মুখোশ-পরা দুশমনদের ভূমিকা
ইসলামী আন্দোলন যখন শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং যখন বাইরে থেকে আক্রমণ চালিয়ে তাকে স্তব্ধ করা যায় না, তখন ইসলামের দুশমনরা ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে। ভেতর থেকে আন্দোলনকে আঘাত হানার জন্য তাদের কিছু সংখ্যক লোক ইসলামী সংগঠনে ঢুকে পড়ে এবং ক্ষতিকর তৎপরতা চালাবার সুযোগের অপেক্ষায় থাকে।
এই ক্ষতিকর তৎপরতার প্রধান ধরন হচ্ছে ইসলামী সংগঠনের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের চরিত্রহনন। ইসলামী সংগঠনের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের প্রতি কর্মীগণ গভীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ পোষণ করে থাকে। এই ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধের কারণেই ইসলামী সংগঠনের কর্মীদের নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য হয় স্বতঃস্ফূর্ত ও অখন্ড। আনুগত্য সাংগঠনিক শৃঙ্খলার প্রধান উপকরণ। তাই ইসলামী সংগঠনের সংহতি বিনাশ করতে হলে এই স্বতঃস্ফূর্ত ও অখন্ড আনুগত্যের ভিত্তিতে আঘাত হানতে হয়।
এই আঘাত হানার জন্য প্রয়োজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সততা ও যোগ্যতা সম্পর্কে কর্মীদের মনে সংশয় সৃষ্টি করা। এই সংশয় সৃষ্টি উদ্দেশ্যে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের ছোট খাটো মানবীয় ত্রুটি বিচ্যুতিকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে কর্মীবাহিনীর মধ্যে প্রচার করা হয়। এতে সফতা অর্জন করার সম্ভাবনা দেখা না দিলে কল্প কাহিনী রচনা ও রটনা করে নেতৃত্বের সততা ও যোগত্য সম্পর্কে সংশয় সৃষ্টির অবিরাম প্রচেষ্টা চালানো হয়।
ইসলামী সংগঠনে অনুপ্রবেশ করে ঘুপটি মেরে বসে ইসলামের মুখোশপরা দুশমনেরা এই কাজই করতে থাকে। খোদ আল্লাহর রাসূলের (সা) পরিচালিত সংগঠন এই আঘাতের সম্মুখীন হয়েছে বারবার। দুশমনেরা বুঝেছিলো আন্দোলনের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিদের চরিত্রহনন করতে না পারলে এই আন্দোলন কিছুতেই বিনাশ করা যাবে না, তাই তারা রাসূলের (সা) ওপরও নৈতিক আক্রমণ চালাতে কুন্ঠিত হয়নি। এখানে দু’টি ঘটনা বিশেষভাবে প্রথম আক্রমণ এসেছিলো আল্লাহর রাসূলের (সা) সঙ্গে যায়নাব বিনতু জাহাশের (রাঃ) বিয়েকে কেন্দ্র করে।
যায়নাব বিনতু জাহাশ (রা) ছিলেন আল্লাহর রাসূলের ফুফাতো বোন। তাঁরই উদ্দোগ্যে এই কুরাইশ যুবতীর বিয়ে হয় তাঁরই আযাদ করা ক্রীতদাস যায়িদ ইবনে হারিসার (রা) সংগে। কিন্তু বনিবনা হয়নি। দাম্পত্য জীবন সুখের হয়নি। অবশেষে যায়িদ (রা) যায়নাবকে তালাক দেন। আল্লাহর নির্দেশে এই তালাক প্রাপ্ত মহিলাকে বিয়ে করে আল্লাহর রাসূল (সা)।
