পঞ্চম অধ্যায়
খেলাফত ও রাজতন্ত্রের পার্থক্য
কিভাবে কোন কোন পর্যায় অতিক্রম করে খেলাফত শেষ পর্যন্ত রাজতন্ত্রে পর্যবসিত হয়েছে, ইতিপূর্বে আমরা তা বিস্তারিত আলোচনা করেছি। খেলাফতে রাশেদার মতো অতুলনীয় আদর্শ শাসন ব্যবস্থা থেকে মুসলমানদের বঞ্চিত হওয়া কোন আকস্মিক দূর্ঘটনা ছিল না। আকস্মাৎ বিনা কারণেও তা সংঘটিত হয়নি- এ বিবরণী পাঠে এ কথাও অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে যায়। বরং ব্যবস্থার পরিবর্তনের পিছনে বেশ কিছু কারণও ছিল; যেগুলো ধীরে ধীরে উম্মাতকে খেলাফত থেকে রাজতন্ত্রের দিকে ঠেলে দিয়েছে। এ মর্মবিদারী পরিবর্তনকালে যেসব পর্যায়ে সামনে এসেছে, তার প্রতিটি পর্যায়েই তাকে রোধ করার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু উম্মাতের তথা সমস্ত মানব জাতিরই দুর্ভাগ্য যে, পরিবর্তনের কার্যকারণ অত্যন্ত শক্তিশালী প্রমাণিত হয়েছে। যার ফলে সে সকল সম্ভাবনার কোন একটিও কাজে লাগান সম্ভব হয়নি।
এখন আমরা পর্যালোচনা করে দেখবো যে, খেলাফত এবং রাজতন্ত্রের মধ্যে মৌল পার্থক্য কি ছিল, একটির স্থান অপরটি দখল করায় মূলত কি পরিবর্তন সূচীত হয়েছিল এবং মুসলমানদের সামাজিক জীবনে এর কি প্রভাব পড়েছিল।
একঃ খলীফা নিয়োগের রীতিতে পরিবর্তন
প্রথম মৌলিক পরিবর্তন শাসনতান্ত্রিক বিধানে, যে বিধানের ভিত্তিতে কোন ব্যক্তিকে উম্মাতের নেতা নির্চাচিত করা হতো।
খেলাফতে রাশেদায় নেতা নির্বাচনের পন্থা ছিল এই যে, কেউ নিজে খেলাফত লাভের চেষ্টা করেননি, নিজের চেষ্টা-তদবীর দ্বারা ক্ষমতা গ্রহণ করেননি, বরং জনগণ উম্মাতের নেতৃত্বের জন্য যাকে যোগ্য মনে করতো, পরামর্শক্রমে তাঁর ওপর দায়িত্ব ন্যস্ত করতো। বায়আত (আনুগত্যের শপথ) ক্ষমতার ফল ছিল না, বরং তা ছিল ক্ষমতার কারণ। বায়আত লাভে মানুষের চেষ্টা বা ষড়যন্ত্রের আদৌ কোন ভূমিকা ছিল না বায়আত করা না-করার ব্যাপারে জনগণ সম্পূর্ণ স্বাধীন মতামতের ভিত্তিতে বায়আত করত। বায়আত লাভের আগে কেউ ক্ষমতা গ্রহণ করতেন না।
খোলাফায়ে রাশেদীনের সকলেই এ বিধান অনুযায়ী ক্ষমতা গ্রহণ করেছেন। তাঁদের কেউই খেলাফত লাভের জন্য নাম মাত্র চেষ্টাও করেননি। বরং তাঁদেরকে খেলাফত দেয়ার পরই তাঁরা তা গ্রহণ করেছেন। সাইয়্যেদেনা হযরত আলী (রাঃ) সম্পর্কে কেউ বড়জোর এটুকু বলতে পারেন যে, তিনি নিজেকে খেলাফতের জন্য যোগ্যতর বলে মনে করতেন। কিন্তু খেলাফত লাভের জন্য তিনি কখনো কোনভাবে সামান্যতম চেষ্টাও করেছেন- নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক বর্ণনা দ্বারা এ কথা প্রমাণিত হয় না। সুতরাং তাঁর নিজেকে যোগ্যতর মনে করাকে এ নিয়মের বিরোধী বলা চলে না। বস্তুতঃ খেলাফত লাভের ব্যাপারে চারজন খলীফাই সমান মর্যাদা সম্পন্ন ছিলেন। তাঁরা আপন চেষ্টা দ্বারা খেলাফত লাভ করেননি বরং তাঁদেরকে খেলাফত দেয়া হয়েছিল।
এ নিয়মের ব্যতিক্রম থেকেই রাজতন্ত্রের সূচনা। হযরত মুআবিয়া (রাঃ)-এর খেলাফত এ ধরনের ছিল না যে, জনগণ খলীফা করেছে বলে তিনি খলীফা হয়েছিলেন- জনগণ খলীফা না করলে তিনি খলীফা হতেন না। যেভাবেই হোক তিনি খলীফা হতে চেষ্টা করেছেন। যুদ্ধ করে তিনি খেলাফত হাসিল করেছেন। মুসলমানদের সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টির তোয়াক্কা করেননি তিনি। জনগণ তাঁকে খলীফা করেনি, তিনি শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে খলীফা হয়েছেন। যখন তিনি খলীফা হয়ে বসলেন, তখন বায়আত করা ছাড়া জনগণের গতান্তর ছিল না। তখন তাঁর বায়আত না করা হলে তিনি নিজের অর্জিত পদ ত্যাগ করতেন না; বরং এর অর্থ হতো রক্তপাত ও বিশৃংখলা, যাকে শান্তি-শৃংখলার ওপর অগ্রাধিকার দেয়া যায় না। এ জন্যই ইমাম হাসান (রাঃ) খেলাফত ত্যাগের (রবিউল আউয়াল-৪১ হিজরী) পর সমস্ত সাহাবী তাবেয়ী এবং উম্মাতের সদাচারী ব্যক্তিবর্গ তাঁর বায়আতের ওপর একমত হয়েছিলেন। তাঁরা একে ‘আমুল জামাআত’ বা দলের বছর বলে অভিহিত করেন। কারণ এর ফলে অন্তত গৃহযুদ্ধের তো অবসান ঘটেছে। হযরত মুআবিয়া (রাঃ) নিজেও তাঁর এ অবস্থা সম্পর্কে ভালোভাবে অবহিত ছিলেন। খেলাফতের সূচনাকালে একবার মদীনায় ভাষণদান প্রসঙ্গে তিনি নিজে বলেছিলেনঃ
*************
– আল্লার কসম করে বলছি, তোমাদের সরকারের দায়িত্ব গ্রহণকালে আমি এ বিষয়ে অনবহিত ছিলাম না যে, আমার ক্ষমতায় আসীন হওয়ায় তোমরা সন্তুষ্ট নও, তোমরা তো পসন্দ করো না। এ বিষয় তোমাদের মনে যা কিছু আছে, আমি তা ভালো করেই জানি। কিন্তু আমার এ তরবারী দ্বারা তোমাদেরকে পরাভূত করেই আমি তা অধিকার করেছি।
………….এখন তোমরা যদি দেখ, আমি তোমাদের হক পুরোপুরী আদায় করছি না, তাহলে সামান্য নিয়েই আমার ওপর সন্তুষ্ট থাকবে। [আল-বেদায়া ওয়ান নেহায়া, ইবনে কাসীর, ৮ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ১৩২।]
এভাবে যে পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল, ইয়াযীদের স্থলাভিষিক্তের পর তা এমন সুদৃঢ় হয়েছিল যে, বর্তমান শতকে মোস্তফা কামাল কর্তৃক খেলাফতের অবসান ঘটান পর্যন্ত একদিনের জন্যও যা নড়বড়ে হয়নি। এ থেকে বাধ্যতামূলক বায়আত এবং বংশধরদের উত্তরাধিকার সূত্রে বাদশাহী লাভের এক স্বতন্ত্র ধারা শুরু হয়। এরপর থেকে আজ পর্যন্ত নির্বাচনভিত্তিক খেলাফতের দিকে প্রত্যাবর্তন মুসলমানদের ভাগ্যে জুটেনি। মুসলমানদের স্বাধীন এবং অবাধ পরামর্শক্রমে নয়, বরং শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে লোকেরা ক্ষমতাসীন হয়েছে। বায়আতের সাহায্যে ক্ষমতা লাভের পরিবর্তে ক্ষমতার সাহায্যে বায়আত হাসিল শুরু হয়। বায়আত করা না করার ব্যাপারে মুসলমানরা স্বাধীন থাকেনি। কিন্তু জনগণের বায়আত না করার অর্থ এ নয় যে, এর ফলে ক্ষমতাসীনের হাত থেকে ক্ষমতা অন্যত্র চলে যাবে।
মুসলমানদের স্বাধীন পরামর্শ ব্যতীত বাহুবলে যে খেলাফত বা কতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, আইনের দৃষ্টিতে তা সিদ্ধ কিনা-এখানে সে প্রশ্ন সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক। আসল প্রশ্ন হচ্ছে, ইসলামে খেলাফত প্রতিষ্ঠার সঠিক পন্থা কি? যে পন্থায় খোলাফায়ে রাশেদীন খলীফা হয়েছেন, না যে পন্থায় হযরত মুআবিয়া (রাঃ) এবং তৎপরবর্তীগণ খলীফা হয়েছেন? কোন কাজ করার জন্য ইসলাম আমাদেরকে একটি পন্থা গ্রহণ করার নির্দেশ দিয়েছে। দ্বিতীয় কোন পন্থায় কোন কাজ করা হলে কেবল এ জন্যই ইসলাম আমাদেরকে তা বরদাস্ত করার শিক্ষা দিয়েছে যে, তা পরিবর্তন এবং মুলোৎপাটনের চেষ্টা তার চেয়েও মারাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। এ দুটো বিষয়কে একই সমতলে রেখে যদি দাবী করা হয় যে, দুটো পন্থাই ইসলামে সমান বৈধ, তাহলে বিরাট অবিচার করা হবে। প্রথম পন্থাটি কেবল বৈধই নয়, বরং ঈপ্সিতও বটে, দ্বিতীয়টি বৈধ হলেও সহ্যের সীমা পর্যন্ত পসন্দনীয়, ঈপ্সিত হিসেবে নয়।
দুইঃ খলীফাদের জীবনধারায় পরিবর্তন
দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ছিল এই যে, রাজতন্ত্রের সূচনালগ্ন থেকেই বাদশাবেশধারী খলীফারা কায়সার ও কেসরার অনুরূপ জীবনধারা অবলম্বন করে। মহানবী (সঃ) এবং চারজন খোলাফায়ে রাশেদীন যে জীবনধারা অবলম্বন করেছিলেন, তারা তা পরিহার করে। তারা শাহী মহলে বসবাস শুরু করে। রাজকীয় দেহরক্ষী বাহিনী ,,,,, তাদের রাপ্রাসাদের হেফাযতে নিয়োজিত হয় এবং সর্বদা তাদের পাহারায় নিযুক্ত থাকে। তাদের এবং জনগণের মধ্যে দেহরক্ষী ও প্রহরী অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।সরাসরি তাদের কাছে প্রজাদের পৌঁছা এবং প্রজাদের মধ্যে তাদের নিজেদের বসবাস ও চলাফেরা বন্ধ হয়ে যায়। প্রজাদের অবস্থা জানার জন্য তারা অধীনস্থ কর্মকর্তাদের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়ে। কর্মচারীদের মাধ্যমে কোন সরকার কখনো সঠিক অবস্থা জানতে পারে না। আর মাধ্যম ছাড়া সরাসরি নিজেদের প্রয়োজন এবং অভিযোগ পেশ করা প্রজাদের পক্ষেও সম্ভব নয়। খোলাফায়ে রাশেদীন যে ধারায় শাসন কার্য পরিচালনা করতেন, এটা ছিল তার সম্পূর্ণ বিপরীত- একেবারেই তার পরিপন্থী। তাঁরা জনগণের মধ্যে বাস করতেন। সেখানে যে কোন ব্যক্তি স্বাধীনভাবে তাঁদের সাথে সাক্ষাৎ করতে পারতো। তাঁরা হাট-বাজারে গমন করতেন এবং যে কোন ব্যক্তি তাঁদের সাথে কথা বলতে পারতো। তাঁরা জনগণের সাথে সারিবদ্ধ হয়ে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করতেন এবং জুমার খোতবায় (অভিভাষণে) আল্লার যিকর এবং দ্বীনের শিক্ষার পাশাপাশি সরকারের নীতি সম্পর্কেও জনগণকে অবহিত করতেন। তাঁদের নিজেদের এবং সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের যে কোন অভিযোগের জবাব দিতেন তাঁরা। হযরত আলী (রাঃ) প্রাণের আশংকা সত্ত্বেও মুহুর্ত পর্যন্ত কুফায় এ নিয়ম বজায় রেখেছিলেন। কিন্তু রাজতন্ত্রের সূচনা পর্ব থেকেই এ পন্থা ত্যাগ করে রোম-ইরানের মডেল গ্রহণ করা হয়। এ পরিবর্তনৈর সূচনা হয় হযরত মুআবিয়া (রাঃ)-এর শাসনকাল থেকেই। পরে এ ধারা রীতিমতো এগিয়ে চলতে থাকে।
তিনঃ বায়তুল মালের অবস্থার পরিবর্তন
তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সূচীত হয় বায়তুল মালের ব্যাপারে খলীফাদের কর্মধারায়।
বায়তুল মাল সম্পর্কিত ইসলামী নীতি এই ছিল যে, তা খলীফা এবং তাঁর সরকারের নিকট আল্লাহ এবং জনগণের আমানত। একে কারো মর্জীমতো ব্যবহারের অধিকার নেই। খলীফা বে-আইনীভাবে তাতে কিছু জমা করতে পারেন না, পারেন না তা থেকে বে-আইনীভাবে কিছু ব্যয়ও করতে। এক একটি পাই পয়সার আয়-ব্যয়ের জন্য তাঁকে জবাবদিহি করতে হয়। মাঝারী ধরনের জবিন যাপনের জন্য যতটুকু প্রয়োজন, কেবল ততটুকু গ্রহণ করার অধিকার আছে তার।
রাজতন্ত্রের বায়তুল মালের এ নীতি পরিবর্তীত হয়ে যায় এবং বায়তুল মাল বাদশা ও শাহী বংশের মালিকাধীন হয়ে পড়ে। প্রজারা পরিণত হয় বাদশার নিছক করদাতায়। সরকারের নিকট হিসেব চাওয়ার কারো অধিকারই থাকে না। এ সময় বাদশাহ এবং শাহজাদাদের এমনকি তাদের গভর্ণর এবং সিপাহসালাদের (সেনাপতিদের) জীবন যে শান-শওকতের সাথে নির্বাহ হয়ে থাকে, তা বায়তুল মালকে অন্যঅয়ভাবে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করা ছাড়া কিছুতেই সম্ভব নয়। হযরত ওমন ইবনে আব্দুল আযীয (রঃ) তাঁর শাসনামলে শাহজাদা এবং আমীর-ওমরাদের অবৈধ সম্পত্তির হিসাব নিতে থাকেন। এসময় তিনি পিতা আব্দুল আযীয ইবনে মারওয়ানের নিকট থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত নিজের বাৎসরিক ৪০ হাযার দিনার আয়ের সম্পত্তিও বায়তুল মালে ফেরত দেন। এ সম্পত্তির মধ্যে ফাদাক বাগানও অন্তর্ভূক্ত ছিল, যা মহানবী (সাঃ)-এর পরে সকল খলীফার শাসনামলে বায়তুল মালের অধিকারে ছিল। হযরত আবুবকর (রাঃ) তা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মীরাস হিসেবে তাঁর কন্যাকে দিতেও অস্বীকার করেছিলেন। কিন্তু মারওয়ান ইবনুল হাকাম তাঁর শাসনামলে এ সম্পত্তি নিজের মালিকানায় এবং তদীয় বংশধরদের মীরাসে পরিণত করেন। [ইবনুল আসীর, ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা-১৬৪; আল-বেদায়া, ৯ম খন্ড, পৃষ্ঠা-২০০-২০৮।]
