কোরআনের ঐশী গ্রন্থ হওয়ার কয়েকটি অকাট্য প্রমাণ
পবিত্র কোরআন যে আল্লাহ তায়ালারই বাণী এবয় এই ধরনের কিতাব যে মানুষের পক্ষে তৈরী করা আদৌ সম্ভব নয় এর অসংখ্য প্রমাণ স্বয়ং কোরআনেই বর্তমান। নিম্নে তা হতে কয়েকটি উদ্ধৃত হচ্ছে:
এক: কোরআনের ভাষাগত ও সাহিত্যিক মান
কোরআনের ভাষাগত ও সাহিত্যিক মান অত্যন্ত উচ্চাঙ্গের। এর ভাষা যেমন- স্বচ্ছ, তেমনি এর বাক্য বিন্যাসও অত্যন্ত নিখুঁত ও অভিনব। নবী করীম (সঃ) যখন কোরআন তেলাওয়াত করতেন, তখন এর ঝংকার ও সুরমাধুরী তাঁর সমভাষীদের মন মগজকে মোহিত করে তুলত। তারা বাস্তবভাবে উপলব্ধি করত যে, এ কালাম কিছুতেই মানুষের পক্ষে রচনা করা সম্ভন নয় তা সে আরবী সাহিত্যের যত বড় পন্ডিতই হোক না কেন। যদিও পূর্ব পুরুষের অন্ধ অনুকরণ, গোত্রীয় অহমিকা ও সংকীর্ণ স্বার্থবোধ কোরআনকে হক বলে গ্রহণ করার পথে তাদের জন্য প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে রেখেছিল, কিন্তু তারা এ কথা ভালোভাবে উপলব্ধি করত যে, একজন উম্মী লোকের পক্ষে, যে কোনদিন পাঠশালার বারান্দাও মাড়ায়নি এ ধরনের উচ্চমানের কালাম রচনা করে পেশ করা কিছুতেই সম্ভব নয়। স্বয়ং কোরআনই একাধিকবার আরবদেরকে খোলাখুলি চ্যালেঞ্জ করেছে যে, “ তোমরা যদি একে নবীর (সঃ) রচিত বাণী বলে মনে কর, তাহলে তোমরা এ ধরনের বাণী তৈরী করে দেখাও।”
মুশরেকদের প্রাণান্তর বিরোধিতার মুখে মক্কা শরীফে বিভিন্ন সময় উক্ত চ্যালেঞ্জ তিনবার প্রদান করা হয়্। রসূলের মাদানী জিন্দেগীর প্রথম দিকে আর একবার এ চ্যালেঞ্জ পুনরোক্তি করা হয়। মক্কায় একবার সুরা ইউনুসের ভিতরে, একবার সুরা হুদের ভিতরে আর একবার সুরা বনি ইসরাইলের ভিতরে নিম্নরূ চ্যালেঞ্জ দান করা হয়:
﴿أَمْ يَقُولُونَ افْتَرَاهُ ۖ قُلْ فَأْتُوا بِسُورَةٍ مِّثْلِهِ وَادْعُوا مَنِ اسْتَطَعْتُم مِّن دُونِ اللَّهِ إِن كُنتُمْ صَادِقِينَ﴾
”এরা কি দাবী করে যে, কোরআন (আপনার) বানানো। আপনি বলুন, তোমরা যদি তোমাদের দাবীতে সত্যবাদী হও, তাহলে একটি সুরা অন্তত তৈরী করে নিয়ে এসো। আর এ ব্যাপারে আল্লাহ ব্যতীত যাদের সাহায্য প্রয়োজন বোধ কর। সাধ্যমত তাদেরকেও ডেকে নাও”
(সুরা ইউনুস, আয়াত-৩৮)
﴿أَمْ يَقُولُونَ افْتَرَاهُ ۖ قُلْ فَأْتُوا بِعَشْرِ سُوَرٍ مِّثْلِهِ مُفْتَرَيَاتٍ وَادْعُوا مَنِ اسْتَطَعْتُم مِّن دُونِ اللَّهِ إِن كُنتُمْ صَادِقِينَ﴾
”উহারা নাকি বলে যে, কোরআন রসূলের (সঃ) তৈরী করা, আপনি বলুন, তোমরা যদি সত্যবাদী হও, তাহলে এ ধরনের রচিত দশটি সুরা নিয়ে এসো। আর এ ব্যাপারে আল্লাহ ব্যতীত যাদের সাহায্য প্রয়োজন বোধ কর সাধ্যমত তাদেরকেও ডেকে নাও।”
(সুরা হুদ, আয়াত-১৩)
﴿قُل لَّئِنِ اجْتَمَعَتِ الْإِنسُ وَالْجِنُّ عَلَىٰ أَن يَأْتُوا بِمِثْلِ هَٰذَا الْقُرْآنِ لَا يَأْتُونَ بِمِثْلِهِ وَلَوْ كَانَ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ ظَهِيرًا﴾
আপনি ঘোষণা করে দিন, জগতের সমগ্র মানব ও জ্বীন জাতি মিলেও যদি এ ধরনে একখানা কোরআন তৈরী করার চেষ্টা করে, তাহলেও তারা তা পারবে না, যদিও তারা এ ব্যাপারে পরস্পরকে সাহায্য করে।”
(সুরা বনী ইসরাইল, আয়াত-৮৮)
নবী করীম (স:) মদীনায় হিজরত করার পরপরই আর একবার সুরায়ে বাকারার ভিতরে উক্ত চ্যালেঞ্জের পুনরাবৃ্ত্তি নিম্নরূপে করা হয়,
﴿وَإِن كُنتُمْ فِي رَيْبٍ مِّمَّا نَزَّلْنَا عَلَىٰ عَبْدِنَا فَأْتُوا بِسُورَةٍ مِّن مِّثْلِهِ وَادْعُوا شُهَدَاءَكُم مِّن دُونِ اللَّهِ إِن كُنتُمْ صَادِقِينَ﴾
আর যে কিতাব আমি আমার বান্দার (মুহাম্মদের) উপর নাযিল করেছি, তা আমার পক্ষ হতে কিনা? এ ব্যাপারে যদি তোমাদের কোন সন্দেহ থাকে. তাহলে অনুরূপ একটি সুরা তৈরী করে নিয়ে এসো। আর এ কাজে আল্লাহ ছাড়া তোমাদের অন্যান্য সাহয্যকারীদেরকে ডেকে নাও যদি তোমরা সত্যবাদী হও।” (সুরা বাকারা, আয়াত-২৩)
আরবদের কঠিন বিরোধিতার মুখে যখন বার বার এ চ্যালেঞ্জ প্রদান করা হয়েছিল, তখন নিশ্চয়ই তারা চুপ করে বসে ছিল না। তাদের ভিতরে বেশ কিছু বড় বড় কবি এবং উচ্চমানের সাহিত্যিক বর্তমান ছিল। এহেন প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জের জওয়াব দানের জন্য ইসলাম বিরোধীরা এদের সকলের দ্বারেই ধর্ণা দিয়েছিল। কিন্তু তারা সকলেই তাদেরকে হতাশ করেছিল। তাদের কোন কবি কিংবা কোন সাহিত্যিক প্রতিভার পক্ষেই কোরআনের ছোট্ট একটি সূরার অনুরুপও কোন সূরা তৈরী করে দেয়া সম্ভব হয়েছিল না।
আল্লাহ তায়ালা ঘোষিত উক্ত চ্যালেঞ্জ শুধু ঐ সময়ের জন্য সীমাবদ্ধ নয়। বরং কোরআন অবতীর্ণের সময় হতে আরম্ভ করে কিয়ামত পর্যন্ত সুদীর্ঘ সময়কালব্যাপী কোরআন বিরোধীদের জন্য এটা একটি খোলা চ্যালেঞ্জ। আজও মিসর, ফিলিস্তিন, সিরিয়া, লেবানন প্রভৃতি দেশে আরবী বংশজাত বহু খৃস্টান ও ইহুদী পরিবার বর্তমান, যাদের মধ্যে আরবী ভাষার বড় বড় পন্ডিতও আছে। ইচ্ছা করলে তারাও এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে ভাগ্য পরীক্ষা করে দেখতে পারে। হয়তো তারা তা করে দেখেছেও। কিন্তু পূর্ববর্তীদের ন্যায় তাদের ভাগ্যেও হতাশা ছাড়া আর কিছুই জুটবেনা।
যারা আরবী ভাষার পন্ডিত এবং যাদের মাতৃভাষা আরবী তারা এটা ভালভাবেই অনুধাবন করতে পারে যে, কোরআনের ভাষার সাথে মানব রচিত কোন আরবী পুস্তকের ভাষার তুলনাই হয় না। বরং নবী করীমের (স:) ভাষাও কোরআনের ভাষার ন্যায় উচ্চমানের ছিল না। নবুয়ত প্রাপ্তির পূর্বে চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি যে সব কথাবার্তা বলেছেন, এমনকি নবুয়ত প্রাপ্তি পরও সাধারণভাবে নবী (স:) (ওয়াহী ব্যতীত) যেসব কথা বলতেন তাও ছিল কোরআনের ভাষা হতে নিম্নমানের। ওয়াহীর ভাষার সাথে তার কোন তুলনাই হতো না।
সুতরাং কোরআন যে আল্লাহর কিতাব, তার উচ্চাঙ্গের সাহিত্যিক মান, সুনিপুন শব্দ গঠন প্রণালী, অভিনব বাক্যবিন্যাস আর মর্মস্পর্শী সুরঝঙ্কার প্রভৃতিই তার অকাট্য প্রমাণ।
দুইঃ কোরআনের আলোচ্য বিষয়সমূহ
কোরআনে যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহের আলোচনা করা হয়েছে এবং যেসব দুরূহ সমস্যার সমাধান দেওয়া হয়েছে। সেটাও কোরআনের ঐশী গ্রন্থ হওয়ার একটি উজ্জ্বল প্রমাণ। কেননা নবী করীম (স:) যে এলাকায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন সে এলাকা ছিল তখনকার সভ্য জগতের বাইরে। কোন সুসংগঠিত রাষ্ট্র ব্যবস্থাও যেমন সেখানে ছিল না, তেমনি কোন মার্জিত সভ্যতাও সেখানে গড়ে উঠেনি। দু একটি ছোটখাট শহর ব্যতীত আর সব এলাকার অধিবাসীরাই যাযাবর জীবন যাপন করতো। প্রতিটি গোত্রই আলাদা আলাদা গোত্রীয় শাসন অর্থাৎ গোত্র সর্দারের অনুশাসন মেনে চলত। কদাচিত এক-আধজন লোক সামান্য লেখাপড়া জানলেও কোথাও কোন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যেত না।
এমন এক পরিবেশে জন্ম নিয়ে মুহাম্মদ (স:) শৈশবেই পিতৃ-মাতৃহীন এতিমে পরিণত হন। ফলে তাঁর ভাগ্যে কোনরূপ লেখাপড়াই জোটেনি। যৌবনে সিরিয়ার দিকে দুটি সংক্ষিপ্ত বাণিজ্যিক সফর ব্যতীত কোন শিক্ষামূলক সফরও তিনি করেননি। কোন শিক্ষিত জ্ঞানী ব্যক্তির সাহচর্যও তিনি আদৌ পাননি।
এমতাবস্থায় এমন একজন উম্মি লোকেরে পক্ষে বহু বিচিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্বলিত কোরআনের মত একখানা গ্রন্থ রচনা করে পেশ করা যে আদৌ সম্ভব নয়, তা যে কোন সাধারণ জ্ঞানের লোকও অনুধাবন করতে পারে। সুতরাং কোরআনের আলোচ্য বিষয়সমূহই বলে দেয় যে, কোরআন আল্লাহর কিতাব।
তিন: প্রাগৈতিহাসিক ঘটনাবলীর যথাযথ বর্ণনা
পবিত্র কোরআনে এমন ঘটনাসমূহের উল্লেখ পাওয়া যায়, যা ঘটেছিল ইতিহাস সৃ্ষ্টির বহু পূর্বে এবং যার সম্পর্কে ষষ্ঠ শতাব্দীর দুনিয়া বিশেষ কোন খোঁজ-খবর রাখত না। প্রাগৈতিহাসিক যুগের কিছু কিছু ঘটনার উল্লেখ ইহুদীদের ধর্ম গ্রন্থে ছিল বটে, তবে তার অধিকাংশই ছিল অতিরঞ্জিত ও বিকৃত। আবার কিছু কিছু ঘটনার চর্চা যদিও আরব এবং পাশ্ববর্তী এলাকার লোকদের ভিতরে ছিল কিন্তু তা ছিল একেবারেই অস্পষ্ট ও সন্দেহপূর্ণ। আবার এমন বহু ঘটনার বর্ণনা কোরআনে দেখা যায়, যার উল্লেখ না ছিল ইহুদীদের ধর্মগ্রন্থে আর না ছিল তার চর্চা আরবদের ভিতরে।
পবিত্র কোরআন প্রাগৈতিহাসিক যুগের বিভিন্ন ঘটনা বিভিন্ন প্রসঙ্গে সংক্ষিপ্ত অথচ এমন নিখুঁতাভাবে বর্ণনা করেছে যার সত্যতাকে আজ পর্যন্ত কেউ চ্যালেঞ্জ করতে পারেনি। বরং অধুনা প্রত্নতত্ত্ববিদের ঐতিহাসিক নিদর্শনসমূহের নব নব আবিষ্কার এর সত্যতাকে আরও সন্দেহাতীত করে তুলেছে।
