পূর্ব পাকিস্তানের অধিকার আদায়ের ব্যাপারে জামায়াতে ইসলামীর দৃষ্টিভঙ্গিঃ
জামায়াতে ইসলামী এক দিকে যেমন ইসলামী আদর্শের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার কাজ করছে, তেমনি ডিকটেটরী শাসন ও স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে পার্লামেন্টের ভিতরে ও বাহিরে গণতন্ত্রে বিশ্বাসী পার্টিসমূহের সাথে মিলিতভাবে আন্দোলন করেছে। এর বিভিন্ন পর্যায় পি,ডি,এম (পাকিস্তান ডেমোক্রাটিক মুভমেন্ট), ডাক (ডেমোক্রাটিক একশান কমিটি) ইত্যাদি জোট, বিরোধী দল সমূহের সমন্বয় গঠিত হয়েছে। এ সব জোটে জামায়াতে ইসলামী সামিল থেকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। পূর্ব পাকিস্তানের বঞ্চনার বিরুদ্ধেও জামায়াতে ইসলামী পার্লামেন্টের ভিতরে ও বাহিরে সমান সোচ্চার ছিল। তবে এ কথা স্বীকার করতে আমাদের কোন দ্বিধা নাই যে, মুসলিম জাহানের সর্ববৃহৎ দেশ পাকিস্তানকে অখন্ড রেখে অধিকার আদায়ের আমরা পক্ষপাতি ছিলাম। জামায়াত সহ সম্মিলিত বিরোধী দলের প্রচেষ্টায় আমারা বাষট্টির পার্লামেন্টে প্যারিটি বিল পাশ করিয়ে চাকুরীবাকুরীসহ আর্থিক ও প্রশাসনিক বিষয়াদিতে পূর্ব পাকিস্তানে সমান অধিকার নিশ্চিত করেছিলাম। বৃহত্তর মুসলিম উম্মাহর স্বার্থে আমরা মুসলমানদের সর্ব বৃহৎ দেশটাকে অখন্ড রেখে পূর্ব পাকিস্তানের অধিকার আদায়ের পক্ষপাতি ছিলাম। আর আওয়ামিলীগ সহ কতিপয় পার্টি বিভক্তির মাধ্যেমে অধিকার আদায়ের পক্ষপাতি ছিল। অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের অধিকার আদায়ের ব্যাপারে আমাদের সকলেরই লক্ষ এক ও অভিন্ন ছিল। তাছাড়া বিভক্তির ব্যাপারে ভারতের অত্যাধিক উৎসাহ এবং ৪৭ এর স্বাধীনতার পরপরই শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে ভারতের মুসলিম শাসিত দেশ হায়দারাবাদ ও জুনাগড় দখল করে নেয় এবং শক্তি বলে মুসলিম কাশ্মীরকে পদানত করার ঘটনা সমূহ আমাদের এই সন্দেহেকে আরও বাড়িয়ে তুলেছিল। তবে বাস্তবে দেশ যখন বিভক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটল, তখন জামায়াতে ইসলামী স্বাধীন বাংলাদেশের বাস্তবতাকে মনে প্রাণে মেনে নিয়ে এ দেশ ও জনগণের কল্যাণের ব্রত নিয়ে দিবা-রাত্রি কাজ করে যাচ্ছে।
আমার গ্রেফতারী ও কারাবাসঃ
দেশ বিভাগের পরপর স্বাধীন বাংলাদেশে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামিলীগ সরকার গঠন করে। আওয়ামিলীগ ক্ষমাতা গ্রহনের পর যেসব পার্টি অখন্ড দেশের পক্ষপাতি ছিল তাদের নেতৃবৃন্দকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠিয়ে দেয় এবং তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহীতার মামলা দায়ের করে। অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সাথে আমাকেও গ্রেফতার করে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠান হয়। পরবর্তী পর্যায় আন্তর্জাতিক মহলের চাপে ১৯৭৩ সনের ডিসেম্বর মাসে পূর্ণ দু’বছর জেল খাটার পরে আমাদেরকে মুক্তি দেয়া হয়। আমি একাধারে দু’বছর জেলে থাকাকালীন আমার সন্তাদের অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করে আমার আপন ছোট ভাই ও আমার শরীকানা ব্যবসার অংশীদার রুহুল আমিন। রুহুল আমিন এখন খুলনা শহরের একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী।
জেলখানায় দু‘বছরঃ
