সুন্নাহর যথাযথ অধ্যয়ন প্রসঙ্গে
ডঃ তাহা জাবির আল আলওয়ানী
ইসলামের শুরু থেকে পন্ডিত ও মুজতাহিদগণের পরিচিতি বিধিসমূহের কাঠামো অনুসারে সুন্নাহর ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এর নির্ভরযোগ্যতা আল-কোরআনের পরেই, দ্বিতীয় স্থানীয়। কার্যতঃ এ দুটোকে পৃথক করা যায় না। কারণ , সুন্নাহ আল-কোরআনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে থাকে এবং কোরআনের শিক্ষা ও পদ্ধতির বাস্তবায়ন করে।
সুতরাং সুন্নাহর নির্ভরযোগ্যতা ইসলামের একটি অপরিহার্য অংগ-যে ব্যাপারে প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের কেউ কখনো প্রশ্ন উঠায়নি। তবে পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে স্বল্প জ্ঞান এবং হিকমত সম্পন্ন এমন অনেক লোক ছিল যারা রসূলের অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত হাদীস তথা সুন্নাহর সাথে প্রাথমিক যুগের কাহিনী এবং সংক্ষিপ্ত ঘটনাপুঞ্জির মধ্যে পার্থক্য করতে পারেনি। তারা জানেনা এধরনের ঐহিহাসিক অথবা সংক্ষিপ্ত রিপোর্টসমূহের কতটুকু প্রামাণ্য হিসেবে গণ্য করা যায়; মানুষের জ্ঞানের পরিস্ফুটনের মাধ্যম হিসেবে এগুলি কি রকম মূল্যবান; অথবা যুক্তিধর্মী চিন্তাধারা বা বাস্তব প্রমাণে সাথে সাংঘর্ষিক হওয়ার পরেও এগুলিকে প্রামাণ্য হিসেবে গণ্য করা হবে কি না। এসব অল্প জ্ঞান সম্পন্ন লোক ধারণা করা যে, এই পদ্ধতিগত দার্শনিক বিষয়ের আলোচনা খোদ সুন্নাহর সাথে বিরোধপূর্ণ। তারা সুনানকে (আচরণ ও কর্মকান্ড) বিবেচনা করে সংশ্লিষ্ট বিবরণ হিসেবে এবং এই বিবরণকে মনে করে শুধু মাত্র বিবরণী হিসেবে এবং অধিকাংশ বিরোধ কেন্দ্রীভুত হয় বিবরণীসমূহের উপর। তারা মহানবী (সঃ) এর সুন্নাহ ও দিক নির্দেশনার এবং যে পন্থায় এগুলি (পরবর্তী পর্যায়ে) প্রচারিত হয়েছে তার মধ্যকার ব্যাপব ব্যাবধান অনুধাবন করতে ব্যার্থ হয়েছেন। তদুপরি রসূলের কার্যক্রম, কর্ম এবং বক্তব্যের রিপোর্ট করার পদ্ধতি এবং অপরাপর লোকদের ব্যাপারে রিপোর্টিং-এর মধ্যে তারা কোন পার্থক্য দেখতে পায়নি। এই দুঃখজনক বিভ্রান্তির ফলে, খোদ সুন্নাহর নির্ভরযোগ্যতা সম্পর্কে প্রশ্নের উদ্রেক করেছে যার ফলে উসুল ও হাদীসের গবেষণা সংক্রান্ত গ্রন্থাদিতে বিস্তর আলোচনা স্থান পেয়েছে। এই শ্রম অনাসয়ে কাজে লাগনো যেতো সুন্নাহর অনুধাবন, ব্যাখ্যা এবং তা থেকে শিক্ষা নেওয়ার লক্ষ্যে সঠিক পদ্ধতি উদ্ভাবনের মাধ্যমে, এভাবে প্রতি যুগের ও স্থানের মুসলমানদেরকে এর শিক্ষার আলোকে চিন্তাধারা ও জীবন পদ্ধতি গড়ে তুলতে সাহায্য করা যেতো।
সাধারণভাবে রিপোর্টসমূহ এবং বিশেষভাবে আহাদ এর নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে অহেতুক ও ইচ্ছকৃত খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে বিতর্কের ফলে নেতিবাচক, অত্যন্ত মারাত্নক ও ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে মুসলমানদেরকে মধ্যে মত পার্থক্য এবং বিতর্ক ঘনীভূত হয়েছে। এবং পরিণতিতে বহু গ্রন্থ বিমূর্ত ও অস্পষ্ট আলোচনায় পর্যবসিত হয়েছে যার কোন ইতিবাচক, বুদ্ধিবৃত্তিক বা বাস্তব প্রভাব ছিল না। কোরআনের প্রেক্ষাপটে সুন্নাহর মর্যাদা এবং কোরআন কর্তৃক সুন্নাহ বাতিল প্রভৃতি বিতর্কে মুসলমানরা অহেতুক দীর্ঘ ও পুনঃপৌনক সমালোচনা এবং ঐতিহাসিক রিপোর্ট, বর্ণনাকরী এবং কর্তৃত্বের ধারাক্রমের (Chains of authority) প্রামাণ্যতার পরীক্ষা-নিরীক্ষায় লিপ্ত হয়। মূল গ্রন্থের সমীক্ষা, বিশ্লেষণ ও অনুধাবনের পদ্ধতিসমূহ এবং সময়-কাল পরিবেশ বাস্তবতার প্রেক্ষিতে হাদীছ পরিবেশন, তারপর সনদ পর্যালোচনায় নিবেদিক ব্যাপক প্রচেষ্টা ও বহুসংখ্যক গ্রন্থের সাথে তুলনা করা হলে যে কেউ তৎপরবর্তী সমস্যা ও বিভ্রান্তির প্রকৃতি অনুধাবন করতে পারতো।