হযরত আদম-হাওয়া (আ) বৃত্তান্ত, হযরত নূহের ঘটনা, হযরত ইবরাহীম, হযরত ইসমাইল ও হযরত ইয়াকুবের (আ) কাহিনী, নমরুদ-ফেরাউনের প্রসঙ্গ, হযরত ইউসুফ ও হযরত ইয়াকুবের (আ) কাহিনী, আদ, সামুদ, তুব্বা ও সাবা ইত্যাদি জাতিসমূহের বৃত্তান্ত, জালুত ও হযরত দাউদের প্রসঙ্গ, জুকারনাইন, আছহাবে কাহাফ ও হযরত লোকমানের ঘটনা, হযরত সুলায়মান, হযরত জাকারিয়া, হযরত ইয়াহীয়া ও হযরত ঈসার (আ) বর্ণনাবলী ইত্যাদি এমন একজন উম্মি লোকের পক্ষে যিনি কোনদিন ইতিহাস-পুস্তকের একটি লাইনও পড়েননি, অথবা বিভিন্ন দেশে পর্যটক হিসেবে আদৌ সফর করেননি, নিখুঁতভাবে বর্ণনা করা যে সম্ভব নয় তা যে কোন লোকই বুঝতে পারে। ইহার প্রমাণ স্বরূপ পবিত্র কোরআন হতে নিম্নে কয়েকটি ঘটনার উদ্ধৃতি দেয়া হচ্ছে,
(ক) মহানবীর আবির্ভাবের হাজার হাজার বছর আগে এবং মানব সৃষ্টির কেবল অল্পকাল পরেই ছাহেবে শরীয়ত পয়গম্বর হযরত নূহের (আ) আগমন ঘটেছিল। পবিত্র কোরআনে সুরায়ে হুদে আল্লাহ রাব্বুল আলামী হযরত নূহের নবুয়ত প্রাপ্তি, কওমের নিকটে তাঁর দাওয়াত পেশ, কওম কর্তৃক উহা প্রত্যাখ্যান এবং নূহকে (আ) নানারূপ তকলীফ দান, দীর্ঘ চেষ্টা যত্নের পরে নিরাশ হয়ে কওমের ধ্বংসের জন্য আল্লাহর দরবারে মোনাজাত, অবশেষে প্রলয়ঙ্করী প্লাবনে হযরত নূহ (আ) এবং তাঁর কতিপয় ঈমানদার সঙ্গী ব্যতীত বাকী সমগ্র মানব গোষ্ঠীর ধ্বংস সাধনের ঘটনাবলী বর্ণনা করার পরে আল্লাহ তাঁর প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদকে (স) লক্ষ্য করে বলেন,
﴿تِلْكَ مِنْ أَنبَاءِ الْغَيْبِ نُوحِيهَا إِلَيْكَ ۖ مَا كُنتَ تَعْلَمُهَا أَنتَ وَلَا قَوْمُكَ مِن قَبْلِ هَٰذَا ۖ فَاصْبِرْ ۖ إِنَّ الْعَاقِبَةَ لِلْمُتَّقِينَ﴾
এ হলো অজ্ঞাত অজানা ঘটনাবলী, যা আমি তোমাকে ওয়াহীর মাধ্যমে অবগত করাচ্ছি। অথচ এসব ঘটনা ইতিপূর্বে না তোমার জনা ছিল, না তোমার জাতির। সুতরাং অপেক্ষা করতে থাক অবশ্যই শেষ ফল পরহিজগারদের ভাগ্যে।” (সুরা হুদ, আয়াত-৪৯)
(খ) রাসূলের জন্মের প্রায় দু হাজার বছর আগে হযরত ইউসুফের (আ) জীবনে যে বিচিত্র ঘটনা ঘটেছিল, তার বর্ণনা দান প্রসঙ্গে রসূলের উপরে কোরআনের সুরায়ে ইউসুফ নামীয় দীর্ঘ সুরাটি অবতীর্ণ হয়। উক্ত ভাষ্যটিতে আল্লাহ তাঁর নবীকে হযরত ইউসুফের পূর্ণ জীবনের বিচিত্র কাহিনীগুলিকে সংক্ষেপে অতি চমৎকার ও নিখুঁরূপে ওয়াহীর মারফতে জানিয়ে দিয়েছিলেন।
কেমন করে হযরত ইউসুফের ভাইয়েরা তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তাকে কূপে নিক্ষেপ করেছিল, কিভাবে তাঁকে বণিক কাফেলার লোকেরা তুলে নিয়ে মিশরের প্রধানমন্ত্রীর কাছে গোলাম হিসেবে বিক্রি করেছিল, তারপর মন্ত্রীর ভা*র ষড়যন্ত্রে কিভাবে তিনি কারাগারে আবদ্ধ হয়েছিলেন, পরে মিশর রাজের স্বপ্নের ব্যাখ্যা দান করে কিরূপে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত সেক্রেটারী ও প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োজিত হয়েছিলেন, অবশেষে পিতা-মাতা ও ভাই-ভগ্নিসহ তাঁর সমগ্র পরিবার কেমন করে কেনান হতে মিশরে এসেছিলেন, এর পূর্ণ বিবরণ সুরায়ে ইউসুফের মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর প্রিয় নবীকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। আর ওয়াহী ব্যতীত অন্য কোন উপায়ে এমন নিখুঁতভাবে জানানো যে সম্ভব হত না তার কথা উল্লেখ করে আল্লাহ বলেন,
﴿ذَٰلِكَ مِنْ أَنبَاءِ الْغَيْبِ نُوحِيهِ إِلَيْكَ ۖ وَمَا كُنتَ لَدَيْهِمْ إِذْ أَجْمَعُوا أَمْرَهُمْ وَهُمْ يَمْكُرُونَ﴾
”আর এসব হল অজানা ও অজ্ঞাত ঘটনাবলী যা ( হে নবী) তোমাকে আমি ওয়াহীর মাধ্যমে অবগত করাচ্ছি। অথচ ইউসুফের (আ) ভাইয়েরা যখন ষড়যন্ত্র করেছিল এবং তাদের পরিকল্পনা ঠিক করে নিয়েছিল, তখন তুমি সেখানে উপস্থিত ছিলে না।” (সুরা ইউসুফ, আয়াত-১০২)
(গ) হযরত ঈসার (আ) জননী হযরত মরিয়মের মাতা হান্নাহ কর্তৃক গর্বস্থ সন্তানকে আল্লাহর রাহে বায়তুল মোকাদ্দাসের খেদমত ও দ্বীনের কাজের জন্য উৎসর্গকরণ, অতঃপর তাঁর নামকরণ ও তাঁকে বায়তুল মুকাদ্দাসের যাজকদের হাতে অর্পণ, কে তাঁর লালন-পালন করবে তা ঠিক করার উদ্দেশ্য কোরআর কলম নিক্ষেপ, আশ্চর্য ও অলৌকিক উপায়ে উক্ত কন্যার খাদ্য প্রাপ্তি, তারপর কন্যা বয়ঃপ্রাপ্ত হলে হযরত জিরাঈলের (আ) তাঁকে সাক্ষাৎ দান ও সুসংবাদ প্রদান ইত্যাদি সম্পর্কীয় অজ্ঞাত কাহিনী বর্ণনা করার আল্লাহ তাঁর নবীকে লক্ষ্য করে বলেন,
﴿ذَٰلِكَ مِنْ أَنبَاءِ الْغَيْبِ نُوحِيهِ إِلَيْكَ ۚ وَمَا كُنتَ لَدَيْهِمْ إِذْ يُلْقُونَ أَقْلَامَهُمْ أَيُّهُمْ يَكْفُلُ مَرْيَمَ وَمَا كُنتَ لَدَيْهِمْ إِذْ يَخْتَصِمُونَ﴾
”এ হল অজ্ঞাত ঘটনাবলী, যা আমি (হে মুহাম্মদ) তোমাকে ওয়াহীর মাধ্যমে অবগত করাচ্ছি। অথচ তারা যখন (মরিয়মের লালন-পালনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য) ভাগ্য নির্ণয়ে কাঠি নিক্ষেপ করেছিল এবং পরস্পর তর্কে লিপ্ত ছিল, তখন তুমি সেখোনে উপস্থিত ছিলে না।” (সুরা আল-ইমরান, আয়াত-৪৪)
(ঘ) রসূলের (স) জন্মের প্রায় এক হাজার আটশত বছর আগে আফ্রিকার মিসর দেশে হযরত সাঃ ও মিসর রাজা ফেরাউনের বিচিত্র ঘটনাবলী সংগঠিত হয়েছিল। হযরত মূসার ভূমিষ্ঠ হওয়া, তাকে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া, ফেরাউনের স্ত্রী কর্তৃক তাকে উত্তোলন ও রাজ পরিবারে ব্যবস্থাপনায় তার লালন পালন, যৌবনে পদার্পণের পর একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে তাঁর ফাঁসির সিদ্ধান্ত, ভীত সন্ত্রস্ত মূসার (আ) দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে মাদায়েনে পলায়ন, সেখানে হযরত সোয়াইবের কন্যান পানি গ্রহণ এবং দশ বছরকাল অবস্থান। অতঃপর পরিবার-পরিজনসহ মিশরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা, পথিমধ্যে সিনাই পর্বতের পবিত্র উপত্যকায় নবূয়ত ও ওয়াহী প্রাপ্তি, অবশেষে তাওহীদের দাওয়াত নিয়ে ফেরাউনের দরবারে উপস্থিত ও দাওয়াত পেশ, ফেরাউন ও তার জাতির সাথে দীর্ঘ দ্বন্ধ ও বিভিন্ন মোযেযা প্রদর্শন, অকৃতকার্য হয়ে কয়েক লক্ষ্য ইসরাইলীদের নিয়ে আল্লাহর আদেশে মিশর ত্যাগ ও ফিলিস্তিনের দিকে রওয়ানা, ফেরাউন ও তার ফওযের পশ্চাদনুসরণ, অতঃপর আল্লাহর অনুগ্রহ হযরত মূসা ও বনি ইসরাইলদের লোহিত সাগর অতিক্রম। ফেরাউনের ও তার লোক-লস্করের সলিল সমাধি, অতঃপর বিস্তীর্ণ সিনাই প্রান্তরে ইসরাইলদের দীর্ঘ চল্লিশ বছর যাযাবর জীবন যাপন এবং সেখানকার বহু বিচিত্র ঘটনাবলীর একটি সংক্ষিপ্ত অথচ অত্যন্ত চমৎকার বর্ণনা দান করার পরে আল্লাহ তার নবীকে লক্ষ্য করে বলেন,
وَمَا كُنتَ بِجَانِبِ الْغَرْبِيِّ إِذْ قَضَيْنَا إِلَىٰ مُوسَى الْأَمْرَ وَمَا كُنتَ مِنَ الشَّاهِدِينَ ﴿٤٤﴾ وَلَـٰكِنَّا أَنشَأْنَا قُرُونًا فَتَطَاوَلَ عَلَيْهِمُ الْعُمُرُ ۚ وَمَا كُنتَ ثَاوِيًا فِي أَهْلِ مَدْيَنَ تَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِنَا وَلَـٰكِنَّا كُنَّا مُرْسِلِينَ ﴿٤٥﴾ وَمَا كُنتَ بِجَانِبِ الطُّورِ إِذْ نَادَيْنَا وَلَـٰكِن رَّحْمَةً مِّن رَّبِّكَ لِتُنذِرَ قَوْمًا مَّا أَتَاهُم مِّن نَّذِيرٍ مِّن قَبْلِكَ لَعَلَّهُمْ يَتَذَكَّرُونَ ﴿٤٦﴾
”সিনাই (তুর) পর্বতের পশ্চিম প্রান্তে মুসাকে (আ) যখন আমি আমার নির্দেশনাবলী দিয়েছিলাম, তখন তুমি সেখানে উপস্থিত ছিলে না। আর প্রকৃত ব্যাপার হল এই যে, জগতে আমি বহু জাতি সৃষ্টি করেছিলাম, যাদের সৃষ্টির পরে দীর্ঘকাল অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে। আর তুমি (হে মুহাম্মদ (স) তৎকালে মাদায়েন নগরের অধিবাসীদের সাথেও বসবাস করতেন না যে, আমার (সেই সময় সংঘটিত) নিদর্শনাবলীর কথা তাদেরকে বলবে। বরং আমি রসূল প্রেরণ করে থাকি (যাদের কাছে অতীত ঘটনা ওয়াহীর মাধ্যমে প্রেরণ করা হয়)। আর যখন আমি মুসাকে তুর পাহাড়ের পাদদেশে আহবান করেছিলাম, তখন তুমি সেখানে উপস্থিত ছিলে না। বরং ইহা হল তোমার প্রভুর পক্ষ হতে রহমত (ওয়াহী) যাতে করে তুমি এমন একটি জাতিকে ভীতি প্রদর্শন করতে পার যাদের কাছে ইতিপূর্বে কোন ভীতি প্রদর্শনকারী (পয়গম্বর) আসেনি। আর এইভাবেই হয়ত তারা উপদেশ গ্রহণ করবে।” (সুরা কাসাস, আয়াত-৪৪-৪৬)
(ঞ) অনুরূপভাবে পবিত্র কোরআনের সুরা ত্বহায় মহাজ্ঞানী আল্লাহ হযরত মুসার (আ) জন্ম ও লালন-পালন থেকে আরম্ভ করে তার যৌবন প্রাপ্তি, মাদায়েনে পলায়ন, নবুয়ত প্রাপ্তি, হারুন (আ) সহ মিশর রাজ ফেরাউনের কাছে দাওয়াতত পেশ, বিভিন্ন মোজেজা প্রদর্শন ও ফেরাউনের সাথে দীর্ঘ দ্বন্ধ। অতঃপর ফিলিস্তিনের দিকে হিজরত। আল্লাহ তায়ালার অলৌকিক মহিমায় কয়েক লক্ষ লোকসহ লোহিত সাগর অতিক্রম। অতঃপর মুসার তুর পাহাড়ে গমন এবং খোনে শরীয়িত প্রাপ্তি ইত্যাতি ঘটনা বর্ণনা করার পরে আল্লাহ তাঁ প্রিয় নবীকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
