নুরসী গোটা সমাজের পর্যাক্রমিক পরিবর্তনে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি গণতন্ত্রকে সেই লক্ষ্য অর্জনের একটি বৈধ উপায় গণ্য করতেন। হঠকারী পদক্ষেপ নেয়ার জন্য তাঁকে ও তাঁর ছাত্রদেরকে নানাভাবে উসকানো হয়েছে। কিন্তু দুশমনদের ফাঁদে তাঁরা পা দেননি। ‘শান্তিপূর্ণ উপায়ে’ ‘ইতিবাচক পদক্ষেপের’ মাধ্যমে আল কুরআনের পথে এগিয়ে যাওয়াই ছিলো তাঁদের কর্ম কৌশল।
ধর্মহীনতা ও নাস্তিকতাবাদ যেই নৈতিক আধ্যাত্মিক অবক্ষয় সৃষ্টি করেছে তার মুকাবিলায় মানুষের মনে ঈমানের আলো প্রজ্জ্বলনকেই তিনি প্রাধান্য দেন। তাঁর জিহাদ ছিলো মুখের ভাষার জিহাদ। কলমের জিহাদ।
তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো, আন্তরিকতা সহকারে ঈমানী চেতনা সৃষ্টি ও মজবুতকরণের কাজ করে যেতে হবে, আল্লাহর কাজে হস্তক্ষেপ করা যাবে না। অর্থাৎ ফল লাভের জন্য তাড়াহুড়া করা যাবে না, ব্যতিব্যস্ত হওয়া যাবে না। কেননা ফল প্রদানের বিষয়টি একমাত্র সর্বশক্তিমান আল্লাহর হাতে নিবদ্ধ।
আরো মামলা
দেশে গণতান্ত্রিক সরকার কায়েম হয়েছিলো বটে, কিন্তু ব্যুরোক্রেসি ও পুলিশ প্রশাসনে পূর্বতন সরকারের চিন্তাধারার অনুসারীদেরই প্রাধান্য ছিলো। ফলে বার বার সাঈদ নুরসী মামলার সম্মুখীন হচ্ছিলেন।
১৯৫২ সনের জানুয়ারী মাসে ইসতাম্বুল (কনস্ট্যান্টিনোপল) ফার্ষ্ট ক্রিমিনাল কোর্টে ‘‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ বিরোধী ধর্মীয় প্রপাগাণ্ডা’’ মূলক পুস্তিকা লেখার অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। ডেনিযলি কোর্টে আগেই এই ধরণের একটি মামলা নিষ্পত্তি হয়ে যাওয়ায় কোর্ট এই মামলা খারিজ করে দেয়। ১৯৫২ সনের মে মাসে আমিরদাগ কোর্টে ইউরোপীয় হ্যাট পরিধান করতে অস্বীকার করার অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করা হয়। কোর্টের রায়ে তিনি নিস্কৃতি পান।
১৯৫৩ সনে ইস্পারটা কোর্টে সাঈদ নুরসী ও তাঁর ৮৯ জন ছাত্রের বিরুদ্ধে ‘‘গুপ্ত সমিতি’’ গঠনের অভিযোগে একটি মামলা দায়ের করা হয়। কোর্ট মামলা খারিজ করে দেয়।
রিসালা–ই–নূরের পাঠচক্র
ইসপারটাতে অবস্থানকালে সাঈদ নুরসী এক গ্রুপ ছাত্রকে নিয়ে রিসালা-ই-নূরের ওপর পাঠচক্র চালু করেন। তাঁর অনুকরণে অন্যান্য অঞ্চলেও তাঁর বিশিষ্ট ছাত্রগণ পাঠচক্র গড়ে তোলেন।
১৯৫৪ সনে সাঈদ নুরসী বারলা আসেন। এখানেই তো ছিলো প্রথম রিসালা-ই-নূর মাদ্রাসা। এখানে পৌঁছে তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। অশ্রু গড়িয়ে পড়ে তাঁর গণ্ড বেয়ে।
রিসালা–ই–নূর মুদ্রণ
১৯৫৭ সনে আংকারা ও কনস্ট্যান্টিনোপলে (ইসতামবুল) প্রিন্টিং প্রেসে প্রথম মুদ্রিত হয় রিসালা-ই-নূর প্রকাশিত হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে সাঈদ নুরসী মন্তব্য করেছিলেন, ‘‘রিসালা-ই-নূরের উৎসবের এই তো সময়। আমার কর্তব্য শেষ হয়ে গেছে। এই তো সেই সময় যার জন্য আমি দীর্ঘকাল অপেক্ষা করেছি। এবার আমি যেতে পারি।’’
ব্যাপক সফর
সাঈদ নুরসী ৮০ বছর বয়সে উপনীত হন। তাঁর শরীর বেশ দুর্বল হয়ে পড়ে। তথাপিও আল কুরআনের মর্মকথা মানুষের কাছে পৌঁছাবার জন্য এবং রিসালা-ই-নূরের ছাত্রদেরকে সাহচর্য ও সঠিক দিক নির্দেশনা দেবার জন্য তিনি দেশের বিভিন্ন স্থানে সফর করতে থাকেন।
ওফাত
১৯৬০ সনে সাঈদ নুরসীর বয়স হয় ৮৩ বছর। তাঁর শরীরের অবস্থা ক্রমশঃ খারাপ হতে থাকে। তিনি উরফা যাওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত ব্যক্ত করেন। একটি বন্ধুর পথ ধরে আমিরদাগ থেকে কয়েকজন সাথী নিয়ে ২২শে মার্চ তিনি উরফা পৌঁছেন। তিনি একটি হোটেলে উঠেন।
