ঈমান
‘‘এটি ইসলামী জিন্দিগীর বুনিয়াদ। …..পরিপূর্ণ ইসলামী জিন্দিগী গঠনের জন্য সুবিস্তারিত, সম্প্রসারিত, সুগভীর সুদৃঢ় ঈমান অত্যাবশ্যক। ঈমানের ব্যপ্তি থেকে জীবনের কোন একটি দিক বা বিভাগও যদি বাইরে থাকে, তাহলে জীবনের সেই দিক বা বিভাগ পুনর্গঠিত হবার সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকে। ঈমানের গভীরতায় যতোটুকু অভাব থাকে ইসলামী জিন্দিগীর প্রাসাদও সেই অনুযায়ী দুর্বল থাকে।’’
‘‘বস্তুত ইসলামী বিশাল প্রাসাদ একমাত্র সেই তাওহীদ স্বীকৃতির ওপরই স্থাপিত হতে পারে যা মানুষের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবনের ওপর সম্প্রসারিত, যার ফলে প্রত্যেক ব্যক্তি নিজেকে ও অন্য সব কিছুকে আল্লাহর মালিকানা বলে মনে করে, মানুষ সেই আল্লাহকেই মালিক, মা’বুদ, প্রভু ও আদেশ-নিষেধের নিরংকুশ অধিকারী বলে মেনে নেয়, জীবন-বিধানের উৎস একমাত্র তাঁকেই মনে করে, আল্লাহর আনুগত্য বিমুখতাকে কিংবা আল্লাহর সত্তা (যাত), গুণ (সিফাত), অধিকার (হক) ও ইখতিয়ারে (ক্ষমতা) অন্যের অংশীদারিত্ব স্বীকার করাকে মারাত্মক ভ্রান্তি ও গুমরাহী বলে মেনে নেয়।’’
‘‘এই প্রাসাদ তখনই মজবুত হওয়া সম্ভব যখন মানুষ স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে তার নিজ সত্তা ও ধন-সম্পদ আল্লাহর জন্য কুরবান করার সিদ্ধান্ত নেয়, নিজের মনগড়া ভালমন্দের মানদণ্ড চূর্ন করে সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর সন্তোষ ও অসন্তোষকেই মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করে, নিজের ধ্যান-ধারণা, বাসনা ও চিন্তাধারাকে একমাত্র আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞানের ভিত্তিতে ঢেলে গঠন করে, যেই সব কাজের দ্বারা আল্লাহর নাফরমানী হয় সেইগুলো পরিত্যাগ করে, আল্লাহর ভালোবাসাকে সর্বোচ্চ স্থান দেয়, বন্ধুতা ও শত্রুতা, পছন্দ-অপছন্দ, যুদ্ধ-সন্ধি সব কিছুকেই আল্লাহর মর্জির অধীন করে দেয়। আল্লাহর প্রতি ঈমানের নিগূঢ় অর্থ এটাই।’’
‘‘এই নিরিখে ঈমানের অন্য দিকগুলোও পরখ করা যেতে পারে। মানুষ যেই পর্যন্ত না জীবনের সকল ক্ষেত্রে নবীকে একমাত্র নেতা ও পথপ্রদর্শক হিসেবে মেনে নেয়, তাঁর নেতৃত্ব বিরোধী যতে নেতৃত্ব প্রচলিত আছে তা প্রত্যাখ্যান না করে ততক্ষণ পর্যন্ত রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতি ঈমান পূর্ণ হতে পারে না। আল্লাহর কিতাবে উপস্থাপিত জীবন-বিধান ছাড়া অন্য কোন বিধানকে প্রতিষ্ঠিত দেখে মনে সামান্যতম সন্তুষ্টি ভাব এবং আল্লাহর বিধানকে দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত দেখার ব্যাপারে ব্যাকুলতার অভাব আল্লাহর কিতাবের প্রতি ঈমান আনার প্রমাণ বহন করে না। অনুরূপভাবে আখিরাতের প্রতি ঈমানও পূর্ণতা লাভ করতে পারে না যেই পর্যন্ত না মানুষ দুনিয়ার ওপর আখিরাতকে প্রাধান্য দেয়। আখিরাতে আল্লাহর সামনে জবাবদিহি করার বিশ্বাসই মানুষকে তার প্রতিটি পদক্ষেপে ভাবতে ও সংযত হতে বাধ্য করে।’’
ইসলাম
‘‘ইসলাম হচ্ছে ঈমানের বাস্তব অভিব্যক্তি, ঈমানের কর্ম-রূপ। ঈমান ও ইসলামের সম্পর্ক বীজ ও গাছের সম্পর্কের মতো। বীজের মধ্যে যা কিছু থাকে তা-ই গাছ রূপে আত্মপ্রকাশ করে।’’
‘‘সত্যি যদি ঈমান থাকে, তাহলে ব্যক্তির বাস্তব জীবনে, কর্মজীবনে, নৈতিকতায়, গতি বিধিতে রুচি ও মানসিক ঝোঁক প্রবণতায়, প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয়েও এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে। কোন একটি ক্ষেত্রে যদি ইসলাম বিরোধী ভাবধারা প্রকাশ পায় তাহলে বুঝতে হবে যে ঐ ক্ষেত্রটি ঈমান শূণ্য অথবা ঈমান থাকলেও তা একেবারেই নিস্তেজ। আর কারো বাস্তব জীবন যদি অমুসলিমদের জীবনধারা অনুযায়ী যাপিত হয় তাহলে বুঝতে হবে তার অন্তরে ঈমানের অস্তিত্ব নেই।’’
তাকওয়া
‘‘তাকওয়া মনের সেই অবস্থারই নাম যা আল্লাহভীতি ও প্রবল দায়িত্বানুভূতির কারণে সৃষ্টি হয় এবং জীবনের প্রত্যেকটি দিকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আত্মপ্রকাশ করে। মানুষ আল্লাহকে ভয় করবে, সে আল্লাহর দাস এই চেতনা তার মনে জাগ্রত থাকবে, এবং আল্লাহ তাকে পৃথিবীর এই পরীক্ষাগারে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পাঠিয়েছেন এই কথা তার মনে সদা জাগ্রত থাকবে। আখিরাতের ফায়সালা এই নিরিখে হবে যে সে তার শক্তি-সামর্থ-যোগ্যতা কিভাবে প্রয়োগ করেছে, যেই সব নিয়ামাত সে পেয়েছে তার ভোগ-ব্যবহার কিভাবে করেছে, অপরাপর মানুষের সাথে তার সম্পর্ক –কাজকর্ম-লেনদেন কেমন ছিলো, এই ধারণা তার মনে জাগ্রত থাকবে।’’
এই অনুভূতি ও চেতনা যার মাঝে তীব্রভাবে বর্তমান থাকে তার হৃদয় মন জাগ্রত হয়। তার ইসলামী চেতনা তেজস্বী হয়। আল্লাহর মর্জির বিপরীত প্রত্যেকটি বিষয়ই তার মনে খটকা সৃষ্টি করে, তার অন্তর্নিহিত কর্তব্য জ্ঞান তাকে আল্লাহ সকল নির্দেশ পূর্ণ আন্তরিকতার সাথে পালন করতে বাধ্য করে। কোথাও আল্লাহর নির্ধারিত সীমা লংঘিত হওয়ার আশংকার দেখা দিলে আল্লাহর ভয়ে তার পা দুটি কেঁটে ওঠে। আল্লাহর হক রক্ষা করা তার স্বতঃস্ফূর্ত স্বভাবে পরিণত হয়।
ইহসান
‘‘এটি ইসলামী জিন্দিগীর সর্বোচ্চ পর্যায়। ইহসান বলা হয় আল্লাহ, তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও ইসলামের প্রতি গভীর ভালোবাসা ও প্রেম-পাগল ভাবধারাকে যা একজন মুসলিমকে ‘‘ফানা ফিল ইসলাম’’ করে তোলে। ….তাকওয়ার মূল কথা হচ্ছে আল্লাহর ভয়। আর ইহসানের মূল কথা হচ্ছে আল্লাহর ভালোবাসা। ইহসান মানুষকে আল্লাহর সন্তোষ অর্জনের জন্য সক্রিয় করে তোলে।’’
তাকওয়া ও ইহসানের পার্থক্য বুঝাতে গিয়ে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী একটি চমৎকার উদাহরণ পেশ করেছেন। তিনি বলেন,
‘‘সরকারী কর্মচারীদের মধ্যে এমন কিছু সংখ্যক লোক থাকে যারা নিজেদের কর্তব্য দায়িত্বানুভূতি ও আগ্রহ-উৎসাহের সাথে আঞ্জাম দিয়ে থাকে। তারা নিয়মকানুন মেনে চলে। শৃংখলা ভংগ করে না। সরকারের দৃষ্টিতে আপত্তিকর কোন কাজই তারা করে না। আবার, সরকারী কর্মচারীদের মধ্যে এমন কিছু সংখ্যক লোকও থাকে যারা ঐকান্তিক নিষ্ঠা, আন্তরিক ব্যগ্রতা আত্মোৎসর্গের ভাবধারা নিয়ে সরকারের কল্যাণ কামনা করে। তাদের ওপর যেই কাজ অর্পিত হয় তারা কেবল সেইগুলোই সম্পন্ন করে না, আরো যেই সব কাজের দ্বারা রাষ্ট্রের কল্যাণ ও উন্নতি হতে পারে, সেই সব কাজও আঞ্জাম দেয়ার জন্য তারা যত্নবান হয়। নির্দিষ্ট কর্তব্যের চেয়ে তারা অনেক বেশি কাজ করে। …..কোথাও আইন-শৃংখলা লংঘিত হতে দেখলে তাদের মনে প্রচণ্ড আঘাত লাগে। কোথাও রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক কোন কিছু দৃষ্টিগোচর হলে তারা অস্থির হয়ে উঠে ও তা দমনের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে।…… পৃথিবীর সর্বত্র একমাত্র তাদের রাষ্টের জয়জয়কার হোক, সর্বত্র এরই বিজয় পতাকা উড্ডীন হোক এটাই হয় তাদের মনের বাসনা।’’
‘‘এই দুইয়ের মধ্যে প্রথমোক্ত কর্মচারীরা হয় রাষ্ট্রের মুত্তাকী আর শেষোক্ত কর্মচারীরা হয় মুহসিন।’’
‘‘ইসলামে মুত্তাকীদেরও যথেষ্ট সম্মান আছে। তারাও শ্রদ্ধাভাজন, সন্দেহ নেই। কিন্তু ইসলামের আসল শক্তি হচ্ছে মুহসিনগুণ। আর পৃথিবীতে ইসলামের আসল উদ্দেশ্য একমাত্র মুহসিনদের দ্বারাই সুসম্পন্ন হতে পারে।’’
[দ্রষ্টব্যঃ ইসলামী আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তি, সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী]
২৬. আযাদী অর্জনের পথে উপ–মহাদেশ
১৯৩৯ সন থেকে ১৯৪৫ সন পর্যন্ত বিস্তৃত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে বৃটেনের জনবল ও ধনবল ব্যাপক হারে ক্ষয় হয়। অতো দূর থেকে ভারত শাসন করা তার জন্য কষ্টকর হয়ে উঠে। অল ইন্ডিয়া ন্যাশনাল কংগ্রেসের ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন, গুপ্ত সমিতিগুলোর সশস্ত্র হামলা, জাপানের সহায়তায় ভারতের বাইরে থেকে সুভাষ চন্দ্র বোসের নেতৃত্বাধীন আযাদ হিন্দু ফৌজ কর্তৃক ভারতের পূর্ব সীমান্তে সামরিক চাপ, আন্তনিয়ন্ত্রণাধিকার দেয়ার জন্য ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকার প্রেসিডেন্ট মিঃ রুজভেল্টের পরামর্শ, হিন্দু-মুসলিম দাংগার বিস্তৃতি সব মিলিয়ে হিসাব নিকাশ করে বৃটিশ সরকার উপ-মহাদেশের আযাদী প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
১৯৪৬ সনের মার্চ মাসে বৃটিশ কেবিনেটের সদস্য প্যাথিক লরেন্স, স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপ্স ও এ.ডি. আলেকজান্ডার সমন্বয়ে গঠিত কেবিনেট মিশন আসে ভারতে। শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া উদ্ভাবনের জন্য পাঠানো হয়েছিলো এই মিশন।
কেবিনেট মিশন গোটা দেশের শাসনতন্ত্র রচনার জন্য একটি গণ-পরিষদ নির্বাচনের প্রস্তান দেয়। কেবিনেট মিশন আরো প্রস্তাব দেয় যে উপ-মহাদেশের প্রদেশগুলোকে গ্রুপ-এ, গ্রুপ-বি ও গ্রুপ-সি তে বিভক্ত করা হবে। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলোকে নিয়ে গঠিত হবে গ্রুপ-এ। আর মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলো নিয়ে গঠিত হবে গ্রুপ-বি ও গ্রুপ-সি।
অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ এই প্রস্তাবকে পাকিস্তান অর্জনের পথে এক ধাপ অগ্রগতি গণ্য করে তা মেনে নেয়। অল ইন্ডিয়া ন্যাশনাল কংগ্রেস গোটা দেশের জন্য শাসনতন্ত্র রচনার জন্য একটি গণ-পরিষদ নির্বাচনের প্রস্তান মেনে নেয়, কিন্তু প্রদেশগুলোর গ্রপিং মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায়। এমতাবস্থায় মুসলিম লীগও সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়।
কেবিনেট মিশনের ব্যর্থতার ফলে হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে বিরাজমান তিক্ততার মাত্রা আরো বেড়ে যায়। কলকাতায় লোমহর্ষক দাংগা সংঘটিত হয়।
২৭. দ্বিতীয় কেন্দ্রীয় সম্মেলন
১৯৪৬ সনের ৫, ৬ ও ৭ই এপ্রিল এলাহাবাদের শহরতলী হারওয়ারা-তে অনুষ্ঠিত হয় জামায়াতে ইসলামীর দ্বিতীয় কেন্দ্রীয় সম্মেলন। কিডনীর ব্যথার জন্য সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী উদ্বোধনী ভাষণ দিতে পারেন নি। সম্মেলন উদ্বোধন করে মাওলানা আমীন আহসান ইসলাহী। এই সময় জামায়াতে ইসলামী রুকন সংখ্যা ছিলো ৪৮৬ জন। তৃতীয় দিন সমাপ্তি ভাষণ পেশ করেন আমীরে জামায়াত সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী। ভাষণে তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন যে বৃটিশরা যখন দেশ ছেড়ে যারার প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন দেশবাসী একে অপরের ওপর হামলা চালাচ্ছে। তিনি হিন্দু ও মুসলিমদের প্রতি সুস্থ চিন্তা অনুশীলনের আহ্বান জানান এবং বলেন হিন্দু ও মুসলিমরা যখন পৃথক হতেই হবে তখন বন্ধুর মতো পৃথক হওয়া উচিত যাতে ভবিষ্যতে সু-প্রতিবেশী রূপে বসবাস করা সম্ভব হয়। এই ভাষণে তিনি জামায়াতে ইসলামীর রুকনদের সর্বাবস্থায় ন্যায়ের পতাকাবাহী হিসেবে ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান।
২৮. অবশেষে দেশ ভাগের প্রতি কংগ্রেসের সম্মতি প্রদান
১৯৪৬ সনের ২৫শে অগাস্ট গভর্ণর জেনারেল লর্ড ওয়াভেল কলকাতা সফরে আসেন। দাংগার ভয়াবহ পরিণতি দেখে তিনি আঁতকে উঠেন।
১৬ই সেপ্টেম্বর মুসলিম লীগের শীর্ষ নেতা মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহ লর্ড ওয়াভেলের সাথে সাক্ষাত করেন এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবির যৌক্তিকতা আবারো তুলে ধরেন। লর্ড ওয়াভেল নীতিগতভাবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবি মেনে নেন।
