৭. আহলূর রায়
ইজতিহাদী রায়ের প্রবণতা
এতোক্ষণ যে মনীষীদের কথা আলোচনা করলাম (এবং যাদেরকে মুলত আহলুল হাদীস বলা হয়), তাদের দৃষ্টিভংগির প্রতিকূল দৃষ্টিভংগির অধিকারী আরেক দল লোক ছিলেন, যারা মাসয়ালা কল্পনা করে তার জবাব নির্ণয় করার কাজকে খারাপ মনে করতেন না এবং ফতোয়া দিতেও ইতস্তত বোধ করতেন না। ইমাম মালিক ও সুফিয়ান সওরীর যুগ থেকে আরম্ভ করে পরবর্তী কিছুকাল পর্যন্ত এদের সময়কাল পরিব্যাপ্ত। এদের বক্তব্য হলোঃ ফিকাহর উপরই দ্বীনের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত। তাই এর প্রসার ও পরিব্যাপ্তি আবশ্যক। অপরদিকে এরা রাসূলুল্লাহর (সা) হাদীস বর্ণনা করতে এবং হাদীসকে রাসূলুল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত করতে ভয় পেতেন। যেমন শা’বী বলেছেনঃ
“কোনো হাদীসকে স্বয়ং রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে সম্পৃক্ত না করে সাহাবীদের সুত্রে বর্ণনা করাই আমার নিকট অধিক প্রিয় (আর মূলত সাহাবীদের সুত্রেই তো হাদীস আমাদের নিকট পৌছেছে), কেননা তাতে কোনো প্রকার কম-বেশী হয়ে থাকলে সে কম বেশীকে নবীর সাথে সম্পৃক্ত করার গুনাহ থেকে রেহাই পাওয়া যাবে।”
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ যখন রাসূলুল্লাহর (সা) কোনো হাদীস বর্ণনা করতেন, তখন (হাদীস বত্তণনার বিরাট দায়িত্বানুভূতির ফলে) তাঁর মুখমফলে অস্বাভাবিকতা পরিলক্ষিত হতো। তিনি বলতেনঃ “রাসূলুল্লাহ (সা) এরূপ কিংবা এরি কাছাকাছি বলেছেন।”
আনসারদের দ্বারা গঠিত একটি প্রতিনিধি দলকে কুফা পাঠানোর সময় উমার (রা) তাঁদের বলেছিলেনঃ
“তোমরা কুফায় যাচ্ছো! শোনো সেখানে তোমরা এমনসব লোকদের সাক্ষাত পাবে, যারা কুরআন পড়ার সময় কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। তোমাদের দেখে তার বলবেঃ ‘মুহামাদ (সা) এর সাথীরা এসেছেন, মুহাম্মাদ (সা) এর সাথীরা আগমন করেছেন।‘ তাঁরা তোমাদের নিকট হাদীস শুনতে চাইবে, তোমরা কিন্তু রাসূলুল্লাহর (সা) পক্ষ হতে যথাসম্বব কম হাদীস বর্ণনা করবে।”
ইবনে আউন বলেছেনঃ “শা’বীর নিকট কোনো মাসয়ালা এলে তিনি (ভয়ে) তার জবাব দেয়া থেকে বিরত থাকতে চাইতেন। পক্ষান্তরে ইব্রাহীম নখয়ীর নিকট কোনো মাসয়ালা এলে তিনি তার জবাব দিতে ইতস্তত করতেন না।”৫৪
[৫৪. এ আছার গুলো দারেমীর সুত্র হতে বর্ণিত। –গ্রন্থকার]
তাখরীজের কারণ
(আহলূল হাদীস এবং আহলূর রায়ের এই দৃষ্টিভংগিগত পার্থক্যের কারণের পূর্ববর্তী লোকারা) হাদীস, ফিকাহ এবং মাসায়েলের যেসব সংকলন তৈরী হরেছিলেন, সেহুলো যেভাবে তাদের কাজে লেগেছিল এবং প্রয়োজন পূরণ করেছিল, তার কারণ ছিলো ভিন্ন। (আর এ লোকেরা তাথেকে সেই ফায়দা লাভ করতে পারেননি, যা পেরেছিলেন সেসব লোকেরা অর্থাৎ হাদীসের আলিমগণ)। এর কারণগুলো এখন আমি বিশ্লেষণ করছি।
ক. এঁদের কাছে হাদীস এবং আছারের সেই বিরাট ভান্ডার ছিলো অনুপুস্থিত, যার ভিত্তিতে তাঁরা হাদীসের আলিমহণের অনুসৃত মূলনীতির ভিত্তিতে ফিকহী মাসায়েল ইস্তিম্বাত করতে পারতেন।
খ. পূর্বতন (সকল) আলিমগণের মতামত (ও মতপার্থক্য) সমূহ গভীরভাবে চিন্তা করে দেখা এবং সেগুলো একত্র করে গবেষণা ও ব্যাখ্যা বিস্লেষণ করে সঠিক মত নির্বাচন করার ব্যাপারে তাদের বক্ষ প্রশস্ততা লাভ করেনি। পক্ষান্তরে তাঁরা এ ব্যাপারে এমন পন্থা অবলম্বন করেন, যার ফলে অপবাদ ও দুর্নামের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন। তাঁরা (অন্যদের ত্যাগ করে) কেবল নিজেদের উস্তাদ ও ইমামদেরি অনুসরণ করেন এবং ইসলামের ব্যাখ্যা বিস্লেষণের ব্যাপারে এঁদের মর্যাদাগত শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা নিজেদের অন্তরে বদ্ধমূল করে নেন। মোটকথা, নিজেদের উস্তাদ ও অগ্রবর্তীদের প্রতি তাদের অন্তর চরমভাবে ঝুকে পড়েছিল। যেমন, আল্কামা স্পষ্টভাবে বলেছেন, “আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদের চাইতে অধিকতর মজবুত রায়ের অধিকারী কোনো সাহাবী ছিলেন কি?” আর আবু হানীফা (রাহ) বলেছেনঃ “ইব্রাহীম নখয়ী সালিম ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে উমারের চাইতে বড় ফকীহ ছিলেন।”
গ. আল্লহতায়ালার পক্ষ থেকে এই লোকেরা এমন মন-মস্তিষ্ক ও বুঝ-জ্ঞান লাভ করেছিলেন এবং একটি জিনিস থেকে আরেকটি জিনিসের প্রতি মনকে এতো দ্রুত ধাবিত করার সামর্থ্য লাভ করেছিলেন যে, স্বীয় উস্তাদ ও অগ্রবর্তীদের বক্তব্য থেকে অতি সহজে তাঁরা মাসয়লা তাখরীজ করতে পারতেন। আসল কথা হলো, যাকে যে কাজের জন্যে সৃষ্টি করা হয়, তার জন্য সেকাজ সহজও করে দেয়া হয়। ওয়া কুল্লু হিযবিন বিমা লাদাইহি ফারেহুন—আর প্রতিটি দল তাদের নিকট যা কিছু আছে তাতেই মগ্ন।
মোটকথা, এসব কারণের প্রেক্ষিতে তার ‘তাখরীজ’কে কিজেদের ফিকাহর ভিত্তি হিসেভে গ্রহণ করেন।
তাখরীজ কি?