এ হচ্ছে বায়তুল মাল থেকে ব্যয়ের ব্যাপারে তাদের নিত। এবার বায়তুল মালের আয়ের বিষয়টি লক্ষ্য করলে দেখা যায়, এ ব্যাপারেও তাঁদের কাছে হালাল-হারামের কোন তারতম্য ছিল না। হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আযীযের পূর্বসূরী উমাইয়া শাসকরা প্রজাদের নিকট থেকে যে সকল অবৈধ ট্যাক্স আদায় করেছিল, তিনি এক ফরমানে সে সবের একটি ফিরিস্তি দিয়েছিলেন। [আত-তাবারী, ৫ম খন্ড, পৃষ্ঠা-৩২১, ইবনুল আসীর, ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা-১৬৩।] বায়তুল মালের আয়ের ক্ষেত্রে তারা শরীয়তের বিধান কিভাবে লংঘন করে চলছিল, উক্ত তালিকা পাঠে তা অনুমান করা যায়।
এ ব্যাপারে যে বৃহত্তম যুলুমটির সন্ধান পাওয়া গেছে তা হচ্ছে এই যে, যেসব অমুসলিম ইসলাম গ্রহণ করতো, তারা নিছক জিযিয়া থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যই ইসলাম গ্রহণ করেছে-এ অজুহাতে তাদের ওপর জিজিয়া আরোপ করা হতো। অথচ এ জিযিয়া আরোপের আসল কারণটি ছিল এই যে, ইসলাম বিস্তারের ফলে তারা বায়তুল মালের আয় হ্রাস পাওয়ার আসংকা করতো। ইবনুল আসীর বর্ণনা করেছেন, হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ (ইরাকের ভাইসরয়)-কে তাঁর গভর্ণররা লিখলেনঃ ‘জিম্মীরা বিপুল সঙখ্যায় ইসলাম গ্রহণ করে বসরা এবং কুফায় বসতি স্থাপন করছে। এর ফলে জিযিয়া এবং খারাজের আমদানী হ্রাস পাচ্ছে।’ জবাবে হাজ্জ্জ ফরমান জারী করলেনঃ “তাদেরকে শহর থেকে বহিষ্কার করা হোক এবং পূর্ববৎ তাদের ওপর জিযিয়া আরোপ করা হোক।” নির্দেশ অনুযায়ী তাদেরকে বসরা ও কুফা থেকে বহিষ্কার করার সময় যখন তারা ‘হে মুহাম্মদ ! হে মুহাম্মদ !’ বলে চিৎকার করে কাঁদছিল তখন সমগ্র এলাকায় যে করুণ দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল, তা বর্ণনা করা রীতিমত দুঃসাধ্য ব্যাপার। তারা বুঝতে পারছিল না কোথায় গিয়ে তারা এ যুলুমের বিরুদ্ধে ফরিয়াদ জানাবে। কুফা ও বসরার আলেম ও ফকীহগণ এ অবস্থা দেখে চিৎকার করে উঠলেন এবং নওমুসলিমরা যখন কাঁদতে কাঁদতে শহর ত্যাগ করছিল, তখন আলেম-ফকীহরাও তাদের ক্রন্দনে শরীক হচ্ছিলেন। [ইবনুল আসীর, ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা-৭৯।] হযরত ওমর ইবনে আবদুল আযীয খলীফা হলে খোরাসানের একটি প্রতিনিধিদল তাঁর নিকট উপস্থিত হয়ে অভিযোগ করে যে, ইসলাম গ্রহণকারী হাযার হাযার লোকের ওপর জিযিয়া আরোপ করা হয়েছে। ওদিকে গভর্ণরের গোত্র ও জাতি বিদ্বেষ এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, তিনি প্রকাশ্যে বলে বেড়াচ্ছেন, “আমার স্বজাতির একজন লোক অন্য একশ ব্যক্তির চেয়ে ও আমার নিকট প্রিয়।” এ অভিযোগের ভিত্তিতে তিনি আল-জাররাহ ইবনে আব্দুল্লাহ আল-হাকামীকে খোরাসানের গভর্ণরের পদ থেকে বরখাস্ত করেন। তিনি তাঁর ফরমানে লিখেনঃ “আল্লাহ তাআলা মুহাম্মদ (সাঃ)-কে আহবানকারী হিসেবে পাঠিয়েছিলেন-তহশীলদার হিসেবে নয়।” [আত-তাবরী, ৫ম খন্ড, পৃষ্ঠা-৩১৪। ইবনুল আসীর, ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা-১৫৮। আল বেয়াদা, ৯ম খন্ড, পৃষ্ঠা-১৮৮।]
চারঃ মতামত ব্যক্ত করার স্বাধীনতার অবসান
এ যুগের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ছিল, মুসলমানদের আমর বিল মা’রুফ ও সাহই আনিল মুনকার-ভাল কাজের নির্দেশ দান এবং অন্যায় কাজ থেকে বারণ করার স্বাধীনতা হরণ। অথচ ইসলাম এটাকে কেবল মুসলমানদের অধিকারই নয়, বরং ফরয বা কর্তব্য বলে স্থির করে দিয়েছেন। জাতির সচেতন বিবেক জনগণের বাক-স্বাধীনতা, যে কোন অন্যায় কাজে সর্বোচ্চ আসনে সমাসীন ব্যক্তির সমালোচনা এবং প্রকাশ্যে সত্য কথা বলার স্বাধীনতার ওপরই ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রের সঠিক পথে পরিচালিত হওয়া নির্ভরশীল ছিল। খেলাফতে রাশেদার আমলে জনগণের এ স্বাধীনতা সম্পূর্ণ সংরক্ষিত ছিল। খোলাফায়ে রাশেদীন এ জন্য শুধু অনুমতিই দিতেন না, বরং এ জন্য জনগণকে উৎসাহিতও করতেন। তাঁদের শাসনামলে সত্যভাষীর কণ্ঠরোধ করা হতো না, বরং এ জন্য তাঁরা প্রশংসা এবং অভিনন্দন লাভ করতেন। সমালোচকদেরকে দাবিয়ে রাখা হতো না, তাদেরকে যুক্তিসঙ্গত জবাব দিয়ে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করা হতো। কিন্তু রাজতন্ত্রের যুগে বিবেকের ওপর তালা লাগান হয়, মুখ বন্ধ করে দেয়া হয়। প্রশংসার জন্য মুখ খোল অন্যথায় চুপ থাকো – এটাই তখন রীতিতে পরিণত হয়। যদি তোমার বিবেক এতই শক্তিশালী হয় যে, সত্য ভাষণ থেকে তুমি নিবৃত্ত থাকতে না পারো তাহলে কারাবরণ, প্রাণদন্ড ও চাবুকের আঘাতের জন্য প্রস্তুত হও। তাই সে সময়ে যারা সত্য ভাষণ এবং অন্যায় কাজে বাধা দান থেকে নিবৃত্ত হননি, তাদেরকে কঠোরতম শাস্তি দেয়া হয়েছে। সমগ্র জাতিকে আতঙ্কিত করাই ছিল এর লক্ষ।
হযরত মুআ’বিয়া (রাঃ)-এর শাসনামলে আল্লার রাসূলের সাহাবী একজন সাধক ও ইবাদতগুযার এবং উম্মাতের সৎ ব্যক্তিদের মধ্যে বিশিষ্ট মর্যাদার অধিকারী হযরত হুজর ইবনে আদীর হত্যার (৫১ হিজরী) মাধ্যমে এ নতুন পলিসীর সূচনা হয়। হযরত মুআ’বিয়া (রাঃ)-এর শাসনামলে খোতবায় প্রকাশ্য মিম্বারে হযরত আলী (রাঃ)-এর লানত (অভিসম্পাত) এবং গালিগালাযের সিলসিলা শুরু হলে সকল সাধারণ মুসলমানের হৃদয় ব্যথিত হয়ে ওঠে। কিন্তু অতি কষ্ঠে সবরের পেয়ালা পান করে তারা চুপ করে থাকতেন। কুফায় হুজর ইবনে আদী তা সহ্য করতে পারেননি। তিনি হযরত আলী (রাঃ)-এর প্রশংসা এবং হযরত মুআ’বিয়া (রাঃ)-এর নিন্দা শুরু করেন। হযরত মুগীর (রাঃ) যতদিন কুফার গভর্ণর ছিলেন, ততদিন তিনি ব্যাপারটি এড়িয়ে গেলেন। কিন্তু পরে বসরার সাথে কুফাকেও যিয়াদের গভর্ণরীর অন্তর্ভৃক্ত করা হলে তাঁদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। যিয়াদ খোতবায় হযরত আলী (রাঃ)-কে গালি দিতেন, আর হুজর (রাঃ) দাঁড়িয়ে তার জবাব দিতেন। এ সময় তিনি একবার জামার সালাতে বিলম্বের জন্যও যিয়াদের সমালোচনা করেন। অবশেষে যিয়াদ ১২ জন সঙ্গী সহ তাঁকে গ্রেফতার করেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করেনঃ তিনি একটি গুপ্তবাহিনী গঠন করেছেন, খলীফাকে প্রকাশ্যে গালী দেন, আমিরুল মুমিনীনের বিরেুদ্ধে লড়াই এর আহবান জানাচ্ছেন এবং আলী (রাঃ)-এর বংশধর ব্যতীত অন্য কারো জন্য খেলাফত জায়েয নয় বলে দাবী করেছেন। তিনি শহরে বিপর্যয় সৃষ্টি করেছেন এবং আমিরুল মুমিনীনের গভর্ণরকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি আবু তোরাব [হযরত আলী (রাঃ)] কে সমর্থন করেন, তাঁর জন্য রহমত কামনা করেন এবং তাঁর বিরোধীদের থেকে দূরে থাকেন। এ অভিযোগের স্বপক্ষে কতিপয় ব্যক্তির সাক্ষ্যও গ্রহণ করা হয়। কাযী শুরাইহকেও অন্যতম স্বাক্ষী হিসেবে দেখানো হয়। কিন্তু তিনি এক পৃথক পত্রে হযরত মুআ’বিয়া (রাঃ)-কে লিখে পাঠানঃ “আমি শুনতে পেলাম, আপনার নিকট হুজর ইবনে আদীর বিরুদ্ধে যেসব স্বাক্ষ্য পেশ করা হয়েছে, আমার নামও তাতে অন্তর্ভূক্ত রয়েছে। তাঁর সম্পর্কে আমার সত্যিকার সাক্ষ্য এই যে, যারা সালাত কায়েম করে, যাকাত আদায় করে, নিয়মিত হজ্জ ও ওমরাহ করে, ভাল কাজের নির্দেশ দান করে, অন্যায় কার্য থেকে বারণ করে, তিনি তাদের অন্তর্ভূক্ত। তাঁর রক্ত ও সম্পদ সম্মানার্হ-হারাম। আপনি ইচ্ছা করলে তাঁকে হত্যা করতে পারেন অথবা ক্ষমা করে দিতে পারেন।”
এমনিভাবে এ অভিযুক্তকে হযরত মুআ’বিয়া (রাঃ) -এর নিকট প্রেরণ করা হয়। তিনি তাকেঁ হত্য করার নির্দেশ দেন। হত্যার পূর্বে জল্লাদরা তাঁর সামনে যে কথাটি পেশ করে তা হচ্ছে, তুমি আলীর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে তাঁর ওপর অভিসম্পাত বর্ষণ করলে তোমাকে মুক্তি দান, অন্যথায় হত্যা করার জন্য আমাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তিনি তা করতে অসম্মতি জানিয়ে বলেন- “আমি মুখে এমন কথা উচ্চরণ করতে পারি না, যা আমার রবকে অসন্তুষ্ট করে।” অবশেষে ৭ জন সঙ্গী সহ তাকেঁ হত্যা করা হয়। এদের মধ্যে আব্দুর রহমান ইবনে হাসসানকে হযরত মুআ’বিয়া (রাঃ) যিয়াদের নিকট ফেরত পাঠান। তিনি যিয়াদকে লিখেন, একে নৃশংসভাবে হত্যা করো। যিয়াদ তাঁকে জীবন্ত পুঁতে ফেলেন। [এ ঘটনার বিস্তারিত বিবরণের জন্য তাবারী, ৪র্থ খন্ড, ১৯০-২০৭ পৃষ্ঠা, আল-ইস্তীআব, ১ম খন্ড, ১৩৫ পৃষ্ঠা। ইবনুল আসীর, ৩য় খন্ড, ২৩৪-২৪২ পৃষ্ঠা। আল-বেদায়া ওয়ান নেহায়া, ৮ম খন্ড, ৫০-৫৫ পৃষ্ঠা এবং ইবনে খালদুন, ৩য় খন্য, ১৩ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।]
এ ঘটনা উম্মাতের সকল সাধু সজ্জনের হৃদয়ে নাড়া দেয়। হযরত আব্দুল্লা ইবনে ওমর এবং আয়েশা (রাঃ) এ খবর শুনে ব্যথিত হন। হযরত আয়েশা (রাঃ) হযরত মুআ’বিয়া (রাঃ)-কে এ কাজ থেকে নিবৃত্ত করার জন্য আগেই চিঠি লিখেছিলেন। পরে হযরত মুই’বিয়া (রাঃ) একবার তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে এল তিনি বলেনঃ “মুআ’বিয়া! হুজরকে হত্যা করতে গিয়ে তুমি আল্লাকে এতটুকুও ভয় করলে না?” হযরত মুই’বিয়া (রাঃ)-এর পক্ষ থেকে খোরাসানে নিযুক্ত গভর্ণর রবী ইবনে যিয়াদ আল-হারেসী এ খবর শুনে চিৎকার করে ওঠেনঃ “হে আল্লাহ! তোমার জ্ঞান অনুযায়ী আমার মধ্যে যদি সামান্য পরিমাণ সৎকর্মশীলতাও অবশিষ্ট থাকে, তা হলে আমাকে দুনিয়া থেকে তুলে নাও। [আল-ইস্তীআব, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা-১৩৫। তাবরী, ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা ২০৮।] হযরত হাসান বসরী (রাঃ) বলেনঃ হযরত মুআ’বিয়া (রাঃ)-এর চারটি কাজ এমন যে, কেউ তন্মধ্যে একটি কাজ করলেও তা হবে তার জন্য ক্ষতিকর। একঃ মুসলিম উম্মাতের বিরুদ্ধে তরবারী ধারণ এবং পরামর্শ ব্যতীত শাসন ক্ষমতা অদিকার করা। অথচ উম্মাতের মধ্যে অবশিষ্ট সাহাবীরা বর্তমান ছিলেন। দুইঃ আপন পুত্রকে স্থলাভিষিক্ত করা। অথচ সে ছিল মদ্যপ এবং নেশাখোর; সে রেশমী বস্ত্র পরিধান করতো এবং তাম্বুরা বাজাত। তিনঃ যিয়াদকে আপন পরিবারভূক্ত করা; অথচ আল্লার রাসূলের স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে যে, শিশু তার, যার শয্যায় সে জন্মগ্রহণ করবে, আর ব্যভিচারীর জন্য রয়েছে পাথর-কংকর। [পরে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।] চারঃ হুজর এবং তাঁর সাথীদের হত্যা কর। [ইবনুল আসীর, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা-২৪২। আল-বেদায়া, ৮ম খন্ড, পৃষ্ঠা-১৩০।]
