ইসলামী সংগঠনের কর্মীদের পরীক্ষা
ইসলামী সংগঠন কেবল নিষ্ঠাবান নিবেদিত প্রাণ ব্যক্তিরই অবস্থান করুক এটাই আল্লাহ চান। যারা নির্ভেজাল ঈমানের অধিকারী এবং আল্লাহর সন্তোষ অর্জনকে কেন্দ্র করেই যাদের জীবনের সামগ্রিক তৎপরতা পরিচালিত, তারাই ইসলামী সংগঠনের পবিত্র অঙ্গনে বিচরণ করার উপযুক্ত ব্যক্তি। সমাজ অঙ্গনে ইসলাম বহির্ভূত ব্যক্তিদের প্রতিপত্তি ও ধন সম্পদের প্রাচুর্য দেখে যাদের মন-মানসিকতা প্রভাবিত হয় না ইসলামী সংগঠনের পবিত্র অঙ্গন তাদেরই জন্য। ব্যাধিগ্রস্ত কোন ব্যক্তি ইসলামী সংগঠনের চৌহদ্দীতে প্রবেশ করলেও ব্যাধি দুর না হলে কোন না কোন এক সময়ে তাকে সংগঠন চ্যুত হতেই হয়।
ইসলামী সংগঠনের হিফাজাতের জন্য ব্যাধিগ্রস্ত ব্যক্তিদের প্রভাব থেকে একে মুক্ত করার জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এমন এক স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার ব্যবস্থা করেছেন যার কার্যকারিতা অতুলনীয়। এই প্রক্রিয়াকে ইসলামী সংগঠনের রক্ষাকবচ বলা যায়।
ইসলামী সংগঠনে যারা এলো তাদের মধ্যে কে ভেজালযুক্ত আর কে ভেজালমুক্ত তা স্পষ্ট করে তোলার জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এই সংগঠনে চলার পথ সুগম রাখেননি। এই পথ অতি দুর্গম। এই পথে আছে অনেক চড়াই উৎরাই।
যারা ভেজালযুক্ত দুর্গম পথের বাঁকে কাফিলা থেকে ছিটকে পড়ে যারা ভেজালমুক্ত তারা পথের দুর্গমতা উপেক্ষা করে দৃঢ় পদে সামনে এগুতে থাকে।
ইসলামী সংগঠনের কর্মীদেরকে প্রতিকূলতার মধ্যে ফেলে দিয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পরীক্ষা করেন। এই পরীক্ষায় কেউ ফেল করে। কেউ আবার কৃতকার্য হয়ে উন্নত মানের মুমিনে পরিণত হয়।
আল্লাহর ওপর যারা পরিপূর্ণভাবে তাওয়াক্কুল করতে পারে না প্রতিকূল পরিবেশে তারা বিহ্বল হয়ে পড়ে। এদের সংখ্যাধিক্যের চাপ থেকে আল্লাহ সংগঠকে হিফাযাত করে থাকেন।
তদুপরি যেই ব্যক্তি জীবনভর আল্লাহর সন্তোষ অর্জনের জন্যই তার সময়, শারীরিক শক্তি, চৈন্তিক যোগ্যতা এবং ধন সম্পদ ব্যয় করে তাকে তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামত-জন্নাত দেবেন বলে ওয়াদা করেছেন। যাকে তিনি জান্নাত দেবেন সে যে সত্যিকারভাবেই তা পাবার উপযুক্ত তার প্রমাণ সে রেখে যাক, এটিই আল্লাহর অভিপ্রায়। পরীক্ষার অন্যতম কারণ এটাও।
কে ঈমানের দাবীতে সত্যবাদী আর কে সত্যবাদী নয়, কে জিহাদে আত্মনিয়োগ করতে প্রস্তুত আর কে প্রস্তুত নয় তা তো আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর অসীম জ্ঞান ও প্রজ্ঞার দ্বারা এমনিতেই জানেন। কোন ব্যক্তির মনের আসল অবস্থা জানার জন্য তাঁকে পরীক্ষার রেজাল্টের ওপর নির্ভর করতে হবে ব্যাপারটি মোটেই এমন নয়।
আসলে আশশাহাদাহ বা সাক্ষ্যদানর দায়িত্ব কে পালন করছে আর কে পালন করছে না তা দুনিয়াবাসীর নিকট সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করাই আল্লাহর ইচ্ছা।