১৯৪৭ সনের মার্চ মাসের শেষভাগে লর্ড ওয়াভেলের স্থলে গভর্ণর জেনারেল হয়ে আসেন লর্ড লুই মাউন্টব্যাটেন। দুই মাস তিনি উপ-মহাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। তিনিও উপলব্ধি করেন যে দেশ ভাগ করা ছাড়া গত্যন্তর নেই।
৩রা জুন তিনি পাকিস্তান দাবি মেনে নেয়ার কথা প্রকাশ করেন এবং হিন্দুদেরকে খুশি করার জন্য ঘোষণা করেন যে বেংগল প্রদেশ ও পাঞ্জাব প্রদেশকে বিভক্ত করা হবে।
অল ইন্ডিয়া ন্যাশনাল কংগ্রেসের শীর্ষস্থানীয় নেতা জাওহারলাল নেহরু ও সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেল ভারত বিভক্তির প্রশ্নে তাঁদের সম্মতির কথা লর্ড লুই মাউন্টব্যাটেনকে জানিয়ে দেন। কিন্তু মিঃ গান্ধী কিছুতেই তা মানতে রাজি হলেন না। তিনি বলেন, ‘‘কংগ্রেস যদি বিভক্তি মেনে নিতে চায়, তা আমার মৃত দেহের উপর দিয়েই হবে। যদ্দিন আমি জীবিত আছি ভারতের বিভক্তি আমি মেনে নেবো না। যদি সম্ভব হয়, আমি কংগ্রেসকে এটা করতে দেবো না।’’
জোর লবিং চলতে থাকে। অবশেষে মিঃ গান্ধী তাঁর মত পরিবর্তন করেন।
কংগ্রেসের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় নেতা মাওলানা আবুল কালাম আযাদ ভারত বিভক্তির ঘোর বিরোধী ছিলেন। তিনি বলেন, ‘‘আমি যখন আবার গান্ধীর সাথে দেখা করলাম দেখলাম তিনি পরিবর্তিত হয়ে গেছেন। এতে আমি আমার জীবনের সবচে’ বড়ো আঘাত পেলাম। তিনি প্রকাশ্যে বিভক্তির পক্ষে না হলেও বিভক্তির জোর বিরোধিতা করছিলেন না। আমার কাছে যেটা বেদনাদায়ক লাগলো এবং বিস্মিত হলাম এই দেখে যে আগে সরদার প্যাটেল যেই সব যুক্তি দেখিয়ে ছিলেন, গান্ধী সেই সব যুক্তিই দেখাতে লাগলেন। দুই ঘন্টা ধরে আমি তাঁকে বুঝাবার চেষ্টা করি। কিন্তু তাঁর ওপর কোন আছর ফেলতে পারলাম না।’’
২৯. হিন্দু–মুসলিম দাংগা ও জামায়াতে ইসলামী
১৯৪৭ সনের ৩রা জুন দেশ-ভাগের পরিকল্পনা প্রকাশ পেলে হিন্দু ভারত ভয়ানক হিংস্র হয়ে উঠে। ‘‘অখণ্ড ভারতে এক জাতীয়তার ভিত্তিতে দেশ শাসনের সুযোগ নষ্ট হওয়ায় তার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য হিন্দুদের হিংস্র মানসিকতার ব্যাপক প্রকাশ ঘটে। দেশের সর্বত্র মুসলিম সংখ্যালঘু অঞ্চলগুলোতে হিন্দুদের পক্ষ থেকে চরম বর্বরতা ও পাশবিকতার তাণ্ডবলীলা শুরু হয়। বিহার প্রদেশে সর্বাধিক লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড হতে থাকে। অখণ্ড ভারত ও একজাতীয়তার পতাকাবাহীগণ মুসলিমদের জনপদগুলো একটির পর একটি জ্বালিয়ে দিতে থাকে। বহু মানব সন্তানকে জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ করে হত্যা করা হয়। কয়েক দিনের মধ্যে হাজার হাজার বর্গ মাইল ব্যাপী এলাকার মুসলিমগণ গৃহহারা ও সর্বস্বহারা হয়ে পড়ে।’’
[দ্রষ্টব্যঃ জামায়াতে ইসলামীর ইতিহাস, আব্বাস আলী খান, পৃষ্ঠা–১৯০।]
হিন্দু-মুসলিম দাংগা শুধু বিহারেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। ছড়িয়ে পড়েছিলো উপ-মহাদেশের সর্বত্র। এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে করণীয় নির্ধারণের জন্য সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী মাজলিসে শূরার অধিবেশন ডাকেন। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সারাদেশে দাংগা বিরোধী একটি প্রচারপত্র বিপুল সংখ্যায় বিতরণ করা হয়। সীমিত সামর্থ নিয়েই জামায়াতে ইসলামী দেশের বিভিন্ন স্থানে রিলিফ ক্যাম্প স্থাপন করে বিপন্ন মানুষের খিদমাতে আত্মনিয়োগ করে। একটি সার্কুলারের মাধ্যমে জামায়াতে ইসলামীর রুকনদের বলা হয় ‘‘জামায়াতে ইসলামী কোন রুকনের সামনে হিন্দু কিংবা মুসলিমদের কোন দলকে কোন ব্যক্তির ওপর আঘাত হানতে দেখলে তাকে রক্ষা করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে। আক্রান্ত ব্যক্তিকে রক্ষা করতে নিজের জীবন বিপ্নন্ন হলেও তা করা উচিত।’’
‘‘দাংগা চলা অবস্থায় কোন ব্যক্তি কিংবা পরিবার যদি বিপন্ন হয়ে পড়ে সেই ব্যক্তি কিংবা পরিবার মুসলিম হোক অথবা অমুসলিম, তারা আশ্রয়প্রার্থী হোক না হোক নিজের চেষ্টায় সেই ব্যক্তি বা পরিবারকে আশ্রয় দিতে হবে। নিজের জীবনকে বিপন্ন করেও তার বা তাদের হিফাজাত করতে হবে।’’
দাংগা চলাকালে যখনই ও যেখানে সুযোগ হবে জনসাধারণকে বুঝাবার চেষ্টা করতে হবে, তাদেরকে আল্লাহর ভয় দেখাতে হবে, মুসলিম হলে তাদেরকে দীনের প্রকৃত উদ্দেশ্য ও তা হাছিলের সঠিক পন্থা বলে দিতে হবে। তাদের কাছে এই কথা সুস্পষ্ট করে তুলতে হবে যে এই জাতীয় সংঘাত-সংঘর্ষ, এই ধরণের হত্যাকাণ্ড কিছুতেই আল্লাহর কাছে পছন্দনীয় নয়, অমুসলিম হলে তাকে জাতীয়তাবাদের ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে অবহিত করে তুলতে হবে।
[দ্রষ্টব্যঃ জামায়াতে ইসলামীর ইতিহাস, আব্বাস আলী খান, পৃষ্ঠা–১৯৩।]
৩০. ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রগঠন
১৯৪৭ সনের পহেলা জুলাই বৃটিশ পার্লামেন্ট ইনডিপেনডেন্স অব ইন্ডিয়া এ্যাক্ট পাস করে। ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তুতি দ্রুততার সাথে সম্পন্ন করা হয়।
১৯৪৭ সনের ১৪ ও ১৫ ই অগাস্টের মধ্যবর্তী রাতে দিল্লীতে বসে পাকিস্তান ও ভারতের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন বৃটিশ শাসিত ভারতের সর্বশেষ গভর্ণর জেনারেল লর্ড লুই মাউন্টব্যাটেন।
স্বাধীন ভারতের প্রথম গভর্ণর জেনারেল হিসেবে দিল্লীতে শপথ গ্রহণ করেন লর্ড লুই মাউন্টব্যাটেন। আর পাকিস্তানের প্রথম গভর্ণর জেনারেল হিসেবে করাচীতে শপথ গ্রহণ করেন মিঃ মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহ।
ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন জাওহারলাল নেহরু। তাঁর মন্ত্রীসভার সদস্য হন সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেল, লাল বাহাদুর শাস্ত্রী, মাওলানা আবুল কালাম আযাদ প্রমুখ।
পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন লিয়াকত আলী খান। তাঁর মন্ত্রীসভার সদস্য হন মালিক গোলাম মুহাম্মদ, স্যার জাফলুল্লাহ খান, মুশতাক আহমদ গুরমানী প্রমুখ।
৩১. সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীর হিজরাত
আগেই বলেছি যে তখন জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কার্যালয় পাঞ্জাবের গুরুদাসপুর জিলার পাঠানকোট তহশিলের ছোট্ট পল্লী জামালপুরে অবস্থিত ছিলো। মিঃ র্যাডক্লিফের নেতৃত্বাধীন বাউন্ডারী কমিশন প্রথমে ঘোষণা করেছিলো যে গুরুদাসপুর জিলা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হবে। ১৯৪৭ সনের ১৭ অগাস্ট বাউন্ডারী কমিশন ঘোষণা করে যে গুরুদাসপুর জিলা ভারতের মধ্যে শামিল হবে। এই ঘোষণা ছিলো একেবারেই অযৌক্তিক। বিশেষজ্ঞদের মত গুরুদাসপুর জিলাকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করার উদ্দেশ্য ছিলো ভারতের জন্য কাশ্মীরে পৌঁছার পথ সুগম করা।
‘‘অগাস্ট পর্যন্ত পাঞ্জাব এক জাহান্নামের রূপ ধারণ করে। চারদিকে শুধু হত্যা, লুটতরাজ ও অগ্নি-সংযোগ এই অঞ্চলে মানুষের নয়, পশুর রাজত্ব কায়েম করে।’’
[দ্রষ্টব্যঃ জামায়াতে ইসলামর ইতিহাস, আব্বাস আলী খান, পৃষ্ঠা–১৯৪।]
জামালপুরের দারুল ইসলামে তখন সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীসহ পঁচিশজন পুরুষ অবস্থান করছিলেন। আর ছিলেন কিছু সংখ্যক মহিলা। জামালপুরের চারদিকের গ্রামগুলোতে শিখেরা ছিলো সংখ্যাগুরু। হিন্দুদের মতো তারাও ছিলো মুসলিমদের প্রতি মারমুখো। ঐ সব গ্রামের মুসলিমদেরকে ব্যাপক হারে হত্যা করা হয়। ২২ শে অগাস্টে এসে পাঠান কোট শহরও মুসলিমশূণ্য হয়ে যায়। যেই সব মুসলিম প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলো তারা ছুটে আসতে থাকে জামালপুরে। কয়েক দিনে মধ্যেই প্রায় আড়াই হাজার লোক এসে জড়ো হয়।
জামায়াতে ইসলামীর পঁচিশজন পুরুষ এই বিপুল সংখ্যক বিপন্ন মানুষের খিদমাতে আত্মনিয়োগ করেন। তাদের মাথা গুঁজবার ব্যবস্থা করা হয়। খাদ্যের ব্যবস্থা করা হয়।
আশংকা ছিলো, যেই কোন মুহূর্তে জামালপুর আক্রান্ত হবে। জামায়াতে ইসলামী সদস্যগণ ক্যাম্পের চারদিকে ট্রেঞ্চ (পরিখা) খনন করে স্থানে স্থানে পাহারার ব্যবস্থা করেন। তিনটি বন্দুক আর কিছু সংখ্যক লাঠি ছিলো তাঁদের সম্বল। সাইয়েদ আবুল আ’লার নির্দেশ ছিলো নিজেরা জীবিত থাকা অবস্থায় কোন হামলাকারীকে দারুল ইসলামে প্রবেশ করতে দেয়া হবে না।
একাংশে অবস্থান করছিলো মহিলারা। তাদেরকে দা-ছুরি ইত্যাদি নিয়ে প্রস্তুত থাকতে বলা হয়। ২৪শে অগাস্ট মহিলাদেরকে একত্রিত করে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী একটি ভাষণ দেন। সেই ভাষণে তিনি বলেন, ‘‘হয়তো দারুল ইসলামবাসীদের আজ জীবনের শেষ দিন। এই অবস্থায় যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের একজন পুরুষ বেঁচে থাকবে ইনশাআল্লাহ দুশমন তোমাদের কাছে পৌঁছতে পারবে না। আল্লাহ না করুন, পুরুষরা যদি খতম হয়েই যায় তোমাদেরকে মুমিন নারীর মতোই লড়াই করে যেতে হবে। আত্মহত্যা করা চলবে না। জীবিত অবস্থায় কারো কাছে আত্মসমর্পণ করা চলবেনা। হামলাকারীর মুকাবিলা করবে এবং আপন ইযযতের জন্য লড়াই করে জান দেবে।’’
[দ্রষ্টব্যঃ জামায়াতে ইসলামীর ইতিহাস, আব্বাস আলী খান, পৃষ্ঠা–১৯৬।]
জামালপুরে আশ্রয় শিবিরে আটকে পড়া এই আড়াই হাজার বিপন্ন মানুষের মুক্তির পথ করে দেন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন।
১৯৪৭ সনের ২৫ অগাস্ট সেনাবাহিনীর একটি কনভয় এসে পৌঁছে জামালপুর। দুইটি ট্রাকে করে শিশু, বৃদ্ধ ও মহিলাদেরকে পাঠিয়ে দেয়া হয় লাহোর। ২৯শে অগাস্ট সেনাবাহিনী জামালপুর আশ্রয় শিবিরের দায়িত্ব গ্রহণ করে। ক্যাম্প রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব থেকে জামায়াতে ইসলামী মুক্ত হয়। ঐ দিনই আরেকটি সামরিক কনভয়ের সাথে তিনটি বাস নিয়ে জামায়াতে ইসলামীর সদস্য আবদুল জাব্বার গাজী জামালপুর পৌঁছেন। ৩০শে অগাস্ট সকালে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী ও তাঁর সহকর্মীগণ লাহোরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। ক্যাম্পে অবস্থানরত ব্যক্তিদের মনোবল সমুন্নত রাখা ও জামায়াতে ইসলামীর রেখে যাওয়া সম্পদ দেখাশুনা করার জন্য ইহসানুল হক, আযম হাশেমী ও মুহাম্মাদ হামেদকে রেখে যাওয়া হয় জামালপুরে।
১৯৪৭ সনের ৩০শে অগাস্ট সন্ধ্যার দিকে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী তাঁর সাথীদের নিয়ে লাহোর পৌছেন। তাঁদের থাকার জন্য সরকার একটি বাড়ি বরাদ্দ করে। কিন্তু ২৪ ঘন্টার পর তা ফেরত নেয়। মুহাজির সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী ও তাঁর সাথীরা লাহোরের ইসলামী পার্কে ছোট ছোট তাঁবু স্থাপন করে মাথা গুঁজলেন।
৩২. নতুন কেন্দ্রীয় কার্যালয়
লাহোর শহরের ইছরা মহল্লার ৫-এ যাইলদার পার্কের বাড়িটি ভাড়া করে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী ইসলামীয়া পার্কের তাঁবু থেকে সেখানে স্থানান্তরিত হন। তখন থেকে এই বাড়িটি তারজুমানুল কুরআনের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। আর জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান এর কেন্দ্রীয় কার্যালয় স্থাপিত হয় এই বাড়িতেই।
৩৩. জামায়াতে ইসলামী বিভক্তি
উপ-মহাদেশের আযাদী হাছিলের সময় জামায়াতে ইসলামী রুকন ছিলেন ৬২৫ জন। দেশ ভাগ হওয়ায় জামায়াতে ইসলামীকে জামায়াতে ইসলামী হিন্দ ও জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান নামে দুইটি স্বতন্ত্র সংগঠনে বিভক্ত করা হয়। দুইশত চল্লিশ জন রুকন নিয়ে জামায়াতে ইসলামী হিন্দ ও তিনশত পঁচাশি জন রুকন নিয়ে জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান কাজ শুরু করে।