এখন প্রশ হলো তাখরীজ কি? তাদের অনুসৃত তাখরীজ ছিলো এই যে, তাদের প্রত্যেকেই এমন একটি কিতাব মুখস্থ ও আত্মস্থ করে নিতেন, যাতে তার উস্তাদ ও অগ্রবর্তীদের বক্তব্যকে পুরোপুরি সমর্থন করে হয়েছে, তাদের বক্তব্যকে সর্বোত্তমভাবে জানার ব্যাবস্থা করা হয়েছে এবং তাদের মতপার্থক্যের একটিকে আরেকটির উপর সঠিকভাবে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। এরপর তারা প্রত্যেকটি মাসয়ালার বিধান কোন কারণের প্রেক্ষিতে নির্ণয় করা হয়েছে সে সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করতেন। অতঃপর যখনই তাদের নিকট কোনো মাসয়ালা জিজ্ঞাসা করা হতো, কিংবা নিজেদেরই শয়ীয়তের কোনো বিধান জানার প্রয়োজন হতো, তখন স্বীয় উস্তাদ ও অগ্রবর্তীদের যেসব বক্তব্য তাঁরা আত্মস্থ করেছিলেন, সেগুলোর প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেন। সেখানে যদি জবাব পেয়ে যেতেন, সানন্দ চিত্তে তা গ্রহন করতেন, কিন্তু সেখানে যদি সরাসরি জবাব না পেতেন, তবে তাঁদের রায় ও বক্তব্য সমূহ যেসব বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত হতো সেগুলোর সাথে নিজের বিষয়টি মিলিয়ে দেখতেন এবং কোথাও না কোথাও তা খাপ খেয়ে যেত। কিন্তু এভাবেও যদি কোনো বিধান নির্ণয় করতে না পারতেন, তবে তাঁদের রায় ও বক্তব্যসমূহের আনুষংগিক ইংগিতের প্রতি লক্ষ্য করতেন এবং তার ভিত্তিতে মাসয়ালা ইস্তিম্বাত করতেন।
প্রকৃতপক্ষে অনেক বক্তব্যের মধ্যি এমন ইংগিত ও উপকরণ থাকে, যা থেকে কোনো মাসয়ালা বা সমস্যার স্পষ্ট সমাধান বুঝা যায়। কখনো এমন হতো যে, নিজের সম্মুখে উপস্থিত মাসয়ালাটির কোনো নজীর পূর্ববর্তীদের বক্তব্যের মধ্যে পেয়ে যেতেন, আর সে নজীরের উপর এ মাসয়ালাটির ভিত্তি স্থাপন করতেন। কখনো আবার এমন হতো যে তাঁরা পূর্ববর্তীদের নির্ণীত এমনসব বিধানের ‘ইল্লত’ তথে কারণ বা উদ্দেশ্যের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করতেন, যেসব বিধান সরাসরি প্রকাশ হয়নি, বরঞ্চ প্রকাশ হয়েছে তাখরীজ, সিবর৫৫ কিংবা প্রত্যাখ্যানের (হযফ) মাধ্যমে।
[৫৫. ‘সিবর’ তাখরীজের মতই একটি প্রচলিত শব্দ। এর অর্থ হলো, মূল জিনিসের স;মস্ত বৈশিষ্ট্য তার এমন একটি অঙ্গ বা শাখার মধ্যে যাচাই করে দেখা যার ভিত্তিতে মূল জিনিস সম্পর্কে ধারণা লাভের চেষ্টা করা হচ্ছে। অতঃপর মূল এবং শাখার মধ্যে যে বৈশিষ্ট্য যৌথভাবে বর্তমান পাওয়া যায়, তাকে গ্রহণ করে বাকীগুলোর উপর শুধু নযর আওড়িয়ে যাওয়া যাতে করে বিধানের কারণ বা উদ্দেশ্য নির্ণীত হতে পারে। —অনুবাদক]
অতঃপর সেই ইল্লতকে নিজের মাসয়ালাটির সাথে সামঞ্জস্যশীল দেখতে পেলে সেটির বিধানই এটির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতেন। (এ ধরনের বিধান নির্ণয়কে তাখরীজের তাখরীজ বলা যেতে পারে)। আবার কখনো পূর্ববর্তী মুজতাহিদের দুটি মত তাদের সামনে আসতো। এ ক্ষেত্রে কোন মতটি নিজ মাসয়ালার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করবেন, তা তাদের ফায়সালা করতে হতো। এমতানস্থায় ‘কিয়াসে ইকতিরানী’৫৬ এবং ‘কিয়াসে শর্তীর’৫৭ ভিত্ততে উভয় মতকে একত্র করলে যে রেজাল্ট বের হতো, সেটাকেই স্বীয় মাসয়ালাটির জবাব বলে ধরে নিতেন।
[৫৬. কিয়াসে ইকতিরানী মুলত যুক্তিশাস্ত্রীয় পরিভাষা। ফিকাহ শাস্ত্রেও এর প্রয়োগ হয়ে থাকে। এটা হচ্ছে সেই কিয়াস যা দুটি ঘটনার বিবরণের সমন্বয়ে গঠিত হয়, যার একটি ছোট আরেকটি বড় এবং উভয়টি থেকে একই রেজাল্ট প্রকাশিত হয়। যেমনঃ “প্রতিটি দেহই সৃষ্ট আর প্রতিটি সৃষ্টিই ধ্বংসশীল। সুতরাং প্রতিটি দেহই ধ্বংসশীল।” ফিকাহ শাস্ত্রে এরূপ উদাহরণ হচ্ছেঃ “সকল মাদকতাই মদ্য আর সকল প্রকার মদ্যই হারাম। সুতরাং সকল প্রকার মাদকতাই হারাম। —অনুবাদক]