كَذَٰلِكَ نَقُصُّ عَلَيْكَ مِنْ أَنبَاءِ مَا قَدْ سَبَقَ ۚ وَقَدْ آتَيْنَاكَ مِن لَّدُنَّا ذِكْرًا ﴿٩٩﴾
”এভাবেই আমি আপনার কাছে অতীত ঘটনাবলী বর্ণনা করছি। আর অবশ্যই আমি আপনাকে নিজের নিকট হতে একটি উপদেশনামা দিয়েছি।” (সুরা তাহা আয়াত-৯৯)
সুতরাং একথা একন জোর করে বলা জলে যে, প্রাগৈতিহাসিক যুগের এসব ঘটনাবলী সেই মহান সত্তাই বর্ণা করেছেন, যিনি ইতিহাস সৃষ্টি পূর্বে ছিলেন, এখনও আছেন এবং ভবিষ্যতেও থাকবেন। কারণ কোরআন তাঁরই শ্বাশতবাণী আর তিনিই উক্ত ঘটনাবলী নবীর কাছে ওয়াহী মারফত বর্ণনা করেছেন।
চার: ভবিষ্যত ঘটনাবলী সম্পর্কে সংবাদ দান
কোরআন শরীফে এমন বহু ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়, যা সংঘটিত হওয়ার বহু পূর্বেই আল্লাহ ওয়াহীর মাধ্যমে রসূলকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। নিম্নে কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করা হচ্ছে,
(ক) ভবিষ্যদ্বানী সম্পর্কীয় এ ধরনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার বর্ণনা আমরা দেখতে পাই পবিত্র কোরআনের সুরায়ে রোমের প্রথমে। রসুলেন হিজরতের প্রায় সাত বছর আগে মক্কা শরীফে এ সুরাটি অবতীর্ণ হয়। সুরার প্রথমে যে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি উল্লেখ করা হয়েছে, তা হল রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াস কর্তৃক পারস্য সম্রাট খসরুকে পরাজিত করার ভবিষ্যদ্বানী। ঘটনাটি ঘটার প্রায় নয় বছর পূর্বে আল্লাহর নবী ওয়াহীর মাধ্যমে এ খবর শুনিয়ে দিয়েছিলেন। ঘটনাটি ছিল নিম্নরূপ:
ইসলামের অভ্যত্থানের সামান্য আগে সারা পৃথিবীতে দুটি রাষ্ট্রই ছিল বৃহৎ ও শক্তিশালী। আর এদের সীমানাও ছিল পরস্পর সন্নিহিত। এর একটি হল পারস্য সাম্রাজ্য এবং অপরটি হল রোম সাম্রাজ্য। দুনিয়ার অপরাপর ছোট-খাট রাষ্ট্র ছিল এদের প্রভাবাধীন। এ দুটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের ভিতরে প্রায়ই যুদ্ধ বিগ্রহ লেগে থাকতো। ৬১৫ খৃষ্টাব্দে রসূলের (স) হিজরতের সাত বছর পূর্বে পারস্য সম্রাট দ্বিতীয় খসরুর সেনাবাহিনীর হাতে রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের বাহিনী ভীষণভাবে পরাজিত হয়। পারসিয়ানরা জেরুজালেমস্থ রোমদের পবিত্র স্থানগুলো ধ্বংস করে দিয়ে খৃস্টানদের পবিত্র ক্রুশ নিয়ে যায়। এ যুদ্ধে সম্রাট তার গোটা এশিয়ান এলাকাই হারিয়ে কনস্ট্যান্টিনোপলে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। আর এ সংঘর্ষে রোমক শক্তি এমনভাবে পর্যুদস্ত হয়েছিল যে, দুর ভবিষ্যতেও তার পুনরুত্থানের কোন সম্ভাবনাই পরিলক্ষিত হচ্ছিল না।
পারস্য সম্রাটের এ বিজয়ের খবর যখন মক্কায় পৌঁছে তখন ছিল নবুয়তের পঞ্চম বর্ষ। পারসিয়ানরা পৌত্তলিক হওয়ার কারণে এ বিজয়ের সংবাদে মক্কার পৌত্তলিকেরাও বিশেষভাবে উৎফুল্ল হয়েছিল এবং মুসলমানদের এ বলে তারা বিদ্রুপ করছিল যে, যেভাবে আহলে কিতাব খৃস্টানরাজ রোম সম্রাট পৌত্তলিক পারসিয়ান সম্রাটের হাতে পর্যুদস্ত ও পরাভূত হয়েছে, তেমনি ভবিষ্যতে কিতাবধারী মুহম্মদ (স) এবং তাঁর অনুসারীরাও পৌত্তলিক কোরায়েশদের হাতে পর্যুদস্তু হবে। মোট কথা উক্ত ঘটনাকে মুশরিকগণ মুসলামানদের বিরুদ্ধে তাদের বিজয়ের একটি শুভ ইঙ্গিত বলে দাবী করছিল।
আর প্রকৃত ব্যাপার ছিল এই যে, এই যুদ্ধের সূচনা হতেই পৌত্তলিক কোরায়েশদের মানসিক সমর্থন ছিল পারসিয়ানদের পক্ষে। আর রোমকরা আহলে কিতাব হওয়ার কারণে মুসলমানদের সমর্থন ছিল রোমকেদের পক্ষে। অতঃপর পারসিয়ানদের বিজয় সংবাদে মক্কার পৌত্তলিকরা যখন বিজয়োৎসব করছিল, তখন রোমকদের বিজয়ের ভবিষ্যদ্বাণী করে আল্লাহ তার নবীর উপরে নিম্নোক্ত আয়াত অবতীর্ণ করেন,
الم ﴿١﴾ غُلِبَتِ الرُّومُ ﴿٢﴾ فِي أَدْنَى الْأَرْضِ وَهُم مِّن بَعْدِ غَلَبِهِمْ سَيَغْلِبُونَ ﴿٣﴾ فِي بِضْعِ سِنِينَ ۗ لِلَّـهِ الْأَمْرُ مِن قَبْلُ وَمِن بَعْدُ ۚ وَيَوْمَئِذٍ يَفْرَحُ الْمُؤْمِنُونَ ﴿٤﴾ بِنَصْرِ اللَّـهِ ۚ يَنصُرُ مَن يَشَاءُ ۖ وَهُوَ الْعَزِيزُ الرَّحِيمُ ﴿٥﴾
”রোমানরা আরবদের নিকটবর্তী ভূ-খন্ডে পরাজয়বরণ করেছে। অতঃপর তারা দশ বছরেরও কম সময়ের ভিতরে বিজয় লাভ করবে। প্রকৃতপক্ষে প্রথমাবস্থায়ও (পরাজয়কালে) যেমন চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী ছিল আল্লাহ্, তেমনি পরবর্তীকালেও (চিরকাল) চুড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী তিনিই। আর সেদিন (রোমকদের বিজয়কালে) মুসলমানেরা আল্লাহ তায়ালার সাহয্যপ্রাপ্ত হয়ে আনন্দোৎসব করবে।” (সুরা রুম আয়াত ১-৫)
আল্লাহ তায়ালাম উপরোক্ত ভবিষ্যদ্বানী রসূল (স) যখন পাঠ করে শুনালেন, তখন মক্কার মুশরিকেরা এ নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রুপ শুরু করে দিল। কেননা রোমান শক্তি পারসিয়ানদের হাতে এমনভাবে পর্যুদস্ত হয়েছিল যে, তাদের পক্ষে পুনরায় একটি বৃহত্তর শক্তি হিসেবে দাঁড়াবার কোন সম্ভাবনাই দেখা যাচ্ছিল না।
এমনাবস্থায় এ ধরনের একটি পর্যুস্ত শক্তি মাত্র দশ বছরেরও কম সময়ের ভিতরে একটি বৃহত্তর শক্তিকে পুনর্গঠিত হয়ে বিজয়ী পারসিয়ানদেরকে পরাভূত করবে, এটাকে কল্পনা বিলাসীর কল্পনা বলেই মনে হত।
তাছাড়াও উপরোক্ত আয়াতগুলোর ভিতরে আল্লাহ ক্ষুদ্র এবং দুর্বল মুসলিম জামাতকেও অনুরূপ সময়কালেন চিতরে তাদের শক্তিশলিী দুশমনদের উপরে বিজয় লাখের সংবাদ দিয়েছিলেন আর এটা ছিল বাহ্যিক দৃষ্টিতে একেবারেই অসম্ভব।
কিন্তু সমগ্র বিশ্বকে আশ্চর্য করে পরাজয়ের মাত্র নয় বছর পর ৬২৪ খৃষ্টাব্ধে পুনর্গঠিত রোমান শক্তি পারসিয়ানদের কাছ থেকে শুধু তাদের এশিয়ার হারানো এলাকাই উদ্ধার করল না বরং মূল পারস্য ভূ খন্ডে পারস্য বাহিনীকে চরম পরাজয় বরণ করতে বাধ্য করল। আর ওই সময়ই বদরের ময়দানে ক্ষুদ্র মুসলিম বাহিনী কর্তৃক কোরায়েশদের বিরাট বাহিনী সম্পূর্ন পর্যুদস্ত হল। ফলে কোরআনের ভবিষ্যদ্বানী অক্ষরে অক্ষরে ফলতে দেখে যেমন মুসলমানরা আনন্দিত হয়েছিল, তেমনি মুশরিকরাও ক্ষোভে ও দুঃখে যথেষ্ট মর্মাহত হয়েছিল, তেমনি মুশরিকরাও ক্ষোভে ও দুঃখে যথেষ্ট মর্মাহত হয়েছিল।
কোরআন মহান আল্লাহর কালাম বলেই তার পক্ষেই এই ধরনের নিখুঁত ভবিষ্যদ্বাণী সম্ভব ছিল। কেননা আল্লাহর কাছে অতীত ও ভবিষ্যৎ বর্তমানের ন্যায়।
(খ) অনুরূপ ভবিষ্যৎবাণী সম্পর্কীয় আর একটি ঘটনা আমরা দেখতে পাই সুরায়ে হাশরে। হিজরী পঞ্চম বছরে আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে মুশরিকদের সম্মিলিত বিরাহ বাহিনী মদীনায় চড়াও হয়ে চতুর্দিক হতে মদীনাকে অবরোধ করে ফেলল। মদীনার ইহুদীদের সাথে মুসলমানদের এই মর্মে চুক্তি ছিল যে, কোন বিদেশী শক্তি যদি মদীনা আক্রমণ করে, তাহলে তারাও মুসলমানদের সাথে মিলে উক্ত শক্তির বিরুদ্ধে লড়বে। কিন্তু খন্দক যুদ্ধে যখন মুশরিকরা এসে মদীনা আক্রমণ করল, তখন ইহুদীরা উক্ত চুক্তির কোর পরওয়া না করে মুশরিকদের পক্ষই অবলম্বন করল। অতঃপর যুদ্ধে যখন সুবিধা না করতে পেরে মুশরিকরা অবরোধ উঠিয়ে চলে গেল, তখন ইহুদীরা তাদের এ কৃতকর্মের জন্য প্রমাদ গুনলো। আর মুসলমানরা যে এরপর ঘরের শত্রুকে বরদাস্ত করবে না, তা তারা উপলব্ধি করে যথেষ্ট ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল। ঠিক এই সময়ে মদীনার মুনাফেকরা ইহুদীদেরকে এই বলে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করল যে, মুসলমানেরা তাদেরকে যদি আক্রমন করে, তাহলে তারা তাদেরকে সর্বতোভাবে সাহায্য করবে, এমনকি যদি মুসলমানেরা ইহুদীদের মদীনা হতে বের করেও দেয়, তাহলে তারাও তাদের সাথে মদীনা ত্যাগ করে চলে যাবে।
মুনাফেকরা যে তাদের এ ওয়াদা পালন করবে না পূর্বাহ্নেই আল্লাহ নিম্নের আয়াত দ্বারা নবীকে তা জানিয়ে দিয়েছিলেন,
أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ نَافَقُوا يَقُولُونَ لِإِخْوَانِهِمُ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ لَئِنْ أُخْرِجْتُمْ لَنَخْرُجَنَّ مَعَكُمْ وَلَا نُطِيعُ فِيكُمْ أَحَدًا أَبَدًا وَإِن قُوتِلْتُمْ لَنَنصُرَنَّكُمْ وَاللَّـهُ يَشْهَدُ إِنَّهُمْ لَكَاذِبُونَ ﴿١١﴾ لَئِنْ أُخْرِجُوا لَا يَخْرُجُونَ مَعَهُمْ وَلَئِن قُوتِلُوا لَا يَنصُرُونَهُمْ وَلَئِن نَّصَرُوهُمْ لَيُوَلُّنَّ الْأَدْبَارَ ثُمَّ لَا يُنصَرُونَ ﴿١٢﴾