এরপর থেকে যুলুম-নিপীড়নের মাধ্যমে জনগণের কণ্ঠ স্তব্দ করার ধারা বৃদ্ধি পেতে থাকে। মারওয়ান ইবনুল হাকাম মদীনার গভর্ণর থাকাকালে হযরত মেসওয়ার ইবনে মাখরামা (রাঃ) তার এক কথার জবাবে “আপনি অন্যায় কথা বলেছেন” -এ বাক্য উচ্চরণ করায় তাকেঁ লাথি মারেন। [আল-আস্তীআব, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা-৩৫৩।] হযরত আবদুল্লা ইবনে ওমর হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফকে খোতবা দীর্ঘ করা এবং জুমার সালাতে অস্বাবিক বিলম্ব করার জন্য সমালোচনা করলে তিনি বলেনঃ “আমার মন চায়, যে মাথায় তোমার চক্ষুদ্বয় রয়েছে তাতে আঘাত করি। [আল-ইস্তীআব, পৃষ্ঠা-৩৬৯। তারাকাতে ইবনে সাআ’দ, ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা-১৮৪।] আব্দুল মালেক ইবনে মারওয়ান হিজরী ৭৫ সালে মদীনা গমন করলে আল্লার মিম্বরে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেনঃ
“তরবারী ব্যতীত অন্য কিছু দিয়ে আমি এ উম্মাতের ব্যাধির চিকিৎসা করবো না। …. এখন কেউ যদি আমাকে বলে, আল্লাকে ভয় করো, তাহলে তার মস্তক দ্বিখন্ডিত করবো। [ইবনুল আসীর, ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা-৪১-১০৪। আল-জাসসাসঃ আহকামুল কুরআন, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা-৮২। ফওয়াতুল ওয়াফাইয়াত, মুহাম্মাদ ইবনে শাকের আল-কুতাবী, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা-৩৩, সাআদাত প্রেস, মিশর।]
ওয়ালীদ ইবনে আবদুর মালেক একবার জুমার খোতবা এতটা দীর্ঘ করেন, যার ফলে সালাতের সময়ই শেষ হওয়ার উপক্রম হয়। জনৈক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বললোঃ “ইমরুল মুমিনীন! সময় আপনার জন্য অপেক্ষা করবে না, আর সালাত এত বিলম্ব করার জন্য আপনি আল্লার সামনে কৈফিয়ত পেশ করতে পারবেন না” ওয়ালিদ জবাবে বলেনঃ “বটে, তুমি ঠিকই বলেছো; কিন্তু তুমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছো, সেটা এহেন স্পষ্টভাষীর স্থান নয়।” রাজকীয় দেহরক্ষী তৎক্ষণাত তাকে হত্যা করে জান্নাতে পাঠাবার ব্যবস্থা করে। [ইবনু আবদে রাব্বিহ আল-ইকদুল ফরীদ, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা-৬২, কায়রো-১৯৪০।]
এ নীতি মুসলমানদেরকে ধীরে ধীরে ভীরু এবং সুবিধাবাদী করে তোলে। বিপদ মাথায় পেতে নিয়ে সত্য কথা বলার লোক হ্রাস পেতে থাকে। তোষামোদ এবং বিবেক বিক্রয়ের মূল্য বাজারে বৃদ্ধি পায় এবং সত্যপ্রীতি ও ন্যায়নীতির মূল্য হ্রাস পেতে থাকে। উচ্চ যোগ্যতাসম্পন্ন, ঈমানদার এবং বিবেকবান ব্যক্তিরা সরকার থেকে দূরে সরে দাঁড়ায়। জনণের জন্য দেশ এবং দেশের কাজ কারবারে কোন প্রকার আকর্ষণই আর থাকে না। এক সরকার আসে, আর এক সরকার যায়, কিন্তু জনগণ কেবল এ গমনাগমনের রঙ্গমঞ্চে দর্শকে পরিণত হয়। এ নীতি জনগণের মধ্যে যে চরিত্র সৃষ্টি করতে থাকে, হযরত আলী ইবনে হুসাইনের (ইমাম যয়নুল আবেদীন) সাথে সংঘটিত একটি ঘটনাই তার প্রমাণ। তিনি বলেনঃ কারবালার শোকাবহ ঘটনার পর কোন ব্যক্তি গোপনে আমাকে তাঁর গৃহে নিয়ে যান, তিনি আমাকে অত্যান্ত আদর আপ্যায়ন করেন। তাঁর অবস্থা ছিল এই যে, তিনি আমাকে দেখে সর্বদা কাঁদতেন আর আমি মনে করতাম আমার জন্য একমাত্র এ ব্যক্তির অন্তরে বিশ্বস্ততা আছে। ইতিমধ্যে ওবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদের ঘোষণা শোনা যায়ঃ “আলী ইবনে হুসাইনকে যে কেউ আমাদের কাছে পাকড়াও করে আনবে, তাকে তিনশ দিরহাম এনাম দেয়া হবে।” এ ঘোষণা শুনেই সে ব্যক্তি আমার কাছে আসে। সে আমার হাত বাঁধছিল আর দরবিগলিত ধারায় কেঁদে চলছিল। এ অবস্থায় সে আমাকে ইবনে যিয়াদের হাতে সোপর্দ করে এনাম গ্রহণ করে। [তাবাকাতে ইবনে সাআদ, ৫ম খন্ড, পৃষ্ঠা-২১২।]
পাঁচঃ বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অবসান
ইসলামী রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতি ছিল বিচার বিভাগের স্বাধীনতা। খেলাফতে রাশেদায় খলীফারাই বিচারপতি (কাযী) নিয়োগ করলেও আল্লার ভয় এবং নিজের জ্ঞান ও বিবেক ব্যতীত অন্য কিছুরই চাপ এবং প্রভাব খাটাতো না তাঁর ওপর। কোন শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিই আদালতের কাজে হস্তক্ষেপের সাহস করতে পারতো না। এমনকি, কাযী স্বয়ং খলীফার বিরুদ্ধে রায় দিতে পারতেন এবং দিতেনও। কিন্তু রাজতন্ত্রের আগমনে অবশেষে এ নীতিরও অবসান ঘটতে থাকে। যেসব ব্যাপারে এ বাদশাহ প্যাটার্ণের খলীফাদের রাজনৈতিক এবং ব্যক্তিগত স্বার্থ জড়িত ছিল, সেসব ব্যাপারে সুবিচার করার ক্ষেত্রে আদালতের স্বাধীনতা হরণ করা হয়। এমনকি শাহযাদা, গভর্ণর, নেতা-কর্তা ব্যক্তি এবং রাজমহলের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলায় সুবিচার করাও অসম্ভব হয়ে পড়ে। সে সময়ের সত্যাশ্রয়ী আলেমদের সাধারণত বিচারকের আসন গ্রহণে রাযী না হওয়ার এটাই ছিল অন্যতম প্রধান কারণ আর যেসব আলেম এ শাসকদের পক্ষ থেকে বিচারকের আসন গ্রহণ করতে রাযী হতেন, জনগণ তাদেরকে সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করে। বিচার বিভাগের ওপর শাসন বিভাগের হস্তক্ষেপ এতটা বৃদ্ধি পায় যে, বিচারপতিদের নিয়োগ এবং বরখাস্তের ইখতিয়ার দেয়া হয় গভর্ণরদেরকে। [আস-সুয়ুতীঃ হুসনুল মুহাযারা, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা-৮৮। আল-মাতবায়াতুশ শারকিয়া, মিশর, ১৩২৭ হিজরী।] অথচ খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলে খলীফা ছাড়া কারোর এ অধিকার ছিল না।
ছয়ঃ শূরাভিত্তিক সরকারের অবসান
ইসলামী রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতি ছিল, রাষ্ট্র শাসিত হবে পরামর্শের ভিত্তিতে আর পরামর্শ নেয়া হবে এমন সব লোকের, যাদের তত্ত্ব জ্ঞান, তাকওয়া, বিশ্বস্ততদা এবং নির্ভুল ও ন্যায়নিষ্ঠ মতামতের ওপর জনগণের আস্থা রয়েছে। খোলাফায়ে রাশেদীনের শাসনামলে জাতির শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তিরা তাঁদের পরামর্শদাতা ছিলেন। তাঁরা ছিলেন পরিপূর্ণ দ্বীনী জ্ঞানের অধিকারী। নিজেদের জ্ঞান এবং বিবেক অনুযায়ী পূর্ণ স্বাধীনতার সাথে তাঁরা নিরপেক্ষ মতামত ব্যক্ত করতেন। তাঁরা কখনো সরকারকে ভুল পথে পরিচালিত হতে দেবেন না- গোটা জাতির এ ব্যাপারে পূর্ণ আস্থা ছিল। এদেরকেই স্বীকার করা হতো সমগ্র মুসলিম উম্মাতের দায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসেবে। কিন্তু রাজতন্ত্রের আগমনে এ নীতিরও পরিবর্তন সাধিত হয়। ব্যক্তি একনায়কত্ব শূরার স্থান ধিকার করে। বাদশাহরা সত্যসন্ধ ও নির্ভিক-কন্ঠ জ্ঞানীদের কাছ থেকে সরে দাঁড়ায়। আর জ্ঞানীরাও তাদের কাছ থেকে সরে আনে। এভাবে জনগণের আস্থা ছিল। তাদের পরিবর্তে গভর্ণর, সেনাপতি, রাজবংশীয় আমীর-ওমরাহ ও দরবারের সভাসদগণই ছিল বাদশাহের পরামর্শদাতা।
এর ফলে যে বৃহত্তম ক্ষতি সাধিত হয় তা হচ্ছে এই যে, একটি ক্রমবর্ধমান তামাদ্দুনে যে সকল শাসনতান্ত্রিক সমস্যা দেখা দেয়, সে সবের ব্যাপারে পরামর্শ দেয়ার মতো কোন ক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানই আর অবশিষ্ট থাকলো না। থাকলো না এমন কোন সংস্থা, যার সম্মিলিত বা সর্বসম্মত ফায়সালা ইসলামী আইনের অংশ হতে পারে এবং দেশের সমস্ত ফায়সালা অনুযায়ী সমস্যার নিষ্পত্তি করতে পারে। রাষ্ট্রের নিয়ম-শৃংখলা, গুরুত্বপূর্ণ আভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক সমস্যা ও সাধারণ নিয়ম-নীতির ব্রাপারে সকল রাজকীয় কাউন্সিল ভাল-মন্দ ফায়সালা করলেও শাসনতান্ত্রিক সমস্যাবলির সমাধান করা তাদের সাধ্যায়ত্ব ছিল না। তারা এ সকল সমস্যা সমাধানের সাহস করলেও উম্মাতের সম্মিলিত বিবেক তা আস্তস্থ ছিল না। নিজেদের মর্যাদা সম্পর্কে তারা নিজেরাও অবহিত ছিল, আর উম্মাতও তাদেরকে ফাসেক ফাজের মনে করতো। তাদের এমন কোন ধর্মীয় এবং নৈতিক মর্যাদা ছিল না, যাতে তাদের ফায়সালা ইসলামী আইনের অন্তর্ভূক্ত হতে পারে। আলেম ও ফকীহগণ এ র্শন্যতা পূরণের চেষ্টায় ত্রুটি করেননি, কিন্তু তাঁদের এ চেষ্টা ছিল ব্যক্তিগত পর্যায়ের। আলেমগণ তাঁদের দরস ও ফতোয়ার মাধ্যমে শাসনতান্ত্রিক বিধান ব্যক্ত করতেন, আর বিচারকগণ তাঁদের জ্ঞান-বুদ্ধি ও ইজতিহাদ অনুযায়ী অথবা অন্য কোন আলেমের যেসব ফতোয়াকে আইন মনে করতেন, সেগুলো অনুযায়ী ফায়সালা করতেন। এর ফলে আইনের ধারাবাহিকতা এবং ক্রমবিকাশে শূন্যতা দেখা দেয়নি, কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্রে আইনগত অরাজকতা দেখা দেয়। গোটা এক শতাব্দী কাল উম্মাতের নিকট এমন কোন নীতিমালা ছিল না, যাকে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করে দেশের সকল আদালত সেই অনুযায়ী খুঁটি-নাটি ব্যঅপারে একই ধরনের ফায়সালা করতে পারে।
সাতঃ বংশীয় এবং জাতীয় ভাবধারার উদ্ভব
রাজতন্ত্রের যুগে অপর যে বিরাট পরিবর্তন সূচীত হয়, তা ছিল এই যে, ইসলাম জাহেলী যুগের যেসব জাতি, বংশ-গোত্র ইত্যাদির ভাবধারা নিশ্চিহ্ন করে আল্লার দ্বীন গ্রহণকারী সকল মানুষকে সমান অধিকার দিয়ে এক উম্মাতে পরিণত করেছিল, রাজতন্ত্রের যুগে তা আবার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। বনী উমাইয়া সরকার শুরু থেকেই আরব সরকারের রূপ ধারণ করেছিল, আরব মুসলমানদের সাথে অনারব মুসলমানদের সমান অধিকারের ধারণা এ সময় প্রায় অনুপস্থিত ছিল। ইসলামী বিধানের স্পষ্ট বিরুদ্ধাচারণ করে নওমুসলিমদের ওপর জিযিয়া আরোপ করার কথা আমরা উতিপূর্বেও উল্লেখ করেছি। এর ফলে কেবল ইসলাম বিস্তারের ক্ষেত্রেই মারাত্নক অন্তরায় দেখা দেয়নি; বরং অনারবদের মনে এ ধারণাও দেখা দিয়েছে যে, ইসলামের বিজয় মূলত তাদেরকে আরবদের গোলামে পরিণত করেছে। ইসলাম গ্রহণ করেও তারা এখন আর আরবদের সমান হতে পারে না। কেবল এখানেই সীমাবদ্ধ ছিল না এ আচরণ। শাসনকর্তা, বিচারপতি এমনকি সালাতের ইমাম নিযুক্ত করার বেলায়ও দেখা হতো, সে আরব, না অনারব। কুফায় হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফের নির্দেশ ছিল, কোন অনারবকে যেন সালাতে ইমমি না করা হয়। [আল-ইকদুল ফরীদ, ২য় খন্ড, ২৩৩ পৃষ্ঠা।] হযরত সাঈদ ইবনে জুবায়ের গ্রেফতার হয়ে এলে হাজ্জাজ তাকে খোঁটা দিয়ে বলেন, আমি তোমাকে সালাতের ঈমাম নিযুক্ত করেছি অথচ এখানে আরব ছাড়া কেউ ইমামতী করতে পারে না। [ইবনে খাল্লেকান ওয়াফাইয়াতুল আইয়াম, ২য় খন্ড, ১১৫ পৃষ্ঠা, কায়রো, ১৯৪৮।] ইরাকে নিবতীদের হাতে মোহর লাগানো হয়। বসরা থেকে বিপুল সংখ্যক অমুসলিমদের বহিষ্কার করা হয়। [আল-ইকদুল ফরীদ, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা-৪১৬-৪১৭।] হযরত সাঈদ ইবনে জুবায়ের এর মতো বিরাট মর্যাদা সম্পন্ন আলেমকে যাঁর পর্যায়ের আলেম তদানিন্তন মুসলিম জাহানে দু’চারজনের বেশী ছিল না, কুফায় বিচারপতি