[৫৭. কিয়াসে শর্তী কিয়াসে ইকতিরানীরই শ্রেণীভুক্ত। তবে, ইকতিরানী থেকে এর পার্থক্য এই যে, এর দুটি অংশই শর্তযুক্ত। যেমনঃ জ্ঞানী ব্যাক্তি যদি ধ্বংসশীল হন, তবে তার সৃষ্টি ও আছে। কিন্তু তিনি অবশ্যি ধ্বংসশীল। সুতরাং তার সৃষ্টিও আছে।
ফিকাহ শাস্ত্রে এর উদাহরণ হলোঃ বিয়েটি যদি বিশুদ্ধ হয়, তবে তা অটুট বন্ধন হবে। কিন্তু বিয়েটি অবশ্যি বিশুদ্ধ। সুতরাং তার বন্ধন অটুট। —অনুবাদক]
অবস্থা এমন হতো যে, উস্তাদ ও অগ্রবর্তীদের বক্তব্যের মধ্যে এমন ফরমান থাকতো যা উপমা উদাহরণ এবং শ্রেনীবিন্যাস হিসেবে স্পষ্ট ছিলো। কিন্তু সেটার সঠিক ও যথার্থ সংজ্ঞা ছিলো অস্পষ্ট। এমতাবস্থায় সেটার সংজ্ঞা জানার জন্যে তাঁরা ভাষাতত্ববিদদের প্রতি প্রত্যাবর্তন করতেন এবং সেটার সঠিক তত্ব ও তাৎপর্য অবগত হতেন। সঠিক ও যথার্থ সংজ্ঞা জেনে নিতেন। অস্পষ্ট ও কঠিন অংশগুলো স্পষ্ট করে নিতেন। কখনো উস্তাদ এবং অগ্রবর্তীদের বক্তব্য দ্ব্যার্থবোধক হতো। এমতাবস্থায় এঁরা চিন্তা গবেষণা করে একটি অর্থকে অগ্রাধিকার প্রদান করতেন। কখনো অগ্রজদের মাসায়েল এবং মাসায়েলের দলিল প্রমাণের মাঝে অন্তরাল সৃষ্টি হয়ে থাকতো। এমতাবস্থায় এঁরা চিন্তা গবেষণা করে সেই অন্তরাল দূরীভুত করে দিতেন। আবার কখনো এই তাখরীজকর্তারা তাদের অগ্রজদের কোনো কাজ বা নীরবতাকে দলিল হিসেবে গ্রহণ করতেন। তাখরীজের এ রকম আরো অনেক উদাহরণ রয়েছে।
মোটকথা, মাসায়েল ইস্তিম্বাতের এই তরীকাকেই ‘তাখরীজ’ বলে।
মাযহাবী মুজতাহিদ
উপরোক্ত তরীকায় যে মাসয়ালা ইস্তিম্বাত করা হয়, তার উল্লেখ এভাবে করা হয়ে থাকেঃ “এটি অমুকের তাখরীজ করা মাসয়ালা।” কিংবা বলা হয়ঃ “অমুক ইমামের মাযহাব অনুযায়ী বা অমুকের প্রতিষ্ঠিত মূলনীতি অনুযায়ী কিংবা অমুকের বক্তব্য অনুযায়ী মাসয়ালাটির জবাব এইরূপ।” আর এই তাখরীজকর্তাদের ‘মাযহাবী মুজতাহিদ’ বলা হয়ে থাকে। যারা বলেঃ “যে ব্যাক্তি মাবসুত৫৮ আয়ত্ত করলো, সে মুজতাহিদ।”
[৫৮. ‘মাসবুত’ হলো হানাফী মাযহাবের ইমাম সারাখাসী লিখিত বিরাট ফিকাহ গ্রন্থ। —অনুবাদক]
তাদের এই কথার অর্থ দাঁড়ায়, সে যদি হাদীস সম্পর্কে কোনো জ্ঞানই না রাখে এবং একটি হাদীসও না জানে, তনু সে মুজতাহিদ। মূলত তাঁরা এই ইজতিহাদ দ্বারা সেই ইজতিহাদকেই বুঝিয়ে থাকেন, যা উপরোল্লেখিত তাখরীজের পন্থায় করা হয়েছে।
কিছু মাযহাব প্রসারিত আর কিছু মাযহাব সংকুচিত হবার কারণ
প্রতিটি মাযহাবে এ ধরণের তাখরীজ হয়েছে এবং জোরেশোরে হয়েছে। কিন্তু যেসব মাযহাবের ইমামরা ছিলেন মশহুর, স্বাভাবিকভাবেই রায় এবং ফতোয়ার পদমর্যাদায় তাদেরকেই অধিষ্ঠিত করা হয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষের কাছে তাদের গ্রন্থাবলী সমাদৃত হয়ে পড়ে। চতুর্দিকে লোকেরা সেগুলোই পঠনপাঠনে লেগে পড়ে। এভাবেই সেসব মাযহাব সারা বিশ্ব ছড়িয়ে পড়ে। এবং পড়তে থাকে। পক্ষান্তরে যেসব মাযহাব এর ইমামদের নাম ততোটা খ্যাতি লাভ করেই, যারা বিচার ফায়সালা এবং ফতোয়া দানের পদ লাভ করেননি এবং সাধারন মানুষেরও তাদের প্রতি আকৃষ্ট গবের সুযোগ ঘটেনি, সেই মাযহাবগুলোই দিন দিন নির্জীব ও বিলীন হবার দিকে এগিয়ে গেছে।
৮. সঠিক পন্থা ও সুষম নীতি
সঠিক পন্থা হলো মধ্যমপন্থা
