১১. চতুর্থ হিজরী শতাব্দীর পর ফিকহী মতপার্থক্য
ফিতনার যুগ এলো
এ যাবত যাদের কথা আলোচনা করলাম, অরপর তাদের সময়কাল অতীতের কোলে পাড়ি জমায়। তাঁদের আবির্ভাব ঘটে মুসলমানদের নতুন প্রজন্মের। এই নতুন প্রজন্ম ডানে বামে যেতে থাকে। (তাদের জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে বিপর্যয়ের বিপ্লব ঘটে। জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে যেসব ধ্বংসাত্মক রোগ তাদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে, সেগুলোর কয়েকটি নিম্নরূপঃ
১. ফিকহী বিবাদ
পহেলা বিপর্যয়টি ছিলো ফিকাহ শাস্ত্রে বিবাদ বিরোধকে কেন্দ্র করে। গাযালীর (রহ) কলামে এর বিস্তারিত রূপ অবলোকন করুনঃ
“খুলাফায়ে রাশেদীন আল-মাহদীয়ীন এর যুগ শেষ হবার পর খিলাফতের বাগডোর এমন সব লোকের হাতে এসে পড়ে, এ মহান দায়িত্ব পালনে যাদের না যোগ্যতা ছিলো আর না ফতোয়া ও আহকামে শরয়ীর ক্ষেত্রে ব্যুৎপত্তি ছিলো। তাই ফতোয়া দান, বিচার ফায়সালা প্রদান ও শরয়ী বিধান কার্যকর করার ক্ষেত্রে তারা ফকীহদের সাহায্য নিতে এবং সবসময় তাদেরকে সাথে রাখতে বাধ্য হয়। ‘আইরুল কুরূন’ এর যুগ যদিও শেষ হয়ে গেছে, তবুও তখন পৃথিবী এমনসব আলিম থেকে শুন্য ছিল না, যারা প্রাথমিক যুগের আলিমদের মতোই ছিলেন বলিষ্ঠচিত্ত ও প্রকৃত দ্বীনের বাহক। শাসকরা এঁদের কাছে টানতে চেষ্টা করে। কিন্তু তারা যতোই এঁদের কাছে টানতে চেষ্টা করতোক তাঁরা ততোই তাদের থেকে দূরে সরে যেতেন। আলিমদের এরূপ সম্মান ও মর্যাদা অবলোকন করে পদলোভী লোকেরা সরকারী পদ ও সম্মান লাভের উদ্দেশ্যে দ্বীনি ইলম হাসিল করতে থাকে। ফলশ্রুতিতে শাসকরা আলিমদের খুঁজে বেড়ানোর পরিবর্তে আলিমরাই শাসকদের পিছে ঘুরতে থাকে। এতোদিন শাসকরা তাদের মুখাপেক্ষী থাকার কারণে তাঁরা ছিলেন মর্যাদাবান। আর এখন শাসকদের নিকট পদমর্যাদা চাইতে গিয়ে তারা লাভ করলেন সম্মানের পরিবর্তে লাঞ্ছনার আর অসম্মান। তবে দু’চারজনের কথা আলাদা। এদের আগেকার একদল লোক ইলমে কালাম (তর্কশাস্ত্র) এর উপর অনেক কিছু লিখে গেছে। তারা যুক্তি তর্কের ঝড় সৃষ্টি করে গেছে। অভিযোগ এবং জবাবের বাজার গরম করে রেখে গেছে। বাহাছ ও মুনাযরার পথ প্রশস্ত করে রেখে গেছে। ফলে আলোচ্য ফকীহরা এগুলোর জালে আবদ্দ হয়ে পড়ে এবং দীর্ঘদিন আবদ্ধ ছিলো। এ সময় এমন কিছু রাজা বাদশাহরও জন্ম হয়, যারা ফিকহী বাহাছ ও মুনাযিরার প্রতি চরমভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। অমুক মাসয়ালার ক্ষেত্রে