৫৩. তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে তৃতীয় সফর
১৯৬২ সনের নভেম্বর মাসে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী তৃতীয়বার তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান সফর করেন। এবার তিনি সফরে ছিলেন আঠার দিন। তিনি মহানগরী ও গুরুত্বপূর্ণ জিলাকেন্দ্রগুলোতে যান, জামায়াতে ইসলামী সাংগঠনিক রিপোর্ট শুনেন ও প্রয়োজনীয় হিদায়াত দেন। বিভিন্ন জনসভাতেও তিনি বক্তব্য রাখেন। এই সব জনসভায় তিনি শাসনতন্ত্রের গণতন্ত্রায়ন, অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরকরণ, তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি অর্থনৈতিক অবিচারের প্রতকার এবং প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করার দাবিতে বক্তব্য রাখেন।
৫৪. ১৯৬৩ সনের কেন্দ্রীয় সম্মেলনের অর্জন
সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী ১৯৬২ সনের শাসনতন্ত্রের অ-গণতান্ত্রিক ধারাগুলোর সমালোচনা করেন। মুসলিম পারিবারিক আইনের ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক বিধানগুলো প্রত্যাহারের জোর দাবি জানান। এই সব কারণে একনায়কতান্ত্রিক সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী তাঁর ও জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে থাকেন।
এই নাজুক পরিস্থিতিতেই সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী লাহোরে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সম্মেলন আহ্বান করেন।
ইকবাল পার্কে সম্মেলন অনুষ্ঠানের অনুমতি চাওয়া হয়। অনুমতি দেয়া হয়নি। আরো কয়েকটি বিকল্প স্থানে অনুমতি চাওয়া হয়। এই অজুহাত সেই অজুহাতে অনুমতি দেয়া হয়ানি। অবশেষে ভাটি গেটের সন্নিকটে একটি লম্বা ও অ-প্রশস্ত স্থানে সম্মেলন অনুষ্ঠানের অনুমতি দেয়া হয়। এবড়ো থেবড়ো স্থান। মাটি ফেলে এটিকে সমতল করে নিতে হয়। ডেলিগেটদের থাকার স্থান, ছালাতের স্থান, খাবারের স্থান, গোসলের স্থান, টয়লেট, সভা অনুষ্ঠানের স্থান, বই-পুস্তকের ষ্টল ইত্যাদি তৈরী হয়ে গেলো। হাজার হাজার ডেলিগেট আসতে থাকে। কিন্তু এতো বড়ো সম্মেলন নিয়ন্ত্রণের জন্য মাইক ব্যবহারের অনুমতি দিলো না সরকার।
তিন দিনের জন্য ডাকা হয়েছিলো এই সম্মেলন। ১৯৬৩ সনের ২৫ অক্টোবর ছিলো উদ্বোধনের দিন। অনেক দূর বিস্তৃত শামিয়ানার নিচে বসে পড়েন হাজার হাজার মানুষ। যথাসময়ে মঞ্চে আসেন আমীরে জামায়াত সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী। মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি লিখিত ভাষণ পড়তে শুরু করেন। শামিয়ানার নিচে কিছু দূরে দূরে রাখা ছিলো টেবিল। নির্দিষ্ট ব্যক্তিরা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীর বক্তৃতার কপি হাতে নিয়ে টেবিলে উঠে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা পড়তে শুরু করেন। যদিও সাইয়েদ আবুল আ’লার কণ্ঠ সকলের শুনার সৌভাগ্য হলো না, কিন্তু তাঁর বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন শ্রোতারা।
হঠাৎ শ্রোতাদের একাংশ থেকে কিছু সংখ্যক লোক দাঁড়িয়ে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীকে গালমন্দ শুরু করে। এই গুণ্ডা দলটির দলপতি ছিলো গোলাম মুহাম্মাদ নামে এক ব্যক্তি। সে স্টেজের দিকে রিভলভার উঁচিয়ে ধরতেই কয়েকজন জামায়াত কর্মী তাকে ধরে ফেলে। এই সময় লোকেরা বলতে থাকে, ‘‘মাওলানা আপনি বসে পড়ুন।’’ সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীর কণ্ঠ থেকে ভেসে আসে দৃঢ় উচ্চারণ, ‘‘আমি যদি বসে পড়ি দাঁড়িয়ে থাকবে কে?’’
গুণ্ডাদল সভাস্থল ত্যাগ করে তাঁবুর রশিগুলো কাটতে শুরু করে। কয়েকজন বুক ষ্টলের দিকে এগিয়ে যায়। তারা তাফসীর তাফহীমুল কুরআন সহ অন্যান্য বই ষ্টলের এদিক ওদিক ছুঁড়ে ফেলে। এরপর তারা মহিলাদের তাঁবুর দিকে অগ্রসর হয়। প্রবেশ পথে যাঁরা কর্তব্যরত ছিলেন তাদের একজন ছিলেন আল্লাহ বকস। গোলাম মোহাম্মাদের গুলির আঘাতে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন ও শাহাদাত লাভ করেন।
জামায়াতে ইসলামীর স্বেচ্ছাসেবকরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। প্রায় ত্রিশ মিনিট সময় চলে যায়। পরিস্থিতি শান্ত হলে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী তাঁর অসমাপ্ত উদ্বোধনী ভাষণ শুরু করেন। এই ভাষণে তিনি বলেন, ‘‘যাঁরা আল্লাহর পথে আন্দোলনে নিবেদিত তাদেরকে অবশ্যই দুইটি গুণের অধিকারী হতে হবে। এইগুলি হচ্ছে ছবর ও হিকমাহ্। ছবরের দাবি হচ্ছে, চলার পথে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হলে উত্তেজিত না হওয়া, মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে না ফেলা এবং হতাশ হয়ে নিজেদের মিশন পরিত্যাগ না করা। যেই কোন সংকটেই সংকল্পের দৃঢ়তা হারিয়ে ফেলা উচিত নয়। হিকমাহ্র দাবি হচ্ছে একটি মাত্র কর্ম পদ্ধতিতে আটকে না যাওয়া। একটি পথ বন্ধ হয়ে গেলে নতুন আরেকটি পথ খোলার যোগ্য হওয়া।’’
সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী পরিস্থিতির শিকার হয়ে কোন কথা বলতেন না, কোন পদক্ষেপও নিতেন না। তিনি আবেগতাড়িত হওয়ার মতো ব্যক্তি ছিলেন না। এতো বড়ো ঘটনা ঘটে গেলো। কিন্তু তাঁর বক্তৃতায় তার কোন প্রতিফলন ঘটেনি। তিনি যা বলার সিদ্ধান্ত নিয়ে এসেছিলেন, তা-ই বলে গেলেন। ঘটনা নিয়ে তিনি মাতামাতি করলেন না। রাতে মাজলিসে শূরার বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় পরদিন সকালেই সম্মেলনে উপস্থিত ডেলিগেটরা গ্রুপ গ্রুপ হয়ে লাহোর বাসীদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে জামায়াতে ইসলামী আহ্বান পৌঁছাবে। কেউ কেউ পরিস্থিতির নাজুকতা তুলে ধরেন। কিন্তু দূরদর্শী সাইয়েদ আবুল আ’লা বুঝাতে সক্ষম হন যে এইটিই মানুষের কাছে যাওয়ার উত্তম সময়।
২৬শে অক্টোবর জামায়াতে ইসলামী ডেলিগেটরা শহরে ছড়িয়ে পড়েন। তাঁরা ২৮,৮৭২ জন ব্যক্তির সাথে সাক্ষাত ও আলাপ করেন। তাঁদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ৫২৭৪ জন সহযোগী সদস্য ফরম পূরণ করেন। ২৭শে অক্টোবর সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী সম্মেলনের সমাপনী ভাষণে বলেন, ‘‘আমি জানি কে এই গুণ্ডাদেরকে ভাড়া করে এনেছে। সরকারের উদ্দেশ্য ছিলো জামায়াতে ইসলামী কর্মীদেরকে উসকিয়ে সহিংস পথে নিয়ে যাওয়া যাতে করে বাহানা বানিয়ে সম্মেলনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা যায়। আল্লাহর শুকরিয়া যে জামায়াতে ইসলামী এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। জামায়াত কর্মীরা ছবর ও হিকমাহ অবলম্বন করেছেন। এর ফলে তাঁরা যে কেবল বিরুদ্ধবাদীদের চক্রান্ত নস্যাত করতে পেরেছে তাই নয়, আশাতীতভাবে তারা সম্মেলনের উদ্দেশ্যও পূরণ করতে পেরেছে।’’
সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী জামায়াতে ইসলামীর জনশক্তিকে বলেন যে বাইরে থেকে যেইসব বিপদ আসে সেইগুলোর তোয়াক্কা না করে তাদের উচিত ভেতরের বিপদ তথা তাদের নিজেদের দুর্বলতার ওপর বিজয় লাভ করা।
৫৫. তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে চতুর্থ সফর
১৯৬৩ সনের নভেম্বর মাসে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী চতুর্থবারের মতো তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন। এই সফরের প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো জামায়াতে ইসলামীর প্রাদেশিক সম্মেলনে যোগদান করা। এই সফর কালে ঢাকা পল্টন ময়দানে এক জনসভাতেও তিনি বক্তৃতা করেন।
৫৬. জামায়াতে ইসলামীকে বে–আইনী ঘোষণা ও সাইয়েদ আবুল আ’লার তৃতীয় গ্রেফতারী
প্রেসিডেন্ট মুহাম্মাদ আইউব খান দারুন নাখোশ ছিলেন জামায়াতে ইসলামী ও সাইয়েদ আবুল আ’লার উপর। জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সম্মেলন বানচাল করার জন্য অনেক কিছুই তিনি করেছেন। কিন্তু সবই হলো বুমেরাং। এতে তাঁর আক্রোশ বেড়ে যায়।
প্রেসিডেন্ট মুহাম্মাদ আইউব খানের নির্দেশে ১৯৬৪ সনের ৬ই জানুয়ারী তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান সরকার জামায়াতে ইসলামীকে বে-আইনী ঘোষণা করে। সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীসহ জামায়াতে ইসলামীর ৬০ জন নেতাকে গ্রেফতার করা হয়।
জামায়াতে ইসলামীর জনশক্তি আবারো পরীক্ষার সম্মুখীন হন। কিন্ত লাহোর সম্মেলনে প্রদত্ত সাইয়েদ আবুল আ’লার দিক-নির্দেশনা তাঁদের মনে তখনো তাজা। এই বিপদের মুকাবিলা করতে হবে ছবর ও হিকমাহর সাথে।
সরকার অভিযোগ করে যে জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা করেছে, কাশ্মীর জিহাদকে না-জায়েয মনে করে, সেনাবাহিনীতে অসন্তোষ সৃষ্টির চেষ্টা চালায়, সরকারী কর্মচারীদের আনুগত্যশীলতা বিনষ্ট করে, ছাত্রদের মাঝে অসন্তোষ সৃষ্টি করে এবং বিদেশ থেকে আর্থিক সাহায্য গ্রহণ করে।
জামায়াতে ইসলামী সরকারের বানোয়াট অভিযোগ ও বে-আইনী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আইনী লড়াই চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। মিঃ এ.কে. ব্রোহীর নেতৃত্বে গঠিত একটি টীমের ওপর মামলা পরিচালনার দায়িত্ব অর্পিত হয়। পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টে রীট পিটিশান দাখিল করা হয়। পশ্চিম পাকিস্তান হাইকোর্ট রীট পিটিশান খারিজ করে দেয়, আর পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্ট সরকারের অর্ডার বাতিল ঘোষণা করে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে জামায়াতে ইসলামী ও পূর্ব পাকিস্তান থেকে সরকার সুপ্রীম কোর্টে আপীল পেশ করে। আল্লাহর শুকরিয়া, সুপ্রীম কোর্ট জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে রায় দেয়। ১৯৬৪ সনের ৯ অক্টোবর জামায়াতে ইসলামীর নেতৃবৃন্দ জেল থেকে মুক্তি পান।
