কোরআন ও জ্ঞানের প্রাথমিক উৎস
ডঃ তাহা জাবির আল্ আলওয়ানী
সর্বশেষ ধর্ম ইসলাম হচ্ছে সকল সৃষ্ট জীবের জন্য ক্ষমা, আলো, নির্দেশনা ও ধন্বন্তরী। “আমরা তোমাকে সকল সৃষ্ট জীবের জন্য রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছি” (কোরআন-২১-১০৭)
এই বাণী ও তার গ্রন্থ কোরআন সর্বদা মানবতাকে নির্দেশনা দিয়ে যাবে এবং সবরকম বিচ্যুতি ও বিকৃতি থেকে অটুট থাকবে। মহান আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তায়ালা) [সুবহানাহু ওয়া তায়ালাঃ আল্লাহর প্রশংসা এবং তার সার্বভৌমত্ব অক্ষুন্ন থাকুক। আল্লাহ প্রসঙ্গে এ কথা বলা হয়।] বলেছেন, বাতিল না সামনের দিকে হতে না পিছন হতে একে মোকবেলা করতে পারে। এটা এক মহাজ্ঞানী ও স্ব-প্রশংসিত সত্তার নাযিল করা জিনিস (৪১:৪২)
পবিত্র কোরআন হচ্ছে সর্বশক্তিমান আল্লাহর কিতাব এবং সর্বশেষ নবী (নবীদের মোহর) হযরত মুহাম্মদ (দঃ) [সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামঃ মহানবীর (সাঃ)ওপর আল্লাহর শান্তি ও রহমত বর্ষিত হোক। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর নামোচ্চারণের সময় এই দরুদ পাঠ করা হয়] এর মাধ্যমে এটা মানব জাতির প্রতি নাযিল হয় হেদায়াত হিসেবে। বস্তুতপক্ষে মুহাম্মদ (দঃ) এর উপরে আর কোন নবী নেই এবং কোরআনের পরে আর কোন ওহী আসবে না।
হযরত মুহাম্মদ (দঃ) এর পূর্ব পযর্ন্ত ধারাবাহিকভাবে নবীদের প্রেরণ করা হতো। প্রত্যেক জাতির কাছে তাদের নিজস্ব ভাষায়, তাদের উপযোগী করে নবী রাসূল প্রেরিত হতেন। নিঃসন্দহে মানুষের প্রয়োজনের প্রতি সর্বাধিক লক্ষ্য রেখে নবীরা সাড়া দিয়েছেন।
অতীতে এমন কোন গোত্র বা জাতি ছিল না যাদের প্রতি নবী বা প্রেরিত পুরুষ প্রেরণ হয়নি।(৩৫:২৪)
আমরা যেখানেই কোন রাসূল পাঠিয়েছি সে নিজ জাতির জনগণের ভাষাতেই পয়গাম পৌছিয়েছে, যেন সে খুব ভালভাবে কথা বুঝিয়েছে বলতে পারে (১৪:২৪)
ইতিপূর্বেকার নবীদের মিশনে ঐশী চিহ্ন এবং শারীরি মুজিজা দেখানো হতো। উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে বিস্ময়াভিভূত করে আল্লাহর কালাম মেনে নিতে উদ্বুদ্ধ কার। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একজন নবী তার লোকদেরকে ছায়াদানের জন্য তাদের মাথার উপর পাহাড় উত্তোলন করতেন, সাগর বিভ্ক্ত করে দুই জলরাশির মধ্যে শুকনো রাস্তা দিয়ে তার গোষ্ঠী চলে যেতো, হাতের ছড়ি নিক্ষেপ করলে তা সাপে রূপান্তরিত হতো কিংবা পকেটে হাত ঢুকিয়ে তা পুনরায় বের করে আনলে তা চকমক করতো, তবে কোন ক্ষতি হতো না। আরেক নবীকে এক বিস্ময়কর উষ্ট্রী দেওয়া হয়েছিল প্রতীক ও নিদর্শন হিসেবে। তৃতীয় এক নবী মৃতকে জীবিত করতে এবং অন্ধ ও কুষ্ঠদের নিরাময় করতে পারতেন। এসব চিহ্ন ও মুজিজা দেখার পরও জনগণ নবীর প্রতি ঈমান না আনলে শাস্তি ও ধ্বংসের মাধ্যমে তাদের শিক্ষা দেয়া হতো। তবে আল্লাহ তায়ালা মুসলিম উম্মাহকে সম্মানিত করেছেন এবং তাদেরকে ধ্বংস থেকে রক্ষা করেছেন।
ম্ক্কার কাফেরগণ যখন মহানবী (সাঃ) কে তাদের জণ্য ঝর্ণাধারা থেকে সবেগে পানি প্রবাহিত করার, আকাশে মই লাগিয়ে তাতে আরোহণ করার অথবা স্বর্ণমন্ডিত একটি বাড়ীর অধিকারী হওয়ার দাবী জানাল আল্লাহ তাদের দাবীর প্রতি সাড়া দেন নি। নবী কিভাবে মানুষ হয়, এটাও তাদের প্রশ্ন ছিল।
এবং তারা বলে, এ কেমন রসূল যে খাবার খায় ও হাটে বাজারে চলাফেরা করে। তার নিকট কোন ফেরেশতা কেন পাঠানো হলো না যে তার সঙ্গে থাকতো এবং (অমান্যকারী লোকদের) ভয় দেখাতো। অথবা অন্ততঃ তার জন্য কোন ধনভান্ডার অবতীর্ণ করা হতো কিংবা তার নিকট কোন বাগান হতো যা থেকে সে রুজী লাভ করতো। আর এই জালেমরা বলে তোমরা তো এক জাদুগ্রস্ত ব্যক্তির পিছনে চলতে শুরু করেছ (২৫:৭-৮)
আমরা এই কোরআনের লোকদেরকে নানাভাবে বুঝিয়েছি, কিন্তু অধিকাংশ লো অস্বীকৃতিতেই দৃঢ় হয়ে থাকলো। (১৭:৮৯)
তারা বললো আমরা তোমার কথা মানব না যতক্ষণ পযর্ন্ত তুমি আমাদের জন্য জমীনকে দীর্ণ করে একটি ঝর্ণা প্রবাহিত করে না দেবে। কিংবা তোমার জন্য খেজুর ও আঙ্গুরের জন্য একটি বাগান রচিত না হবে আর তুমি এতে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত করে না দিবে। অথবা তুমি আকাশ মন্ডলকে টুকরো টুকরো করে আমাদের উপর ফেলে দিবে, যেমন তুমি দাবী করছো। কিংবা খোদা ও ফেরেশতাগণকে সামনাসামনি আমাদের সম্মুখে নিয়ে আসবে। অথবা তোমার জন্য স্বর্নের একখানি ঘর নির্মিত হবে কিংবা তুমি আসমানে আরোহন করবে। আর তোমার এই আরোহণকে আমরা বিশ্বাস করব না যতক্ষন তুমি আমাদের উপর এমন একখানি লিপি অবতরণ না করবে যা আমরা পড়ব। হে মুহাম্মদ! বলো, পাক ও পবিত্র আমার খোদা আমি একজন পয়গামবাহক মানুষ ছাড়া আরও কি কিছু?
লোকদের সামনে যখনই হেদায়াত এসেছে তখনই তার প্রতি ঈমান আনা হতে তাদেরকে কোন জিনিস বিরতি রাখে নি।
বিরত রেখেছে শুধু তাদের এই কথাটি যে, আল্লাহ কি (আমাদের মতো একবলে) মানুষকে নবী রাসূল বানিয়ে পাঠিয়েছেন। (১৭:৮৯-৯৪)
একই সুরায় কাফেরদের দাবীর ব্যাপারে আল্লাহ বলেন: আগের লোকেরা মিথ্যা মনে করে অমান্য করায় আমরা নিদর্শন পাঠাতে বিরত থেকেছি। আমরা চোখ খুলে দেওয়ার জন্য সম্পদ-এর প্রতি উষ্ট্রী এনে দিয়েছি। আমরা চোখ খুলে দেওয়ার জন্য সম্পদ-এর প্রতি উষ্ট্রী এনে দিয়েছি। আর তারা তার উপর জুলুম করলো। আমরা নিদর্শন তো এ জন্য পাঠাই যে, লোকেরা উহা দেখে ভয় করবে (১৭:৫৯)।
আল্লাহ তায়ালা অবশ্য হযরত মুহাম্মদকে (দ:) সুস্পষ্ট করে বুঝিয়ে দেন যে, সুস্পষ্ট চিহ্ন ও মুজিজার অভাবেই কাফেরগণ আল্লাহর বাণী প্রত্যাখান করে নি, তার অন্যান্য কারণও রয়েছে। হযরত মুসা (আঃ) [আলাইহিস সালামঃ তাঁর প্রতি আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক। অন্যান্য নবীদের বেলায় এই দোয়া পাঠ করতে হয়।] এর মাধ্যমে মিসরের ফেরাউন এবং জনগণকে সন্দেহাতীত চিহ্ন ও মুজিজা দেখানো হয়েছিল, তবুও তারা জনগণকে সন্দেহ আর ম্ক্কার কাফেরদের অনুরূপই প্রতিক্রিয়া দেখছিল।
আমরা মুসাকে নয়টি প্রকাশ্য নিদর্শন দান করেছিলাম। এখন তোমরা স্বয়ং বনী ইসরাঈলেন নিকট জিজ্ঞাসা কর, যখন তিনি তাদের কাছে আগমন করেন, ফেরাউন তাকে বললঃ হে মুসা আমার ধারণায় তুমি জাদুগ্রস্থ (১৭:১০১)।
আর আল্লাহ হযরত মুহাম্মদ কে (দঃ) বললেন যে, এই অহীর জন্য তিনি ছাড়া অন্য কোন নবী অথবা কোরআন ছাড়া অপর কোন নিদর্শন বা গ্রন্থের প্রয়োজন নেই এবং আমি তা তাদের মধ্যে বিভিন্নভাবে বিতরণ করি যেন তারা কিছু শিক্ষা গ্রহণ করে। কিন্তু অধিকাংশ লোক অকৃতজ্ঞতা ছাড়া কিছুই করে না। আমি ইচ্ছা করলে প্রত্যেক জনপদে একজন ভয় প্রদর্শনকারী পাঠাতে পারতাম। অতএব আপনি কাফেরদের কথা কখনও মানবেন না এবং কোআন নিয়ে তাদের সাথে বড় জিহাদ করুন (২৫:৫০-৫২)
এই সর্বশেষ অহীর মাধ্যমে কোরআন অধ্যয়ন, শ্রবণ ও অনুধাবন করে আল্লাহর বাণীর প্রতি ঈমান আনার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। যারা আগ্রহের সাথে সত্যের বাণী শুনতে এবং তা প্রত্যক্ষ করতে চায় তাদের মন-মানস ও হৃদয়ের কাংখিত পরিবর্তনের জন্য এটাই যথেষ্ট। তবে যাদের দিলে মোহর মেরে দেয়া হয়েছে তাদের উগ্রতা ও প্রগলভতা আগের মতই রয়ে যায়।