৩৪. সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীর রেডিও ভাষণ
সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী একজন বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ হিসেবে ইতোমধ্যেই সর্বমহলে পরিচিত হয়ে উঠেন। ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান-গর্ভ ভাষণ দেয়ার জন্য রেডিও পাকিস্তান লাহোর তাঁকে আমন্ত্রণ জানায়। এই আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে তিনি ১৯৪৮ সনের ৬ই জানুয়ারী ‘‘ইসলামের নৈতিক বিধান’’, ২০শে জানুয়ারী ‘‘ইসলামের রাজনৈতিক বিধান’’, ১০ই ফেব্রুয়ারী ‘‘ইসলামের সমাজ ব্যবস্থা’’, ২রা মার্চ ‘‘ইসলামের অর্থ ব্যবস্থা’’ ও ১৬ই মার্চ ‘‘ইসলামের আধ্যাত্মিক বিধান’’ সম্পর্কে মূল্যবান ভাষণ পেশ করেন।
৩৫. ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন
১৯৪৮ সনের জানুয়ারী মাসে ‘‘ল কলেজ, লাহোর’’ তাঁকে ‘‘ইসলামী আইন’’ সম্পর্কে বক্তব্য রাখার জন্য আহ্বান জানায়। জ্ঞানী গুণী ব্যক্তিরা সমবেত হয়েছিলেন ঐ আলোচনা সভায়। সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী প্রাঞ্চল ভাষায় ইসলামী আইনের বিভিন্ন দিক ও এইগুলোর শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরেন তাঁর ভাষণে। তিনি এই কথাও স্মরণ করিয়ে দেন যে পাকিস্তান আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ একদিকে আল্লাহর কাছে, অন্য দিকে মানুষের কাছে এই ওয়াদা করেছেন যে তাঁরা পাকিস্তানে ইসলামী বিধি বিধান প্রবর্তন করবেন। এখন যদি ইসলামের পরিবর্তে পাশ্চাত্য জগতের আইন প্রবর্তন করার চেষ্টা চালানো হয় তাহলে তো মুসলিমদের জন্য আলাদা আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার যৌক্তিকতার থাকে না।
১৯৪৮ সনের ১৯শে ফেব্রুয়ারী সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী ‘‘ল কলেজ, লাহোর’’ কর্তৃক আয়োজিত আরেকটি আলোচনা সভায় ভাষণ দেন। এবার তিনি ‘‘ইসলামী আইন প্রবর্তনের উপায়’’ সম্পর্কে বক্তব্য রাখেন। ভাষণে তিনি বলেন যে ইসলামী আইন রাতারাতি প্রবর্তন করা যাবে না। বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে তা কার্যকর করতে হবে। তিনি আরো বলেন যে ইসলামী আইন প্রবর্তনের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে পাকিস্তানের গণ-পরিষদকে ঘোষণা করতে হবেঃ
১. সার্বভৌমত্ব আল্লাহর। আর পাকিস্তান সরকার আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে দেশ শাসন করবে।
২. ইসলামী শরীআহ হবে দেশের মৌলিক আইন।
৩. ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক আইনগুলোকে পরিবর্তিত করে ইসলামের সাথে সংগতিশীল আইনে পরিণত করতে হবে।
৪. ক্ষমতা প্রয়োগ করতে গিয়ে রাষ্ট্র কোন অবস্থাতেই শরীয়াহর সীমা লংঘন করতে পারবে ন।
[দ্রষ্টব্যঃ মাওলানা মওদূদী এন্ড হিজ থট, প্রফেসার মাসুদুল হাসান, পৃষ্ঠা–৩৪৫]
১৯৪৮ সনের মার্চ মাসে জামায়াতে ইসলামীর উদ্যাগে করাচীর জাহাংগীর পার্কে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এই জনসভায় প্রধান বক্তা ছিলেন সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী। এই জনসভায় তিনি উপরোক্ত চার দফা দাবি উত্থাপন করেন এবং চার দফা ভিত্তিক ‘আদর্শ প্রস্তাব’ গ্রহণের জন্য গণ পরিষদের প্রতি আহ্বান জানান। এইভাবে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের সূচনা করে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী দেশের বিভিন্ন স্থানে সফর করে জনসভায় ভাষণ দিতে থাকেন। অল্প সময়ের মধ্যেই ইসলামী শাসনতন্ত্রের পক্ষে জনমত গড়ে উঠে। কিন্তু বিব্রতবোধ করতে থাকেন পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর সেকুলার অংশটি।
৩৬. প্রথম গ্রেফতারী
১৯৪৮ সনের ১১ই সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের স্থপতি ও প্রথম গভর্ণর জেনারেল মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহ মৃত্যুবরণ করেন। খাজা নাজিমুদ্দিন হন পাকিস্তানের গভর্ণর জেনারেল। প্রধানমন্ত্রী পদে বহাল থাকেন লিয়াকত আলী খান।
১৯৪৮ সনের ৪ঠা অক্টোবর অর্থাৎ মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহর ওফাতের ২২ দিন পর জননিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার হন সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী, মাওলানা আমীন আহসান ইসলাহী, মিয়া তুফাইল মুহাম্মাদ প্রমুখ।
সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীকে লায়ালপুরে জেলে রাখা হয়। অতপর তাঁকে মুলতান জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। অন্যান্য জেলখানা থেকে মাওলানা আমীম আহসান ইসলাহী, মিয়া তুফাইল মুহাম্মাদ ও আরো কয়েকজন সহকর্মী বন্দীকেও মুলতান জেলে আনা হয়। তাঁরা ছালাতুল ফজর আদায় করার পর জেলের ভেতরে খোলা জায়গায় ভ্রমণ করতেন। সকালে নাস্তা খেয়ে তাঁরা আল কুরআন অধ্যয়ন করতেন। এরপর খবরের কাগজ ও অন্য বই পড়তেন। ছালাতুজ জুহরের পর আবার একত্রিত হতেন ও বিভিন্ন বিষয়ে মত বিনিময় করতেন। বিকেলে তাঁরা আবার বেরুতেন হাঁটার জন্য। রাতের খাবার খেয়ে ছালাতুল ইশা আদায় করে ঘুমুতে যেতেন। মোটামুটি এই ছিলো জেলখানায় তাঁদের কাজের রুটিন।
শীর্ষস্থানীয় নেতারা জেলে থাকলেও জামায়াতে ইসলামীর জনশক্তি ইসলামী শাসনতন্ত্রের পক্ষে জনমত গঠনের প্রয়াস চালাতে থাকে। অকুণ্ঠ সমর্থন নিয়ে এগিয়ে আসে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামী। জনমত এতোখানি প্রবল হয়ে উঠে যে তা উপেক্ষা করা সরকারের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে।
১৯৪৯ সনের ৯ই মার্চ গণ-পরিষদ প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের নেতৃত্বে ‘‘আদর্শ প্রস্তাব’’ (Objective Resolution) পাস করে। ‘‘আদর্শ প্রস্তাব’’ পাস করায় জামায়াতে ইসলামী মজলিসে শূরা সরকারকে মুবারকবাদ জানায়। এই দিকে সরকার একের পর এক ডিটেনশান অর্ডার দিয়ে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী ও তাঁর সাথীদের জেলবাস দীর্ঘায়িত করতে থাকে। সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী তাঁর ডিটেনশন চ্যালেঞ্জ করে কোন পিটিশান পেশ করেননি। তিনি বলেন যে তিনি তাঁর বিষয়টি আল্লাহর নিকট সুপর্দ করে দিয়েছেন। এইদিকে অন্য এক মামলা নিষ্পত্তি করতে গিয়ে ফেডারেল কোর্ট রায় দেয় যে জননিরাপত্তা আইনে ডিটেনশান মাত্র দুইবার বর্ধিত করা যায়, দুইবারের বেশি বর্ধিত করা যায় না। ঐ রায় সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য ছিলো বিধায় সরকার অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাঁকে ও তাঁর সাথীদেরকে মুক্তি দেয়। ১৯৫০ সনের ২৮শে মে প্রায় বিশ মাস কারাবাসের পর সাইযেদ আবুল আ’লা মওদূদী ও তাঁর সাথীরা মুক্তি লাভ করেন।
১৯৫০ সনের সেপ্টেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান শাসনতন্ত্রের মূলনীতি কমিটির রিপোর্ট গণপরিষদে উত্থাপন করেন। বিস্ময়ের ব্যাপার এই রিপোর্ট ছিলো ইতঃপূর্বে গৃহীত ‘‘আদর্শ প্রস্তাবের’’ সাথে সামঞ্জস্যহীন। এতে ছিলো ইসলামের পরিবর্তে পাশ্চাত্য চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন।
১৯৫০ সনের ১৪ই অক্টোবর লাহোরে অনুষ্ঠিত জনসভায় সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী এই রিপোর্টের তীব্র সমালোচনা করেন। জামায়াতে ইসলামী দেশের বিভিন্ন স্থানে জনসভা করতে থাকে। সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী এইসব জনসভায় বক্তব্য রেখে মূলনীতি কমিটির রিপোর্টের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে থাকেন। দেশের অন্যান্য ইসলামী ব্যক্তিত্বও এই সময় সোচ্চার হন। সমালোচনার মুখে সরকার মূলনীতি কমিটির রিপোর্ট প্রত্যাহার করে নেয়। এই সময় প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এই চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন যে দেশের আলিম সমাজ যদি সর্বসম্মতভাবে কোন শাসনতান্ত্রিক প্রস্তান উপস্থান করতে পারে তবে গণ-পরিষদ তা বিবেচনা করে দেখবে।
৩৭. ইসলামী শাসনতন্ত্রের মূলনীতি প্রণয়ন
সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীর উদ্যোগে ১৯৫১ সনের ২১শে জানুয়ারী করাচীতে অনুষ্ঠিত হয় দেশের সেরা আলিমদের একটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিং। দীর্ঘ আলাপ আলোচনার পর তৈরী হয় মূল্যবান একটি দলীল- ‘‘ইসলামী শাসনতন্ত্রের ২২ দফা মূলনীতি’’। মূলনীতিগুলো ছিলো নিম্নরূপঃ
১. দেশের সার্বভৌমত্বের মালিক আল্লাহ।
২. দেশের আইন আল কুরআন ও আস্সুন্নাহর ভিত্তিতে রচিত হবে।
৩. রাষ্ট্র ইসলামী আদর্শ ও নীতিমালার ওপর সংস্থাপিত হবে।
৪. রাষ্ট্র মারুফ প্রতিষ্ঠা করবে ও মুনকার উচ্ছেদ করবে।
৫. রাষ্ট্র মুসলিম দেশগুলোর সাথে ভ্রাতৃত্ব ঐক্য সম্পর্ক মজবুত করবে।
৬. রাষ্ট্রকে দেশের সকল নাগরিকের মৌলিক প্রয়োজন পূরণের গ্যারাণ্টি দিতে হবে।
৭. শারীয়াহর নিরিখে নাগরিকদের সকল অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
৮. আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে কাউকে শাস্তি দেয়া যাবে না।
৯. স্বীকৃত মুসলিম মাযহাবগুলো আইনের আওতায় পরিপূর্ণ দ্বীনি স্বাধীনতা ভোগ করবে।
১০. অমুসলিম নাগরিকরা আইনের আওতায় পার্সোনাল ও পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করবে।
১১. রাষ্ট্র শরীয়াহ কর্তৃক নির্ধারিত অ-মুসলিমদের অধিকারগুলো নিশ্চিত করবে।
১২. রাষ্ট্র প্রধান হবেন একজন মুসলিম পুরুষ।
১৩. রাষ্ট্র প্রধানের হাতে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব অর্পিত হবে।
১৪. রাষ্ট্র প্রধানকে পরামর্শ প্রদানের জন্য একটি মাজলিসে শূরা থাকবে।
১৫. রাষ্ট্র প্রধান দেশের শাসনতন্ত্র সাসপেন্ড করতে পারবেন না।
১৬. সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে রাষ্ট্র প্রধানকে পদচ্যুত করা যাবে।
১৭. রাষ্ট্র প্রধান তাঁর কার্যাবলীর জন্য দায়ী থাকবেন এবং তিনি আইনের ঊর্ধ্বে হবেন না।
১৮. বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগ থেকে স্বাধীন হবে।
১৯. সরকারী ও প্রাইভেট সকল নাগরিক একই আইনের অধীন হবে।
২০. ইসলাম বিরোধী মতবাদের প্রচারণা নিষিদ্ধ হবে।
২১. দেশের বিভিন্ন অঞ্চল একই দেশের বিভিন্ন প্রশাসনিক ইউনিট বলে গণ্য হবে।
২২. আল কুরআন ও আস্সুন্নাহর পরিপন্থী শাসনতন্ত্রের যেই কোন ব্যাখ্যা বাতিল বলে গণ্য হবে।
এই মিটিংয়ে সভাপতিত্ব করেন সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী। প্রস্তাবের খসড়া তিনিই তৈরী করেন। অন্যদের উত্থাপিত সামান্য সংশোধনীসহ সর্বসম্মতিক্রমে এই নীতিমালা গৃহীত হয়।
১৯৫১ সনের ৮ই মে করাচীর আরামবাগে অনুষ্ঠিত জনসভায় সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী ইসলামী শাসনতন্ত্র প্রণয়নের দাবিতে জোরালো বক্তব্য রাখেন। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন যে ভারত ও পাকিস্তান একই সময়ে স্বাধীন হলো, ভারত তার শাসনতন্ত্র তৈরী করে নিলো, কিন্তু পাকিস্তান তার শাসনতন্ত্র তৈরীর কাজে এখনো একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে অবস্থান করছে। শাসনতন্ত্র প্রণয়নের বিলম্বকে তিনি জাতীয় স্বার্থ পরিপন্থী বলেও উল্লেখ করেন। তিনি আরো বলেন যে, দেশের মানুষ গণ-পরিষদের কাছে শুধু একটি শাসনতন্ত্রই চাচ্ছে না, চাচ্ছে একটি ইসলামী শাসনতন্ত্র।
সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীর নেতৃত্বে জামায়াতে ইসলামী সারা দেশে জনসভা অনুষ্ঠান, পোস্টারিং ও হ্যান্ডবিল বিলির মাধ্যমে ইসলামী শাসনতন্ত্রের পক্ষে জনমত বলিষ্ঠতর করার অভিযান চালাতে থাকে।