৫৭. প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মিস ফাতিমা জিন্নাহর প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন
প্রেসিডেন্ট মুহাম্মাদ আইউব খানের অ-গণতান্ত্রিক শাসনে দেশের মানুষের নাভিশ্বাস অবস্থা দেখা দেয়।
১৯৬৫ সনের গোড়ার দিকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা। আশি হাজার মৌলিক গণতন্ত্রীরা ভোটার। এমতাবস্থায় অন্য কারো নির্বাচনে পাস করার সম্ভাবনা ক্ষীণ। কিন্তু বিনা চ্যালেঞ্জে প্রেসিডেন্ট আইউব খানকে আবারো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে দেয়া যায় না। এই বিষয়ে ১৯৬৪ সনের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মত বিনিময় হয়। ঢাকার নওযার পরিবারের সন্তান খাজা নাজিমুদ্দীন এই ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ‘কম্বাইন্ড অপোজিশান পার্টিজ’ নামে সরকার বিরোধী একটি রাজনৈতিক ঐক্যজোট গড়ে উঠে।
১৯৬৪ সনের সেপ্টেম্বর মাসে ‘কম্বাইন্ড অপোজিমান পার্টিজ’ পাকিস্তানের স্থপতি মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহর বোন মিস ফাতিমা জিন্নাহকে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী মনোনীত করে। এই সময় জামায়াতে ইসলামী ছিলো নিষিদ্ধ। সাইয়েদ আবুল আ’লাসহ জামায়াতে ইসলামীর নেতৃবৃন্দ ছিলেন বন্দি।
জামায়াতে ইসলামী কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার যেই সব সদস্য জেলের বাইরে ছিলেন তাঁরা ১৯৬৪ সনের ২রা অক্টোবর মিটিংয়ে একত্রিত হন। মিস ফাতিমা জিন্নাহকে সমর্থন করা বা না করা সম্পর্কে আলোচনা হয়। আলোচনান্তে মাজলিসে শূরা অভিমত ব্যক্ত করে যে স্বাভাবিক অবস্থায় একজন মহিলাকে রাষ্ট্র প্রধান করা সমীচীন নয়, কিন্তু দেশে চলছে এক অস্বাভাবিক অবস্থা, স্বৈরশাসক মুহাম্মাদ আইউব খানে বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ক্ষেত্রে মিস ফাতিমা জিন্নাহর কোন বিকল্প নেই। এমতাবস্থায় সার্বিক অবস্থার নিরিখে জামায়াতে ইসলামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মিস ফাতিমা জিন্নাহকেই সমর্থন করবে।
জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে সুপ্রীম কোর্টের রায় ঘোষিত হবার পর ১৯৬৪ সনের ৯ই অক্টোবর সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী জেল থেকে বেরিয়ে আসেন। তিনি জামায়াতে ইসলামীর মাজলিসে শূরার সিদ্ধান্তের সাথে একমত হন।
উল্লেখ্য যে ১৯৬৪ সনের ২২শে অক্টোবর খাজা নাজিমুদ্দীন ইন্তিকাল করেন।
এই সময় প্রেসিডেন্ট আইউব খান কয়েকজন উলামা মাশায়েখ থেকে ফাতওয়া হাছিল করেন যে, একজন মহিলা ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধান হতে পারেন না। জামায়াতে ইসলামীর সদস্যদের মধ্যেও এইসময় কিছুটা বিভ্রান্তি দেখা দেয়। লাহোরের আমীল কাউসার নিয়াযী বলেন যে, খোদ সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী তাঁর বিভিন্ন বইতে লিখেছেন যে একজন মহিলা ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান হতে পারেন না, এখন কিনা তিনিই একজন মহিলাকে প্রেসিডেন্ট বানাতে চাইছেন। কাউসার নিয়াযী জামায়াতের সদস্যপদ থেকে ইস্তফা দেন।
উলামা মাশায়েখ প্রদত্ত ফাতওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী বলেন, ‘‘যারা অভিযোগ করেন যে আমি সুবিধা মতো আমার মত পরিবর্তন করি তাঁদের প্রতি আমার জিজ্ঞাসাঃ ইসলাম কি একজন মহিলাকে মন্ত্রী ও রাষ্ট্রদূত বানাবার অনুমতি দেয়? সহশিক্ষার অনুমতি দেয়? ইসলাম কি পুরুষ ও মহিলাদেরকে একই অফিসে পাশাপাশি বসে কাজ করার অনুমতি দেয়? ইসলাম কি মহিলাদেরকে এয়ার হোষ্টেস হয়ে পুরুষদের মদ পরিবেশন করার অনুমতি দেয়? এইগুলো যদি নিষিদ্ধ হয় তাহলে এতোকাল এইসব বিষয়ে আপনারা কথা বলেন নি কেন? আপনারা শুধু একজন মহিলার রাষ্ট্র প্রধান পদপ্রার্থী হওয়ার বিষয়ে ইসলামের ব্যাপারে জাগলেন কেন?’’
সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী আরো বলেন যে, এটি সু-প্রতিষ্ঠিত যে শারীয়াহর নিরিখে রাষ্ট্র-পরিচালনার দায়িত্ব মহিলাদের নেই, কাজের এই ক্ষেত্রটি পুরুষদেরই। বর্তমান মুহূর্তে একজন মহিলা রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে পারেন কি পারেন না তা বিবেচ্য নয়। প্রশ্ন হচ্ছে কিভাবে এমন এক ব্যক্তির ডিকটেটরিয়াল শাসন থেকে জাতিকে মুক্ত করা যায় যিনি ইসলামী মূল্যবোধের অবনতির জন্য দায়ী। আইউব খানের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য আমাদের প্রয়োজন এমন এক ব্যক্তিকে পাওয়া যিনি জাতির শ্রদ্ধাভাজন। এই প্রেক্ষাপটে আমরা জাতির স্থপতির বোন মিস ফাতিমা জিন্নাহর চেয়ে উত্তম ও অধিক প্রিয় আর কোন ব্যক্তি দেখছি না। আমরা যদি মিস ফাতিমা জিন্নাহর পক্ষে না দাঁড়াই তার অর্থ হয় আইউব খানকে সমর্থন করা। আমাদেরকে দুইটি মন্দের একটি গ্রহণ করতে হবেঃ হয় আমাদেরকে একজন মহিলাকে সমর্থন করতে হবে, নয়তো সমর্থন করতে হবে একজন অত্যাচারীকে। একজন অত্যাচারীকে সমর্থন করার চেয়ে একজন মহিলাকে সমর্থন করা কম মন্দ। বর্তমান মুহূর্তের বিশেষ অবস্থায় (in special circumstances) প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে একজন মহিলাকে সমর্থন করা ইসলামের বিরুদ্ধে যাওয়া নয়।
[দ্রষ্টব্যঃ সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী এন্ড হিজ থট, প্রফেসর মাসুদুল হাসান, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা–১৭৯।]
৫৮. তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান পঞ্চম সফর
জেল থেকে বেরিয়ে আসার পর সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের করাচী, লাহোর, পেশাওয়ার, সারগোদা প্রভৃতি স্থানে অনুষ্ঠিত জনসভায় ভাষণ দেন। ১৯৬৪ সনের নভেম্বর মাসের শেষের দিকে তিনি ঢাকা আসেন। তিনি ২৭শে নভেম্বর ঢাকার পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় বক্তব্য রাখেন। তিনি ২রা ডিসেম্বর নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ ও ৪ঠা ডিসেম্বর চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত জনসভায় বক্তৃতা করেন।
৫৯. ১৯৬৫ সনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন
১৯৬৫ সনের ২রা জানুয়ারী প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আশি হাজার মৌলিক গণতন্ত্রী ছিলো ভোটার। মিস ফাতিমা জিন্নাহ নির্বাচনে বিজয়ী হলে মৌলিক গণতন্ত্র বিলুপ্ত হবে তা জেনে মৌলিক গণতন্ত্রীদের তাঁকে ভোট দেয়া সহজ ব্যাপার ছিল না। যারা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী, বিবেকবান ও সাহসী কেবল তাঁদের পক্ষে কম্বাইন্ড অপোজিশন পার্টিজ এর নমিনিকে ভোট দেয়া সম্ভব ছিলো।
এই নির্বাচনে আইউব খান পান ৪৯,৬৪৭ ভোট। মিস ফাতিমা জিন্নাহ পান ২৮,৩৪৫ ভোট। দের্দণ্ড প্রতাপশালী প্রেসিডেন্ট মুহাম্মাদ আইউব খানের নানামুখী চাপ ও চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে আটাশ হাজারেরও বেশি মৌলিক গণতন্ত্রী মিস ফাতিমা জিন্নাহকে ভোট দেয়ায় স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছিলো দেশের রাজনৈতিক হাওয়া কোন দিকে বইছে। স্বৈরশাসক আইউব খানের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টির ক্ষেত্রে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী ও জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকা ছিলো খুবই বলিষ্ঠ।
৬০. ১৯৬৫ সনের যুদ্ধকালে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীর ভূমিকা
১৯৬৫ সনের অগাস্ট মাসে ভারত-অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মীরের মুক্তি পাগল মানুষেরা ভারতীয় আধিপত্য রুখে দাঁড়ায়। ভারতীয় সৈন্যদের সাথে তারা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। আযাদ কাশ্মীর থেকে কিছু সংখ্যক মুজাহিদ জম্মু ও কাশ্মীরের মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যের জন্য অগ্রসর হয়। এতে ভারতীয় সেনাবাহিনী ভীত হয়ে পড়ে এবং পাকিস্তানের একটি গ্রামে গোলাবর্ষণ করে। ফলে পাকিস্তানের সৈন্যরা আযাদ কাশ্মীরের মুজাহিদদেরকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে যায়।
এই প্রেক্ষাপটে ৬ই সেপ্টেম্বর ভারত যুদ্ধের ঘোষণা না দিয়েই আন্তর্জাতিক সীমানা অতিক্রম করে তিন দিক থেকে লাহোর আক্রমণ করে বসে। ভারতীয় সৈন্যদেরকে মুকাবিলা করার জন্য পাকিস্তানী সৈন্যরা দ্রুত রণাংগনে উপস্থিত হয়। দুই তিন দিনের মধ্যে শিয়ালকোট সেকটার ও সিনধের হায়দারাবাদ সেকটারও ভারতীয় আগ্রাসনের শিকার হয়।
৬ই সেপ্টেম্বর সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী রাওয়ালপিন্ডি ছিলেন। যুদ্ধ শুরু হওয়ার খবর শুনে তিনি লাহোরের পথে রওয়ানা হন। মাঝামাঝি পথে তিনি খবর পান যে, প্রেসিডেন্ট মুহাম্মাদ আইউব খান চান সাইয়েদ আবুল আ’লা রাওয়ালপিন্ডিতে ফিরে এসে তাঁর সাথে সাক্ষাত করুন। বিরোধী দলের অন্যান্য যাঁদেরকে প্রেসিডেন্ট ডেকেছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন চৌধুরী মুহাম্মাদ আলী, চৌধুরী গোলাম আব্বাস ও নওয়াবজাদা নাসরুল্লাহ খান।
প্রেসিডেন্ট যুদ্ধ তৎপরতায় বিরোধী দলগুলোর সহযোগিতা কামনা করেন। চৌধুরী মুহাম্মাদ আলী সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দেন। চৌধুরী গোলাম আব্বাস কাশ্মীরীদের পক্ষে ভূমিকা রাখায় সরকারের প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী এই যুদ্ধকে ‘জিহাদ’ বলে উল্লেখ করেন। তিনি আরো বলেন যে দুশমন বাহিনীকে পরাজিত করার জন্য সরকারের সাথে সহযোগিতা করা পাকিস্তানের মুসলিমদের অবশ্য কর্তব্য। সাইয়েদ আবুল আ’লার বক্তব্যে প্রেসিডেন্ট আইউব খান খুবই খুশী হন এবং রেডিও পাকিস্তান থেকে ‘আল-জিহাদ’ সম্পর্কে কয়েকটি বক্তৃতা করার জন্য তাঁকে অনুরোধ জানান।
