কোরআন ও আধনিক বিজ্ঞানঃ পদ্ধতি বিজ্ঞান সম্পর্কে পর্যবেক্ষণ
ডঃ ইমাদ আল দীন খলিল
সতর্কতার সঙ্গে পবিত্র কোরআন অধ্যয়ন করলে এবং বিজ্ঞানের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি জানার প্রচেষ্টা চালালে দেখতে পাওয়া যায় এমন বহুসংখ্যক আয়াত আছে, যাদে বিজ্ঞান নিয়ে সার্বিক আলোচনা করা হয়েছে। এগুলি চারটি শ্রেণীতে পড়ে যা বিজ্ঞানের চারটি ক্ষেত্রের অনুরূপ। প্রথম শ্রেণীতে আলোচনা করা হয়েছে বিজ্ঞানের বাস্তবতা, তার পরিধি ও লক্ষ্য সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে, যেগুলি বিজ্ঞানের দর্শন হিসেবে পরিচিত। দ্বিতীয় ভাগে রয়েছে বৈজ্ঞানিক তথ্য আবিষ্কারের পদ্ধতি বিজ্ঞান। তৃতীয় ভাগে রয়েছে বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্র বিশেষ করে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের বেলায় প্রযোজ্য আইন। চতুর্থ পর্যায়ে রয়েছে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে আবিস্কৃত সূত্র সমূহ যে গুলোতে জীবনযাত্রার উন্নয়নে পৃথিবীতে আল্লাহর খলিফা হিসেবে মানুষ কাজে লাগাবে। এই ক্ষেত্রটি ফলিত বিজ্ঞান হিসেবে পরিচিত।
সন্দেহ নেই, এর প্রত্যেক শ্রেণীর মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। বিজ্ঞানের দর্শন, বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য বিশ্লেষণ করে, অপরদিকে পদ্ধতি বিজ্ঞান সত্য উদঘাটনের কার্য প্রণালী প্রণয়ন করে যেমন সুনান বা বিশ্বজগতের প্রকৃতি ও আইন- যা দুনিয়া জাহান, বিশ্ব ও জীবনযাত্রা পরিচালিত করে এবং যথাসময়ে তাদের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে। পরিণামে এসব আইন ও পদ্ধতি এমন ফর্মুলা দেয় যা তাকে সৃষ্টির বৈচিত্র অনুসন্ধানে সক্ষম করে তোলে। ফলে মানবতার অগ্রগতি ও কল্যাণের জন্য এগুলি হয় উপকরণ; হয় পৃথিবীতে বেচেঁ থাকার জন্য দৈনন্দিন একঘেয়েমী থেকে মুক্ত হওয়ার মাধ্যম এবং তার আধ্যাত্নিক প্রয়োজন পূরণে সক্ষম হয় বেশী পরিমাণে, যা তাকে অন্যান্য সৃষ্টি থেকে পৃথক করেছে। এভাবে সে আল্লাহর খলিফা হিসেবে এবং বিশ্বের সভ্যতা ও কল্যাণ আনয়নে তার ভূমিকা পালনে আরও বেশী সক্ষম হয়।
এ কথা সত্য যে, পবিত্র কোরআন বিজ্ঞান গ্রন্থ অথবা অন্য কোন পাঠ্য বই হিসেবে নাজিল হয়নি। একইভাবে এটাও সত্য যে, কতিপয় আধুনিক চিন্তাবিদ জোর দিয়ে বলতে চান যে, কোন কোন আয়াতের বৈজ্ঞানিক অর্থ ও ব্যাখ্যা রয়েছে যা তার লেখকের (আল্লাহর) ইচ্ছা ছিল না। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে কতিপয় চিন্তাবিদ আরেক চরম পর্যায়ে গিয়ে বলেন, বৈজ্ঞানিক তথ্যের সঙ্গে কোরআনের কোন সম্পর্ক নেই।
এটা স্বতঃসিদ্ধ বিষয় যে, কোরআনী এবং বৈজ্ঞানিক উপাত্ত (data) সামঞ্জস্যপূর্ণ ও একই ধরনের ( সাধারণ অর্থে এবং আপেক্ষিক বাস্তবতার বাইরে ও পরিবর্তন শীল) এবং এটা সুস্পষ্ট যে, এদের মধ্যে কোন মতানৈক্য বা বিরোধ নেই। সর্বোপরি এগুলো এসছে অভিন্ন উৎস আল্লাহ থেকে। আর আল্লাহ হচ্ছেন এই বিশ্ব জাহান ও তার মহাজাগতিক বিধি ও পদ্ধতির উদগাতা, কোরআন নাযিলকারী এবং মানুষের সৃষ্টিকর্তা। তদুপরি আইন প্রনয়ন ও কোরআন নাজিল প্রক্রিয়ায় মানুষ একটি পক্ষ। সে হচ্ছে পৃথিবীতে আল্লাহর খলিফা যে আল্লাহর জন্যই সভ্যতা গড়ে তোলার চেষ্টা চালায়। কোরআনের বাণী এবং মহাজাগতিক বিধির মধ্যেকার অপরিহার্য সম্পর্কের প্রকৃতির ব্যাপারে কোরআন গুরুত্ব আরোপ করে। এই বিশ্ব জগত সম্পর্কে অনুধাবন এবং তার আইন ও পদ্ধতি খুঁজে বের করার প্রচেষ্টা না চালানো পর্যন্ত কোরআনের শিক্ষা কাঠামোয় আওতায় মানুষ পৃথিবীতে তার ভূমিকা পালন করতে পারে না।
এ ক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, বিগত কয়েক শতাব্দীর তুলনায় আধুনিক বিজ্ঞান ধর্মীয় বিধানের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ বা প্রত্যাখ্যান করে না। বিজ্ঞান স্বীকার করে যে, বিষয় তার ধারণার চাইতে ব্যাপক হতে পারে সে ব্যাপারে চূড়ান্ত কথা বলার সুযোগ তার নেই।
এ কথা স্বীকার করার পর বিজ্ঞান তার সীমিত পরিসরে আরো নিশ্চিতভাবে বলে, মানব জীবন উদ্দেশ্যহীন যদি তার এক বৃহৎ পরিসর ছিনিয়ে নেয়া হয় যা বস্তু ও গতির বাইরে বিস্তৃত। বিজ্ঞান এখন এমন এক অবস্থায় এসে পৌঁচেছে যে, সে এখন ধর্মের সাথে সামঞ্জস্য রেখে কাজ করে।
সাম্প্রতিক আবিষ্কার বিশেষ করে প্রাকৃতি ও পরমাণু বিজ্ঞানের আবিষ্কারসমূহ এবং মস্তিষ্কের কাজ করার পদ্ধিতি সম্বন্ধে মানুষের অনুধাবনের ফলে বিজ্ঞান দর্শনে এই বিরাট বিপ্লব ঘটেছে। এ প্রসঙ্গে পরমাণুর কেন্দ্রবিন্দু (Core) আবিষ্কার করতে গিয়ে গবেষণায় দেখা গেল বস্তুগত প্রতিবন্ধক (Material barrier) ভেঙ্গে গেছে এবং ফলতঃ প্রাকৃতিক বিশ্বের কাঠামো ও গঠনের পশ্চাতে সামঞ্জস্য খুঁজে পেলো। [২৬] সুতরাং বিজ্ঞানের চারটি ক্ষেত্র এবং কোরআনে বিধৃত উপাত্তের (data) মধ্যেকার সম্পর্কের প্রতি আমরা একটুখানি দৃষ্টিপাত করলে কি দেখতে পাই? [২৯]
(১) বিজ্ঞান দর্শন, তার লক্ষ্য এবং ইসলামের মৌলনীতিঃ
বিজ্ঞান যা অর্জন করতে চায় এবং প্রথমতঃ মানুষের সভ্যতা গড়ে তোলার প্রচেষ্টার সাথে তার সম্পর্ক এবং দ্বিতীয়তঃ এই বিশ্বজাহান, যে বিশ্বে সে বাস করে তার প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করা সাথে বিজ্ঞান দর্শন জড়িত। বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং পরীক্ষামূলক পদ্ধতি হচ্ছে ইসলামী জীবন ব্যবস্থার প্রয়োজনীয় বিষয় কোন বিলাসিতা বা গঠন বিষয় নয়। এর কারণ হলো উম্মাহর কার্যক্রম, পৃথিবীতে তার মিলনের প্রকৃতির এবং বিশ্বজাহান জীবন, বিশ্ব ও মানুষের ব্যাপারে তার সার্বিক বিশ্বাসের সাথে এগুলি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।