আল্লাহর প্রতি ঈমান পোষণকারী যেই কোন ব্যক্তির এটা অবশ্য কর্তব্য যে সে তার কথাবার্তা ও কাজকর্মের মাধ্যমে সাক্ষ্য দেবে যে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব মেনে নিয়েছে এবং অন্য কারো নির্দেশ পালন ও শাসন কর্তৃত্ব গ্রহণ তার পক্ষে সম্ভব নয়।
যেই ব্যক্তি কেবল মৌখিক সাক্ষ্য দেয় অথচ তার অন্তরে খাঁটি ঈমান থাকে না তার জান্নাত পাওয়ার তো কোন প্রশ্নই ওঠে না। তদুপরি মেকী ঈমান নিয়ে তার ইসলামী সংগঠনে অবস্থানও আল্লাহর নিকট পছন্দনীয় নয়।
ঝড় এলে যেভাবে গাছের শুকনো পাতা ঝরে পড়ে, চলার পথে সংকট বা বিপদ এসে পড়লে তারাও সেভাবে ঝরে পড়ে। ঝড় তুফানের ঝাপটা সহ্য করে যে পাতাগুলো টিকে থাকে সেগুলো জীবন্ত ও মজবুত। তেমনিভাবে বিপদ সংকটে ঝাপটা সহ্য করে যারা ইসলামী সংগঠনে টিকে থাকে তারা নিষ্ঠাবান মুমিন।
বিপদ-সংকট তাই ইসলামী সংগঠনকে দুর্বল করে না, বরং তার মান উন্নত করে। ইসলামী সংগঠনের মান সংরক্ষণের জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলাইমীনই এই বিজ্ঞান সম্মত প্রক্রিয়া প্রবর্তন করেছেন।
ইসলামী সংগঠনে বাইতুল মাল
ইসলামী সংগঠনে বাইতুলমালের আয়ের প্রধান উৎস হচ্ছে কর্মীদের ইনফাক ফী সাবীলিল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহর পথে অর্থদান। দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে মুমিনগণ যেন তাদের ধন সম্পদ অকাতরে দান করে তার নির্দেশে রয়েছে আল কুরআনের বহু স্থানে। নিন্মে কয়েকটি অংশ উদ্ধৃত করা হলো :
وَتُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنفُسِكُمْ
“এবং তোমরা আল্লাহর পথে সংগ্রাম কর তোমদের মাল ও জান দিয়ে।”
– আসসাফ: ১১
وَأَنفِقُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ
“এবং তোমরা অর্থ দান কর আল্লাহর পথে।” – আল বারাকাহ: ১৯৫
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَنفِقُوا مِمَّا رَزَقْنَاكُم مِّن قَبْلِ أَن يَأْتِيَ يَوْمٌ لَّا بَيْعٌ فِيهِ وَلَا خُلَّةٌ وَلَا شَفَاعَةٌ
“হে মুমিনগণ, তোমরা দান কর আমি যা তোমাদেরকে দিয়েছি তা থেকে সেদিন আসার পূর্বেই যেদিন বেচাকেনা, কোন বন্ধুত্ব এবং কোন সুপারিশ চলবে না।” – আল বাকারা: ২৫৪
الَّذِينَ يُنفِقُونَ فِي السَّرَّاءِ وَالضَّرَّاءِ وَالْكَاظِمِينَ الْغَيْظَ وَالْعَافِينَ عَنِ النَّاسِ
“যারা সচ্ছল অবস্থায় ও অসচ্ছল অবস্থায় দান করে, যারা ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করে এবং যারা মানুষকে ক্ষমা করে।” -আল ইমরান : ১৩৪
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللَّهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيمَانًا وَعَلَىٰ رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ
“প্রকৃত মুমিন তারাই যাদের অন্তর আল্লাহর কথা উল্লেখ করলে কেঁপে ওঠে, আল্লাহর আয়াত যখন পড়া হয় তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায়, তার তাদের রবের ওপর আস্থা ও নির্ভরতা রাখে, সালাত কায়েম করে এবং তাদেরকে যেই ধন-সম্পদ দিয়েছি, তা থেকে দান করে। এরাই সত্যকার মুমিন। তাদের জন্য তাদের রবের নিকট রয়েছে উচ্চ মর্যাদা, অপরাধের ক্ষমা এবং উত্তম রিযিক।” – আল আনফাল: ২
إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَهَاجَرُوا وَجَاهَدُوا بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنفُسِهِمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَالَّذِينَ آوَوا وَّنَصَرُوا أُولَٰئِكَ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ
“যেসব লোক ঈমান এনেছে, হিজরাত করেছে, আল্লাহর পথে মাল ও জান উৎসর্গ করেছে এবং যারা হিজরাতকারীদের আশ্রয় দিয়েছে ও সাহায্য করেছে তারা একে অপরের বন্ধু ও পৃষ্ঠপোষক। ” – আল আনফাল :৭২
الَّذِينَ آمَنُوا وَهَاجَرُوا وَجَاهَدُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنفُسِهِمْ أَعْظَمُ دَرَجَةً عِندَ اللَّهِ ۚ وَأُولَٰئِكَ هُمُ الْفَائِزُونَ
“যারা ঈমান এনেছে, হিজরাত করেছে এবং তাদের মাল ও জান দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করেছে আল্লাহর নিকট তাদেরই বড়ো মর্যাদা। তারাই সফলকাম। ” – আত তাওবাহ : ২০
انفِرُوا خِفَافًا وَثِقَالًا وَجَاهِدُوا بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنفُسِكُمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ ۚ ذَٰلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ إِن كُنتُمْ تَعْلَمُونَ
“হালকা বা ভারী যাই হও না কেন বেরিয়ে পড় (অর্থাৎ যে অবস্থাতেই তোমরা থাক না কেন) আর জিহাদ কর আল্লাহর পথে তোমদের মাল ও জান দিয়ে। এটা তোমাদের জন্য কল্যাণকর-যদি তোমরা জান।”
-আত তাওবাহ : ৪১
إِنَّ اللَّهَ اشْتَرَىٰ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ أَنفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُم بِأَنَّ لَهُمُ الْجَنَّةَ ۚ
“নিশ্চয়ই আল্লাহ মুমিনদের জান ও মাল খরিদ করে নিয়েছেন জান্নাতের বিনিময়ে। -আত তাওবা: ১১১
وَلَا يُنفِقُونَ نَفَقَةً صَغِيرَةً وَلَا كَبِيرَةً وَلَا يَقْطَعُونَ وَادِيًا إِلَّا كُتِبَ لَهُمْ لِيَجْزِيَهُمُ اللَّهُ أَحْسَنَ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ
“তারা অল্প বা বেশি যা কিছু খরচ করুক না কেন কিংবা কোন উপত্যকা অতিক্রম করুক না কেন এসব তাদের নামে রেকর্ড করা হয় যাতে তারা যা করছে তার সর্বোত্তম প্রতিদান আল্লাহ তাদের দিতে পরেন।” – আত তওবা: ১২১
لَن تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّىٰ تُنفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ ۚ وَمَا تُنفِقُوا مِن شَيْءٍ فَإِنَّ اللَّهَ بِهِ عَلِيمٌ
“তোমরা কিছুতেই প্রকৃত কল্যাণ লাভ করতে পারবে না যে পর্যন্ত না তোমাদের প্রিয় বস্তুগুলোকে আল্লাহর ব্যয় করবে।” – আলে ইমরান: ৯২
ইসলামী সংগঠনে কর্মীর আত্মগঠন
