১০. ইজতিহাদ
ইজতিহাদে মতলক
(এবার ইজতিহাদ প্রসঙ্গে আলোচনা করা যাক। ইজতিহাদ মূলত দুই প্রকার। একঃ ইজতিহাদে মতলক দুইঃ ইজতিহাদে মুকাইয়্যাদ।) মুজতাহিদ মতলক হচ্ছে তিনি, যিনি পাঁচ প্রকার জ্ঞানে দক্ষতা রাখেন। ইমাম নববী তাঁর ‘আল মিনহাজ’ গ্রন্থে এর বিবরণ লপবদ্ধ করেছেন। তিনি লিখেছেনঃ
“কাযী হবার শর্তাবলী হলোঃ ব্যাক্তিকে মুসলিম হতে হবে। বালেগ ও বিবেকসম্পন্ন হতে হবে। স্বাধীন হতে হবে। পুরুষ হতে হবে। ন্যায়পরায়ণ হতে হবে। শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি এবং বাকশক্তি সম্পন্ন হতে হবে। আর মুজ্জতাহিদ ঐ ব্যাক্তিই হতে পারেনঃ
১. যিনি কিতাব ও সুয়াহর বিধান সংক্রান্ত অংশগুলোর উপর গভীর পান্ডিত্যের অধিকারী। তাছাড়া ঐসব বিধানের খাস, আম, মুজমাল, মুবাইয়্যান, নাসিখ ও মানসূখ সম্পর্কে গভীর জ্ঞান রাখেন।
২. যিনি বর্ণনা গত দিক থেকে হাদীসসমূহের মুতাওয়াতির, খবরে ওয়াহিদ, মুত্তাসিল ও মুরসাল হবার অবস্থা এবং শক্তিশালী ও দুর্বল রাবী সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন।
৩. যিনি ভাষাতত্ব ও ব্যাকরণ উভয় দিক থেকেই আরবী ভাষায় পান্ডিত্য রাখেন।
৪. যিনি সাহাবী ও তাবেয়ী আলিমগণের ব্যাপারে এ খবর রাখেন যে, তাঁরা কোন কোন মাসয়ালার ক্ষেত্রে একমত পোষণ করতেন আর কোন কোন মাসয়ালার ক্ষেত্রে তাঁদের মতপার্থক্য ছিলো।
৫. যিনি কিয়াসের তাৎপর্য ও তার সকল প্রকারভেদ সম্পর্কে সম্যক অবগত।”
মুজতাহিদ মতলকের প্রকারভেদ
ইজতিহাদে মতলক সম্পর্কে জানার পর যে জিনিসটি জানা দরকার তা হলো, ‘মুজতাহিদ মতলক’ দু’রকম হয়ে থাকেন। এক, ‘মুজতাহিদ মতলক মুসতাকিল।’ দুই ‘মুজতাহিদ মতলক মুনতাসিব’।
মুজতাহিদ মতলক মুসতাকিল এবং তার বৈশিষ্ট্য
এমন এক ইসলামী বিশেষজ্ঞকে ‘মুজতাহিদ মতলক মুসতাকিল’ (স্বাধীন স্বয়ংসম্পুর্ণ মুজতাহিদ) বলা হয়, যাঁর মধ্যে তিনটি বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান এবং সেগুলো এতোটা বিশেষভাবে বিদ্যমান যে, সেগুলো তাঁকে অন্য সকল ইজতিহাদের অধিকারী লোকদের থেকে পৃথক বৈশিষ্ট্য ও শ্রেষ্ঠত্ব দান করে। যেমন, তোমরা শাফেয়ীকে দেখতে পাচ্ছো, যাঁর মধ্যে এ বৈশিষ্ট্যগুলো স্পষ্টভাবে বিদ্যমান। সেই বৈশিষ্ট্য তিনটি হলোঃ
এক. তিনি নিজেই ফিকহী মাসায়েল ইস্তিম্বাত করার উসূল ও নিয়মকানূন নির্ধারণ করবেন।৬৭ যেমন
[৬৭. অর্থাৎ উসূলে ফিকাহ প্রণয়ন করবেন। –অনুবাদক]