অবশ্য আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে মূল্যবান গ্রন্থ রচনায় যথেষ্ট শক্তি ব্যয় করতে হয়েছে। এধরনের গ্রন্থে শুধু আইনগত দিক আলোচিত না হয়ে সুন্নাহর সকল দিক স্থান পেলে উম্মাহর প্রয়োজন আরো বেশি করে পূরণ হতো। যেহেতু সুন্নাহ সার্বিকভাবে বিশেষ ধরনের আদর্শিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি ঐতিহাসিক ও ভৌগলিক প্রেক্ষাপটে কোরআনের পদ্ধতিগত বাস্তবায়নের মাধ্যমে নির্দেশনার ধারারক্রমের প্রতিনিধিত্ব করে সেজন্য সুন্নাহ অনুধাবনের পদ্ধতিগত সমীক্ষা হচ্ছে উসুল হাদীস শিক্ষার অন্যতম সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় দিক। এসময় ইসলামকে চূড়ান্ত পর্যায়ে বাস্তবায়িত করা হচ্ছিল এবং ইসলামের আদর্শ বাস্তবে রূপ দিতে এবং ইতিহাসের এই কালকে (সময়) এমন যুগে পরিণত করতে পবিত্র কোরআন স্বয়ং নেতৃত্বস্থানী ভুমিকা পালন করে যাদে ভাবী বংশধরদের অনুসরণের জন্য এটা হয় অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এভাবে আল্লাহর বাণী বাস্তবায়নে সুন্নাহ উচ্চতম, সর্বাধিক স্বচ্ছ, উত্তম ও সত্যিকারের ধারার প্রতিনিধিত্ব করে। আল কোরআনের নিয়ম সম্পর্কিত বিজ্ঞানের এটা একটা বাস্তববাদী, বিদগ্ধ ও সার্বিক প্রতীক। কোরআন নাযিলের সময় যেভাবে যে রূপে ছিল তা সংরক্ষন এবং কোন রকম বিচ্যুতি থেকে রক্ষা করাই বোধ হয় খোদা তায়ালার ইচ্ছার অনুকূলে কাজ করেছে। মহানবী (সঃ) স্বয়ং কোরআনের প্রতিটি অক্ষর সংরক্ষনের অত্যন্ত দৃঢ়তা দেখিয়েছন এবং প্রতিটি স্বরবর্ণ ও যতি চিহ্ন বহাল রেখেছেন। এ জন্য অব্যাহ হুশিয়ারী উচ্চারণ করা হয়েছে যে, কোরআনের প্রতিটি অক্ষর নাযিল কালের মতই অক্ষুণ্ন রেখে প্রচার করতে হবে-শব্দান্তরিত আকারে প্রকাশ করা নিষিদ্ধ।
কিন্তু সুন্নাহর বিষয়টি এরকম নয়। সুন্নাহর সংরক্ষন করা হলেও তার উপর উপরোক্ত কড়াকড়ি আরোপ করা হয়নি। তাছাড়া পবিত্র কোরআনের ন্যায় মহানবী (সঃ) হাদীস লিখে রাখাও ব্যবস্থা করেননি। এছাড়া তিনি কোরআনের ন্যায় জিবরাঈলের সাথে এ নিয়ে মুখ আওড়াননি (কন্ঠস্থ করেননি) দৃষ্টিভঙ্গির এই পার্থক্যের কারণ হচ্ছে মহানবীর মত মানব সামর্থের সর্বোচ্চ পর্যায়ে সুন্নাহ বাস্তব অভিজ্ঞতা হিসেবে বিরাজ করুক। মহানবী (সঃ) আল কোরআনের অনুসরণ করেছেন সর্বাত্নকও চূড়ান্ত রূপে। বস্তুতঃ দৈনন্দিন জীবনের সকল ক্ষেত্রে এবং সকল পার্থিব কার্যক্রমে তিনি এর নিযম সংক্রান্ত বিজ্ঞান প্রয়োগ করেছেনঃ করেছেন ধর্মপ্রচার, শিক্ষাদান, নিষেধাজ্ঞা দান, উপভোগ, পরামর্শ, ও উপদেশ দান, বিচার কারর্য, ফতোয়া দান, নির্দেশ দান, শৃঙ্খলা বিধান, যুদ্ধ পরিচালনা, শান্তি স্থাপন ,চুক্তি সম্পাদন, ক্রয় বিক্রয়, বার্তা বিনিময়, বিবাহ, তালাক, নির্মাণ, ধ্বংস, ভ্রমণ প্রভৃতিতে।
আল কোরআনের নিয়ম সংক্রান্ত বিজ্ঞান নবীজীর কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও অনুরসণ করেছে। কোরআনের অনেক আয়াত এই নিয়ম বিজ্ঞানের মূল্যায়ন করেছে এবং প্রয়োজনবোধে সমালোচনা, বিশ্লেষণ ও সংশোধন ও পরিচালিত করেছে। কারণ প্রয়োগ প্রক্রিয়া মানবিক সীমাবদ্ধতা ও সময় স্থানের দরুন শর্তাধীন ছিল। এজন্য আল্লাহ বলেন, যতদূর পার, আল্লাহর স্মরণে থাক।
