আব্বাসীয় সাম্রাজ্য
সিন্ধু থেকে স্পেন পর্যন্ত দুনিয়ার এক বিরাট অঞ্চলে দোর্দণ্ড প্রতাপের সাথে বনী উমাইয়াদের শাসন চলে। বাহ্যুত তাদের শক্তি-সামর্থ দেখে কেউ ধারণাও করতে পারেনি যে, একদিন এ সুবিশাল সাম্রাজ্যেরও পতন ঘটবে। কিন্তু যেভাবে তাদের শাসন চলছিল তাতে কেবল মানুষের মাথাই তাদের সামনে নত হয়েছিল-মানুষের মনে তাদের কোন স্থানই ছিল না। এ কারণে এক শতাব্দী হতে না হতেই আব্বাসীয়রা অতি সহজেই তাদের পতন ঘটাল। আর তাদের এ মর্মান্তিক পতনে অশ্রুপাত করার মতোও কেউ ছিল না।
খেলাফতের নয়া দাবীদারদের জয়যুক্ত হবার কারণ ছিল, তারা মুসলমানদেরকে নিশ্চয়তা দিয়ে বলেছিল যে, তারা রাসূলের বংশের লোক, তারা কুরআন-সুন্নাহ অনুযায়ী কাজ করবে এবং তাদের হাতে আল্লার বিধির-বিধান কায়েম হবে। হিজরী ১৩২ সালের রবিউসসানী মাসে সাফফার হাতে কুফায় খেলাফতের বায়আত কালে প্রথম ভাষণে বনী উমাইয়াদের অত্যাচার-অবিচারের বিষয় উল্লেখ করে সাফফাহ বলেছিলেনঃ
“আমি আশা করি, যে খান্দান থেকে তোমরা কল্যাণ লাভ করেছ সে খান্দান থেকে তোমাদের প্রতি কোন যুলুম-নির্যাতন চালান হবে না। যে খান্দান থেকে তোমরা সংশোধনের পথ লাভ করেছো সে খান্দান তোমাদের ওপর কোন ধ্বংস বা বিপর্যয় ডেকে আনবে না।“
সাফফার পর তার চাচা দাউদ ইবনে আলী জনগণকে নিশ্চয়তা দিয়ে বলে
“নিজেদের জন্য স্বর্ণ-রৌপ্য সংগ্রহ, রাজ প্রাসাদ নির্মাণ এবং তাতে নহর খননের জন্য আমাদের উদ্ভব হয়নি। বরং যে বিষয়টি আমাদেরকে ডেকে এনেছে, তা হচ্ছে এই যে, আমাদের অধিকার ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিল। আমাদের চাচার বংশধরদের (অর্থাৎ আবু তালেবের বংশ) ওপর যুলুম-নির্যাতন চলছিল। বনী উমাইয়ারা তোমাদের মধ্য দিয়ে চলছিল অত্যন্ত খারা পথে। তারা তোমাদেরকে অপদস্থ ও লাঞ্চিত করে চলছিল। আর তোমাদের বায়তুল মালকে অন্যায় ভাবে ব্যবহার করছিল। এখন আমরা তোমাদের জন্য আল্লাহ, তাঁর রাসুল এবং হযরত আব্বাসের দায়িত্ব নিয়ে বলছি যে, আমরা আল্লার কিতাব এবং তাঁর রাসুলের সুন্নাহ অনুযায়ী তোমাদের মধ্যে শাসন কার্য পরিচালনা করবো।’’ [আত-তাবারী, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠা-৮২-৮৩। ইবনুল আসীর, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩২৫। আল-বেদায়া, ১০ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৪২।]
কিন্তু শাসন-ক্ষমতা লাভের পর কিছু দিন যেতে না যেতে না যেতেই তারা এ কথা প্রমাণ করে যে এ সব কিছুই ছিল ভাওতা মাত্র।
আব্বাসীদের কার্যকলাপ
বনী উমাইয়াদের রাজধানী দামেশক জয় করে আব্বাসী সৈন্যরা সেখানে গণহত্যা চালায়। এ হত্যাকাণ্ডে ৫০ হাজার লোক নিহত হয়। ৭০ দিন যাবৎ দামেশকের উমাইয়া জামে মসজিদ ঘোড়ার আস্তাবলে পরিণত হয়েছিল। হযরত মুআ’বিয়া (রাঃ) সহ সকল বনী উমাইয়ার কবর উপড়ে ফেলা হয়। হেশাম ইবনে আবদুল মালেক (রাঃ)-এর লাশ কবরে অবকৃত অবস্থায় পেয়ে তার ওপর চাবুক মারা হয়। কয়েকদিন যাবত তা প্রকাশ্যে রাজপথে ঝুলিয়ে রাখা হয়, অতঃপর আগুনে পুড়িয়ে তার ছাই উড়িয়ে দেয়া হয়। বনী উমাইয়াদের শিশুদেরকেও হত্যা করা হয় এবং তাদের রক্তাক্ত লাশের ওপর ফরাশ বিছিয়ে খাদ্য খাওয়া হয়। বসরায় বনী উমাইয়াদের হত্যা করে মৃতদেরকে ঠ্যাং ধরে টেনে টেনে এনে রাস্তায় ফেলা হয়। সেখানে শৃগাল-কুকুর তাদের লাশ ভক্ষণ করে। মক্কা-মদীনায়ও তাদের সাথে এ ধরণের আচরণ করা হয়। [হবনুল আসীর, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩৩৩-৩৩৪, ৩৪১; আল-বেদায়া, ১০ম খণ্ড, পষ্ঠা-৪৫; ইবনে খালদুন, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৩২-১৩৩।]