আত্মগঠনের অনেকগুলো প্রক্রিয়া আছে। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি প্রক্রিয়ার কথা এখানে উল্লেখ করা হচ্ছেঃ
(১) আল্লাহর দিকে আহবান
মুমিন আল্লাহর পথের পথিক। এই পথের পরিচয় লাভ করার পর একজন মুমিন চুপ করে বসে থাকতে পারে না। বস্তুতঃ চুপ করে বসে থাকার অনুমতি আল্লাহ তাদের দেননি। তাকে পৌঁছতে হবে অন্যান্য মানুষের কাছে। তাদেরকে আল্লাহর পথে এগিয়ে আসার আহবান জানাতে হবে। দায়ী ইলাল্লাহ বা তাদেরকে আল্লাহর পথে এগিয়ে আসার আহবানকারীদেররূপে মুমিন তার জীবনকে গড়ে তুলবে।
(২) একাগ্রতা সহকারে সালাত আদায়
সালাত ব নামায ইসলামী যিন্দিগীর একটি বুনিয়াদী বিষয়। দেহ ও মন নিয়ে সার্বভৌম সত্তা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রতি আনুগত্য জ্ঞাপনের এ এক অপূর্ব মহড়া। মানুষের যেই শির অপর কোন শক্তির নিকট নত হতে রাজী নয় সেই উন্নত শির বিশ্ব জাহানাএর স্রষ্টার উদ্দেশ্যে অবনত করা সত্যি অনন্য।
একজন খাঁটি মুমিন নিতান্তই গতানুগতিকভাবে সালাত আদায় করে না। বিশ্বলোকের স্রষ্টার সামনে যেভাবে দাঁড়ানো উচিত এবং তাঁর দৃষ্টিতে থেকে যেভাবে পূর্ণাঙ্গ সালাত আদায় করা উচিত সে সেভাবেই তা পালন করে। প্রাণহীন মহড়ার কোন দাম আল্লাহর কাছে নেই। কাজেই একাগ্রচিত্তে সালাত আদায়ের অভ্যাস প্রত্যেক মুমিন্দের সৃষ্টি করতে হবে।
(৩) আল কুরআন অধ্যয়ন
আল কুরাআনে আল্লাহ, বিশ্বজাহান, পৃথইবীর জীবনে মানুষের কর্তব্য, ব্যক্তি ও সমষ্টির সর্ববিধ সমস্যা সমাধানের মূলনীতি, মানব জীবনের পরিণতি ইত্যাদি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ও নির্ভুল জ্ঞান পরিবেশিত হয়েছে। এগুলো পরিবেশিত হয়েছে সংক্ষিপ্ত ও বিজ্ঞজনোচিতভাবে। আল কুরআনকে তাই পড়তে হবে। এর গভীরে প্রবেশ করে এর নির্যাস সংগ্রহ করার প্রচেষ্টা চালাতে হবে। এর জন্য প্রয়োজনে গভীর মনোযোগ এবং গবেষকের মন নিয়ে অধ্যয়ন। কেবল এভাবেই একজন মুমিন আল্লাহর মহাজ্ঞান ও বিচক্ষণতা উপলব্ধিই হয় তাঁর জীবনধারার নিয়ামিক।
(৪) আল হাদীস অধ্যয়ন
আল্লাহর সাথে নিবিড়তম সম্পর্ক ছিলো মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা)। আল্লাহ প্রদত্ত জীবন বিধানের সর্বোচ্চ জ্ঞান হাসিল করেছিলেন তিনি। তাঁর হাতেই হয়েছে সেই জীবন বিধানের সার্থক রূপায়ণ। তাঁর অনুসৃত ও প্রবর্তিত পদ্ধতি ছিলো নির্ভুল। রাসূলের পদ্ধতি অনুসরণ করেই রাসূলের সত্যিকার অনুসারী হওয়া যায়। আর এই অনুসরণকে আল্লাহ খুবই পছন্দ করেন। কাজেই আল-হাদীস অধ্যয়ন ইসলামী আন্দোলনের একজন কর্মীর প্রাত্যহিক অভ্যাসে পরিণত হতে হবে।
(৫) সহায়ক সাহিত্য অধ্যয়ন
ইসলামী জীবন বিধানকে সহজ সরলভাবে মানুষের কাছে তাদের নিজেদের ভাষায় পরিবেশনের জন্য যুগে যুগে সাধনা করেছেন অনেক বিদগ্ধ ব্যক্তি। তাঁরা সৃষ্টি করেছেন ইসলামী সাহিত্যের ভান্ডার। ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব ও সৌন্দর্য সুন্দরভচাবে উপস্থাপিত হয়েছে এসব বইতে। এগুলো পাঠকদেরকে দায়িত্ব সচেতন করে তোলে এবং আল্লাহর নির্দেশ মতো জীবন গড়ে তোলার প্রেরণা দান করে। তাই ইসলামী সংগঠনের একজন কর্মীর এসব সাহিত্যও নিয়মিত পড়া দরকার।