নিযুক্ত করা হলে শহরে গুঞ্জন শুরু হয়, আরব ছাড়া কেউ বিচারপতির যোগ্য হতে পারে না। শেষ পর্যন্ত হযরত আবু মুসা আশআরীর পুত্র আবু বোর্দাকে কাযী নিযুক্ত করা হয়। ইবনে যুবায়েরের সাথে পরামর্শ ব্যতীত কোন ফায়সালা না করার জন্য তাঁকে নির্দেশ দেয়া হয়। [ইবনে খাল্লেকান, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা-১১৫।] এমনকি কোন অনারবকে জানাযার সালাত আদায় করার জন্যবো অগ্রবর্তী করা হতো না, যতক্ষণ একজন আরব শিশুও উপস্থিত থাকতো। [আল-ইকদুল ফরীদ, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা-৪১৩।] কোন ব্যক্তি অনারব নওমুসলিম কন্যাকে বিবাহ করার ইচ্ছা পোষণ করলে কন্যার পিতা বা আত্মীয়-স্বজনের নিকট পয়গাম না পাঠিয়ে পয়গাম পাঠাতে হতো তাদের পৃষ্ঠপোষক আরব খান্দানের নিকট। [েআল-ইকদুল ফরীদ, ৩য় খন্ডম পৃষ্ঠা-৪১৩।] দাসরি ঔরসে জন্মগ্রহণকারীদের জন্র আরবদের মধ্যে হাজীন (ত্রুটিপূর্ণ) বলে একটা পরিভাষার প্রচলন ছিল। উত্তরাধিকারে তার হিসসা আরব স্ত্রীর সন্তানদের সমান হতে পারে না-এ ধারণা জনসাধারণের মধ্যে বিস্তার লাভ করেছিল। [ইবনে কোতায়বা উয়ুনুল আখবার, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা-৬১, মিশর, ১৯২৮।] অথচ শরীয়তের দৃষ্টিতে উভয় ধরনের সন্তানদের অধিকার সমান। আবুল ফারাজ আল-ইসফাহানীর বর্ণনা মতে বনু সুলাইমের এক ব্যক্তি জনৈক নওমুসলিম অনারবের নিকট তার কন্যা বিবাহ দিলে মাহাম্মাদ ইবনে বশীর আল-খারেজ মদনিা গমন করে গভর্ণরের নিকট তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে তিনি তৎক্ষণাৎ স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটান, নওমুসলিমকে বেত্রাঘাতের শাস্তি দেন এবং চুল-দাঁড়ি কামিয়ে তাকে অপদস্ত করেন। [কিতাবুল আগানী, ১৪শ খন্ড, পৃষ্ঠা-১৫০। আল-মাতবায়াতুল মিসরিয়্যা, বোলাক, মিশর, ১২৮৫ হিজরী।]
এ সকল কার্যকলাপের ফলে অনারবদের মধ্যে শুউবী (অনারবী জাতীয়তাবাদ) আন্দোলনের জন্ম হয়। আর এই বদৌলতে খোরাসানে বনী উমাইয়াদের বিরুদ্ধে আব্বাসীয়দের আন্দোলন বিস্তার লাভ করে। অনারবদের মনে আরবদের বিরুদ্ধে যে ঘৃণা-বিতৃষ্ণার সৃষ্টি হয়, আব্বাসীয়দের প্রচারকরা তাকে আরবদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে। আর এ আশায় তারা আন্দোলনে আব্বাসীয়দের সাথে যোগ দিয়েছিলেন যে, তাদের মাধ্যমে বিপ্লব সাধিত হলে তারা আরবদের দাপট খর্ব করতে সক্ষম হবে।
বনী উমাইয়াদের এ নীতি কেবল আরব-আজমদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না বরং আরবদের মধ্যেও তা কঠোর গোত্রবাদ সৃষ্টি করে। আদনানী ও কাহতানী, ইয়ামানী ও মুযারী, আযদ ও তামীম, কালব ও কায়েসের মধ্যেকার সকল পুরাতন ঝগড়া নতুন করে সৃষ্টি হয় এ যুগে। সরকার নিজেই এক গোত্রকে অন্য গোত্রের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতো। আরব গভর্ণররা স্ব-স্ব এলাকায় নিজের গোত্রের লোকদেরকে অনুগ্রহীত করতো, আর অন্যদের সাথে করতো বে-ইনসাফী। এ নীতির ফলে খোরাসানে ইয়ামানী এবং মুযারী গোত্রের মধ্যে দ্বন্দ্ব এতটা চরমে পৌঁছে যে, আব্বাসীয় সম্রাজ্রের আহবায়ক আবু মুসলিম খোরাসানী এ গোত্রদ্বয়কে একে অন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত করে উমাইয়া সম্রাজ্যের অবসান ঘটান। হাফেজ ইবনে কাসীর আল-বেয়াদা ওয়ান নেহায়া গ্রন্থে ইবনে আসাকের উদ্ধৃতি দিয়ে লেখেনঃ যে সময় আব্বাসীয় বাহিনী দামেশক শহরে প্রবেশ করছিল, উমাইয়াদের রাজধানী তখন ইয়ামানী আর মুযারীদের গোত্রবাদ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল। এমনকি শহরের প্রতিটি মসজিদে দুটি পৃথক পৃথক মেহরাব ছিল। জামে মসজিদে দুজন ইমমি দুটি মিম্বারে থোৎবা দিতেন এবং দুটি জামাতের পৃথক পৃথক ইমামতি করতেন। এ দুটি দলের কেউ অন্য দলের সাথে সালাত আদায় করতেও প্রস্তুত ছিল না। [আল-বেয়াদা, ১০ম খন্ড, পৃষ্ঠা-৪৫।]
আটঃ আইনের সার্বভৌমত্বের অবসান
রাজতান্ত্রিক শাসনামলে মুসলমানদের ওপর সবচেয়ে বড় বিপদ নিপতিত হয়, তা হচ্ছে এই যে, সে সময় আইনের প্রাধান্যের নীতি ভং্গ করা হয়। অথচ তা ছিল ইসলামী রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি।
ইসলাম যে ভিত্তির ওপর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে, তা হচ্ছে এই যে, শরীয়ত সব কিছুর উর্ধ্বে, সকলের ওপরে। রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্র প্রধান, শাসক এবং শাসিত ছোট-বড়, সাধারণ এবং অসাধারণ সকলেই শরীয়াতের অধীন। কেউই শরীয়াতের উর্ধ্বে নয়, নয় কেউ ব্যতিক্রম। শরীয়াত থেকে দূরে সরে কাজ করার আধিকার নেই কারো। শত্র হোক কি মিত্র, যুদ্ধে লিপ্ত কাফের হোক বা চুক্তিবদ্ধ কাফের, মুসলিম প্রজা হোক বা যিম্মী প্রজা, রাষ্ট্রের অনুগত মুসলিম হোক আ যুদ্ধে লিপ্ত বিদ্রোহী- এক কথায় যেই হোক না কেন, তার সাথে আচরণ করার একটা রীতি শরীয়ত নির্ধারিত রয়েছে। সে রীতি কোন অবস্থায়ই লংঘন করা যায় না।
খোলাফায়ে রাশেদীন তাদের গোটা শাসনামলে এ নীতি কঠোরভাবে অনুসরণ করে চলেছিলেন। এমনকি, হযরত ওসমান (রাঃ) এবং হযরত আলী (রাঃ) অত্যন্ত নাজুক এবং উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতেও শরীয়াতের সীমা লংঘন করেননি। এসব সত্যাশ্রয়ী খলীফাদের শাসনের বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, তা শরীয়াত নির্ধারিত সীমা মেনে চলতো, যথেচ্ছাচারী ও বল্গাহীন ছিল না।
কিন্তু রাজতন্ত্রের যুগে রাহা-বাদশাহরা ব্যক্তিস্বার্থ, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এবং বিশেষ করে নিজেদের শাসন পাকা-পোক্ত করার ব্যাপারে শরীয়াত নির্ধারিত বিধি-বিধান লংঘন এবং তার সীমারেখা অতিক্রমে কুণ্ঠাবোধ করেনি। যদিও তাদের সময়েও দেশের আইন ইসলামী-ই ছিল, তাদের কেইউ আল্লার কিতাব এবং রাসূলের সুন্নার আইনগত মর্যাদা অস্বীকার করেনি। এ আইন অনুযায়ী আদালত ফায়সালা করতো, সাধারণ পরিস্থিতিতে শরীয়তের বিধান অনুযায়ী সকল বিষয়ের মিমাংসা হতো। কিন্তু এ সকল বাদশাহের রাজনীতি দ্বীনের অনুবর্তী ছিল না। বৈধ অবৈধ সকল উপায়ে তারা রাষ্ট্রের দাবী মিটাতেন। এ ব্যাপারে হালাল-হারামের কোন পার্থক্য করতেন না। বনী উমাইয়ার বিভিন্ন খলীফাদের শাসনামলে আইনের বাধ্যবাধকতা কোন পর্যায়ে ছিল, এখানে আমরা উল্লেখ করবো।
হযরত মুআ‘বিয়া (রাঃ)-এর শাসনামলে
হযরত মিআ’বিয়া (রাঃ)-এর শাসনামল থেকেই এই নীতির সূচনা হয়। ইমাম যুহুরীর বর্ণনা মতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এবং চারজন খোলাফায়ে রাশেদীনের যামানায় মুসলমানদের মধ্যে এ নীতি চলে আসছিল যে, কাফের মুসলমানের ওয়ারিশ হতে পারতো না, আর মুসলমান হতে পারতো না কাফেরের ওয়ারিস। হযরত মুআ’বিয়া (রাঃ) তাঁর শাসনামলে মুসলমানকে কাফেরের ওয়ারিস করেছেন, কাফেরকে মুসলমানের ওয়ারিস করেননি। হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আযীয এ বেদআতকে রহিত করেন। কিন্তু হিসাম ইবনে আব্দুল মালেক তাঁর খান্দানের ঐতিহ্র পুনর্বহাল করেন। [আল-বেদায়া ওয়ান নেহায়া, ৮ম খন্ড, পৃষ্ঠা-১৩৯; ৯ম খন্ড, পৃষ্ঠা-২৩২।]
হাফেজ ইবনে কাসীর বলেন, রক্তপনের ব্যাপারেও হযরত মুআ’বিয়া (রাঃ) খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতকে বদলিয়ে দেন। সুন্নাত ছিল এই যে, চুক্তিবদ্ধ অমুসলিমের মুক্তিপণ মুসলিমের সমান হবে। কিন্তু হযরত মুআ’বিয়া (রাঃ) তাকে অর্ধেক করে অবশিষ্ট অর্ধেক নিজে গ্রহণ করা শুরু করেন। [আল-বেদায়া ওয়ান নেহায়া, ৮ম খন্ড, পৃষ্ঠা-১৩৯। ইবনে কাসীরের ভাষায়ঃ ****************** মুআ’বিয়াই প্রথম ব্যক্তি যিনি রক্তপণকে হ্রাস করে অর্ধেক করেছেন এবং অবশিষ্ট অর্ধেক নিজে গ্রহণ করেছেন।]
হযরত মুআ’বিয়া (রাঃ)-এর শসনামলে আর একটি নিকৃষ্টতম বেদআত চালু হয়। তিনি নিজে এবং তাঁর নির্দেশে তার গভর্ণররা মিম্বারে দাঁড়িয়ে একবারে নবীজীর রওযার সামনে হুযুর (সাঃ)-এর প্রিয়তম সাথী ও আত্মীয়কে গালি দেয়া হতো। আর হযরত আলী (রাঃ)-এর সন্তানেরা এবং তাঁর নিকটতম আত্মীয়রা নিজেদের কানে এসব শুনতেন। [আত-তাবারী, ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা-১৮৮। ইবনুল আসীর, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা-২৩৪; ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা-১৫৪। আল-বেদায়া, ৮ম খন্ড, পৃষ্ঠা-২৫৯; ৯ম খন্ড পৃষ্ঠা-৮০।] কারো মৃত্যুর পর তাকে গালি দেয়া শরীয়ত তো দূরের কথা, মানব সুলব চরিত্রেরও পরিপন্থী। বিশেষ করে খোতবাকে এভাবে কলংকিত করা দ্বীন এবং নৈতিকতার দৃষ্টিতে আরও জঘন্য কাজ। হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আযীয তাঁর খান্দানের অন্যান্য খারাপ ঐতিহ্যের মতো ও ঐতিহ্যও পরিবর্তন করেন এবং জুমার খোতবায় হযরত আলী (রাঃ) কে গালমন্দ দেয়ার পরিবর্তে এ আয়াত পাঠ শুরু করেনঃ
*****************
… নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে সুবিচার এবং সৌজন্যের নির্দেশ দেন, আর নির্দেশ দেন নিকটাত্মীয়দের দান করার আর বারণ করেন অশ্লীল ঘৃণ্য কাজ এবং সীমা লংঘন করতে তিনি তোমাদেরকে সদুপদেশ দেন, যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ করো। -আন-নাহল ৯০
গণীমতের মাল বন্টনের ব্যাপারও হযরত মুআবিয়া কিতাবুল্লাহ এবং সুন্নাতে রাসুলের স্পষ্ট বিধানের বিরুদ্ধাচরণ করেন। কিতাব এবং সুন্নার দৃষ্টিতে গণীমাতের মালের এক পঞ্চমাংশ বায়তুল মালে জমা করতে হবে এবং অবশিষ্ট চার অংশ যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী সৈন্যদের মধ্যে বন্টন করতে হবে। কিন্তু হযরত মুআরিয়া (রাঃ) গণীমাতের মাল থেকে স্বর্ণ রৌপ্য তাঁর জন্য পৃথক করে রাখার এবং অন্যান্য মাল শরীয়াতের বিধান অনুযায়ী বন্টন করার নির্দেশ দান করেন। [তাবাকাতে ইবনে সাআদ, ৭ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৮-২৯। আত-তাবারী, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৮৭। আল-ইন্তীআব, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১১৮ ইবনুল আসীর, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৩৩। আল-বেদায়া ওয়ান নেহায়া, ৮ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৯।