সাফফার বিরুদ্ধে মুসেলে বিদ্রোহ দেখা দিলে তার ভ্রাতা ইয়াহইয়াকে বিদ্রোহ দমন করতে পাঠান। সে ঘোষণা জারী করেঃ যে ব্যক্তি শহরের জামে মসজিদে প্রবেশ করবে, তাকে নিরাপত্তা দেয়া হবে। হাযার হাযার লোক মসজিদে প্রবেশ করলে দরযায় পাহারা বসিয়ে আশ্রয় গ্রহণকারীদের পাইকারী হারে হত্যা করা হয়। যেসব স্ত্রীর স্বামী এবং অভিভাবকদের হত্যা করা হয়, রাতের বেলায় তাদের আর্তনাদ ইয়াহইয়ার কানে ভেসে আসে। সে ঘোষণা দেয় যে, আগামীকাল স্ত্রী এবং শিশুদের পালা। এমনিভাবে ৩ দিন মুসেলে গণহত্যা চলে। স্ত্রী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ কাউকে ক্ষমা করা হয়নি। ইয়াহইয়ার সেনাবাহিনীতে ৪ হাযার জঙ্গী সেনা ছিল। তারা মুসেল-এর মেয়েদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুরু হয় ধর্ষণের পালা। জনৈকা মহিলা ইয়াহইয়ার ঘোড়ার লাগাম ধরে তাকে লজ্জা দিয়ে বলেঃ “তোমরা বনু হাশেমের লোক, রাসূল (সাঃ)-এর চাচার বংশধর। তোমাদের জঙ্গী সিপাহীরা আরব মুসলিম মহিলাদের সতীত্ব সম্ভ্রম লুটছে। তোমাদের লজ্জা হয় না?” ইয়াহইয়ার মর্যাদাবোধ জেগে ওঠে। সে সেনাবাহিনীর জঙ্গী লোকদের বেতন এবং এনামের লোভ দেখিয়ে তাদেরকে জড়ো করে সকল হত্যা করে। [আত-তাবারী, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠা-১০৭-১০৯। ইবনুল আসীর, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩৩৮; আল-বেদায়া, ১০ খণ্ড, পৃষ্ঠা-৫৪-৫৫। ইবনে খালদুন, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৭৬।
আব্বাসীয়রা কিতাব এবং সুন্নাহ অনুযায়ী আল্লাহর বিধি-বিধান কায়েম করবে-এ শর্তে এবং প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী খোরাসানের মশহুর ফকীহ ইবরাহীম ইবনে মায়মুন আসসায়েগ তাদের আহ্বানে অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। বিপ্লব সফল হওয়া পর্যন্ত তিনি ছিলেন আবু মুসলিম খোরাসানীর দক্ষিণ হস্ত। কিন্তু বিপ্লব সফল হওয়ার পর তিনি আবু মুসলিমের নিকট আল্লার বিধিবিধান কায়েমের দাবী এবং কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে আপত্তি জানালে আবু মুসলিম তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দান করেন। [আল-বেদায়া, ১০খণ্ড, পৃষ্ঠা-৬৮।]
আবুতালেবের বংশধরদের ওপর বনী উমাইয়াদের যুলুম-নির্যাতনের প্রতিশোধ নেয়ার জন্যই আব্বাসীয়দের অভ্যুদয়-মনসুরের শাসন আমলে তাদের এ দাবীরও মুখোশ উন্মোচিত হয়। মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ নফসে যাকিয়্যা এবং তাঁর ভাই ইবরাহীমের আত্মগোপন কালে তাদের ঠিকানা বলে না দেয়ার অপরাধ মনসুর তাদের পরিবারের সদস্যবর্গ এবং আত্মীয়-স্বজনকে গ্রেফতার করে। তাদের সকল সম্পত্তি বাযেয়াপ্ত করে নিলাম করা হয়। তাদেরকে হাতকড়া লাগিয়ে মদীনা থেকে ইরাকে নিয়ে যাওয়া হয়। ইবরাহীম ইবনে আবদুল্লার শ্বশুরকে উলঙ্গ করে দেড়শ কোড়া মারা হয়। তারপর তাকে হত্যা করে খোরাসানের রাস্তায় রাস্তায় তার মস্তকের প্রদর্শনী করা হয়। কয়েকজন লোককে নিযুক্ত করা হয়েছিল, তারা জনগণের সামনে সাক্ষী দিচ্ছিল যে, এটা নফসে যাকিয়্যার মস্তক। [তাবারী, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৬১, ১৭১-১৮০। ইবনুল আসীর, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩৭০-৩৭৫। আল-বেদায়া, ১০ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৮০-৮২। কিছুদিন পর নফসে যাকিয়্যা মদীনায় শহীদ হলে তাঁর শিরচ্ছেদ করে শহরে শহরে প্রদর্শনী করা হয়। তাঁর এবং তার সঙ্গীদের লাশ তিন দিন যাবৎ মদীনার রাজপথে ঝুলিয়ে রাখা হয় এবঙ পরে সাল’আ পর্বতের নিকটে ইয়াহুদীদের গোরস্থানে নিক্ষেপ করা হয়। [আল-বেদায়া, ১০ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৯০।]
এসব ঘটনাবলী শুরু থেকেই এ কথা প্রমাণ করে যে, বনী উমাইয়াদের মতো আব্বাসীদের শাসনও দ্বীন বর্জিত। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আল্লাহ নির্ধারিত সীমারেখা লংঘনে উমাইয়ারা যেমন দ্বিধা করতো না, তেমনি আব্বাসীয়দেরও কোন দ্বিধা নেই। আব্বাসীয়রা যে বিপ্লব সাধন করে তাতে কেবল শাসকের পরিবর্তন হয়েছে, শাসন পদ্ধতির কোন পরিবর্তন হয়নি। তারা উমাইয়া যুগের কোন একটি বিকৃতির সংশোধন করেনি। বরং খেলাফতে রাশেদার পর রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ফলে ইসলামী রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থায় যেসব পরিবর্তন সাধিত হয়েছে তারা তার সবটুকু পুরোপুরিই বহাল রাখে।
