বিভাগীয় আমীর হিসাবে দায়িত্ব পালনঃ
আমি যখন বিভাগীয় আমীররের দায়িত্ব প্রাপ্ত হই, তখন খুলনা বিভাগে বৃহত্তর খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, বরিশাল ও পটুয়াখালী অন্তর্ভূক্ত ছিল। তখন বর্তমান জেলা সমূহ সাব-ডিভিশন ছিল। আমি যখন বিভাগীয় আমীর তখন পটুয়াখালী, পিরোজপুর, ভোলা ইত্যাদি সহ বৃহত্তর বরিশাল জেলার আমীর ছিলেন মুফতী মাওলানা আব্দুস সাত্তার (সাবেক) এম.পি। বাগরেহাট, সাতক্ষীরা সহ বৃহত্তর খুলনা জেলার আমীর ছিলেন মাওলানা মীম ফজলুর রহমান। বৃহত্তর যশোর অর্থাৎ ঝিনাইদাহ,মাগুরা, ও নড়াইল সহ বৃহত্তর যশোর জেলার আমীর ছিলেন মাষ্টার আব্দুল ওয়াহেদ। বৃহত্তর ফরীদপুর ও কুষ্টিার আমীর ছিলেন মরহুম মাওলানা আব্দুল আলী। সাবেক এম,এন, এ জনাব শাসুর রহমান ছিলেন খুলনা বিভাগের জেনারেল সেক্রেটারী। এসময় পূর্ব পাকিস্তানে মোট বিভাগ ছিল চারটি। আর জেলা সংখ্যা ছিল মোট ১৯টি। ১৯৫৮ সনের ৮ই অক্টোবর আইয়ুব খান কর্তৃক সামরিক শাসন জারির আগ পর্যন্ত আমি ঐ দায়িত্ব পালন করতে থাকি। সামরিক শাসনের মাধ্যমে যেহেতু সমস্ত রাজনৈতিক ওদ ও রাজনৈতিক ক্রিয়াকান্ড নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। তাই আমি খুলনা আলীয়া মাদ্রাসার কর্তৃপক্ষের অনুরোধে অধ্যক্ষ হিসাবে খুলনা আলীয়া মাদ্রাসায় যোগদান করি।
জাতীয় পরিষদে নির্বাচনে অংশ গ্রহনঃ
আইয়ুব খান সাহেব সামরিক শাসন বহাল রেখে তার প্রণীত শাসণতন্ত্র অনুসারে ১৯৬২ সনে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন দেন। ভোটার ছিল ইউনিয়ন কাউন্সিলের মেম্বররা। আইয়ুব খান সাহেব এর নাম দিয়েছিলেন বি.ডি অর্থাৎ ব্যসিক ডেমোক্রাসী। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদকে তখন ১৫০ আসনে বিভক্ত করা হয়েছিল। ৭৫টি আসন পূর্ব পাকস্তিানের আর ৭৫টি পশ্চিম পাকিস্তানের ভাগে আসে। আমাকে জামায়াতে ইসলামী খুলনা ও বরিশালের একটি জয়েন্ট সিট হতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে বলে। কেননা এই নির্বাচনী এলাকাভুক্ত শরনখোলা থানায় আমার গ্রামের বাড়ী ছিল। ফলে আমি আলীয়া মাদ্রাসার চাকুরী হতে ইস্তেফা দিয়ে জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে অংশ গ্রহন করি। আমার নির্বাচনী এলাকা ছিল ৭টি থানার সমন্বয়। সাড়ে তিনটি খুলনা জেলায় আর সাড়ে তিনটি বরিশাল জেলায়। মাঝখানে সাড়ে তিন মাইল চড়ওড়া বলেশ্বর নদী। আমি এই এলাকায় ব্যাপক সংগঠনিক কাজ করে জামায়াতে ইসলামীর সংগঠন কায়েম করেছিলাম। ফলে আমি বিপুল ভোটের ব্যাবধানে বিজয়ী হয়ে জাতীয় পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হই। আমর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বীতা ছিলেন দু’জন। একজন ছিলেন খুলনা জেলার অধিবাসী অধ্যাপক আব্দুর রহমান, (আওয়ামিলীগ) আর একজন ছিলেন বরিশাল জেলার অধিবাসী মোখতার আব্দুল গফুর। আব্দুল গফুর সাহেবের ধারণা ছিল যে, খুলনা হতে দুজন প্রতিদ্বন্দ্বীতা করতেছে, আর সে একা বরিশাল জেলা হতে প্রতিদ্বন্দী, ভোটার প্রায় সমান সমান। সুতরাং তিনি এককভাবে শুধু বরিশালের ভোট পেয়ে বিজয়ী হবেন। কিন্তু তার এ ধারনাকে ভুল প্রমাণ করে বরিশাল জেলার ভোটাররা আমাকে ব্যাপকবাবে সমর্থন দান কেরেন। আর খুলনা জেলার ভোট প্রায় এককভাবেই আমি পেয়েছিলাম।
জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশন রাওলপিন্ডিরতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। পরিষদের বৈঠকে যোগ দিয়ে জানতে পারলাম যে, আমিই জাতীয় পরিষদের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য। আমার বয়স তখন পয়ত্রিশ বছর। জামায়াতে ইসলামী থেকে তখন আমরা ঐ পষিদে চারজন নির্বাচিত হয়েছিলাম। (১) মরহুম আব্বাস আলীখান (২) মরহুম শামসুর রহমান (৩) মরহুম ব্যরিস্টার আখাতরুদ্দিন এবং (৪) আমি। নেজামে ইসলাম হতে নির্বাচিত হয়েছিলেন চারজন ও জমিয়তে ওলামা হতে দুজন। আমাদের নেতাদের পরামর্শে ও আগ্রহে এই দশজনে, পার্লামেন্ট দশ সদস্য বিশিষ্ঠ পাপর্লামেন্টরী গ্রুপ গঠন করি। আমদের উদ্দেশ্য ছিল ন্যায় ও ইনসাফের পক্ষে পার্লামেন্টে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা। আল’হামদুলিল্লাহ পার্লামেন্টের এই পূর্ণ টর্মে আমরা উত্তমভাবে এ দায়িত্ব পালন করেছি।
আমার ব্যাপক পশ্চিম পাকিস্তান সফরঃ
জামায়াতে ইসলামীর সংগঠ যেহেতু পশ্চিম পাকিস্তানের সর্বত্র বিস্তারিত ছিল। তাই জাতীয় পরিষদের বৈঠকের বিরতির দিনে আমরা জামায়াতে ইসলামীর দাওয়াতে রাওলপিন্ডির বাহিরে প্রগ্রামে যেতাম। ১৯৬৫সন পর্যন্ত জাতীয় পরিষদের সদস্য থাকাকালিন এবং পরবর্তী পর্যায় পি.ডি.এম (পাকিস্তান ডেমোক্রাটিক মুভমেন্ট) এর কেন্দ্রী কমিটির সদস্য হওয়ায় আমি ব্যাপকভাবে জামায়াত ও পি.ডি.এম এর প্রগ্রামে পশ্চি পাকিস্তানের সর্বত্র সফর করেছি। পি,ডি,এম যেহেতু সম্মিলিত বিরোধী দলের একটি মোর্চা ছিল, তাই বিভিন্ন পার্টির নেতৃবৃন্দ মিলে আমরা একত্রেও সফর করেছি। একবার আমাদের সফর টিমে নেজামে ইসলামে নেতা সাবেক প্রধান মন্ত্রী চৌধুরী মুহাম্মদ আলী, আওয়ামিলীগ নেতা নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ, কাউন্সিল মুসলিম লীগ নেতা এ্যাডভোকেট শফিকুর রহমান প্রমুখ ছিলেন। এসব সফরে আমরা জনসভা, বুদ্ধিজীবী সম্মেলন ও প্রেস কনফারেন্সে বক্তব্য রেখেছি। দেশ বিভাগের আগ পর্যন্ত এভাবেই আমি ব্যাপকবাবে পশ্চি পাকিস্তান সফর করেছি।
প্রবল গণ-আন্দোলনের মুখে আইয়ুব খানের পদত্যাগ ও ইয়াহইয়া খানের ক্ষমতা গ্রহনঃ
১৯৭০ সনে প্রবল গণ আন্দোলনের মুখে আইয়ুব খান সেনাবাহিনী প্রধান ইয়াহইয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বিদায় নেন। ইয়াহইয়া খান ক্ষমাতায় এসে এক পশ্চিম পাকিস্তানের জায়গায় সাবেক প্রাদেশিক কাঠামো বহাল করেন। অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তান চারটি প্রদেশে ভিভক্ত হয়ে যায়। তিনি বিরোধী দল ও জনগণের দাবীর প্রেক্ষিতে বি,ডি (বেসিক ডেমোক্রাসি) সিস্টেম বাতিল করে জনগণের ভোটাধিকার বহাল করেন। অতঃপর ১৯৭০ সনের নির্বাচনে আঞ্চলিক পার্টি হিসাবে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ ও পশ্চিম পাকিস্তানে ভূট্টোর পিপলস পার্টি সংখাগরিষ্ঠতা লাবভ করে।
পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের প্রায় সব ছিট আওয়ামিলীগ দখল করে একক সংকাগরিষ্ঠ দল হিসাবে কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের পজিশান হাসিল করে। কিন্তু কেন্দ্রে পশ্চিম পকিস্তান ভিত্তিক সামরিক সরকার ক্ষমাতায় থাকায় সম্পূর্ণ অবৈধভাবে আওয়ামীলগিকে ক্ষমতা না দিয়ে ষড়যন্ত্রের পথ বাছাই করে নেয়। ফলে যে দুর্বিসহ অবস্থার সৃষ্টি হয, তাতে সশস্ত্র সংঘাতের ভিতর দিয়ে বাংলাদেশ স্বতন্ত্র স্বাধীন দশে হিসাবে অস্তিত্ব লাভ করে।