শাফেয়ী ‘আল উম্ম’ গ্রন্থের প্রথম দিকে বিষয়টি পরিষ্কারভাবে আলোচিত হয়েছে। সেখানে তিনি তাঁর পূর্ববর্তী আলিম ও মুজতাহিদ্গণের ইজতিহাদের পদ্ধতি আলোচনা করে তাঁদের কিছু কিছু উসূলের সমালোচনা ও বিরোধিতা করেছেন। ইমাম শাফেয়ীর সেই বক্তব্যটির মধ্যেও আমার এ কথার সমর্থন রয়েছে, যে বক্তব্যটি আমার উস্তাদ শাইখ আবু তাহের মুহাম্মাদ ইবনে ইব্রাহীম মাদানী তাঁর নিম্নোক্ত মাক্কী শাইখগণের সুত্রে আমার নিকট বর্ণনা করেছেন। সুত্রটি হলোঃ শাইখ হাসান ইবনে আলো আজমী>শাইখ আহমদ নখলী> শাইখ মুহাম্মাদ ইবনে আ’লা বাহেলী>ইব্রাহীম ইবনে ইব্রাহীম লাক্কানী>আবদুর রউফ তাবলাবী জালাল>আবু ফদল সুয়ুতী>আবিল ফদল মারজানী>আবুল ফরজ গযযী>ইউনুস ইবনে ইব্রাহীম দবূসী>আবুল হাসান ইবনুল বকর>ফদল ইবনে সাহল ইসফ্রাইনী>হাফিযুল হুজ্জাত আবু বকর আহমাদ ইবনে আল খতীব>আবু নুয়ীম আল হাফিয আবু মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে জা’ফর ইবনে হাব্বান>আবদুল্লাহ ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে ইয়াকুব আবু হাতিম অর্থাৎ রাযী ইউনুস ইবনে আবুল আ”লা মুহাম্মাদ ইবনে ইদরীস শাফেয়ী। তিনি (শাফেয়ী) বলেনঃ
“মূল (উৎস) হচ্ছে, কুরআন ও সুন্নাহ। কিন্তু কুরআন ও সুন্নাহ যদি সরাসরিভাবে কোনো মাসয়ালা পাওয়া না যায়, তবে সেগুলোর ভিত্তিতে কিয়াস করতে হবে। কোনো হাদীসের সনদ যদি রাসূলুল্লাহ (স) পর্যন্ত পৌছে এবং তা যদি বিশুদ্ধ হয়, তবে সেটাই ‘সুন্নাহ’। খবরে মুফরাদের চাইতে ইজমা অধিকতর শক্তিশালী। হাদীসে বাহ্যিক অর্থই গ্রহ করা উচিত। কোনো হাদীস যদি একাধিক অর্থবহ হয়, সেক্ষেত্রে ঐ অর্থই গ্রহণ করা উচিত, যা হাদীসটির বাহ্যিক দিকের নিকটতর। যদি একই বিষয়ে (মতবিরোধপূর্ণ) কয়েকটি হাদীস পাওয়া যায়, সেক্ষেত্রে ঐ হাদীসটিকেই বিশুদ্ধ মনে করতে হবে, যেটির সনদ বিশুদ্ধতম। মুনকাতি হাদীসের তেমন কোনো গুরুত্ব নেই। সায়ীদ ইবনে মুসাইয়্যেব বর্ণিত (মুনকাতি) হাদীসগুলো অবশ্যি গুরুত্বপূর্ণ। শরীয়তের কোনো মূলভিত্তিকে অপর মূলভিত্তির উপর কিয়াস করা যাবে না। এটা ‘কেন হলো’ ‘কেমন করে হলো’ –শরীয়তের কোনো মূলভিত্তির ব্যাপারে এ ধরনের কোনো কথা বলা যাবে না। তবে প্রাসংগিক (ফরুয়াত) বিধানের ক্ষেত্রে এ ধরনের কথা বলা যাবে। আর কিয়াসের প্রয়োজন তো প্রাসংগিক বিষয়গুলোর ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে।
সুতরাং কোনো মূলভিত্তির নিরিখে কোনো প্রাসংগিক বিষয়ের কিয়াস যদি সঠিক হয়, তবে সে প্রাসংগিক বিধান সহীহ এবং হুজ্জাত হিসেবে স্বীকৃত হবে।”
দুইঃ তিনি সাধ্যানুযায়ী ‘হাদীস’ এবং ‘আছারের’ একটা বড় ভান্ডার সংগ্রহ করবেন। এগুলোর ভেতর থেকে যেসব বিধান পাওয়া যেতে পারে, সেগুলো জেনে নেবেন। এগুলোর মধ্যে কোন হাদীসগুলো ফিকাহর উৎস। সেগুলো পরিস্কারভাবে চিহ্নিত করবেন। ইখতিলাফপূর্ণ হাদীসগুলোর মধ্যে সমতা বিধান করবেন। এবং দলিল প্রমাণের ভিত্তিতে একটিকে আরেকটির উপর অগ্রাধিকার প্রদান করবেন। কোনো হাদীস যদি একাধিক অর্থবহ হয় সেটির একটি অর্থ নির্ণয় করবেন। (এগুলো বিরাট যোগ্যতার ব্যাপার) এমনকি আমার মতে এই বৈশিষ্ট্যটি ইমাম শাফেয়ীর দুই তৃতীয়াংশ ইলমের সমতুল্য। তবে আল্লাহই অধিক জানেন।