বনী উমাইয়া যেভাবে রাজ কার্জ চালিয়ে আসছিলেন আব্বাসীয় আমলেও সেভাবেই চলতে থাকে। পার্থক্য হয়েছে কেবল এটুকু যে, বনী উমাইয়াদের জন্য আদর্শ ছিল কনস্টান্টিনোপলে কাইজার আর আব্বাসীয়দের জন্য অনুসরণীয় হয়েছে ইরানের কিসরা।
শূরা ভিত্তিক শাসন নীতিও পরিত্যাগ করা হয়। এর যা ফল দাঁড়ায়, সেদিকে আমি ইতিপূর্বেও ইঙ্গিত করেছি।
বায়তুল মালের ব্যাপারে তাদের কর্মধারা উমাইয়াদের থেকে স্বতন্ত্র ছিল না। বায়তুল মালের আয়-ব্যয় কোন ব্যাপারেই শরীয়াতের বিধান এবং নিয়ম-নীতি মেনে চলা হতো না। জনগণের নয়, বরং বাদশাহদের ধন-ভাণ্ডারে পরিণত হয় বায়তুল মাল। তার আয়-ব্যয়ের ব্যাপারে কারো জিজ্ঞাসাবাদ করার কোন অধিকার ছিল না।
বিচার বিভাগের ওপর খলীফা, রাজপ্রাসাদের ব্যক্তিবর্গ, শাসক ও পরিষদ বর্গের হস্তক্ষেপ তেমনি চলতে থাকে, যেমনি চলছিল বনি উমাইয়াদের শাসনামলে। খলীফা আল-মেহেদীর সময় তাঁর জনৈক সিপাহসালার এবং একজন ব্যবসায়ীর মামলা কাযী ওবায়দুল্লাহ ইবনে হাসানের আদালতে পেশ করা হয়। খলীফা কাযীকে লিখে পাঠান যে, এ মামলার রায় আমার সিপাহসালারের পক্ষে করবেন। কাযী তার নির্দেশ পালন না করায় তাঁকে বরখাস্ত করা হয়। [আল-খতীবঃ বাগদাদের ইহিাস, ১০ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩০৯, মিসর-১৯৩১।] হারুনুর রশীদের শাসনকালে কাযী হাফস ইবনে গেয়াস খলীফার বেগম যুবায়দার জনৈক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ফায়সালা করলে তাঁকে চাকুরী হারাতে হয়। [তাশ কোবরাযাদাহঃ মেফতাহুস সাআদাহ, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-১১৯, ১ম সংস্করণ, হায়দারাবাদ, ১৩২৯ হিজরী।]
শুউরী আন্দোলন ও যিন্দীক
বনী উমাইয়ারা বঙশ-গোত্র এবং জাতীয়তাবাদের য বিদ্বেষের জন্ম দিয়েছিল, আব্বাসীয়দের শাসনকালে তা আরও তীব্র হয়ে ওঠে। এক খান্দানের বিরুদ্ধে আরেক খান্দানের অধিকারের ওপর ভিত্তি করেই আব্বাসীয়দের আন্দোলনের সূচনা হয়। কিন্তু নিজেদের বিজয় ও সাফল্যের জন্য তারা একদিকে আরবদের এক কবীলাকে আরেক কবিলার বিরুদ্ধে সংঘাত মুখর করে অপরদিকে আজমীরদেরকে আরবদের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত করে তুলে এটাকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করার নীতি অবলম্বন করে। আব্বাসী আন্দোলনের অগ্রনায়ক ছিলেন ইবরাহীম ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে আলী ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস। আবু মুসলিম খোরাসীকে খোরাসানের দায়িত্বে নিয়োগ করার প্রাক্কালে তিনি যেসব নির্দেশ দান করেন তার মধ্যে একটি ছিল এই যে, আরবদের মধ্যে ইয়ামানী এবং মুযারীর যে দ্বন্দ্ব বর্তমান রয়েছে তার সুযোগ গ্রহণ করে ইয়ামানীদেরকে মুযারীদেরকে বিরুদ্ধে সংঘর্ষে লিপ্ত করে। তাঁর দ্বিতীয় নির্দেশ ছিলঃ সম্ভব হলে আরবী বলতে পারে এমন একজন লোকও জীবিত রাখবে না। পাঁচ আঙ্গুল বা তার চেয়ে বড় কোন আরব শিশু সম্পর্কে তোমার সামান্যতম সন্দেহ হলে তাকে হত্যা করবে। [ইবনুল আসীর, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৯৫। আল-বেদায়া, ১০ খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৮। ইবনে খালদুনঃ ৩য় খণ্ড, ১০৩।] এ কর্মকাণ্ডের ফল দাঁড়ায় এই যে, বনী উমাইয়াদের শাসনামলে তাদের আরবী প্রীতির ফলে আজমীদের মনে স্বজাতি পূজার (শূউবিয়্যাত) যে আগুন ভেতরে ভেতরে জ্বলছিল, আব্বাসীয়দের শাসনামলে তা দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে এবং তা কেবল আরবদের স্বজাতি প্রীতির বিরুদ্ধেই নয়, বরং স্বয়ং ইসলামের বিরুদ্ধেও যিন্দিকদের একটি দল সক্রিয় হয়ে ওঠে।