মুনাফিকগণ এই বিবাহকে একটা ইস্যু বানালো। তারা এই কল্প-কাহিনী রটনা করলো যে মুহাম্মাদ (সা) তাঁর পালকপুত্র যায়িদের স্ত্রী যায়নাবকে দেখে প্রেমাসক্ত হয়ে পড়েছিলেন, পুত্র তা জানতে পেরে তাকে তালাক দেন এবং মুহাম্মাদ (সা) সেই তালাক প্রাপ্ত নারীকে বিয়ে করে তাঁর মনের খাহেশ মিটিয়েছেন। এভাবে মিথ্যার পাহাড় সৃষ্টি করা হলো। এই কল্প-কাহিনী মুখে মুখে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লো। বিভ্রান্তির ধুম্রজাল ক্রমশ্ল বিস্তৃত হতে থাকলো।
দ্বিতীয় আক্রমণ এসেছে এক অভিযান শেষে আয়িশার (রা) পেছনে পড়ে যাওয়া এবং এক সাহাবীর সাথে মদীনায় ফিরে আসার ঘটনাকে কেন্দ্র করে।
বনীল মুস্তালিক যুদ্ধের পর এক রাতের শেষভাগে মদীনার দিকে রওয়ানা হবার প্রস্তুতি চলছিলো। সেই সময়ে আয়িশা (রা) ঘুম থেকে জেগে ওঠে প্রাকৃতিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য একটু দূরে যান। ফিরে আসার সময় খেয়াল হলো যে তাঁর গলায় হার পড়ে গেছে। তিনি হার খুঁজতে লাগলেন। এই সময়ে কাফিলা রওয়ানা হয়ে গেলো। লোকেরা টেরই পেলো না যে আয়িশা (রা) পেছনে রয়ে গেছেন। ফিরে এসে আয়িশা (রা) গায়ের চাদর দিয়ে সারা শরীর ঢেকে সেখানে শুয়ে থাকেন। কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি ঘুমিয়ে পড়েন। সকালবেলা “ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইনি রাজিউন! রাসূলুল্লাহর বেগম এখানে রয়ে গেছেন” কথাগুলো শুনে তিনি জেগে ওঠেন। তিনি তাড়াতাড়ি চাদর দিয়ে চেহারা ঢেকে নেন।
আগন্তুক ছিলেন অন্যতম সাহাবী সাফওয়ান ইবনে মুয়াত্তাল সুলামী (রা) পর্দার বিধান নাযিল হওয়ার আগে তিনি আয়িশাকে (রা) দেখেছিলেন। তিনি তাঁকে চিনতে সক্ষম হন।
সাফওয়ান (রা) নিভৃত স্থানে ঘুমাচ্ছিলেন। ঘুম থেকে জেগে ওঠে দেখেন কাফিলা চলে গেছে। তিনি ঊটে আরোহণ করে মদীনার পথ ধরেন। একটু এগুতেই তিনি আয়িশাকে (রা) দেখতে পেয়ে এভাবে বিস্ময় প্রকাশ করেন।
সাফওয়ান (রা) তাঁর উট বসিয়ে দিলেন। আয়িশা (রা) উটের উপর ওঠে বসলেন। সাফওয়ান (রা) উটের লাগাম টেনে হাঁটতে লাগলেন।
পরবর্তী মানযিলে কাফিলা থেমেছে। অমনি আয়িশাকে (রা) নিয়ে সাফওয়ান (রা) সেখানে পৌঁছেন। তখন সকলে জানতে পেলো যে উম্মুল মুমিনীন আয়িশা (রা) পেছনে রয়ে গিয়েছিলেন।
মুনাফিক সরদার আবদুল্লাহ ইবনে উবাই মোক্ষম সুযোগ পেয়ে গেলো। সে চিল্লিয়ে বললো, “আল্লাহর কসম, মেয়ে লোকটি নিজেকে বাঁচিয়ে আসতে পারে নি। দেখ, দেখ, তোমাদের নবীর স্ত্রী অন্য পুরুষের সাথে একরাত কাটিয়ে এখন তাঁকে সংগে নিয়ে এসেছে। ’’
এই বানোয়াট কাহিনী প্রচারে লেগে গেলো মুনাফিকের দল। সরলপ্রাণ মুমিনদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। আল্লাহর রাসূল (সা) অস্থির হয়ে ওঠেন।