পুলিশ আসে তাঁকে ইস্পারটা নিয়ে যেতে। কিন্তু তাঁর সাথীরা ও স্থানীয় জনগণ এই রুগ্ন ব্যক্তিটিকে কিছুতেই কোথাও নিয়ে যেতে দিতে রাজি হয়নি। ডাক্তারও জানালেন যে রোগী সফর করার অবস্থায় নেই।
রাতে তাঁর জ্বর খুব বেড়ে যায়। তিনি কথা বলার শক্তিও হারিয়ে ফেলেন।
১৯৬০ সনের ২৩শে মার্চ রাত তিনটার সময় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তঁর মৃত্যুর খবর শুনে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে অগণিত মানুষ ছুটতে থাকে উরফার দিকে। উলু মাসজিদে তাঁর জানাযার নামায হয়। স্থানীয় কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।
অজ্ঞাত স্থানে লাস স্থানান্তর
মুস্তাফা কামাল পাশার চিন্তা-ধারার অনুসারী রিপাবলিকান পিপলস পার্টি সাধারণ নির্বাচনে দুই দুইবার জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়ে ভিন্ন পথে ক্ষমতায় আসার চক্রান্ত শুরু করে।
এই দলটির কারসাজিতে ১৯৬০ সনের ২৭শে মে তুর্কীতে জেনারেল জামাল গুরসেলের নেতৃত্বে একটি সামরিক অভ্যূত্থান সংঘটিত হয়। প্রেসিডেন্ট জালাল বায়ার, প্রধানমন্ত্রী আদনান মেনদারেস, অন্যান্য মন্ত্রী ও গ্র্যান্ড ন্যাশনাল এসেম্বলীর সদস্যগণকে গ্রেফতার করে জেলে ঢুকানো হয়। উল্লেখ্য যে বিচারের নামে প্রহসনের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট জালাল বায়ারকে কারাদণ্ড এবং প্রধানমন্ত্রী আদনান মেনদারেস, পররাষ্ট্র মন্ত্রী ফুয়াদ যোরলু ও অর্থমন্ত্রী হাসান পোলাতকানকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় (মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় ১৯৬১ সনের ১৭ই সেপ্টেম্বর)।
প্রপাগান্ডা যুদ্ধ শুরু করা হয় রিসালা-ই-নূরের ছাত্রদের বিরুদ্ধে। তাদের ওপর নেমে আসে নিপীড়ন। সাঈদ নূরসী দুনিয়া থেকে চলে গেছেন। কিন্তু বহু লোক তাঁর কবর দেখতে আসে। এটাও সহ্য হচ্ছিলো না কামাল-পন্থী সরকারের। সরকার সিদ্ধান্ত নিলো উরফা কবরস্থান থেকে তাঁর লাস তুলে নিয়ে অজ্ঞাত স্থানে দাফন করতে হবে।
১৯৬০ মনের ১২ই জুলাই।
উরফা শহরে অসংখ্য সৈন্য এসে পৌঁছে। শহরে কারফিউ দেয়া হয়। সৈন্যরা কোন লোককে ঘর থেকে বের হতে দেয়নি। কবর থেকে তাঁর লাস তুলে প্লেনে তোলা হয়। প্লেন ইস্পার্টা বিমান বন্দরে অবতরণ করলে একটি গাড়িতে করে তাঁর লাস বহু দূরে এক অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। আগেই একটি কবর খুঁড়ে রাখা হয়েছিলো। তাঁকে সেই কবরে শুইয়ে দেয়া হয়। তখন রাত প্রায় শেষ হয়ে আসছিলো। আজো সেই অজ্ঞাত কবরেই শুয়ে আছেন ইসলামী জাগরণের মহান পথিকৃৎ বাদীউয্যামান সাঈদ নুরসী (রহ)।
উপসংহার
দূরদর্শী সাঈদ নুরসী একবার গ্র্যান্ড ন্যাশনাল এসেম্বলীর একজন সদস্যের সাথে আলাপকালে বলেছিলেন, ‘‘আদনান মেনদারেস দীনের একজন বলিষ্ঠ সমর্থক। দীনের জন্য তিনি অনেক কিছু করেছেন, অনেক কিছু করবেন। কিন্তু তিনি প্রত্যাশিত ফল দেখে যেতে পারবেন না। আমিও দীনের কিছু খিদমাত করেছি, এই কথা আমি গোপন করতে পারিনা। আদনান বে-র মতো আমিও প্রত্যাশিত ফল দেখে যেতে পারবো না। তবে উভয়ের প্রচেষ্টার ফল ভবিষ্যতে স্পষ্ট হয়ে দেখা দেবে।
…………………………………………….
তথ্যসূত্রঃ
১. Badiuzzaman Said Nursi, Sukran Wahida
২. ইসলামের ইতিহাস, কাযী আকরাম হুসাইন
৩. মুসলিম ও আধুনিক বিশ্বের ইতিহাস, কে আলী।