আজমীদের (অনারবদের) মধ্যে বংশ-গোত্রের কৌলিণ্য স্পৃহা শুরু থেকেই বর্তমান ছিল। বিষশষত আরবদেরকে তারা নিজেদের তুলনায় একেবারেই নগণ্য জ্ঞান করতো। ইসলামের বিজয়কালে আরব মরুভূমির উন্ট্রচালকদের হাতে পরাজিত হয়ে প্রথম প্রথম নিজেদেরকে ভীষণ অপমানিত বোধ করে তারা। কিন্তু ইসলামের ন্যায় ও সাম্যনীতি এবং সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন, উম্মাতের আলেম ও ফকীহগণের দ্বনিদারীপূর্ণ কর্মপন্থা তাদের যখমে কেবল মলমই দেয়নি বরং তা তাদেরকে পূর্ণ সামাজিক সমঅধিকারসহ বিশ্বজনীন মুসলিম মিল্লাতের সাথে একীভুত করতে থাকে। সরকারের প্রশাসনিক নীতিও যদি এ নীতির সহায়ক হতো, তাহলে কোন অ-আরবের মনে স্বতন্ত্র অনুভুতি সৃষ্টি হতো না। সৃষ্টি হতো না স্বজাতি পূজার উদ্দীপনা। কিন্তু তাদের সাথে অবমাননাকর ব্যবহারের ফলে বনী উমাইয়াদের অন্ধ আরব প্রীতি (ইতিপূর্বে আমরা তা আলোচনা করেছি) তাদের মধ্যে প্রতিহিংসার জন্ম দেয় এবং পরে আব্বাসীয়রা এটিকে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করে তার পরিপুষ্টি এবং বিস্তৃতি লাভের সুযোগ করে দেয়। আমাদের তরবারীর বলে নূতন রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে আমরাই তাতে কর্তৃত্ব করবো এবং আরবী নেতৃত্ব শেষ করে দেবো। তাদের এ প্রত্যাশা যথার্থ ছিল এবং তা পূর্ণও হয়েছিল।
আল জাহেয বলেন, আব্বাসীয়দের সাম্রাজ্য খোরসানী রাজত্বে পর্যবসিত হয়েছিল। [আল-বয়ান ওয়াত-তারঈন, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৮১। মাতবাআতুল ফুতুহিল আদবীয়্যাহ, মিসর, ১৩৩২ হিজরী।] মনসুরের খেলাফতকালে সিপাহসালার এবং গবর্ণরের অধিকাংশ পদে আজমীদের নিয়োগ করা হয় এবং আরবদের কর্তৃত্বের অবসান ঘটে। [আল-মাসউদীঃ মুরুয যাহাব, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৫১৫, সাআ’দা সঙস্করণ মিসর, ১৯৫৮ ইং; আল মাকরিযী-কিতাবুস সুলুক, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৫, দারুল কিতাব মিসর, ১৯৩৪ ইং।] আল জিহশিয়ারী তারীখুল ওযারায় (উযীরদের ইতিবৃত্ত) মুনসুরের শাসনকর্তাদের যে বিবরণ দিয়েছেন তাতে সব আজমীকেই দেখতে পাওয়া যায়। [দিয়ানা সঙস্করণ, ১৯২৬ ইং, পৃষ্ঠা-১৩৯, ১৫৩, ১৫৫, ১৫৭।] এ সকল আজমীরা রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভ করে শুউবী আন্দোলন শুরু করে। বাস্তবতার নিরিখে এটা নিছক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনই ছিল না, বরং এ আন্দোলনের মর্মমূলে নাস্তিক্যবাদের বীজানুও উপ্ত ছিল।
আজমীদের ওপর আরবদের কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই-এ বিতর্ক থেকেই শুউবি আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। কিন্তু অনতিকাল পরেই এ আন্দোলন আরব বিরোধিতার রূপ ধারণ করে এবং আরব এমনকি কুরায়েশ সহ তাদের একটি গোত্রের নিন্দায় গ্রন্থ রচিত হতে থাকে। ইবনে নদীম-এর ‘আল-ফিরিস্তিতে’ আমরা এ সকল গ্রন্থের বর্ণনা দেখতে পাই। মধ্যপন্থী শুউবীরা এর চেয়ে বেশী অগ্রসর হয়নি, কিন্তু তাদের চরমপন্থীরা আরো অগ্রসর হয়ে স্বয়ং ইসলামের ওপর আক্রমণ চালাতে শুরু করে। আর আজমী আমীর-উযীর-সচিবরা এবং সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা গোপনে তাদের প্রেরণা যোগায়। আল-জাহেয বলেনঃ ‘এমন বহু লোক যাদের অন্তরে ইসলামের বিরুদ্ধে সংশয় ছিল, তাদের মধ্যে শুউবিয়্যাত থেকে এ রোগ সংক্রমিত হয়। আরবরা ইসলামের প্রচারক বলে তারা ইসলামের প্রতি রুষ্ট।’’ [কিতাবুল হায়ওয়ান, ৭ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৬৮, মিসর, ১৯০৬ সালের সংস্করণ।] এরা মানী, জর্রথুষ্ট ও মাযদাক-এর ধর্ম-বিশ্বাস এবং চিন্তাধারা জীবন্ত করে তুলতে শুরু করে। শুরু করে আজমী সংস্কৃতি, রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনার মাহাত্ম বর্ণনা। কাব্য সাহিত্যের অন্তরালে তারা পাপ, অনাচার এবং নৈতিক দেউলিয়াপনা বিস্তার করতে থাকে। ধর্ম এবং ধর্মীয় বিধি-বিধানের উপহাস করতে থাকে। মদ-জুয়ার প্রতি মানুষকে আহ্বান জানায়। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানকে কটাক্ষ করতে থাকে। পরকাল এবং বেহেশত দোযখের কথা যারা বলতো, তাদেরকে উপহাসের বস্তুতে পরিণত করে। পরকাল এবং বেহেশত দোযখের কথা যারা বলতো, তাদেরকে উপহাসের বস্তুতে পরিণত করে। ইসলামকে বিকৃত করার মানসে এদের অনেকে মিথ্যা হাদীস রচনা করে তা প্রচার করে। ইবনে আবিল আওজা নামক জনৈক যিন্দীককে গ্রেফতার করা হলে সে স্বীকার করে যে, ৪ হাযার মিথ্যা হাদীস রচনা করে তার মাধ্যমে হারামকে হালাল আর হালালকে হারাম করেছে এবং ইসলামের আইন-কানুনে রদবদল করেছে। মনসুরের শাসনকালে কুফার গবর্ণর মুহাম্মাদ ইবনে সুলায়মান ইবনে আলী তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন। [আল-বেদায়া, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১১৩।] ইউনুস ইবনে আবি ফারওয়া নামে অপর এক ব্যক্তি ইসলাম ও আরবদের নিন্দা করে গ্রন্থ রচনা করে ্রবেঙ রুম এর শাসনকর্তা কাইজার-এর দরবারে তা পেশ করে এনাম লাভ করে। [আমালিল মুরতায়া, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৯০-১০০,সাআ’দা সংস্করণ, মিশর ১৯০৭ ইং।] আল-জাহেয আজমী সচীবদের এক বিরাট অংশ সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন যে, এরা কুরআনের বিন্যাসের সমালোচনা করে, এর মধ্যে বৈপরীত্য রয়েছে বলে দাবী করে, হাদীসকে অস্বীকার করে এবং তার সত্যতায় সংশয় সৃষ্টি করে। সাহাবায়ে কিরামের গুণাবলী স্বীকার করতে তাদের কণ্ঠ আড়ষ্ট হয়ে আসে। কাযী শুরাইহ, হাসান বসরী এবং আশ-শাবীর প্রসঙ্গ উঠলে তাদের বিরুদ্ধে নানা প্রকার প্রশ্ন উত্থাপন করে। কিন্তু ইরদশের ববকান এবং নওশেরাউঁয়ার প্রসঙ্গ এলে তাদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং দুরদর্শিতার প্রসংশায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠে। [ছালাছু রাসায়েল লিল-জাহেয, পৃষ্ঠা-৪২, সালকিয়া সংস্করণ, কায়রো ১৩৪৪ হিঃ।] এ সময়ের বড় বড় নাম করা আজমীদের সম্পর্কে আবুল আ’লা আল-মা’আররী বলেন, এদের সবাই ছিল যিন্দীক। উদাহারণ স্বরূপ দেবেল, বাশশর ইবনে বুদ’, আবু নোয়াস এবং আবু মুসলিম খোরাসানী প্রমুখের নাম উল্লেখ করেছেন। [আল-গোফরানা দাবুল মায়ারেফ, মিশর-১৯৫০ ইং।] এ সব যিন্দীক সুলভ চিন্তাধারা কেবল ইসলাম বিরোধী আকীদা-বিশ্বাসের পর্যায়েই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং কার্যত নৈতিক বন্ধন হতে মুক্তি ছিল-এর অপরিহার্য অংশ। ইবনে আবদে রাব্বিহী বলেনঃ শুরা, ব্যভিচার এবং উৎকোচ যিন্দীক সুলভ চিন্তাধারা অপরিহার্য অংশ-জনগণ তা ভাল করেই জানতো। [আল-ইকবুদর ফরীদ, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৭৯।]
খলীফা মনসুরের শাসনকালে (১৩৬-১৫৮ হিজরী, ৭৫৪-৭৭৫ খৃষ্টাব্দ) এ ফেতনা সর্বতোভাবে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এটা মুসলমানদের মধ্যে কেবল আকীদা-বিশ্বাস এবং নৈতিক বিকৃতির আশঙকাই সৃষ্টি করেনি বরঙ সামাজিক ্রবেং রাজনৈতিক দিক থেকে এটা মুসলিম সমাজ এবং রাষ্ট্রকে খণ্ড-বিখণ্ড করে দেবে-সে আশংকাও ছিল। আল-মাহদী তাঁর নিজ খান্দানের কুটনীতির এ আশংকাজনক পরিণতি দেখে শংকিত হয়ে ওঠেন। তিনি শক্তি প্রয়োগে এ আন্দোলনকে নির্মূল করার চেষ্টাই কেবল করেননি, বরং যিন্দীকদের সাথে বিতর্ক করা ্রবেং তাদের বিরুদ্ধে গ্রন্থ রচনার জন্য তিনি একদল আলেমকেও নিয়োগ করেন। ইসলামের বিরুদ্ধে গণমনে এরা যেসব সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টি করেছিল, জনগণের মন থেকে তা দুর করার জন্য এ সকল গ্রন্থ রচিত হয়। [আল-মাসউদী ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৫১৫। আল-মাকরিযী-কিতাবুস সুলুফ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৫।] তাঁর শাসনে ওমর আল-কালোয়াযীর অধীনে একটা স্বতন্ত্র বিভাগ স্থাপন করা হয়। যিন্দীকসুলভর চিন্তাধারার মুলোৎপাটন এবং যিন্দীকদের বিলোপ সাধনই ছিল এ বিভাগের কাজ। [আত-তাবারী, ৬ খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৯১-৩৮৯। আল-বেদায়া ১০ম অখণ্ড, পৃষ্ঠা-১৪৯।] নিজ পুত্র আল-হাদীকে তিনি যে সকল নির্দেশ দেন তা থেকে অনুমান করা যায়, তিনি যিন্দীকদেরকে কত বড় বিপদ মনে করতেন। তিনি বলেনঃ