উপরে যে দুটি পন্থার কথা আলোচনা করে এলাম, অর্থাৎ (১) হাদীসের শব্দের হুবহু অনুসরণ এবং (২) ফকীহদের বক্তব্য থেকে মাসয়ালা তাখরীজ করা –এই উভয় পন্থারই দ্বীনি ভিত্তি রয়েছে। সকল যুগের মহাক্কি আলিমগন দু’টি পন্থাই অনুসরন করে আসছেন। তবে (পার্থক্য ছিলো কেবল উভয় পন্থার মধ্যে সাওঞ্জস্য বিধানের)। অর্থাৎ তাদের কেউ তাখরীজের তরীকার প্রতি অধিক ঝুঁকে পড়েন আবার কেউ অধিক ঝুঁকে পড়েন হাদীসের শব্দ অনুসরণ নীতির প্রতি। (উভয় নীতির মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের প্রতি তাঁরা কেউই মনোযোগ দেননি।) আসলে, এই দুটি পন্থার কোনো একটিকে পুরোপুরি পরিত্যাগ করা যেতে পারে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত উভয় পন্থার (অর্থাৎ আহলে হাদীস ও আহলে ফিকাহর) লোকেরাই এই কাজটী করেছেন। তাঁরা একটিকে পরিত্যা করে অপরটির দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। কিন্তু সঠিক পন্থা ছিলো এর চাইতে ভিন্নতর। উচিত ছিলো, উভয় তরীকাকে একত্র করে একটিকে আরেকটির সাথে তুলনা করে দেখা এবং একটিতে কোন ভুল ক্রুটি থাকলে অপরটির দ্বারা তা নিরসন করা। এ কথাটিই বলেছেন হাসান বসরী তার নিম্নোক্ত বক্তব্যেঃ
“কসম সেই আল্লাহর, যিনি ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই, তোমাদের পথ হচ্ছে গালী (সীমালংঘনকারী) এবং জাফী (অপরিহার্য সীমার নিচে অবস্থানকারী) এর মাঝখান দিয়ে।”
অতএব আহলে হাদীসের উচিত, তাদের অনুসৃত ও অবলম্বিত যাবতীয় মাসয়ালা এবং মাযহাবকে তাবেয়ী এবং পরবররীকালের মুজতাহিদ ইমামগণের রায়ের সাথে তুলনা করে দেখা এবং তাদের ইজতিহাদ থেকে ফায়দা হাসিল করা। আর আহলে ফিকাহর লোকদেরও উচিত সাধ্যানুযায়ী হাদীসের ভান্ডারে চিন্তা ও গবেষণার দৃষ্টি নিক্ষেপ করা, যাতে করে সরীহ ও সহীহ হাদীসের বিপরীত মত প্রদান থেকে বাঁচতে পারেন এবং যেসব বিষয়ে হাদীস কিংবা আছার বর্তমার রয়েছে, সেসব বিষয়ে মত প্রদান থেকে মুক্ত থাকতে পারেন।
আহলে হাদীসের বাড়াবাড়ি
হাদীসের ইমমগণ পূর্ণ ইতমীনানের সাথে যেসব বিধিমালা প্রণয়ন করেছেন, অথচ সর্বাবস্থায় সেগুলোর অকাট্যতার পক্ষে সরয়্যত প্রণেতার কোনো সুষ্পষ্ট দলিল নেই, সেগুলো প্রয়োগের ক্ষেত্রে কোনো মুহাদ্দিসের এতোটা বাড়াবাড়ি করা উচিত নয় যে, কোনো হাদীস (যা এসব বিধিমালার মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হয়নি) কিংবা সহীহ কিয়াসের সাথে সাংজ্ঞহর্ষিক হলেও সেসব বিধিমালার উপর অটল থাকবেন। যেমনঃ
(ক) কোনো হাদীস মুরসাল কিংবা মুনকাতি হবার ব্যাপারে মামুলী কোনো সন্দেহ থাকলেও সেটিকে অস্বীকার করা, যেমনটি করেছেন ইবনে হাযম। তিনি বুখারীর বর্ণিত ‘তাহরীমে মায়ারিফ’ (গানবাদ্য হারাম হওয়া) সংক্রান্ত হাদীসটি কেবল সনদে ইনকিতা থাকার সন্দেহে অগ্রাহ্য ও অস্বীকার করেছিলেন। অথচ প্রকৃতপক্ষে, হাদীসটি মুত্তাসিল এবং সহীহ। তাই ভিত্তিহীন সন্দেহকে কিছুতেই এতোটা গুরুত্ব দেয়া উচিত নয় যে, তার ভিত্তিতে কোনো হাদীসকে অগ্রহণযোগ্য ঘোষণা করা যাবে। এ ধরণের সন্দেহ কেবল তখনই মনোযোগ লাভের যোগ্য হয়, যখন সন্দেহ আরোপিত হদীসটির সাথে সাংঘর্ষিক কোনো সহীহ হাদীস বর্তমান পাওয়া যাবে।
