মহাগ্রন্থ আল – কোরআন কি ও কেন
আবুল কালাম মুহাম্মাদ ইউসুফ (মোমতাজুল মোহাদ্দেছিন)
স্ক্যান কপি ডাউনলোড
লেখকের আরজ
বর্বর, বেদুইন, যাযাবর, শিক্ষা ও তামাদ্দুনের আলো হতে বঞ্চিত একটি জাতি মাত্র অর্ধ শতাব্দীর কম সময়ের ভিতরে পৃথিবীর বৃহত্তম শক্তিদ্বয়কে পর্যুদস্ত ও পরাভূত করে কি করে অর্ধপৃথিবী জয় করে ফেলল? কি করে তাঁরা এই স্বল্পকালীন সময়ের ভিতর মানব সভ্যতার উপরে এক স্থায়ী ও অক্ষয় ছাপ রেখে গেল? সে কথা ভেবে ভেবে আজও ঐতিহাসিকদের পেরেশানীর অন্ত নেই। তাঁরা ভাবতেই পারে না যে, এমন কোন্ মহাশক্তির যাদু লেগেছিল, যার ফলে আরব- মুসলমানরা সারা পৃথিবীতে এক প্রলয়কান্ড ঘটিয়ে দিয়েছিল। মহাগ্রন্থ আল-কোরআনের মহাশক্তিই যে আরব- মুসলমানদের এ সফলতার পিছনে মূল শক্তি হিসেবে ক্রিয়াশীল ছিল, তা বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ও চিন্তাবিদদের অনেকেই অম্লান বদনে স্বীকার করেছেন।
প্রসিদ্ধ পাশ্চাত্য পন্ডিত ইমানুয়েল ডুয়েৎচ বলেছেন, “পৃথিবীর প্রধান প্রধান ধর্মসমূহের মধ্যে কোরআন যে একটি বিশেষ মর্যাদার অধিকারী তা স্বীকার করতেই হবে। এ ধরনের যুগান্তকারী সাহিত্যের মধ্যে কোরআন সর্বকনিষ্ঠ বটে; তবে জনসাধারনের উপর প্রভাব বিস্তারে তা কারও অপেক্ষা ন্যুন নহে। কোরআন মানবীয় চিন্তাধারার যেমন এক নতুন ভাবের সৃষ্টি করেছে, তেমনি সৃষ্টি করেছে এক নতুন চরিত্রের। উহা আরব উপদ্বীপের মরুচারী কতগুলি পরস্পর বিরোধী গোষ্ঠিকে এক সুমহান বীর জাতিতে পরিনত করেছে”।
কোরআন নাযিলের পর থেকে আরম্ভ করে দুনিয়ার বিভিন্ন ভাষায় কোরানের উপর অসংখ্য গবেষণামূলক গ্রন্থ রচিত হয়েছে। কিন্তু আমাদের মাতৃভাষা বাংলাতে এ ধরনের গবেষণামূলক পুস্তকের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। তাই বাংলা ভাষা- ভাষী মুসলিম ভাই-বোনদের খেদমতে পবিত্র কোরানের উপর গবেষণামূলক আমার এ ক্ষুদ্র পুস্তিকাখানি পেশ করছি।
ইতিমধ্যে এর দ্বাদশ সংস্করণ শেষ হয়েছে। ত্রয়োদশ সংস্করণ বের করতে পেরে মহান রাব্বুল আলামীনের শুকরিয়া আদায় করছি।
-আবুল কালাম মুহাম্মদ ইউসুফ
কোরআনের পরিচয়
কোরআন আল্লাহ্র নাযিলকৃত ঐ কিতাবকে বলা হয়, যা তিনি তাঁর শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)- এর উপরে দীর্ঘ তেইশ বৎসর কালব্যাপী বিভিন্ন পর্যায়, প্রয়োজন মোতাবেক অল্প অল্প করে অবতীর্ণ করেছিলেন। ভাষা এবং ভাব উভয় দিক হতেই কোরআন আল্লাহ্র কিতাব। অর্থাৎ কোরআনের ভাব (অর্থ) যেমন আল্লাহ্র তরফ হতে আগত তেমনি তাঁর ভাষাও।
কোরআন নাযিলের কারণ
নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল ভক্ষণের পরে আদম (আঃ) ও হাওয়া (আঃ) কে বেহেশত হতে দুনিয়ায় পাঠানোর প্রাক্কালে তায়ালা বলে দিয়েছিলেন যে,
قُلْنَا اهْبِطُوا مِنْهَا جَمِيعًا ۖ فَإِمَّا يَأْتِيَنَّكُم مِّنِّي هُدًى فَمَن تَبِعَ هُدَايَ فَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ ﴿٣٨﴾ وَالَّذِينَ كَفَرُوا وَكَذَّبُوا بِآيَاتِنَا أُولَـٰئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ ۖ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ
“তোমরা সকলেই এখান হতে নেমে পড়। অতঃপর তোমাদের কাছে আমার পক্ষ হতে জীবন বিধান যেতে থাকবে। পরন্তু যারা আমার জীবন বিধান অনুসারে চলবে, তাঁদের ভয় ও চিন্তার কোন কারণ থাকবেনা। (অর্থাৎ দুনিয়ার জীবনের সমাপ্তিতে তাঁরা আবার অনন্ত সুখের আধার এ বেহেশতেই ফিরে আসবে)। আর যারা তা অস্বীকার করে আমার নিদর্শন সমুহকে মিথ্যা সাব্যস্ত করবে, তাঁরা হবে জাহান্নামের অধিবাসী এবং সেখানে তাঁরা অনন্তকাল থাকবে”। (সূরা বাকারা, আয়াত নং ৩৮-৩৯)
আল্লাহ্ তায়ালার উক্ত ঘোষণা মোতাবেকই যুগে যুগে আদম সন্ততির কাছে আল্লাহ্র তরফ হতে হেদায়েত বা জীবন বিধান এসেছে। এই জীবন বিধানেরই অন্য নাম কিতাবুল্লাহ। যখনই কোন মানবগোষ্ঠী আল্লাহ্র পথকে বাদ দিয়ে নিজেদের মন গড়া ভ্রান্ত পথে চলতে থাকে, তখনই কিতাব নাযিল করে আল্লাহ্ মানুষকে সঠিক পথের সন্ধান দিয়ে থাকেন।
কিতাব নাযিলের ব্যাপারে আল্লাহ্ তায়ালার চিরন্তন নীতি হল এই যে, তিনি যখন কোন জাতির জন্য কিতাব নাযিলের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন, তখনই সেই জাতির মধ্য থেকে মানবীয় গুনের অধিকারী সর্বোৎকৃষ্ট লোক্টিকে পয়গাম্বর হিসেবে বাছাই করে নেন, অতঃপর ওয়াহীর মাধ্যমে তাঁর উপরে কিতাব নাযিল করে থাকেন।
মানব সৃষ্টির সুচনা হতে দুনিয়ায় যেমন অসংখ্য নবী-রাসুল এসেছেন, তেমনি তাঁদের উপরে নাযিলকৃত কিতাবের সংখ্যাও অগণিত। নবীদের মধ্যে হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) যেমন সর্বশেষ নবী, তেমনি তাঁর উপরে নাযিলকৃত কোরআনও আল্লাহ্র সর্বশেষ কিতাব। অতঃপর দুনিয়ায় আর কোন নতুন নবীও আসবে না এবং কোন কিতাবও অবতীর্ন হবে না।
কোরআনের আলোচ্য বিষয় ও উদ্দেশ্য
কোরআনের আলোচ্য বিষয় হল, মানব জাতি। কেননা মানব জাতির প্রকৃত কল্যাণ ও অকল্যাণের সঠিক পরিচয়ই কোরআনে দান করা হয়েছে। কোরআনের উদ্দেশ্য হল মানব জাতিকে খোদা প্রদত্ত জীবন ব্যবস্থার দিকে পথ প্রদর্শন, যাতে দুনিয়ায়ও নিজের জীবনকে কল্যাণময় করতে পারে এবং পরকালেও শান্তিময় জীবনের অধিকারী হতে পারে।