তথাপি এই লোকেরা বলে, এই ব্যক্তির উপর তার খোদার তরফ হতে নিদর্শন নাযিল করা হয়নি কেন? বল, নিদর্শনসমূহ তো আল্লাহর নিকট রয়েছে। আমি তো শুধু সুস্পষ্টভাবে ভয় প্রদর্শণকারী ও সাবধানকারী। এই লোকদের জন্য এটা (এই নিদর্শন) কি যথেষ্ট নয় যে, আমরা তোমার প্রতি কিতাব নাযিল করেছি যা এই লোকদের পড়ে শুনানো হয়? প্রকৃতপক্ষে এতে রয়েছে রহমত ও নসিহত সেই লোকদের জন্য যারা ঈমান আনে (২৯:৫০-৫১)।
এই উম্মাহর জীবনে আল্লাহ তায়ালা পড়াকে মূল বিষয় বানিয়েছেন। হযরত জিবরাঈল ফেরেশতা কর্তৃক হযরত মুহাম্মদ (দঃ) এর উপর নাযিলকৃত প্রথম শব্দ হচ্ছে ইকরা (পড়)। এর জবাবে নিরক্ষর নবী বললেন, আমি পড়তে পারিনা। এরপর ফেরেশতা তাঁকে আল্লাহর আদেশে (বাণী) শোনালেনঃ
পড় (হে নবী) ! তোমার খোদার নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। জমাটবাঁধা রক্তের এক পিন্ড হতে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। পড়, আর তোমার রব বড়ই অনুগ্রহশীল। যিনি কলমের সাহায্যে জ্ঞানদান করেছেন। মানুষকে এমন জ্ঞান দিয়েছেন যা সে জানতো না (৯৬:১-৫)
যে প্রতিক্রিয়ায় নবী করিম (স:) অহী পেতেন, তার শুরুর এই আয়াতগুলিতে [আয়াতঃ কুরআনের আয়াত। খোদার কুদরত অর্থেও ব্যবহৃত হয়।] দুটি নির্দেশ রয়েছে। এবং এর প্রত্যেকটিতে একটি ঐশী ও একটি মানবিক দিক রয়েছে।
প্রথম নির্দেশ হচ্ছে পড়তে। অর্থাৎ নাযিলকৃত অহী গ্রহণ, অনুধাবন ও ঘোষণা করতে। কোরআন যে আল্লাহর কালাম ও অহী এবং তিনিই তার নবীর কাছে এটা নাযিল করেছেন যাতে করে তা মানুষের কাছে সম্পূর্ণ ও গ্রহণযোগ্যভাবে পৌঁছে দেয়া যায়- এই নির্দেশের মধ্যে ঐশী দিকের প্রতিফলন ঘটেছে। আর মানুষের কাজ হচ্ছে এটা ভেবে দেখা, স্মরণ করা, অনুধাবন করা ও অব্যাহতভাবে শিক্ষা করা।
কোরআন পাঠে তাড়াহুড়া করো না, যতক্ষণ না তোমার প্রতি তার অহী পরিপূর্ণতায় পৌঁছে যায়। আর বল, হে খোদা! আমাকে অধিক ইলম দার কর (২০:১১৪)।
আমরা এই কোরআনকে উপদেশ গ্রহণের জন্য সহজ মাধ্যম বানিয়েছি। এ থেকে উপদেশ গ্রহণে কেহ প্রস্তু আছে কি? (৫৪:১৭)
”হে নবী! এই অহীকে খুব তাড়াতাড়ি মুখস্থ করে নেয়ার জন্য নিজের জিহ্বা নাড়াবে না। এটা মুখস্থ করিয়ে দেয়া এবং পড়িয়ে দেয়া আমাদের দায়িত্ব (৭৫:১৬-১৭)
সুতরাং আল্লাহর দায়িত্ব হচ্ছে নাযিল করা, প্রেরণ করা, সংগ্রহ করা ও সংরক্ষণ করা, মানুষের কাজ হচ্ছে পড়া, শিক্ষা করা এবং শিক্ষাদান করা যাতে রুহ পরিশুদ্ধ ও পরিস্কার হতে পারে। এরপর তারা খলিফা হিসেবে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সম্পাদনের এবং সভ্যতার নির্মাণে এবং মানব জাতির মধ্য উত্তম মানুষ সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান কাজে লাগাতে পারেঃ
এতো তিনিই যিনি উম্মীদের মধ্যে একজন রসূল স্বয়ং তাদের মধ্য হতে পাঠিয়েছেন, যিনি তাদেরকে তার আয়াত শুনান (৬২:২)।
অধ্যয়নের দ্বিতীয় প্রত্যাদেশে মানব সমাজজে বিশ্বজাহান পর্যবেক্ষণ এবং তার বিবিধ উপাদান ও উপকরণের অর্থ অনুধাবনের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এ সবই সৃষ্টি করেছন আল্লাহ এবং এ গুলিতে তার তাওহীদের প্রকাশ সুস্পষ্ট। আসলে মানুষের খোদ সৃষ্টিসহ সৃষ্টিতে ঐশী প্রাধান্য সুস্পষ্ট। তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এক জমাটবাঁধা রক্ত থেকে (৯৬:২)। জমাটবাঁধা রক্ত থেকে মানুষ এবং জীবন ও মৃত্যুর সম্পর্ক এবং এ পর্যায়লো এই সুশৃঙ্খল বিশ্বজাহানে ক্রিয়াশীল ঐশী শক্তির অন্যান্য চিহ্নের সাথে মিলে যায়। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে জ্ঞানার্জনে এবং সভ্যতা বিকাশের উপযোগী করে তৈরী করা। এটা আল্লাহন রহমতের সুস্পষ্ট প্রমাণ এবং সকলের কন্ঠ ও ভাষায় তাঁর গৌরব গাঁথা বিঘোষিত। ”পৃথিবীতে এমন কোন জিনিস নেই যা তার প্রশংসা করে না (১৭:৪৪)। অপর উদ্দেশ্যটি হচ্ছে অস্তিত্ব এবং সৃষ্টির যৌক্তিকতা ও অস্তিত্বের উদ্দেশ্য অনুধাবন।
তিনিই তোমাদেরকে পৃথিবীতে সৃষ্টি করেছেন এবং সেখানে বসবাস করতে দিয়েছেন। (১১:৬১)
আমি মানুষ এবং জ্বীনকে শুধুমাত্র আমার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি (৫১:৫৬)
এই দুটি পাঠ পরস্পর সম্পর্কযুক্ত এবং একই সাথে ঘটে থাকে এবং তা হয়ে থাকে আল্লাহর নামে। তদুপরি তাদের আন্তঃসম্পর্ক আল্লাহ ও মানুষের মধ্যে একটি যোগসূত্র সৃষ্টি করে এবং নিশ্চিতভাবে জানিয়ে দেয় খলীফা (প্রতিনিধি) হিসেবে এবং মহাবিচারকালে তিনি তার সহযোগী হন। “এবং তোমরা যেখানেই থাক তিনি তোমাদের সঙ্গে আছেন। (৫৭:৪)। আল্লাহ মানুষের প্রতি এতই রহম দিল যে, তিনি এই দুই অবস্থাতে কোনটিতেই মানুষকে একা ছেড়ে দেন না। বরঞ্চ এই আয়াতের মাধ্যমে জানা গেল যে, তিনিই মানুষকে পরিচালিত করেন:
”পড় এবং তোমার প্রভুই হচ্ছে অতি দানশীল।” তিনি তোমাদেরকে কলমের ব্যবহার শিক্ষা দিয়েছেন এবং যা জানতো না তা শিক্ষা দিয়েছেন (৯৬:৩-৫)
তিনি জানেন মানুষের দুর্বলতা, তার সামর্থের সীমাবদ্ধতা, তার জ্ঞানের এবং চিন্তার আপেক্ষিক স্বল্পতা।
তিনি যে সৃষ্টি করেছেন তা কি তিনি জানেন না? তিনি সু্ক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম রহস্যসমূহ সম্বন্ধে ওয়াকেফহাল এবং তাদের ব্যাপারে অত্যন্ত ভালভাবেই অবগত (৬৭:১৪)
মানুষকে দুর্বল প্রকৃতির হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছে (৪:২৮)। আর জ্ঞানের অত্যন্ত সামান্য অংশই তোমাদের দেয়া হয়েছে (হে মানুষ) (১৭:৮৫)।
আল্লাহ এভাবে আদমকে (আ:) সব কিছুর নাম শিক্ষা দিলেন। তিনি শিক্ষা দিলেন কলমের মাধ্যমে এবং মানুষ যা জানতো না তাও শিক্ষা দিলেন। উদ্দেশ্য মানুষের প্রথম পাঠ সম্পূর্ণ করা এবং তিনি প্রতিটি জিনিসই তার অনুগত করে দিলেন, তাকে বিশ্বময় ভ্রমণের আদেশ দিলেন এবং পর্যবেক্ষণ, চিন্তন ও অনুধাবনের জন্য প্রয়োজনীয় দিকগুলো খুলে দিলেন। সে যাতে দ্বিতীয় পাঠ নিতে পারে তার চিহ্নও বলে দিলেন। এই দুই পাঠের সম্মিলন হচ্ছে বিশ্ব এবং পরজগতের কল্যাণের পূর্বশর্ত। এই দুই পাঠের যে কোন একটির পরিত্যাগ অথবা অবহেলা প্রদর্শন অথবা তাদের মধ্যকার ভারসাম্যহীনতা ঘটানোর অর্থই হচ্ছে আল্লাহর কালাম থেকে দূরে চলে যাওয়া। এ ধরনের কার্যকারণের দুঃখজনক পরিণতি হচ্ছে দুনিয়ার জীবনকে সংকটময় করে তোলা এবং পরকালের জীবনকেও মারাত্মক ক্ষতির মধ্যে নিক্ষেপ করা।
”যারাই আমার আয়াত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে তাদের জীবন হবে সংকীর্ণ এবং কিয়ামতের দিন আমরা তাকে অন্ধ করে উঠাব (২০:১২৪)।
এ অবস্থায় মানুষ খলিফা এবং সাক্ষীদাতা হিসেবে তার অবস্থান থেকে বিচ্যুত হবে এবং অপমান ও দাসত্বের জীবন বরণ করে নেবে।
যারা খোদাকে প্রত্যাখ্যান করবে তারা স্ফূর্তি করবে (এই দুনিয়াতে) এবং গবাদিপশুর মত খাবে। আর দোযখ হবে তাদের বাসস্থান (৪৭:১২)।
তারা গবাদি পশুর মত-বরং আরো বেশী বিভ্রান্ত; কারণ তারা (হুশিয়ারী থেকে) একেবারেই বেপরোয়া (৭:১৭৯)।