প্রেসিডেন্ট আইউব খান সাইয়েদ আবুল আ’লার প্রতি দারুণ বিদ্বেষ পোষণ করতেন। তিনি ও তাঁর মন্ত্রীরা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীর বিরুদ্ধে মিথ্যা চালিয়ে ছিলেন। আইউব খানের নির্দেশেই দুইটি প্রাদেশিক সরকার জামায়াতে ইসলামীকে বে-আইনী ঘোষণা করেছিলো। সরকার সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী ও অন্যান্য নেতাকে অন্যায়ভাবে নয় মাস বন্দী জীবন যাপন করতে বাধ্য করেছিলো। কিন্তু জাতির দুর্যোগ মুহূর্তে প্রেসিডেন্ট আইউব খান সহযোগিতার অনুরোধ জানালে সাইয়েদ আবুল আ’লা জাতীয় স্বার্থকে সামনে রেখে অকাতরে সরকারের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। জিহাদের জন্য জাতিকে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে তিনি ১৪, ১৬ ও ১৮ই সেপ্টেম্বর রেডিও পাকিস্তান থেকে ভাষণ দেন।
ভারতের সৈন্য ছিলো পাকিস্তানের সৈন্য সংখ্যার ছয়গুণ বেশি। কিন্তু যুদ্ধে ভারতীয় সৈন্যরা পাকিস্তানের যেই পরিমাণ ভূমি দখল করেছিলো তার চারগুণ বেশি ভারত ভূমি দখল করেছিলো পাকিস্তানী সৈন্যরা। পাকিস্তানী সৈন্যরা চার শত ভারতীয় ট্যাংক ধ্বংস করতে সক্ষম হয়। তারা ভারতের একশত দশটি জংগী বিমান ভূপাতিত করে। পক্ষান্তরে পাকিস্তানের মাত্র ষোলটি জংগী বিমান ধ্বংস হয়। পাকিস্তান নৌ-বাহিনী ভারতীয় নৌ-ঘাঁটি দ্বারকা-তে আক্রমণ চালিয়ে একটি যুদ্ধ জাহাজ ধ্বংস করে। পক্ষান্তরে ভারতীয় নৌ-বাহিনী পাকিস্তানের কোন নৌ-ঘাঁটির কাছে ঘেঁষতে পারেনি।
যুদ্ধকালে পাকিস্তানে এক নীরব সামাজিক বিপ্লব ঘটে যায়। ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনিতে পাকিস্তানের আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে উঠে। একটি ইসলামী প্রেরণা গোটা জাতিকে আলোড়িত করে। মাসজিদে মুছাল্লীর সংখ্যা ব্যাপকহারে বেড়ে যায়। অ-সামাজিক কার্যকলাপ বন্ধ হয়ে যায়। চুরি-ডাকাতি অবিশ্বাস্য রকমের হারে হ্রাস পায়। খুন-খারাবী বন্ধ হয়ে যায়। দ্রবমূল্য স্থিতিশীল থাকে। জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সৈন্যদেরকে সাহায্য সহযোগিতা করতে থাকে। সরকারী কর্মচারীরা ছুটির দিনেই অফিসে কাজ করে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
সন্দেহ নেই, এই নীরব সামাজিক বিপ্লব সৃষ্টি পেছনে সাইয়েদ আবুল আ’লার অবদান ছিলো উল্লেখযোগ্য।
৬১. আযাদ কাশ্মীর সফর
১৯৬৫ সনের নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী আযাদ কাশ্মীর সফর করেন। আযাদ কাশ্মীরে এটাই ছিলো তাঁর প্রথম সফর।
২৬শে নভেম্বর আযাদ কাশ্মীরের রাজধানী মুজাফফারাবাদে অবস্থিত মুজাফফারাবাদ কলেজ ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় তিনি বক্তৃতা করেন। ২৭শে নভেম্বর তিনি রেডিও মুজাফফারাবাদ থেকে কাশ্মীরবাসীদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। তিনি ভারত কর্তৃক ন্যায়-নীতি ও আন্তর্জাতিক আইন লংঘনের সমালোচনা করেন। কাশ্মীরে গণভোট অনুষ্ঠানের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করে আঞ্চলিক শান্তির পথ রুদ্ধ করায় ভারতের তীব্র সমালোচনা করেন।
আযাদ কাশ্মীরে অবস্থানকালে যুদ্ধে আহত সৈনিকদের সেবা ও অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মীর থেকে আগত হাজার হাজার মুহাজিরের বিভিন্ন প্রয়োজন পূরণের জন্য জামায়াতে ইসলামী করণীয় নির্ণয় করেন। আযাদ কাশ্মীরের দুইটি জিলায় আটটি মেডিকেল সেন্টার কায়েমের ব্যবস্থা করেন। মুহাজিরদের মধ্যে সকল প্রকারের ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছাবার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
৬২. পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিষয়ে বক্তৃতা
১৯৬৫ সনের ১৭ই ডিসেম্বর ইসলামের অর্থনীতির ওপর বক্তৃতা করার জন্য সাইয়েদ আবুল আ’লা আমন্ত্রিত হন। এই আলোচনা সভায় বিদগ্ধ ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী ইসলামের দৃষ্টিতে অর্থনীতির বিভিন্ন দিক এমন বিশদভাবে বিশ্লেষণ করেন যে শ্রোতারা বিস্মিত ও মুগ্ধ হন। এই বক্তৃতায় তিনি ইসলামী অর্থনীতির স্বরূপ, যাকাত ব্যবস্থা, সুদবিহীন ব্যাংক, দীনী-অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক সম্পর্ক, ভূমি ব্যবস্থা, শ্রম-পুঁজি-ব্যবস্থাপনার সম্পর্ক, ব্যক্তি মালিকানা, অর্থ-সম্পদের বিনিময়, অর্থ-সম্পদ বণ্টন, একচেটিয়া ব্যবসা, মওজুদদারী, একব্যক্তির অর্থ সম্পদে অন্যদের অধিকার ইত্যাদি স্বচ্ছ ও সাবলীলভাবে উপস্থাপন করেন। তাঁর জ্ঞানগর্ভ আলোচনা ইসলামের অর্থনীতি সম্পর্কে শ্রোতাদেরকে সুস্পষ্ট ধারণা দান করে।
৬৩. তাসখন্দ চুক্তির বিরোধিতা
১৯৬৫ সনের পাক-ভারত যুদ্ধ চলেছিলো সতর দিন। রণাংগনে ভারতের দুরবস্থা দেখে ভারতের মিত্ররা সারা দুনিয়ায় তোলপাড় শুরু করে দেয়। পাকিস্তানের ওপর যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব চাপিয়ে দেয়। যুদ্ধ থেমে যায়। জোর কূটনৈতিক তৎপরতা চলতে থাকে ভারতের হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারের জন্য।
ভারতের মিত্র রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী এলেকসী কোসিগিনের আহ্বানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মুহাম্মাদ আইউব খান সংগী-সাথীদের নিয়ে গেলেন তাসখন্দ। ১৯৬৬ সনের ১০ই জানুয়ারী তাঁরা একটি শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।
চুক্তিতে ছিলো, উভয় পক্ষ সু-প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক গড়ার প্রচেষ্টা চালাবে, পারস্পরিক বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য শক্তি প্রয়োগ করা থেকে বিরত থাকবে, উভয় পক্ষ অধিকৃত এলাকা থেকে সৈন্য সরিয়ে নেবে, একে অপরের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না, এক পক্ষ অপর পক্ষের বিরুদ্ধে প্রচারাভিযান চালাবে না, উভয় দেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য-যোগাযোগ-সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান চালু হবে, যুদ্ধবন্দী বিনিময় হবে, শরণার্থী সমস্যা ও বেআইনি অভিবাসীদের বিষয়ে আলাপ-আলোচনা চালানো হবে ও পারস্পরিক স্বার্থ বিবেচনার জন্য বিভিন্ন যুক্ত কমিটি গঠিত হবে।
সবই ছিলো সেই চুক্তিতে। ছিলো না শুধু কাশ্মীর প্রসংগ যাকে কেন্দ্র করে সংঘটিত হলো এতো বড়ো যুদ্ধ। যুদ্ধের ময়দানের জয়লাভ করেও কূটনীতির ময়দানে হেরে গেলো পাকিস্তান। ১৯৬৬ সনের ১৬ই জানুয়ারী জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে একত্রিত হন সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী, চৌধুরী মুহাম্মাদ আলী, নওয়াবজাদা নাসরুল্লাহ খান, চৌধুরী মুহাম্মাদ হুসাইন চাত্তা, মালিক গোলাম জিলানী প্রমুখ বিরোধী দলীয় নেতৃবৃন্দ।
আলোচনান্তে তাঁরা একটি যুক্ত বিবৃতি তৈরী ও প্রকাশ করেন। তাঁরা বলেন যে তাসখন্দ চুক্তিতে কাশ্মীর সমস্যার উল্লেখ নেই, কাশ্মীর যে একটি বিরোধ-পূর্ণ অঞ্চল তার স্বীকৃতি পর্যন্ত নেই। অথচ স্বাক্ষরিত চুক্তি প্রকৃতপক্ষে একটি যুদ্ধ নয় চুক্তি। তারা এই চুক্তির নিন্দা করেন।
১৯৬৬ সনের ৫ ও ৬ই ফেব্রুয়ারী লাহোরে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর বড়ো আকারের একটি কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। এই কনভেনশনে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী একটি প্রস্তাব পেশ করেন। এই প্রস্তাবে তাসখন্দ চুক্তির নিন্দা করা হয়, এই চুক্তিকে কাশ্মীরের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা বলা হয় এবং বলা হয় জাতি এই চুক্তি প্রত্যাখ্যান করেছে। প্রস্তাবে আরো বলা হয় যে পাকিস্তানের জনগণ কাশ্মীরীদের আত্ম-নিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ের সংগ্রাম চালিয়ে যাবে। এই প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।
৬৪. তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে ষষ্ঠ সফর
সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী ১৯৬৬ সনের ফেব্রুয়ারী মাসের তৃতীয় সপ্তাহে পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন। এটি ছিলো এই অঞ্চলে তাঁর ষষ্ঠ সফর। তিনি প্রাদেশিক জামায়াতে ইসলামীর সম্মেলনে যোগদান করেন। তাছাড়া ঢাকা, চট্টগ্রাম, দিনাজপুর, খুলনা প্রভৃতি স্থানে জনসভায় বক্তৃতা করেন। ঢাকা ও চট্টগ্রামে তিনি প্রেস কনফারেন্সেও বক্তব্য রাখেন।
৬৫. প্রায় তিন বছর পর আবার সাউদী আরব সফর
১৯৬৪ সনের ৬ই জানুয়ারী সরকার কর্তৃক জামায়াতে ইসলামী বে-আইনী ঘোষিত হবার আগেই সরকার সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীর আন্তর্জাতিক পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করে। ফলে বেশ কয়েক বছর ধরে তিনি রাবিতাতুল আলম আল-ইসলামী সম্মেলনে অংশ নেবার জন্য মাক্কায় ও মাদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের মিটিংয়ে অংশ নেবার জন্য মাদীনায় যেতে পারেন নি। ১৯৬৫ সনের যুদ্ধ শেষ হবার পর তাঁর পাসপোর্ট ফেরত দেয়া হয়।
১৯৬৬ সনের মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে তিনি হাজ পালনের জন্য মাক্কায় আসেন। সাথে নিয়ে আসেন কাশ্মীর সমস্যার ওপর ইংরেজী ও আরবীতে ছাপানো পঞ্চাশ হাজার পুস্তিকা। এই পুস্তিকা দুনিয়ার সকল দেশ থেকে আগত শিক্ষিত ব্যক্তিদের মধ্যে বিতরণ করা হয়।