মদীনায় ফেরার পর আয়িশা (রা) অসুস্থ হয়ে পড়েন। আল্লাহর রাসূল (সা) এতোই বিচলিত হন যে তিনি প্রিয়তমা পত্নীর প্রতিও মনোযোগ দিতে পারছিলেন না। মুনাফিকের মিথ্যা প্রচারাভিযান রাসূলুল্লাহর (সা) মনকে ক্ষত বিক্ষত করে ফেলেছিলো। তদুপরি এই প্রচারাভিযান মুসলিম মিল্লাতের সংহতির প্রতি মারাত্মক হুমকি হিয়ে দাঁড়িয়েছিলো।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ওহী নাযিল করে এই ঘটনাগুলোর প্রতিবাদ না করেওলে সেদিন মদীনায় গড়ে ওঠা নতুন ইসলামী শক্তির কি দুর্দশা হতো তা কল্পনা করতেও শিউরে ওঠে।
মনে রাখা দরকার যে মুখোশ পরা দুশমন এই যুগের ইসলামী সংগঠনগুলোকে ধ্বংস করার জন্যও একই কায়াদায় তৎপরতা চালাতে পারে। এই সম্পর্কে ইসলামী নেতৃত্ব এবং কর্মীবাহিনীকে পূর্ণভাবে সজাগ থাকতে হবে।
ইসলামী সংগঠনের স্বাভাবিক বর্ধন
ইসলামী সংগঠন একটি স্বাভাবিক পথ ধরে ক্রমবিকশিত হয়। এই ক্রমবিকাশের জন্য যেমন প্রয়োজন কর্মীদের নিরলস ও সর্বাত্মক প্রচেষ্টা, তেমনি প্রয়োজন সময়ের। আকাংখিত মানের কর্মীবাহিনী গঠন এবং কর্ম এলাকার জনগণের মনে ইসলামী জীবন-বিধান গ্রহণের মন মানসিকতা গঠনের জন্য যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন। তড়িঘড়ি করে মানযিলে মাকসুদে পৌঁছে যাওয়া ইসলামী সংগঠনের পক্ষে সম্ভব নয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন একটি উপমার মাধ্যমে ইসলামী সংগঠনের ক্রমবিকাশের চিত্র আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন।
كَزَرْعٍ أَخْرَجَ شَطْأَهُ فَآزَرَهُ فَاسْتَغْلَظَ فَاسْتَوَىٰ عَلَىٰ سُوقِهِ
“এ এমন এক কৃষি যা অংকুর বের করলো, অতঃপর শক্তি সঞ্চয় করলো, অতঃপর মোটা-তাজা হলো এবং নিজ কাণ্ডের ওপর দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে গেলো।” -আল ফাতহ ২৯
এই আয়াতাংশে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা) কর্তৃক পরিচালিত সংগঠনের ক্রমবিকাশ ও প্রতিষ্ঠা লাভের কথা সুন্দরভাবে ব্যক্ত করছে। এতে ক্রমবিকাশের চারটি পর্যায় উল্লেখ করা হয়েছে। যথাঃ
১। অংকুর বের করা।
২। শক্তি অর্জন করা।
৩। মোটা-তাজা হওয়া।
৪। কাণ্ডের উপর দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে যাওয়া।
‘অংকুর বের করা’ অর্থ হচ্ছে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের সূচনাকরণ।
‘শক্তি অর্জন করা’ অর্থ হচ্ছে আহ্বানে সাড়া দানকারী ব্যক্তিদেরকে সংঘবদ্ধ ও সংশোধিত করে সাংগঠনিক শক্তি অর্জন।
‘মোটা-তাজা হওয়া’ অর্থ হচ্ছে কর্ম এলাকার সর্বত্র প্রভাব সৃষ্টি ও গণ- মানুষের সমর্থন লাভ। আর গণ-মানুষের সমর্থন লাভেরই আরেক নাম গণ-ভিত্তি অর্জন।
‘কাণ্ডের ওপর দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে যাওয়া’ অথ হচ্ছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অর্জন।
— সমাপ্ত —