আমার তৃতীয়বার হজ্জ্ব সফরঃ
১৯৮৯ইং সালে হজ্জ্ব অনুষ্ঠিত হয়েছে ১২ জুলাই বুধবার। এ দিনটি ছিল সৌদি আরবে ৯ জিলহজ্জ্ব আরাফায় অবস্থানের দিন। জুলাই মাসের তিন তারিখ সৌদি দূতাবাসের টেলিফোন পাই যে, আমাকে রাবেতাতুল আলমে ইসলামী এবারে হজ্জ্বে তাদের মেহমান করেছে এবং ভিসা পাঠিয়েছে। সুতারাং এখনই যেন আমি দূতাবাস থেকে ভিসা সংগ্রহ করে প্রস্তুতি নিয়ে পরের দিনই অর্থাৎ ৪ জুলাই পবিত্র হজ্জ্ব আদায়ের ইদ্দেশ্যে বাংলাদেশ বিমানে মক্কা শরীফের পথে দজিদ্দায় রওয়ানা হই। আমার সাথে আরও ছয়জন সঙ্গী ছিলেন। জিদ্দা বিমান বন্দরের যাবতীয় অনুষ্টানাদি শেষ করে বাইরে এসে দেখি ন্সেহেবর শহীদুল ইসলাম রাবেতার পত্রসহ আমাদেরকে নেয়ার জন্য গাড়ি নিয়ে হাজির হয়েছে। আমারা ঢাকা থেকে বাংলাদেশ সময় ৭টায় বিমানে রওয়ানা হই।
একটানা প্রায় ৭ ঘন্টা উড়ার পর বিমান সৌদি সময় প্রায় ১টায় জিদ্দা অবতরণ করে। এয়ারপোর্টের অনুষ্ঠানিকতায় বেশ সময় নেয়। অতঃপর আমরা যখন মক্কা শরীফে পৌঁছি তখন মাগরিব হতে কিছু বাকি। আমরা আসরের নামায দজিদ্দার পথে আদায় করে নিয়েছিলাম। যেহেতু আমরা সকলেই ক্লান্ত ছিলাম, তাই রাতে উমরা সমাপ্ত করা সম্ভব হয় নাই। ভোরে নাস্তা সেরে তওয়াফ ও ছাঈ করার উদ্দেশ্যে আল্লাহর ঘরে হাজির হই। তওয়াফ ও ছাঈসহ উমরার আনুষ্ঠানাদি সেরে ঐ রাত শহীদুল ইসলামের বাসায় কাটাই। পরের দিন সকালে মিনায় রাবেতার গেস্ট হাইজে গিয়ে অভ্যর্থনা কক্ষে রিপোর্ট করি। অভ্যার্থনা কক্ষ হতে আমাকে থাকার জন্য রুম বরাদ্ধ করে চাবি, ব্যাজ ও খাবার টিকিট দিয়ে দেয়।
মিনায় মসজিদে খায়েফের সংলগ্ন একটি ৪ তলা বিশিষ্ট বিরাট দালানে রাবেতার মেহমানখানা অবস্থিত। এখানে নামায ও সম্মেলনের জন্য একটি বিরাট কক্ষ আছে। আমি পাঁচ বছর আগে আরও একবার সৌদি সরকারের মেহমান হয়ে হজ্জ্ব পালন উপলক্ষে এই মেহমানখানয় অবস্থান করেছিলাম। রাবেতার মেহমান হিসেবে ৭০টি দেশের প্রায় হাজার খানেক প্রতিনিধি এখানে হজ্জ্ব পালনের জন্য এসে সমবেত হয়েছিল। জিলহজ্জ্ব মাসের ৩ তারিখে আমি মেহমান খানায় প্রবেশ করি এবং বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের সাথে মতামত বিনিময় ও পরিচয় ইত্যাদি করতে থাকি।
একটানা প্রায় ৭ ঘন্টা উড়ার পর বিমান সৌদি সময় প্রায় ১ টায় জিদ্দা অবতরণ করে। হজ্জ্ব ইসলামের পঞ্চম রুকন। স্বচ্ছল মুসলমান তিনি দুনিয়ার যে অংশেই বাস করুন না কেন, জিন্দেগিতে একবার তার হজ্জ্ব আদায় করা ফরয। হ্জ্ব আদায় উপলক্ষে দুনিয়ার বহু দেশ হতে কয়েক লাখ মুসলমান নারী পুরুষ যখন মক্কায় সমবেত হয় তখন এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন ভাষারত, বিভিন্ন রংয়ের ও বিভিন্ন লেবাসের অগণিত, অজস্র লোকের সমাসেশ সত্যিই খুব আকর্ষণীয়। এসব লোকই আবার একই লেবাসে অর্থাৎ একখানা সাদা কাপড় পরিধান করে আর এখানা গায়ে জড়িয়ে লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক আওয়াজ তুলে যখন মিনা, আরাফাত ও মুজদালিফায় হাজির হয় তখন সে দৃশ্যের অবতারণ হয় তা ভাষায় বর্ণনা করা অসম্ভব। কা’বা ঘরকে আল্লাহ তা’য়ালা বিশ্বের মুসলমানদের মিলন কেন্দ্র এবং হজ্জকে মিলন অনুষ্ঠান করে যে নির্দেশ দিয়েছেন তাতে অসংখ্য কল্যাণ নিহিত আছে। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘যাতে করে প্রত্যক্ষ করতে পারে হজ্জ্ব যাত্রীরা তাদের উদ্দেশ্য নিহিত হজ্জ্বের কল্যাণ সমূহ’ (আল কোরআন)
দুনিয়ার বিভিন্ন অংশের বিভিন্ন ভাষার ও বিভিন্ন রাষ্ট্রের মুসলমানদের পরষ্পরের অবস্থা জানার ও উপলব্ধি করার এ এক মহা সুযোগ। রাবেতার মেহমান হওয়ার কারণে দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের নেতৃস্থানীয় হজ্জ্ব প্রতিনিধিদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ, আলোচনার মাধ্যেমে আমি এই সুযোগের সদ্ব্যবহারের পুরামাত্রায় চেষ্টা করেছি। এ উপলক্ষে বিভিন্ন দেশের বিশিষ্ট লোকের সাথে আমার আলোচনার বিবরণ আমার লিখিত বই ‘দেশ হতে দেশান্তরের ভিতরে দেয়া হয়েছে। তবে এখানে বাদশাহ ফাহদের মিনার বাড়ির অনুষ্ঠানে যোগদানের বিষয়টি কেবলমাত্র দেয়া হল।
১১ জিলহজ্জ্ব বাদশাহ ফাহদের বাড়ির অনুষ্ঠানে যোগদানঃ
১০ জিলহজ্জ্ব বিকেলে রাবেতার একজন কর্মচারী এসে খবর দিল, ‘আগামীকাল সকাল সাড়ে সাতটায় মহামান্য বাদশাহ ফাহদের বাড়িতে এক অনুষ্ঠান হবে। উক্ত অনুষ্ঠানে যারা আমন্ত্রিত তাদের মধ্যে আপনিও আছেন। সুতরাং আপনি প্রস্তত হয়ে সময়ের পূর্বেই অভ্যর্থনা কক্ষে হাজির হবেন। খোঁজ নিয়ে জানলাম, হাজার-খানেক প্রতিনিধির মধ্য হতে মাত্র ৩৫ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিদেরকে বাছাই করে আমন্ত্রণ জানান হয়েছে। আমরা সময়মত অভ্যর্থনা কক্ষে হাজির হলে পরে কয়েকখানা গাড়িতে করে আমাদেরকে বাদশার মিনায় অবস্থিত বিরাট বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। কয়েকটি গেট পার হয়ে আমরা বাদশার বাড়ির বিরাট কনফারেন্স কক্ষে গিয়ে হাজির হই। রাবেতার আমন্ত্রিত মেহমান ছাড়াও হজ্জ্ব মন্ত্রলালয় ও বাদশার মেহমানসহ আমরা মোট দু’শ মেহমান ওখানে উপস্থিত হই। আমন্ত্রিতদের মধ্যে কয়েকটি দেশের প্রাক্তন রাষ্ট্র প্রধান ও রাজপ্রতিনিধিরাও ছিলেন। আফগানিস্তানের মুহাজিদ সরকারের প্রধান সেবগাতুল্লাহ মোজাদ্দেদীও বাদশার পাশে রাষ্ট্র প্রধানদের সারিতে উপবিষ্ট ছিলেন। বাদশাহ ফাহাদ অনুষ্ঠানে এসে আসন গ্রহণ করার পর পবিত্র কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে অনুষ্ঠানে কার্যক্রম শুরু হয়। অতঃপর পর্যায়ক্রমে রাবেতার সেক্রেটারী জেনারেল আবদুল্লাহ নাসিফ, হজ্জ্ব মন্ত্রী এবং বায়তুল মুকাদ্দাসের মুফতি সাহেবান মেহমানদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন। সব শেষে পবিত্র হারাম শরীফদ্বয়ের খাদিম মহামান্য বাদশাহ ফাহদ বিন আব্দুল আজিজ সারা দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের বিশিষ্ট হজ্জ্ব প্রতিনিধিদের উদ্দেশ্যে এক দীর্ঘ বক্তব্য রাখেন। এতে তিনি মুসলিম বিশ্বের প্রধান প্রধান সমস্যা যেমন ফিলিস্তিন সমস্যা, আফগানিস্তানের স্বাধীনতার জিহাদ, ইরান-ইরাক যুদ্ধ ইত্যাদির উপরে সৌদি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি পেশ করেন।
বাদশার বক্তব্য শেষ হওয়ার পর তিনি এক এক করে সকল মেহমানের সাথে করমর্দন করেন এবং পরিচয় নেন। এখানের অনুষ্ঠান শেষ হলে আমাদেরকে বৃহদাকার খাওয়ার কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। খাওয়ার কক্ষে এক অদ্ভুত কান্ড। সারিবদ্ধ বিরাট টেবিলে মাঝখানে বৃহদাকার খাঞ্চার উপরে পোলাও রেখে তার উপরে একটি রোস্ট করা আস্ত দুম্বা বসিয়ে রেখেছে। চার চার জনের জন্য এধরনের একটি খাঞ্চা ছাড়াও প্রচুর কাবাব, মিষ্টি ও ফলমূল প্লেটে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। অনুমানিক এ ধরনের শ’তিনেক খাঞ্জায় তিনশ আস্ত ভাজি করা দুম্বা, পোলাও, বিরিয়ানী ও নানা ধরনের উপাদেয় খাদ্য সম্ভারে এক দশমাংশ খাওয়াও আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। জানিনা এর পর আর কোন মেহমান এসব খাবার খাবে কিনা? খানার অনুষ্ঠান শেষে আমরা আবার আমাদের নির্দিষ্ট মেহমানখানায় ফিরে আসি। ১৫ জিলহজ্জ্ব পর্যন্ত আমি রাবেতার মেহমানখানায় বিভিন্ন দেশের হাজিদের সাথে মত বিনিময় ও দেখা সাক্ষাৎ করে কাটাই। অতঃপর মক্কা শরীফে এসে বিদায়ী তওয়াফ সমাধা করে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে জিদ্দা রওয়ানা হই।
হারামে বোমা বিষ্ফোরণঃ
সবশেষে একটি বিষয় আলোচনা করা প্রয়োজন বোধ করছি। তা হলো হারাম শরীফে বোমা বিষ্ফোরণের বিষয়। ৭ জিলহজ্জ্ব দুটি এবং ১০ জিলহজ্জ্ব একটি এই মোট তিনটি বোমা পবিত্র হারাম শরীফে বিষ্ফোরিত হয়। যাতে একজন হাজি মুত্যুবরণ করেন।এবং বেশ কতিপয় হাজী আহত হন। মহান আল্লাহ পবিত্র কা’বা ঘর এবং তার পার্শ্ববর্তী নির্দিষ্ট এলাকাকে হারাম হিসেবে ঘোষণা করে এখানে সব রকমের রক্তপাত, খুন-খারাবীকে কিয়ামত পর্যন্ত হারাম করে দিয়েছেন। অবহমানকাল হতে এমনকি জাহেলিয়াত যুগেও আরবরা এ নিয়ম নিষ্ঠা সহকারে মেনে চলেছে। সুতরাং যিনি বা যারা এ ধরনের একটি মারাত্মক অপরাধের কাজ হারাম শরীফের সীমানায় করল সমগ্র মুসলিম উম্মাহর তারা ঘৃণার পাত্র। আশা করি সৌদি সরকার অপরাধীদেরকে খুঁজে বের করে উপযুক্ত শাস্তি দানে হারামের পবিত্রতা নিশ্চিত করবেন। ( বোমা হামলার এসব অপরাধীদেরকে পরে সৌদি পুলিশ পাকড়াও করে এবং বিচারে তাদের সকলের শিরোচ্ছেদ হয়, এরা ছিল কুয়েতি শিয়া।)