ওয়াহীর সূচনা কিভাবে হয়েছিল
বোখারী শরীফে হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে একটি হাদীস বর্ণিত আছে। তাতে বর্ণনা করা হয়েছে যে, “ওয়াহীর সূচনা এভাবে হয়েছিল যে, হুজুর ঘুমের ঘোরে এমন বাস্তব স্বপ্ন দেখতে থাকেন যা উজ্জ্বল প্রভাতের ন্যায় বাস্তবায়িত হতে থাকে’। অতঃপর হুজুরের নিকটে নির্জনবাস আকর্ষনীয় অনুভূত হল এবং তিনি হেরা গুহায় নির্জনবাস শুরু করে দিলেন। এখানে তিনি একাধিক রাত্রি কাটিয়া দিতেন এবং প্রয়োজনীয় খাদ্য পানীয় ও জরুরী সামগ্রী সাথে নিয়ে যেতেন। তা ফুরিয়ে গেলে আবার ফিরে এসে খাদীজার(রাঃ) নিকট হতে তা নিয়ে গুহায় ফিরে যেতেন। এভাবেই এক শুভক্ষনে হেরায় ধ্যানমগ্ন অবস্থায় তাঁর কাছে হকের(ওয়াহীর) আগমন ঘটল। ফিরিশতা (জিবরাইল আমিন) এসে তাঁকে বললেন, আপনি পড়ুন। (হুজুর বলেন) আমি বললাম, আমি পাঠক নই। হুজুর বলেন, অতঃপর ফিরিশতা আমাকে বগলে দাবিয়ে ছেড়ে দিলেন। ফলে আমি খুব ক্লান্তি বোধ করতে থাকলাম। আবার তিনি আমাকে পড়তে বললেন এবং আমি একই জওয়াব দিলাম। তিনি আবার আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ছেড়ে দিলেন। এভাবে তিনি তিনবার করলেন এবং তিনবারই হুজুর একই জওয়াব দিলেন। অতঃপর ফিরিশতা পাঠ করলেন,
اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ ﴿١﴾ خَلَقَ الْإِنسَانَ مِنْ عَلَقٍ ﴿٢﴾ اقْرَأْ وَرَبُّكَ الْأَكْرَمُ ﴿٣﴾ الَّذِي عَلَّمَ بِالْقَلَمِ ﴿٤﴾ عَلَّمَ الْإِنسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ ﴿٥﴾
“তুমি পাঠ কর তোমার সেই প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন যিনি সৃষ্টি করেছেন মানব জাতিকে ঘনীভূত রক্ত বিন্দু হতে। তুমি পাঠ কর তোমার সেই মহিমান্বিত প্রভুর নামে যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। যিনি মানব জাতিকে শিখিয়ে দিয়েছেন যা সে জানত না”। (সুরা আলাকঃ ১-৫)
অতঃপর হুজুর উক্ত আয়াতসমুহ নিয়ে কম্পিত হৃদয়ে বাড়ি ফিরলেন। আর খাদীজার (রাঃ) ঘরে প্রবেশ করে বললেন, ‘আমাকে কম্বল দিয়ে ঢেকে দাও’। এভাবে কম্বল দিয়ে ঢেকে দেয়ার কিছুক্ষন পর তার অস্থিরতা কেটে গেল। তিনি হযরত খাদীজাকে আদ্যোপান্ত সমস্ত ঘটনা শুনালেন এবং বললেন, আমার নিজের জীবন সম্পর্কেই আমার ভয় হচ্ছে। হযরত খাদীজা তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, “আল্লাহর শপথ, আল্লাহ কিছুতেই আপনার কোন অনিষ্ট করবেন না। কেননা আপনি আত্নীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করেন, দরিদ্র ও নিরন্নকে সাহায্য করেন, অতিথির সেবা