হানাফী মাযহাব শ্রেষ্ঠ কিংবা অমুক মাসয়ালার ক্ষেতের শাফেয়ী মাযহাব সেরা প্রভৃতি তথ্যের জানার জন্যে তারা উৎফুল্ল উঠে। এর ফলশ্রুতিতে লোকেরা কালাম শাস্ত্র এবং অন্যান্য বিষয়ের ইলমী গবেষণা ত্যাগ করে আবু হানীফা ও শাফেয়ীর (রহ) মাযহাবের মধ্যকার বিরোধপূর্ণ মাসয়ালাসমূহের প্রতি মনোনিবেশ করে। বিশেষভাবে এ দু’টি মাযহাবকে তর্ক-বাহাছের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করা হয়। এদিক থেকে তারা মালিক, সুফিয়ান এবং আহমদ ইবনে হাম্বল এর মাযহাবকে কিছুটা ছাড় দেয় (কারণ শাসকদের আকর্ষণ ছিলো বিশেষভাবে উক্ত দু’টি মযহাবের প্রতিই)।
তাদের ধারণা ছিলো, এভাবে তারা শরীয়তের সুক্ষাতিসুক্ষ রহস্যসমূহ উদঘাটলন করছে, প্রতিটি মাযহাবের ভাল-মন্দ দিকসমূহ নির্ণয় করছে এবং ফতোয়ার নীতিমালার পথ প্রশস্ত করছে। এ উদ্দেশ্যে তারা রচনা করে বহু গ্রন্থাবলী, উদ্ভাবন করে বহু বিষয়াদি, নিত্যনতুন আবিষ্কার করে বাহাছ ও বিবাদের অসংখ্য হাতিয়ার। বড়োই আফসোসের বিষয় তারা এইসব কার্যক্রম এখনী চালিয়ে যাচ্ছে। এসব তৎপরতা যে ভবিষ্যতে কী রূপ নেবে, তা আল্লহই ভাল জানেন।”
২. মুজতাহিদ ইমামদের মধ্যকার মতপার্থক্যের কারণ সম্পর্কে অজ্ঞতা
শুনো, আমি এদের অধিকাংশ কেই এ ধারণা পোষণ দেখেছি যে আবু হানিফা ও শাফেয়ীর মধ্যকার মতপার্থক্যের কারণ হলো সেসব উসূল, যেগুলো বয়দুবী প্রমুখের গ্রন্তে উল্লেখ হয়েছে। অথচ প্রকৃত ব্যাপার হলো, সেসব উসূলের অধিকাংশই সম্মানিত ইমামদ্বয়ের মতামতের আলোকে পরবর্তীকালে নির্ণয় করা হয়েছে। যেমন, আমার মতে নিম্নোক্ত ফিকহী উসুলগুলো ইমামদের বক্তব্যের আলোকে পরবর্তী লোকেরা নির্ণয় করেছেঃ
১. ‘খাস’ এর বিধান সুস্পষ্ট। তার সাথে কোনো ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের সংমিশ্রণ ঘটানো যাবে না।
২. কোনো বিধানের উপর পরিবর্ধন রহিত।
৩. ‘খাস’ এর মতো ‘আম’ ও অকাট্য দলিল।
৪. বর্ণনাকারীদের আধিক্য অগ্রধিকারের জন্য অনিবার্য নয়।
৫. ফকীহ নয় এমন রাবীর রেওয়ায়েত কিয়াসের বিপরীত হলে তা গ্রহণ করা আবশ্যকীয় নয়।
৬. ‘মাফহুম শর্ত’ এবং ‘মাফহুম ওয়াসফ’ এর কোন ব্যাখ্যা নেই।
এ ক’টি এবং এ রকম আরো অনেক ফিকহী উসূল হানাফী ইমামদের কর্তৃক নির্ধারিত নয়। বরঞ্চ তাদের ফতোয়ার আলোকে পরবর্তী লোকেরা এগুলো নির্ণয় করেছে। আবু হানীফা এবং তাঁর দুই সাথী (আবু ইউসুফ ও মুহাম্মাদ) কর্তৃক এগুলি নির্ধারিত হয়েছে বলে কোনো প্রমাণিত রেওয়ায়েত নেই। এখন এসব রসূলের হিফাযত করতে গিয়ে এবং এগুলোর উপর আরোপিত অভিযোগ খন্ডন করতে গিয়ে লোকেরা যা করছে তা নিতান্তই অযৌক্তিক ও হাস্যকর।
কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি স্পষ্ট করতে চাইঃ
১. এই পরবর্তী আলিমরা তো হানাফী ফিকাহর এইসব উসূল নির্ধারণ করলো যেঃ “খাস এর বিধান সুস্পষ্ট। তার সাথে কোনো ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের সংমিশ্রণ ঘটানো যাবে না।” কিন্তু উসূলটি পূর্ববর্তী আলিমগণের দৃষ্টি ভংগির বিপরীত। ‘ওয়াসজুদু ওয়ারকাউ’ (রুকু কর, সিজদা করো) –কুরআনের এই আয়াত এবং “ততোক্ষণ পর্যন্ত কোনো ব্যাক্তির নামায হয় না, যতোক্ষন না সে রুকু এবং সিজদায় পূর্ণভাবে নিজের পিঠকে স্থির করবে” –রাসূলুল্লাহ (সা) এর এই হাদীসের বিধানের ক্ষেত্রে পূর্বর্তীদের দৃষ্টিভংগি ছিলো তাদের দৃষ্টিভংগির বিপরীত। পূর্ববর্তীরা হাদীসটিকে আয়াতটির ব্যাখ্যা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। আর এরা উল্লিখিত উসূলের আলোকে হাদীসটিকে আয়াতের ব্যাখ্যা হিসেবে গ্রহণ না করে কেবল রুকু সিজদাকেই ফরয বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং রুকু সিজদায় গিয়ে পিঠ স্থির করাকে ফরয ধরেননি। পরবর্তীদের বক্তব্য হলো, তারা পূর্ববর্তীদের অনেক মাসায়েলের সাথেই তাদের এই উসূল সাংঘর্ষিকঃ
‘ওয়ামসাহু বিরুউসিকুম৬৯ (আর তোমাদের মাথাকে মসেহ করো)’ আয়াতে শুধুমাত্র মাথা মাসেহ করা হুকুম দেয়া হয়েছে (কোনো সীমা নির্ধারণ করা হয়নি)। কিন্তু পূর্ববর্তী আলিমগণ নবী করীমের (সা) কপাল মাসেহ করাকে আয়াতের ব্যাখ্যা হিসেবে গ্রহণ করেছেন এবং এর-চতুর্থাংশ মাথা মাসেহ করাকে ফরয বলে ফতোয়া দিয়েছেন।
[৬৯. সুরা মায়িদাঃ ৬]
এইভাবেঃ “ব্যভিচারী এবং ব্যভিচারিনী এদের প্রত্যেককে একশ’ কোড়া মারো”৭০ “চোর পুরুষ এবং চোর নারীর হাত কেটে দাও”৭১ এবং যতক্ষোণ না সে (নারী) অপর কোনো পুরুষের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়”৭২ প্রভৃতি আয়াতে ‘খাস’ বিদ্যমান।
[৭০. সুরা আন নূনঃ ২]
[৭১. সূরা আল মায়িদাঃ ৩৮]
[৭২. সূরা আলা বাকারাঃ ২৩০]
কিন্তু পূর্ববর্তীগণ এসব ‘খাস’ এর বিধানের ক্ষেত্রে হাদীসকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। অর্থাৎ এ আয়াতগুলোর বিধান প্রসঙ্গে যেসব হাদীস এসেছে, তারা সেসব আয়াতের ব্যাখ্যা হিসেবে গ্রহণ করেছেন।৭৩