দ্বিতীয় পাঠের প্রতি যথেষ্ট মনোযোগ না দিয়ে প্রথম পাঠের সাথে অতিরিক্ত সংশ্লিষ্টতার ফলে পাঠক অনেকগুলো ব্যাখ্যা বিশ্লেষনের অধিকারী হতে পারে যা তার ধারণা ও চেতনার প্রতি অত্যন্ত উপকারী হতে পারে। একই সাথে এটা তাকে এক ধরনের আধ্যাত্নিক স্থবিরতায় নিয়ে যেতে পারে এবং খলিফা ও সভ্যতার ধারক হিসেবে তার প্রয়োজন এবং দায়িত্বের সাথে অসম্পৃক্ত বিষয়ে আত্মলীন হতে পারে। এটা সীমিত পরিমাণে ব্যক্তিগত পর্যায়ে মেনে নেয়া যেতে পারে বা যুক্তিগ্রাহ্য হতে পারে তবে উম্মাহর বিস্তৃত পর্যায়ে যদি এটা ঘটে অথবা তার জীবনে বিধানের অংশ হিসেবে গ্রহণ করে নেওয়া হয় তাহলে তা হবে অত্যন্ত বিপজ্জনক। কারণ এর ফলে মানবিক মূল্যবোধের ধারণা অবহেলিত এবং প্রত্যাখ্যাত হবে। পরিণামে কোন ব্যক্তিজীবন দর্শনের এবং বিশ্বে তার অস্তিত্বের জন্য মানুষ হিসেবে যে ভূমিকা, তার প্রতি বিকৃত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করবে। এটা তখন এমন পর্যায়ে উপনীত হতে পারে যে, সে পৃথিবীতে তার অস্তিত্বকেই বোঝা হিসেবে গ্রহণ করবে এবং কেয়ামতের সাফল্যের প্রত্যাশায় চরম কৃচ্ছ্রতার মধ্যে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেয়ার চেষ্টা করবে।
কোরআনের কতিপয় বৈশিষ্ট্য
পবিত্র কোরআন ক্রমান্বয়ে নাযিল হয়েছে। নাযিলের সময় জনগণের হৃদয় ও মন মানস যাতে গ্রহণ, অনুধাবন এবং চিন্তা-ভাবনা করতে পারে। সে জন্য বিশেষ পরিস্থিতি ও পরিবেশ উপলক্ষে এটা নাযিল হয়েছে। এর ফলে জনসাধারণ তা বুঝতে পারত এবং তাদের হৃদয়-মনে কোরআনের শব্দ, অর্থ, আদেশ ও নির্দেশ স্থায়ীভাবে গেঁথে নিত। এরপর তাদের হৃদয় তা গ্রহণের জন্য উন্মুক্ত হতো, তাদের মন-মানস এগুলো অনুধাবন করত এবং তাদের মানসিকতা হতো উন্নত। সামগ্রিক জীবন এতে সাড়া দিত এবং তা সন্তুষ্টি এবং পবিত্রতার জীবনে রূপান্তরিত হতো।
পবিত্র কোরআন এভাবে প্রথম যুগ এবং পরবর্তী যুগের জন্য একটি দিক নির্দেশনা, একটি প্রমাণ ও একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র হতে পারে।
তারা বলে, এই ব্যাক্তির উপর সমস্ত কোরআন একই সময়ে নাযিল হয় না কেন?-হ্যাঁ, এরূপ করা হয়েছে এজন্য যে, আমরা উহাকে খুব ভালভাবে মনমগজে বদ্ধমূল করছিলাম আর (এই উদ্দেশ্যেই) আমরা উহাকে এক বিশেষ ধারায় আলাদা অংশে সজ্জিত করেছি (২৫:৩২)।
আর এই কোরআনকে আমরা অল্প অল্প করে নাযিল করেছি-যেন তুমি তা লোকদের শুনাও আর একে আমার ক্রমশঃ নাযিল করেছি (১৭:১০৬)।
পবিত্র কোরআন নাযিল হয়েছে একটি চ্যালেঞ্জ ও মুজিজা হিসেবে যা মানুষের হৃদয়ে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করত, ফলে তার আত্মা হতো আলোকিত। এভাবে খোদার বাণী গ্রহণ করার পথ উন্মুক্ত এবং তারা দেহ-মন উজাড় করে দিয়ে তা গ্রহণ করতো।
পবিত্র কোরআন প্রত্যেক স্থান ও কালের এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সকল মানুষের উপযোগী মৌলিক ধারণা, সাধারণ বিধি, নির্দেশনা এবং উপদেশ রয়েছে। যদি নাযিল হওয়ার সময়ের সাথে সংশ্লিষ্ট ছোট খাটো ঘটনা ও সমস্যা নিয়ে এতে আলোচনা করা হতো তাহলে সময় ও কালের সার্বজনীনতার অনন্য বৈশিষ্ট্য তার থাকত না এবং পরবর্তী যুগের মানুষ তাতে দেখতে পেতো ব্যাপক অসংগতি ও অসামঞ্জস্যতা। যেসব বিশেষ সমস্যার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেয়া হয়েছে সেগুলো প্রত্যেক কালের পরিস্থিতির সাথে অনিবারর্যভাবে একই প্রকৃতির ও বিধির এবং পূর্ববর্তী গোষ্ঠী ও মানুষের ইবাদর, উত্তরাধিকার ও ইতিহাসের সাথে সংশ্লিষ্ট। মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনের সংরক্ষরণের ওয়াদা করে বলেছেন,
আমরা নিঃসন্দেহে কোরআন নাযিল করেছি এবং আমরা নিশ্চিতই তা (বিকৃতি থেকে) রক্ষা করব (১৫:৯)।
কোরআনকে তার মূল ভাষায় সংরক্ষণের পেছনে উদ্দেশ্য (এবং অর্থ ও ব্যাখ্যা অনুসারে একে আরবীতে প্রচারের নিষেধ) ছিল এটা নিশ্চিত করা যে আল্লাহ মানব জাতির জন্য যেরূপ জীবন পদ্ধতি পছন্দ করেছেন তা প্রতিষ্ঠা করতে যেন এ গ্রন্থটি (সর্বকালের) সক্ষম থাকে। কোটি কোটি মুসলমান পবিত্র কোরআন নাযিল হওয়ারকালে যেসব শব্দে ও আকারে ছিল-সেভাবেই পড়ছে ও আবৃত্তি করছে। এরফলে মুসলমানদের মত ও পথ যত রকমের হোক না কেন সকল কালের এবং সকর দেশের মুসলমানরা কোরআনকে ভিত্তি হিসেবে ধরে নেয় এটা আল্লাহর এক বিস্ময়কর কুদরত। এজন্যে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (দঃ) এবং তার সাহাবী ও নেতৃস্থানীয় ফকিহগন [ফকিহ (বহুবচন ফুকাহা): ফিকাহ শাস্ত্রে পন্ডিত ব্যক্তি, এরূপ আলিম (বহুবচন উলামা) অর্থ পন্ডিত।] দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন যে, কোরআনের প্রত্যেকটি অক্ষর মানুষের মননে প্রথমে গেঁথে রাখতে হবে, এরপর লিখে রাখা হবে। একই ধারা মহানবীর (দঃ) সাহাবীদের পক্ষ হতে অনুসরণ করা হয়েছে বলে তাবেঈনরা (যারা সাহাবীদের দেখেছেন) জানিয়েছেন। সাহাবীরা পবিত্র কোরআন ছাড়া অন্য কোন কিছু লিখে রাখা নিষিদ্ধ মনে করতেন। অন্যান্য বিষয় বাস্তব প্রয়োগ সংক্রান্ত এবং তা ছিল তার শিক্ষা সম্পর্কে। ধর্মীয় বা অন্য কোন গ্রন্থের বেলায় এ ধরনের অবস্থা কখনো ঘটেনি।
কোরআনের অর্থ সম্পর্কে বলা যায়, মহানবী (দঃ) প্রত্যেক আয়াতের ব্যাখ্যা করার জ্ঞান রাখতেন। তবে তিনি তা করতেন না। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেছেন, আল্লাহর নবী হযরত জিবরাঈলের (আঃ) মারফত শিক্ষা পেয়ে অল্প কিছু আয়াতের ব্যাখ্যা করেছেন। এসব আয়াত গায়েব (অদৃশ্য) সম্পর্কিত এবং এমন আরো কিছু বিষয় যা শুধু অহীর মাধ্যমেই জানা সম্ভব। ফলে কোরআনের তাফসীর ক্রমশঃ বিস্তার লাভ করতে থাকে শতাব্দীর পর শতাব্দী মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা নানা পথে কোরআন চষে বেড়িয়েছেন। এদের কেউ সফল হয়েছেন, কেউ হন নি। মহানবীর (দঃ) সাহাবীরা অহী নাযিল হওয়া প্রত্যক্ষ করেছেন এবং নাযিল হওয়ার কারণ, নাসিখ এবং মানসুখ আয়াত [আল নাসিখ (বাতিল): কোরআনের এমন আয়াত যার বিষয়বস্তু অন্য একটি আয়াত দ্বারা বাতিল হয়েছে, এ জন্য এদের বলা হয় মানসুখ।] এবং এসব আয়াতের সাথে সম্পর্কিত কারণ জানতেন। ইমাম গাজ্জালী (রহঃ) এবং ঈমাম কারতবী (রহঃ) বলেছেন,
সাহাবীরা তাফসীর সম্পর্কে যেসব বলেছেন তা সবই রসূলে করীম (দঃ) থেকে এসেছে-এ কথা মনে করা দুটো কারণে ভুল। এর একটা হচ্ছে মুহাম্মদ (দঃ) অল্পসংখ্যক আয়াতেরেই তাফসীর করেছেন। হযরত আয়েশা (রাঃ) এরূপ মত পোষণ করেন। অপর কারণটি হচ্ছে তারা স্বয়ং বিভিন্ন বিষয়ে তাদের তাফসীরে ভিন্ন মত পোষণ করেছে যার সমন্বয় সাধন করা হয়নি এবং মহানবী (দঃ) থেকে যার সব কিছু ব্যাখ্যা করা হয়নি, যদিও অনেকেই এরূপ করে থাকতে পারেন।[বিন আশুর: শায়খ মুহাম্মদ আল তাহার; তাফসীর আল তাহরীর ওয়া আল তানবীর, আল দার আল তিউনিসিয়া, তিউনিস, ১৯৮৪ পৃ: ২৮-২৯।]
সীমিত পরিমাণে কোরআন শরীফ অনুধাবনের ফলে মেধা বা মননের ক্ষেত্রে যে সংকটের সৃষ্টি হয় তার ফলে একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অথবা কোর ক্ষেত্রে বা বংশের জন্য এর অর্থ বন্দী হয়ে পড়ে।