করেন এবং উত্তম কাজের সাহায্য করেন”। অতঃপর হযরত খাদীজা হুজুরকে নিয়ে তার চাচাত ভাই আরাকা বিন নওফেলের কাছে গেলেন। তিনি জাহেলিয়াতে ঈসায়ী ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং ইবরাণী ভাষা জানতেন। আর ইঞ্জিল হতে উক্ত ভাষায় যা ইচ্ছা নকল করতে পারতেন। তিনি খুবই বৃদ্ধ ছিলেন এবং দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন। খাদীজা তাঁকে সম্বোধন করে বললেন, ভাই আপনি আপনার ভাইপোর ঘটনা শুনুন, আরাকা সব ঘটনা শুনে বললেন, “এতো সেই ফিরিশতা যিনি হযরত মুসার (আঃ) কাছে এসেছিলেন। আফসোস! তোমার লোকেরা তোমাকে যখন দেশ থেকে বের করে দিবে, তখন যদি আমি জীবিত থাকতাম!” হুজুর বললেন, তাহলে কি তারা আমাকে বের করে দিবে? আরাকা বললেন, হ্যাঁ, তুমি যা পেয়েছ ইহা যে যে পেয়েছে তার সাথে অনুরুপ ব্যবহার করা হয়েছে। আমি যদি ঐ দিন জীবিত থাকি, তাহলে তোমাকে সাধ্যমত সাহায্য করব। অতঃপর পুনরায় ওয়াহী নাযিলের আগেই আরাকা ইন্তেকাল করেন।
উপরোক্ত ঘটনাটি যেদিন ঘটে সেদিন ছিল ১৭ই রমজান সোমবার। হুজুরের বয়স ছিল তখন চল্লিশ বছর ছয় মাস আট দিন। অর্থাৎ ৬ই আগস্ট ৬১০ খৃস্টাব্দ।
ওয়াহী কিভাবে নাযিল হত
হুজুরের উপর যখন ওয়াহী অবতীর্ন হত তখন হুজুরের ভিতরে এক বিশেষ অবস্থার সৃষ্টি হত। চেহারা মোবারক উজ্জ্বল ও রক্তবর্ন হয়ে যেত, কপালে ঘাম দেখা দিত, নিঃশ্বাস ঘন হয়ে যেত এবং শরীর অত্যধিক ভারী হয়ে যেত। এমন কি উটের পিঠে ছওয়ার অবস্থায় যখন ওয়াহী নাযিল হত, তখন অত্যধিক ভারে উট চলতে অপারগ হয়ে মাটিতে বসে যেত।
ওয়াহী নাযিলের সময় কেন এমন অবস্থা হত, এর কারন স্বরূপ বলা চলে যে, নবীগন ছোট বড় সব রকমের গোনাহ হতে পবিত্র থাকার ফলে তাদের স্বভাবে ফিরিশতা স্বভাবের আধিক্য থাকলেও তারা মানবীয় স্বভাবের উর্ধে নন। ফলে আল্লাহ তাঁর পবিত্র কালাম নাযিল হবার পুর্ব মুহুর্তে তাদেরকে এমন এক বিশেষ নুরানী অবস্থায় নিয়ে যেতেন, যেখানে তাদের কল্ব মানবীয় সবটুকু বৈশিষ্ট হারিয়ে ফিরিশতা স্বভাবে রুপান্তরিত হত এবং আল্লাহর অনুগ্রহের নূর তাহাদের অন্তর- আত্নাকে মোহিত করে ফেলত। ফলে এক নীরব ও প্রশান্তিময় পরিবেশে আল্লাহ তাঁর কালাম নবীদের উপরে নাযিল করতেন। কেননা আল্লাহর পবিত্র কালাম পুর্ন মনোনিবেশ সহকারে শুনা, উহা অন্তরে গেঁথে রাখা এবং উহার প্রকৃত মর্ম হৃদয়-মন দিয়ে অনুধাবন করার জন্য উপরোক্ত বিশেষ অবস্থায় নবীদেরকে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন হত।
এভাবে যখন ওয়াহী নাযিল হওয়া সমাপ্ত হত, তখন উপরোক্ত অবস্থা কেটে যেত এবং হুজুর পুর্বাবস্থায় ফিরে আসতেন। আর নাযিলকৃত কালাম ছাহাবাদেরকে তেলাওয়াত করে শুনাতেন।