(খ) অথবা এমনটি বলা যে, “অমুক ব্যাক্তি অমুকের বর্ণিত হাদীসের সবচাইতে বড় হাফিয।” এই মানসিকতার ভিত্তিতে তার বর্ণিত হাদীসকে অন্যদের বর্ণিত হাদীসের উপর অগ্রাধহিকার দান করা, যদিও অগ্রাধিকার লাভের পক্ষে অন্যদের মধ্যে হাজারো কারণ বর্তমান থাকে। আর একথা সর্বজন স্বীকৃত যে, রাবীগণ ‘অর্থভিত্তিক বর্ণনার’ (রেওয়ায়াত বিল মা’না) সময় সাধারণত হাদীসের অর্থ ও মূল বক্তব্যের প্রতিই লক্ষ্য রাখেন, ভাষাতত্ববিদদের মতো ভাষা ও সাহিত্যের অনুকরণের প্রতি গুরুত্ব প্রদান করেন না। এমতাবস্থায় কোনো বিশেষ ব্যাক্তির বর্ণনার প্রতিটি বর্ণকে অনুকরণ করার কি গুরুত্ব হতে পারে? মজার ব্যাপার হলো যে, তোমরা দেখবে একই হাদীস অপর কোনো বিশ্বস্ত রাবী সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের শব্দ প্রয়োগ করে বর্ণনা করেছেন। বক্তব্যের মধ্যে আগপাছ করেছেন।
সুতরাং, প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে এই যে, প্রত্যেক রাবী বাহ্যত যা বর্ণনা করেন তা নবীর (সা) বাণি বা ইরশাদ। তবে কোনো বর্ণনার বিপরীত কোনো হাদীস বা দলিল যদি সকলের নিকট গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করে তবে এই বর্ণনাকে পরিত্যাগ করে সেটাকে গ্রহণ করতে হবে।
আহলূর রায়ের বাড়াবাড়ি
একইভাবে তাখরীজকারীদেরও এমন কোনো কথা তাখরীজ করা উচিত নয়, যা তাদের পূর্ববর্তী ইমামদের বক্তব্য ও বক্তব্যের ভাব্ধারার অউসারী নয়, যেটাকে জ্ঞানী লোকেরা এবং ভাষাবিদরা পূর্ববর্তীদের বক্তব্যের অনুসারী এবং অনুকূল মনে করেন না এবং পূর্ববর্তীদের যে নজীর বা দৃষ্টান্তকে ভিত্তি করে তাখরীজ করা হয়েছে, বিশেষজ্ঞ এবং ভাষাবিদগণে তাখরীজটিকে সেই দৃষ্টান্তের সাথে সামঞ্জস্যশীল হবার ব্যাপারে একমত নন, এমনকি পূর্ববর্তীরা যদি বেঁচে থাকতেন এবং তাঁদের জিজ্ঞেস করা হতো যে, আপনাদের যে মাসয়ালাটিকে দৃষ্টান্ত হিসেবে গ্রহণ করে এই তাখরীজটি করা হয়েছে, তা কি সেটার সাথে সামঞ্জস্যশীল? তখন, হয়তো তাঁরা বলতেন যে, এক্ষেত্রে আমাদের যে উদ্দেশ্য ও কার্যকারণ ছিল তার সাথে এটা সামঞ্জস্যশীল নয়। (সুতরাং এই পন্থায় তাখরীজ করা বা রায় প্রদান করা সঠিক নয়, বরং বাড়াবাড়ি)। প্রকৃতপক্ষে তাখরীজ তো অবশ্যি মুজতাহিদের অনুকরণের ভিত্তিতে হতে হবে। মুজতাহিদের অনুকরন বা তাকলীদের ভিত্তিতে যে তাখরীজ হবে, সেটাই বৈধ তাখরীজ। মুজতাহিদের বক্তব্যকে সঠিকভাবে অনুধাবন করে তার যথার্থ অনুকরণ করতে পারলেই তাখরীজ ক্রুটিমুক্ত হতে পারে।
একই ভাবে ইজেদের কিংবা নিজেদের উস্তাদদের নির্ধারিত উসূলের অনুসরণ করতে গিয়ে (যে উসূল অকাট্য হবার কোনো প্রমাণ নেই) এমন কোনো হাদীস বা আছারকে বর্জন করা তাদের উচিত নয়, যা সকল হাদীস বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিতে বিশুদ্ধ। (নিজেদের কিয়াস এবং উসূল অনুসরণ করতে গিয়ে) এ ধরণের কাজ করেছেন তাঁরা ‘হাদীসে মুসাররা’৫৯ এবং গনীমতের মালে রাসূলুল্লাহর (সা) নিকটাত্মীয়দের৬০ অংশ রদ করে দিয়ে।
[৫৯. মুসাররা সেই দুধদানকারী পশুকে বলা হয়, যাকে বিক্রি করার উদ্দেশ্যে গেরস্থ করেক বেলা দুধ দুহন করেনি, যাতে করে ক্রেতা তার উলান বড় দেখে প্রতারিত হয়। ‘হাদীসে মুসাররা’ বলতে সেই হাদীসকে বুঝায়, যাতে নবী করীম (সা) বলেছেনঃ “যে ব্যাক্তি মুসাররা পশু ক্রয় করলো এবং তা দুহন করার পর তার প্রকৃত অবস্থা অবগত হলো, তার জন্যে পশুটি রাখার বা ফেরত দেবার ইখতিয়ার রয়েছে। সে যদি পশুটি ফেরত দেবার সিদ্ধান্ত নেয়, তবে দুহনকৃত দুধের বিনিওয়ে মালিককে এক সা’ পরিমাণ খুরমা প্রদান করতে হবে।”
হানাফী ফকীহরা এই কারণের হাদীসটি গ্রহন করতে অস্বীকার করেছেন যেঃ হাদীসটির বক্তব্য কিয়াসের বিপরীত। তাই এটি সাধারণ বিধান হতে পারে না। কিয়াস বলে দুধের বিনিময় সমপরিমাণ হওয়া উচিত। অথচ হাদীসটিতে বলা হয়েছে, দুধের পরিমাণ এক সের কিংবা দশ সের যাই হোক না কেন, তার বিনিময়ে এক সা’ খুরমা প্রদান করতে হবে। —অনুবাদক]