নবী করীম (সঃ) ছাড়া অন্য কোন ব্যক্তি কোরআনের নিয়ম বিজ্ঞান প্রয়োগ করার সময় নবী করীম (সাঃ) এর প্রয়োগ পদ্ধতির সাথে তুলনা করে মূল্যায়ন করা উচিৎ। কারণ মহানবী (সঃ) ছাড়া অন্য কোর ব্যক্তি ব্যক্তিগত ঝোঁকপ্রবণতা ও স্বতস্ফূর্ত প্রভাবে সংবেদনশীল হতে পারেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, জনসাধারণ নামাজ কালামের ক্ষেত্রে নবী করীম (সাঃ) কেই অনুসরণ করেছে। অনুসরণ করার পরিবর্তে তারা তার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করতো। কারণ কোন দৃষ্টান্ত অনুসরণ করার অর্থ হচ্ছে মেধাকে সংশ্লিষ্ট করে একটা সচেতন কর্মতৎপরতা-এজন্য প্রয়োজনে এই দৃষ্টান্তকে কেন্দ্র করে সকল উপকরণের বিষয়কে সচেতনতার সাথে অনুসরণ করা। ইন্টান্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব ইসলামিক থ্যাট (International Institute O Islamic Thought)) বর্তমানে মুসলিম পন্ডিতদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্ব পূর্ণ বিষয় হিসেবে ইসলামী জ্ঞান ও সংস্কৃতির উৎস ব্যবহারের জন্য সুন্নাহর অনুধাবন, এর ব্যাপক ও চূড়ান্ত বিশ্লেষণ এবং যথাযথ দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে আসছে। এটা বিশেষভাবে এ জন্য প্রয়োজন যে মুসলিম জ্ঞান, সংস্কৃতি ও সভ্যতার পুনর্গঠনে মৌলিক পূর্বশর্ত হিসেবে ইসলামের ভিত্তি ও উৎস এবং যেগুলি অনুধাবনের পন্থা ব্যাখ্যা করা জরুরী। এ লক্ষ্য অর্জনে ইনস্টিটিউট কতিপয় কর্মসূচী গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
প্রথমতঃ এর উদ্দেশ্য হচ্ছে যেসব বিষয়ে ইতিমধ্যে সিদ্ধান্ত মূলক আলোচনা করা হয়েছে তার পরিবর্তে এখন পর্যন্ত অমিংমাংসিত বিষয় এবং যার সমাধান প্রয়োজন তার প্রতি উসূল ও হাদীস শিক্ষার দৃষ্টি নিবন্ধ করতে হবে। এ প্রসঙ্গে ইনষ্টিটিউট মনে করে, যেহেতু আল্লাহ ও রসূলের প্রতি আস্থাশীল কোন মুসলমান সুন্নাহর কর্তৃত্ব অস্বীকার করতে পারেনা, সেজন্য সুন্নাহর কর্তৃত্বের প্রশ্নটা চূড়ান্তভাবে আলোচিত হয়েছে। ইনস্টিটিউট প্রখ্যাত উসুল বিশেষজ্ঞ শেখ আব্দুল গনি আব্দুল খালেক প্রণীত হুজিয়াত আল সুন্নাহ (সুন্নাহর আইনগত কর্তৃত্ব) গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে। গ্রন্থটি এ বিষয়ের উপর একটি মূল্যবান পান্ডিত্যপূর্ণ বিষয় এ ক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ এবং ইনস্টিটিউট এটিকে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত গ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করে।
ইতিমধ্যে ইনস্টিটিউট বিভিন্ন বিষয়ে পন্ডিত ও গবেষকদের কাছে সুন্নাহকে অধিকতর গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য এক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের প্রতি গবেষকদের দৃষ্টি আকর্ষনের প্রয়াস চালিয়েছে। ইনস্টিটিউট এ লক্ষ্যে কর্মরত বহু পন্ডিতকে ইতিমধ্যে সহযোগিতা দিয়েছে।
তাছাড়া ইনস্টিটিউট বিষয়গতভাবে সুন্নাহর শ্রেণী বিন্যাস শুরু করেছে। শুধু ফিকাহর উৎস হিসেবে সীমিত না রেখে সুন্নাহকে সমাজ বিজ্ঞানের জ্ঞানের উৎস হিসেবে পরিণত করার আমাদের লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক যে কোন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগের সাথেও সংশ্লিষ্ট হয়েছে।
চূড়ান্ত পর্যায়ে (Finally) ইনস্টিটিউট বিশিষ্ট পন্ডিতদের ইসলামী সভ্যতা পুনর্গঠনে সুন্নাহর বিভিন্ন দিক এবং তার ভূমিকা সংক্রান্ত গ্রন্থ রচনার জন্য আমন্ত্রণ জানানোর কাজ শুরু করেছে। সুবিখ্যাত পন্ডিত শেখ মুহাম্মদ আল গাজালীর ইতিমধ্যে একটি সাড়া জাগানো গ্রন্থঃ আল সুন্নাহ আল বায়না আহলাল ফিকাহ ওয়া আহলাল হাদীস ( ফিকাহ বিশেষজ্ঞ ও হাদীছ বিশেষজ্ঞদের মাঝে সুন্নাহ) রচনা করেছেন গ্রন্থটিকে সুন্নাহ অনুধাবনের পদ্ধতি সম্পর্কে দেয়া হয়েছে এবং যারা সনদের কাঠামো ও রিপোর্ট নিয়ে যারা সংশ্লিষ্ট ও যারা সুন্নাহ অনুধাবনের আগ্রহী ও তা থেকে শিক্ষা নিতে চায়, তাদের মধ্যেকার পার্থক্য টানা হয়েছে। ইনস্টিটিউটের মতে, এই বিদগ্ধ পন্ডিত গ্রন্থ রচনায় এত অভিজ্ঞ ও জ্ঞানী যে, গ্রন্থ প্রনয়নে কারো নির্দেশ বা ভুল ত্রুটি সংশোধনে কারো নির্দেশের প্রয়োজন বোধ করেনা। তবে তার গ্রন্থে সন্নিবেশিত কতিপয় বিস্তারিত তথ্য ও ব্যবহৃত উদাহরণ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা সৃষ্টি হয়েছে। এ ব্যাপারে হৈ চৈ এত বেশী হয়েছে যে, এসব তুচ্ছ বিবরণের জন্য গ্রন্থটি মূল মর্মবাণী প্রায় তলিয়ে গেছে।