মূলতঃ কোন মুসলমানের পক্ষে খোদার নিকটবর্তী হওয়ার সবচেয়ে কার্যকর দিক হচ্ছে কোরআন অধ্যয়ন এবং সাথে সাথে তার আয়াত ও অর্থ সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করা। এর বিপরীতক্রমে অনুধাবন ছাড়া পাঠ বা অধ্যয়ন সমর্থনযোগ্য নয়। ফকীহগণ এ ব্যাপারে একমত যে, অনুধাবন ও অনুধ্যান সহকারে অল্প পরিমাণ পড়া ও চিন্তা-ভাবনা করা অনুধ্যান ছাড়া বেশী পড়ার চাইতে উত্তম। এখানে অনুধ্যান বলতে আমরা বুঝি আয়াতের আবৃত্তি করা, পর্যালোচনা করা, এর অন্তর্নিহিত সকল অর্থ জানার লক্ষ্যে আলোচ্য অংশের বিশদ আলোচনা করা এবং মেধাবী ও বুদ্ধিবৃত্তির মননশীল লোকদের জন্য আল্লাহ যে অন্তর্নিহিত অর্থ সাজিয়ে রেখেছেন সে ব্যাপারে অবাধ ও অব্যাহত চিন্তা-ভাবনার সুযোগ দান।
ঐশী গ্রন্থ হিসেবে কোরআন হচ্ছে সর্ব প্রকার জ্ঞানের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সূত্র এবং মানবিক ও সমাজ বিজ্ঞানের পন্ডিতদের জন্য একটি প্রামাণ্য নির্দেশিকা। এতে সাধারণ বৈজ্ঞানিক সূত্র এবং নির্দেশনা রয়েছে যা মানুষের বৈজ্ঞানিক স্পৃহাকে জাগ্রত ও পরিচালিত করে। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে বহু মুসলমান দীর্ঘদিন এ ধারণা পোষণ করে আসছেন যে, পবিত্র কোরআন হচ্ছে মূলতঃ বিভিন্ন জাতির অতীত ইতিহাসের একটি সূত্র। এর কাহিনীগুলো বর্ণনা করা হয়েছে হুশিয়ারী বাণী হিসেবে, এছাড়া কিয়ামত এবং অদৃশ্য বিষয় ও ফিকাহর [ফিকাহ: আইন কানুনের মাধ্যমে ইসলামী জ্ঞান; ইসলামের আইন জ্ঞান; উসূলে ফিকাহ; ইসলামী জুরিস প্রুডেন্স বিজ্ঞান অর্থাৎ ইসলামী আইনের উৎস থেকে আইন প্রণয়ন পদ্ধতি এবং এসব আইনের আওতা বা পরিধি নির্ণয়] খুঁটিনাটি বিধিবিধান সম্পর্কে একটা তথ্যের ভান্ডার।
তারা এর কবিত্বপূর্ণ ভাষা, ষ্টাইল (style) এবং আরবী ভাষার ওজস্বিনী ছন্দ ও ভাষাগত সৌর্যর অনুকরণীয় দিকের যাদুকরী সৃজনশীলতার ব্যাপারেই বেশি দৃষ্টি নিবন্ধ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে প্রাথমিককালে পন্ডিতরা পবিত্র কোরআনের বিস্ময়কর গুণাগুণের সমীক্ষায় প্রায় এ তিনটি বিষয়ের মধ্যেই সীমিত রাখতেন। আল রূমানি, আলবাকিল্লানি, আলমুরযানি ও কাজী আয়াজ এবং অন্যান্য পন্ডিতদের গ্রন্থরাজিতে তা দেখা যায়, পবিত্র কোরআনকে ফিকাহ এবং আইনের উৎস হিসেবেই গণ্য করা হয়েছে, যা কোরআনের দুইশ থেকে পাঁচশ আয়াতের মধ্যে সীমিত। বাকী আয়াতগুলি মৃদু তিরস্কার ও হুশিয়ারী এবং মানসিক উন্নতি সাধনের একমাত্র লক্ষ্যেই প্রেরিত হয়েছে। তবে এ ধরনের বিধি-নিষেধ কোরআনের মুজিজাকে ভাষার অলংকরণে সীমাবদ্ধ করা ছাড়াও যেসব বিষয় নবায়নযোগ্য এবং যে কোন স্থান ও কালে প্রয়োগযোগ্য এবং যা কোরআনের বিস্ময়কর প্রকৃতির সাক্ষীস্বরূপ এসব বিষয়ে খুঁজে বের করার ব্যাপারে উৎসাহ হ্রাস করে দেয়।
আমরা যেহেতু ইসলামী রেনেসাঁর লক্ষ্যে একটি চমৎকার সমকালীন ইসলামী জীবন ধারা রচনা করতে চাই সে জন্য আমাদের সচেতন থাকতে হবে যে, ফিকাহ সম্পর্কিত বিধান পবিত্র কোরআনের ব্যাপক আওতার খুব সামান্য অংশই মাত্র জুড়ে আছে। স্মরণ রাখতে হবে যে, পবিত্র কোরআনের সকল আয়াত অনুধাবন এবং চিন্তাভাবনা করার জন্য মুসলমানদেরকে তাদের মেধা কাজে লাগাতে হবে। মানুষের ফিতরাতের (স্বভাব প্রকৃতি) ক্ষেত্রে এবং সামাজিক ও ফলিত বিজ্ঞানের সকল জ্ঞানের প্রাথমিক উৎস ও ভিত্তি হিসেবে কোরআনকে বেছে নিতে হবে। বস্তুতঃ জ্ঞানের যে কোন ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ প্রত্যেক মুসলমানকে অনুপ্রেরণা এবং নির্দেশনার জন্য কোরআনের প্রতি মনোনিবেশ করতে হবে। খোদায়ী গ্রন্থের সচেতন এবং চিন্তাশীল তার জ্ঞানের ভান্ডারকে সংশোধন, পরিবর্ধন এবং পুনর্বিন্যাস করতে সাহায্য করবে। এর ফলে মুসলমানরা কোরআনের সত্যিকার উম্মাহ গড়ে তুলতে পারবে। তবে এ পর্যায়ে উপনীত হওয়ার পূর্বে আমাদেরকে বেশ কিছু বিষয় অর্জন করতে হবেঃ
পবিত্র কোরআনের মুজিজার বিষয় সংক্রান্ত অধ্যয়নের ক্ষেত্রটি পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। সাধারণভাবে মুজিজার বিষয় সংক্রান্ত অধ্যয়নের ক্ষেত্রটি পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। সাধারণভাবে মুজিজা হিসেবে বর্ণিত কোরআনের এসব বিষয়ে আধুনিক মুসলমানরা অতিরিক্ত বৈশিষ্ট্য হিসেবে কি কি যোগ করতে পারে তা চিন্তা করা প্রয়োজন। বিশেষতঃ গবেষণার বিষয়ের মধ্যে মানুষের ফিতরাতের ওপর কোরআনের প্রভাব, যেকোন স্থান বা কালের সর্বোত্তম মানুষ এবং সর্বোত্তম পরিবার গড়ে তোলায় তার সামর্থ এবং সমাজ ও জাতি গঠনে তার প্রভাব অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। মুসলিম মনস্তত্ত্ববিদগণ ও সমাজতত্ত্ববিদগণ এ ব্যাপারে আগ্রহের সাথে গবেষণা করতে পারেন। একইভাবে মুসলিম ফলিত বিজ্ঞানী এবং পন্ডিতরা কোরআনে মূল্যবান উপকরণ খুঁজে পেতে পারেন। মুসলিম চিন্তাবিদ আলেমগণ সুন্দর মানব জীবন এবং ন্যায়সঙ্গত, সহজে অনুধাবনে সক্ষম ও বাস্তবে প্রযোজ্য একটি পদ্ধতির দৃঢ়ভিত্তি রচনায় সমর্থ আহকামের ক্ষেত্রে তাঁর মুজিজার বিষয়ে গবেষণা করতে পারে।
দ্বিতীয় পর্যায়ে পবিত্র কোরআন পাঠ এবং তফসীরের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে হবে। দেশ ও জাতিসমূহের অতীত, কিয়ামত এবং ফিকাহের বিধান সম্পর্কে জ্ঞানার্জনের তিনটি উদ্দেশ্যের বাইরে যেতে হবে। এছাড়া আরও অপরিহার্য উদ্দেশ্য থাকতে পারে, এদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছেঃ
১. মানুষের জীবনাচরণ এবং ব্যক্তিগত, সামাজিক আচারণ ও ফিতরাত সম্পর্কিত বিজ্ঞানের ব্যাপারে সাধারণ নির্দেশনা লাভ।
২. সমাজ ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার সংস্কারের লক্ষ্যে মৌলিক বিধি ও নির্দেশনা সম্পর্কে জ্ঞানার্জন, মানবিক এবং সমাজ প্রকৃতির সাথে সঙ্গতি রেখে এ জ্ঞানার্জন করতে হবে এবং এই লক্ষ্য কিভাবে অর্জিত হবে সে সম্পর্কে প্রচেষ্টা চালাতে হবে। আমরা নিম্নোক্ত দুটি উদ্দেশ্যে সামাজিক বিজ্ঞানের সকল শাখাকে শ্রেণীবদ্ধ করতে পারি। এভাবে পবিত্র কোরআন সকল শ্রেণীর বৈজ্ঞানিক ও পন্ডিতের কাছে নির্ভরযোগ্য রেফারেন্স এবং নৈতিক মাপকাঠিতে পরিণত হয়, যে রেফারেন্সের বিষয়বস্তু কখনো সেকেলে হবে না। সামাজিক ও ফলিত এবং সাহিত্যের বিশেষজ্ঞরা প্রাত্যহিক পরামর্শের জন্য এখানে মূল্যবান উৎস খুঁজে পাবেন। এর অর্থ হচ্ছে একজন মুসলমান বর্তমানে পবিত্র কোরআনকে যেভাবে দেখছে তা থেকে ভিন্নরূপে দেখতে হবে; বর্তমানে তারা আল্লাহর রহমত লাভের আশায় অথবা বিশেষ বিশেষ বিধান জানার উদ্দেশ্যে কোরআন পড়ে থাকে। এক্ষেত্রে দুধরনের তাফসীর সম্পর্কে আমাদেরকে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে সমাধান করতে হবেঃ আল তাফসীর বাই আল মাসুর (মহানবী এবং সাহাবীদের থেকে তথ্য অনুসারে ব্যাখ্যা করা) এবং আল তাফসীর বাই আল রাই (স্বাধীন চিন্তা-ভাবনার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা) এই বিষয়টি গুরুত্বের দাবী রাখে কারণ এখনকার আলেম ও পন্ডিতগণ তাঁদের ব্যাখ্যা ও সিদ্ধান্তের সমর্থনে মহানবী (দঃ) ও সাহাবীদের জীবনধারা সম্পর্কে সবসময় খোঁজ রাখতে পারেন না। সুতরাং তাদের বক্তব্যে ব্যক্তিগত মতামতের প্রাধান্য থাকবে বেশী। এখন প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে, হাদীসের গ্রন্থরাজি বিদ্যমান থাকার প্রেক্ষাপটে আল তাফসীর বাই আল রাই এর পক্ষে কিভাবে কাজ করা যাবে? হাদীসে [হাদিস (বহুবচন আহাদিস) রসূলে করিম (সঃ) এর পবিত্র মুখ নিঃসৃত বাক্য ও কর্মের সমষ্ঠির নাম হাদিস। ইংরেজী H (Capital-H) অক্ষর দ্বারা রসূলে হাদিসের সমষ্ঠি বুঝায়। হাদিসের পন্ডিতদের মুহাদ্দিসীন বলা হয়।] ব্যক্তিগত মতামতের ভিত্তিতে কোরআন ব্যাখ্যা করতে সুষ্পষ্টভাবে নিষেধ করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে মহানবীর (দঃ) অনেক সাহাবী, তাবেঈন সুন্নাহর সমর্থন ছাড়া কোন প্রকার ব্যাখ্যা দানে বিরত থাকতেন। তাহলে আমরা কি এখন যেকোন বিষয়ে খাঁটি মুসলিম গবেষক প্রত্যাশা করতে পারিনা? যিনি পবিত্র কোরআনের আয়াত ব্যাখ্যা করতে তাঁর যুক্তি প্রয়োগ করবেন? অবশ্য এটা একটা বড় এবং নাজুক প্রশ্ন। এর উত্তর স্পষ্ট হয়ে আসবে নিচের আলোচনা লক্ষ্য করলে।