যিয়াদ ইবনে সুমাইয়্যার ব্যাপারটিও হযরত মুআবিয়া (রাঃ)-এর এমন সব কার্যাবলীর অন্যতম, যাতে তিনি ব্যক্তিগত স্বার্থে শরীয়াতের একটি সর্বসম্মত রতির বিরুদ্ধাচরণ করেছেন। তায়েফে সুমাইয়্যা নাম্নী একজন দাসীর উদরে যিয়াদের জন্ম। লোকে বলে, জাহেলী যমানায় হযরত মুআবিয়া (রাঃ)-এর পিতা জনাব আবু সুাফিয়ান সুমাইয়্যার সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হন। তার ফলে সে অন্তঃসত্তা হয়। হযরত আবু সুফিয়ানও একবার এদিকে ইঙ্গিত করে বলেছিলেন যে, তাঁর বীর্যে যিয়াদের জন্ম। যৌবন-প্রাপ্ত হয়ে তিনি উন্নত মানের ব্যবস্থাপক, প্রশাসক, সেনাধ্যক্ষ এবঙ অনন্য সাধারণ যোগ্যতার অধিকারী প্রমাাণিত হন। ইনি হযরত আলী (রাঃ) -এর বিরাট সমর্থক ছিলেন এবং সহায়ক করার জন্য তাঁর পিতার ব্যভিচারের সাক্ষ্য গ্রহণ করে প্রমাণ করেন যে, সে তাঁর পিতার অবৈধ সন্তান। আর এরই ভিত্তিতে তিনি তাকে নিজের ভাই এবং আপন পরিবারের সদস্য হিসেবে গ্রহণ করেন। তাঁর এ কার্য নৈতিক দিক থেকে কত ঘৃণ্য, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু আইনের দৃষ্টিতেও এটা ছিল স্পষ্ট অবৈধ কাজ। কারণ শরীয়াতে ব্যভিচারের মাধ্যমে কোন নসব (বংশধারা) প্রমাণিত হয় না। আল্লার রাসুলের স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছেঃ শিশু যার বিছানায় ভূমিষ্ঠ হয় তার; আর ব্যভিচারীর জন্য রয়েছে প্রস্তরখণ্ড। উন্মুখ মুমিনীন হযরত উম্মে হাবীবা এ জন্য তাকে ভাই হিসেবে গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন এবঙ তার সাথে পর্দা করে চলেন। [আল-ইস্তীআব, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৯৬; ইবনুল আসীর, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-২২০-২২১; আল-বেদায়া ওয়ান নেহায়া, ৮ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৮। ইবনে খালদুন, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭-৮।]
হযরত মুআবিয়া তাঁর গবর্ণরদেরকে আইনের ঊর্ধে স্থান দেন এবঙ তাদের বাড়াবাড়ির জন্য শরলীয়াতের বিধান অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে স্পষ্টত অস্বীকৃতি জানান। তাঁর গবর্ণর আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে গাইলান একবার বসরার মিম্বারে দাঁড়িয়ে খোতবা দিচ্ছিলেন। এ সময় এক ব্যক্তি তাঁর দিকে কংকর নিক্ষেপ করে। এতে তিনি তাকে গ্রেফতার করে তার হাত কেটে ফেলেন। অথচ শরীয়াতের বিধান অনুযায়ী এটা এমন কোন অপরাধ ছিল না, যার জন্য কারো হাত কাটা যায়। হযরত মুআবিয়া (রাঃ)-এর কাছে ফরিয়াদ করা হলে তিনি বলেন, আমি বায়তুল মাল থেকে হাতের দিয়াত (ক্ষতিপূরণ) আদায় করবো। কিন্তু গভর্ণর থেকে প্রতিশোধ (কিসাস) গ্রহণের কোন উপায় নেই। [ইবনুল আসীর, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৪৮। আল-বেদায়া, ৮ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭১।] হযরত মুআবিয়া (রাঃ) যিয়াদকে যখন বসরার সাথে কুফারো গবর্ণর নিযুক্ত করেন, তখন তিনি প্রথম বার খোতবা দেয়ার জন্য কুফার জামে মসজিদের মিম্বারে দাঁড়ালে কিছু লোক তার প্রতি কংকর নিক্ষেপ করে। তিনি তৎক্ষণাৎ মসজিদের দরজা বন্ধ করে কংকর নিক্ষেপকারীদেরকে (যাদের সংখ্যা ৩০ থেকে ৮০ পর্যন্ত বলা হয়) গ্রেফতার করিয়ে তাদের হাত কেটে ফেলেন। [আত-তারাবী, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৭৫। ইবনুল আসীর, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-২২৮।] তাদের বিরুদ্ধে কোন মামলা দায়ের করা হয়নি। কোন আদালতেও হাযির করা হয়নি তাদেরকে। গবর্ণর নিছক প্রশাসনিক নির্দেশক্রমে এতগুলো লোককে হাত কাটার শাস্তি দেন, শরীয়াতে এ জন্য আদৌ কোন বিধান নেই। কিন্তু খলীফার দরবার থেকে বিষয়টির প্রতি কোন লক্ষ্যই দেয়া হয়নি। বুসর ইবনে আরতাতো এর চেয়ে মারাত্মক নির্যাতনমূলক কাজ চালায়। হযরত মুআবিয়া (রাঃ) এ ব্যক্তিকে সর্বপ্রথম হেজায এবং ইয়ামানে পাঠান, হযরত আলী (রাঃ)-এর অধিকার থেকে এলাকা দুটি মুক্ত করার জন্য, পরে হামাদান অধিকারের জন্য তাকে নির্দেশ দেন। সে ইয়ামানে হযরত আলী (রাঃ)-এর গবর্ণর ওবায়দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) -এর ২টি ছোট শিশুকে হত্যা করে। পুত্রশোকে শিশুদের মাতা পাপগল হয়ে যায়। এ যুলুম দেখে বনী কেনানার জনৈক মহিলা চিৎকার করে ওঠে-তুমি-পুরুষদেরকে হত্যা করেছো। এখন শিশুদের কি অপরাদে হত্যা করছো? জাহেলীযুগেও তো শিশুদের হত্যা করা হতো না। ইবনে আরতাত শোন, শিশু-বৃদ্ধদের নির্বিচারে হত্যা, নিষ্ঠুরতা এবং ভ্রাতৃত্ব বন্ধন ছিন্ন করা ছাড়া য সরকার টিকে থাকতে পারে না, তার চেয়ে নিকৃষ্ট কোন সরকার নেই। [আল-ইস্তীআব, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৬৫, আত-তাবারী, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা-১০৭। ইবনুল আসীর, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৯৩। আল-বেদায়া, ৮ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৯০।] এরপর হযরত মুআবিয়া (রাঃ) এ অত্যাচারী ব্যক্তিকে হামাদানে অভিযান পরিচালনার জন্য প্রেরণ করেন। তখন হামাদান হযরত আলী (রাঃ)-এর অধিকারে ছিল। সেখানে সে অন্যান্য বাড়াবাড়ীর সাথে আরো একটি বিরাট অন্যায় করে বসে। যুদ্ধে যে সকল মুসলিম মহিলাকে গ্রেফতার করে আনা হয়েছে, তাদেরকে দাসীতে পরিণত করে। [আল-ইস্তীআব ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৬৫। ইবনে আবদুল বার বলেনঃ এই প্রথম বার মুসলমানদের পারস্পরিক যুদ্ধে গ্রেফতারকৃত মহিলাদেরকে দাসীতে পরিণত করা হয়। অথচ শরীয়াতে আদৌ এ রকম কোন বিধান নেই। গবর্ণর এবঙ সিপাহসালারদেরকে এখন যুলুম-নির্যাতনের অবাধ অধিকার দেয়া হয়েছে, আর শরীয়াতের ব্যাপারে তারা এখন আর কোন সীমারেখা মেনে বলতে রাযী নয়- এসব কার্যকলাপ ছিল এ কথারই বাস্তব ঘোষণা।
মস্তক দ্বিখণ্ডিত করে স্থানান্তরে প্রেরণ এবং প্রতিশোধ স্পৃহায় লাশের অবমাননা করার পাশবিক ধারা-জাহেলী যুগে যা চালু ছিল এবং ইসলাম যাকে নির্মুল করেছিল-তা এ যুগে আবার শুরু হয়।
ইসলামের আবির্ভাবের পর সর্ব প্রথম হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসের (রাঃ) তাঁর মুসনাদে নির্ভুল সনদসহ বর্ণনা করেছেন এবং ইবনে সাআদ (রাঃ) তাবাকাতেও তা উদ্ধৃত করেছেনঃ সিফ্ফীন যুদ্ধে হযরত আম্মার (রাঃ)-এর মস্তক খণ্ডিত করে হযরত মুআবিয়া (রাঃ)-এর কাছে হাযির করা হয়। এ সময় দুই ব্যক্তি ঝগড়া করছিল। উভয়েরই দাবী ছিল-আমি আম্মারকে হত্যা করেছি। [মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-৬৫৩৮; ৬৯২৯। দারুল মাআরেফ, মিসর, ১৯৫২। তাবাকাতে ইবনে সাআদ, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৫৩।
এরপর আল্লাহর রাসুলের অন্যতম সাহাবী আমর ইবনুল হামেক (রাঃ)-এর মস্তক দ্বিখণ্ডিত করা হয়। আল্লাহ রাসুলের সাহাবী হলেও হযরত ওসমান (রাঃ)-এর হত্যা তিনিও অংশ গ্রহণ করেন। যিয়াদ ইরাকের গবর্ণর থাকা কালে তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা করা হয়। তিনি পলায়ন করে একটি গুহায় আশ্রয় নেন। সেখানে সাপের দঙশনে তিনি মারা যান। পিছু ধাওয়াকারীরা মৃতদেহ থেকে মস্তক বিচ্ছিন্ন করে যিয়াদের নিকট উপস্থিত করে। তিনি এ খণ্ডিত মস্তক দামেশকে হযরত মুআবিয়া (রাঃ) -এর নিকট প্রেরণ করেন। সেখানে তা রাস্তায় রাস্তায় প্রদর্শনীর পর তার স্ত্রীর কোলে নিক্ষেপ করা হয়। [তাবাকাতে ইবনে সাআদ, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৫। আল-ইস্তীআব, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৪৪০ আল-বেদায়া, ৮ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৪৮। তাহযীবুত-তাহযীব, ৮ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৪।]
এমনি বর্বরোচিত আচরণ করা হয় মিসরে নিযুক্ত হযরত আলী (রাঃ)-এর গবর্ণর মুহাম্মদ ইবনে আবুবকর (রাঃ)-এর সাথে। হযরত মুআবিয়া (রাঃ) মিসর অধিকার করার পর তাঁকে গ্রেফতার করে হত্যা করেন এবঙ মৃত গাধার চামড়ায় জড়িয়ে তাঁর লাশ পুড়িয়ে ফেলা হয়। [আল-ইস্তীআব, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৩৫। আত-তাবারী, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭৯। ইবনুল আসীর, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৮০। ইবনে খালদুন, ২য় খণ্ডের পরিশিষ্ট, পৃষ্ঠা-১৮২।]
এরপর থেকে রাজনৈতিক প্রতিশোধ হিসেবে যাদেরকে হত্যা করা হয়, তাদের লামকেও ক্ষমা না করা একটি স্বতন্ত্র রীতিতে পরিণত হয়। হযরত হুসাইন (রাঃ)-এর মস্তক বিচ্ছিন্ন করে কারবালা থেকে কুফা এবং কুফা থেকে দামেশকে নিয়ে যাওয়া হয়। আর তাঁর লাশের োপর দিয়ে ঘোড়া চালিয়ে দেয়া হয়। [আত-তাবারী, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩৪৯, ৩৫০, ৩৫১, ৩৫৬। ইবনুল আসরি, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৯৬-২৯৮। আল-বেদায়া, ৮ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৭৯-১৯২।
ইয়াযিদের শাসনকাল পর্যন্ত হযরত নোমান ইবনে বশীর (রাঃ) বনী উমাইয়্যাদের সমর্থক ছিলেন। মারওয়াদের শাসনামলে আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়েরকে সমর্থন করার অপরাধে তাঁকে হত্যা করা হয়। তাঁর মস্তক কর্তন করে তাঁর স্ত্রীর কোলে ছুঁড়ে দেয়া হয়। [তাবাকাতে ইবনে সাআদ, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠা-৫৩। আল-বেদায়া, ৮ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৪৫।
হযরত মুসআব ইবনে যুবায়ের-এর মস্তক কুফা এবং মিসরে প্রদক্ষিণ করানো হয়। তারপর দামেশক নিয়ে প্রকাশ্যে রাজপথে ঝুলিয়ে রাখা হয়। এরপর সিরিয়ার নগরে নগরে তা প্রদক্ষিণ করাবার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু স্বয়ং আবদুল মালেক ইবনে মারওয়ানের স্ত্রী আতেকা বিনতে ইয়াযীদ ইবনে মুআবিয়া নিজে এর বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিবাদ করে বলেনঃ এ যাবৎ যা কিছু করেছ, তাতেও কি তোমাদের প্রাণ ঠাণ্ডা হয়নি? এখন আবার তার প্রদর্শনী করে বেড়াচ্ছ কেন? অতঃপর মস্তক নামিয়ে গোসল দিয়ে দাফন করা হয়। [ইবনুল আসীর, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৪। ইবনে খালদুন, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩৫।]
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যোবায়ের এবং তাঁর সাথী আবদুল্লাহ ইবনে সাফওয়ান এবঙ োমারা ইবনে হায্ম-এর সাথে এর চেয়েও কঠোর বর্বরোচিত এবং জাহেলী যুগের আচরণ করা হয়। দেহ থেকে তাদের মস্তক বিচ্ছিন্ন করে মক্কা থেকে মদীনা, মদীনা থেকে দামেস্ক নিয়ে যাওয়া হয়। স্থানে স্থানে প্রদর্শনী করা হয়। তাদের দেহ মক্কায় কয়েকদিন যাবত শূলিতে টাঙ্গিয়ে রাখা হয়। পচে-গলে যাওয়া পর্যন্ত তা এ অবস্থায় ছিল। [আল-ইস্তীআব, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩৫৩, ৩৫৪। আত-তাবারী, ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩৩, ৩৪।]
যাদের লাশের সাথে এহেন আচরণ করা হয়, তারা কোন স্তরের লোক ছিলেন, সে প্রশ্ন এখানে অবাস্তব। প্রশ্ন হচ্ছে, ইসলাম কি কোন অমুসলিমের সাথেও এহেন আচরণের অনুমতি দিয়েছে?