এখানে ইসলামিক জীবন ধারা এবং বিশ্ব সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারে কতিপয় মৌলিক নীতি উল্লেখ করা সম্ভবতঃ প্রয়োজন। কারণ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক সত্যের সাহায্যে অনাবিস্কৃত বিধি ও পদ্ধতি এবং যে সব পন্থায় এগুলি বাস্তবায়ন করা হয়-এসব নীতি তার ব্যহার সম্পর্কে নির্দেশনা দেয়। এসব নীতি জোরদার করতে, বিশ্বব্যাপী ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির মৌলিক উপাদানসমূহের ঘোষণা করা, বিশ্বের সাথে এগুলির সংযোগ সাধন এবং সভ্যতার প্রতি সক্রিয় অবদান রাখার উপযোগী করার ক্ষেত্রে এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমাদের মতে বৈজ্ঞানিক তৎপরতার সাথে চারটি মৌলিক নীতি রয়েছেঃ
(ক) ইসতিখালফ (খলিফা)
মানুষের কাছে যে ঐশী আমানত রয়েছে সেটাই হচ্ছে খেলাফাত অর্থাৎ মানুষ পৃথিবীতে আল্লাহর খলিফা বা প্রতিনিধি। পবিত্র কোরআন ও হাদীসে উল্লিখিত খলিফার নীতি হচ্ছে সেই সব নীতির অন্যতম যা বিজ্ঞান বাস্তবতা হিসেবে সমুন্নত রেখেছে।
মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে পৃথিবীর বিকাশ, সভ্যতার সৃষ্টি, তার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা, অভাব মুক্ত নিরাপদ জীবনের পরিবেশ সৃষ্টি যা আরো উচ্চতর সাফল্য সহ সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্যে যাওয়ার অনুকূল হতে পারে ইত্যাদি করতে পারে।
মানুষ পূর্বে উল্লিখিত মহাজাগতিক বা ঐশী সুনান আবিষ্কার করার লক্ষ্যে বৈজ্ঞানিক গবেষণা পদ্ধতি ব্যবহার না করা পর্যন্ত খলিফা হিসেবে তার দায়িত্ব পালন অথবা অব্যাহত অগ্রগতি অর্জনের লক্ষ্যে যথেষ্ট নিশ্চয়তা এবং সাহায্য লাভ করতে পারে না। শুধুমাত্র তক্ষুণি সে জ্বালানীর রিজার্ভে প্লাগ লাগাতে পারে এবং তার পরিবেশ ও তার মধ্যে বৃহত্তর সমন্বয় ঘটাতে পারে। এটা ছাড়া খলিফার নীতি শূণ্য শুধু তত্ত্বকথা হিসেবেই রয়ে যাবে।
(খ) তাওয়াজুন (ভারসাম্য)
ইসলামী জীবন ও চিন্তার অন্যতম নীতি হচ্ছে মানুষের আধ্যাত্নিক ও জাগতিক প্রয়োজনের মধ্যে তাওয়াজুন বা ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা। এটা কোরআন সুন্নাহ গভীরভাবে প্রোথিত রয়েছে এবং আমরা দেখতে পাই বিভিন্ন ধাঁচে ও প্রকারে তা আলোচিত হয়েছে। আমরা এক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে একটি স্বতঃপ্রকাশিত তথ্য উপেক্ষা করে এসেছি। তা হচ্ছে আল্লাহ তায়ালা মানুষের দায়িত্বের সাথে সঙ্গতি রেখে পৃথিবীকে তার অধীন করে দিয়েছেন। আল্লাহ মানুষকে একটি বিশেষ প্রকৃতিতে সৃষ্টি করেছেন এবং তার চাহিদা পূরণের জন্য পৃথিবীকে তার অনুগত করে দিয়েছেন অথচ অন্যান্য ঐশী ধর্ম আধ্যাত্নিক ও জাগতিক প্রয়োজনের মধ্যে পার্থক্য রেখা টেনে দিয়েছে-ইসলাম এ মত সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করেছে। এরূপ করতে গিয়ে তারা আধ্যাত্নিকতার দিকে ঝুঁকে পড়ছে। ফলে মানুষের মন-মেজাজের চাহিদা এবং তার প্রতি অনুগত করে দেয়া পৃথিবীর নেয়ামত এবং সুযোগ-সুবিধার মধ্যে প্রতিবন্ধকতা টেনে দেয়া হয়েছে।
সত্য কথা এই যে, মানুষের এই দু প্রকার চাহিদার মধ্যে সুষ্ঠু ভারসাম্য ছাড়া ইসলামী জীবন চলতে পারে না। তবে ইসলামের উদ্দেশ্য হচ্ছে বাস্তবতার মধ্যে বাস করা এবং উত্তেজনা, বিচ্যুতি বা নির্যাতনমুক্ত থেকে একটি ভারসাম্য পূর্ণ মানব জীবন গঠন করা যা হবে কর্মতৎপর, পরিবর্তনশীল ও গতিময়। এতদসত্বেও এই ভারসাম্যপূ্র্ণ দৃষ্টিভঙ্গি, যা পৃথিবীর আর কোন মতবাদ বা ধর্ম একই রকম সার্বজনীনতা ও অঙ্গীকার নিয়ে গ্রহণ করেনি। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বিজ্ঞান, তথ্য ও প্রয়োগ ব্যতিরেকে বাস্তবায়িত হতে পারে না।
(গ) তাসখীর (আনুগত্য)
বিশ্ব জগত এবং জীবন সম্পর্কে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির একটি আরেক মৌলিক বৈশিষ্ট্য। এ ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গির বাস্তবায়ন করার ও তার মহান সুপ্ত শক্তির অনুধাবনের আগেই নিঃসন্দেহে বিজ্ঞান প্রয়োজন। ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে প্রকৃতি ও বিশ্ব জগতে মানুষের অনুগত করে দেয়া হয়েছে। পৃথিবীতে প্রতিনিধি হিসেবে মানুষের মৌলিক কর্তব্যের উপযোগী করে এবং প্রকৃতির সঙ্গে বাস্তব ও কার্যকর পন্থায় মিথস্ক্রিয়ার যোগ্যতা অনুসারে আল্লাহ তার আইন, পদ্ধতি ও সামর্থরের বিধান জারি করেছেন।
এই মিথস্ক্রিয়া প্রসঙ্গে ইসলাম একটি মধ্যম পন্থার প্রস্তাব দেয়ার পক্ষপাতি। এটা মানবতাকে এই নীতি জানাতে চায় যে, প্রকৃতি মানবিক প্রয়োজনের সেবায় নিয়োজিত। তবে একই সাথে মূল্যবোধ, নীতি ও কনভেনশান প্রতিষ্ঠার সাহায্যে মানুষের প্রয়োজনের দুইদিকের মধ্যে মিথস্ক্রিয়ার একটি স্থিতিমাপ (Parameter) নির্ধারণ করে দিয়েছে। এর লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের উচ্চাকাংখা, নীতি ও বিশ্বজগতে তার অবস্থানের সাথে সঙ্গতি রেখে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ উদ্ভাবন ও সভ্যতার গুনাগুণ অনুপ্রবেশ করিয়ে দেয়।