তিনি রাবিতাতুল আলম আল ইসলামী কর্তৃক আমন্ত্রিত দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে আগত প্রায় আটশত বিশিষ্ট ব্যক্তিদের এক সমাবেশে বক্তব্য রাখেন। মাক্কা ও মাদীনায় কর্মমুখর সময় কাটিয়ে তিনি দেশে ফিরেন।
৬৬. অনন্য গ্রন্থ ‘‘খিলাফাত ও রাজতন্ত্র’’ রচনা
১৯৬৬ সনে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী তাঁর অনবদ্য গ্রন্থ ‘‘খিলাফাত ও রাজতন্ত্র’’ রচনা করেন। গ্রন্থে তিনি বিশ্ব প্রকৃতি সম্পর্কে ইসলামের ধারণা, আল্লাহর সার্বভৌমত্ব, আল্লাহর রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মর্যাদা, খিলাফাতের তাৎপর্য, রাষ্ট্রের আনুগত্যের সীমা, শূরার গুরুত্ব, উলুল আমরের গুণাবলী, শাসনতন্ত্রের মৌলনীতি, মৌলিক অধিকার, নাগরিকদের ওপর সরকারের অধিকার, ইসলামী রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য, আদল-সকল মানুষের প্রতি সুবিচার, সরকারের কর্তব্য ও জওয়াবদিহিতা, নেতৃত্ব পদপ্রার্থী হওয়ার নিষিদ্ধতা, গণ-সমর্থনপুষ্ট সরকার, শূরা ভিত্তিক শাসন, বাইতুল মাল একটি আমানত, আইনের শাসন, খিলাফাতে রাশেদার বৈশিষ্ট্য, খিলাফাত থেকে রাজতন্ত্রে পরিবর্তন, খিলাফাত ও রাজতন্ত্রের পার্থক্য প্রভৃতি বিষয় অত্যন্ত সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন। এই গ্রন্থ ইসলামের রাষ্ট্র-নীতি ও রাজনীতি সম্পর্কে নানাবিধ প্রশ্নের জওয়াব সরবরাহ করেছে। আর দূর করেছে অনেক অনেক অস্পষ্টতা। ইসলামী রাষ্ট্র-চিন্তার ইতিহাসে এই গ্রন্থ একটি মাইলস্টোন।
৬৭. সাইয়েদ আবুল আ’লার চতুর্থ গ্রেফতারী
১৯৬৭ সনের ১১ই জানুয়ারী ছিলো ২৯শে রামাদান। ঐদিন আকাশ ছিলো পরিষ্কার। চাঁদ উঠলে সকল স্থান থেকেই তা দেখা যাবার কথা। কোথাও চাঁদ দেখা যায়নি। ফলে সকলে ত্রিশতম রোযা রাখার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নেয়। রাতে রেডিও থেকে ঘোষণা হলো যে সীমান্ত প্রদেশের কোন কোন স্থানে চাঁদ দেখা গেছে। অতএব আগামী কাল ঈদ।
সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী বিশিষ্ট কয়েকজন আলিমের সাথে মত বিনিময় করেন ।তাঁরা একমত হন যে সীমান্তের কোথাও যদি চাঁদ দেখা গিয়ে থাকে সেখানকার লোক ঈদ করতে পারে। কিন্তু অন্যান্য অঞ্চলে আকাশ সম্পূর্ণ মেঘমুক্ত থাকায়ও চাঁদ দেখা না যাওয়ায় এই সব অঞ্চলের লোকেরা ঈদ করতে পারেনা। একদিকে সরকারী ঘোষণা, অন্য দিকে বিশিষ্ট আলিমদের অভিমত। ফলে জনগণের একাংশ ঈদ করেন ১২ই জানুয়ারী ও অপরাংশ করেন ১৩ই জানুয়ারী। সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী ১৩ই জানুয়ারী লাহোরের গুলবাগে অনুষ্ঠিত ঈদের খুতবায় সরকারের ঘোষণার সমালোচনা করেন। সরকারী ঘোষণা সত্ত্বেও দুই দিন ঈদ হওয়ায় প্রেসিডেন্ট মুহাম্মাদ আইউব খান খুবই বিব্রত বোধ করেন।
সরকারের তল্পীবাহক ডঃ ফজলুর রহমান ঘোষণা করেন যে ঈদ সম্পর্কে সরকারের সিদ্ধান্ত মানা সকল মুসলিমের ওপর বাধ্যতামূলক এবং সরকারী ঘোষণা সত্ত্বেও যারা ঈদ পালন করেন নি তাঁদের শাস্তি হওয়া উচিত। একদল মৌলিক গণতন্ত্রী প্রেসিডেন্ট আইউব খানের সাথে সাক্ষাত করে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানায়।
১৯৬৭ সনের ২৯শে জানুয়ারী সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীকে গ্রেফতার করে পুলিশ ভ্যানে করে বান্নুতে নিয়ে গিয়ে একটি বাংলোতে আটক করে রাখা হয়। এই ইস্যুতে আরো যেই সব বিশিষ্ট আলিম বন্দী হন তাঁদের মধ্যে ছিলেন মাওলানা ইহতিশামুল হক থানবী, মুফতী মুহাম্মাদ হুসাইন নায়িমী, মাওলানা আযহার হুসাইন যায়িদী ও মাওলানা গোলাম গাউস হাজরাবী।
১৯৬৭ সনের ৩রা মার্চ সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীর পক্ষে মিঃ এ.কে. ব্রোহী, মিঃ আনোয়ার ও মিঃ জাবিদ ইকবাল হাইকোর্টে রীট পিটিশন দায়ের করেন। ষ্পষ্টত প্রতীয়মান হচ্ছিলো যে মামলার রায় সরকারের বিপক্ষে যাবে। ফলে ১৫ই মার্চ পুলিশ ভ্যানে করে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীকে বান্নু থেকে লাহোরে এনে ছেড়ে দেয়া হয়। সাইয়েদ আবুল আ’লা অর্জন করেন আরেকটি নৈতিক বিজয়।
৬৮. ‘পাকিস্তান ডিমোক্রেটিক মুভমেন্ট’
তাসখন্দ চুক্তি স্বাক্ষরের পর প্রেসিডেন্ট মুহাম্মাদ আইউব খান ও বিরোধী দলগুলোর মধ্যে আবার দূরত্ব সৃষ্টি হয়। প্রেসিডেন্ট মুহাম্মাদ আইউব খান শাসনতন্ত্র গণতন্ত্রায়নের পথে এগুলেন না। তাঁর শাসনকালের গৌরব-গাথা মানুষকে গেলাবার জন্য ‘উন্নয়ন দশক’ পালন করলেন। লাভ কিছুই হলো না। গণ মানুষকে বোকা বানানো গেলোনা। শাসক ও শাসিতের ব্যবধান আরো বেড়ে গেলো।
১৯৬৬ সনের ৬ই ফেব্রুয়ারী লাহোরে বিরোধী দলের নেতৃবৃন্দের সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ‘‘ছয় দফার’’ কপি বিতরণ করেন। তিনি নেতৃবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হন। তবে তিনি তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে ‘‘ছয় দফার’’ প্রতি জনসমর্থন আদায়ের চেষ্টা চালাতে থাকেন।
১৯৬৭ সনের ৩০ শে এপ্রিল ঢাকাতে জনাব আতাউর রহমান খানের বাসভবনে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের জনাব নূরুল আমীন, হামিদুল হক চৌধুরী, আতাউর রাহমান খান, মুসলিম লীগের মুমতাজ মুহাম্মাদ খান দাওলাতানা, তোফাজ্জল আলী, খাজা খায়ের উদ্দীন, জামায়াতে ইসলামীর মিয়া তুফাইল মুহাম্মাদ, মাওলানা আবদুর রহীম, অধ্যাপক গোলাম আযম, আওয়ামী লীগের নওয়াবজাদা নাসরুল্লাহ খান, আবদুস সালাম খান, গোলাম মুহাম্মাদ খান লুন্দখোর এবং নেজামে ইসলাম পার্টির চৌধুরী মুহাম্মাদ আলী, মৌলভী ফরিদ আহমাদ ও এম আর খান সূচনা করেন ‘‘পাকিস্তান ডিমোক্রেটিক মুভমেন্ট।’’
উল্লেখ্য যে, ‘পাকিস্তান ডিমোক্রেটিক মুভমেন্ট’ (পিডিএম) গঠন প্রশ্নে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়।
মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ ও রাজশাহীর মুজীবুর রহমান পরিচালিত আওয়ামী লীগ ‘পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্টের’ অন্তর্ভুক্ত থাকে। আর শেখ মুজিবুর রহমান ও রাজশাহীর কামারুজ্জামান পরিচালিত আওয়ামী লীগ আলাদাভাবে ‘ছয় দফা’ ভিত্তিক আন্দোলন চালাতে থাকে।
৬৯. তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান সাইয়েদ মওদূদীর সপ্তম সফর
আইউব খান বিরোধী আন্দোলকে তীব্রতর করার জন্য পিডিএম নেতৃবৃন্দ সারা দেশ সফর করেন। ১৯৬৭ সনের ২৪শে নভেম্বর অন্যান্য নেতাদের সাথে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী ঢাকা আসেন। তাঁরা ঢাকা ও চট্টগ্রামের জনসভায় পিডিএম এর আট দফা ব্যাখ্যা করে বক্তব্য রাখেন।
৭০. তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে সাইয়েদ মওদূদীর অষ্টম সফর
১৯৬৮ সনের ২১শে ফেব্রুয়ারী সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী ঢাকা আসেন। অতপর তিনি চৌমুহনী সফর করেন ও এক জনসভায় ভাষণ দেন। ২৬শে ফেব্রুয়ারী তিনি ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনষ্টিটউটে এক সুধী সমাবেশে বক্তব্য রাখেন। ১লা মার্চ তিনি ইসলামী ছাত্র সংঘের সম্মেলনে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা রাখেন।
৭১. সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীর লন্ডন সফর
বহু বছর আগে থেকেই সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী কিডনীর যন্ত্রণায় ভুগছিলেন। স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটায় তিনি চিকিৎসার জন্য লণ্ডন যাবার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৬৮ সনের ২৪শে অগাস্ট তিনি করাচী থেকে লন্ডনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন ও ২৫শে অগাস্ট লন্ডন পৌঁছেন।
২রা সেপ্টেম্বর তিনি ইউ.কে ইসলামিক মিশনের বার্ষিক সম্মেলনে যোগদান করেন ও দিক-নির্দেশনামূলক বক্তব্য রাখেন।
অতপর তিনি ডাক্তার বেইড নক এর ক্লিনিকে ভর্তি হন। আনুষঙ্গিক চেক আপের পর তাঁর মূত্রথলিতে অপারেশন করা হয় ৯ই সেপ্টেম্বর। ২২শে সেপ্টেম্বর বাম কিডনীর অপারেশন সম্পন্ন হয়। তিন সপ্তাহ ক্লিনিকে থাকেন। বেশ কয়েক সপ্তাহ তাঁকে থাকতে হয় লন্ডনে। এই সময় দেশ-বিদেশের বহু ইসলামী ব্যক্তিত্ব তাঁর সাথে সাক্ষাত ও আলাপ করেন। অতপর তিনি দেশে ফিরে আসেন।
৭২. গণ–বিস্ফোরণের মুখে আইউব খানে নতি স্বীকার ও সাইয়েদ আবুল আ’লার দিক–নির্দেশনামূলক ভাষণ
বছরের পর বছর ধরে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো আইউব খানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিলো।
১৯৬৮ সনের নভেম্বর মাসে পশ্চিম পাকিস্তানে ছাত্ররা ব্যাপকহারে মাঠে নেমে পড়ে। পশ্চিম পাকিস্তানের ছাত্র আন্দোলনের ঢেউ লাগে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানেও। ১৯৬৯ সনের ৭ই জানুয়ারী ঢাকার সকল স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিক্ষোভ মিছিল বের করে।
১৯৬৯ সনের ৭ ও ৮ই জানুয়ারী ঢাকাতে অনুষ্ঠিত মিটিংয়ের পর নেজামে ইসলাম পার্টির সভাপতি চৌধুরী মুহাম্মাদ আলী, পাকিস্তান আওয়ামী লীগের (৮ দফা পন্থী) সভাপতি নওয়াবজাদা নাসরুল্লাহ খান, জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমীর মিয়া তুফাইল মুহাম্মাদ, ন্যাশনাল ডিমোক্রেটিক ফ্রন্টের সভাপতি নূরুল আমীন, মুসলিম লীগের সভাপতি মুমতাজ মুহাম্মাদ খান দাওলাতানা, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের (৬ দফা পন্থী) ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সেক্রেটারী জেনারেল মুফতী মাহমুদ ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আমীর হুসাইন শহ নিম্নোক্ত আট দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে গঠন করেন ডিমোক্রেটিক এ্যাকশান কমিটি (DAC).