ইয়াযীদের শাসনকালে
হযরত মুআ’বিয়া (রাঃ) এর শাসনামলে রাজনীতিকে দ্বীনের ঊর্ধে স্থান দান এবং রাজনৈতিক সার্থে শরীয়াতর সীমা লংঘনের যে ধারা শুরু হয়েছিল, তাঁর নিজের নিয়োজিত উত্তরাধিকারী ইয়াযীদের শাসনকালে তা আরো নিকৃষ্ট পর্যায়ে পৌঁছে। তাঁর শাসনামলে এমন তিনটি ঘটনা ঘটে, যা গোটা মুসলিম জাহানকে বিষ্মিত ো স্তম্ভিত করেছে।
প্রথম ঘটনাটি হচ্চে সাইয়্যেদেনা হুসাইন রাযিয়াল্লাহু আনহুর শাহাদাতের ঘটনা। সন্দেহ নেই, ইরাকের জনগণের আহ্বানে ইয়াযীদের সিংহাসন ভেঙ্গে খান খান করার উদ্দেশ্যে তিনি রওয়ানা হয়েছিলেন আর ইয়াযীদের সরকারও তাঁকে বিদ্রোহী বলেই মনে করতো। ইসলামের দৃষ্টিতে তাঁর এ বিদ্রোহ বৈধ কিনা? [এ ব্যাপারে আমি আমার দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট ব্যক্ত করেছি ‘মহররমের শিক্ষা’ পুস্তিকায়। তা ছাড়া আলোচ্য গ্রন্থের অষ্টম অধ্যায়ে এ সম্পর্কে আরও বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।] ক্ষণিকের জন্য আমরা এ প্রশ্ন এড়িয়ে যাবো। অবশ্য তাঁর এ বিদ্রোহ অবৈধ ছিল, তিনি একটি হারাম কার্য করতে যাচ্ছিলেন-তাঁর জীবদ্দশায় এবং জীবনাবসানে একজন সাহাবী বা তাবেয়ী এমন কথা বলেছেন, তা আমাদের জানা নেই। সাহাবীদের মধ্যে যাঁরা তাঁকে বারণ করেছিলেন, তাঁরা করেচিলেন এ জন্য যে, দুরদর্শীতার বিচারে তা সমীচীন নয়। তর্কের খাতিরে যদি স্বীকারো করে নেয়া হয় যে, এ ব্যাপারে ইয়াযীদ সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিই নির্ভুল। তাহলেও তিনি সেনাবাহিনী সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছিলেন না। তাঁর সাথে ছিল, তাঁর ছেলে-মেয়ে, পরিবার পরিজন; আর ছিল ৩২ জন আরোহী এবঙ ৪২ জন পদাতিক। কোন ব্যক্তি একে সামরিক অভিযান বলতে পারে না। তাঁর মুকাবিলায় ওমর ইবনে সাআদ ইবনে আবু ওয়াক্কাসের নেতৃত্বে কুফা থেকে যে বাহিনী প্রেরণ করা হয়, তার সংখ্যা ছিল ৪ হাযার। একটি ক্ষুদ্র দলের সাথে এত বিরাট বাহিনীর যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার কোন প্রয়োজন ছিল না, প্রয়োজন ছিল না তাকে হত্যা করার। ঘেরাও করে সহজেই তারা ক্ষুদ্র দলটিকে গ্রেফতার করতে পারতো। এছাড়া হযরত হুসাইন (রাঃ) শেষ সময় যা কিছু বলেছিলেন, তা হচ্ছে এই যে, আমাকে ফিরে যেতে দাো, অথবা কোন সীমান্তের দিকে চলে যেতে দাও অথবা ইয়াযীদের নিকট নিয়ে যাও। কিন্তু এর কোন একটিও স্বীকার করা হয়নি বরং পীড়াপীড়ি করা হয় যে, আপনাকে ওবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদের নিকট সোপর্দ করতে প্রস্তুত ছিলেন না। কারণ, মুসলিম ইবনে আকীলের সাথে তিনি যে আচরণ করেছেন, তা তাঁর জানা ছিল। অবশেষে তাঁর সাথে যুদ্দ করা হয়। তাঁর সঙ্গীরা সকলেই শহীদ হয়েছেন, যুদ্ধের ময়দানে একা কেবল তিনিই রয়েছেন এমন সময়ো তাঁর ওপর আক্রমণ করাকে প্রয়োজনীয় মনে করা হয়। তিনি আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লে তাঁকে জবাই করা হয়। তাঁর কাছে যা কিছু ছিল, সবই খুলে ফেলা হয়, এমনকি তাঁর লাশ থেকে কাপড়ো খুলে ফেলা হয়। এবং পরে তাঁকে ঘোড়ার পায়ে পিষ্ট করা হয়। এরপর তাঁর অবস্থান-স্থল লুট করা হয় এবং মহিলাদের গায়ের চাদরও ছিনিয়ে নেয়া হয়। এরপর তাঁর এবং কারবালার অন্য সকল শহীদের মস্তক বিচ্ছিন্ন করে কুফায় নিয়ে যাওয়া হয়। ইবনে যিয়াদ কেবল প্রকাশ্যে তার প্রদর্শনীই করেনি বরঙ জামে মসজিদের মিম্বরে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেঃ ***************
-সকল প্রশংসা আল্লার জন্য, যিনি সত্য এবং সত্যের অনুসারীকে সুস্পষ্ট করে দিয়েছেন, আমীরুল মু’মিনীন ইয়াযীদ এবং তাঁর দলকে বিজয়ী করেছেন, আর মিথ্যাবাদীর পুত্র মিথ্যাবাদী-হুসাইন ইবনে আলী এবং তার সমর্থকদেরকে হত্যা করেছেন।
এরপর এ সকল বিচ্ছিন্ন মস্তক দামেস্কে ইয়াযীদের নিকট প্রেরণ করা হয় এবং ইয়াযীদ জমজমাট দরবারে তার প্রদর্শনী করে। [বিস্তারিত কাহিনী জানার জন্য তাবারী ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩০৯-৩৫৬। ইবনুল আসীর, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৮২-২৯৯ এবং আল-বেদায়া, ৮ম খণ্ড, ১৭০-২০৭ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।]
ধরে নিন, ইয়াযীদের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী হযরত হুসাইন বিদ্রোহীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। যদি তাই হয়েও থাকে, তাহলে সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীর জন্য ইসলামে কি কোন আইন নেই? ফিকাহর সকল বড় বড় গ্রন্থেই এ আইন লিপিবদ্ধ রয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ কেবল হেদায়া এবং তার ভাষ্য ফাতহুল কাদীর এর বিদ্রোহী অধ্যায় দেখা যেতে পারে। এ আইনের দৃষ্টিতে বিচার করলে কারবালা প্রান্তর থেকে শুরু করে কুফা এবঙ দামেস্কের দরবার পর্যন্ত যা কিছু, করা হয়েছে, তা সবই একেবারে হারাম এবং মারাত্মক যুলুম ছিল। দামেস্কের দরবারে ইয়াযীদ বা কিছু করেছে বা বলেছে, সে সম্পর্কে নানা রকম বর্ণনা দেখা যায়। এ সকল বর্ণনা বাদ দিয়ে আমরা কেবল এ বর্ণনাকেই নির্ভুল বলে স্বীকার করে নিচ্ছি যে, হযরত হুসাইন (রাঃ)-কে ক্ষমা করে দিতাম। ‘তিনি আরও বলেনঃ ‘হুসাইন! আল্লার কসম, আমি তোমার প্রতিপক্ষ থাকলে তোমাকে হত্যা করতাম না।’ [আত-তাবারী, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩৫২। ইবনুল আসীর, ৩য় খণ্ড,] এরপরও কার্যত প্রশ্ন থেকে যায়, এ বিরাট যুলুমের জন্য তিনি তার কীর্তিমান গবর্ণরকে কি শাস্তি দিয়েছেন? হাফেয ইবনে কাসীর লিখেছেন যে, তিনি ইবনে যিয়াদকে কোন শাস্তি দেননি, তাকে বরখাস্তো করেননি, নিন্দা করে কোন চিঠিও লিখেননি। [আল-বেদায়া ওয়ান নেহায়া, ৮ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-২০৩।] এরপরও কার্যত প্রশ্ন থেকে যায়, এ বিরাট যুলুমের জন্য তিনি তার কীর্তিমান গবর্ণরকে কি শাস্তি দিয়েছেন? হাফেয ইবনে কাসীর লিখেছেন যে, তিনি ইবনে যিয়াদকে কোন শাস্তি দেননি, তাকে বরখাস্ত্ও করেননি, নিন্দা করে কোন চিঠিও লিখেননি। [ আল-বেদায়া ওয়ান নেহায়া, ৮ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-২০৩।] ইসলামী ভদ্রতা তো অনেক দূরের কথা ইয়াযীদের মধ্যে বিন্দুমাত্র মানবিক ভদ্রতাও যদি থাকতো, তাহলে সে চিন্তা করে দেখতো যে, মক্কা বিজয়ের পর আল্লার রাসুল (সাঃ) তার গোটা খান্দানের সাথে কি ধরনের সহৃদয় ব্যবহার করেছিলেন, আর তার সরকার তাঁর দৌহিত্রের সাথে কি আচরণ করেছে।
এরপর দ্বিতীয় মর্মান্তিক ঘটনা ছিল হাররা যুদ্ধ। হিযরী ৬৩ সালের শেষের দিকে এবং স্বয়ং ইয়াযীদের জীবনের শেষ অধ্যায়ে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ এই যে, মদীনাবাসীরা ইয়াযীদকে ফাসেক-ফাজের ও যালেম অ্যাখ্যা দিয়ে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। তারা মদীনার গবর্ণরকে শহর থেকে বিতাড়িত করে আবদুল্লাহ ইবনে হানযালাকে তাদের নেতা নিযুক্ত করে। ইয়াযীদ এ সম্পর্কে জানতে পেরে মুসলিম ইবনে ওকবা আল-মুররী (সালফে সালেহীন তাকে মুশরেক ইবনে ওকবা বলে অভিহিত করেছেন)-কে ১২ হাযার সৈন্য নিয়ে মদীনা আক্রমণের জন্য প্রেরণ করেন। তাকে নির্দেশ দেন যে, শহরবাসীদেরকে ৩ দিন যাবৎ আনুগত্য গ্রহণের আহ্বান জানাবে। এরপরও তারা আনুগত্য স্বীকার না করলে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। আর বিজয় লাভ করলে ৩ দিন যাবত মদীনাকে সৈন্যদের জন্য মোবাহ করে দেবে। নির্দেশ অনুযায়ী সৈন্যরা মদীনা প্রবেশ করে যুদ্ধে মদীনা জয় করে। অতঃপর ইয়াযীদের নির্দেশে তিন দিন যাবত মদীনায় যা ইচ্ছা তা করার জন্য সেন্যদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়। এ তিন দিনে শহরের সর্বত্র লুট-তরাজ চলে। অধিবাসীদের পাইকারী হারে হত্যা করা হয়। ইমাম যুহরীর বর্ণনা মতে ৭শ সম্মানিত এবং প্রায় ১০ হাজার সাধারণ লোক নিহত হয়েছেন। বর্বর সেনা বাহিনী ঘরে ঘরে উপস্থিত হয়ে নির্বিচারে স্ত্রীদের শ্লীলতা হানি করে। হাফেয ইবনে কাসীর বলেনঃ
-বলা হয়, এ সময় এক হাযার মহিলা ব্যাভিচারের ফলে অন্তঃসত্ত্বা হয়েছে। [ঘটনার বিস্তারিত বিবরণের জন্য তাবারী, ৩য় খণ্ড, ৩৭২-৩৭৯। ইবনুল আসীর, ৩য় খণ্ড, ৩১০-৩১৩ এবং আল-বেদায়া, ৮ম খণ্ড, ২১৯-২২১ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।]
তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেয়া হয় যে, মদীনাবাসীদে বিদ্রোহ অবৈধ ছিল, তাহলেও কি কোন বিদ্রোহী মুসলিম জনবসতি, এমনকি অমুসলিম বিদ্রোহী এবং যুদ্ধংদেহী কাফেরদের সাথেও এহেন আচরণ ইসলামের দৃষ্টিতে বৈধ ছিল। তাও আবার অন্য কোন শহরে নয়, স্বয়ং মদীনা তুর-রাসুল (সঃ) এর ব্যাপার। এ শহর সম্পর্কে বুখারী, মুসলিম, নাসায়ী এবং মুসনাদে আহমাদে আহমাদে বিভিন্ন সাহাবা থেকে রাসুলুল্লাহ (সঃ)-এর এ উক্তিসমূহ উদ্ধৃত হয়েছেঃ
*****************
-যে কোন ব্যক্তি মদীনার সাথে মন্দ কাজের ইচ্ছা করবে, আল্লাহ তাকে জাহান্নামের আগুনে শিশার মতো গালিয়ে দেবেন।
মহানবী আরও বলেছেনঃ
-যে ব্যক্তি মদীনাবাসীকে যুলুমে আতংকগ্রস্ত করবে, আল্লাহ তাকে আতংকগ্রস্ত করবেন; তার োপর আল্লাহ, তাঁর ফিরেশতাকুল এবং সকল মানুষের অভিসম্পাত। কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা তার কাছ থেকে তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে কোন কিছুই গ্রহণ করবেন না।
হাফেয ইবনে কাসীর বলেন, এসকল হাদীসের ভিত্তিতে একদল আলেম ইয়াযীদের োপর দানতকে জায়েয মনে করেন। এদের সমর্থনে ইমাম আহমাদ ইবনে হ্যম্বলের একটি উক্তিও পাওয়া যায়। কিন্তু এর ফলে তার পিতা বা অন্য কোন সাহাবীর ওপর লানতের দ্বার লানতের দ্বার লানতের দ্বার উন্মুক্ত হওয়ার আশংকায় অপর একটি দল তা করতে নিষেধ করেন। [আল-বেদায়া, ৮ম খণ্ড পৃষ্ঠা-২২৩। ইবনে কাসীর ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বলের যে উক্তির উদ্ধৃতি দিয়েছেন, তার বিবরণ এই যে, একদা তাঁর পুত্র আবদুল্লাহ তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, ইয়াযীদের োর লানত সম্পর্কে আপনি কি বলেন? জবাবে তিনি বলেনঃ আল্লাহ যার ওপর লানত করেছেন, আমি কেন তার ওপর লানত করবো না? এর প্রমাণ হিসাবে তিনি এ আয়াত পাঠ করেনঃ
