মহানবীর চিঠি পড়ে কেঁদে ফেললেন মানজার
আরব উপদ্বীপের পূর্ব উপকূলে পারস্য উপসাগরের পানির উপর দাঁড়ানো বাহরাইন। বাহরাইনের শাসক তখন মানজার ইবনে ছাভী। ইসলামের দাওয়াত নিয়ে মহানবী (সা.)-এর একটা চিঠি তাঁর কাছে পৌঁছল। ইসলামের উত্থান ও এর গতিধারা সম্পর্কে আগে থেকেই খবর রাখছিলেন তিনি। ইয়ামেনের শাসনকর্তা ‘বাজান’-এর খবরও তাঁর কাছে ছিল। পারস্য সম্রাট মহানবী (সা)-কে ধরতে পাঠিয়ে নিজেই ধরাধাম থেকে বিদায় নিলেন, তাও তিনি জানতেন।
মহানবীর চিঠি পেয়ে মানজার সঙ্গে সঙ্গেই ইসলাম গ্রহণ করলেন। বাহরাইনের আরব বাসিন্দারাও তাঁর সাথে সাথে ইসলাম গ্রহণ করলো না।
কিন্তু রাজ্যের ইহুদী ও অগ্নিপূজকরা ইসলাম গ্রহন করলেন না ।
বাহরাইনের শাসক মানজার ইবনে ছাভী একে ভালোভাবে নিলেন না। শাসক যাকে ভালো মনে করা কঠিন ছিল। মানজারও কিছু প্রজার এই ঐদ্ধত্য হজম করতে পারলেন না। তবে মহানবীর হুকুম ছাড়া কিছু না করার সিদ্ধান্ত তিনি নিলেন। প্রয়োজনীয় নির্দেশ লাভের জন্যে মানজার লিখলেন মহানবীর (সা) কাছে। মানজারের সিদ্ধান্ত এবং মহানবীর কাছে তাঁর লিখার বিষয়টা ইহুদী ও অগ্নিপূজকরা জানতে পারলো। তার উদ্বিগ্ন হলো তাদের ভবিষ্যত নিয়ে। যথাসময়ে মহানবী (সা)-এর চিঠি এলো মানজারের কাছে। অত্যন্ত আদবের সাথে চিঠি খুলে পড়তে লাগলেন তিনি :
“ধর্ম সম্বন্ধে কোন জোর-জবরদস্তি করা অধর্ম। যে ব্যক্তি উপদেশ গ্রহণ করে, সে তো কেবল নিজেরই কল্যাণ সাধন করে থাকে। যারা ইহুদী বা পারসিক ধর্মে থাকতে চায়, তাদেরকে যিজিয়া দিতে হবে মাত্র। এর অতিরিক্ত অন্য কোন বিষয়ে তাদের উপর তোমার আর কোন অধিকার থাকবে না।”
চিঠি পড়ে মহানবী (সা)-এর দয়া ও মহানুভবতায় কেঁদে ফেললেন মানজার। কত বড় দয়ার সাগর তিনি? বিধর্মী প্রজাদের পক্ষ হয়ে মানজারকেই তিনি শাসন করেছেন।
এই খবর ইহুদী এবং অগ্নিপূজক প্রজাদেরকেও অভিভুত করলো। এতদিন তারা পারস্য সম্রাট ও তাদের কর্মচারীদের অমানুষিক অত্যাচারে একেবারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। এক যিজিয়ার বিনিময়ে সব কর ও যুলুম থেকে রেহাই পেয়ে তারা মহানবী (সা)-এর নামে সকলে জয়ধ্বনি করতে লাগলো। ইসলাম গ্রহনের হার তাদের মধ্যে দ্রুত বেড়ে চললো।
মহানবী আবারও অভয় দিলেন
রাহমাতুল্লিল আলামীন মহানবী সা) রক্তপাত চান না। মক্কা প্রবেশেও তিনি রক্তপাত এড়াতে চাইলেন্
এ লক্ষ্যেই তিনি একটা পাহাড়ের শীর্ষে বসে চারদিকে নজর রাখলেন কোথায় কি ঘটে তা দেখার জন্যে। হাঠাৎ মক্কার এক উপত্যকা-পথে সকালের রোদে উত্তোলিত তরবারির ঝিলিক দেখতে পেলেন মহানবী (সা)। ঐ উপত্যকা পথে হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদের নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনীর একটা দল মক্কায় প্রবেশ করছে। মহানবী (সা) উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি খালিদকে হাজির করার নির্দেশ দিলেন কৈফিয়ত দেয়ার জন্যে। খালিদ হাজির হলেন। নিবেদন করলেন বিনীতিভাবে, ‘আমি আপনার আদেশ পালনে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু কুরাইশদের দলটাকে কোনোভাবেই নিরস্ত্র করা যায়নি। তারা আমাদেরকে আক্রমণ করে এবং দু’জন মুসলিম সৈন্যকে হত্যা করে। তখন বাধ্য হয়ে আমাদেরকেও অস্ত্র বের করতে হয়।’ এই সময় মহানবী (সা) আরও খবর পেলেন, কুরাইশ-প্রধানরা পরামর্শ করে কুরাইশ ও অন্যান্য অনুগত গোত্রের দুর্দান্ত ও গুন্ডা শ্রেণীর বহুসংখ্যক লোকদের বিভিন্ন স্থানে মুসলমানদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়। ঠিক হয় যে, তারা সুবিধা করতে পারলে সবাই একযোগে মুসলমানদের আক্রমণ করবে। আর যদি তারা ব্যর্থ হয়, তাহলে যে অভয় তারা মহানবীর কাছ থেকে পেয়েছে, তার অধীনে তারা আত্মরক্ষা করবে।
কুরাইশদের অকারণ সৈন্য সমাবেশের মধ্যেও মহানবী এরই প্রমাণ পেলেন। কুরাইশদের এই ষড়যন্ত্র টের পেয়ে মহানবী (সা) আনসার রেজিমেন্টকে সতর্ক থাকতে এবং সকালে ছাফা পর্বতের পাদমূলে সমবেত হতে আদেশ দিলেন। মহানবী (সা) দেখাতে চাইলেন মুসলমানরা প্রস্তুত আছে, অতএব কুরাইশদের কোন ষড়যন্ত্র কাজে আসবে না। কুরাইশরাও শীঘ্র এটা বুঝতে পারলো এবং ষড়যন্ত্র বাদ দিয়ে নিজেদের ভবিষ্যত ভেবে ব্যাকুল হয়ে উঠলো।
আবু সুফিয়ান আবার ছুটলো মহানবীর (সা) কাছে। আর্তনাদ করে আবার সেই আগের মতই বলল, ‘মুহাম্মদ, কুরাইশদের এই দলকে তুমি যদি ধ্বংস কর, তাহলে আজ থেকে কুরাইশদের নাম-নিশানা বিলুপ্ত হয়ে যাবে।’ কুরাইশরা সর্বশেষেও যে অপরাধ করলো তাতেও মহানবী (সা) তাদের জন্যে ভয়াবহ শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারতেন। কিন্তু মহানবী (সা) তো এসেছেন মানুষকে মানুষ বানাবার জন্যে, তাদের শাস্তি দেবার জন্য নয়। মহানবী (সা) আবু সুফিয়ানকে বললেন, যাও, আবার অভয় দিলাম, তোমাদের পুনরায় ক্ষমা করলাম। যা বলেছিলাম সেই অনুসারে কাজ কর গিয়ে।
একমাত্র আল্লাহ্ই আমাদের প্রানের মালিক
মক্কা বিজয়ের পর মহানবী (সা) মক্কাবাসীর জন্যে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন। এরপরও কিছু পাষন্ড প্রকৃতির মানুষ মহানবী (সা)-কে হত্যার ষড়যন্ত্র আটলো। এমনই এক মদ্যপ ও পাষন্ড ছিল ফুজালা ইবনে উসার। অপরাধীদের আড্ডাখানা, মদের দোকান আর বেশ্যালয়ই ছিল তার স্থান। জাত-অপরাধী ফুজালা মহানবী (সা)-কে হত্যা করার জন্যে কা’বায় পৌঁছে দেখলো, মহানবী (সা) নিবিষ্ট মনে তাওয়াফ করছেন, আল্লাহর ধ্যান ছাড়া কোনদিকে তাঁর দৃষ্টি নেই। ফুজালা একে তার জন্যে এক মহাসুযোগ বলে মনে করলো। অস্ত্রটা কাপড়ের আড়ালে রেখে অত্যন্ত সন্তর্পণে মহানবীর (সা) দিকে এগুলো ফুজালা।