”হে রাসূল (স) আপনি কি মুনাফেকদের সম্পর্কে অবগত আছেন, যারা তাদের আহলে কিতাব কাফের ভাইদেরকে বলছে- “আল্লাহর শপথ! যদি তোমাদেরকে (মদীনা হতে) বের করে দেয়া হয়, তাহলে আমরাও তোমাদের সাথে বের হয়ে যাব এবং তোমাদের ব্যাপারে আমরা আদৌ কারও কথা শুনব না। আর যদি তোমাদের সাথে যুদ্ধ করা হয়, তাহলে অবশ্যই আমরা তোমাদের সাহায্য করব।” আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, মুনাফেকরা (তাদের দাবীতে) একেবারেই মিথ্যাবাদী। যদি ইহুদীদের বের করে দেয়া হয়, তাহলে এরা তাদের সাথে বের হয়ে যাবে না। আর যদি তাদের সাথে যুদ্ধ হয়, তাহলে মুনাফেকরা তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে না।” (সুরা হাশর আয়াত-১১-১২)
ইতিহাস সাক্ষী পরবর্তী পর্যায়ে যখন ইহুদীদের বিশ্বাসঘাতকতা ও চুক্তি ভঙ্গের কারণে তাদেরকে অবরোধ করা হল, তখন মুনাফেক সর্দার আব্দুল্লাহ বিন উবাই ও তার সঙ্গী তাদের সাহায্যের জন্য আদৌ এগিয়ে আসেনি। অতঃপর যখন মদীনার নিরাপত্তার খাতিরে ইহুদীদেরকে মদীনা হতে বের করে দেয়া হল, তখনও মুনাফেকরা তাদের সাথে বের হয়ে যায়নি। আর এভাবেই কোরআনের ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে প্রতিফলিত হয়েছিল।
(গ) এই ধরনের আর একটি ঘটনার উল্লেখ আছে সুরা বাকারায়। নবী করিম (সাঃ) মদীনায় হিযরত করার পরে প্রায় বছরকাল বায়তুল মোকাদ্দেসকে কেবলা করে নামায আদায় করেন। অতঃপর হিজরী দ্বিতীয় বর্ষে কাবা শরীফকে কেবলা করে আয়াত অবতীর্ণ হয়। কেবলা পরিবর্তনের পরে মুনাফেক, ইহুদী তথা ইসলামী বিরোধীদের ভিতরে তার কি প্রতিক্রিয়া হবে এবং তারা কি বলে প্রপাগান্ডা করবে, আল্লাহ আগে-ভাগেই তা ওয়াহীর মাধ্যমে রসূলকে জানিয়ে দিয়েছেলেন,
سَيَقُولُ السُّفَهَاءُ مِنَ النَّاسِ مَا وَلَّاهُمْ عَن قِبْلَتِهِمُ الَّتِي كَانُوا عَلَيْهَا ۚ قُل لِّلَّـهِ الْمَشْرِقُ وَالْمَغْرِبُ ۚ يَهْدِي مَن يَشَاءُ إِلَىٰ صِرَاطٍ مُّسْتَقِيمٍ ﴿١٤٢﴾
“শীঘ্রই নির্বোধ লোকেরা বলবে,” যে কেবলার দিকে মুখ করে তাঁরা এতদিন নামায পড়েছে, কি কারণে তাঁরা সেটা হতে ফেরত গেল।” হে নবী, আপনি বলে দিন, পূর্ব-পশ্চিম সব দিকই আল্লাহর। তিনি যাকে ইচ্ছা সৎপথ প্রদর্শন করেন।” (সুরা বাকারা আয়াত-১৪২)
উপরোক্ত আয়াত দ্বারা মুনাফেক ও ইহুদীরা কেবলা পরিবর্তনের পরে কি ধরনের প্রপাগান্ডা করবে তা পূর্বাহ্নেই নবীকে (স) জানিয়ে দেয়া হয়েছিল।
(ঘ) ভবিষ্যদ্বাণী সম্পর্কীয় আর একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা আমরা সুরায়ে তওবার একাদশ রুকুতে দেখতে পাই। নবম হিজরীতে নবী করীম (স) খবর পেলেন যে, রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াস এক বিরাট বাহিনী নিয়ে মদীনা আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং এই উদ্দেশ্যে সিরিয়া ও হেজাজ সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করছে। হুজুর (স) এ সংবাদ পাওয়া মাত্রই গোটা মুসলিম বাহিনী নিয়ে হেজাজ সীমান্তেই তাদেরকে বাধা দেয়ার জন্য রওয়ানা হলেন। আর যুদ্ধক্ষম প্রতিটি মুসলিমকেই হুকুম দিলেন যে, সকলকেই এ যুদ্ধে শরীক হতে হবে। কেউ বাড়ী থাকতে পারবে না।
মদীনায় কিছু সংখ্যক মুনাফেক ছিল, তারা যে যুদ্ধে মুসলমানদের নিশ্চিত বিজয়ের সম্ভাবনা থাকত কেবলে সেগুলিতেই শরীক হত। আর যে যুদ্ধে সম্ভাবনা থাকত না টালবাহানা করে সেগুলো হতে বিরত থাকত।
তাবুক অভিযান ছিল এমন একটি শক্তির বিরুদ্ধে যে শক্তিটি তখনকার দুণিয়ায় এক নম্বর শক্তি হিসেবে বিবেচিত হত। তাই মুনাফেকদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, এ যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজয় অনিবার্য। এছাড়াও তখন ছিল গ্রীষ্মকাল। মরুভূমিতে প্রচন্ড বেগে লু-হাওয়া বইতেছিল। এমতাবস্থায় মদীনা হতে তাবুক পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিনশত মাইল পথ অতিক্রম করে এক শক্তিশালী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া তাদের কাছে ছিল সাক্ষাৎ মৃত্যুর সামিল। সুতরাং তারা নানারূপ টালবাহানা করে মদীনায় থেকে গেল।
অতঃপর অভিযান শেষে নবী করীম (স) যখন মদীনার দিকে রওয়ানা হলেন, তখন পথিমধ্যেই আল্লাহ ওয়াহীর মাধ্যমে একদিকে যেমন মুনাফেকদের গোপন দুরভিসন্ধির কথা হুজুরকে জানিয়ে দিলেন, অন্যদিকে তেমনি হুজুরের মদীনা প্রত্যাবর্তনের পরে তারা শাস্তির হতে বাঁচার জন্য যে, সব মিথ্যা ওজর পেশ করবে তারও আগাম সংবাদ নবীকে দিয়ে দিলেন,
يَعْتَذِرُونَ إِلَيْكُمْ إِذَا رَجَعْتُمْ إِلَيْهِمْ ۚ قُل لَّا تَعْتَذِرُوا لَن نُّؤْمِنَ لَكُمْ قَدْ نَبَّأَنَا اللَّـهُ مِنْ أَخْبَارِكُمْ ۚ وَسَيَرَى اللَّـهُ عَمَلَكُمْ وَرَسُولُهُ ثُمَّ تُرَدُّونَ إِلَىٰ عَالِمِ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ فَيُنَبِّئُكُم بِمَا كُنتُمْ تَعْمَلُونَ ﴿٩٤﴾
“হে রসূল, আপনারা যখন মদীনায় মুনাফেকদের কাছে ফিরে যাবেন, তখন তারা ওজর পেশ করবে। আপনি বলুন, তোমাদের ওজর পেশ করার কোন প্রয়োজন নাই। আমরা আর তোমাদের কথা বিশ্বাস করছি না। আল্লাহ (পূর্বাহ্নেই) তোমাদের বিষয় আমাদেরকে অবগত করিয়ে দিয়েছেন।” (সুরা তওবা আয়াত-৯৪)
অতঃপর আল্লাহ নবীকে আরও জানিয়ে দিচ্ছেন,
سَيَحْلِفُونَ بِاللَّـهِ لَكُمْ إِذَا انقَلَبْتُمْ إِلَيْهِمْ لِتُعْرِضُوا عَنْهُمْ ۖ فَأَعْرِضُوا عَنْهُمْ ۖ إِنَّهُمْ رِجْسٌ ۖ وَمَأْوَاهُمْ جَهَنَّمُ جَزَاءً بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ ﴿٩٥﴾
“আপনারা যখন (মদীনায়) এদের নিকট প্রত্যাবর্তন করবেন, তখন এই মুনাফেকরা আপনাদের কাছে এসে আল্লাহর নামে শপথ করবে। যেন আপনারা তাদের বিরুদ্ধে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করেন। আচ্ছা, আপনারা এদেরকে ছেড়ে দিন, এরা এদের কৃতকর্মের ফল স্বরূপ জাহান্নাম ভোগ করবে।” (সুরা তওবা আয়াত-৯৫)
يَحْلِفُونَ لَكُمْ لِتَرْضَوْا عَنْهُمْ ۖ فَإِن تَرْضَوْا عَنْهُمْ فَإِنَّ اللَّـهَ لَا يَرْضَىٰ عَنِ الْقَوْمِ الْفَاسِقِينَ ﴿٩٦﴾
এরা আপনাদের কাছে এ জন্যই শপথ করবে, যেন আপনারা তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যান। মনে রাখবেন, আপনারা এদের প্রতি সন্তুষ্ট হলেও আল্লাহ এসব পাপীদের প্রতি সন্তুষ্ট হবেন না।” (সুরা তওবা, আয়াত-৯৬)
উপরোক্ত আলোচনায় মাত্র কয়েকটি ভবিষ্যদ্বাণীর কথা উল্লেখ করা হল, যার প্রতিটিই হুবহু সত্যে প্রমাণিত হয়েছে। এ ছাড়াও বহু ভবিষ্যদ্বাণী পবিত্র কোরআনে দেখা যায়, যা ইতিপূর্বেই বাস্তবায়িত হয়েছে।
এতদ্ব্যতীত হাশর-নাশর, পরকাল-পুনরুত্থান হিসাব-নিকাশ, বেহেশত-দোযখ ইত্যাদি সম্পর্কীয় অসংখ্য ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে যা প্রতিফলিত হওয়ার সময় এখনও আসেনি। এসব নিখুঁত ভবিষ্যদ্বানী নিশ্চয়ই এ কথা প্রমাণ করে যে, কোরআন আল্লাহর কিতাব, কেননা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ ভবিষ্যতের জ্ঞান রাখে না।
পাঁচ: মানব জীবনের জন্য সূদুর প্রসারী ও মৌলিক ব্যবস্থা দান
কোরআন মানব জীবনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে যে সমস্ত সুসামঞ্জস্য, সুপরিকল্পিতও সূদুরপ্রসারী ব্যবস্থা দান করেছে, তাও কোরআনের ঐশীগ্রন্থ হওয়ার একটি জাজ্জল্যমান প্রমাণ।
কোরআনের এসব চমৎকার বিধানবলীর প্রশংসা করতে গিয়ে প্রসিদ্ধ পাশ্চাত্য পন্ডিত স্যার ডায়মন্ডবার্স লিখেছেন,
“কোরআনের বিধানবলী শাহানশাহ থেকে আরম্ভ করে পর্ণকুটীরের অধিবাসী পর্যন্ত সকলের জন্যই সমান উপযোগী ও কল্যাণকর। দুনিয়ার জন্য কোন ব্যবস্থায় এর বিকল্প খুঁজে পাওয়া একেবারেই অসম্ভব।”
ডক্টর অসওয়েল জনসন বলেন,
“কোরআনের প্রজ্ঞাপূর্ণ বিধানবলী এতই কার্যকরী এবং সর্বকালের উপযোগী যে, সর্বযুগের দাবীই উহা পূরণ করতে সক্ষম। কর্ম-কোলাহলপূর্ণ নগরী, মুখর জনপদ, শূণ্য মরুভূমি এবং দেশ হতে দেশান্তর পর্যন্ত সব জায়গায় এ বাণী সমভাবে ধ্বনিত হতে দেখা যায়।”
গীবন বলেন,
“জীবনের প্রতিটি শাখার কার্যকরী বিধান কোরআন মওজুদ রয়েছে”
বিবাহ-তালাক সম্পর্কীয় যাবতীয় বিধান, উত্তরাধিকার সম্পর্কীয় ব্যবস্থাবলী, রাষ্ট্রীয় ও আর্থিক মূলনীতিসমূহ, যুদ্ধ-সন্ধি সম্পর্কীয় নিয়ম কানুন ইত্যাদি নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে যে, কোরআন আল্লাহর কিতাব। কেননা যে নবীর মুখ থেকে আমরা এ কিতাব পেয়েছি তিনি ছিলেন উম্মি। সুতরাং তিনি কোন আইনের কিতাবও অধ্যয়ন করেননি, কিংবা কোন আইনজ্ঞের কাছে কোন পাঠও গ্রহণ করেননি। কাজেই নবী না হলে তাঁর পক্ষে এ ধরনের চমৎকার বিধানবলী পেশ করা সম্ভব ছিল না।
ছয়: বিশ্বলোক ও উর্দ্ধজগত সম্পর্কে নির্ভুল তথ্যের বর্ণনা দান
পবিত্র কোরআনে বহু জায়গায় বিভিন্ন প্রসঙ্গে আল্লাহর অসীম কুদরতের বর্ণনা দান করতে গিয়ে উর্ধ্বর্লোক, ভুমণ্ডল এবং এর ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে যে সব তথ্যে অবতারণা করা হয়েছে, বিজ্ঞানের উন্নতি বিভিন্ন পর্যায় তার বাস্তবতা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। নিম্নে তার কয়েকটি নমুনা পেশ করা হচ্ছে,