[৭৩. এসব আয়াতে “ব্যভিচারী ও ব্যভিচারীনী” “চোর পুরুষ এবং চোর নারী” “বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়” শব্দগুলো খাস। এখানে ব্যভিচারী, চুরি, এবং হিল্লা বিবাহের বিধান দেয়া হয়েছে। এটা বিবাহিত নাকি অবিবাহিত ব্যভিচারীর শাস্তি, সে কথা বলা হয়মি। কি পরিমাণ মাল চুরি করলে চোরের এ শাস্তি হবে তা বলা হয়নি। এবং বিবাহের পর স্বামীর সাথে যৌনসংগম করতে হবে, সেকথা এখানে বলা হয়নি। এই ব্যাখ্যাগুলো হাদীসে রয়েছে। –অনুবাদক]
অতঃপর এখন যখন এর ভিত্তিতে পরবর্তীদের বানানো ফিকহী উসূলের ব্যাপারে অভিযোগ উথাপিত হয়, তখন তারা এর জবাবে অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলতে থাকে, যার বিস্তারিত বিবরণ তাদের রচিত গ্রন্থাবলীতে দেখা যেতে পারে।
২. নামাজের কিরআত সম্পর্কে কুরআনে স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে, “যতোটা কুরআন সহজে পাঠ করতে পার, পড়ো।”৭৪
[৭৪. সূরা আল মুযযাম্মিলঃ ২]
কিন্ত্য হাদীসে বলা হয়েছেঃ “লা-সালাতা ইল্লা বিফাতিহাতিল কিতাব—সূরা ফাতিহা ছাড়া নামাজ নেই।”৭৫
[৭৫. জামে তিরমিযী]
“যতোটা সহজে পড়া যায়” কথাটি ‘খাস’, কিন্তু এই হাদীসটি তার ব্যাখ্যা। হাদীসটির দাবী অনুযায়ী প্রত্যেক রাকায়াতে ‘ফাতিহা’ পড়া ফরয।
একটি হাদীসে বলা হয়েছেঃ “নদী নালা ও খাল বিলের পানিতে (সেচের পাই ছাড়াই) যে ফসল জন্মে, তার যাকাত এক দশমাংশ।”৭৬
[৭৬. বুখারী ও মুসলিম]
অথচ অপর একটি হাদীসে বলা হয়েছেঃ “পাচ ওয়াসকের কম ফসলের যাকাত নেই।”৭৭
[৭৭. মুয়াত্তা-ই-ইমাম মালিক]
এখানেও তারা পরবর্তী হাদীসটিকে পূর্ববর্তী হাদীসটির ব্যাখ্যা হিসেবে গ্রহণ করেননি। অথচ “ফাইন উহসিরতুম ফামাস্তাইসারা মিনাল হাদাইয়ে—কোথাউ যদি পরিবেষ্টিত হয়ে পড়ো, তবে যে কুরবানীই সম্ভব তা খোদার উদ্দেশ্যে পেশ করো।”৭৮
[সুরা আল বাকারাঃ ১৯৬ আয়াত]
আয়াতটির ব্যাপারে যখন বলা হয় যে, পূর্বর্তী আলিমগণ ‘যে কুরবানীই সম্ভব’ কথাটিকে অকাট্য ধরে নেননি। (কেননা তাঁরা যদি এটাকে তাঁদের নিয়মের ছাঁচে ঢালতেন, তাহলে বলতেন, এর অর্থ ছোট বড় যে পশুই সম্ভব কুরবানী করো)। কিন্তু সেটা না বলে তাঁরা হাদীসের ভিত্তিতে এর ব্যাখ্যা করে বএছেন, এই কুরবানীর জন্যে ছাগলের চাইতে বড় কোনো পশু হতে হবে। তখন এই অভিযোগের ব্যাপারে তারা (পরবর্তীরা) যতসব অযৌক্তিক ও হাস্যকর জবাব দেন এবং এরূপ জবাবের উপর একগুঁয়েমী প্রদর্শন করেন।