এ গ্রন্থটি মূলতঃ রচিত হয়েছিল সেই সব লোকদের জন্য যাদের শরীয়া এবং গবেষণা পদ্ধতি সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান নেই এবং যাদের ইতিহাস, সীরাহ ফিকাহ ও আরবী জ্ঞান শুদ্ধরূপে হাদীস অনুধাবনের জন্য যথেষ্ট নয়। বহু লোক হাদীস অধ্যয়ন শুরু করে এবং তার প্রকৃতি অথবা নবী করীম (সঃ) এর বক্তব্যের বা কাজের কথিত কারণ না বুঝে অথবা হাদীসে সাধারণ ভাষ্য অনুধাবন না করেই পড়ে যায়। তাদের এ অনুধাবন ত্রটিপূর্ণ ও বিভ্রান্তিকর এবং এর ফলে তারা হাদীসের একটি বিকৃতি ধারণা লাভ করে এবং এটা তারা সর্বসাধারণের মাঝে ছড়িয়ে দেয়। এসব লোক এতদূর পান্ডিত্যের দাবী করে যে, কোরআনের উপরে রয়েছে সুন্নাহর প্রাধান্য এবং তা স্থগিত করতে পারে। তদুপরি যদি তারা কোন অধিকতর সহী হাদীসের সম্মুখীন হয় যা তাদের যুক্তির বিপক্ষে যায় তখন তারা তার মত দ্বৈধতার প্রকৃতি বুঝতে পারে না। এ ধরনের হাদীস মুল্যায়নের পন্থা-এমনকি আলোচ্য হাদীস অনুধাবনের জন্য সঠিক পদ্ধতি ও বিধিও বুঝতে পারে না।
গ্রন্থটি রচিত হয়েছিল সুন্নাহ অধ্যয়নে নিয়োজিত পন্ডিত ও গবেষকদের উদ্দেশ্যে। তাদের পরামর্শ দেয়া হয় সুন্নাহর অনুধাবনের সুষ্ঠু পদ্ধতির জন্য তারা যেন কিছুটা দৃষ্টি দেন। কারণ সুষ্ঠু উপলব্ধি ছাড়া কোন হাদীস নেই এবং সুন্নাহ ছাড়া কোন ফিকাহ, ইসলামী সভ্যতা বা সত্যিকার জ্ঞান থাকতে পারে না।
শেখ আল গাজালীর গ্রন্থের বিভ্রান্তির ব্যাপারে ইনস্টিটিউট সচেতন হয়ে তারা ডঃ ইউসুফ আল কারা দায়ীকে অনুরোধ করেন দুটি বিস্তারিত গ্রন্থ লিখতে। এর একটি হচ্ছে সুন্নাহ অনুধাবনের পন্থা এবং অপরটি জ্ঞানের উৎস হিসেবে সুন্নাহ। প্রথমটি ইনস্টিটিউট কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে কায়ফা নাতা আমল মাআল সুন্নাহ আল নাবাবিয়াহ (সুন্নাহ অনুধাবনের পন্থা) এই শিরোনামে এবং দ্বিতীয়টি যথাসময়ে প্রকাশিত হবে ইনশাআল্লাহ।
সমকালীন ইসলামিক জীবন ধারা বিনির্মানে সুন্নাহর ইতিবাচক ও সক্রিয় ভুমিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জ্ন্য যেসব বিষয় সিদ্ধান্তমূলকভাবে ইতিমধ্যে আলোচিত হয়েছে তার পরিবর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ইসলামী উচ্চতর শিক্ষার ক্ষেত্রে হাদীস শিক্ষার পাঠ্যক্রমে সুন্নাহর পদ্ধতিগত দৃষ্টিভঙ্গি অন্তর্ভুক্ত করা।
আশা করা যায় যে, মুসলমানরা সুন্নাহর উপলব্ধির জন্য ক্রমবর্ধমান অধিকতর আগ্রহ দেখাবে। এ ধরনের উপলব্ধির বিধি বিধান (Rules and conditions of such understanding) তাদেরকে জানতে হবে ও প্রচার করতে হবে এবং সুন্নাহর সম্পর্কে ভুল বুঝাবুঝির কারণ জানার জন্যও গভীর আগ্রহ সৃষ্টি করতে হবে। তাদেরকে অনুধাবন করতে হবে এই উপলব্ধির ক্ষেত্রে যুগপৎ সংগঠিত ঘটনাবলী (Overlapping issues) কেন সংকটের সৃষ্টি করেছে এবং কেমন করে এই সংকটের ফলে সুন্নাহর কর্তৃত্ব সংক্রান্ত বিতর্কে দার্শনিক যুক্তি প্রয়োগ শুরু হয়েছে। সুন্নাহর উপলব্ধির জন্য একটি সার্বিক পদ্ধতিগত দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে তিনটি প্রশ্নের সুগভীর গবেষণা প্রয়োজন।
(ক) উপলব্ধির শর্তাবলী