[৬০. রাসূলুল্লাহর (সা) নিকতাত্মীয় মানে বনী হাশেম এবং বনী মুত্তালিব। খাইবার বিজয়ের পর রাসূলুল্লাহর (সা) তাদেরকে গনীমতের মাল প্রদান করেছিলেন। খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগে এর উপর আমল না হওয়ায় কিছু কিছু ফকীহ তাদের অংশ অস্বীকার করেন। —অনুবাদক]
মনে রাখা দরকার, নিজেদের তৈরী তাখরীজের উসূলের তুলনায় রাসূলুল্লাহর (সা) হাদীসকে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ মনে করা উচিত। এ সত্যটির প্রতি ইংগিত করেছেন শাফেয়ী (রহ)। তিনি বলেছেনঃ
“যে রায়ই আমি দিয়েছি, কিংবা নির্ধারণ করেছি কোন উসূল, (হাদীসে রাসূলের (সা) মুকাবিলায় তার কোনো গুরুত্ব নেই।) আমার রায় কিংবা উসূলের বিপরীত যদি রাসূলুল্লাহর (সা) পক্ষ হতে কোনো বাণী পাওয়া যায়, তবে তার বাণীকেই গ্রহণ করতে হবে।”
(আহলে হাদীস এবং আহলে রায়ের বাড়াবাড়ি সম্পর্কে) এ যাবত আমরা যা কিছু বললাম, প্রায় অনুরূপ কথাই বলেছেন আবুল সুলাইমান খাত্তাবী তাঁর ‘মুয়ালিমুস সুনান’ গ্রন্থের শুরুর দিকে। তিনি বলেছেনঃ
“আমি দেখতে পাচ্ছি আমাদের যুগের আলিমরা দু’টি দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। একটি দল হলো হাদীস ও আছারের অনুসারী আর অপর দলটি হলো ফিকাহ ও রায়পন্থী। তাঁদের বাস্তব অবস্থা হচ্ছে এই যে, (দু’টি বিপরীত ক্যাম্পে অবস্থান করা সত্বেও) তাঁরা নিঃসন্দেহে পরস্পরের নিকট সমভাবে মুখাপেক্ষী। নিজ নিজ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যেতাদের একদলের পক্ষে আরেক দলকে বাদ দিয়ে চলা সম্ভব নয়। হাদীস এবং ফিকাহ একটি আরেকটির সাথে এমন ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত, যেমন ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত একটি অট্টালিকা এবং তার ভিত। এ ক্ষেত্রে হাদীস হচ্ছে ‘ভিত’ আর ফিকাহ হচ্ছে তার উপর নির্মিত ‘অট্টালিকা’। আর একথা তো সকলেরই জানা যে, কোনো অট্টালিকাকে যদি ভিত ছাড়াই নির্মাণ করা হয়, তবে তার পক্ষে যেমন প্রতিষ্ঠিত থাকা সম্ভব নয়, তেমনি যে ভিতের উপর কোনো ইমারত নির্মাণ করা হয়না তাও মানুষের কোনো কল্যাণে আসে না। উভয় দলের প্রত্যেকেই যদিও মর্যাদার দিক থেকে একে অপরের অপরিহার্য সাথী ও পরিপূরক, পরস্পরের মুখাপেক্ষী এবং কারো পক্কে কাউকেও বাদ দিয়ে চলা সম্ভব নয়, কিন্তু তা সত্বও আমি তাদের দেখতে পাচ্ছি পরস্পরের প্রতি বিমুখ। অথচ হকের পথে পরস্পরকে ছাড়িয়ে যাবার পরিবর্তে পরস্পরের সাহায্য-সহযোগিতা করাই ছিলো তাদের অপরিহার্য কর্তব্য। এদের মধ্যে যে দলটির নাম ‘আহলে হাদীস’ তাদের অধিকাংশই রেওয়ায়াত বর্ণনা করা, সনদ সংগ্রহ করা এবং আমনসব গরীব ও শায হাদীস অন্বেষণ করার কাজে তৎপর, যেগুলোর অধিকাংশই হয় মওদ’ না হয় মাকলুব৬১।
[৬১. ‘মাকলুব’ হচ্ছে সেই হাদীস যা রাবীর ভ্রান্তির কারণে যার শব্দ বা বাক্য আগপাছ হয়ে গেছে। —অনুবাদক]
তাঁরা হাদীসের মতনের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করে না, অর্থ ও তাৎপর্য বুঝার চেষ্টা করে না, বক্তব্যের উদ্দেশ্য উপলব্ধি করতে যত্নবান হয়না এবং বক্তব্যের গভীরে দৃষ্টিদান করে অন্তর্নিহিত ভাব বের করার চেষ্টা করে না। তারা প্রতিনিয়ত ফকীহদের ক্রুটি খুঁজে বেড়ায়, তাদের দুর্নাম রটায় এবং তাঁদের বিরুদ্ধে সুন্নাতে রাসূলের বিরোধিতার অভিযোগ উত্থাপিত করতে থাকে। অথচ তারা এ জিনিসটা বুঝে না যে, ফকীহদেরকে শরীয়তের যে