এতেও যদি বিজ্ঞানের সুপ্তশক্তি তথা পদ্ধতি বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানের তথ্য ও প্রয়োগের সদ্ব্যবহার করা না যায়, তাহলে কোন ইসলামী সমাজ তাসখীর এর নীতি বাস্তবায়ন এবং তাকে একটি ঐতিহাসিক বাস্তবতায় রূপান্তরিত করতে পারবে না।
(ঘ) সৃষ্টি ও স্রষ্টার মধ্যে প্রয়োজনীয় সম্পর্ক
বিশেষভাবে ইসলামী জাগতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং সাধারণভাবে ধর্মের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নীতি বাস্তবায়নে বিজ্ঞানকে অবশ্যই ব্যবহার করতে হবে। সৃষ্টির আশ্চর্যজনক পদ্ধতি এবং স্রষ্টার অস্তিত্বের মধ্যে এটা প্রয়োজনীয় সম্পর্ক। এই সম্পর্ক প্রকাশ ও ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে বিজ্ঞান হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। অনেকেই সৃষ্টির মুজিজা সম্পর্কে লিখেছেন। বহু বিজ্ঞানী ও পন্ডিত বিজ্ঞানের একটি অমোঘ সত্য উদঘাটনে জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন এবং সে সত্য হচ্ছেঃ সৃষ্টির একজন স্রষ্টা রয়েছে। এই বিষয়টির চূড়ান্তভাবে সমাধান করা হয়েছে এবং এ ব্যাপারে কোন প্রশ্ন রাখা হয়নি।
যেহেতু বিশ্বজগত পরিচালিত হয় সাংগঠনিক কার্যক্রম, নির্ভুল ও সামঞ্জস্যপূর্ণ গতি ও গঠনমূলক আন্তঃসম্পর্ক দ্বারা, আর সবই সমাধান হয় গাণিতিক সতর্ক বিচার ও বৈজ্ঞানিক ফর্মুলার সাহায্যে, তাই অসংখ্য প্রমাণ ও বেশুমার বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফলে প্রমাণিত হয়েছে যে, এটি একটি অতি প্রাকৃতিক, সর্বাত্নক ক্ষমতার অধিকারী এবং মহানির্দেশকের ইচ্ছা (Directing Will) থেকে সূচিত। [২৮]
বৈজ্ঞানিক গবেষণায় যতদিন বিশ্বজগত, পৃথিবী ও জীবনের গোপন রহস্য অনুসন্ধানে জটিল তৎপরতায় নিয়োজিত থাকবে ততদিন ইসলামী জীবনের জন্য তা অপনিহার্য হয়ে থাকবে। তাছাড়া অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য উপায়ে এটা বিশ্বজাহানের স্রষ্টার কাছে নিয়ে যায় এবং স্রষ্টামুখী হলেই তা এবাদতের কার্যক্রম চলে যায়।
(২) পদ্ধতি বিজ্ঞান
এই প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআন বিশ্বজগতের বিধি-বিধান আবিস্কারের জন্য একটি পদ্ধতি বিজ্ঞানের কথা ব্যাখ্যা করে। এটা একটি নমনীয়, চূড়ান্ত পদ্ধতি বিজ্ঞান যা সময় এবং স্থানের প্রেক্ষাপটে কখনও অস্থিতি হয় না। কারণ এটা মূলতঃ গবেষণা ও অনুসন্ধানের জন্য একটি পদ্ধতি বা হাতিয়ার। সুতরাং এটা আপেক্ষিক পরিবর্তনে উর্দ্ধে থাকে এবং প্রত্যেক যুগে ও পরিবেশ অক্ষুন্ন থাকে। পবিত্র কোরআন মানুষকে তাদের অস্তিত্ব এবং বিশ্বজগতে তাদের স্থান সম্পর্কে অন্তদৃষ্টি নিয়ে চিন্তার আহ্বান জানায়। এ জন্যে তাদেরকে জমিনের ওপর দাঁড়িয়ে পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকে মন ও বিশ্বজগতের দিগন্ত ঈমানের উচ্চতর পরিধিতে মানুষের কি চমৎকার মনোভাব তা পর্যবেক্ষণের জন্য তাদের চেতনা কাজে লাগাবার আহ্বান জানানো হয়েছে। তাছাড়া পবিত্র কোরআন গবেষণা, ধ্যান, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে মুসলমানদের গৃহীত পদক্ষেপের ব্যাপারে চেতনাসমূহের প্রতি মৌলিক দায়িত্ব দিয়েছে।
পবিত্র কোরআন আরো একধাপ অগ্রসর হয়ে মানুষকে তার সকল ইন্দ্রিয়কে কাজে লাগিয়ে অফুরন্ত উপাত্ত (data) গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে যাতে করে তার উপলব্ধিজাত ক্ষমতা মহাসত্যের কাছে পৌঁছার লক্ষ্যে তাদেরকে তালিকাভুক্ত, বাছাই, গ্রহণ বা বর্জন করতে পারে। মহাসত্যের নিয়মে বিশ্বজগতে আইনের ঐক্যতান রয়েছে।
অনুসন্ধান, পরীক্ষা, আরোহী যুক্তি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে মেধা ও ইন্দ্রিয়সমূহ যৌথভাবে কার্যকর। এই কার্যকারিতার দায়িত্বের ভিত্তিতে মানুষকে পরীক্ষা করা হবে, কেননা অন্যান্য জীবিত প্রাণী থেকে অপরিহার্যরূপেই পৃথক। পবিত্র কোরআনে বহু আয়াত রয়েছে যেখানে বারবার বলা হয়েছে শ্রবণ, দর্শন ও হৃদয়ের অনুভূতি (আল ফুয়াদ) যৌথভাবে মানব জীবনকে তার মূল্য ও অনন্যতা দান করেছে। মানুষ যদি এসব শক্তিকে সক্রিয় করে তা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারে তাহলে সে বৈজ্ঞানিক ও ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্বের শীর্ষস্থানে পৌঁছে যাবে। এর ফলে সে বিশ্ব জগতের প্রভু বনে যাবে এবং পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে তার অবস্থান সুদৃঢ় করবে। অপরদিকে, সে যদি এসব শক্তিকে কাজে না লাগায় তাহলে তার পর্যায় হবে নিকৃষ্টতম এবং আল্লাহ যখন তাকে শ্রবণ, দর্শন ও হৃদয়ের অনুভূতিসহ পৃথিবীতে পাঠান তখন এ ধরনের অবস্থা তার জন্য নির্ধারণ করে দেননি।
এছাড়া প্রায় পঞ্চাশটি আয়াত রয়েছে যাতে মানুষকে তার বুদ্ধিবৃত্তি শাণিত করার আহ্বান জানানো হয়েছে। এই বুদ্ধিবৃত্তি হচ্ছে আল্লাহ প্রদত্ত সম্পদ যার সাহায্যে তার প্রতি ঈমান বৃদ্ধি করা যায়। তদুপরি এসব আয়াতে মানুষকে তার চারপাশের ঘটনাবলী গভীরভাবে উপলব্ধি ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে চিন্তাভাবনা করার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