১৯৫১ সনের ১৬ই অক্টোবর রাওয়ালপিন্ডির এক জনসভায় বক্তৃতা দান কালে আততায়ী গুলিতে নিহত হন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। ক্ষমতার উচ্চ কেন্দ্রে ঘটে বড়ো রকমের রদবদল। পাকিস্তানের তৃতীয় গভর্ণর জেনারেল হন ইসলাম বিদ্বেষী মালিক গোলাম মুহাম্মাদ। আর গভর্নর জেনারেল পদ থেকে নামিয়ে খাজা নাজিমুদ্দীনকে করা হয় প্রধানমন্ত্রী।
খাজা নাজিমুদ্দীন শাসনতন্ত্র রচনার কাজে হাত দেন। তাঁরই প্রচেষ্টায় ১৯৫২ সনের ২২শে ডিসেম্বর গণ-পরিষদে নতুন করে শাসনতন্ত্রের মূলনীতি কমিটির রিপোর্ট উপস্থাপিত হয়।
১৯৫৩ সনের ৩০শে জানুয়ারী অনুষ্ঠিত জামায়াতে ইসলামী জনসভায় সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী ভাষণ দেন। এই ভাষণে তিনি মুলনীতি কমিটির রিপোর্ট প্রসংগে বলেন যে এই রিপোর্টের অনেক কিছু ভালো দিক রয়েছে। আর কিছু মন্দ দিকও রয়েছে। তিনি আরো বলেন যে, ভালো দিকগুলোকে সমর্থন করা ও মন্দ দিকগুলো পরিবর্তনের জন্য কাজ করা প্রয়োজন।
৩৮. কাদিয়ানীদেরকে অ–মুসলিম ঘোষণার দাবিতে আন্দোলন
১৯৫৩ সনের জানুয়ারী মাসে কাদিয়ানী সমস্য নিয়ে আলোচনার জন্য করাচীতে একটি সর্বদলীয় কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। এতে যোগদান করে জামায়াতে ইসলামী, জমিয়তে ইলামায়ে ইসলাম, মজলিসে আহরার, জমিয়তে আহলে হাদীস, আনজুমানে তাহাফফুজে হুকুমে শিয়া, মুসলিম লীগ প্রভৃতি।
সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী কাদিয়ানী সমস্যাটিকে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনে শামিল করে নেয়ার প্রস্তান দেন।
১৯৫৩ সনের ২৭শে ফেব্রুয়ারী এই বিষয়ে আলোচনার জন্য করাচীতে সর্বদলীয় নির্বাহী পরিষদের মিটিং বসে। এই সভায় সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য ডাইরেক্ট এ্যাকশানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। জামায়াতে ইসলামী এই ধরণের কার্যক্রমে বিশ্বাসী ছিলো না বিধায় সর্বদলীয় কনভেনশনের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে। করাচীতে ডাইরেক্ট এ্যাকশান ব্যর্থ হয়। পাঞ্জাবে তা ভয়াবহ আকার ধারণ করে। এই জন্য সরকারের অসহিষ্ণুতাই মূলত দায়ী ছিলো।
পাঞ্জাবের মূখ্যমন্ত্রী ছিলেন মুসলিম লীগের মুমতাজ মুহাম্মাদ খান দাওলাতানা। মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে মুসলিম লীগের বিক্ষোভ, এটা তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না। তিনি পুলিশ লেলিয়ে দেন। কাদিয়ানীরাও জীপে চড়ে এখানে ওখানে মুসলিমদের ওপর গুলি ছোঁড়ে। ফলে পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করে।
১৯৫৩ সনের ৬ই মার্চ লাহোরে মার্শাল ল ঘোষণা করা হয়। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পরিস্থিতি শান্ত হয়ে যায়।
৩৯. দ্বিতীয় গ্রেফতারী ও মৃত্যুদণ্ডাদেশ
১৯৫৩ সনের ২৮শে মার্চ মার্শাল ল কর্তৃপক্ষ সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী, মাওলানা আমীন আহসান ইসলাহী, মিয়া তুফাইল মুহাম্মাদ, মালিক নাসরুল্লাহ খান আযীয, চৌধুরী মুহাম্মাদ আকবার ও সাইয়েদ নকী আলীকে গ্রেফতার করে।
‘‘কাদিয়ানী সমস্যা’’ শীর্ষক পুস্তিকার মাধ্যমে জনগণের মধ্যে বিদ্বেষ ছড়ানো ও সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার অভিযোগে এনে মিলিটারী ট্রাইবুনালে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীর বিচার শুরু করা হয়। ৮ই মে ট্রাইব্যুনাল তাঁকে ফাঁসির হুকুম দেয়।
উল্লেখ্য যে এই দাংগায় নিহত হন ১১ জন লোক। আহত হন ৪৯ জন। এই দাংগার জন্য জামায়াতে ইসলামী বিন্দুমাত্র দায়ী ছিলো না। উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপায় সরকার।
সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীকে ফাঁসির হুকুম দেয়ায় দারুণ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করতে থাকে তাঁর আত্মীয়-স্বজন ও জামায়াতে ইসলামীর কর্মীরা। কিন্তু সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী ছিলেন একেবারেই নিরুদ্বিগ্ন। তাঁর ক্রন্দনরত ছেলেকে সান্ত্বনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘কাঁদছো কেন? জীবন ও মৃত্যুর ফায়সালা হয় আসমানে, যমীনে নয়।’’
৪০. ইসলামী শাসনতন্ত্র প্রণয়নে অগ্রগতি
প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন শাসনতন্ত্র প্রণয়নে হাত দেন। কিন্তু বিভিন্ন বিষয়ে গভর্ণর জেনারেল মালিক গোলাম মুহাম্মাদের সাথে তাঁর মত বিরোধ ঘটে। ১৯৫৩ সনের ১৭ই এপ্রিল গোলাম মুহাম্মাদ প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে নাজিমুদ্দীনকে বরখাস্ত করেন। আমেরিকা থেকে বগুড়ার মুহাম্মাদ আলীকে ডেকে এনে প্রধানমন্ত্রী বানানো হয়।
সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীর মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রচারিত হবার পর দেশে-বিদেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠে। ১২ই মে করাচীতে হরতাল পালিত হয। প্রধানমন্ত্রী মুহাম্মাদ আলী ঢাকা থেকে করাচী এয়ারপোর্টে পৌঁছে বিশাল জনতার বিক্ষোভের সম্মুখীন হন। প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি বিবেচনার ওয়াদা করেন। ১৪ই মে মার্শাল ল কর্তৃপক্ষ সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীর মৃত্যুদণ্ড রহিত করে চৌদ্দ বছর সশ্রম কারাদণ্ডের কথা ঘোষণা করে।
প্রধানমন্ত্রী মুহাম্মাদ আলী ঘোষণা করেছিলেন যে তিনি পাকিস্তানের স্থপতি মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহর জন্মদিন ২৫শে ডিসেম্বর দেশবাসীকে একটি ইসলামী শাসনতন্ত্র উপহার দেবেন।
গভর্ণর জেনারেল গোলাম মুহাম্মাদ সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীকে ফাঁসিতে ঝুলাতে পারেন নি, সেই জন্য দারুণ মর্মজ্বালায় ভুগছিলেন। ইসলামী শাসনতন্ত্রের ঘোষণা উচ্চারিত হওয়ায় তিনি আর স্থির থাকতে পারলেন না। ১৯৫৪ সনের ২৪শে অক্টোবর তিনি শাসনতন্ত্র তৈরীর কাজে নিয়োজিত গণ-পরিষদই ভেংগে দেন।
গণ-পরিষদের স্বীকার মৌলভী তমিজউদ্দীন খান সিনধের চীফ কোর্টে গভর্ণর জেনারেলের পদক্ষেপ চ্যালেঞ্জ করেন। কোর্ট তাঁর পক্ষে রায় দেয়। কিন্তু ফেডারেল কোর্ট সরকারের পক্ষে রায় দেয়।
এমতাবস্থায় গভর্ণর জেনারেল মালিক গোলাম মুহাম্মাদ ইমার্জেন্সী পাওয়ারস অর্ডিন্যান্স জারি করে অনেক ধরণের ক্ষমতার সাথে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের ক্ষমতাও নিজের হাতে তুলে নেন। কিন্তু ১৯৫৫ সনের ১৩ই এপ্রিল ভিন্ন একটি মামলার রায় প্রদান কালে ফেডারেল কোর্ট ইমার্জেন্সী পাওয়ারস অর্ডিন্যান্স বাতিল ঘোষনা করে এবং সরকারকে নতুন গণ পরিষদ গঠন করে তার ওপর শাসনতন্ত্র রচনার ভার অর্পণ করতে বলে।
ফেডারেল কোর্টের রায়ের ফলে যেই সব আইন অকার্যকর হয়ে পড়ে তার একটির আওতায় বন্দী ছিলেন সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী। ফলে তাঁকে আর বন্দী রাখা সম্ভব ছিলো না। দুই বছর একমাস কারাবাসের পর ১৯৫৫ সনের ২৯শে এপ্রিল সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী মুক্তি লাভ করেন।
১৯৫৫ সনের ২৫শে জুন ৮০ সদস্য বিশিষ্ট নতুন গণ-পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। গভর্ণর জেনারেল মালিক গোলাম মুহাম্মাদ এবার চৌধুরী মুহাম্মাদ আলীকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন।
চৌধুরী মুহাম্মাদ আলী একটি ইসলামী শাসনতন্ত্র তৈরীর জন্য আন্তরিকভাবে চেষ্টা চালাতে থাকেন।
১৯৫৬ সনের ২৯শে ফেব্রুয়ারী গণ-পরিষদ পাকিস্তানের জন্য একটি শাসনতন্ত্র পাশ করে। ২রা মার্চ গভর্ণর জেনারেল তাতে স্বাক্ষর করেন। ২৩শে মার্চ থেকে এই শাসনতন্ত্র কার্যকর করা হবে বলে স্থির হয়। উল্লেখ্য যে, ১৯৪০ সনের ২৩শে মার্চ লাহোর সম্মেলনে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ ‘‘পাকিস্তান প্রস্তাব’’ গ্রহণ করেছিলো।
১৯৫৬ সনের ২৩শে মার্চ গভর্ণর জেনারেল মালিক গোলাম মুহাম্মাদকে অব্যাহতি দেয়া হয়। শাসনতন্ত্র অনুযায়ী দেশের নাম হয় ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান। আর এর প্রথম প্রেসিডেন্ট হন মেজর জেনারেল ইসকান্দার আলী মির্যা। চৌধুরী মুহাম্মাদ আলী বহাল থাকেন প্রধানমন্ত্রী পদে। বহু চড়াই-উৎরাই অতিক্রম করে অবশেষে একটি শাসনতন্ত্র তৈরী ও প্রবর্তন করা সম্ভব হয়।
৪১. সাইয়েদ আবুল আ’লার তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান সফর
১৯৫৫ সনের ২৯শে এপ্রিল মুলতান জেলখানা থেকে মুক্তি লাভের পর সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী কোয়েটা এক্সপ্রেস ট্রেনে করে লাহোর পৌঁছেন। লাহোর রেল ষ্টেশন তখন লোকে লোকারণ্য। চার মাইল দীর্ঘ এক মিছিলের সাথে তিনি পৌঁছেন জামায়াতে ইসলামী কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। এরপর তিনি সফরে বের হন। দেশের বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত সমাবেশে তিনি ইসলামী শাসনতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য, প্রয়োজনীয়তা ও যৌক্তিকতা সম্পর্কে বক্তব্য পেশ করতে থাকেন। ১৯৫৬ সনের ২৬শে জানুয়ারী সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী আকাশ পথে লাহোর থেকে ঢাকা পৌঁছেন। তেজগাঁও এয়ারপোর্টে প্রাদেশিক শীর্ষনেতা মাওলানা আবদুর রহীম ও অধ্যাপক গোলাম আযমের নেতৃত্বে জামায়াতে ইসলামী কর্মীরা তাঁকে সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করে।
২৭শে জানুয়ারী তিনি ঢাকা পল্টন ময়দানে একটি জনসভায় বক্তৃতা করেন। ৩০শে জানুয়ারী তিনি ভাষণ দেন সিলেটের জনসভায়। ১লা ফেব্রুয়ারী তিনি বক্তব্য রাখেন কুমিল্লা টাউন হলে, ২রা ফেব্রুয়ারী তিনি চট্টগ্রামের জে. এম. সেন হলে অনুষ্ঠিত সুধী সমাবেশে বক্তব্য রাখেন। ৬ই ফেব্রুয়ারী তিনি বক্তব্য রাখেন লালদীঘি ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায়। ৭ই ফেব্রুয়ারী তিনি নারায়ণগঞ্জে অনুষ্ঠিত জনসভায় বক্তৃতা করেন। ১০ই ফেব্রুয়ারী তিনি বরিশালের জনসভায় যোগ দেন। বরিশাল বি.এম.কলেজে একটি ছাত্র সমাবেশেও তিনি বক্তব্য রাখেন। টাউন হলে অনুষ্ঠিত সমাবেশেও তিনি মূল্যবান বক্তব্য পেশ করেন।
বরিশাল থেকে তিনি স্টীমারে করে খুলনা পৌঁছেন। ১১ই ফেব্রুয়ারী তিনি খুলনার জনসভায় ভাষণ দেন। ১৩ই ফেব্রুয়ারী তিনি বক্তব্য পেশ করেন যশোরে অনুষ্ঠিত জনসভায়। রাতে তিনি ফরিদপুরের পথে রাজবাড়ী এসে পৌঁছেন। রাজবাড়ী পৌঁছে তিনি রেস্ট হাউসের সামনে সমবেত ব্যক্তিদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন এবং রেস্ট হাউসেই রাত কাটান। ১৪ই ফেব্রুয়ারী তিনি ফরিদপুরে অনুষ্ঠিত জনসভায় ভাষণ দেন। ১৫ ফেব্রুয়ারী তিনি কুষ্টিয়ায় বক্তব্য রাখেন। অতপর তিনি রাজশাহী ঈদগাহ ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় ভাষণ দেন। তিনি রাজশাহী বারে রাজশাহী বার এসোসিয়েশনের সদস্যদের উদ্দেশ্যেও বক্তব্য রাখেন। ২২শে ফেব্রুয়ারী তিনি বগুড়াতে এক জনসভায় ভাষণ দেন। ২৩শে ফেব্রুয়ারী তিনি বক্তব্য রাখেন গাইবান্ধা জনসমাবেশে। পরদিন তিনি ঠাকুরগাঁও সফর করেন। ১লা মার্চ তিনি ঢাকা পৌঁছেন। ২রা মার্চ তিনি ঢাকা ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড হলে অনুষ্ঠিত এক সুধী সমাবেশে বক্তব্য রাখেন।
তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) ব্যাপক সফর করে ইসলামের পক্ষে আলোড়ন সৃষ্টি করে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী ১৯৫৬ সনের ৪ঠা মার্চ লাহোরে ফিরেন।