আমরা বলেছি মহানবী (দঃ) থেকে তাফসীর বাই আল মাসুর এর সীমিত সংখ্যক গ্রন্থ রয়েছে। সুতরাং যুক্তির দাবী এই যে, মুসলিম বুদ্ধিজীবীদেরকে কোরআনের আয়াত অনুধাবনের জন্য চিন্তা-ভাবনা, অনুধ্যান এবং যুক্তির সাহায্যে গ্রহণের অনুমতি দিতে হবেঃ
যুগ যুগ ধরে তাফসীরের বহুসংখ্যক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে এবং তাফসীরকারক গণ পবিত্র কোরআনের বিধান ও অন্যন্য বিষয়ের অর্থ ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে বহুমুখী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছেন। ইমাম ফখরুদ্দিন আল রাজি (অফাত ৬০৬ হিজরী) বলেছেন, তিনি যদি ইচ্ছা করতেন তাহলে সুরা ফাতিহার ব্যাখ্যায় একটি উট বোঝাই করার গ্রন্থাদি লিখতে পারতেন। কার্যত এই সুরা সংক্রান্ত তার তাফসীর লিখিত হয়েছে এক বিরাট গ্রন্থে। ইবনুল আতিয়্যাহ, আল কুর্তুবী, ইবনুল সাববাগের ন্যায় বহু আলেম একটি আয়াতের লব্ধ অর্থ থেকে শত শত বিষয় উথত্থাপন করতেন পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য। এ প্রসংগে নতুন নতুন প্রশ্ন উত্থাপিত হতো এবং মহাজাগতিক আইন, সভ্যতার ধরন প্রভৃতির সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে চিন্তা ভাবনা চলতো। এসবের দরুন আল কোরআন অবতীর্ণ অন্যান্য আসমানী কিতাবের মধ্যে অন্য বৈশিষ্টের অধিকারী। অবশ্য এসব বিষয়ে আগে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়নি বা রাসূলে করীম (দঃ)এর ব্যাখ্যাও দেননি। এখন পর্যন্ত অন্যান্য উলেমা ও পন্ডিতগণ তাফসীর করার সঠিক শর্তাবলী পূরণ না করা পর্যন্ত পবিত্র কোরআনের ব্যাখ্যার এই দৃষ্টিভঙ্গি বাতিল করে দেননি। তাইয়্যেবীর ভাষায় এসব শর্তাধীন তাফসীর হতে হবে (মূলগ্রন্থের) প্রকৃত বাক্যের শর্তের সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং কৃত্তিমতা, অস্বাভাবিক আচরণ, বাগাড়ম্বর ও বাহুলতামুক্ত [বিন আশুর; প্রাগুক্ত পৃষ্ঠা-১২]।
সুতরাং কোরআনের তাফসীরে ব্যক্তিগত অভিমতের ব্যাখ্যা যে, অর্থে হাদীসে নিষেধ করা হয়েছে তা নিম্নোক্ত শ্রেণীতে পড়েঃ
১) আরবী ভাষা, তার স্টাইল শরীয়তের উদ্দেশ্যে নসিখ ও মনসুখ আয়াতের প্রশ্নে ব্যাপক ব্যুৎপত্তি ছাড়া এবং বিশেষ আয়াতের শানে নযুলের প্রতি মনোনিবেশ না করে ব্যক্তিগত মতামতের সাহায্যে তাফসীর করা। এই ধরনের নৈমিত্তিক তাফসীর হচ্ছে পুরোপুরি অনুমান সর্বস্ব এবং সত্যের অগ্রগতিতে কোন অবদান রাখেনা।
২) চিন্তা ভাবনা ও অনুধ্যানের ভিত্তিতে তাফসীর করা তবে এসব তাফসীরকারক আয়াতের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল বিষয়ের ব্যাপারে সমন্বিত দৃষ্টি দিতে না পারার কারণে এই তাফসীর ত্রটিপূর্ণ। এক্ষেত্রে তাফসীরকারক আয়াত অথবা এই বিষয়ের যে কোন অর্থের বাহ্যিক অর্থ ধরে নিয়ে উপসংহার টানেনে এবং ধরে নেন যে, শুধু এই অর্থে আলোচ্য আয়াত নাযিল হয়েছে।
৩) সর্বশেষ শ্রেণীই হচ্ছে তাফসীরকারক যদি কোন বিশেষ গোষ্ঠীর চিন্তার বা মতের সমর্থক হয়ে থাকেন যার ফলে তিনি ভাষাশৈলীর অর্থ এবং আয়াতের শানে নুযুলের প্রতি লক্ষ্য না রেখে তার নিজস্ব মতামতের স্বপক্ষে কোরআনের আয়াতের ব্যাখ্যা দিতে চান। উদাহরণস্বরূপ বায়ানীয়াহ গোষ্ঠীর কথা বলা যায়। তারা তাদের নেতা বায়ান বিন শামান আল তামিমী প্রসঙ্গে বলেন, এই আয়াত হচ্ছে মানুষের প্রতি একটি বয়ান (একটি সোজাসুজি বিবৃতি) (৩:১৩৮)। কাদিয়ানীরা সুসংবাদদাতা এমন এক রাসূলের যে আমার পরে আসবে এবং যার নাম হবে আহামদ (৬১:৬) এই আয়াতের আহমদ অর্থ গোলাম আহমদ কাদিয়ানী হিসেবে দাবী করেছে। বাতেনীরা দাবী করেন যে, কোরআনের একটি জাহেরী ও একটি বাতেনী অর্থ রয়েছে। জাহেরী অর্থ মুসলমানরাই অনুধাবন করে থাকেন। অপরদিকে বাতেনী অর্থ তারা কাজে লাগান অতীত দর্শন, প্রাচীন, ধর্মীয় বিশ্বাস অথবা তাদের বিভিন্ন নেতার বিভ্রন্তিকর মতের সমর্থনে সংগৃহীত কুসংস্কারের পক্ষে। কেউ যাতে তাদের যুক্তি খন্ডন করতে না পারে সে জন্যে তারা উম্মাহর নেতৃস্থানীয় পন্ডিতবর্গ এই ধারণা খন্ডন করতে এবং এর উদ্দেশ্য তুলে ধরতে পারেনি।
এরপর এক ধরনের চিহ্ন যা বর্তমানে প্রতীক হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে তার কথা এসে যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একটি আয়াতের প্রতীকী অর্থ রয়েছে যাতে এমন কিছু বিষয় রয়েছে যা তাৎক্ষনিকভাবে চেতনায় ধরা পড়েনা এবং ঐ ভাষাতেও যার অর্থ প্রতিফলিত নেই। এখানে দেখুন,
যে ব্যক্তি মসজিদসমূহে খোদার নাম স্মরণ করতে বাধা দেয় তা বিধ্বস্ত করতে চেষ্টা চালায়, তার চেয়ে জালেম আর কে হবে (২:১১৪) এখানে কেউ কেউ দাবী করতে পারে যে, মসজিদের অর্থ হচ্ছে হৃদয় কেন না আল্লাহর সাথে মানুষের সম্পর্ক হচ্ছে হৃদয়ের। এ ধরনের ব্যাখ্যা ভাষাগত দিক থেকে সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। তবে তিন পদ্ধতির তাফসীর গ্রহণযোগ্য হতে পারেঃ
প্রথমতঃ শব্দের সুষ্পষ্ট অর্থের অনুধাবনের মধ্যে সীমিত রাখা।
দ্বিতীয়তঃ শব্দের সুষ্পষ্ট অর্থ থেকে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া। সতর্ক চিন্তা ভাবনার পর বিজ্ঞ তাফসীরকারকগণ এ ধরনের সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেনে এবং এর ভিত্তি হবে প্রচলিত বাকধারার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ভাষাগত প্রেক্ষিতে এবং তা পবিত্র কোরআনের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্যের বিরোধী হবে না।
তৃতীয়তঃ তাফসীরকারক তার নিজস্বকালের বুদ্ধিবৃত্তিক, বৈজ্ঞানিক এবং সাংস্কৃতিক সঙ্গীদের ব্যবহার করে আয়াতের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে দেখতে চায় পবিত্র কোরআনের নির্দেশনার সাথে তা কতখানি সামঞ্জস্যপূর্ণ। এরপর তিনি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন আয়াতের নির্দেশিত অর্থের আলোকে কিভাবে তিনি এ বিষয়ের ব্যাখ্যা করবেন।
তিনি যাকে চান সুবুদ্ধি দান করেন, আর যে ব্যক্তি এই জ্ঞান লাভ করলো, প্রকৃতপক্ষে সে বিরাপ সম্পদ লাভ করলো। এসব কথা হতে তারাই শ্ক্ষিা ও উপদেশ গ্রহণ করতে পারে যারা বুদ্ধিমান (২:২৬৯)
