ষষ্ঠ অধ্যায়
মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় মতবিরোধের সূচনা ও তার কারণ
যে সকল কারণে যে পরিস্থিতিতে খেলাফতে রাশেদের পতন হয়, তার অন্যতম ফুলশ্রুতি ছিল মুসলিম মিল্লাতের অভ্যস্তরে ধর্মীয় মতবিরোধ সৃষ্টি। অতঃপর খেলাফতে রাশেদা তার যথার্থ অবয়বে প্রতিষ্ঠিত না থাকার কারণেই ্র সকল মতবিরোধ শিকড় গেড়ে বসে এবং তাদের বিভিন্নমুখী স্বতন্ত্র দলের ভিত্তি স্থাপনের সুযোগ দেয়। কারণ, যথাসময় যথাযথভাবে এসব মতবিরোধ দূর করার মতো নির্ভরযোগ্য এবঙ ক্ষমতাসম্পন্ন কোন প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব রাজতন্ত্রে আদৌ বর্তমান ছিল না।
এ ফেতনার সূচনা বাহ্যত তেমন মারাত্মক ছিল না। সাইয়্যেদেনা হযরত ওসমান (রাঃ)-এর শাসনকালের শেষের দিকে কিছু কিছু রাজনৈতিক অভিযোগ এবং প্রশাসনিক অভিযোগ থেকেই এ গোলযোগের উদ্ভব হয়। তখনও তা কেবল একটি গোলযোগের পর্যায়েই ছিল। এর পেছনে কোন দর্শন, মতবাদ বা ধর্মীয় আকীদা ছিল না। কিন্তু এর পরিণতিতে যখন তাঁর শাহাদাত সঙঘটিত হয় এবং হযরত আলী (রাঃ)-এর খেলাফতকালে তুমুল বিরোধ এক ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের আকার ধারণ করে, একের পর ্রকে জামাল যুদ্ধ, সিফফীন যুদ্ধ, সালিসের ঘটনা এবং নাহরাওয়ান যুদ্ধ সঙঘটিত হতে থাকে, তখন নানাজনের মনে প্রশ্ন, দেখা দেয়-এসব যুদ্ধে কে ন্যায়ের পথে আছে এবং কেন? কে অন্যায়ের পথে আছে? তার অন্যায়ের পথে হওয়ার কারণ কি? এ সকল প্রশ্ন নানা স্থানে আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়। উভয় দলের কার্যকলাপের ব্যাপারে কেউ যদি নীরবতা ও নিরপেক্ষ নীতি অবলম্বন করে, তাহলে কোন যুক্তি-প্রমাণের ভিত্তিতে সে এ নীতি অবলম্বন করেছে? এসব প্রশ্ন কয়েকটি নিশ্চিত ও সুস্পষ্ট মতবাদের উদ্ভব ঘটায়। মূলত এ সকল মতবাদ ছিল নিরেট রাজনৈতিক। কিন্তু পরে এসব মতবাদের সমর্থকরা তাদের মতবাদ সুদৃঢ় করার জন্য কিছু না কিছু ধর্মীয় ভিত্তি সংগ্রহের প্রয়োজন অনুভব করে। এমনি করে এ সব রাজনৈতিক দল ধীরে ধীরে ধর্মীয় দলে রূপান্তরিত হতে থাকে।
অতঃপর মতবিরোধের সূচনাকালে যে সকল খুন-খারাবী সঙঘটিত হয় এবং পরবর্তীকালে বনী উমাইয়া এবং বনী-আব্বাসীয়দের শাসনামলে তা অব্যাহত থাকে, তার ফলে এ সকল মতবিরোধ আর বিছক বিশ্বাস ও ধারণা-কল্পনার বিরোধেই সীমিত থাকেনি, বরং তাতে এমন সব কঠোরতা দেখা দেয়, যা মুসলমানদের ধর্মীয় ঐক্যকে এক বিরাট সঙকটের মুখে নিক্ষেপ করে। বিরোধমূলক বিতর্ক ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিটি বিষয় থেকে নতুন নতুন রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও দার্শনিক সমস্যা দেখা দেয়। প্রতিটি নতুন সমস্যাকে কেন্দ্র করে ফেরকার সৃষ্টি হয়, আর সেসব ফেরকার উদর থকে আরও অসংখ্য ছোট ছোট ফেরকার জন্ম হতে থাকে। এসব ফেরকার মধ্যে কেবল পারস্পরিক ঘৃণা-বিদেষই সৃষ্টি হয়নি, বরং কলহ বিবাদ এবং দাঙ্গা-হাঙ্গামার উদ্ভব হয়। ইরাকের কেন্দ্রস্থল কুফা ছিল এ ফেতনা ফাসাদের সবচেয়ে বড় কেন্দ্র। কারণ, ইরাক অঞ্চলেই জামাল, সিফফীন এবং নাহরাওরান যুদ্ধ সংঘটিত হয়। হযরত হুসাইন (রাঃ)-এর শাহাদাতের হৃদয়বিদারক ঘটনা এখানেই সংঘটিত হয়। এখানেই জন্ম হয়েছে সকল বড় বড় ফেরকার। বনী উমাইয়া এবঙ পরে বনী আব্বাসীয়রা তাদের বিরোধী শক্তিকে দমন করার জন্য এখানেই সবচেয়ে বেশী কঠোরতা অবলম্বন করে।
অনৈক্য, বিচ্ছিন্নতা ও মতবিরোধের এ যুগে যে অসংখ্য ফেরকার উদ্ভব হয়, মূলত এ সবের মূলে ছিল ৪টি বড় ফেরকাঃ শী’আ, খারেজী, মুর্জিয়া এবং মু’তাযিলা। আমরা অতি সংক্ষেপে এখানে প্রতিটি ফেরকার মতবাদের সঙক্ষিপ্ত সার বিবৃত করবো।
শীআ’
হযরত আলী (রাঃ)-এর সমর্থক দলকে প্রথমে শীআ’নে আলী বলা হতো। পরে পরিভাষা হিসেবে এ দলকে কেবল শীআ’ বলা হতে থাকে।
বনী হাশেমের কিছু লোক এবং অন্যদের মধ্যেও এমন কিছু লোক ছিল, যারা নবী করীম (সঃ)-এর পরে হযরত আলী (রাঃ)-এর খেলাফতের জন্য যোগ্যতর ব্যক্তি মনে করতেন। অনেকের এ ধারণাও ছিল যে, তিনি অন্যান্য সাহাবা, বিশেষ করে হযরত ওসমান (রাঃ) থেকে শ্রেষ্ঠ। এমনও কেউ কেউ ছিল, যারা নবী (সঃ)এর সঙ্গে আত্মীয়তার কারণে তাঁকে খেলাফতের অধিক হকদার মনে করতো। কিন্তু হযরত োসমান (রাঃ)-এর সময় পর্যন্ত এ ধারণাগুলো কোন সম্প্রদায়কত বিশ্বাসের আকার ধারণ করেনি। এহেন চিন্তাধারার লোকেরা তাদের সময়ের খলীফাদের বিরোধীও ছিল না। বরং তারা প্রথম তিন খলীফারই ফেলাফত স্বীকার করতেন।
জামাল যুদ্ধে তালহা (রাঃ) ও যোবায়ের (রাঃ)-এর সঙ্গে, সিফফীন যুদ্ধে হযরত মুআ’বিয়া (রাঃ)-এর সঙ্গে এবং নাহরাওয়ান যুদ্ধে খারেজীদের সঙ্গে হযরত আলী (রাঃ)-এর বিরোধীকালে বিশেষ মতবাদ সম্বলিত একটা দলের উদ্ভব হয়। অতঃপর হযরত হুসাইন (রাঃ)-এর শাহাদাত এদেরকে আরো সংঘবদ্ধ করে, এদের উৎসাহে ইন্ধন যোগায়-শক্তি দান করে। তাদের মতবাদ কে একটা সুস্পষ্ট কাঠামো দেয়। এ ছাড়াও বনী উমাইয়াদের শাসন পদ্ধতির ফলে তাদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের মধ্যে যে ঘৃণা বিস্তার লাভ করে এবং উমাইয়া-আব্বাসীয়দের যুগে আলী (রাঃ)-এর বংশধর এবং তাদের সমর্থকদের প্রতি অত্যাচার অনাচারের ফলে মুসলমানদের হৃদয়ে যে সমবেদনার উদ্ভব হয়, তা শীআ’দের দাওয়াতকে অসাধারণ শক্তি যোগায়। কুফা ছিল এদের সবচেয়ে শক্তিশালী কেন্দ্র। এদের বিশেষ মতবাদ ছিল এইঃ
একঃ ইমামত (খেলাফতের পরিবর্তে এটা তাদের বিশেষ পরিভাষা) জনসাধারণের বিবেচ্য বিষয় নয়। ইমাম নির্বাচনের দায়িত্বভার জনগণের হাতে ন্যস্ত করা যায় না। জনসাধারণ ইমাম বানালেই কোন ব্যক্তি ইমাম হয়ে যাবে না। বরং ইমামত দ্বীনের একটি অঙ্গ, ইসলামের একটি মৌলিক ভিত্তি। ইমাম নির্বাচনের ভার জনগণের হাতে ন্যস্ত না করে বরং সুষ্পষ্ট নির্দেশের সাহায্যে ইমাম নিযুক্ত করা, নবীর অন্যতম দায়িত্ব। [ইবনে খালদুন, আল-মুকাদ্দিমা, পৃষ্ঠা-১৯৬, মুস্তফা মুহাম্মাদ প্রেস, মিসর। আশশাহরিসতানী, কিতাবুল মিলাল ওয়ান নিহাল, লণ্ডন সংস্করণ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১০৮-১০৯।]
দুইঃ ইমামকে মা’সুম-নিষ্পাপ হতে হবে। অর্থাৎ তাকে ছোট-বড় সকল পাপ থেকে মুক্ত হতে হবে, হতে হবে তা থেকে সংরক্ষিত। তার দ্বারা কোন ভুল-ভ্রান্তি হতে পারবে না। তার সকল কথা এবং কাজ সত্য হতে হবে। [ইবনে খালদুন, পৃষ্ঠা-১৯৬। আশ-শাহরিস্তানী, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১০৯।]
মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় মতবিরোধের সূচনা ও তার কারণ
তিনঃ রাসুলুল্লাহ (সঃ) হযরত আলী (রাঃ)-কে তাঁর পরে ইমাম মনোনীত করেছেন। স্পষ্ট শরীয়াতের নির্দেশ মতে তিনি ইমাম। [আশ্-শাহরিস্তানী, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১০৮। ইবনে খালদুন, পৃষ্ঠা-১৯৬-১১৭।]
চারঃ পূর্ববর্তী ইমামের নির্দেশক্রমে প্রত্যেক ইমামের পরে নতুন ইমাম নিযুক্ত হবেন। কারণ, এ পদে নিয়োগের দায়িত্ব উম্মাতের হাতে ন্যস্ত হয়নি। তাই মুসলমানদের নির্বাচনক্রমে কোন ব্যক্তি ইমাম হতে পারবে না। [ইবনে খালদুন, পৃষ্ঠা-১৯৭, আল-আশআ’রীঃ মাকালাতুল ইসরামিইঈন, আন-নাহতাতুল মিসরিয়া লাইব্রেরী, কায়রো, ১ম সংস্করণ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৮৭। আশ্-শাহরিস্তানী, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১০৯।]
পাঁচঃ ইমামত কেবল আলী (রাঃ)-এর বংশধরদেরই হক- কেবল তাদেরই প্রাপ্য। শী’আদের সকল দল-উপদল এ ব্যাপারে একমত। [আশ্-শাহরিস্তানী, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১০৮।]
“এ সর্বসম্মত মতের পরে শীআ’দের বিভিন্ন উপদলের মধ্যে মত-পার্থক্য দেখা দেয়। মধ্যপন্থী শীআ’দের মতে হযরত আলী (রাঃ) সকল মানুষের মধ্যে উত্তম ব্যক্তি। যে ব্যক্তি তার সাথে লড়াই করে বা বিদ্বেষ পোষণ করে, সে আল্লার দুশমন। সে চিরকাল দোযখে বাস করবে। কাফের মুনাফিকদের সাথে তার হাশর হবে। আবু বকর, ওমর এবং োসমান (রাযিয়াল্লাহু আনহুম)-যাদের তাঁর পূর্বে ইমাম বানান হয়েছে, হযরত আলী (রাঃ) তাঁদের খেলাফত অস্বীকার করলে এবং তাঁদের প্রতি অসন্তুষ্টি প্রকাশ করলে আমরাবলতাম যে, তিনিো দোযখী। কিন্তু তিনি যেহেতু তাঁদের নেতৃত্ব মেনে নিয়েছেন, তাঁদের হাতে বায়আত গ্রহণ করেছেন, তাঁদের পিছনে সালাত আদায় করেছেন, তাই আমরা তাঁর কার্যকে অস্বীকার করে অগ্রসর হতে পারি না। আলী (রাঃ) এবঙ নবী (সঃ)-এর মধ্যে আমরা নবুয়াতের মর্যাদা ছাড়া অন্য কোন পার্থক্য করতে পারি না। অন্যসব ব্যাপারে আমরা তাঁকে নবীর সমমর্যাদা দেই। [ইবনু আবিল হাদীদ, নাহজুল বালাগার ভাষা, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা-৫২০।]
চরমপন্থী শীআ’দের মতে হযরত আলী (রাঃ)-এর পূর্বে যেসব খলীফা খেলাফত গ্রহণ করেছেন, তারা ছিনতাইকারী। আর যারা তাদেরকে খলীফা বানিয়েছেন, তারা হুমরাহ ও যালেম। কারণ, তাঁরা নবীর ওসিয়্যাত অস্বীকার করেছে, সত্যিকার ইমামকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। এদের কেউ কেউ আরও কঠোরত্ম অবলম্বন করে প্রথম তিন খলীফা এবঙ যারা তাঁদেরকে খলীফা বানিয়েছে, তাদের কাফেরও বলে।