৩. ‘মাফহু শর্ত এবং মাফহুম ওয়াসফের কোনো ব্যাখ্যা নেই’–এই উসূলটির ক্ষেত্রেও তারা একই কান্ড ঘটিয়েছেন। অর্থাৎ তাঁদের বক্তব্য অনুযায়ী এ উসূলটিও তাঁরা প্রাচীনদের অনুসৃত নীতী থেকেই গ্রহণ করেছেন। অথচ বাস্তবে দেখা যায়, প্রাচীনরা এক্ষেত্রে ব্যাখ্যা করেছেন। যেমনঃ “আর তোমাদের মধ্যে যে ব্যাক্তি বংশীয় মুসলমান মেয়েদের বিয়ে করার সামর্থ্য রাখে না, সে যেনো মালিকানাভুক্ত মুমিন দাসীদের বিয়ে করে।”৭৯
[৭৯. সূরা আন নিসাঃ ২৫ আয়াত]
এ আয়াতে দাসী বিয়ে করার জন্যে ‘অসামর্থ্যের’ যে শর্তারোপ করা হয়েছে প্রাচীণ সে শর্ত উন্মুক্ত করে সামর্থবানদের জন্যেও দাসী বিয়ে করা বৈধ বলে ফতোয়া দিয়েছেন।
এভাবে পূর্ববর্তীদের আরো অনেক ফতোয়া উত্তরবর্তীদের এই উসূলের সাথে সাংঘর্ষিক প্রমাণিত হয়েছে।
তাছাড়া, তুমি দেখবে, এই পরবর্তী হানাফীদের তাখরীজসমূহের মধ্যে রয়েছে বহু স্ববিরোধিতা। আরো দেখবে এমন অনেক তাখরীজ, যেগুলোর একটিকে আরেকটি রহিত করে দেয়।
৩. ফিকহী মতামতের তাৎপর্য সম্পর্কে অজ্ঞতা
আমি দেখতে পেয়েছি, এদের (হানাফীদের) কিছু লোক মনে করে ফিকাহ ও ফতোয়ার গ্রন্থাবলীতে যতো টিকা টিপ্পনী ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ রয়েছে সবই আবু হানীফা কিংবা সাহিবাইনের মতামত। মূল জিনিস আর তার তাখরীজের মধ্যে তারা কোনো পার্থক্য করে না। ‘কারখীর ফতোয়া অনুযায়ী বিষয়টি এরূপ’ এবং ‘তোহাবীর ফতোয়া অনুযায়ী এরূপ’—তারা যেনো এ ধরনের বাক্যগুলোকে অর্থহীন মনে করে। ‘আবু হানীফা এরূপ বলেছেন’ এবং ‘এটি আবু হানীফার মাযহাবের মত’ তাদের দৃষ্টি তে এ দু’টি কথার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।
আমি আরো দেখেছি, কিছুলোক মনে করে, আবু হানীফার মাযহাব সারাখসী প্রণীত মাবসূত এবং হিদায়া ও তিবঈন প্রভৃতি গ্রন্থাবলীতে ছড়িয়ে থাকা বিবাদমূলক বাহাছসমূহের উপর প্রতিষ্ঠিত। অথচ তারা জানে না যে, তার্কিক বাহাছের ভিত্তির উপর তাঁর মাযহাব প্রতিষ্ঠিত নয়। তাদের মধ্যে এরূপ বাহাছের সূত্রপাত করে আসলে মুতাযিলারা। ফলে পরবর্তী লোকেরা ধারণা করে বসে, ফিকহী আলোচনার মধ্যে হয়তো এরূপ কথাবার্তার অবকাশ রয়েছে। তাছাড়া এর ফলে শিক্ষার্থীদের মনমস্তিষ্কেও তর্কবাহাছের তীক্ষ্মতা স্থান করে নিয়েছে।
লোকদের এসব ধারনা কল্পনা ও সন্দেহ সংশয়ের প্রতিবিধানকল্পে এখানে আমি দীর্ঘ আলোচনা করতে চাই না। কারণ, এ অধ্যায়ের সূচনাতে আমি যে ভূমিকা দিয়েছিলাম, এর অধিকাংশের নিরসনের জন্যে তাই যথেষ্ট।
৪. ‘রায়’ এবং ‘যাহেরীয়াতের’ তাৎপর্য সম্পর্কে অজ্ঞতা