(ক) মহাশুন্যে বিভিন্ন গ্রহ উপগ্রহ যে একটি অপরটিকে আকর্ষণ করে এবং এরই ফলে যে এরা শূণ্যে ভেসে রয়েছে, ১৯৬৫ খৃষ্টাব্দে নিউটনের মধ্যাকর্ষণ থিওরী আবিষ্কারের পূর্বে জগদ্বাসী এর বিশেষ কোন খবর রাখত না। কিন্তু নিউটনের জন্মের প্রায় হাজার বছর আগে এ তথ্য আল্লাহ ওয়াহীর মাধ্যমে তাঁর নবীকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। নিম্নে এ সম্পর্কীয় আয়াত উদ্ধৃত করা হচ্ছে,
وَمِنْ آيَاتِهِ أَن تَقُومَ السَّمَاءُ وَالْأَرْضُ بِأَمْرِهِ ۚ ثُمَّ إِذَا دَعَاكُمْ دَعْوَةً مِّنَ الْأَرْضِ إِذَا أَنتُمْ تَخْرُجُونَ ﴿٢٥﴾
“এবং আল্লাহ তায়ালার মহা নিদর্শনাবলীর মধ্যে এটাও একটি যে উর্দ্ধলোক ও ভূমন্ডল তারই আমর দ্বারা মহাশূণ্যে প্রতিষ্ঠিত।” (সুরা রুম, আয়াত-২৫)
যে মহাশক্তি বলে উর্দ্ধলোকের যাবতীয় বস্তু এবং ভূ মন্ডল শূণ্যে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে, তাকে আয়াতে “আমরুল্লাহ” বলা হয়েছে। আর সেটাই হচ্ছে নিউটনের আবিস্কৃত মধ্যাকর্ষণ শক্তি।
وَسَخَّرَ لَكُمُ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ وَالشَّمْسَ وَالْقَمَرَ ۖ وَالنُّجُومُ مُسَخَّرَاتٌ بِأَمْرِهِ ۗ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَاتٍ لِّقَوْمٍ يَعْقِلُونَ ﴿١٢﴾
“আর সমস্ত নক্ষত্ররাজি তারই আমর দ্বারা বাঁধা (নিয়ন্ত্রিত)। নিশ্চয়ই এর ভিতরে বিজ্ঞ লোকদের জন্য নিদর্শন রয়েছে।” (সুরা নাহল, আয়াত-১২)
উপরোক্ত আয়াতে আমর দ্বারা সেই মহা আকর্ষণ শক্তিকে বুঝানো হয়েছে, যার আকর্ষণ শক্তি বলে মহাশূণ্য নক্ষত্ররাজি বিক্ষিপ্ত হয়ে ছুটে পড়ছেনা।
إِنَّ اللَّـهَ يُمْسِكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ أَن تَزُولَا ۚ وَلَئِن زَالَتَا إِنْ أَمْسَكَهُمَا مِنْ أَحَدٍ مِّن بَعْدِهِ ۚ إِنَّهُ كَانَ حَلِيمًا غَفُورًا ﴿٤١﴾
নিশ্চয় আল্লাহ নভোমণ্ডল ও ভূ মণ্ডলকে এমনভাবে ধারণ করে রেখেছেন যার ফলে উহা বিচ্ছিন্ন হয়ে পতিত হয় না।” (সুরা ফাতের, আয়াত-৪১)
বর্ণিত আয়াতে আল্লাহ তায়ালার ধারণ শক্তি হল নিউটনের আবিষ্কৃত মধ্যাকর্ষণ শক্তি।
যদিও খৃষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে গ্রীক বিজ্ঞানী টলেমী পৃথিবীর গোলাকৃতি এবং মহাশূন্যে সেটা ঝুলে থাকার তথ্য আবিষ্কার করেছিলেন, কিন্তু কোন শক্তি বলে তা ঝুলে রয়েছে, তার যেমন তিনি সন্ধান দিতে পারেননি, তেমনি তিনি পৃথিবীর গতি সম্পর্কেও কোন খবর দিতে পারেননি।
(খ) সৃষ্টির ব্যাপারে বিশ্বের সর্বত্রই যে আল্লাহ তায়ালা দ্বৈত ও জোড়া পদ্ধতি অবলম্বন করেছে, ফরাসী পদার্থ বিজ্ঞানী দ্য-ব্রগলী ১৯১৫ সনে এই আশ্চর্য দ্বৈতরূপের প্রতি ইঙ্গিত করেন। তার মতে প্রকৃতির সর্বত্র যে দ্বৈতভাব বিরাজ করছে, আলোর দ্বৈতধর্ম তারই একটি দিক মাত্র। অথচ দ্য-ব্রগলীর প্রায় তের শত বছর পূর্বে এই দ্বৈত ভাবের কথা কোরআনের মাধ্যমে মানুষকে জানানো হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন,
سُبْحَانَ الَّذِي خَلَقَ الْأَزْوَاجَ كُلَّهَا مِمَّا تُنبِتُ الْأَرْضُ وَمِنْ أَنفُسِهِمْ وَمِمَّا لَا يَعْلَمُونَ ﴿٣٦﴾
“ বড়ই মহিমান্বিত সেই সত্ত্বা যিনি দ্বৈতরূপে সবকিছুকে সৃষ্টি করেছেন। যা কিছু ভূমি হতে ও তাদের (মানুষের) ভিতর হতে জন্মে এবং এমন বস্তু হতে জন্মে যার খবর তারা রাখেনা।” (সুরা ইয়াসিন, আয়াত-৩৬)
وَخَلَقْنَاكُمْ أَزْوَاجًا ﴿٨﴾
“এবং আমি তোমাদেরকে জোড়া জোড়া সৃষ্টি করেছি।” (সুরা নাবা, আয়াত-৮)
(গ) চন্দ্র সূর্যসহ বিশ্বের সবকিছুই যে অবিরতভাবে গতিশীল, কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও, নিউটন ও আইনিস্টাইন প্রভৃতি বিজ্ঞানীদের জন্মের বহু পূর্বে কোরআন এ কথা ঘোষণা করেছে,
وَالشَّمْسُ تَجْرِي لِمُسْتَقَرٍّ لَّهَا ۚ ذَٰلِكَ تَقْدِيرُ الْعَزِيزِ الْعَلِيمِ ﴿٣٨﴾ وَالْقَمَرَ قَدَّرْنَاهُ مَنَازِلَ حَتَّىٰ عَادَ كَالْعُرْجُونِ الْقَدِيمِ ﴿٣٩﴾ لَا الشَّمْسُ يَنبَغِي لَهَا أَن تُدْرِكَ الْقَمَرَ وَلَا اللَّيْلُ سَابِقُ النَّهَارِ ۚ وَكُلٌّ فِي فَلَكٍ يَسْبَحُونَ ﴿٤٠﴾
“সূর্য তার গন্তব্যস্থলের দিকে চলছে। আর এ হল তাঁরই ব্যবস্থাপনা যিনি মহা-পরাক্রমশালী, মহাজ্ঞানী। আর চন্দ্রের জন্যও আমি তার মনজিল ঠিক করে দিয়েছি, এমনকি এক সময় উহা পুরান খেজুর শাখের রূপ ধারণ করে। সূর্যের যেমন শক্তি নেই চন্দ্রকে ধরে ফেলার, রাতেরও তেমনি ক্ষমতা নেই দিনকে অতিক্রম করার। আর প্রত্যেকেই মহাশূন্যে সাঁতার কাটছে।” (সুরা ইয়াসীন, আয়াত-৩৮-৪০)
﴾ وَهُوَ الَّذِي خَلَقَ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ وَالشَّمْسَ وَالْقَمَرَ ۖ كُلٌّ فِي فَلَكٍ يَسْبَحُونَ ﴿٣٣﴾
“তিনিই সৃষ্টি করেছেন দিন ও রাতকে, সূর্য ও চন্দ্র তাঁরই সৃষ্টি। আর সকলেই মহাশূন্যে সাঁতার কাটছে।” (সুরা আম্বিয়া, আয়াত-৩৩)
এবার এ সম্পর্কে বিশ্ব বিখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের কথা শুনুন,
“বিশ্বে গতিহীন স্থির কোন কাঠামো নেই। বিশ্ব গতিশীল, নক্ষত্র, নীহারীকা-জগত এবং বহির্বিশ্বের বিরাট মধ্যাকর্ষণীয় জগত সমস্তই অবিরামভাবে গতিশীল।”
এ সম্পর্কে স্যার আইজাক নিউটনের মত হলো নিম্নরূপ:
“পৌরনীতি প্রবর্তনের সময় সৃষ্টিকর্তা প্রতিটি বস্তুকে তার অক্ষের উপর প্রদক্ষিণ করার ব্যবস্থা করেন।”
(ঘ) সৃষ্টির প্রথমাবস্থায় নক্ষত্র, নীহারিকা ও সৌরজগত যে পরস্পর সংযু্ক্ত ও অবিচ্ছিন্ন ছিল বিজ্ঞানীদের বহু পূর্বে কোরআন আমাদেরকে তার সন্ধান দিয়েছে,
أَوَلَمْ يَرَ الَّذِينَ كَفَرُوا أَنَّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ كَانَتَا رَتْقًا فَفَتَقْنَاهُمَا ۖ وَجَعَلْنَا مِنَ الْمَاءِ كُلَّ شَيْءٍ حَيٍّ ۖ أَفَلَا يُؤْمِنُونَ ﴿٣٠﴾
“যারা কুফরীর পথ অবলম্বন করেছে, তারা কি ইহা অবলোকন করে না যে, আদিতে আকাশ মণ্ডলী ও ভূ-মণ্ডল পরস্পর সংযুক্ত ছিল। অতঃপর আমি উহাকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছি।” (সুরা আম্বিয়া, আয়াত-৩০)
বিশ্ব সৃষ্টি সম্পর্কে বেলজিয়াম বিশ্বতত্ত্ববিদ আথেল্য মেতরের কথা হল এই যে,“একটি বিরাটাকায় আদিম অনু হতেই বিশ্বের সৃষ্টি হয়েছে। অণুটি কালক্রমে বিদীর্ণ হয়ে যায় এবং তার নানা অংশ নানা দিকে ছড়িয়ে পড়ে।”
(*********)
সম্প্রতি জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের জর্জ গ্যামো বিশ্ব সৃষ্টি সম্পর্ক নিম্ন লিখিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন,
“আদিতে বিশ্বের কেন্দ্র সমজাতীয় আদিম বাষ্পের একটা জ্বলন্ত নরককুন্ড ছিল- ক্রমে ক্রমে এই মহাজাগতিক ভর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে আরম্ভ করে এবং বিভিন্ন অংশের তাপমাত্রা ক্রমেই কমতে থাকে।”
উপরোক্ত দু জন খ্যাতনাম বিজ্ঞানীদের মতের সাথে উপরে বর্ণিত ঘোষনাটির আশ্চর্য সামঞ্জস্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
(ঙ) মহাবিশ্বের সৌরজগৎসহ বিভিন্ন জগতের সময়কাল ও দিবা-রাত্রি পরিমাণ যে এক নয়, বর্তমান বিজ্ঞানের অনেক আগে কোরআন এর ইঙ্গিত দিয়েছে,
يُدَبِّرُ الْأَمْرَ مِنَ السَّمَاءِ إِلَى الْأَرْضِ ثُمَّ يَعْرُجُ إِلَيْهِ فِي يَوْمٍ كَانَ مِقْدَارُهُ أَلْفَ سَنَةٍ مِّمَّا تَعُدُّونَ ﴿٥﴾
“সে মহান সত্ত্বাই আকাশ হতে ভূমণ্ডল পর্যন্ত যাবতীয় বিষয়গুলোর তদারক করেন। অতঃপর এমন একদিনে সবকিছুই তার নিকট ফিরে আসবে, যে দিনটির সময়কাল হবে তোমাদের গণনা মোতাবেক হাজার বছর।” (সুরা সাজদা, আয়াত-৫)
কোরআন অবতীর্ণ হবার সময় কালের এ ব্যবধানটি বোধগম্য না হলেও বর্তমান বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার তা মানুষের কাছে সহজ ও বোধগম্য করে দিয়েছে।
এ সম্পর্কে বিশ্ব বিখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের উক্তি হল নিম্নরূপ,
“প্রত্যেক জগতের একটি নিজস্বকাল আছে। জগতের উল্লেখ না করে কোন ঘটনার কালের উল্লেখের কোন অর্থই হয় না। প্রত্যেক জগতের গতিবেগ অনুসারে স্থান ও কালের পরিবর্তন ঘটে।”
বিশ্ব রহস্য ও ড. আইনস্টাইন,লিংকন বেমিট।
সুতরাং আল্লাহ যদি কিয়ামতের দিন আমাদের হিসাব-নিকাশের ব্যবস্থা এমন একটি জগতে করেন, যে জগতকে আলোকিত করবে এমন একটি গ্রহ যে গ্রহকে কেন্দ্র করে উক্ত জগতটি তার অক্ষের উপরে আমাদের পৃথিবীর হাজার বছরে একবার মাত্র ঘুরে আসবে; আর এরই ফলে সেখানকার একদিনের পরিমাণ হবে আমাদের পৃথিবীর হাজার বছরের সমান, তাহলে তাতে আশ্চর্য হওয়ার কি আছে?