৪২. সাইয়েদ আবুল আ’লার প্রথম বিদেশ সফর
১৯৫৬ সনের মধ্যভাগে সিরিয়ার রাজধানী দামিসকে অনুষ্ঠিত হয় মু’তামার আল আলম আল ইসলামীর সম্মেলন। এই সম্মেলনে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী অন্যতম মেহমান হিসেবে আমন্ত্রিত হন। ২৫শে জুন তিনি করাচী এয়ারপোর্ট থেকে আকাশ পথে বৈরুত রওয়ানা হন। যথাসময়ে তিনি সেখানে পৌঁছেন। লেবাননের ইসলামী আন্দোলন ‘‘ইবাদুর রাহমান’’ ও ‘‘আল ইখওয়ানুল মুসলিমূনের’’ নেতৃবৃন্দ তাঁকে এয়ারপোর্টে সম্বর্ধনা জানান। সেখান থেকে মোটর গাড়িতে চড়ে তিনি সিরিয়ার রাজধানী দামিসকে পৌঁছেন। মু’তামারের সম্মেলনে মুসলিম উম্মাহর সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমস্যা সম্পর্কে তিনি জ্ঞানগর্ভ ভাষণ পেশ করেন। তিনি মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও সংহতির গুরুত্বও বিশ্লেষণ করেন। তিনি একটি কেন্দ্রীয় সংস্থা গড়ে তোলার প্রস্তাব দেন যেটি দুনিয়ার বিভিন্ন ভাষায় রচিত উন্নতমানের ইসলামী সাহিত্য অন্যান্য ভাষায় অনুবাদ করে বিতরণের ব্যবস্থা করবে। তিনি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মুসলিম প্রিন্ট মিডিয়া ও নিউজ এজেন্সী গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি মুসলিম দেশগুলোর শিক্ষা ব্যবস্থাকে ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থায় রূপান্তরের প্রয়োজনীয়তাও বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেন।
তাঁর সফর কালে তিনি দামিসকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের এক সমাবেশে বক্তৃতা করেন। এই সমাবেশে সভাপতিত্ব করেছিলেন সিরিয়ার তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী। দামিসক অবস্থানকালে তিনি মরক্কোর ইসলামী আন্দোলনের নেতা মাক্কী আন্নাসিরী এবং মিসরের আল ইখওয়ানুল মুসলিমূনের স্থপতি শহীদ হাসানুল বান্নার জামাতা ডঃ সায়ীদ রমাদানের সাথে সাক্ষাত ও মত বিনিময় করেন।
জর্ডনের কিং হুসাইন সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী ও মু’তামারের সম্মেলনে যোগদানকারী অন্যান্য প্রতিনিধিকে জর্ডন সফরের আমন্ত্রণ জানান। যথসময়ে তাঁরা জর্ডন পৌঁছেন। সাইয়েদ আবুল আ’লা রাজধানী আম্মানে এক বিশাল জনসমাবেশে ভাষণ দেন। তিনি ইবরাহীম (আ) এর কর্মকেন্দ্র ও সমাধিস্থল আল খালীল বা হেবরনও দর্শন করেন। (তখন আল খালীল জর্ডনের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। বর্তমানে এটি ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাঈলের দখলে রয়েছে)। অতপর তিনি হলব শহর দেখতে যান। পরে দামিস্ক পৌঁছেন।
১৯৫৬ সনের ১১ই জুলাই সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী আকাশ পথে সাউদী আরবের জিদ্দা পৌঁছেন। জিদ্দা থেকে মাক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। তখন ছিলো হাজ মওসুম। সাইয়েদ আবুল আ’লা হাজ পালন করেন। মাক্কাতে তিনি আঠার দিন অবস্থান করেন। এই সময় তিনি ইসলামের ঐতিহাসিক স্থানগুলো দেখার সুযোগ পান। মাক্কা থেকে তিনি পৌঁছেন মাদীনা। তিনি মাসজিদে নববীতে ছালাত আদায় করেন। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কবরের সন্নিকটে দাঁড়িয়ে প্রিয় নবীর উদ্দেশ্যে ছালাত ও সালাম পেশ করেন। তিনি মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও খুলাফায়ে রাশেদীনের স্মৃতি বিজড়িত বিভিন্ন স্থান দেখেন।
১৯৫৬ সনের অগাস্ট মাসের মাঝামাঝি সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী তাঁর প্রথম বিদেশ সফর সমাপ্ত করে লাহোর ফিরেন।
৪৩. ১৯৫৬ সনের শাসনতন্ত্রের দুই দিক
সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী দেশের জন্য একটি শাসনতন্ত্র তৈরী হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেন। শাসনতন্ত্রে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি থাকাটাকে তিনি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় গণ্য করেন। শাসনতন্ত্রে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণরূপে আলাদা করার বিধান রাখা হয়েছো এবং জনগণের মৌলিক অধিকার হিফাজাতের দায়িত্ব বিচার বিভাগের ওপর ন্যস্ত করা হয়েছিলো। এটিকেও তিনি বড়ো রকমের সাফল্য হিসেবে দেখেন।
তবে এই কথাও সত্য যে ইসলামী মূলনীতিগুলোকে জাতীয় জীবনে কিভাবে বাস্তবায়ন করা হবে তার দিক নির্দেশনা শাসনতন্ত্রে ছিলো না। তদুপরি ‘‘যুক্ত নির্বাচন’’ না ‘‘পৃথক নির্বাচন’’ এই বিষয়টি অমীমাংসিত রাখা হয়েছিলো।
৪৪. ক্ষমতার দ্বন্দ্ব
এই শাসনতন্ত্র না ছিলো পুরোপুরি ‘‘প্রেসিডেনশিয়াল’’ না ছিলো পুরোপুরি ‘‘পার্লামেন্টারী’’। ফলে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে বনিবনা না থাকলে ক্ষমতা নিয়ে টাগ-লব-ওয়ারের সুযোগ ছিলো। এই সুযোগেরই সদ্ব্যবহার করেছিলেন ‘‘ইসলামিক রিপাবলিকান অব পাকিস্তানের’’ প্রথম প্রেসিডেন্ট ইসকান্দার আলী মীর্যা।
ব্যক্তিগতভাবে তিনি কোন ইসলামী ব্যক্তিত্ব ছিলেন না। ইসলামের প্রতি তাঁর অনুরাগও ছিলো না। পক্ষান্তরে প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী মুহাম্মাদ আলী ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান মুসলিম। এসেম্বলীতে মুসলিম লীগের নেতা হিসেবে তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ অলংকৃত করেছিলেন। তাঁর সাথে বনিবনা না হওয়ায় প্রেসিডেন্ট ইসকান্দার আলী মীর্যা মালিক ফিরোজ খান নুনকে দিয়ে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে রিপাবলিকান পার্টিকে শক্তিশালী করে তোলেন। একে একে বহু লোক মুসলিম লীগ ছেড়ে রিপাবলিকান পার্টিতে যোগ দিতে হবে।
চৌধুরী মুহাম্মাদ আলীর জন্য অবস্থা নাজুক হয়ে উঠে। বিরক্ত হয়ে তিনি ১৯৫৬ সনের ৮ই সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী পদে ইস্তফা দেন।
১৯৫৬ সনের ১২ই সেপ্টেম্বর কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ ও রিপাবলিকান পার্টির কোয়ালিশন সরকার কায়েম হয়। প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন আওয়ামী লীগের হুসাইন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কিছুদিন পরেই প্রধানমন্ত্রী হুসাইন শহীদ সোহরাওয়ার্দী লাহোরের এক জনসভায় ‘‘যুক্ত নির্বাচন’’ পদ্ধতির পক্ষে জনমত সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন। ঐ বছরের অক্টোবর মাসে করাচীতে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী ‘পৃথক নির্বাচন’ পদ্ধতির পক্ষে বক্তব্য রাখেন। ঐ জনসভায় এক লাখের বেশি শ্রোতা উপস্থিত ছিলেন।
৪৫. জামায়াতে ইসলামীতে মতবিরোধ
গণ-পরিষদে ‘‘আদর্শ প্রস্তাব’’ পাস হওয়ার পর ১৯৫১ সনের ১০ই নভেম্বর করাচীতে অনুষ্ঠিত হয় জামায়াতে ইসলামী রুকন সম্মেলন। এই সম্মেলনে গৃহীত একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছিলো এই যে অতপর জামায়াতে ইসলামী দেশের সাধারণ নির্বাচনগুলোতে অংশ নেবে।
এই সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে জামায়াতে ইসলামী পাঞ্জাব প্রদেশ, সীমান্ত প্রদেশ ও বাহাওয়ালপুর রাজ্যের কয়েকটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। পাঞ্জাব প্রদেশে একজন ও বাহাওয়ালপুরে দুইজন নমিনি নির্বাচিত হন। অধিকাংশ নমিনি নির্বাচনে ফেল করায় কেন্দ্রীয় মাজলিসে শূরার কয়েকজন সদস্য বলেন যে জামায়াতে ইসলামীর নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করা ভুল হয়েছে এবং ব্যাপক হারে লোক তৈরী না হওয়া পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকা উচিত।
এই মত বিরোধ নিরসনের জন্যই ১৯৫৭ সনের ১৭, ১৮, ১৯, ২০ ও ২১শে ফেব্রুয়ারী বাহাওয়ালপুর রাজ্যের রহীম ইয়ার খান জিলার মাছিগোঠ পল্লীতে অনুষ্ঠিত হয় জামায়াতে ইসলামী রুকন সম্মেলন। এই সময় রুকন ছিলেন ১২৭২ জন। নয়শত পঁয়তাল্লিশজন রুকন সম্মেলনে যোগদান করেন।
নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকার জন্য যাঁরা বক্তৃতা করেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন মাওলানা আমীন আহসান ইসলাহী ও আবদুল জাব্বার গাজী। বিভিন্ন যুক্তির অবতারণা করে তাঁরা ছয় ঘন্টা বক্তব্য রাখেন। তাঁদের যুক্তি খণ্ডন করে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীও ছয় ঘন্টাব্যাপী ভাষণ পেশ করেন।
এই ভাষণে তিনি বলেন,
‘‘সমাজকে ইসলামী জীবন ব্যবস্থার জন্য তৈরী করাই যদি আপনাদের সমাজ সংশোধনের উদ্দেশ্য হয় তাহলে ভোটারদেরকে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তৈরী করার কাজটি সেই প্রচেষ্টার কর্মসীমার বাইরের বিষয় হয় কিভাবে? আর এই কাজটি না করলে সমাজ বিপর্যয় সৃষ্টিকারী নেতৃত্বকে অপসারিত করে সৎ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার যোগ্য হবে এটাই বা কি করে সম্ভব? ইসলামী জীবন বিধানের সাথে তাদেরকে পরিচিত করে তুলতে হবে। ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার আকাংখা তাদের মাঝে সৃষ্টি করতে হবে। সৎ ও অসৎ নেতৃত্বের পার্থক্য তাদেরকে বুঝাতে হবে। দেশের ভালো-মন্দ, কল্যাণ-অকল্যাণের দায়িত্ব যে তাদের ওপর ন্যস্ত, এই চেতনা তাদের মাঝে সৃষ্টি করতে হবে। তারা যাতে অর্থের বিনিময়ে ভোট বিক্রি না করে, কারো হুমকিতে বিবেকের বিরুদ্ধে গিয়ে কাউকে ভোট না দেয়, কোন ধোঁকাবাজের দ্বারা প্রতারিত না হয়, অথচ দুর্নীতি দেখে বীতশ্রদ্ধ হয়ে ঘরে বসে না থাকে অন্তত অতোটুকু নৈতিক শক্তি ও বিচারবুদ্ধি তাদের মাঝে সৃষ্টি করতে হবে। নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করে এই কাজটুকু আমরা করতে চাই। কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তি কি ভাবতে পারেন যে এটা সমাজ সংশোধনের কাজ নয়? কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তি কি ভাবতে পারেন যে দেশের ভোটারদেরকে এইভাবে তৈরী না করেই নেতৃত্বের পরিবর্তন সাধিত হতে পারে?
[দ্রষ্টব্যঃ ইসলামী আন্দোলনের ভবিষ্যত কর্মসূচী, সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী, পৃষ্ঠা–১২৩,১২৪।]
এই ভাষণের একাংশে তিনি বলেন, ‘‘লোকদের ঈমানদার, নামাযী, পরহেযগার ও সংশোধনকামী হওয়া এক কথা, আর ফায়সালার সময় বিদ্বেষ, প্রলোভন, ভয়-ভীতি ও প্রতারণা থেকে মুক্ত হয়ে কার্যত ইসলামী জীবন ব্যবস্থার পাল্লাকে ভারী করার জন্য দৃঢ় সংকল্প হওয়া ভিন্ন কথা। প্রথম ধরণের সংশোধনের কাজ যতো খুশি বেশি করতে চান তো করতে থাকুন। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে কতো লোক এই চূড়ান্ত পর্যায়ের সংশোধনকে কবুল করেছেন, তা শুধু ফায়সালার সময়েই জানা যেতে পারে। আর ফায়সালার সময় আসে নির্বাচনের মওসুমে। এই মানদণ্ডই কয়েক বছর অন্তর সমাজের মনোভংগি ও নৈতিকতার প্রকৃত অবস্থা এবং তার ভালো-মন্দের প্রতিটি দিক মেপে-জুকে দেখিয়ে দেয়। এ এক ধরণের আদম শুমারী। সমাজে কয়জন ভোট বিক্রয়কারী রয়েছে, কয়জন চাপের কাছে নতি স্বীকার করে, কয়জন বিদ্বেষে লিপ্ত, কয়জন ইসলাম-বিরোধী মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত, কি পরিমাণ দুর্নীতি এখানে প্রচলিত এবং তাদের মধ্যে ক’জন ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার সহায়তার জন্য তৈরী হয়েছে এর প্রতিটি বিষয়ই এই আদম শুমারি হিসাব করে বলে দেয়। এই মানদন্ডের সম্মুখীন না হয়ে সমাজ সংশোধনের জন্য আপনাদের মেহনতের ফলে প্রকৃতপক্ষে কতোটুকু সংশোধনের কাজ সম্পন্ন হয়েছে, আর কতোটুকুই বা বাকি আছে তা জানা যাবে আর কোন উপায়ে?’’