“আমার পরে এ রাষ্ট্রে শাসন কর্তৃত্ব তোমার হাতে এলে মানীর অনুসারীদের মুলোৎপাটনের কোন ত্রুটি করবে না। এরা প্রথমে জনসাধারণকে বাহ্যিক কল্যাণের প্রতি আহ্বান করে, যথাঃ অশ্লীল কাজ থেকে বিরত থাকা, দুনিয়ায় দরবেশীর জীবন যাপন এবং পরকালের জন্য কাজ করা। এরপর তারা জনগণকে দীক্ষা দেয় যে, গোশত হারাম, পানি স্পর্শ করা উচিত নয় (অর্থাৎ গোসল করা ঠিক নয়) কোন জীব হত্যা করা ঠিক নয়। এরপর তাদেরকে দুই খোদার প্রতি বিশ্বাসের দিকে নিয়ে যায়। এবং শেষ পর্যন্ত ভাই-বোনের মধ্যে বিবাহ এবং পেশার দ্বারা গোসল করাকেও হালাল করে। বিপথগামী করার উদ্দেশ্যে তারা শিশু চুরি করে। [আত-তাবারী, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠা-৪৩৩, ৪৩৪।]
আল-মাহদীর এর বর্ণনা থেকে এ কথা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, সে সময়ের আজমী যিন্দীকরা বাহ্যত মুসলমান সেজে ভেতরে ভেতরে তাদের প্রাচীন ধর্মকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য সচেষ্ট ছিল। আল-মাসউদীর বর্ণনা মতে মনসুরের শাসনকালে পাহলবী এবং ফারসী ভাষা থেকে সে সব গ্রন্থ অনুদিত হয়েছে। এবং ইবনে আবু আওজা, হাম্মাদ আজরাদ, ইয়াহিয়া ইবনে যিয়াদ, মুতী ইবনে ইয়াস-এর মতো লোকদের গ্রন্থাদি এ বিষ ছড়াচ্ছিল। [মরুজুয যাহার, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৫১৫।]
উম্মাতের প্রতিক্রিয়া
খেলাফতে রাশেদার স্থলে রাজতন্ত্রের পত্তনের ফলে যে সকল পরিবর্তন সুচিত হয়, এটা হচ্ছে তার সঙক্ষিপ্ত বিবরণী। জনগণের রায়কে উপেক্ষা করে কোন ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা দলের নিজের ক্ষমতা লাভের জন্য চেষ্টা করা এবং জোরপূর্বক তা প্রতিষ্ঠা করার পরিণতি কি দাঁড়ায়; এ থেকেই তা অনুমান করা যায়। এ ভুল করার সময় তার কাজের পরিণতির অনুভুতি না থাকলেও এবং এর এ পরিণতি হোক এমন ইচ্ছা সে পোষণ না করলেও তার এ স্বাভাবিক পরিণতি দেখা দিতে বাধ্য।
কিন্তু এ সকল রাজনৈতিক পরিবর্তন ইসলামী জীবন বিধানের সম্পূর্ণ অবসান ঘটিয়েছিল- এমন ধারণা করা মারাত্মক ভুল হবে। কেউ কেউ অত্যন্ত ভাসাভাসাভাবে ইতিহাস অধ্যয়ন করে নির্ধ্বিধায় ফায়সালা করে বসেন যে, ইসলাম তো কেবল ৩০ বছর চলেছিল, এরপরই তার অবসান ঘটেছে। অথচ সত্যিকার পরিস্থিতি এর সম্পূর্ণ বিপরীত। সম্মুখে আমরা সংক্ষিপ্তভাবে এ কথা লিপিবদ্ধ করছি যে, মুসলিম উম্মাহ যখন এ রাজনৈতিক বিপ্লবের সম্মুখীন হলো, তখন কিভাবে তাদের সামষ্টিক অনুভুতি তাদের জীবন ব্যবস্থাকে আকড়ে ধরার জন্যে একটি পন্থা অবলম্বন করলো।
নেতৃত্বের বিভক্তি
খেলাফতে রাশেদার সত্যিকারের সৌন্দর্য ছিল এই যে, তা ছিল রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর পরিপূর্ণ প্রতিনিধিত্ব-ইতিপূর্বে আমরা তা আলোচনা করেছি। খলীফায়ে রাশেদ নিছক রাশেদ বা সত্যাশ্রয়ীই ছিলেন; বরং তিনি ছিলেন মুরশেদ বা পথ প্রদর্শকও। রাষ্ট্রের কোন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করা এবং সেনাবাহিনী পরিচালনা করাই তাঁর কাজ ছিল না; বরং সামগ্রীকভাবে আল্লার গোটা দ্বীনকে প্রতিষ্ঠা করাও ছিল তাঁর কাজ। তাঁর সত্তায় একই কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব একীভুত ছিল। রাজনৈতিক দিক থেকে এ নেতৃত্ব মুসলমানদের দিক দর্শনের ভূমিকা পালন করতো এবং বিশ্বাস, ধর্ম, নৈতিকতা, আধ্যাত্মিকতা, আইন, শরীয়াত, সত্যতা, সংস্কৃতি, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ এবং দাওয়াত ও তাবলীগের সমস্ত বিষয়ে তাদের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের দায়িত্বও আঞ্জাম দিচ্ছিল। যেভাবে ইসলাম মানব জীবনের প্রতিটি বিভাগে পরিব্যাপ্ত আছে, ঠিক তেমনি এ নেতৃত্বও সকল দিককে বেষ্টন করেছিল। মুসলমানরা পরিপূর্ণ আস্থার সাথে এ নেতৃত্বের দিক দর্শনে তাদের সামগ্রিক জীবন পরিচালিত করতো।
রাজতন্ত্র যখন এ নেতৃত্বের দিক দর্শনে তাদের সামগ্রিক জীবন পরিচালিত করতো।