তিন. তিনি তাঁর ইজতিহাদী যোগ্যতা দ্বারা তাঁর সামনে আসা সমস্ত মাসয়ালার জবাব দিতে সক্ষম হবেন, যেগুলোর জবাব তাঁর পূর্বে কেউই দিয়ে যাননি।
মোটকথা, মুজতাহিদ মতলক মুসতাকিল তিনিই হতে পারেন, যিনি এই তিনটি বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে এতোটা দখতা, পারদর্শিতা ও স্বতন্ত্রের অধিকারী যে, এ ময়দানে তিনি অন্যদের ছাড়িয়ে অনেক দূরত্বে এগিয়ে গেছেন।
উপরোক্ত তিনটি বৈশিষ্ট্য ছাড়াও চতুর্থ একটি বিষয় আছে, তা হলো, উর্ধ্বজগত থেকে তার পক্ষে সাধারণের নিকট গ্রহনযোগ্যতা নাজিল হতে হবে আর তা হবে রভাবে যে, মুফাসসিরীন, মুহাদ্দিসীন, উসূল বিশেষজ্ঞগণ এবং ফিকাহ গ্রন্থাবলীর হাফিযগণ দলে দলে তাঁর ইলমের প্রতি আকৃষ্ট ও প্রভাবিত হয়ে পড়বে। আর এই সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা পরবর্তীতে যুগের পর যুগ চলে থাকবে। এমনকি মানুষের অন্থরের গহীনে এই গ্রহণযোগ্যতা শিকড় গেড়ে নিবে।৬৮
[৬৮. এই চতুর্থ বিষয়টি একজন মুজতাহিদ মতলক মসতাকিলের জন্যে প্রয়োজন বটে, কিন্তু শর্ত নয়। প্রথম তিনটি এ যোগ্যতার অপরিহার্য শর্ত। এ জন্যেই গ্রন্থকার চতুর্থটিকে পয়লা তিনটি থেকে পৃথক করে আলোচনা করেছেন। –অনুবাদক]
মুজতাহিদ মতলক মুনতাসিব
‘মুজতাহিদ মতলক মুনতাসিব’ (স্বাধীন সম্পর্কযুক্ত মুজতাহিদ) বলা হয় তাকে যিনি উপরোক্ত তিনটি শর্তের মধ্যে প্রথমটির ক্ষেত্রে উপরোল্লেখিত ধরনের কোনো মুজতাহিদকে অনুসরন করেন। কিন্তু দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বৈশিষ্ট্যের অধিকারী তিনি নিজেই। এ দুটির ক্ষেত্রে ইমামের তাকলীদের পরিবর্তে নিজেই তাঁর মতো স্বতন্ত্র অবদান রাখেন।
মুজতাহিদ ফিল মাযহাব
মুজতাহিদ ফীল মাযহাব বা মাযহাবী মুজতাহিদ হলেন তিনি, যিনি উল্লিখিত তিনটি শর্তের দুইটির ক্ষেত্রে ইমাম মুজতাহিদকে তাকলীদ করেন। তবে তৃতীয়টির ক্ষেত্রে কিছুটা স্বতন্ত্র অবদান রাখেন। অর্থাৎ ইমাম মুজতাহিদের পন্থা অনুসরণ করে মাসয়ালা ইস্তিম্বাত করেন। বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য একটি উদাহরণ দিচ্ছিঃ
এখন আমাদের যুগে যারা চিকিৎসকের কাজ করেন, তারা হয় প্রাচীন ইউনানী চিকিৎসকদের প্রদর্শিত পন্থানুযায়ী চিকিৎসা করেন, না হয় প্রাচীন ভারতীয় চিকিৎসকদের অনুসরণে চিকিৎসাকার্য পরচালনা করেন। এক্ষেত্রে এই প্রাচীন ইউনানী (গ্রীক) বা প্রাচীন ভারতীয় চিকিৎসকগণ (যাদের প্রদর্শিত পন্থায় বর্তমান কালের চিকিৎসকগণ চিকিৎসাকার্য পরিচালনা করেন) মুজতাহিদ মতলক মুসতাকিলের মতো মর্যাদায় অধিষ্ঠিত।