এদের মধ্যে সবচেয়ে নরম মত হচ্ছে যায়দিয়াদের। এরা যায়েদ ইবনে আলী ইবনে হুসাইন (ওফাতঃ ১২২ হিজরী-৭৪০ ঈসায়ী)-এর অনুসারী। এরা হযরত আলী (রাঃ)-কে উত্তম মনে করে কিন্তু, এদের মতে উত্তমের উপস্থিতিতে অ-উত্তম ব্যক্তির ইমাম হোয়া অবৈধ নয়। উপরন্তু এদের মতে হযরত আলী (রাঃ)-এর স্বপক্ষে স্পষ্টত এবং ব্যক্তিগতভাবে রাসুলুল্লাহ-এর কোন নির্দেশ ছিল না। তাই এরা হযরত আবুবকর ও ওমর (রাঃ)-এর খেলাফত স্বীকার করতো। তবুও এদের মতে ফাতেমার বংশধরদের মধ্য কোন যোগ্য ব্যক্তির ইমাম হওয়া উচিত। তবে এ জন্য শর্ত এই যে, তাকে বাদশাদের বিরুদ্ধে ইমামতের দাবী নিয়ে দাঁড়াতে হবে এবং ইমামতের দাবী করতে হবে। [আল-আশআ’রী, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১২৯। ইবনে খালদুন, পৃষ্ঠা-১৯৭-১৯৮। আশ্-শাহরিস্তানী, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১১৫-১১৭।]
খারেজী
শীআ’ মতবাদের সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী মতবাদের অধিকারী দলটি ছিল খারেজী। সিফফীন যুদ্ধকালে হযরত আলী (রাঃ) এবং হযরত মুআ’বিয়া (রাঃ) যখন নিজেদের মতবিরোধ নিরসনে দুজন লোককে সালিস নিযুক্তিকে সম্মত হন, ঠিক সে সময় এ দলের উদ্ভব হয়। তখন পর্যন্ত এরা হযরত আলী (রাঃ)-এর সমর্থক ছিল। কিন্তু সালিস নিযুক্তির বিষয়কে কেন্দ্র করে হঠাৎ এরা বিগড়ে যায়। এরা বলেঃ আল্লার পরিবর্তে মানুষকে ফায়সালাকারী স্বীকার করে আপনি কাফের হয়ে গেছেন। অতঃপর এরা আপন মতবাদের ব্যাপারে অনেক দূর এগিয়ে যায়। যেহেতু এরা ছল চরম কঠোর মনোভাব সম্পন্ন। উপরন্তু এরা নিজেদের থেকে ভিন্ন মতবাদ পোষণকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা এবং যালেম সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ ঘোষণার সমর্থক ছিল, তাই দীর্ঘকাল পর্যন্ত এরা খুন-খারাবী চালিয়ে যেতে থাকে। শেষ পর্যন্ত আব্বাসীয় শাসনামলে এদের শক্তি নির্মুল হয়ে যায়।
এদেরও সবচেয়ে বেশী শক্তি ছিল ইরাকে। বসরা এবং কুফার মধ্যবর্তী ‘আল-বাতায়েহ’ নামক স্থানে এদের বড় বড় আখড়া ছিল। এদের মতবাদের সংক্ষিপ্তসার নিম্নরূপঃ
একঃ এরা হযরত আবুবকর (রাঃ) এবং হযরত ওমর (রাঃ)-এর খেলাফতকে বৈধ স্বীকার করতো। কিন্তু এদের মতে খেলাফতের শেষের দিকে হযরত ওসমান (রাঃ) ন্যায় এবং সত্যচ্যুত হয়েছেন। তিনি হত্যা বা পদচ্যুতির যোগ্য ছিলেন। আল্লাহ ছাড়া মানুষকে সালিস নিযুক্ত করে হযরত আলী (রাঃ)-ও কবীরা গুনাহের ভাগী হয়েছেন। উপরন্তু উভয় সালিস অর্থাৎ হযরত আমর ইবনুল আ’স, এদেরকে সালিস নিযুক্তকারী অর্থাৎ হযরত আলী (রাঃ) এবং মুআ’বিয়া ও এদের সালিসীতে সন্তুষ্ট বক্তিবর্গ অর্থাৎ আলী (রাঃ)-এবং মুআ’বিয়া (রাঃ)-এর সকল সাথীই গুনাহগার ছিল। হযরত তালহা যোবায়ের এবং উম্মুল মু’মেনীন হযরত আয়েশা (রাঃ) সমেত জামাল যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকলেই বিরাট পাপের ভাগী ছিলেন।
দুইঃ তাদের মতে পাপ কুফরীর সমার্থক। সকল কবীরা গুণাহকারীকে এরা কাফের বলে আখ্যায়িত করে (যদি তারা তাওবা করে গুণাহ থেকে প্রত্যাবর্তন না করে)। তাই, ওপরে যেসব বুযর্গের উল্লেখ করা হয়েছে, এরা তাঁদের সকলকেই প্রকাশ্যে কাফের বলতো। বরং তাঁদেরকে অভিসম্পাত করতে এবং গালী-গালাজ করতেও এরা ভয় পেতো না, উপরন্তু সাধারণ মুসলমানকেও এরা কাফের বলতো। কারণ প্রথমত, তারা পাপমুক্ত নয়। দ্বিতীয়ত, পূর্বোক্ত সাহাবীদেরকে তারা কেবল মু’মিনই স্বীকার করতো না, বরং নিজেদের নেতা বলেও গ্রহণ করতো। তাদের বর্নীত হাদীস থেকে শরীয়াতের বিধানও প্রমাণ করেন।
তিনঃ খেলাফত সম্পর্কে তাদের মত এই ছিল যে, কেবল মুসলমানদের স্বাধীন মতামতের ভিত্তিতেই তা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় মতবিরোধের সূচনা ও তার কারণ
চারঃ শলীফাকে কুরাইশী বংশোদ্ভুত হতেই হবে এ কথা তারা স্বীকার করতো না। তারা বলতো, কুরাইশী, অ-কুরাইশী-যাকেই মুসলমানরা নির্বাচিত করে, সে-ই বৈধ খলীফা।
পাঁচঃ তারা মনে করতো যে, খলীফা যতক্ষণ ন্যায় এবং কল্যাণের পথে অটল-অবিচল থাকে, ততক্ষণ তার আনুগত্য ওয়াজেব। কিন্তু সে যদি এ পথ থেকে বিচ্যুত হয় তখন তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা, তাকে পদচ্যুত এবং হত্যা করাও ওয়াজেব।
ছয়ঃ কুরআনকে তারা ইসলামী আইনের মৌলিক উৎস হিসেবে মানতো। কিন্তু হাদীস এবং ইজমার ক্ষেত্রে তাদের মত সাধারণ মুসলমান থেকে স্বতন্ত্র ছিল।
এদের একটি বড় দল-যাদেরকে আন-নাজদাত বলা হয়-মনে করতো যে, খেলাফত কথা রাষ্ট্র-সরকার প্রতিষ্ঠা আদতেই অপ্রয়োজনীয়-এর কোন দরকার নেই। মুসলমানদেরকে নিজেদের পক্ষ থেকে সামাজিক ভারবে কাজ করা উচিত। অবশ্য তারা যদি খলীফা নির্বাচন করার প্রয়োজন উপলব্ধি করে, তা-ও করতে পারে তারা। এমনটি করাও জায়েজ-বৈধ।
এদের সবচেয়ে বড় দল আযারেকা নিজেদের ছাড়া অন্য সকল মুসলমানকে মুশরিক বলতো। এদের মতে নিজেদের ছাড়া আর কারো আযানে সাড়া দেয়া খারেজীদের জন্য জায়েয নয়। অন্য কারো জবাই করা পশু তাদের জন্য হালাল নয়; কারো সাথে বৈবাহিক সম্পর্কও জায়েয নয়। খারেজী আর অ-খারেজী একে অন্যের উত্তরাধিকরী হতে পারে না। এরা অন্য সব মুসলমানের বিরুদ্ধে জিহাদকে ফরযে আইন মনে করতো। তাদের স্ত্রী-পুত্র হত্যা করা এবং ধন-সম্পদ লুন্ঠন করাকে ’মোবাহ’ মনে করতো। তাদের নিজেদের মধ্যকার যেসব লোক এ জিহাদে অংশগ্রহণ করে না, তাদেরকেও কাফের মনে করতো। তারা তাদের বিরোধীদের ধন-সম্পদ আত্মসাত করাকে হালাল মনে করতো। মুসলমানদের প্রতি তাদের কঠোরতা এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে, মুসলমানদের তুলনায় তাদের কাছে অমুসলিমরা অধিক নিরাপত্তা লাভ করতো।
এদের সবচেয়ে নমনীয় দল ছিল ইবাদিয়া। এরা সাধারণ মুসলমানকে কাফের বললেও মুশরিক বলা থেকে বিরত থাকতো। তারা বলতো ‘এরা মু’মিন নয়।‘ অবশ্য তারা মুসলমানদের সাক্ষ্য গ্রহণ করতো। এদের সাথে বিবাহ-শাদী এবং উত্তরাধিকারীকে বৈধ জ্ঞান করতো। এরা তাদের অঞ্চলকে দারুল কুফর বা দারুল হারব নয়, বরং দারুত-তাওহীদ মনে করতো। অবশ্য সরকারের কেন্দ্রকে এরা দারুত-তাওহীদ মনে করতো না। গোপনে মুসলমানদের ওপর আক্রমণ করাকে তারা অবৈধ মনে করতো। অবশ্য প্রকাশ্যে যুদ্ধকে তারা বৈধ মনে করতো। [বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুনঃ আবদুল কাহের বাগদাদীঃ আল-ফারকু বাইনাল ফেরাক, আল-মায়ারেক প্রেস, মিসর, পৃষ্ঠা-৫৫, ৬১,৬৩, ৬৪, ৬৭, ৬৮, ৮২, ৮৩, ৯৯, ৩১৩, ৩১৪ এবং ৩১৫।
আশ্-শাহরিস্তানী, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭৮, ৯০, ৯১, ৯২ এবং ১০০।
আল-আশআ’রী, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৫২, ১৫৭, ১৫৯, ১৮৯, ১৯০। আল-মাসউদী, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৯১।]
মুর্জিয়া
শিআ’ এবং খারেজীদের চরম পরস্পর-বিরোধী মতবাদের প্রতিক্রিয়া একটি তৃতীয় দলের আকারে প্রকাশ পেয়েছে। এ দলটিকে মুর্জিয়া বলে অভিহত করা হয়। হযরত আলী (রাঃ)-এর বিভিন্ন যুদ্ধের ব্যাপারে কিছু লোক তাঁর পূর্ণ সমর্থক এবং কিছু লোক তার চরম বিরোধী ছিল। একটি দল নিরপেক্ষও ছিল। এরা গৃহযুদ্ধকে ফেতনা মনে করে দূরে সরে ছিল অথবা এ ব্যাপারে কে ন্যায়ের পথে আর কে অন্যায়ের পথে আছে এ সম্পর্কে সন্ধিগ্ধ ছিল। মুসলমানদের পরস্পরের মধ্যে খুন-খারাবী একটি বিরাট অন্যায়-এ কথা তারা অবশ্যই উপলব্ধি করতো। কিন্তু এরা সংষর্ষে লিপ্ত কাউকে খারাপ বানাতে প্রস্তুত ছিল না। তারা ্র বিষয়ের ফায়সালা আল্লার হাতে ছেড়ে দিতো- কিয়ামতের দিন তিনিই ফায়সালা করবেন, কে ন্যায়ের পথে আছে আর কে অন্যায়ের পথে এ পর্যন্ত তাদের চিন্তাধারা সাধারণ মুসলমানদের চিন্তাধারা বিরোধী ছিল না। কিন্তু শি’আ এবং খারেজীরা যখন তাদের চরম মতবাদের ভিত্তিতে কুফরী আর ঈমানের প্রশ্ন উঠাতে শুরু করে এবং তা নিয়ে ঝগড়া ও তর্ক-বিতর্কের সিলসিলা শুরু হয় তখন এ নিরপেক্ষ দলটিও নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গির স্বপক্ষে স্বতন্ত্র ধর্মীয় দর্শন দাঁড় করায়। এদের ধর্মীয় দর্শনের সার সংক্ষেপ এইঃ
একঃ কেবল আল্লাহ এবং রাসূলের মা’রেফাতের নামই ঈমান। আমল ঈমানের মূলতত্ত্বের পর্যায়ভুক্ত নয়। তাই, ফরয পরিত্যাগ এবং কবিরা গুণাহ করা সত্ত্বেও একজন লোক মুসলমান থাকে।
দুইঃ নাজাত কেবল ঈমানের ওপর নির্ভরশীল। ঈমানের সাথে কোন পাপাচার মানুষের ক্ষতি করতে পারে না। কেবল শিরক থেকে বিরত থেকে তাওহীদ বিশ্বাসের ওপর মৃত্যু বরণই মানুষের নাজাতের জন্য যথেষ্ট। [আশ্-শাহরীস্তানী, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১০৩, ১০৪, আল-আশআ’রী, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৯৮, ২০১।]
কোন কোন মুর্জিয়া আরও একটু অগ্রসর হয়ে বলে যে, শিরক থেকে নিকৃষ্ট যতবড় পাপই করা হোক না কেন, অবশ্যই তা ক্ষমা করা হবে। [আশ্-শাহরিস্তানী, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১০৪।] কেউ কেউ আরও এক ধাপ অগ্রসর হয়ে বলে যে, মানুষ যদি অন্তরে ঈমান পোষণ করে এবং সে যদি দারুল ইসলামেও বসে-যেখানে কারো পক্ষ থেকে কোন আশংকা নেই-মুখ কুফরী ঘোষণা করে, বা মুর্তি পূজা করে বা ইয়াহুদীবাদ-খৃষ্টবাদ গ্রহণ করে-এতদসত্ত্বেও সে কামেল ইমানদার, আল্লার ওলী এবং জান্নাতী। [ইবনে হাযমঃ আল-ফসল ফিল মিলাল ওয়ান নিহাল, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা-২০৪ আলমাতবাআতুল আদাবীয়্যা, মিসর, ১৩১৭ হিজরী।]
এসব চিন্তাধারা পাপাচার ফাসেকী ও অশালীন কার্যকলাপ এবং যুলুম নির্যাতনকে বিরাট উৎসাহ যুগিয়েছে। মানুষকে আল্লার ক্ষমার আশ্বাস দিয়ে পাপাচারে উৎসাহী করে তুলেছে।