আট দফা-
১. ফেডারেল পার্লামেন্টারী সরকার,
২. প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ নির্বাচন,
৩. অবিলম্বে জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার,
৪. নাগরিক স্বাধীনতা পুনর্বহাল ও সকল কলাকানুন বাতিল ও বিশেষ করে বিনা বিচারে আটকের আইন ও বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স বাতিল,
৫. শেখ মুজিবুর রহমান, খান আবদুল ওয়ালী খান, জুলফিকার আলী ভুট্টোসহ সকল রাজনৈতিক বন্দী, ছাত্র-শ্রমিক-সাংবাদিক বন্দীদের মুক্তি এবং কোর্ট ও ট্রাইব্যুনালে দায়েরকৃত মামলা সংক্রান্ত গ্রেফতারী পরোয়ানা প্রত্যাহার,
৬. ১৪৪ ধারার সকল আদেশ প্রত্যাহার,
৭. শ্রমিকদের ধর্মঘট করার অধিকার বহাল,
৮. নতুন ডিক্লারেশনসহ সংবাদপত্রের উপর আরোপিত সকল নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং বাজেয়াপ্ত সকল প্রেস, পত্রিকা ও সাময়িকীর পুনর্বহাল।
৯ই জানুয়ারী লাহোরের ছাত্ররা গণ-মিছিল বের করে। মুলতানের ছাত্রদের ওপর পুলিশ হামলা চালায়। ১০ই জানুয়ারী মুলতানের মহিলা কলেজের ছাত্রীরা মিছিলে যোগ দেয়। ১১ জানুয়ারী রাওয়ালপিন্ডিতে মহিলাদের মিছিল বের হয়।
১২ই জানুয়ারী ‘ডিমোক্রেটিক এ্যাকশান’ কমিটির ডাকে সারাদেশে হরতাল পালিত হয। ঐদিনই অবসরপ্রাপ্ত লেঃ জেনারেল মুহাম্মাদ আযম খান শাসনতন্ত্রের গণতন্ত্রায়নের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। ১৩ই জানুয়ারী অবসরপ্রাপ্ত এয়ার মার্শাল আসগার খান বিবৃতি দিয়ে বলেন যে, আইউব সরকারের আর দেশ পরিচালনার অধিকার নেই। ১৭ই জানুয়ারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশ হামলা চালায়। ১৭ ও ১৮ই জানুয়ারী ঢাকা মহানগরী ছাত্রদের মিছিলের নগরীতে পরিণত হয়। ২০শে জানুয়ারী সরকারী বাহিনীর গুলিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র আসাদুজ্জামান নিহত হয়। ঢাকায় এক বিশাল গণ মিছিল বের হয়। ২২শে জানুয়ারী রাওয়ালপিন্ডি ও হায়দারাবাদে জনতার ওপর পুলিশ লাঠি চার্জ করে। সেই দিন ঢাকার প্রায় দশ হাজার ছাত্রের বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। ২৭শে জানুয়ারী লাহোর ও করাচীতে সেনাবাহিনী নামিয়ে কারফউ দেয়া হয়। ২৮শে জানুয়ারী পেশাওয়ার শহর তুলে দেয়া হয় সেনাবাহিনীর হাতে। ৩১শে জানুয়ারী ‘ডিমোক্রেটিক এ্যাকশান কমিটির’ আহ্বানে সারাদেশে শোক দিবস পালিত হয়।
এইভাবে একের পর এক ঘটতে থাকে ঘটনা। কিছু উগ্রপন্থী গ্রুপ সহিংস কর্মকাণ্ড সংঘটিত করে। সরকার দেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। লৌহ-মানব আইউব খান সুস্পষ্ট ভাবে দেখতে পেলেন দেয়ালের লিখন।
১৯৬৯ সনে ১৪ই ফেব্রুয়ারী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে মুক্তি দেয়া হয়।
১৯৬৯ সনের ২১শে ফেব্রুয়ারী প্রেসিডেন্ট মুহাম্মাদ আইউব খান জাতির উদ্দেশ্যে এক রেডিও ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি বলেন যে তিনি যেই রাজনৈতিক পদ্ধতি চালু করেছিলেন তার উদ্দেশ্য ছিলো দেশের স্থিতিশীলতা ও জনগণের সমৃদ্ধি অর্জন। নিজের ক্ষমতা স্থায়ী করার জন্য তিনি এটি করেন নি। যেহেতু জনগণ সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচন চায়, তিনি বিষয়টি নিয়ে সকল রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনা করতে চান। আর ভুল বুঝাবুঝির অবসানের জন্য তিনি ঘোষণা করেন যে পরবর্তী নির্বাচনে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না।
১৯৬৯ সনের ২২শে জানুয়ারী ১৯৬৮ সনের জানুয়ারী মাস থেকে শেখ মুজিবুর রহমানরহ পঁয়ত্রিশ ব্যক্তির বিরুদ্ধে পরিচালিত ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ প্রত্যাহার করে নেয়া হয়।
১৯৬৯ সনের ২২ ফেব্রুয়ারী রাওয়ালপিন্ডিতে এক ছাত্র সমাবেশে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন। বক্তৃতায় তিনি বলেন যে সামরিক শক্তি বলে ক্ষমতা দখলকারী কোন ব্যক্তিকে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করা কঠিন। পাকিস্তানের জনগণকে আল্লাহ মহা বিজয় দান করেছেন। তাঁদের কর্তব্য আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা। প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেছেন তিনি আর নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না। ফলে এখন জনগণের ওপর এক বিরাট দায়িত্ব এসে পড়েছে। এখন তাদের কর্তব্য দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা। দেশের নেতৃত্ব প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে পরিবর্তন করা ও একটি দায়িত্বশীল পার্লামেন্ট গঠন করা।
ঐ দিন সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী রাওয়ালপিন্ডিতে জামায়াতে ইসলামীর এক কর্মী সমাবেশেও বক্তব্য রাখেন। বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘‘দুনিয়াবাসীকে আমরা জানিয়ে দিতে চাই যে পাকিস্তান ইসলামের দুর্গ। এখানে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। আমরা যেমন একনায়কতন্ত্র বরদাশত করব না, তেমনি বরদাশত করবো না ভিন্ন কোন মতবাদ।’’
৭৩. রাউন্ড টেবিল কনফারেন্সে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী
১৯৬৯ সনের ২৬শে ফেব্রুয়ারী রাওয়ালপিন্ডিতে ‘রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স’ শুরু হয়। এই কনফারেন্সে প্রেসিডেন্ট মুহাম্মাদ আইউব খানের নেতৃত্বে পনর ব্যক্তি, ডিমোক্রেটিক এ্যাকশান কমিটির পক্ষ থেকে নওয়াবজাদা নাসরুল্লাহ খান, চৌধুরী মুহাম্মাদ আলী, সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী, অধ্যাপক গোলাম আযম, নূরুল আমীন, মুমতাজ মুহাম্মাদ খান দাওলাতানা, খাজা খায়েরুদ্দিন, মুফতী মাহমুদ, পীর মুহসিনুদ্দিন, আবদুস সালাম খান, মৌলভী ফরিদ আহমদ, খান আবদুল ওয়ালী খান, অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ, হামিদুল হক চৌধুরী, মাহমুদ আলী, শেখ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ এবং নির্দলীয় অবসরপ্রাপ্ত এয়ার মার্শাল আসগার খান ও বিচারপতি এস.এম. মোরশেদ যোগদান করেন। অবসরপ্রাপ্ত লেঃ জেঃ মুহাম্মদ আযম খান আমন্ত্রিত ছিলেন। রাওয়ালপিন্ডিতে থাকা সত্ত্বেও তিনি কনফারেন্সে যোগ দেন নি।
পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো ও পিকিংপন্থী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি প্রধান মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন।
২৬শে ফেব্রুয়ারী ‘রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স’ শুরু হলেও ঈদুল আযহার জন্য ১০ই মার্চ পর্যন্ত মূলতবী হয়ে যায়। অতপর ১০ই মার্চ থেকে ১৩ই মার্চ পর্যন্ত বৈঠক চলে।
‘ডিমোক্রেটিক এ্যাকশান কমিটির’ আহ্বায়াক নওয়াবজাদা নাসরুল্লাহ খান আঞ্চলিক স্বয়ত্ত্বশাসন, ফেডারেল পার্লামেন্টারী সরকার পদ্ধতি প্রবর্তন ও প্রাপ্ত বয়স্কদের প্রত্যক্ষ ভোটে আইন পরিষদের নির্বাচনের দাবি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন। শেখ মুজিবুর রহমান আঞ্চলিক স্বয়ত্ব শাসন, দুই মুদ্রা প্রবর্তন অথবা একই মুদ্রা রেখে প্রত্যেক অঞ্চলে আলাদা রিজার্ভ ব্যাংক স্থাপন, দেশের পররাষ্ট্রনীতির নিরিখে বৈদেশিক বাণিজ্য ও বৈদেশিক সাহায্য নিগোশিয়েট করার ক্ষমতা আঞ্চলিক সরকারগুলোর হাতে অর্পণ, কর ধার্য ও আদায় করার ক্ষমতা আঞ্চলিক সরকারগুলোর হাতে প্রদান ও কেন্দ্রীয় সরকারকে আঞ্চলিক সরকারগুলো নিকট থেকে কর আদায়ের ক্ষমতা দান, পশ্চিম পাকিস্তানের এক ইউনিট বাতিল বা সাব-ফেডারেশান গঠন ইত্যাদি বিষয় বিশ্লেষণ করে বক্তব্য রাখেন।
সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী তাঁর বক্তৃতায় বলেন যে, ‘‘পাকিস্তান অর্জিত হয়েছিলো ইসলামের নামে, অথচ ইসলামী জীবন বিধান কায়েম করা হয়নি, ফলে এই দেশ অসংখ্য সমস্যার দেশে পরিণত হয়েছে। জন-প্রতিনিধিরা যদি প্রথমে মুসলিম ও পরে অন্য কিছু হতেন তাহলে সংখ্যা সাম্য, আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন ও আনুষঙ্গিক অন্য সব বিষয়ের উদ্ভব ঘটতো না। এমন কি ফেডারেল সরকার পদ্ধতিরও প্রয়োজন হতো না। ইসলামের জীবন পদ্ধতি কায়েম হলে সামন্তবাদ ও পুঁজিবাদ সৃষ্ট সকল অন্যায় অবিচার বিদূরিত হতো। শাসনতন্ত্রের কয়েকটি সংশোধনী আমাদেরকে বেশি দূর নিয়ে যেতে পারবে না। প্রয়োজন আইনগত, নৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক সামগ্রিক সংস্কার। এই লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্যই আমরা প্রথমে গণতন্ত্রে উত্তরণ চাই। গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও বাক স্বাধীনতা না থাকলে জনগণকে ইসলামের আলোকে শিক্ষাদান করা কঠিন। যেই সব সমস্যা সমাজকে জর্জরিত করছে তার সমাধান একদিনে সম্ভব নয়। এর জন্য যথেষ্ট সময়ের প্রয়েজন। এই জন্য প্রথমে চাই প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সরাসরি নির্বাচন ও ফেডারেল পার্লামেন্টারী সরকার পদ্ধতির প্রবর্তন।’’