এখন আমাদের কালের এই চিকিৎসকদের দুইটি অবস্থা হতে পারে। একটা অবস্থা এই হতে পারে যে, তারা ঔষধের বিশেষত্ব, গুণপ্রকৃতি এবং রোগের উৎস ও শ্রেণী বিভাগ সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিফহাল। এ প্রসংগে প্রাচীন চিকিৎসকগণ যে পথ ও পদ্ধতি প্রদর্শন করে গেছেন, তা অনুসরণ করে তারা এই শাস্ত্রবিদ্যায় স্বয়ংসম্পূর্ণ ও প্রত্যক্ষ জ্ঞানের অধিকারী হয়েছেন। প্রাচীন চিকিৎসকদের মতো নিজেরাও এতোই বুৎপত্তি অর্জন করেছেন যে, তারা তাদের অনুসরণ ছাড়াই রোগের এমনসব প্রকৃতি বৈশিষ্ট্য, কারণ ও শেণীবিন্যাস নির্ণয় করেন যা প্রাচীন চিকিৎসকেরা আলোচনাই করে যাননি। তাছাড়া এ পর্যায়ে প্রাচীনদের অনুসরণ ছাড়াই তারা রোগের প্রকৃতি অনুযায়ী ঔষধ তৈরী ও চিকিৎসার ফর্মূলা স্থির করতে সক্ষম। এ ক্ষেত্রে তারা প্রাচীন চিকিৎসকদের সাথে মতপার্থক্য করেন। তাদের ফর্মূলাকে ভুল প্রমাণ করে নিজেরা নতুন ফর্মূলাও প্রদান করেন। এ মতপার্থক্য সীমিত পরিসরে ও হতে পারে আবার ব্যাপক পরিসরেও হতে পারে, এইরূপ চিকিৎসকদের মর্যাদা হলো মুজতাহিদ মতলক মুনতাসিবের মতো।
আমাদের কালের এই চিকিৎসকদের আরেকটি অবস্থা এই হতে পারে যে, তারা চিকিৎসা সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়ে প্রাচীন চিকিৎসকদের মতামত ও ফর্মূলা মেনে চলে। তবে তাদের আসল দক্ষতা হলো, তারা প্রাচীন চিকিৎসকদের ফর্মূলা অনুযায়ী ঔষধ প্রস্তুত করেন। এইরূপ চিকিৎসকদের মর্যাদা হলো মুজতাহিদ ফীল মাযহাব বা মাযহাবী মুজতাহিদের মতো।
আরেকটি উদাহরণ দিচ্ছি। আমাদের যুগে যারা কবিয়ালী করে, তারা কবিতার মাত্রা, ছন্দ, আনুপ্রাস ও স্টাইলের ক্ষেত্রে হয় প্রাচীন আরব কবিদের অনুসরণ করে, না হয় প্রাচীন অনারব কবিদের। এক্ষেত্রে এই প্রাচীন আরব বা অনারব কবিদের মর্যাদা হলো, মুজতাহিদ মতলক মুসতাকিল এর মতো।
এখন আমাদের যুগের এই কবিদের দুইটি অবস্থা হতে পারে। এদের মধ্যে যারা কবিতার মাত্রা, ছন্দ, অনুপ্রাস, এবং স্টাইলের ক্ষেত্রে তারা এমন এমন অভিনব নিয়ম-পন্থা তৈরী করে নেয়, যা অতীতের কেউ চিন্তা ও করে নাই। যেমন দুই দুই বা চার চার পংক্তির কবিতা, কিংবা অন্তমিল বা বে-মিল পংক্তির কবিতা। এরূপ কবিদের মর্যাদা হলো, মুজতাহিদ মতলক মুনতাসিবের মতো। পক্ষান্তরে এদের মধ্যে যেসব কবি কেবল ঐ প্রাচীন কবিদের রীতিনীতিকেই অনুসরণ করে, তাদের মর্যাদা হলো মুজতাহিদ ফীল মাযহাবের মতো। ইলমে তাফসীর, ইলমে তাসাউফ এবং অন্যান্য শাস্ত্রের ক্ষেত্রেও একই ধরনের উদাহরণ প্রযোজ্য।
প্রাচীনরা উসূলে ফিকাহ সংকলন করেননি কেনো?