ওয়াহি কিভাবে নাযিল হত সে সম্পর্কে হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে নিম্নলিখিত মর্মে একটি হাদীস বর্ণিত আছে,
“হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, একদা হারিস-বিন হিসাম হুজুরকে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রসূল, আপনার উপরে ওয়াহী কিরূপে নাযিল হয়? হুজুর বললেন, কখনও কখনও ওয়াহীর আওয়াজ আমার অন্তরে ঘন্টা ধ্বনির ন্যায় ধ্বনিত হতে থাকে, ওয়াহীর এই ধরনটাই আমার জন্য খুব কঠিন হয় এবং আমি ক্লান্তি বোধ করতে থাকি। অতঃপর উহা আমার অন্তরে বিঁধে যায়। আবার কখনও ফিরিশতা মানুষের আকৃতিতে আসেন এবং আমার সাথে কালাম করেন (ওয়াহী নাযিল করেন)। আর আমি মনে গেঁথে নেই। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, অত্যধিক শীতের সময়ও যখন ওয়াহী নাযিল হত, হুজুরের শরীরে তাপ সঞ্চয় হত এবং তাঁহার চেহারা মোবারকে ঘাম দেখা দিত”।
উপরোক্ত দুই ধরনের বাইরেও কখনও কখনও আল্লাহ কোন মাধ্যম ব্যতিরেকেই সরাসরি পর্দার আড়াল হতে নবীদের সাথে কথা বলেছেন।
বুখারী শরীফের ওয়াহী সম্পর্কীয় হাদীসের ব্যাখ্যায় আল্লামা আইনী তাঁর গ্রন্থে ওয়াহীর বিভাগ সম্পর্কে নিম্নরূপ ব্যাখ্যা দিয়েছেন,
(১) আল্লাহ কোন প্রকার মাধ্যম ছাড়াই সরাসরি কথা বলতেন। যেমন পবিত্র কোরআন এবং বিশুদ্ধ হাদীসের বর্ণনায় জানা যায় যে, হযরত মুসা (আঃ) এবং হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সাথে আল্লাহ এ ধরনের কথোপকথন করেছেন।
(২) কোন ফিরিশতা পাঠিয়ে তাঁর মাধ্যমে ওয়াহী নাযিল করতেন।
(৩) অন্তরে ওয়াহীর শব্দসমূহ ধ্বনিত করে বিঁধে দিতেন। যেমন হুজুর বলেছেনঃ “পবিত্র ফিরিশতা আমার অন্তরে দম করে দিয়েছেন”। হযরত দাউদের (আঃ) উপরে তৃতীয় ধরনের ওয়াহী নাযিল হত।
কোরআন নাযিল হওয়ার পদ্ধতি
কোরআনকে বুঝা এবং তাকে হৃদয়ঙ্গম করার নিমিত্তে কোরআন নাযিল হওয়ার পদ্ধতি অনুধাবন করা অপরিহার্য। মনে রাখা দরকার যে, কোরআন গ্রন্থাকারে একই সময় নবী করীমের (সাঃ) উপরে অবতীর্ণ হয়নি। বরং যে বিপ্লবী আন্দোলন পরিচালনার দায়িত্ব নবী (সাঃ) এবং তাঁর আত্নোৎসর্গিত সাথীদের উপরে আল্লাহ চাপিয়ে ছিলেন, সেই আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে অল্প অল্প করে প্রয়োজনানুসারে পূর্ন তেইশ বছর কালব্যাপী অবতীর্ন হয়েছে। হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) চল্লিশ বছর বয়সে নবুয়ত প্রাপ্ত হন এবং পূর্ণ তেইশ বছর কাল নবী হিসেবে খোদা প্রদত্ত দায়ীত্ব পালন করে তেষট্টি বছর বয়সে দুনিয়া ত্যাগ করেন। এই সুদীর্ঘ তেইশ বছর কালব্যাপী বিভিন্ন পর্যায়ে কোরআনের বিভিন্ন অংশ আল্লাহর রাসুলের প্রতি অবতীর্ন হতে থাকে।