গভীর চিন্তার ব্যাপারে যা বলা হয়েছে তা জ্ঞানার্জনের বেলায়ও প্রযোজ্য; কারণ এটা হচ্ছে গভীর চিন্তার বাইরে একটি বুদ্ধবৃত্তিক পদক্ষেপ এবং এর ফলাফল মাত্র। জ্ঞানার্জনের ফলে মানুষ তার চারপাশের অবস্থা সম্পর্কে ব্যাপক সচেতনতা লাভ করে এবং তার সত্তা ও বিশ্বজগতের সাথে তার সম্পর্কের পরিধির ব্যাপারে গভীর উপলব্ধি অর্জন করে। এর ফলে তার উপলব্ধির ক্ষমতা সবসময়ের জন্য খুলে যায় এবং তার সামনে উপস্থাপিত প্রত্যেক সমস্যা, ঘটনাবলী বা বিষয় দায়িত্বশীলতার সাথে সমাধানের পথ নিশ্চিত হয়।
মানুষ যাতে আরোহ, তুলনা, ভারসাম্য ও পরীক্ষার মাধ্যমে এবং সম্মত বাহ্যিক উপাত্তের (Agreed external data) সমর্থনে ও অধিকতর যোগ্য ব্যক্তিদের বুদ্ধিবৃত্তিক ও যৌক্তিক ক্ষমতায় বলীয়ান হয়ে সুষ্ঠু ফলাফল লাভ করতে পারে সে জন্য পবিত্র কোরআন পরীক্ষা-নিরীক্ষা, যুক্তি প্রমাণ ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিতর্কের ন্যায় পদ্ধতি সমূহের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হচ্ছে পবিত্র কোরআন. ইলম (জ্ঞান বিজ্ঞান) শব্দটি ব্যবহার করেছে কয়েকটি অর্থেঃ (ক) দ্বীন [৩০] (ধর্ম জীবন ব্যবস্থা)-যা আল্লাহ তার নবী রসূলদের উপর জারি করেছেন এবং মহাসত্যসমূহ-যা এ আয়াতসমূহে বিধৃত। নাযিলকৃত ধর্মীয় মূল্যবোধের লক্ষণ হিসেবেও ইলম এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
এভাবে কোরআনের ভাষায় ইলম এবং দ্বীন একই ধরনের শব্দার্থ বহন করে। আল্লাহর আয়াত এ শিক্ষাই দিয়েছে এবং আমাদের কে ব্যাপক আন্তঃসম্পর্কযুক্ত চেতনা অনুধাবনে সক্ষম করে তোলে যা প্রত্যক্ষবাদীদের (positivists) তথ্যানভিজ্ঞ ও বিদ্বেষদুষ্ট উৎপন্ন অর্থের পরিবর্তে ইলম ও দ্বীন এর অর্থ প্রচারিত হোক বলে তিনি চান। সাড়ে সাতশোরও বেশী আয়াতে ইলম শব্দের বিবিধ শব্দরূপ ও ব্যুৎপন্ন শব্দ রয়েছে।
প্রাকৃতিক ও অতিপ্রাকৃতিক ঘটনাবলী অধ্যয়নে পুরোপুরি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের উপর পবিত্র কোরআন জোর দিয়েছে এবং বিদ্বেষপ্রসূত, তথ্যাভিজ্ঞ মতামত, যাদু ও কুসংস্কারের ন্যায় দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারে নেতিবাচক ক্রিয়া করে এমন প্রতিটি বিষয় সে দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রত্যাখ্যান করছে। দ্বীন মানুষকে তার অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য যে সিরাতুল মোস্তাকিমের পথে চলার আহ্বান জানায়, এ ধরনের অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সবগুলি সত্য পথ থেকে বিচ্যুত। আমরা সবাই জানি, সরল পথ হচ্ছে দুটি পয়েন্টের মধ্যেকার সংক্ষিপ্ততম দূরত্ব। সুতরাং এ থেকে কোন প্রকার বক্রতা সৃষ্টি হলে দূরত্ব ও কষ্ট বাড়ায় এবং পর্যটকদের এতটা বিভ্রান্ত করতে পারে যে, তারা কখনো গন্তব্যস্থলে নাও পৌঁছতে পারে। পবিত্র কোরআন পুনঃপুনঃ একটি সুস্পষ্ট ও পরিস্কার তথ্যের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে বলে যে বিদ্বেষ থেকে অর্থহীনত্ব ও নির্বুদ্ধিতার সৃষ্টি হয় এবং সত্যের একমাত্র বিকল্প হচ্ছে ভুল।
৩. ঘটনাসমূহ
পবিত্র কোরআনের পেশ করা তৃতীয় ব্যাপ্তির (dimension) মধ্যে রয়েছে ঘটনাসমূহ ও বিজ্ঞানের বিভিন্ন পদ্ধতির সমাহারঃ জ্যোতির্বিদ্যা, ভূগোল, জীববিদ্যা, প্রাণীবিদ্যা, মানুষের শরীরতত্ত্ব—–। এ ক্ষেত্রে বহু আধুনিক চিন্তানায়ক দুটি বিরোধপূর্ণ অবস্থার যে কোন একটি গ্রহণ করেন। প্রথম পর্যায়ে কোরআনের আয়াতের ব্যাখ্যায় আধুনিক বৈজ্ঞানিক উপাত্তের (data) ব্যবহারের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল থাকা যায়। ফলে পদ্ধতিগত ভূল ভ্রান্তি থেকে যায়। অপরদিকে আংশিক উপাত্ত (partial data) ব্যবহার করা হয় একটি সাধারণ রূলিং এর জন্য, পরিবর্তনশীল উপাত্ত কালে লাগানো হয় স্থায়ী রূলিং দানের জন্য, এবং আপেক্ষক উপাত্ত (relative data) ব্যাবহার করা হয় নিরঙ্কুশ রুলিং দানের জন্য। এই দৃষ্টিভঙ্গির দুর্বল দিক হচ্ছে যদি এসব আংশিক ও আপেক্ষিক বৈজ্ঞানিক উপাত্তের পরিবর্তন হয় এবং স্বয়ং বৈজ্ঞানিকরাই স্বীকার করেন যে এটা হচ্ছে তাদের স্বাভাবিক ধর্ম যে ক্ষেত্রে এই তত্ত্বের প্রবক্তারা এ ধরনের মানসিক যন্ত্রণায় ভুগবেন।
এ ধরনের পরিস্থিতি এড়াবার প্রচেষ্টায় দ্বিতীয় অবস্থানও (position) সম্পূর্ণভাবে বৈজ্ঞানিক উপাত্ত প্রত্যাখ্যান করে ভ্রান্ত চিন্তাধারার ফাঁদে পড়ে যায়।
সুস্থ পদ্ধতি বিজ্ঞানের নিকটতম দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে মধ্যম পন্থা যা কোরআন জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে অনুসরণ করতে শিক্ষা দেয়। পরিবর্তনীয় উপাত্ত সহ (variable data) বিজ্ঞানের প্রতি কখনই পরিপূর্ণ অঙ্গিকারবদ্ধ হয় না এবং এরই সাথে ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের ভূমিকা রয়েছে তা পুরোপুরি প্রত্যাখ্যনও করে না। পবিত্র কোরআনের সমকালীন দক্ষ চিন্তানায়ককে কোরআনের আয়াত এবং বৈজ্ঞানিক অভিসন্দর্ভ সমীকরণের প্রকৃতি অনুধাবনের জন্য নিজেস্ব বিশেষায়িত ক্ষেত্রে তার মেধা ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে সক্ষম হবে। তদুপরি সম্প্রতি প্রকাশিত কোরআনের তাফসীরের কতিপয় আধুনিক ধারা সম্পর্কে তাকে অবহিত হতে হবে। এসব ধারায় কোরআনের অর্থ ও বিষয়বস্তু অনুধাবনের জন্য কোরআনের পরিভাষা ও চিত্রকল্পের ব্যবহার করে-যা আল তাফসীর আল বায়ানী লী আল কোরআন নামে পরিচিত। এ পদ্ধতিতে বাস্তব নিশ্চয়তা রয়েছে যা বাক্য ও বাকধারার কাংখিত