ফুজালা তখন মহানবীর একেবারে কাছে পৌঁছে গেছে। মহানবী (সা) ফুজালার দিকে তাকালেন।
বললেন, ‘কে, ফুজালা নাকি?‘ অন্তরটা কেঁপে উঠলো ফুজালার। বললো সে, ‘জ্বি, কিছু না। এই আল্লাহ আল্লাহ করছি।’
মহানবী (সা) ফুজালার চোর ধরা পড়ার মতো দুর্দশাকর অবস্থা দেখে হাসি সম্বরণ করতে পারলেন না। মধুর হেসে তিনি বললেন, ‘বেশ কথা, ফুজালা। সেই আল্লাহর কাছে ক্ষামা প্রার্থনা করো।’ ফুজালা বুঝলো তার গোপন অভিসন্ধি মহানবীর কাছে ধরা পড়ে গেছে। ফুজালা বুঝলো তার গোপন অভিসন্ধি মহানবীর কাছে ধরা পড়ে গেছে। ফুজালার অবস্থা তখন অবর্ণনীয়। ভয়, লজ্জা, অনুতাপে অভিভূত ও বিমূঢ় হয়ে পড়লো সে। বুকের ভেতর তখন তার অসহ্য তোলপাড়। বিমূঢ়, নিশ্চল ফুজালার বুকে মহানবী (সা) তাঁর ডান হাত রাখলেন। ফুজালা স্বয়ং বলেছেন, ‘মহানবীর হাতের স্পর্শ পাওয়ার সাথে সাথে আমার মনের সমস্ত চাঞল্য ও সকল অশান্তি দূর হয়ে গেলো। আমি এক স্বর্গীয় শান্তি ও মহানবীর স্পর্শে ধন্য পবিত্র দেহ ও শুদ্ধ হৃদয় নিয়ে ফুজাল ছুটলেন তার বাড়ীর দিকে। পথে দেখা হলো ফুজালার বড় আদরের, বড় গৌরবের রক্ষিত-সুন্দরীর সাথে। রক্ষিত সুন্দরী বললো, ‘প্রাণেশ্বর ফুজালা, এভাবে কোথায় ছুটছো? এসো আমার কাছে।’
ফুজালা মুহূর্তের জন্যে না দাঁড়িয়ে রক্ষিতার দিকে দ্বিতীয়বার না তাকিয়ে ছুটতে ছুটতে বলতে লাগলেন, ‘একমাত্র আল্লাহই আমাদের প্রাণের মালিক, তাকেই প্রেম করো, শান্তি পাবে। আর নয়, আল্লাহ্ ও ইসলাম আমাকে তোমার থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে।’
বিশ্বজয়ী মানবতা
মক্কার আবু জাহল ইসলামের প্রধানতম বৈরী ছিলো। বদর যুদ্ধে সে নিহত না হওয়া পর্যন্ত মহানবী (সা) ও ইসলামের বিরুদ্ধে অবিরাম শত্রুতা করে গেছে। আবু জাহলের পুত্র ইকরামাও তার পিতার মতই ইসলামের বৈরী ছিলো। বিভিন্ন যুদ্ধে তিনি ইসলামের বিরুদ্ধে খুবই সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। এমন কি মহানবী (সা)-এর মক্কা প্রবেশের সময় যখন সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। এমন কি মহানবী (সা)-এর মক্কা প্রবেশের সময় যখন কুরাইশদের অস্ত্র হাতে না নেয়ার কথা, তখন ইকরামার নেতৃত্বেই কুরাইশদের একটা দল হত্যা করে দু’জন মুসলিম সৈনিককে।
সেই ইকরামা মক্কা বিজয়ের পর ইসলামের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহণ করলেন।
মক্কা বিজয়ের পর তখনও মহানবী (সা) মক্কায়। একদিন ইকরামা ইবনে আবু জাহল মহানবীর কাছে এলেন। বললেন অভিমান-ক্ষুব্ধ কণ্ঠে, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ, মুসলমানরা আমার পিতাকে গালাগালি দিয়ে থাকে।’ খবরটা মহানবী (সা)-কে খুবই বেদনা দিল। তিনি মুসলমানদের এক সামাবেশে সকলকে সম্বোধন করে বললেন, মৃতদের গালাগালি দিয়ে জীবিতদের যন্ত্রণা দিও না। মৃতরা তাদের কর্মফল নিয়ে চলে গেছে। তাদের গালি দেয়া অনুচিত। উচিত মৃত ব্যক্তিদের জীবনের মন্দ দিকটা বাদ দিয়ে কেবল তাদের ভাল দিকটা আলোচনা করা। ইসলামের এই সভ্যতা, শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে ইসলামের এই মানবতা এবং ইসলামের এই সৌন্দর্যই মানুষের হৃদয় জয়ের মাধ্যমে বিশ্বজয় করেছিল।
‘ফাতহুম মুবিন’
মক্কা নগরী মুক্ত হয়েছে।
কা’বাঘরকে মূর্তির ও পূজার হাত থেকে মুক্ত করা হয়েছে। মুসলমনরা মুক্ত আল্লাহর ঘর কা’বায় প্রাণভরে একদিন একরাত তাওয়াফ করেছে। কিন্ত্র নামায তখনও হয়নি, আযান তখনও উত্থিত হয়নি কা’বায় মক্কার আকাশে। মক্কা জয়ের পর কে নামাযের সময় হলে মহানবী (সা) বেলালকে আযান দিতে বললেন। আদেশমাত্র বেলাল কা’বার একটি উচ্চস্থানে উঠে আযান দিতে শুরু করলেন। কত শতাব্দী পর কে জানে মক্কায় এই প্রথম আযান। মক্কার আকাশে-বাতাসে, প্রতিটি পাহাড় এবং পাথওে সে আযান প্রতিধ্বনিত হলো। অভূতপূর্ব আবেগে শিহরিত মুসলমানদের প্রতিটি কণ্ঠ বেলালের প্রথম তাকবির ধ্বনির সঙ্গে সঙ্গেই একযোগে তাকবির দিয়ে উঠলো। বেলালের আযান এবং সম্মিলিত তাকবির ধ্বনি কিয়ামতকাল পর্যন্ত এক নতুন পৃথিবীর আগমনি সঙ্গীত হিসেবে যেন প্রতিভাত হলো। স্বাধীন সক্কায় প্রথম নামায অনূষ্ঠিত হলো। নামায শেষ হয়েছে। মহানবী (সা) উঠে দাঁড়ালেন। সারিবদ্ধ মুসলমানরা বসে। তাদের সকলের চোখ মহানবীর মুখে নিবদ্ধ। কুরাইশদের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সকলে সমবেত হয়েছে মহানবী (সা) কি ঘোষণা দেন তা শোনার জন্যে। মহানবী (সা) যুদ্ধকালীন সময়ে তাদের নিরাপত্তা দিয়েছেন, এখন যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে পরাজিত মক্কাবাসীদের জন্যে কি ব্যবস্থা তিনি দেন তা শোনার জন্যে তারা উদগ্রীব। তাদের সকলেরই অন্তর কাঁপছে অজানা সব আশংকায়। মক্কার জীবনে মহানবীকে এমন কষ্ট নেই যা তারা দেয়নি। তারপর মদীনা গেলে সেখানেও মক্কাবাসীরা একের পর অভিযান পাঠিয়েছে মহানবীসহ মুসলমানদের ধ্বংস করার জন্যে। সেই মহানবী আজ বিজয়ী। মক্কাবাসীদের সম্পর্কে তিনি কি ব্যবস্থা নেবেন?