জেলখানায় আমরা রাজবন্দী হিসেবে আইনতঃ প্রথম শ্রেণীর কয়েদী ছিলাম। ফলে আমাদের কিছু অতিরিক্ত সুযোগ সুবিধা ছিল। জেলখানার নূতন দালানের ডিভিশন প্রাপ্ত কয়েদীরা আমরা একত্রে জামায়াতে নামাজ আদায় করতাম এবং আমি দৈনিক নামাজ বাদ এক দিন কোরআনের দারস ও একদিন হাদীসের দারস দিতাম। এই দু’বছেরে কেন্দ্রীয় কারাগারের লাইব্রেরী হতে আমি ছোট বড় দুই’শতখানা বই পাঠ করেছি। আর এই জেলখানায় আমার দুখানা বই ‘মহাগ্রন্থ আল কোরআন কি ও কেন? এবং হাদীসের আলোকে মানব জীবন’ লেখা সমাপ্ত করি। হাদীসের আলোকে মানব জীবনের বাকী তিন খন্ড আমি জেল থেকে বের হওয়ার পরে লিখেছি।
আমার কারা জীবনের একটা ঘটনা লেখার লোভ আমি সংবরণ করতে পারছিনা। আমাদেরকে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে নেয়ার পরে আমার ক্যাবিনেট কলীগসহ চারজনকে একটি চার কক্ষ বিশিষ্ট জেলে আবদ্ধ করে রাখে। দিনে কক্ষের তালা খুলে দিলে কক্ষের বারান্দায় আমরা চারজন একত্রেই খানাপিনা খেতাম ও আলাপ আলোচনা করতাম। তখন সকলেরই ভিতরে চরম হতাশা ও পেরেশানী ছিল। সূর্য অস্ত যাওয়ার আগেই কারা রক্ষীরা আমাদের স্ব-স্ব রুমে ঢুকিয়ে তালা লাগিয়ে দিত। আমার বন্ধু ও ক্যাবিনেট কলীগ মুহতারাম আব্বাস আলী খান আমার পার্শ্বের রুমেই ছিলেন। তিনিও বেশ হতাশ ও পেরেশান ছিলেন। বিশেষ করে নূতন সৃষ্ট বাংলাদেশে আর বোধ হয় ইসলামের নাম নেয়া যাবেনা বলে তিনি আমার কাছে বার বার বলছিলেন। আমিও বেশ বিচলিত ও পেরেশান ছিলাম। এ সময় রাত্রে জেলখানায় দেখা একটি খাব (স্বপ্ন) আমার হতাশা দূর করতে বেশ সাহায্য করেছে। আমি এখানে উল্লেখ করতে চাই যে, খাব বা স্বপ্ন শরীয়তের কোন দলিল নয়। তাই কোন স্বপ্ন দ্রষ্টাকে যদি শরীয়তর বিরুদ্ধে কোন কাজ করার নির্দ্দেশ স্বপ্নে দেয়া হয় তাহলে সে নির্দ্দেশ মানা যাবেনা। তবে উত্তম খাব নবুয়তের চল্লিশ ভাগের এক ভাগ বলে আল্লাহর রসূল (সঃ) বলেছেন।
জেলখানায় এক রাতে চিন্তা-ভাবন করতে করতে আমি ঘুমিয়ে গিয়েছি। হঠাৎ আমি স্বপ্নে দেখি যে, আমি লাহোরে মাওলানা মওদূদীর (রঃ) বাড়িতে। তিনি আমাদেরকে নিয়ে তার লাহোর শহরের বাড়িতে আছরের নামাজ আদায় করে বৈকালিক বৈঠকে নিত্য দিনের মত বসেছে। মাওলানা মওদূদী সাহেব চেয়ারে পশ্চিমমূখী হয়ে বসা ছিলেন। আর সকলে চেয়ারে মওদূদী সাহেবের দিকে মুখ করে বসেছেন। আমি বসার চেয়ার না পেয়ে মাওলানার দিকে পূর্বমূখী হয়ে দাড়িয়ে আছি। হঠাৎ আমি দেখতে পাই পূর্ব দিকের গেট হতে ছোরা হাতে একটা লোক মাওলানা মওদূদী সাহেবের দিকে সাবধানে অগ্রসর হচ্ছে। ইদ্দেশ্য তাকে হত্যা করা। যেহেতু আন্যেরা সবাই মওদূদী সাহেবের দিকে মুখ করে নীচু হয়ে কথা শুনছিলেন। তাই তারা এ দৃশ্য দেখতে ছিলনা। দাড়ান থাকার কারনে আমিই এই দৃশ্য দেখছিলাম। আমি মাওলানার জীবনের জন্য খুবই বিচলিত হয়ে পড়েছিলাম। হাঠাৎ দেখি আমার পার্শ্বে জালানী কাঠের স্তুপ। লোকটি মাওলানা মওদূদীর কাছে পৌছতেই তাকে ছুরি দিয়ে আঘাত করার আগেই আমি জালানি কাঠ নিয়ে জাম্প করে গিয়ে তাকে আঘাত দিয়ে ধরাশায়ী করে ফেলি। এই স্বপ্ন দেখে আমার ঘুম ভেংগে যায়। সকাল বেলা যখন সেলের তালা খুলে দেয়া হল, তখন আমি খুবই আশ্বস্থি সহকারে আব্বাস আলী খানকে খাবের বিবরণ শুনিয়ে বলি, আমি ইঙ্গিত পেয়েছি বাংলাদেশে ইসলামের কাজ আবার চলবে এবং ইসলামের শত্রুরা পরাভুত হবে।