যদি শুদ্ধরূপে উপলব্ধির প্রশ্নটি সুন্নাহর ক্ষেত্রে সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় তাহলে ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে মতানৈক্য ও বিভ্রান্তিকর কারণগুলি কি? সুষ্ঠু অধ্যয়ন ও উপলব্ধির জন্য কি ধরণের গুণাগুন ও যোগ্যতার প্রয়োজন? ইসলামের প্রতি অস্বীকার উপলব্ধির জন্য পূর্ব শর্ত কি? কারো সার্বিক অন্তর্দৃষ্টির কমতি কেমন করে পূরণ করা যাবে? কেমন করে আমরা এই সংকটের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তমূলক আলোচনা করতে পারবো? কেমন করে আংশিক চাপা সমস্যাবলীর প্রশ্নে সমাধান করবো যা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে এবং যা অনেক গবেষকের মতে, সুন্নাহর সার্বিক বিষয়ে না হলেও আংশিকভাবে কর্তৃত্বে (Authority) ব্যাপারে বিতর্ব সৃষ্টি করেছে? এই বিতর্কের ফলে যুক্তিতর্ক ও অহংকারীদের পক্ষে অজুহাত দাঁড় করাবার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। অবশ্য ইসলামরে ইতিহাসে প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের মধ্যে এই বিষয়টি কখনই সমস্যা সৃষ্টি করেনি।
(খ) মতপার্থক্য ও বিভাগ
উম্মাহ কেন ও কি জন্য নানা ফেরকা ও তরিকায় বিভক্ত হয়ে গেল? সুন্নাহ ওতার কর্তৃত্বের ব্যাখ্যা, অনুধাবন ও প্রচারকে কেন্দ্র করে কিভাবে বিভিন্ন ফেরকা সৃষ্টি হলো? সুন্নাহ কিভাবে বিভিন্ন ফেরকা ও তরিকার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হলো? জাল হাদীস হাদীসের অসম্পুর্ণ উপলব্ধি এবং সুন্নাহ থেকে আইনের প্রয়োগ নিয়ে প্রশ্ন উঠলো কেন? এসব ঘটনা বিভিন্ন গ্রুপের বিকাশে কি প্রভাব ফেলেছে এবং হাদীস অধ্যয়ন ও রাবীদের (হাদীস বর্ণনাকারী) বন্ণা পরষ্পর বিশ্লেষণে বিশেষ প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে? পূর্বেকার উসূল এর পন্ডিতবর্গও খুঁটিনাটি বিষয়ে ধর্মতাত্বিকদের (Scholastic theologians) আলোচিত ব্যাপারে সুন্নাহর অধ্যয়নে এসব বিষয় সম্পৃক্ত হলো কেমন করে? এসব বিষয়ের মধ্যে রয়েছে, সুন্নাহর কর্তৃত্ব, কোরআনের প্রেক্ষাপটে তার মর্যাদা, কতিপয় আয়াত মনসুখ হওয়া, কোরআনের আলোচনায় তার ব্যাখ্যা ও সীমা নির্দেশ করা, মহানবীর (সঃ) ইজতিহাদ, এই সম্পর্কেও বর্ণিত হাদীস (Spoken Sunnah) এবং এসব ব্যাপারে কোরআনের বিভিন্ন আয়াতের মূল্যায়ন ইত্যাদি।
এখন এসব বিষয় বুদ্ধিবৃত্তি ও শিক্ষাগত দৃষ্টি ভঙ্গিতে মুসলিম মানসের ওপর কি প্রতিক্রিয়া ফেলেছে? কোন ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতে এসব সম্যাসার সৃষ্টি হয়েছে? এর বুদ্ধিবৃত্তি তাৎপর্য এবং এগুলি এপর্যন্ত কি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে? আধুনিক সুন্নাহ সমীক্ষায় এবং এ ধরনের সমীক্ষার জন্য পাঠক্রম প্রণয়নের সর্বোত্তম উপায় কি? মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ করতে এবং সভ্যতার পুনর্নিমাণে উম্মাহকে উদ্বুদ্ধ করার ব্যাপারে এসব বিষয় থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে কিভাবে সর্বোত্তম দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা সম্ভব।
(গ) সুন্নাহ উপলব্ধিতে স্থান ও কালেন গুরুত্ব
প্রথম প্রজন্মের মুসলমানের ন্যায় উসুলিয়াগণ মহানবী (সঃ)-এর কার্যক্রম ও বক্তব্য এবং তার অভিজ্ঞতা মানবিক দিকের বিশেষ ঐতিহাসিক ও ভৌগলিক প্রেক্ষিতের স্বীকৃতি দিয়েছেন। সুতরাং এসব বিষয় বিবেচনা করার জন্য কতিপয় বিধি নির্ধারণ করে দিয়েছেন। বিভিন্ন ধরনের হাদীস অধ্যয়নের সময় বিশেষজ্ঞরা কি কতিপয় নির্দেশনা প্রণয়ন করতে পারেন? এ প্রসঙ্গে কোন পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে এবং এসব রূপরেখার ব্যাখ্যায় আধুনিক হাদীস সমীক্ষার ভূমিকা কি?