এহনবী (সা) তাঁর ভাষণ শুরু করে বললেন।
জনমন্ডলীকে সম্বোধন করে বললেন তিনি :
“আল্লাহ্র শোকর যিনি নিজের ওয়াদা পূর্ণ করেছেন, যিনি নিজের দাসকে সাহায্য করেছেন এবং একাকী শত্রুদের যিনি পরাভূত করেছেন।”
(১) “সকলে শ্রবণ কর! অন্ধকার যুগের সমস্ত অহংকার-তা অর্থগত হোক আর শোণিতগত হোক-সমস্তই আমার এই যুগল পদতলে দলিত, সথিত ও চিরকালের তরে রহিত হয়ে গেল।
(২) অতঃপর যদি কেউ কোন ব্যক্তিকে ইচ্ছাপূর্বক হত্যা করে, তাহলে সেটা তার ব্যক্তিগত অপরাধ বলে গণ্য হবে এবং সে জন্য তাঁকে প্রাণদন্ডে দন্ডিত কর হবে। ভ্রমজনিত নরহত্যার জন্য নিহত ব্যাক্তির উত্তরাধিকারীগণকে একশত উষ্ট্র ক্ষতিপূরণ দেয়ার ব্যবস্থা হলো। এটাও তার ব্যক্তিগত অপরাধ বলে গণ্য হবে।
(৩) ‘হে কুরাইশ জাতি। মূর্খতা যুগের অহামিকা এবং কৌলিন্যের গর্ব আল্লাহ আমারেদর থেকে দূর করে দিয়েছেন। মানুষ সমস্তই আদম হতে আর আদম মাটি হতে তৈরী হয়েছে।‘ সকলে শ্রবণ কর, আল্লাহ বলছেন : ‘হে মানব! আমি তোমাদের সকলকেই (একই উপকরণে) স্ত্রী-পুরুষ হতে সমুৎপন্ন করেছি এবং তোমাদেরকে একমাত্র এই জন্য বিভিন্ন শাখা ও বিভিন্ন শাখা ও বিভিন্ন গোত্রে ((বিভক্ত) করেছি যে, তা দ্বারা তোমরা পরস্পরের নিকট পরিচিতি হতে পারবে (অহংকার ও অত্যাচার করার জন্য নয়)। নিশ্চয় জেনো যে, তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি অধিক সংযমশীল (পরহেযগার), আল্লাহর নিকট সে-ই অধিক মহৎ। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও সর্বদশী।’ সকল মানুষই আদম হতে পয়দা হয়েছে। সুতরাং আদমের সন্তানগণ পরস্পর পরস্পরের ভাই এবং তার সকলেই সমান। এরপর এও বলে দেয়া হচ্ছে যে, আদম মাটি থেকে সৃষ্টি। সুতরাং মানুষকেও মাটির মত সর্বসহ, সর্বপালক ও অহংকারশূন্য হওয়া চাই।
(৪) ‘সকল প্রকার মদ ও মাদক দ্রব্যের ক্রয়-বিক্রয়, মুসলমান-অমুসমান সকলের পক্ষে নিষিদ্ধ।’
এই সাধারণ ঘোষণা দেয়ার পর মহানবী (সা) কুরাইশদের প্রতি দৃষ্টিপাত করলেন। সাধারণভাবে তাদের সকলকে সম্বোধন করে বললেন, ‘হে কুরাইশ জাতি, হে মক্কার অধিবাসীবৃন্দ! তোমাদের প্রতি কেমন ব্যবহার করবো বলে মনে করছো?‘
এহানবী (সা) থামতেই সমাবেশের চারদিক থেকে শতকণ্ঠে উচ্চরিত হলো : “আমরা কল্যাণের আশা করিিছ। হে আমাদের মহিমাময় ভ্রাতা, হে আমাদের মাহমাময় ভ্রাতা, হে আমাদের ভ্রাতুষ্পুত্র, তুমি আজ বিজয়ী। তুমি আজ দন্ডদানে সমর্থ। যদিও আমরা অপরাধ তবু তোমার কাছে সদয় ব্যবহার পাবার প্রত্যাশী।” তাদের কণ্ঠে থামলে মহানবী (সা)গুরু-গম্ভীর কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, “আজ তোমাদের প্রতি কোনই অভিযোগ নেই। আল্লাহ্ তোমাদের ক্ষমা করুন, তিনি দয়াময়। তোমরা সকলে মুক্ত, সকলে স্বাধীন।”
কত মূল্য মানুষের!
মক্কার আশে-পাশের অনেক বেদুইন গোত্র আগে থেকেই কুরাইশদেও বাড়াবাড়ির কারণে তাদের উপর বিক্ষুব্ধ ছিল এবং সহানুভূতিশীল হয়ে উঠেছিল মুসলমানদের প্রতি। মুসলমানদের মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে কুরাইশদের দর্প চূর্ণ হবার পর এই বেদুইন গোত্রগুলো ইসলামের আরও কাছাকাছি হয়ে পড়েছিল।
মক্কা বিজয় পরবর্তী তাৎক্ষনিক কাজগুলো সম্পন্ন হবার পর মহানবী (সা) তার সাহাবীদের ছোট ছোট বিভক্ত করে পাঠালেন বেদুইন গোত্রগুলোর কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছাবার জন্যে। অস্ত্র ব্যবহার ও যুদ্ধ করার অনুমতি এই দলগুলোর প্রতি ছিল না।
হঠাৎ মহানবী (সা)-এর কাছে খবর এল যে, বনি যাজিমা গোত্রের কয়েকজনকে খালিদ বিন ওয়ালিদের দল হত্যা করে ফেলেছে।
এই খবর শোনামাত্র মহানবী (সা) ব্যাকুলভাবে উচ্চস্বরে বলে উঠলেন, ‘হে আল্লাহ, তুমি জান, খালিদের এই কাজের সাথে আমার বিন্দুমাত্রও সম্পর্ক নেই।’ সংগে সংগেই মহানবী (সা) বিষয়টার তদন্ত করলেন। তদন্তে পরিষ্কার হলো যে, আবদুল্লাহ ইবনে হুজাইফার বলার দোষে হোত, অথবা নিজের শুনার ভুলের কারণে হোক, খালিদ একটা ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে ঐ অন্যায় কাজে লিপ্ত হয়েছিলেন।
বনি যাজিমার লোকরাও জেনে আনন্দিত হলো যে, খালিদের কাজের সাথে মহানবীর (সা) কোন প্রকার সম্বন্ধ বা সহানুভূতি নেই। তারা আরও বুজতে পারলো যে, খালিদ ভুলক্রমেই যুদ্ধাদেশ প্রদান করেছিলেন।
এসব জেনে বনি যাজিমার লোকরা আশ্বস্ত হলো এবং তাদের মনের বিরূপতাও মিটে গেল।
ওদিকে তদন্ত শেষে মহানবী (সা) হযরত আলী (রা)-কে প্রচুর অর্থসহ বনি যাজিমার কাছে প্রেরণ করলেন তাদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার জন্যে।
বনি যাজিমার লোকেরা দারুণ বিস্মিত হলো ক্ষতিপূরণ দেয়ার জন্যে হযরত আলীকে আসতে দেখে। যেহেতু হত্যাকান্ড ইচ্ছাকৃত নয়, ভুলক্রমে তা সংঘটিত হয়েছে, তাই ক্ষতিপূরণ নেবার কোন চিন্তাও তাদের মনে উদয় হয়নি।
হযরত আলী (রা) মহানবী (সা)-এর প্রতিনিধি হিসেবে বনি যাজিমার ক্ষতিপূরণ পরিশোধ করলেন। নিয়ম অনুয়ায়ী রক্তপণ বাবদ যে অর্থ বনি যাজিমা’র প্রাপ্য হতে পারে, তার চেয়ে অনেক বেশী অর্থ হযরত আলী তাদের দিলেন। বনি যাজিমা’র কাঞেছ এ এক অকল্পনীয় দৃশ্য, অভাবনীয় এক ঘটনা। যারা আজ বিজয়ী সেই শক্তি তাদের মত এক ক্ষুদ্র গোত্রের কাছে অপরাধ না হওয়া সত্ত্বেও অপরাধ স্বীকার করে এবাবে তার ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে। বনি যাজিমা পল্লীতে তখন জয়-জয়কার পড়ে গেল মহানবী (সা) এবং ইসলামের নামে।