(চ) পবিত্র কোরআনের অন্য এক স্থানে আল্লাহ তাঁর সৃষ্টির বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নৈপুণ্যের বর্ণনা দান প্রসঙ্গে বলেন,
﴾ الَّذِي خَلَقَ سَبْعَ سَمَاوَاتٍ طِبَاقًا ۖ مَّا تَرَىٰ فِي خَلْقِ الرَّحْمَـٰنِ مِن تَفَاوُتٍ ۖ فَارْجِعِ الْبَصَرَ هَلْ تَرَىٰ مِن فُطُورٍ ﴿٣﴾ ثُمَّ ارْجِعِ الْبَصَرَ كَرَّتَيْنِ يَنقَلِبْ إِلَيْكَ الْبَصَرُ خَاسِئًا وَهُوَ حَسِيرٌ ﴿٤﴾
“সেই মহান সত্ত্বাই সাত আসমানকে স্তরে স্তরে তৈরী করেছেন। তুমি সে করুণাময়ের সৃষ্টিতে কোথাও কোন ত্রুটি দেখতে পাবে না। আবার দৃষ্টি ফিরাও কোন ত্রুটি দেখতে পাচ্ছ কি? অতঃপর তুমি পুনঃ পুনঃ দৃষ্টি নিক্ষেপ কর। তোমার দৃষ্টিশক্তি অবনমিত হয়ে ফিরে আসবে।” (অথচ তুমি কোথাও কোন ত্রুটি দেখতে পাবে না।) (সুরা মূলক, আয়াত ৩-৪)
এই বৈশিষ্ট্যময় বিশ্ব যে আল্লাহ অহেতুক খেলাচ্ছলে সৃষ্টি করেননি, সে সম্পর্কে কোরআন বলে,
وَمَا خَلَقْنَا السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَمَا بَيْنَهُمَا لَاعِبِينَ ﴿٣٨﴾ مَا خَلَقْنَاهُمَا إِلَّا بِالْحَقِّ وَلَـٰكِنَّ أَكْثَرَهُمْ لَا يَعْلَمُونَ ﴿٣٩﴾
“আমি আকাশ ও ভূমণ্ডল এবং তন্মধ্যস্থ যাবতীয় বস্তু খেলাচ্ছলে সৃষ্টি করিনি। নিশ্চয় আমি উভয়কে উদ্দেশ্যমূলকভাবে তৈরী করেছি! কিন্তু অধিকাংশই লোকই তা অনুধাবন করে না।” (সুরা দোখান, আয়াত ৩৮-৩৯)
এবার এই নৈপূন্যময় বিশ্ব সম্পর্কে বিশ্ব বিখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের মত শুনুন,
আমি একটি সুসামঞ্জস্য ও সুশৃঙ্খল বিশ্বে বিশ্বাসী। অনুসন্ধানী মানুষ একদিন বাস্তব সত্যের সন্ধান পাবে ঐ বিশ্বাস আমি পোষণ করি। আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারিনা যে, জগত নিয়ে সৃষ্টিকর্তা পাশা খেলছেন।” (বিশ্ব রহস্য ও ড. আইনস্টাইন)।
(ছ) পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন যে, সে ভয়াবহ দিনে সূর্য ও চন্দ্রে কোন আলো থাকবে না এবং নক্ষত্রগুলিও তাদের কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলবে। আর আল্লাহ এক অভিনব নূর (আলো) দ্বারা সমগ্র হাশর ময়দানটি আলোকিত করে ফেলবেন। যেমন সুরায়ে কিয়ামায় উল্লেখ আছে,
يَسْأَلُ أَيَّانَ يَوْمُ الْقِيَامَةِ ﴿٦﴾ فَإِذَا بَرِقَ الْبَصَرُ ﴿٧﴾ وَخَسَفَ الْقَمَرُ ﴿٨﴾ وَجُمِعَ الشَّمْسُ وَالْقَمَرُ ﴿٩﴾
“এরা (রসূলেন কাছে) জিজ্ঞেস করছে যে, কিয়ামত কবে হবে? যেদিন দৃষ্টি শক্তি ঝলসে যাবে এবং চন্দ্রে কোন আলা থাকবে না। আর চন্দ্র, সূর্য একই অবস্থা প্রাপ্ত হবে।” (সুরা কিয়ামাহ, আয়াত ৬-৯)
কিয়ামতের বর্ণনা দান প্রসঙ্গে আল্লাহ পবিত্র কোরআনের অন্য এক স্থানে বলেছেন,
إِذَا الشَّمْسُ كُوِّرَتْ ﴿١﴾ وَإِذَا النُّجُومُ انكَدَرَتْ ﴿٢﴾ وَإِذَا الْجِبَالُ سُيِّرَتْ ﴿٣﴾
“যেদিন সূর্য কোন আলো থাকবে না, নক্ষত্রগুলো স্থানচ্যুত হবে, আর পাহাড়-পর্বতগুলিও সরে যাবে।” (সুরা তাকবীর, আয়াত ১-৩)
কোরআন নাযিলের সময় যদিও উক্ত কথাগুলি কারো কারো কাছে অসম্ভব বলে মনে হত, কিন্তু বর্তমান বিশ্বের প্রখ্যাত বিজ্ঞানীরা চন্দ্র ও নক্ষত্ররাজির উপরোক্ত অবস্থা প্রাপ্তির কথাকে আর আদৌ অসম্ভব মনে করেন না। বরং তাদের মতামত তাকে সমর্থন করার পক্ষে। যেমন তারা বলেছেন,
“সূর্য ধীরে ধীরে কিন্তু নিশ্চিতভাবে নিভে যাচ্ছে। তারকাদের অনেকেই এখন পোড়া কয়লা মাত্র। বিশ্বের সর্বত্রই তাপের মাত্রা কমে আসছে। পদার্থ বিকীর্ণ হয়ে ধ্বংস প্রাপ্ত হচ্ছে এবং কর্মশক্তি মহাশূন্যে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। ক্রমে ক্রমে বিশ্ব এভাবে তাপ-মৃত্যুর দিকে অগ্রসর হচ্ছে। অনেক কোটি বছর পরে বিশ্ব যখন এরূপ অবস্থায় পৌঁছবে, তখন প্রকৃতির সমস্ত প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাবে।”
(বিশ্ব রহস্য ও ড. আইনস্টাইন, পৃঃ নং ১২৩-১২৪)
“প্রকৃতির সমস্ত দৃশ্য এবং তথ্যাদি দ্বারা এই একমাত্র সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, অনমনীয় ও অপরিবর্তনীয়ভাবে বিশ্ব এক অন্ধকার ধ্বংসের দিকে এগিয়ে চলছে।” (বিশ্ব রহস্য ও ড. আইনস্টাইন পৃঃ নং ১২৭)
বিজ্ঞানীদের মতে প্রকৃতির সমস্ত প্রক্রিয়া যেদিন স্তব্ধ হয়ে যাবে সেদিন বিশ্ব ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে।
كُلُّ مَنْ عَلَيْهَا فَانٍ ﴿٢٦﴾ وَيَبْقَىٰ وَجْهُ رَبِّكَ ذُو الْجَلَالِ وَالْإِكْرَامِ
“বিশ্বে যা কিছু আছে সবই ধ্বংস হয়ে যাবে। আর তোমরা একমাত্র প্রতিপালকই অবশিষ্ট থাকবেন, যিনি মহীয়ান ও গরীয়ান।”
(সুরা আর-রহমান, আয়াত ২৬-২৭)
(জ) পবিত্র কোরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন উদ্ভিদ, তরুলতা ও গাছ-গাছড়া ইত্যাদিকে মানব ও জন্তু-জানোয়াররের জন্য মহামূল্যবান সম্পদ বলে আখ্যায়িত করেছেন। যেমন আল্লাহ বলেন,
وَالْأَرْضَ بَعْدَ ذَٰلِكَ دَحَاهَا ﴿٣٠﴾ أَخْرَجَ مِنْهَا مَاءَهَا وَمَرْعَاهَا ﴿٣١﴾ وَالْجِبَالَ أَرْسَاهَا ﴿٣٢﴾ مَتَاعًا لَّكُمْ وَلِأَنْعَامِكُمْ ﴿٣٣﴾
“অতঃপর তিনি জমিনকে বিস্তার করে দিয়েছেন। আর তা হতে পানি ও তরুলতাদি নির্গত করেছেন এবং পাহাড়কে তিনিই সু-প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আর তা (গাছ-গাছড়া) হল তোমাদের এবং তোমাদের জন্তু-জানোয়ারদের জন্য মহামূল্যবান সম্পদ।” (সুরা আন নাজিয়াত, আয়াত নং ৩০-৩৩)
অন্যত্র আল্লাহ বলেন,
فَلْيَنظُرِ الْإِنسَانُ إِلَىٰ طَعَامِهِ ﴿٢٤﴾ أَنَّا صَبَبْنَا الْمَاءَ صَبًّا ﴿٢٥﴾ ثُمَّ شَقَقْنَا الْأَرْضَ شَقًّا ﴿٢٦﴾ فَأَنبَتْنَا فِيهَا حَبًّا ﴿٢٧﴾ وَعِنَبًا وَقَضْبًا ﴿٢٨﴾ وَزَيْتُونًا وَنَخْلًا ﴿٢٩﴾ وَحَدَائِقَ غُلْبًا ﴿٣٠﴾ وَفَاكِهَةً وَأَبًّا ﴿٣١﴾ مَّتَاعًا لَّكُمْ وَلِأَنْعَامِكُمْ ﴿٣٢﴾ فَإِذَا جَاءَتِ الصَّاخَّةُ ﴿٣٣﴾ يَوْمَ يَفِرُّ الْمَرْءُ مِنْ أَخِيهِ ﴿٣٤﴾ وَأُمِّهِ وَأَبِيهِ ﴿٣٥﴾ وَصَاحِبَتِهِ وَبَنِيهِ ﴿٣٦﴾ لِكُلِّ امْرِئٍ مِّنْهُمْ يَوْمَئِذٍ شَأْنٌ يُغْنِيهِ ﴿٣٧﴾ وُجُوهٌ يَوْمَئِذٍ مُّسْفِرَةٌ ﴿٣٨﴾ ضَاحِكَةٌ مُّسْتَبْشِرَةٌ ﴿٣٩﴾ وَوُجُوهٌ يَوْمَئِذٍ عَلَيْهَا غَبَرَةٌ ﴿٤٠﴾ تَرْهَقُهَا قَتَرَةٌ ﴿٤١﴾ أُولَـٰئِكَ هُمُ الْكَفَرَةُ الْفَجَرَةُ ﴿٤٢﴾
মানুষের উচিৎ তার খাদ্য বস্তুর দিকে লক্ষ্য করা। এক অত্যাশ্চর্য পদ্ধতিতে আমি পানি বর্ষণ করেছি। অতঃপর অভিনব পদ্ধতিতে আমি জমিনকে বিদীর্ণ করে তা হতে নানা ধরনের শস্য, আঙ্গুর, শাক-সব্জি, জাইতুন, খেজুর, ঘন বৃক্ষরাজি পরিপূর্ণ বাগ-বাগিচা ফল-মূল, তৃণ-রাজি উৎপাদন করেছি। আর এসব হল তোমাদের ও তোমাদের গৃহপালিত পশুগুলির জন্য বিশেষ উপকারী।” (সূরা আবাসা, আয়াত ২৪-৩২)
বর্তমান বিজ্ঞানীদের উদ্ভিদ সম্পর্কে নানারূপ গবেষণা চালিয়ে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, প্রকৃতির মধ্যে মানুষের এবং জন্তু-জানোয়ারদের জন্য উদ্ভিদের চেয়ে পরম বন্ধু আর কিছুই নেই। কেননা উদ্ভিদ শুধু আমাদের খাদ্যই জোগায় না, বরং বায়ু হতে বিষাক্ত গ্যাস কার্বন-ডাই-অক্সাইড শুষে নিয়ে আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য অক্সিজেন তৈরী করে দেয়।
উদ্ভিদ শিকড়ের সাহায্যে মাটি হতে পানি শুষে পাতায় নিয়ে আসে এবং পাতা বায়ু হতে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস শুষে নেয়। গাছের পাতায় রক্ষিত ক্লোরোফিল (যার কারণে পাতা সবুজ দেখায়) ও সূর্য কিরণের দ্বারা পাতার ভিতরেই এক ধরণের রান্নার কাজ চলে। ফলে তৈরী হয় শর্করা যা আমাদের শরীরের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন। আর বের হয়ে আসে অক্সিজেন যা না হলে আমরা সামান্য সময়ও বাঁচতে পারি না।
কাজেই উদ্ভিদ আমাদের জন্য মামুলী সম্পদ নয় বরং মহামূল্যবান সম্পদ। কোরআনে অসংখ্য বার আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর উদ্ভিদরূপ নেয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের আহ্বান জানিয়েছেন।