প্রেসিডেন্ট মুহাম্মাদ আইউব খান ১৩ই মার্চ ‘রাউন্ড টেবিল কনফারেন্সের’ সমাপ্তি কালে প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটে জনপ্রতিনিধিদের নির্বাচন ও ফেডারেল পার্লামেন্টারী সরকার প্রবর্তনের দাবি মেনে নেয়ার ঘোষণা দেন।
‘রাউন্ড টেবিল কনফারেন্সের পর ‘ডিমোক্রেটিক এ্যাকশান কমিটি’ প্রেসিডেন্টের ঘোষণা বিবেচনা করার জন্য মিটিং করে। শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ছয় দফা সমর্থন না করায় পূর্বাহ্নেই ‘ডিমোক্রেটিক এ্যাকশান কমিটির’ সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। মস্কোপন্থী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি প্রতিনিধি ডিমোক্রেটিক এ্যাকশান কমিটির মিটিংয়ে যোগ দেননি।
আন্দোলনের লক্ষ্য অর্জিত হওয়ায় ডিমোক্রেটিক এ্যাকশন কমিটির বিলুপ্তি ঘোষণা করা হয়।
৭৪. উগ্রপন্থীদের অপ–রাজনীতি
একতান্ত্রিক শাসন থেকে দেশ গণতান্ত্রিক শাসনের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো দেশ। উগ্রপন্থীরা এই উজ্জ্বল সম্ভাবনা বিনাশ করে দেয়।
দেশের সর্বত্র ঘেরাও আন্দোলন চলতে থাকে। চলতে থাকে জ্বালাও-পোড়াও অভিযান। হত্যা, আগুন লাগানো, নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। সেক্রেটারিয়েটে হরতাল, ছাত্রদের হরতাল, শিক্ষকদের হরতাল ও শ্রমিকদের হরতাল চলতে থাকে। ভিন্ন মতাবলম্বী রাজনীতিবিদদের ওপর হামলা চালানো হয়। আইন শৃঙ্খলার চরম অবনতি ঘটে। প্রশাসন ভেংগে পড়ে। সর্বত্র ত্রাস ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। দেশে কোন সরকার আছে বলে মনে হচ্ছিলো না।
৭৫. আবার অ–সাংবিধানিক শাসনের কবলে পাকিস্তান
এই নাজুক অবস্থায় প্রেসিডেন্ট মুহাম্মাদ আইউব খান দেশে সামরিক শাসন জারি করতে চান সেনাপ্রধান জেনারেল আগা মুহাম্মাদ খান তাঁকে জানিয়ে দেন যে সামরিক শাসন জারি করতে হলে তা করবে সেনাবাহিনী। এই কথার অর্থ বুঝতে প্রেসিডেন্টের কষ্ট হয়নি। ১৯৬৯ সনের ২৪শে মার্চ প্রেসিডেন্ট মুহাম্মাদ আইউব খান এক চিঠির মাধ্যমে সেনাপ্রধানকে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব ভার গ্রহণ করার অনুরোধ জানান।
১৯৬৯ সনের ২৫শে মার্চ সন্ধ্যা সোয়া সাতটায় জেনারেল আগা মুহাম্মাদ ইয়াহইয়া খান দেশে সামরিক শাসন জারি করেন। তিনি শাসনতন্ত্র বাতিল করেন। জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদগুলো ভেংগে দেন। প্রকাশ্য রাজনৈতিক তৎপরতার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়। ৩১শে মার্চের এক ঘোষণা অনুযায়ী চীফ মার্শাল ল এডমিনিষ্ট্রেটর জেনারেল আগা মুহাম্মাদ ইয়াহইয়া খান ২৫শে মার্চ সন্ধ্যা সোয়া সাতটা থেকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভারও হাতে তুলে নেন। এইভাবে তিনি হন পাকিস্তানের তৃতীয় প্রেসিডেন্ট।
৭৬. সাইয়েদ আবুল আ’লার তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে নবম সফর
১৯৬৯ সনের ১৪ই জুন সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী ঢাকা আসেন। ১৫ই জুন ঢাকায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনষ্টিটউটে অনুষ্ঠিত এক সীরাত সম্মেলনে তিনি বক্তব্য রাখেন। দুই সপ্তাহ সফর করে তিনি লাহোর ফিরেন।
৭৭. মরক্কোতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শিক্ষা সম্মেলনে যোগদান
১৯৬৯ সনের ১৩ই সেপ্টেম্বর রাতে এয়ার ফ্রান্সের প্লেনে চড়ে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী প্যারিস রওয়ানা হন। প্যারিস থেকে মরক্কো এয়ার লাইনসের প্লেনে করে তিনি ১৪ই সেপ্টেম্বর রাবাত পৌঁছেন। রাতে রাবাতে অবস্থান করে তিনি ১৫ই সেপ্টেম্বর ফাস পৌঁছেন। এখানেই অনুষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক শিক্ষা সম্মেলন।
সাইয়েদ আবুল আ’লা খুবই অসুস্থ ছিলেন। তিনি এই সম্মেলনে যেতে চাননি। কিন্তু মরক্কোর শিক্ষামন্ত্রী তাঁকে অনুরোধ জানান। অগত্যা তিনি সফরের প্রস্তুতি নেন। তাঁর সফরসংগী ছিলেন খলীল আহমাদ হামিদী।
আন্তর্জাতিক শিক্ষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছিলো কাইরোয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে। এই কাইরোয়ান বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো নবম শতাব্দীতে। অর্থাৎ এগার শত বছর আগে।
এই সম্মেলনে ২০টি দেশের বিশিষ্ট ইসালামী চিন্তাবিদরা যোগদান করেন। সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য পেশ করেন। বক্তৃতায় তিনি বলেন যে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় উন্নত মানের স্কলার তৈরী করতে হবে যারা হবে মূলত নিষ্ঠাবান মুসলিম। জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে ইসলামের নৈতিক মূল্যবোধ সম্পৃক্ত করতে হবে, বিদ্বেষবশত পশ্চিতের প্রাচ্যবিদরা ইসলামের যেই বিকৃত রূপ পেশ করেছে তার মুকাবিলায় ইসলামের আসল রূপ তুলে ধরতে হবে এবং উচ্চ শিক্ষার জন্য মুসলিম দেশগুলো থেকে যেই সব ছাত্র পশ্চিমের দেশগুলোতে যায় তাদেরকে ইসলামবিরোধী চিন্তাধারা থেকে বাঁচিয়ে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।
৭৮. প্রথম ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনে যোগদান
১৯৬৯ সনের ২২শে সেপ্টেম্বর মরক্কোর রাজধানী রাবাতে দুনিয়ার মুসলিম দেশগুলোর রাষ্ট্রপ্রধান-সরকার প্রধানদের প্রথম শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সন্দেহ নেই, এটি ছিলো বিশ শতকের মুসলিম উম্মাহর জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ। ইরাক ও সিরিয়া ছাড়া বাকি মুসলিম দেশগুলো এই সম্মেলনে অংশ নেয়।
আন্তর্জাতিক শিক্ষা সম্মেলনে যোগদানের জন্য বিশটি দেশের যেই সব প্রখ্যাত ব্যক্তি মরক্কো এসেছিলেন শীর্ষ সম্মেলনেও তাঁদেরকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিলো। সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীও এই সম্মান লাভ করেন। তবে স্বাস্থ্যের অবনতির কারণে তিনি শীর্ষ সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশন ছাড়া আর কোন অধিবেশনে থাকতে পারেননি।
মরক্কো থেকে তিনি লন্ডন পৌঁছেন ২৩শে সেপ্টেম্বর। ২৪শে সেপ্টেম্বর তিনি ইস্ট লন্ডন মাসজিদে সমবেত মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন।
লন্ডনে অবস্থানকালে তাঁর মেডিকেল চেক-আপ সম্পন্ন হয়। তিনি ২৭শে সেপ্টেম্বর লন্ডন থেকে রওয়ানা হয়ে ২৮শে সেপ্টেম্বর করাচী পৌঁছেন। সেখান থেকে রাতে পৌঁছেন লাহোর।
২৯শে সেপ্টেম্বর তিনি লাহোরে একটি প্রেস কনফারেন্সে বক্তব্য রাখেন। এতে তিনি আন্তর্জাতিক শিক্ষা সম্মেলনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন এবং বলেন যে শিক্ষা সম্মেলনের প্রধান প্রস্তাবে মুসলিম দেশগুলোতে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
ইসলামী শীর্ষ সম্মেলন সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বলেন যে যদি নিয়মিতভাবে এই শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে থাকে তাহলে এক সময় তা ‘মুসলিম ইউনাইটেড নেশানসে’ পরিণত হতে পারে।
৭৯. সাউদী আরবে সর্বশেষ সফর
১৯৬৯ সনের অক্টোবর মাসে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীর রাবিতাতুল-আলম-আল ইসলামীর মিটিংয়ে যোগদান করার জন্য সাউদী আরব আসেন। মিটিংয়ে যোগদান, বিভিন্ন ব্যক্তিদের সাথে সাক্ষাত, মাক্কা ও মাদীনায় পালনীয় কাজগুলো সম্পন্ন করে তিনি দেশে ফিরেন ৩১শে অক্টোবর।
৮০. তদানীন্তন পূর্ব–পাকিস্তানে সাইয়েদ আবুল আ’লার দশম সফর
ইতোমধ্যে প্রেসিডেন্ট আগা মুহাম্মাদ ইয়াহইয়া খান ঘোষণা করেন যে ১৯৭০ সনের অক্টোবর মাসে দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ১৯৭০ সনের ১লা জানুয়ারী প্রকাশ্য রাজনৈতিক তৎপরতা চালানোর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়। ৪ঠা জানুয়ারী এক বিবৃতির মাধ্যমে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী সরকারের এই সিদ্ধান্তকে অভিনন্দিত করেন।