ওদিকে মহানবীর কাছে হযরত আলী যখন ফিরে গেলেন ক্ষতিপূরণ শেষে এবং বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, ওদের যা প্রাপ্য তার চেয়ে ওদের বেশী দিয়ে ফেলেছি। মহানবী আনন্দিত কণ্ঠে বললেন, ‘ভাল করেছে, বেশ করেছে।’
তারপর মহানবী (সা) তার দুই হাত উপরে তুলে উচ্চকণ্ঠে আবার বললেন, ‘আল্লাহ, তুমি জান। খালিদের কাজের সাথে আমার কোন সম্বন্ধ নেই, আমি নিরাপরাধ।’
মহানবীর কণ্ঠস্বরে কেঁপে উঠলেন উসামা
মক্কা বিজয়ের পর মহানবী (সা) তখনও মক্কায়। এ সময় কুরাইশ গোগের একজন সম্মানিতা মহিলা চুরির অপরাধে ধরা পড়ল।
কুরাইশ বংশের স¤¿ান্ত লোকরা তাকে এই অভিযোগ থেকে বাঁচাবার চেষ্টা করল। কিন্তু তারা যখন দেখল কোনভাবেই তাকে নিরপরাধী প্রমাণের উপায় নেই, তখন তারা একযোগে উসামাকে গিয়ে ধরল।
উসামা হযরতের খুবই প্রিয়পাত্র। সকলেই গেখেছে, মক্কা বিজয়ের দিন মহানবী (সা) উসামাকে নিজ উটে নিজের পাশে বসিয়ে মক্কা প্রবেশ করেছিলেন। সকলে উসামাকে অনুরোধ করল, ‘আপনি নবীর কাছে সুপারিশ করুন যেন স্ত্রী-লোকটিকে বিনাদন্ডে মুক্তি দেয়া হয়।’
কুরাইশ সরদারদের অনুরোধ করতে রাজি হলেন।’ খুশী হলো কুরাইশরা। তারা নিশ্চিত যে, এমন প্রিয়জনের অনুরোধের প্রতি নবী কখনই উপেক্ষা প্রদর্শন করতে পারবেন না।
যথাসময়ে উসামা মহানবী (সা)-এর দরবারে উপস্থিত হলেন এবং অভিযক্ত স্ত্রীলোকটির জন্য মহানবীর স্বগোত্রীয় সম্ভ্রন্তদের অনুরোধের কথা শুনামাত্র মহানবী (সা)-এর চেহারায় ভাবান্তর দেখা দিল। উসামাকে লক্ষ্য করে গম্ভীর কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘উসামা, তুমি কি আল্লাহর নির্ধারিত দন্ডের ব্যতিক্রম করার জন্যে আমাকে অনুরোধ করতে এসেছ?’ মহানবী (সা)-এর কথা ও গম্ভীর কণ্ঠস্বর শুনে উসামা কেঁপে উঠলেন। তার ভুল বুঝতে পারলেন উসামা। নিজের অপরাধের কথা ভেবে তিনি দিশেহারা হয়ে পড়লেন। বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল, আমাকে ক্ষমা করুন।’
মহানবীর বিচার-নীতির আর একটি ঘটনা।
উপরোক্ত ঘটনার পরবর্তি অপরাহ্ন।
মহানবী (সা)-কে ঘিরে অনেক লোক উপস্থিত।
এক সময় মহানবী (সা) তাদেরকে কিছু বলার জন্য দাঁড়ালেন।
প্রথমে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রশংসার পর তিনি সকলকে সম্বোধন করে বললেন, “তোমরা নিশ্চিত জেনে রেখ, তোমাদের আগের অনেক জাতি ধ্বংস হয়েছে বিচার-ক্ষেত্রে তাদের নিরপেক্ষতার অভাবের কারণে। তখন বিচারের সময় জাতি-কুল ও ধন-সম্পত্তির তারতম্য অনুসারে অপরাধীদের দণ্ড ভিন্ন ভিন্ন রকমের হতো। মানী ও ধনীদের অপরাধ উপেক্ষা করা হতো এবং দরিদ্র ও দুর্বলদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হতো। সকলে জেনে রাখ, এটা ইসলামের আদর্শ নয়, ইসলাম এই পক্ষপাত সহ্য করে না। আল্লাহর কসম, আমার কন্যা ফাতিমাও যদি অপরাধে লিপ্ত হতো, তাহলে তাকেও নির্ধারিত দণ্ডদানে আমি একবিন্দুও কুণ্ঠিত হতাম না।”
‘আনান্নাবী লা কাজেব’
হুনাইনের যুদ্ধ
ওহোদ যুদ্ধের মতোই এক বিপর্যয়কর পরিস্থিতি। ছড়ানো-ছিটানো বিশাল রণাঙ্গনের এক স্থানে মহানবী তাঁর শ্বেত অশ্বের উপর বসে।
মুসলিম পতাকাগুলো ভূলুণ্ঠিত। মুসলিম বাহিনী সম্পূর্ণ বিশৃংখল হয়ে পড়েছে। ওহোদ যুদ্ধে বিপর্যয় হয়েছিল মহানবীর যুদ্ধ-সংক্রান্ত একটা আদেশ থেকে সরে আসার কারণে। আর হুনাইন যুদ্ধে বিপর্যয়ের কারণ কারো কারো মধ্যে সংখ্যাধিক্যের উপর নির্ভরতা এবং মুসলিম সেনাদলের অতি উৎসাহ ও অপরিণামদর্শিতা এবং তাদের কারো কারো ষড়যন্ত্রও।
হুনাইন যুদ্ধের দু’টি বড় বৈশিষ্ট্য ছিল। এক. এ যুদ্ধে মুসলিম পক্ষের সৈন্য সংখ্যা ছিল বার হাজার, যা তখন পর্যন্ত সংঘটিত যুদ্ধের মধ্যে সর্বোচ্চ (বদরে সৈন্য সংখ্যা ছিল ৩১৩, ওহোদ যুদ্ধে এক হাজার এবং খন্দক যুদ্ধে তিন হাজার)। দুই. এই যুদ্ধে প্রায় দুই হাজার পৌত্তলিক সৈন্য মুসলমানদের পক্ষে যোগদান করে। এ যুদ্ধে মুসলমানদের প্রতিপক্ষ ছিল আরবের সুদক্ষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ তীরন্দাজ যোদ্ধা হিসেবে পরিচিত হাওয়াজিন, সাকিফ এবং তাদের মিত্র গোত্রসমূহের বিশাল বাহিনী।
হুনাইন প্রান্তরে আগে থেকেই হাওয়াজিন ও সাকিফরা সুকৌশলে সৈন্য মোতায়েন করে ওত পেতে ছিল।
মুসলিম বাহিনীর অগ্রভাগে ছিল পৌত্তলিক সৈন্য ও নব্য মুসলমানরা। তাদের উৎসাহ-আস্ফালন যতটা আকাশস্পর্শী ছিল, তার স্থায়িত্ব ততটাই ছিল পাতালস্পর্শী।
অগ্রভাগে থাকার কারণে হাওয়াজিন ও সাকিফদের পরিকল্পিত প্রচণ্ড ও অব্যাহত আক্রমণ তাদের উপর প্রথম আসে। আক্রান্ত হয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য অবস্থায় তারা পালাতে শুরু করে। ভয়ানক বিশৃংখল পরিবেশের সৃষ্টি হয়। শুরুতেই ভেঙে পড়ে মুসলিম বাহিনীর গোটা শৃংখলা। এই শৃংখলা আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি।
এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে মহানবী (সা) স্থিরভাবে বসেছিলেন তাঁর ঘোড়ার পিঠে। হযরত আব্বাস (রা) দাঁড়িয়েছিলেন ঘোড়ার লাগাম ধরে আবু সুফিয়ান ধরেছিলেন ঘোড়ার রেকাব। আশেপাশে ছিল দু’তিনজন মাত্র মুসলিম সৈনিক।
মহানবী (সা)-কে একা দেখে ছুটে আসছে শত্রু-বাহিনী মহা সোরগোল তুলে, আর আস্ফালন করতে করতে।
এই ঘোরতর বিপদ মুহূর্তে মহানবীর মুখে ভয় বা ভাবনার কোন চিহ্ন নেই। এ সময় মহানবী (সা) ধীর-স্থিরভাবে ঘোড়া থেকে মাটিতে অবতরণ করলেন এবং নতজানু হয়ে পরম প্রভু রাব্বুল আলামিনের কাছে একান্ত প্রার্থনা জানালেন।
তারপর উঠে দাঁড়িয়ে আরোহণ করলেন ঘোড়ায় এবং দ্রুত ছুটলেন অগ্রসরমান সহস্র শত্রুসেনার দিকে।