কিছু লোককে আমি এ ধারণাও পোষণ করতে দেখেছি যে, “মাত্র দু’টি ফিকহী গ্রুপই বর্তমান আছে। এ ক্ষেত্রে তৃতীয় কোনো গ্রুপ নেই। দু’টির একটি গ্রুপ হলো ‘আহলুর রায়’ আর অপরটি হলো ‘যাহেরিয়া’। আহলুর রায় হলো সে গ্রুপ যারা কিয়াস এবং ইস্তিম্বাত এর সাহায্যে কার্য সম্পাদন করে।” অথচ এ ধারণা একটা দারূণ অজ্ঞতা। ‘রায়’ মানে নিরেট বুঝ-বুদ্ধি (ফাহম ও আকল) ই নয়। কারণ কোনো আলিমই এ দুটি গুণবিহীন নন। এই ‘রায়’ সুন্নাতের রাসূলের সাথে সম্পর্কহীন ‘রায়’ নয়। কারণ, ইসলামের কোনো অনুসারীই সুন্নাতের সাথে সম্পর্খীন রায় গ্রহণ করতে পারেনা। ‘রায়’ এর অর্থ নিরেট কিয়াস এবং ইস্তিম্বাতের যোগ্যতাও নয়।
আসলে, ‘আহলূর রায়’ এর অর্থ এগুলো নয়। প্রকৃতপক্ষে ‘আহরুল রায়’ হলেন সেইসব লোক যাঁরা মুসলমানদের সর্বসম্মত কিংবা অধিকাংশ কর্তৃক গৃহীত মাসায়েলসমূহের প্রাসংগিক বিষয়াদি তাখরীজ করার প্রতি মনোনিবেশ করেছেন ইমাম মুজতাহিদদের নির্ণীত উসূলের ভিত্তিতে। তারা এ কাজ হদীস এবং আছারের ভিত্তিতে করেননি। বরং মুজতাহিদ ইমামদের নির্ণীত মাসায়েল সমূহের অজীর ও কার্যকারণকে সামনে রেখে করেছেন। পক্ষান্তরে ‘আহলুয যাহের’ বা ‘যাহেরিয়া’ হলেন তাঁরা, যারা কিয়াস বা সাহাবীগণের আছার এ দু’টির কোনোটিকেই অবলম্বন করেননি। যেমন, ইমাম দাউদ এবং ইবনে হাযম। এই উভয় গ্রুপের মাঝে রয়েছেন ‘মুহাক্কিকীন’ এবং ‘আহলুস সুন্নাহ’। যেমন, আহমদ এবং ইসহাক।
৫. অন্ধ অনুকরনের প্রাধান্য
আরেকটি প্রধান বিপর্যয় হলো, এ সময় লোকেরা চরমভাবে অন্ধ অনুকরণে (তাকলীদে) নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। এতোটা নিশ্চিন্তে তারা এ পথে অগ্রসর হয় যে, তারা তাদের অস্থি-মজ্জায় মিশে যায়। এর পিছনে নিম্নোক্ত কারণগুলো কাজ করেছিলঃ
একটি কারণ ছিলো ফকীহদের মধ্যে পারস্পরিক ঝগড়া-বিবাদ। ফলে, একজন ফকীহ যখন কোথাও কোনো ফতোয়া দিলেন, সাথে সাথে আরেকজন ফকীহ তা খন্ডন করে, আরেকটি ফতোয়া দিয়ে বসেন। সে কারণে প্রত্যেকেই স্বীয় ফতোয়াকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে মুজতাহিদ ইমামদের (মতামতের) প্রতি প্রত্যাবর্তন করেন।
এ সময় শাসকদের যুলুমের কারণে মুসলমানগণ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট ছিলেন না। ফলে, তাদের নিয়োগকৃত কাজীদের প্রতিও জনগণ আস্থাশীল ছিল না। তাই, তারা বাধ্য হয়েই নিজেদের ফতোয়া ফায়সালার পক্ষে ইমাম মুজতাহিদ্গণের মতামত দলিল হিসেবে পেশ করতো।