****************
-তোমরা ক্ষমতার অধিকারী হলে বিশ্বে বিপর্যয় ঘটাবে, আর আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করবে-তোমাদের কাছ থেকে এ ছাড়া আর কি আশা করা যায়? এরাই হচ্ছে সেসব লোক, আল্লাহ যাদের ওপর লানত করেছেন।‘ এ আয়াত পাঠ করে ইমাম সাহেব বলেন, ইয়াযীদ যা কিছু করেছে, তাঁর চেয়ে বড় বিপর্যয় এবং তার চেয়ে বড় আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন আর কি হতে পারে? মুহাম্মদ ইবনে আবদুর রাসূল আল-বারযানজী ‘আল-ইশয়াহ ফী আশরাতিস-সা-আহ’ এ এবং ইবনে হাজার আল-হাইসামী আস-সাওয়ায়েকুল মুহরিকা’য় ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বলের এ উক্তিটি উদ্ধৃত করেছেন। কিন্তু আল্লামা সাফারিনী এবং ইমাম ইবনে তাইমিয়া বলেন, অধিক নির্ভরযোগ্য বর্ণনা মতে ইমাম আহমাদ ইয়াযীদের ওপর লানতকে পসন্দ করতেন না। আহলুস সুন্নাতের আলেমদের মধ্যে যারা লানতের স্বপক্ষে, তাঁদের মধ্যে ইবনে জাওযী, কাযী আবু ইয়ালা, আল্লামা তাফতাযানী এবং আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ুতীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আর যাঁরা এর বিপক্ষে, তাঁদের মধ্যে ইমাম গাযযালী এবং ইমাম ইবনে তাইমিয়া শীর্ষস্থানীয়। আমার মতে, অভিসম্পাতযোগ্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারীদের ওপর সামগ্রিকভাবে লানত করা যায় (যেমন, বলা যায়, যালেমদের ওপর আল্লার লানত); কিন্তু কোন ব্যক্তিবিশেষের ওপর নির্ধারিত ধারায় লানত করা উচিত নয়। কারণ, তিনি জীবিত থাকলে হতে পারে, পরে আল্লাহ তাকে তাওবা করার তাওফিক দিবেন, আর তিনি মারা গিয়ে থাকলে, আমরা জানিনা, কি অবস্থায় তাঁর জীবনের সমাপ্তি হয়েছে। এ জন্য আমাদেরকে এ সব লোকদের অন্যায় কাজকে অন্যায় বলেই ক্ষান্ত হতে হবে এবং লানত থেকে বিরত থাকাই উত্তম। কিন্তু এর অর্থ এ নয় যে, এখন ইয়াযীদের তা’রীফ করতে হবে, তাকে রাযিয়াল্লাহু আনহু (আল্লাহ তার ওপর সন্তুষ্ট থাকুন) শিখা হবে। একদা জনৈক ব্যক্তি হযরত ওমর ইবনে আবদুল আযীযের দরবারে ইয়াযীদের আলোচনা প্রসঙ্গে আমীরুল মুমিনীন ইয়াযীদ শব্দ উচ্চারন করলে তিনি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে বলেঃ তুমি ইয়াযীদকে আমীরুল মুমিনীন বলছো ? এ বলে তিনি তাকে ২০ টি কশাঘাত করেন। ) তাহযীবুত – তাহযীব, ১১ শ খন্ড, পৃষ্ঠা – ৩৬১)। ]
হযরত হাসান বাসরী (রঃ) – কে বিদ্রুপ করে বলা হয়ঃ আপনি তো বনী উমাইয়াদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কোন আন্দোলনে যোগ দিচ্ছেন না, তাহলে আপনি কি সিরিয়াবাসীদের (মানে উমাইয়াদের) ওপর সন্তুষ্ট? জবাবে তিনি বলেনঃ “সিরিয়াবাসীদের ওপর আমি সন্তুষ্ট থাকবো? আল্লাহ্ তাদের ধ্বংস করুন। তারা কি রাসুলুল্লাহর হেরেমকে হালাল করেনি? তিন দিন ধরে সেখানকার অধীবাসীদের পাইকারী হারে হত্যা করেনি। তাদের নিবতী এবং কিবতী সৈন্যদেরকে সেখানে যা খুশী করার অনুমতি দেয়নি? তারা শরীফ দ্বীনদার মহিলাদের ওপরও আক্রমন চালিয়েছে, কারোর সম্ভ্রম বিনষ্ট করা থেকেই তারা নিবৃত হয়নি। অতঃপর বায়তুল্লাহ-আল্লাহর ঘরের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। প্রস্তর খণ্ড বর্ষণ করে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। তার ওপর আল্লার লানত হোক,তার পরিণতি হোক নিকৃষ্ট। [ইবনুল আসীর, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৭০। ]
তৃতীয় ঘটনাটি সম্পর্কে হযরত হাসান বাসরী (রঃ) সব শেষে উল্লেখ করেছেন। রাসুলুল্লাহ (স:) হেরেমের ধ্বংস সাধন করে উক্ত বাহিনী হযরত ইবনে যুবাইয়ের (রা:)-এর সাথে যুদ্ধ করার জন্য মক্কা আক্রমণ করে এবঙ মিঞ্জানিক দিয়ে খানায়ে কা’বার ওপর প্রস্তর বর্ষণ করে। ফলে কা’বার একখানা দেয়াল ভেঙ্গে যায়। কা’বায় অগ্নিসংযোগের বর্ণনাও পাওয়া যায়। অবশ্য এর অন্যান্য কারণো রয়েছে বলে বলা হয়। তবে প্রস্তর বর্ষণ সম্পর্কে কোনো দ্বিমত নেই। [আত-তাবারী, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩৮৩। ইবনুল আসীর, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩১৬। আল-বেদায়া, ৮ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-২২৫। তাহযীবুত তাহযীব, ১১শ খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩৬১।]
এ সকল ঘটনা সুষ্পষ্ট করে তুলে ধরে যে, এ শাসকরা তাদের ক্ষমতা এবং তার স্থিতি ও সংরক্ষণকে সবার ঊধ্বেঙ স্থান দিতেন। তারা এ জন্য যে কোন সীমাতিক্রম এবঙ যে কোন রকম অন্যায় কাজ করতেও কুষ্ঠাবোধ করতো না।
মারওয়ান বঙশের রাজত্বকালে
এরপর মারওয়ান এবং তার বংশের লোকদের শাসনকালশুরু হয়। এ সময় ধর্ম থেকে রাজনীতির পৃথকীকরণ বরং রাজনীতির যুপকাষ্ঠে ধর্মের বিধি-বিধান বলি দেবার প্রবণতা চরমে পৌঁছে। আবদুল মালেক ইবনে মারওয়ান উঁচুদরের ফকীহদের অন্যতম ছিলেন। বাদশাহ হওয়ার আগে তাকে মদীনায় হযরত সাঈদ ইবনে মুসাইয়্যেব, উরওয়া ইবনে যুবায়ের এবং কাবীসা ইবনে যুবাইর-এর সমপর্যায়ের ফকীহ মনে করা হতো। ইয়াযীদের শাসনকালে খানায়ে কা’বায় প্রস্তর বর্ষণের বিরুদ্ধে তিনি ভীষণ অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু তিনি নিজে খলীফা হয়ে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যোবায়ের (রা:)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফকে মক্কায় পাঠান। যালেম হাজ্জাজ ঠিক হজ্বের সময় মক্কা আক্রমণ করে; জাহেলী যুগে কাফের মুশরিকরাও এ সময় যুদ্ধ থেকে বিরত থাকতো। সে আবু কুবায়েস পাহাড়ে মিঞ্জালনক স্থাপন করে খানায়ে কা’বার ওপর প্রস্তর বর্ষণ করে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমরের কঠোর পীড়াপীড়িতে বাইরে আগত হাজীদের তাওয়াফ এবং সাঈ সম্পন্ন করা পর্যন্ত প্রস্তর বর্ষণ বন্ধ রাখে। কিন্তু সে বর মক্কার লোকেরা মিনা এবং আরাফাতে যেতে পারেনি, স্বয়ং হাজ্জজের সেনাবাহিনীর লোকেরও তাওয়াফ এবং সাঈ করতে পারেনি। বহিরাগতরা তাওয়াফ শেষ করলে হাজ্জাজ সকলকে বেরিয়ে যাওয়ার নির্দেশ গিয়ে নতুন করে প্রস্তুর বর্ষণ শুরু করে। [ইবনুল আসীর, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৩; আল-বেদায়া, ৮ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩২৯। ইবনে খালদুন, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৭-২৮।] বিজয় লাভের পর আবদুল্লাহ ইবনে যোবায়ের, আবদুল্লাহ ইবনে সাফওয়ান এবং ওমারা ইবনে হাযম-এর মস্তক এবং লাশের সাথে যা কিছু আচরণ করা হয় আমরা ইতিপূর্বে তা উল্লেখ করেছি।
হাজ্জাজের গবর্ণরী ছিল আবদুল মালেক এবং তাঁর পুত্র ওয়ালিদের শাসনামলের সবচেয়ে বড় অভিশাপ। ২০ বছর যাবৎ তাকে যুলুম-নির্যাতন চালাবার অনুমতি দেয়া হয়। দুনিয়ায় কোন মানুষই নিরংকুশভাবে অনিষ্টের প্রতীক নয়; হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফের মধ্যেও ভাল কিছু ছিল না, তা নয়। কুরআনে ‘যের-যবর-পেশ বসান তার এমন এক পুন্যকাজ, বিশ্বযতদিন টিকে থাকবে, ততদিন তার কাজের প্রশংসা করা হবে। সিন্ধু বিজয়ও তার অন্যতম প্রশংসনীয় কীর্তি, যার বদৌলতে আজ এ উপমহাদেশে আল্লার নাম নেয়ার লোক পাওয়া যায়। কিন্তু হাজ্জাজ তার দীর্ঘ শাসনামলে যেসব যুলুম নির্যাতন চালিয়েছে, তার কথা সরাসরি বাদ দিয়েও বলা যায়, কোন ব্যক্তি একেজন নিরপরাধ মু’মিনকে হত্যা করে যে ধরনের গুনাহের অধিকারী হয়, তার সারা জীবনের সমস্ত নেকীও তার কাছে মূল্যহীন হয়ে পড়ে। ইলমে কেরাআতের মশহুর ইমাম আসেম ইবনে আবিন নজুদ বলেনঃ ‘আল্লার এমন কোন হারাম কাজ নেই, যা সে করেনি।‘ হযরত ওমর ইবনে আবদুল আযীয বলেনঃ ‘দুনিয়ার সমস্ত জাতি যদি তাদের সকল কুর্কীতি উপস্থাপিত করেই সকলের ওপর টেক্কা দিতে পারি।‘ সে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ)-কে মোনাফেকদের সর্দার বলতো। সে বলতো, ‘আমি ইবনে মাসউদকে পেলে তার রক্ত দিয়ে মাটির পিপাসা নিবৃত্ত করতাম। সে ঘোষণা করেঃ কোন ব্যক্তি ইবনে মাসউদের কেরাত অনুযায়ী কুরআন পাঠ করলে আমি তার গর্দান উড়িয়ে দেবো। আর কুরআন থেকে তার কেরাআত শুকুরের হাড্ডি দিয়ে মুছে ফেলতে হলে তাও আমি করবো। সে হযরত আনাস ইবনে মালেক এবং ইবনে সাহাল ইবনে সাআদ সায়েদী (রাঃ)-এর মতো বুযবর্গ ব্যক্তিবৃদ্ধকে গালি দেয়। এবং তাঁদের ঘাড়ে মোহর অংকিত করে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ)-কে হত্যার হুমকি দেয়। সে প্রকাশ্যে বলতো, আমি যদি লোকদেরকে মসজিদের এক দরজা দিয়ে বের হবার নির্দেশ দেই, আর তারা অন্য দরযা দিয়ে বের হয়, তাহলে আমার জন্য তাদের রক্ত হালাল। তার শাসন কালে বিনা বিচারে আটক যে সকল ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়, বলা হয়ে থাকে, তাদের সংখ্যা ছিল আশি হাযাব। [বিস্তারিত বিবরণের জন্য দেখুন আল-ইস্তীআব, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩৫; ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৫৫১। ইববুল আসীর, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৯, ১৩৩। আল-বেদায়া, ৯ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-২, ৮৩, ৯১, ১২৮, ১২৯, এবং ১৩১-১৩৮। ইবনে খালদুন, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩৯।] আবদুল মালেক ইবনে মারওয়ান মৃত্যুকারে এ যালেম গবর্ণর সম্পর্কে তাঁর পুত্রদেরকে ওয়িয়্যাত করেছিলেনঃ হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফের প্রতি সব সময় সুনযর দেবে। কারণ সেই-তো আমাদের জন্য রাজত্ব কন্টকমুক্ত করেছে, শত্রুদের পরাভুত করেছে আমাদের বিরোধীদের দমন করেছে। [ইবনুল আসীর, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা-১০৩। আল-বেদায়া, ৯ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৬৭। ইবনে খালদুন, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৫৮।] তারা যে মাসনিকতা নিয়ে রাজত্ব করেছে, এ ওসিয়্যাত তার প্রতিনিধিত্ব করে। তাদের দৃষ্টিতে আসল গুরুত্ব ছিল নিজেদের গদীর। যেসব উপায়ে ক্ষমতা সংহত ও প্রতিষ্ঠিত করা যায়, তা-ই তাদের কাছে ভালো বলে গৃহীত। এতে শরীয়াতের সকল সীমা লংঘিত হলেও তাদের কিছু যায় আসে না।
এ যুলুম-নির্যাতন এতদুর পৌঁছে যে, ওয়ালীদ ইবনে আবদুল মালেক-এর শাসনকালে হযরত ওমর ইবনে আবদুল আযীয একদা চিৎকার করে বলে ওঠেনঃ ইরাকে হজ্জাজ, সিরিয়ায় ওয়ালীদ, মিসরে কুররা ইবনে শরীফ, মদীনায় ওসমান ইবনে হাইয়্যান এবং মক্কায় খালেদ ইবনে আবদুল্লাহ আল কাসরী-হে আল্লাহ! তোমার পৃথিবী যুলুমে ছেয়ে গেছে। এবার জনগণকে শাস্তি দাও, মুক্তি দাও। [ইবনুল আসীর, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৩২।] রাজনৈতিক নির্যাতন ছাড়াও এরা সাধারণ ধর্মীয় ব্যাপারে অনেক ঔদ্ধত্যপরায়ণ হয়ে ওঠে। সালাতে অস্বাভাবিক বিলম্ব তাদের অভ্যাস হয়ে পড়ে। [আল-বেদায়া, ৯ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৮৯।] তারা বসে বসে জুমার প্রথম খোতবা দিতো। [ইবনুল আসীর, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা-১১৯।] ঈদের সালাতের পূর্বে খোতবা দেয়ার রীতি মারওয়ান চালু করে। আর তার খান্দানের জন্য এটা ছিল একটা স্বতন্ত্র রীতি। [আত-তাবারী, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৬। আল-বেদায়া, ৮ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৫৮। ১০ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩০-৩১। ইবনুল আসীর, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩০০।]