হযরত আব্বাস ও আবু সুফিয়ান আতংকিত হয়ে মহানবীকে বাধা দেবার চেষ্টা করলেন। মহানবী (সা) দৃঢ়কণ্ঠে, গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘আনান্নাবী লা কাজেব, আনা ইবন আবদুল মোত্তালেব’ (আমি নবী, আমাতে মিথ্যার লেশমাত্র নেই, আমি আবদুল মোত্তালিব বংশের সন্তান)।
মহানবী (সা)-এর মুখমণ্ডল তখন বিশ্বাসের প্রভায় অপরূপ, দীপ্ত। মহানবীর দিকে তাকিয়ে এবং তাঁর তেজোদীপ্ত ঘোষণা শুনে হযরত আব্বাস এবং আবু সুফিয়ান বিহ্বল হয়ে পড়লেন এবং তাঁকে বাধা দেবার আর শক্তি পেলেন না।
একদল শত্রু মহানবীর (সা) একদম সামনে এসে পড়েছিল। মহানবী তাদের বিরুদ্ধে কোন অস্ত্র ব্যবহার করলেন না। তিনি এক মুষ্ঠি ধুলা মাটি তুলে নিয়ে ছুড়ে মারলেন তাদের দিকে। দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়া ধুলাক্রান্ত সৈনিকরা চোখ মুছতে মুছতে পেছনে হটে গেলে। ইতোমধ্যে মহানবী (সা) একা ছুটে যাবার দৃশ্য দেখে এখানে-সেখানে বিক্ষিপ্ত মুসলিম সৈনিকরা ছুটে আসতে লাগল মহানবীর দিকে। অন্যদিকে হযরত আব্বাস উঠেছেন এক পাহাড় টিলায়। সেখান থেকে হযরত আব্বাসের স্বাভাবসিদ্ধ দরাজ কণ্ঠে ধ্বনিত হলো : “হে আনসার বীরগণ, হে শাজরার বাইয়াত গ্রহণকারীগণ, হে মুসলিম বীরবৃন্দ। হে মুহাজিরগণ, কোথায় তোমরা? এদিকে ছুটে এসো।”
বিক্ষিপ্ত, বিশৃংখল সৈনিকরা সমবেত হবার জন্যে একটা কেন্দ্রের সন্ধান করছিল। এই আহবানের সাথে সাথে মুসলিম সৈনিকরা বিশাল যুদ্ধক্ষেত্রের যে যেখানে ছিল সেখান থেকে দলে দলে ছুটে আসতে লাগল। শত শত কণ্ঠে আওয়াজ উঠল, ‘ইয়া লাব্বায়েক, ইয়া লাব্বায়েক‘ (এই যে হাজির, হাজির)। হযরত আব্বাসের ভাষায় “সদ্যপ্রসূত গাভী যেমন তার বাছুরের বিপদ দর্শনে চিৎকার করতে করতে ছুটে আসে, আমার আহবান শুনে মুসলমানরা সেভাবে ছুটে আসতে লাগল।”
মুসলিম বাহিনীর ব্যুহ আবার নতুন করে রচিত হলো। পাতাকাগুলো আবার তুলে ধরা হয়েছে।
মহানবী (সা) এক মুঠো কংকর শত্রুর দিকে নিক্ষেপ করে বললেন, ‘শত্রু পরাস্ত, যাও অগ্রসর হও।’
মুসলিম বাহিনী বন্যাবেগের মতো আপতিত হলো শত্রু সৈন্যের উপর।
প্রচণ্ড যুদ্ধ চলল।
অবশেষে হাওয়াজিন ও সাকিফদের অজেয় বলে কথিত বাহিনী স্ত্রী-পুত্র, রণসম্ভার ও সমস্ত ধনদৌলত যুদ্ধক্ষেত্রে ফেলে রেখে পালিয়ে বাঁচল।
বন্দী মুক্তির এমন দৃশ্য দুনিয়া আর দেখেনি
হুনাইন যুদ্ধে হাওয়াজিনরা তাদের সমুদয় ধন-সম্পদ এবং স্ত্রী-পুত্র পরিজন ফেলে পালিয়ে গিয়েছিল।
এই ‘মালে গণিমত’ ও বন্দীদের উপর ছিল যুদ্ধে যোগদানকারী প্রতিটি মুসলমানের হক। সর্বসম্মত যুদ্ধ-আইন অনুসারে তাঁদের মধ্যেই এসব বণ্টন করে দেবার কথা। কিন্তু মহানবী (সা) ধন-সম্পদ ও যুদ্ধবন্দী সবকিছুই মক্কার জি’রানা নামক স্থানে সযত্নে রক্ষা করলেন। তার ইচ্ছা ছিল সর্বস্বান্ত হয়ে পড়া হাওয়াজিনরা এসে এসব ফিরে পাবার প্রার্থনা করলে তাদের এসব ফেরত দেবার ব্যবস্থা করবেন।
কিন্তু সপ্তাহকাল অপেক্ষার পরেও যখন তারা এল না, তখন মহানবী (সা) ধন-সম্পদগুলো মুসলমানদের মধ্যে বণ্টন করে দিলেন।
দু’সপ্তাহ পরে হাওয়াজিনরা এল।
হাওয়াজিনদের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা মহানবীর (সা)-এর কাছে উপস্থিত হয়ে কাতর কণ্ঠে আরজ করল, “মুহাম্মাদ! আজ আমরা আপনার করুণা ভিক্ষা করতে এসেছি। আমাদের আপরাধে ও অত্যাচারের দিকে আপনি তাকাবেন না। হে আরবের সাধু, নিজ গুণে আমাদের প্রতি দয়া করুন।” মহানবী (সা) দয়ার সাগর। মানুষের দুঃখ-বেদনা মোচন করে আলোর পথে নেয়ার জন্যেই তো তাঁর আগমন।
হাওয়াজিনদের করুণ অবস্থায় অভিভূত হয়ে পড়লেন মহানবী (সা)। কিন্তু কি করবেন তিনি! হাওয়াজিনরা দেরী করায় তাদের যুদ্ধক্ষেত্রের ধন-সম্পদ সমুদয় বণ্টন হয়ে গেছে। বাকি আছে ছয় হাজার যুদ্ধবন্দী নর-নারী। কিন্তু মুক্তিপণ ছাড়া তাদের ছেড়ে দিতে কেউ রাজী হবে না। সবদিকে ভেবে মহানবী (সা) ওদের বললেন, “তোমাদের জন্যে অনেক অপেক্ষা করেছি। ধন-সম্পদ ফিরে পা্বার কোন উপায় তোমাদের আর নেই। বন্দীদের মুক্তির ব্যাপারটা নিয়ে আমি ভাবছি। আমার ও আমার স্বগোত্রীয়দের প্রাপ্য বন্দীদের বিনাপণে মুক্তি দেবার ভার আমি নিতে পারি। অন্যান্য মুসলিমান ও অমুসমানদের অংশ সম্বন্ধে আমি এখন জোর করে কোন কথা বলতে পারছি না। তোমরা নামাযের সময় এসো এবং নামায শেষে সকলের কাছে প্রার্থনা জানাও। আমি যা বলার তখন বলব।” নামাযের সময়।
নামাজ শেষ হতেই হাওয়াজিন প্রতিনিধিরা উঠে দাঁড়িয়ে সকলের সামনে কাতর কণ্ঠে তাদের বন্দীদের মুক্তি প্রার্থনা করল। হাওয়াজিনদের কথা শেষ হবার সাথে সাথে মহানবী (সা) উঠে দাঁড়ালেন এবং বললেন, “তোমাদের এই ভাইয়ের অনুতপ্ত হৃদয়ে তোমাদের কাছে তাদের বন্দী স্বজনদের মুক্তি প্রার্থনা করছে। আমি এ ব্যাপারে তোমাদের সকলের মতামত জানতে চাই। তবে তার আগে আমার মতটা তোমাদের জানিয়ে দিচ্ছি যে, আবদুল মুত্তালেব গোত্রের প্রাপ্য সমস্ত বন্দীকেই আমি বিনা পণে মুক্তি দিয়েছি।” মহানবী (সা) মত জানার পর একে একে মুহাজির ও আনসার দলপতিরা আনন্দের সাথে তাঁদের নিজ নিজ গোত্রের প্রাপ্য অংশের দাবী পরিত্যাগ করলেন। দু’একজন গোত্রপতি শত্রু হাওয়াজিনদের বন্দীদের বিনাপণে মুক্তি দিতে অমত প্রকাশ করলেন। তাদের কোন প্রকার চাপ না দিয়ে মহানাবী (সা) তাদের উদ্দেশ্য বললনে, “তোমাদের প্রাপ্য ক্ষতি পূরণের জন্যে আমি দায়ী রইলাম। প্রথম সুযোগেই এই ঋণ আমি পরিশোধ করে দেব।”
হাওয়াজিনদের ছয় হাজার বন্দীর সবাই মুক্তি পেল। এক কপর্দক মুক্তপণও হাওয়াজিনদের উপর চাপানো হলো না।
বিদায় দেবার সময় মহানবী (সা) ছয় হাজার বন্দীর সকলকে নতুনকাপড় পরিয়ে দিলেন।