এ চিন্তাধারার কাছাকাছি আর একটি দৃষ্টিভঙ্গি একটি দৃষ্টিভঙ্গি এই ছিল যে, আমর বিল মা’রুফ এবং নাহী আনিল মুনকার-ভাল কাজের নির্দেশ এবং খারাপ কাজে নিষেধ-এর জন্য যদি অস্ত্র ধারণের প্রয়োজন দেখা দেয়-তাহলে এটা একটা ফেতনা। সরকার ছাড়া অন্যদের খারাপ কাজে বাধা দেয়া নিঃসন্দেহে জায়েয-কিন্তু সরকারের যুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে মুখ খোলা জায়েয নয়। [আল-জাসসাসঃ আহকামুল কুরআন, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৪০।] আল্লামা আবুবকর জাসসাস এ জন্য অত্যন্ত কঠোর ভাষায় অভিযোগ করে বলেন, এসব চিন্তা যালেমের হস্ত সুদৃঢ় করেছে। অন্যায় এবং ভ্রান্তির বিরুদ্ধে মুসলমানদের প্রতিরোধ শক্তিকে মারাত্মক মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
মু’তাযিলা
এ সংঘাত মুখর যুগে একটি চতুর্থ মতবাদও জন্ম নেয়। ইসলামের ইতিহাসে যা ইতিযাল নামে অভিহিত। অবশ্য প্রথম তিনটি দলের মতো তিনটি দলের মতো এ দলের জন্মও নিরেট রাজনৈতিক কার্যকারণের পরিণতি ছিল না। তা সত্ত্বেও এ দলটি সমকালীন রাজনৈতিক সমস্যার ব্যাপারে কতিপয় সুস্পষ্ট দর্শন উপস্থাপিত করেছে; মতবাদ এবং চিন্তাধারার লড়াইয়ে অত্যন্ত সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেছে। সমকালীন রাজনৈতিক কার্যকারণের ফলে সারা মুসলিম জাহানে, বিশেষ করে ইরাকে যে মতবাদের দ্বন্দ্ব চলছিল, তাতে তারা শক্তিশালী ভূমিকা নিয়েছ্ ও মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা ছিল ওয়াসেল ইবনে আতা (৮০-১৩১ হিজরীঃ ৬৯৯-৭৪৮ ঈসায়ী) এবং আমর ইবনে ওবায়েদ (মৃত্যুঃ ১৪৫ হিজরী-৭৬৩ ঈসায়ী)। প্রথম দিকে বসরা ছিল এদের আলোচনার কেন্দ্রস্থল।
এদের রাজনৈতিক মতবাদের সার-সংক্ষেপ এইঃ
একঃ এদের মতে ইমাম নিযুক্তি অর্থাৎ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা শরীয়াতের দৃষ্টিতে ওয়াজেব। আবার কোন কোন সময় মু’তাযিলার মতে ইমামের আদৌ কোন প্রয়োজনই নেই। উম্মাত নিজে যদি ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকে, তাহলে ইমাম নিযুক্তি অর্থহীন। [আল-মাসউসী, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৯১।]
দুইঃ এদের মতে ইমাম নির্বাচনের ভার উম্মাতের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। উম্মাতের নির্বাচনক্রমেই ইমামত প্রতিষ্ঠিত হয়। [আলমাসউদী, ২য় খণ্ড পৃষ্ঠা-১৯১।] কোন কোন মু’তাযিলা অতিরিক্ত শর্ত আরোপ করে বলে যে, ইমামত কায়েম করার জন্য সমস্ত উম্মাতের একমত হওয়া প্রয়োজন। বিপর্যয় এবং মতভেদের পরিস্থিতিতে ইমাম নিযুক্ত করা যায় না। [আশ্-শাহরিস্তানী, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৫১।]
তিনঃ এদের মতে উম্মাত নিজের ইচ্ছামতো যে কোন সৎ এবং যোগ্য মুসলমানকে ইমাম বানাতে পারে। এ ব্যাপারে কুরায়শী, অ-কুরায়শী, আরবী বা আজমীর কোন শর্ত নেই। [আল-মাসউদী, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৯১।] কোন কোন মু’তাযিলা আরও অগ্রসর হয়ে বলে যে, আজমীকে ইমাম করাই শ্রেয়। বরং মুক্ত ক্রীতদাসকে ইমাম করা হলে তা আরও উত্তম। কারণ, ইমামের সমর্থক সংখ্যা অধিক না থাকলে যুলুম-নির্যাতন কালে তাকে অপরারণ করা সহজ হবে। [আশ্-শাহরিস্তানী, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৬৩।] যেন সরকারকে স্থিতিশীল করার তুলনায় শাসকদেরকে কিভাবে সহজে অপসারণ করা যায় সেই চিন্তাই এদের বেশী।
চারঃ এদের মতে দুষ্কৃতিকারী ইমামের পেছনে সালাত জায়েয নয়। [আল-আশআ’রী, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-১২৪।]
পাঁচঃ আমর বিল মারুফ এবং নিহী আনিল মুনকার-ভাল কাজের নির্দেশ এবং মন্দ কার্য থেকে বারণও এদের অন্যতম মুলনীতি। বিদ্রোহের ক্ষমতা থাকলে এবং বিপ্লব সফল করার সম্ভাবনা থাকলে অন্যায়-অত্যাচারী সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকে এরা ওয়াজেব মনে করতো। [আল-আশআ’রী, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-১২৫।] এ কারণে এরা উমাইয়া খলীফা ওয়ালীদ ইবনে ইয়াযীদ (১২৫-১২৬ হিজরীঃ ৭৪৩-৭৪৪ ঈসায়ী)-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহে এরা অংশ গ্রহণ করে। এবং তাঁর পরিবর্তে ইয়াযীদ ইবনে ওয়ালীদকে ক্ষমতাসীন করার চেষ্টা করে। কারণ, তিনি তাদের সমমনা মুতাযিলা মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। [আল-মাসউদী, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৯০, ১৯৩, আস্ সুয়ুতীঃ তারীখুল খুলাফা, পৃষ্ঠা-২৫৫, গবর্ণমেন্ট প্রেস, লাহোর ১৮৭০ ঈসায়ী।]
ছয়ঃ খারেজী এবং মুর্জিয়াদের মধ্যে কুফর এবং ঈমানের ব্যাপারে যে বিরোধ চলে আসছিল, সে ব্যাপারে এদের নিজস্ব ফায়সালা এই ছিল যে, পাপী মুসলমান মু’মিনও নয়, কাফেরও নয়; বরং এ দু’য়ের মাঝামাঝি অবস্থায় থাকে। [আল-ফারকু বাইনাল ফেরাক, পৃষ্ঠা-৯৪-৯৫।]
এসব মতবাদ ছাড়াও সাহাবাদের মতবিরোধ এবং অতীত খেলাফতের ব্যাপারেও এরা নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করে। ওয়াসেল ইবনে আ’তার উক্তি ছিলঃ জামাল এবং সিফফীন যুদ্ধের পক্ষ দ্বয়ের মধ্যে কোনও এক পক্ষ ফাসেক ছিল। কিন্তু কোন পক্ষ ফাসেকী কাজ করেছিল, তা নিশ্চিত করে বলা চলে না। এর কারণে এরা বলতো যে, আলী, তালহা এবং যোবায়ের (রাঃ) যদি এক আঁটি তরকারীর ব্যাপারেও সাক্ষ্য দেয়, তাহলেও আমি এদের সাক্ষ্য গ্রহণ করবো না। কারণ, এদের ফাসেক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আমর ইবনে ওবায়েদের মতে উভয় পক্ষই ফাসেক ছিল। [আল-ফারুক বাইনাল ফেরাক, পৃষ্ঠা-১০০, ১০১, আশ-শাহরিস্তানী, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩৪।] এরা হযরত ওসমান (রাঃ)-এরও কঠোর সমালোচনা করে। এমনকি এদের কেউ কেউ হযরত ওমর (রাঃ)-কেও গাল-মন্দ দেয়। [ঐ, পৃষ্ঠা-১৩৩-১৩৪, আশ-শাহরিস্তানী, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৪০।] এছাড়াও অনেক মু’তাযিলা ইসলামী আইনের উৎসের মধ্য থেকে হাদীস এবং ইজমাকে প্রায় বাতিলই করে। [ঔ, পৃষ্ঠা-১৩৮-১৩৯।]
বৃহত্তম অংশের অবস্থা
এ সব দ্বন্দ্ব মুখর এবং চরমপন্থী দলগুলোর মধ্যে মুসলমানদের বৃহত্তম অংশ খোলাফায়ে রাশেদীনের আমল থেকে যেসব মূলনীতি ও আদর্শ সর্বসম্মতভাবে চলে আসছিল সেগুলোর ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। সাধারণত সাহাবা-তাবেঈন এবং সাধারণ মুসলমানরা শুরু থেকে সেগুলোকেই ইসলামী মূলনীতি ও আদর্শ মনে করতেন। মুসলিম জনগোষ্ঠীর বড়জোর শতকরা ৮/১০ জন এর ফেরকাবাদীতে প্রভাবিত হয়েছে। অবশিষ্ট সকলেই ছিল গণমানুষের চিন্তা-বিশ্বাসের ওপর অটল-অবিচল।
কিন্তু মতবিরোধের যুগ শুরু হওয়ার পর থেকে ইমাম আবু হানীফা (রঃ)-এর সময় পর্যন্ত কেউই বিরোধপূর্ণ বিষয়ে সাধারণ মুসলমানদের মতামত যথারীতি ব্যাখ্যা করেননি। কেউ তাকে একটা স্বতন্ত্র চিন্তাধারার রূপ দেননি। বরং বিভিন্ন ফকীহ মুহাদ্দিস বিভিন্ন উপলক্ষে তাদের উক্তি, ফতোয়া, বর্ণনা-ঐতিহ্য এবং কর্মধারার মাধ্যমে বিক্ষিপ্তভাবে ইসলামী চিন্তাধারার ব্যাখ্যা করেছেন।
সপ্তম অধ্যায়
ইমাম আবু হানীফা (রঃ)
ইতিপূর্বে আমরা আলোচনা করেছি যে, রাজতন্ত্রের সূচনার সাথে সাথে নেতৃত্ব দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। একঃ রাজনৈতিক নেতৃত্ব শাসক শ্রেণীর হাতে ছিল এর চাবিকাঠি। দুইঃ দ্বীনি নেতৃত্ব উম্মাতের আলেম সমাজ এবং সত্যনিষ্ঠ লোকেরা এ নেতৃত্ব গ্রহণ করে। নেতৃত্বের এহেন বিভক্তির কার্যকারণ এবং তার ফলাফল সম্পর্কে ইতিপূর্বে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এ বিভক্তির যুগে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ধরন-প্রকৃতি কিরূপ ছিল, তাও উল্লেখ করেছি। যারা উম্মাতের দ্বীনি নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন, তাঁরা কেমন ছিলেন, সে সময়ে উদ্ভুত সমস্যাগুলো তাঁরা কিভাবে সমাধান করেছিলেন, এমন এক নযরে আমরা তা দেখতে চাই। এ উদ্দেশ্যের জন্যে ইমাম আবু হানীফা (রাঃ)-কে দ্বীনি নেতৃত্বের একজন প্রতিনিধি হিসেবে গ্রহণ করে এখানে তাঁর কার্যাবলী পেশ করবো। তাঁর ছাত্র ইমাম আবু ইউনুফ (রাঃ) কিভাবে তাঁর কার্য সমাপ্ত করেছিলেন, অতঃপর আমরা তা-ও উল্লেখ করবো।
সংক্ষিপ্ত জীবনেতিহাস
তাঁর নাম ছিল নোমার ইবনে সাবেত। নির্ভরযোগ্য বর্ণনা মতে হিজরী ৮০ সালে (৬৯৯ কৃষ্টাব্দ) কুফায় তাঁর জন্ম। আবদুল মালেক ইবনে মারওয়ান তখন উমাইয়া খলীফা। আর হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ ইরাকের গবর্ণর। তিনি তাঁর জীবনের ৫২ বছর উমাইয়াদের শাসন কালে এবং ১৮ বছর আব্বাসীয়দের শাসনামলে কাটান, হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফের মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল ১৫ বছর। ওমর ইবনে আবদুল আযীযের যমানায় তিনি তরুণ। ইয়াযীদ ইবনুল মুহাল্লাব, খালেদ ইবনে আবদুল্লাহ আল-কাসরী এবং নসর ইবনে সাইয়্যার প্রমুখ ইরাকের শাসনকর্তাগণের ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ শাসন কালে তাঁর চোখের সামনে কেটেছে। উমাইয়াদের শেষ গবর্ণর ইবনে হুরায়রার যুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তিনি নিজে। আর তাঁর সামনেই আব্বাসীয় আন্দোলনের সূচনা হয়। তাঁর নিজের শহর কুফা ছিল এ আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল। বাগদাদ প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত কুফাই ছিল কার্যত নব উদ্ভুত আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের কেন্দ্রের মর্যাদায় অভিষিক্ত। খলীফা মনসুরের শাসনামলে হিজরী ১৫০ সালে (৭৬৭ খৃষ্টাব্দে) তিনি ইন্তেকাল করেন।