এ পর্যায়ে তোমরা যদি আমাকে প্রশ্ন করো, প্রাথমিক যুগের আলিমগণ উসূলে ফিকাহ সংকলন করে যাননি কেন? এমনকি তারাতো এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোকপাতও করে যাননি। অতঃপর ইমাম শাফেয়ীর প্রকাশ ঘটল। তিনি উসূলে ফিকাহ প্রণয়ন ও সংকলন করে যান যা পরম কল্যাণকর প্রমাণিত হয়। এখন প্রশ্ন হলো তার পূর্বেকার মুজতাহিদ্গণ কেনো এ বিষয়ে হাত দেননি?
এর জবাবে আমি বলবো, প্রাচীন আলিমগণের প্রত্যেকের কাছে কেবল নিজ নিজ শহরের লোকদের বর্ণিত হাদীস এবং আছারই বর্তমান ছিলো। সকল শহরের সম্মিলিত বর্ণনাসমূহ কোনো একজনের নিকট সঞ্চিত ছিল না। এ কারণে কোনো বড় ধরনের মতপার্থক্যের সম্মুখীন তাদের হতে হয়নি। নিজ শহরের বর্ণনাসমূহের মধ্যে যদি কখনো কোনো মতবিরোধপূর্ণ বর্ণনা পাওয়া যেতো, সেক্ষেত্রে তারা নিজ নিজ বিচক্ষণতা ও অন্তর্দৃষ্টির দ্বারা তার মধ্যে সমতা বিধান করতেন। অতঃপর শাফেয়ীর যুগ আসে। এসময় পর্যন্ত সকল শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হাদীস ও আছারসমূহ এবং বিভিন্ন শহরের ফকীহদের রায়ের মধ্যে ব্যাপক মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। এর মধ্যে বহু মতপার্থক্য ছিলো জটিল ধরনের। প্রত্যেক শহরের লোকেরা নিজ নিজ শাইখদের বর্ণিত হাদীস, আছার ও রায়কেই সঠিক মনে করেছিল। ফলে ইখতিলাফ আরো জটিলতর ও ব্যাপকতর হয়ে পড়ছিল। ইখতিলাফের ঝড় বয়ে যাচ্ছিল। লোকেরা এসব ইখতিলাফের ঘূর্ণিপাকে ঘুরপাক খাচ্ছিল। এর থেকে বেরুবার কোনো পথ পাচ্ছিলনা। অতঃপর তাদের প্রতি আল্লাহর সাহায্য এলো। শাফেয়ীর অন্তরে এমন কিছু উসূল ও নিয়ম বিধান ইলহাম করে দেয়া হয়, যেগুলোর সাহায্যে তিনি বিরোধপূর্ণ হাদীসসমূহের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করেন। ফলে পরবর্তী লোকদের এ পথে চলার পথ প্রশস্ত ও সুগম হয়ে যায়।
চার মাযহাবের ইজতিহাদের ইতিহাস
১. তৃতীয় হিজরী শতাব্দীর পর আবু হানীফার মাযহাবে ‘মুজতাহিদ মতলক মুনতাসিব’ আবির্ভাব হবার ধারাবাহিকতা শেষ হয়ে যায় কারণ, হানাফী আলিমরা আগে পরে সবসময়ই হাদীসশাস্ত্রের সাথে খুব কমই সম্পর্ক রাখতেন ও রাখছেন। আর হাদীসশাস্ত্রে অগাধ পান্ডিত্যের অধিকারী হওয়া ছাড়া একজন আলিম কোনো অবস্থাতেই ‘মুজতাহিদ মতলক মনতাসিব’ হতে পারে না। তবে তৃতীয় হিজরী শতাব্দীর পর এ মাযহাবে ‘মাযহাবী মুজতাহিদ’ (মুজতাহিদ ফীল মাযহাব) এর আবির্ভাব ঘটে। আর যিনি মুজতাহিদ হবার নুন্যতম শর্ত ‘মাবসূত’ গ্রন্থটি মুখস্ত থাকতে হবে বলে উল্লেখ করেছেন, তিনি মূলত মাযহাবী মুজতাহিদের কথাই বুঝাতে চেয়েছেন।