বন্দী মুক্তির এমন দৃশ্য দুনিয়া আর কখনও দেখেনি, দেখবেও না কোনদিন।
‘ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমরা আপনাকে চাই’
হুনাইন যুদ্ধের ‘মালে গণিমত’ (যুদ্ধলব্ধ ধন-সম্পদ) বণ্টন করলেন মহানবী (সা)।
যুদ্ধলব্ধ সব সম্পদই তিনি বণ্টন করলেন ইসলামে নবদীক্ষিত কুরাইশদের মধ্যে। মদীনার আনসাররা কিছুই পেল না।
মুহাজির ও আনসাররা কিছুই পেল না। মদীনার মুনাফিকরা একে একটা মহা সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করল। মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টায় লেগে গেল তারা। তাদের কুমন্ত্রণায় কতিপয় অদূরদর্শী আনসার যুবক প্রভাবিত হয়ে পড়ল। তারা প্রকাশ্যেই অসন্তোষ প্রকাশ করতে লাগল। অনেক আনসারের মধ্যে এ ভাবনারও সৃষ্টি হলো যে, মহানবী (সা) এবার হয়তো স্বদেশ মক্কাতেই অবস্থান করবেন এবং আমরা তাঁর সেবা করার সুযোগ পাব না।
এসব কথা আনসারদের মধ্যে ব্যাপকভাবে কানাঘুষা হতে লাগল। বিষয়টা মহানবী (সা) জানতে পারলেন। সকল আনসারকে ডাকলেন তিনি। আনসারদের এ সভায় তিনি প্রশ্ন করলেন, যা তিনি শুনেছেন তা সত্য কিনা? আনসার প্রধানগণ খুবই লজ্জিত ও বিব্রত হলেন। বিনীত কণ্ঠে বললেন তারা, আমাদের দু’একজন যুবকমাত্র এ ধরনের কথা বলেছে, একথা সত্য।
সবার একথা নয়। তাদের কথা শুনার পর মহানবী (সা) গণিমতের মাল বণ্টন বিষয়ে বললেন, ‘কুরাইশরা নবদীক্ষিত, বিশেষত তারা যুদ্ধ-বিগ্রহের ফলে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের ক্ষতিপূরণ করে সন্তুষ্ট করার জন্যেই এ ব্যবস্থা আমি করেছিলাম। আর যারা যা প্রত্যাশা করে, তারা তাইতো পায়।’ বলে মহানবী (সা) আনসারদের উদ্দেশ্য করে বললেন, আমি তোমাদের জিজ্ঞাসা করছি, তোমরা কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, লোকেরা ছাগল-ভেড়া নিয়ে বাড়ী যাচ্ছে, আর তোমরা রাসূলকে সাথে নিয়ে বাড়ী ফিরছ?’
আনসাররা সানুনয়ে ও ভক্তিগদগদ কণ্ঠে নিবেদন করলেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমরা আপনাকে চাই। আপনাকে পেয়ে, আপনাকে সেবা করেই আমরা পরিতৃপ্ত ও কৃতার্থ হয়েছি। আমরা যেন এই পরম সম্পদ থেকে বঞ্চিত না হই।’ মহানবী (সা) বললেন, ‘জীবনে-মরণে কখনই আনসারদের সাথে তাঁর বিচ্ছেদ হবে না।’
‘এমন শত্রু তো শত্রু নয়’
নবম হিজরী সনের ঘটনা।
এক মহাবিপদ সংবাদ এল মদীনায়।
রোম সম্রাট মদীনা আক্রমণ করতে আসছেন। তাঁর সাথে যোগ দিয়েছে লাখম, জোজম, গাচ্ছান প্রভৃতি খৃস্টান আরব গোত্রগুলো।
রোম সম্রাট পূর্ণ এক বছরের রণসম্ভার ও রসদাদি সঙ্গে নিয়েছেন এবং সৈন্যদের এক বছরের পুরো বেতন অগ্রিম দেয়া হয়েছে।
সিরিয়া-ফেরত বাণিজ্য বহর খবর দিল, বিশাল রোমক সৈন্যের অগ্রবাহিনী ‘বালকা’ পর্যন্ত পৌঁছেছে।
খবর শুনে মহানবী (সা) সমগ্র মুসলিম হেজাজের প্রান্তে প্রান্তে স্বধর্ম, স্বজাতি ও স্বদেশের স্বাধীনতা ও অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে যথাসর্বস্ব নিয়ে প্রস্তুত হবার আদেশ প্রদান করলেন। মহানবী (সা) আরও জানিয়ে দিলেন, মদীনা থেকে চারশ’ মাইল দূরে আরব সীমান্তের ওপারে সিরিয়ার ভেতর রোমক বাহিনীকে বাধা দেয়া হবে। ঠিক হলো, ত্রিশ হাজার মুসলিম যোদ্ধা এই তাবুক অভিযানে অংশ নেবে। কিন্তু অস্ত্রশস্ত্র, যানবাহন ও রসদাদি কোথায়?
মহানবী (সা) এই সমরায়োজনে যথাসাধ্য সাহায্য করার জন্যে মুসলমানদের প্রতি উদাত্ত আহবান জানালেন।
আহবান সকলের কানে পৌঁছল ।
কানে পৌঁছার সাথে সাথে যে যেখানে ছিল ছুটল বাড়ীর দিকে যা কিছু সম্ভব তা নিয়ে মহানবীর দরবারে হাজির হবার জন্যে।
হযরত উমর (রা) তাঁর যা কিছু অর্থ-সম্পদ আছে দুইভাগে ভাগ করলেন। একভাগ পরিবারের জন্যে রেখে অন্য অর্ধেক নিয়ে তিনি ছুটলেন মহানবীর দরবারের দিকে।
যেতে যেতে ভাবলেন, সব ভাল কাজেই হযরত আবু বকর প্রথমস্থানে থাকেন, আজ তিনি আবু বকরকে পরাজিত করবেন।
হযরত উমর (রা) তাঁর অর্থ-সম্পদ নিয়ে হাজির হলেন মহানবীর দরবারে। মহানবী (সা) তাঁকে বাড়ীর জন্যে কিছু রেখেছে কিনা জিজ্ঞাসা করলে। হযরত উমর (রা) জানালেন তিনি কিভাবে সম্পদ ভাগ করেছেন। হযরত আবু বকরও তাঁর ধন-সম্পদ মহানবীর চরণে হাজির করেছেন। মহানবী (সা) তাকেও জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আবু বকর, পরিবার বর্গের জন্য কি রেখে এসেছো ? আবু বকর বিনীতভাবে বললেন, ‘শ্রেষ্ঠতম সম্পদ আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল আমার পরিবারবর্গের জন্যে আছেন।’
সকল মুসলমানই এভাবে তাদের সাধ্য অনুসারে দান করলেন। হযরত উসমান (রা) এসে মহানবীর দরবারে নিবেদন করলেন, এক হাজার উট, সত্তরটি ঘোড়া এবং এর জন্য আবশ্যকীয় সরঞ্জাম এবং সেই সাথে এক হাজার স্বর্ণ মুদ্রা। কিন্তু ৩০ হাজার মুসলিম যোদ্ধার সকলকে যুদ্ধের সরঞ্জাম দেয়া গেল না। কিছু যোদ্ধা বঞ্চিত থাকল। তারা মহানবীর সাথে যুদ্ধে শরিক হতে পারবে না, এই দুঃখ শিশুর মত কান্না শুরু করে দিল।