একদিকে ফকিহদের আলোচিত ছোটখাট বিষয় এবং চিন্তাবিদ, দার্শনিক ও মোতাকাল্লিমদের আলোচিত বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয় এবং অন্যদিকে সমাজ বিজ্ঞানীদের আলোচিত সামাজিক কার্যক্রমের ব্যাপারে অপরিহার্য পার্থক্য জ্ঞানের জন্য প্রয়োজন সুন্নাহর অনুধাবন ও প্রয়োগের বহুবিদ পন্থা ও পদ্ধতি। ফকিহদের আওতাভুক্ত একটি ছোটখাট বিষয় সংক্রান্ত হাদীস থেকে সাধারণ সামাজিক বিষয়ের হাদীস আলাদা ধরণের। এ ধরণের হাদীসের ব্যাখ্যায় এই ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট সকল সামাজিক দিক বিবেচনায় আনতে হবে এবং সমাজ বিজ্ঞানী তার বিশ্লেষণেও এ বিষয়টি দেখবেন। উম্মাহর দীর্ঘস্থায়ী বিবেধ থেকে আমরা কিভাবে মুক্তি পাব? এ বিভেদের ফলে একই হাদীস প্রতিদ্বন্ধী ধারণার সমর্থনে অপ্রয়োগ করা হয়। একেক গ্রুপ তাদের বিশ্বাসের প্রতি অন্ধ আনুগত্য থেকে কেমন করে রেহাই পাবে? ইসলামী চিন্তাধারার পবিত্র দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তি আমরা কিভাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে পারব এবং দুষ্ট চক্র থেকে রেহাই পাব। যে সময় সুন্নাহ (হাদীস) সংগ্রহ করা এবং পান্ডিত্যপূর্ণ গবেষণা পরিচালনা ও বিতর্কানুষ্ঠান এবং এই লক্ষ্যে যৌথ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার বিষয়টি সহজতর হয়ে পড়েছে?
উম্মাহর সমস্যা সমাধানে সুন্নাহর ভূমিকা
সাধারণভাবে ইসলামী বিশ্ব এবং বিশেষভাবে আরব বিশ্ব নানা সংকটে ভুগছে, যার ফলে ইসলামী চিন্তাধারার সন্ধিক্ষন চলছে। এই সন্ধিক্ষণ নানাভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। এর ভিতর গুরুত্বপূর্ণগুলো হচ্ছেঃ
ক. উম্মাহর বিভিন্ন মাজহাবের মধ্যে সংহতির অভাব, বুদ্ধিবৃত্তিক, সামাজিক, উপদলীয় রাজনৈতিক বিষয়ে বিরোধপূর্ণ চেতনা, উম্মাহর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টিকারী আদর্শের পুনরুজ্জীবন অথবা পূর্বে ছিল না এমন আদর্শের উদ্ভাবন।
খ. অন্যান্য সামাজিক আঞ্চলিক স্থিতিশীল উপাদানের ঘাটতি, স্বার্থপর, একদেশদর্শী ও উপদলীয় দৃষ্টিভঙ্গির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উদ্বেগ এবং বর্তমান সম্পর্কে নৈরাশ্যভাবে বিদ্যমান ইতিবাচক কাজের ব্যাপারে উদ্যোগের অভাব এবং বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে প্রতিক্রিয়াশীল দৃষ্টিভঙ্গির প্রাধাণ্য-এর ফলে উদ্যোগী মনোভাব পড়ে থাকে এবং বিরোধের স্বপক্ষে বিতর্ক সৃষ্টির চেতনার জন্য নেয়।
গ. উম্মাহর সামাজিক সমস্যাবলীর যথার্থ প্রকৃতি সম্বন্ধে সচেতনতার এবং ইতিহাসের সাথে তার সম্পর্কের অভাব। সামগ্রিক ও বিশ্লেষণধর্মী দৃষ্টিভঙ্গির ওপরে ভাসাভাসা, সংকীর্ণ ও আবেগপ্রবণ মতামতের প্রাধাণ্য এবং এ সময় মুসলিম মানসের যাচাই বাচাই ছাড়া বা ভুলে দরুণ যে কোন জিনিস গ্রহণে আগ্রহ। এ ছাড়া আরো নেতীবাচক ঘটনাবলী রয়েছে যা সংখ্যায় এত অধিক যে তার বিস্তারিত তালিকা প্রনণয়ন দুস্কর।সুতরাং উম্মাহর সমস্যার প্রকৃত জবাব দানের জন্য প্রয়োজনীয় সুস্থ জীবন মন এবং দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতা অর্জন এবং উম্মাহর সমস্যাবলী সমাধানে সহায়তার লক্ষ্যে সুন্নাহকে আমরা কিভাবে প্রয়োগ করতে পারি? ইসলামী লক্ষের পানে মুসলমানের কাজ করতে ও সংগঠিত হতে এবং সামাজিক চেতনাকে উদ্বুদ্ধ করতে এটাকে কিভাবে কাজে লাগানো যায়? এর ফলে উম্মাহর মধ্যে প্রাণস্পন্দন ও সজীবতা ফিরে আসবে। তদুপরি উম্মাহকে সাংস্কৃতিক বিকল্প ও বাস্তব সামাজিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মসূচী খুঁজে পেতে উদ্বুদ্ধ করবে। এর ফলে তার পরিচয় পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং গভীরভাবে প্রথিত ও মহান সভ্যতা ও ইতিহাসের অঙ্গীভুত হওয়ার চেতনা জোরদার করবে।