অর্থলাভের প্রচেষ্টায় তাফসীরকারককে অতিরঞ্জন বা ভ্রান্তি থেকে রক্ষা করে। বৈজ্ঞানিক বিশেষায়ন ও আল তাফসীর আল বায়ান-এর মধ্যেকার এই ভারসাম্য কোরআনের বৈজ্ঞানিক আয়াতের কাংখিত অর্থ প্রকাশের প্রচেষ্টা আধুনিক চিন্তাবিদকে সক্ষম করে তোলে। এমন কতিপয় বৈজ্ঞানিক ঘটনা রয়েছে যা চূড়ান্তভাবে অথবা অবিসংবাদী, স্বতঃপ্রকাশিত সত্য হিসেবে বিধানে পরিণত হয়েছে। যেমন বৃষ্টি আনার ক্ষেত্রে বাতাসের ভূমিকা, সৌরজগতের পরিক্রমায় মাধ্যাকর্ষণের ভূমিকা, ভ্রুণের গঠনে বিভিন্ন পর্যায়, ভূ পৃষ্ঠ থেকে গ্যাসীয় পদার্থের দূরত্ব হ্রাস বৃদ্ধির ফলে অনুপাতের পরিবর্তন। এগুলি ছাড়াও আরও বহু তথ্য রয়েছে যার বৈজ্ঞানিক প্রকৃতির সাথে কোরআন নাজিলের সময়কার আরবরা পরিচিত ছিল না। এসব তথ্য সংক্রান্ত কোরআনের আয়াতের তাফসীরকালে গত কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত স্বতঃপ্রকাশিত বৈজ্ঞানিক ঘটনাবলীর ওপর নির্ভর করতে হয়েছে এবং এজন্যে কোরআনের বহু আশ্চর্যজনক দিকের একটি প্রকাশ করেছে।
এমন বহু বৈজ্ঞানিক তথ্য রয়েছে যা বাস্তবতার একাধিক বিষয় প্রকাশ করে। তবে এসব বিষয় একটি একক, নমনীয় কাঠামোর মধ্যে বিদ্যমান। এটা কোন কোন সময় কোরআনের অন্যান্য আয়াতের সঙ্গে প্রসঙ্গক্রমে নির্দেশ করা যায় অন্য আয়াতের সম্পর্কে তার তাৎপর্য অনুধাবনের জন্য। এর ফলে বিশ্ব জগতের বিশ্বয়কর কাঠামো জোটবদ্ধ রয়েছে এবং একটি পদ্ধতির সাহায্যে বিচ্ছিন্ন হওয়া থেকে রক্ষা পেয়েছে। তবে প্রমাণিত বিধি ও স্বতঃপ্রকাশিত সত্যের বাইরে যেসব তত্ত্ব এখনও আলোচনা ও মূল্যায়নের পর্যায়ে রয়েছে এবং প্রতিষ্ঠিত হয়নি সেগুলি খুব সতর্কতার সাথে বিবেচনা করতে হবে এবং আধুনিক চিন্তাবিদদের উচিৎ হবে না আলোচিত আয়াতের ব্যাপারে কোন প্রকার আলোকপাত করা।
নিয়ত বৈজ্ঞানিক উপাত্তের (data) ক্ষেত্রে সমাধানে অগ্রসর হতে হবে এবং (ক) বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার প্রতি পূর্ণ অঙ্গিকার এবং (খ) পুরোপুরি প্রত্যাখ্যানের সম্ভাব্য ভ্রান্তি এড়াতে হবে। বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার প্রতি পুরোপুরি অঙ্গিকারের ফলে সুষ্ঠু অনুধাবন, সচেতনতা এবং সকল পর্যায়ে আরো অনুসন্ধান ব্যাহত হবে। অপরদিকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যানের ফলে অনুধাবনের ক্ষমতা হ্রাস পাবে এবং আধুনিক মানুষ ও কোরআনের তথ্যের এক বিষয়ের মধ্যে প্রতিবন্ধকতার দেয়াল দাঁড় করাবে। আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস অর্জনের জন্য প্রমাণ হিসেবে উদ্ভাবিত বিজ্ঞানভিত্তিক উপাত্ত পবিত্র কোরআনের সর্বত্র ব্যাপকভাবে দেখতে পাওয়া যায়। উল্লেখযোগ্য যে, কোরআনেরর উল্লিখিত প্রতিটি বৈজ্ঞানিক বিষয় ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য মুজিজা হবে, এমন কথা নেই। অথবা নাজিলেন সময় এ বিষয়টি অজ্ঞাত ছিল এমন নয়। দু ধরনের আয়াত রয়েছে, এক ধরনের আয়াতে তথ্য সরবরাহ করা হয়েছে এবং মহাকাশ, বিশ্ব এবং জীবন আল্লাহর এই সৃষ্টির শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। এ ধরনের আয়াত প্রত্যেক যুগের ন্যায় কোরআন নাজিলের সময় অপরিচিত বৈজ্ঞানিক তথ্য, পদ্ধতি এবং সুনানের নির্দেশক যা বিজ্ঞান পরবর্তীকালে প্রকাশ করে দিয়েছে। এ ধরনের বৈশিষ্ট্যকেই কোরআনের বৈজ্ঞানিক মুজিজা ও বিস্ময়কর প্রকৃতি হিসেবে অভিহিত করা হয়।
স্মরণ রাখতে হবে, কোরআন যেহেতু বৈজ্ঞানিক পাঠ্য গ্রন্থ নয়, সেজন্য সবরকম বৈজ্ঞানিক তথ্য এতে বিধৃত নেই। তবে একে কতিপয় তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে এবং অন্যান্য ব্যাপারে ইংগিত দেওয়া হয়েছে। এতে গবেষকদের উপযোগী মনস্তাত্ত্বি পরিবেশ সৃষ্টি করে, ফলে মানুষ আরো ব্যাপক তথ্যাদি আবিষ্কার করার স্বাধীনতা পায়। তবে কোরআনের মতে, মানুষ ধর্মীয় বিশ্বাস ও অঙ্গিকারের এসব আবিষ্কার করতে পারে।
৪. প্রয়োগ
কোরআন ও বিজ্ঞানের মধ্যেকার সম্পর্কে চতুর্থ বিষয়টি বিবেচনা করলে দেখা যায় কোরআন জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন এবং প্রতিটি স্তরে মানব সভ্যতার উৎকর্ষ সাধনে বৈজ্ঞানিক তথ্য ও আবিষ্কার কাজে লাগানোর জন্য অহর্নিশ তাগিদ দিয়েছে। এটা এক প্রশস্ত, নমনীয় ও অহর্নিশ অবস্থা যা মানুষের প্রতি আহবান জানায় স্থান-কাল নির্বিশেষে বৈজ্ঞানিক উপাত্ত থেকে উপকৃত হবার এবং সমকালীন সভ্যতায় তার কাজে লাগাবার জন্য। যদি এরকম ঘটে এবং পরিচিত বৈজ্ঞানিক ঘটনা ও সভ্যতার কোন প্রকার উন্নয়ন হয় তাহলে কোরআন কার্যকরভাবে আবেদন জানাবে প্রত্যেক বংশধরকে নতুন ঘটনা ও নতুন পরিস্থিতির আলোকে পরিবর্তন সাধনের জন্য। কোরআন ও বিজ্ঞানের মধ্যেকার এই সম্পর্কের চতুর্থ ব্যাপ্তিতে দেখা যায় কোরআন অহর্নিশ ও নিঃশর্তভাবে ঈমানদারদের প্রতি আহ্বান জানায়, বৈজ্ঞানিক তথ্য, আবিষ্কার ও ফর্মূলার অধিকতর সদ্ব্যবহার করতে। নিজেদের মালামাল রক্ষা এবং পৃথিবীতে তাদের ভূমিকা সমুন্নত রাখান জন্য কোরআন শত্রুদের মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকার এবং তাদের প্রতি তীব্র আঘাত হানার আহবান জানায়নি। এ থেকে কি প্রশ্বস্ত, নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটেনা, যদ্দরুন তাৎক্ষণিকতার সাথে সার্বজনীনতার এবং স্থায়ীত্বের সাথে ক্ষণস্থায়ীত্বের সমন্বয় ঘটিয়ে প্রতিটি কাল ও স্থানে প্রয়োগ করা যায়?