যথাসময়ে তিরিশ হাজার সৈন্য মহানবীর (সা) নেতৃত্বে সিরিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করল। কিন্তু অতুলনীয় ত্যাগের এই যুদ্ধ প্রস্তুতির মধ্যেই আল্লাহ বিজয় দিয়ে দিয়েছিলেন মুসলমানদের। মুসলিম বাহিনী সিরিয়ার তাবুক নামক স্থানে উপস্থিত হয়ে শুনতে পেলেন, রোম সম্রাটের আরবমুখী বাহিনী ৩০ হাজার মুসলিম সৈন্যের সিরিয়া অভিমুখে ছুটে আসার খবর পেয়ে ফিরে গেছে। সিরিয়ার স্থানীয় খৃস্টান গোত্ররা রোম সম্রাটকে জানিয়েছেণ দারিদ্র-তাড়িত মুসলমানরা এখন ভয়ানক দুর্দশায়, তারা যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত নয়। তাদের ধ্বংস করার এটাই উপযুক্ত সময়। কিন্তু ৩০ হাজার মুসলিম সৈন্যের দ্রুত অগ্রাভিযান তাদের খবর মিথ্যা প্রতিপন্ন করল। মুতা’র যুদ্ধের স্মৃতি তারা ভোলেনি। তাই যুদ্ধ না করে ফিরে যাওয়াই তার সমীচীন মনে করে। মহানবী (সা) সিরিয়ার খৃস্টান গোত্রগুলোকে তাদের অপরাধের জন্যে ধ্বংস করে দিতে পারতেন। কিন্তু মহানবী (সা) তাদের কিছুই বললেন না। শত্রু নয়, আত্মার আত্মীয় এরা। এমন মানুষ, এমন চরিত্র তারা দেখেনি, শোনেওনি। তাবুক অঞ্চলের বিভিন্ন খৃস্টান গোত্র দলে দলে এসে ইসলাম গ্রহণ করল। যারা ইসলাম গ্রহণ করল না, তারা বার্ষিক সামান্য কর দিয়ে মদীনার ইসলামী শাসনের অধীন হয়ে গেল।
যার কাছে সম্পদ অপেক্ষা সত্য বড়
আবদুল্লাহ মহানবীর (সা) একজন সাহাবী।
ইসলাম গ্রহণের আগে তাঁর নাম ছিল আবদুল ওজ্জা।
পিতৃহীন আবদুল ওজ্জা ছিলো বিশাল বিত্ত-বৈভবের অধিকারী। পিতৃব্যের একমাত্র উত্তরাধিকারী।
সুখের সাগরে লালিত আবদুল ওজ্জার বিয়ে হয় এক ধনী কন্যার সাথে।
মক্কায় চলছিল তখন ইসলামের দাওয়াত।
ইসলামের দাওয়াত হৃদয় জয় করে নিল আবদুল ওজ্জার। তিনি ইসলাম গ্রহণের জন্যে ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। একদিন সে পিতৃব্যের কাছে গিয়ে হাজির হয়ে ইসলাম ধর্মকে সত্য ধর্ম হিসেবে অভিহিত করে অনুরোধ জানালো পিতৃব্যকে ইসলাম গ্রহণের জন্যে। পিতৃব্যের কাছে অকল্পনীয় ছিল তার কাছে ভ্রতুষ্পুত্রের এই আহবান। ক্রোধে আগুন হয়ে উঠলেন তিনি। ভ্রতুষ্পুত্রকে ভয় দেখাবার জন্যে বলে উঠলেন, ‘তোর মত নাস্তিক আমার সম্পত্তির এক কপর্দকও পাবে না।’ উত্তরে আব্দুল ওজ্জা সসম্ভ্রমে পিতৃব্যকে বলল, ‘তার সম্পত্তি অপেক্ষা সত্য অনেক বড়।’
বলে আবদুল ওজ্জা তার দেহ থেকে বহুমূল্য পোশাক খুলে ফেললেন। ছুটে গেলেন বিধবা মাতার কাছে। বললেন মা, আমাকে লজ্জা নিবারণের মত কাপড় দাও।
তাঁর মা আবদুল ওজ্জার পিতার আমলের এক জীর্ণ কম্বল ছুড়ে দিলেন পুত্রের দিকে।
আবদুল ওজ্জা সেই কম্বল ছিঁড়ে দুই ভাগ করে একখণ্ড পরিধান করলেন, আরেক খণ্ড গায়ে চাপালেন। তারপর ছুটলেন মদীনার দিকে মহানবীর কাছে। দীর্ঘ পথ-পরিক্রমা শেষে মসজিদের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালেন আবদুল ওজ্জা। আবদুল ওজ্জার মুখের দিকে একবার তাকিয়েই সব বুঝতে পারলেন মহানবী (সা)। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি কে?
‘আমি আবদুল ওজ্জা, সত্যের সেবক ।’
মহানবী (সা) বললেন, ‘তুমি আর ওজ্জার দাস নও, তুমি আল্লাহর দাস আবদুল্লহ। যাও তুমি আত্মোৎসর্গকারী আসহাবে ছুফফার জামায়াতে প্রবেশ কর। আমার নিকট এই মসজিদেই তুমি থাকবে।’
মহানবী (সা) অপরিসীম ভালবাসতেন এই নতুন আবদুল্লাহকে।
ভাবে বিভোর আবদুল্লাহ একদিন উচ্চস্বরে কুরআন শরীফ তেলাওয়াত করতে থাকায় হযরত উমর বিরক্তি প্রকাশ করলেন। মহানবী (সা) উমর (রা)-কে লক্ষ্য করে বললেন, ‘উমর, ওকে কিছু বলো না। এই আবেগের কল্যাণেই তো সে নিজের যথাসর্বস্ব বিসর্জন দিতে সমর্থ হয়েছে।’ তাবুক অভিযানের সময় পথিমধ্যে আবদুল্লাহ ইন্তেকাল করেন।
কি সৌভাগ্য আবদুল্লাহর।
স্বয়ং হযরত আবু বকর ও হযরত উমর এগিয়ে এসে তাঁর দেহ কবরে নামাতে লাগলেন। বেলাল তুলে ধরলেন প্রদীপ। আর মহানবী (সা) ব্যাকুল কণ্ঠে তখন বলছেন, ‘সসম্ভ্রমে, সসম্ভ্রমে তোমাদের ভ্রাতাকে সসম্ভ্রমে নামাও।’
বলতে বলতে স্বয়ং মহানবী কবরে নেমে পড়লেন এবং নিজ হাতে তার দেহ কবরে স্থাপন করলেন।
‘আমি শহীদদের সাথে মিলিত হতে চললাম‘
তায়েফের সাকিফ গোত্রের প্রধান ব্যক্তি উরওয়া ইবনে মাসউদ মদীনা এলেন এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেন মহানবীর কাছে।
আরবের তৎকালীন প্রথা অনুসারে উরওয়ার অনেক স্ত্রী ছিল।
চারজনের বেশী স্ত্রী মুসলমানদের জন্যে তখন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই আদেশ জানার সাথে সাথে উরওয়া চারজন স্ত্রী রেখে অন্যদের তালাক দিয়ে দিলেন। ইসলাম গ্রহণের কয়েকদিন পর উরওয়া মহানবীর কাছে হাজির হলেন এবং বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল, আমার স্বজাতীয়রা অজ্ঞতা ও অন্ধবিশ্বাসের অন্ধকারে ডুবে আছে। আপনি অনুমতি দিলে আমি ফিরে গিয়ে তাদের কাছে সত্য দ্বীনের দাওয়াত দিতে পারি।’
তায়েফের বনি সাকিফ তখনও ইসলামের ভয়ানক বৈরী।
উরওয়ার আবেদন শুনে মহানবী (সা) বললেন, ‘উরওয়া, সে তো ভাল কথা। কিন্তু আমার আশংকা হচ্ছে, তোমার স্বজাতিরা তোমাকে হত্যা করবে।’
উরওয়া বললেন, ‘আমার স্বজনরা আমাকে খুবই ভালবাসে।’
উরওয়া তায়েফ ফিরলেন।
এখন উরওয়া আগের সেই উরওয়া নেই। সে এখন সত্যের সৈনিক, আল্লাহর সৈনিক।
সত্যের প্রতি মানুষকে আহবান করার কাজ তিনি শুরু করলেন নির্ভীকভাবে, নিরলসভাবে।
অতি অল্প সময়ের মধ্যে উরওয়ার স্বজন-স্বজাতীয়রা উরওয়ার জান-দুশমনে পরিণত হলো। নিপীড়ন-নির্যাতন নেমে এল তাঁর উপর।
এমনকি নিজ বাড়ীতেও উরওয়ার পক্ষে একটু শান্তিতে-স্বস্তিতে থাকা কঠিন হয়ে দাঁড়াল।
একদিন উরওয়া তাঁর নিজ বাড়ির জানালায় দাড়িয়ে আল্লাহর প্রশংসা কীর্তন করছিলেন। লোকরা এসে তাঁকে চারদিকে থেকে ঘিরে দাঁড়াল। শুরু হলো উরওয়ার প্রতি তীর ও পাথর বর্ষণ।
তীর ও পাথরের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে উঠল উরওয়ার দেহ। কিন্তু উরওয়ার মুখ মুহূর্তের জন্যেও বন্ধ হয়নি আল্লাহর প্রশংসা কীর্তন থেকে।