[দ্রষ্টব্যঃ ইসলামী আন্দোলনের ভবিষ্যত কর্মসূচী, সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী, পৃষ্ঠা–১২৫।]
তিনি আরো বলেন,
‘‘আমি স্বীকার করি যে বর্তমান পরিস্থিতিতে সাফল্যের সম্ভবনা খুবই কম। এও স্বীকার করি যে ব্যর্থতার ফলে জনমনেও খারাপ প্রভাব পড়ে, আন্দোলনের সমর্থকরাও নিরুৎসাহিত হয় এবং আমাদের কর্মীদের মধ্যেও কিছুটা বীতশ্রদ্ধার সৃষ্টি হয়। কিন্তু এতদসত্ত্বেও নির্বাচন থেকে বিচ্ছন্ন থাকার জন্য এটাকে সঠিক ও যুক্তিসংগত কারণ বলে আমি স্বীকার করিনা। ব্যর্থতার যেই কারণগুলো দেখানো হয়, নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে তার একটিও দূর করা যাবে না। নির্বাচন থেকে দূরে সরে থাকলে এই কারণগুলো হ্রাস পাওয়া তো দূরে থাক বরং আরো বৃদ্ধি পেতে থাকবে। এইগুলোর প্রতিকারের একমাত্র উপায় হচ্ছে নিরবচ্ছিন্নভাবে এই সংগ্রাম ক্ষেত্রে অবতরণ করে এইগুলোর মুকাবিলা করতে থাকা ও এইগুলোর শিকড় উপড়ে ফেলা।’’
[দ্রষ্টব্যঃ ইসলামী আন্দোলনের ভবিষ্যত কর্মসুচী, সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী, পৃষ্ঠা– ১৩২,১৩৩।]
আরো এগিয়ে তিনি বলেন,
রাজনৈতিক দলগুলো যেইসব নির্বাচনী অস্ত্র ব্যবহার করে ও শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তিরা যেইগুলো ব্যবহারে অধিকতর দক্ষতা, নির্ভীকতা ও বেপরোয়া ভাব দেখায় তা আপনা-আপনি পরিত্যাক্ত হবে বলে কি আপনারা মনে করেন? আপনারা কি মনে করেন যে এই লোকগুলো আপনা-আপনি সাধু-সজ্জন হয়ে যাবে ও এইসব অস্ত্র ব্যবহার করতে লজ্জা পাবে? নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব ক্ষমতার পরিবর্তনের জন্য আপনারা কি এমন একটি মুহূর্তের প্রত্যাশী যখন দুষ্কৃতিকারীরা ময়দান থেকে আপনা আপনি সরে দাঁড়াবে, আর কেবল ভদ্র লোকদের সাথেই আপনাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে? এই যদি আপনাদের আকাংখা হয় এবং এই শর্তগুলো পূর্ণ হলে যদি আপনারা নেতৃত্বের পরিবর্তনের জন্য কাজ করতে চান, তাব আপনাদের এই আকাংখা ও শর্তগুলো কবে পূর্ণ হবে এবং কবে আপনারা এই সৎ কাজের জন্য অগ্রসর হতে পারবেন, তা আমি জানিনা। নেতৃত্বের পরিবর্তনের জন্য আপনারা যদি সত্যিই কিছু করতে চান তো এই ‘‘নোংরা খেলায়’’ পবিত্রতার সাথে এগিয়ে আসুন, বৈধ পন্থায় তামাম অবৈধ অস্ত্রের মুকাবিলা করুন, জাল ভোটের মুকাবিলায় নির্ভেজাল ভোট দিন, অর্থের বিনিময়ে ভোট ক্রয়কারীদের মুকাবিলায় নীতি ও আদর্শের খাতিরে ভোট দাতাদের নিয়ে আসুন এবং ধোঁকা প্রতারণা ও মিথ্যার দ্বারা কাজ হাছিলকারীদের মুকাবিলায় ইস্পাত কঠিন ঈমানের পরিচয় দিন। এর ফলে একবার নয়, দশবার পরাজয় বরণ করতে হলেও করুন। আপনারা পরিবর্তন আনতে চাইলে একমাত্র এভাবেই আনতে পারেন। এইবাবে কাজ করতে করতে এমন এক সময় আসবে যখন সমস্ত অবৈধ অস্ত্র প্রয়োগ করেও দুষ্কৃতিকারীরা পরাজিত হবে।’’
[দ্রষ্টব্যঃ ইসলামী আন্দোলনের ভবিষ্যত কর্মসূচী, সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী, পৃষ্ঠা–১৩৩।]
এই ভাষণে তিনি আরো বলেন,
‘‘সন্দেহ নেই, এ একটি দুর্গম পথ। এতে হোঁচট খেতে হবে, পরাজয় বরণ করতে হবে, দুর্বলচিত্ত লোকেরা নিরুৎসাহিত হবে। আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যদের মনেও হতাশা সৃষ্টি হবে। আর এই কথাও সত্য যে জনগণের একটি বিরাট অংশ এই প্রাথমিক পরাজয় থেকে ভুল অর্থ গ্রহণ করবে। কিন্তু এই দুর্গম পথ ছাড়া আমাদের লক্ষ্যস্থলে পৌঁছার বিকল্প কোন পথ নেই।’’
[দ্রষ্টব্যঃ ইসলামী আন্দোলনের ভবিষ্যত কর্মসূচী, সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী, পৃষ্ঠা– ১৩৪।]
উল্লেখ্য যে, এই ভাষণে একটি মৌলিক বিষয়ের দিকেও তিনি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি বলেন, ‘‘একটি নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বসবাস করে নেতৃত্বের পরিবর্তনের জন্য কোন অনিয়মতান্ত্রিক পন্থাবলম্বন করা শারীয়াহ সমর্থিত নয়।’’
[দ্রষ্টব্যঃ ইসলামী আন্দোলনের ভবিষ্যত কর্মসূচী, সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী, পৃষ্ঠা–১২০]
অতপর সম্মেলনে উপস্থিত রুকনদের মতামত গ্রহণ করা হয়। নয়শত পঁয়তাল্লিশ জন রুকনের মধ্যে নয়শত বিশ জন সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীর মত সমর্থন করেন। ভিন্নমত সমর্থন করেন মাত্র পনের জন রুকন।
৪৬. দেশের নির্বাচন পদ্ধতি প্রশ্নে গণ–ভোট দাবি
প্রেসিডেন্ট ইসকান্দার আলী মীর্যার সাথে মত বিরোধ সৃষ্টি হওয়ায় ১৯৫৭ সনের ১৬ই অক্টোবর হুসাইন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী পদে ইস্তফা দেন।
এবার প্রধানমন্ত্রী পদে নিযুক্ত হন মুসিলম লীগের আই.আই. চুন্দ্রিগড়। নতুন প্রধানমন্ত্রী ‘‘পৃথক নির্বাচন’’ পদ্ধতি প্রবর্তনের জন্য একটি বিলের খসড়া তৈরী করে ফেলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ ‘‘পৃথক নির্বাচন’’ পদ্ধতি প্রতিরোধ করতে ছিলো দৃঢ় সংকল্প। আওয়ামী লীগ কেন্দ্রে রিপাবলিকান পার্টিকে মন্ত্রীসভা গঠনে সাহায্য করতে এই শর্তে প্রস্তুত হয় যে রিপাবলিকান পার্টি ‘‘পৃথক নির্বাচন’’ নয়, ‘‘যুক্ত নির্বাচন’’ পদ্ধতি প্রবর্তন করবে। ক্ষমতার মোহে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মনোভংগি উপেক্ষা করে রিপাবলিকান পার্টি আওয়ামী লীগের প্রস্তাব মেনে নেয়। ১৯৫৭ সালের ১৬ই ডিসেম্বর মালিক ফিরোজ খান নূন প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন।
প্রধানমন্ত্রী হয়ে মালিক ফিরোজ খান নূন ‘‘যুক্ত নির্বাচন’’ পদ্ধতি সংক্রান্ত বিল তৈরীর কাজে হাত দেন। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মত উপেক্ষা করে ‘‘যুক্ত নির্বাচন’’ সংক্রান্ত বিল তৈরী করার উদ্যোগ গ্রহণ করায় সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধমে বিপাবলিকান পার্টি ও আওয়ামী লীগের তীব্র সমালোচনা করেন।
১৯৫৮ সনের ১৯শে জানুয়ারী লাহোরের মুচিগেটে অনুষ্ঠিত এক বিশাল জনসভায় সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী নির্বাচন পদ্ধতি বিষয়ে সারা দেশে গণভোট (রেফারেন্ডাম) অনুষ্ঠানের দাবি জানান।
৪৭. সাইয়েদ আবুল আ’লার তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে দ্বিতীয় সফর
১৯৫৮ সনের ৩০শে জানুয়ারী সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী করাচী থেকে আকাশ পথে ঢাকা পৌঁছেন। ৩১শে জানুয়ারী তাঁকে ঢাকাতে সম্বর্ধনা দেয়া হয়। সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি ‘‘যুক্ত নির্বাচন’’ পদ্ধতি ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরে বক্তব্য রাখেন।
অতপর সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী চট্টগ্রাম সফর করেন। এখানে তিনি সুধী সমাবেশ, বার এসোসিয়েশান সদস্যদের সমাবেশ ও জনসভায় বক্তব্য রাখেন।
সেখানে থেকে কুমিল্লা পৌঁছেন। কুমিল্লায় তিনি সুধী সমাবেশে জনসভায় বক্তব্য রাখেন।
৮ই ফেব্রুয়ারী তিনি সিলেটে এক জনসভায় ভাষণ দেন। ১১ই ফেব্রুয়ারী তিনি বক্তৃতা করেন রাজশাহীতে অনুষ্ঠিত জনসভায়।
১৫ই ফেব্রুয়ারী তিনি মোমেনশাহীতে একটি সুধী সমাবেশে বক্তব্য রাখেন।
২২ই ফেব্রুয়ারী তিনি ট্রেনযোগে রংপুরে পৌঁছেন। ষ্টেশনে পৌঁছেলে তাঁকে জানানো হয় যে জিলা ম্যাজিষ্ট্রেট শহরে ১৪৪ ধারা জারি করেছেন। শহরে জামায়াতে ইসলামী কোন জনসভা করতে পারবে না। উল্লেখ্য যে তখন তদানীন্তর পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ সরকার কায়েম ছিল। সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী ষ্টেশনে সমবেত ব্যক্তিদের উদ্দেশ্যে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রেখে ঐ ট্রেনে করেই সৈয়দপুরে পৌঁছেন। ২৩শে ফেব্রুয়ারী তিনি সৈয়দপুর জনসভায় ভাষণ দেন। ২৭ শে ফেব্রুয়ারী তিনি ভাষণ দেন দিনাজপুর অনুষ্ঠিত জনসভায়। ২৮শে ফেব্রুয়ারী ঠাকুরগাঁওতে অনুষ্ঠিত জনসভায় তিনি বক্তব্য রাখেন।
এবার তিনি একটানা ৪৫ দিন সফর করেন। ১৯৫৮ সনের ১৫ই মার্চ ঢাকাতে তিনি একটি প্রেস বিবৃতি দেন। এতে তিনি বলেন যে ৮০ থেকে ৯০ ভাগ লোক ‘‘পৃথক নির্বাচন’’ পদ্ধতির পক্ষে। রিপাবলিকান পার্টি ও আওয়ামীলীগ বলে বেড়াচ্ছে যে দেশের বেশির ভাগ লোক ‘‘যুক্ত নির্বাচন’’ তিনি প্রশ্ন করেন, তাদের দাবি যদি সত্য হয় তাহলে গণভোট (রেফারেন্ডাম) দিতে ভয় পাচ্ছে কেন?
সফর শেষে তিনি লাহোর ফিরেন।
৪৮. অ–শাসনতান্ত্রিক শাসনের কবলে পাকিস্তান
১৯৫৪ সনের ৮ থেকে ১২ই মার্চ তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রাদেশিক পরিষদের আসন সংখ্যা ছিলো তিনশত নয়।
এই নির্বাচনে শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও হুসাইন সোহরাওয়ার্দী কর্তৃক পরিচালিত যুক্তফ্রন্ট তিন শত আসনে বিজয়ী হয়। মুসলিম লীগ পায় মাত্র নয়টি আসন।
১৯৫৪ সনের ৩রা এপ্রিল শেরে বাংলা এ.কে.ফজলুল হকের নেতৃত্বে প্রাদেশিক মন্ত্রীসভা গঠিত হয়। আওয়ামী লীগ এই মন্ত্রীসভায় যোগদানে বিরত থাকে। যুক্তফ্রন্টের বিভিন্ন দলগুলো পারস্পরিক কোন্দলে লিপ্ত হয়। এক মাস সাতাশ দিন পর ১৯৫৪ সনের ৩০ শে মে কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেংগে দিয়ে প্রদেশে গভর্ণরের শাসন কায়েম করে।
১৯৫৬ সনের ৬ই জুন গভর্ণরের শাসন প্রত্যাহার করা হয় এবং আবু হুসাইন সরকারের নেতৃত্বে দ্বিতীয়বার যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন করা হয়। এবারও আওয়ামীলীগ মন্ত্রীসভায় যোগদানে বিরত থাকে। মাত্র দুই মাস পর আওয়ামী লীগ আনীত অনাস্থা প্রস্তাবের ফলে আবু হুসাইন সরকার মন্ত্রীসভার পতন ঘটে। ১৯৫৬ সনের ৬ই সেপ্টেম্বর আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ একটি কোয়ালিশন সরকার গঠন করে। প্রায় দুই বছর এই সরকার ক্ষমতায় ছিলো।
১৯৫৮ সনের ৩০ মার্চ তদানীন্তন গভর্ণর শেরে বাংলা এ.কে.ফজলুল হক আতাউর রহমান খানের মন্ত্রীসভা বরখাস্ত করায় আবু হুসাইন সরকারের নেতৃত্বে আবার মন্ত্রীসভা গঠিত হয়। এই দিকে এ.কে.ফজলুল হক গভর্ণর পদ হারান।
নতুন গভর্ণর হয়ে আসেন সুলতানউদ্দীন আহমদ। তিনি আবু হুসাইন সরকারকে বরখাস্ত করে আবার মুখ্যমন্ত্রী নিযুক্ত করেন আতাউর রহমান খানকে।
১৯৫৮ সনের ২০শে সেপ্টেম্বর আতাউর রহমান খান মন্ত্রীসভার প্রতি আস্থা ভোটের জন্য প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন ডাকা হয়। এই অধিবেশন স্পীকার আবদুল হামিদের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব পাস করে। ফলে ডেপুটি স্পীকার শাহেদ আলী পাটোয়ারী স্বীকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু সংসদ সদস্যরা এক পর্যায়ে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে স্পীকারের উপর হামলা চালায়। হাসপাতালে তিনি ইন্তেকাল করেন।
এই সময় তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানে খান আবদুল কাইয়ুম খানের নেতৃত্বে মুসলিম লীগ মারমুখো হয়ে উঠে। আবার কালাত দেশীয় রাজ্যের খান তার রাজ্যটিকে পাকিস্তান থেকে আলাদা করে নেয়ার চেষ্টা চালাতে থাকেন।
১৯৫৮ সনের ৬ই অক্টোবর সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী লাহোরের মুচিগেটে অনুষ্ঠিত জনসভায় ভাষণ দেন। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন যে দেশ এমন এক নাজুক অবস্থায় পৌঁছেছে যে কেউ বলতে পারে না আগামীকাল কি ঘটবে, এমন হতে পারে যে লোকেরা রাতে ঘুমিয়ে পড়বে, আর সকালে উঠে জানতে পাবে যে পুরো শাসনতন্ত্রই বাতিল হয়ে গেছে।
বিরাজমান পরিস্থিতি বস্তুনিষ্ঠভাবে বিশ্লেষণ করেই সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী এমন মন্ত্রব্য করেছিলেন। তাঁর এই আশংকা সত্যে পরিণত হয়।
১৯৫৮ সনের ৭ই অক্টোবর প্রেসিডেন্ট ইসকান্দার আলী মীর্যা দেশে সামরিক শাসন জারি করেন। শাসনতন্ত্র বাতিল করা হয়। জাতীয় পরিষদ, প্রাদেশিক পরিষদ, কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা ও প্রাদেশিক মন্ত্রীসভা ভেংগে দেয়া হয়। প্রধান মার্শাল ল এডমিনিষ্ট্রেটর নিযুক্ত হন সেনা প্রধান জেনারেল মুহাম্মাদ আইউব খান।