আধুনিক মুসলিম অর্থনীতিবিদ যখন আল্লাহর এই আয়াত পড়ে ধনসম্পদ যেন তোমাদের বিত্তবানদের মধ্যে আবর্তিত না হয় (৫৭:৭) এবং ধনসম্পদ অর্জন এবং বিতরণ এবং জনস্বার্থে কিভাবে সর্বোত্তম পন্থায় এগুলি কাজে লাগানো যেতে পারে সে ব্যাপারে এমন এক ধারণা পেশ করে যা মুসলিম পন্ডিতরা কখনোই করেনি-তাহলে আগে কেউ তার মত বক্তব্য দেয়নি এতে হাদীসের সমর্থন নেই এই অজুহাতে তার বিরোধিতা করা উচিৎ নয়। তবে খাঁটি ইসলামপন্থি (উসুলিয়ান) [উসুলিয়ুন: মৌলবাদী হিসেবে কদর্থ করা হয় এবং বিশুদ্ধবাদী হিসেবে ভুল ব্যাখ্যা করা হয়। এর প্রকৃত অর্থ, বিশুদ্ধ এবং তাদেরকেই এ বিশেষণে বিশেষায়িত করা হয়, যারা কোরআন ও সুন্নাহর ঐতিহ্যবাহী ব্যাখ্যার প্রতি অনুরুক্ত এবং যারা ইজতিহাদ এর প্রতি অনুরক্ত নন (১৬ নম্বর টীকা দেখুন)] মনে করেন যে, ওহী নাযিলের সময় আরবদের মৌলিক ধ্যান-ধারণার বাইরে কোন অর্থে উনীত হওয়া যাবে না। তাদের অবস্থানেও সুচিন্তি ভিত্তির উপর স্থাপিত তবে তা আলোচনা করে দেখা যেতে পারে।
আল মুয়াফাকাত এর গ্রন্থকার আল সাতিবি বলেন,
নিরক্ষরদের শরীয়ত (উম্মীয়াত আল শরীয়া) [নিরক্ষর লোকদের অনুধাবনের জন্য প্রণীত] এর কিছু কিছু বিষয় তার জনগণ-আরবদের জন্য প্রণীত হলে ধরে নেয়া হবে তার ভিত্তিতেই বিধিবিধান রচিত হয়। এর একটা পরিণতি হতে পারে যে, বহু লোক কোরআন থেকে এই প্রত্যাশা করে যে, কোরআনের ভায়াতত্ত্ব, যুক্তিবিদ্যা, শব্দার্থবিদ্যা ছাড়াও সমসাময়িক ও পূর্বেকার জাতিসমূহের জ্ঞাত সকল প্রাকৃতিক বিজ্ঞান অন্তর্ভুক্ত থাকুক। কিন্তু ইতিপূর্বেকার অনুসৃত নীতির সাথে তা খাপ খায় না। সন্মানিত পূর্ব পুরুষগণ পবিত্র কোরআন, এর বিজ্ঞানময়তা ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে সর্বাধিক অবহিত ছিলেন। তথাপি তার সুনির্দিষ্ট বিধিনিষেধ এবং কিয়ামত সম্পর্কিত ধারণার বাইরে কোন বিষয় মতামত দেননি। হ্যাঁ পবিত্র কোরআনে আরববাসীর জানা ও পরিচিত বিজ্ঞানের কথা বিধৃত রয়েছে। অবশ্য এই সন্নেবেশিত বিজ্ঞান সম্পর্কে জ্ঞানী লোকেরা বিস্ময়াভিভূত হয়েছে [বিন আশুর, প্রাগুক্ত পৃ: ৪৪]।
পবিত্র কোরআন আইন কানুনের উৎস এবং আরবদের মত নিরক্ষর জাতির প্রতি নাযিল হয়েছিল-আল-সাতিবীর মতামত এই ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত। সুতরাং কোরআনের ধারণা এবং রচনাশৈলীর আরবদের নিজস্ব অনুধাবনের সামর্থ দ্বারা নির্ণীত হয়। বহুলোক শ্রদ্ধেয় আলেমের এই ধারণাকে অত্যন্ত ভ্রমাত্নক বলে মনে করেন। কারণ পবিত্র কোরআন প্রতিটি কালের ও স্থানের মানুষের জন্য নির্দেশক গ্রন্থ হিসেবে নাযিল হয়েছিল। ব্যাপকতা ও সমৃদ্ধিসহ আরবী ভাষা এই বাণী বহনের সবচেয়ে উপযুক্ত বাহন ছিল। অবশ্য এর অর্থ এই নয় যে, আরবদের এ মনমানসিকতা ভাষাতত্ব অথবা অন্যান্য অর্থের ব্যাপারে তারাই একমাত্র সমঝদার ছিল। তাছাড়া পবিত্র কোরআনে এমন বহু বিষয় রয়েছে আরবরা যা ইতিপূর্বে জানতো না বা বুঝতো না। এসব বিষয়ে সংক্ষিপ্ত পরিসরে বর্ণনা করা সম্ভব নয়।
আল্লাহ বলেছেনঃ এগুলো হচ্ছে অজানা কাহিনী যা আমরা তোমার প্রতি নাযিল করেছি। ইতিপূর্বে তুমি অথবা তোমাদের কেউ এ ব্যাপারে জানতে না (১১:৪৯)।
পবিত্র কোরআন নাযিলের সময় আরবদের উদ্দেশ্যে এমনভাবে বক্তব্য রাখা হয়েছে যাতে তারা সহজেই বুঝতে পারে। পরে সমঝোতার পরিধি বাড়ানো হলো এবং মূল রচনায় অবতীর্ণ নতুন নতুন পরিস্থিতি ও প্রভাবে নানা ধরনের অর্থের সৃষ্টি হয় যা ভাষাগত সীমাবদ্ধতায় সীমিত ছিল না। এটা কার্যত পবিত্র কোরআনের মুজিজার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। যুগ যুগ ধরে একটি একক গ্রন্থ অনুধাবন এবং একই অক্ষর ও শব্দ সমন্বিত থেকেও বিভিন্ন প্রয়োজনের জবাব দিতে সক্ষম হবে। হযতর আলী ইবনে আবু তালিব (রাঃ) এর বরাত দিয়ে তিরমিজি শরীফে বলা হয়েছে কোরআনের মুজিজা কখনও শেষ হবে না। যদি বলা হয় কোরআনের মূল বক্তব্যে ভাষাতাত্বিক অর্থের বাইরে যাওয়ার অনুমতি নেই, এ কথার অর্থ কোরআনের মুজিজার সীমাবদ্ধতা রয়েছে এবং তা সময় এবং স্থান দ্বারা সীমিত। কোন আয়াত সম্পর্কে পূর্ব পুরুষরা বিশেষ কিছু উল্লেখ না করে থাকলে তার অর্থ এ নয় যে, এসব বিষয়ে ব্যাখ্যা করা নিষিদ্ধ। এর সাধারণ অর্থ হচ্ছে, যেসব বিষয়ে তারা অভিজ্ঞ ছিলেন যার ব্যাখ্যা প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল সেসব ক্ষেত্রেই তারা ব্যাখ্যা করেছেন।
এসব বিষয় থেকে জানা যায় যে, কোরআন এবং বিভিন্ন বিজ্ঞানের সম্পর্ক সব সময়ই বিদ্যমান।
১) কোরআন থেকে বিভিন্ন রকম জ্ঞান বিজ্ঞান গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে তাওতীদ [তাওহীদ; খোদার একত্ববাদ; এই ধারণার পোষণ করা যে, আল্লাহ এক, সার্বভৌম, বিশ্ব জাহানের সৃষ্টিকর্তা, সমস্ত সৃষ্টিকূলের মালিক। তাওহীদ হচ্ছে ইসলামের নির্যাস], তাশরী (আইন প্রণয়ন) এবং উসুল (আইনের উৎস)।
২)এর উপর নির্ভরশীল অন্যান্য বিজ্ঞান। এগুলি হচ্ছে ভাষা বিজ্ঞান এবং বালাগাহ (অলংকার শাস্ত্র)।
৩)এমন জ্ঞান বিজ্ঞানের আভাস দেয়া হয়েছে যা কোরআন বুঝতে সহায়ক হয় এবং তার উপর আস্থা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত বহু মানবিক এবং সমাজ বিজ্ঞান ও কতিপয় জ্যোতির্বিদ্যা এবং কতিপয় ফলিত বিজ্ঞান।
৪) তাছাড়া এমন সব বিজ্ঞানও রয়েছে যার সাথে কোন দিক দিয়েই এর সম্পর্ক নেই। সুতরাং আধুনিক ইসলামিক সমাজবিজ্ঞান ও মানবিক বিষয়াবলীর প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইসলামিক চিন্তাধারার পদ্ধতি কৌশল সংস্কার এবং ইসলামিক সাংস্কৃতিক ব্যবস্থার বিনির্মানে প্রচেষ্টা চালাতে হবে। সর্ব পর্যায়ে এর উদ্দেশ্য হবে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনানুসারে পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহর [সুন্নাহ: রসূলে করিমের (স) কথিত, সম্পাদিত ও অনুমোদিত বা অনুনোমদিত কে কাজের সমষ্টি] সঙ্গে সর্বোত্তম উপায়ে এসব বিষয়ের সম্পর্ক সৃষ্টি করা। চারটি নীতির ভিত্তিতে এটা হতে পারে।
এসব নীতির প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হবে ইসলামিক সাংস্কৃতি পরিমন্ডলে পবিত্র কোরআনের পুনঃপ্রতিষ্ঠা, মুসলিম মানস এবং এ মধ্যেকার বিভক্তির অবসান এবং কোরআনকে সমসাময়িক মুসলমানদের জ্ঞানের প্রধান উৎসে পরিণত করা – যেমনটি ছিল অতীতে। তখন আমাদের পূর্বপুরুষগণ জীবন, মানুষ এবং মানবিক বিধি বিধান সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট ও সার্বিক জ্ঞানার্জনের জন্য তার (পবিত্র কোরআনের) আশ্রয় নিতেন।
দ্বিতীয় নীতি হওয়া উচিত রাসূলে করীমের (দঃ) সুন্নাহ অনুধাবনের জন্য একটি পদ্ধনি গড়ে তোলা এবং একটি ইসলামী সংস্কৃতি সভ্যতা নির্মাণে তা ব্যবহার করা।
তৃতীয়ত নীতি প্রণীত হবে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ইসলামী ঐতিহ্য অনুধানের জন্য সুষ্ঠু পদ্ধতির প্রয়োগ, আমাদের বর্তমান সংস্কৃতি গঠনে তার ব্যবহার এবং তা থেকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা লাভ।
চতুর্থ নীতি হবে উপলব্ধির পন্থা যাচাইয়ের মাধ্যমে সমসাময়িক আরব চিন্তা ধারার প্রতি মনোনিবেশ, তার ব্যবহার এবং তা থেকে উপকারিতা লাভ। পবিত্র কোরআন অনুধাবন ও প্রয়োগের জন্য পদ্ধতির উদ্ভাবনরক অগ্রাধিকার দানের কৌশল। এই প্রসংগে নিম্নোক্ত ক্ষেত্রে গবেষণা ও সমীক্ষায় মনোনিবেশ করার জ্ন্য একটি কোরআন ফাইল তৈরী করতে হবেঃ