তাঁর খান্দান প্রথমত ছিল কাবুলের অধিবাসী। তাঁর দাদা-যার নাম কেউ যাওতা আর কেউ যুতা লিখেছেন-যুদ্ধ বন্দী হয়ে কুফায় নীত হন এবঙ মুসলমান হয়ে বনী তাইমুল্লা গোত্রের পৃষ্ঠপোষকতায় (Patronage) এখানে অবস্থান করেন। ব্যবসায় ছিল তাঁর পেশা। হযরত আলী (রাঃ)-এর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। তাঁর সাথে এতদুর সম্পর্ক ছিল যে, তিনি কখনো কখনো তাঁর কাছে হাদিয়া (উপঢৌকন) পাঠাতেন। [আল-কারদারীঃ মানাকেবুল ইমামিল আ’যাম, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৬৫-৬৬, ১ম সংস্করণ, ১৩২১ হিজরী, দায়েরাতুল মাআ’রেফ হায়দারাবাদ। তাঁর পুত্র সাবেত (ইমাম আবু হানিফার পিতা)-ও কুফায় ব্যবসা করতেন। স্বয়ং ইমামের এক বর্ণনায় জানা যায় যে, কুফায় তাঁর রুটির দোকান (Bakery) ছিল। [আল-মাক্কী, আল-মুয়াফফাক ইবনে আহমাদ, মানাকেবুল ইমামিল আ’যাম আবি হানীফা, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৬২, ১ম সংস্করণ, ১৩২১ হিজরী, দায়েরাতুল মাআ’রেফ, হায়দারাবাদ।
ইমামের শিক্ষা সম্পর্কে তাঁর নিজের বর্ণনা এই যে, প্রথমত তিনি কেরাআত, হাদীস, আরবী ব্যাকরণ, সাহিত্য, কাব্য, কালাম শাস্ত্র ইত্যাদি যে সময়ের প্রচলিত সকল জ্ঞানই অধ্যয়ন করেন। [আল-মাক্কী, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৫৭-৫৮।] অতঃপর তিনি কালাম শাস্ত্রে বিশেষ ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন এবং দীর্ঘদিন ধরে এর সাথে সংশ্লিষ্ট থেকে এতটুকু পর্যন্ত উন্নতি করেন যে, এ বিষয়ে তাঁর দিকে সবাই দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে শুরু করে। তাঁর প্রসিদ্ধ শাগরিদ যুফার ইবনুল হোযাইলের বর্ণনা মতে ইমাম তাঁকে বলেনঃ প্রথম কালাম শাস্ত্রের প্রতি আমার আসক্তি ছিল। এতে আমি এমন পর্যায়ে উপস্থিত হয়েছিলাম যে, লোকেরা এ ব্যাপারে আমার প্রতি আঙ্গুলি নির্দেশ করতো। [আল-মাক্কা, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৫৫-৫৯।] অপর এক বর্ণনায় ইমাম নিজেই বলছেনঃ
’আমি এমন এক ব্যক্তি ছিলাম, ইলমে কালামের আলোচনায় যার দক্ষতা ছিল। এক সময় এমন ছিল যে, আমি এসব বিতর্ক আলোচনায় মশগুল থাকতাম। অধিকাংশ মতবিরোধের কেন্দ্রস্থল যেহেতু বসরায়ই ছিল, তাই আনুমানিক বিশ বার আমি সেখানে গিয়েছি। কখনো কখনো ছ’মাস-এক বছর যেখানে অবস্থান করে খারেজীদের বিভিন্ন দল-এবাযিয়া ছুফরিয়া ইত্যাদি ্রবেঙ হাশবিয়্যাদের নানা উপদলের সাথে বিতর্ক-যুদ্ধ করেছি। [আল-মাক্কা, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৫৯।]
এত্থেকে এ সিদ্ধান্তে উপনিত হওয়া যেতে পারে যে, তিনি তৎকালীন দর্শন, তর্কশাস্ত্র (মানত্বেক) এবং ধর্মীয় বিরোধ সম্পর্কিত বিষয়াবলীতেও অবশ্যই প্রচুর জ্ঞান লাভ করে থাকবেন। কারণ, এ ছাড়া কেউ কালাম শাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি অর্জন করতে পারে না। উত্তরকালে তিনি আইন শাস্ত্রে ন্যায়ানুগ যুক্তি প্রয়োগ এবং বুদ্ধি ব্যবহারের যে দক্ষতা দেখিয়েছেন, বড় বড় জটিল সমস্যা সমাধানে যে খ্যাতি অর্জন করেছেন, তা ছিল এ প্রাথমিক মানস গঠনের ফলশ্রুতি।
দীর্ঘদিন যাবৎ এ কাজে মশগুল থাকার পর কালাম শাস্ত্রের কুটতর্ক এবং বাদানুবাদের প্রতি তাঁর মন বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠে এবং তিনি ফিকাহ (ইসলামী আইন)-এর প্রতি মনযোগ দেন। এখানে স্বভাবত-ই আহলুল হাদীসদের চিন্তাধারার প্রতি তাঁর আসক্তি হতে পারেনি। তখন ইরাকের আসহাবুর রায়দের (স্বাধীন মতামত-এর অধিকারী) কেন্দ্র ছিল কুফা। তিনি এর সাথেই সংশ্লিষ্ট হন। হযরত আলী (রাঃ) এবং হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (মৃত্যু ৩২ হিজরী-৬৫২ খৃঃ) থেকেই এ চিন্তাধারার সূচনা হয়েছে। অতঃপর তাদের ৩ শগরিদ কাজী মুরাইহ (মৃত্যুঃ ৭৬ হিজরী-৬৯৭ খৃষ্টাব্দ) আলক্বামা (মৃত্যুঃ ৬২ হিজরী-৮১৪ খৃষ্টাব্দ) এবং মাসরুক (মৃত্যু ৭৬ হিজরী, ৬৮২ খৃষ্টাব্দ) এ চিন্তাধারার নামযাদা ইমাম হয়েছেন। তখন সমগ্র মুসলিম জাহানে তাঁদের খ্যাতি ছিল অতঃপর ইবরাহীম নাখয়ী (মৃত্যুঃ ৯৫ হিজরী-৭১৪ খৃষ্টাব্দ) এবং তাঁর পরে হাম্মাদ পর্যন্ত এর নেতৃত্ব পৌঁছে। ইমাম আবু, হানীফা (রঃ) এ হাম্মাদেরই শাগরিদী (শিষ্যত্ব) গ্রহণ করেন এবং তাঁর ইন্তেকাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১৮ বছর তাঁর সান্নিধ্যে কাটান। কিন্তু কুফায় তাঁর শিক্ষক মণ্ডলীর কাছে যে জ্ঞান ছিল তিনি শুধু তাতেই তুষ্ট হননি; বরং হজ্জ উপলক্ষে বারবার হেজায গিয়ে ফিকাহ এবং হাদীসের অন্যান্য বড় বড় জ্ঞানী ব্যক্তিদের কাছ থেকেও জ্ঞান অর্জন করতে থাকেন।
হিজরী ১২০ সালে তাঁর উস্তাদ হাম্মাদের ইন্তেকাল হলে তাঁর চিন্তাধারার অনুসারীরা সকলে একমত হয়ে ইমাম আবু হানীফা (রঃ)-কে তাঁর স্থালাভিষিক্ত করেন। এ পদ-মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়ে দীর্ঘ তিরিশ বছর ধরে পঠন-পাঠন এবং ফতওয়া দানের এমন অক্ষয়কীর্তি তিনি আঞ্জাম দেন, আজ যা হানাফী মাযহাবের ভিত্তি হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। এ তিরিশ বছর সময়ে তিনি কারো মতে ৬০ হাযাব, আর কারো মতে ৮৩ হাযাব আইন সংক্রান্ত সমস্যার (কানুনী মাসায়েল) সমাধান দেন, যা তাঁর জীবন কালেই বিভিন্ন শিরোনামে সংহীত হয়েছিল। [আল-মাক্কী, ১ম, খণ্ড, পৃষ্ঠা-৯৬। দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৩২-১৩৬।] তিনি এমন সাত-আটশো শাগরিদ তৈরী করেন, যারা মুসলিম জাহানের বিভিন্ন অঞ্চলে পৌঁছে দারস এবং ফতোয়ার মসনদ অলংকৃত করেন এবং জনগণের ভক্তি-শ্রদ্ধার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন। তাঁদের শাগরিদদের মধ্যে এমন প্রায় পঞ্চাশজনের সন্ধান পাওয়া যায়, যারা তাঁর পরে আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের ক্বাযী (বিচার পতি) নিযুক্ত হন। তাঁর মাযহাব মুসলিম জাহানের বিশাল অংশের আইনে পরিণত হয়। তা আব্বাসী, সালজুকী, ওসমানী এবং মোগল সাম্রাজ্যেরও আইন ছিল। আর আজ চীন থেকে তুরস্ক পর্যন্ত কোটি কোটি মুসলমান তাঁরই ফিকাহ অনুসরণ করে।
পৈত্রিক পেশা ব্যবসাকে তিনি জীবিকার অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করেন। কুফায় তিনি ‘খায’ (এক বিশেষ ধরণের কাপড়)-এর ব্যবসা করতেন। ধীরে ধীরে তিনি এক পেশায়ও অস্বাভাবিক উন্নতি করেন। তাঁর নিজের একটি বিরাট কারখানা ছিল; সেখানে ‘খায’ তৈরী করা হতো। [আল-ইয়াফেয়ীঃ মেরআতুল জেনান ওয়া ইকবরাতুল ইয়াকাতান, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩১০, প্রথম সংস্করণ, ১৩৩৭ হিজরী, দায়েরাতুল মাআ’রেফ, হায়দরাবাদ।] তাঁর কারখানায় তৈরী কাপড় কেবল কুফাতে তাঁর নিজস্ব কুঠিতে বিক্রি হতো না, বরং দেশের দূর দূরান্তেও তাঁর পণ্য যেতো। তাঁর বিশ্বস্ততা ো সততায় সাধারণ আস্থা বৃদ্ধি পেলে তাঁর কুঠিটি কার্যত একটি ব্যাংক-এর রূপ ধারণ করে। মানুষ সেখানে কোটি কোটি টাকা আমানত রাখতো। তাঁর ইন্তেকালের সময় সে কুঠিতে পাঁচ কোটি দিরহাম আমানত জমা ছিল। [আল-মাক্কী, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-২২০।] অর্থ এবং ব্যবসায় সংক্রান্ত ব্যাপারে এ ব্যাপক অভিজ্ঞতা তাঁর মধ্যে আইনের বহু বিভাগে এমন এসব দুরদর্শীতা সৃষ্টি করেছিল।, নিছক তাত্ত্বিক দিক থেকে আইনবিদরা যা অর্জন করতে পারতেন না। ফিকাহ শাস্ত্র প্রণয়নে তাঁর এ অভিজ্ঞতা অনেক সহায়ক হয়েছে। এ ছাড়াও জাগরিক কাজ কারবারে তাঁর দুরদর্শীতা এবং অভিজ্ঞতার ধারণা এ থেকেও হতে পারে যে, হিজরী ১৪৫ সালে (৭৬২ খৃষ্টাব্দ) আল-মনসুর বাগদাদ নগরের পত্তন শুরু করলে তাঁকেই এর তত্ত্বাবধান কার্যে নিযুক্ত করেন। দীর্ঘ চার বছর পর্যন্ত তিনি এ কার্যের প্রধান তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। [আত-তাবারী, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৩৮। ইবনে কাসীরঃ আল-বেদায়া ওয়ান নেয়াহা, ১০ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৯৭।]