১৯৭০ সনের ১৭ই জানুয়ারী সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী ঢাকা পৌঁছেন। ১৮ই জানুয়ারী পল্টন ময়দানে তাঁর বক্তৃতা করার কথা। যথাসময়ে জামায়াতে ইসলামী স্থানীয় নেতৃবৃন্দ জনসভার কাজ শুরু করেন। ইসলাম বিদ্বেষী একটি রাজনৈতিক দল এই জনসভা পণ্ড করার সিদ্ধান্ত নেয়। লাঠি হাতে ও ইট পাটকেল নিয়ে গ্রুপ গ্রুপে সেই দলের কর্মীরা বিভিন্ন দিক থেকে পল্টন ময়দানে ঢুকে জনসভার ওপর হামলা চালায়। জামায়াতে ইসলামীর কর্মীরা এই হামলা ঠেকাবার চেষ্টা করে। দীর্ঘ সময় ধরে চলে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া। একের পর এক আহত হতে থাকে জামায়াতে ইসলামীর কর্মীরা। আহতের সংখ্যা পাঁচশত ছাড়িয়ে যায়। দুইজন ছাত্র শাহাদাত বরণ করেন। ঢাকার জিলা প্রশাসক ছিলেন একজন কাদিয়ানী। তিনি পুলিশ পাঠালেন বটে। তারা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। লাঠিধারীরা জনসভা ভেংগে দিতে সক্ষম হওয়ার পর পুলিশকে সক্রিয় হতে দেখা গেছে। নির্দিষ্ট সময়ে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী পল্টন ময়দানের গেটে পৌঁছেন। অবস্থার নাজুকতা লক্ষ্য করে ড্রাইভার তাঁকে তার অবস্থানস্থলে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। ২১শে জানুয়ারী তিনি করাচী পৌঁছেন।
৮১. তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে সাইয়েদ আবুল আ’লার একাদশ ও সর্বশেষ সফর
১৯৭০ সনের ২৮শে জুন সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী একাদশ বারের মতো তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান সফর করেন। এটাই ছিলো পূর্ব পাকিস্তানে তাঁর সর্বশেষ সফর। এই সফরে এসে আসন্ন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য নমিনি তালিকা চূড়ান্ত করতে তিনি পার্লামেন্টারী বোর্ডের মিটিংয়ে যোগ দেন। ঢাকার এক কর্মী সমাবেশেও তিনি বক্তব্য রাখেন। ৩রা জুলাই তিনি লাহোর ফিরে যান।
৮২. সাইয়েদ মওদূদীকে হত্যার উদ্যোগ
সারগোদা জিলার জাওহারাবাদে সমাজতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন কয়েকজন আলিম এক জনসভার সাইয়েদ আবুল আ’লার বিরুদ্ধে বিষোদগার করে বক্তৃতা করেন। তাঁরা তাঁকে সাহাবীদের শান বিনষ্টকারী হিসেবে আখ্যায়িত করে শ্রোতাদেরকে তাঁর প্রতি বিরূপ মনোভাবাপন্ন করে তোলার চেষ্টা চালান। তাঁদের বক্তব্য সত্য মনে করে জাওহারাবাদের এক যুবক খুবই বিক্ষুব্ধ হয়। সে সিদ্ধান্ত নেয় যে সাইয়েদ আবুল আ’লাকে হত্যা করতে হবে।
সেই যুবকের নাম ছিলো জাহিদ ইকবাল। দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে সে জাওহারাবাদ থেকে লাহোর আসে। সে সাথে নিয়ে আসে একটি ধারালো ছোরা। সে যখন ৫-ই যাইলদার পার্কে পৌঁছে তখন ছালাতুল আছরের সময় হয়ে গেছে। সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী বাসা থেকে বেরিয়ে এসে ছালাতুল আছরের ইমামত করেন। জাহিদ ইকবালও জামায়াতে শরীক হয়। ছালাতুল আছরের পর সাইয়েদ আবুল আ’লা বাড়ির চত্বরে সাজানো চেয়ারের একটিতে বসে পড়েন। অন্যরা চেয়ার নিয়ে তাকে ঘিরে বসে পড়ে।
জাহিদ ইকবাল সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীর পেছনে দাঁড়িয়ে তার লুক্কায়িত ছোরার বাঁট চেপে ধরে। এমন সময় তার দৃষ্টি পড়ে সাইয়েদের পূর্ণ চেহারার ওপর। তার মনে খানিকটা ভাবান্তর সৃষ্টি হয়। সে কিছুক্ষণ অপেক্ষ করার সিদ্ধান্ত নেয়। শ্রোতাদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলো, ‘‘সমাজতন্ত্রী গ্রপের আলিমরা আপনাকে গালমন্দ করে, আপনি কেন তাদের জওয়াব দেন না?’’ সাইয়েদ আবুল আ’লা উত্তর দেন, ‘‘শেষাবধি সত্যই বিজয়ী হয়, আমি যা লিখছি তার পক্ষে যুক্তি প্রমাণও পেশ করছি। গালির বদলে গালি দেয়া ইসলামের বিধান নয় এবং জনগণ তাদের বিবেক ব্যবহার করে দেখবে সত্য কোথায় অবস্থান করছে।’’ এই সব কথা শুনার পর জাহিদ ইকবালের বিবেক জেগে ওঠে। সে অনুভব করতে শুরু করে যে সত্য তো এখানে। তাকে যারা গালমন্দ করছেন তাঁরাই মিথ্যাবাদী।
হঠাৎ জাহিদ ইকবাল বসে পদে সাইয়েদ আবুল আ’লার পা জড়িয়ে ধরে। সাইয়েদ মওদূদী তাকে টেনে তুলে সে এমনটি করছে কেন জানতে চান। জাহিদ ইকবাল বললো, ‘‘আপনি আমাকে ক্ষমা করুন, আমি আপনাকে হত্যা করতে এসেছিলাম।’’ সাইয়েদ মওদূদী বললেন, ‘‘এই তো আমি, তুমি তোমার কর্তব্য পালন করতে পার।’’
কয়েকজন লোক ছুটে আসেন জাহিদ ইকবালকে পাকড়াও করতে। সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী তাঁদেরকে থামিয়ে দেন। জাহিদ ইকবালের বিমর্ষ চেহারার দিকে তাকিয়ে সাইয়েদ আবুল আ’লা বললেন, ‘‘মনে হচ্ছে তুমি দুপুরের খাওয়া খাওনি।’’ তার জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা হলো। জাহিদ ইকবাল এসেছিলো সাইয়েদ আবুল আ’লাকে হত্যা করতে। সত্যের সাথে পরিচিত হয়ে সে শামিল হয় সাইয়েদ আবুল আ’লার সহকর্মীদের কাতারে।
৮৩. ১৯৭০ সনের নির্বাচনী মেনিফেস্টো ঘোষণা
১৯৭০ সনের সাধারণ নির্বাচনের আগে শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ছয় দফার প্রতি সমর্থন আদায়ের জন্য পূর্ব পাকিস্তান চষে বেড়াতে থাকেন। মস্কোপন্থী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি খান আবদুল ওয়ালী খান ও অধ্যাপক মুজাফফর আহমাদ ‘সমাজতন্ত্রের’ পক্ষে জনমত সৃষ্টির চেষ্টা চালাতে থাকেন। পশ্চিম পাকিস্তানে পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো জোরেসোরে বলতে লাগলেন যে পাকিস্তানে ‘ইসলামী সমাজতন্ত্র’ কায়েম করতে হবে। পিকিং পন্থী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীও আওয়াজ তুললেন যে পাকিস্তানে ‘ইসলামী সমাজতন্ত্র’ কায়েম করতে হবে। মাওলানা ভাসানী নির্বাচন বয়কট করে জনগণের উদ্দেশ্যে আহ্বান জানালেন ‘‘তোমরা যদি বাঁচতে চাও হাতিয়ার হাতে তুলে নাও।’’ সরদার আবদুল কাইউম খান, মিয়া মুমতাজ মুহাম্মাদ খান দাওলাতানা প্রমুখ মুসলিম জাতীয়তাবাদের পতাকাবাহী রূপে প্রচার কাজ চালাতে থাকেন। সাইয়েদ আবুল আ’লার নেতৃত্বে জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানকে ইসলামী কল্যাণরাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্যে জনসমর্থন আদায়ের চেষ্টা চালাতে থাকে। নির্বাচনের পূর্বে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকে রেডিও-টেলিভিশনে বক্তৃতা করার সুযোগ দেয়া হয়। ১৯৭০ সনের ৩রা নভেম্বর সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী রেডিও-টেলিভিশনের মাধ্যমে জামায়াতে ইসলামীর নির্বাচনী মেনিফেস্টো জনগণের সামনে পেশ করেন।
৮৪. তাফসীর তাফহীমুল কুরআন সমাপ্তকরণ
লেখার জগতে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীর শ্রেষ্ঠ অবদান তাফসীর তাফহীমুল কুরআন। তিনি ইসলামী দাওয়াতের গাইড বুক আল কুরআনের তাফসীর প্রঞ্জল ভাষায় তথ্য সমৃদ্ধ ও আকর্ষণীয় রূপে উপস্থাপন করেন। তাফসীর তাফহীমুল কুরআন তাঁর ত্রিশ বছরের অধ্যয়ন ও গবেষণার ফসল। প্রধানত ভবিষ্যত জেনারেশনাকে সামনে নিয়েই তিনি এই তাফসীর লিখেন। তিনি বলতেন, ‘‘তাফহীমুল কুরআন লেখার কাজ আমার ওপর ভবিষ্যত প্রজন্মের হক বলে মনে করি।’’
তিনি ১৯৪২ সনে এই তাফসীর লেখার কাজ শুরু করেন। শেষ করেন ১৯৭২ সনে।
৮৫. আমীর পদ থেকে অব্যাহতি গ্রহণ
সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীর স্বাস্থ্যের অবস্থা ক্রমশই অবনতির দিকে যেতে থাকে। আমীর হিসেবে বহুমুখী কার্যক্রমে অংশ নেয়া তাঁর পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। ১৯৭২ সনে তিনি আমীর পদ থেকে অব্যাহতি নেন। ১৯৭২ সনের ২রা নভেম্বর মিয়া তুফাইল মুহাম্মাদ জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানের আমীর নির্বাচিত হন।
৮৬. দ্বিতীয় ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনে মেমোরেন্ডাম পেশ
১৯৭১ সনের স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় হওয়ার পর পাকিস্তানের তৃতীয় প্রেসিডেন্ট আগা মুহাম্মাদ ইয়াহইয়া খান পদত্যাগ করেন এবং পাকিস্তানের চতুর্থ প্রেসিডেন্ট হন জুলফিকার আলী ভুট্টো।
১৯৭৩ সনের পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রে বড়ো রকমের পরিবর্তন আনা হয়। এর অধীনে চৌধুরী ফজলে ইলাহী পাকিস্তানের পঞ্চম প্রেসিডেন্ট ও জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রধানমন্ত্রী হন।