(৬) রাত্রি জাগরণ
আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্ক স্থাপনের একটি উত্তম উপায় রাত্রি জাগরণ। মানুষ যখন গভীর রাতে নিদ্রা ও আরামে নিমগ্ন, সেই সময়টিতে আরাম বর্জন করে আল্লাহর সন্তোষ অর্জনের জন্য যেই ব্যক্তি শয্যাত্যাগ করে আল্লাহর ইবাদাতে আত্মনিয়োগ করে, আল্লাহ তাকে ভালো না বেসে পারেন না। আল্লাহ তাঁর প্রতি রাহমাত ও বারকাত বরষণের জন্য এগিয়ে আসেন। ইসলামী সংগঠনের একজন কর্মীর সুযোগ পেলেই রাতের শেষাংশে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিকট পাতার অভ্যাস সৃষ্টি করার প্রয়োজন।
(৭) আল্লাহর পথে অর্থ দান
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন দুনিয়ার প্রত্যেক মানুষকে সরাসরি সমান পরিমাণ সম্পদ দান করেন না। কারো কারো হাতে বেশি পরিমাণের সম্পদ জমা হয়। কারো কারো হাতে এত কম পরিমাণ সম্পদ থাকে যে তা দিয়ে মৌলিক প্রয়োজনেও পূরণ হয় না। এই দু’ধরণের লোকের মধ্যে বিদ্যমান অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর হয়। ধনবানদের কাছ থেকে সম্পদের একটি অংশ আদায় করে তা নির্ধনদের মধ্যে বন্টন করা হয়। ব্যক্তিগতভাবেও একজন মুমিন দুঃস্থ ও নিঃস্ব মানুষের কল্যাণের জন্য সাহায্যের হাত বাড়াতে হবে, এটা আল্লাহর নির্দেশ। তদুপরি আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠা করা এবং প্রতিষ্ঠিত রাখার জন্য যেই সংগ্রাম পরিচালিত হয়ে থাকে তার জন্য অর্থদান করার নির্দেশও রয়েছে প্রত্যেক মুমিনদের প্রতি। ইসলামী আন্দোলনের একজন কর্মী অকুন্ঠভাবে এই নির্দেশ পালন করবেন।
(৮) সকল কাজে আল্লাহর স্মরণ
আল্লাহর স্মরণই মানুষকে পাপ কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখে। তাই প্রতি দিনের যাবতীয় কাজ-কর্ম সমাপনের সময়েও মুমিন যাতে আল্লাহর স্মরণ রাখতে পারে তাঁর জন্য আল্লাহর রাসূল বিভিন্ন কাজের আগে ও পরে পেশ করার জন্য দু’আ শিকিয়েছেন। নিদ্রার প্রাক্কালে, নিদ্রা থেকে জেগে, আযান শুনে, পায়খানায় যাতায়াতকালে, অযুকালে, মসজিদে প্রবেশ ও নির্গমন কালে, পানাহারের পূর্বে ও পরে, পোশাক পরাকালে, আয়নায় চেহারা দেখার সময়ে, কোন কাজের শুরুতে ও শেষে, কোন স্থানে রওয়ানা হওয়াকালে, সোয়ারীতে আরোহণকালে, বিপদের সময়ে অর্থাৎ যাবতীয় কাজ সম্পাদন কালে পঠনীয় দু’আ রয়েছে। অর্থ বুঝে এবং অর্থের দিক লক্ষ্য করে এসব দু’আ পড়লে অন্তর আল্লাহ মুখী হয়। ইসলামী সংগঠনের একজন কর্মী ধীরে ধীরে তাঁর ব্যবহারিক জীবনে এসব দু’আর অনুশীলন করতে সচেষ্ট হবে।
(৯) রাসূলের প্রতি দরূদ পড়া