(ঝ) উদ্ভিদ ও যাবতীয় ধাতব পদার্থের যে জীবনী শক্তি আছে, প্রখ্যাত ভারতীয় বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুই নাকি তা সর্বপ্রথম প্রমাণ করেন। অথচ বসু মহাশয়ের উক্ত আবিষ্কারের প্রায় তেরশত বছর পূর্ব পবিত্র কোরআন আমাদেরকে উদ্ভিদ, পাথর যাবতীয় ধাতব পদার্থ ইত্যাদির জীবনী শক্তি ও অনুভূতি শক্তির সন্ধান দিয়েছে। নিম্নে এ সম্পর্কে কোরআন হতে কয়েকটি উদ্ধৃতি দেয়া হচ্ছে,
﴿تُسَبِّحُ لَهُ السَّمَاوَاتُ السَّبْعُ وَالْأَرْضُ وَمَن فِيهِنَّ ۚ وَإِن مِّن شَيْءٍ إِلَّا يُسَبِّحُ بِحَمْدِهِ وَلَٰكِن لَّا تَفْقَهُونَ تَسْبِيحَهُمْ ۗ إِنَّهُ كَانَ حَلِيمًا غَفُورًا﴾
“সপ্ত আকাশ, ভূমণ্ডল ও তন্মধ্যস্থ সকল বস্তুই আল্লাহর গুণগান করে। আর এমন কোন বস্তু নেই যা তার গুণকীর্তন করে না, কিন্তু তোমরা তাদের এ গুণকীর্তন (তাসবীহ পাঠ) উপলব্ধি করতে পারো না। আর তিনি হলেন ধৈর্যশীল ও ক্ষমাকারী।” (সুরা বনি ইসরাঈল, আয়াত-৪৪)
سَبَّحَ لِلَّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ ۖ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ
“আকাশ ও ভূমণ্ডলস্থ সকলেই আল্লাহর গুণগানে মশগুল। আর তিনি হলেন মহাপরাক্রমশালী, মহাজ্ঞানী।” (সুরা ছফ, আয়াত-১)
নিম্নের আয়াতটি বিশেষভাবে পাথরের জীবনী শক্তির ইঙ্গিত বহন করে,
﴿ثُمَّ قَسَتْ قُلُوبُكُم مِّن بَعْدِ ذَٰلِكَ فَهِيَ كَالْحِجَارَةِ أَوْ أَشَدُّ قَسْوَةً ۚ وَإِنَّ مِنَ الْحِجَارَةِ لَمَا يَتَفَجَّرُ مِنْهُ الْأَنْهَارُ ۚ وَإِنَّ مِنْهَا لَمَا يَشَّقَّقُ فَيَخْرُجُ مِنْهُ الْمَاءُ ۚ وَإِنَّ مِنْهَا لَمَا يَهْبِطُ مِنْ خَشْيَةِ اللَّهِ ۗ وَمَا اللَّهُ بِغَافِلٍ عَمَّا تَعْمَلُونَ﴾
“আর কোন কোন পাথর এমনও হয়ে থাকে যা হতে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত হয়। কোন কোনটি ফেটে গিয়ে তা থেকে পানি নির্গত হয়। আবার কোন কোনটি আল্লাহর ভয়ে কম্পিত হয়ে ভূতলে পতিত হয়। আর আল্লাহ তোমাদের ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে মোটেই অনবহিত নহেন।”
(সুরা বাকারা, আয়াত-৭৪)
একদা এক অভিযানকালে হযরত মুহাম্মদ (স) যখন সৈন্যদেরকে নির্দেশ দিচ্ছিলেন, তখন তিনি দেখতে পেলেন যে, কোন কোন সাহাবী হাতের অস্ত্রের আঘাতে পথিপাশর্স্থ গাছের ডাল-পালা কাটছেন। হুজুর (স) তাদেরকে নিষেধ করলেন, আর বললেন, “ খবরদার অযথা তোমরা গাছ-পালার উপরে আঘাত করবে না। কেননা তাদের প্রাণ আছে তোমাদের আঘাতে তারা কষ্ট পায় ও কাঁদে।”
অতিসম্প্রতি রুশ বিজ্ঞানী মানুষের সুখে ও দুঃখে নিকটবর্তী ফুলও যে প্রভাবান্বিত হয়, অর্থাৎ মানুষের সুখে ও আনন্দে নিকটবর্তী ফুলও আনন্দিত হয় এবং মানুষের দুঃখে বেদনা বোধ করে, এ তথ্যটি আবিষ্কার করেছেন।
মাত্র কিছুদিন পূর্বে আমেরিকার দুজন খ্যাতনামা বিজ্ঞানী পিটার টস্পকীন এবং ক্রিস্টোফার-বার্ত্ত কর্তৃক লিখিত (the crescent life of plan) নামক পুস্তক প্রকাশিত হয়েছে। তাতে তারা প্রমাণ করেছেন যে, সব রকমের গাছ-গাছড়া এমনকি মূলা, গাজর, পিঁয়াজ ইত্যাদির শুধু অনুভূতি শক্তিই নেই বুদ্ধি এবং ইচ্ছা শক্তিও আছে।
এমনকি অন্য উদ্ভিদের সাথে যোগাযোগ করার ভাষাও আছে। এ ব্যাপারে বিজ্ঞানীদ্বয় তাদের পুস্তকে খ্যাতনামা বিজ্ঞানী ক্লেপব্যকস্টার, মর্সেল ভোগেল, কেন হার্মিমোট ও ভারতীয় বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু প্রভৃতি বিজ্ঞানীদের মতামতও প্রমাণ হিসেবে পেশ করেছেন।
শস্যের চারা কিভাবে সঙ্গীতে সাড়া দেয়, বীজ ও কুঁড়ি কিভাবে বৈদ্যুতিক আঘাতে জেগে ওঠে, এ সম্পর্কে কাজাকিস্তানের রুশ বিজ্ঞানীদের অনুসন্ধানের ফলাফলও উক্ত পুস্তকে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
সাত: কোরআনের অভিনব হেফাযত ব্যবস্থা
স্মরণাতীত কাল হতে পয়গাম্বরদের উপরে যে সব কিতাব নাযিল হয়েছে তার অধিকাংশই এখন দুষ্প্রা্প্য । যে অল্প কয়েকখানা পাওয়া যায় তাও তার মূল ভাষায় নয়। আর মূল ভাষা হতে যখন কোন গ্রন্থকে অনুবাদ করা হয়, তখন তা অনুবাদ গ্রন্থ, আসল গ্রন্থ নয়। বিশেষ করে মহান আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাবের অনুবাদ। আর অনুবাদ গ্রন্থের ভাষা গ্রন্থের অনুবাদকের, আল্লাহর নয়।
তাছাড়া ঐ সমস্ত গ্রন্থ যে পরিবর্তন মুক্ত নয় তা তাদের বিজ্ঞ অনুসারীদের অনেকেই মুক্ত কন্ঠে স্বীকার করেছেন। কেননা সে যুগে না ছিল কাগজ, আর না ছিল আজকের মত ছাপাখানা। ফলে বৃক্ষপত্র, কাষ্ঠফলক, সমৃণ পাথর-প্লেট অথবা পাতলা চামড়ায় উহা লিখে রাখা হত এবং উহার অতিরিক্ত কপি করা অসম্ভব বিধায় পাদরী পুরোহিতদের কাছে উহার এক আধ কপি তাদের কেন্দ্রীয় উপাসনালয়ে রক্ষিত হত। আর যখনই তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী কোন জাতি তাদের রাজধানী কিংবা নগর আক্রমণ করত, তখন তাদের ধর্মগ্রন্থ ও উপাসনালয়ই হত বিজয়ী জাতির আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যস্থল। ইসলামের অভ্যুত্থানের পূর্বে এভাবে বহুবার প্রতিদ্বন্দ্বি শক্তি কর্তৃক ইহুদী ও খৃস্টানদের ধর্মগ্রন্থ ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। অধুনা একখানা পূর্ণাঙ্গ তাওরাত কিংবা ইঞ্জিল তার মূল ভাষায় পাওয়া সাধারণভাবে অসম্ভব।
পবিত্র তাওরাত গ্রন্থ যা হযরত মূসার (আ) উপরে অবতীর্ণ হয়েছিল, সেটা কয়েকবারেই ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে খৃঃ পূঃ ৫৮৬ সনে ব্যাবিলনের অত্যাচারী শাসক বখতে নাছার (নবুকারদোযাহ) জেরুজালেম আক্রমণ করে শহরটিকে ধ্বংস করে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয় এবং ইসরাইলী আলেম ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে বন্দী করে ব্যাবিলনে নিয়ে যায়। বখতে নাছার হযরত সুলায়মানের (আ) তৈরী পবিত্র বায়তুল মোকাদ্দাস মসজিদ এবং সেখানে রক্ষিত তাওরাত গ্রন্থও ধ্বংস করে দেয়।
অতঃপর প্রায় অর্ধ শতাব্দী পরে খৃ: পৃ: ৫৩৮ সনে পারস্য সম্রাট মহামতি সাইরাছ ব্যাবিলনের বাদশাহকে পরাজিত করে ইহুদীদের মুক্ত করে দেন এবং ফিলিস্তিনে তাদের পূনর্বাসন, নতুন করে জেরুজালেম নগরী ও বায়তুল মোকাদ্দাস মসজিদ পুনঃনির্মাণে সহায়তা করেন। তৎপর ইহুদী আলেমগণ তাওরাতের বিক্ষিপ্ত অংশ যা তাদের পক্ষে সংগ্রহ করা সম্ভব ছিল এবং যা তাদের মুখস্ত ছিল তা হতে তাওরাত নতুন করে লিপিবদ্ধ করেন। এ সম্পর্কে (the story of bible) নামক গ্রন্থের প্রসিদ্ধ ইউরোপীয়ান লেখকের মত হল নিম্নরূপ:
That the original manuscripts were destroyed with Solomon’s temple and the Ezra made a fresh set from such copies as could be found. (The Story of Bible)
“প্ৰকৃত ব্যাপার ছিল এই যে, তাওরাতের মূল লিপি, হযরত সুলায়মানের পবিত্র মসজিদের সাথেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। অত:পর ইজরা বা হযরত ওজায়ের (আ:) যা কিছু সংগ্ৰহ করতে পেরেছিলেন তা দ্বারা নতুন একটি কপি তৈরী করলেন ।”
রোমান ঐতিহাসিক প্রিাণীর মতে জেরোস্তারের উপরে নাযিলকৃত কিতাব জিন্দাবেস্তা মোট বার হাজার গরুর চামড়ায় সোনালী কালিতে লিপিবদ্ধ করে পারসিয়ানদের তদানীন্তীন রাজধানী পার্সেপলিসের বিখ্যাত লাইব্রেরীতে রাখা হয়েছিল। অত:পর গ্ৰীক সম্রাট আলেকজান্ডার যখন উক্ত রাজধানী দখল করে পুড়িয়ে দেয়, তখন লাইব্রেরীটি এবং তাতে রক্ষিত পবিত্র জিন্দাবেস্তা কিতাবখানিও পুড়ে ভস্ম হয়ে যায়। বাইবেল নিউটেস্টামেন্ট (ইঞ্জিল) সম্পর্কে লেখক তার অনুসন্ধানের ফল ব্যক্ত করে বলেন,
“All the New Testment is found, with documents in a manuscript calle the ‘Sainaitic Codex’ preserved at Leningrad probably written in Egypt in the 4th century.” (The Story of Bible P. no. 107)
“সমস্ত নিউটেস্টামেন্টই (ইঞ্জিল) অন্যান্য ডকুমেন্টসহ যে মূল লিপিতে লেনিনগ্রাডে রক্ষিত আছে সেটাকে ‘ছায়ানাইটিক লিপি’ বলা হয় । এটা যথাসম্ভব খৃস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে মিসরে লিখিত হয়।”
সুতরাং হযরত ঈসার (আ:) মৃত্যুর চারশত বছর পর যদি তাঁর উপর আছে তা ভাববার বিষয় বটে?