প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের আরেক দৃশ্য দেখা গেলো ২৭শে অক্টোবর। ঐ দিন জেনারেল মুহাম্মাদ আইউব খানের চাপের মুখে প্রেসিডেন্ট পদে ইস্তফা দেন ইসকান্দার আলী মীর্যা। শুধু ক্ষমতা ছাড়তেই নয়, দেশ ছাড়তেও তিনি বাধ্য হন। জেনারেল মুহাম্মাদ আইউব খান নিজেই প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা গ্রহণ করেন। সামরিক শাসন কায়েম হওয়ায় সকল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ হয়ে যায়। জামায়াতে ইসলামীও রাজনৈতিক কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়।
৪৯. সাইয়েদ আবুল আ’লার দ্বিতীয় বিদেশ সফর
সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী অবিরাম লিখে চলছিলেন তাফহীমুল কুরআন। আল কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বিভিন্ন নবীর কার্যাবলী আলোচনা করতে গিয়ে তাদের বিচরিত বিভিন্ন স্থানের নাম উল্লেখ করেছেন। ঐ সব স্থান দেখার দারুণ আগ্রহ ছিলো সাইয়েদ আবুল আ’লার মনে।
১৯৫৯ সনের ৩রা নভেম্বর তিনি করাচী থেকে সমুদ্র পথে যাত্রা করে ৮ই নভেম্বর বাহরাইন পৌঁছেন। রাজধানী মানামা থেকে আকাশপথে তিনি খুবার পৌঁছেন ১০ই নভেম্বর। ১১ই নভেম্বর রাস তানুরাহ ও ১৩ই নভেম্বর বাকিক সফর করেন।
১৩ই নভেম্বর পৌঁছেন সাউদী আরবের অন্যতম শহর দাহরান। ১৪ই নভেম্বর তিনি দাম্মাম পৌঁছেন। ১৫ই নভেম্বর উক্ত অঞ্চলের গভর্ণর সাইয়েদ আবুল আ’লার সম্মানে লাঞ্চের আয়োজন করেন এবং এয়ারপোর্ট হোটেলে রাষ্ট্রীয় মেহমান হিসেবে তাঁর থাকার ব্যবস্থা করেন। ১৮ই নভেম্বর তিনি ট্রেনযোগে সউদী আরবের রাজধানী রিয়াদ পৌঁছেন। রিয়াদে তিনি শায়খ আবদুল আযীয বিন বায, উস্তাদ হামাদুল জাসার, শায়খ মিনাহ আলকাতান, আবদুল্লাহ ফিলবী প্রমুখ ইসলামী চিন্তাবিদদের সাথে সাক্ষাত ও মতবিনিময় করেন।
রিয়াদের গভর্ণর আমীর আবদুল্লাহ তাঁর সম্মানে এক ডিনারের আয়োজন করেন। আমীর আবদুল্লাহ তাঁকে দারইয়াহ সফরের আমন্ত্রণ জানান।
২৩শে নভেম্বর সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী দারইয়াহ পৌঁছেন। উল্লেখ্য যে দারইয়াহ ছিলো ছোট্ট একটি রাজ্য যার আমীর ছিলেন সাউদী রাজ বংশের পূর্বপুরুষ মুহাম্মাদ ইবনুস সাউদ। উয়াইনা থেকে শায়খ মুহাম্মাদ ইবুন আবদিল ওয়াহহাব (রহ) দারইয়াহ এসে আমীর মুহাম্মাদ ইবনুস সাউদের নিকট ইসলামের খাঁটি রূপ তুলে ধরেন। আমীর মুহাম্মাদ তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে দারইয়াহকে একটি ক্ষুদ্র ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করেন। আজকের সাউদী আরব সেই রাষ্ট্রের সম্প্রসারিত রূপ। সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী ঐতিহাসিক স্থানগুলো ঘুরে ঘুরে দেখেন।
২৮শে নভেম্বর সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী আকাশ পথে জিদ্দা পৌঁছেন। জিদ্দা এয়ারপোর্টে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত চৌধুরী আলী আকবার তাঁকে রিসিভ করেন। রাষ্ট্রদূত তাঁর সম্মানে একটি ডিনারের আয়োজন করেন। জিদ্দার গণমান্য ব্যক্তিরাও এতে যোগ দেন। জিদ্দাতে বাস করতেন শায়খ মুহাম্মাদ নাসিফ নাম একজন বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ। সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী তাঁর বাড়িতে গিয়ে তাঁর সাথে সাক্ষাত করেন। ৩০শে নভেম্বর সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী মাক্কা পৌঁছেন এবং ১লা ডিসেম্বর উমরাহ করেন। মাক্কায় অবস্থানকালে তিনি দারুল আরকাম, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জন্মস্থান, শিয়াবে আবু তালিব, মাসজিদে রাইয়া, মাসজিদে জিন, আলমায়াল্লা কবরস্থান, জাবালুন্নূর, মিনা, মাশআরুল হারাম, মুযদালিফা, আরাফাত প্রান্তর, সাউর পাহাড় প্রভৃতি স্থান দর্শন করেন।
৪ঠা ডিসেম্বর তিনি মোটর গাড়িতে করে তায়েফের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন এবং রাত দশটায় তায়েফ পৌঁছেন। ৫ই ডিসেম্বর তায়েফের নিকটবর্তী বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থান দেখেন। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তায়েফের মুশরিকদের নিক্ষিপ্ত কংকরের আঘাতে জর্জরিত হয়ে যেই স্থানটিতে বসে বিশ্রাম নিয়েছিলেন ও আদ্দাস নামক একজন নিনেভাবাসী ক্রীতদাস তাঁকে আংগুর খেতে দিয়েছিলেন সেই স্থানটিতে রয়েছে একটি মাসজিদ। সাইয়েদ আবুল আ’লা সেই স্থানটিও দেখেন। তায়েফের মাসজিদে আবদুল্লাহ ইবনুল আব্বাসও তিনি দেখতে যান। এই মাসজিদের পাশেই রয়েছে আল্লাহর রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অন্যতম প্রিয় সাহাবী ও চাচাতো ভাই আবদুল্লাহ ইবনুল আব্বাসের (রা) কবর। উল্লেখ্য যে তায়েফ অবরোধ কালে মুসলিম বাহিনী এই স্থানটিতেই ক্যাম্প স্থাপন করেছিলো। ৬ই ডিসেম্বর উকায ও হুনাইন হয়ে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী মাক্কা পৌঁছেন।
৭ই ডিসেম্বর তিনি ঐতিহাসিক হুদায়বিয়া চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার স্থান হুদাইবিয়া জনপদ পরিদর্শন করেন ও রাতে মাক্কায় ফিরে আসেন।
৮ই ডিসেম্বর তিনি জিদ্দা পৌঁছেন।
১২ই ডিসেম্বর সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী স্থলপথে মাদীনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। মাসতুরা, মুফরাক প্রভৃতি স্থান অতিক্রম করে তিনি বদর জনপদে প্রবেশ করেন। বদরের যুদ্ধের ময়দান, বদরের শহীদদের কবর, যুদ্ধকালে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অবস্থান স্থল দর্শন করে সংগীদের নিয়ে তিনি আলওয়াসতা, আলহামরা ও যুল হুলাইফা হয়ে ১৩ই ডিসেম্বর সন্ধ্যায় মাদীনায় পৌঁছেন। মাদীনায় তিনি প্যালেস হোটেলে অবস্থান করেন। রাতেই তিনি মাসজিদে নববীতে যান, ছালাত আদায় করেন ও মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উদ্দেশ্যে ছালাত ও সালাম পেশ করেন।
১৪ই ডিসেম্বর তিনি মাদীনীন অঞ্চলের আমীরের সাথে সাক্ষাত করেন। ১৫ই ডিসেম্বর তিনি উহুদ প্রান্তরে যান এবং মাহনবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও সাহাবীদের স্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলো দেখেন। ঐদিন বিকেলে তিনি কুবা মাসজিদে যান। সেখানে ছালাতুল আছর আদায় করেন। আরো কিছু স্থান দেখে তিনি হোটেলে ফিরে আসেন। ১৬ই ডিসেম্বর তিনি বিরে উসমান, মাসজিদে কিবলাতাইন, আকীক উপত্যকা, সালা পাহাড়, জুবাব মাসজিদ, মাসজিদুল ফাতহ, পাঁচ মাসজিদ, সাকীফা বানু সায়েদাহ, আবু আইউব আনসারীর (রা) বাড়ি প্রভৃতি স্থান দেখেন।
১৮ই ডিসেম্বর আল বাকী কবরস্থান দেখতে যান। এই কবরস্থানে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বহু সংখ্যক প্রিয়জন ও সাহাবীর কবর রয়েছে।
২০শে ডিসেম্বর ওয়াদউল কুরা পৌঁছেন। ২১শে ডিসেম্বর তিনি আল্লাহর অন্যতম নবী সালিহ (আ) এর স্মৃতি বিজড়িত স্থান মাদায়েনে সালিহ (আল হিজর) পৌঁছেন। এটি ছিলো সামুদ জাতির বসতি স্থল।
২৩শে ডিসেম্বর তিনি পৌঁছেন খাইবার। তিনি সেই রণাংগন দেখেন যেখানে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে খাইবারের ইহুদীদের যুদ্ধ হয়েছিল। তিনি বিভিন্ন দুর্গের ধ্বংসাবশেষও দেখেন। ২৫শে ডিসেম্বর তিনি তাইমা পৌঁছে সেখানেই রাত কাটান। ২৬শে ডিসেম্বর তিনি তাবুক পৌঁছেন। এখানে তিনি সরকারী গেষ্ট হাউসে উঠেন। ২৭শে ডিসেম্বর তিনি তাবুকের বিভিন্ন স্থান দেখার জন্য বের হন। সম্রাট হিরাক্লিয়াসের নেতৃত্বে রোমান সৈন্য বাহিনী মাদীনা ইসলামী রাষ্ট্রের সীমান্তে চাপ সৃষ্টি করলে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ত্রিশ হাজার মুজাহিদ নিয়ে তাবুক পৌঁছেন। তাঁর আগমণের খবর পেয়ে সম্রাট হিরাক্লিয়াস সীমান্ত থেকে রোমান সৈন্যদেরকে সরিয়ে নেন। যেই স্থানটিতে মুসলিম সৈনিকেরা তাঁবু গেড়ে অবস্থান করেছিলেন সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী ঘুরে ফিরে সেই স্থানটি দেখেন। ২৯শে ডিসেম্বর তিনি শুয়াইব (আ) এর কর্মক্ষেত্র মাদাইন দেখে এসে বাদাহ-তে বিশ্রাম নেন।
৩০শে ডিসেম্বর সাউদী আরবের সীমানা পেরিয়ে তিনি তাঁর সাথীদের নিয়ে জর্ডনের আকাবাহ শহরে পৌঁছেন। অতীতে এই স্থানের নাম ছিলো আইলা। এখানে ‘‘আখ-ইখওয়ানুল মুসলিমূনের’’ স্থানীয় শাখার সদস্যরা তাঁকে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করেন।
৩১শে ডিসেম্বর তিনি ওয়াদিয়ে মূসা পৌঁছেন। এখানে মূসা (আ) তাঁর জীবনের শেষদিনগুলো কাটান। হারুন (আ) এখানেই ইন্তিকাল করেন। উপত্যকায় অবস্থিত জাবালে হারুনের শীর্ষদেশে হারুন (আ) কবরস্থ হন।
এই উপত্যকাতেই প্রাচীন পেত্রা নগরীর ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। ঈসা ইবনু মারইয়ামের (আ) জন্মের দুই শত বৎসর পূর্বে নাবাতী নামক একটি জাতির রাজধানী ছিলো এই পেত্রা নগরী। সাইয়েদ আবুল আ’লা শহরের ধ্বংসাবশেষ দর্শন করেন।
পেত্রা থেকে আলমাযার নামক স্থানে পৌঁছেন। এখানে যায়িদ ইবনু হারিসাহ (রা), জা’ফর ইবনু আবী তালিব (রা) ও আব্দুল্লাহ ইবনু রাওয়াহা (রা) সহ মূতাহ যুদ্ধে যাঁরা শহীদ হয়েছিলেন তাঁদের কবর রয়েছে।
১৯৬০ সনের ১লা জানুয়ারী তিনি মৃত সাগরের (Dead Sea) পূর্ব তীরে পৌঁছেন। এই স্থানটিতে লূত (আ) এর জাতি বসবাস করতো।
ঐ দিনই তিনি জর্ডনের রাজধানী আম্মানে পৌঁছেন এবং প্যালেস হোটেলে অবস্থান গ্রহণ করেন। ২রা জানুয়ারী জর্ডনের আল ইখওয়ানুল মুসলিমূনের নেতা আবদুর রাহমান খালীফাহ তাঁর সম্মানে এক সংবর্ধনা সভার আয়োজন করেন। এতে আম্মানের বিশিষ্ট ইসলামী ব্যক্তিরা যোগ দেন।
৪ঠা জানুয়ারী তিনি সাথীদেরকে নিয়ে ফিলিস্তিনের পথে রওয়ানা হন। আস সালাত শহরে তিনি শুভাকাংখীদের এক সভায় বক্তব্য রাখেন। সেখান থেকে তিনি ওয়াদিয়ে শুয়াইবে পৌঁছেন। আল্লাহর আযাবে মাদাইন ধ্বংস হয়ে যাবার প্রাক্কালে শুয়াইব (আ) সেখান থেকে হিজরাত করে এসে এইস্থানে বসবাস করতে থাকেন। এখানে একটি ছোট্ট পাহাড়ের ওপর তাঁর কবর রয়েছে।
জর্ডন নদী পার হয়ে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী ফিলিস্তিন ভূ-খন্ডে পৌঁছেন। বিকেল তিনটায় তিনি বহু সংখ্যক নবীর স্মৃতি বিজড়িত শহর জেরুসালেম পৌঁছেন। এখানে আল ইখওয়ানুল মুসলিমুনের একটি মিটিংয়ে তিনি বক্তব্য রাখেন। অতপর তিনি মাসজিদুল আকসাতে ছালাতুল মাগরিব ও ছালাতুল ইশা আদায় করেন।
৫ই জানুয়ারী জেরুসালেম থেকে কয়েক মাইল দূরে অবস্থিত বাইতুল লাহাম (Bethelhem) দর্শন করেন। এই স্থানেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন ঈসা ইবনু মারইয়াম (আ)।
সেখান থেকে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী হেবরন বা আল খালীল পৌঁছেন। নামরুদের উপর নগরী থেকে হিজরত করে ইবরাহীম (আ) হেবরন এসে বসতি স্থাপন করেন। এখানে থেকেই তিনি ফিলিস্তিন, হিযায ও মিসর রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় ইসলাম প্রচার করতেন। এখানে একটি গুহায় ইবরাহীম (আ) ও তাঁর বংশধরদের কবর রয়েছে। পাশেই রয়েছে একটি মাসজিদ। সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী তাঁর সাথীদের নিয়ে এই মাসজিদেই ছালাতুজ-জুহর আদায় করেন।
সেখান থেকে তিনি বানু নায়ীম পৌঁছেন। এখানে একটি ছোট্ট পাহাড়ের উপর লূত (আ) এর কবর রয়েছে। আল্লাহর আযাবে তাঁর কাউমের বসতিস্থল ধ্বংস হয়ে যাবার প্রাক্কালে হিজরাত করে তিনি এই স্থানে এসে বসতি স্থাপন করেন।
৬ই জানুয়ারী তিনি মাসজিদুল আকসা, কুব্বাতুস সাখরা ও অন্যান্য ঐতিহাসিক স্থান ঘুরে ঘুরে দেখেন।
৭ই জানুয়ারী তিনি মিউজিয়াম দর্শন করেন। ৭ই জানুয়ারী রাতে তিনি জেরুসালেম থেকে আম্মনে পৌঁছেন।
৮ই জানুয়ারী তিনি আম্মানে আল ইখওয়ানুল মুসলিমূন পরিচালিত ‘‘কুল্লিয়াতুল ইসলামী’’ (ইসলামিয়া কলেজ) পরিদর্শন করেন।
৯ই জানুয়ারী জর্ডন সরকার তাঁকে সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করে। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সমাবেশে তিনি বক্তব্য পেশ করেন।
১০ই জানুয়ারী তিনি ‘‘আসহাবে কাহফের’’ গুহাটি দেখতে যান। গুহাটি আম্মান থেকে ৭ মাইল দুরে রাজিব নাম স্থানে অবস্থিত। অবশ্য ভিন্ন মতে, আসহাবে কাহাফের গুহাটি তুর্কীর এফসুস নামক স্থানে অবস্থিত।
ওখান থেকে তিনি ইরবাদ পৌঁছেন। ১১ই জানুয়ারী তিনি ফাহল পৌঁছেন। এখানেই উমার ইবনুল খাত্তাবের (রা) শাসন কালে রোমান বাহিনীর সংগে মুসলিম বাহিনীর যুদ্ধ হয়। যুদ্ধক্ষেত্র দেখার পর সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী মুয়ায ইবনু জাবাল (রা), আবু উবাইদাহ ইবনুল জাররাহ (রা), শুরাহবীল ইবনু হাসনা (রা) ও যিরার ইবনু আযওয়ার (রা) এর কবর দর্শন করেন।