ব্যক্তি জীবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত পরহেযগার ও বিশ্বস্ত ব্যক্তি। একবার তিনি নিজের জনৈক অঙশীদারকে পণ্য বিক্রয় করার জন্য বাইরে পাঠান। সে পণ্যের একাংশ ত্রুটিপূর্ণ ছিল। ইমাম অংশীদারকে নির্দেশ দেন, যার কাছেই বিক্রি করবে, তাকে ত্রুটি সম্পর্কে অবহিত করবে। কিন্তু অংশীদার তা ভুলে যান এবং ত্রুটি প্রকাশ না করেই সমস্ত পণ্য বিক্রি করে ফিরে আসেন। ইমাম সমস্ত পণ্যের উসুলকৃত মূল্য (তা ছিল ৩৫ হাযার দিরহাম) দান করে দেন। [আল-খতীবঃ তারীখে বাগদাদ, ১৩শ খণ্ড অধ্যায়, ৩৫৮ পৃষ্ঠা, মোল্লা আলী কারীঃ যায়লুল জাওয়াহেরিল মুযিয়্যা, পৃষ্ঠা-৪৮৮, দায়েরাতুল মাআ’রেফ, হায়দারাবাদ, ১ম সংস্করণ, ১৩৩২ হিজরী।] ঐতিহাসিকরা এমন অনেক ঘটনারও উল্লেখ করেছেন যে, অনভিজ্ঞ ব্যক্তিরা তাদের পণ্য বিক্রয় করার জন্য তাঁর দোকানে এসে দাম কম চাইলে ইমাম নিজে তাদেরকে বলতেন, তোমার পণ্যের মূল্য আরো বেশি। এবং তাদেরকে সঠিক মুল্য দিতেন। [আল-মাক্কী, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-২১৯-২২০।] তাঁর সমকালীন ব্যক্তিবর্গ তাঁর পরহেযগারীর প্রশংসায় অস্বাভাবিক পঞ্চমুখ। হাদীসের মশহুর ইমাম আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক-এর উক্তিঃ “আমি আবু হানিফা (রঃ)-এর চেয়ে অধিকাৱ পরহেযগার ব্যক্তি দেখিনি। তাঁর সামনে দুনিয়া এবং তার সম্পদ পেশ করা হয়েছিল কিন্তু তিনি তা উপেক্ষা করেছেন। তাঁকে চাবুকের আঘাতে জর্জরিত করা হয়েছে, তবুও তিনি দৃঢ় চিত্ত রয়েছেন। যেসব পদমর্যাদা লাভ করার জন্য মানুষ ছুটাছুটি করে, তিনি কখনো তা গ্রহণ করেননি। এমন ব্যক্তি সম্পর্কে কী বলা যেতে পারে।’’ [আয-যাহাবীঃ মানাকেবুল ইনাম আবি হানীফা ওয়া সাহেবাঈহে, পৃষ্ঠা-১১৫, দারুল কুবুবিল আরাবী, মিসর, ১৩৬৬ হিজরী।] কাযী ইবনে শুবরুমা বলেনঃ “দুনিয়া তাঁর পেছনে দৌঁড়ায় কিন্তু তিনি তা থেকে দূরে সরে যান; আর আমাদের কাছ থেকে তা দূরে সরে যায় কিন্তু আমরা তার পেছনে ছুটি।’’ [আর-রাগেব আল-ইসফাহানীঃ মুহাযারাতুল উদাবা, পৃষ্ঠা-২০৬, মাতবাআতুল হিলাল, মিসর, ১৯০২ খৃষ্টাব্দ।] হাসান ইবনে যিয়াদ বলেনঃ “আল্লার কসম, ইমাম আবু হানিফা (রঃ) কখনো কোন আমীরের উপহার উপঢৌকন বা হাদিয়া গ্রহণ করেননি।’’ [আয-যাহাবী, পৃষ্ঠা-২৬।] একদা হারুনুর রশীদ ইমাম আবু ইউনুফ (রঃ)-এর নিকট ইমাম আবু হানিফা (রঃ)-এর চরিত্র বৈশিষ্ট্য জানতে চান। তিনি বলেনঃ
“আল্লার কসম, তিনি আল্লার নিষিদ্ধ (হারামকৃত) বস্তুরাজী কঠোরভাবে পরিহারকারী, দুনিয়াদার থেকে দূরে অবস্থানকারী এবং অধিকাংশ সময় মৌনতা অবলম্বনকারী ব্যক্তি ছিলেন। সবসময় চিন্তা গবেষণায় মগ্ন থাকতেন, কখনো বাজে কথা বলতেন না। তাঁকে কোন মাসআলা (ইসলামের বিধি-বিদান সম্পর্কিত সমস্যা) জিজ্ঞেস করা হলে সে সম্পর্কে তার কোন জ্ঞান থাকলে জবাব দিতেন। আমীরুল মোমিনীর! আমি তো শুধু এটুকু জানি যে, তিনি নিজের নফস এবং দ্বীনকে মন্দ কাজ থেকে সংরক্ষণ করতেন এবং লোকদের প্রতি মুখাপেক্ষী না হয়ে নিজেকে নিয়ে মশগুল থাকতেন। তিনি কখনো কারোর চরিত্রের খারাপ দিক নিয়ে আলোচনা করতেন না।’’ [আয-যাহাবী, পৃষ্ঠা-৯।]
তিনি অত্যন্ত দানশীল ছিলেন। বিশেষ করে বিদ্বজ্জন মণ্ডলী ও ছাত্রদের জন্য দু’হাতে অর্থ ব্যয় করতেন। তিনি তাঁর ব্যবসায়িক লভ্যাংশের এক বিশেষ অংশ এ জন্য পৃথক করে রাখতেন। এ থেকে সারা বছর ধরে আলেম এবং ছাত্রসমাজকে আর্থিক সাহায্য করতেন। শেষ পর্যন্ত কিছু অবশিষ্ট থাকলে তাও তাদের মধ্যে বন্টন করে দিতেন। তাদেরকে অর্থ দানকালে তিনি বলতেনঃ আপনারা এ সব নিজেদের প্রয়োজনে ব্যয় করুন, আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে কৃতজ্ঞ হবেন না। আমি আপনাদেরকে আমার নিজের কাছ থেকে কিছুই দেইনি। “এটা আল্লার ফযল (অনুগ্রহ) যা আপনাদের জন্যই তিনি আমাকে দান করেছেন।’’ [আল-খতীব, এয়োদশ খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৬০। আল-মাক্কী, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৬২।] তাঁর শাগরিদদের মধ্যে বিপুল সংখ্যক এমন ছিল, যাদের ব্যয়ভার তিনি নিজেই বহন করতেন। ইমাম আবু ইউসুফের পরিবারের সমস্ত ব্যয়ভারই তিনি নিজ দায়িত্বে গ্রহণ করেন। কারণ তাঁর পিতা ছিলেন গরীব। তাঁরা শিশুকে শিক্ষা থেকে সরিয়ে নিয়ে কোন অর্থকরী কাজে নিয়োযিত করতে চাইতেন। [ইবনে খাল্লেকান, ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৪২২-২৩। আল-মাক্কী, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-২১২।]
এহেন চরিত্র ও ব্যক্তিত্বের অধিকারী ইমাম আবু হানিফাকে খেলাফতে রাশেদার পরবর্তী পরিস্থিতিতে উদ্ভুত হিজরী দ্বিতীয় শতকের প্রথমার্ধের প্রায় সবগুলো গুরুত্বপূর্ণ সমস্যারই মুখোমুখী হতে হয়েছে।
তাঁর মতামত
যেসব সমস্যা সম্পর্কে ইমাম তাঁর চিন্তাধারাকে নিজ হাতে লিপিবদ্ধ করে গেছেন এখন আমরা সর্বপ্রথম সেগুলো আলোচনা করবো। তিনি কোন লেখক ছিলেন না। তাই তাঁর কার্য সম্পর্কে অধিকন্তু অন্যান্য নির্ভরযোগ্য মাধ্যমের দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হয়। কিন্তু শিআ’, খারেজী, মুর্জিয়া এবং মোতাযিলাদের উপস্থাপিত কতিপয় সমস্যা এমন ছিল যে, যে সম্পর্কে স্বীয় অভ্যাসের বিরুদ্ধে তিনি লেখনী ধারণ করেছেন এবং অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত অথচ স্পষ্ট ভাষায় আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াত (অর্থাৎ মুসলিম সমাজের সংখ্যাধিক্য লোকের) বিশ্বাস এবং মত ও পথ সংকলন করেছেন। স্বভাবতঃই তাঁর কার্যধারা পর্যালোচনা করতে গিয়ে তাকেই আমাদের প্রথম স্থান দিতে হবে, যা তাঁর রচনার আকারে আমরা পাই।
ইতিপূর্বে আমরা আলোচনা করেছি যে, হযরত আলী (রঃ)-এর খেলাফত আমলে বনু উমাইয়াদের শাসনের সূচনা পর্বে মুসলমানদের মধ্যে যে সকল মতবিরোধ দেখা দেয় তার ফলে চারটি বড় ফেরকা জন্ম লাভ করে। কতিপয় সমস্যা সম্পর্কে এরা শুধু চরম মতামত ব্যক্ত করেনি, বরং তাকে ধর্মীয় আকীদা-বিশ্বাস বলে গ্রহণ করেছে, যা মুসলিম সমাজ গঠন, ইসলামী রাষ্ট্রের ধরন-প্রকৃতি, ইসলামী আইনের উৎস এবং উম্মাতের অতীতের সমষ্টিগত ফায়সালার নির্ভরযোগ্য ভূমিকার ওপরও প্রভাব বিস্তার করতো। এ সমস্যা সম্পর্কে মুসলিম সংখ্যাধিক্যের মত ও পথ সুনির্দিষ্ট-সুস্পষ্ট ছিল। কারণ, সাধারণ মুসলমানরা সে অনুযায়ী চলতো এবং বড় বড় ফকীহরা সময়ে সময়ে নিজেদের কথায় ও কাজে তা ব্যক্তও করতেন। কিন্তু ইমাম আবু হানীফা (রঃ)-এর সময় পর্যন্ত কেউ দ্ব্যর্থহীন পন্থায় স্পষ্ট লিখিত রূপে এগুলো সংকলিত করেননি।
আহলে সুন্নাতের আকীদা বিশ্লেষণ
ইমাম আবু হানীফা (রঃ) প্রথম ব্যক্তি, যিনি আল-ফিকহুল আকবার। [ইলমে কালাম’ (যু্ক্তি শাস্ত্র)-এর সঙ্গা প্রবর্তনের পূর্বে আকায়েদ, দ্বীনের মূলনীতি এবং আইন-সব কিছুর জন্যই ‘ফিকাহ’ শব্দ ব্যবহৃত হতো। অবশ্য এভাবে পার্থক্য করা হতো যে, আকায়েদ এবং দ্বীনের মূলনীতিকে আল-ফিকহুল আকবার বলা হতো। ইমাম আবু হানীফা (রঃ) তাঁর গ্রন্থের জন্য এ নামই ব্যবহার করেন। এ গ্রন্থ সম্পর্কে সাম্প্রতিককালে গবেষকরা সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যে, তা সংযোজন মাত্র-তাঁর নিজস্ব রচনা নয়। কিন্তু আমরা এখানে তার যেসব অংশ নিয়ে আলোচনা করছি, তার সত্যতা সর্বজন স্বীকৃত। কারণ, অন্যান্য যেসব উপায়েই ্রসেব সমস্যা সম্পর্কে ইমাম আবু হানীফা (রঃ)-এর মত-পথ জানা যায়, তা এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। যেমন, ইমাম আবু হানীফার আল-ওয়াছিয়াত, আবু মুতী আল-বলখীর বর্ণিত ‘আল-ফিকহুল আবসাত’ এবং আকীদায়ে তাহাবীয়া-যাতে ইমাম তাহারী (২৩৯-৩২১ হিজরীঃ ৮৫৩-৯৩৩ খৃষ্টাব্দ) আবু হানীফা (রঃ) এবং তাঁর শাগরিদদ্বয়-ইমাম আবু ইউসুফ এবং ইমাম মুহাম্মদ ইবনে হাসান আশ-শায়বানী থেকে বর্ণিত আকায়েদ লিপিবদ্ধ করেছেন।] (সবচেয়ে বড় ফিকাহ) রচনা করে এ সব ধর্মীয় ফেরকার মুকাবিলায় আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াত-এর আকীদা সপ্রমাণ করেছেন।
এ গ্রন্থে আমাদের আলোচ্য বিষয় সংক্রান্ত, যেসব প্রশ্ন নিয়ে তিনি আলোচনা করেছেন, তার প্রথমটি হচ্ছে খোলাফায়ে রাশেদীনের ভূমিকা সংক্রান্ত। ধর্মীয় ফেরকাগুলো এদের কারোর কারোর খেলাফতের যথার্থতার প্রশ্ন উত্থাপন করে। তাঁদের কে কার চেয়ে অধিক মর্যাদাবান? এবং তাদের কেউ মুসলমানও ছিলেন কিনা? এ সকল প্রশ্নের ধরণ অতীতের কতিপয় ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে নিছক ঐতিহাসিক রায়ই ছিল না, বরং তা থেকে মৌলিক প্রশ্ন সৃষ্টি হতো যে, যেভাবে এসব খলীফাদেরকে মুসলমানদের ইমাম বাবানো হয়েছিল, তাকে ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্র-প্রধান নিযুক্তির আইনগত পন্থা স্বীকার করা হবে কিনা। এছাড়াও তাদের কারো খেলাফত সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করা হলে তা থেকে প্রশ্ন দাঁড়ায়, তার সময়ের এজমাভিত্তিক ফায়সালা ইসলামী আইনের অংশ বলে স্বীকৃত হবে কিনা, এবং সে খলীফার নিজস্ব ফায়সালা আইনসিদ্ধ নযীর এবং মর্যাদা পাবে কিনা? এছাড়াও তাঁর খেলাফতের বৈধ-অবৈধ এবং তাঁর ঈমান থাকা না থাকা এমনকি তাঁদের মধ্যে কারুর ওপর কারুর ফযীলত (প্রাধান্য)-এর প্রশ্নও আপনা-আপনিই এ প্রশ্নে এসে দাঁড়ায় যে, পরবর্তীকালের মুসলমানরা সে প্রাথমিক ইসলামী সমাজের প্রতি আস্থা রাখে কিনা। তাদের সমষ্টিগত ফায়সালাকে স্বীকার করে কিনা, যেসব ফায়সালা নবী (সঃ)-এর সরাসরি হেদায়াত-তারবিয়াত (পথ নির্দেশ এবং দীক্ষা)-এর ভিত্তিতে গৃহীত হয়েছিল, এবং যার মাধ্যমে কুরআন, রাসূলের সুন্নাহ ও ইসলামী বিধানের সমস্ত জ্ঞান পরবর্তী বংশধরদের নিকট পৌঁছেছিল।
দ্বিতীয় প্রশ্নটি হচ্ছে সাহাবাদের জামায়াতের পজিশন সংক্রান্ত। একটি দল-যার বিপুলাংশ ক একটি দল যালেম, গুমরাহ বরং কাফের পর্যন্ত বরতো। কারণ, তারা প্রথম তিনজন খলীফাকে ইমাম বানিয়েছিলেন। খাওয়ারেজ এবং মু’তাযিলারা যাদের এক বিরাট জনসংখ্যাকে কাফের-ফাসেক আখ্যায়িত করতো। এ প্রশ্নটিও পরবর্তী কালে নিছক একটি ঐতিহাসিক প্রশ্নের পর্যায়ে ছিল না। বরং তা থেকে আপনা আপনি এ প্রশ্ন দাঁড়ায় যে, তাদের মাধ্যমে নবী (সঃ) থেকে যেসব বিধান বর্ণিত হয়েছে, তা ইসলামী আইনের উৎস হবে কিনা?
তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে ঈমানের সংঙ্গা, ঈমান কুফর-এর মৌলিক পার্থক্য এবং গুনাহর প্রভাব পরিণতি সম্পর্কে। খাওয়ারেজ, মুতাযিলা এবং মর্যিয়াদের মধ্যে এ নিয়ে কঠোর বিতর্কের সৃষ্টি হয়। এ প্রশ্নটিও নিছক দ্বীনিয়াতের প্রশ্ন ছিল না, বরং মুসলিম সমাজ গঠনের সাথে এর সম্পর্ক ছিল। কারণ, এ সম্পর্কে যে ফায়সালাই করা হবে, মুসলমানদের সামাজিক অধিকার এবং তাদের আইন সংক্রান্ত ব্যাপারে অবশ্যই তার প্রভাব পড়বে। উপরন্তু একটা ইসলামী রাষ্ট্রে এ থেকে এ প্রশ্নও সৃষ্টি হতো যে, পাপাচারী শাসকদের শাসনে জুমা এবং জামায়াতের মতো ধর্মীয় কার্য, আদালত তথা বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা এবং যুদ্ধ ও জেহগাদের মতো রাজনৈতিক কার্য যথার্থভাবে কিভাবে করা যাবে, অথবা আদৌ করা যাবে কিনা?
ইমাম আবু হানীফা (রঃ) এ সব সমস্যা সম্পর্কে আহলুস সুন্নাতের যে মত পথ সপ্রমাণ করেছেন তা এইঃ
খেলাফায়ে রাশেদীন প্রসঙ্গ
রাসুলুল্লার পরে সর্বোত্তম মানুষ আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ), তারপর ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ), তারপর ওসমান ইনবে আফফান (রাঃ) অতঃপর আলী ইবনে আবুতালেব (রাঃ) আনহুম। এরা সকলেই হকের ওপর ছিলেন আর সত্যের সাথেই তাঁরা জীবন যাপন করেন। [মোল্লা আলী ক্বারীঃ আল-ফিকহুল আকবার-এর ভাষ্য, পৃষ্ঠা-৭৪-৮৭, হিজরী ১৩৪৮, হিজরী ১৩৪৮ সালে দিল্লীর মুজতাবায়ী প্রেস থেকে মুদ্রিত সংস্করণ, আল-মাগনিসারী আল-মাগনিসারী আল-ফিকহুল আকবার-এর ভাষ্য, পৃষ্ঠা-২৫-২৫ দায়েরাতুল মাআ’রেফ হায়দরাবাদ, ১৩২১ হিজরী।]
‘আকীদায়ে তাহবিয়া’ গ্রন্থে এর আরও ব্যাখ্যা করা হয়েছে এভাবেঃ ‘আমরা রাসুলুল্লাহ (সঃ)-এর পর আবু বকর সিদ্দিকী (রাঃ)-কে সমস্ত উম্মাতের ওপর সর্বাধিক মর্যাদাবান মনে করে সর্বপ্রথম তাঁর জন্য খেলাফত প্রমাণ করি। অতঃপর ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ)-এর জন্য। এরপর ওসমান (রাঃ)-এর জন্য এবং অতঃপর আলী ইবনে আবু তালেব (রাঃ)-এর জন্য। এরা হচ্ছেন খোলাফায়ে রাশেদীন-সত্যাশ্রয়ী খলীফা এবং হেদায়াত প্রাপ্ত ইমাম।’’ [ইবনু আবিল ইয আল-হানাফীঃ তাহবিয়ার ভাষ্য, পৃষ্ঠা-৪০৩-৪১৬ দারুল মাআরেফ মিসর, ১৩৭৩ হিজরী।]
এ প্রসঙ্গে এ কথাও উল্লেখযোগ্য যে, ইমাম আবু হানীফা (রঃ) ব্যক্তিগতভাবে হযরত ওসমান (রা:)-এর তুলনায় হযরত আলী (রা:)-কে অধিক ভালবাসতেন। [আল-কারদারীঃ মানাকিবুল ইমামিল আযম, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭২, ১ম সংস্করণ, ১৩২১ হিজরী, হায়দরাবাদ। বুযুর্গদ্বয়ের মধ্যে কাউকে কারুর ওপর প্রাধান্য দেয়া যায় না। [ইবল আবদিল যার আর-ইন্তেকা, পৃষ্ঠা-১৬৩, আল-মাতাবাতুল কাদসী, কায়রো, ১৩৭০ হিজরী। আল-সারাখসীঃ শারহুস সিয়ারিল কাবীর, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৫৭-১৫৮, মিসরীয় সংস্করণ, ১৯৫৭ খৃষ্টাব্দ। ইমাম মালেক এবং ইয়াহইয়া ইবনে সায়ীদ আল-কাত্তান-এরও এ মতছিল। ইবনু আবদিল বারঃ আল-ইস্তীআ’ব, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৪৬৭।] কিন্তু হযরত ওসমান (রা:)-এর নির্বাচন উপলক্ষে সংখ্যাধিক্যে যে ফায়সালা হয়েছিল, তাকে স্বীকার করে নিয়ে তিনি এই সামষ্টিক আকীদা স্থির করেন যে, মর্যাদার ক্রমিক ধারাও তাই, যা খেলাফতের ক্রমিক ধারা।
সাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কে
“ভাল ব্যতীত অন্য কোন রকমে আমরা সাহাবীদের স্মরণ করি না।“ [মোল্লা আলী ক্কারী, পৃষ্ঠা-৮৭। আল-মাগনিসারী, পৃষ্ঠা-২৬।]
‘আকীদায়ে তাহরিয়া’ গ্রন্থে এর আরও বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা হয়েছে এভাবেঃ
“আমরা রাসুলুল্লাহ (স:)-এর সমস্ত সাহাবীকেই ভালবাসি। তাঁদের কারো ভালোবাসায় সীমা লংঘন করি না, কাউকে গাল-মন্দ দেই না। যারা তাদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে এবং তাদেরকে মন্দবলে, আমরা তাদেরকে না-পসন্দ করি। ভাল ব্যতীত অন্য কোনভাবে তাদের আলোচনা করি না।’’ [ইবনু আবিল ইয, পৃষ্ঠা-৩৯৮]।
অবশ্য সাহাবা (রা:)-দের গৃহযুদ্ধ সম্পর্কে ইমাম আবু হানীফা (রা:)-তাঁর মত ব্যক্ত করতে কুণ্ঠিত হননি। তিনি স্পষ্টভাবে বলেন যে, যাদের সাথে হযরত আলী (রা:)-এর যুদ্ধ হয়েছে (স্পষ্ট যে, জামাল ্রবেঙ সিফফীন যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারীরাও এর পর্যায়ভুক্ত), তাদের তুলনায় আলী (রা:) অধিক সত্যাশ্রয়ী ছিলেন। [আল-মাক্কী, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৮৩-৮৪। আল-কারদারী, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭১-৭২। এটাও কেবল এটা ইমাম আবু হানীফারই মত ছিল না, বরং সকল আহলুস সুন্নাত এ ব্যাপারে একমত ছিলেন। হাকেম ইবনে হাজার আল-এসাবা গ্রন্থে (২য় খণ্ড, ৫০২ পৃষ্ঠা) এ কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু প্রতিপক্ষকে নিন্দা করা থেকে তিনি সর্বতোভাবে বিরত থাকেন।
ঈমানের সংঙ্গাঃ
“স্বীকার করা এবং বিশ্বাস করার নাম ঈমান।’’ [মোল্লা আলীক্বারী, পৃষ্ঠা-১০৩। আল-মাগনিসারী, পৃষ্ঠা-৩৩।
‘আল-ওয়াসিয়্যাত’ গ্রন্থে তিনি এর ব্যাখ্যা করেছেন এভাবেঃ “মুখে স্বীকার এবং অন্তরে বিশ্বাস করার নাম ঈমান।” আরও সামনে অগ্রসর হয়ে এর অতিরিক্ত ব্যাখ্যা করেন তিনি এভাবেঃ “আমল (কর্ম) ঈমান থেকে পৃথক জিনিস, আর ঈমান আমল থেকে পৃথক এর প্রমাণ এই যে, কোন কোন সময় মু’মিন থেকে আমল অপসৃত হয়ে যায়, কিন্তু ঈমান অপসৃত হয় না। …. যেমন, বলা যেতে পারে যে, ধনহীন ব্যক্তির ওপর যাকাত ওয়াজেব নয়; কিন্তু এ কথা বলা যায় না যে, তার ওপর ঈমান ওয়াজেব নয়।’ [মোল্লা হুসাইন, আল-জাওহারাতুল মুনীফা শারহে ফি ওয়াসিয়্যাতিল ইমান আবি হানীফা; পৃষ্ঠা-৩, ৬ ও ৭। দায়েরাতুল মাআ’রেফ, হায়দরাবাদ, ১৩২১ হিযরী।] এমনি করে তিনি খারেজীদের এ মত-আমল ঈমানের মূল তত্ত্বের পর্যায়ভুক্ত এবং গুনাহ অবশ্যই ইমানহীনতার সমর্থক-বাতিল করে দেন, তার প্রতিবাদ করেন।
গুনাহ এবং কুফরের পার্থক্য
“কোন গুনাহর ভিত্তিতে-তা যত বড়ই হউক না কেন-আমরা কোন’ মুসলমানকে কাফের সাব্যস্ত করি না যতক্ষণ সে তাকে হালাল বলে স্বীকার না করে। আমরা তার থেকে ঈমান অপসারণ করতে পারি না, বরং মূলত তাকে মুমিন বলেই মনে করি। একজন মু’মিন ব্যক্তি ফাসেক (পাপাচারী) হতে পারে, কিন্তু কাফের নয়-আমাদের মতে এমন হতে পারে।” [মোল্লা আলী ক্বারী, পৃষ্ঠা-৮৬-৮৯। আল-মাগনিসারী, পৃষ্ঠা-২৭-২৮।]
‘আল-ওয়াসিয়্যাত’ গ্রন্থে এ বিষয়টি ব্যক্ত করেছন এভাবেঃ
‘মুহাম্মাদ (স:)-এর উম্মাতের সকল গুনাহগার মুমিন, কাফের নয়।”[মোল্লা হোসাইন, পৃষ্ঠা-৬।]
‘আকীদায়ে তাহবিয়্যা’ গ্রন্থে এর আরও ব্যাখ্যা এইঃ
“বান্দা ঈমান থেকে খারেজ হয় না, কিন্তু শুধু সে জিনিসকে অস্বীকার করে, যে জিনিস তাকে ঈমানে দাখিল করেছে।” [ইবনু আবিল ইয্। পৃষ্ঠা-২৬৫।]
একবার খারেজীদের সাথে এ বিষয়ে ইমাম আবু হানীফা (রা:)-এর মোনাযারা (তর্কযুদ্ধ) হয়। এ মোনাযারা থেকে এ আকীদা এবং তার সামাজিক ফলাফল (Social Consequences) এর ওপর পূর্ণ আলোকসম্পাত হয়। খারেজীদের একটি বিরাট দল তাঁর কাছে এসে বলে যে মসজিদের দ্বারে দুটি জানাযা হাযির। একটি জানাযা এমন এক মদ্যপায়ীর, মদ পান করতে করতে যার মৃত্যু হয়েছে। দ্বিতীয়টি এক মহিলার, যস ব্যভিচারের ফলে গর্ভবতী হয় এবং লজ্জায় পড়ে আত্মহত্যা করে মারা যায়। তিনি জিজ্ঞেস করেনঃ এরা কোন মিল্লাতের লোক ছিল? তারা কি ইয়াহুদী ছিল? তারা বললো, না। জিজ্ঞাসা করলেন, খৃষ্টান ছিল। বললো, না। জিজ্ঞাসা করলেন, মজুসী (অগ্নিপুজক) ছিল? তারা বললো, না। তিনি জিজ্ঞেস করলেন তবে তারা কোন মিল্লাতের লোক ছিল? তারা জাবাব দেয়, তারা সে মিল্লাতের লোক ছিল, যে মিল্লাত ইসলামের কালেমার সাক্ষ্য দেয়। ইমাম জিজ্ঞেস করেনঃ বল, তা ঈমানের না না অংশ? তারা বলে, ঈমানের তৃতীয়, চতুর্থ বা পঞ্চমাংশ হয় না। সে কালেমার শাহাদাতকে শেষ পর্যন্ত তোমরা ঈমানের কত অংশ বলে স্বীকার করো? তারা বললো, পুরো ঈমান। এরপর ঈমান তাদেরকে তৎক্ষণাৎ প্রশ্ন করেন, তোমরা নিজেরাই যখন তাদেরকে মু’মিন বলছো, তবে আর আমাকে কি জিজ্ঞেস করছো? তাদের জবাব, আমরা জানতে চাইঃ তারা জান্নাতী, না জাহান্নামী? ইমাম জবাব দেনঃ তোমরা যখন জানতেই চাও তখন আমি তাদের সম্পর্কে তা-ই বলবো, আল্লার নবী ইবরাহীম (আ:) তাদের চেয়েও নিকৃষ্ট গুনাহগার সম্পর্কে যা বলেছিলেনঃ
-“আল্লাহ! যে কোন অনুসরণ করে, সে আমার, নাফরমানী করে, তবে তুমি গাফুরুর রাহীম-ক্ষমাশীল, দয়ালু।-ইবরাহীমঃ ৩৬
******************
আল্লার আর এক নবী ঈসা (আ:)-ও যা বলেছিলেন এদের চেয়েও বড় গুনাহগার সম্পর্কেঃ
****************
-“আপনি যদি তাদেরকে আযাব দেন, তবে তারা তো আপনার বান্দা, আর যদি তাদেরকে ক্ষমা করে দেন, তবে আপনি মহা পরাক্রমশালী, মহাজ্ঞানী।”-আল মায়েদাঃ ১১৮
আল্লার আর এক নবী নূহ (আ:) যা বলেছিলেনঃ
****************
-“তাদের হিসাব নেয়া তো আমার রব-এর কাজ; যদি তোমরা বুঝতে। আমি তো মু’মিনদের বিতাড়নকারী নই।- আশ-শুয়ারাঃ ১১৩-১১৪
ইমামের এ জবাব শোনে সেই খারেজীদেরকে নিজেদের চিন্তার ভ্রান্তি স্বীকার করে নিতে হয়েছে। [আল-মাক্কী, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১২৪-১২৫।]