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা) ছিলেন বিশ্ব মানবতার প্রতি আল্লাহর রহমত স্বরূপ। তাঁর প্রতি দরূদ পড়ার তাদিক করেছেন স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। আল্লাহর রাসূল বলেছেন যে, যেই ব্যক্তি তাঁর প্রতি একবার দরূদ পড়ে আল্লাহ সেই ব্যক্তির জন্য দশটি পুণ্য লিপিবদ্ধ করেন। তাই আত্মিক সমৃদ্ধির জন্য ইসলামী সংগঠনের একজন কর্মীর উচিত প্রতিদিন রাসূলের উদ্দেশ্যে দরূদ পড়া।
(১০) আত্ম সমালোচনা
এটা কাম্য যে একজন কর্মী দিনান্তে তার নিজের যাবতীয় কাজের হিসাব নিজেই নেবে। রাতের সালাত আদায় করে কিছুক্ষণ নীরবে বসে থেকে তার সারাদিনের কাজ মনে মনে পর্যালোচনা করা উচিত। সারাদিনে আল্লাহর পছন্দনীয় যেসব কাজ হয়েছে সেগুলো স্মরণ করে আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপন করা উচিত। আবার যে সমস্ত অবাঞ্চিত কাজ হয়ে গেছে তার জন্য অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত। সংগে সংগে সেসব কাজের যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে তার জন্য দৃঢ় সংকল্প করতে হবে। এভাবে আত্মবিশ্লেষণের মাধ্যমে ইসলামী সংগঠনের একজন কর্মীকে প্রতিদিনই নিজের নৈতিক মান উন্নত করার প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
(১১) সাওম পালন
রামাদান সাওম বা রোযার মাস। আল্লাহর ইবাদাতের এ এক রকম বিশেষ মওসুম। সাওম পালন একজন মুমিনকে প্রবৃত্তি দমন করে আত্মিক শক্তি বৃদ্ধির সুযোগ দান করে। সাউম সাধনা মুমিনের দেহ ও মনের ওপর এক গভীর প্রভাব রাখতে সক্ষম হয়। সেই কারণে ইসলামী সংগঠনের একজন কর্মীকে মাহে রামাদাঙ্কে আত্মগঠনের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের মাস হিসাবে গ্রহণ করতে হবে। তদুপরি অন্যান্য মাসগুলোতেও কিছু নাফল রোযা পালনের চেষ্টা করতে হবে।
(১২) মৌলিক মানবীয় গুন অর্জন
পরিশ্রমপ্রিয়তা, কষ্টসহিষ্ণুটা, সংযম, বিপদে দৃঢ়তা, সময়ানুবর্তিতা, নিয়মানুবর্তিতা, সাহসিকতা, বিশ্লেষণ শক্তি, উদ্ভাবন শক্তি, তড়িৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণ যোগ্যতা, সংগঠন গড়ে তোলার যোগ্যতা, সংগঠন পরিচালনার যোগ্যতা, হৃদয়ের প্রশস্ততা, নম্র ব্যবহার, উত্তম লিখন ও ভাষণ প্রভৃতি মৌলিক মানবীয় গুণ। সচেতনভাবে প্রচেষ্টা চালালে এসব গুণের বিকাশ ঘটানো যেতে পারে।
ইসলামী সংগঠনের একজন কর্মীকে এসব গুণের অধিকারী হবার জন্য চেষ্টা চালাতে হবে এবং এগুলো অর্জনের জন্য আল্লাহর কাছে মুনাজাতও করতে হবে।
(১৩) পারস্পরিক সম্পর্ক বিনষ্টকারী কাজ বর্জন
(ক) অশালীন ও অশোভন কথাবার্তা
আল্লাহর রাসূল (সা) বলেন,
يا عائشة إن شر الناس منزلة عند الله يوم القيامة من ودعه أو تركه الناس اتقاء فحشه
“আল্লাহর নিকট সেই ব্যক্তি নিকৃষ্ট যার অশালীন ও অশোভন কথা থেকে বাঁচার জন্য লোক এড়িয়ে চলে।” -সহীহুল বুখারী
জিহবা সংযত করার গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে আল্লাহর রাসূল বলেন,
أن يضمن لى ما بين لحييه وما بين رجليه أضمن له الجنة –
“যেই ব্যক্তি তার জিহবা ও লজ্জাস্থানের হিফাজাতের যামিন অবে আমি তার জান্নাতের যামিন হবো।”
-সহীহুল বুখারী
আল্লাহর রাসূল আরো বলেন,