১৯৭৪ সনের ফেব্রুয়ারী মাসে পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় ইসলামী শীর্ষ সম্মেলন। মুসলিম দেশগুলোর রাষ্ট্রপ্রধান, সরকার প্রধানগণ এই সম্মেলনে যোগদান করেন। এই শীর্ষ সম্মেলনে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী একটি মেমোরেন্ডাম পেশ করেন। এই মেমোরেন্ডামে তিনি যেইসব বিষয়ের প্রতি দুনিয়ার মুসলিম নেতৃবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন সেইগুলো হচ্ছে-
১. মুসলিম দেশগুলোর সম্মিলিতভাবে ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা উদ্ভাবন।
২. মুসলিম দেশগুলোতে আরবী ভাষাকে কমন আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে গ্রহণ।
৩. সমরাস্ত্র উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন।
৪. মুসলিম দেশগুলোর পারস্পরিক বিরোধ নিজেরাই মেটানো।
৫. মুসলিম দেশগুলো মিলে একটি কমন নিউজ এজেন্সী গঠন।
৬. মুসলিম দেশগুলোতে সহজ গমনাগমনের জন্য ভিসার কড়াকড়ি কমানো।
৭. আফ্রিকার মুসলিমদের খৃস্টানদের কর্তৃত্বমুক্ত হওয়ার প্রয়াসের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন।
৮. অ-মুসলিম দেশগুলোর মুসলিম নাগরিকদের অধিকার সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ।
৯. পশ্চিমা দেশগুলোতে অধ্যয়নরত মুসলিম ছাত্রদের জন্য নিজস্ব ছাত্রাবাসের ব্যবস্থা করণ।
১০. শক্তিশালী রেডিও ষ্টেশন স্থাপন করে মুসলিম স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রোগ্রাম উপস্থাপন।
১১. মুসলিমদের একটি আন্তর্জাতিক ব্যংক প্রতিষ্ঠা।
১২. ফিলিস্তিন ও কাশ্মীরের মুসলিমদের প্রতি বলিষ্ট সমর্থন প্রদান।
এই মেমোরেন্ডাম সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী গভীর চিন্তা, সূক্ষ্ণ দৃষ্টি ও দূরদৃষ্টির সাক্ষ্য বহন করে।
৮৭. ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকাতে প্রথম সফর
সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীর দ্বিতীয় ছেলে ডাঃ আহমাদ ফারুক মওদূদী ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকার বাফেলো সিটিতে কর্মরত ছিলেন। তাঁর অনুরোধে চিকিৎসার জন্য সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী সেখানে যেতে সম্মত হন।
১৯৭৪ সনের এপ্রিল মাসে তিনি সস্ত্রীক বাফেলো পৌঁছেন। চিকিৎসার ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন ইসলামী ব্যক্তিদের সাথে তাঁর ব্যক্তিগত ও গ্রুপ ভিত্তিক সাক্ষাত ও আলাপ চলতে থাকে। কানাডার টরান্টোতেও তাঁকে যেতে হয়। সেখানে মুসলিমদের একটি সম্মেলনে তিনি বক্তব্য রাখেন। কয়েক মাস ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকাতে অবস্থানের পর তিনি দেশে ফিরেন।
৮৮. পাকিস্তানের রাজনৈতিক মঞ্চে জেনারেল মুহাম্মাদ জিয়াউল হকের আগমণ
গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হলেও প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর সরকার জনগণের ওপর ডিকটেটোরিয়াল শাসন চালাতে থাকে। এতে জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো জোটবদ্ধ হয়ে ভুট্টো সরকারের বিরোধীতা করতে থাকে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সাথে সমঝোতা না করে মিঃ ভুট্টো দমন নীতি চালাতে থাকেন। দেশ দারুণভাবে অশান্ত হয়ে উঠে।
এই প্রেক্ষাপটে ১৯৭৭ সনের ৪ঠা জুলাই সেনাপ্রধান জেনারেল মুহাম্মাদ জিয়াউল হক ক্ষমতা দখল করেন। ১৯৭৭ সনের ১৬ই সেপ্টেম্বর প্রেসিডেন্ট চৌধুরী ফজলে ইলাহী পদত্যাগ করেন। পাকিস্তানের ষষ্ঠ প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন জেনারেল মুহাম্মাদ জিয়াউল হক। তিনি ঘোষণা করেন যে পাকিস্তান ইসলামের নামে অর্জিত হয়েছে, অতএব তিনি ইসলামী বিধান প্রবর্তনের পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
৮৯. সাইয়েদ আবুল আ’লার কিং ফায়সাল এওয়ার্ড লাভ
১৯৭৯ সনে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী কিং ফায়সাল এওয়ার্ডে ভূষিত হন। এটি ছিলো তাঁকে প্রদত্ত অনন্য সম্মান। পুরস্কার হিসেবে প্রাপ্ত সমুদয় অর্থ তিনি ইসলামী গবেষণা কাজে ব্যয় করার জন্য দান করেন।
৯০. ওফাত
সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী হাঁটু ও কোমরের ব্যথায় ভুগছিলেন। আরো ভুগছিলেন পেটের ব্যথায়।
১৯৭৯ সনের মধ্যভাগে ডাঃ আহমাদ ফারুক মওদূদী দেশে এসে তাঁর আব্বাকে চিকিৎসার জন্য ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকাতে যেতে পীড়াপীড়ি করতে থাকেন। অবশেষে সাইয়েদ আবুল আ’লা তাঁর স্ত্রীসহ ছেলের সাথে আমেরিকা পৌঁছেন। ২০শে আগস্ট বাফেলোর একটি হাসপাতালে তাঁর মেডিকেল চেকআপ শুরু হয়। ৪ঠা সেপ্টেম্বর তাঁর পেটের আলসার অপারেশন করা হয়। তিনি বেশ সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন।
৬ই সেপ্টেম্বর হঠাৎ তাঁর হার্ট এটাক হয়। তাঁকে মিলার ফ্লাওয়ার হসপিটালে স্থানান্তরিত করা হয়। পরবর্তী দুই সপ্তাহে তিনি বেশ কয়েকবার হার্ট এটাকের সম্মুখীন হন। ক্রমশ তাঁর জীবনী শক্তি নিঃশেষ হয়ে আসে।
১৯৭৯ সনের ২২শে সেপ্টেম্বর সকালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিলো ৭৬ বছর।
তাঁর মৃত্যুর খবর পৃথিবীর বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে। দুনিয়ার ইসলামী আন্দোলনের নেতা ও কর্মীরা তাঁদের মনের গভীরে দারুণ শূণ্যতা অনুভব করেন। প্রাণ ভরে তাঁরা তাঁর জন্য দুআ করতে থাকেন আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সমীপে।
বাফেলোতে তিনবার জানাযার নামায অনুষ্ঠিত হয়। একটি চার্টার্ড বিমানে করে তাঁর লাশ আনা হয় নিউইয়র্ক। কেনেডী আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে জানাযার নামায অনুষ্ঠিত হয়। প্যান এমেরিকান এয়ার লাইনসের বিমানে করে নিউইয়র্ক থেকে লাশ লন্ডনের হিথ্রো এয়ারপোর্টে আনা হয়। এখানেও অনুষ্ঠিত হয় জানাযার নামায। অতপর ২৬শে সেপ্টেম্বর পাকিস্তান ইন্টান্যাশনাল এয়ার লাইনসের একটি বিমানে করে তাঁর লাশ আনা হয় পাকিস্তানের করাচী এয়ারপোর্টে। এখানেও জানাযার নামায অনুষ্ঠিত হয়। ঐ দিনই বিকেলে লাশ পৌঁছে লাহোর। সাত মাইল লম্বা মিছিলের সাথে লাশ পৌঁছে গন্তব্যস্থলে।
২৬শে সেপ্টেম্বর সকাল ১০টায় পাকিস্তানের বৃহত্তম স্টেডিয়াম লাহোরের গাদাফী স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয় সর্বশেষ জানাযা। জানাযার নামাযে শরীক হওয়ার জন্য পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল মুহাম্মাদ জিয়াউল হক বিমানযোগে রাওয়ালপিন্ডি থেকে লাহোর পৌঁছেন। মক্কার মাসজিদুল হারামের ইমাম শায়খ মুহাম্মাদ বিন আবদুল্লাহ বিন সুবাইল গাদাফী স্টেডিয়ামে জানাযার নামাযে ইমামত করার কথা ছিলো। অনিবার্য কারণে তাঁর যাত্রা বিলম্বিত হয়। ফলে কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডঃ ইউসুফ আবদুল্লাহ আল কারদাভী ইমামত করেন। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ছাড়াও জানাযায় অংশগ্রহণকারী বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন সাউদী আরবের রাষ্ট্রদূত, জর্দানের রাষ্ট্রদূত, ইরানের স্বরাষ্ট্র সচিব, ওয়ার্ল্ড এসেম্বলী অব মুসলিম ইয়ুথ এর অন্যতম নেতা ডঃ আহমাদ তুতুনজী, সিরিয়ার সেরা ইসলামী চিন্তাবিদ শায়খ সাঈদ হাওয়া ও শায়খ আদনান সা’সুদ্দীন, কুয়েতের শায়খ আবদুল্লাহ আল আকীল, শায়খ মুবারাক ও শায়খ আবদুল আযীয আলী আল মুতাওয়া, মিসরের ডঃ কামালা ও শায়খ হাসানুল বান্নার পুত্র সাঈফুল ইসলাম, জামায়াতে ইসলামী হিন্দের আমীর মাওলানা ইউসুফ, পাকিস্তানের বিশিষ্ট আলিম মুফতী মাহমুদ, রাজনীতিবিদ নওয়াবজাদা নাসরুল্লাহ খান, সরদার শাওকাত হায়াত খান, চৌধুরী জহুর ইলাহী, খাজা খাইরুদ্দীন, আল্লামা ইহসান ইলাহী জহীর প্রমুখ, আযাদ কাশ্মীরের সাবেক প্রেসিডেন্ট সরদার আবদুল কাইউম খান এবং বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমীর আব্বাস আলী খান। প্রায় তিন লাখ লোক জানাযায় শরীক হন।
৫-এ যাইলদার পার্কে সাইয়েদ আবুল আ’লার বাসগৃহের সম্মুখস্থ সবুজ চত্বরের একটি কোণে তাঁকে দাফন করা হয়।
৯১. উপসংহার
সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী মৃত্যুবরণ করেছেন, কিন্তু মৃত্যু ঘটেনি তাঁর চিন্তাধারার। ইসলামী আন্দোলনের যেই জোয়ার তিনি সৃষ্টি করে গেছেন তা দুর্বার বেগে এগিয়ে যাচ্ছে সামনে। তাঁর বিজ্ঞান-সম্মত সাংগঠনিক দিক-নির্দেশনা ইসলামী আন্দোলনকে উত্তরোত্তর শক্তিধর করে তুলছে।
— সমাপ্ত —