রাজতন্ত্র যখন এ খেলাফতের স্থান গ্রহণ করে, তখন তা এ ব্যাপক নেতৃত্বের যোগ্য ছিল না; আর মুসলমানরা এক দিনের জন্যও রাজতন্ত্রকে এ মর্যাদা দান করতে প্রস্তুতর ছিল না। বাদশাহদের যে কীর্তিকলাপ আমরা ইতিপূর্বে আলোচনা করেছি, তারপর বাহ্যত তাদের কোন নৈতিক মান-মর্যাদা জাতির মধ্যে বজায় থাকতে পারে না। তারা জনগণের মাথা জোরপূর্বক নোয়াতে পারতো এবং তারা তা করেছিলও। ভয়-ভীতি এবং লোভ-লালসার অস্ত্র দ্বারা তারা অগণিত মানুষকে নিজেদের উদ্দেশ্যের খাদেমে পরিণত করতে পারতো এবং করেছিলও তাই। কিন্তু দ্বীনের ব্যাপারে লোকেরা যাতে তাদেরকে ইমাম বলে গ্রহণ করে, সে জন্য তারা সাধারণ মানুষের অন্তর জয় করতে পারেনি।
এ নুতন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতেই মুসলমানদের নেতৃত্ব দুভাগে ভাগ হয়ে যায়ঃ
রাজনৈতিক নেতৃত্ব
বাদশাহরা শক্তি প্রয়োগ করে রাজনৈতিক নেতৃত্বের একটি অংশ নিজেদের করায়ত্ব করেছিল। আর যেহেতু শক্তি প্রয়োগ ছাড়া তার অপসারণ সম্ভবপর ছিল না এবং শক্তি বিহীন রাজনৈতিক নেতৃত্ব সম্ভবই ছিল না, তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও মুসলিম উম্মাহ এ নেতৃত্ব গ্রহণ করে নেয়। তা আল্লাদ্রোহী নেতৃত্ব ছিল না যে, উম্মাত তা প্রত্যাখ্যান করবে। এর রাজনৈতিক নেতৃত্বের পরিচালকরা মুসলমান ছিল। তারা ইসলাম ও ইসলামের আইন মেনে চলতো। আল্লার কিতাব এবং রাসূলের সুন্নাহকে তারা আইনের ভিত্তি হিসেবে মানতে কখনো অস্বীকার করেনি। তাদের শাসনে সাধারণ বিষয়াদি শরীয়াত অনুযায়ী পরিচালিত হতো। কেবল তাদের রাজনীতি দ্বীনের অনুবর্তী ছিল না। আর এ কারণেই তারা ইসলামের শাসননীতি থেকে দূরে সরে গিয়েছিল। তাই মুসলিম উম্মাহ ও রাষ্ট্রের শাসন-শৃঙ্খলা বহাল, আইন-শৃংখলা রক্ষা, সীমান্ত প্রতিরোধ, দ্বীনের দুশমনদের সাথে জিহাদ, জুমা, জামাআত এবং হজ্জ অনুষ্ঠিত হতে থাকে। আদালতের মাধ্যমে ইসলামী আইন কানুনের প্রয়োগ অব্যাহত থাকে। সাহাবা, তাবেঈন এবং তাবে তাবেঈন এ সব উদ্দেশ্যে তাদের নেতৃত্ব স্বীকার করে থাকলে তার অর্থ এ নয় যে, তাঁরা এ বাদশাহদেরকে সত্য-পন্থী নেতা এবং তাদের খেলাফতকে খেলাফত রাশেদা ও মুরশেদা-সত্যের ধারক-বাহক ও সত্যের পথ প্রদর্শক-বলে স্বীকার করতেন। বরং তার অর্থ ছিল এই যে, এখন তারাই উম্মাতের রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধিকারী-এ বাস্তব সত্যকে তারা স্বীকার করতেন।
ধমীয় নেতৃত্ব
দ্বিতীয় পর্যায়টি ছিল ধর্মীয় নেতৃত্বের। সাহাবাদের অবশিষ্টাংশ তাবেঈন, তাবে তাবেঈন, ফকীহ, মুহাদ্দিস এবং উম্মাতের সদাচারী জনগোষ্ঠী এগিয়ে এসে এ দায়িত্ব আঞ্জাম দেন। যদিও তাদের নেতৃত্ব সুসংগঠিত ছিল না, সকলে পথ প্রদর্শক (মুরশেদ) বলে স্বীকার করে নিতে পারে, এমন কোন একজন ইমাম বা নেতা যদিও ছিল না, যদিও ছিল না তার এমন শক্তি-সম্পন্ন কাউন্সিল, যাতে করে কোন ধর্মীয় সমস্যা দেখা দিলে তৎক্ষণাৎ একটা সমাধান করা যায় আর গোটা দেশ সে সমাধান গ্রহণ করে নেয়, তবুও ধর্মীয় ব্যাপারে মুসলমানরা সম্পূর্ণ আস্থার সাথে তাদের নেতৃত্ব মেনে নেয়। এরা সকলেই একই হেদায়াতের উৎস-আল্লার কিতাব এবং রাসূলের সুন্নাহ থেকে আলো গ্রহণ করেন এবং সদুদ্দেশ্য নিয়ে দ্বীনি নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, তাই খুঁটি-নাটি বিষয়ে ভিন্ন মত পোষণ করা সত্ত্বেও সামগ্রিকভাবে তাঁদের মেজায এবং প্রকৃতি ছিল এক ও অভিন্ন। মুসলিম জাহানের প্রত্যন্ত প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সত্ত্বেও তাঁদের সকলেই মুসলমানদেরকে একই চিন্তা-চরিত্রের নেতৃত্ব দিয়ে যান।
উভয় নেতৃত্বের পারস্পরিক সম্পর্ক
এ দু’প্রকার নেতৃত্বের মধ্যে সহযোগিতা ছিল সামান্য এবং সংঘাত বা কমপক্সে অসহযোগিতা ছিল বেশী। ধর্মীয় নেতৃত্বকে পালনে রাজনৈতিক নেতৃত্ব খুব কমই সাহায্য করেছে। আর যতটুকু সাহায্য সে করতে পারতো ধর্মীয় নেতৃত্ব তারও অনেক কম গ্রহণ করেছে। কারণ তার সাহায্যের বিনিময়ে রাজনৈতিক নেতৃত্বের নিকট তাকে যে মূল্য দিতে হতো, তা আদায় করতে তার ঈমান এবং বিবেক প্রস্তুত ছিল না। আর স্বয়ং উম্মাতের অবস্থা ছিল এই যে, ধর্মীয় নেতাদের মধ্যে যারাই রাজা-বাদশাদের সান্নিধ্যে এসেছেন এবং যারাই তাদের নিকট থেকে কোন পদ বা পারিতোষিক গ্রহণ করেছেন, তারা অতিকষ্টে জাতির মধ্যে তাদের আস্থা বহাল রাখতে সক্ষম হয়েছেন। রাজা-বাদশাদের সান্নিধ্য