মক্কী-মাদানী
নবুয়াত প্রাপ্তির পরে হযরত (সাঃ) তের বৎসর কাল মক্কা শরীফে অবস্থান করেন এবং মক্কা ও উহার পার্শ্ববর্তী এলাকায় ইসলামের দাওয়াত দিতে থাকেন। মক্কায় অবস্থানকালীন এই দীর্ঘ তের বছরে যে সব সূরা নবীর (সাঃ) উপরে অবতীর্ন হয়েছে তাঁকে বলা হয় মক্কী সূরা।
অতঃপর আল্লাহর নবী মদীনা শরীফে হিজরত করেন এবং দীর্ঘ দশ বছরকাল মদীনায় অবস্থান করে ইসলামকে একটি জীবন্ত- বিধান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে পরকালের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। মদীনায় অবস্থানকালীন এই দশ বছর কালব্যাপী কোরআন মজীদের যে সব সূরা হযরতের (সাঃ) উপরে অবতীর্ন হয়েছে উহাকে বলা হয় মাদানী সুরা।
মক্কী সুরাসমুহের বৈশিষ্ট্য
ইসলামী দাওয়াত সূচনায় মক্কা শরীফে নবী করীমের (সাঃ) উপরে যে সব সূরা অবতীর্ন হয়েছে তাঁর অধিকাংশ ছিল আকারে ছোট, অথচ অত্যন্ত প্রভাব বিস্তারকারী। সাধারনত ইসলামের মৌলিক আকীদা-বিশ্বাস সম্পর্কীয় বিষয়সমুহ, যেমন- তওহীদ, রেসালাত, আখেরাত ইত্যাদি বিষয়ের ইহাতে যেমন আলোচনা করা হয়েছে, তেমনি শিরক, কুফরী, নাস্তিকতা পরকাল অস্বীকৃতি প্রভৃতি আকীদা সম্পর্কীয় প্রধান প্রধান পাপ কার্যেরও উহাতে বর্ণনা দান করা হয়েছে। অতীতে যে সব জাতি নবীর দাওয়াতে সাড়া দিয়ে পরকালে বিশ্বাস স্থাপন করত একমাত্র আল্লাহ্ প্রদত্ত দ্বীন অনুসারে চলে দুনিয়ায়ও অশেষ কল্যাণ লাভ করেছে এবং পরকালেও অনন্ত সুখের অধিকারী হবে, তাদের সম্পর্কে যেমন ইহাতে আলোচনা করা হয়েছে, তেমনি আলোচনা করা হয়েছে সেই সমস্ত ভাগ্যহীনদের সম্পর্কে যারা নবীর দাওয়াতকে অস্বীকার করে আল্লাহ্র দ্বীনকে প্রত্যাখ্যান করে দুনিয়ায়ও ধ্বংস হয়েছে এবং পরকালেও চরম শাস্তি ভোগ করবে। আর এই ঘটনাগুলি বর্ণনা করা হয়েছে উহা হতে উপদেশ গ্রহন করার জন্য, ইতিহাস আলোচনার জন্য নয়।
এ ছাড়াও মক্কী সূরা সমূহে রসুল (সাঃ) এবং তাঁর মুষ্টিমেয় সাথীদেরকে কাফির ও মুশরিকদের অবিরাম নির্যাতনের মুখে যেমন ধৈর্য ধারন করার নছিহত করা হয়েছে, তেমনি কাফির মুশরিকদেরও তাদের হঠকারিতা ও বাড়াবাড়ির ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে।
মাদানী সূরার বৈশিষ্ট্য
মহানবীর (সাঃ) মাদানী জীবনের সূচনা হয় নবূয়তের তের বছর পরে। মক্কা শরীফে রসুলের দাওয়াতে যারা ইসলাম কবুল করেছিলেন, তারা যেমন ছিলেন প্রভাবহীন তেমনি ছিলেন সংখ্যায় নগন্য। কোরায়েশ এবং মক্কার পার্শবর্তী গোত্রসমূহের নেতৃস্থানীয় লোকেরা ছিল রসুলের দাওয়াতের ঘোরতর বিরোধী।