একটা তীর এসে উরওয়ার বক্ষ ভেদ করল। উরওয়ার মুখে উচ্চকণ্ঠে ধ্বনিত হলো ‘আল্লাহু আকবর।’ তার মুখে আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি শেষ হবার সাথে সাথে উরওয়ার রক্তরঞ্জিত দেহ লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। তাঁর স্বজনরা মুমূর্ষূ উরুওয়ার কাছে এসে বিদ্রুপ কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল, ‘এখন কেমন বুঝছ?’ উরওয়া উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, “সত্যের সেবায় ও দেশবাসীর কল্যাণে যে রক্ত উৎসর্গ করা হয়, তা শুভ এবং পুণ্যময়। আল্লাহ আমাকে এই সৌভাগ্যের অধিকারী করেছেন, সত্যের সেবায় জীবন দিয়ে আমি শহীদদের সাথে মিলিত হবার জন্যে চললাম।”
উরওয়ার কণ্ঠে নীরব হলো। সেই সাথে পরম আকাঙ্কখিত শহীদী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন উরওয়া।
ভয়ংকর ছোমামা মহানবীর অতিথি হলো
বনু হানিফা আরবের একটা বিখ্যাত গোত্র। মক্কা ও ইয়েমেনের মধ্যপথ ইয়ামামায় তাদের বাস। একটা অভিযানকালে বনু হানিফার একজন প্রধান ব্যাক্তি ছোমামা ইবনে ওছাল মুসলমানদের হাতে বন্দী হলেন।
তাকে আনা হল মদীনায়।
খুব বিপজ্জনক বন্দী ছোমামা।
তাকে মসজিদের একটা থামে বেঁধে রাখা হয়েছে।
খবর পাওয়ার পর মহানবী (সা) তার কাছে এলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ছোমামা, তোমার প্রতি কিরূপ ব্যবহার করা হবে বলে মনে করছ?’ ছোমামা উত্তরে বলল, “ভালই মনে করছি। আমি খুনের অপরাধী, আপনি ইচ্ছা করলে আমাকে হত্যা করতে পারেন। তবে আপনার কাছে আমি প্রতিশোধের বদলে ক্ষমা লাভ করার আশ করি। আপনি দেখবেন, আমি কত কৃতজ্ঞ, কত ভদ্র। আর বিনিময় হিসাবে অর্থ গ্রহণ করতে চাইলে বলুন, যা চাইবেন দিতে প্রস্তুত আছি।’ কোন প্রতিশ্রুতি না দিয়ে মহানবী (সা) তাকে নিজের মেহমান হিসাবে গ্রহণ করলেন এবং নিজ বাড়ীতে নিয়ে গেলেন। রাতে মহানবী (সা) ছোমামাকে খাবার দিলেন। মহানবীর পরিবারের সব খাবার সে একাই শেষ করল। পরদিন সকালে মহানবী (সা) তাকে বললেন, ‘ছোমামা, আমি তোমাকে ক্ষমা করলাম, তুমি এখন মুক্ত।’
মুক্তির এই বার্তা পেয়েই মসজিদের নিকটস্থ ক্ষুদ্র জলাশয়টিতে গোসল করল ছোমামা। তারপর মহানবীর (সা) খেদমতে হাজির হয়ে উচ্চস্বরে কলেমায়ে শাহাদাত পাঠ করে সত্য ধর্মে প্রবেশ করলেন। কিছুদিন মদীনায় অবস্থানের পর ছোমামা ফিরে গেলেন তাঁর স্বদেশে। তাঁর একক প্রচারেই অল্পকালের মধ্যে বনু হানিফার সকল মানুষ ইসলামে দীক্ষিত হলো।
ব্যবসা করতে গিয়ে হলেন মিশনারী
তারিক ইবনে আবদুল্লাহর একটি স্মৃতি কথা : “ আমি একদিন মক্কার ‘মাজাজ’ নামক বাজারে দাঁড়িয়ে আছি। এমন সময় দেখলাম, একজন অত্যন্ত প্রিয়-দর্শন লোক বাজারের চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছেন আর বলছেন, ‘হে মানব সকল, তোমরা বল আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়। তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তাহলে তোমরা সফলকাম হতে পারবে।
এই সঙ্গেই দেখলাম, আর একটা লোক তাঁর পশ্চাতে পশ্চাতে ঘুরছেন আর বলে বেড়াচ্ছেন, ‘খবরদার, কেউ এর কথা শুনোনা। এ একটা ভয়ংকর যাদুকর, মস্ত একটা মিথ্যাবাদী।’ এইসব কথা বলার সাথে সাথে পেছনের লোকটা তাঁকে পাথর ছুড়ে মারছেন।
আমি জিজ্ঞাসা করলে আমার সাথের একজন বয়স্ক লোক বললেন, প্রথম লোকটি হাশেম বংশের। তিনি নিজেকে আল্লাহর প্রেরিত রাসূল বলে মনে করেন। আর দ্বিতীয় লোকটি তাঁর চাচা আবদুল ওজ্জা- আবু লাহাব।
এই ঘটনার অনেক বছর পরের কথা।
মদীনার বাইরে একটা খোরমা বাগানে আমরা বিশ্রাম নিচ্ছি। আমরা খেজুর কিনতে মদীনায় এসেছি। আমরা যখন বাগানে বিশ্রামরত, তখন একজন লোক এসে আমাদের সালাম দিল। তাঁর পরনে তহবন্দ এবং গায়ে চাদর। তিনি আমাদের পরিচয় জিজ্ঞাসা করলেন। তাঁর কণ্ঠ খুবই মধুর। আমাদের সাথে একটা লাল রঙের উট ছিল। পরিচয় জিজ্ঞাসার পর তিনি লাল উটটি আমরা বিক্রি করব কিনা, কত দাম জিজ্ঞাসা করলেন।
বললাম, এত মণ খেজুর পেলে উটটা আমরা বিক্রি করতে পারি।
তিনি কোন প্রকার দর-কষাকষি না করে আমাদের দাবীকৃত মূল্যে উট কিনতে রাজী হলেন এবং উটের দড়ি ধরে টেনে উট নিয়ে চললেন নগরীর দিকে। তিনি চলে যাবার পর আমাদের চেতনা হলো যে, একি করলাম আমরা? দাম না নিয়ে একজন অপরিচিত লোককে উট নিয়ে যেতে দিলাম। আমাদের সাথে একজন বৃদ্ধ ছিলেন। তিনি বললেন, ‘চিন্তা করো না। লোকটার মুখ পূর্ণ চন্দ্রের ন্যায় স্বর্গীয় সুষমায় উদ্ভাসিত। এমন লোক কখনই প্রবঞ্চক হতে পারে না। তোমরা নিশ্চিন্ত থাক, টাকার জন্যে আমি দায়ী রইলাম।’
অল্প কিছুক্ষণ পর নগরীর দিক থেকে একজন লোক আমাদের কাছে এলেন। তাঁর সাথে প্রচুর খেজুর । তিনি আমাদের বললেন ,”আমি রাসুলুল্লাহর নিকট থেকে এসেছি। উটের মূল্য বাবদ এই খেজুর তিনি পাঠিয়েছেন । ওজন করে নিন। আর কিছু খেজুর তিনি পাঠিয়েছেন উপঢৌকন স্বরূপ আপনাদের খাওযার জন্যে। আপনারা গ্রহণ করলে তিনি খুশী হবেন।’
যথাসময়ে আমরা মদীনা প্রবেশ করলাম। পৌঁছলাম আমরা মসজিদে নববীর সামনে। দেখলাম সেই লোকটি মসজিদের মিম্বারে বসে লোকদের উদ্দেশ্যে কথা বলছেন। আমরা শেষের এই কয়টি কথা শুনতে পেয়েছিলাম, ‘হে লোক সকল, অভাবগ্রস্ত ও কাঙ্গালদের দান কর। তোমাদের জন্যে এটা বিশেষ কল্যাণকর। স্মরণ রেখ, উপরের (দাতার) হাত নিম্নের (গ্রহীতার) হাত অপেক্ষা উত্তম। পিতা-মাতা ও অন্যান্য স্বজনদের প্রতিপালন কর।’
আমরা কয়েকদিন মদীনায় থাকলাম। আমরা সবাই ইসলাম গ্রহণ করে দেশে ফিরে এলাম। গিয়েছিলাম মদীনায় ব্যবসায়ী হয়ে, ফিরে এলাম দেশে ইসলামের প্রচারক হয়ে।