বুঝ ও জ্ঞান দান করা হয়েছে, তারা সে পর্যায়ে পৌছুতে অক্ষম। তারা একথাও বুঝতে পারছে না যে, খামোখা তাদের বিরুদ্ধে মন্দবাক্য উচ্চারণ করে তাঁরা গুনাহগার হচ্ছে। বাকী থাকলো দ্বিতীয় দলটির কথা, যারা ফিকাহ ও রায়পন্থী। তাদের মদ্ধ্যে খুব কম লোকই হাদীসের সাথে ব্যাপক ও গভীর সম্পর্ক রাখে, সহীহ-জয়ীফ হাদীসের তারতম্য করতে পারে এবং কৃত্রিম হাদীস থেকে খাঁটি হাদীস পৃথক করার যোগ্যতা রাখে। হাদীসের ব্যাপারে তার এতই বেপরোয়া যে, তাদের অবলম্বিত মাযহাব এবং পছন্দনীয় রায়ের অনুকূলে কোনো হাদীস পাওয়া গেলে, সেটাকে ও তাঁরা তাদের বিপক্ষের বিরুদ্ধে প্রমাণ স্বরূপ পেশ করতে কোনো প্রকার পরোয়া করেনা। তাদের ইমাম ও উস্তাদদের নিকট কোনো ‘খবরে জয়ীফ’ এবং ‘হাদীসে মুনকাতি’ ও যদি মশহুর এবং গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করে থাকে, তবে, তার ভিত্তি যতোই টোটকা এবং বিশুদ্ধতা যতোই সন্দেহযুক্ত হোকনা কেন, সেটাকে গ্রহণ করার ব্যাপ্রে তাঁরা নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করে নিয়েছে, সুতরাং এটা রায়ের এক বিরাট ভ্রান্তি ও সন্দিগ্ধতা। এই লোকদের অবস্থা হচ্ছে এই যে, (আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে এবং বিশেষভাবে তাদেরকে তোয়ফিক দান করুন), তাদের নিকট যদি তাদের মাযহাবের প্রথম সারির কোনো ব্যাক্তি কিংবা তাদের স্কুলের কোনো দায়িত্বশীল চিন্তাবিদের ইজতিহাদকৃত কোনো কথা বর্ণনা করা হয়, তবে সেটা গ্রহণ করার জন্যে কথাটি কার বা কাদের মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে, প্রথমে তাঁরা সেটা দেখে নেয় এবং কেবল সেকাহ ও নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীর মাধ্যমে প্রাপ্ত কথাটাই গ্রহণ করে। এই অনুযায়ী আমরা মালেকীদের দেখতে পাই, তারা তাদের মাযহাবের ইমাম ও দায়িত্বশীলদের বক্তব্য গ্রহণ করার ক্ষেত্রে কেবলমাত্র ইবনে কাসেম, আশহুব এবং এদের সমপর্যায়ের লোকদের বর্ণনা উপরই নির্ভর করে। কিন্তু এদের তুলনায় কিছুটা কম মর্যাদার আলেমদের মাধ্যমে যদি মাযহাবের ইমাম ও দায়িত্বশীলদের এমন কোনো বক্তব্য শুনতে পায় যা এদের বর্ণনার বিপরীত, তবে তাঁরা তা গ্রহণ করে না। যেমন আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল হাকাম এবং তার সমপর্যায়ের লোকদের বর্ণনা। তুমি হানাফীদের দেখতে পাবে, তাঁরা আবু ইউসূফ, মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান এবং আবু হানীফার ছাত্রদের মধ্যে এদের সমপর্যায়ের শ্রেষ্ঠ ছাত্রদের মাধ্যম ছাড়া অন্যদের মাধ্যমে তাঁরা আবু হানীফার বক্তব্য গ্রহণ করে না। তারা হাসান ইবনে যিয়াদ লুলুবী এবং তার সমপর্যায়ের বা তার চাইতে নিচের দরজার এলেমদের মাধ্যমে উপরোক্তদের বর্ণিত বক্তব্যের বিপরীত আবু হানীফার কোনো কোনো বক্তব্য পেলে সেটাকে বিন্দু মাত্র গুরুত্ব দেয়না। সেটাকে নির্ভরযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য মনে করে না। একইভাবে তুমি শাফেয়ীর মুকাল্লেদদের দেখতে পাবে, তাঁরা শাফেয়ীর বক্তব্য গ্রহণের ক্ষেত্রে কেবল মুযান্নী এবং রবী ইবনে সুলাইমান মুরাদীর বর্ণনাকেই গুরুত্ব দেয়। কিন্তু হারমালা, জীযী ও এদের সমপর্যায়ের লোকদের মাধ্যমে যদি উপরোক্তদের বর্ণনা বিপরীত শাফেয়ীর কোনো বর্ণনা তাঁরা শুওতে পায়, সেটাকে তাঁরা গ্রহণযোগ্যই মনে করেনা। মোটকথা, প্রত্যেক ফেরকার আলেমরাই তাদের ইমাম ও উস্তাদদের থেকে তাদের মাযহাবের আহকাম গ্রহণের ক্ষেত্রে এই নিয়ম