গুনাহগার মু’মিনের আঞ্জাম
“মু’মিনের জন্য গুনাহ ক্ষতিকর নয়-এমন কথা আমরা বলি না। মু’মিন জাহান্নামে যাবে না, তা-ও আমরা বলি না; সে ফাসেক হলে চিরকাল জাহান্নামে থাকবে- এমন কথাও আমরা বলি না।” [মোল্লা আলী ক্কারী, ৯২ পৃষ্ঠা। আল-মাগনিসাবী, ২৮-২৯।]
“আর মুর্যিয়াদের মতো আমরা এ কথাও বলি না যে, আমাদের নেকীসমূহ অবশ্যই গৃহীত হবে এবং আমাদের ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো অবশ্যই ক্ষমা করা হবে।” [আল-মাগনিসাবী, পৃঃ ৯৩ ও আল মাগনিসাবি, পৃঃ ২৯।]
‘আকীদায়ে তাহাবিয়া’-এর ওপর এতটুকু সংযোজন করছেঃ
“আহলি কেবলার মধ্যে কারো জান্নাতী হওয়ার ফায়সালা আমরা করি না, জাহান্নামী হওয়ারও না। আমরা তাদের ওপর কুফর, শিরক এবং মুনাফিকীর হুকুমও আরোপ করি না-যতক্ষণ তাদের দ্বারা এমন কোন বিষয়ের কার্যত প্রকাশ না পাওয়া যায়। তাদের নিয়াতের ব্যাপারে আমরা আল্লার ওপর ছেড়ে দিচ্ছি।” [ইবনু আবিল ইয, পৃষ্ঠা-২১২-২১৩।]
এ আকীদার ফলাফল
এমনিভাবে ইমাম শিআ’, খারেজী, মু’তাযিলা এবঙ মু’র্যিয়াদের চরম মতামতের মধ্যে এমন এক ভারসাম্যপূর্ণ আকীদা পেশ করেন, যা মুসলিম সমাজকে বিশৃংখলা, পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-বিদ্বেষের হাত থেকে রক্ষা করে; মুসলিম সমাজের ব্যক্তিবর্গকে নৈতিক দেউলিয়াপনা এবং গুনাহের কাজে উদ্বুদ্ধ হওয়া থেকেও বারণ করে। যে বিপর্যয়কালে তিনি আহলে সুন্নাতের আকীদার এ ব্যাখ্যা পেশ করেছিলেন, তার ইতিহাস দৃষ্টির সামনে তুলে ধরলে এটা তার বিরাট কীর্তি বলে প্রতীয়মান হয়; যদ্বারা তিনি উম্মাতকে সত্য-সরল পথে প্রতিষ্ঠিত রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। এ আকীদার অর্থ ছিল এই যে, নবী (সঃ) যে প্রাথমিক ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন উম্মাত তার ওপর পূর্ণ আস্থাশীল। সে সমাজের ব্যক্তিবর্গ সর্বসম্মতিক্রমে বা সংখ্যাধিক্যের বলে যে ফায়সালা করেছিল, উম্মাত তা স্বীকার করে। তারা যেসব সাহাবীদেরকে পরস্পর খলীফা মনোনীত করেছিলেন, তাদের খেলাফত এবঙ তাদের সময়ের ফায়সালাকেও উম্মাত আইনের মর্যাদায় সত্য সঠিক মনে করে। শরীয়াতের সে পূর্ণ জ্ঞানকেও উম্মাত গ্রহণ করে, যা সে সমাজের ব্যক্তিবর্গ (অর্থাৎ সাহাবায়ে কেরাম)-এর মাধ্যমে পরবর্তী বংশধররা লাভ করেছে। যদিও এ আকীদা ইমাম আবু হানীফা (রাঃ)-এর নিজের আবিষ্কার নয়, বরং উম্মাতের বিপুল সংখ্যক লোক সে সময় এ আকীদা পোষণ করতো, কিন্তু ইমাম তাকে লিখিত আকারে সংগৃহীত করে এক বিরাট খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন। কারণ, এদ্বারা সাধারণ মুসলমানরা জানতে পারে যে, বিভিন্ন দলের মুকাবিলায় তাদের বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত মত এবং পথ কি?
ইসলামী আইন প্রণয়ন
কিন্তু ইমাম আবু হানীফা (রঃ) এর সবচেয়ে বড় কীর্তি-যা তাঁকে ইসলামের ইতিহাসে অক্ষয় মহত্ব দান করেছে-এ ছিল যে, খেলাফতে রাশেদার পর শুরার পথ রুদ্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে ইসলামের আইন ব্যবস্থায় যে শূন্যতা দেখা দিয়েছিল, তিনি তা পূরণ করেছেন। ইতিপূর্বে আমরা এর প্রভাব-পরিণতির প্রতি ইঙ্গিত করেছি। প্রায় এক শতাব্দী এ অবস্থায় কেটে যাওয়ার ফলে যে
কত ক্ষতি হতে থাকে, সকল চিন্তাশীল ব্যক্তিই তা উপলব্ধি করতেন। এক দিকে সিন্ধু থেকে স্পেন পর্যন্ত মুসলিম দেশের সীমা বিস্তার লাভ করেছিল; নিজেদের স্বতন্ত্র তামাদ্দুন পৃথক আচার-প্রথা এবং অবস্থা নিয়ে অসংখ্য জাতি মুসলিম দেশের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছিল। দেশের অভ্যন্তরে অর্থনীতি সংক্রান্ত সমস্যা, শিল্প-কলা, কৃষি এবং ব্যবসা-বাণিজ্যর সমস্যা, বিবাহ-শাদীর সমস্যা, শাসনতান্ত্রিক এবং দেওয়ানী-ফৌজদারী আইন-বিধানের সমস্যা দিন দিন উদ্ভুত হচ্ছিল। দেশের বাইরে বিশ্বের বহু জাতির সাথে এ বিশাল-বিস্তির্ণ সাম্রাজ্যের সম্পর্ক ছিল; তাদের মধ্যে যুদ্ধ-সন্ধি, কুটনৈতিক সম্পর্ক, বানিজ্যিক লেন-দেন, জলে-স্থলে পরিভ্রমন, কাস্টম ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিচ্ছিল। মুসলমানদের যেহেতু এক স্বতন্ত্র দর্শন, জীবনধারা এবং মৌলনীতি ছিল, তাই নিজেদের আইন-বিধান অনুযায়ী এ সব নিত্য নতুন সমস্যা সমাধান করা তাদের জন্য ছিল একান্ত অপরিহার্য। মোদ্দাকথা, এক দিকে সময়ের এ বিরাট চ্যালেঞ্জ, ইসলামকে যে চ্যালেঞ্জের মুকাবিলা করতে হচ্ছিল; অপরদিকে অবস্থা এই যে, খেলাফত রাশেদার অবসানের পর এমন কোন স্বীকৃত আইন সংস্থা অবশিষ্ট ছিল না, যেখানে মুসলমানদের নির্ভরযোগ্য জ্ঞানী-ফকীহ এবং বিশেষজ্ঞরা বসে সেসব সমস্যা নিয়ে আলোচনা করবে, শরীয়তের মূলনীতি অনুযায়ী সেসব সমস্যার নির্ভরযোগ্য সমাধান পেশ করবে, যে সমাধান দেশের আদালত এবং সরকারী বিভাগগুলোর জন্য আইন বলে স্বীকৃত হবে, সমগ্র দেশে সমভাবে তা কার্যকরী হবে।
খলীফা, গবর্ণর, শাসক, কাযী-বিচারপতি সকলেই এ ক্ষতি উপলব্ধি করছিলেন। কারণ, ব্যক্তিগত ইজতিহাদ, এবং জ্ঞান-ধ্যানের জোরে দৈনন্দিন উদ্ভূত এতসব নানাবিধ সমস্যা যথা সময় সমাধান করা কোন মুফতী, শাসক-বিচারক এবং কোন একটি বিভাগের পরিচালকের পক্ষে সহজসাধ্য ছিল না। বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গ একক এবং বিভিন্নভাবে তা সমাধান করলেও তার ফলে পরস্পর বিরোধী ফায়সালার এক জঞ্জাল সৃষ্টি হয়ে পড়ছিল। অসুবিধা এই যে, এমন একটা সংস্থা সরকারই স্থাপন করতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্রক্ষমতা এমন লোকদের হাতে ছিল, যারা নিজেরা জানতো যে, মুসলমানদের মধ্যে তাদের কোন নৈতিক মর্যাদা এবং আস্থা নেই। তাদের পক্ষে ফকীহদের সন্মুখীন হওয়া তো দুরের কথা, তাদেরকে বরদাস্ত করাই ছিল দুষ্কর। তাদের অধীনে প্রণীত আইন কোন অবস্থায়ই মুসলমানদের নিকট ইসলামী আইন-বিধানের অংশ হতে পারতা না। এ শূন্যতা পুরণ করার জন্য ইবনুল মুকাফ্ফা তার আসসাহাবা গ্রন্থে আল-মনসুরের নিকট এ প্রস্তাব পেশ করেন: খলীফা জ্ঞানীদের একটি কাউন্সিল গঠন করবেন, এতে সকল দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তাধারার সুধীজনরা নিজ নিজ জ্ঞান এবং মতামত পেশ করবেন। অত:পর খলীফা নিজে প্রতিটি সমস্যা সম্পর্কে নিজস্ব ফায়সালা দেবেন। আর খলীফার ফায়সালাই হবে আইন। কিন্তু মনসুর এ বোকামী করার মতো নিজের সম্পর্কে এত বেখবর ছিল না। তার ফায়সালা আবুবকর-ওমর(রা:)-এর ফায়সালা হতে পারতো না। তার ফায়সালার বয়স স্বয়ং তার নিজের বয়সের চেয়ে বেশী হতে পারতো না। বরং সারা দেশে এমন একজন মুসলমান পাওয়া যাবে, যে তার মুঞ্জরীকৃত আইন নিষ্ঠার সাতে মেনে চলবে-তার নিজের জীবনে এমন আশাও ছিল না। তা একটা ধর্মহীন আইন(Secure Law)_তো হতে পারতো, কিন্তু ইসলামী আইনের একটা অংশও হতে পারতো না।
এ পরিস্থিতিতে ইমাম আবু হানিফা (রা:) এক সম্পূর্ণ ভিন্ন পথ বেছে নেন। তা ছিল এই যে, রাষ্ট্র-সরকার থেকে সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত থেকে তিনি নিজে এক বেসরকারী আইন পরিষদ (Private Legislature) স্থাপন করেন্ একজন একান্ত স্বতন্ত্র চিন্তাধারার ব্যক্তিই এমন প্রস্তাবের কথা ভাবতে পারে। এ ছাড়াও কেবল সে ব্যক্তিই এমন সাহস করতে পারে, স্বীয় যোগ্যতা প্রতিভা, চরিত্র এবং নৈতিক মান মর্যাদার প্রতি যার এতটুকু আস্থা আছে যে, এমন কোন প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে সে আইন প্রনয়ন করলেও তা কোন রাজতিক অনুমোদন (Political Sanction) ছাড়াই স্বীয় সৌন্দর্য, বৈচিত্র, বিশুদ্ধতা, পরিবেশ পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্য বিধান এবং আইন প্রণয়নকারীদের নৈতিক প্রভাব বলে আপনাপনিই তা কার্যকরী হবে, জাতি নিজেই তা গ্রহণ করবে। রাষ্ট্র-সরকার আপনাপনিই তা মেনে নিতে বাধ্য হবে। ইমাম গায়েব জানতেন না যে, সত্য সত্যই তাঁর পরে অর্ধশতাব্দীর মধ্যেই এমন সব ফলাফল দেখা দিয়েছে যা তিনি পূর্বাহ্নেই দেখে নিয়েছেন। কিন্তু তিনি নিজেকে এবং নিজের সঙ্গী-সাথীদেরকে জানতেন। মুসলমানদের সামাজিক মন-মানস সম্পর্কে অবহিত ছিলেন, সময়ের পরিস্থিতির প্রতি গভীর দৃষ্টি রাখতেন। একজন বিজ্ঞ দূরদৃষ্টি সম্পন্ন মানুষ হিসেবে তিনি একান্ত সঠিক ধারণাই করে নিয়েছিলেন যে, তিনি তাঁর ব্যক্তিগত মর্যাদা দিয়ে এ শূন্যতা পূরণ করা দ্বারা এ শূন্যতা সত্যই পূরণ হবে।
এ পরিষদের সদস্যরা ছিলেন ইমামের আপন শাগরেদ, বছরের পর বছর তিনি যাদেরকে স্বীয় আইন প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত আইন সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে, তাত্ত্বিক পদ্ধতিতে গবেষনা করতে এবং যুক্তি-প্রমাণ থেকে ফলাফল বের করতে শিক্ষা দান করেছেন। তাদের প্রায় সকলেই ইমাম ছাড়াও সেকালের অন্যান্য বড় বড় ওস্তাদের নিকট কুরাআন, হাদীস, ফিকাহ এবং অন্যান্য সহায়ক জ্ঞান-যথা ভাষা, ব্যকরণ, সাহিত্য, ইতিহাস এবং জীবন-চরিত শিক্ষা লাভ করেছেন। বিভিন্ন শাগরেদকে বিভিন্ন জ্ঞানের বিশষ পারদর্শী মনে হতো। যেমন, কেয়াস এবং রায় (যুক্ত ও মতামত)-কারো বিশিষ্ট স্থান ছিল, কারো কাছে ছিল হাদীস, সাহবাদের ফতওয়া (মতামত) এবং অতীত খলীফা ও কাযীদের নজীরের বিপুল জ্ঞান, আর কেউ বিশেষ পারদর্শী ছিলেন ইলমে তাফসীর বা আইনের কোন বিশেষ বিভাগে, ভাষা জ্ঞান, ব্যকরণ এবং মাগাযী (যুদ্ধ-বিগ্রহ সংক্রান্ত জ্ঞান)-এ। এরা কোন পর্যায় এবং কি মর্যাদার লোক ছিলেন, সে সম্পর্কে ইমাম নিজেই একবার তঁার এক বৈঠকে বলেছিলেন:
‘এরা ছত্রিশ জন, যাদের মধ্যে ২২ জন কাযী হওয়ার যোগ্য, ৬ জন ফতওয়া দেয়ার যোগ্যতা রাখে; আর দুজন এমন যোগ্যতা সম্পন্ন যে, কাযী এবং মুফতী তৈরী করতে পারে তারা।[আল-মাক্কী, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা-২৪৬]
ইমামের নির্ভরযোগ্যতা চরিতকাররা এ পরিষদের যে কার্যপদ্ধতি লিপিবদ্ধ করেছেন, তা আমরা তাদের নিজের ভাষায় উল্লেখ করছি। আল-মুয়াফফাক ইবনে আহমদ আল মাক্কী (মৃত্যু ৫৬৮ হিজরী-১১৭২ খৃষ্টাব্দ) লিখেছেন:
আবু হানিফা (র:) তাঁর মাযহাব তাদের (যাকে তাঁর নিজের যোগ্য এবং বিশেষজ্ঞ শাগরেদদের) পরামর্শক্রমে সংকলন করেছেন। আপন সাধ্যানুযায়ী দ্বীনের জন্য চরম চেষ্টা-সাধনা
করার যে উৎসাহ-উদ্দীপনা তার ছিল, আল্লাহ,আল্লার রাসুল এবং ঈমানদারদের জন্য যে পূর্ণমানের এখলাস (নিষ্ঠা) তাঁর অন্তরে ছিল, তার কারণে শাগরেদদের বাদ দিয়ে নিছক নিজের ব্যক্তিগত মতে এ কাজ করে ফেলা তিনি পছন্দ করেননি। এক একটি সমস্যা তিনি তাদের সামনে পেশ করতেন, সমস্যার বিভিন্ন দিক তাদের সামনে তুলে ধরতেন, তাদের জ্ঞানযুক্তি এবং মতামতও শোনতেন ও নিজের রায়ও ব্যক্ত করতেন। এমনকি, কখনো কখনো এক একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে মাসের পর মাস কেটে যেতো। শেষ পর্যন্ত একটি মত (রায়) সাব্যস্ত হলে কাযী আবু ইউসুফ কুতুবে উসুলে (মূলনীতি গ্রন্থে) তা লিপিবদ্ধ করতেন। [আল-মাক্কী, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা-১৩৩]
ইবনুল বাযযায আল-কারদারী (ফাতাওয়া বাযযাযিয়ায় রচয়িতা, মৃত্যু : ৮২৭ হিজরী-১৪২৪ খৃষ্টাব্দ) বলেন:
তাঁর শাগরেদরা একান্ত দিল খুলে এক একটি সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতেন, সকল বিষয়ের দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করতেন। এ সময় ইমাম নীরবতার সাথে তাদের বক্তব্য শুনতেন। অত:পর আলোচ্য সমস্যা সম্পর্কে তিনি নিজের ভাষণ শুরু করতেন, তখন মজলিসে এমন নীরবতা বিরাজ করতো, যেন তিনি ছাড়া আর কেউ-ই সেখানে উপস্থিত নেই। [ আল-কারদারী, দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা-১০৮]
আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক বলেন, একবার এ মজলিসে একটি সমস্যা নিয়ে একাধারে তিন দিন আলোচনা চলে। তৃতীয় দিন বিকেলে আমি যখন আল্লাহু আকবার ধ্বনি শুনি, তখন বুঝতে পারলাম যে, আলোচনার ফায়সালা হয়েছে। [আল-মাক্কী, দিত্বীয় খন্ড, পৃষ্ঠা-৫৪ ]
ইমামের অপর এক শাগরেদ আবু আবদুল্লার বর্ণনা থেকে যানা যায় যে, এ মজলিসে ইমাম আবু হানীফা (র:) যেসব মতামত ব্যক্ত করতেন, পরে তিনি তা পড়িয়ে শুনে নিতেন। তাঁর নিজের ভাষা এই : আমি ইমামের বক্তব্য তাকে পাঠ করে শোনাতাম। আবু ইউসুফ (মজলিসের ফায়সালা লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে ) সঙ্গে সঙ্গে নিজের বক্তব্যও বিধিবদ্দ করতেন। তাই পড়ার সময় আমি চেষ্টা করতাম তাঁর বাদ দিয়ে যেতে; কেবল ইমামের নিজস্ব বক্তব্যই তাকে শোনাতে। একদিন আমি ভুলে ভিন্ন বক্তব্যও পড়ে ফেলি। ইমাম জিজ্ঞেস করেন, এ ভিন্ন বক্তব্যটি কার। [ আল-কারদারী, দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা-১০৯ ]
আল-মাক্কীর বর্ণনা থেকে এ-ও জানা যায় যে, যে ফায়সালা এ মজলিসে লিপিবদ্ধ করা হতো, ইমাম আবু হানিফা (র:)-এর জীবদ্দশায়ই তা স্বতন্ত্র শিরোনামার অধীনে অধ্যায় এবং পরিচ্ছেদে সন্নিবিষ্টও হয়েছিল:
আবু হানীফা (র:) প্রথম ব্যক্তি, যিনি এ শরীয়াতের জ্ঞান সংকলন করেন। তাঁর পূর্বে কেউ এ কাজ করেনি।……… তিনি তাকে অধ্যায় এবং পৃথক পৃথক শিরোনামার অধীনে পরিচ্ছেদের আকারে সংগৃহীত করেন। [ আল-মাক্কী, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা ]
ইতিপুর্বে আমরা আল-মাক্কীর উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করেছি যে, এ মজলিসে ৮৩ হাযার আইন সংক্রান্ত সমস্যা মীমাংসা করা হয়েছে। সে সময় পর্যন্ত ব্যক্তি বা রাষ্ট্রকে কার্যত যেসব সমস্যার মুখোমুখী হতে হয়েছে, এ মজলিসে শুধু সেসব সমস্যাই আলোচনা হতো না ; বরং বিভিন্ন বিষয়ের সম্ভাব্যরূপ কল্পনা করে তা নিয়েও আলোচনা করা হতো, তার সমাধান তালাশ করা হতো-যাতে, এখন পর্যন্ত দেখা দেয়নি, এমন কোন সমস্যা আগামীতে দেখা দিলে আইনে তার সমাধান পাওয়া যায়। এ সব সমস্যা আইনের প্রায় সব বিভাগের সাথেই সম্পৃক্ত ছির। আন্তজাতিক আইন [ বর্তমান কালের লোকেরা এ ভূল ধারণায় রয়েছে যে, আন্তর্জাতিক আইন একটা নতুন জিনিস। প্রথম যে ব্যক্তি আইনের এ বিভাগের পত্তন করেন, তিনি হচ্ছেন হল্যান্ডের গ্রোটিয়াস ( Grotius ১৫৮৩-১৬৪৫ খৃষ্টাব্দ )। কিন্তু ইমাম আবু হানিফার শাগরেদ মুহাম্মাদ ইবনে হাসান আশ-শায়বাণী (১৩২-১৮৯ হিজরী, ৭৪৯-৮০৫ ঈসায়ী ) (র:)-এর কিতাবুস সিয়ার যিনি দেখেছেন, তিনি জানেন যে, গ্রোটিয়াসের ৯ শ বছর আগে ইমাম আবু হানীফার হাতে এ জ্ঞান অত্যন্ত বিস্তারিতভাবে সংগৃহীত হয়েছিল। এতে আর্ন্তজাতিক আইনের অধিকাংশ দিক এবং তার বড় বড় জটিল সমস্যা নিয়ে আলোচনাও হয়েছিল। সাম্প্রতিককালে জ্ঞানীদের একটি দল এ সত্য স্বীকারও করেছেন এবং জার্মানে Shaibani Society Of International Law নামে একটি সংস্থাও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।] (যার জন্য আল-মিসর-এর পরিভাষা ব্যবহৃত হতো ), শাসনতান্ত্রিক আইন, দেওয়ানী এবং ফৌজদারী আইন, আদালতের নীতিমালা, অর্থনৈতিক জীবনের সকল বিভাগের স্বতন্ত্র আইন, বিবাহ তালাক এবং উত্তরাধিকার ইত্যাদি ব্যক্তিগত বিষয়ের আইন, ইবাদতের বিধি-বিধান-এ মজলিসের সংগৃহীত তথ্যাবলী দ্বারা ইমাম আবু ইউসুফ এবং অত:পর ইমাম মুহাম্মদ ইবনে হাসান আশ-শায়বানী পরবর্তীকালে যেসব গ্রন্থ রচনা করেন, তার সূচীপত্রেই আমরা এ সব শিরোনামা দেখতে পাই।
এ যথারীতি আইন বিধিবদ্ধ করণের (Codification )ফল এই হয়েছিল যে, ব্যক্তিগত পর্যায়ে যেসব মুজতাহিদ, মুফতী এবং কাযী কাজ করেন, তাদের কাজে আস্থা হারাতে থাকে। কুরআন-হাদীসের বিধি-বিধান এবং অতীত ফায়সালা এবং নজীরের যাঁচাই বাছাই করে সুধীজনদের একটি পরিষদ ইমাম আবু হানীফা (র:)-এর মতো একজন সুক্ষাদর্শী ব্যক্তির সভাপতিত্ব এবং তত্ত্বাবধানে শরীয়াতের যে বিধান একান্ত পরিচ্ছন্নরূপে তুলে ধরেছিল অত:পর শরীয়াতের মূলনীতির ভিত্তিতে ব্যাপক ইজতিহাদ করে জীবনের সকল অধ্যায়ে দেখা দিতে পারে এমন সম্ভাব্য প্রয়োজনের জন্য গ্রহণযোগ্য যে আইন সংগৃহীত করে দিয়েছেন, তারপরে বিভিন্ন-বিচ্ছিন্ন ব্যক্তির সংকলিত সংগৃহীত বিধান। অতিকষ্টে মর্যাদা লাভ করতে পারে। তাই, এ কার্যধারা জন-সমক্ষে উপস্থিত হলেই জনগণ-শাসক-বিচারক-সকলেই সে দিকে প্রত্যাবর্তন করতে বাধ্য হয়। কারণ,
তা ছিল সময়ের দাবী। আর মানুষ দীর্ঘ দিন থেকে এ জিনিসটিরই অভাব বোধ করেছিল। তাই, প্রসিদ্ধ ফকীহ ইয়াহ্ইয়া ইবনে আদাম (মৃতু:২০৩ হিজরী-৮১৮ ঈসায়ী ) বলেন: ইমাম আবু হানীফা (র:)-এর বক্তব্যের সামনে অন্যন্য ফকীহদের বক্তব্যের বাজার ঠান্ডা হয়ে পড়েছে। তাঁর জ্ঞানই বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে, খলীফা, ইমাম এবং শাসকরা তার ভিত্তিতেই ফায়সালা করতে শুরু করেন; তার আলোকেই লেনদেন চলতে থাকে [আর-মাক্কী, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা-৪১ ।] খলীফা মামুনের (১৯৮-২১৮ হিজরী-৮১৩-৮৩৩ খৃষ্টাব্দ ) যমানা পর্যন্ত পৌছতে পৌছতে অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, আবু হানীফা (র:)-এর জনৈক বিরুদ্ধবাদী ফকীহ একদা উযীরে আযম ফযল ইবনে সহলকে পরামর্শ দেন যে, হানীফা ফিকাহর প্রয়োগ বন্ধ করে দেয়ার নির্দেশ জারী করা হউক। ইযীরে আযম বিশেষজ্ঞদের ডেকে এ ব্যাপারে তাদের মতামত চান। ‘তারা সকলেই এক মত হয়ে বলেন, এটা বলবেন না, সারা দেশের লোক আপনার বিরুদ্ধে ফেটে পড়বে। যে ব্যক্তি আপনাকে পরামর্শ দিয়েছে, তার জ্ঞান অসম্পূর্ণ।’ উযীর বলেন, আমি নিজেও এদের সাথে একমত নই। আর আমীরুল মুমিনীনও এতে রাযী হবেন না। [ আল-মাক্কী, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা-১৫৭-১৫৮। আল-কারদারী, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা-১০৬-১০৭। ]
এমনি করে ইতিহাসের এ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয় যে, এক ব্যক্তির প্রতিষ্ঠিত বেসরকারী আইন প্রণয়ন সংস্থার প্রণীত আইন নিছক নিজের চরিত্র বৈশিষ্ট্য এবং তার সংকলকদের নৈতিক মর্যাদা বলে নানা দেশ এবং নানা রাষ্ট্রের আইনে পরিণত হয়েছে। এ সাথে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ফল এ-ও দেখা দেয় যে, তা মুসলিম আইন গবেষকদের জন্য ইসলামী আইন প্রনয়নের এক নতুন পথ উন্মুক্ত করে দেয়। পরবর্তীকালে অন্য যতো বড় বড় ফিকাহ ব্যবস্থা প্রণীত হয়েছে, স্বীয় ইজতিহাদ পদ্ধতি এবং তার ফলাফলের বিচারে তা যতই স্বতন্ত্র হউক না কেন, কিন্তু এটাই ছিল সে জন্য নমুনা। এ নমুনাকে সামনে রেখেই তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।