আরেকটি কারণ এই ছিলো যযে, এ সময় সমাজের নেতৃস্থানীয় লোকেরা দ্বীনি জ্ঞান লাভ থেকে ছিলেন অনেক দূরে। ফলে, লোকেরা ফতোয়া নেয়ার জন্যে এমনসব লোকদের দিকে প্রত্যাবর্তন করে যাদের না হাদীসের জ্ঞান ছিলো আর না তাখরীজ এবং ইস্তিম্বাতের যোগ্যতা ছিলো। পরবর্তীকালের আলিমদের মধ্যে এ অবস্থা তোমরা নিজেরাই দেখতে পাচ্ছো। ইমাম ইবনে হুমাম প্রমুখ এ বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন পেশ করেছেন। এ সময় মুজতাহিদ নয় এমন লোকদেরও ফকীহ বলা হতে থাকে।৮০
[৮০. সে সময় মুজতাহিদ নয় এমনসব লোকদের ফকীহ বলার কারণে গ্রন্থকার আফসোস করেছেন। কিন্তু আমাদের কালে ফকীহ হবার জন্যে মুজতাহিদ হবার প্রয়োজন তো নেই ই, বরঞ্চ ইজতিহাদ করাকে নিষিদ্ধ মনে করা হয়। –অনুবাদক]
এ সময় মানুষের মধ্যে ফিকহী বিষয়াদি নিয়ে বিদ্বেষ এবং রেষারেষিও ছড়িয়ে পড়ে।
প্রকৃতপক্ষে ফকীহদের মধ্যে যে মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হয়, তার অধিকাংশই মাযহাবীহবের মতামতের বিভিন্নতা থেকেই সৃষ্টি হয়েছে। যেমনঃ আইয়্যামে তাশরীকের তাকবীর, দুই ঈদের তাকবীর, মুহরেমের (ইহরামকারীর) বিয়ে, ইবনে আব্বাস এবং ইবনে মাসউদের তাশাহহুদ, নামাযে বিসমিল্লাহ এবং আমীন সশব্দে বা নিঃশব্দে বলা প্রভৃতি। তাঁদের মধ্যে এগুলোর সংখ্যা ও পদ্ধতি ইয়ে যে মতপার্থক্য ছিলো, তা ছিলো নেহাতই অগ্রাধিকারের ব্যাপার। তাঁরা একটি মতকে আরেকটি মতের চাইতে উত্তম মনে করতেন। এর চাইতে বেশী কিছু নয়।
৬. শাস্ত্রীয় গবেষণার অপ্রয়োজনীয় হিড়িক
এ সময় আরেকটি রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। তা হলো, শরীয়তের আসল উৎসকে উপেক্ষা করে অধিকাংশ লোক বিভিন শাস্ত্রীয় গবেষণার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। ফলে কেউ কেউ আসমাউল রিজাল এবং জারাহ ও তা’দীলের ক্ষেত্রে গবেষণায় অবতীর্ণ হয়ে ধারণা করে বসে আমি এ বিষয়ের ভিত্তি মযবুত করছি। কেউ নিমজ্জিত হয় প্রাচীন ও সমকালীন ইতিহাস গবেষণায়। কেউ নিমজ্জিত হয় বিরল, গরীব এমনকি মওদু’ হাদীসসমূহের যাচাই বাছাইর কাজে।
কেউ কেউ তাঁর গবেষণার ঘোড়া দৌড়ান উসূলে ফিকাহর ক্ষেত্রে। স্বীয় অনুসারীদের জন্যে আবিষ্কার করেন বিবাদ করার নিয়ম কানুন। অতঃপর অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগের তুফান ছুটান। বীরদর্পে জবাব্দেন অন্যদের অভিযোগের। প্রতিটি জিনিসের সংজ্ঞা প্রদান করেন। মাসয়ালা এবং বাহাছকে শ্রেণী বিভক্ত করেন। এভাবে এসব বিষয়ে দীর্ঘ হ্রস্ব গ্রন্থাদি রচনা করে যান।