و من كان يؤمن بالله واليوم الاخر فليقل خيرا أو ليصمت
“আর যেই ব্যক্তি আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি ঈমান পোষণ করে সে যেন ভালো কথা বলে অথবা চুপ করে থাকে।”
(খ) গীবাত
কারো পশ্চাতে তার দোষত্রুটি চর্চা করার নাম গীবাত। এটা আল্লাহর নিকট অত্যন্ত অপছন্দনীয়। আল্লাহ বলেন,
وَلَا يَغْتَب بَّعْضُكُم بَعْضًا ۚ
“তোমাদের কেউ যেন গীবাত না করে।” –আল হুজরাতঃ ১২
গীবাত যে কতোবড়ো পাপ তা বুঝাতে গিয়ে আল্লাহর রাসূল (সা) বলেন,
الغيبة أشدّ من الزنا
“গীবাত যিনার চেয়েও জঘন্যতর।”
(গ) আন্দাজ- অনুমান
আন্দাজ-অনুমানের ভিত্তিতে কারো প্রতি খারাপ মনোভাব পোষণ করা গুনাহর কাজ। এই সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اجْتَنِبُوا كَثِيرًا مِّنَ الظَّنِّ إِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ
“হে মুমিনগণ, তোমরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে আন্দাজ-অনুমান করা থেকে বিরত থাক। কেননা, কোন কোন আন্দাজ-অনুমান গুনাহর কাজ।” –আল হুজরাতঃ ১২
(ঘ) হিংসা
হিংসা এক জঘন্য দোষ। বরং এটা এক রকমের মনস্তাত্ত্বিক রোগ। এই রোগ থেকে আত্মরক্ষা করার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহর রাসূল বলেন,
ایاگم و الحسد فان الحسد یا گل الحسنات کما تأگل التار الحطب
“হিংসা থেকে দূরে থাক। নিশ্চয়ই হিংসা নেক কাজগুলোকে এমনভাবে খেয়ে ফেলে যেভাবে আগুন লাকড়ীকে খেয়ে থাকে।” –সুনানু আবী দাউদ
(ঙ) রাগ
রাগ মানব চরিত্রের অতি বড়ো এক দোষ। রাগের বশবর্তী হয়ে দুনিয়ার মানুষ দুনিয়ার অংগনে প্রতিনিয়ত অসংখ্য অঘটন ঘটিয়ে চলছে। এই রাগের কারণে পারিবারিক, দলীয় ও সামাজিক সুস্থতা বিঘ্নিত হয়। মুমিনদের অন্যতম বৈশিষ্ট হচ্ছে যে তারা রাগ দমন করে। এই সম্পর্কে রাসূল (সা) বলেন,
ليس الشديد بالصئراعة ائما الشديد الذى يملك نفسة عند الغضب
“বলবান সে নয় যে কুস্তিতে অন্যকে পরাজিত করে বরং বলবান সে যে রাগের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে।” – সহীহুল বুখারী
(চ) অহংকার
অহংকারী ব্যক্তি আত্মপূজারী হয়। সে নিজেকে শ্রেষ্ঠ এবং অন্যদেরকে হেইয় জ্ঞান করে। ফলে তার সংগে অন্যদের সম্পর্কের ব্যবধান থাকে। অহংকারী ব্যক্তি অন্যদেরকে ডিকটেট করতে চায়। কিন্তু অন্য কারো কথা বা পরামর্শ সে কানে তুলতে চায় না। অহংকারী ব্যক্তি সংগঠন ও সমাজ জীবনে ফিতনা-ফাসাদের জন্ম দিয়ে থাকে। আল্লাহ আল কুরাআনে বলেছেন যে তিনি অহংকারীকে ভালবাসেন না। এক হাদীসে আল্লাহর রাসূল (সা) বলেন,
لاً يدخل الجثة من كان فى قلبه مثقال ذرة من كبر
“যার অন্তরে সামান্য পরিমাণও অহংকার আছে সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।”
এখানে বড়ো বড়ো কতগুলো দোষের কথা উল্লেখ করা হয়েছে মাত্র। এই জাতীয় যাবতীয় দোষ বর্জন করে ইসলামী সংগঠনের একজন কর্মী চারিত্রিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি করবেন।