আর তোমরা যতদূর সম্ভব বেশী শক্তিশালী ও সদাসজ্জিত বাঁধা ঘোড়া তাদের সঙ্গে মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত করে রাখ যেন তার সাহায্যে আল্লাহর এবং নিজের শত্রুদের ভীত শংকিত করতে পার (৮:৬০)।
নিরঙ্কুশ শক্তি ও যুদ্ধাস্ত্রকে ও সময়ের শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনের লৌহ (সুরাহ হাদিদ) অধ্যায়ের এই খনিজ ধাতুকে শান্তি ও যুদ্ধকালে গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এতে এর ব্যবহার ও প্রক্রিয়া সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছেঃ
আমরা আমাদের রসূলগণকে সুস্পষ্ট নিদর্শনাদি ও হেদায়াতসহ পাঠিয়েছি এবং সেই সঙ্গে কিতাব ও মানদন্ড নাজিল করেছি যেন, লোকেরা ইনসাফ ও সুবিচারের ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। এবং আমরা লোহাও অবর্তীণ করেছি উহা যুদ্ধের জন্য (উপকরণ) এবং লোকদের জন্য এতে বিপুল কল্যাণ নিহিত রয়েছে। এর উদ্দেশ্য এই, যেন আল্লাহ তায়ালা জানতে পারেন কে তাকে না দেখেই তার ও তার রসূলগণকে সহযোগিতা করে। নিঃসন্দেহে খোদা বড়ই শক্তিমান ও মহাপরাক্রমশালী (৫৭:২৫)।
একটি গুরুত্বপূর্ণ খনিজ ধাতুর নামে একটি সমগ্র সূরারা নামকরণের ফলে পৃথিবীর সাথে মুসলমানদের সম্পর্কের এর চেয়ে বড় প্রমাণ কি আর হতে পারে? বিজ্ঞানীর অন্তরে যে ঈমান পোষণ করা দরকার, সে ঈমান থেকে উৎসারিত আচরণ ও নীতিকে ইসলাম একটি অপরিহার্য উপাদান হিসেবে গণ্য করেছে এবং উপরোক্ত আয়াতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রয়োগ এবং সৃজনশীল ও শিক্ষিত মার্জিত রুচি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এর চেয়ে সুস্পষ্ট অনুমোদন কি হতে পারে? তদুপরি এই আয়াতে লৌহকে বান্দাদের প্রতি আল্লাহর মহা দান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। একই সাথে এতে লোহার দুটি সম্ভাব্য ব্যবহারের কথা বলা হয়েছেঃ ভয়াবহ যুদ্ধের উপকরণ হিসেবে লোহা যখন অস্ত্র তৈরী ও সামরিক প্রস্তুতিতে ব্যবহার করা হয় এবং সুবিধাদি (benefits) (মানুষ শান্তিকালীন গঠনমূলক তৎপরতায় এই খনিজ থেকে যে সুবিধা পেয়ে থাকে) যুগ যুগ ধরে শান্তি ও যুদ্ধকালে লোহার ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব সম্পর্কে আর কি বলার প্রয়োজন আছে? বর্তমান কালে মানবতার কল্যাণে অথবা ধ্বংসাত্নক তৎপরতায় এটা অন্যতম সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ উপকরণে পরিণত হয়েছে। লৌহ সমৃদ্ধ যে কোন আধুনিক দেশ শত্রুর গভীর অভ্যন্তরে আঘাত হানতে পারে। কারণ অস্ত্র তৈরীতে লোহার রয়েছে বিপুল সম্ভাবনাময় শক্তি। তাছাড়া শিল্প ও সম্পদের চালিকাশক্তি হিসেবে এই দেশ একই সাথে প্রধান প্রধান শিল্পোন্নত দেশের পর্যায়ে উন্নীত হতে পারে।
লৌহের আলোচনা প্রসঙ্গে আমরা দেখছি একটি সূরাহর নামকরণ করা হয়েছে। স্মরণ রাখতে হবে সূরা সাবার আয়াতসমূহ। এই সূরায় আল্লাহ তায়ালা হযরত দাউদকে (আঃ) লোহা নমনীয় করার শিক্ষাদান প্রসঙ্গে তার রহমতের কথা উল্লেখ করেছেন। মানবতাকে উন্নত কলাকৌশল শিক্ষাদান প্রসঙ্গে এ উদাহরণ পেশ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে জুলকারনায়েন এর দৃষ্টান্ত পেশ করা হয়েছে। মজলুম জনগণের সামনে ভাষণ দিতে গিয়ে এবং আসন্ন হামলা থেকে তাদের রক্ষা করার তাওফিক কামনা করে তিনি বলেন,
আমার খোদা আমাকে যাহা কিছু দিয়েছেন তাহা প্রচুর। তোমরা শুধু খাটুনী করে আমার সাহায্য কর। আমি তোমাদের ও তাদের মধ্যে বাঁধ নির্মাণ করে দিচ্ছি। আমাকে লৌহখন্ড এনে দাও। শেষ পর্যন্ত তিনি যখন উভয় পাহাড়ের মধ্যবর্তী পূন্যস্থান, পূর্ণরূপে ভরে দিলেন তখন লোকদের বললেন, এখন আগুনের কুন্ডলী উত্তপ্ত কর। শেষ পর্যন্ত যখন (এই লৌহ প্রাচীর) সম্পূর্ণরূপে আগুনের মতো লাল হয়ে উঠলো তখন তিনি বললেন, আনো, আমি এখন ইহার উপর গলিত তামা ঢেলে দিব। এভাবে তা লংঘন করার অথবা তা খোঁড়ার ক্ষমতা তাদের রইলো না (১৮:৯৫-৯৭)।
পবিত্র কোরআন মানুষ, প্রকৃতি ও অতি প্রাকৃতিক বিষয়ের মধ্যে এক অনন্য সমন্বয়ের চিত্র এঁকেছে। এতে মানুষের সেবায় পার্থিব শক্তির আনুগত্য ও রূপান্তর এবং আল্লাহর এবাদত সম্পর্কে এক ভারসাম্য টানা হয়েছে। এতে সৌন্দর্যতত্ত্ব ও প্রকৃতির বাস্তব দিকের ব্যাপক বৈপরীত্য দেখানো হয়েছে। একদিকে মানুষের শক্তি ও বাস্তব সম্ভাবনা এবং অন্যদিকে প্রাণীকূলের তুলনায় তার অবস্থান, তার দূর্বলতা এবং আল্লাহর ওপর স্থায়ী নির্ভরশীলতা দেখানো হয়েছে। মানুষের বস্তুগত ও স্বাভাবিক প্রয়োজন পূরণে নীতিভ্রষ্ট হওয়ার প্রবনতাকে সংঘত প্রহরায় রাখার প্রয়োজনের ওপর কোরআন সবসময় গুরুত্ব দিয়েছে।
আমরা দাউদের প্রতি অনুগ্রহ করেছিলাম এই আদেশ মর্মে যে, হে পর্বতমালা তোমরা দাউদের সাথে আমার পবিত্রতা ঘোষণা কর এবং হে পক্ষী সকল তোমরাও। আমি তার জন্য লৌহকে গরম করেছিলাম। এবং তাকে বলেছিলাম, প্রশস্ত বর্ম তৈরী কর, কড়াসমূহ যথাযথভাবে সংযুক্ত কর এবং সৎকর্ম সম্পাদন কর। তোমরা যা কিছু কর, আমরা তা দেখি। আর আমরাও সোলায়মানের অধীন করেছিলাম বায়ুকে যা সকালে এক মাসের পথ এবং বিকেলে এক মাসের পথ অতিক্রম করতো। আমরা তার জন্য গলিত তামার এক ঝরণার প্রবাহিত করেছিলাম। কতিপয় জ্বিন তার সামনে কাজ করতো তার পালনকর্তার আদেশে। তাদের যে কেউ আমার আদেশ অমান্য করবে, জ্বলন্ত অগ্নির শাস্তির আস্বাদন করাব। তারা সোলায়মানের ইচ্ছানুযায়ী দুর্গ, ভাস্কর্য, হাউস, সুদৃশ্য বৃহদাকার পাত্র এবং চুল্লীর উপর স্থাপিত বিশাল ডেগ নির্মাণ করতো। হে দাউদ পরিবার কৃতজ্ঞতা সহকারে তোমার কাজ করে যাও। আমার বান্দাদের মধ্যে অল্প সংখ্যকই কৃতজ্ঞ। যখন আমরা সোলায়মানের মৃত্যু ঘটালাম, তখন শুধু ঘুন পোকাই জ্বিনদেরকে তার মৃত্যু সম্পর্কে অবহিত করলো। সোলায়মান যখন মাটিতে পড়ে গেলেন, তখন জ্বিনেরা বুঝতে পারলো যে, অদৃশ্য বিষয়ে জ্ঞান থাকলে তারা এই লাঞ্ছনাপূর্ণ শাস্তিতে আবদ্ধ থাকতো না। (৩৪:১০-১৪)