আবার কোন কোন ঐশীবাণী (ওয়াহী) পুরুষাক্রুমে ধর্মযাজকগণ তাদের শিষ্যদের তালিম দিতেন। অতঃপর সেটা যখন কালের গর্ভে বিলীন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিত, কিংবা ব্যাপকভাবে তাতে বাইরের আখ্যান ইত্যাদি যুক্ত হত, তখনই তাদের কোন জ্ঞানী ব্যক্তি সেটাকে গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করে নিতেন। ফলে উহা হতে যেমন কোন অংশ বাদ পড়ত, তেমনি অনেক বাইরের কথাও তাতে শামিল হয়ে যেত।
হিন্দুদের পবিত্র গ্রন্থ বেদ বৈদিক যুগের অনেক পরে মহাভারতীয় যুগে (কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সময়) বেদব্যাস মুনি কর্তৃক সঙ্কলিত হয়। পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের মতে বেদ যীশু খৃস্টের জন্মের মাত্র সাত কি আটশত বছর পূর্বের রচনা। অনুরূপভাবে বৌদ্ধদের ধর্মগ্রন্থ ত্রিপিটককে তৃতীয় পিটকখানা বুদ্ধের মৃত্যুর প্রায় দুই শত বছর পর মহামতি অশোকের নেতৃত্বে লিপিবদ্ধ করা হয়। প্রথম ও দ্বিতীয় পিটকদ্বয়ও বুদ্ধের মৃত্যুর পরে সংকলিত। উপরন্তু কোরআন পূর্ববর্তী আসমানী গ্রন্থগুলো যে সব ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছিল, দুনিয়ার কোথাও আর সে সব ভাষার প্রচলন নেই। জগতের অধিকাংশ পয়গম্বরই ছিলেন বনি ইসরাইল কওমভুক্ত, আর তাদের ভাষা ছিল ইবরানি বা হিব্রু। এ সকল ইবরানী পয়গম্বরদের উপরে নাযিলকৃত সমস্ত কিতাবের ভাষাই ছিল ইবরানি বা হিব্রু। এ সকল ইবরানী পয়গম্বরদের উপরে নাযিলকৃত সমস্ত কিতাবের ভাষাই ছিল হিব্রু। কিন্তু দুনিয়ার কোথাও আজ আর হিব্রু ভাষার তেমন প্রচলন নেই।
অনুরূপভাবে হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ বেদ ও গীতার ভাষা সংস্কৃতেরও যেমন কোন সন্ধান পাওয়া যায় না, তেমনি বৌদ্ধদের ধর্মগ্রন্থ পিটকের ভাষা পালিতেও এখন আর কেউ কথা বলে না। এসব এখন মৃত ভাষার শামিল।
কিন্তু একমাত্র কোরআনের ব্যাপারই এসব থেকে স্বতন্ত্র। যে মূল ভাষায় কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে, সেই মূল ভাষায়ই তার কোটি কোটি কপি দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন লোকের কাছে মওজুদ আছে। কোরআন যে শুধু গ্রন্থাবস্থাই রক্ষিত আছে তাই নয়, বরং কোরআন নাযিলের পর থেকে আরম্ভ করে আজ পর্যন্ত দুনিয়ার বিভিন্ন অংশে অগণিত লোক তা পুরাপুরি মুখস্থ করে রেখেছেন।
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, কোরআন অল্প অল্প করে তেইশ বছর ধরে অবতীর্ণ হয়েছে। যখনই কোরআনের কোন অংশ হুজুর (স) এর উপরে অবতীর্ণ হত, হুজুর (স) সাথে সাথেই যেমন সেটা কাতিব (ওয়াহী লিপিবদ্ধকারী) দ্বারা লিপিবদ্ধ করিয়ে নিতেন, তেমনি বহু মুসলমান সঙ্গে সঙ্গেই ঐ অংশটুকু মুখস্থ করে ফেলতেন। তেইশ বছর পর যখন কোরআন নাযিল হওয়া সমাপ্ত হলো, তখন একদিকে যেমন কোরআন পুরাপুরি লিপিবদ্ধ হয়ে রক্ষিত হয়ে গিয়েছিল, অন্যদিকে তেমনি অসংখ্য মুসলমান সেটাকে পূর্ণরূপে মুখস্থ করে তার হেফাযতের চমৎকার ব্যবস্থা করে ফেলেছিলেন। অতঃপর শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে উক্ত হেফাযত ব্যবস্থা যথা নিয়মেই চলে এসছে।
কেউ যদি উহা পরীক্ষা করে দেখতে চায়, তাহলে তিনি যেন পূর্ব এশিয়ার কোন এক দেশ হতে একখানা কোরআন সংগ্রহ করেন। অতঃপর উত্তর আফ্রিকার কোন একজন হাফেযের মুখে তা পাঠ করিয়ে শুনে নেন। শব্দ ও অক্ষর তো দূরের কথা একটা জের যবরেরও কোন অমিল পাবে না।
তাছাড়াও যে মূল আরবী ভাষায় কোরআন মহানবীর প্রতি নাযিল হয়েছে, আজ চৌদ্দশত বছরের ব্যবধানেও কোরআনের সে ভাষা না পুরান হয়েছে, না পরিত্যক্ত।
[আরবী ভাষার বিশেষ বৈশিষ্ট্যের প্রশংসা করতে গিয়ে প্রখ্যাত আমেরিকান পণ্ডিত জর্জ সার্টন বলেন,
“মুসলিম তামুদ্দুন ছিল বিচিত্র প্রকৃতির। মুসলমানেরা ধর্ম ও ভাষারূপ দুটি শক্তিশালী বন্ধন দ্বারা নিজেদেরকে ঐক্যসূত্রে গেথে নিয়েছিল। মুসলমানদের প্রধান কর্তব্যগুলোর ভিতরে একটি হল মূল আরবী ভাষার কোরআন পাঠ করা। এ চমৎকার ধর্মীয় বিধানকে ধন্যবাদ…..। আজকেও যেসব ভাষা পৃথিবীর সর্বত্র ব্যাপকভাবে ব্যবহার হচ্ছে, আরবী তাদের অন্যতম। (the life of science by George sarton) লেখক তাঁর পুস্তকের অন্য এক জায়গায় বলেছেন’ “অষ্টম শতকের মধ্য ভাগ হতে একাদশ শতকের শেষ পর্যন্ত আরবী ভাষা-ভাষীরা এগিয়ে চলছিল মানব জাতির পুরো ভাগে। তাদেরকে ধন্যবাদ, আরবী ভাষা শুধু কোরআনের পবিত্র ভাষা বা আল্লাহর বাণীর বহনরূপেই প্রতিষ্ঠিত হয়নি, বরং তা বিশ্বের সামনে নিজেকে তুলে ধরেছে আন্তর্জাতিক ভাষারূপে।” মানব সভ্যতার অগ্রগতিতে আরবী রচনাবলী অসীম গুরুত্বের কথা স্বীকার করে লেখক গ্রন্থের অন্য এক জায়গায় লিখেছেন,
“ইউরোপীয় পণ্ডিতদের মধ্যে যারা অগ্রগামী ছিলেন তারা বুঝতে পারলেন যে, আরবী রচনাবলী শুধু যে গুরুত্বপূর্ণ তাই নয়, সেগুলো অপরিহার্যও বটে। কারণ তারই মধ্যে সঞ্চিত ছিল জ্ঞানের প্রচুর সম্পদ। এ কথা বললে মোটেই অতিরিক্ত হবে না, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত খৃস্টান পণ্ডিতদের প্রধান কাজ ছিল আরবী গ্রন্থের ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ।”( the life of science by George sarton)
বরং দুনিয়ার বেশ কয়েক কোটি লোকই উক্ত ভাষায় কথাবার্তা বলে। কোরআনের পাঠক মাত্রই তার এ অভিনব হেফাযত ব্যবস্থায় মুগ্ধ না হয়ে পারবে না।
আল্লাহ তায়ালার সর্বশেষ পয়গম্বরের প্রতি নাযিলকৃত তাঁর এ সর্বশেষ কিতাবখানার এ অভিনব হেফাযত ব্যবস্থা যে আল্লাহর নিজেরই পরিকল্পিত সে কথা আল্লাহ নিজেই ঘোষণা করেছেন। এ ঘোষণাটি একবার আমরা দেখতে পাই ‘সুরা কিয়ামাহ’ নামক প্রাথমিক স্তরের একটি মক্কী সুরাতে। আর একবার আমরা দেখতে পাই ‘সুরায়ে হিজর’ নামক অপর একটি মক্কী সুরাতে।
মক্কা শরীফের প্রথম যখন জিরারাইল (আ) হুজুরের (স) কাছে উপস্থিত হয়ে ওয়াহী পাঠ করে শুনাতেন, তখন হুজুর (স) জিবরাইলের (আ) সাথে ব্যস্ততার সাথে তা পাঠ করতে থাকতেন, যাতে ওয়াহীর কোন একটা অংশও বাদ না পড়ে। ফলে মহান আল্লাহ নিম্নলিখিত মর্মে হুজুরকে আশ্বস্ত করলেন,
﴿لَا تُحَرِّكْ بِهِ لِسَانَكَ لِتَعْجَلَ بِهِ﴾
﴿إِنَّ عَلَيْنَا جَمْعَهُ وَقُرْآنَهُ﴾
﴿فَإِذَا قَرَأْنَاهُ فَاتَّبِعْ قُرْآنَهُ﴾
﴿ثُمَّ إِنَّ عَلَيْنَا بَيَانَهُ﴾
“হে রাসূল, দ্রুত কোরআন আয়ত্ব করার জন্যে আপনি আপনার জিহ্বা সঞ্চালন করবেন না। কোরআন পূর্নাঙ্গ করা এবং তা পাঠ করিয়ে দেয়া আমার দায়িত্ব। সুতরাং আমি যখন (জিবরাইলের জবানে) সেটা পাঠ করি, তখন আপনি তা অনুসরণ করুন। অতঃপর তার ব্যাখ্যা দানও আমার জিম্মাদারী।” (সুরা কিয়ামাহ, আয়াত ১৬-১৯)
মহান আল্লাহ আরও বলেন,
﴿إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ﴾
“নিশ্চয় কোরআন আমিই নাযিল করেছি। আর অবশ্যই তার হেফাযতের দায়িত্ব আমারই।” (সুরা হিজর, আয়াত-৯)
সুরা তায়াহায়ও অনুরূপ ধরনের একটি উক্তি দেখা যায়।
وَلَا تَعْجَلْ بِالْقُرْآنِ مِن قَبْلِ أَن يُقْضَىٰ إِلَيْكَ وَحْيُهُ ۖ وَقُل رَّبِّ زِدْنِي عِلْمًا
“কোরআন যখন নাযিল হয়, তখন তা সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত কোরআনের (হেফাযতের) জন্য আপনি উদ্বিগ্ন হবেন না। আর আপনি বলুন, হে আল্লাহ! তুমি আমার ইলম বাড়িয়ে দাও”। (সুরা তায়াহা, আয়াত-১১৪ )
কোরআনের এই অত্যাশ্চর্য হেফাযতের ব্যবস্থার দিকে লক্ষ্য করলে মন আপন হতে সাক্ষ্য দিবে যে, এ হেফাযত ব্যবস্থার মূলে তাঁর হাতই ক্রিয়াশীল, যিনি উহা নাযিল করেছেন।
আট: কোরআনের ভাষা ও ভাবে আশ্চর্য সাঞ্জস্য
দীর্ঘ তেইশ বছর কালব্যাপী অল্প অল্প নাযিল হওয়ার পরেও কোরআনের প্রথম হতে শেষ পর্যন্ত ভাষা, সাহিত্যিক মান, অর্থ ও ভাবে যে আশ্চর্য ধরনের সামঞ্জস্য উহাও প্রমাণ করে যে, কোরআন মানব রচিত কোন গ্রন্হ নয়। কেননা কোন মানুষের পক্ষে উক্ত বিষয়সমূহের ভিতরে এরূপ ধারাবাহিকতা ও সামঞ্জস্য রক্ষা করা দীর্ঘকালব্যাপী সম্ভব ছিল না।