২. মালিকী মাযহাবেও মুজতাহিদ মতলক মুনতাসিব খুব কমই হয়েছেন। আর কেউ এ পর্যায়ে উন্নীত হয়ে থাকলেও তাঁর ইজতিহাদী রায়সমূহকে মালিকী মাযহাবের মত বলে গণ্য করা হয় না। যেমন কাযী আবু বকর ইবনে আরবী এবং আল্লামা ইবনে আবদুল বার নামে খ্যাত আবু উমার।
৩. আহমাদ ইবনে হাম্বলের মাযহাব প্রথম দিকেও খুব একটা সম্প্রসারিত হয়েছি না, আর এখনো তা হয়নি। কিন্তু তা সত্বেও এই মাযহাবে ‘মুজতাহিদ মতলক মুনতাসিব’ পয়দা হতে থাকে। এর ধারাবিহিকতা নবম হিজরী তে এসে শেষ হয়। এর পরে এসে অধিকাংশ স্থানেই এ মাযহাবের কর্তৃত্ব নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়ে। তবে মিসর ও বাগদাদে এখনো এ মাযহাবের কিছু অনুসারী রয়েছে, যদিও তাদের সংখ্যা খুবই নগণ্য।
আসলে আহমাদ ইবনে হাম্বলের মাযহাব সেরকম ভাবেই শাফেয়ীর মাযহাবের সাথে সমন্বিত হয়ে আছে, যেমনটি সমন্বিত হয়ে আছে আবু ইউসুফ এবং মুহাম্মাদের মাযহাব আবু হানীফার মাযহাবের সাথে। তবে শেষোক্ত দু’জনের মাযহাবের মতো আহমাদের মাযহাব শাফেয়ীর মাযহাবের সাথে একত্রে সংকলিত হয়নি। একারণেই তোমরা দেখতে পাচ্ছ, দু’জনের মাযহাবকে এক মাযহাব গণ্য করা হয় না। অন্যথায় উভয় মাযহাবকে মনোযোগের সাথে অধ্যয়নকারীর পক্ষে দু’টিকে একটি মাযহাব হিসেবে (মানা) ও সংকলন করা মোটেও কঠিন নয়।
৪. বাকী থাকলো শাফেয়ীর মাযহাব। মূলত এ মাযহাবেই সর্বাধিক ‘মুজতাহিদ মতলক মুনতাসিব’ ও মুজতাহিদ ফীল মাযহাবের আবির্ভাব ঘটে। এখানেই সর্বাধিক আবির্ভাব ঘটে উসূল ও ইলমে কালাম বিশেষজ্ঞদের। কুরআনের মুফাসসির এবং হাদীসে ব্যাখ্যাদাতাদেরও আবির্ভাব ঘটে এখানে সর্বাধিক। এ মাযহাবের রেওয়ায়েত ও সনদসমূহও অন্যান্য মাযহাবের তুলনায় সর্বাধিক মজবুত। এর ইমামের মতামতসমূহ সর্বাধিক মজবুতভাবে সংরক্ষিত। ইমামের এবং আসহাবুল উজুহ’র বক্তব্য এখানে সুস্পষ্টভাবে পৃথক রাখা হয়েছে। বিভিন্ন মত ও বক্তব্যের একটিকে আরেকটির উপর অগ্রাধিকার দেয়ার ক্ষেত্রে সর্বাধিক মনযোগ দেয়া হয়েছে।
এই কথাগুলো সেইসব লোকদের অজানা নয়, যারা উপরোক্ত মাযহাবসমূহ সম্পর্লে বিশ্লেষণমূলক অধ্যয়ন করেছেন এবং একটা দীর্ঘসময় এর পিছে লেগে থেকেছেন।