অপর এক সূরায় বলা হয়েছে:
সোলায়মান বললো, হে আমার পালনকর্তা, আমাকে মাফ করুন এবং আমাকে এমন এক সাম্রাজ্য দান করুন যা আমার পরে কেউ পেতে না পারে। নিশ্চয়ই আপনি মহাদাতা। তখন আমি বাতাসকে তার অনুগত করেছিলাম যা তার হুকুমে অবাধে প্রবাহিত হতো যেখানে সে পৌঁছতে চাইতো। আর সকল শয়তানকে তার অধীন করে দিলাম অর্থাৎ যারা ছিল প্রাসাদ নির্মাণকারী ও ডুবুরী এবং অন্য আরো অনেককে অধীন করে দিলাম যারা আবদ্ধ থাকতো শৃঙ্খলে। এগুলো আমার অনুগ্রহ; অতএব কাউকে দাও অথবা নিজে রেখে দাও-এর কোন হিসাব দিতে হবে না (৩৮-৩৫-৩৯)।
কোরআনে আরও বলা হয়েছে:
অতঃপর আমরা সোলায়মানকে সে ফয়সালা বুঝিয়ে দিয়েছিলাম। আমরা উভয়কে প্রজ্ঞা ও জ্ঞান দান করেছিলাম। আমরা পর্বত ও পরীসমূহকে দাউদের অনুগত করে দিয়েছিলাম; তারা আমার পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করতো। এ সমস্ত আমরাই করেছিলাম। আমরা তাকে তোমাদের জন্য বর্ম নির্মাণ শিক্ষা দিয়েছিলাম যাতে তা যুদ্ধে তোমাদেরকে রক্ষা করে। অতএব তোমরা কি শোকর গুজার হবে? এবং সোলায়মানের অধীন করে দিয়েছিলাম প্রবল বায়ুকে; তা তার আদেশে প্রবাহিত হতো ঐ দেশের দিকে, যেখানে আমরা কল্যাণ দান করেছি। আমরা সব বিষয়েই সম্যক অবগত আছি। এবং অধীন করেছি শয়তানের কতককে যারা তার জন্য ডুবুরীর কাজ করতো এবং এ ছাড়া অন্য আরো অনেক কাজ করতো। এদের নিয়ন্ত্রণে আমরাই ছিলাম। (২১:৭৯-৮২)
এসব আয়াত হচ্ছে কয়েকটি দৃষ্টান্ত যা আল্লাহর ইচ্ছার ব্যাপারে সক্রিয় সাড়া দিয়ে গায়েব (Unseen) , খোদার ক্ষমতা, প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে সমাজ বিকাশের পদ্ধতির প্রতি সর্বোচ্চ সংহতি প্রকাশ করছে। এখানে মানুষের সেবায় গায়েবী শক্তি সুশৃঙ্খল সমন্বয়ে কাজ করছে, আর মানুষ এসব অকৃপণ দানের জন্য তার ইবাদত, প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা রুজু করছে আল্লাহর প্রতি যাতে পৃথিবীতে যে জন্য তাকে সৃষ্টি করা হয়েছিল সেই মর্যাদা অর্জনে সক্ষম হয়।
আমি জ্বিন ও মানুষকে অন্য কোন উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করিনি, কেবল এজন্য সৃষ্টি করেছি যে তারা আমার বন্দেগী করবে। আমি তাদের নিকট কোন রিজক চাইনা, এও চাইনা যে, তারা আমাকে খাওয়াবে (৫১:৫৬-৫৭)।
এখানে আমরা আল্লাহর দু জন নবী দাউদ ও সোলায়মান (আঃ)এর সাক্ষ্য পেলাম। প্রকৃতির অফুরন্ত শক্তি ও মানুষের অনুগত করে দেয়া হয়েছে। একই কথা প্রযোজ্য খোদার শক্তির ক্ষেত্রে যেখানে কোন সময়সীমা (Time limit) বা স্থানের প্রতিবন্ধকতা (Place barrier) নেই এবং এর সামনে বিজ্ঞান চূড়ান্ত পর্যায়ে অসহায়। লৌহ, বায়ু, গলিত তাম্র জ্বিন-এসব শক্তিকে অনুগত করে দেয়া হয়েছে যাদে দায়িত্বশীল, খোদাভীরু মানুষের নির্দেশে এগুলো পরিচালিত হতে পারে এবং শিল্প ও শিল্পকর্ম গড়ে তোলার মাধ্যমে সমাজ বিকাশের লক্ষ্য পূরণ করতে পারেন। লোহা ও তামার সুস্পষ্ট প্রসঙ্গে টেনে পবিত্র কোরআনে কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে, যা আজ বিংশ শতাব্দীতে আমাদের কাছে সুস্পষ্টভাবে ব্যবহারযোগ্য এবং নির্মাণ, শিল্পায়ন ও প্রতি ক্ষেত্রে উৎকর্ষ সাধনে আগ্রহী আধুনিক সভ্যতা বা যে কোন সভ্যতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আরো দেখতে পাচ্ছি আল্লাহ হযরত দাউদকে (আঃ) অকারণেই লৌহ দান করেন নি; তিনি শিক্ষা দিয়েছেলেন কিভাবে তা ব্যবহারযোগ্য করে তুলতে হবে। তদুপরি বায়ুর প্রসঙ্গ ভুলে গেলে চলবে না। ভৌগলিক গবেষণায় দেখা গেছে, পৃথিবীতে প্রাণের বর্ধন ও বিকাশের জন্য বায়ু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ।
অন্যান্য বহু আয়াতের ন্যায় এসব আয়াতে তাদের প্রতি চূড়ান্ত জবাবস্বরূপ যারা অভিযোগ করেন যে, ঐশী ধর্মের একমাত্র কাজ হলো তার অনুসারীদের বিচ্ছিন্ন ও নিষ্ক্রিয়তার দিকে পরিচালিত করা এবং তাদেরকে এভাবে প্ররোচিত করে যে গড়ে তোলার জন্য নয়, বরং এই পৃথিবী হচ্ছে কোনক্রমে কাল ক্ষেপণের গলিপথ, এসব লোকের কাছে ধর্ম হচ্ছে সভ্যতা বিরোধী এবং ঈমান হচ্ছে সৃজনশীলতা, আবিষ্কার নব জীবনের প্রতি বাধাস্বরূপ। তারা আরো বলেন, মানুষ ও তার স্রষ্টার মধ্যেকার সম্পর্কের ফলে নিষ্ক্রিয়তার সৃষ্টি হয়। তারা দাবী করেন জীবনের বিকাশ ও উন্নয়নের জন্য নৈয়ায়িত প্রত্যক্ষবাদী ধারাই (Positive School) রয়েছে গতিশীল ভূমিকা। এই ধারণা সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য।
এই সমীক্ষায় এমন বহু উদাহরণ পেশ করা হয়েছে যাতে প্রমাণিত হয় কোরআন পুরোপুরি পরাজিত মনোভাব ও নিষ্ক্রিয়তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। কারণ তা ধর্ম ও প্রগতিকে শত্রুতে পরিণত করার পরিবেশ সৃষ্টি করে। প্রকৃতপক্ষে খোদাভীরু হওয়ার অর্থ স্বাভাবিক জীবনযাত্রা থেকে সরে যাওয়া বুঝায় না কিংবা এমন কাজ করতে হয় যার কোন প্রতিযোগিতা মূল্য নেই। ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে প্রকৃত ধর্ম হচ্ছে জীবন যাত্রার মান উন্নত করা। এক্ষেত্রে ইসলাম জীবন ও ইতিহাস প্রক্রিয়ার সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত।