সুন্নাহর অতি আক্ষরিক ব্যাখ্যায় বিপদ
মহানবীর সময়ে জনসাধারণ তাদের দৈনন্দিন জীবনের সকল ক্ষেত্রে সুন্নাহ বাস্তবায়ন করেছে এবং এর মাধ্যমে তারা পবিত্র কোরআন অনুধাবন করেছে সম্পূর্ণরূপে। কোরআনের এই মুজিজার প্রভাব দৃশ্যঃত প্রতিভাত হয়েছে উম্মাতুন ওয়াসাতান, (মধ্যমপন্থী জাতি) গঠনে- এটা অন্যদের জন্য সাক্ষী ও পথ প্রদর্শক যাতে রয়েছে কল্যাণের সমাহার এবং যা কোন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সক্ষম। কালক্রমে জনগণের সুন্নাহর অনুধাবন যোগ্যতা হ্রাস।
পেলো, অপরদিকে অভিধান ভিত্তিক (Dictionary based) সংস্কৃতি অন্যান্য ব্যাখ্যা ও টিকা-টিপ্পনীর উপরে প্রাধান্য পেল এবং এটাই একমাত্র মাধ্যম হয়ে পড়লো। ফলে আক্ষরিক দৃষ্টিভঙ্গির সৃষ্টি হলো যা অভিধান সমন্বিত ব্যাখ্যার উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল ছিল। বিষয়টি এতই বেড়ে গেল যে, এ ধরনের অভিধান ভিত্তিক প্রবণতা স্থান কালেন বিষয়টিকে বিবেচনায় আনেনি। পরিণামে বিভ্রান্তি, কুটতর্ক ও বিরোধ সৃষ্টির মাধ্যমে উম্মাহর রেঁনেসাকে বাধাগ্রস্থ করার প্রবণতা জোরদার করেছে।তারা ইসলামকে পুরোনো ভাবমূর্তির সমষ্টি (Collection) হিসেবে গণ্য করতে নিদিত্ত স্বরূপ কাজ করেছে, তারা অনেক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে অনভিপ্রেত ভিত্তির উপর এবং তারা মনে করেছে যে সত্যিকার পরিস্থিতিতে যে একটি হাদীস রচিত হয়েছে তা বারবার সংগঠিত হতে পারে যেটা বাস্তব জীবনে আসলে অসম্ভব। তাহলে আধুনিক সুন্নাহ বিশেষজ্ঞগণ কিভাবে এ বিষয়টি সামলাবেন এবং মুসলিম মানসকে তার বিপদ থেকে রক্ষা করবেন? যারা ইসলামের বাণীকে তার বিষয়বস্তু থেকে অন্তসারশূণ্য করে তুলতে এবং তার সর্বাধিক সাংস্কৃতিক ও সভ্যতার ভূমিকা পরিহার করার ক্ষেত্রে প্রায় সাফল্য অর্জন করেছিল তাদের প্রতিক্রিয়া থেকে মুসলিম মানসকে কিভাবে রক্ষা করা যাবে? সত্যি কথা এই যে, এসব লোক ইসলামকে ব্যক্তিগত ও আচরণগত বিষয়ে সীমিত করে এনেছে এবং তুচ্ছ ও ভাষা ধারণায় তার দৃষ্টিভঙ্গির সীমা টেনে দিয়েছে এবং প্রথা সর্বস্ব ধর্মে পরিণত করেছে। এ ধরণের দৃষ্টিভঙ্গি সত্যিকার ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠা ধর্মে, জনগণের ঐক্য অথবা সভ্যতা নির্মাণে অনুকূল নয়।
উম্মাহর পুনরুজ্জীবনে সুন্নাহর ভূমিকা
নিঃসন্দেহে আমাদের উম্মাহ রেনেসাঁর জন্য একটি চূড়ান্ত পরিকল্পনার অত্যন্ত প্রয়োজন বোধ করছে, যা তাকে মানবতার অগ্রণী দল হিসেবে মধ্যমপন্থী জাতির অবস্থানে পুনঃপ্রতিষ্ঠ করবে। মুসলিম সমাজ প্রয়োজনীয় পূর্ব শর্ত পূরণ করা ব্যতীত এটা অর্জিত হবে না। এর প্রথম কাজ হচ্ছে ইসলামী রেনেসাঁর জন্য একটি বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক রূপরেখা প্রণয়ন করা।
আজ উম্মাহ দুটি সংস্কৃতির ধারায় প্রতিষ্ঠিত। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সংস্কৃতি-যা ঐতিহাসিক যুগের বৈশিষ্ট্য ও পরিবেশমন্ডিত এবং আমদানি করা বিদেশী সংস্কৃতি। মুসলিম মানস এই দুই সংস্কৃতির ব্যাপারে নিস্পৃহ-তাদের পণ্য ব্যবহারেই সন্তুষ্ট এবং নিজের কোন মৌলিক অবদান রাখতে অক্ষম।