১)পবিত্র কোরআন অনুধাবনের পন্থা এবং কোরআনকে আধুনিক মুসলমানদের সংস্কৃতি, জ্ঞান বিজ্ঞান এবং দিক-নির্দেশনার প্রাথমিক উৎসে পরিণত করা।
২) পবিত্র কোরআনের তাফসীর, তাবীল (অর্থের ব্যাখ্যা), শ্রেণী বিন্যাস ও অনুক্রমিকা, ইতিপূর্বেকার এবং বর্তমান মুসলিম বিজ্ঞানের সাথে তার সম্পর্ক ও সংশ্লিষ্টতা।
৩) অন্যান্য বিষয়ের উদ্দেশ্য হচ্ছে (ক) সুষ্ঠু উপায়ে পবিত্র কোরআনের বাস্তবায়নের ব্যাপারে মুসলিম মেধার পুনরুজ্জীবন এবং (খ) পবিত্র কোরআনকে আধুনিক মুসলিম সংস্কৃতি জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং সভ্যতার কেন্দ্রস্থল ও যথার্থ স্থানে পুনর্বহাল করা। এরপর মুসলিম বুদ্ধিমত্তা পুনর্গঠিত সংশোধিত হবে এবং পবিত্র কোরআন তার আলোকে বিতরণের ভূমিকা পুনরায় গ্রহণ করবে।
উল্লিখিত কোরআন ফাইল উদ্বোধন করা হয়েছে। শায়খ মুহাম্মদ আল গাজালীর কায়ফা নাতা আমাল মাআল কোরআন শীর্ষক গ্রন্থে। এই বিষয়ের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে অতঃপর সেমিনার ও সমীক্ষা পরিচালিত হবে।[ Methods of understanding the Quran, IIIT Virgina, 1991 Herndon]
নতুন সচেতনতার দিক নির্দেশ করে এই গ্রন্থে পরিবর্তনশীল বিশ্বের বাস্তব প্রেক্ষাপটে কোরআনকে নিয়ে আসার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। কার্যত কোন ব্যক্তির এই ধারণা নিয়ে এই গ্রন্থের ব্যাপারে কাজ করা উচিত হবে না।
যে গ্রন্থটি কোরআন এবং ইসলামিক বিষয়সমূহের ব্যাখ্যা করার ব্যাপারে বহু ভ্রান্ত ধারণা সংশোধন করতে গিয়ে সমীক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে সকল প্রশ্নে জবাব দেয় এবং সকল সমস্যার সমাধান পেশ করে। তথাপি এটা আধুনিক ইসলামিক পদ্ধতিগত সচেতনতা সৃষ্টির প্রথম ধাপ। এ ব্যাপারে মানবিক প্রেক্ষিতে ইসলামিক উত্তরাধিকার সম্পর্কে পর্যালোচনা ও মূল্যায়নের উপর গুরুত্ব দিতে হবে।
এই সমীক্ষা এবং এই বিষয়ে ভবিষ্যৎ গ্রন্থরাজি ইসলামী চিন্তাধারা সম্পর্কে ঐতিহ্য সূত্রে প্রাপ্ত গ্রন্থাদির ব্যাপারে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করবে না। প্রকারান্তরে এগুলি উত্তরাধিকার সূত্রে সেগুলির প্রমাণিত (Authenticated) এবং সকল ইসলামিক মাযহাব ও ভাবধারার প্রতি ইতিবাচক সাড়া দেয়, বিশেষ করে যেসব চিন্তাধারা অধঃপতন, পশ্চাদপদতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক স্থবিরতার যুগের আগে যার উদ্ভব হয়েছিল সেগুলির প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভংগি পোষণ করবে।
বুদ্ধিমান, যুক্তিপ্রবণ মানুষের কাছে পবিত্র কোরআনকে আরো গ্রহণযোগ্য করে তোলার ক্ষেত্রে ইসলামিক দায়িত্ববোধ পালনের জন্য এক নিয়োজিত করতে হবে। এই গ্রন্থটি বহু সংখ্যক সমালোচনামূলক নিবন্ধ নিয়ে রচিত।বিভিন্ন বিষয় এ ক্ষেত্রে আলোচিত হয়েছে-অন্যক্ষেত্রে রয়েছে পদ্ধতিগত নীতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কোরআনিক সচেতনতা গড়ে তোলার প্রচেষ্টা সম্পর্কিত প্রশ্নোত্তর-যে ক্ষেত্রে সমালোচনা বা বিশ্লেষণ ছাড়া বিদ্যমান যে কোন ধারণা অন্ধভাবে মেনে নেওয়া হয় না।
পবিত্র কোরআন এমন একটি উৎস যা থেকে পন্ডিতরা তাদের নিজস্ব বিশেষ জ্ঞানের ক্ষেত্রে অনেক কিছু সংযোজন করতে সক্ষম হয়েছেন। একই ভাবে বিশ্বকে অনুধাবনের ক্ষেত্রে এই মহাগ্রন্থ ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে; অবশ্য মানবিক চিন্তাধারার ঐতিহাসিক বিকাশের সাথে তাদের প্রয়োগ পদ্ধতি ভিন্নতর হয়েছে। যে ব্যক্তি পরস্পর সম্পর্ক যুক্ত গ্রন্থ হিসেবে পবিত্র কোরআন অধ্যয়ন করে তার দৃষ্টিভঙ্গি সেই চয়নকারী পাঠক থেকে ভিন্নতর হবে যিনি যথাযথ প্রেক্ষিত ছাড়া এক একটি আয়াত বিচ্ছিন্ন করে অধ্যয়ন করেন। একইভাবে কোন ব্যক্তি এই মহাগ্রন্থকে দেখেন গল্প, আইন কানুন, উৎসাহ ভীতি প্রদর্শনের একটি সংকলন হিসেবে। আবার অন্য পাঠক এটাকে দেখেন এক স্বয়ংসম্পূর্ণ বিশ্বকোষ হিসেবে যাতে মহাজাগতিক ও গতিশীল অস্তিত্ব আলোচিত, যার মাধ্যমে তিনি এই বিশ্বজগত, তার চলাচল এবং সময় ও স্থানের অব্যাহত পরিবর্তনশীল প্রেক্ষাপটে বিশ্ব সম্পর্কে একটি বস্তুনিষ্ঠ ধারণা লাভ করতে পারেন।
পবিত্র কোরআন তার নিজস্ব বিশেষ গুণাবলীর কথা ব্যাখ্যা করে বলেছে, এতো একটি পরিপূর্ণ ঐশী গ্রন্থ যা অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সকল কালের সকল ধরনের পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে সক্ষম।
(হে নবী) যে কিতাব আমরা তোমার প্রতি অহীর সাহায্যে পাঠিয়েছি তাহাই সত্য- সেই কিতাবগুলির সত্যতা প্রমাণকারী যেগুলি তার পূর্বে এসেছিল। আল্লাহ তার বান্দাহদের সম্পর্কে ওকেফহাল এবং তিনি প্রতিটি জিনিসের উপর দৃষ্টি রাখেন।পরে আমরা এই কিতাবের উত্তরাধিকারী বানিয়ে দিয়েছি সেই লোকদের যাদেরকে আমরা আমাদের বান্দাহদের মধ্যে হতে বাছাই করে নিয়েছি। এখন তো তাদের মধ্যে কেহ তো নিজের প্রতি যুলুমকারী, কেহ মধ্যমপন্থী আর কেহ আল্লাহর অনুমতি ক্রমে নেক কাজে অগ্রসর। এটাই বড় অনুগ্রহ (৩৫:৩১-৩২)
এ আয়াত সুস্পষ্টভাবে বলে দিচ্ছে যে, পবিত্র কোরআন তার নিজস্ব পুনঃনবায়ন প্রক্রিয়ায় যুগ যুগ ধরে সৃষ্ট পরিস্থিতি ও প্রয়োজনে প্রতিনিয়ত জবাব দিয়ে থাকে।
অতএব, আমি তারকারাজির অস্তাচলের শপথ করছি। নিশ্চয় এটা এক মহাশপথ-যতি তোমরা জানতে। নিশ্চয়ই এটি সন্মানিত কোরআন যা আছে এক গোপন কিতাবে, যারা পাক পবিত্র তারা ছাড়া কেউ একে স্পর্শ করবে না। (৫৬:৭৫-৭৯)।
কোরআনের মাধ্যমেই আল্লাহ তায়ালা আমাদের পূর্বপুরুষদের বিভিন্ন ঘটনা বর্নণা করেছেন। এই পবিত্র কোরআনে রয়েছে এক অনন্য বৈশিষ্ট্য-এটা শাশ্বত অভ্রান্ত এবং অতি পবিত্র আসমানী কিতাবঃ
আমরাই নিসঃন্দেহে আয়াত নাযিল করেছি এবং আমরাই তা রক্ষা করব (১৫:৯)। সুতরাং ভবিষ্যত বংশধরদের জন্য এটা একটা প্রামাণ্য রেকর্ড যা তাদের কাজে লাগবে।
হে মুহাম্মদ আমরা তোমার পূ্র্বেও যখন রাসূল পাঠিয়েছি, তো মানুষ পাঠিয়েছি: যাদের প্রতি আমরা আমাদের পয়গামসমুহ অহী করতাম। এই যিকরাওয়ালাদের নিকট জিজ্ঞাসা করে দেখ, যদি তোমরা নিজেরা না জান। অতীতের নবী, রাসূলদেরও আমরা উজ্জ্বল নিদর্শনসমূহ ও কিতাবসমূহ দিয়ে পাঠিয়েছিলাম। আর এখন এই যিকর তোমরার প্রতি নাযিল করেছি, যেন তুমি লোকদের সামনেই সেই শিক্ষার ধারার ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করতে থাক, যা তাদের জন্য নাযিল করা হয়েছে এবং যেন লোকেরাও চিন্তা ভাবনা করে (১৬:৪৩-৪৪)
ইতিপূর্বেকার আসমানী গ্রন্থের বিকৃতি ও পরিবর্তনের মোকাবেলায় এটি একটি শাশ্বত গ্রন্থ।
ইতিপূর্বে আমরা মুসাকে কিতাব দিয়েছিলাম, তখন তার ব্যাপারেও এরকম মতভেদ হয়েছিল। তোমরা খোদা যদি প্রথমেই একটি কথা সিদ্ধান্ত করে না দিতেন তাহলে এই মতভেদকারীদের চূড়ান্ত ফয়সালা করে দেওয়া যেতো। আর এই লোকরা কঠিন বিপরর্যয়কারী সন্দেহের মধ্যে নিমজ্জিত রয়েছে (৪১:৪৫)