ফলে মুসলমানদের সেখানে কুফরী প্রভাবের অধীনে যথেষ্ট নির্যাতিত জীবন –যাপন করতে হয়েছে। কিন্তু মদীনার অবস্থা ছিল ইহার সম্পূর্ণ বিপরীত। মদীনায় দুটি প্রভাবশালী গোত্র ‘আওস’ ও ‘খাজরাজের’ নেতৃস্থানীয় লোকেরা ইতিপুর্বে হজ্জ উপলক্ষে মক্কায় এসে রসুলের কাছে ইসলাম গ্রহন করে গিয়েছিলেন। আর তাদেরই অনুসরনে গোত্রের প্রায় সব লোকেরাই ইসলাম কবুল করে ফেলেছিলেন।
অতঃপর নবুয়তের ত্রয়োদশ বর্ষে হুজুর যখন তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে মদীনায় হিজরত করলেন, তখন তিনি দেখতে পেলেন যে, মদীনার প্রভাবশালী নেতা এবং তাদের অনুসারীরা শুধু হুজুরের দ্বীনই কবুল করেননি, উপরন্তু তাঁরা তাদের এলাকাটাও হুজুরের নিয়ন্ত্রনে ছেড়ে দিতে প্রস্তুত। ফলে ইসলামের যাবতীয় বিধানাবলী কার্যকর করার ব্যাপারে বাহিরের হস্তক্ষেপ ব্যাতিত ভিতরের দিক থেকে আর তাঁকে কোন প্রতিবন্ধকতার মোকাবিলা করতে হবে না। মদীনায় ইহুদীদের যে দুটি গত্র বাস করত, ইতিপুর্বে রসুল (সাঃ) তাদেরকে সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ করে ফেলেছিলেন।
সুতরাং আল্লাহ্র নবী কালবিলম্ব না করে ইসলামকে পূর্নাংগ রূপ দেয়ার নিমিত্ত ছোট অথচ সম্ভাবনাময় একটি ইসলামী রাষ্ট্রের বুনিয়াদ স্থাপন করলেন। এখন প্রয়োজন ছিল এই রাষ্ট্রের পরিচালনার জন্য যাবতীয় বিধি- ব্যবস্থার। উহাই পর্যায়ক্রমে মাদানী সূরাসমূহের মাধ্যমে নবীর জীবনের বাকী দশ বছরে অবতীর্ণ হতে থাকে।
রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালনা সম্পর্কীয় যাবতীয় মৌলিক আইন যেমন ফৌজদারী কানুন, উত্তরাধিকার সম্পর্কীয় আইন, বিবাহ- তালাক সম্পর্কীয় বিধি ব্যবস্থা, যাকাত- ওশর প্রভৃতি অর্থনৈতিক বিধান এবং যুদ্ধ- সন্ধি সম্পর্কীয় হুকুম- আহকাম হল মাদানী সূরাসমূহের প্রধান আলোচ্য বিষয়।
মক্কায় কোন ইহুদি গোত্র বাস করতোনা আর মুনাফিকদেরও (সুবিধাবাদী শ্রেণী) কোন সংগঠিত দল তথায় ছিলনা। ফলে মক্কী সূরা সমূহে এদের সম্পর্কে বিশেষ কোন আলোচনা দেখা যায় না। কিন্তু মদীনায় এ দুটি শ্রেণীই ছিল এবং বাহ্যিক দিক দিয়ে এরা মুসলমানদের শুভাকাঙ্ক্ষী বলে নিজেদেরকে জাহির করলেও ভিতরে ভিতরে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। ফলে আল্লাহ্ মাদানী সূরাসমূহের মাধ্যমেই এদের কুটিল ষড়যন্ত্রের কথা নবীকে জানিয়ে দেন এবং ইহুদী ও মোনাফেকদের তাদের জঘন্য পরিণাম সম্পর্কে সাবধান করে দেন।