টীকা:
১। সুবহানাহু ওয়া তায়ালাঃ আল্লাহর প্রশংসা এবং তার সার্বভৌমত্ব অক্ষুন্ন থাকুক। আল্লাহ প্রসঙ্গে এ কথা বলা হয়।
২। সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামঃ মহানবীর (সাঃ)ওপর আল্লাহর শান্তি ও রহমত বর্ষিত হোক। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর নামোচ্চারণের সময় এই দরুদ পাঠ করা হয়।
৩। আলাইহিস সালামঃ তাঁর প্রতি আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক। অন্যান্য নবীদের বেলায় এই দোয়া পাঠ করতে হয়।
৪। আয়াতঃ কুরআনের আয়াত। খোদার কুদরত অর্থেও ব্যবহৃত হয়।
৫। ফকিহ (বহুবচন ফুকাহা): ফিকাহ শাস্ত্রে পন্ডিত ব্যক্তি, এরূপ আলিম (বহুবচন উলামা) অর্থ পন্ডিত।
৬। আল নাসিখ (বাতিল): কোরআনের এমন আয়াত যার বিষয়বস্তু অন্য একটি আয়াত দ্বারা বাতিল হয়েছে, এ জন্য এদের বলা হয় মানসুখ।
৭। বিন আশুর: শায়খ মুহাম্মদ আল তাহার; তাফসীর আল তাহরীর ওয়া আল তানবীর, আল দার আল তিউনিসিয়া, তিউনিস, ১৯৮৪ পৃ: ২৮-২৯।
৮। ফিকাহ: আইন কানুনের মাধ্যমে ইসলামী জ্ঞান; ইসলামের আইন জ্ঞান; উসূলে ফিকাহ; ইসলামী জুরিস প্রুডেন্স বিজ্ঞান অর্থাৎ ইসলামী আইনের উৎস থেকে আইন প্রণয়ন পদ্ধতি এবং এসব আইনের আওতা বা পরিধি নির্ণয়।
৯। হাদিস (বহুবচন আহাদিস) রসূলে করিম (সঃ) এর পবিত্র মুখ নিঃসৃত বাক্য ও কর্মের সমষ্ঠির নাম হাদিস। ইংরেজী H (Capital – H) অক্ষর দ্বারা রসূলে হাদিসের সমষ্ঠি বুঝায়। হাদিসের পন্ডিতদের মুহাদ্দিসীন বলা হয়।
১০। বিন আশুর; প্রাগুক্ত পৃষ্ঠা-১২
১১। উসুলিয়ুন: মৌলবাদী হিসেবে কদর্থ করা হয় এবং বিশুদ্ধবাদী হিসেবে ভুল ব্যাখ্যা করা হয়। এর প্রকৃত অর্থ, বিশুদ্ধ এবং তাদেরকেই এ বিশেষণে বিশেষায়িত করা হয়, যারা কোরআন ও সুন্নাহর ঐতিহ্যবাহী ব্যাখ্যার প্রতি অনুরুক্ত এবং যারা ইজতিহাদ এর প্রতি অনুরক্ত নন (১৬ নম্বর টীকা দেখুন)।
১২। বিন আশুর, প্রাগুক্ত পৃ: ৪৪
১৩। তাওহীদ; খোদার একত্ববাদ; এই ধারণার পোষণ করা যে, আল্লাহ এক, সার্বভৌম, বিশ্ব জাহানের সৃষ্টিকর্তা, সমস্ত সৃষ্টিকূলের মালিক। তাওহীদ হচ্ছে ইসলামের নির্যাস।
১৪। সুন্নাহ: রসূলে করিমের (স) কথিত, সম্পাদিত ও অনুমোদিত বা অনুনোমদিত কে কাজের সমষ্টি।
১৫। Methods of understanding the Quran, IIIT Virgina, 1991 Herndon.
১৬। ইজতিহাদ: ইসলামের বিচার সংক্রান্ত উৎস, সর্বকাল ও স্থানের জন্য অপরিবর্তনীয়। মুসলিম সমাজের পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে এ সমস্ত সূত্রের সুশৃঙ্খল বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচেষ্টাকে ইজতিহাদ বলা যেতে পারে।
১৭। ইমাম (আ ইম্মাহ বহুবচন): ইসলামী জ্ঞানের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ধর্মীয় ও পার্থিব বিষয়ের সমাজ নেতা, ইসলামী আইনের ব্যাখ্যাকারীকেও ইমাম বলা হয়।
১৮। সনদ (আসানিদ বহুবচন): কোন সুনির্দিষ্ট হাদিসের বর্ণনাকারী দল। আল মুসনাদ; হাদিসের বর্ণনাকারীদের ক্রমানুসারে যে কোন হাদিসের সংকলন; যেমন মুসনাদ আবু দাউদ।
১৯। মুহাদ্দেসীন: ৯নং টীকা দেখুন।
২০। মুনতাহিদুন: ১৬ নং টীকা দেখুন।
২১। আহাদ: যে সমস্ত হাদীস শুধু একজন বর্ণনাকারী সূত্রে বর্ণিত।
২২। ফতওয়া: ইসলামী আইনের সাথে সম্পৃক্ত কোন আলেম, মুফতি বা মুজতাহিদের দেয়া আইনানুগ রায়।
২৩। কায়রো ও বৈরুতের দারুর সুরূক প্রকাশিত।
২৪। সীরাত: মহানবীর (সঃ) এ জীবন গ্রন্থ।
২৫। সঠিক স্দ্ধিান্তে পৌঁছতে সুন্নাহর ব্যাপারে গবেষণা পরিচালনার নীতি অনুসারে ইনস্টিটিউট আম্মান ভিত্তিক রয়্যাল সোসাইটি ফর দি স্টাডি অব ইসলামিক সিভিলাইজেশন-এর সহযোগিতায় একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারের আয়োজন করে। ১৯৮৯ সালের নভেম্বর মাসে সোসাইটির ৭ম সাধারণ সম্মেলনকালে মহানবীর সুন্নাহ ও সভ্যতা বিনির্মাণে তার পদ্ধতি বিষয়ে আয়োজিত এই সেমিনারে ১২৬ জন পন্ডিত, অধ্যাপক এবং গবেষক যোগ দেন সেমিনার আলোচিত সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মধ্যে শেখ আল গাজালীর এবং ড. আল কারদাবীর সুন্নাহ সম্পর্কে ইতিপূর্বে প্রকাশিত দুটি গ্রন্থ ( আগে উল্লেখিত) এবং অন্যান্য নিবন্ধও ছিল।
২৬। এসব বিষয়ে আমার আলম ফি মুয়াজাহাত আর মাদ্দিয়াহ ( বস্তুবাদের মুখোমুখি বিজ্ঞান) গ্রন্থে আলোচনা করা হয়েছে বৈরুতে মুয়াসাসাত আল রিসালাহ, ১৯৮৬।
২৭। আরো বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন মদীয় গ্রন্থ মাদখাল ইলা মাওফীক আল কোরআনুল করিম মিনাল ইলম ( বিজ্ঞানের প্রতি কোরআনের দৃষ্টিভঙ্গির ভুমিকা) বৈরুত, মুয়াসাসাত আল রিসালাহ, ১৯৮৩, এখানে পাঠক বিষয়ভিত্তিক কোরআনের পূর্ণাঙ্গ রেফারেন্স পাবেন।
২৮। খিলাফাহ: মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি, রসূলে করিম (সঃ) এর পার্থিব সরকারের ধারাবাহিকতায় সরকারের বিধান। খলিফাহ (খুলাফাহ বহুবচনে): আল্লাহর প্রতিনিধি।
২৯। ঈমান: আল্লাহ-ই একমাত্র খোদা এবং মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) তার শেষ নবী-এই বিশ্বাস রাখা।
৩০। দ্বীন: মানুষের জন্য জারী করা আল্লাহর স্বাভাবিক বা প্রকৃত ধর্ম যাতে রয়েছে ঈমান, নীতি, আইন, ভক্তি, বিধি-বিধান ও বিচার।
–– সম্পাপ্ত —