ফাহল থেকে ইরবাদ পৌঁছে আরেক পথ ধরে তিনি ইয়ারমুক প্রান্তরে পৌঁছেন। উমার ইবনুল খাত্তাবের (রা) শাসনকালে এখানে সংঘটিত হয়েছিল মুসলিম বাহিনী ও রোমান বাহিনীর মধ্যে বড়ো রকমের এক যুদ্ধ।
অতপর সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী সিরিয়ার রাজধানী দামিসকের পথ ধরেন। ১২ থেকে ১৪ই জানুয়ারী তিনি এখানে অবস্থান করে বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থান ও গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেন।
১৫ই জানুয়ারী তিনি দামিস্ক থেকে আকাশপথে কায়রো পৌঁছেন। পাকিস্তান এমবেসীর কর্মকর্তারা তাঁকে এয়ারপোর্টে রিসিভ করেন। তিনি গ্র্যান্ড হোটেলে উঠেন।
১৬ই জানুয়ারী মিসরে নিযুক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত খাজা শাহাবুদ্দীন তাঁর সম্মানে এক সংবর্ধনা আয়োজন করেন। ঐ তারিখে রাতে আল্লামা মুহাম্মাদ আল বাশীর আল ইব্রাহীমী তাঁর সম্মানে ডিনারের আয়োজন করেন। এতে কায়রোর সেরা ইসলামী ব্যক্তিরা যোগ দেন।
১৭ই জানুয়ারী তিনি পিরামিডগুলো ও কায়রো মিউজিয়াম দেখেন।
১৯শে জানুয়ারী তিনি আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করে এবং রেকটার মুহাম্মাদ মাহমুদ সালতুতের সাথে সাক্ষাত করেন। কায়রোতে অবস্থানকালে তিনি বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থান দেখেন ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে সাক্ষাত করেন।
২০শে জানুয়ারী তিনি কায়রো থেকে ২৫ মাইল দূরবর্তী সুয়েজ পৌঁছেন। রাতে তিনি সুয়েজে থাকেন।
২১শে জানুয়ারী তিনি সিনাই উপত্যকার দিকে রওয়ানা হন। সুয়েজ থেকে ১৪ মাইল দূরে রয়েছে আইওয়ান মূসা নামক একটি জনপদ। মূসা (আ) তাঁর অনুসারীদেরকে নিয়ে মিসর থেকে বেরিয়ে এখানে কিছু সময় অবস্থান করেছিলেন। এরপর তিনি পৌঁছেন ঈলাম উপত্যকা। অতপর তিনি আবু যানীমা বন্দরে পৌঁছেন। এটি সুয়েজ থেকে ১০০ মাইল দূরে অবস্থিত। আবু যানীমা থেকে তিনি ফারান মরুদ্যান অতিক্রম করে সেন্ট ক্যাথেরাইন গীর্জা এলাকায় পৌঁছেন।
২২শে জানুয়ারী তিনি তাঁর সংগীদের নিয়ে জাবালে মূসার দিকে অগ্রসর হন। এখানে কোন রাস্তা না থাকায় বেশ কিছু দূর তাঁদেরকে উটের পিঠে বসে যেতে হয়। এখানে অবস্থানকালেই আল্লাহ সাথে মূসা (আ) কথা বলেন। জাবালে মূসা থেকে এসে রাতে সেন্ট ক্যাথেরাইন এলাকায় অবস্থান করেন।
২৩শে জানুয়ারী তিনি কায়রোর পথ ধরেন। পথিম্যে তিনি একটি উপত্যকায় পৌঁছেন। যেখানে সালিহ (আ)-এর কবর রয়েছে। তাঁর এলাকায় আল্লাহর আযাব নাযিলের পূর্বে হিজরাত করে তিনি এখানে এসে বসতি স্থাপন করেন।
২৩শে জানুয়ারী রাতে তিনি কায়রো পৌঁছেন। ২৪ তারিখে আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টারের সাথে তিনি এক ডিনারে মিলিত হন।
২৫শে জানুয়ারী রাতে তিনি আকাশ পথে কায়রো থেতে দামিস্ক পৌঁছেন। দামিস্ক থেকে পৌঁছেন কুয়েত। ৪ঠা ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত তিনি কুয়েত অবস্থান করেন।
৫ই ফেব্রুয়ারী সকাল বেলা তিনি কুয়েত থেকে করাচী পৌঁছেন। পরদিন তিনি পৌঁছেন লাহোর।
এইভাবে ১৯৬০ সনের ৬ই ফেব্রুয়ারী শেষ হয় সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীর দ্বিতীয় বিদেশ সফর।
৫০. মাদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপকার
সাউদী আরবের কিং এর আমন্ত্রণে রাষ্ট্রীয় মেহমান হিসেবে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী ১৯৬১ সনের ডিসেম্বর মাসে রিয়াদ পৌঁছেন। কিং একটি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপনে আগ্রহী ছিলেন এবং একটি পরিকল্পনা তৈরী করে দেবার জন্য সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীর প্রতি আহ্বান জানান।
সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের খসড়া পরিকল্পনা তৈরী করে ফেলেন অল্প সময়ের মধ্যেই। তিনি প্রস্তাব করেন যে, এই বিশ্ববিদ্যালয় এমন উন্নতমানের আলিম তৈরী করবে যারা বর্তমান যুগের চাহিদার ইসলামী সমাধান পেশ করার যোগ্যতা সম্পন্ন হবে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাকার্য হবে নয় বছর। প্রথম স্তর হবে চার বছরের। এই স্তরে শিক্ষার্থীদেরকে আল কুরআন, আল হাদীস, আল ফিকহ, ইসলামের ইতিহাস ও সমাজ বিজ্ঞান পড়ানো হবে। দ্বিতীয় স্তর হবে তিন বছরের। এই স্তরে থাকবে পাঁচটি ফ্যাকাল্টি। তৃতীয় স্তর হবে দুই বছরের। এই স্তরে উপরোক্ত যেই কোন একটি ফ্যাকাল্টিতে একজন স্কলার গবেষণা কাজে নিয়োজিত হবে।
তিনি আরো প্রস্তাব করেন যে এই বিশ্ববিদ্যালয় পৃথিবীর সকল দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে, বিশ্ববিদ্যালয়টি হবে আবাসিক, এতে থাকবে একটি বিশাল সমৃদ্ধ লাইব্রেরী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য উপযুক্ত পাঠ্যপুস্তক রচনার জন্য একটি সংস্থাও থাকবে।
১৯৬১ সনের ২১শে ডিসেম্বর সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী, চৌধুরী গোলাম মুহাম্মাদ ও খলীল আহমাদ হামিদী কিং এর প্রাসাদে গিয়ে তার কাছে এই পরিকল্পনা হস্তান্তর করেন। কিং এর নির্দেশে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী, শায়খ মুহাম্মাদ আকবার, শায়খ আবদুল লতীফ, শায়খ মুহাম্মাদ আলী আল হারাকান পরিকল্পনাটি চূড়ান্ত করেন।
এই পরিকল্পনার ভিত্তিতেই স্থাপিত হয় মাদীনার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। এর প্রথম ভাইস-চ্যান্সেলার হন মুহাম্মাদ আলী আল হারাকান। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সিন্ডিকেটের একজন সদস্য নিযুক্ত হন সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী।
১৯৬২ সনের জানুয়ারী মাসে তিনি দেশে ফিরে আসেন। কিন্তু ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের মিটিংয়ে যোগদানের জন্য মে মাসে আবার সাউদী আরব সফরে যান।
১৯৬২ সনের মে মাসেই গঠিত হয় ‘‘রাবিতাতুল-আলম-আল ইসলামী।’’
সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হওয়ার মর্যাদা লাভ করেন।
৫১. ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক ‘‘মুসলিম পারিবারিক আইনের’’ বিরোধিতা
১৯৬১ সনের ২রা মার্চ প্রেসিডেন্ট মুহাম্মাদ আইউব খান একটি অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে মুসলিম পারিবারিক আইন জারি করেন। এই আইনে দাদার বর্তমানে পিতা মারা গেলে নাতিকে সরাসরি দাদার সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারী করার বিধান রাখা হয়। তালাক সংক্রান্ত কতগুলো বিধান সন্নিবেশিত হয় যা ইসলামী ভাব ধারার সাথে সাংঘর্ষিক।
সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী এই আইনের ইসলামী শরীয়াহ পরিপন্থী বিধানগুলোর সমালোচনা করেন। তাঁরই উদ্যোগে দেশের চৌদ্দজন সেরা আলিম লাহোরে একত্রিত হয়ে এই আইনের চুলচেরা বিশ্লেষণ করেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন মাওলানা মুহাম্মাদ ইদরিস কান্দালুভী, মুফতী মুহাম্মাদ হাসান, হাফিয কিফায়েত হাসান ও হাফিয আবদুল কাদির রূপারী। ১৯৬১ সনের ১৪ই মার্চ যুক্ত বিবৃতির মাধ্যমে তাঁরা এই আইন প্রত্যাহার করে নেবার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। জামায়াতে ইসলামীর কর্মীরাও নানাভাবে আল্লাহর বিধানের সাথে সাংঘর্ষিক এই আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে থাকেন।
৫২. ১৯৬২ সনের শাসনতন্ত্র গণতন্ত্রায়নের দাবি
১৯৬০ সনের মে মাসে প্রেসিডেন্ট মুহাম্মাদ আইউব খান বিচারপতি শাহাবুদ্দিনকে চেয়ারম্যান করে একটি কনস্টিটউশন কমিশন গঠন করেন। দেশের জন্য যুগোপযোগী একটি শাসনতন্ত্রের প্রস্তান তৈরী করার ভার ন্যস্ত হয় কমিশনের ওপর। কমিশন একটি প্রশ্নমালা প্রকাশ করে ও সুধীজনের কাছ থেকে উত্তর আহ্বান করে। সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (রহ) প্রশ্নমালার জওয়াব তৈরী করেন। তাঁর জওয়াব প্রকাশের জন্য প্রেসে পাঠানো হয় এবং বিভিন্ন পত্রিকা তা প্রকাশও করে। এতে মার্শাল ল কর্তৃপক্ষ অসন্তুষ্ট হন। তাঁকে লাহোরের মার্শাল ল প্রশাসকের অফিসে ডেকে নেয়া হয়। কর্তৃপক্ষ তাঁকে জানান যে তাঁর জওয়াব পত্রিকায় প্রকাশ করাটা মার্শাল ল-এর খেলাফ কাজ হয়েছে। সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী বলেন যে, কমিশন প্রশ্নমালা প্রণয়ন প্রকাশ করেছে, তিনি সেই প্রশ্নমালার জওয়াব দিয়েছেন এবং তিনি মনে করেন যে তিনি কি জওয়াব দিয়েছেন তা জানার অধিকার রয়েছে জনগণের। তিনি আরো বলেন যে কর্তৃপক্ষ যদি মনে করে যে তিনি মার্শাল ল ভংগ করেছেন তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। অবশ্য কর্তৃপক্ষ আর এই বিষয়ে অগ্রসর হয়নি।
১৯৬১ সনের মে মাসেই কমিশন তার সুপারিশমালা প্রেসিডেন্টের নিকট পেশ করে। কমিশন প্রেডিসেন্ট পদ্ধতির সরকার, প্রত্যক্ষ ভোট, দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট আইন পরিষদ ও একজন ভাইস প্রেসিডেন্টের পদ সৃষ্টির সুপারিশ করে।
অক্টোবর মাসে প্রেসিডেন্ট মুহাম্মাদ আইউব খান রাওয়ালপিন্ডিতে গভর্ণরদের মিটিংয়ে সুপারিশগুলো আলোচনা করে এবং বেশিরভাগ সুপারিশ প্রত্যাখ্যান করেন। অতঃপর প্রেসিডেন্টের মর্জি মতো একটি শাসনতন্ত্র রচিত হয়।
১৯৬২ সনের ১লা মার্চ প্রেসিডেন্ট এই শাসনতন্ত্র জারির ঘোষণা দেন। এই শাসনতন্ত্রে বিধান রাখা হয়েছিলো ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা যাদের সংখ্যা তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে ছিলো ৪০ হাজার ও পশ্চিম পাকিস্তানে ৪০ হাজার এব্ং যাদেরকে নাম দেয়া হয়েছিলো মৌলিক গণতন্ত্রী (Basic Democrats) দেশের প্রেসিডেন্ট, জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচন করবে। এই শাসনতন্তের ভিত্তিতে নির্বাচনও হয়ে যায়।
১৯৬২ সনের ৮ই জুন রাওয়ালপিন্ডিতে জাতীয় পরিষদের অধিবেশ বসে এবং জেনারেল আইয়ুব খান ‘‘রিপাবলিক অব পাকিস্তানে’’ দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। ঐ দিনই মার্শাল ল তুলে নেয়া হয়। কিন্তু তখনো রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা বলবৎ ছিলো।
১৯৬২ সেনের ১৭ই জুলাই রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়। আর চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে জামায়াতে ইসলামী দেশের সর্বত্র নতুন উদ্দীপনা নিয়ে কর্মমুখর হয়ে উঠে।
মার্শাল ল তুলে নেয়ার পর জামায়াতে ইসলামীর প্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত হয় রাওয়াপিন্ডির লিয়াকতবাগে। এই জনসভায় সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী ঘোষণা করেন যে পাকিস্তানকে ইসলামের আবাসভূমি বানাবার সংগ্রাম চলবে, এই সংগ্রাম চলবে নিয়মতান্ত্রিকভাবে। তিনি আরো বলেন যে দেশের মানুষের ওপর যেই শাসনতন্ত্র চাপিয়ে দেয়া হয়েছে তা একনায়কতান্ত্রিক। পরোক্ষ নির্বাচন পদ্ধতির মাধ্যমে একটি শ্রেণীর মধ্যে রাজনৈতিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা হয়েছে, এটি মোটেই গণতান্ত্রিক নয়।
১৯৬২ সনের ১৫ই সেপ্টেম্বর লাহোরের মুচি গেটে অনুষ্ঠিত জনসভায় সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নৈতিক অবস্থার ক্রমাবনতির জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন দেশের অর্থ-সম্পদের সিংহভাগ ২২২ পরিবারের হাতে রয়েছেন, অথচ দরিদ্র মানুষেরা দিন দিন আরো দরিদ্র হচ্ছে। ভাষণে তিনি আরো বলেন যে, পাকিস্তান অর্জিত হয়েছিলো ইসলামের নামে, দুর্ভাগ্যের বিষয়, পাকিস্তান অর্জিত হওয়ার পর এমন সব লোক রাষ্ট্র-ক্ষমতা কেড়ে নেয় যারা একদিকে ইসলাম, অন্যদিকে গণতন্ত্রের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। তিনি ‘‘মৌলিক গণতন্ত্রের’’ও সমালোচনা করেন। তিনি দাবি করেন যে-
১. দেশের জীবন বিধান হতে হবে আল কুরআন ও আস্ সুন্নাহ ভিত্তিক জীবন বিধান।
২. কোন শ্রেণী নয়, জনগণ হবে ক্ষমতার মালিক।
৩. সরকার গঠন করবেন জনগণের নির্বাচিত প্রতনিধিরা।
৪. অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে যাঁরা নির্বাচিত হবেন তাঁরাই জনগণের প্রতিনিধি বলে গণ্য হবেন।
৫. সকল ব্যক্তি ও দলের মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকতে হবে।
৬. সরকার রেডিও, টেলিভিশন ও অন্যান্য গণমাধ্যমে একতরফাভাবে ব্যবহার করবেন না।