থেকে দূরে সরে থাকা এবং তাদের রোশানলের সামনে অটল-অবিচল থাকা মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় নেতৃত্বের যোগ্যতার মাপকাঠি হয়ে দাঁড়ায়। কোন ধর্মীয় নেতা এ মানদণ্ডে না উৎরালে জাতি অত্যন্ত কঠোর দৃষ্টিতে তাকে নিরীক্ষণ করতো। রাজা-বাদশাদের সান্নিধ্যে এসেও দ্বীনের ব্যাপারে কোন আপোষ না করলেই কেবল জাতি তার শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে নিয়েছে। সাধারণ মুসলমান তো দূরের কথা, যারা রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাতে মাথা বিক্রি করে দিয়েছিল, তারাও এমন কোন ব্যক্তিকে দ্বীনের ইমাম ও ধর্মীয় নেতৃত্বের পদে বসাতে রাযী ছিল না যে তাদেরই মতো বিক্রি হয়ে গেছে অথবা ক্ষমতার দাপটে পড়ে ধর্মীয় বিধানে কোন প্রকার পরিবর্তন সাধন করতে উদ্যত হয়েছে।
এমনি করে হিজরী প্রথম শতকের মধ্যভাগ থেকেই ধর্মীয় নেতৃত্বের পথ রাজনৈতিক নেতৃত্বের পথ থেকে পৃথক হয়ে যায়। [এখানে ইতিহাসের ছাত্রদের জন্য এ কথা জেনে নেয়া ফুলপ্রসূ হবে সে, হিজরী ৩য় শতকে যখন আব্বাসীয় খেলাফতের পতন শুরু হয়, তখন ধর্মীয় নেতৃত্ব দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। এমনকি শেষ পর্যন্ত আমীর উমরাহ ও সুলতানরাই কার্যত এ নেতৃত্বের অধিকারী হয়ে বসলেন, যাদের হাতে মূলত রাষ্ট্রের চাবিকাঠি ছিল। আর আব্বাসীয় খলীফারা নিছক রাজনৈতিক গদিনশীন হয়ে পড়লেন। ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক নেতৃত্ব-কোনটাই তাদের হাতে ছিল না। তারা নিছক প্রদর্শনী সুলভ-ধর্মীয় ‘সুচীতার’ অধিকারী ছিল, যা খলাফতের নামে তারা লাভ করেছিলেন। এরই ভিত্তিতে তারা সুলতানদের মুকুট পরাতেন, আর সুলতানরা তাদের খোতবা এবং মুদ্রা চালাতেন।] উম্মাতের আলেম সমাজ তাফসীর, হাদীস, ফিকাহ এবং দীনী জ্ঞানের অন্যান্য বিভাগে গ্রন্থ প্রণয়ন ও কুরআন হাদীস পঠন-পাঠন এবং ফতোয়ার যতটুকু কাজ করেছেন, তার সবটুকুই করেছেন সরকার থেকে মুক্ত থেকে, সরকারী সাহায্য ছাড়াই, বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে সরকারের বিরোধীতার মুখে এবং সরকারের অন্যায় হস্তক্ষেপের কঠোর মুকাবিলা করেই করেছেন। উম্মাতের সৎকর্মশীল মুসলমানদের মন-মানস এবং চরিত্র ও আচার-আচরণ পরিশুদ্ধ করার যে দায়িত্ব পালন করেন, তাও ছিল রাজনৈতিক নেতৃত্বের সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্ত। অধিকন্তু এ সকঝ বুযর্গদের বদৌলতেই ইসলাম বিস্তার লাভ করেছে। রাজা-বাদশারা বড়জোর এতটুকু দায়িত্ব পালন করেছেন যে, দেশের পর দেশ জয় করে কোটি কোটি মানুষকে ইসলামের প্রভাব বলয়ে নিয়ে এসেছেন।
এরপর কোটি কোটি মানুষের ঈমানের বৃত্তে প্রবিষ্ট হওয়া রাজা-বাদশাদের রাজনীতির ফল ছিল না; বরং তা ছিল উম্মাতের সৎকর্মশীল পুত-পবিত্র চরিত্রের অলৌকিক ফলশ্রুতি।
ইসলামের সত্যিকার উদ্দেশ্য
কিন্তু এটা স্পষ্ট যে, নেতৃত্বের এহেন বিভক্তি দ্বারা ইসলামের উদ্দেশ্য সফল হয় না। রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকে মুক্ত হয়ে ধর্মীয় নেতৃত্ব ইসলামী মূল্যবোধ সংরক্ষণের যে মহামূল্য খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন তা নিঃসন্দেহে অতি গুরুত্বপূর্ণ। এর সকল খেদমতের ফলেই আজ দুনিয়ায় ইসলাম টিকে আছে, আর মুসলিম মিল্লাত তাদের দ্বীনকে যথার্থ ও অবিকৃত আঙ্গিকে দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু ইসলামের আসল উদ্দেশ্য কেবল তখন পূর্ণ হতে পারতো, যখন উম্মাত এমন একে নেতৃত্ব লাভ করতো, যা খেলাফতে রাশেদার ন্যায় একই সংগে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক উভয়ই হতো এবং যার রাজনৈতিক ক্ষমতা নিজের সমস্ত উপায় উপকরণ কেবলমাত্র দ্বীনের উদ্দেশ্য সার্থক করার কাজে ব্যয়িত হতো না, বরং এ ক্ষমতার মূল লক্ষ্যই হতো দ্বীনের উদ্দেশ্য পূর্ণ করা। দেড় দু’শো বছর পর্যন্ত যদি ইসলামী ফলাত এর অবস্থা টিকিয়ে রাখতে পারতো তাহলে দুনিয়ার বুকে সম্ভবত কুফরীর চিহ্নই তাকতো না, আর থাকলেও তার মাথা তুলে দাঁড়াবার সামর্থ থাকতো না।