অনেকে আবার এমনসব ধরে নেয়া বিষয়াদি নিয়ে চিন্তা গবেষণা চালান, যেগুলো ছিলো নিতান্তই অনর্থক এবং কোনো জ্ঞানবান ও বুদ্ধিমান ব্যাক্তি যেগুলোকে তাকিয়ে দেখারও যোগ্য মনে করে না। এসব মতবিরোধ ঝগড়া বিবাদ ও বাহুল্য গবেষণার ফিতনা ছিলো প্রায় সেই ফিতনার মতো, যারশিকার হয়েছিল মুসলমানরা তাদের প্রাথমিক যুগে। যখন রাষ্ট্র ক্ষমতা নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু হ্য আর প্রত্যেকেই নিজ নেতাকে ক্ষমতাসীন করা বা ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার কাজে আদাজল খেয়ে লেগে পড়েছিল। এর ফলে তখন যেমন মুসলমানদের উপর যালিম অত্যাচারী একনায়ক শাসকরা সওয়ার হয়ে বসেছিল এবং ইসলামের ইতিহাসের সবচাইতে ন্যাক্কারজনক ঘটনাবলো সংঘটিত হয়েছিল, ঠিক তেমনি এই নব ফিতনাও মুসলিম সমাজে অজ্ঞতা, অন্ধতা, সন্দেয়-সংশয় ও ধারণা কল্পনার চরম ধ্বংসকারী ঝড় তুফান বইয়ে দেয়।
অতঃপর আসে এদের পরবর্তী জেনারেশন। এই জেনারেশন তাদের পূর্বসূরীদের অন্ধ অনুকরণ করে সম্মুখে ধাবিত হয়। ফলে, তারা সত্য মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করতে ব্যার্থ হয়। ঝগড়া বাহাছ এবং সঠিক ইস্তিম্বাতের মধ্যে পার্থক্য করার চেতনাই তারা লাভা করেনি। এখন সেই ব্যাক্তিই ফকীহ উপাধি পেতে থেকে যে বেশী বকবক করতে এবং মিথ্যা জটিলতা পাকাতে পারে, যে কোনো বিষয়ে নীরব থাকতে এবং সত্য মিথ্যা যাচাই করতে জানে না এবং ফকীহদের দুর্বল ও মযবুত বক্তব্যের পার্তক্য নির্ণয় করতে পারে না। একইভাবে এমনসব লোকদেরকে মুহাদ্দিস বলা হতে হাকে, যারা সঠিক ও ভ্রান্ত হাদীসের মধ্যে পার্থক্য করতে জানে না এবং সঠিক ও ভ্রান্ত হাদীসকে সমানভাবে চালিয়ে দেয়।
সকলেরই এরূপ অবস্থা ছিলো, সে কথা আমি বলি না। আল্লাহর একদল বান্দাহ সব সময়ি তাঁর সন্তুষ্টির পথে কাজ করেছেন, কোনো শত্রুতা তাদেরকে এপথ থেকে ফিরাতে পারেনি। পৃথিবীতে এরাই আল্লাহর হুজ্জত।
অতঃপর এদের পরে যে জেনারেশনের আগমন ঘটে, তারা এদের চাইতেও বড় ফিতনাবাজ প্রমাণিত হয়। তারা বিদ্বেষমূলক তাকলীদের দিক থেকেও ছিলো অগ্রগামী। তাদের অন্তরে না ছিলো জ্ঞানের আলো আর না ছিলো অন্তরদৃষ্টি। তারা দ্বীনি বিষয়ে চিন্তা গবেষণা করাকে ‘বিদআত’ বলে আখ্যায়িত করে সদর্পে ঘোষণা দিয়েছেঃ
“আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের এভাবেই চলতে দেখেছি আর আমরা তাদেরই পদাংক অনুসরন করতে থাকবো।”
এখন একমাত্র আল্লাহর কাছেই এ বিষয়ে অভিযোগ করা যায়! তাঁর কাছেই সাহায্য চাওয়া যেতে পারে। তিনিই একমাত্র নির্ভরযোগ্য সত্ত্বা আর তাঁর উপরই ভরসা করা যেতে পারে।