শাফেয়ীর প্রথম দিককার ছাত্ররা সবাই মুজতাহিদ মতলক (মুনতাসিব) ছিলেন। তাদের মধ্যে এমন কেউই ছিলেন না, যিনি তাঁর (শাফেয়ীর) সকল ইজতিহাদের তাকলীদ করতেন। অতঃপর ইবনে সুরাইজের যামানা এলো। তিনি তাকলীদ ও তাখরীজের নিয়ম-কানুন প্রতিষ্ঠা করেন। অতঃপর তাঁর শিষ্যরা তাঁর দেখানো পথে চলতে থাকে। এ হিসেবেই তাঁকে সেই মুজতাহিদদের অন্তর্ভুক্ত গণ্য করা হয় , প্রতি শতাব্দীর মাথায় যাদের আগমনের সংবাদ দেয়া হয়েছে। আল্লাহই সর্বাধিক জ্ঞাত।
যে ব্যাক্তি দীর্ঘ সময়কাল ধরে মাযহাবসমূহের বিশ্লেষণমূলক অধ্যায়ন করেছেন, তাঁর কাছে একথাও গোপন থাকতে পারে না যে, যেসব হাদীস ও আছারের উপর শাফেয়ীর মাযহাবের বুনিয়াদ প্রতিষ্ঠিত সেগুলো নিয়মতান্ত্রিকভাবে সংকলিত ও সম্পাদিত। এ কথাগুলো সকল আহলে ইলমেরই জানা। এবং এগুলো থেকে তারা উপকৃত ও হয়েছেন। এটা এই মাযহাবের এমন একটা মর্যাদা, যা আর কোনো মাযহাবই লাভ করতে পারেনি। এই সংকলিত ও সম্পাদিত গ্রন্থাবলির মধ্যে যেগুলোর উপর শাফেয়ী মাযহাবের ভিত প্রতিষ্ঠিত, সেগুলোর একটি হলো মুআত্তা, যা নাকি শাফেয়ীর অনেক আগেই সংকলিত হয়েছে। শাফেয়ী এই গ্রন্থটিকে তার মাযহাবের ভিত হিসেবে গ্রহণ করেন। অন্যান্য গ্রন্থগুলো হচ্ছেঃ সহীহ আল বুখারী, সহীহ আল মুসলিম, সুনানে আবু দাউদ, তিরমিযী, ইবনু মাজাহ, দারেমী, মুসনাদে শাফেয়ী, সুনানে নাসায়ী, সুনানে দারু কুতনী, সুনানে বায়হাকী এবং বগবীর শরহুস সুন্নাহ।
অধিকাংশ ফিকহী ব্যাপারে ঐক্যমত থাকার কারণের যদিও বুখারীকে শাফেয়ীর প্রতি সমন্ধযুক্ত (মুনতাসিব) করা হয়, তবুও এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, অনেক বিষয়ে তিনি আবার শাফেয়ীর সাথে মতপার্থক্যও করেছেন, সেগুলো শাফেয়ী মাযহাবের বলে গণ্য হয় না।
আবু দাউদ এবং তিরমিযী তার দুজনই মুজতাহিদ মতলক মুনতাসিব। তবে তাদের ইনতেসাব আহমাদ ইবনে হাম্বল এবং ইসহাক ইবনে রাহুইয়ার প্রতি। ইবনে মাজাহ এবং দারেমীর অবস্থাও তাদের অনুরূপ।
আর মুসলিম, মুসনাদে শাফেয়ীর সংকলক আব্বসুল আসাম এবং অন্য যাদের কথা উল্লেখ করেছি এরা সবাই এককভাবে শাফেয়ীর অনুসারী।
এ যাবত আমি যা কিছু আলোচনা করলাম, তার মর্ম যদি তুমি উপলব্ধি করে থাকো, তবে অবশ্য তোমার কাছে এ সত্য উদ্ঘাটিত হয়েছে যে, ঐ ব্যাক্তি নিঃসন্দেহে ইজতিহাদে মতলক থেক বঞ্চিত হবে, যে শাফেয়ীর মাযহাবের সাথে শত্রুতা পোষণ করবে। আর যে ব্যাক্তি শাফেয়ী এবং আসহাবে শাফেয়ীর ইলমী ফয়েজ থেকে বিমুখ তার কর্মকান্ড মূলত হাদীসের ইলম অস্বীকারেরই নামান্তর।