ওমর ইবনে আবদুল আযীযের মোবারক শাসনকাল
বনী উমাইয়াদের দীর্ঘ ৯২ বছরের শাসনামলে ওমর ইবনে আবদুল আযীযের খেলাফতের আড়াই বছর অন্ধকারে আলোকবর্তিকা স্বরূপ। একটি ঘটনা তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। ঘটনাটি এইঃ
”হিজরী ৯৩ সাল। তিনি তখন মদীনার গবর্ণর। ওয়ালীদ ইবনে আবদুল মালেকের নির্দেশে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যোবায়েরের পুত্র খোবায়েবকে ৫০টি চাবুক মারা হয়। শুধু তাই নয়, কনকনে শীতের মধ্যে তাঁর মাথায় পানির মশক ছেড়ে দেয়া হয়। এরপর সারাদিন তাকে মসজিদে নববীর দরযায় দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। এরি ফলে শেষ পর্যন্ত তাঁর মৃত্যু হয়। [আল-বেদায়া, ৯ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৮।] এটা ছিল সুস্পষ্ট যুলুম এবং সম্পূর্ণ শরীয়াত বিরোধী শাস্তি। গবর্ণর হিসেবে তাকে এ শাস্তি বরদাস্ত করতে হয়। কিন্তু এরপর তিনি গবর্ণর পদে ইস্তফা দেন। এ জন্য তিনি ভীষণ মর্মপীড়া অনুভব করেন এবং আল্লার ভয়ে ভীত হয়ে পড়েন।
হিজরী ৯৯ সালে সুলায়মান ইবনে আবদুল মালেকের গোপন ওসিয়াত ক্রমে তাঁকে খলীফা করা হলে তিনি আর একবার বিশ্বের দরবারে ফেলাত এবং বাদশাহীর পার্থক্য স্পষ্ট করে তুলে ধরেন। তার পক্ষে আনুগত্যের শপথ গ্রহণ শেষে সর্বপ্রথম তিনি যে ভাষণ দেন, তার ভাষা ছিল এইঃ
“আমার ওপর এ সরকার পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করে আমাকে পরীক্ষায় ফেলা হয়েছে। আমি এটা চাইনি। এ ব্যাপারে আমার মতামত গ্রহণ করা হয়নি, মুসলমানদের পরামর্শও গ্রহণ করা হয়নি। তোমাদের ঘাড়ে আমার আনুগত্যের যে রজ্জু পরিয়ে দেয়া হয়েছে, আমি নিজে তা খুলে ফেলেছি। এখন যাকে খুশী তোমরা নিজেদের নেতা বানাতে পার।
সমবেত জনতা সমন্বয়ে বলে ওঠে, আমরা আপনাকেই চাই। আমরা সকলেই আপনার রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বে সন্তুষ্ট। জনগণের এ স্বতস্ফুর্ত সমর্থনের পরই তিনি খেলাফত গ্রহণ করেন। অতঃপর বলেনঃ “আমলে রব, নবী ও দ্বীনি কিতাবের ব্যাপারে এ উম্মাতের মধ্যে কোন মতবিরোধ নেই, মতভেদ আছে কেবল দীনার-দিরহামের ব্যাপারে। আল্লার কসম! আমি অন্যায় ভাবে কাউকে দেবো না, কারো বৈধ অধিকারে বাধাও দেবো না। জনগণ! শোন যে আল্লার আনুগত্য করে, তার আনুগত্য ওয়াজেব। আর যে আল্লার আনুগত্য করে না, তার জন্য কোন আনুগত্য নেই। যতক্ষণ আমি আল্লার অনুগত থাকি, তোমরা আমার আনুগত্য কিছুতেই বাধ্যতামূলক হবে না। [আল-বেদায়া, ৯ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-২১২-২১৩।]
এরপর তিনি তাঁর পূর্বসুরীদের অনুসৃত সকল রাজকীয় রীতিনীতি, আচার-অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ বর্জন করে খোলাফায়ে রাশেদীনের অনুরূপ জীবন ধারা অবলম্বন করন। উত্তরাধিকার সূত্রে যেসব অবৈধ সম্পত্তি তিনি লাভ করেছিলেন, তার সব কিছু ফেরত দেনঃ এমনকি স্ত্রীর অলংকারাদি এবং সোনাদানা সব বায়তুল মালে ফেরত পাঠান। বার্ষিক ৪০ হাযার দীনারের সম্পত্তির মধ্যে মাত্র বার্ষিক চারশ’ দীনার নিজের জন্য গ্রহণ করেন। তিনি কেবল এ চারশ’ দীনারেরই বৈধ মালিক ছিলেন। [আল-বেদায়া, ৯ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-২০০-২০৮। ইবনুল আসীর, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৫৩-১৬৪।] এভাবে সর্বপ্রথম আল্লাহ এবং জনগণের কাছে নিজের হিসেব পেশ করে তিনি ঘোষণা করেনঃ রাজপরিবার এবং ওমরাদের মধ্যে যার বিরুদ্ধে কারো কোন দাবী আছে, সে যেন তার অভিযোগ পেশ করে। অধিকার হরণের কথা যে কোন ব্যক্তি প্রমাণ করতে পেরেছে, তাকে এর অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছেন তিনি। এতে বনী উমাইয়াদের মধ্যে হৈ চৈ পড়ে যায়। তারা ওমর ইবনে আবদুল আযীযের ফুফী ফাতেমা বিনতে মারওয়ানকে-যাকে তিনি অত্যন্ত সম্মান করতেন-তাঁর কাছে পাঠায় তাঁকে একাজ থেকে বিরত রাখার জন্য। কিন্তু তিনি তাকে জবাব দেনঃ শাসনকর্তার আপন জনেরা যুলুম করলে সে যদি তা প্রতিহত করতে না পারে, তবে সে কোন মুখে অন্যদেরকে বারণ করবে? জবাবে তিনি বলেনঃ “তোমার বংশের লোকেরা তোমাকে সতর্ক করছে যে, তোমাকে এ জন্য কঠোর পরিণতির সম্মুখীন হতে হবে।“ জবাবে ওমর ইবনে আবদুল আযীয বলেনঃ কিয়ামতের চেয়েও বেশী যদি কোন কিছুকে ভয় করে থাকি, তবে তা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আমি দোয়া করি। “অবশ্য তাঁর ফুফী নিরাশ হয়ে ফিরে গিয়ে গোত্রের লোকদেরকে বলেনঃ এ সবই হচ্ছে তোমাদের নিজেদের কর্মফল। তোমরা ওমর ইবনুল খাত্তারের বংশের মেয়ে বিয়ে করিয়ে এনেছ। ছেলে শেষ পর্যন্ত তার নানার পথ অনুসরণ করেছে। [ইবনুল আসীর, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৬৪। আল-বেদায়া, ৯ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-২১৪।] (উল্লেখ্য যে হযরত ওমর ইবনে আবদুল আযীযের মাতা ছিলেন হযরত ওমর এর দৌহিত্রী)।
দায়িত্বের অনুভূতি যে তাঁর মধ্যে কি পরিমাণ জাগ্র ছিল তা নিম্নোক্ত ঘটনাটি থেকে জানা যায়। তাঁর পূর্বসূরী সুলায়মান ইবনে আবদুল মালেক-এর দাফন কার্য সম্পন্ন করে ফিরে আসার পর তাঁকে অত্যন্ত বিষন্ন দেখায়। জনগণ অবাক হন যে, বাদশাহী পেয়ে আনন্দিত না হয়ে উল্টো দুঃখিত হয়েছেন। তারা দুঃখিত হোয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেনঃ “পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত উম্মাতে মুহাম্মাদীর এমন একজন সদস্যও নেই, দাবী করার পূর্বেই আমাকে যার অধিকার আদায় করতে হবে না। [ইবনুল আসীর, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৬৪।] তাঁর স্ত্রী বলেনঃ আমি তাঁর কক্ষে প্রবেশ করে দেখি, জায়নামাযে বসে বসে কাঁদছেন। জিজ্ঞেস করলাম, কাঁদছেন কেন? তিনি জবাব দেনঃ উম্মাতে মুহাম্মাদীর দায়িত্ব আমার ঘাড়ে ন্যস্ত হয়েছে। ভাবছি তাদের অনেকে কপর্দকহীন অবস্থঅয় দিন কাটাচ্ছে, অনেকে রোগে-শোকে আক্রান্ত হয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে, অনেকে যুলুম-নির্যাতনের শিকার, অনেকে দ্বীন-হীন অবস্থায় বন্দীত্বের জীবন যাপন করছে। আবারঅনেকে বার্ধক্যজনিত দুর্বলতা ও বিপুল দারিদ্রের মধ্যে পরিবার পরিজন নিয়ে দিন অতিবাহিত করছে এক কথায় দেশের অত্যন্ত অঞ্চলে এ ধরনের লোক ছড়িয়ে আছে। আমি জানি, কিয়ামতের দিন পরওয়ারদেগার আমাকে জিজ্ঞেস করবেন, আমি এদের জন্য কি করেছি। মুহাম্মাদ (সঃ) কিয়ামতের দিন আমার বিরুদ্ধে ফরিয়াদ করবেন; আমি ভয় করছি, মামলায় আমি যেন দোষী সাব্যস্ত না হই। এ জন্য নিজের ভবিষ্যতের করুণ অবস্থা চিন্তা করে কাঁদছি। [ইবনুল আসীর, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৬৫।] উপরোক্ত বর্ণনা থেকে তার দায়িত্বানুভূতির পরিচয় পাওয়া যায়।
তিনি যালেম গবর্ণর এবঙ কর্মচারীদের বরখাস্ত করে তৎপরিবর্তে সৎ লোকদেরকে শাসক হিসেবে নিযুক্ত করেন। বনী উমাইয়াদের শাসনামলে যেসব অবৈধ কর উসুল করা হতো, তিনি সে সব রহিত করেন। নও-মুসলিমদের ওপর জিযিয়া আরোপের নিয়ম বন্ধ করেন তিনি। কর্মচারীদের কঠোর নির্দেশ দিয়ে লেখেন যে, কোন মুসলমান বা যিম্মীকে বেআইনীভাবে বেত্রাঘাত করবে না, আমাকে জিজ্ঞেস না করে কাউকে হত্যা করবে না বা কারো হাত কাটবে না। [আত-তাবারী, ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩১৪, ৩১৫, ৩২১। ইবনুল আসীর, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৫৮, ১৬৩।
তাঁর শাসনকালের শেষের দিকে একদল খারেজী তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পতাকা উত্তোলন করে। তিনি বিদ্রোহীদের দলপতিকে লিখেনঃ “খুন-খারাবী দ্বারা কি লাভ হবে? এসে আমার সাথে আলোচনা করো; তোমরা সত্যের ওপর থাকলে আমি মেনে নেবো, আর আমি সত্যের ওপর থাকলে তোমরা মেনে নেবে। খারেজীদের দলপতি তাঁর প্রস্তাবে সম্মত হয়ে আলাপ আলোচনার জন্য ২ ব্যক্তিকে তাঁর নিকট প্রেরণ করে। তারা বলেঃ “স্বীকার করে, আপনার খান্দানের অন্যান্য ব্যক্তিদের চেয়ে আপনার রীতি স্বতন্ত্র। তাদের কার্যকলাপকে আপনি অন্যান্য বলে অভিহিত করেন। তবে তারা যখন গুমরাহীর ওপর ছিল, তখন আপনি তাদের ওপর অভিসম্পাত কনের না কেন? হযরত ওমর ইবনে আবদুল আযীয জবাব দেনঃ “আমি, তাদের কার্যকলাপকে অন্যায় বলে থাকি; তাদের নিন্দা করার জন্য এটাই কি যথেষ্ট নয়? এরপরো আবার অভিশম্পাত করার দরকার? তোমরা ফেরাউনের ওপর কতবার অভিশম্পাত করেছো?’ এমনি করে তিনি খায়েজীদের এক একটি অভিযোগের দাঁত ভাং্গা জবাব দেন। অবশেষে তাদের একজন বলেঃ একজন ন্যায় পরায়ণ ব্যক্তি কি এটা সহ্য করতে পারে যে, তার উত্তরাধিকারী হবে একজন অত্যাচারী। তিনি নেতিবাচক জবাব দিলে সে পুনরায় প্রশ্ন করে আপনি আপনার অবর্তমানে ইয়াযীদ ইবনে আবদুল মালেকের হাতে খেলাফতের দায়িত্ব ন্যস্ত করবেন, অথচ আপনি জানেন যে, সে সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে না।‘ তিনি জবাব দেনঃ “আমার পূর্বসূরী (সুলায়মান ইবনে আবদুল মালেক তার স্বপক্ষে পূর্বেই বায়াত গ্রহণ করেছেন। এখন আমি কি করতে পারি?” খারেজী আবার প্রশ্ন করেঃ “যে ব্যক্তি ইয়াযিদ ইবনে আবদুল মালেককে আপনার পর উত্তরাধিকারী নিযুক্ত করেছে, আপনি কি মনে করেন, তার এমনটি করার অধিকার ছিল? আপনি কি তার এ সিদ্ধান্তকে ন্যয়সঙ্গত বলে মনে করেন? এ প্রশ্নে ওমর ইবনে আবদুল আযীয লা-জবাব হয়ে যায়। বৈঠক ভেঙ্গে যাওয়ার পর তিনি বারবার বলতে থাকেনঃ ইয়াযীদের ব্যাপারটি আমাকে শেষ করে দিয়েছে। আমার কাছে এ যুক্তির কোন জবাব নেই। পরওয়ারদেরগার! আমাকে ক্ষমা করো” [আত-তাবারী, ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩১১। ইবনুল আসীর, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৫৫-১৫৭। ইবনে খালদুন, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৬২-১৬৩।
এ ঘটনার পর বনী উমাইয়ারা আশংকা করতে থাকে যে, এখন এ ব্যক্তি বংশীয় কর্তৃত্বও খতম করে শূরার হাতে খেলাফত ন্যস্ত করবে। এর কিছুকাল পরেই তাঁকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয় এবং তারপর সব কিছু আবার আগের মতো চলতে থাকে।