অবলম্বন করে আসছে। খুঁটিনাটি বিষয়ে (ফরূয়াত) এই হচ্ছে তাদের সতর্কতার দৃষ্টান্ত। যেখানে নিজেদের ইমাম ও অগ্রবর্তীদের থেকে এসব খুঁটিনাটি বষয় গ্রহণের ক্ষেত্রে তাঁরা এতোটা সেকাহ, বিশুদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য মাধ্যম বা সুত্র অন্বেষণ করে, সেক্ষেত্রে কি করে তাদের পক্ষে সুত্রের বাছবিচার ছাড়াই অনায়াসে যেকোনো ব্যাক্তির থেকেই সেই মহান ইমামেরবাণী গ্রহণ করা বৈধ হতে পারে, যিনি সকল ইমামের ইমাম, রাব্বুল ইযযতের রাসূল, যাঁর ফরমান সর্বাবস্থায় আমাদের জন্যে ফরয, যাঁর আনুগত্য অপরিহার্য, যাঁর হুকুমের সম্মুখে মাথানত করে দেয়া মাদের জন্যে অবশ্যকর্তব্য, যাঁর ফায়সালা রহণ করার ক্ষেত্রে আমাদের অন্তরে বিন্দুমাত্র অনীহা, সংকীর্ণতা ও হঠকারিতার উদ্রেক হওয়া আমাদের জন্যে বয়ে আনবে চরম ধ্বংসাত্মক পরিণতি?… আসলে কিছু লোক সূক্ষাতিসুক্ষভাবে যাচাই বাচাই করে খাঁটি ও প্রকৃত জ্ঞান হাসিল করাকে সুষ্কর মনে করে নিয়েছে। তাঁরা মনে করছে, এ পন্থায় জ্ঞান্রাজ্যে অগ্রসর হওয়া এক সুদীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন। অথচ তাঁরা অতি সহজে ও অল্প সময়ের মধ্যেই মনযিলে মাকসাদে পৌছে যেতে চায়। এজন্যে তাঁরা জ্ঞান লাভের পথিকে সংক্ষিপ্ত করে নিয়েছে। সীমিত কিছু কথা এবং উসূলে ফিকাহর বিধিবদ্ধ নিয়ম থেকে মুক্ত হয়ে বিশেষ বিশেষ কিছু জিনিসকেই তাঁরা নিজেদের জন্যে যথেষ্ঠ মনে করে নিয়েছে। আর তাঁরা এটার নাম রেখেছে ‘ইলাল’ যাতে করে তাদেরকেও জ্ঞানের পঞ্চয়ারোহীদের মধ্যে গণ্য করা হয়। এসব তত্বকে তাঁরা তাদের মর্যাদাগত শ্রেষ্ঠত্বের প্রতীকরূপে গ্রহণ করেছে। আর এসব তত্বকে তাঁরা বিরীধী পক্ষের সাথে বিতর্কযুদ্ধে ঢাল হিসেবে ব্যাবহার করে। এরি অন্তরালে তাঁরা চুলচেরা খুঁজে খুঁজে বের করে জগড়া ও বিতর্কের উপকরণ সংগ্রহ করে এবং তাই দিয়ে বিপক্ষের সাথে বাহাছ ও মুনাযেরায় লিপ্ত হয়ে তুফান সৃষ্টি করে। অতঃপর মুনাযেরার ময়দান থেকে ফিরে এসে বাকযুদ্ধে বিজয়ী ব্যাক্তির মাথায় তাঁরা শেষ্ঠ বুদ্ধিমানের শিরোপা পরিয়ে দেয়। আর তাকেই তারা যুগের সেরা ফকীহ এবং সর্বশেরেষ্ঠ ইমামের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করে নেয়। এতো গেলো তাদের অবস্থার একদিক। কিন্তু এর চাইতেও লজ্জাকর দিক হলো, শয়তান অতি সংগোপনে একটি সুক্ষ কৌশল তাদের অন্তরে অদ্রেক করে দিয়েছে এবং তাদেরকে এক সুগভীর ফাঁদে ফেঁসে দিয়েছে। এর্থ সে তাদেরকে এই পাঠদান করেছে, তোমাদের কাছে জ্ঞানের যে পুঁজি আছে তা খুবই নগণ্য। তা দিয়ে তোমাদের প্রয়োজন পূরণ হতে পারেনা এবং তা তোমাদের জন্যে যথেষ্টও হতে পারেনা। সুতরাং ‘ইলমে কালাম’ শিখে সেটাকে মজবুত করে নাও। ইলমে কালামের কিছু কিছু বিতর্ক পদ্ধতি শিখে নিয়ে তাতে পট্টি লাগাও। এইসাথে মুতাকাল্লিমদের (দার্হনিক বা দর্শনবেত্তাদের) কিছু নীতিমালা শিখে নাও, এতে তোমাদের চুলচেরা বিশ্লেষণ করার যোগ্যতা বাড়বে এবং দৃষ্টি প্রশস্ত হবে। এভাবে ইবলিস তাদের উপর তার চিন্তাকে সত্যে পরীণত হতে দেখলো। তাদের বিরাট সনহখ্যক লোক শয়তানের আনুগ্রত্য ও অনুবর্তনের পথ ধরলো। কেবল অল্পসংখ্যক লোকই এ থেকে আত্মরক্ষা করতে পেরেছে। আফসোস, এই লোকদের বিদ্যাবুদ্ধির প্রতি! তারা কোথায় ছুটে চলেছে? শয়তান তাদেরকে তাদের লক্ষ্যপথ ও হিদায়াত থেকে কোনদিকে হটিয়ে নিয়ে যাচ্ছ? কেবল মহান আল্লাহই সেই সত্তা, যার কাছে সাহায্য চাওয়া যেতে পারে।”৬২
[৬২. ইমাম আবু সুলাইমা খাত্তাবীঃ মুয়ালিমস সুনান]