উম্মাহর ইসলামী জীবন পদ্ধতির সঙ্গে সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্য ও কর্মপন্থার সংযোগ সাধনের ফলে মুসলিম বিশ্বের কর্মপ্রচেষ্ঠা সংগঠন ব্যাপকভাবে সহায়ক হবে পরিণামে প্রয়োজনীয় সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবর্তন আনায়ন সম্ভব হবে, আর উম্মাহকে এই গুরুদায়িত্ব বহনে সহায়তা করবে।
ইসলামী চিন্তাধারায় বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণ এবং সমসাময়িক চ্যালেঞ্চ মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় সচেতনতা ও শক্তিমত্তা অর্জন করতে এবং উম্মাহর স্বর্ণযুগের সাংস্কৃতিক বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থান পুনরুদ্ধারে আমাদেরকে অবশ্যই ইসলাম, কোরআন ও সুন্নাহর অফুরন্ত উৎসের প্রতি পুনরায় নজর দিতে হবে এবং সেগুলো পুনরায় বিস্তারিত ও সতর্কতার সাথে এবং সমসাময়িক ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গিতে অধ্যয়ন করতে হবে। এধরনের দৃষ্টিভঙ্গির জন্য প্রয়োজন দুরদৃষ্টি এবং প্রভাব বিস্তারকারী উপকরণ আর বিভিন্ন দিককে বিবেচনায় আনার মত ঔদার্য। এর লক্ষ্য ব্যাখ্যা করতে হবে, মৌলনীতির সংজ্ঞা দিতে হবে এবং জরুরী প্রয়োজন মিটানো এবং উম্মাহর ভিত্তি যেসব উপাদান নিয়ে গঠিত সেগুলি পনর্গঠনের জন্য পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে হবে।
পবিত্র কোরআন আমাদের পূর্বপুরুষদের একটি চমৎকার বুদ্ধবৃত্তিক কাঠামো দিয়েছিল। এর ফলে তারা বিভিন্ন জাতির উত্থান, সভ্যতার উত্থান ও পতন সংক্রান্ত আইন অনুধাবন ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হন। যার ফলে তারা বস্তুনিষ্ঠ উপায়ে ও গভীরভাবে তথ্যাদি যাচাই করতে সক্ষম হয়েছিলো। এটা ছিল এব যৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি যা কল্পনা নয় বাস্তবতাকে সমন্বিত ও তর্কাতীকভাবে আলোচনা করে। এই দৃষ্টিভঙ্গি ইতিহাসের গতিময়তাকে সামনে রেখে সমাজের অভ্যন্তরীণ উত্তেজনা ব্যাখ্যা করতে কখন ও কিভাবে এগুলি ঘটে, ঘটনাবলীর ব্যাখ্যা কিভাবে করা যেতে পারে, এগুলি থেকে কিভাবে শিক্ষাগ্রহণ করা যায় এবং এগুলি কিভাবে ভবিষ্যতের দিক নির্দেশনা দিতে পারে এবং সম্ভাব্য ঘটনা ঘটার আগেই উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণে সক্ষম করে তোলে সেই দৃষ্টিভঙ্গি রাখা।
উপসংহার
মহানবীর (স) সুন্নাহ, তাঁর ও তাঁর সাহাবীদের জীবনধারা সেই লক্ষ্য বুদ্ধিবৃত্তিক কাঠামোর বাস্তব প্রতীকের প্রতিনিধিত্ব করে। এটা সমসাময়িক ইসলামী চিন্তাধারা বাদবাকী সৃষ্টিকূলের সাথে সঙ্গতি রেখে মানুষের জীবন সংগঠন ও নির্দেশনা দিতে সক্ষম একটি চূড়ান্ত পদ্ধতির মাধ্যমে এক সুষ্ঠু যুক্তিধর্মী মন নিয়ে কোরআন অধ্যয়ন করলেই বুদ্ধবৃত্তিক মহাসংকটের সমাধান আমাদের আওতায় আসবে।
একই ভাবে সুন্নাহ এবং মহানবী (সঃ) কর্তৃক পবিত্র কোরআনের বাণীর ও মানুষের জীবনে তার হুবহু রূপায়নের উদ্দেশ্যের সঠিক অধ্যয়ন আমাদের উম্মাহর অজ্ঞতা, ঘৃণা, বিরোধ এবং শক্তির অপচয়ের অবসান ঘটাবে। এভাবে সমকালীন মুসমানেরা আধুনিক মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক জটিলতা দেখে আমাদের স্ব-আরোপিত অসামর্থতা কাটিয়ে উঠতে পারবে এবং সঠিক ও চূড়ান্ত ইসলামী শিক্ষার অনুধাবনের মাধ্যমে মানবতাকে সত্যিকার নির্দেশনা ও কল্যাণ উপহার দিতে পারবে। এ ধরণের অনুধাবন অভিযোজিত বিধিমালা থেকে অপরিবর্তনীয় নীতির পার্থক্য করতে সহায়তা করবে এবং লক্ষ্য ও উপায় নির্দেশ করবে।