তদুপরি কোরআনের রয়েছে অন্যান্য আরও গুণ। অহী নাযিলের সময় বিশেষ পরিস্থিতির ( এ সময় বিশেষ কারণের প্রেক্ষিতে অবতীর্ণ আয়াত ছিল বিক্ষিপ্ত) অবসানের পর এই মহাগ্রন্থ আল্লাহর নির্দেশেই পদ্ধতিগত কাঠামোগত ঐক্যে সাজানো হয়। আল কোরআন ঐশীভাবে সংরক্ষিত এবং সময়ের প্রয়োজন অনুসারে তার রত্নরাজি উন্মোচনের মাধ্যমে মানুষের সমস্যা সমাধানে তার চিরন্তন অবদান থেকে এই মহাগ্রন্থের গুণাবলী উপলব্ধি করা যায়-যেহেতু এটা বিশ্ব জগত, তার আন্দোলন এবং তার সম্পর্কের ব্যাপারে সার্বিক সচেতনতা সৃষ্টি করে। সে জন্য এটা সময়, স্থান এবং পরিবর্তনের উপর আধিপত্য বিস্তারী। এতে মহান আল্লাহর জ্ঞানসহ সমগ্র অস্তিত্বের চেতনা বিধৃত। সুতরাং অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ বংশধররা কোন ক্রমেই এই মহাগ্রন্থের চূড়ান্ত অধিকারী হতে সক্ষম নয়। পরিবর্তে তারা তাদের নিজস্বকালের চিন্তাপ্রবাহ এবং সভ্যতা ও ঐতিহাসিক পরিস্থিতির প্রয়োজন অনুসারে এই গ্রন্থ থেকে শিক্ষা নিয়ে থাকে।
শায়খ আল গাজালীর গ্রন্থের গুরুত্ব নতুন ব্যাখ্যা দানের জন্য নয় বরং জ্ঞানার্জন এবং সুস্পষ্ট পদ্ধতির প্রতি দিক নির্দেশনার আগে সমসাময়িক ইসলামিক চিন্তাধারাকে বহু অসম্পূর্ণতা ও ত্রুটি থেকে মুক্ত করার প্রয়াসই এর গুরুত্ব। ইসলামী সমাজেই এটা অর্জন করা যেতে পারে েএবং বিশ্বে ঘটমান পরিবর্তন ও তার পরিণতির সব কিছুই এ সমাজে অধিকৃত হয়েছে বলে আমরা দাবী করি না, তবে এ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলতে পারি। যে কোন ক্ষেত্রে চিন্তাধারা ও লক্ষ্যের সার্বজনীনতার ধারণা একটি ইসলামিক গুণ। মহানবীকে (দঃ) শেষনবী (খাতামুননবীঈন) এবং আল কোরআনকে সর্বশেষ এবং চূড়ান্ত আসমানী কিতাব হিসেবে উল্লেখ করে ইসলাম প্রথম বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় আন্দোলন শুরু করে। তদুপরি পশ্চিমে আটলান্টিক মহাসাগর থেকে পূর্বে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত সাম্রাজ্য বিস্তৃত করে ইসলামী সভ্যতায় হয় প্রাচ্য এবং তা প্রাচীন বিশ্বের মধ্যাঞ্চল বরাবর বহু সভ্যতা এবং জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে।
ইসলামিক কাঠামোয় বিশ্ব জনীনতা গভীরভাবে প্রোথিত; এজন্য বিশ্ব সভ্যতার সংকট এবং এর ইসলামী সমাধানের ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করা আমাদের অবশ্য কর্তব্য। অবশ্য এ কাজটি সম্পাদন করতে হবে পদ্ধতিগত সচেতনতার মাধ্যমে এবং এই পদ্ধতিতে সমসাময়িক মানব চিন্তাধারার সাফল্যকে একটি একক প্রেক্ষাপটে নিয়ে আসে এবং সমগ্র মানব ইতিহাসে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন করে-যদিও পবিত্র কোরআন কখনই পরিবর্তন বা আধুনিকায়ন করা হয়নি।
এবার সমসাময়িক পদ্ধতি যা সচেতনতার জন্য প্রয়োজন সে সম্পর্কে আলোকপাত করা দরকার। শুধু একটি নির্দিষ্ট কাল অথবা সময় আত্ননিয়োগ করে অথবা পারিপার্শ্বিক পরিবেশ অবহেলা বা উপেক্ষা করে এই সচেতনতা অর্জন করা সম্ভব নয়। বিকাশ ও উন্নয়ন শুধু সমসাময়িক সাফল্যের সমাবেশ এবং পুরাতন সমাজ কাঠামোয় কেবল সর্বাধুনিক আবিষ্কার জুড়ে দেওয়াই নয় বরং মাজের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও আদর্শিক কাঠামোর গুনগত পরিবর্তন প্রয়োজন, আর এ জন্য প্রয়োজন পবিত্র কোরআনের প্রতি এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এবং নতুন বাস্তবতার প্রয়োজনে নতুনতার দৃষ্টিভঙ্গি সমসাময়িক সমাজের ধারণার অর্থ ভবিষ্যতকালের প্রেক্ষাপটে পুরাতন সমাজ এবং তার চিন্তাধারা অব্যাহত রাখা নয়, বরং এটা ঐতিহাসিক পরিবর্তনের সাথে যুক্ত এবং সমসাময়িক অভিধায় উত্তরণের জন্য সমাজের পরিবর্তন অপরিহার্য। এসব পরিবর্তনের ফলে সমাজের পুনঃ আবিষ্কার সম্ভব হবে এবং আমরাও এই পরিবর্তনশীল বিশ্বকাঠামোর আওতায় পবিত্র কোরআনের পুনঃআবিষ্কার করতে সক্ষম হবে।
এই প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করলে এপা স্পষ্ট যে, আমাদের অনেক আরব এবং ইসলামিক সমাজ বর্তমান কালে রয়েছে যারা ধারণায় নিজেদেরকে সমসাময়িক বলে মনে করে। তবে প্রকৃতপক্ষে তারা সমসাময়িক পরিস্থিতিতে বাস করে না; এমনকি বর্তমান বিশ্বব্যাপী সংস্কৃতিতে সচেনতনতা এবং তার সমালোচনামূলক ও বিশেলষনাত্নক মানসিকতা ও পদ্ধতিগত জ্ঞানার্জন ও আজকের সমস্যা সমস্যা সমাধানে তার আগ্রহের অধিকারীও তারা নয়। আরব এবং ইসলামী সমাজসমূহের প্রবণতা রয়েছে তাদের অতীত এবং ঐতিহ্যগত চিন্তাধারায় আঁকড়ে থাকার অথচ তাদের বাস করতে হয় আধুনিক আন্তর্জাতিক যুগে। এই বৈপরীত্য তাদেরকে সমসাময়িকত্বের চেতনা এনে দিয়েছে। পাশাপাশি সমসাময়িক বিশ্বজনীন সচেতনতা অর্জনের উপযোগী পরিস্থিতিতে সাড়া দেবার অপরাগতা এনে দিয়েছে। এজন্য আমরা দেখতে পাই যে এসব সমাজের কিছু সংখ্যক প্রভাব শালী বুদ্ধিজীবী ঐতিহ্যগত চিন্তাধারার উপর ভিত্তি করে গ্রন্থাদি রচনা করে চলেছেন এবং বিশ্বের ঐতিহাসিক ও সামাজিক পরিবর্তনের প্রকৃতি অনুসন্ধান না করেই বর্তমানের মধ্যে অতীতকে খুঁজে পাবার চেষ্টা করেছেন। তারা আমাদের সত্যাশ্রয়ী সাহাবীদের সম্পর্কে ইজতিহাদের ভাষায় যেভাবে তারা তাদের যুগে চর্চা করেছেন এবং সমস্যা সমাধানে প্রয়োগ করেছেন এবং সেভাবেই তারা বিষয়বস্তু রচনা করতে চান। একই সাথে এসব প্রভাবশালী বুদ্ধিজীবী দুই কালের মধ্যেকার ঐতিহাসিক পার্থক্য উপেক্ষা করেন এবং আধুনিক যুগে ইজতিহাদের প্রয়োজনীয়তা খুঁজে পান না। ইজতিহাদকে আদর্শ হিসেবে গণ্য করার পরিবর্তে সত্যাশ্রয়ী সাহাবীদেরকে অনুকরণের আদর্শ হিসেবে ধরা হয়।
আমরা এই ধারা ভাঙ্গতে চাই এবং ব্যাপক অর্থে ফিকাহর অগ্রগতিতে বাধা সৃষ্টিকারী ঐতিহাসিক কর্মকান্ড চিহ্নিত করতে চাই। ফিকাহর অগ্রগতির মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক আইন এবং অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আইনও। আমরা এবার ফিকাহর বিভিন্ন শাখায় আইম্মাদের (ইমাম শব্দের বহুবচন) প্রচার ওসনদ সংশ্লিষ্ট সুন্নাহর বিভিন্ন বিষয়ে মুহাদ্দেসীনের অবস্থান যে সব ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর দরুন প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হয়েছে তা ব্যাখ্যা করব।
ইতিহাস যা থেকে বাদ দিয়েছিল এবং যা শাসন কর্তৃপক্ষ এবং আলেম সমাজ ফিকাহ ও সূফীবাদ এবং যারা সুন্নাহর প্রসঙ্গ ছাড়া কোরআন অধ্যয়ন করেছেন এবং যারা কোরআনের প্রসঙ্গ ছাড়া সুন্নাহ অধ্যয়ন করেছেন-এসবের মধ্যে পরস্পর বিরোধিতা উন্মোচিত হয়। এ ধরনের ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি ফিকাহকে তার সেই যথার্থ অস্থান পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সাহায্য করতে পারে ইসলামিক পদ্ধতির অধীনে এ ধরনের বিরোধের উৎপত্তি হওয়া উচিৎ নয়। কারণ সমগ্র ইসলামী উম্মাহর কর্মকান্ড এবং গতিধারার জন্য একটি একক কেন্দ্র বিন্দু রয়েছে যা হচ্ছে স্ববিরোধিতা মুক্ত গ্রন্থ আল-কোরআন। এর ফলে পরিপূর্ণ এবং ভারসাম্যপূর্ণ সভ্যতা সৃষ্টিতে আল কোরআন তার পূর্ণ ভুমিকা পালনের জন্য ঐশী ইচ্ছা এবং মানবীয় প্রচেষ্টার সমন্বয় সাধন সম্ভব হবে আর সে সভ্যতার কল্যাণের অংশীদার হবে মুসলিম এবং সকল জীব।
এবং আমরা তোমার প্রতি এই কিতাব নাযিল করেছি যা প্রত্যেক বিষয়ে সুস্পষ্ট বর্ণনাকারী এবং হেদায়াত, রহমত ও সুসংবাদ সেই – সব লোকদের জন্য যারা মস্তক অবনত করেছে (১৬:৮৯)।